০৪. ভেগোলজি ও অর্থনীতি : ‘না মিথ্যা, না সত্য’

ভেগোলজি ও অর্থনীতি : ‘না মিথ্যা, না সত্য’

বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা অর্জনের জন্য কোন ধরনের গুণাবলির প্রয়োজন, সে সম্পর্কে নানা মত রয়েছে। পল জনসন (১৯৮৮) ১৩ জন বুদ্ধিজীবী নিয়ে Intellectuals নামে একটি বই লিখেছেন। এই বইয়ের নির্ঘষ্টে বুদ্ধিজীবীদের নিম্নোক্ত গুণাবলি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে : মাদকাসক্তি, পরিবারের প্রতি ঔদাসীন্য, সমকাম, মুনাফেকি, প্রতারণা, কৃতঘ্নতা, নিষ্ঠুরতা ও অসহিষ্ণুতা। তবে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হওয়ার জন্য এত সব বদ খাসিয়তের প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হওয়ার জন্য দুটি গুণই যথেষ্ট। প্রথমত, বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হতে হলে আড্ডাবাজ হতে হবে। ডেনমার্কের রাজপুত্র ছাড়া যেমন হ্যামলেট নাটক সম্ভব নয়, তেমনি আড্ডাবাজ না হয়ে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীর শিরোপা অর্জন অকল্পনীয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হতে হলে ‘ভেগোলজি’তে পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। ভেগোলজির অস্পষ্টতাতেই বাঙালি মনীষার দীপ্তি ঘূর্তি লাভ করে।

আজ্ঞা ও ভেগোলজি দুটি বিষয়েই পারদর্শী হিসেবে প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন পরিমল রায়। স্বর্গীয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক। তার বড় গুণ হলো, তিনি ছিলেন মহা আড্ডাবাজ। সঙ্গে সঙ্গে ভেগোলজি সম্পর্কেও ছিল তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান। সৈয়দ মুজতবা আলী নিজেকে গুলের আলমগীর বা গুলমগীর বলে দাবি করেছিলেন। অনুরূপভাবে পরিমল রায়ের খেতাব হওয়া উচিত বাবায়ে ভেগোলজি।

রায়ের আড্ডার সূচনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু দেশ বিভাগের ডামাডোলে তিনি ঢাকা থেকে ছিটকে পড়তে বাধ্য হন। একপর্যায়ে তিনি দিল্লিতে ডেরা বাঁধেন। সেখানে আড্ডার বিবরণ অশোক মিত্র (২০০৩, ৩৮) তার আত্মজীবনী আপিলা চাপিলা বইয়ে লিখেছেন। তবে জীবিকার প্রয়োজনে শেষ পর্যন্ত তিনি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে চাকরি নেন। কিন্তু ঢাকার আড্ডা দিল্লিতে স্থানান্তর সম্ভব হলেও পঞ্চাশের দশকে নিউ ইয়র্কে বাঙালি কায়দায় আড্ডা বসানো সম্ভব ছিল না। দুঃখ করে শিষ্য অশোক মিত্রকে তিনি নিউ ইয়র্ক সম্পর্কে লিখলেন, ‘অশোক এ দেশে গরুতেও থাকে না।’ আড্ডাবিহীন নিউ ইয়র্কে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান।

১. ভেগোলজির উৎপত্তি ও বিকাশ

বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক রায় আড্ডার শোকে অকালে ঝরে পড়লেও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসে তার একটি অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তিনি হলেন ভেগোলজি তত্ত্বের জনক। লাতিন ভেগাস (পথবিলাস) ও logos (বিজ্ঞান) শব্দ দুটি মিলিয়ে তিনি ভেগোলজি’ শব্দটি পয়দা করেন। তাঁর মতে, ভেগোলজির বাংলা প্রতিশব্দ হলো সন্ধ্যাবিদ্যা অথবা আলো-আঁধারি বিদ্যা। এটি এমন ধরনের বিদ্যা, যার কিছুটা বোঝা যায় এবং অনেকটাই অনধিগম্য থেকে যায়। ভেগোলজি ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, যেখানে গন্তব্য নেই অথচ গগন আছে, ক্ষুধা নেই অথচ ভুঞ্জন আছে, বক্তব্য নাই কিন্তু বাক্য আছে–অর্থাৎ যেখানে যাবতীয় সন্ধান, বিকৃত মনোবৃত্তির ঊর্ধ্বে লক্ষ্য নিরপেক্ষ নভোচারী চিলের মতো কেবল ভাসিয়া বেড়াইবার উৎসাহ আছে। সেখানেই ভেগোলজির প্রকৃষ্ট প্রকাশ’ (রায়, ২০০৩ (পুনর্মুদ্রণ, ৩৫৫)। এখানে অধ্যাপক রায় গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করেছেন; ভেগোলজির ভাষাতেই ভেগোলজির সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন।

পরিমল রায় ভেগোলজি তত্ত্বের জনক। তবে বাংলাদেশে ভেগোলজি কোনো অভিনব বিষয় নয়। এর উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলার সুপ্রাচীন। ঐতিহ্যে। সান্ধ্য বিদ্যার চল ছিল প্রাচীন বাংলায়। সান্ধ্য বিদ্যা রচিত হতো সান্ধ্য ভাষায়। সান্ধ্য ভাষা গোধূলিলগ্নের মতো অস্পষ্ট। ধর্মের গূঢ়তম তত্ত্বগুলি আলো-আঁধারি ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ এর বিকৃত ব্যাখ্যা না করতে পারে। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাগীতি সান্ধ্য ভাষায় রচিত। এর বক্তব্যে রয়েছে আলো-আঁধারের সংমিশ্রণ, যার কিছুটা বোঝা যায় আর অনেকটাই বোঝা সম্ভব নয়। তবে চর্যাপদে এই অস্পষ্টতার অত্যন্ত সুন্দর দার্শনিক ব্যাখ্যা রয়েছে। লুই পাদ লিখেছেন,

জাহের বাণ চিহ্ন রূব ণ জানী
সো কইছে আগম বেএঁ বখানী।
কাহেরে কিস ভণি মই দিবি পিরিচ্ছা
উদক চান্দ জিম সাচ ন মিচ্ছা।।

(সরকার, ২০০১, ৯৯)।

অধ্যাপক সুকুমার সেন শ্লোকটির নিম্নরূপ অনুবাদ করেছেন :

যার রঙ চিহ্ন রূপ কেহ নাহি জানে
কিরূপে তাহারে বেদে শাস্ত্রেতে বাখানে।
জলেতে চাঁদের ছবি না মিথ্যা না সত্য।

(অনুবাদ : সুকুমার সেন, ১৯৭৮, ৫৮)

লুইপাদ বলছেন যে চূড়ান্ত সত্য ভগবান। তাঁর রং, রূপ, চিহ্ন নিয়ে আমরা কিছু জানি না, কাজেই বেদ বা শাস্ত্রের ভিত্তিতে ভগবানকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। তেমনি বাস্তব জীবনে আমরা অনেক কিছু দেখি–যা না সত্য, না মিথ্যা। যেমন জলেতে চাঁদের ছবি। অবশ্যই জলের ভেতরে চাঁদ নেই। কেউ যদি বলে যে জলের ভেতর চাঁদ রয়েছে তবে সে মিথ্যা বলছে। অথচ জলের ওপর চাঁদের প্রতিবিম্বও সত্য। এ ধরনের অনেক ক্ষেত্রেই সত্য আর মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ করা সম্ভব নয়। কাজেই ভেগোলজির অস্পষ্টতা মুনাফেকি নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে বাস্তব।

শুধু দার্শনিক কারণে নয়, বাঙালি চরিত্রেই অস্পষ্টতার দিকে ঝোঁক রয়েছে। মধ্যযুগের পুঁথিকাররা লিখেছেন, ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, একুনে শুমার হইল চল্লিশ হাজার’। এখানে কবি লাখ আর হাজারের তফাতই বোঝেন না। তাই বক্তব্যের অসামঞ্জস্যতা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই।

ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে অজ্ঞানতা হচ্ছে ভেগোলজির একটি বড় কারণ। কোথাও কোথাও এই অজ্ঞানতা স্পষ্ট (যেমন পুঁথিতে লাখের সঙ্গে হাজার গুলিয়ে ফেলা)। আবার কোথাও কোথাও ভেগোলজি অজ্ঞতাকে ঢেকে দেয়। এ ধরনের ভেগোলজির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হিং টিং ছট’ কবিতায়। গৌড়ীয় পণ্ডিত হিং টিং ছট শব্দগুলির নিম্নরূপ ব্যাখ্যা দেন :

…নিতান্ত সরল অর্থ, অতি পরিষ্কার–
বহু পুরাতন ভাব, নব আবিষ্কার।
ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ
শক্তিভেদে ব্যক্তিভেদে দ্বিগুণ বিগুণ।
বিবর্তন আবর্তন সম্বৰ্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী।
আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি
আণব চৌম্বক বলে আকৃতি বিকৃতি।
কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত।
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট,
সংক্ষেপে বলিতে গেলে–হিং টিং ছট্‌।

এখানে পণ্ডিত হিং টিং ছটের তাৎপর্য জানেন না। তার অজ্ঞতাকে পাণ্ডিত্যের আড়ালে ঢাকার জন্য অর্থপূর্ণ শব্দ এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে মনে হবে তিনি অনেক কিছু বলছেন। পণ্ডিতদের এ ধরনের বক্তব্য নিয়ে পরিমল রায়ও লিখেছেন। এক পণ্ডিতকে প্রশ্ন করা হলো, গ্রিক কালচার আর ইন্ডিয়ান কালচারের মধ্যে তফাতটা কী? পণ্ডিত বোর্ডে দুটি লাইন টেনে বললেন যে ধরা যাক, এই লাইনটি গ্রিক কালচার আর অপর লাইনটি ইন্ডিয়ান কালচার। এবার তিনি জবাব দিলেন, ‘বেশ। এখন কথা হচ্ছে কী জানেন? গ্রিক কালচার অর্থাৎ এইটেতে এমন একটি বস্তু আছে, যা ইন্ডিয়ান কালচারে অর্থাৎ এইটেতে নেই। বুঝলেন কিনা। আবার ইন্ডিয়ান কালচারে অর্থাৎ এইটেতে এমন একটি জিনিস আছে যা গ্রিক কালচারে বা এইটেতে নেই।’

তবে ভেগোলজি শুধু পণ্ডিতদের ভাবমূর্তি রক্ষার ব্রহ্মাস্ত্র নয়। রাজনীতিবিদেরাও একে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহু লোককে খুশি করা সহজ। উপরন্তু অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি সম্ভব কি না, সে সম্বন্ধেও প্রশ্ন ওঠে না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের একটি বড় অস্ত্র হচ্ছে যে কোনো সমস্যা দেখা দিলেই তাঁরা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, সমস্যার সমাধান হচ্ছে বা হবে। হচ্ছে-হবের মানেই হচ্ছে আদতে কিছুই হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভেগোলজিকে বিদ্রূপ করে তাই অন্নদাশঙ্কর রায় ছড়া লিখেছেন :

সব পেয়েছির দেশে নয়
হচ্ছে হবের দেশে
কাঁঠাল গাছে আম ধরেছে
খাবে সবাই শেষে।
দুধের বাছা, কাঁদে কেন
হচ্ছে হবের দেশে
গোরুর বাটে মদ নেমেছে
খাবে সবাই হেসে।
হাত পা কেউ নাড়বে নাকো
হচ্ছে হবের দেশে।
ফাইল জমে পাহাড় হলে
প্ল্যানগুলো যায় ফেঁসে।
কারখানাতে ঝুলছে তালা
হচ্ছে হবের দেশে।
মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে
বক্তৃতা দেয় ঠেসে।
মনের কথা লুকিয়ে রাখে
হচ্ছে হবের দেশে
সবাই ভাবে পেয়ে যাবে।
সব কিছু অক্লেশে।
লক্ষ্মী সোনা ভয় পেয়ো না
হচ্ছে হবের দেশে
হাজারটা দল বাজায় মাদল
বিপ্লবীর বেশে।

রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা ভেগোলজির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। এ ধরনের বক্তৃতার একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন পরিমল রায়। বক্তৃতাটি নিম্নরূপ :

মানে আপনারা এদিক থেকে এই করতে থাকুন। আর আমরা ওদিক থেকে ওই করতে থাকি। আপনারা যদি এটুকু করেন, তাহলে আপনাদের কাছ থেকে আমাদের এতে একটি সত্যিকারের সাহায্য হবে। মানে, বাংলাদেশের যে অবস্থা, বুঝতে পেরেছেন। এখন যদি আমরা এটা না করি তাহলে মানে, এদের ব্যাপারটি তো বুঝতে পারছেন? এরা দেবে না। কিন্তু দেবে না বললেই তো আমরা এ করতে পারি না। আমাদের কেড়ে নিতে হবে।

এখানে বাক্য অনেক আছে, কিন্তু অর্থ কিছু নেই। দুষ্ট লোকেরা বলে যে এ ধরনের বক্তৃতা শুনেই রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন :

অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি ৷।

অনুমান করি, আলো-আঁধারি বক্তব্যের ছড়াছড়ির জন্যই বিভিন্ন দেশে রাজনীতিবিদদের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায় ।

২. ভেগোলজির দার্শনিক পটভূমি

পরিমল রায় মারা যাওয়ার পর অবশ্য উভয় বাংলাতেই ভেগোলজি চর্চায় ভাটা পড়েছে। তবে বিদেশে এ ধরনের শাস্ত্রচর্চায় অনেক নতুন গবেষণা হয়েছে। ‘ভেগোলজি’ শব্দটি এখনো ইংরেজি ভাষায় ঢুকতে পারেনি। তবে দর্শনচর্চায় আবোলতাবোলের গুরুত্ব প্লেটোর সময় থেকেই স্বীকৃত। প্লেটো যথার্থই মনে করতেন যে মিথ্যা না থাকলে সত্যের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে জরথুস্ত্র বলতেন যে শুভ (Ahura Mazda) ও অশুভ (Ahriman) দুই-ই যমজ। এরা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্লেটো লিখেছেন, ‘Serious things cannot be understood without laughable things, nor opposites at all without opposites.? (5599 বিষয় ছাড়া গুরুগম্ভীর বিষয় বোঝা সম্ভব নয়, যেমনি বিপ্রতীপ ছাড়া পরস্পরবিরোধী অবস্থানের উপলব্ধি সম্ভব নয়)। দর্শনের সুস্থ চর্চার জন্য তাই ভেগোলজি বোঝার প্রয়োজন রয়েছে।

অর্থহীন আবোলতাবোল নিয়ে বিগত শতকে তিনজন দার্শনিক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। একজন হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিটগেনস্টাইন। তিনি বিষয়টির ওপর কোনো স্বতন্ত্র বই লেখেননি, তবে সাধারণভাবে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় জন হচ্ছেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাক্স ব্লাক। এ সম্পর্কে ব্ল্যাক (১৯৮৩) The Prevalence of Humbug and other Essays’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। তৃতীয় দার্শনিক হলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যারি জে ফ্রাঙ্কফার্ট। ২০০৫ সালে প্রকাশিত তার বইয়ের নাম On Bullshit। লক্ষণীয় যে এরা অর্থহীন আবোলতাবোল অর্থে ইংরেজিতে তিনটি স্বতন্ত্র শব্দ ব্যবহার করেছেন। ভিটগেনস্টাইন চিরাচরিত Nonsense’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। ব্ল্যাক এর নাম দিয়েছেন ‘Humbug’। আর ফ্রাঙ্কফার্ট বলছেন bullshit i

দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভেগোলজি বুঝতে হলে ‘ননসেন্স’, ‘হামবাগ’ ও ‘বুলশিট’ তিনটি শব্দেরই তাৎপর্য বুঝতে হবে। বাংলা একাডেমীর ইংরেজি বাংলা অভিধানে nonsense-এর নিম্নরূপ বাংলা করা হয়েছে : ‘অর্থহীন শব্দ, নির্বোধ কথাবার্তা, আগড়ম-বাগড়ম, আলাৎ পালাৎ’। হামবাগ (humbug) শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, হামবাগ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে জার্মান শহর হামবুর্গ থেকে। মধ্যযুগে এ শহর থেকে ইউরোপ মহাদেশে বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধ সম্পর্কে মিথ্যা গুজব ছড়ানো হতো। তাই গুলবাজির নাম করা হয় হামবাগ। আবার কেউ কেউ বলেন, আয়ারল্যান্ডে দুনম্বরি মুদ্রাকে বলা হতো uimbog। এই আইরিশ শব্দটি থেকেই হামবাগ শব্দটি এসেছে। কারণ যা-ই হোক, হামবাগ শব্দটি এখন অভিধানে ঠাই পেয়েছে। বাংলা একাডেমীর ইংরেজি-বাংলা অভিধানে humbug শব্দটির নিম্নরূপ তরজমা করা হয়েছে : ‘দমবাজি, ধোঁকাবাজি, কৌতব, দমবাজ, ধোকাবাজ’।

তবে bullshit শব্দটি নিয়ে সমস্যা আছে। বেশির ভাগ অভিধানে এর ঠাই হয়নি। আসলে শব্দটি নোংরা নয়। এখানে bull শব্দটি ষাঁড় অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, বুল’ শব্দটির আরেকটি অর্থ হলো nonsense বা অর্থহীন; আবোলতাবোল । শব্দটি এই অর্থে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাবাহিনীতে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে মার্কিন সেনারাই বুল’ শব্দটির সঙ্গে ‘শিট’ শব্দটির সংযোগ ঘটায়। বিষ্ঠা অর্থে মার্কিন সেনা বাহিনীতে shit একটি জনপ্রিয় লফজ। বড় অর্থে বাঙালিরা যেরূপ ছাগলের আগে রাম শব্দটি যোগ করে রামছাগল বলে, তেমনি মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা কোনো কিছু খারাপ মনে করলে বলে ‘শিট’। মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে পড়ে ‘বুল’ হয়ে গেল ‘বুলশিট’ বা (বিষ্ঠার মতো) জঘন্য অর্থহীন। তবে বুলশিট শব্দটি পাতে তুলতে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমী বা কলকাতার সাহিত্য সংসদ রাজি হয়নি। অবশ্য গৌরীপ্রসাদ ঘোষ তাঁর Everyman’s Dictionary English-Bengali-60 Japoyo wanfo অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বুলশিটের নিম্নরূপ অনুবাদ করেছেন : ‘(অশ্লীল) ফালতু কথা, ষাঁড়ের গোবর’ । ফালতু শব্দটির এখানে প্রাসঙ্গিকতা থাকলেও, ষাঁড়ের গোবর প্রতিশব্দটি একেবারেই ফালতু। ঘোষমশাই গবাদিপশুর লিঙ্গভেদে বিষ্ঠার তফাত কীভাবে করেন জানি না। তবে গাভিরই হোক বা ষাঁড়েরই হোক, বিষ্ঠার জন্য গোবর শব্দটি যথেষ্ট। এখানে লিঙ্গভেদের প্রশ্ন না তোলাই ভালো।

ইংরেজি nonsense, humbug এবং bullshit–এই তিনটি ধারণার মধ্যে একমাত্র মিল হলো যে প্রতিটি শব্দই অর্থহীন ও আবোলতাবোল অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে এদের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও রয়েছে। ‘ননসেন্স’ শব্দটি অপেক্ষাকৃত নির্মল । ননসেন্স নিছক আবোলতাবোল; এর মধ্যে কোনো মতলববাজি নেই। হামবাগ’ শব্দে আবোলতাবোলের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। আর ‘বুলশিট’ হচ্ছে জঘন্য ধরনের মিথ্যাচার। যেখানে জঘন্য মিথ্যা বলা হয় সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুমতলব থাকে। কাজেই ‘হামবাগ’ আর ‘বুলশিট’ কাছাকাছি শব্দ। এদের মধ্যে হামবাগ কম জঘন্য আর বুলশিট সবচেয়ে জঘন্য।

প্রথমে ননসেন্স নিয়ে শুরু করি । nonsense poems ইংরেজি ও বাংলা উভয় সাহিত্যেই সম্মানজনক স্বীকৃতি লাভ করেছে। উদাহরণস্বরূপ নিচে দুটি ইংরেজি ননসেন্স কবিতা উদ্ধৃত হলো। প্রথম উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে লুই ক্যারলের একটি কবিতা থেকে :

Twas brilling and slithy toves
Did gyre and gimble in the wabe
All mimsy were the borogoves
And mome raths outgrabe.

দ্বিতীয় উদাহরণটি নেওয়া হয়েছে স্পাইক মিলিগানের কবিতা থেকে :

On the Ning Nang Nong
Where the cows go bong!
And the monkeys all say Boo!
There’s a Nong Nang Ning.

এ দুটি কবিতায় কিছু অর্থপূর্ণ শব্দ থাকলেও অধিকাংশ শব্দ অর্থহীন। তাই এসব কবিতাকে আপাতদৃষ্টিতে অর্থপূর্ণ মনে হলেও আসলে এরা অর্থহীন। নেহাত ধ্বনি সৃষ্টির জন্য কিছু অর্থহীন শব্দ একত্র করা হয়েছে।

আবার কোনো কোনো কবিতায় সব শব্দের অর্থ আছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে কবিতাটির কোনো অর্থ নেই। সুকুমার রায় বাংলায় এ ধরনের কবিতা লিখেছেন। যেমন ধরুন, নিচের কবিতাটি :

শুনেছো কি বলে গেলো সীতানাথ বন্দ্যো?
আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ?
টক টক থাকে নাকো হলে পরে বৃষ্টি–
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি।

এখানে প্রত্যেকটি শব্দের অর্থ আছে। কিন্তু পুরো কবিতাটি স্রেফ গুল । আকাশের কি গন্ধ আছে? কারও পক্ষে সে গন্ধ চাটা কি সম্ভব? কবিতাটি যে অর্থহীন তা কাউকে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অথবা নিচের কবিতাটি উপভোগ করলেও কেউ এর অর্থ খুঁজতে যাবে না :

মাসি-গো মাসি পাচ্ছে হাসি
নিম গাছেতে হচ্ছে শিম
হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা
কাগের বাসায় বগের ডিম।

সুকুমার রায়ের কবিতায় কোনো অস্পষ্টতা নেই। রায়ের পাঠককে কখনো বলে দিতে হবে না যে তার বক্তব্য উদ্ভট। বরং উদ্ভট বলেই আমাদের তা আওড়াতে ইচ্ছে করে :

যে সব লোকে পদ্য লেখে
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে
কানের কাছে নানান সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে
সামনে রেখে মুদির খাতা–
হিসাব কষায় একুশ পাতা।

‘আবোলতাবোল’ কবিতায় অর্থ না থাকলেও শব্দের ফুলঝুরি রয়েছে। বক্তব্য না থাকলেও শব্দের মূৰ্ছনা আমাদের মোহিত এবং আনন্দিত করে। ননসেন্স’ রচনা হচ্ছে নির্মল ভেগোলজি। এখানে বক্তব্যে আলো-আঁধারের অস্পষ্টতা আছে, তবে কোনো ফেরেববাজি নেই।

নির্দোষ ভেগোলজির উদাহরণ হচ্ছে ‘ননসেন্স’ আর ফেরেববাজ ভেগোলজি হলো হামবাগ’ ও ‘বুলশিট’। অধ্যাপক ব্ল্যাকের সংজ্ঞা অনুসারে 7455 260g: ‘Deceptive misrepresentation short of lying, especially by pretentious word or deed, of somebody’s own thoughts, feelings or attitudes.’ (প্রবঞ্চনামূলক অসৎ উপস্থাপন যা মিথ্যা নয়, তবে মিথ্যার কাছাকাছি এবং যাতে বক্তার চিন্তা, অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গি চালবাজ ভাষায় ও কর্মে প্রকাশিত)। এ সংজ্ঞা অনুসারে অর্থহীন আবোলতাবোলের বা হামবাগের চারটি বিশেষত্ব রয়েছে।

ফেরেববাজ ভেগোলজি বা হামবাগের প্রথম শর্ত হলো এতে প্রবঞ্চনার অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে হবে। না জেনে অথবা প্রতারণার মতলব ছাড়া ভ্রান্ত উপস্থাপনকে এই সংজ্ঞা অনুসারে bullshit বা humbug বলা যাবে না। ভিটগেনস্টাইন এ মতের সঙ্গে একমত নন। তাঁর মতে, ভেবেচিন্তে কিছু না বললে, মতলব যা-ই হোক না কেন, তা অসৎ উপস্থাপন।

ভিটগেনস্টাইনের এ মত সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। ভিটগেনস্টাইনের বান্ধবী ফানিয়ার একবার টনসিল অপারেশন হয়। ভিটগেনস্টাইন তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যান ও জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন লাগছে?’ ফানিয়া উত্তর দিলেন, ‘গাড়ি চাপা পড়লে কুকুরের যেমন লাগে তেমন।’ ভিটগেনস্টাইনের মতে, এ উক্তি অর্থহীন আবোলতাবোল । ফানিয়া কুকুর নন। গাড়ি চাপা পড়লে কুকুরের কেমন লাগে, ফানিয়া তা জানেন না। কাজেই তার উক্তি নিজেকে গাড়ির নিচে চাপা পড়া কুকুরের মতো লাগছে সম্পূর্ণ অর্থহীন বা ননসেন্স। অধ্যাপক ব্ল্যাক বা ফ্রাঙ্কফার্ট এ মতের সঙ্গে একমত নন। তাঁদের মতে, এখানে ফানিয়ার পক্ষ থেকে কোনো ছলনা বা প্রতারণা নেই। ফানিয়া তাঁর নিজস্ব অনুভূতি সম্পর্কে সত্য কথা বলেছেন। বিভিন্ন রূপে সত্যের উপস্থাপন সম্ভব।  

দ্বিতীয়ত, ব্ল্যাকের মতে, চালবাজ বা ভণ্ডামিপূর্ণ কথা বা কাজ হচ্ছে ফেরেববাজ আবোলতাবোলের আরেকটি লক্ষণ। কিন্তু ব্ল্যাক নিজেই স্বীকার করেছেন যে ভণ্ডামি প্রায়শ দেখা যায়, তবে সব সময় তা না-ও ঘটতে পারে। এর ব্যতিক্রমও ঘটতে পারে। কোনো কোনো সময়ে অজ্ঞতার কারণেও আবোলতাবোল বলা সম্ভব। আবার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়াও আবোলতাবোল বলার ঘটনা ঘটতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসে একজন নেতা বলেছেন, আমাদের মহান ও আশীর্বাদপুষ্ট দেশে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-জনকেরা ঐশী নির্দেশে মানবজাতির জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। এখানে কোনো প্রমাণ নেই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা ঐশী নির্দেশ পেয়েছেন। তবে বক্তব্যটি সত্য না হলেও এতে কোনো খারাপ মতলব নেই। আবার এ বক্তব্যকে ননসেন্সও বলা যাবে না।

তৃতীয়ত, ব্ল্যাকের মতে, আবোলতাবোল সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়। তবে মিথ্যার কাছাকাছি। মূল সমস্যা হলো, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ফারাক করা অনেক সময় শক্ত হয়ে ওঠে। ধরুন, করিম রহিমের শত্রু। গ্রামে আজিজ খুন হলো। গ্রামের লোকেরা সন্দেহ করছে আসমত এ খুনের জন্য দায়ী। কিন্তু কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই করিম অভিযোগ করল যে রহিম এ খুনের জন্য দায়ী। করিম মনে মনে জানে, সে মিথ্যা বলছে। পরে পুলিশি তদন্তে দেখা গেল, আসলে রহিম এ কাণ্ড করেছে। প্রশ্ন হলো। করিম কি সত্য বলছে, না মিথ্যা বলছে? করিম মনে মনে জানত, সে শত্রুতা করে মিথ্যা বলছে। অথচ বাস্তবে সে সত্য কথা বলেছে। আমরা যদি এ ক্ষেত্রে ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের যুক্তি গ্রহণ করি, তবে করিম সত্য কথা বললেও সে মিথ্যার চেয়েও খারাপ কাজ করেছে। ব্ল্যাক লিখেছেন :

A truth that is told with bad intent
Beats all the lies you can invent.

(অসৎ উদ্দেশ্যে বলা সত্য কল্পনা করা যায় এমন সব মিথ্যার চেয়েও নিকৃষ্ট।) চতুর্থত, ব্ল্যাক বলছেন যে ‘হামবাগে’ বক্তার চিন্তা, অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। এ বক্তব্যও সব সময় সঠিক না হতে পারে। এসব বিষয় সম্পর্কেও বক্তা প্রতারণা করতে পারে।

ওপরের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে ব্ল্যাক চালবাজ ভেগোলজির যে। সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন তা অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট নয়। তবে এ সংজ্ঞার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মিথ্যার সঙ্গে ভেগোলজি বা হামবাগ বা বুলশিটের সম্পর্ক। বাইরে থেকে মিথ্যা ও সত্যের ফারাকটা সহজ মনে হলেও আসলে এদের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। সেন্ট অগাস্টিন নিম্নলিখিত আট ধরনের মিথ্যা চিহ্নিত করেছেন :

• ধর্মের শিক্ষা সম্পর্কে মিথ্যা

• যে মিথ্যা অন্যের অপকার করে কিন্তু কারও উপকারে লাগে না

• যে মিথ্যা অন্যের অপকার করে তবে কারও উপকারে লাগে

• মনের আনন্দে মিথ্যা বলা

• অন্যদের খুশি করার জন্য মিথ্যা বলা।

• যে মিথ্যা কারও অপকার করে না অথচ কারও জীবন রক্ষা করে

• যে মিথ্যা কারও অপকার করে না অথচ কাউকে সাহায্য করে

• যে মিথ্যা কারও ক্ষতি করে না অথচ কারও উপকার করে।

ওপরের তালিকার আট ধরনের মিথ্যার মধ্যে সাত ধরনের মিথ্যা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে বলা হয়। নিজস্ব ধর্মীয় মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ধর্মের শিক্ষা সম্বন্ধে মিথ্যা বলা পাপ নয়। অন্য ক্ষেত্রে উপকার, অপকার বা খুশি করার জন্য মিথ্যা বলা হয়। অগাস্টিনের মতে, এসব মিথ্যা ঠিক মিথ্যা নয়। এই ধরনের মিথ্যা যারা বলে, তারা ঠিক মিথ্যুক নয়। শুধু একধরনের মিথ্যা আছে, যা শুধু আনন্দের জন্য বলা হয়। সেন্ট অগাস্টিনের মতে, এ ধরনের মিথ্যাই হলো আসল মিথ্যা। এ ধরনের মিথ্যা যারা বলে তারাই প্রকৃত মিথ্যুক ।

অধ্যাপক ফ্রাঙ্কফার্টের মতে, মিথ্যা হামবাগ’ বা ‘বুলশিটের প্রধান চিহ্ন নয়। বুলশিটের প্রধান লক্ষণ হলো এ ধরনের বক্তব্য জাল। ফ্রাঙ্কফার্টের ভাষায়, ‘For the essence of bullshit is not that it is false but that it is phony.’ (বুলশিটের মর্ম এই নয় যে এটি মিথ্যা, আসলে এটি হচ্ছে মেকি)।

অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত সম্প্রসারণের পরও ভেগোলজি এখনো কীভাবে টিকে আছে? অর্থনীতির ভাষায়, এর কারণ খুঁজতে হবে ভেগোলজির চাহিদা ও জোগানে। ভেগোলজির চাহিদা বাড়ার কারণ দুটি। প্রথমত, মানুষ সব জটিল প্রশ্নের সহজ জবাব চায়। এ জবাব তাদের চিরাচরিত ধারণার সঙ্গে যত সংগতিপূর্ণ হয় ততই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। দ্বিতীয়ত, কোন উত্তর কতটুকু সত্য তা যাচাই করার সময় বেশির ভাগ লোকেরই নেই। মনস্তাত্ত্বিকেরা এ ধরনের প্রবণতার নাম দিয়েছেন Belief perseverance and confirmatory bias (পূর্ববিশ্বাসের প্রলম্বন ও অনুসমর্থক পক্ষপাত)। একবার কোনো তত্ত্বে বিশ্বাস জন্মালে মানুষের মধ্যে নতুন ও বিপরীত সাক্ষ্য অগ্রাহ্যের প্রবণতা দেখা দেয়। (ম্যাথু রাবিন, ১৯৯৮)।

ভেগোলজির জোগানও বাড়ছে। শুধু প্রতারণার জন্য মানুষ ভেগোলজির আশ্রয় নেয় না। জীবনের জটিলতা বাড়ার ফলে অনেক নতুন প্রশ্ন উঠছে, যার জবাব কারও জানা নেই। অধ্যাপক ফ্রাঙ্কফার্ট (২০০৫, ৬৩) তাই লিখেছেন, ‘Bullshit is unavoidable whenever circumstances require someone to talk without knowing what he is talking about.’ (যখনই কেউ যে বিষয় সম্পর্কে জানে না সে বিষয় সম্পর্কে বলতে বাধ্য হয়, তখনি আবোলতাবোল অনিবার্য হয়ে ওঠে)।

প্রশ্ন হলো, আবোলতাবোল কি সত্যি সত্যি ক্ষতিকর? স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে আবোলতাবোলের চাহিদা রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থহীন আশ্বাস সমাজে অস্থিতিশীলতা হ্রাস করে। সঠিক উত্তর না দিতে পারলেও আবোলতাবোল অজ্ঞেয় রহস্যের ভয় কমিয়ে আনে।

আবোলতাবোল সত্য নয়, আবার একেবারে মিথ্যাও নয়। তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে অর্থহীন আবোলতাবোলের বিরূপ প্রভাব অত্যন্ত সীমিত। অধ্যাপক ফ্রাঙ্কফার্ট অতি সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন, আবোলতাবোল মিথ্যা না হলেও মিথ্যার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর। যারা মিথ্যা বলে তারা জানে যে তারা মিথ্যা বলছে। তারা এ ক্ষেত্রে সত্য কী, তা-ও জানে। তারা জেনেশুনেই সত্য কিংবা মিথ্যা বলে। যারা আবোলতাবোল বলে তারা সত্য ও মিথ্যার প্রভেদ নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায় না। এ প্রসঙ্গে তিনি যথার্থই লিখেছেন, ‘Someone who lies and someone who tells the truth are playing on opposite sides, so to speak, in the same game. Each responds to the facts as he understands them, although the response of the one is guided by the authority of the truth, while the response of the other defies that authority and refuses to meet its demands. The bullshit ignores these demands altogether. He does not reject the authority of the truth as the liar does and oppose himself to it at all. By virtue of this bullshit is a greater enemy of the truth than lies.’ (যে সত্য বলে এবং যে মিথ্যা বলে, তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে একই খেলা খেলে। তাদের নিজস্ব উপলব্ধির আলোকে তারা প্রতিটি ঘটনা সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, যদিও একজন সত্যের কর্তৃত্বের প্রতি অনুগত এবং অন্যজন এ ধরনের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে এবং এর চাহিদা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। আবোলতাবোলের বেলায় এসব বালাই নেই। যিনি আবোলতাবোল বলেন তিনি মিথ্যাবাদীর মতো সত্যের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন না আবার মিথ্যার বিরোধিতাও করেন না। এ কারণে আবোলতাবোল মিথ্যার চেয়েও সত্যের বড় শত্রু।)। আবোলতাবোলের জগতে মিথ্যা আর সত্যের মধ্যে প্রভেদ ঘুচে যায়। আবোলতাবোল সত্য উদ্ঘাটনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

৩. ভেগোলজি ও অর্থনীতি

ভেগোলজির দুটি প্রধান দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, ভেগোলজিতে রয়েছে অস্পষ্টতা, যা আমাদের সুনির্ধারিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দেয় না। দ্বিতীয়ত, ভেগোলজি সত্য ও মিথ্যার প্রভেদ নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই ভেগোলজি সত্যের অনুসন্ধানে একটি বড় প্রতিবন্ধক। ভেগোলজির দুটি দুর্বলতাই কমবেশি অর্থনীতির রয়েছে।

প্রথমত, অর্থনীতির অস্পষ্টতা নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়। এর একটি কারণ হলো, প্রায় প্রতিটি প্রশ্নেই অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রচণ্ড মতবিরোধ রয়েছে। তাই বলা হয়ে থাকে, যেখানে দুজন অর্থনীতিবিদ রয়েছেন সেখানে দুটি নয়, তিনটি অভিমত দেখা যায়। এমনকি একই অর্থনীতিবিদ একই বিষয়ে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন মত দিয়ে থাকেন। অর্থনীতিবিদদের সম্পর্কে তাই নিম্নরূপ দুটি সূত্র প্রচলিত আছে :

The First Law of Economists: For every economist, there exists an equal and opposite economist (অর্থনীতিবিদ সম্পর্কে প্রথম সূত্র : প্রতিটি অর্থনীতিবিদের বিপরীতে একজন সমকক্ষ ও বিপরীত মতাবলম্বী অর্থনীতিবিদ রয়েছেন)।

The second law of economists: they’re both wrong (অর্থনীতিবিদ সম্পর্কে দ্বিতীয় সূত্র : এঁরা দুজনই ভ্রান্ত)।

অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য মনে করেন যে অর্থনীতিবিদদের মতানৈক্যকে প্রায়ই অতিরঞ্জিত করা হয়ে থাকে। অর্থনীতিবিদদের মতানৈক্যের যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। এ সম্পর্কে একটি মজার কাহিনি প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন প্রাক্তন ছাত্র বিপুল অর্থ কামাই করেন। অর্থনীতি বিভাগে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অধ্যাপকের সম্মানে তিনি একটি গবেষণা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য ১০ কোটি ডলার দান করেন। প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ছাত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন। সবাই তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখাল। উপাচার্য তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি আর কিছু দেখতে চান কি না। প্রাক্তন ছাত্র বললেন, তিনি তাঁর প্রিয় শিক্ষকের সর্বশেষ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখতে চান। যখন সর্বশেষ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রাক্তন ছাত্রকে দেখানো হলো, তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। ৪০ বছর আগে যেসব প্রশ্ন তার পরীক্ষায় এসেছিল হুবহু একই প্রশ্ন। কোনো পরিবর্তন নেই। প্রাক্তন ছাত্র শিক্ষকের কাছে। জানতে চাইলেন, এটা কী করে সম্ভব? শিক্ষক জবাব দিলেন, বৎস, অর্থনীতিতে প্রশ্ন পরিবর্তিত হয় না। কোনো অর্থনৈতিক সমস্যারই সমাধান হয় না। প্রতিবছর তাই একই প্রশ্ন থাকে। তবে প্রতিবছরই উত্তর বদলে যায়। অর্থনীতিবিদেরা নতুন নতুন সমাধান নিয়ে আসেন।

অর্থনীতিতে মতবিরোধের একটি বড় কারণ হলো অর্থনীতিবিদেরা নিজেরাই অনেক প্রশ্নের জবাব জানেন না। একে ভেগোলজি বলা যাবে না। প্রধানত, দুটি কারণে ভেগোলজি ব্যবহৃত হয়। একটি নির্মল আনন্দের জন্য। অন্যটি বিশেষ মতলব নিয়ে। অর্থনীতিতে মতানৈক্যের ক্ষেত্রে এর কোনোটিই খাটে না।

এ অনুমান মোটেও ঠিক নয় যে অর্থনীতিবিদরা সবকিছু নিয়ে ঝগড়া করেন। স্যামুয়েলসন ও নর্ডহাউস (১৯৯২) ঠিকই বলেছেন, অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে মতৈক্য রয়েছে। সবাই একই প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন। মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে শুধু সমাধান নিয়ে। এঁদের মতে, অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক অর্থনীতির দুর্বলতার লক্ষণ নয়, এর সবলতার চিহ্ন। এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রম্যানের একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ট্রম্যান সাদাসিধা লোক ছিলেন। অর্থনীতিবিদদের বিতর্ক তাঁর পছন্দ ছিল না। তাই তিনি বলতেন যে তিনি দুই হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদ চান না; এক হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদ চান। দুই হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদকে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেন এক দিকে (on the one hand) এ রকম ঘটতে পারে, আবার অন্যদিকে (on the other hand) ভিন্ন কিছু ঘটবে। এ অবস্থাতে তাদের কাছ থেকে কোনো সুস্পষ্ট পরামর্শ পাওয়া যায় না। তাই ট্রম্যান বললেন এক হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদই সর্বোত্তম। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসনকে এ গল্পটি বলা হলে তিনি বললেন, ট্রুম্যানের পরামর্শ অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাঁর মতে, এক হাতওয়ালার যদি ডান হাত থাকে, তবে সে ডানপন্থী হবে এবং সব ক্ষেত্রেই চরম রক্ষণশীল পরামর্শ দেবে। আর যদি শুধু তাঁর বাম হাত থাকে তবে সে বামপন্থী হবে ও সব বৈপ্লবিক দাওয়াই দেবে। দুহাত থাকলে ডান ও বামের সমন্বয় হবে। কাজেই দুই হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদেরাই নীতিনির্ধারকদের জন্য শ্রেয়।

অর্থনীতির অস্পষ্টতার আরেকটি বড় কারণ হলো এর পদ্ধতি। অনেক। সময় সহজ প্রশ্নের জবাব খোঁজার জন্য অর্থনীতিবিদেরা গাণিতিক ও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নামে সহজ বক্তব্যকে এমন দুরূহ করে তোলেন। যে সে বক্তব্য সাধারণ পাঠকদের বোধগম্য থাকে না। এ জন্য অনেক সময়। ঠাট্টা করে বলা হয়, Economics is the painful elaborations of the obvious’ (অর্থনীতি হচ্ছে সোজা বিষয়ের বেদনাদায়ক সম্প্রসারণ)। অনেক অর্থনীতিবিদের নিজেদের মনেই প্রশ্ন আছে, অর্থনীতিবিদেরা যেভাবে সব বিষয়ের বিশ্লেষণ করতে চান তার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না। এ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ কেনেথ বোল্ডিং একটি সুন্দর ছড়া লিখেছেন যা নিচে উদ্ধৃত হলো :

If you do some acrobatics
With a little mathematics
It will take you far along
If your idea’s not defensible
do not make it comprehensible
your folks will find you out,
and your work will draw attention
if you fail to mention
what the whole thing is about.

You must talk of GNP’
And of elasticity
Of rates of substitution
And undeterminate solution
And oligonopopsony

(সামান্য অঙ্ক মিশিয়ে কিছু কসরত করো, দেখবে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যদি তোমার ধারণাগুলি টেকানো সম্ভব না হয়, তবে তা বোধগম্য করে তুলো না, তাহলে ধরা পড়ে যাবে। তোমার বক্তব্য অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করবে যতক্ষণ পুরো বিষয়টি কী তুমি না বলো। তুমি জিএনপির (স্কুল জাতীয় উৎপাদ) কথা বলবে; স্থিতিস্থাপকতার কথা বলবে, পরিবর্তের হারের কথা বলবে এবং সব ধরনের একচেটিয়া বা অপ্রতিযোগী ব্যবসার কথা বলবে।)

পদ্ধতির দুর্বলতার জন্যও অর্থনীতিকে ভেগোলজি বলা যাবে না। অর্থনীতি নিয়ে যতই ঠাট্টা করা হোক না কেন, অর্থনীতিবিদদের মনে কোনো সন্দেহ। নেই যে অর্থনীতি হচ্ছে একটি বিজ্ঞান। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ মানুষের যুক্তিশীল আচরণ সম্পর্কে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য অল্প কয়েকটি পূর্ব-অনুমানের ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে। অর্থনীতির বক্তব্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। প্রতিটি বক্তব্য এত স্পষ্ট যে তার গ্রহণযোগ্যতা উপাত্তের ভিত্তিতে পরীক্ষা করা সম্ভব। লিপসি, স্টেইনার ও পারভিস (১৯৮৪) তাই মনে করেন যে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই; কেননা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেও আমরা সব প্রশ্নের সঠিক জবাব জানি না। তবে আশার কথা হচ্ছে যে অর্থনীতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ভ্রান্ত বক্তব্য চিহ্নিত করতে পারছে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত অর্থনীতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত এখানে অস্পষ্টতার অবকাশ থাকবে না।

অস্পষ্টতার দায়ে অর্থনীতিকে ভেগোলজি বলা যায় না। তবে ভেগোলজির একটি বড় দুর্বলতা অর্থনীতিতে অনেক সময়ই দেখা যায়। ভেগোলজির মতো অর্থনীতিতে অনেক সময় সত্য ও মিথ্যার প্রভেদ গুলিয়ে ফেলা হয়। মোটা দাগে দুই ধরনের অর্থনীতিবিদ আছেন। একধরনের অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন যে অর্থনীতির মূল প্রশ্নগুলি পরিবর্তিত হয় না; পরিস্থিতিভেদে উত্তরের পরিবর্তন হয়। আরেক ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন যে অর্থনীতিতে প্রশ্নের পরিবর্তন হলেও উত্তরের কোনো পরিবর্তন হয় না। এ প্রসঙ্গে ডানপন্থী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান সম্পর্কে একটি গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি একদিন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। তিনি দেখতে পেলেন যে ক্লাসে একজন ছাত্র ঘুমাচ্ছে। খুব বিরক্ত হয়ে তিনি ছাত্রটির কাছে গেলেন এবং তাকে প্রশ্ন করলেন, বাপু, তুমি ঘুমোচ্ছ কেন?’ ছাত্রটি ভয় পেয়ে জবাব দিল যে সে ঘুমাচ্ছে না, শুধু চোখ বন্ধ করে অধ্যাপক ফ্রিডম্যানের বক্তব্য শোনার চেষ্টা করছে। ফ্রিডম্যন এবার তাকে বললেন, তা-ই যদি হয়, তবে আমি যে প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করছিলাম, বলো তো তার সঠিক জবাব কী? ছাত্রটি ঘুমিয়ে ছিল, তাই সে প্রশ্ন শোনেনি। সে চটপট জবাব দিল, ‘স্যার, প্রশ্নটা কী আমি জানি না, তবে আমি উত্তর জানি। ফ্রিডম্যান বললেন, উত্তর বলো।’ ছাত্রটি জানত যে ফ্রিডম্যানের সব প্রশ্নের জবাব হলো, পরিস্থিতিভেদে হয় মুদ্রার জোগান বাড়াও অথবা কমাও। ছাত্রটি ঘুমিয়ে ছিল। তাই সে জানে না মুদ্রার জোগান বাড়াতে হবে না কমাতে হবে। ছাত্রটি তাই জবাব দিল, ‘মুদ্রার জোগান পরিবর্তন করতে হবে।’

সমস্যা হলো মিল্টন ফ্রিডম্যানের মতো দ্বিতীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদদের নিয়ে। এঁরা তর্ক-বিতর্ক না করে বিশেষ মতবাদ বা আদর্শবাদকে অভ্রান্ত সত্য বলে ধরে নেন। এঁদের কাছে সত্য ও মিথ্যা বড় কথা নয়। এঁরা কোনো অবস্থাতেই তাদের মতবাদ পরিবর্তন করতে রাজি নন। এ ধরনের অর্থনীতিবিদদের সর্বশেষ ভরসা হলো ‘বুলশিট’ বা ‘হামবাগ’। যেখানে যুক্তির শেষ, সেখানেই ভেগোলজির শুরু।

সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সব অর্থনীতিই ভেগোলজি নয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থনীতি ভেগোলজি দোষে দুষ্ট হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বাস্তব জীবনে অর্থনীতির লেবাসধারী ভেগোলজিকে অগ্রাহ্য করার জো নেই; কেননা এ ধরনের অর্থনীতির চাহিদাই বেশি। এলান এস ব্লাইন্ডার যথার্থই বলেছেন, ‘Economists have the least influence on policy where they know the most and are most agreed; they have the most influence on policy where they know the least and disagree most vehemently (যেসব বিষয়ে অর্থনীতিবিদেরা সবচেয়ে ভালো জানেন এবং একমত, সেসব নীতির ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদদের প্রভাব সবচেয়ে কম এবং যেসব বিষয়ে তাঁরা সবচেয়ে কম জানেন এবং প্রবলভাবে ভিন্নমত পোষণ করেন, সেসব ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়)। এর একটি বড় কারণ হলো, যারা অর্থনীতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন তারা অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণের আলোকে নয়, নিজেদের ধ্যানধারণার আলোকে সিদ্ধান্ত নেন। এ সব ধ্যানধারণা অনেক সময় অল্প বয়সে (কেইনসের মতে, ২৫-৩০ বছর বয়সের আগে) তারা যা শিখেছেন তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এসব তত্ত্ব বাতিল হলেও তারা নতুন মতবাদ মেনে নেন না। লর্ড কেইনস (১৯৬৪, ৩৮৩) যথার্থই লিখেছেন, ‘Practical men, who believe themselves to be quite exempt from any intellectual influences, are usually the slaves of some defunct economist. Madman in authority, who hear voices in the air, are distilling their frenzy from some academic scribbler of a few years back. I am sure that the power of vested interest is vastly exaggerated compared with gradual encroachment of ideas.’ (718TTIntande, যারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাবের উর্ধ্বে বলে মনে করেন, তারা সাধারণত কোনো পরলোকগত অর্থনীতিবিদের দাস। কয়েক বছরের পুরোনো একাডেমিক জগতের কতিপয় বাজে লেখকের ধ্যানধারণা ক্ষমতাসীন উন্মাদরা তাদের উন্মত্ততায় বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। আমি নিশ্চিত যে ভাবের ক্রম অনধিকার প্রবেশের (ক্ষতির) তুলনায় কায়েমি স্বার্থবাদীদের ভূমিকা অনেক বেশি অতিরঞ্জিত করা হয়েছে।)।

ভেগোলজি নয় বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বই হচ্ছে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা। অর্থনীতিবিদদের একই উত্তর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। ভেগোলজি থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে পুরোনো প্রশ্নের নতুন নতুন জবাব খুঁজতে হবে এবং নতুন নতুন প্রশ্ন তুলে ধরতে হবে। তবে একা অর্থনীতিবিদেরা ভেগোলজির জন্য দায়ী নন। অর্থনীতিতে ভেগোলজির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন নীতিনির্ধারকেরা, যারা তাদের প্রথম জীবনের বস্তাপচা ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। যতক্ষণ অর্থনীতিতে ভেগোলজির চাহিদা থাকবে ততক্ষণ এর জোগানে কোনো ঘাটতি দেখা দেবে না।

.

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

অশোক মিত্র। ২০০৩। আপিলা চাপিলা। কলকাতা: আনন্দ।

কেইনস, জন মেনার্ড (Keynes, John Maynard)। ১৯৬৪। The General Theory of Empolyment, Interest and Money. New York: Harcourt, Brace and World Incorporated.

পরিমল রায়। ২০০৩ (পুনর্মুদ্রিত)। ভেগোলজি’। বঙ্গ সাহিত্যে রঙ্গ ব্যঙ্গ, (সম্পাদনা) পবিত্র অধিকারী। কলকাতা: করুণা প্রকাশনী।

পল জনসন (Paul Johnson)। ১৯৮৮। Intellectuals. New York: Harper and Row Publishers.

ফ্রাঙ্কফার্ট, হ্যারি জে (Frankfurt, Harry J.) ২০০৫। Bullshit. Princeton and Oxford: Princeton University Press

ম্যাক্স ব্ল্যাক (Max Black). ১৯৮৩। The Prevalence of Humbug and Other Essays. Cornell: Cornell University Press. asist silta (Matthew Rabin)sodb 1 ‘Psychology and Economics’, Journal of Economic Literature. Vol. xxxvi, No. 1 (March 1998). 11-46.

সৌমেন্দ্রনাথ সরকার। ২০০১। চর্যাগীতি-কোষ। কলকাতা: রচনাবলী।

স্যামুয়েলসন, পল ও উইলিয়াম ডি নর্ডহাউস (Samuuelson, Paul and William D. Nordhouse)। ১৯৯২। Economics (14th ed.). New York: McGraw Hill.

লিপসি, আর, জি; পিটার ও. স্টেইনার এবং ডগলাস ডি. পারভিস (Lipsey, Richard G; Peter O. Steiner and Douglas D. Purvis) i SD681 Economics. New York: Harper and Row Publishers.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *