০১. জন্মভূমি তাঞ্জির ত্যাগ

০১.

হিজরী ৭২৫ সালের ২রা রজব, বৃহস্পতিবার (১৪ই জুন, ১৩২৫ খ্রী:) বাইশ বৎসর বয়সে মক্কার কাবা শরীফে হজব্রত পালন ও মদিনায় রসুলের রওজা মোবারক জেয়ারতের উদ্দেশ্য আমি জন্মভূমি তাঞ্জির ত্যাগ করি। পথের সাথী হিসাবে কোন বন্ধু বা ভ্রমণকারী না পেয়ে আমাকে একাকীই রওয়ানা হতে হয়। উল্লিখিত পবিত্র স্থানগুলি দর্শনের অদম্য আবেগ ও বাসনা নিয়া আমি প্রিয় বন্ধুবান্ধব ও গৃহের মায়া কাটাইতে সংকল্প করি। তখনও আমার পিতামাতা জীবিত ছিলেন। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে আমার মনে যেমন কষ্ট হয়েছিল তাদের মনেও ঠিক তেমনি কষ্টই হয়েছিল।

তিলিম্যান (Tlemsen) শহরে পৌঁছে আমি তিউনিসের সুলতানের দু’জন রাষ্ট্রদূতের দেখা পেলাম। তখন তিলিম্যাসনের সুলতান ছিলেন আবু ওশিফিন।(২) আমি যেদিন সেখানে পৌঁছলাম সেদিনই রাষ্ট্রদূত দু’জন শহর ত্যাগ করে রওয়ানা হয়ে গেছেন। আমার একজন বন্ধু তাদের সঙ্গী হতে আমাকে পরামর্শ দিলেন। আমি এ বিষয়ে ইতিকর্তব্য চিন্তা করতে লাগলাম (৩) এবং তিন দিন সে শহরে কাটিয়ে যাত্রার সমুদয় আয়োজন শেষ করে ঘোড় নিয়ে দ্রুত তাঁদের অনুগমন করলাম। তাদের নাগাল। পেলাম মিলিয়ানা শহরে। অত্যধিক গরমে দুজন রাষ্ট্রদূতই পীড়িত হয়ে পড়েছিলেন। বলে আমাদের দশ দিন সে শহরে কাটাতে হল। আমরা পুনরায় রওয়ানা হবার পরে একজন রাষ্ট্রদূতের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠল। মিলিয়ানা শহর থেকে চার মাইল দূরে একটি নদীর পারে তিন রাত্রি কাটাবার পরে তিনি এন্তেকাল করলেন। আমি তাদের সঙ্গ সেখানেই ত্যাগ করলাম এবং তিউনিসের সওদাগরদের একটি কাফেলায় যোগদান করে পথ বলতে লাগলাম। এভাবে আল-জাজাইর (Algiers) পৌঁছে শহরের বাইরে আমাদের দিন কয়েক কাটাতে হল। আমাদের আগে একটি দল রওয়ানা হয়ে এসেছিল। তারা এসে পৌঁছলে একত্র হয়ে আমরা মিটিজার(৪) ভেতর দিয়ে ওয়াকস্ (জুরজুরা) পর্বত পার হয়ে বিজায়া (Bougie)(৫) পৌঁছলাম। তখন বিজয়ার সেনানায়ক ছিলেন ইবন সাইয়েদ আনাস। সেখানে পৌঁছবার পর আমাদের সঙ্গে তিন হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিনার ছিল। তার ওয়ারিশদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য সে আগেই তা আলজিয়ার্সের একজন লোকের হাতে সঁপে দিয়েছিল। ইব্‌নে সায়ইদ আনাস এ খবর পেয়ে বলপ্রয়োগে সে অর্থ আত্মসাৎ করে নিলেন। তিউনিসিয়া সরকারের কর্মচারীদের অত্যাচারের দৃষ্টান্ত এই প্রথম দেখলাম। বিজায় থাকতে আমি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তাই দেখে আমার এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন আরোগ্য না হওয়া অবধি সেখানে থেকে যেতে। কিন্তু আমি সে প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে বললাম, “আমার মৃত্যু যদি খোদার ইচ্ছে হয়ে থাকে, তবে মক্কার দিকে মুখ করে পথেই মৃত্যুবরণ করব।”

জবাবে তিনি বললেন, “তোমার সঙ্কল্প যদি তাই হয় তবে তোমার গাধাটা এবং ভারী বোঝা বিক্রি করে ফেলো। তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু আমি তোমাকে ধার দিব। তা হলে তুমি হালকা হয়ে সফর করতে পারবে। আমাদের দ্রুত পথ চলতে হবে, কেন না, পথে আরব দস্যুদের ভয় আছে।” (৬)

তার পরমর্শ মতই আমি কাজ করলাম এবং তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। আল্লাহ্ তার কল্যাণ করুন।

কুসানটিনায় (Constantise) পৌঁছে আমরা তাবু ফেললাম শহরের বাইরে কিন্তু রাত্রে অত্যধিক বৃষ্টি হওয়ায় আমরা তাবু ত্যাগ করে নিকটবর্তী একটি গৃহে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম। পরের দিন শহরের শাসনকর্তা এলেন আমাদের দেখতে। বৃষ্টির দরুন আমার পরিধেয় জামা কাপড় অপরিষ্কার হয়েছে দেখে তিনি সে সব তার গৃহে পরিষ্কার করবার হুকুম দিলেন। আমার পুরাতন ও ছিন্ন পাগড়ীর পরিবর্তে তিনি সিরিয়ার উত্তম কাপড়ের একটি পাগড়ী দিলেন। সেই পাগড়ীর এক খুটে বাঁধা ছিল দুটি সোনার দিনার। সফরে বেরিয়ে এই প্রথম আমি অন্যের সাহায্য গ্রহণ করলাম। কুসানটিনা। থেকে আমরা গেলাম বোন। এখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর আমাদের সঙ্গী সওদাগরদের রেখে আবার আমরা যাত্রা করলাম এবং দ্রুত পথ চলতে লাগলাম। পথে আমি আবার জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তাই, শারীরিক দুর্বলতার জন্য পড়ে যাই ভয়ে পাগড়ীর কাপড় দিয়ে ঘোড়ার জিনের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখতে হয়েছিল। আমার এত ভয় হয়েছিল যে তিউনিসে পৌঁছবার আগে আর আমি ঘোড়ার থেকে নিচে নামিনি। সমস্ত শহরের বাসিন্দা এসে জমায়েত হল আমাদের দলের লোকজনের সঙ্গে দেখা। করতে। চারদিকেই আদর আপ্যায়ন এবং কুশল প্রশ্নাদি জিজ্ঞাসার ছড়াছড়ি। কিন্তু আমিও একমাত্র অপরিচিত লোক বলে একটি প্রাণীও আমার দিকে ফিরে তাকাল না। নিজের এই একাকিত্বে আমি এতটা অভিভূত হয়ে পড়লাম যে অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না; আমি কেঁদে ফেললাম। তখন অপর একজন হজযাত্রী আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এগিয়ে এলেন আমাকে সান্ত্বনা দিতে। তিনি আমার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করলেন এবং শহরে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে চললেন।

তখন তিউনিসের সুলতান ছিলেন দ্বিতীয় আবু জাকারিয়ার পুত্র আবু ইয়াহিয়া। শহরে সে সময়ে কয়েকজন খ্যাতনামা জ্ঞানীলোকও ছিলেন।(৭) আমার সেখানে অবস্থিতিকালেই রমজানের শেষে ঈদল ফেতর উদযাপিত হয়। আমি জমায়েতে যোগদান করি।(৮) শহরের বাসিন্দারা মূল্যবান পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে বিপুল সংখ্যায় এসে উৎসবে যোগদান করে। সুলতান আবু ইয়াহিয়া এলেন অশ্বারোহণে। তার পশ্চাতে মিছিল করে পদব্রজে এলেন সমস্ত আত্মীয়স্বজন এবং সরকারী কর্মচারীগণ। ঈদের নামাজ ও খোদ্যার শেষে সবই স্ব-স্ব গৃহে ফিরে গেল।

কিছুদিন পরে হেজাজ গমনেচ্ছু যাত্রীদের একটি কাফেলা ঠিক হল। আমাকে তারা মনোনীত করল কাজী। নবেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমরা তিউনিস ত্যাগ করে সমুদ্রোপকূলের পথে মুসা, স্কাল্প (sfax) ও কাবিস (৯) অতিক্রম করলাম। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির জন্য কাবিসে আমাদের দশ দিন কাটাতে হল। সেখানে থেকে আমরা ত্রিপলী রওয়ানা হলাম। একশ’ বা আরও অধিক অশ্বারোহী এবং একদল তীরন্দাজ অনেক দূর। অবধি আমাদের সঙ্গী ছিল। স্কাসে থাকতে তিউনিসের একজন রাজকর্মচারীর কন্যার। সঙ্গে আমার বিবাহের কথাবার্তা স্থির হয়। ত্রিপলীতে তাকে আমার নিকট আনা হয়। কিন্তু ত্রিপলী ত্যাগ করবার পরেই তার পিতার সহিত আমার মনোমালিন্যের ফলে তাকে আমি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হই। অতঃপর আমি ফেজের একজন ছাত্রের এক কন্যাকে বিবাহ করি। বিবাহের সময় একদিন অপেক্ষা করে সবাইকে আমি এক ওয়ালিমার ব্যবস্থা করি।

অবশেষে ৫ই এপ্রিল, ১৩২৬ খ্রীস্টাব্দে আমরা আলেকজান্দ্রিয়া এসে পৌঁছলাম। চারটি সিংহদ্বার (১০) বিশিষ্ট একটি সুন্দর বন্দর-যেমন সুগঠিত তেমনি সুরক্ষিত। সারা দুনিয়ায় যে সব বন্দর আমি দেখেছি, তার ভেতর কালাম (guilon), ভারতের কালিকট, তুর্কীর সুডাক এবং চীনের জয়তুন ছাড়া আলেকজান্দ্রিয়ার সমকক্ষ আর কোন বন্দর নেই। এসব বন্দরের বিবরণ আমি পরে প্রদান করব। এখানে এসেই আমি বাতিঘর দেখতে গেলাম। এর একটি দিক তখন প্রায় ধ্বংসসানুখ। চতুষ্কোণ বিশিষ্ট বেশ উঁচু একটি অট্টালিকা। মাটীর চেয়ে অনেক উঁচতে এর প্রবেশদ্বার। বাতিঘরের উল্টা দিকে আছে সমান উঁচু অপর একটি দালান। সেখান থেকে প্রবেশদ্বার অবধি একটি কাঠের পুল। এটি সরিয়ে নিলে বাতিঘরে প্রবেশের আর কোন উপায় থাকে না। দরজার পরেই বাতিঘর রক্ষকের বাসস্থান। বাতিঘরের ভেতরের অনেকগুলি কামরা। বাতিঘরের ভেতরের রাস্তাটি নয় বিঘত প্রশস্ত এবং দেওয়াল দশ বিঘত পুরু। বাতিঘরের প্রতিটি পাশের মাপ ১৪০ বিঘত। শহর থেকে তিন মাইল দূরে সমুদ্রের দিকে শহরের প্রাচীর। ঘেষে লম্বা হয়ে এগিয়ে গেছে একখণ্ড ভূমি। তার একটি উঁচু ঢিবির উপর এ বাতিঘর। কাজেই শহর থেকে ছাড়া বাতিঘরে স্থলপথে পৌঁছবার আর কোনই পথ নেই। ৭৫০ হিজরীতে (১৩৪৯ খ্রীস্টাব্দ) পশ্চিম অঞ্চলে ফিরে এসে পুনরায় আমি বাতিঘরটি দেখতে যাই। তখন এটি এমন জীর্ণ দশায় এসে পৌঁছছে যে এতে প্রবেশ আর নিরাপদ মনে হল না।(১১) আল-মালিক আন-নাসির পাশেই অপর একটি বাতিঘর নির্মাণ আরম্ভ করেন কিন্তু বাতিঘরের নির্মাণ কার্য শেষ হবার আগেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

এ শহরের আর একটি বিস্ময়কর বস্তু এর মার্বেল স্তম্ভ। শহরের বাইরে অবস্থিত এ স্তম্ভটি একখণ্ড মার্বেলে সুকৌশলে খোদিত। স্তম্ভটি স্থাপন করা হয়েছে বিরাটকায় প্রস্তরের ইট বেদীর উপর। কি ভাবে কর দ্বারা এ স্তম্ভ বেদীর উপর স্থাপিত হয়েছে কেউ তা বলতে পারে না।(১২)

আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানী লোকদের একজন ছিলেন সেখানকার কাজী। তিনি ছিলেন বাগিতায় সুপটু। বিরাটাকারের একটি শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করতেন তিনি। পাশ্চাত্যের বা প্রাচ্যের কোথাও আমি এত বড় পাগড়ী ব্যবহার করতে দেখিনি। সেখানকার জ্ঞানী লোকদের ভেতর আরেকজন ছিলেন ধর্মপ্রাণ তাপস বোরহান উদ্দিন। আলেকজান্দ্রিয়ায় থাকাকালে তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম এবং তাঁর আতিথ্যে তিনদিন কাটিয়েছিলাম। একদিন তার কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি বললেন, “আমি দেখছি বিদেশে সফর করতে তুমি খুব ভালবাস।”

আমি উত্তর দিলাম, “জী, হাঁ।” (যদিও তখনও ভারতের বা চীনের মত দূরদেশে সফরে যাবার সঙ্কল্প আমার ছিল না।)

তখন তিনি পুনরায় বললেন, “ভারতে কখনো গেলে তুমি নিশ্চয়ই আমার ভাই ফরিদ উদ্দিনের(১৩) সঙ্গে দেখা করবে, সিন্ধে দেখা করবে ভাই রোকনউদ্দিনের সঙ্গে এবং চীনে গেলে দেখা করবে বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। দেখা করে তাদের কাছে আমার শুভেচ্ছা জানাবে।”

তার ভবিষ্যদ্বাণী শুনে আমি বিস্মিত হলাম। তখন থেকেই এসব দেশে যাবার ইচ্ছা আমার অন্তরে বদ্ধমূল হয়। উল্লিখিত তিন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা না-করা পর্যন্ত আমি সফরে রত ছিলাম।

আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থান কালে শেখ আল মুরসিদি নামক একজন ধার্মিক লোকের কথা শুনেছিলাম। তিনি অলৌকিক উপায়ে যে কোন জিনিস তৈরি করে প্রার্থীর সামনে হাজির করতে পারতেন। একটি নির্জন স্থানে গহ্বরে তিনি বাস করতে যেতেন। নানা শ্রেণীর অসংখ্য লোক দল বেঁধে যেত তার সঙ্গে দেখা করতে। তাদের সবার আহার্য সরবরাহ করতেন তিনি নিজে, তারা প্রত্যেকে বিভিন্ন রকমের মাংস, ফলমূল, মিষ্টি খাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করত। সে সব দুষ্প্রাপ্য হলেও এবং মৌসুমের অনুপযোগী হলেও তিনি তা সামনে এনে হাজির করতেন। মানুষের মুখে-মুখে তার খ্যাতি এতদূর বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে সুলতান নিজেও একাধিক বার তার আস্তানায় এসে দেখা করেছেন।

শেখের সঙ্গে দেখা করবার উদ্দেশ্যে আমি একদিন আলেকজেন্দ্রিয়া থেকে রওয়ানা হলাম। সামানহার ছাড়িয়ে সুন্দর শহর ফাবা (fva) গিয়ে পৌঁছলাম। শহরের পাশে একটি খাল। খালের অপর পারে শেখের আস্তানা। দ্বিপ্রহরের মাঝামাঝি সময়ে আমি গিয়ে পৌঁছলাম সেখানে। শেখকে সালাম করে দেখতে পেলাম সুলতানের একজন দেহরক্ষী রয়েছে তার কাছে। একটু দূরে দলবল সহ তিনি তাবু ফেলেছিলেন। শেখ উঠে আমার সঙ্গে কোলাকুলি করলেন এবং কিছু ফল আনিয়ে আমাকে খেতে দিলেন।

আসরের নামাজের সময় হলে তিনি আমাকে এমামের পদে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যতদিন তার সঙ্গে ওখানে ছিলাম তিনি প্রতি ওয়াক্তেই আমাকে এমামতি করতে বলেছেন। শোবার সময় হলে তিনি আমাকে বললেন, “ছাদের উপরে গিয়ে শুয়ে থাকো।” (তখন গ্রীষ্মের গরম কাল)।

আমি বললাম, “বিসমিল্লাহ”।(১৪) তিনি কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে জবাব দিলেন, “আমাদের ভেতর এমন কেউ নেই যার জন্য জায়গা নির্দিষ্ট নেই।”

আমি তখন গিয়ে আস্তানার ছাদের উপরে গিয়ে উঠলাম। সেখানে দেখতে পেলাম একটি খড়ের তোশক, চামড়ার বিছানা, একপাত্র উজুর পানি, এক সোরাহী খাবার পানি, আরেকটি পানপাত্র। আমি সেখানেই শুয়ে পড়লাম।

সেই রাত্রে শেখের বাসস্থানের ছাদে ঘুমন্ত অবস্থায় আমি স্বপ্নে দেখলাম, বিরাটাকার একটি পাখির ডানার উপর চড়ে আমি মক্কার দিকে উড়ে চলেছি। সেখান থেকে ইয়েমেন, ইয়েমেন থেকে পূর্ব দিকে। তারপরে কিছুদূর দক্ষিণে গিয়ে দূর পূর্বাঞ্চলের দিকে। সর্বশেষে নামলাম গিয়ে কালো ও সবুজ এক দেশে। এ স্বপ্ন দেখার পর বিস্মিত হয়ে আমি মনে-মনে ভাবতে লাগলাম, “শেখ যদি আমার এ স্বপ্ন সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন তবেই বুঝব লোকে যা বলে সত্যিই তিনি তাই।”

পরের দিন ভোরে সমস্ত দর্শনেচ্ছু লোক বিদায় নিলে শেখ আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমার স্বপ্নের বিবরণ শুনে তিনি ব্যাখ্যা করলেন, “তুমি মক্কায় হজ ব্রত পালন করবে, মদিনায় হজরতের রওজা মোবারকও জেয়ারত করবে। তারপর সফর করবে ইয়েমেন এবং তুর্কীদের দেশ ইরাক। সেখান থেকে যাবে ভারতে। আমার ভাই দিলশাদের সঙ্গে ভারতে তোমার সাক্ষাৎ হবে। ভারতে তোমাকে অনেকদিন কাটাতে হবে। সেখানে গিয়ে তোমার এক মুসিবৎ হবে এবং আমার ভাই দিলশাদ তোমাকে উদ্ধার করবে সেই মুসিবতের কবল থেকে।” এই বলে পথের সম্বল স্বরূপ তিনি আমাকে ছোট-ঘোট কয়েকখানা পিঠা দিলেন আর দিলেন কিছু অর্থ। আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। তার কাছ থেকে বিদায়ের পরে পথে কখনও আর বিপদে-আপদে পড়তে হয়নি। তাঁর শুভেচ্ছা সর্বক্ষণ আমার পথের সাথী হয়ে রয়েছে।

এখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে আগের অনেকগুলি শহর পার হয়ে পৌঁছলাম গিয়ে ভামিয়েটা। পথে প্রতি শহরেই আমরা সেখানকার ধর্মনেতার সঙ্গে দেখা করেছি। তামিয়েটা শহর নীলনদের তীরে অবস্থিত। নদীর তীরস্থ গৃহের বাসিন্দারা বালতি করে নদীর পানি নিয়ে ব্যবহার করে। অনেক বাড়ির সিঁড়ি নেমে এসে নদীর পানি ছুঁয়েছে। লোকদের ছাগল-ভেড়া সারা দিন-রাত স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে দেখতে পেলাম। সেজন্য ভামিয়ো সম্বন্ধে প্রবাদ আছে, “এ শহরের দেয়ালগুলো মিঠাই, কুকুরগুলো ভেড়া।” এ শহরে একবার প্রবেশ করলে শাসনকর্তার অনুমতি ছাড়া শহর ত্যাগ করে যেতে পারে না। খ্যাতনামা লোকদের কাছে শাসনকর্তার শীলমোহরাঙ্কিত এক টুকরা কাগজ থাকে যাতে তারা দ্বাররক্ষীকে তা দেখিয়ে দরকার মত বাইরে যেতে পারেন। অন্যান্য লোকদের শিলমোহর আছে তাদের নিজ-নিজ বাহুতে। এ শহরে অনেক সামুদ্রিক পাখি আছে। এসব পাখির গোশত আঁঠার মত। এছাড়া এখানকার মহিষের দুধ যেমন মিষ্টি তেমনি সুস্বাদু। এখানকার বুড়ি(১৫) নামক মাছ সিরিয়া, আনাতোলিয়া, কায়রো প্রভৃতি শহরে চালান হয়ে যায়। বর্তমান শহরটি হালে নির্মিত। পুরাতন ভামিয়েটা শহর আল-মালিক আস্-সালের (১৬) আমলে ফ্রাঙ্কদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

ভামিয়েট্টা থেকে আমি পৌঁছলাম ফারিকোর শহরে। এ-শহরটিও নীলনদের তীরে অবস্থিত। শহরের বাইরে থাকতেই ভামিয়েট্টা থেকে একজন অশ্বারোহী এল আমার। কাছে। তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন ভামিয়েট্টার শাসনকর্তা। অশ্বারোহী আমাকে কিছু অর্থ দিয়ে বলল, “আমাদের শাসনকর্তা আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। আপনি চলে এসেছেন শুনে এই অর্থ আপনাকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে পুরস্কৃত করুন।”

সেখান থেকে আমি আসমুনে গিয়ে পৌঁছলাম। নীলনদ থেকে বেরিয়ে আসা একটি খালের পারে আসমুন একটি পুরাতন বড় শহর। শহরে একটি কাঠের পুল আছে। অনেক নৌকা এসে এ-পুলের সঙ্গে লঙ্গর থাকে। বিকেলে পুলটি খুলে দেওয়া হয় এবং নৌকাগুলি উজান-ভাটির পথে যাতায়াত করে। এখান থেকে আমি গেলাম সামালুদ। সামালুদ থেকে গেলাম উজানের দিকে কায়রো। একটানা অনেকগুলি শহর ও গ্রামের। মধ্যস্থলে কায়রো। নীলনদ অঞ্চলে সফরকালে পথের সম্বল না নিলেও অসুবিধা হয় না। নীল-নদের তীরে ওজু, গোসল, নামাজ বা আহারের জন্য যেখানে খুশী তা পাওয়া যায়। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এবং সেখান থেকে মিসরের উষ্ণমণ্ডল অবধি অন্যান্য পথে রয়েছে অসংখ্য বাজারের সারি।

অবশেষে শহুরকুল জননী অত্যাচারী ফেরাউনের বাসস্থান কায়রোতে এসে পৌঁছলাম। কথিত হয় যে,(১৭) কায়রোতে বার হাজার ভিস্তি আছে। তারা উটের সাহায্যে পানি সরবরাহ করে। এছাড়া ত্রিশ হাজার আছে গাধা ও খচ্চর ভাড়া দেবার লোক। নীলনদের বুকে সুলতানের এবং তাঁর প্রজাদের নৌকা আছে ছত্রিশ হাজার। মিসরের উষ্ণাঞ্চল থেকে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া ও ভামিয়েটা অবধি এ-সব নৌকা পাল খাঁটিয়ে যাতায়াত করে বাণিজ্যের নানা বেসাতি নিয়ে।

নীলনদের তীরে পুরাতন কায়রোর অপর দিকে একটি জায়গার নাম বাগিচা।(১৮) অনেকগুলি মনোরম বাগান এখানে আছে। কারণ, কায়রোর লোকেরা আমোদ-প্রমোদের ভক্ত। একবার সুলতানের হাত ভেঙ্গে যায়। তার আরোগ্য উপলক্ষ্য করে সেবার যে আমোদোল্লাস হয় আমি তাতে যোগদান করেছিলাম। শহরের সমস্ত ব্যবসায়ী তাদের দোকানপাট কয়েকদিন অবধি সজ্জিত করে রেখেছিল এবং রেশমী কাপড় ঝুলিয়ে রেখেছিল প্রতিটি দোকানের সম্মুখে। এখানকার মসজিদ আমর-এর প্রতি যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়। শুক্রবারে এখানে নিয়মিত জুমার নামাজ হয়। মসজিদের অভ্যন্তরস্থ পথ পূর্ব থেকে পশ্চিমদিকে প্রসারিত। কায়রোতে মাদ্রাসা রয়েছে অসংখ্য। দুটি দূর্গের মধ্যস্থলে সুলতান কালাউনের সমাধির নিকটে কায়রোর মারিস্তান বা হাসপাতাল। হাসপাতালটির সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। সাজসরঞ্জাম ও ঔষধপত্রও আছে প্রচুর। হাসপাতালের দৈনিক আয় হাজার দিনারের কাছাকাছি।(১৯)

এখানে খানকাহ্ আছে অনেকগুলি। সম্ভ্রান্ত বাসিন্দারা খানকাহু প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এখানে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এক একটি খানকাহ্ ভিন্ন-ভিন্ন সম্প্রদায়ের দরবেশদের জন্য নির্দিষ্ট। দরবেশদের অধিকাংশই শিক্ষিত পার্শিয়ান। তারা মারেফতী বা গুপ্তমতাবলম্বী। প্রত্যেক খানকাহ্র একজন প্রধান ব্যক্তি এবং একজন। দ্বাররক্ষী আছে। তাঁদের কাজকর্ম সুশৃঙ্খলাবদ্ধ। তারা কতকগুলি বিশেষ ধরনের। রীতিনীতি মেনে চলেন। একটি প্রচলিত রীতি আছে আহারের ব্যাপারে। ভোরে বাড়ির খানসামা এসে দরবেশদের কে কি সেদিন আহার করবেন তা জেনে যায়। পরে আহারের জন্য যখন তারা একত্র হন তখন ভিন্ন-ভিন্ন থালায় প্রত্যেকের রুটি ও সুরুয়া। পরিবেশন করা হয়। দৈনিক তাঁরা দু’বার আহার গ্রহণ করেন। তাদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে শীতের ও গরম কালে ব্যবহারোপযোগী কাপড় দেওয়া হয়। তা ছাড়া বিশ হতে ত্রিশ দেরহাম অবধি মাসোহারাও তারা পেয়ে থাকেন। বৃহস্পতিবার রাত্রে তাদের দেওয়া হয় বাতাসা এবং কাপড় ধোবার সাবান। গোসলের উপকরণ এবং বাতির জন্য। তৈল। এঁদের সবাই অকৃতদার। বিবাহিতদের জন্য রয়েছে পৃথক খানকাহ্।

কায়রোতে আছে আ-কারাদার কবরস্তান। এটি একটি পবিত্রস্থান বলে গণ্য। এখানে অসংখ্য জ্ঞানী, গুণী ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির কবর আছে। এখানকার লোকেরা কারাদার কবরগুলি এমনভাবে দেওয়াল দিয়ে ঘেরে যে দেখতে ঠিক অট্টালিকার মতই দেখায়।(২০) তারা কামরাও তৈরি করে এবং কোরআন তেলায়তের জন্য লোক নিযুক্ত করে। সুললিত কণ্ঠে তারা রাদিন সেখানে পবিত্র কোরআন আবৃত করে। অনেকে সমাধি প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও ধর্ম চর্চার স্থান ও মাদ্রাসা স্থাপন করে এবং বৃহস্পতিবার রাত্র সপরিবারে সেখানে অতিবাহিত করে এবং প্রসিদ্ধ কবরগুলি প্রদক্ষিণ করে। শাবান মাসের মধ্যভাগেও তারা একদিন সেখানে নিশা যাপন করে। দোকানদাররা সেদিন সেখানে যায় নানা প্রকার খাদ্যদ্রব্য নিয়ে।(২১)

শহরের পবিত্র স্থানগুলির ভেতর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হল হজরত আল হুসাইনের(২২) সমাধি। সমাধির ধারেই একটি সুদৃঢ় অট্টালিকা। অট্টালিকার দরজার আংটাগুলি রৌপ্য নির্মিত।

সুপেয় পানির জন্য, দীর্ঘতার জন্য এবং প্রয়োজনীয়তার জন্য নীলনদ(২৩) পৃথিবীর অন্যান্য নদীর অগ্রগণ্য। পৃথিবীর অন্য কোন নদীর তীরে এত একটানা শহর ও গ্রাম নেই অথবা এমন শস্য শ্যামল উর্বর ভূমিও নেই। নদীটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত। অন্যান্য প্রসিদ্ধ নদীর গতির পক্ষে এটি একটি ব্যতিক্রম। এ নদের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হ’ল গরমের মৌসুমে যখন অন্যান্য নদনদী প্রায় শুকিয়ে ওঠে তখন এর পানি বৃদ্ধি পায়। নীলনদের পানি যখন কমতে থাকে তখন অন্যান্য নদনদীর পানি বৃদ্ধি পায়। এ-ব্যাপারে নীলনদের মিল আছে একমাত্র সিন্ধু নদের সঙ্গে। পৃথিবীর পাঁচটি প্রসিদ্ধ নদী-নীল, ইউফ্রেটিস, টাইগ্রিস, সির দরিয়া এবং আমু দরিয়া। আরও যে পাঁচটি নদীর সঙ্গে নদীগুলির তুলনা চলে সেগুলি হল- সিন্ধু, যার অপর নাম পাঞ্জাব (পঞ্চ নদী), গ্যাঙ (গঙ্গা) নামক ভারতীয় নদী, যাকে হিন্দুরা তীর্থ বলে মনে করে, মৃতদেহের ভাবশেষ এ নদীতে নিক্ষেপ করে এবং নদীটির উৎপত্তিস্থান স্বর্গ বলে মনে করে, ভারতের যুন (যমুনা অথবা ব্ৰহ্মপুত্ৰ), তৃণাচ্ছাদিত অঞ্চলের ইটিল (ভলগা) নদী যার তীরে রয়েছে সারা শহর এবং কেথের সারু (হোয়াং হো) নদী। এ সব নদীর উল্লেখ আমি যথাস্থানে করব। কায়রো থেকে নিম্নদিকে কিছু দূর গিয়ে নীলনদ ভাগ হয়েছে তিনটি শাখায় (২৪) শীতে বা গ্রীষ্মে এ নদী তিনটি নৌকা ব্যতীত পার হওয়া যায় না। নীলনদ থেকে প্রতি শহরের বাসিন্দারা খাল কেটে নেয় এবং নীলনদের পানি বৃদ্ধি পেলে এ-সব খাল মাঠের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়।

হেজাজ যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি কায়রো থেকে মিসরের উষ্ণাঞ্চলে যাই। এখানে আমি প্রথম রাত্রি যাপন করি দাইর আত-তিন দরগায়। কয়েকটি প্রসিদ্ধ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষণের জন্য এ দরগাটি নির্মিত হয়। হজরত (সাঃ) একটি কাঠের গামলার অংশ, তাঁর সুর্মা ব্যবহারের একটি শলাকা, পাদুকা শেলাইর একটি সূচ বা ফুরনী। এছাড়া আছে হজরত আলীর স্বহস্ত লিখিত একখানা কোরআন। কথিত আছে লক্ষ দিরহাম ব্যয় করে দরগার নির্মাতা এগুলি ক্রয় করেন। এছাড়া আগন্তুকদের খাদ্যদানের জন্য এবং স্মৃতি চিহ্নগুলি রক্ষণাবেক্ষণকারীদের ব্যয় নির্বাহের জন্য কিছু অর্থেরও ব্যবস্থা করে গেছেন।

এখান থেকে আসবার পথে শহর ও গ্রাম পার হয়ে আমি হাজির হলাম মুনিয়াত ইব্‌নে আসিব (Minie) শহরে। মিসরের উচ্চাঞ্চলে নীলনদের তীরে নির্মিত এটি একটি বড় শহর। এখানে আসবার পথে আমাকে অতিক্রম করতে হয়েছে মানফুলুর, আসিউত, ইয়মিম, কিনা, কুস, লুক্সর, এসৃনা এবং এডনফু। ইথমিমে একটি বারবা(২৫) বা প্রাচীন মিসরীয় মন্দিরে প্রস্তর মূর্তি ও খোদিত লিপি আছে কিন্তু এখন তার পাঠোদ্ধার করা সাধ্যের অতীত। অপর একটি বারবা ভেঙ্গে যাবার পর তার পাথর দিয়ে একটি মাদ্রাসা। তৈরি হয়েছে। কুসে মিসরের উচ্চাঞ্চলের শাসনকর্তা বাস করেন। পুর নামক এই সুন্দর ছোট শহরটিতে ধর্মপ্রাণ তাপস আবুল হাজ্জাজের(২৬) সমাধি বর্তমান। এসৃনা থেকে একদিন ও এক রাত্রি মরু পথে চলে আমরা হাজির হই এডনফু। এখানে নীলনদ পার হয়ে আমরা উট ভাড়া করে একদল আরবের সঙ্গে জনমানবহীন অথচ নিরাপদ মরু পথে রওয়ানা হই। পথে আমাদের একবার বিশ্রাম নিতে হয়েছিল হুমেথিরা নামক স্থানে। এ-স্থানের আশেপাশে অনেক হায়েনার বাস। সারারাত তাই আমাদের হায়না। তাড়িয়ে কাটাতে হয়। তবু একটি হায়না কোন ক্রমে এসে আমার জিনিসপত্রের উপর চড়াও করে একটি বস্তা নিয়ে যায় এবং তার ভেতর থেকে এক থলে খেজুর নিয়ে সরে পড়ে। পরের দিন শূন্য থলেটি আমরা কুড়িয়ে পাই ছিন্ন অবস্থায়।

পনর দিন পর আমরা পৌঁছি ‘আইধার (২৭) শহরে। এখানে প্রচুর দুধ ও মাছ পাওয়া যায়। খেজুর ও শস্যাদি আমদানি হয় মিসর থেকে। এখানকার অধিবাসীদের বলা হয় বেজা। অধিবাসী সবাই কৃষ্ণকায়। এরা হলদে রঙের কম্বলে শরীর আবৃত করে রাখে। এবং মাথায় এক আঙ্গুল পরিমাণ চওড়া ফিতা বেঁধে রাখে। এখানকার মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির কোন অংশ পায় না। আইধারের বাসিন্দাদের প্রধান খাদ্য ছিল উটের দুধ। এ শহরের এক তৃতীয়াংশের মালিক মিসরের সুলতান, বাকি অংশের মালিক বেজাদের আল-হুদরুকি(২৮) নামক রাজা।

আইধারে পৌঁছে আমরা জানতে পারলাম, আল-হুঁদরুবি তখন তুর্কিদের জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছেন এবং তুর্কীরা পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের পক্ষে তখন সমুদ্র পাড়ি দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠল। আমরা অগত্যা আমাদের আয়োজিত সমুদ্র পাড়ির প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রি করে জঙ্গী আরবদের সঙ্গে কুসে ফিরে এলাম। সেখান থেকে পালতোলা নৌকায় নীলনদ দিয়ে আট দিন পরে আমরা কায়রো এসে পৌঁছলাম। সেখানে একরাত্রি কাটিয়েই আমি সিরিয়ার পথে রওয়ানা হই। তখন ১৩২৬ খ্রীস্টাব্দের জুলাইর মাঝামাঝি।

আমাদের পথে ছিল বিলবেস ও আস-সালিহিয়া। সেখান থেকে বালুকাময় পথের শুরু, মধ্যে-মধ্যে সফর বিরতির স্থান। িিতর স্থানে সরাইখানা আছে। এখানকার লোকেরা তাকে খান(২৯) বলে। খানে মুসাফেররা তাদের বাহন পশু নিয়ে বিশ্রাম করে। প্রত্যেক খানেই পানির ব্যবস্থা আছে এবং মুসাফের ও পশুর প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রির জন্য এক একটি দোকান আছে। কাটিয়া(৩০) (Qatya) নামক স্থানের সরাইখানায়। আবগারী শুল্ক আদায় করা হয়। সওদাগরদের কাছ থেকে এবং তাদের মালপত্র তন্ন তন্ন। করে তল্লাসী করা হয়। এখানে অফিস গৃহ আছে, তাতে অফিসার, কেরানী ইত্যাদি আছে। এখানকার প্রাত্যহিক আয় হাজার সোনার দিনার। মিসর থেকে প্রবেশপত্র (পাসপোর্ট) ছাড়া কেউ সিরিয়ায় যেতে পারে না। ঠিক তেমনি সিরিয়ার প্রবেশপত্র না। নিয়ে কেউ মিসরে প্রবেশ করতে পারে না। প্রজাদের মালামাল ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য এবং ইরাকের গুপ্তচর প্রবেশের বাধা দেবার জন্যই এ ব্যবস্থা। এই রাস্তাটি রক্ষার দায়িত্বভার দেওয়া আছে বেদুঈনদের উপর। সন্ধ্যা হলে তারা পথের বালিরাশি এমন করে মসৃণ করে রাখে যাতে কোন পদচিহ্ন দৃষ্ট হয় না, পরের দিন ভোরে শাসনকর্তা এসে বালুকাময় পথ পরীক্ষা করেন। তিনি তখন সে পথে কোন পদচিহ্ন দেখলেই আরবদের হুকুম করেন তাকে ধরে আনতে। তারা তৎক্ষণাৎ সে লোকের পিছু ধাওয়া করে এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে তবে ফিরে আসে। তাকে যথারীতি শাসনকর্তার সামনে হাজির করা হয় এবং তিনি তার শাস্তি বিধান করেন। শাসনকর্তা আমার সঙ্গে মেহমানের মত ব্যবহার করেন, সদয় ব্যবহার করেন এবং আমার সঙ্গে যারা ছিল তাদের সবাইকে যাওয়ার অনুমতি দেন। এখান থেকে আমরা সিরিয়ার প্রথম শহর গাঁজায় পৌঁছি। মিসর সীমান্ত পার হলেই গাঁজা শহর।

গাজা থেকে আমি যাই ইব্রাহিম-এর শহরে (Hebron). এখানকার মসজিদটি বেশ সুন্দর, মজবুত ও উঁচু এবং চতুষ্কোণ প্রস্তরে প্রস্তুত। এ মসজিদের একটি কোণে এমন একটি পাথর রয়েছে যার একটা ধার সাতাশ বিঘত লম্বা। কথিত আছে পয়গম্বর সোলেমান জিনদের(৩১) হুকুম দিয়ে এ মসজিদ তৈরি করান। এ মসজিদের ভেতর ইব্রাহিম, ইছহাক ও ইয়াকুবের পবিত্র কবরও রয়েছে। এ-গুলির উল্টাদিকে তিনটি কবর আছে তাদের বিবিদের। মসজিদের ইমাম একজন বোজর্গ ব্যক্তি। এ কবরগুলি সম্বন্ধে তাকে আমি জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, “যত জ্ঞানীজনের সঙ্গে এ পর্যন্ত আমার দেখা হয়েছে তারা সবাই স্বীকার করেন যে, এ-গুলিই হজরত ইব্রাহিম, ইছহাক এবং ইয়াকুবের ও তাদের বিবিদের কবর। মিথ্যার যারা সমর্থনকারী তারা ছাড়া এ-বিষয়ে আর কেহ কোন প্রশ্ন উত্থাপন করে না। বহুদিন থেকে বংশানুক্রমে সবাই এ বিশ্বাস করে আসছে এবং কেউ এতে কোনদিনও সন্দেহ প্রকাশ করেনি।”

এ মসজিদে ইউসূফের কবরও রয়েছে এবং তার কিছু পূর্বে রয়েছে হজরত লূত(৩২) এর কবর। কবরটি সুন্দর একটি অট্টালিকার অভ্যন্তরে। অদূরে আছে লোতের হ্রদ (Dead sea)। এ হ্রদের পানি লবণাক্ত। কথিত আছে সূতের লোকেরা যেখানে বাস করত সেখানেই এ হ্রদটির সৃষ্টি হয়েছে।

হেবরন (ইব্রাহিমের শহর) থেকে জেরুজালেম যাবার পথে বেধূলেহেম-হজরত ঈসার জন্মস্থান। স্থানটি প্রকাণ্ড একটি অট্টালিকায় আবৃত। খ্রীস্টানরা স্থানটিকে তীর্থ হিসাবে গণ্য করে এবং সেখানে যারা গমন করে তাদের অতিথির মত যত্ন করে।

অতঃপর আমরা জেরুজালেমে পৌঁছলাম। খ্যাতির দিক থেকে পবিত্র তীর্থস্থান মক্কা ও মদিনার পরে জেরুজালেমের তৃতীয় স্থান এবং এখান থেকেই আমাদের পয়গম্বর মেরাজ(৩৩) গমন করেন। খ্রীস্টানরা এ নগরটি অধিকার করে সুরক্ষিতভাবে বসবাস আরম্ভ করতে পারে আশঙ্কা করে বিখ্যাত সম্রাট সালাহউদ্দিন ও তার পরবর্তিগণ(৩৪) এর প্রাচীরগুলি নষ্ট করে ফেলেন। জেরুজালেমের পবিত্র মসজিদটি অতি সুদৃশ্য এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মসজিদ বলে খ্যাত। পূর্ব থেকে পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য ৭৫২ রাজ হাত এবং প্রস্থ ৪৩৫ হাত। মসজিদের তিনদিকে অনেকগুলি প্রবেশ পথ আছে। যতদূর দেখেছি, মসজিদটির দক্ষিণদিকে আছে মাত্র একটি দরজা। এ-দরজা দিয়ে শুধু এমাম প্রবেশ করেন। এ মসজিদটি অনাবৃত একটি বৃহৎ চত্বর বিশেষ। কিন্তু আল-আকসা মসজিদটি এর ব্যতিক্রম। আল-আকসা মসজিদের ছাদটি কারুকার্য খচিত এবং সোনালী ও বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত। মসজিদের অংশ বিশেষ ছাদ দ্বারা আবৃত। মসজিদটির গুম্বজ গঠনের শোভা সৌন্দর্য ও দৃঢ়তায় অতুলনীয়। গুম্বজটি মসজিদের মধ্যস্থানে অবস্থিত। মার্বেল পাথরের একটি সিঁড়ি দিয়ে গুঁজে পৌঁছা যায়। গুম্বজের চারটি দরজা, চতুষ্পর্শ এবং অভ্যন্তর মার্বেল পাথরে মণ্ডিত। ভিতরের এবং বাইরের কারুকার্য এবং সাজসজ্জা এত সুন্দর যে ভাষায় তা বর্ণনা করা যায় না। এর অধিকাংশই স্বর্ণাবৃত। কাজেই এর দিকে চাইলেই চোখ ঝলসে যায়, বিদ্যুৎ চমকের মত মনে হয়। গুম্বজের মধ্যস্থলে পবিত্র প্রস্তরখণ্ড। এখান থেকেই আমাদের প্রিয় পয়গম্বর মেরাজে গমন করেন। এ প্রস্তরখণ্ড একটি মানুষের সমান বাইরের দিকে বাড়ানো। তার নিচেই রয়েছে ছোট একটি প্রকোষ্ঠ। সেটিও একটি মানুষের সমান নিচু। নিচে নেমে যাবার সিঁড়িও রয়েছে। প্রস্তরখণ্ড ঘিরে আছে দু’প্রস্থ আবেষ্টনী। যে আবেষ্টনীটি প্রস্তরখন্ড থেকে অপেক্ষাকৃত নিকটে সেটি অতি সুন্দরভাবে লোহা(৩৬) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। অপরটি কাঠের তৈরি।

জেরুজালেমে যে-সব পবিত্র দরগা আছে তার একটি জাহান্নাম (Gehenna) উপত্যকায় শহরের পূর্বপ্রান্তে পাহাড়ের উপর অবস্থিত। কথিত আছে হজরত ঈসা যেখান থেকে বেহেস্তে(৩৭) গমন করেন সেখানে এ-দরগাটি অবস্থিত। এ উপত্যকার নিম্নদেশে খ্রীস্টানদের একটি গীর্জা আছে। খ্রীস্টানরা বলে যে এ গীর্জাটির অভ্যন্তরে বিবি মরিয়মের কবর আছে। একই স্থানে আরও একটি গীর্জা আছে যাকে খ্রীস্টানরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং তীর্থ উদযাপন করতে আসে। খ্রীস্টানদের মিথ্যাভাবে বিশ্বাস করানো হয় যে এ গীর্জার ভেতরে হজরত ঈসার সমাধি আছে। এখানে যারা তীর্থ। করতে আসে তাদের প্রত্যেককে নির্দিষ্ট কর আদায় করতে হয় এবং মুসলিমদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক প্রকার অবমাননা সহ্য করতে হয়। এ স্থানটির নিকটেই আছে। হজরত ঈসার দোলনা।(৩৮) শুভেচ্ছা লাভের জন্য তীর্থযাত্রীরা তা দেখতে আসে।

অতঃপর জেরুজালেম থেকে আমরা গেলাম আসকালনের দূর্গ দেখতে। দুর্গটি তখন পুরোপুরি ধ্বংসের কবলে গিয়ে পড়েছে। ওমরের মসজিদ নামে বিখ্যাত যে মসজিদটি ছিল তারও তখন শুধু দেওয়ালগুলি আছে, আর আছে, মার্বেল প্রস্তরের কয়েকটি স্তম্ভ। কয়েকটি স্তম্ভ তখনও দাঁড়িয়ে আছে, বাকিগুলি ধরাশায়ী। একটি স্তম্ভ চমৎকার লাল রঙের। সেখানকার লোকরা বলে, ক্রীস্টানরা এক সময়ে এ স্তম্ভটি বয়ে নিয়ে যায় তাদের দেশে। কিছুদিন পরে সেটি হারিয়ে যায়। পরে দেখা যায় সেই স্তম্ভটি আসকালনে আবার যথাস্থানে এসে গেছে। সেখান থেকে আমি গেলাম আর-রামলা শহরে। আর-রামলা ফিলিস্তিন (Palestine) নামেও পরিচিত। কথিত আছে এখানকার মসজিদের পশ্চিমদিকে পয়গম্বরদের তিন শ’ জন সমাহিত আছেন। আর-রামলা থেকে। আমি এলাম নাবুলাস (Shechem)। এখানে প্রচুর গাছ-গাছড়া আছে আর আছে। সততঃপ্রবহমান নহর। সিরিয়ার ভেতর জলপাইর জন্য বিখ্যাত স্থানগুলির একটি নাবুলাস। এখান থেকে জলপাই তেল রপ্তানী হয়ে যায় কায়রো ও দামেশক শহরে। নাবুলাসে খরুবা মিষ্টি তৈরি হয় এবং সেসব মিষ্টি এখান থেকে দামেশক ও অন্যান্য। শহরে রপ্তানী হয়। খরুবাগুলিকে প্রথমে জাল দেওয়া হয় তারপর সেগুলিকে পেষণ করে। বের করা হয় রস। সেই রস থেকেই তৈরি হয় মিষ্টি। শুধু রসও দামেশক ও কায়রো। শহরে চালান দেয়া হয়। এছাড়া নাবুলাসে এক রকম তরমুজও পাওয়া যায়। সে তরমুজ খুবই সুস্বাদু।

সেখান থেকে লাধিকিয়ার পথে দ্বায়র হয়ে আজালনে(৩৯) পৌঁছলাম। পথে আকার (Acre) ধ্বংসাবশেষ দেখলাম। আক্কা ছিল সিরিয়ার ফ্রাঙ্কদের রাজধানী বন্দর। তখন কনস্টাটিনোপলের সঙ্গে এ বন্দরের তুলনা চলত।

এখান থেকে গেলাম ধ্বংসপ্রাপ্ত সুরে (Tyre)। সুর তখন ধ্বংস হয়ে গেলেও সেখানে একটি লোকালয় আছে। লোকালয়ের অধিকাংশ বাসিন্দা রিফুসার সম্প্রদায়ের লোক। সুর বা টায়ার শহরটি তার দুর্ভেদ্যতার জন্য প্রসিদ্ধ। শহরের তিনটি দিক সমুদ্রের দ্বারা আবৃত। দুটি প্রবেশপথের একটি সমুদ্রের দিকে, অপরটি স্থলের দিকে। স্থলের দিকে যে প্রবেশ পথটি রয়েছে সেটি পর-পর চারটি মাটির প্রাচীর দিয়ে আবৃত। সমুদ্রের দিকে প্রবেশপথটি দু’টি টাওয়ার বা সুউচ্চ মিনারের মধ্যস্থলে। এমন সুন্দর স্থাপত্যের নির্দশন দুনিয়ার আর কোথাও নেই। এর তিনটি দিক সমুদ্রের দ্বারা আবৃত। অপরদিকে দেওয়াল। দেওয়ালের নিচে জাহাজ যাতায়াতের পথ। পূর্বে এক টাওয়ার থেকে অপর টাওয়ার অবধি একটি লোহার শিকল ঝুলান ছিল। সে শিখলটি নিচু করে না দেওয়া পর্যন্ত যাতায়াতের কোন উপায় ছিল না। দ্বার রক্ষার ভার ন্যস্ত থাকত বিশ্বাসী পাহারাদারদের উপর। তাদের অজ্ঞাতে কেউ বাইরে যেতে বা ভেতরে আসতে পারত না।

আক্কাতেও এ-ধরনের একটি পোতাশ্রয় আছে। কিন্তু তার ভেতর শুধু ছোট জাহাজই প্রবেশ করতে পারে। সুর বা টায়ার থেকে এলাম সায়দা (Sidon)। ফলের জন্য প্রসিদ্ধ সুন্দর এ শহরটি সমুদ্রোপকূলে অবস্থিত। এখান থেকে কায়রোয় ডুমুর, কিসমিস ও জলপাই তেল চালান হয়।

অতঃপর আমি তাবারিয়া (Tiberias) (৪০) শহরে হাজির হই। এক কালে এটি একটি ঘদ্ধি বড় শহর ছিল। এর কয়েকটি স্মৃতিচিহ্ন মাত্র দাঁড়িয়ে আছে অতীত সুদিনের সাক্ষ্য বহন করে। এখানে নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক ব্যবস্থাযুক্ত অতি চমৎকার হামাম আছে। হামামের পানি বেশ গরম। তাবারিয়ার গ্যালিলির দরিয়া (Sea of galilee) নামে আঠার মাইল লম্বা ও নয় মাইল চওড়া একটি হ্রদ আছে। শহরের একটি মসজিদ ‘পয়গম্বরদের মসজিদ’ নামে পরিচিত। মসজিদে রহিয়াছে শোয়ব Jethss) যার কন্যা হজরত মুসার বিবি এবং সুলেমান, জুদা ও রিউবেনের সমাধি। তাবারিয়া থেকে আমরা গেলাম যে কূপে ইউসুফকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তা দেখতে। সেখানে গিয়ে কূপের পানি দ্বারা আমরা তৃষ্ণা নিবারণ করলাম। একটি ছোট মসজিদের চত্বরে বেশ বড় ও গভীর একটি কূপ। পানি ছিল বৃষ্টির কিন্তু কূপের রক্ষণাবেক্ষণ কারী বলল, কূপের মধ্যে একটি ঝরণাও আছে। সেখান থেকে আমরা বৈরুত গিয়ে হাজির হলাম। বৈরুত শহরটি ছোট্ট কিন্তু চমৎকার বাজার ও সুন্দর মসজিদ আছে এখানে। এখান থেকে ফল এবং লোহা চালান হয়ে মিসরে যায়।

বৈরুত থেকে আমরা রওয়ানা হলাম আবু ইয়াকুব ইউসুফের কবর জেয়ারতের জন্য। তিনি উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার একজন রাজা বলে পরিচিত। কারাফনূহ (৪১) নামক একটি জায়গায় এ কবরটি অবস্থিত। সমাধির ধারেই একটি মুসাফেরখানা আছে। মুসাফেররা এখানে আদরযত্ব পেয়ে তাকে। অনেকে বলে, সুলতান সালাহুদ্দিন এটি স্থাপন করেন। কিন্তু অপর লোকদের মতে এটির প্রতিষ্ঠাতা সুলতান নুরুউদ্দিন। কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, সুলতান একবার স্বপ্নে দেখলেন আবু ইয়াকুবের দ্বারা তিনি উপকৃত হবেন। এজন্য আৰু ইয়াকুবকে তিনি কিছুদিনের জন্য নিজের কাছে এনে রাখেন। আবু ইয়াকুব এক রাত্রে সেখান থেকে একাকী পলায়ন করেন। পথে অসহ্য শীতের মধ্যে তিনি একটি গ্রামে এসে হাজির হন। সেই গ্রামের একটি দরিদ্র লোক তাকে আশ্রয় দেন এবং তাঁর অনুমতি নিয়ে একটি মুরগী জবাই করে রুটি আহার করতে দেন। আহারান্তে আবু ইয়াকুব গৃহস্বামীকে দোয়া করেন। গৃহস্বামীর কয়েকটি ছেলেমেয়ে ছিল। অচিরেই একটি মেয়ে বিবাহ হবে বলে স্থির হয়েছিল। কন্যার বিবাহে পিতার দান-দেহাজ দেওয়ার রীতি তখনও সেখানে প্রচলিত ছিল। এ-সব দান দেহারেজ অধিকাংশই হত তামার নির্মিত তৈজসপত্র। বিবাহের চুক্তির অঙ্গ স্বরূপ এসব দান-দেহাজের বস্তু নিয়ে সবাই গর্ববোধ করত। আৰু ইয়াকুব গৃহস্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কোন তামার তৈজসপত্র আছে কি?”

গৃহস্বামী বলল, “হ্যাঁ, আছে। আমার মেয়ের বিয়েতে দেহাজ দিবার জন্য কিছু তৈজসপত্র কেনা হয়েছে।”

সেগুলি কাছে আনা হলে আবু ইয়াকুব বললেন, “তোমার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আরও যতটা পার ধার করে আন।” গৃহস্বামী তাই করল এবং অতিথির সামনে সব এনে হাজির করল। তিনি তখন তার চারদিকে আগুন জ্বেলে একটি থলের ভেতর থেকে কিছু আরক বের করে সেগুলির উপর ছড়িয়ে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে সব পাত্র সোনার পাত্রে পরিণত হল। আবু ইয়াকুব সে সমস্ত একটি তালাবদ্ধ করে রেখে গেলেন। এবং দামাস্কে সুলতান নুরুউদ্দিনকে সে সবের কথা উল্লেখ করে বিদেশী মুসাফেরদের জন্য হাসপাতাল ও একটি মুসাফেরখানা স্থাপন করতে লিখলেন। তিনি ঐ সব তৈজসপত্রের মালিকদের সন্তুষ্ট করতে এবং উপরোক্ত গৃহস্বামীকে ভরণপোষণ করতেও আদেশ দিলেন। গৃহস্বামী নিজেই পত্রখানা নিয়ে সুলতানের কাছে গেল। অতঃপর সুলতান এসে সবাইকে সন্তুষ্ট করলেন। সুলতান আবু ইয়াকুবকে অনেক সন্ধান করেও। দেখা পেলেন না। অবশেষে দামেস্কে ফিরে গিয়ে ঐ নামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করলেন। এটি পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল।

অতঃপর আমি হাজির হলাম আত্রাবুলাস (Trpoli) শহরে। আত্রাবুলাস সিরিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর। নবনির্মিত এ শহরটি ছ’মাইল অভ্যন্তরে অবস্থিত। পুরাতন শহরটি সমুদ্রের তীরেই ছিল। এক সময়ে খ্রীস্টানরা শহরটি অধিকার করেছিল। অতঃপর সুলতান বেইবাস(৪২) এটি পুনরুদ্ধার করে ধ্বংস করেন এবং নতুন শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ শহরে অনেকগুলি সুন্দর হামাম আছে। একটি হামাম একজন শাসনকর্তার নামানুসারে সিন্দামুর নামে পরিচিত। তিনি অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিতেন। সে সম্বন্ধে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। একবার একজন স্ত্রীলোক এসে ফরিয়াদ জানাল, শাসনকর্তার একটি কর্মচারীর বিরুদ্ধে। স্ত্রীলোকটি দুধ বিক্রি করত। কিছু দুধ নিয়ে ঐ কর্মচারী খেয়ে ফেলেছে। স্ত্রীলোকটির কোন সাক্ষী ছিল না। কিন্তু তবু শাসনকর্তা তাকে তলব করে পাঠালেন এবং সে হাজির হলে তাকে দু’টুকুরা করে কেটে ফেললেন। তখন দেখা গেল লোকটির পাকস্থলীতে সত্যিই দুধ রয়েছে। তুকিস্তানের সুলতান বেবেক(৪৩) সম্বন্ধে এবং সুলতান কালাউনের অধীনে আইধারের শাসকর্তা আল আত্রিশ সম্বন্ধেও অনুরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে।

ত্রিপলি থেকে হিস-আল্ আকরাদ (এখন কালাতে-আল্-হিস) ও হিস হয়ে আমরা হামা পৌঁছলাম। হামা সিরিয়ার অপর একটি প্রসিদ্ধ শহর। শহরটি ফলের বাগ বাগিচায় ঘেরা। এখানে গোলকাকার ও ঘূর্ণায়মান অনেকগুলি (water wheel) আছে। সেখান থেকে আমরা মা’রা এসে হাজির হলাম। মারা যে এলাকায় অবস্থিত সে। এলাকায় একশ্রেণীর শিয়া বাস করে। তারা দশ সাহাবা’কে ঘৃণার চোখে দেখে এবং ‘ওমর’(৪৪) নামধারী লোকমাত্রই ঘৃণা করে। মারা থেকে আমরা যাই সারমিন। সারমিনে সাবান প্রস্তুত হয় এবং দামাস্কাস ও কায়রোতে রপ্তানী হয়। হাত ধোবার উপযোগী সুগন্ধি সাবানও এখানে প্রস্তুত হয়। এ সাবান তারা লাল ও হলদে রঙে রঞ্জিত করে। এখানকার বাসিন্দারাও দশ সাহাবাকে ঘৃণা করে। একটি তাজ্জব ব্যাপার এই যে, এরা। দশ’ শব্দটিও উচ্চারণ করে না। দালালরা যখন নীলামে কোন জিনিস বিক্রি করতে যায় তখন বাজারে তারা নয়ের পর দশ না বলে নয় আর এক’ বলে। একদিন সেখানে একজন তুর্কী উপস্থিত ছিল। এক দালালকে নয় আর এক বলতে শুনেই সে তার। হাতের লাঠিটা দালালের মাথার কাছে তুলে বলল, “বল দশ!” তাতে লোকটি বলল, “লাঠির সঙ্গে দশ।”

সেখান থেকে আমরা এলাম হালাব (Aleppo) (৪৫)। এখানে মালিক-উল-উমারার ঘাঁটি অবস্থিত। তিনি ছিলেন মিসরের সুলতানের প্রধান সেনানায়ক। তিনি সুবিচারক ছিলেন এবং তার ন্যায় বিচারের অনেক সুখ্যাতি আছে কিন্তু তিনি একজন ব্যয়কুণ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন।

এলেপ্পো থেকে রওয়ানা হয়ে তুকমনদের(৪৬) নবনির্মিত শহর তিজিন হয়ে আমরা পৌঁছলাম অ্যানটাকিয়া (Antioch)। সিরিয়ার শহরগুলির ভেতর একমাত্র এ্যান্টিকয়ক। সুদৃঢ় প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কিন্তু আল মালিক আজ-জহির (বেবার্স) যখন এ শহরটি অধিকার করেন তখন তিনি ঐ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলেন।(৪৭) সুন্দর-সুন্দর অট্টালিকা। বিশিষ্ট শহরটি জনবহুল এবং এখানে গাছগাছড়া ও পানির অভাব নেই। সেখানে থেকে আমি বারাস(৪৮) দূর্গ দেখতে যাই। দূর্গটি সিনদের অর্থাৎ আর্মেনিয়ান বিধর্মীদের দেশের প্রবেশপথে অবস্থিত। তাছাড়া কয়েকটি প্রাসাদ এবং আরও কয়েকটি দূর্গে প্রবেশের একই পথ। এখানকার কয়েকটি দূর্গ ইসমাইলিটায় (Ismailites) ফিদায়ী সম্প্রদায়ের(৪৯) লোকদের অধিকারে। উক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত লোক ছাড়া কাহারও এসব দূর্গে প্রবেশের অধিকার নেই। তারা সুলতানের তীর স্বরূপ। তাদের সাহায্যেই সুলতান তার শত্রুদের আক্রমণ করেন। শত্রুরা তখন ইরাক ও অন্যান্য দেশে গিয়ে প্রাণরক্ষা করে। সুলতানের এসব লোক নির্দিষ্ট বেতন পেয়ে থাকে। কিন্তু সুলতান যখন তাদের কাউকে কোন শত্রু নিপাত করতে পাঠান তবে তাকে জীবনের মূল্য স্বরূপ অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে থাকেন। কাজ সমাধা করে ফিরে এলে লোকটি সে অর্থ নিজেই গ্রহণ করে কিন্তু লোকটি মারা গেলে সে অর্থ দেওয়া হয় তার পুত্রদের। তাদের কাছে বিষাক্ত ছোরা থাকে এবং তাই দিয়েই তারা শত্রুদের আক্রমণ করে। অনেক সময় তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় এবং নিজেরাই মৃত্যুর কবলে পড়ে।

ফিদায়ীদের দূর্গ থেকে আমি জাবালা শহরে গেলাম। জাবালা সমুদ্র পার থেকে এক মাইল অভ্যন্তরে অবস্থিত শহর। এ শহরে প্রসিদ্ধ তাপস ইব্রাহিম-ইন-আদ্-হাম-এর কবর আছে। তিনি রাজ্য ত্যাগ করে নিজকে খোদার নামে উৎসর্গ করেছিলেন।(৫০) এখানে যারা আসে তাদের সবাই কবর রক্ষককে অন্ততঃ একটি করে মোমবাতি দিয়ে যায়। তার ফলে বহু মন মোমবাতি এখানে মৌজুদ থাকে। সমুদ্র উপকূলবর্তী এ জেলার অধিকাংশ বাসিন্দা সুনারি (Nusayis) সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা হজরত আলীকে খোদা বলে বিশ্বাস করে (৫১)। তারা নামাজ পড়ে না, অজু গোসল করে না এবং রোজাও রাখে না। আল-মালিক আজ-জাহির এখানকার বাসিন্দাদের নিজ গ্রামে মজিদ তৈরী করতে বাধ্য করেছিলেন। তখন তারা বাসগৃহের থেকে অনেক দূরে একটি করে মসজিদ তৈরি করে রাখে। কিন্তু তারা সে মসজিদে কখনও প্রবেশ করে না বা মেরামত করে না। অনেক সময় সে সব মসজিদ তাদের গরু ও গাধার আশ্রয়স্থলরূপে ব্যবহৃত হয়। সময় সময় বিদেশী লোকরা সেসব মসজিদে আশ্রয় লয়। তখন তারা আজান দিতে লাগলে স্থানীয় লোকেরা বিদ্রূপ করে বলে “গাধার মত চীৎকার করো না, তোমার জন্য খড়বিচালী আসছে।” এ শ্রেণীর অনেক লোকের বাস এখানে।

এখানকার লোকদের ভেতর প্রচলিত একটি কাহিনী আছে। একবার একজন অপরিচিত লোক এসে নিজকে এদের কাছে মেহেদী বলে পরিচয় দিল। এ-কথা শুনে তারা এসে লোকটিকে ঘিরে ধরল। সে তখন দেশের মালিক হিসেবে সারা সিরিয়া তাদের ভেতর ভাগ করে দিল এবং প্রত্যেকটি শহরের জন্য তাদের এক-এক জনকে নিযুক্ত করল। অতঃপর তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে জলপাই গাছের পাতা দিয়ে বলে দিল,”এটা তোমার নিযুক্তির প্রতীক।” এই বলে এক-এক শহরে তাদের এক-এক জনকে পাঠিয়ে দিল।

অতঃপর এদের কেউ কোন শহরে গিয়ে হাজির হলেই সেখানকার শাসনকর্তা তাকে ডেকে পাঠাতেন। লোকটি তখন হাজির হয়েই বলত, “ইমাম-আল-মেহেদী আমাকে এ শহর দিয়েছেন।” শাসনকর্তা জিজ্ঞেস করতেন, “তোমার সনদ কোথায়?” সে তখন জলপাই গাছের পাতাটি বের করে দেখাত। শাসনকর্তা তাকে কারাগারে বন্দী করে রাখতে হুকুম দিতেন। তখন সেই তথাকথিত মেহেদী তাদের যুদ্ধ করতে বলল মুসলমানদের সঙ্গে এবং জাবালাতেই প্রথম শুরু হবে সে যুদ্ধ। তরবারীর পরিবর্তে তিনি তাদের প্রত্যেককে মেদী গাছের ডালা নিয়ে যুদ্ধ করতে বললেন এবং আশ্বাস দিলেন যে, এ ডালাই তাদের হাতে যুদ্ধের সময় তরবারী হবে। এক শুক্রবার যখন মুসলমানরা মসজিদে নামাজে রত ছিল তখন সহসা তারা জাবলায় মুসলমানদের গৃহে হামলা করল এবং মেয়েলোকদের অবমাননা করল। মুসলমানরা এ খবর পেয়ে দ্রুত মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে অস্ত্রধারণ করল এবং যথেচ্ছভাবে তাদের হত্যা করতে লাগল। লাঠিকিয়ায় এ সংবাদ পৌঁছলে শাসনকর্তা তার সৈন্য নিয়ে এসে হাজির হলেন। এদিকে সংবাদবাহী কবুতরের সাহায্যে ত্রিপলীতে সংবাদ পাঠালে প্রধান সেনানায়ক ও একদল সৈন্য নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগদান করলেন। বিশ হাজার বিধর্মী নুসারীকে এভাবে হত্যা করা হল। বাকি সবাই পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং প্রধান সেনানায়ককে বলে পাঠায় যে তাদের প্রাণে বাঁচালে তারা মাথা পিছু এক দিনার প্রধান সেনানায়ককে নজরানা দিবে। কবুতরের সাহায্যে তাদের এ-শর্ত পুনরায় সুলতানের কাছে পাঠান হল। সুলতান তাদের কেটে ফেলতে হুকুম দিলেন। তখন প্রধান সেনানায়ক সুলতানকে বুঝিয়ে দিলেন এসব লোক মুসলমানদের জমিজমা চাষাবাদ করত। এদের সবংশে হত্যা করা হলে পরে মুসলমানদের বহু অসুবিধা হবে। এর ফলে লোকগুলির জীবন রক্ষা পেল

অতঃপর আমি লাঠিকিয়া (Lataka] শহরে গেলাম। শহরের বাইরে খ্রীস্টানদের একটি মঠ আছে। মঠটি দার-আল-ফাস্ নামে পরিচিত। সিরিয়া এবং মিসরের মধ্যে। এটিই বড় মঠ। খ্রীস্টান সাধুরা এখানে বাস করে এবং বিভিন্ন দেশের খ্রীস্টানরা এখানে তীর্থ করতে আসে। খ্রীস্টান বা মুসলমান যারাই এখানে আসে তাদেরই খাবার দেওয়া হয়। খাবার হল রুটী, পনির, জলপাই এবং সিকা। লাঠিকিয়ার পোতাশ্রয়টি দুটি টাওয়ার বা স্তম্ভের মধ্যে শিকল বেঁধে বন্ধ করে রাখা হয়। শিকলটি নিচু করে না দেওয়া পর্যন্ত কোন জাহাজ যেতে বা আসতে পারে না। এটি সিরিয়ার একটি প্রসিদ্ধ পোত্রয়। এখান থেকে আমি যাই আল-মারফাব (Beluedere) দূর্গে। কারাকের। দূর্গের মত এটিও একটি প্রসিদ্ধ দূর্গ। একটি উঁচু পাহাড়ের উপর দূর্গটি নির্মিত হয়েছে। বিদেশী মুসাফেররা এলে এর উপকণ্ঠে আশ্রয় পায়, ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পায় না। আল-মালিক আল-মনসুর কালাউন এ দূর্গটি খ্রীস্টানদের নিকট থেকে অধিকার করেন। এ দূর্গের নিকটেই তার পুত্র, মিসরের বর্তমান সুলতান আল-মালিক আন্-নাসিরের জন্ম হয়। এখান থেকে আমি আল-আকরা পর্বত দেখতে পাই। আল-আরা সিরিয়ার সর্বোচ্চ পর্বত। সমুদ্র থেকে দেশের যে অংশটি দৃষ্টিগোচর হয় সে অংশেও এত বড় পর্বত আর নেই। পার্বত্যাঞ্চলের অধিবাসীরা তুর্কীমেন। এখানে ঝরণা এবং নহর। আছে।

অতঃপর আমি লুবনান (Lebanon) পর্বতে যাই। পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর পর্বতশ্রেণী এই লুবনান। এখানে সবরকম ফলমূল জন্মে এবং অনেক ঝরণা ও লতাকুঞ্জ আছে। এখানে সব সময়েই বহুসংখ্যক ধর্মনিষ্ঠ লোক যাতায়াত করে এবং এজন্যই স্থানটি প্রসিদ্ধ।

এখান থেকে আমি বা-আবেক শহরে এলাম। বা-আলবেক দামাস্কের মতই সুখ সুবিধাযুক্ত একটি পুরাতন শহর। এখানকার মত এত প্রচুর চেরী কোন জেলায়ই জন্মে না। এখানে বহুরকম মিষ্টি তৈরি হয়। তাছাড়া এখানকার বস্তু, কাঠের পাত্র ও চামচ সর্বোকৃষ্ট। এখানকার কারিগরেরা এক রকম থালা তৈরি করে একটির ভেতর আরেকটি করে দশটি অবধি এভাবে সাজিয়ে রাখে যে, দেখলে একখানা থালা বলেই মনে হয়। চামচও তারা এমনি করেই তৈরি করে এবং চামড়ার থলেতে রেখে দেয়। একজন লোক তার কোমরবন্দের মধ্যেই এগুলো রাখতে পারে। পরে প্রয়োজন মত বের করলে দেখা যাবে একটি চামচ কিন্তু সে তখন তার অপর নয় জন বন্ধুকেও নয় খানা চামচ দিতে পারবে। দ্রুত হেঁটে গেলে বা-আলবাক থেকে দামেস্ক একদিনের পথ। বা-আলবাক ছেড়ে কাফেলা আজ-জাদানী নামক ছোট্ট একটি গ্রামে গিয়ে রাত্রি যাপন করে এবং পরের দিন ভোরে দামেস্কে পৌঁছে। দামেস্কে যাওয়ার জন্য আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম বলে বিকেল বেলা বা-আলবাক পৌঁছে পরের দিন ভোরেই পথে বেরিয়ে পড়ি।

মঙ্গলবার ৯ই রমজান, ৭২৬ হিজরী (৯ই আগস্ট, ১৩২৬ খ্রঃ) আমি দামেঙ্কে প্রবেশ করলাম এবং আশ শারাবিসিয়া বিদ্যালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। সৌন্দর্যে দামেস্ক শহর অন্যান্য সমস্ত শহরের শীর্ষস্থানে। এ শহরের শোভা-সৌন্দর্য বর্ণনার অতীত। ইব্‌নে জুবাইর(৫২) এ শহরের যেভাবে সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন তার চেয়ে ভাল বর্ণনা আর হতে পারে না। এখানকার উন্মিয়া মসজিদ নামে পরিচিত গীর্জা মসজিদটি জগতে অতুলনীয়। গঠন-পারিপাট্যে ও বহি সৌন্দর্যে মসজিদটি সর্বোৎকৃষ্ট এবং অদ্বিতীয়। খলিফা প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫-৭১৫) এ মসজিদ স্থাপন করেন। মসজিদ প্রস্তুতের জন্য তিনি কনস্টান্টিনোপলের ম্রাটের কাছে কারিগর চেয়ে পাঠান। ম্রাট এ কাজের জন্য বার হাজার দক্ষ কারিগর দামেস্কে পাঠান। মসজিদ যেখানে স্থাপিত আছে পূর্বে সেখানে। একটি গীর্জা ছিল। মুসলমানরা যখন দামেস্ক অধিকার করে তখন একজন সেনানায়ক। তরবারী হস্তে গীর্জার একদিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে মধ্যদেশ অবধি পৌঁছে। কাজেই গীর্জার যে অর্ধাংশ মুসলমানরা বলপ্রয়োগে দখল করে সে অর্ধাংশ মসজিদে

পরিণত করে এবং বাকি যে অংশে তারা শান্তিপূর্ণভাবে প্রবেশ করে সে অংশ গীর্জাই। থেকে যায়। অতঃপর ওয়ালিদ সমগ্ৰ গীর্জা ব্যাপিয়া মসজিদটি সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে যে। কোন মূল্যে গীর্জাটি ক্রয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু গ্রীকগণ তাহাতে সম্মত হয় না। তখন খলিফা গীর্জাটি অবরোধ করতে বাধ্য হন। খ্রীস্টানগণ তখন বলতে থাকে যে, এ গীর্জা যে নষ্ট করবে সে উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হবে। এ কথা ওয়ালিদের কানে গেলে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর খেদমত করতে আমিই প্রথম উন্মাদ হতে চাই।’ এই বলে তিনি কুঠার হস্তে নিজে গীর্জাটি ভাঙ্গতে আরম্ভ করেন। তখন অন্য মুসলমানরা তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এবং খ্রীস্টানদের ধারণা যে অলীক তা প্রমাণ করে।(৫৩)

এ মসজিদের চারটি প্রবেশদ্বার। দক্ষিণ দ্বারটি ‘বৃদ্ধির দ্বার’ নামে খ্যাত। দরজার সামনেই প্রশস্ত একটি পথ আছে। সেখানে পুরাতন জিনিস এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকানপাট আছে। এ পথেই পূর্বেকার অশ্বারোহী সৈন্যদের বাসস্থানে যেতে হতো। এখান থেকে বেরিয়েই তাম্রনির্মিত জিনিসপত্রের কারিগর বা কাঁসারীদের। বাজার। মসজিদের দক্ষিণ দিক অবধি প্রসারিত এ বাজারটি দামেস্কের অন্যতম সুন্দর বাজার। মাবিয়া খলিফার আল-খাদূরা (সবুজ প্রাসাদ) নামক প্রাসাদের স্থানে। বাজারটি স্থাপিত হয়েছে। আব্বাসিকগণ প্রাসাদ ধ্বংস করে এখানে বাজার স্থাপন। করে। মসজিদের পূর্বদিকের সুবৃহৎ দরজাটি ‘জেরুন দরজা’ নামে পরিচিত। এখান থেকে একটি প্রশস্ত রাস্তা স্তম্ভশ্রেণীর ভেতর দিয়ে ছয়টি সুউচ্চ স্তম্ভের মধ্যস্থ প্রবেশদ্বার পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। রাস্তাটির উভয় পার্শ্বস্থ স্তম্ভের উপরে গোলাকৃতি বারান্দা বা। গ্যালারী। এসব বারান্দায় বস্ত্র বিক্রেতা এবং অন্যান্যদের দোকান। তার উপরে লম্বা বারান্দায় রয়েছে স্বর্ণকার, পুস্তক বিক্রেতাদের দোকান এবং সুদৃশ্য কাঁচের জিনিসের দোকান। প্রথম দরজা সংলগ্ন চত্বরে দলিলপত্রাদি সম্পাদনকারী কর্মচারীদের কার্যালয়। প্রত্যেক কার্যালয়ে পাঁচ ছয় জন করে সাক্ষী মোতায়েন রয়েছে আর রয়েছে বিবাহাদি অনুষ্ঠানের জন্য কাজীর দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন কর্মচারী। দলিলপত্র সম্পাদনের কার্যালয় শহরের অন্যান্য জায়গায়ও আছে। এসব দোকানের কাছেই মনোহারী বাজার। সেখানে কাগজ, কলম, কালি বিক্রয় হয়। পথের মধ্যস্থলে মার্বেল পাথরের গোলাকার একটি প্রকাণ্ড চৌবাচ্চা। চৌবাচ্চা আবেষ্টন করে রয়েছে মার্বেল পাথরের উপর স্থাপিত ছাদবিহীন চত্বর। চৌবাচ্চাটির মধ্যস্থলে একটি তামার নল। নলটির মুখ দিয়ে সজোরে পানি নির্গত হয়ে মানুষ সমান উঁচুতে উঠে ছড়িয়ে পড়ে। লোকেরা একে Waterspoul বলে। দৃশ্যটি সত্যই মনোরম।

‘জেরুন দরজা’টির অপর নাম ‘ঘন্টার দরজা’। জেরুন দরজা অতিক্রম করলেই ডানদিকে উপরে প্রকাণ্ড খিলানের আকারে নির্মিত গ্যালারী বা বারান্দা। বৃহদাকার খিলানটার মধ্যে অনেকগুলি ক্ষুদ্রাকার অনাবৃত খিলান। এক দিনে যত ঘন্টা ক্ষুদ্রাকার খিলানের সংখ্যা ঠিক ততটি। এসব খিলানের একটি করে দরজা। দরজার ভিতর দিক। সবুজ এবং বাইরের দিক হলদে রঙ্গে রঞ্জিত। দিনের একটি ঘন্টা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে একটি খিলানের দরজার ভিতরের সবুজ দিক ঘুরিয়ে বাইরের দিক করে দেওয়া হয়, তখন হলদে দিকটি যায় ভিতর দিকে। লোকে বলে, বারান্দায় একজন লোক থাকে। ঘন্টা শেষ হলে সে হাত দিয়ে দরজা(৫৫) ঘুরিয়ে দেয়।

পশ্চিম দিকে দরজাটি Door of the Post (থামের দরজা) নামে পরিচিত। এ দরজার বাইরের পথে রয়েছে মোমবাতি প্রস্তুতকারক ও ফল বিক্রেতাদের দোকান। উত্তরের দরজাটি মিঠাইওয়ালাদের দরজা’ নামে পরিচিত। এ দরজার বাইরেও রয়েছে একটি প্রশস্ত রাস্তা, তার ডাইনে পানির বৃহৎ চৌবাচ্চা ও চলমান পানিসহ শৌচাগারযুক্ত খানকাহ, মসজিদের চারটি দরজার প্রত্যেকটিতেই একটি দালানে ওজুর ব্যবস্থা ও দালানে চলমান পানি সরবরাহের ব্যবস্থাযুক্ত প্রায় একশত কুটরী আছে।

সে সময়ে তকি উদ্দিন ইব্‌নে তায়মিয়া নামে দামেস্কে একজন হাম্বলী ধর্মশাস্ত্রবিদ ছিলেন। তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল কিন্তু মাথায় ছিল সামান্য ছিটু। দামেস্কের লোকেরা তাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করত। তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে মিম্বারে দাঁড়িয়ে তিনি ধর্মসম্বন্ধে। বক্তৃতা দিতেন। একবার তার কোন বক্তব্যের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রবিদরা একমত হতে পারলেন না। বিষয়টি সুলতানের গোচরীভূত করলে তিনি ইব্‌নে তায়মিয়াকে কয়েক বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখেন। কারারুদ্ধাবস্থায় তিনি কোরআনের তফসির লেখেন। এবং চল্লিশ খণ্ডে সমাপ্ত সেই তফসিরের নাম রাখেন সদ্র। অতঃপর ইব্‌নে তায়মিয়ার মাতা সুলতানের সঙ্গে দেখা করে তায়মিয়ার মুক্তিকামনা করেন। ইব্‌নে তায়মিয়া পুনরায় অনুরূপ অপরাধ না করা পর্যন্ত মুক্তই ছিলেন। এক শুক্রবার তায়মিয়া যখন মিম্বার থেকে খোত্ব পড়ে মুছাল্লিদের শোনাচ্ছিলেন তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। খোবার মধ্যে তিনি বললেন, “আমি যে ভাবে অবতরণ করছি ঠিক সেই ভাবে খোদাও আমাদের মাথার উপরের আকাশে অবতরণ করেন।” বলেই তিনি মিম্বার থেকে এক ধাপ নিচে নেমে এলেন। একজন মালেকী সম্প্রদায়ের শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি তার প্রতিবাদ করলেন এবং তাঁর কথায় ঘোর আপত্তি উত্থাপন (৫৬) করলেন। উপস্থিত সাধারণ শ্রোতারা শেষোক্ত ব্যক্তির উপর ক্ষেপে গিয়ে তাঁকে যথেচ্ছভাবে প্রহার করতে লাগল। প্রহারের সময় তার মাথার পাগড়ীটি পড়ে যায়। পাগড়ীর তলায় লোকটির মাথায় ছিল একটি রেশমি টুপি। রেশম ব্যবহারের জন্য (৫৭) তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গেল হাম্বলীদের কাজীর কাছে। কাজী লোকটিকে কারাগারে বন্দী করে প্রহারের হুকুম দিলেন। এ ব্যবহারের প্রতিবাদ করলেন অপরাপর শাস্ত্রবিদগণ। তারা বিষয়টি প্রধান আমীরের গোচরীভূত করলেন। তিনি সমুদয় লিখে পাঠালেন সুলতানের কাছে। অধিকন্তু তায়মিয়া বিভিন্ন সময়ে যে সব আপত্তিকর উক্তি করেছেন তারও একটি ফিরিস্তি সুলতানের নিকট দাখিল করলেন। সুলতান তায়মিয়াকে দূর্গে বন্দী রাখবার হুকুম। দিলেন। তায়মিয়া আমরণ সে দূর্গে বন্দী ছিলেন।(৫৮)

দামেস্কের আর একটি পবিত্র স্থান পদচিহ্ন মসজিদ (আল্-আকদাম)। শহর থেকে দু’মাইল দক্ষিণে হেজাজ, জেরুজালেম ও মিসর যাবার পথে এ মসজিদটি স্থাপিত। দামেস্কবাসীরা সুবৃহৎ এ মসজিদটিকে বিশেষ সম্ভ্রমের চোখে দেখে। একখণ্ড পাথরের উপর অঙ্কিত যে পদচিহ্নের জন্য মসজিদের নামকরণ হয়েছে সেগুলি হরজত মূসার পদচিহ্ন বলে কথিত। এ মসজিদের ক্ষুদ্র একটি কক্ষে এক খণ্ড পাথরের খোদিত আছে–”কোন একজন ধার্মিক লোক একরাত্রে হজরত রসূলুল্লাকে স্বপ্নে দেখেন। তখন রসূলুল্লাহ বলেন, এখানে আমার-ভাই মুসার কবর আছে।’ এ মসজিদটিকে দামেস্কবাসীরা সত্যই কি রকম শ্রদ্ধার চোখে দেখে তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখেছিলাম ১৩৪৮ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসের শেষাশেষি দামেস্ক হয়ে ফিরবার পথে। দামেস্কের তত্ত্বালীন শাসনকর্তা আরগুন শাহ্ ঢোল শহরৎ যোগে রাষ্ট্র করে দিলেন, দামেস্কের সবাইকে তিনদিন রোজা রাখতে হবে এবং উক্ত তিন দিন বাজারে কেউ কোন রকম খাদ্যদ্রব্য তৈরি করতে পারবে না।(৫৯) কারণ সেখানকার অধিকাংশ লোকই বাজারে তৈরি খাদ্য ছাড়া আর কিছু গ্রহণ করে না।(৬০) শাসনকর্তার হুকুম মত সবাই একাদিক্রমে তিন দিন রোজা রাখল। শেষের দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিন। দামেস্কের আমীর, শরিফ, কাজী, মোল্লা থেকে শুরু করে সাধারণ লোক অবধি নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রধান মসজিদে গিয়ে হাজির হল। সেখানে সারারাত তারা। খোদার এবাদত বন্দেগীতে কাটাল। পরের দিন সেখানে ফজরের নামাজ সেরে পুনরায় তারা মিছিল করে রওয়ানা হল পদচিহ্নের মসজিদের দিকে। এ মিছিলে খালি পায়ে আমীর ওমরাহ সবাই এসে যোগদান করল। মুসলমানগণ চলল কোরআন হাতে, খ্রীস্টানগণ বাইবেল হাতে এবং য়িহুদীগণ তাদের কেতাব হাতে। সবারই সঙ্গে পরিবারের নারী ও শিশুরা রয়েছে। সবাই কেঁদে কেঁদে স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থের ও পয়গম্বরের দোহাই দিয়ে খোদার করুণা ভিক্ষা করতে লাগল। এমনি করে প্রায় দ্বিপ্রহর অবধি তারা সেখানে কাটাল। অতঃপর তারা শহরে ফিরে এসে শুক্রবারের জুমা নামাজ আদায় করল। এর ফলে খোদা তাদের দুঃখের লাঘব করেছিলেন। দামেস্ক শহরে একদিনে মৃত্যুসংখ্যা কখনও দু’হাজারের উপরে উঠত না, অথচ কায়রো ও পুরাতন কায়রো। শহরে দৈনিক মৃত্যুসংখ্যা চব্বিশ হাজারে উঠত।

দামেস্ক শহরে ধর্মের নামে দান-খয়রাতের পরিমাণ ও প্রকার মানুষের ধারণার অতীত। অক্ষম হজযাত্রীদের অর্থসাহায্য, বদলা হজের জন্য সাহায্য, কন্যার বিবাহের দান দেহাজ দেবার জন্য দরিদ্র পিতা-মাতাকে সাহায্য, গোলাম আজাদ করার উদ্দেশ্যে সাহায্য, মুসাফেরদের আহার, বাসস্থান ও স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য সাহায্য। এসব ছাড়াও আছে রাস্তাঘাটের উন্নতি বিধান ও রাস্তাঘাট পাকা করার সাহায্য। কারণ, দামেস্কের সকল রাস্তারই দুপার পাকা। পথচারীরা সেখান দিয়া যাতায়াত করে, মধ্যের অংশ ব্যবহার করে অশ্বারোহীরা। এসব ছাড়াও আছে অন্যান্য দাঁতব্য ব্যাপার। একদিন দামেঙ্কের এক গলিপথে যেতে যেতে আমি দেখতে পেলাম, একটি ছোট গোলাম একটি চীনা মাটির বাসন হাত থেকে ফেলে ভেঙ্গে ফেলেছে। তাই দেখে কয়েকজন লোক তাকে ঘিরে ধরেছে। তাদের একজন লোক ছেলেটিকে বলল, “বাসনের টুকরাগুলি কুড়িয়ে নিয়ে তৈজসপত্রের দানের যিনি জিম্মাদার তার কাছে যাও।” ছেলেটি তাই। করল। পরে ঐ লোকটি তাকে নিয়ে জিম্মাদারের কাছে গেলে ভাঙ্গা পাত্রের টুকরাগুলি পরীক্ষা করে তিনি ছেলেটিকে টাকা দিয়ে দিলেন। কারণ, এরকম ব্যবস্থা না থাকলে। ছেলেটিকে মনিবের প্রহার অথবা গালাগাল নিশ্চয়ই সহ্য করতে হত। তাছাড়া এ ঘটনার জন্য ছেলেটিও মনমরা হয়ে যেত। এ রকম দান মানুষের অন্তরের ক্ষত আরোগ্য করে। ভাল কাজের জন্য যারা দান করেন খোদা তাদের পুরস্কৃত করুন।

মসজিদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, সমাধিস্তম্ভ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার কার্যে দামেস্কবাসীরা একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। উত্তর আফ্রিকাবাসীদের সম্বন্ধে তাদের ধারণা খুব উচ্চ। বিনাদ্বিধায় তারা তাদের অর্থ ও স্ত্রীপুত্রের ভার উত্তর আফ্রিকার লোকদের উপর ছেড়ে দেয়। বিদেশীদের প্রতিও তারা খুব ভাল ব্যবহার করে। সম্মানের হানিজনক কোন কাজ যাতে বিদেশীদের না করতে হয় সেদিকে এরা সর্বদাই নজর রাখে। আমি দামেস্কে আসার পর মালিকী সম্প্রদায়ভুক্ত অধ্যাপক নূর উদ্দিন শাখায়ীর সঙ্গে আমার যথেষ্ট বন্ধুত্ব হয়। রমজানের মাসে তিনি আমাকে তার গৃহে এফতার করার নিমন্ত্রণ করেন। চারদিন তার গৃহে এফতার করার পর আমি জ্বরাক্রান্ত হয়ে পঞ্চম দিনে। অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হই। তিনি আমার সংবাদ নিতে পাঠান। অসুখের কথা বলে পাঠালে তিনি তা মেনে নিতে নারাজ হন। কাজেই আমাকে পুনরায় সেখানে যেতে হয় এবং তাঁর গৃহে রাত্রি যাপন করতে হয়। পরের দিন ভোরে আমি বিদায় নিতে চাইলে তাতেও অসম্মতি জানিয়ে তিনি বললেন, “আমার বাড়িটাকে আপনার নিজের ভাইয়ের বা পিতার বাড়ী বলে মনে করে নিন।” এই বলে তৎক্ষণাৎ তিনি একজন ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। হুকুম দিলেন ডাক্তার যে ঔষধ পথ্যের ব্যবস্থা করবেন তার সবই আমার জন্য তৈরি হবে তার বাড়িতে। এভাবে রোজা শেষ হওয়া অবধি আমাকে তাঁর সঙ্গে। থাকতে হ’ল। সেখানে ঈদের উৎসব উদযাপনের পরে খোদা আমাকে নিরাময় করলেন। ইত্যবসরে আমার ব্যয়নির্বাহের জন্য যে অর্থ ছিল তা সবই নিঃশেষ হয়ে গেছে। নুরউদ্দিন তা জানতে পেরে আমাকে উটভাড়া করে দিলেন এবং প্রয়োজনীয় আরও সবকিছু দিয়ে কিছু অর্থও দিলেন। দিয়ে বললেন, “পথে কোন রকম বিপদ আপদে প্রয়োজনের সময় কাজে লাগবে।” খোদা যেন তাকে পুরস্কৃত করেন।

জানাজার শোকযাত্রার সময় দামেস্কবাসীরা অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে নিয়ম পালন। করে। সুললিত কণ্ঠে তারা কোরআন আবৃত্তি করতে করতে লাশের খাটের পুরোভাগে থেকে অগ্রসর হয় এবং গীর্জা ও মসজিদে গিয়ে জানাজা আদায় করে। জানাজা শেষ হলে মোয়াজ্জিন উঠে বলেন, “অমুক জ্ঞানী ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির জন্য প্রার্থনা করুন।” এই বলে মৃতকে গুণবাচক বিশেষণে ভূষিত করে প্রার্থনা সমাপন করার পরে কবরে সমাহিত করে।

ভারতে এর চেয়েও প্রশংসনীয়ভাবে মৃতকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর তৃতীয় দিবস ভোরে তারা গোরস্থানে জমায়েত হয়। সেখানে সুদৃশ্য কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয় এবং কবরের উপরেও দেওয়া হয় কাপড়ের আচ্ছাদন। কবর আবৃত করা হয় গোলাপ ও নানা রকম সুগন্ধি ফুলে। কারণ, ফুল সেখানে বারমাসেই পাওয়া যায়। তারা লেবুগাছ বা ঐ জাতীয় গাছ নিয়ে আসে এবং তখন গাছে ফল না থাকলে ফল এনে গাছে বেঁধে দেয়। শোকযাত্রীদের ছায়া দেবার জন্য মাথার উপরে থাকে চাঁদোয়া। কাজী, আমীর ও অন্যান্য পদস্থ ব্যক্তিরা এসে আসন গ্রহণ করেন। কোরআন পাঠের পর কাজী উঠে। মৃতের কথা বলে, তার মৃত্যুতে শোকপূর্ণ গাথায় তার জন্য শোক প্রকাশ করে সর্বশেষ মৃতের আত্মীয়দের সান্ত্বনা দিয়ে ও সুলতানের জন্য প্রার্থনা করে কর্তব্য সম্পাদন করে। যখন সুলতানের নামোচ্চারণ করা হয় তখন শ্রোতারা সবাই উঠে সুলতানের বাসস্থানের দিকে মাথা নোয়ায়। অতপর কাজী আসন গ্রহণ করলে কাজীর থেকে শুরু করে সবাইকে গোলাপ জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তারপর শরবত এনে প্রথমে কাজীকে এবং পরে সবাইকে বিতরণ করা হয়। সর্বশেষে দেওয়া হয় পান। পানকে তারা শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং সম্মানের চিহ্ন স্বরূপ মেহমানদের পান দেওয়া হয়। সুলতানের নিকট হতে অর্থ বা পোশাক-পরিচ্ছদের চেয়ে এনাম স্বরূপ পান পাওয়া অধিকতর সম্মানজনক। কোন ব্যক্তি এন্তেকাল করলে এ দিনের অনুষ্ঠান হবার পূর্বে তার পরিবারের কেউ পান খায় না। অনুষ্ঠানের পরে কাজী কয়েকটি পানপত্র গ্রহণ করে মৃতের ওয়ারীশদের হাতে দেন। অতঃপর শোকযাত্রীরা স্ব-স্ব গৃহে ফিরে যায়।

সে-বছরই শাওয়াল মাসের চন্দ্রোদয় হলে (১লা সেপ্টেম্বর ১৩২৬) হেজাজযাত্রী একটি কাফেলা দামেস্ক ত্যাগ করে। আমিও তাদের সঙ্গে যাত্রা করি (৬১)। বসরায় পৌঁছে কাফেলা সাধারণতঃ চার দিন অপেক্ষা করে। কোন জরুরী প্রয়োজনে কাফেলার কেউ দামেস্কে থাকলে এ সময়ের ভেতর বসরায় এসে দলে ভিড়তে পারে। এখান থেকে তারা যায় জিঞ্জার জলাশয়ে। সেখানে একদিন কাটিয়ে আল-লাজুন হয়ে কারাক দূর্গে যায়। কারাক দূর্গকে The castle of the Raven বলা হয়। এটি অতি বিস্ময়কর ও দুর্ভেদ্য ঘোট দূর্গগুলির একটি। চতুর্দিক নদী দ্বারা বেষ্টিত এ দূর্গের প্রবেশ পথ একটি মাত্র। তাও ক্ষুদ্র পাহাড়ে সমাচ্ছন্ন। বিপদের সময় আশ্রয়স্থল হিসেবে সুলতানরা এ দূর্গটি ব্যবহার করে থাকেন। সালার সর্বময় ক্ষমতা দখল করলে সুলতান আন-নাসির এ দূর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কারাকের বাইরে আ-থানিয়া নামক স্থানে কাফেলা চারদিন অবস্থান করে এবং মরুপথে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে আমরা সিরিয়ার শেষ শহর মা-আন্ পৌঁছি। পরে আকাবাত-আস সাওয়ান হয়ে মরুভূমিতে প্রবেশ করি। এ মরুভূমি সম্বন্ধে কথিত হয় : “যে এখানে প্রবেশ করে সে হারিয়ে যায়, যে মরুভূমি থেকে বেরিয়ে আসে সে নবজন্ম লাভ করে।” দুদিন পথ চলার পর আমরা দাহূত হজ এসে পৌঁছলাম। এখানে অন্তঃসলিলা জলাশয় আছে কিন্তু মানুষের বসতি নেই।(৬২) সেখান থেকে এলাম ওয়াদিবদা। (এখানে পানি নেই। তারপরে এলাম তাবুক। আমাদের পয়গম্বর (সাঃ) একবার তাবুক অভিযান করেন। সিরিয়ার হজযাত্রীদের ভেতর একটি রীতি প্রচলিত আছে। তাবুকের শিবিরে পৌঁছে তারা নিজ নিজ অস্ত্র বের করে এবং মুক্ত তরবারী দিয়ে হাতের তালুতে আঘাত করতে করতে বলতে থাকে, “আমাদের রসুলুল্লাহ্ এভাবে এখানে প্রবেশ করেছেন?”

তাঁবুকে পৌঁছে কাফেলা চারদিন বিশ্রাম করে। এ সময়ে তারা তাবুক ও আল উলার মধ্যবর্তী ভয়াবহ মরুপথের জন্য উটের ও নিজেদের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করে নেয়। পানি সরবরাহকারী ভিস্তিরা ঝরণার কাছে বাস করে। মহিষের চামড়ায়। তৈরি আধারে তারা পানি সরবরাহ করে এবং চামড়ার পানিপাত্র বোঝাই করে দেয়। আমীর ও অন্যান্য পদস্থ ব্যক্তিদের নিজস্ব পানির আধার আছে। অপর ব্যক্তিরা নিজেদের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট মূল্যে পানি ক্রয় করে নেয়।

এ মরুপথটির ভয়ে তাবুক ত্যাগের পর কাফেলা রাতদিন দ্রুত চলতে থাকে। অর্ধপথ অতিক্রমের পর আল-উখায়দির উপত্যকায় পৌঁছা যায়। একে দোজখের উপত্যকা বলা চলে (আল্লাহ্ এর থেকে আমাদের রক্ষা করুন (৬৩))। এক বছর সাইমুমের কবলে তীর্থযাত্রীরা এখানে ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন হয়। পানি শুকিয়ে যায় এবং একবারমাত্র পানের উপযোগী পানির মূল্য হাজার দিনারে পৌঁছে। কিন্তু অতঃপর ক্রেতা। ও বিক্রেতা উভয়ই ধ্বংসের কবলে পতিত হয়। এ উপত্যকায় একটি প্রস্তরখণ্ডে তাদের কাহিনী খোদিত আছে।

তাঁবুক থেকে যাত্রার পাঁচদিন পরে কাফেলা আল-হিজর কূপের কাছে পৌঁছে। আল-হিজর কূপে প্রচুর পানি আছে কিন্তু কেউ তা তুলে ব্যবহার করে না। তাবুক অভিযানের সময় পয়গম্বর (সাঃ) এখান দিয়া গমন করেন এবং এ কূপের পানি পান করতে সঙ্গীদের বারণ করে দেন।(৬৪)

আল-হিজর থেকে (৬৫) অর্ধদিন বা তার চেয়ে কম সময় চলার পরে আল্-উলা পৌঁছা যায়। আল-উলা নামক মনোরম ও বৃহৎ এ গ্রামটিতে খেজুর বাগান ও পানির ঝরণা আছে। নিজেদের পরিধেয় বস্ত্রাদি ধৌতকরণ ও প্রয়োজনীয় খাদ্যাদি সংগ্রহের জন্য যাত্রীরা এখানে চার দিন অপেক্ষা করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য বা অপর কিছু। সঙ্গে থাকলে যাত্রীরা তা এখানে রেখে যায়। এ গ্রামের বাসিন্দারা সবাই বিশ্বস্ত। সিরিয়ার খ্রীস্টান ব্যবসায়ীগণ এ স্থান অবধি আসতে পারে এবং এর বেশী অগ্রসর হতে পারে না। তারা যাত্রীদের কাছে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যাদি বিক্রয় করে। আল্-উলা ত্যাগের তৃতীয় দিনে কাফেলা মদিনা শরিফের উপকণ্ঠে গিয়ে হাজির হয়।

সেই দিন বিকালেই আমরা পবিত্রস্থানে বিখ্যাত মসজিদে হাজির হলাম। শাস্তির দরজায় আমরা আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করে হজরতের (সাঃ) রওজা মোবারক ও পবিত্র মিম্বারের মধ্যবর্তী প্রসিদ্ধ ‘বাগানে’ প্রার্থনা করলাম। অতঃপর হজরত (সাঃ) যে খেজুর গাছটির পাশে দাঁড়িয়ে খোতবা পাঠ করতেন তার ধ্বংসাবশেষ শ্রদ্ধাভরে স্পর্শ করলাম।

এ যাত্রায় আমরা মদিনায় চারদিন অবস্থান করলাম। চার দিনই আমরা পবিত্র। মসজিদে রাত্রিযাপন করলাম। মসজিদের চত্বরে যাত্রীরা বহুসংখ্যক মোমবাতি জ্বেলে বৃত্তাকারে বসে পবিত্র কোরআন পাঠ করে, সুর করে দরুদ শরীফ পড়ে বা পবিত্র রওজা জেয়ারত করে।

অতঃপর মদিনা থেকে আমরা পবিত্র মক্কার পথে রওয়ানা হলাম। পাঁচ মাইল দূরে ধুনা-হুজায়ফা মসজিদে গিয়ে আমরা অবস্থান করলাম। এখানেই আমাদের পয়গম্বর। (সাঃ) হজের বস্ত্র পরিধান করেন এবং অন্যান্য বাধ্যবাধকতা পালন করেন। আমিও এখানে সেলাই করা বস্ত্রাদি ত্যাগ করে গোসল করলাম। পরে হজের জন্য নির্দিষ্ট বস্ত্র পরিধান করে নামাজ আদায় করে নিজেকে হজের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম। আমাদের যাত্রার চতুর্থ বিরতিস্থান হল বদর। এখানেই খোদা তার প্রিয় পয়গম্বরকে সাহায্য করেন। এবং নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন।(৬৬) বদর একটি গ্রাম। কয়েকটি খেজুর বাগান ও ঝরণা থেকে উৎসারিত একটি নহর এখানে আছে। এখান থেকে আমাদের পথ শুরু হয় ভয়াবহ বাজওয়া উপত্যকার মধ্য দিয়ে। বাজওয়া ছেড়ে তিন দিন চলার পর রাবিখ উপত্যকা। এখানে বৃষ্টির পানি জমে একটি পুকুরের সৃষ্টি হয় এবং অনেক দিন অবধি পানি থাকে। এখানে এসে মিসরের এবং আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের হজযাত্রীরা হজের বস্ত্র পরিধান করে। রাবিক ত্যাগের তিন দিন পরে আমরা খুলার জলাশয়ে পৌঁছি। সমতল ভূমিতে অবস্থিত খুলায় অনেক খেজুর বাগান আছে। আশেপাশের বেদুঈন অধিবাসীদের দ্বারা এখানে একটি বাজারের সৃষ্টি হয়েছে। বেদুঈনরা এখানে। ভেড়া, ফলমূল ও মসল্লাদি বিক্রয়ের জন্য আনে। এখান থেকে উসফান হয়ে আমরা মার-ভী(৬৭) নামক উপত্যকায় পৌঁছলাম। মার উপত্যকাটি বেশ উর্বর। এখানে বহু খেজুর বাগান ও একটি ঝরণা থেকে উৎসারিত নহর আছে। এখান থেকে সারা এলাকায় পানি সেচনের কাজ চলে। এ উপত্যকা থেকেই মক্কার পবিত্র তীর্থে হাজির হলাম। গন্তব্যস্থানে পৌঁছবার অদম্য আশায় ও আনন্দে তখন অন্তর আমাদের ভরপুর। ভোরে আমরা গিয়ে মক্কা শরীফ হাজির হলাম এবং তৎক্ষণাৎ পবিত্র কাবা গৃহে প্রবেশ করে হজের পালনীয় কর্তব্যাদি সম্পাদনে রত হলাম।(৬৮)

মক্কার বাসিন্দারা দুর্বল ও নিরীহদের প্রতি বিদেশীদের প্রতি আতিথ্য, দান, দয়া প্রভৃতি বহু সদগুণের জন্য প্রসিদ্ধ। তাদের কেউ কোন ভোজের আয়োজন করলে প্রথমেই অসহায় দরিদ্র ধর্মপ্রাণ লোকদের আহার করায়। এ সব হতভাগ্য লোকের অধিকাংশকে দেখতে পাওয়া যায় রুটীর দোকানের আশেপাশে। কেউ রুটী তৈরি করে নিয়ে যাবার সময় এরা তাকে অনুসরণ করে। সে কাউকে বঞ্চিত না করে নিজের রুটির কিছু অংশ এদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। যদি তার মাত্র একখানা রুটীও থাকে তবু সে তার অর্ধেক বা এক চতুর্থাংশ হাসিমুখে এদের হাতে তুলে দেয়। আরও একটি ভাল অভ্যাস এদের দেখেছি। এতিম ছেলেরা ছোট বড় দু’টি আঁকা নিয়ে বাজারে বসে থাকে। শহরের লোক বাজারে এসে শস্য, গোশত বা তরিতরকারী কিনে এদের একজনকে ডেকে এক ঝাঁকায় গোশত অপর ঝাঁকায় অন্যান্য জিনিস সাজিয়ে দেয়। ছেলেটি ঠিক ঠিক সেই জিনিসগুলি নিয়ে লোকটির গৃহে পৌঁছে দেয়। লোকটি নিজের কাজ সেরে গৃহে ফিরে এবং ইত্যবসরে তার আহার্য প্রস্তুত হয়ে থাকে। এ-কাজে এসব এতিমের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন একটি দৃষ্টান্তও নেই। এ জন্য তারা অতি সামান্য মজুরী পেয়ে থাকে।

আরবের পোশাক-পরিচ্ছদ সুরুচিপূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন। তারা সাধারণত শাদা বস্ত্র ব্যবহার করে যা সর্বদাই তুষারশুভ্র থাকতে দেখা যায়। আরবরা প্রচুর সুগন্ধদ্রব্য ও সুরমা এবং সর্বদা দাঁতন ব্যবহার করে। মক্কার নারীরাও অত্যন্ত সুন্দরী, ধর্মপরায়ণা ও স্র স্বভাবা। তারাও এত সুগন্ধদ্রব্য ব্যবহার করে যে তারা একটু আতর কিনবার পয়সা বাঁচাবার জন্য সারারাত অনাহারে কাটিয়ে দেয়। ভাল জামাকাপড় পরে প্রতি বৃহস্পতিবার রাত্রে তারা মসজিদে গমন করে। তখন তাদের আতরের গন্ধে সমস্ত পবিত্রস্থান মোহিত হয়ে যায়। এরা চলে যাবার পরেও সে স্থানে বহুক্ষণ সুগন্ধ থাকে।

যে সব ধর্মপ্রাণ তাপস তখন মক্কায় অবসর ধর্মজীবন যাপন করছিলেন তাদের ভেতর একজন ছিলেন আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। কখনো তানজিরে এলে তিনি আমাদের সঙ্গে বাস করতেন। দিনের বেলা তিনি মুজাফফরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করতেন এবং রাত্রিযাপন করতেন রাবি নামক স্থানে কর্মচারীদের একটি আশ্রয়স্থলে। মক্কার একটি প্রসিদ্ধ আশ্রয়স্থল রাবি। এ স্থানের নিকট এমন একটি কুয়া আছে যার পানির সঙ্গে মিষ্টতায় মক্কার অন্য কোন কুয়ার তুলনা চলে না। এখানকার অধিবাসীরা সবাই ধর্মপ্রাণ। ব্যক্তি। হেজাজের লোকেরা এ স্থানটিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং নেয়াজ দেয়। তাইফের লোকেরা এখানে ফল সরবরাহ করে। সেখানে প্রচলিত রীতি অনুসারে খেজুর, আঙ্গুর, পিচ প্রভৃতি ফলের বাগানের মালিকগণ উৎপন্ন ফলের কিছু অংশ নেয়াজ স্বরূপ। উটের পিঠে করে এখানে পৌঁছে দিয়ে যায়। তাইফ থেকে মক্কা দু’দিনের পথ। যদি কোন ব্যক্তি এখানে নেয়াজ দিতে কসুর করে তবে তার ফসলের ফলন পরের বছর কমে। যায়।

একদিন মক্কার শাসনকর্তার সহিসরা তাঁর ঘোড়াগুলি নিয়া এ আশ্রয়স্থলে আসে এবং উপরোক্ত কুয়ার পানি দ্বারা ঘোড়ার শরীর ধোয়ায় ও পানি খেতে দেয়। পরে ঘোড়া গুলি আস্তাবলে নিয়া গেলে তারা পেটের ব্যথায় মাটীতে মাথা ও পা আছড়াতে থাকে। শাসনকর্তা এ সংবাদ পেয়ে নিজে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের সেই আশ্রয়স্থলে যান এবং ক্ৰটী স্বীকার করে সেখানকার বাসিন্দাদের এক ব্যক্তিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি এসে স্বহস্তে ঘোড়াগুলির পেট মলে দেবার পরে তারা যতটুকু পানি খেয়েছিল তার সবই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। অতঃপর ঘোড়াগুলি সুস্থ হয়। এর পর কোন দিনও সহিসরা ভাল উদ্দেশ্য ছাড়া উক্ত স্থানে যায়নি।

***

টীকা
পরিচ্ছেদ ১

১। সৌর বৎসরের হিসাবে একুশ বছর চার মাস।

২। জিয়ানিদ বংশের প্রথম আবু তাশিফিনের রাজত্বকাল ১৩১৮হতে ১৩৪৮সাল অবধি। এ সময়ে তার রাজ্য আলজিয়ার্স অবধি বিস্তৃতি লাভ করেছিল। তিউনিসের সুলতানের বিরুদ্ধে। ১৩২৫ খ্রীষ্টব্দে আৰু তাশিফিন এক সংঘর্ষে অবতীর্ণ হন।

৩। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হতো। এসবের একটি ছিল, কোরাণের বিশেষ কোন আয়াত পাঠ করে স্বপ্নদেশের অপেক্ষা করা। আরেকটি প্রধা, কোরাণের কিছুটা অংশ পাঠ করে তার ভেতর থেকে ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণ করা। ইব্‌নে বতুতা প্রায়ই এ প্রথা অবলম্বন করতেন।

৪। আলজিয়ার্সের পশ্চাতে অবস্থিত উর্বরা সমতলভূমি।

৫। তখনকার দিনে ইরিকিয়া(তিউনিস) রাজ্যের সীমান্ত জেলা।

৬। একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কোন একজন বিদ্রোহী শাসনকর্তাকে শাস্তি দিবার জন্য মিশরের ফাতেমী বংশীয় খলিফা যাযাবর আরবদের প্রেরণ করেন। সে সময় আরব সৈন্যের দ্বারা তিউনিসিয়া ও আলজিরিয়ার পূর্বাঞ্চল বিধ্বস্ত হয়। সে আক্রমণের মুখে শুধু প্রাচীর বেষ্টিত নগরগুলির জান ও মাল রক্ষা পায়।

৭। মোড়শ শতাব্দীতে হাফসি বংশের আমলে তিউনিসিয়া ছিল উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল এবং বহু মুর পরিবার স্পেন থেকে সেখানে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল।

৮। রমজান মাসের রোজার পরে যে উৎসব বা পর্ব উদযাপিত হয় প্রাচ্য দেশে তাকে ঈদ উল-ফিতর বা বাইরাম বলে। ৭২৫ খ্রীস্টাব্দে এ পর্ব উদযাপিত হয় ৯ই সেপ্টেম্বর। এই পর্বদিনের নামাজ আদায় করা হয় প্রাচীরের বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে। সে স্থানকে বলা হয় ‘মুসাল্লা’। এ সময় নতুন পোষাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারের রীতি প্রচলিত আছে।

৯। উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার তখন প্রসিদ্ধ পবিত্রস্থান ছিল কায়রাওয়ান। আভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য এ দলটি সেখানে যেতে পারেনি।

১০। আলেকজেন্দ্রিয়ার চারটি প্রবেশপথের নাম (পশ্চিম দ্বার, সমুদ্রদ্বার, সেটা দ্বার ও সবুজ দ্বার) সাম্প্রতিক কাল অবধি শহরের রাস্তার নাম হিসাবে বজায় ছিল। সম্ভবতঃ প্রাচ্যের একমাত্র শহর আলেকজেস্ক্রিয়া যেখানে ইব্‌নে বতুতার সম্মানার্থে তার নামে একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছিল।

১১। ফারোস ও শহরের মধ্যবর্তী দূরত্ব তিন মাইল নির্ধারণ করে ইব্‌নে বতুতা অতিশয়োক্তি করেছেন, যদিও ইদ্রিসি বলেছেন স্থল পথে আলোকগৃহ তিন মাইল এবং সমুদ্রপথে এক মাইল দূরে অবস্থিত। আল-ফাল-কাশান্দি নামক পরবর্তী একজন লেখক এ দূরত্ব এক মাইল বলে বর্ণনা করেছেন।

১২। ’পমপিস পিলার’ লাল পাথরের একটি স্ত। রোমানদের সময় প্রাচীন মন্দিরের জায়গায় এটি স্থাপিত হয়েছিল।

১৩। পীর দরবেশদের মধ্যে প্রচলিত ভাষায় পীর ভাই।

১৪। শেখের প্রতি সৌজন্য প্রকাশের জন্য বাক্যটি ব্যবহৃত হয়েছে।

১৫। এক প্রকার সামুদ্রিক মাছ। এর থেকে ইটালিয়ান ক্যাভিয়ার (bottargo) পাওয়া যায়।

১৬। ইব্‌নে বতুতা এখানে ভুল করেছেন। ১২৪৯-৫০ খ্রীষ্টাব্দে সেন্ট লুইর ক্রুসেড় অভিযানের পর ইজিপসিয়ান গবর্ণমেন্ট এ শহরটি ধ্বংস করেন ফ্রাঙ্কদের পুনরাধিকার অভিযান প্রতিরোধ করার জন্য।

১৭। মূলগ্রহের অলংকারপূর্ণ বর্ণনা হচ্ছে রচনার প্রাঞ্জল পদ্ধতির একটি দৃষ্টান্ত (এখানে সেটা যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত)। এ রচনা সুষম এবং ছন্দো বদ্ধ বাক্যে গঠিত হয়েছে। গ্রহের অধিকাংশ স্থলে এ রকম রচনা পরিদৃশ্যমান। সম্ভবতঃ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভক্তি এবং বিস্ময়ের ভাব জ্ঞাপন করা। কিন্তু এ সব কেবল বাগাড়ম্বর নয়। ইটালিয়ান ফ্রেস্কোবাডি এই শেষ উক্তিটির সত্যতা প্রমাণ করেছেন। ১৩৮৪ খ্রীষ্টাব্দে কায়রো ভ্রমণ কালে তিনি মন্তব্য করেন যে বাসঘরের অভাবে রাত্রিকালে হাজার হাজার লোক নগরের বাইরে শুইত। ১৩৪৮ এবং ১৩৮১ খ্রিষ্টাব্দের দুটি মহামারীর ধ্বংসলীলাও এর অন্যতম কারণ।

১৮। আর-রাওদা,এখন এটা রোডা দ্বীপ। রোজার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য-সচরাচর উল্লেখিত হয়েছে। এবং আরব্য উপন্যাসেও এর উল্লেখ দেখা যায়।

১৯। এই জাঁকজমকশালী হাসপাতালটির কেবল সম্মুখের দৃশ্য, প্রবেশ কক (মিনারসহ) এবং কতকগুলি খণ্ডাংশ অবশিষ্ট রয়েছে। এটা নির্মিত হয়েছিল ১২৭৯-৯০ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান কালাউন কর্তৃক। সুলতানের সমাধি-স্তম্ভ মধ্যযুগের সারাসিন স্থপতিশিল্প এবং অলংকারের অন্যতম উৎকৃষ্ট মনুমেন্ট, বর্তমানে অংশতঃ সংস্কার করা হয়েছে। রাস্তার কিছুটা অংশে এখনো পুরানো নাম “দুই প্রসাদের মাঝখানে” বজায় রয়েছে। সম্ভবতঃ এ নামটি এসেছে দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে এ অঞ্চলে নির্মিত ফাতেমি প্রাসাদরাজী থেকে।

২০। প্রধান কারাফা অবস্থিত রয়েছে আধুনিক কায়রোর দক্ষিণে পুরাতন কায়রো এবং মিউকাটাম পাহাড় শ্রেণীর মাঝখানে। পরিসর এবং পরিদৃষ্টির দিক দিয়ে এটা দেখতে শহরের অনুরূপ-এটা হয়ে উঠেছে এখানে উল্লেখিত কবরের উপর নির্মিত অট্টালিকা, কক্ষ, এবং গৃহরাজীর অদ্ভুত রকমের মিশরীয় প্রথা বশতঃ।

২১। ১৪ই শাবানের (হিজরী বছরের অষ্টম সাল) পরের রাতে সমস্ত মসজিদে বিশেষ উপাসনা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর ঐতিহ্যগত কারণ হচ্ছে এই যে “বেহেশতে যে লটু বৃক্ষ বা। ভাগ্য-বিটপী রয়েছে এবং যার পাতায় লেখা সমস্ত জীবিত ব্যক্তির নাম সে রাতে সে বৃক্ষের পাতাগুলি কেঁপে উঠে এবং পরবর্তী বছরে যে পাতায় যে ব্যক্তির পূর্ব নির্দিষ্ট মৃত্যু লেখা রয়েছে সেটা ম্লান হয়ে ঝড়ে পড়ে মাটিতে।” (মিচেল কপটিক্ বছর ১৬১৭ খ্রীস্টাব্দের জন্য মিশরীয় ক্যালেণ্ডার ১৯০০-১৯০১ খৃষ্ট-পরাব্দ)।

২২। আল-হোসাইন খলিফা আলীর কনিষ্ঠ পুত্র এবং পয়গম্বরের দৌহিত্র। হোসাইন তার অধিকাংশ পরিজন পরিবারসহ নিহত হয়েছিলেন ইরাকের অন্তগর্ত কারবালায়। এ ঘটনা। ঘটেছিল ৬৮১ খ্রীষ্টাব্দে যখন দামেস্কের উমিয়া বংশের খলিফার বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন। এ ভাবে পয়গম্বরের দৌহিত্রের মৃত্যুর উমিয়া বংশের বিরুদ্ধে বিরাগ উৎপন্ন করেছিল এবং অদ্যাবধি সুন্নী এবং শিয়া সম্প্রদায় উভয়ে ১০ মহরম তারিখে সেই মৃত্যুর বাৎসরিক অনুষ্ঠান উদযাপন করেন। সৈয়দানা হোসেনের মসৃজিদ( সুলতান হাসানের অধিকতর প্রসিদ্ধ কলেজ মসজিদ থেকে এটা ভিন্ন। কলেজ মসজিদ তখনও তৈরি হয়নি) একটি চিত্তাকর্ষক সৌধ। এটা নগরের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত।

২৩। “সুদানিজ নাইল” অর্থাৎ নাইজারের বিপরীত রূপে এরূপ বলা হয়।

২৪। এ বিভাগ অন্য আরব ভূগোলজ্ঞদের মধ্যে দেখা যায়। তৃতীয় শাখাঁটি খুব সম্ভব হয়। আইবিয়ার (থারমুটিয়াক) শাখা যা লেক বার এবং বাইরে সেবেনিটিকের মোহনার ভিতর। দিয়ে কিম্বা লেক সেনজালে প্রবাহিত টানাইটিক শাখা।

২৫। এ নাম দেওয়া হয়েছিল পুরাকালীন মিশরীয় মন্দিরগুলিকে। পিরামিডের ন্যায় এদের চারদিক ঘিরে রচিত হয়েছিল বহু কাল্পনিক কাহিনী। সাধারণের মতে এদের নির্মাতা বলে ‘প্রাচীন’ হাসিসের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। একে যুক্ত করা হয়েছিল এনকের সঙ্গে। পিরামিড ব্যতীত মিশরে ইব্‌নে বতুতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল মনে হয় অন্য একটি পুরনো কীর্তি। সেটা আইখমিমের মন্দির।

২৬। এটা উল্লেখযোগ্য যে আমাদের পর্যটক লাসরের মন্দিরগুলি সম্বন্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি যদিও আবুল হাজ্জাজের সমাধি (একজন প্রসিদ্ধ আওলিয়া, এখানে এন্তেকাল করেন ১২৪৪ খ্রীস্টাব্দে) প্রকৃতপক্ষে অবস্থিত আম্মানের মন্দিরের শরহদ্দের মধ্যে।

২৭। বারো, তেরো, এবং চৌদ্দ শতাব্দীতে আইধা ছিল ইয়েমেন এবং ভারতীয় বানিজ্যের শেষ বন্দর, এবং স্থানটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৪২২ খ্রীষ্টাব্দে মিশরীয় সুলতান। কর্তৃক ধ্বংস হলে ওর স্থান দখল করে প্রতিদ্বন্দ্বী বন্দর সুয়াকি। এর ধ্বংসাবশেষ সনাক্ত করা হয়েছে লোহিত সাগর উপকূলের একটি পানিশূন্য সমতল টিবিতে। এটা হ্যলেব থেকে ১২ মাইল উত্তরে ২২.২০ উত্তরে, ৩৬.৩২পূর্বে। (জিওগ্রাফিকাল জার্ণাল ৬৮ (১৯২৬) এ সি, ডব্লিও সুরে দেখিয়েছেন ২৩৫-৪০, পৃষ্ঠায় যেখানে দ্রাঘিমা দেওয়া হয়েছে ৩৬”৯৩২”। কিন্তু ম্যাপের সঙ্গে এর সঙ্গতি নেই)।

২৮। হুড্রবিজগন আরব ছিলেন, বেজাজ নন।

২৯। একটি পান্থনিবাস (ফানডাক, খান কিম্বা কারাওয়ানসারি) সাধারণতঃ একটি চৌকোণ প্রাচীর ঘেরা দালান, মাঝখানে প্রাঙ্গণ। মালপত্র এবং পশুগণের স্থান দেওয়া হয় নীচের। তলায় এবং মুসাফিরগণকে উপরের তলায়। উপরের তলার অভাবে সবাই থাকে একত্রে।

৩০। এখন সিনাই মিলিটারী রেলওয়ের একটি স্টেশন, উত্তর কান্টারা থেকে প্রায় তিরিশ মাইল পূর্বে।

৩১। জ্বিন (জেনি) ফেরেশতার অধস্তন, কিছুটা মানুষের ন্যায় সৃষ্টি, তৈরি আগুন দিয়ে এবং এদের রয়েছে অলৌকিক ক্ষমতা। কোরাণ অনুসারে তারা সুলেমানের অধীন ছিল। “তিনি যা চাইতেন তাই ওরা সৃষ্টি করতে তাঁর জন্য-সুউচ্চ প্রাসাদ, প্রতিমূর্তি, পুকুরের মতো থালা, এবং বৃহৎ রান্নার পাতিল।”

গ্রন্থের পরবর্তী একস্থানে ইব্‌নে বতুতা উল্লেখ করেছেন যে জ্বিনদের সাহায্যে সুলেমান পার্মিরা পর্বত গড়েছিলেন। (তুলনা করুন বাইবেলের ১ কিংবা ৯,১৮)।

৩২। হেবরনের মসজিদ হচ্ছে ক্রুসেডারগণের একটি গিঁজা। এটা নির্মিত হয়েছিল আরো অধিক পুরাতন ভিত্তির উপরে( সম্ভবতঃ রোমানদেরও পূর্বে। এর কতকগুলি পাথরের উল্লেখ রয়েছে ইব্‌নে বতুতার বর্ণনায়। গুহাটি এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ধর্মপতি এবং তাদের স্ত্রীগণের স্মৃতি স্তম্ভগুলি এখনো ঘোট গির্জার প্রধান অংশের দুই ধারে অবস্থিত রয়েছে। জোসেফের অনুমিত সমাধি বাইরের অন্য একটি ছোট গির্জাতে রক্ষিত আছে। পয়গম্বর লুতের সমাধি কয়েক মাইল পূর্বে অবস্থিত।

৩৩। বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে হজরত মোহাম্মদের (ছঃ) রহস্যময় “নিশিথ ভ্রমণ” কি উর্ধ্বে আরোহণ” (মেয়ারাজ) সম্বন্ধে। এই আরোহণে তিনি আল্লার দিদার লাভ করেন। যদিও সে সময়ে তিনি বাস করছিলেন মক্কায়, তথাপি প্রবাদ অনুসারে তিনি প্রথমে গমন করেন দূরতম জেরুজালেমের মসজিদে(আল্ মসজিদ আল-আ) এবং সেখান থেকে আরোহণ করেন স্বর্গীয় ঘোটকী বোরাখে।

৩৪। বর্তমান প্রাচীর শ্রেণী নির্মিত হয়েছিল অটোম্যান সুলতান সুলেমান “ঐশ্বর্যবান” কর্তৃক। (১৫২০-১৫৬৬)।

৩৫। “রাজকীয়” কিউবিটের মাপ হচ্ছে ২৬ ইঞ্চি।

৩৬। এই রেলিং নির্মাণ করেছিলেন ফ্রাঙ্কগণ ক্রুসেডারদের জেরুজালেম অধিকারের সময়।

৩৭। এই স্বর্গারোহণ মসজিদটি অলিভ পর্বতের পুরোভাগে অবস্থিত। সেটা জেহোশাফাত উপত্যাকার দূরতর অংশে, হিম উপত্যকায় (জেহেনা) নয়।

৩৮। এখানে মনে হয় জেরুজালেম এবং বেথলহেমের মধ্যে একটি গোলমাল ঘটে গেছে। বেথলহেমের নেটিভিটি গির্জার গহ্বরে রয়েছে মেঙ্গার এবং জন্মস্থানের মন্দির।

৩৯। আজালুন, এখন কালাত আর-রাবাদ, ঘোরের পূর্ব শৈল শিবার একটি প্রদর্শনীয় দুর্গ ছিল (জর্ডান উপত্যাকায়), জেরাসের ১২ মাইল উত্তর পশ্চিমে।

৪০। ইব্‌নে বতুতা সিরিয়ার বিন্নি তিনটি পর্যটন জড়িয়ে ফেলেছেন।

৪১। জাহালার নিকটবর্তী একটি গ্রাম। এখানে নুহ পয়গম্বরের সমাদি আছে বলে পূর্বে খ্যাত ছিল। চৌদ্দ শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত এ স্থানে বাকার (কয়েলি-সিরিয়া) তলদেশ ঢাকা ছিল একটি হ্রদে বা জলাভূমিতে। একটা প্রবাদ ছিল যে হজরত নুহের কিস্তি জাহালার বিপরীত দিকে দক্ষিণ পূর্বে আন্জারে এসে থেমেছিল।

৪২। ত্রিপলি পূর্ণ উদ্ধার করছিলেন সুলতান কালাউন ১২৮৯ খ্রীস্টাব্দে।

৪৩। অনুরূপ গল্প প্রচলিত ছিল দফতরদার মোহাম্মদ সম্বন্ধে ১৮২১ খ্রীস্টাব্দে কর্দোফানে তুর্কি-মিশরীয় অভিযান কালে। একজন সৈনিকের বিরুদ্ধে একটি স্ত্রীলোক অভিযোগ করেছিল। সেনাপতি এই শর্তে সৈনিকের পেট কেটেছিলেন যে তার পাকস্থলী থেকে যদি দুধ না বের হয় তাহলে স্ত্রীলোকটিকেও কাটা হবে। (জার্ণাল অব দি আফ্রিকান সোসাইটি নম্বর ৯৮,জানুয়ারী ১৯২৬, ১৭০ পৃষ্ঠা)।

৪৪। “দশ” ছিলেন হজরত মোহাম্মদের (ছঃ) বিশিষ্ট সহচর বর্গের সদস্য এবং ধর্মপরায়ণ মুসলিমদের বিশেষ ভক্তিভাজন। অন্যদিকে শিয়াগণ এদের দেখতেন যেমন ক্রিশ্চানগণ দেখে থাকেন জুডা ইস্কারিকে। এদের বিশেষ বিদ্বেষ হচ্ছে হজরত ওমরের প্রতি। কেন না তিনি প্রথম এবং নিজেকে দ্বিতীয় খলিফা মনোনয়নের ব্যাপারে দায়ী ছিলেন। হজরত ওমরকে তারা আরো দোষী করেন যে তিনি হজরত আলীকে পয়গম্বরের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন(সমস্ত ঐতিহাসিক যুক্তির বিরুদ্ধে তারা এই উত্তরাধিকার ঘোষণা করে থাকেন)।

৪৫। মূলগ্রন্থের কতকগুলি পৃষ্ঠা ব্যাপি সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে আলেপ্পোর বিষয়–প্রধানতঃ ইব্‌নে জুবিয়ার থেকে গদ্যাংশের উধৃতি রয়েছে এতে-এবং প্রসিদ্ধ কবিগণ কর্তৃক রচিত নগরের প্রশংসামূলক কবিতা থেকে সংক্ষিপ্ত সারাংশ।

৪৬। টিজিন অবস্থিত রয়েছে আলেপ্পোর ২৮ মাইল পশ্চিমে।

৪৭। ১২৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ইউলের মার্কো পলোতে নগরের ধ্বংস বিবরণ সম্বলিত বুমাণ্ডের কাছে লিখিত তার পত্র দেখুন। (মার্কোপলো, ৩য় সংস্করণ কডিয়ার সম্পাদিত) ১, ২৪ টীকা।

৪৮। পেগ্রের দূর্গ। ক্রুসেডারগণ এটাকে বলতেন গ্যাষ্টন কিম্বা গ্যাষ্টিন। আলেকজাটো এবং এন্টিরকের মধ্যস্থিত বেলেন গিরিপথের ভেতর দিয়ে যে প্রবেশ পথ সেটাকে এখানে প্রতিরোধ করা হয়েছিল। ১১৮৮ খ্রীষ্টাব্দে সালাউদ্দীন এটা পুনরাধিকার করেছিলেন।

৪৯। ইউরোপে ঘাতক বলে সুপরিচিত। তারা ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের ফাতেমি শাখার একটি উপ-শাখা সম্প্রদায়। এর প্রতিষ্ঠা একাদশ শতাব্দীতে।

৫০। প্রসিদ্ধ আওলিয়া ইব্রাহিম ইব্‌নে আহামের জন্ম বালুখে। ৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে গ্রিকদের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযানের কালে তার মৃত্যু হয়েছে বলে কথিত। তাঁর জীবন সম্বন্ধে খুব অল্প বিবরণই পাওয়া যায়। কেবল এ টুকুই জানা যায় যে সিরিয়া ছিল তার ধর্মীয় কাজের প্রধান কেন্দ্র। অতঃপর সূফি কাহিনীর বিভিন্ন কালচক্রে তিনি হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় আদর্শ–স্পষ্টতঃ এ সব কাহিনী নেওয়া হয়েছে বুদ্ধের প্রাচীন উপাখ্যান থেকে।

৫১। পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদের জামাতা এবং চাচাতো ভাই, এবং শিয়াদের মতবাদের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

৫২। এখানে ইনে জুবের থেকে একটি সুদীর্ঘ ছন্দোবদ্ধ গদ্যের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। এ সব অংশে যে আলংকারিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে পাঠকগণ যাতে তা উপভোগ করতে পারেন সেজন্য প্রথম কতকগুলি বাক্যের এরূপ আক্ষরিক অনুবাদ দেওয়া যেতে পারেঃ ‘দামাকা হচ্ছে প্রাচ্যের বেহেশত; এবং তার উজ্জ্বল আলোকের উদয়-স্থান; ইস্লাম জগতের শিলমোহর, আমরা উপভোগ করেছি এর আতিথ্য আর এ হচ্ছে সমস্ত নগরীর দুহিন, আমরা তার ঘোমটা উন্মোচন করেছি। সে সজ্জিত হয়েছে সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত উদ্ভিদের পুস্পরাশি দিয়ে–এবং দাঁড়িয়েছে সুশোভিত বাগিচার মাঝখানে, মনোহর স্থানের মধ্যে সে জুড়ে রয়েছে একটি সুউচ্চ স্থান এবং অতি অপূর্ব সাজে সজ্জিতা রয়েছে তার নব-বধুর আসনে।” সম্পাদক কর্তৃক ইব্‌নে বতুতার বিবরণ শুরু হওয়ার পূর্বে অন্যান্য অনেকগুলি উদ্ধৃতির অবতারণা করা হয়েছে।

৫৩। এটা একটা সাধারণ প্রবাদ। এর উদ্দেশ্য এই দেখানো যে আরবদের দ্বারা দামাস্কা জয় করার সত্তর বছর অতিবাহিত হওয়ার আগে পর্যন্ত সে জন্ গিজা একটি মসজিদে পরিণত হয়নি। গির্জাটি ধ্বংস করা হয়নি, কেবল এর ক্রিশ্চান সাজসজ্জা বদল করে তাকে একটি মসৃজিদের যোগ্য করা হয়েছিল। ইব্‌নে বতুতা মসৃজিদটির যে বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে যান সেটা তিনি দিয়েছেন তার সময়ে যে রূপ দেখেছিলেন সেইরূপে। এ মসজিদটি তৈমুরলংয়ের দামাস্ কাস্ দখলের সময় আগুনে নষ্ট হয়ে যায় ১৪০০ খৃষ্টাব্দে। তারপর একাধিকবারের বেশী পুণঃ নির্মিত হয়েছে। বর্তমান নির্মাণ কার্যটি মাত্র ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দের এবং তিনটি সুন্দর মিনার ব্যতীত এর পূর্বের সৌন্দর্যের খুব স্বল্প নির্দশনই অবশিষ্ট রয়েছে।

৫৪। উন্মিয়া বংশের খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা। এ বংশের খলিফাগণ ৬৬০ থেকে ৭৪৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। আব্বাসিয়া বংশ কর্তৃক পরাজিত হয়। এরা রাজধানী স্থাপন করেন বাগবাদে। তাম্রকরদের বাজার এখনো একই অবস্থায় রয়েছে–কিন্তু বর্তমানে এটা দামাস্কাসের অন্যতম সুন্দর শিল্প কোনক্রমেই নয়।

৫৫। মূলতঃ এটা ছিল একটি যান্ত্রিক জল-ঘড়ি। ১১৮৪ খৃষ্টাব্দে জুবের যখন দামাসকাসে আসেন তখনো এটা কার্যকারী ছিল (লা ট্রেঞ্জের মুসলিম অধীনে প্যালেষ্টাইন, ২৫০ পৃষ্ঠা। দেখুন)। কিন্তু তারপর সেটা বেমেরামত পড়ে থাকে। সুরঙ্গ পথগুলি যদিও অনেক দিন হলো অদৃশ্য, তবু উৎসারিত নিৰ্কর (বাইজান্টাইন যুগের একটি নিদর্শন) এখনও বর্তমান রয়েছে।

৫৬। যেমন এটা গোড়া ধার্মিকদের মতের বিপরীত যে মানুষের কোনো কার্য কিংবা গুণের সঙ্গে আল্লার কোনো কাজের কিম্বা গুণের তুলনা হয় না। চারটি রক্ষণশীল গোঁড়া মতাবলম্বীদের মধ্যে হাম্বলি মত (উপক্রমণিকা, ২৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য) অন্য মতগুলির যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা সমর্থন করে না।

৫৭। রেশমের পোশাক পরা মুসলিম শরীয়তের বিরোধী।

৫৮। ইব্‌নে তেমিয়া সম্বন্ধে। ১৩২৮ খৃষ্টাব্দে এর মৃত্যু হয়। ভূমিকা দ্রষ্টব্য। যথেষ্ট ভক্তির সঙ্গে তাঁর নাম স্মরণ করা হয়। কেননা তিনি ছিলেন ওহাবী আন্দোলনের অগ্রদূত এবং ইসলামের অন্য সব আধুনিক সংস্কার আন্দোলনের সমর্থক।

৫৯। মুসলিমদের রোজা সূর্যোদয়ের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু সারাদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ উপবাস-এমন কি পানি গ্রহণও নিষিদ্ধ।

৬০। এ বৈশিষ্ট্যের জন্যই সম্ভবতঃ দামাসকাসের ডাক নাম হচ্ছে আল-মাতবাক’ অর্থাৎ রান্না ঘর।

৬১। তার স্ত্রী অথবা অন্যতম স্ত্রীকে পিছে ফেলে রেখে–যার সম্বন্ধে নিচে উল্লেখ করেছেন এই স্ত্রীর গর্ভে তার একটি ছেলে হয়েছিল, কিন্তু সে শিশুকালেই মারা যায়।

৬২। আকাবাত আস্-সোয়ান, এখন আকাবাত আল্-হিজাজিয়া, হিজাজ রেলওয়ের একটি স্টেশন। প্রফেসার অললাইজ মিউজিলের ম্যাপে এ স্থানটি ২৯.৫০ উত্তরে, ৩৫.৪৮ পূর্বে অবস্থিত।

ধাত্‌-আল-হজ্জ, একটি স্টেশন ২৯.০৫ উত্তরে ৩৬.০৮ পূর্বে অবস্থিত।

মিউজিল কর্তৃক বান্দাকে (উত্তর হেজাজ, ৩২৯পৃঃ) যুক্ত করা হয়েছে আল-বাওয়া উপত্যাকার সঙ্গে-এটা ধাত্ আল-হজ্জ থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং আল্ হাজম স্টেশনের সন্নিকট ২৮.৪১ উত্তরে, ৩৬.১৪ পূর্বে অবস্থিত।

৬৩। আল-ওখেদিরের বিরাম স্থান (আল্-আজার) উঁচু ঢালু বেষ্টিত গভীর উপত্যকায় অবস্থিত-স্থানে স্থানে লাভার দ্বারা ঢাকা। ইব্‌নে বতুতা একে সঙ্গতভাবেই নরক উপত্যাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন (মিউজিল,৩২৯)। আল-আখজার নামটি (ছোট সবুজ স্থান) স্পষ্টতঃ একটি ব্যঙ্গোক্তি–এটা ২৮.০৮ উত্তরে ৩৭.০১ পূর্বে অবস্থিত।

৬৪। অধার্মিক সামুদ জাতির কথা বার বার কোরাণে উল্লেখিত হয়েছে অবাধ্যতার জন্য এদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল। এটা সম্ভবতঃ উত্থাপিত হয়েছিল এ সব কবরের অস্তিত্ব থেকে যে গুলি ছিল সে সব প্রথম যুগের দক্ষিণ-আরবীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের যারা ইয়েমেন এবং সিরিয়ার বাজারের মাঝখানের ধারে বাসস্থান স্থাপন করেছিল-পরে পুরাতন উত্তর আরবীয় সামুদ জাতির সঙ্গে এদের জড়িত করা হয়েছিল।

৬৫। আলহিজর (মাদাইন্ সালি) থেকে আল্-ইলার দুরত্ব প্রায় ১৮ ইংরেজি মাইল। আল-হিজর ২৬.৪৯উত্তরে, ৩৭.৫৬ পূর্বে, আল্-ইলা ২৬.৩৬ উত্তরে, ৩৮.০৪ পূর্বে অবস্থিত।

৬৬। ৬৩৩ খ্রীষ্টাব্দে বদর যুদ্ধ পৌত্তলিক মক্কাবাসিগণ পরাজিত হন স্বল্পসংখ্যক আরব সৈন্যের কাছে। এটাই নব-প্রবর্তিত মুসলিম ধর্মের প্রথম কৃতকার্যতা। এবং মোহাম্মদের (দঃ) কর্মজীবনের অন্যতম সন্ধিকাল।

৬৭। আরবীয় ভৌগলিক হামদানীর মতানুসারে (১৮৪-৫) জুফার স্টেশন ছিল রাওহা থেকে ১০৩ আরবী মাইল দূরে-মদিনা থেকে এটা ছিল দ্বিতীয় স্টেশন এবং নগর থেকে ৪৭ মাইল দূরে। আরবীয় পরিমাপ ১৯২১ মিটার, ইংরেজি মাইলে ১৬০৯।

খুলেজ হচ্ছে আরবীয় ভৌগলিক ইয়াকুতের বর্ণনা অনুসারে মক্কা এবং মদিনার মাঝখানে অবস্থিত একটি সুরক্ষিত স্থান-মনে হয় পুরানো স্টেশন কুদেদের স্থান দখল করেছে। স্থানটি জুফা থেকে ২৪ মাইল। এবং উস্ফান পরবর্তী স্টেশন থেকে ২৩ মাইল।

উস্‌ফান এবং মার্‌ (কিম্বা মার্‌ আজ্‌-জুহ্‌রান) এখনও রয়েছে। পরবর্তীটি উস্‌ফান থেকে ২৩ মাইল এবং মক্কা থেকে ১৩ মাইল।

৬৮। মক্কা এবং তীর্থযাত্রার যে বিবরণ মুলগ্রন্থে রয়েছে তা ইব্‌নে জুবেরের থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে গৃহীত–এবং বার্টন কর্তৃক তার মা এবং মদিনার তীর্থযাত্রার ব্যক্তিগত বিবরণে টীকাসহ পুরা ব্যাখা করা হয়েছে। এর উপরে, তীর্থযাত্রার বিবরণ সম্বন্ধে এত বেশী ইংরেজী রচনা রয়েছে যে তার এখানে বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া অনাবশ্যক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *