২.১ বিএলএফ

পর্ব ২ মুজিববাহিনী

বিএলএফ

১৯৭০ সালের অক্টোবরের একদিন। রোজার ছুটি শুরু হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হচ্ছে না। কলাভবনের পূর্ব দিকের করিডরের পাশে। লাগোয়া দুটি কামরা। একটিতে ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব বসেন। অন্যটিতে বসেন সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখন। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সদস্যরা দুটি কামরায় সচরাচর আলাদা আলাদাভাবে বসে, আড্ডা দেয়। সিরাজুল আলম খানপন্থীরা জড়ো হন রবের কামরায়। অন্যরা তাঁদের ‘রব গ্রুপ’ হিসেবে ইতিমধ্যে ব্র্যাকেটবন্দী করে ফেলেছেন।

সকাল ১০টা-১১টা হবে। আমরা কয়েকজন বসে আছি সহসভাপতির কামরায়। এমন সময় ওখানে এলেন কাজী আরেফ আহমদ। হাতে একটা। প্যাকেট। প্যাকেট খুলে কিছু কাগজ বের করে আমাদের দিলেন। ফুলস্কেপ সাইজের তিন পৃষ্ঠার একটা দলিল। হাতে লেখা, সাইক্লোস্টাইল করা। শিরোনাম ‘জয় বাংলা। বুঝলাম, এটা একটা প্রচারপত্র।

আরেফ আমাদের ব্রিফ করলেন। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ সারা দেশে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন হবে। আমাদের বিভিন্ন কনস্টিটিউয়েন্সিতে গিয়ে নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার চালাতে হবে। একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার বক্তব্য কৌশলে তুলে ধরতে হবে, স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলা এবং এ লক্ষ্যে কিছু তরুণকে বাছাই করে একটা নেটওয়ার্কে নিয়ে আসতে হবে।

প্রচারপত্রটি হাতে মুড়ে নিয়ে এলাম মুহসীন হলে আমার কামরায়। হলের আবাসিক ছাত্ররা বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের। তারা অনেকেই চলে গেছেন। যার যার বাড়িতে। আমার স্বজনেরা সবাই ঢাকায় থাকেন। তাই বাড়ি যাওয়ার। তাড়া নেই। ধীরেসুস্থে বসে বসে প্রচারপত্রটি পড়লাম। এত দিন অন্যদের। সাহস আর বীরত্বের গল্পগাথা শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছি। এখন নিজেদেরই কাজটা করে দেখাতে হবে। প্রচারপত্রে আমাদের জন্য কিছু নির্দেশনা ছিল। এক জায়গায় বলা হয়েছে :

ক. জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও যেকোনো কারণে ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণীত না হলে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনই হবে পরবর্তী কর্মসূচি এবং পশ্চিমা শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর সঙ্গে সেখানেই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু।

খ. সে সংগ্রাম নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তীকালে অসহযোগ, ট্যাক্স বন্ধ, পণ্য বর্জন ইত্যাদি আন্দোলনে পরিণত হবে এবং আরও পরে রক্ত দেওয়া ও রক্ত নেওয়ার পর্যায়ে উপনীত হবে। সে জন্য প্রত্যেককে মানসিক ও দৈহিক দিক থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

গ. ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণীত হলেও বাংলা ও বাঙালির স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য অনুরূপভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

ঘ. পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত না হলে বাংলা ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ঘোষণা করা ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকবে না।

তত্ত্বের কচকচানি নেই, কোটেশন-কণ্টকিত বাণী নেই, ধোঁয়াশাপূর্ণ কথাবার্তা নেই। প্রতিটি বাক্য সরল, প্রাঞ্জল এবং সরাসরি মনের মধ্যে গেঁথে যায়। নির্বাচন হোক বা না হোক, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাক বা না পাক, লক্ষ্যটি পরিষ্কার। দেশ স্বাধীন করতে হবে। প্রচারপত্রের শেষ দুটি পরিচ্ছেদ মনে হলো শপথনামার মতো :

জাতীয় নেতার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা, সর্বোপরি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রত্যেক কর্মীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।

শত প্রতিবন্ধকতা, লোভ-লালসা, আত্মকলহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, জয় বাংলা একটি আদর্শ। ‘জয় বাংলা আমাদের মূল উৎস। জয় বাংলা আমাদের চলার পথের

শেষ প্রান্ত। জয় বাংলা। এই প্রচারপত্র নিয়ে ছাত্রলীগের অনেক সদস্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন। কোথাও একজন, কোথাও-বা একাধিক সংগঠক আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারের সমান্তরাল কাজ হিসেবে স্বাধীনতার বক্তব্য প্রচারের কাজে নিয়োজিত হন। কাজটি করতে হচ্ছিল খুবই কৌশলে এবং গোপনে। ছাত্রলীগের সিরাজপন্থীদের বাইরে এটি কারও জানা ছিল না। এমন একটি মিশনে সিরাজগঞ্জে গিয়েছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দুজন সহসম্পাদক–আ ফ ম মাহবুবুল হক ও বদিউল আলম। বদিউল তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :

‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই অস্বস্তিতে ছিলেন। অক্টোবরে (১৯৭০) আ ফ ম মাহবুবুল হক আর আমি গেছি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর নির্বাচনী এলাকায়। মাহবুব ভাই সিরিয়াস বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতার এক ফাঁকে মনসুর আলী সাহেব আমার পাঞ্জাবি ধরে টেনে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়ার ব্যাপারে মৃদু আপত্তি জানালেন। তাঁর চিন্তা হলো, এই স্লোগান দিলে ভোট কমে যাবে।

আরেকটা ইন্টারেস্টিং ঘটনার কথা বলি। আমরা গেছি বেলকুচি। এটা হলো মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের এলাকা। জায়গাটা মাদ্রাসায় ভরা। মওলানাকে জানালাম, আমরা এখানে নির্বাচনী প্রচার। চালাব, মিটিং-টিটিং করব। উনি সহজভাবেই বললেন, “তোমরা। তোমাদের কাজকর্ম করতে থাকো। সেখানে একটা মিটিংয়ে মাদ্রাসার অনেক মৌলভি হাজির হলো। জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে। সেখানে সিরিয়াস রিপারকেশন দেখা দিল। এটা হিন্দু স্লোগান, ভারতের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চক্রান্ত–এই সব কথাবার্তা। মওলানা তর্কবাগীশ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের পক্ষে কোরআন-হাদিস থেকে নানান উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, এটা একটা সঠিক স্লোগান। বাংলার উন্নতির জন্যই তো এটা বলা হচ্ছে। উপস্থিত মৌলভিরা মাথা নিচু করে শুনছিল। তর্কবাগীশ ভাবলেন, ওরা হয়তো কনভিন্সড হয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘সবাই আমার সঙ্গে স্লোগান ধরেন–জয় বাংলা।’ কেউ একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। সবাই চুপ। তখন তর্কবাগীশ বললেন, ঠিক আছে, আপনারা তো বাংলার জয় চান না। চলেন স্লোগান দিই–পরাজয় বাংলা। উপস্থিত হুজুররা খুবই অপ্রস্তুত হলো। তর্কবাগীশ বললেন, হয় জয় চাইবেন, না হলে পরাজয় চাইবেন।’ তখন সবাই খুব নিচু স্বরে বলল–জয় বাংলা। [১]

এর কয়েক দিন পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজের নামে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করা হয়। এর শিরোনাম ছিল ‘নির্বাচন–বাংলাদেশ ও ছাত্রসমাজ’। প্রচারপত্রে সরাসরি বলা হয়েছিল, বর্তমানে পশ্চিমা শোষণ হতে মুক্তি এবং ইতিহাস-স্বীকৃত বাঙালির বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই আজ ৭ কোটি মানুষ “বাংলাদেশ” গঠন ও বাঙালি জাতি সৃষ্টির জন্য উদ্যোগী।’

‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ভেতরে মতভিন্নতা ছিল। তরুণদের আবেগের ওপর ভর করে নৌকা ভাসিয়ে দেওয়া আর নৌকার পক্ষে ভোট পাওয়ার বিষয়টি এক করে দেখা যায়নি। তখন তরুণদের মধ্য থেকে সমাজতন্ত্রের পক্ষে জোরালো বক্তব্য উঠে আসছে। আওয়ামী লীগের অনেক রক্ষণশীল নেতা এটা পছন্দ করতেন না। তারা বড়জোর ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদ’-এর কথা বলতেন। এ প্রসঙ্গে কামরুদ্দীন আহমদের পর্যবেক্ষণ ছিল এ রকম:

নির্বাচন প্রচারণার প্রাক্কালে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের আধিপত্য ও জয়জয়কার প্রকাশিত হয়ে উঠেছিল। দেশবাসীর মুখে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিব ছাড়া যেন আর কথা ছিল না। সবাই শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা বলে মেনে নেয়। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগের এই ভরা জোয়ারের পূর্ণ লগ্নেও কিন্তু ভেতরে-ভেতরে চলছিল ভিন্ন প্রস্তুতি। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্র এবং যুব সম্প্রদায়ের অংশ কার্যসূচির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করতে ক্রমশ দ্বিধান্বিত হয়ে উঠছিল। সভা সমিতিতে তারা যেসব স্লোগান দিতে আরম্ভ করল, তা শেখ মুজিবের মনঃপূত হতো না। এগুলো ছিল সমাজতান্ত্রিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী স্লোগান। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি শেখ সাহেব নির্বাচনের সময় ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার জন্য বলেছিলেন। শেখ সাহেব নির্বাচনী প্রচারণায় এ ধরনের স্লোগান পছন্দ করতেন না। কিন্তু ছাত্র সম্প্রদায় তার সে অনুরোধ রক্ষা করেনি। শেখ সাহেব অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, জয় বাংলা, জয় সিন্ধু, জয় সীমান্ত প্রদেশ, জয় বেলুচিস্তান, জয় পাঞ্জাব এবং শেষ স্লোগান দিলেন জয় পাকিস্তান। এ ছাড়া অনেকগুলো সমাজতন্ত্রবাদী স্লোগানও শেখ সাহেবের সভায় দেওয়া হতো। অথচ শেখ মুজিব তখনো সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর আদর্শ ছিল নির্ভেজাল সংসদীয় গণতন্ত্র। ফলে দেখা যায়, তখনই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। [২]

.

শুরুতে ছিল ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট বা ইবিএলএফ। উনসত্তরের গণ আন্দোলনের পর ছাত্রলীগের তরুণদের একটা বড় অংশের চিন্তার মধ্যে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি আর জায়গা ছিল না। এ সময় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ বা ‘বিএলএফ’ শব্দটির চাউর হতে থাকে। সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘আমাদের রাজনৈতিক সংগঠন হলো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং সামরিক সংগঠন হলো বিএলএফ।

‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামটি ১৯৭২ সালের আগে অজানা ছিল। ১৯৭০ সালের গোড়া থেকেই এই প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়লেও আমি এ নাম শুনিনি। কিন্তু আমি শুনিনি বলেই এর অস্তিত্ব ছিল না, এমন উপসংহার টানা ঠিক হবে না। সিরাজুল আলম খানকে কেন্দ্র করে যে চক্রটি স্বাধীনতার পক্ষে গোপন প্রচার ও সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল, তিনি এটাকে বলেছেন নিউক্লিয়াস’। সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের তিনজন, অর্থাৎ আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমদ এবং পরে ১৯৬৮ সালের দিকে এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে যুক্ত হন মনিরুল ইসলাম। দেখতে একটু মোটাসোটা হওয়ার কারণে তাঁকে সবাই মার্শাল নামে ডাকতেন। মার্শাল মনি নামের আড়ালে তাঁর আসল নাম চাপা পড়ে গিয়েছিল। ১৯৭০ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে যে কমিটি নির্বাচিত হয়েছিল, তাতে তিনি পাঁচজন সহসভাপতির অন্যতম ছিলেন। নূরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন সভাপতি এবং শাজাহান সিরাজ ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। সহসভাপতিদের ক্রম অনুযায়ী এক নম্বরে ছিলেন সৈয়দ রেজাউর রহমান এবং দুই নম্বরে ছিলেন এস এম ইউসুফ। ছাত্রলীগের নেতৃত্বের কাঠামোয় মনিরুল ইসলাম তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও সিরাজুল আলম খানপন্থীদের কাছে তিনি ছিলেন চোখে পড়ার মতো। ওই সময় সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগকে সরাসরি দেখভাল করতেন না। তাঁর হয়ে এ কাজটি করতেন কাজী আরেফ আহমদ। বিশেষ করে ঢাকা শহরে। মনিরুল ইসলাম সব সময় কাজী আরেফের সঙ্গে পরামর্শ করেই ছাত্রলীগের ভেতরে কাজ করতেন। তাঁর কাজের প্রধান ক্ষেত্র ছিল উত্তরবঙ্গ, অর্থাৎ রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন এলাকা। আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন :

মহিউদ্দিন আহমদ : সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ বা পরিচয় কখন থেকে?

মনিরুল ইসলাম : ১৯৬৬ সাল থেকে। তখন আমি রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসি।

মহি : ‘নিউক্লিয়াস’ শব্দটির সঙ্গে কি আপনি পরিচিত ছিলেন?

মনিরুল : না। ওইভাবে নামটি শুনিনি। তবে একটা প্রক্রিয়া ছিল। তবে এই শব্দ তখন প্রচারে ছিল না।

মহি: এরপর তো এসে গেল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। এ নাম কি কখনো প্রচার পেয়েছে? এ নামে কি কোনো প্রচারপত্র বা পুস্তিকা দেখেছেন, শুনেছেন?

মনিরুল : ঠিক এই নামে কিছু ছিল বলে মনে পড়ছে না।

মহি : আমার মনে হয়, তাঁদের তিনজনের মনে মনে হয়তো এ ধরনের একটা ধারণা কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু এ নামে কোনো প্রচারপত্র আমি নিজে দেখিনি।

মনিরুল : হতে পারে। আমি জানি না।

মহি : ১৯৭০ সালের অক্টোবরে ‘জয় বাংলা’ শিরোনামে যে প্রচারপত্রটি আমাদের দেওয়া হলো, সেখানে কিন্তু স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামটি ছিল না। প্রচারপত্রে কোনো সংগঠনেরই নাম ছিল না। তবে আমরা জানতাম এটা আমাদের গ্রুপের গোপন প্রক্রিয়ার ফসল।

মনিরুল : ওই নাম ব্যবহার না করা হলেও স্বাধীনতার জন্যই এই প্রচার ছিল।

মহি: আমাকে আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, তাঁরা বিপ্লবী বাংলা নামে একটি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। হাতে লিখে, সাইক্লোস্টাইল করে এটা বিলি করা হতো। আপনি কি নিজের চোখে এটা দেখেছেন?

মনিরুল : না।

মহি : আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কারও কাছে বিপ্লবী বাংলার কোনো কপি পাইনি। ১৯৭০ সালে প্রচারিত ‘জয় বাংলা’ প্রচারপত্রের আগে এ ধরনের কোনো গোপন প্রচারপত্রও দেখিনি। হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু তার কোনো এভিডেন্স পাইনি।

মনিরুল : আমার যোগাযোগ বেশি ছিল কাজী সাহেবের (কাজী আরেফ আহমদ) সঙ্গে। তার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েই আমি কাজ করতাম। এর বেশি কিছু থাকলে, সেটা আমার জানা নেই। এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। [৪]

.

তিন সংগঠকের নিউক্লিয়াস থেকে চার সংগঠকের বিএলএফ। এটা হলো বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায়। এই পরিবর্তনের ফলে কাটা পড়লেন কাজী আরেফ আহমদ। যুক্ত হলেন শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদ। প্রকৃতপক্ষে কাজী আরেফ কখনোই শেখ মুজিবের হিসাবের মধ্যে ছিলেন না। সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য অনুযায়ী, শেখ মুজিবের সঙ্গে আরেফের কখনোই সরাসরি দেখা বা কথা হয়নি। [৫]

১৯৬৩ সালে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে সিরাজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। শেখ ফজলুল হক মনির ইচ্ছার বিরুদ্ধে এটি হয়েছিল। কাজী আরেফের নেতৃত্বে ঢাকা। নগর ছাত্রলীগের একটি অংশ তখন থেকেই সিরাজের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। আরেফ তখন থেকেই মনির চক্ষুশূল। ১৯৬৪ সালে আরেফ ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই কমিটির সহসভাপতিদের মধ্যে ছিলেন শেখ শহীদুল ইসলাম এবং মামুনুর রশীদ (পরে নাট্যকার)। আরেফ। কখনো শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাড়িতে যাননি। শেখ মনি থাকলে তিনি আওয়ামী লীগ অফিসেও যেতেন না। ঢাকা নগর ছাত্রলীগে আরেফের ভূমিকা ছিল অনেকটা গডফাদারের মতো। তিনি বিভিন্ন কলেজে কমিটি বানাতেন, ভাঙতেন, জোড়া লাগাতেন। অনেকের চোখে তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রকারী, ক্লিকমাস্টার।

বিএলএফের শীর্ষ নেতৃত্বে জায়গা না পেয়ে কাজী আরেফ আগের মতোই নিউক্লিয়াসের ত্রিভুজ নেতৃত্বের অংশ হয়ে থাকলেন। নিউক্লিয়াস ও বিএলএফ সমান্তরাল অবস্থানে থাকল। পরে তাঁকে বিএলএফের গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে প্রচার করেছেন স্বয়ং সিরাজুল আলম খান। আরেফ একাত্তরের জুনে কলকাতায় গিয়ে বিএলএফের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং প্রশিক্ষণ নেন। [৬]

বিএলএফের মাধ্যমে শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে যে রসায়নটি তৈরি হয়, তার পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিরাজুল আলম খান বলেন :

একদিন মুজিব ভাই আমাকে একা ডেকে কাঁধে হাত রেখে অনেক কথার মধ্যে বললেন, তোদের তো কাজ অনেক বেড়ে গেছে দেখছি। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তোদের লোক দরকার। আমি তাঁর এই কথাকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে বললাম, তাহলে তো অনেক ভালো হয়। আমি ভেবেছিলাম আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ, এম এ হান্নান, যদিও আমাদের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়, এই ধরনের কাউকে নিউক্লিয়াসের অন্তর্ভুক্ত করতে বলবেন। আমাকে অবাক বিস্ময়ে শুনতে হলো, ‘মনি-তোফায়েলকে নিয়ে কাজ করতে পারবি না?’ আমি আধা মিনিটের মতো নিশ্চুপ থেকে বললাম, রাজ্জাক আরেফের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।

সেদিনই গভীর রাতে আমরা তিনজন ইকবাল হলের মাঠে বসে বিষয়টি চার ঘণ্টা ধরে আলোচনা করে ‘হ্যাঁ’ সিদ্ধান্তে আসি। আমাদের মধ্যে একজন–আরেফ ভেটো দিয়েছিল। প্রায় চার ঘণ্টা লাগল ভেটো প্রত্যাহার করাতে। আরেফ শর্ত দিয়েছিল, তাকে যেন অন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়।

পরদিন রাজ্জাক আর আমি মুজিব ভাইয়ের কাছে গিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত জানালাম। এর পরদিন দুপুর ১২টায় আমাদের দুজনকে তাঁর বাসায় যেতে বললেন। আমরা গিয়ে দেখি মনি তোফায়েল উপস্থিত। আমাদের যাওয়ার পাঁচ মিনিট আগে ওরা গেছে। আমরা বারান্দায় বসলাম। মুজিব ভাই একতলার ড্রয়িংরুমে চারজনকেই আসতে বললেন। তিনি দুহাত দিয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘চারজন মিলে একসঙ্গে কাজ করবি।’ আমরাও খুশি হলাম। দুপুরের খাবার একসঙ্গেই খেলাম।

শেখ ফজলুল হক মনি তার কিছুদিন আগে জেল থেকে বেরিয়েছে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে বিদায় নিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে মনি ৭ জুন হরতালের সময় গ্রেপ্তার হয়। জেল থেকে বেরিয়ে জেলে যাওয়ার আগের ও পরের রাজনীতি এবং আন্দোলনের চেহারা ও কাজের হিসাব মেলাতে পারছিল না সে। আমার ও রাজ্জাকের অগোচরে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে তোফায়েলের ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ার মতো। অবিরাম আন্দোলনের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা তোফায়েল আহমেদের ডাকসুর নেতা হিসেবে যে বলিষ্ঠতা এবং তার আরও বেশি কাজ করার ইচ্ছা, তা আমাদের চোখে ধরা পড়েছে। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্প্রসারণ এবং নতুন চিন্তার যে বিকাশ ঘটছিল, তা মনি ও তোফায়েলের অগোচরে থাকল না। ইকবাল হলের মাঠে গোটা বিকেলটাই ঢাকা শহরের কর্মী-সংগঠকদের যাওয়া-আসা এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি মনি হয়তো পরে শুনেছে। কিন্তু তোফায়েল সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো বুঝতে পারত। [৭]

সিরাজুল আলম খানের দেওয়া তথ্য আমি যাচাই করেছি তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে। তিনি এই ভাষ্যের সঙ্গে একমত হলেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল এ রকম :

ইয়াহিয়ার মার্শাল লর মধ্যে ‘৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তখন স্বামীর সঙ্গে ইতালিতে ছিলেন। সেখান থেকে লন্ডনে গিয়ে পিতার সঙ্গে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু সেই সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ প্রতিনিধি ও বিশেষ সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সঙ্গে বৈঠক করেন এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ট্রেনিং ও অস্ত্র সহযোগিতার আশ্বাস মেলে। [৮]

তোফায়েল আহমেদের ভাষ্যের সঙ্গে আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্য অনেকটাই মিলে যায়। ১৯৮৩ সালের অক্টোবরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুর রাজ্জাক আমাকে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে মনি ভাই, সিরাজ ভাই, তোফায়েল ও আমি–আমাদের এই চারজনের বায়োডাটা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আবদুর রাজ্জাকের কথার সূত্র ধরে বলা যায়, ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে তাঁদের চারজন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছিল এবং আসন্ন রাজনৈতিক পালাবদলের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তোফায়েল আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন :

বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ফিরে এসে আমাদের চারজনকে প্রস্তুতি নিতে বলেন। ছাত্রলীগের তরুণদের মধ্যে বাছাই করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানোর কথা হয়। আমাদের বলা হলো, ২৪ জনের গ্রুপ করে পাঠানো হবে। এক গ্রুপ প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এলে আরেক গ্রুপ যাবে। এভাবে ট্রেনিং চলবে। পরে যখন দেখা গেল নির্বাচন হবে, তখন বিষয়টি স্থগিত করা হয়। কেননা, এ ধরনের ট্রেনিংয়ের কথা জানাজানি হয়ে গেলে নির্বাচন বানচাল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। [১০]

.

বিএলএফ নামটির সূত্রপাত কখন থেকে এবং চার যুবনেতা কবে থেকে একসঙ্গে কাজ শুরু করলেন, এটি জানতে আমি আগ্রহী ছিলাম। সিরাজুল আলম খান বলেছিলেন, শেখ মুজিব লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর তাঁরা একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। দিন-তারিখ তিনি উল্লেখ করেননি। এই ভাষ্য তোফায়েল আহমেদের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়। খটকা বাধে অন্য জায়গায়। ১৯৬৯ সালের শেষে বা ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে তারা চারজন যৌথভাবে কাজ করছিলেন বিএলএফের ব্যানারে। কিন্তু ছাত্রলীগের মধ্যে দুটি স্রোতোধারা তখনো বহমান। অর্থাৎ বিএলএফের কার্যক্রমের সমান্তরাল আরেকটি গ্রুপ তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ভালোভাবেই বজায় রেখেছিল, যেটি পরিচালিত হতো সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে। বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বললাম তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে। আমাদের কথোপকথন ছিল এ রকম :

মহিউদ্দিন আহমদ : বিএলএফ নামটি কখন আপনার নজরে এল, কখন শুনলেন?

তোফায়েল আহমেদ : আমার নজরে এসেছে ১৯৬৯ সালের পর। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স মানে কী? একটা মুক্তিযুদ্ধ করা। অন্যরা অন্য রকম বলতে পারে। আমি আমার কথা বলছি। অনেস্টলি বললে, আমি জেনেছি আফটার সিক্সটি নাইন।

মহি : এটা কি উনসত্তরের আন্দোলনের পরে?

তোফায়েল : হ্যাঁ।

মহি: বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ফিরে আসার পরে, নাকি যাওয়ার আগে?

তোফায়েল : উনি আসার পরে।

মহি : আমি বারবার প্রশ্ন করে জানতে চাচ্ছি। কেননা, ইতিহাস রাইট ট্রাকে নাই।

তোফায়েল : রাইট ট্র্যাকে নাই। যে যেভাবে বলে, নিজেকে বড় করে বলে। আমি কিন্তু ‘আমি’ দিয়ে বলি না। আমার মধ্যে আমিত্ব নাই। আমি হিস্টোরিক্যাল ফ্যাক্ট বলছি। আমি ডিসটর্ট করি না।

মহি: তাহলে ধরে নেব, সিক্সটি নাইনে বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর, ওখানে ওনার একটা কানেকশন হলো।

তোফায়েল : অ্যাকচুয়ালি আগরতলা মামলা হওয়ার পরে, বিশেষ করে ওনার মুক্তির পরই কিন্তু স্বাধীনতার কথা…আগে থেকেই তো আমরা স্লোগান দিচ্ছি, বাষট্টি সালেই ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ৬ দফার সময় ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা’, উনসত্তরে বলেছি ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো।’ আমরা কিন্তু ধাপে ধাপে এসেছি।

মহি: আপনাদের এই চারজনের টিম, এটা কি আপনারা নিজেরা নিজেরা হলেন, নাকি বঙ্গবন্ধুর এখানে কোনো রোল ছিল? কেননা, সিরাজ ভাই যেটা বলেছে….

তোফায়েল : কী বলেছে?

মহি: যেটা বলেছে, সেটা আপনার সঙ্গে ক্রস চেক করছি। ওনার ভাষ্য হলো, বঙ্গবন্ধু একদিন তাকে ডেকেছেন। বলেছেন, অনেক কাজ, তোদের তো আরও লোক দরকার। আমি দুইজন লোক দিব। সিরাজ ভাই ভেবেছে চিটাগাংয়ের এম এ আজিজ আর মান্নান সাহেবের কথা। পরদিন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখে মনি ভাই আর আপনি বসা। রাজ্জাক ভাই আর সিরাজ ভাই গিয়ে বসছে। আপনারা চারজন। বঙ্গবন্ধু আপনাদের ধরে বলেছে, তোরা একসঙ্গে কাজ করতে পারবি না? সিরাজ ভাই বললেন, পারব।

তোফায়েল : একদম অবাস্তব। মনি ভাই তো বড় নেতা ছিল। সিরাজ ভাইও বড় নেতা ছিল। রাজ্জাক ভাইও সেক্রেটারি ছিল। আমি নতুন হইলাম। আমি হলের ভিপি, ডাকসুর ভিপি, ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট।

একটা কথা বলি। সিরাজ ভাই আমাকে অনেক স্নেহ করতেন, আদর করতেন। আমাদের হলেই থাকতেন। তাহলে আমাকে উনি নিউক্লিয়াসে ইনফ্লুড করে নাই কেন? বলে নাই কেন? এত কিছু করছি। ওনার সঙ্গে। উনি আমাকে করে নাই কেন?

মহি : নিউক্লিয়াসের কথা তো আমি প্রথম শুনি রাজ্জাক ভাইয়ের কাছে, ১৯৮৩ সালে। উনিও তো বলেন তিনজনের নিউক্লিয়াসের। কথা?

তোফায়েল : আমি জানি না। মনি ভাইয়ের মতো নেতা, যিনি বাষট্টি সাল থেকে স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন, উনিও এক্সকুডেড, আমিও এক্সক্লডেড। রাজ্জাক ভাই, সিরাজ ভাই আর কাজী আরেফ–যাহোক, এটা নিয়ে আর আলাপ করতে চাই না।

মহি: আপনার ব্যাপারটা আমি বুঝি। আপনি লাইমলাইটে এসেছেন সিক্সটি নাইন মুভমেন্টের সময়।

তোফায়েল : একদম ঠিক কথা। [১১]

.

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ক্রমে তীব্রতর হয়। এটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা। এই ধারার আড়ালে আরেকটি প্রক্রিয়া চালু ছিল। এর নেতৃত্বে ছিলেন তফসিলি সম্প্রদায়ের নেতা চিত্তরঞ্জন সুতার এবং ডা. কালিদাস বৈদ্য। দুজনের বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানায়। চিত্তরঞ্জন সুতার বাটনাতলায় তার গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। তিনি ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদে নির্দল প্রার্থী হিসেবে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কালিদাস বৈদ্য ছিলেন একজন চিকিৎসক। তাঁর বাড়ি সামন্তগাতি গ্রামে। তিনি ঢাকার শাঁখারীবাজারে থাকতেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে দুজনেরই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লন্ডনে যান। আগরতলা মামলায় আটক থাকা অবস্থায় তার মামলা পরিচালনায় লন্ডনে বসবাসরত বাঙালিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারা বিখ্যাত আইনজীবী টমাস উইলিয়ামকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। শেখ মুজিব দৃশ্যত লন্ডনবাসী বাঙালিদের ধন্যবাদ দিতে এই সফরে যান। সেখানে তিনি যে নিপ বসে ছিলেন না, তোফায়েল আহমেদের বর্ণনায় তা কিছুটা উঠে এসেছে। তাঁর এই ইন্ডিয়া কানেকশন’ পরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবের লন্ডন সফর নিয়ে কালিদাস বৈদ্যের বয়ানটি চমকপ্রদ :

জেল থেকে মুক্তি পাবার কিছুদিন পরই একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মুজিব লন্ডনে যান। সেই বিশেষ উদ্দেশ্যটা কী, তা কেবল মুজিব নিজে, চিত্তবাবু ও আমি জানতাম। লন্ডনের কাজ সেরে ঢাকায় ফেরার দিনই আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। কারণ, তাঁর লন্ডন যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের কাছে তার ফলাফল ছিল আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সেদিন আমাকে দেখেই মুজিব খুশির মেজাজে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘খবর খুব ভালো। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।’ পরক্ষণেই আরও জোরে ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে বলে উঠলেন, কবিরাজ, উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বটে, কিন্তু গুজরাটে হিন্দুরা যেভাবে মুসলমানদের মারছে, তাতে এখানকার মুসলমানরাও যদি হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন পরিণতি কী হবে? (আমাকে বৈদ্য না বলে তিনি কবিরাজ বলতেন এবং সেই সময় ভারতের গুজরাটে হিন্দু-মুসলমান। দাঙ্গা চলছিল।) সে কথার কোনো জবাব দেওয়া আমার পক্ষে সেদিন সম্ভব হয়নি।…

আর পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। সংযত হলেন। আর চিত্তবাবুকে সত্বর ঢাকায় আসার জন্য জরুরি খবর পাঠাতে বললেন। আমার জরুরি খবর পেয়ে চিত্তবাবু ঢাকায় এলেন এবং মুজিবের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যাপারটা তাঁকে বিস্তারিতভাবে জানালাম। তারপর মুজিবের লন্ডন যাত্রার সাফল্য ও অন্যান্য বিষয়ে আমাদের আলোচনা হয়। তখন আমরা এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে মুজিবের লন্ডন সফর যেহেতু সফল হয়েছে, তাই তাঁর ব্যক্তিগত গুণাগুণের দিকে গুরুত্ব দেওয়াটা ঠিক হবে না। কারণ, আমাদের লক্ষ্য হলো পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা, মুজিবকে দিয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা ঘোষণা করানোটাই ছিল আমাদের প্রথম ও সর্বপ্রধান কাজ। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে তার মুখ দিয়ে একবার স্বাধীনতা ঘোষণা করাতে পারলে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হবেই হবে। কেউ তা রুখতে পারবে না।…

মুজিবের লন্ডন যাত্রার সফলতার ভিত্তিতে তার সঙ্গে বিশেষ। আলোচনার পরই তখন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশ্য কী কী আলোচনা সেদিন মুজিবের সঙ্গে হয়েছিল এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে কী কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা প্রকাশ করে বলা এখন সম্ভব নয়। তবে চিত্তবাবুর কলকাতা আসার সিদ্ধান্ত ওই দিন নেওয়া হয়। মুজিবের প্রতিনিধি হয়েই তিনি স্বাধীন পূর্ববঙ্গের জন্য গোপনে কাজ করেন।

আগেই বলেছি যে চিত্তবাবু ঢাকা থেকে অনেক দূরে বরিশালে তাঁর গ্রামের বাড়িতে থাকতেন এবং মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসতেন। আমি ঢাকা শহরেই বাস করতাম। তাই মুজিবকে জানার সুযোগ আমার ছিল অনেক বেশি। আমাদের মধ্যে বয়সের তফাত তেমন বেশি ছিল না। বড়জোর চার-পাঁচ বছরের ব্যবধান হবে। তাই বেশ সহজ-সরলভাবেই আমরা মেলামেশার সুযোগ পেয়েছি। দরকার মতো আমার গাড়িও তিনি ব্যবহার করতেন। কারণ, তখন আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী বা নেতার গাড়ি ছিল না। নেতাদের বেশির ভাগই ছিলেন ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট বা ইন্সপেক্টর।…

শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার বা চিত্তবাবুর কথাবার্তা হতো অত্যন্ত গোপনে। কারণ, আমাদের আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিপজ্জনক। তার স্ত্রীর সঙ্গেও চিত্তবাবু ও আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে তাঁর বাড়ি যাওয়ার আমার অবাধ সুযোগ ছিল। চিত্তবাবু ও আমার মধ্যে এই বোঝাপড়া হয়েছিল যে ঘটনা এমনভাবে ঘটিয়ে যেতে হবে, যাতে শেষ পর্যন্ত দেশের সাধারণ মানুষই চিৎকার করে বলতে থাকবে, আমরা পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা চাই। [১২]

১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে গঠন করা হয় জাতীয় গণমুক্তি দল। নতুন এই দলের সভাপতি হলেন মুনীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ডা. কালিদাস বৈদ্য সাধারণ সম্পাদক এবং অ্যাডভভাকেট মলয় রায় কোষাধ্যক্ষ। নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে থাকলেন চিত্তরঞ্জন সুতার। দলের ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে ছিল ‘অসাম্প্রদায়িক শাসনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন। স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে এই দল মুজিবের ৬ দফাঁকে পূর্ণ সমর্থন জানাল।’ দলের লক্ষ্য সম্পর্কে কালিদাস বৈদ্যের ভাষ্য হলো :

গণমুক্তি দলের ঘোষণাপত্রে স্বায়ত্তশাসনের দাবির আড়ালে স্বাধীন পূর্ববঙ্গ রাষ্ট্র গঠনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। তখন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই স্বাধীনতার কথা চিন্তা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তখন তাদের কাছে স্বাধীনতা ছিল কল্পনাতীত। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীনতার কথা বললে তখন সব রাজনৈতিক দলই তার বিরোধিতা করত। এমনকি আওয়ামী লীগের কাছেও তখন স্বাধীনতার কথা ছিল অবাস্তব। তখন প্রকাশ্যে স্বাধীনতার কথা বললে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই তার বিরোধিতা করত। এককালে ছয় দফা দাবিরও তারা বিরোধিতা করেছিল। কাজেই স্বাধীনতার কথা বললে তারা যে আরও প্রবলভাবে তার বিরোধিতা করত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার ব্যাপারে আমাদের যুক্তিগুলো ছিল অকাট্য এবং তা রূপায়ণের বিষয়ে আমরা ছিলাম নিশ্চিত। তাই গণমুক্তি দলের ঘোষণাপত্রে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে সাহসের সঙ্গে লেখা হয়েছিল, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির ২২ বছর পরও যদি সংখ্যালঘুদের ভিটামাটি ছাড়িয়া যাইতে বলা হয় তবে ন্যূনতম দায়িত্ব হিসাবে তাহাদের জন্য অন্য কোনো আস্তানার ব্যবস্থা করিয়াই তাহাদের যাইতে বলিতে হইবে। এই বক্তব্য সংখ্যালঘুদের জন্য পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে একটি হোমল্যান্ড গড়ার দাবির ইঙ্গিত ছাড়া আর কিছুই নয়। আর ইসলামিক পাকিস্তানের মধ্যে বসবাস করে এর থেকে স্পষ্ট ভাষায় এই দাবির। কথা বলা সম্ভব ছিল না।…

আমরা বুঝতে পারি মুজিবের মনে যা-ই থাকুক না কেন, বৃহত্তর। স্বার্থে তার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।…মুজিবেরও তখন প্রয়োজন ছিল সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার। তাই পারস্পরিক স্বার্থেই ক্রমে যোগাযোগ ঘনীভূত হয়।…গণমুক্তি দলের সমস্ত জনসভায় মুজিবের প্রশংসা ও তাঁর নেতৃত্বের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের উল্লেখ করেই আমরা আমাদের বক্তব্য রাখতে থাকি। [১৩]

গণমুক্তি দল রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। তাঁদের কয়েকজন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সবাই পরাজিত হন। দলটি পরে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু দলের নেতাদের যোগাযোগ ছিল ভারতের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে চিত্তরঞ্জন সুতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

.

একটা কঠিন সময় যে এগিয়ে আসছে, সেটি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারছিলেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে একচেটিয়া জয় পান। জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট তাকে করেছিল আরও আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী এবং একই সঙ্গে দায়িত্বশীল। এই ম্যান্ডেটকে তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে দর-কষাকষির অস্ত্র হিসেবে। একদিকে তিনি খোলা রেখেছিলেন আলোচনার দরজা, অন্যদিকে তাঁর প্রশ্রয়ে ডালপালা মেলছিল তারুণ্যের দ্রোহ। এটি ছিল একটি কৌশল। তরুণদের একটি অংশ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে পা বাড়াতে চাইত না। অপর অংশটি ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি জঙ্গি, আগ্রাসী। ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্ম মেঘনা যমুনা’, কিংবা ‘পিন্ডি না ঢাকা/ ঢাকা ঢাকা’–এসব স্লোগান উনসত্তরের আন্দোলনের আগেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের জঙ্গি অংশের কণ্ঠে উনসত্তর সাল থেকেই শোনা যাচ্ছিল ভিন্ন স্লোগান, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘মুক্তিফৌজ গঠন করো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। তখনই বিভাজনরেখাঁটি স্পষ্ট হয়ে পড়ে। বোঝ যায়, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থকেরা শেখ মনির অনুগত এবং অন্য গ্রুপটি সিরাজুল আলম খানের সমর্থক। কিন্তু এ থেকে সরল উপসংহার টানা ঠিক হবে না যে মনিপন্থীরা স্বাধীনতাবিরোধী। তাদের যুক্তি ছিল প্রধানত দুটি। এক. এমন কিছু করা যাবে না, যা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা হয়ে দাঁড়ায়; এবং দুই. শেখ মুজিব নিজে থেকে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আগবাড়িয়ে স্বাধীনতার স্লোগান দেওয়া হবে হঠকারিতা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দুটি ধারাকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন। দুই ধারার কর্মী সমর্থকেরা অনেক সময় পরস্পরের বিরুদ্ধে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়েছেন, ছাত্রলীগের বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটির সম্মেলনে ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পাল্টাপাল্টি প্যানেল দিয়েছেন। তবু উভয় গ্রুপের একচ্ছত্র নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনিই সুপ্রিমো। শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান প্রকাশ্যে কখনো কোন্দলে জড়াননি। তবে তাঁদের অনুসারীদের ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। শেখ মুজিবের অবস্থান ছিল বেশ সুবিধাজনক। তাঁর কাছে দুটো বিকল্পই খোলা থাকল। তবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা একাত্তরের জানুয়ারিতেই উবে গিয়েছিল। ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণার সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করেছিলেন। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ বেশ সতর্কতার সঙ্গেই পর্যালোচনা করেছিলেন। এ ঘোষণার সামরিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আক্রমণ করলে জনগণের তা মোকাবিলা করার ক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ওই আলোচনার ভিত্তি ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ওই সময়ের সামর্থ্য। [১৪]

ভারতীয় গোয়েন্দারা একাত্তরের ৩০ জানুয়ারি কাশ্মীরি মুজাহিদের ছদ্মবেশে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের অভ্যন্তরীণ রুটের একটি বিমান ছিনতাই করে লাহোরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে বিমানটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এর জবাবে ভারত সরকার ভারতের আকাশসীমার ওপর দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়। এর ফলে ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর সক্ষমতা তলানিতে ঠেকে। শেখ মুজিব বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেন বলেছেন :

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শ অনুযায়ী আমি খসড়া তৈরি করি। খসড়ায় আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছিল, যেখানে স্বাধীনতা ঘোষণার কারণ হিসেবে ব্রিটিশরাজের অবিচারের কথা বলা হয়েছিল। তাজউদ্দীন ভাইকে কাছে রেখে মতিঝিলে আমার শরীফ ম্যানশনের অফিসে দুদিন কাজ করি। ঘোষণাপত্রটি আমি নিজেই টাইপ করি। খুব গোপনে এটি করা হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি আমরা এটা বঙ্গবন্ধুর হাতে দিই। তিনি এটা তাঁর কাছে রেখে দেন। তাজউদ্দীন আহমদ শুধু খসড়া তৈরিতেই অংশ নেননি, ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের একটি কর্মসূচিও তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন। এই কর্মসূচিতে প্রধান প্রধান শহরে মহাসমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষকে রাজপথে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়। সামরিক বাহিনী এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমরা রেডিও স্টেশন, সচিবালয় ও গভর্নর হাউসের দখল নিয়ে নেব এবং গভর্নর তখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন।

আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার দাবি করে আসছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও কার্যকরী কমিটির সদস্যদের একটি যৌথ সভা ডাকা হয়। সভায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানানো হয়। মনে হয়েছিল, ওই সভায় স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। আমার মনে আছে, এক বিদেশি কূটনীতিক আমাকে আগের দিন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনারা কি এই সভায় একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন?

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে দেরি হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ বাড়ছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সভা হওয়ার কথা। ওই দিন সকালে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। [১৫]

ড. কামাল হোসেনের ভাষ্যে এটা পরিষ্কার যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার অপেক্ষায় ছিলেন শেখ মুজিব। অধিবেশন না বসলে বিকল্প হিসেবে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার চিন্তা বিবেচনায় ছিল।

এটি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে সমঝোতার আশা খুবই ক্ষীণ। এত দিন ইয়াহিয়া মনে করেছিলেন, মুজিব ছয় দফা পরিমার্জন করবেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তাঁর সেই আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। [১৬]

শেখ মুজিব তখন পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে পা বাড়াননি। ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নেতা নির্বাচন করা হয়। উপনেতা নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। [১৭] ঠিক এ সময় আরেকটি ঘটনা ঘটে, যার ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ধানমন্ডির বাসায়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের। ‘হাইকমান্ডের সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এম মনসুর আলী ও তাজউদ্দীন আহমদ। যেকোনো কারণে খন্দকার মোশতাক উপস্থিত ছিলেন না বা তাঁকে রাখা হয়নি। আরও উপস্থিত ছিলেন যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। শেখ মুজিব তাঁদের একটি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ঠিকানাটি হলো ৩২১ রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। [১৮] যুবনেতাদের বয়ানে পরে এ তথ্য খণ্ডিতভাবে এসেছে। তারা ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের চার নেতার উপস্থিত থাকার কথা কখনো প্রকাশ্যে বলেননি। শুধু আবদুর রাজ্জাক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে শেখ মুজিব প্রয়োজনে তাদের ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বলেছিলেন।[১৯] ওই ঠিকানায় ছিল ১৮ কামরার একটি তিনতলা বাড়ি। চিত্তরঞ্জন সুতার সপরিবার ওই বাড়িতে থাকতেন। বাড়িটির নাম সানি ভিলা’। [২০]

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কাজ করতেন দশ হাতে। তিনি জানতেন কাকে দিয়ে কী করানো যাবে। ছাত্রদের মধ্যে কাজ করতেন কেউ কেউ। এ ক্ষেত্রে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের মধ্যেও যোগাযোগ হতো তার মাধ্যমে। অন্য একজন বা কয়েকজন হয়তো যোগাযোগ রাখতেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। আরেকজন হয়তো সামলাতেন গণমাধ্যম। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও তার লোক ছিল, যাদের মাধ্যমে তিনি তথ্য পেতেন। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটি করতেন অন্য কেউ। অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে তিনি। নিজেই সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন। প্রত্যেকেই দরকারি কাজ করতেন। তারা একে অপরের কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা পেতেন না, প্রয়োজনও হতো না। প্রত্যেকেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য মনে করতেন। সিরাজুল আলম খানকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আলমগীর রহমানকে চেনেন কি না। তিনি বলেছেন, চেনা তো দূরের কথা, নামও শোনেননি। অথচ তিনি শেখ মুজিবের আস্থাভাজন ছিলেন।

সময়টা ছিল উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তায় ভরা। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শেখ মুজিব মার্কিন প্রশাসনের সাহায্য চেয়েছিলেন। ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল ছিলেন আর্চার কে ব্লাড। শেখ মুজিবের পক্ষে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন আলমগীর রহমান। তিনি ছিলেন মার্কিন তেল কোম্পানি ইএসএসওর (ESSO) পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের প্রধান। আলমগীরকে দিয়ে মুজিব আর্চার ব্লডকে বার্তা পাঠালেন, বাংলাদেশ যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতা করবে কি না। আর্চার ব্লাড জানিয়ে দেন যে তাঁর সরকার চায় পাকিস্তানের ঐক্য টিকে থাকুক এবং সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করার সুযোগ আছে। আর্চার ব্লাডের বক্তব্যের প্রথম অংশটির ভাষা ছিল কূটনৈতিক এবং পরের অংশে যুক্তরাষ্ট্রের নমনীয় ভূমিকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।[২১]

শেখ মুজিব আলোচনার দরজা সব সময় খোলা রেখেছিলেন। তিনি সমঝোতার মাধ্যমে একটি নিষ্পত্তি চেয়েছিলেন। ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হবে, এ তথ্য তাঁকে ২৮ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছিলেন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং গভর্নর এস এম আহসান। শেখ মুজিব বারবার অনুরোধ করছিলেন, নতুন একটি তারিখ ঠিক না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলে তার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।[২২] ২৮ ফেব্রুয়ারি তার ধানমন্ডির বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ তার পেছনে এককাট্টা। তবে কিছু চরমপন্থী কমিউনিস্ট আছে। তারা ইতিমধ্যে তাঁর তিনজন নেতাকে হত্যা করেছে। তিনি এর বদলা নিতে বলেছেন। তার একজনকে মারলে তিনজন কমিউনিস্ট মারা হবে এবং এটি বাস্তবায়িত হয়েছে। যদি দেশের ঐক্য ধরে রাখা না যায়, তাহলে গুলির মুখোমুখি হতে তিনি পিছপা হবেন না। তাঁকে যদি আবারও জেলে নেওয়া হয়, কিংবা যদি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়, তবু তিনি জনগণের দেওয়া ম্যান্ডেট থেকে সরে আসবেন না। তিনি বিচ্ছিন্নতা চান না। তিনি চান। একটি কনফেডারেশন, যেখানে বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পাবে। [২৩]

একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য তরুণ সমাজের চাপ ছিল। পয়লা মার্চ বেলা একটায় রেডিওতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পক্ষে জনমনস্তত্ত্ব যেন তৈরিই ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই জনতা পথে নামে, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘোষণা করে স্বাধীনতা। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। এই পতাকা ১৯৭০ সালের ৭ জুন পল্টন ময়দানে ‘জয় বাংলা বাহিনী’র প্যারেডে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে এর আগেও বাংলাদেশের একটি পতাকা তৈরি করেছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তরা। মামলার অভিযোগপত্রের ৫০ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ১৯৬৬ সালের জুন মাসে মামলার ২ নম্বর আসামি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন তার চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির বাসায় একটি সভা ডেকেছিলেন। ওই সভায় তিনি সবাইকে তাঁর একটি ডায়েরি ও নোটবুক দেখান, যাতে ‘বাংলাদেশ’ নামে প্রস্তাবিত নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধান দিকগুলো লিপিবদ্ধ ছিল। সবুজ ও সোনালি রঙের জাতীয় পতাকাও সেখানে দেখানো হয়।[২৪] বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় পতাকার ধারণা এটাই প্রথম।

৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের পক্ষে শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রকাশ্যে জানান দেওয়া এটিই ছিল প্রথম লিখিত ঘোষণাপত্র। এই ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবকে জাতীয় নেতা এবং আমার সোনার বাংলা…’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। সভায় পাঠ করা একটি প্রস্তাবে শেখ মুজিবকে বলা হয় জাতির পিতা। ২ মার্চ সন্ধ্যায় ইকবাল হলের (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ৩১৩ নম্বর কামরায় শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের উপস্থিতিতে ইশতেহারটির প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রায়হান ফিরদাউস (মধু)।[২৫] বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাপত্রটি এসেছে বিএলএফের মাধ্যমে।

৩ মার্চ পল্টনে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের ওই জমায়েতে শেখ মুজিব। বলেছিলেন, ৭ মার্চ অনুষ্ঠেয় জনসভায় তিনি তাঁর বক্তব্য দেবেন। পল্টনে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ ছিল না। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কী বলবেন, এ নিয়ে শেখ মুজিবকে অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হয়েছিল। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ ও ঝুঁকি ছিল প্রবল। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবের অন্যতম উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ভাষ্য উল্লেখ করার মতো :

আওয়ামী লীগের তরুণেরা, যেমন সিরাজুল আলম খান, যিনি কাপালিক নামে পরিচিত, এখনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পুরোদস্তুর মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার পক্ষে ছিলেন। ৭ মার্চের সভায় যাওয়ার আগে নুরুল ইসলাম (পরে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান) ও আমি তাদের মনের ভাব জানার জন্য ইকবাল হলে গেলাম। কাপালিকের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁকে হতাশ মনে হলো। তিনি বললেন, স্বাধীনতার কোনো নাটকীয় ঘোষণা আসছে না।[২৬]

রেহমান সোবহানের ভাষ্যে এটা বোঝা যায়, সিরাজুল আলম খান ৭ মার্চের ভাষণে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব এ প্রস্তাবে রাজি হননি। তোফায়েল আহমেদের ভাষ্যমতে, সিরাজ ভাই বঙ্গবন্ধুকে বলল, আজ কিন্তু কমপ্লিট স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া মানব না।’ তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের কাঁধে হাত রেখে বললেন, সিরাজ, আই অ্যাম দ্য লিডার অব দ্য পিপল। আই লিড দেম। দে ডোন্ট লিড মি।’২৭ শেখ মুজিব সরাসরি ওইভাবে ঘোষণা না দিয়ে সমঝোতার শেষ চেষ্টা হিসেবে চার দফা দাবি জানিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি জনতাকে প্রতিরোধসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওই ভাষণে বলা কথার চেয়ে না বলা কথা কম ছিল না। পরে মুজিববিরোধীরা কেউ কেউ প্রচার করেছে যে মুজিব স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন; সে জন্য সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।

.

তথ্যসূত্র

১. বদিউল আলম

২. আহমদ (১৯৮২), পৃ. ১০৩-১০৪

৩. সিরাজুল আলম খান

৪. মনিরুল ইসলাম

৫. সিরাজুল আলম খান

৬. মাজহারুল হক টুলু

৭. সিরাজুল আলম খান

৮. তোফায়েল আহমেদ; পীর হাবিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু লন্ডনে ইন্দিরার প্রতিনিধির সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৮ জুন ২০১৯

৯. আবদুর রাজ্জাক

১০. তোফায়েল আহমেদ

১১. ওই

১২. বৈদ্য, ডা. কালিদাস (২০০৫), বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব, কর্মকার বুক স্টল, কলকাতা, পৃ. ১১৬-১১৯

১৩. ওই, পৃ. ১১১-১১৬

১৪. Hossain, Kamal (2013), Bangladesh: Quest for Freedom and Justice, UPL, Dhaka, p. 71-73

১৫. Ibid

১৬. আহমদ, মহিউদ্দিন (২০১৭), আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ৩২

১৭. The Pakistan Observer, 17 February 1971

১৮. তোফায়েল আহমেদ

১৯. তৃতীয় মাত্রা, চ্যানেল আই, ৪ এপ্রিল ২০০১

২০. সিরাজুল আলম খান

২১. Blood, Archer K (2006), The Cruel Birth of Bangladesh: Memoirs of an American Diplomat, UPL, Dhaka, p. 136

২২. Sisson, Richard & Rose, Leo (1990), War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California Press, California, p. 89-90

২৩. Blood, p. 148-152

২৪. বেগম, সাহিদা (২০০০), আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ৭৩

২৫. রায়হান ফিরদাউস।

২৬. Sobhan, Rehman (2016), Untranquil Reflection: The Years of Fulfilnent, Sage, New Delhi, p. 328-329

২৭. তোফায়েল আহমেদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *