০৬. শুভ জন্মদিন : জন্মদিনের অর্থনীতি ও রাজনীতি

শুভ জন্মদিন : জন্মদিনের অর্থনীতি ও রাজনীতি

১. ভূমিকা

রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী সরলাদেবী চৌধুরানী তাঁর আত্মজীবনী জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে লিখেছেন, “মেজমামী বিলেত থেকে ফিরে আসার পর থেকে ‘জন্মদিন’ বলে একটা ব্যাপারের সঙ্গে পরিচয় হল আমাদের–সে বিলাতী ধরনে সুরেন বিবির জন্মদিন উৎসব করার উপলক্ষে। তার আগে এ পরিবারে ‘জন্মদিন’ কেউ কারো জন্য করে নি (২০০৯, ৫৪)।” মেজো মামি অর্থাৎ প্রথম ভারতীয় আইসিএস সত্যেন ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ১৮৭৭ সালে প্রথমবার বিলেতে যান। সঙ্গে ছিল পাঁচ বছরের ছেলে সুরেন ও চার বছরের কন্যা ইন্দিরা (যার ডাক নাম ছিল বিবি)। ১৮৮০ সালে তিনি পুত্র-কন্যা নিয়ে ফিরে আসেন। ফেরতযাত্রায় তাঁর সঙ্গে যোগ দেন স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দেবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সরলাদেবীর বিবরণ থেকে প্রতিভাত হয় যে বাংলাদেশে বিলেতি কেতায় জন্মদিনের চল হয় ১৮৮০ সাল বা তার কিছু পর। এর আগে কারও কারও জন্মদিনে জন্মতিথির পূজা হয়েছে। কিন্তু জন্মদিন উৎসব ছিল বাঙালিদের অজানা। জন্মদিন পালিত হতো দেবতাদের (যেমন জন্মাষ্টমী) অথবা প্রেরিত পুরুষদের (যেমন বড়দিন ও ঈদে মিলাদুন্নবি) এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাদশাহদের। দেবতা ও পয়গম্বররা হচ্ছেন অমর। আর বাদশাহরা যখন গদিতে থাকতেন তখন নিজেদের অমর গণ্য করতেন। তবে মরণশীল মানুষের জন্মদিন নিয়ে মাতামাতি করা হতো না।

মনে করা হয়, ভারতের সাধারণ মানুষ দুটি কারণে জন্মদিন নিয়ে হই হুল্লোড় করত না। প্রথমত, উনবিংশ শতাব্দীতে অধিকাংশ ভারতীয় ছিল দরিদ্র। তাই অধিকাংশ লোকেরই জন্মদিনের রেস্ত ছিল না। তবে এ যুক্তি দুটি কারণে দুর্বল। অভিজিৎ ভি ব্যানার্জি ও এসথার ডাফলো (২০১১) সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন, অতিদরিদ্ররাও জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্য উৎসব ও পালাপার্বণে নিজেদের ক্ষমতা না থাকলেও (ধারদেনা করে বা আধপেটা থেকে) দরাজ হাতে খরচ করতে দ্বিধা বোধ করে না। তাই অর্থাভাবে জন্মদিনের উৎসব বন্ধ হয়ে থাকার সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয়ত, গরিব দেশে সবাই দরিদ্র নয়। এসব দেশে অনেক সচ্ছল পরিবার রয়েছে। তারাও প্রাক ব্রিটিশ বাংলায় জন্মদিন পালনে উৎসাহ দেখায়নি। তাই অর্থাভাবের কারণটি খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় না।

জন্মদিন উদ্যাপিত না হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল খুবই কম। শিয়রে অপেক্ষমাণ যমদূত নিয়ে জন্মদিনের মাতামাতির কথা অধিকাংশ মানুষই চিন্তা করতে পারত না। সারণি ৬.১-এ ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশে ও যুক্তরাজ্যে গড় আয়ুর প্রত্যাশার তুলনামূলক চিত্র দেখা যাবে।

সারণি ৬.১
ভারত ও যুক্তরাজ্যের গড় আয়ুর প্রত্যাশার তুলনা, ১৮২০-১৯৯৯

ভারত ও যুক্তরাজ্যের গড় আয়ুর প্রত্যাশার তুলনা, ১৮২০-১৯৯৯

উৎস: অ্যাংগাস ম্যাডিসন, ২০০১, ৩০

১৮২০ সালে ভারতে গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল মাত্র ২১। ১৯০০ সালে ভারতে মানুষ গড়ে ২৪ বছর বাঁচত। এই সময় শিশুমৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি। তাই এক জন্মদিন থেকে আরেক জন্মদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকাটাই ছিল একটি বড় ঝক্কি। অবশ্য বিলাতের পরিস্থিতি ছিল অনেকটা ভিন্ন। সেখানে ১৮২০ সালে গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল ভারতের প্রায় দ্বিগুণ (অর্থাৎ ৪০ থেকে ৫০ বছর)। বিলাতে তাই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে জন্মদিনের রেওয়াজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিলাতের অনুকরণে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর মতো বিলেতফেরতরা বাংলাদেশে জন্মদিন চালু করেন।

জন্মদিন নিয়ে আমার ঔৎসুক্যের প্রধান কারণ হলো, আমি আমার জন্মদিন কবে জানি না। অথচ আমার দুটি জন্মদিন আছে। আমার সরকারি জন্মদিন হচ্ছে ২ আগস্ট ১৯৪৪। এই তারিখ জন্মদিন হিসেবে আমার প্রবেশিকা পরীক্ষার সনদে লেখা রয়েছে। এই তারিখের ভিত্তিতেই আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দিই এবং সরকার থেকে অবসর গ্রহণ করি। আমার মা, যিনি আমার জন্মদিন সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানতেন, বারবার জোর দিয়ে বলতেন যে তারিখটি একেবারেই ভুল। মায়ের মতে, আমার জন্ম শ্রাবণ-ভাদ্রে নয়, আমার জন্ম হাড়-কাঁপানো শীতে। তাহলে আমার জন্মদিন নিয়ে এমন অঘটন কেন ঘটল? আমার মা বলতেন, কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন আমার প্রধান শিক্ষক বাবু বিহারীলাল চক্রবর্তী। তখন নাকি প্রবেশিকা পরীক্ষার বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে সাড়ে চৌদ্দ বছর বয়স না হলে সে বছর পরীক্ষা দেওয়া যেত না। ডিসেম্বরে জন্মদিন হলে পরীক্ষার জন্য এক বছর বসে থাকতে হবে। হেডমাস্টার বিধাতাকে অগ্রাহ্য করে কেরানি বাবুকে হুকুম দিলেন, ‘এর জন্মদিন ২রা আগস্ট লিখে দাও।’ আমার মায়ের হিসাবে আমার জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর। এই দ্বিতীয় দিনটিই আমার আপনজনেরা মাঝেসাঝে পালন করে থাকে।

আমার মায়ের হিসাব ঠিক হলে আমি মহাপুরুষদের জন্মদিনে ভূমিষ্ঠ হয়েছি। বলা বাহুল্য, একই দিনে যিশুখ্রিষ্ট ও পাকিস্তানের জনক জিন্নাহর জন্ম হয়। এক স্কুলের ছাত্রকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, মহাপুরুষের লক্ষণ কী? ছাত্রটি জবাব দিয়েছিল, মহাপুরুষ হতে হলে ছুটির দিনে জন্ম হতে হয়। ছাত্রটি অবশ্য চিন্তা করেনি যে ২৫ ডিসেম্বরের ছুটির দিনে জন্ম হওয়াতে যিশু প্রেরিত পুরুষ হননি, বরং যিশুর জন্ম হওয়াতেই ওই দিনটিতে ছুটি পালন করা হয়। ছোটবেলায় অত শত বুঝতাম না। বরং ২৫ ডিসেম্বরের ছুটির দিনে জন্ম হওয়াতে ছোটবেলায় আমার মনে অনেক অহংকার ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য জন্মদিন নিয়ে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্ন জাগে। বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো জন্মদিন নিয়ে এসব প্রশ্নের আলোচনা।

প্ৰথম খটকা আমার মনে জাগে, আমার মা কীভাবে মনে রেখেছেন আমার সঠিক জন্মদিন কবে। আমার কোনো কুষ্ঠি নেই। আমার জন্মতারিখ কোথাও লেখা নেই। আমার বাবা এতটুকু মনে করতে পারতেন যে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য আমার বয়স বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু ডিসেম্বরের কোন তারিখে আমার জন্ম তিনি তা স্মরণ করতে পারেননি। ২৫ ডিসেম্বর আমার প্রকৃত জন্মদিন কি না, এ নিয়ে আমার মনে সংশয় দেখা দিলে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, যিশুখ্রিষ্ট ও পাকিস্তানের জনক জিন্নাহর জন্য সত্যি সত্যি ২৫ ডিসেম্বর ছিল কি না। একটু গবেষণা করলেই বোঝা গেল, আমার সন্দেহ একেবারে অমূলক নয়। গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয় যে আমার জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর কি না, সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ২৫ ডিসেম্বর যে যিশু ও জিন্নাহর বানানো জন্মদিন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় খণ্ডে পঁচিশে ডিসেম্বর নিয়ে যেসব প্রচারণা রয়েছে তা বিশ্লেষণ করা হবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, শুধু আমার জন্মদিন নয়, ভারত ও বাংলাদেশে জন্মদিন সংক্রান্ত তথ্যগুলি আদৌ নির্ভরযোগ্য কি না। এ প্রসঙ্গে ভারতে ২ হাজার ৪৫৬ জন আইএএস (IAS) কর্মকর্তার ও বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৯১ জন প্রাক্তন ছাত্রের জন্মদিন-সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়াতে, বিশেষ করে বাংলাদেশে ব্যক্তিদের ঘোষিত জন্মতারিখ এখনো নির্ভরযোগ্য নয়। প্রবন্ধের তৃতীয় খণ্ডে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রবন্ধটির চতুর্থ খণ্ডে সর্বনিম্ন বয়ঃসীমার রাজনৈতিক বিবেচনাগুলি আলোচিত হয়েছে। শুধু চাকরিতে নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনেক সময় সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা নির্ধারণ করা হয়। এ ধরনের বিধিনিষেধের যৌক্তিকতা এ খণ্ডে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রবন্ধটির পঞ্চম খণ্ডে জন্মদিন নিয়ে যেসব ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে এ প্রবন্ধের মূল বক্তব্যগুলি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে এবং কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে।

২. ২৫ ডিসেম্বর : কার জন্মদিন?

যিশুখ্রিষ্টের জন্ম নিয়ে দেড় হাজার বছর ধরে যে ধরনের মাতামাতি হয়েছে, মানুষের ইতিহাসে অন্য কারও জন্ম নিয়ে তত বাড়াবাড়ি করা হয়নি। এ জন্মদিন নিয়ে যত চিত্র আঁকা হয়েছে আর কারও জন্মদিন নিয়ে এত ছবি নেই। এ দিন নিয়ে যত গান গাওয়া হয়েছে এত সংগীত অন্য কারও জন্মদিন নিয়ে গাওয়া হয়নি। গির্জায় গির্জায় যিশুর জন্য যত প্রার্থনা হয়েছে তেমনটি আর কারও কপালে জোটেনি।

যিশুর জন্মের বর্ণনা রয়েছে বাইবেলে । জেরুজালেমের কুমারী মেরি কাঠমিস্ত্রি জোসেফের বাগদত্তা ছিলেন। বিয়ের আগে দেবদূতেরা স্বপ্নে মেরিকে জানালেন, মেরি ভগবানের সন্তান নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা। কুমারী অবস্থায় মা হয়েছেন শুনে মেরি ভয় পেয়ে যান। দেবদূতেরা তাকে আশ্বস্ত করেন যে তার ভয়ের কারণ নেই। মেরি জোসেফকে যখন জানালেন যে তিনি গর্ভবতী; জোসেফ বিয়ে ভেঙে দিলেন। এবার দেবদূতেরা স্বপ্নে জোসেফকে আশ্বস্ত করলেন যে মেরি কুমারী এবং ভগবানের অভিপ্রায় যে জোসেফ যেন বিয়ে না ভেঙে দেন। জোসেফ এবার মেরিকে বিয়ে করতে রাজি হলেন। এ সময়ে বেৎলেহেম শহর থেকে জোসেফের এত্তেলা এল।

জোসেফের পূর্বপুরুষদের বাসস্থান ছিল বেৎলেহেম শহরে। ইহুদিদের প্রাচীন রীতি ছিল, প্রতিটি নাগরিককে পূর্বপুরুষদের বাসভূমিতে মাথাপিছু কর। দিতে হতো। যদি কেউ পূর্বপুরুষদের বাসভূমির বাইরে কাজ করে, তবে তাকে কর প্রদানের সময় পিতৃপুরুষদের শহরে ফিরে আসতে হয়। জোসেফ কর পরিশোধের লক্ষ্যে সন্তানসম্ভবা মেরিকে নিয়ে বেলেহেমে এলেন। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, জোসেফকে বেৎলেহেমের আদমশুমারিতে নিবন্ধনের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে আদমশুমারি আর মাথাপিছু কর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আদমশুমারির ভিত্তিতেই নির্ণীত হতো মাথাপিছু কর বাবদ মোট প্রাপ্যের পরিমাণ। তবে এ সময় জোসেফের মতো আরও অনেক প্রবাসী একই উদ্দেশ্যে বেৎলেহেমে আসেন। সব অতিথিশালা ও পান্থশালা অতিথিতে ভরে গেল। যখন জোসেফ মেরিকে নিয়ে বেৎলেহেমে এলেন তখন কোনো অতিথিশালায় বা পান্থশালায় কোনো থাকার জায়গা ছিল না। অন্তঃসত্ত্বা মেরিকে নিয়ে জোসেফ বিপদে পড়লেন। একজন পান্থশালার মালিক জোসেফ ও মেরিকে শূন্য আস্তাবলে ঠাই দিলেন। এখানে খড়বিচালির মধ্যে জন্ম নিলেন ‘জগতের প্রভু’ যিশুখ্রিষ্ট। আশপাশে যেসব রাখাল গৃহপালিত পশু পাহারা দিচ্ছিল তারা দেখতে পেল, জ্যোতির্ময় দেবদূতেরা আকাশ থেকে নেমে আসছে এবং সবাইকে মহাপ্রভুর আগমনবার্তা জানাচ্ছে।

যিশুর জন্মদিন নিয়ে ওপরে বর্ণিত বয়ান সম্পর্কে অনেক খুঁটিনাটি বাইবেলে রয়েছে। কিন্তু বাইবেলে কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই, যিশু কখন অর্থাৎ কোন সালে ও কোন তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। বাইবেলের বিবরণ পাঠ করলে মনে হয়, যিশু আদৌ ডিসেম্বরে বা শীতকালে জন্মাননি। বাইবেলের লুক খণ্ডে বলা হয়েছে, ‘And there were shepherds living out in the fields nearby keeping watch over their flocks at night.’ অর্থাৎ যিশুর যখন জন্ম হয়, তখন ভেড়ার পাল পাহারা দেওয়ার লক্ষ্যে রাখালেরা আশপাশে মাঠের মধ্যে বাস করছিল। বসন্তকাল থেকে শরকাল পর্যন্ত ভেড়ার পাল বাইরে রাখা হতো। শীতকালে ভেড়া ঘরের ভেতর রাখা হতো। কাজেই শীতকালে রাখালদের মাঠে বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। বাইবেলের বর্ণনা সঠিক হলে যিশুর জন্ম শীতকালে হয়নি।

যিশুর জন্মসাল নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সাধারণত মনে করা হয়, পয়লা খ্রিষ্টাব্দে যিশুর জন্ম। এ ধারণাও ঠিক নয়। যদি বাইবেলে বর্ণিত পূর্ব দেশের জ্ঞানী ব্যক্তিদের (যাদের মেজাই বলা হয়ে থাকে) দেখা তারকার ভিত্তিতে হিসাব করা হয়, তবে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক সময়ে যিশুর জন্ম হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন যে রাজা হারড, যিনি নবজাত যিশুকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন, এঁর মৃত্যু হয় ৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাই কেউ কেউ বলেন, যিশুর জন্ম ৪ খ্রিষ্টাব্দে। কাজেই বেশির ভাগ গবেষক মনে করেন যে ৪ থেকে ৬ খ্রিষ্টাব্দে যিশুর জন্ম।

যিশুর সঠিক জন্মতারিখ নির্ণয়ের একটি বড় সমস্যা হলো, যিশুর জন্মের পর প্রথম ৪০০ বছরে তার জন্মদিন উদ্যাপিত হয়নি। তাই তার জন্মদিন সম্পর্কে ধর্মগ্রন্থের বাইরে কোনো নির্ভরযোগ্য উৎস নেই। অবশ্য ২০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া নগরের ক্লিমেন্ট যিশুর সম্ভাব্য কয়েকটি জন্মতারিখ উল্লেখ করেন। এ তারিখগুলি হচ্ছে : ২০ মে, ২১ মার্চ, ১৫ এপ্রিল, ২০ অথবা ২১ এপ্রিল। ক্লিমেন্টের লেখা থেকে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ২৫ ডিসেম্বরকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি (অ্যান্ড্রু ম্যাকগোয়ান, ২০০৯)। চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যিশুর জন্মদিন উদ্যাপনও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকে জাঁকজমকের সঙ্গে খ্রিষ্টের জন্মোৎসব পালন করা শুরু হয়। রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে খ্রিষ্টের জন্মদিন পালিত হতো ২৫ ডিসেম্বর। মধ্যপ্রাচ্যে এ উৎসব পালিত হতে ৬ জানুয়ারি। আস্তে আস্তে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন হিসেবে বেশির ভাগ অঞ্চলে স্বীকৃতি লাভ করে। তবে এখনো কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। আর্মেনিয়ার খ্রিষ্টানরা ৬ জানুয়ারি ক্রিসমাস উদযাপন করে। রাশিয়ার প্রাচীনপন্থী গির্জায় ৭ জানুয়ারি যিশুর জন্মদিনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আবার কোথাও কোথাও ২৫ ডিসেম্বর ও ৬ জানুয়ারি দুটি দিনই উদযাপিত হয়। ২৫ ডিসেম্বর পালিত হয় যিশুর জন্মদিন রূপে। ৬ জুন প্রতিপালিত হয় Feast of the Epiphany বা প্রাচ্য অঞ্চল থেকে আসা বিজ্ঞ মেজাইদের (Magi) আবির্ভাবের দিন হিসেবে।

প্রশ্ন ওঠে; যিশুর জন্মের ৪০০ বছর পর ২৫ ডিসেম্বর হঠাৎ কীভাবে যিশুর জন্মদিনের শিরোপা পেল? যারা ২৫ ডিসেম্বরের কট্টর সমর্থক, তারা দাবি করেন যে যিশুর মৃত্যু ও মেরির গর্ভে আবির্ভাবের তারিখ অভিন্ন। সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুসারে যিশুর মৃত্যু ঘটে ২৫ মার্চ। সুতরাং তাদের বিশ্বাস অনুসারে যিশু মায়ের গর্ভে আসেন ২৫ মার্চ। তাঁদের মতে, যিশু মায়ের গর্ভে ছিলেন ঠিক নয় মাস (এটা তাদের বিশ্বাস, এ নিয়ে অবশ্যই তর্কের অবকাশ আছে)। তাই যিশুর জন্ম ২৫ ডিসেম্বর।

যারা ২৫ ডিসেম্বরের কট্টর সমর্থক নন, তারা বলেন যে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন নয়। তবে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ২৫ ডিসেম্বরকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বরের কাছাকাছি সময়ে (২১/২২ ডিসেম্বর) দিন সবচেয়ে ছোট হয়। এরপর দিন বড় হতে থাকে। অতি প্রাচীনকাল থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে যে পঁচিশে ডিসেম্বর সূর্যদেবতার জন্মদিন। এরপর সূর্যের তাপ বাড়তে থাকে। মধ্যযুগে খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে ধুমধাম করে সূর্যের জন্মদিন পালন করা হতো। গির্জার নেতারা মনে করলেন যে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন পালিত হলে তা অতি সহজেই জনপ্রিয় হবে। হলোও তাই। সারা পৃথিবীতে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করল (কিফ রেমন্ড, ১৯৮৬)।

সূর্যদেবতার অনুকরণে যিশুর জন্মদিন নির্ধারিত হলো। আর যিশুর জন্মদিনের আলোকে নিজেকে মহিমান্বিত করার উদ্যোগ নিলেন পাকিস্তানের কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি ছিলেন শিয়া মুসলমান। তাঁর কোনো কুষ্ঠি নেই। তিনি কখনো এন্ট্রান্স পাস করেননি (সে আমলে ব্যারিস্টারি পাস করার জন্য এন্ট্রান্সের বালাই ছিল না)। তাই তাঁর জন্মতারিখ-সংবলিত সনদপত্র নেই। তার যখন জন্ম হয়, তখন করাচি পৌরসভায় জন্মনিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কাজেই, জিন্নাহ যে তারিখ তার জন্মদিন বলে ঘোষণা করেন তা প্রত্যাখ্যান করা শক্ত। জিন্নাহ দাবি করতেন যে তাঁর জন্ম হয়েছে। ১৮৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তাঁর জীবনীকার স্ট্যানলি ওয়ালপার্ট এ তথ্য মানতে রাজি নন। ১৮৮৭ সালে ২৩ ডিসেম্বর জিন্নাহ করাচির মাদ্রাসা-তুল ইসলামে ভর্তি হন। এই মাদ্রাসার নিবন্ধনের খাতা থেকে দেখা যায়, মাহমেদ আলী জিন্নাবাই-এর জন্মতারিখ হলো ২০ অক্টোবর ১৮৭৫। পরবর্তীকালে জিন্নাহ সবই পরিবর্তন করলেন। নিজের নাম পরিবর্তন করলেন। মাহমেদ আলীর স্থলে লিখলেন মোহাম্মদ আলী। জিন্নাহবাইকে হেঁটে নাম করা হলো জিন্নাহ। মাদ্রাসায় জিন্নাহর জন্মসাল ছিল ১৮৭৫। জিন্নাহ তা প্রায় ১৪ মাস কমিয়ে ১৮৭৬ সালে নিয়ে এলেন। জন্মতারিখ ২০ অক্টোবরের স্থলে ২৫ ডিসেম্বর নির্ধারণ করলেন। জিন্নাহ কেন এ কাজ করলেন তাঁর কৈফিয়ত আমাদের জানা নেই। তিনি কি অল্প বয়সে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন, যার ফলে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সচেতনভাবে বয়স বাড়িয়েছিলেন, যাতে তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ব্যাঘাত না ঘটে? আমাদের কাছে এ সম্পর্কে কোনো প্রমাণ নেই।

আরেকটি কারণ হতে পারে, তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিযোগিতার বয়স কম থাকায় তাঁর বয়স কমানোর চেষ্টা করা হয়। এ অনুমান দুর্বল মনে হয়। জিন্নাহর বয়স যখন মাদ্রাসার দলিল অনুসারে ১৮, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তিনি বার অ্যাট ল পড়বেন অর্থাৎ তিনি সরকারি চাকরি করবেন না। তার বয়স এই সময়টাতেই কমানো হয়েছে। কাজেই এর সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে চাকরির কোনো যোগসূত্র দেখা যাচ্ছে না। জিন্নাহর জীবনীকার স্ট্যানলি ওয়ালপার্টের ব্যাখ্যা ভিন্ন। তিনি মনে করেন যে জিন্নাহ মাদ্রাসার পর কিছুদিন একটি মিশনারি স্কুলে পড়েছেন। সেখানে ক্রিসমাসের জাঁকজমকে অভিভূত হয়ে তার জন্মদিন ২০ অক্টোবরকে পরিবর্তন করে ২৫ ডিসেম্বর করার সিদ্ধান্ত নেন। এই অনুমানের পক্ষেও যথেষ্ট প্রমাণ নেই।

কারণ যা-ই হোক না কেন, ঐতিহাসিক উপাত্ত থেকে সন্দেহের অবকাশ নেই। যে ২৫ ডিসেম্বর যিশু ও জিন্নাহর বানানো জন্মদিন, আসল জন্মদিন নয়। তাহলে কি ২৫ ডিসেম্বর আমার জন্মদিনও তাই? হতেই পারে। খ্রিষ্টান ধর্মাজকেরা যদি জনপ্রিয়তার লোভে সূর্যদেবতার জন্মদিনকে, খ্রিষ্টের জন্মদিন হিসেবে চালাতে পারে; যদি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ খ্রিষ্টের জন্মদিনকে নিজের জন্মদিন হিসেবে বেছে নিতে পারেন, তবে আমার মা যদি ভুলে বা ইচ্ছা করে ২৫ ডিসেম্বরকে আমার জন্মদিন হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

৩. দক্ষিণ এশিয়ায় ঘোষিত জন্মদিন কতটুকু সঠিক?

শিল্পোন্নত দেশগুলিতে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জন্মনিবন্ধনের ব্যবস্থা রয়েছে। এর ফলে এসব দেশে জন্মদিন নিয়ে ফাঁকি-ফড়ির সুযোগ কম। দক্ষিণ এশিয়াতে এখনো নির্ভরযোগ্য জন্মনিবন্ধন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। তাই প্রশ্ন ওঠে, এখানে যেসব জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়, তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? এ প্রশ্ন পরীক্ষা করতে হলে সবার প্রকৃত জন্মতারিখ জানতে হবে। কিন্তু এ ধরনের উপাত্ত আমাদের কাছে নেই। তাই জন্মতারিখের নির্ভরযোগ্যতার প্রত্যক্ষ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। তবে পরোক্ষভাবে জন্মতারিখের নির্ভরযোগ্যতা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সংখ্যাতত্ত্বের নর্মাল নিবেশনসূত্র বা Law of normal distribution অনুসারে প্রতিদিন গড়ে সমসংখ্যক শিশুর জন্ম প্রত্যাশিত। কাজেই কোনো মাসে যদি ৩০ দিন থাকে তবে সে মাসে সারা বছরে যত শিশু ভূমিষ্ঠ হয় তার ৮.১৯ শতাংশ শিশু ভূমিষ্ঠ হবে । ৩১ দিনে মাস হলে ৮.৪৯ শতাংশ শিশু জন্মাবে আর ২৮ দিনের মাসে জন্ম নেবে ৭.৬৭ শতাংশ শিশু। যদি কোনো দেশে একটি বড় জনগোষ্ঠীর (ধরুন ৫০০-এর বেশি) জন্মতারিখের নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে কোনো কোনো মাসে ৮ শতাংশের অনেক বেশি বা অনেক কম জন্ম হয়েছে, তবে সেখানে জন্মতারিখের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্মতারিখের ওপর এ ধরনের গবেষণা হয়েছে। উইকিপিডিয়ার বিবরণ অনুসারে, এসব গবেষণার মূল বক্তব্য নিম্নরূপ :

ক) শুধু সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাস ছাড়া অন্য ১০টি মাসে প্রায় সমহারে শিশু জন্ম নেয়। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে জন্মের হার বেশি হওয়ার কারণ হলো, ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে রজনী হয় দীর্ঘতম। এই সময়টা নরনারীর মিলনের জন্য সুবিধাজনক। এই সময়ে সন্তান গর্ভে এলে পরবর্তী সেপ্টেম্বরে নয় মাস পূর্ণ হয়। (গর্ভাবস্থার গড় মেয়াদ ২৮০ থেকে ২৮৪ দিন)। তাই সেপ্টেম্বরে ও অক্টোবরে জন্মের হার বেড়ে যায়।

খ) ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্মদিন বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি শিশু জন্মে ১৬ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ এদের জন্মের সূচনা ডিসেম্বরে। সবচেয়ে কম শিশু জন্মায় ২৫ ডিসেম্বর। এর সঙ্গে বড়দিন বা ছোট রাত্রির কোনো সম্পর্ক নেই। এর বড় কারণ প্রাকৃতিক নয়, প্রশাসনিক। যেহেতু বেশির ভাগ ডাক্তার ২৫ ডিসেম্বর ছুটিতে থাকেন, সেহেতু তারা অনেক ক্ষেত্রে ক্রিসমাসের আগেই প্রসবের ব্যবস্থা করেন। তাই ২৫ ডিসেম্বরে অপেক্ষাকৃত কম শিশু জন্মায়।

গ) সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩৬৬ জন ব্যক্তির জন্মদিন-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হলে কমপক্ষে দুজন ব্যক্তির একই জন্মদিন হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১০০ শতাংশ। ৫৭ জন দৈবচয়নকৃত ব্যক্তির মধ্যে কমপক্ষে দুজনের অভিন্ন জন্মদিনের সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। আর ২৩ জনের মধ্যে কমপক্ষে দুজনের একই জন্মদিনের সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ।

এই প্রবন্ধে ভারত ও বাংলাদেশে জন্মতারিখের নির্ভরযোগ্যতা বিশ্লেষণ করার জন্য দুই ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রথমত, ভারতের ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের ২ হাজার ৪৫৬ জন কর্মকর্তার জন্মতারিখ বিশ্লেষণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৩ সালে যেসব ছাত্র মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে, তাদের মধ্য থেকে ৭৯১ জনের জন্মদিন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। উভয় দেশের জন্মদিন নিয়ে সমীক্ষাতেই শিক্ষিত লোকদের জন্মদিন সম্পর্কে উপাত্ত জোগাড় করা হয়েছে। এই দুটি সমীক্ষার একটিতেও কোনো অশিক্ষিত লোক অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এই সমীক্ষা দুটিতে যাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তাঁরা চাইলে তাদের জন্মদিন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য উপাত্ত দিতে পারেন। যদি এখানে ভুল উপাত্ত দেওয়া হয়, তবে তা ইচ্ছা করে দেওয়া হয়েছে। ভারতে ২ হাজার ৪৫৬ জন কর্মকর্তার জন্মদিনের উপাত্ত বিশ্লেষণ সারণি ৬.২-এ দেখা যাবে।

সারণি ৬.২
ভারতের ২৪৫৬ জন আইএএস কর্মকর্তার জন্মদিনের মাসভিত্তিক বিশ্লেষণ

ভারতের ২৪৫৬ জন আইএএস কর্মকর্তার জন্মদিনের মাসভিত্তিক বিশ্লেষণ

জুন জুলাই

এই বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ১২ মাসের মধ্যে ১১ মাস মোট জন্মের শতকরা হার ৭ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে সীমিত ছিল। বিস্তারিত সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ছাড়াও এ কথা স্পষ্ট (কেননা মাসের মোট দিনভেদে এ সংখ্যা ৭.৬৭ থেকে ৮.৪৯ হতে পারে) যে এ ধরনের সংখ্যা মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো জুলাই মাস বা বাংলা পঞ্জিকায় আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। এ মাসে ১১ শতাংশ আইএএস অফিসারের জন্মদিন। এটা মাসিক প্রত্যাশিত গড়ের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। এর কারণ স্পষ্ট নয়। জানুয়ারি মাসে জন্মতারিখ বেশি হলে ধরে নেওয়া যেত, জন্মতারিখ না জানায় ভর্তির সময়ের কাছাকাছি একটি তারিখ স্কুলের নিবন্ধনের ফর্মে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে জন্মের হার বেশি। অনুমান করা হয়, এসব সন্তানের গর্ভাবস্থা শুরু হয় পূর্ববর্তী ডিসেম্বরে দীর্ঘতম রজনী ও তার কাছাকাছি সময়ে। এই সমীক্ষায় ভারতে সন্তান উৎপাদনে দীর্ঘতম রজনীর কোনো প্রভাব দেখা যায় না। ভারতীয়রা অবশ্য বিশ্বাস করে, নরনারীর জন্য সবচেয়ে রোমান্টিক সময় হচ্ছে বর্ষাকাল। কালিদাস মেঘদূত-এ আষাঢ়ের প্রথম দিনে নতুন মেঘ দেখে যক্ষের মনে যে ভাবের উদ্রেক হয় তা বর্ণনা করেছেন। বুদ্ধদেব বসু এই বর্ণনার নিম্নরূপ অনুবাদ করেছেন :

কামের উদ্রেক যে করে, সেই মেঘে সহসা দেখে তাঁর সমুখে
যক্ষ কোনোমতে চোখের জল চেপে ভাবলে মনে মনে বহুখন
নবীন মেঘ দেখে মিলিত সুখী-জন তারাও হয়ে যায় আনমনা।
কি আর কথা তবে, যদি সে দূরে থাকে সে চায় কণ্ঠের আলিঙ্গন।

কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রবণে
যদি না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গল বার্তা?
যক্ষ অতএব কুরচি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য
স্বাগত-সম্ভাষ জানাল মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।

নবীন মেঘের আবির্ভাবের সঙ্গে যদি প্রিয়ার আলিঙ্গনের জন্য দয়িতরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে, তাহলে আষাঢ়-শ্রাবণের ২৮০ দিন পর অনেক নতুন শিশুর জন্ম হওয়ার কথা। কালিদাসের অনুমান সঠিক হলে চৈত্র-বৈশাখে শিশু জন্মের হার বেশি হওয়া ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতীয় সমীক্ষায় জন্মের হার বেশি দেখা যাচ্ছে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। এর কোনো বোধগম্য ব্যাখ্যা দেখা যাচ্ছে না। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যারা বেরিয়ে যান তাঁদের জন্মদিন বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সারণি ৬.৩-এ দেখা যাবে।

সারণি ৬.৩
১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৭৯১ জন পুরুষ ও মহিলার

১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৭৯১ জন পুরুষ ও মহিলার

জন্মতারিখের বিশ্লেষণ।

উৎস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮৩ ব্যাচের পুনর্মিলনী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা

সারণি ৬.৩ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২২.৩ শতাংশ পুরুষ এবং ২১.৬৮ শতাংশ মহিলা জানুয়ারি মাসে জন্মেছেন। জানুয়ারি মাসে এত উঁচু হারে জন্মের কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। এর একমাত্র সহজ ব্যাখ্যা হলো, জানুয়ারি মাসে শিক্ষাবছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। ওই সময়ে যেসব ছাত্রছাত্রী তাদের সঠিক জন্মদিন জানে না, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের জন্মদিন পয়লা জানুয়ারি বা তার কাছাকাছি সময়ে লিখে দেয়। এর ফলে বিদ্যালয়ের সনদে উল্লেখিত জন্মতারিখ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুয়া ও কল্পিত।

ভারতীয় আইএএস অফিসারদের তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্মদিন অনেক বেশি ভুয়া মনে হয়। এর একটি কারণ হতে পারে, ভারতীয় আইএএস অফিসারদের সিংহভাগ অভিজাত হিন্দু পরিবারের সন্তান। এদের প্রায় সবারই কুষ্ঠি আছে। তাই তারা সঠিক জন্মদিন জানেন। এর ফলে এঁদের জন্মতারিখ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। পক্ষান্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীই জানেন না তারা কখন জন্মেছেন।

৪. জন্মদিনের রাজনীতি : চাকরি ও বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা কতটুকু যৌক্তিক?

ইংরেজি একটি প্রবাদে বলা হয়ে থাকে, যারা সত্যিকার বন্ধু তারা বন্ধুর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে কখনো ভোলে না, তবে ভুলেও জিজ্ঞেস করে না কতটি জন্মদিন পার হলো। ভারতবর্ষেও কুষ্ঠি তৈরি ছাড়া অন্য কোনো কাজে জন্মদিন নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। ইংরেজদের ভারত দখলের আগে চাকরিতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বয়ঃসীমা ছিল না। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ারও কোনো নির্ধারিত বয়স ছিল না। বাদশাহ খোশ হলে নোকরি মিলত, বাদশাহ নাখোশ হলে চাকরি খতম হয়ে যেত। ব্রিটিশরা ভারতে প্রথম চাকরিতে যোগদান আর অবসরের সময়সীমা নির্ধারণ করে। এর ফলে প্রকৃত বয়স লুকিয়ে বয়স কম করে দেখানোর প্রবণতা দেখা দেয়। সবাই বয়স কম দেখিয়ে বেশি দিন চাকরি করতে চায়। এই প্রবণতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের পরও সক্রিয় রয়েছে। এমনকি, দীর্ঘদিন চাকরির পরও অনেক উচ্চপদস্থ আমলা তাদের বয়স কমিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়াতে চায়। ২০০১ সালে বাংলাদেশে একজন সংস্থাপন সচিব বয়স জাল করে নিজের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করেন। অথচ তার একটি বড় দায়িত্ব ছিল কেউ যেন জাল-জালিয়াতি করে বয়স না কমাতে পারে, তা নিশ্চিত করা। হাতেনাতে ধরা পড়ার পর তার চাকরি চলে যায়। ভারতে ২০১১-১২ সময়কালে সেনাপ্রধান ভি কে সিং তার নিজের বয়স কমানোর চেষ্টা করেন। চাকরি নেওয়ার সময়ে তার জন্মতারিখ লেখা হয় ১০ মে ১৯৫০। তিনি দাবি করেন, তাঁর প্রকৃত জন্মতারিখ ঠিক এক বছর পর ১০ মে ১৯৫১। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ দাবি অগ্রাহ্য করেন। ভি কে সিং সুপ্রিম কোর্টে ভারত সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট শুনানির সময় একটি বিষয়ের ওপর জোর দেন। চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেকেই জন্মতারিখ এগিয়ে আনতে চান। এ ধরনের লক্ষাধিক আবেদন বিভিন্ন হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করেছে। কাজেই আদালত ভি কে সিংকে এ আবেদন প্রত্যাহারের পরামর্শ দিলে তিনি তা মেনে নেন।

ভারতে গড় আয়ুর প্রত্যাশার তুলনায় ব্রিটিশ আমলে চাকরির অবসরের সময়সীমা যথেষ্ট উদার ছিল। তাই এ নিয়ে খুব একটা অসন্তোষ ছিল না।

ব্রিটিশ সরকারের রাজনীতির খেল ছিল চাকরিতে নিয়োগের সর্বোচ্চ বয়ঃসীমা নিয়ে। ব্রিটিশ শাসকেরা দেশি কর্মকর্তাদের চেয়ে বিলাতের সাহেবদের চাকরি দিতে পছন্দ করতেন। জন্মসূত্রে সাহেব না হলে চাকরি দেওয়া যাবে না, এ ধরনের শর্ত ছিল স্পষ্টত বৈষম্যমূলক। তাই তারা একই উদ্দেশ্যে ভিন্ন ধরনের শর্ত আরোপ করেন। সবচেয়ে কঠিন শর্ত হলো, চাকরিতে যোগদানের বয়ঃসীমা কমানো। আইসিএসের ক্ষেত্রে এ সীমা অনেক সময় ১৮/১৯-এ নামিয়ে আনা হয়। এ ধরনের বয়ঃসীমার পক্ষে যুক্তি ছিল, অল্প বয়সের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের স্বভাব ও চরিত্র চাকরির উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু বেশি বয়সে নিয়োগ দেওয়া হলে নতুন কর্মকর্তারা তাদের বদ অভ্যাস নিয়ে আসবেন। তাদের অভ্যাস আদৌ বদলানো সম্ভব হবে না। অন্যদিকে এই ব্যবস্থার সমালোচকেরা দাবি করেন, যে বয়ঃসীমা কম হলে গরিবের সন্তানেরা, যাঁরা অল্প বয়সে সুযোগের অভাবে লেখাপড়া শুরু করতে পারেন না, তাঁরা বৈষম্যের শিকার হন। এখানে দুটি পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি কাজ করছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে চাকরির বয়ঃসীমা যথেষ্ট বেশি (ধরুন ৩৫-৪০ বছর) হওয়া উচিত। অন্যদিকে প্রশাসনিক দিক থেকে অল্প বয়সের কর্মকর্তাদের গড়েপিটে সংগঠনের উপযোগী করা সম্ভব। কাজেই প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে চাকরির বয়ঃসীমা যত কম করা যায় ততই মঙ্গল।

সরকারি চাকরিতে অবসর গ্রহণের বয়ঃসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও দুটি স্বার্থগোষ্ঠী রয়েছে। যারা প্রবীণ, তাঁরা চাকরিতে থাকতে চান। প্রবীণদের যুক্তি হলো, তাঁদের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তাঁরা অনেক বয়স পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকেন, কাজেই তাদের অবসরে পাঠিয়ে আনকোরা কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে সরকারের ব্যয় বাড়বে; কেননা, অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন দিতে হবে এবং নবনিযুক্তদের বেতন দিতে হবে। অনেক উন্নত দেশে চাকরিতে অবসরের বয়ঃসীমা একেবারে তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মচারীরা নিজেরা ঠিক করেন কখন তারা অবসর নেবেন। অন্যদিকে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের হার কমে গেলে নতুন নিয়োগ কমে যাবে। নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ কমে গেলে প্রশাসনে নবীনদের নতুন ধ্যানধারণা ঢুকতে পারবে না।

বয়ঃসীমা নিয়ে বিতর্ক শুধু সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বা গণপরীক্ষাতে অংশগ্রহণের জন্য কোনো সর্বনিম্ন বয়ঃসীমার প্রয়োজন আছে কি না, সে সম্পর্কেও বিতর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে এ দেশে নিয়ম করা হয়, অতি অল্প বয়সে ছাত্রদের স্কুলে ভর্তি করা যাবে না। অবশ্য এ নিয়মের সমর্থকেরা মনে করেন যে নিয়মটি ব্রিটিশরা রাজনৈতিক কারণে করেনি। এর পেছনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি রয়েছে। অল্প বয়সের প্রতিভাবান শিশুদের ডাবল প্রমোশন বা ট্রিপল প্রমোশন দিয়ে ডিগ্রি দিলে তাদের ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটবে না। তারা সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না। শিক্ষা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়। শিক্ষার অন্যতম দায়িত্ব হলো ব্যক্তিকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে সে সমাজের সবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। গণপরীক্ষাতে অংশগ্রহণের জন্য তাই সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা থাকা উচিত। এ নিয়মের বিরোধীরা বলেন, এগুলি হচ্ছে শিক্ষকদের পেশাগত স্বার্থ রক্ষার জন্য জারিজুরি। যদি প্রতিভাবান ছাত্রদের দ্রুত পাস করতে দেওয়া হয়, তবে ছাত্রসংখ্যা কমে যাবে। তাই শিক্ষকেরা প্রতিভাবান ছাত্রদের তাড়াতাড়ি পাস করাতে আগ্রহী নয়। পক্ষান্তরে, প্রতিভাবান ছাত্ররা যথাযথ স্বীকৃতি না পেলে গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়। তাদের প্রতিভার বিকাশ ব্যাহত হয়। যদিও বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা ঔপনিবেশিক আমলে চালু হয়, তবে নিয়মটির যথার্থতা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে এখনো বিতর্ক চলছে।

এই বিতর্ক মীমাংসার একটি উপায় হলো, যারা বিশ্বে সবচেয়ে কম বয়সে ডিগ্রি অর্জন করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করা। পৃথিবীর কনিষ্ঠতম স্নাতকদের জীবনবৃত্তান্ত ব্লগে দেখা যাবে।

(http://accreditedonlinecolleges.com/blog/2011/the-10 youngest)। এর মধ্যে রয়েছেন একজন ভারতীয়। তাঁর নাম তথাগত অবতার তুলসী । তিনি ৯ বছরে হাইস্কুলের পাঠ শেষ করেন; ১০ বছর বয়সে পাটনা থেকে বিএসসি পাস করেন; ১২ বছর বয়সে পাটনা বিজ্ঞান কলেজ থেকে এমএসসি পাস করেন। এসব ডিগ্রি সাততাড়াতাড়ি পেলেও তার পিএইচডি করতে নয় বছর লাগে। তিনি বর্তমানে মুম্বাইয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াচ্ছেন। তার বয়স এখন ৩৭। এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো অসাধারণ অবদানের কথা শোনা যায়নি।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ আইকিউর অধিকারী শো ইউয়ানো চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। ১২ বছর বয়সে তিনি স্নাতক হন, ১৮ বছরে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এখন ডাক্তারি পড়ছেন। ক্যাথলিন হলজ ১৫ বছর বয়সে স্নাতক হন এবং ১৮ বছর বয়সে আইন পাস করেন। তিনি বর্তমানে আইন পেশায় নিয়োজিত। মার্কিন নাগরিক আলিয়া সবুর আট মাস বয়সে পড়তে শুরু করেন। তিনি চতুর্থ শ্রেণী থেকে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮ বছর বয়সের মধ্যে ম্যাটেরিয়াল বিজ্ঞান প্রকৌশল শাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পৃথিবীর কনিষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। মাইকেল কারনি ১০ বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এখনো পড়াশোনা করছেন। গ্রেগরি স্মিথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ এক বছরে সাঙ্গ করেন। দুই বছরে হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন। ১৩ বছর বয়সে কলেজের ডিগ্রি পান। বর্তমানে তিনি পিএইচডি করছেন। তবে সব প্রতিভাবানের পক্ষে তাড়াহুড়ো করে ডিগ্রি অর্জনের অভিজ্ঞতা সমান সুখকর হয়নি। এ প্রসঙ্গে আড্রাগন দি মালোর উদাহরণ স্মরণ করা যেতে পারে। বাপ মায়ের চাপে পড়ে তিনি ১১ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর লেখাপড়ার চাপে তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তাকে নিয়ে ঝগড়া করে বাপ-মায়ের বিয়ে ভেঙে যায়। স্বাভাবিকভাবে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়াশোনার সুযোগ না পাওয়ার জন্য তিনি অনুতাপ বোধ করেন। তিনি এখন লেখাপড়া ছেড়ে দোকানে বিক্রেতার কাজ করছেন। আরেকজন প্রতিভাবান ছাত্রের নাম মোশে কাই কাভালিন। আট বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। যথাসময়ে নভঃপদার্থবিদ্যা বা asrtrophysics শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।

ওপরের পর্যালোচনা থেকে দুটি অনুমানের সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমত, এটা অনুমান করা ঠিক নয় যে বাল্যকালে যারা অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন, তারাই পরবর্তী জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা হিসেবে আবির্ভূত হন। ওপরের আলোচনায় আটজন অসাধারণ অল্প বয়সের শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে এঁদের অধিকাংশই কর্মজীবনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। পক্ষান্তরে যারা শৈশবে প্রতিভার স্বাক্ষর দেখাতে পারেননি, তাঁদের অনেকেই হবেন আজকের আইনস্টাইন, প্লেটো, শেকস্‌পিয়ার ও রবি ঠাকুর। কাজেই অতি প্রতিভাবান শিশুদের শিক্ষা নিয়ে এত হইচইয়ের কারণ নেই।

দ্বিতীয়ত, শুধু পরীক্ষায় ভালো করলেই শিক্ষিত হওয়া যায় না। প্রকৃত শিক্ষার জন্য সুষ্ঠু ব্যক্তিত্বের বিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। তাড়াতাড়ি ডিগ্রি অর্জনের জন্য বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাতে তারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। ওপরে বর্ণিত আটজন প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীর মধ্যে অন্তত একজন তাড়াতাড়ি ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আরেকজন দ্রুততার সঙ্গে তাল মিলাতে ব্যর্থ হয়ে হাঁপিয়ে পড়েছেন। কাজেই শিক্ষাব্যবস্থায় ভর্তিসংক্রান্ত নিয়মকানুন পরিবর্তন করার আগে ভালোভাবে লাভক্ষতি বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে ।

৫. জন্মদিনের অর্থনীতি

অর্থনীতির চাহিদা ও জোগানের সূত্র ভবিষ্যদ্বাণী করে, ক্রেতারা যা কিনতে চায় বাজারে তারই বিকিকিনি হয় । কিন্তু প্রখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ গলব্রেথ মনে করেন যে শুধু চাহিদা জোগান সৃষ্টি করে না; পক্ষান্তরে জোগানও চাহিদার সৃষ্টি করে। যে পণ্য ক্রেতা কখনো দেখেনি, জোগানদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার চাহিদা সৃষ্টি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে একজন পণ্ডিত ঠিকই লিখেছেন, ‘To sell something to some one who wants it is not business. But to sell something you do not have to some one who does not want it that is business.’(কেউ যা চায় তা বেচাকে প্রকৃত অর্থে ব্যবসা বলা যায় না। তবে বিক্রেতার কাছে যা নেই এবং ক্রেতা যা চায় না তা বিক্রয় করতে পারাটাই আসল ব্যবসা)।

বিক্রেতাদের জন্য জন্মদিন একটি বড় সুযোগ। জন্মদিনের উৎসবে বাচ্চারা সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায়। বাপ-মায়েরাও বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য খরচের ভয়ে পিছিয়ে আসতে চায় না। যিশুর জন্মদিন তাই বাজার সৃষ্টির একটি অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে। তবে শিল্প বিপ্লবের আগে এ ধরনের সুযোগের ব্যবহার সহজ ছিল না, কেননা তখন পণ্য ও সেবার জোগান ছিল সীমিত। শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা লোককাহিনির সান্তা ক্লজকে বাজার সৃষ্টির হাতিয়াররূপে গড়ে তোলে।

পণ্ডিতেরা মনে করেন, চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের গ্রিক ধর্মযাজক সেন্ট নিকোলাসের আদলে সান্তা ক্লজ চরিত্রটি সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করে যে তিনি বাচ্চাদের উপহার দিতে ভালোবাসতেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে যখন হল্যান্ডের রমরমা অবস্থা, তখন ওলন্দাজদের মধ্যে ক্রিসমাসের আগে সেন্ট নিকোলাসের আবির্ভাব উপলক্ষে বাচ্চাদের উপহার দেওয়ার রীতি গড়ে ওঠে। তবে সারা ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায় সেন্ট নিকোলাস সান্তা ক্লজ নামে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের পর। এই সময়ে সান্তা ক্লজকে নিয়ে অনেক বই প্রকাশিত হয়। মোটা নাদুসনুদুস লাল রঙের পোশাক পরিহিত এই সাধু থাকেন উত্তর মেরুতে। তিনি নয়টি অতি দ্রুতগামী হরিণে-টানা-গাড়িতে চলাফেরা করেন। বাচ্চাদের প্রার্থিত সব উপহার তিনি ক্রিসমাসের আগের রাতে নিয়ে আসেন। চিমনি দিয়ে বাড়িতে ঢুকে তিনি বাচ্চাদের উপহার ক্রিসমাসের গাছের নিচে রেখে যান। ব্যবসায়ীরা সান্তা ক্লজের এই ভাবমূর্তিকে তাদের বিপণনের কাজে লাগান। লোক ভাড়া করে তাঁদের সান্তা সাজানো হয়। তারা মোটা হলে ভালো, না হলেও অসুবিধা নেই। পেটে বালিশ বেঁধে তাদের মোটা করা যায়। রংচঙে পোশাকে সান্তাকে দোকানে বসানো হলো। তাঁর বসার জায়গার আশপাশে তার বাহক হরিণদের মূর্তি স্থাপন করা হলো। বড় বড় দোকানে সান্তার দরবার বসানো শুরু হয়। দলে দলে বাচ্চারা দোকানে ভিড় জমায়। সান্তার বদৌলতে ব্যবসায়ীদের কামাই বেড়ে গেল। ধর্মযাজকেরা খুশি যে শিশুরা যিশুর জন্মদিন জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করায় ধর্মের প্রসার ঘটছে। বাপ-মায়েরা খুশি, বাচ্চারা আনন্দে লাফাচ্ছে। দোকানিরাও সমভাবে উপকৃত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এখানে কারও কোনো আপত্তির কারণ নেই। কিন্তু এখানে একটি বড় নৈতিক প্রশ্ন উপেক্ষা করা হচ্ছে। সান্তা চিমনি দিয়ে ঢুকে বাচ্চাদের উপহার দিয়ে যায়–এই খবরটি একেবারেই মিথ্যা। তবু প্রতিবছর ক্রিসমাসের সময় এ মিথ্যা বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে। মিথ্যার ওপর ভর করে চলছে বড়দিনের রমরমা ব্যবসা।

সান্তা ক্লজ যিশুর জন্মদিনে বিপণনের একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু জন্মদিনের বাজার অনেক বড়। সান্তা ক্লজ সাধারণ মানুষের জন্মদিনে বড় ধরনের চাহিদা সৃষ্টি করতে পারেনি। খুব কম লোকই নিজের জন্মদিনে নিজের জন্য উপহার কেনে। জন্মদিনের উপহার আসে অন্যদের কাছ থেকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই লিখেছেন, ‘নিজের জন্মদিন বৎসরের অন্য ৩৬৪ দিনের চেয়ে নিজের কাছে কিছুমাত্র বড় নয়। যদি অন্যের কাছে তার মূল্য থাকে তবেই তার মূল্য।’ এখানে একটি বড় সমস্যা হলো, অন্যরা প্রিয়জনের জন্মদিন মনে রাখতে পারে না। এ ক্ষেত্রে বাজার সৃষ্টি করতে হলে প্রিয়জনদের জন্মদিন যথাসময়ে মনে করিয়ে দিতে হবে । এ কাজটি সান্তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এত দিন সান্তা যা করতে পারেনি, তা সাফল্যের সঙ্গে এখন ইন্টারনেট করছে। ফেসবুক, টুইটার–এ ধরনের সামাজিক জাল প্রতিদিন আগে থেকে প্রিয়জনদের জন্মদিন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। উপরন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে উপহার বিপণন সহজ হয়ে যাচ্ছে। সেদিন দূরে নয়, যখন ইন্টারনেটকে ভিত্তি করে জন্মদিনের একটি সুসমন্বিত বাজার গড়ে উঠবে।

ব্যক্তির জন্য সঠিক জন্মতারিখ গুরুত্বপূর্ণ না হলেও রাষ্ট্রের জন্য তা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ভোটাধিকারের জন্য সঠিক জন্মদিন জানা দরকার । শিশু অধিকার নিশ্চিত করার জন্য জন্মের তারিখ জানতে হবে । শিশু ও বৃদ্ধদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সম্ভাব্য উপকারভোগীদের সঠিক জন্মতারিখের প্রয়োজন। তাই আধুনিক রাষ্ট্রে জন্মনিবন্ধন-ব্যবস্থা রাষ্ট্রের খরচে গড়ে তোলা হচ্ছে। আবার ব্যবসায়ীরাও সঠিক জন্মতারিখ সম্পর্কে উপাত্ত চায়। তাদের বিপণন রণকৌশলের জন্য জন্মতারিখ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ীরা জানতে চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের জন্মদিন নিয়ে আগ্রহ নেই। তাই আইন করে ব্যক্তিকে বাধ্য না করলে জন্মদিন নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না।

৬. উপসংহার,

বাংলা প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘জন্ম মৃত্যু বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে।’ অর্থাৎ জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ে–এ তিন ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করেন বিধাতা, এতে মানুষের কোনো হাত নেই। বাঙালিদের এ আপ্তবাক্যের সারবত্তা মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা মানেন না। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্যারি এস বেকার (১৯৭৬) মনে করেন যে বিয়ে ও জন্ম অর্থনীতির সূত্র মেনে চলে। বিধাতার খেয়ালিপনা বিয়ে ও জন্মের নিয়ামক নয়। কপাল ভালো, অর্থনীতিবিদেরা এখন পর্যন্ত আজরাইলকে রেহাই দিয়েছেন। মৃত্যুর মতো রসকষহীন বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে বিয়ে ও সন্তান উৎপাদন সম্পর্কে গ্যারি এস বেকারের বক্তব্য হলো, ব্যক্তির আয়-ব্যয় ও লাভ-ক্ষতি হচ্ছে এসব বিষয়ের নিয়ামক। বেকার মনে করেন, সন্তান হচ্ছে একটি বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগের ব্যয় হচ্ছে গর্ভকালে মায়ের আয় হ্রাস, বাচ্চা প্রতিপালনের ব্যয়, বাচ্চাকে শিক্ষিত করার ব্যয় ইত্যাদি। অন্যদিকে বাচ্চা পয়দার আয় শুধু বৃদ্ধ বয়সে অসমর্থ পিতা-মাতাকে আর্থিক সাহায্যে সীমাবদ্ধ। নয়। বাচ্চাকে মানুষ করার যে অনাবিল আনন্দ, তাকেও একধরনের মানসিক আয় গণ্য করা যেতে পারে। যদি বাচ্চা উৎপাদনের ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হয়, তবেই বাচ্চার জন্ম হয়। এ বিষয়ে আরেক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ টি ডাবলু শুলজ (১৯৭৪) একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে অর্থনীতির তত্ত্ব কারা বাপ-মা হতে চাইবেন, সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। কিন্তু তারা কখন তাদের বাচ্চার জন্ম দেবেন, সে সম্পর্কে তাদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হয়নি।

অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন যে যখন রাত্রি দীর্ঘ হয় তখন নরনারীর মিলন সহজ হয়। তাই দীর্ঘ রজনীর নয় মাস পর সেপ্টেম্বরে আমেরিকাতে বাচ্চা জন্মের হিড়িক পড়ে যায়। ১৬ সেপ্টেম্বর সবচেয়ে বেশি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। তবে শীতকালে রাত বড় শুধু এই কারণে নরনারীর মিলন বেড়ে যায়, এই অনুমান সঠিক নয়। শীতকালের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে শীতকালে মানুষ ঘরে আবদ্ধ থাকে। এর ফলে নরনারীর মিলন সহজ হয়। ভারতে তাই বিশ্বাস করা হয়, নরনারীর সর্বাধিক মিলন ঘটে বর্ষাকালে। কালিদাস থেকে রবি ঠাকুর–সব কবিই বর্ষার সঙ্গে প্রেমের ও কামের সংযোগ দেখতে পেয়েছেন। তবে বর্ষা শুধু আষাঢ়-শ্রাবণে সীমাবদ্ধ। নয়। নরনারীর এ মৌতাত শরৎ অবধি গড়ায়। তাই তো বৈষ্ণব কবি লিখেছেন, ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর। অবশ্য ভারত ও বাংলাদেশের জন্মদিনের বিশ্লেষণ করলে জন্মের তারিখের ওপর বর্ষার কোনো তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব দেখা যায় না।

সরকারি দলিল-দস্তাবেজে যে জন্মতারিখ দেখা যায় তা কতটুকু সঠিক, তা নিয়ে তর্কের অবকাশ রয়েছে। স্পষ্টতই, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের জন্মতারিখ মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়। বাংলাদেশে জানুয়ারি মাসে ২০ ভাগের বেশি মানুষের জন্ম হওয়া অস্বাভাবিক। তবে ভারতে জন্মদিন সম্পর্কে প্রাপ্ত উপাত্তগুলি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। ভারতের অনেকেরই কুষ্ঠি আছে। তাই তারা সঠিক জন্মতারিখ জানেন। ভারতীয়দের জন্মদিন অধিক নির্ভরযোগ্য মনে হয়। তবে নির্ভরযোগ্য জন্মতারিখ নিশ্চিত করার জন্য জন্ম নিবন্ধনের বিকল্প নেই।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ও অবসরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় বয়ঃসীমা-সংক্রান্ত নিয়মাবলির মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক আমলে বয়ঃসীমা নির্ধারণের প্রধান নিয়ামক ছিল সরকারের রাজনীতি। ব্রিটিশ শাসকেরা চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ সময়সীমা কমিয়ে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। এর কারণ ছিল যে ঔপনিবেশিক শাসকেরা মনে করতেন, অল্প বয়সের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়েপিটে মানুষ করা সম্ভব। কিন্তু বেশি বয়সের প্রার্থীদের চরিত্র ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট আকার ধারণ করেছে। এদের আচার-আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব নয়। বাস্তবে আধুনিক রাষ্ট্রগুলিতে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার জন্য চাকরিতে নিয়োগের বয়ঃসীমা ক্রমশ বাড়ানো হচ্ছে। উপরন্তু গড় আয়ুর প্রত্যাশা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবসর গ্রহণের সীমাও বেড়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই অবসরের জন্য কোনো নির্ধারিত বয়স নেই। কর্মচারীরা যত দিন খুশি চাকরি করতে পারেন। তবে পদ উঠে গেলে চাকরি চলে যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চাকরি করতে পারেন। আমেরিকানরা তাই বলে থাকে, বিচারকদের নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হলেও তাদের অপসারণের ক্ষমতা ভগবানের।

ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতে শিক্ষার ক্ষেত্রেও সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা প্রবর্তন করে। দুষ্ট লোকেরা বলে, শিক্ষকেরা এ ব্যবস্থাকে তাদের স্বার্থে সমর্থন করেন। প্রতিভাবান ছাত্ররা যদি ডাবল/ট্রিপল প্রমোশন নিয়ে তরতর করে পাস করে যায়, তবে বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র কমে যাবে। অনেক অভিভাবকই মনে করেন যে তাঁদের প্রতিভাবান সন্তানদের দ্রুত প্রমোশন দিয়ে ওপরের দিকে নিয়ে গেলে তারা অসাধারণ প্রতিভা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, এ ধারণা ভুল। অল্প বয়সের বাচ্চাদের অতি দ্রুত প্রমোশনের বিপক্ষে শিক্ষকদের আপত্তির কারণ রয়েছে। শিক্ষা শুধু জ্ঞান লাভের জন্য নয়, শিক্ষার একটি বড় দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। যেসব ছাত্র সাততাড়াতাড়ি ওপরের ক্লাসে উঠতে থাকে, তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় না। তাদের সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সময় থাকে না। চতুর্থ খণ্ডের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বের তরুণতম স্নাতকদের অনেকেই স্বাভাবিক শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে পরবর্তী জীবনে অনুশোচনায় ভুগেছেন। পক্ষান্তরে বিশ্বের তরুণতম স্নাতকেরা কেউই এখন পর্যন্ত কেষ্টবিষ্ট হননি। বাঙালি মনীষীরা অনেক আগেই বলে গেছেন, কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না। প্রতিভাবান বালকদের পিতামাতারা এ আপ্ত বাক্য মনে রাখলে উপকৃত হবেন।

জন্মদিনের বাণিজ্য শুরু হয় যিশুর জন্মদিন নিয়ে। ইন্টারনেটের সম্প্রসারণের ফলে জন্মদিনের ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ অনেক বেড়ে গেছে। ইন্টারনেটে সামাজিক জালগুলিতে সবার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের জন্মদিন মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বৈদ্যুতিন বাণিজ্যের (e-commerce) মাধ্যমে সহজে পৌঁছানো যাচ্ছে উপহার। একদিকে জন্মদিন নিয়ে বাণিজ্য বাড়ছে। অন্যদিকে গড় আয়ুর প্রত্যাশা বাড়ছে। আরও বেশিদিন ধরে অনেক জন্মদিন পালন চলবে।

জন্মদিনের এই অগ্রগতির দিনে বেকায়দায় পড়েছেন আমার মতো কিছু লোক, যারা তাদের সঠিক জন্মদিন জানেন না। একজন জ্ঞানী বন্ধুর কাছে এ সম্পর্কে পরামর্শ চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে একটি গল্প শোনালেন। একজন আলেম ও একজন নাস্তিক খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নাস্তিক বন্ধুটি দুঃখ করে বলল, নাস্তিকতায় সবই ভালো, শুধু একটি অসুবিধা। নাস্তিকদের কোনো মহাপুরুষ নেই। তাই তারা মহাপুরুষদের জন্মদিনে আমোদ-আহ্লাদ করতে পারে না, যেমনটি খ্রিষ্টানরা করে যিশুর জন্মদিনে, যেমনটি হিন্দুরা করে কৃষ্ণের জন্মদিনে, যেমনটি মুসলমানেরা করে ঈদে মিলাদুন্নবিতে। আলেম সাহেব বললেন, ‘তোমাদের যখন কোনো মহাপুরুষও নেই, জন্মদিনও নেই, তখন তোমরা ১ এপ্রিলে বিশ্ব বেকুব দিবস (All Fools Day) পালন করো।’ আমি জ্ঞানী বন্ধুর পরামর্শ বুঝতে পারি, তবে আমি তার কথা শুনিনি। যদি জন্মদিন না হওয়া সত্ত্বেও যিশু ও জিন্নাহর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর প্রতিপালিত হতে পারে, তবে আমার জন্মদিনও ২৫ ডিসেম্বরেই হবে–এই আমার অসিয়ত ।

.

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

ওয়ালপার্ট, স্ট্যানলি (Wolpert, Stanley)। ১৯৯৪। Jinnah of Pakistan. New York: Oxford University Press.

কালিদাস। ১৯৯৯। মেঘদূত। অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু। ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স।

চৌধুরানী, সরলাদেবী। ২০০৯। জীবনের ঝরাপাতা। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং।

বেকার, গ্যারি এস (Becker, Gary S.)। ১৯৭৬। The Economic Approach to Human Behavior. Chicago: Chicago University Press.

ব্যানার্জি, অভিজিৎ ভি এবং এসথার ডাফলো। (Banerjee, Abhijit V. and Esther Duflo) । ২০১১ । Poor Economics. Norda: Random House, India.

ম্যাকগোয়ান, অ্যান্ড্রু (McGowan, Andrew)। ২০০৯। How December 25 became Christmas. www.Plaintruthmagazine. Blogspot. Com/2009/12.

ম্যাডিসন, অ্যাংগাস (Angus Maddison। ২০০১, The World Economy: A Millennial Perspective. Paris: OECD.

রেমন্ড, কিল্ডাফ (Raymond, Kilduff)। ১৯৮৬। The Christian Tradition: The Birthday of The Sun’. The Sun Francisco Jung Institute Library Journal. Vol. 6. No. 2.

শুলজ, টি, ডাবলু। (Schultz, T.w.)। (সম্পাদিত)। ১৯৭৪। Economics of the Family. Marriage, Children and Human Capital. Chicago and London: University of Chicago Press.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *