৭০. রাগে চোয়াল শক্ত

অধ্যায় ৭০

“হাসিবকে তুই কী করেছিস?” দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো আসলাম।

“হাসিব কে?” বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো বন্দী। “তার আগে বল, তোরা কে? তুই কে?” পাল্টা প্রশ্ন করলো সে।

রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো আসলামের। বন্দী অবস্থায়ও ভেঙে পড়েনি, পাল্টা তুই-তোকারি করছে তাকে! “আমার পরিচয় তোর জানা দরকার নেই। তুই শুধু বল, হাসিবকে কী করেছিস।”

“আশ্চর্য,” রাগেক্ষোভে বলে উঠলো সে। বার বার এক কথা বলছিস কেন! বললাম না, হাসিব নামের কাউকে চিনি না।”

“তাহলে তুই স্বীকার করবি না?”

“অসহ্য!” বিরক্ত হয়ে বললো বন্দী। “কী স্বীকার করব?”

আসলাম মুচকি হাসি দিলো। “তুই কে, আমরা সেটা জেনে গেছি। এসব নাটক করে কোনো লাভ হবে না।”

“কী জেনে গেছিস তোরা?” চেঁচিয়ে বললো। “কী বলতে চাস!”

আসলাম বাঁকা হাসি দিলো। “তুই কি ভেবেছিস, চেহারা পাল্টে ফেললেই তোকে কেউ ধরতে পারবে না?”

“কি!” বিস্ময়ের সীমা রইলো না বন্দীর, চোখমুখ কুঁচকে গেলো তার। “আমি চেহারা পাল্টে ফেলেছি?! কী যা-তা বলছিস! আমাকে কিডন্যাপ করেছিস কেন সেটা আগে বল্। টাকার জন্য? তোদের ডিমান্ড কতো, শুনি?”

চোখমুখ শক্ত করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো আসলাম। “তোকে যদি টাকার জন্যই তুলে আনতাম, তাহলে সবার আগে তোর নাগর ঐ বুড়ো ডাক্তারকে ফোন দিতাম।”

“শাট আপ, ইউ ব্লাডি সোয়াইন!” চেঁচিয়ে উঠলো এবার। অপহরণকারীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, “ডাক্তার আসকার আমার বাবা হয়।”

আসলামের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। “নিজের চেহারা প্লাস্টিক সার্জনকে দিয়ে পাল্টে, নতুন একটা নাম নিয়ে, এখন নাগরকে বাবা বলে চালাতে চাচ্ছিস, বেজন্মা মাগি!”

“ইউ ডার্টি শোয়াইন!” তিক্তমুখে বললো বন্দী। “বেজন্মা তো তুই! যার পোষা কুকুর হয়ে এসব করছিস তাকে গিয়ে বল, আমি কে! ডাক্তার আমার কী হয়!”

গালি শুনে আসলামের মেজাজ খারাপ হলো না, উল্টো তার অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। মনীষা তার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পর যতো মেয়ে তার সাথে শুয়েছে, টাকার বিনিময়েই শুয়েছে। আর তাদের সবাইকে বাধ্য করেছে ওসব করার সময় তাকে গালি দেবার জন্য। মেয়েগুলোর কাছ থেকে গালি শোনার পর সে জেগে উঠতো। এখনও ঠিক সেটাই হচ্ছে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আসলাম বললো, “নুরে ছফাকে তো চিনিস, নাকি?”

ভুরু কুঁচকে গেলো বন্দীর, “এ আবার কে?”

হেসে ফেললো চাকরিচ্যুত পুলিশ অফিসার। “ছফাকেও চিনিস না! বাহ্। ভালোই অভিনয় করতে পারিস তো!”

“স্টুপিড!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো বন্দী। “যে তোকে এসব ভুয়া খবর দিয়েছে, আগে তাকে গিয়ে ধরু!”

হেসেই বললো আসলাম, “ছফা কলকাতায় গেছিলো কদিন আগে, একটু থেমে মেয়েটার অভিব্যক্তি দেখে নিলো সে। ভড়কে যাবার চিহ্ন দেখতে পেয়ে খুশিই হলো। “তোর সব কিছু সে জেনে গেছে। সব!”

বন্দী স্থিরচোখে চেয়ে রইলো অপহরণকারীর দিকে। তারপর ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো, “কী জেনেছে ওই লোক?”

“হা-হা-হা,” হাসিতে ফেটে পড়লো পিএসের গানম্যান। “বললাম না, সব কিছু। তুই কোথায় থাকতি, কী করেছিস…সব।”

বন্দীর কপালে ভাঁজ পড়লো।

“এখন শোন্, একটা কথা বলি। বুদ্ধিমান হলে টর্চার হবার আগেই সব স্বীকার করে ফেল, নয়তো শেষ পর্যন্ত সবই বলবি, মাঝখান থেকে…” কথাটা আর শেষ করলো না।

“কী করবি তুই?” রেগেমেগে জানতে চাইলো। “ইউ স্কাউলে?”

লম্পটের মতো হাসি দিলো আসলাম, তারপর আস্তে করে প্যান্টের জিপারটা টেনে খুলে ফেললো সে। “কী করবো জানতে চাস, নাকি দেখতে চাস!” একটু থেমে মেয়েটার কাছে মুখ এনে আবার বললো, “নাকি, ফিল করতে চাস!”

কথাটা শুনে ভড়কে গেলো সুস্মিতা, তারপরও রাগ একটুও কমলো না। “ইউ ব্লাডি শোয়াইন!”।

“আরো বল!” বন্দীর চুলের মুঠি ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে বললো। ভড়কে গেলো মেয়েটা। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।

“খানকি!” গর্জে উঠলো আসলাম। “যত গালি জানিস সব দে আমাকে!”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো বন্দী।

“গালি দে, খানকি!” বলেই মেয়েটার চোয়াল শক্ত করে ধরলো। “দিচ্ছিস না কেন, ডাইনি!”

সুস্মিতা আবারো গভীর করে দম নিয়ে নিলো। “শ্যামলকে আগে ছেড়ে দে, তারপর বলবো।”

মুচকি হেসে মাথা নাড়লো আসলাম।

“ও ঢাকা শহর চেনে না। ওকে বহু দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দে। ও কিছু করবে না…গ্রামে চলে যাবে।”

“শর্ত দেবার জন্য একটা পজিশন থাকে, তোর সেটা নেই। বুঝতে পেরেছিস, ডাইনি!”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো সুস্মিতা। বাঁকাহাসি দিলো আসলাম। “তাহলে তুই বলবি না?”

“না।” সোজা জবাব বন্দীর।

“তোকে আমি এখন কী করবো, জানিস?”

সুস্মিতার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো আবার।

লম্পটের মতো হাসি দিয়ে মেয়েটার ফতুয়ার গলা ধরলো দু-হাতে। “তোর জামাকাপড় সব ছিঁড়ে ফেলবো! ন্যাংটা করে…” এক হাত জিপারে রাখলো সে। লম্পটের হাসি দিলো।

“ইউ সান অব অ্যা বিচ!” রেগেমেগে বললো সুস্মিতা।

আসলাম সঙ্গে সঙ্গে একটা চড় মারলো বন্দীকে। তারপর আরেকটা। তৃতীয় চড়টা মারার আগে থমকে গেলো একটা কণ্ঠ শুনে।

“আসলাম!”

বন্দীকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। আশেক মাহমুদ কখন ঘরে ঢুকেছে টেরই পায়নি।

“ইউ ডিড অ্যা গ্রেট জব!” বন্দীর দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।

“থ্যাঙ্কস, বস।”

বন্দী বুঝতে পেরেছে, এই লোকই তাকে কিডন্যাপ করিয়েছে। “আপনি কে? আমাকে কিডন্যাপ করেছেন কেন?”

পিএস আশেক মাহমুদ চোখমুখ শক্ত করে তাকালো চেয়ারে বসা বন্দীর দিকে। “মুশকান জুবেরি! কেমন আছেন!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো

সে। এই মহিলা তার বড়বোনের সমবয়সী বলেই হয়তো অজ্ঞাতসারেই আপনি সম্বোধনটা চলে এসেছে।

বন্দী অবিশ্বাস্যে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “কী বলছেন?! আমি সুস্মিতা! সুস্মিতা সমাদ্দার!”

হা-হা-হা করে অট্টহাসি দিলো আশেক মাহমুদ।

অনেক দিন পর আসলাম তার বসকে এভাবে হাসতে দেখলো।

.

অধ্যায় ৭১

মুশকান জুবেরি এখন পিএসের হেফাজতে আছে!

ছফার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে ব্যাপারটা।

রমাকান্তকামার যখন জানালেন, সুস্মিতা সুন্দরপুর থেকে চলে গেছে, তখন সে ভেবেছিলো আবারো পালিয়ে গেছে ঐ ডাইনি-তারপরও মাস্টারের কথাটাকে বেদবাক্য হিসেবে মেনে নেয়নি সে। পুলিশ ফোর্স নিয়ে পুরো স্কুলটা চষে বেড়িয়েছে। বেশ কয়েকজন কর্মচারীকেও জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছে, মাস্টার সত্যিই বলেছেন, শ্যামল নামের ছেলেটাকে নিয়ে সুস্মিতারূপী মুশকান গতকাল ঢাকায় চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে, কেউ জানে না।

ছফা অনেকটা হতাশ হয়েই পিএস আশেক মাহমুদকে ফোন দেয়, কিন্তু তার ফোনটা বন্ধ পেয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠে সে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না কী করবে। তবে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। একটু পরই পিএস তাকে ফোন দেয়। ছফা যখন জানালো, সুস্মিতারূপী মুশকান সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে গেছে তখন দুঃসংবাদটি শুনে আশেক মাহমুদ উদ্বিগ্ন না হয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে, সুস্মিতা যদি মুশকান জুবেরি হয়ে থাকে তাহলে চিন্তার কিছু নেই, সে এখন তার হাতে বন্দী।

কথাটা শুনে যারপরনাই অবাক হয় ছফা। পিএস তখন সংক্ষেপে সবটা জানায়। হাসপাতালে তার পরিচিত এক ডাক্তার তাকে জানিয়েছিলো, ডাক্তার আসকারকে দেখতে এক মেয়ে এসেছে, নাম তার সুস্মিতা। ডাক্তারের খুবই ঘনিষ্ঠ, কেননা তাকে স্পেশাল কেবিনে ঢুকতে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পিএস তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, বুড়োকে বাগে আনার জন্য, তার কাছ থেকে মুশকানের খবর আদায় করার জন্য ঐ মেয়েকেও নজরদারিতে রাখবে। দরকার হলে তাকে কজায় নিয়ে নেবে যাতে করে ডাক্তারকে বাধ্য করা যায় মুশকানের সন্ধান দিতে। কিন্তু আজকে কলকাতা থেকে রওনা দেবার আগে ছফা যখন তাকে জানিয়ে দিলো, মুশকান জুবেরি কলকাতায় প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা পাল্টে ফেলেছে, সুস্মিতা সেজে সুন্দরপুরে আছে, তখন আর দেরি করেনি আশেক মাহমুদ। আসলামকে দিয়ে মেয়েটাকে নিজের কজায় নিয়ে নেয়। খবরটা ছফাকে তখনই জানাতে গেছিলো, কিন্তু ঐ সময় তার ফোন বন্ধ পায়। ছফা তখন কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে দিয়েছে, নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলো সম্ভবত। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সাথে জরুরী এক মিটিঙে চলে গেলে নিজের ফোনটাও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় পিএস, তাই একটু আগে ছফাও তাকে ফোন করে পায়নি। যাই হোক, সুসংবাদটি শোনার পর ছফা আর দেরি করেনি, দ্রুত সুন্দরপুরের এসপির গাড়িটা ধার নিয়ে রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্যে।

এখন ঢাকার প্রবেশপথে আছে নুরে ছফা, টের পেলো উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছে সে। অবশেষে মুশকান জুবেরিকে সে ট্র্যাক ডাউন করতে পেরেছে! মহিলা এখন তাদের হাতে বন্দী!

*

ডাক্তার আসকার একটু আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আবারো ফোন দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক যখন বিরোধীদলে ছিলো তখন নিয়মিত অরিয়েন্ট হাসপাতালের সেবা নিতে বিনেপয়সায়। প্রতিটি বেসরকারী হাসপাতালই কিছু রাজনীতিককে এভাবে বিনেপয়সায় সেবা দিয়ে থাকে, অরিয়েন্ট হাসপাতালও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান সরকারের তিন-চারজন মন্ত্রী আর বেশ কয়েকজন এমপির সাথে ডাক্তারের সখ্যতা রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তার সেই সখ্যতা আরো বেশি। যেকোনো সময় যেকোনো প্রয়োজনে তাকে ফোন করতে পারেন তিনি। তারপরও এখন মনে হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখে প্রধানমন্ত্রীর পিএস!

মন্ত্রীকে তিনি জানিয়েছেন, তার মেয়ে সুস্মিতা বনানীর বাসা থেকে উবারে করে এয়ারপোর্টে রওনা দিয়েছিলো, কিন্তু ফ্লাইট মিস করেছে। তারপর থেকেই ওর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছেন। কথাটা শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুব অবাক হয়েছে। ডাক্তার কি কাউকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করছেন? এমন প্রশ্নে আসকার ইবনে সায়িদ কোনো রকম ভণিতা না করেই বলেছেন, তাকে যে ব্যক্তি ইমিগ্রেশন পার হতে বাধা দিয়েছে, সেই একই ব্যক্তি নুরে ছফা নামের ডিবি অফিসারকে দিয়ে সুস্মিতাকে অপহরণ করেছে বলেই তার বিশ্বাস।

কিন্তু মন্ত্রী খুব অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কী এমন ঘটে গেছে। যে, তার মেয়েকে অপহরণ করবে ওরা? ডাক্তার পরিহাসের হাসি দিয়ে বলেছিলেন, তিনিই বা কী অপরাধ করেছেন যে, তাকে ইমিগ্রেশনে আটকে দেয়া হলো?

এ কথা শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলেছে, সে খোঁজ নিয়ে দেখবে কী ঘটেছে আসলে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট জানতে পারেননি তিনি।

যেভাবে উদ্বিগ্নতা তাকে চেপে ধরছে, একটু পর হয়তো সত্যি সত্যি আইসিসিইউতে নেয়ার দরকার হবে। এর আগে নুরে ছফার হাত থেকে বাঁচতে সামান্য নাভাস ব্রেক ডাউনকে হার্ট অ্যাটাকের অভিনয় করে পার পেয়ে গেছিলেন। কিন্তু এখন সত্যি সত্যি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন।

.

অধ্যায় ৭২

সুস্মিতা হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ মেরে গেছে এখন।

বার বার বলে যাবার পরও এ ঘরের দু-জন মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারেনি, সে মুশকান জুবেরি নয়। তার নাম সুস্মিতা সমাদ্দার। ডাক্তার আসকার তার বাবা।

“সুস্মিতা সমাদ্দার কী করে ডাক্তার আসকারের মেয়ে হয়?” আশেক মাহমুদ জানতে চাইলো।

বিরক্তিতে ভরে উঠলো বন্দীর মুখ। অসভ্য আর অশিক্ষিতের মতো প্রশ্ন! আর এটা তাকে এই প্রথম শুনতে হচ্ছে না।

“আপনি যদি মনে করে থাকেন আপনাকে ধরে এনে এটা জানতে চাচ্ছি, আপনি মুশকান জুবেরি কিনা তাহলে ভুল করছেন। প্রধানমন্ত্রীর পিএস বেশ আয়েশ করে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে সোফায় বসে আছে এখন। বন্দীর চেয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আসলাম।

“এসব করে সময় নষ্ট করার কোনো ইচ্ছেও আমার নেই,” আশেক মাহমুদ বললো। “এর চেয়ে অনেক জরুরী প্রশ্নের উত্তর আমাকে জানতে হবে।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সুস্মিতা।

“আমি স্রেফ দুটো প্রশ্ন করবো। আপনি যদি ভেবে থাকেন ছলচাতুরি করে পার পেয়ে যাবেন তাহলে বিরাট বড় ভুল করবেন।”

“কী প্রশ্ন, আপনার?” গভীর করে দম নিয়ে সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো সুস্মিতা। তার আগে বলুন, আপনি কে।”

“চুপ, খানকি!” তেঁতে উঠলে আসলাম। পিএসের সামনে এই ডাইনিকে গালি দিতে মোটেও দ্বিধা করলো না সে। “বস্ যা বলবে তার জবাব দিবি, পাল্টা কোনো প্রশ্ন করবি না!”

সুস্মিতা কয়েক মুহূর্ত কটমট চোখে আসলামের দিকে চেয়ে থেকে আশেক মাহমুদের দিকে ফিরলো। তার মার্জিত পোশাক আর অভিজাত ভাবভঙ্গি দেখে গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে সে। লোকটা কে হতে পারে, কোনো ধারণাই করতে পারছে না।

মেয়েটার দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো পিএস, “হাসিবকে কী করেছেন?”

বন্দী আবারো গভীর করে দম নিয়ে নিলো। “আমি মুশকান জুবেরি নই। আর হাসিব নামের কাউকে কখনও চিনতামও না। আমার কথা বিশ্বাস না করলে কিছু করার নেই, কিন্তু বার বার এক কথা জিজ্ঞেস করবেন না। বড্ড অসহ্য লাগছে।”

চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ, তারপর আসলামের দিকে ফিরলো। আমি ওর সাথে একটু কথা বলবো।”

চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেলো পুলিশের সাবেক এসআই। বসের ইশারা বুঝতে এক সেকেন্ডও দেরি হয় না তার।

“মুশকান জুবেরি!” ঘর থেকে আসলাম চলে যাবার পর দাঁতে দাঁত পিষে বললো আশেক মাহমুদ। “আমি জানি হাসিবের সাথে কী করেছিস তুই!”

মুখ তুলে তাকালো সুস্মিতা। তাকে একা পেয়ে লোকটার ভাবভঙ্গি যে বদলে গেছে বুঝতে পারলো। কিন্তু সে-ও কম যায় না। রেগেমেগে বলে উঠলো, “ফাক ইউ!”

নিজের রাগটা দমন করে বেশ শান্তকণ্ঠে বললো পিএস, “তুই কি চাস, ঐ ছেলেটা বেঘোরে মারা যাক?”

এ কথায় কাজ হলো, অস্থির হয়ে উঠলো বন্দী। “ও একটা নিরীহ ছেলে…ওর কিছু করবেন না!” কাকুতি মিনতি করে জানালো সে। তার কণ্ঠ এখন ভঙ্গুর শোনাচ্ছে। “প্লিজ!”

শীতল চোখে তাকালো আশেক মাহমুদ। “যে তোকে এখানে তুলে এনেছে সে কতোটা ভয়ঙ্কর তোর কোনো ধারণাই নেই। আমি চাইলে, সে তোকে ছিঁড়ে-খুবলে খাবে!”

বন্দীর নিশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো।

“যা জানতে চাই তা বল, নইলে ঐ ছেলেটা মরবে।”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো বন্দী। তার নার্ভ ভেঙে পড়ার উপক্রম হচ্ছে। “আপনি আসলে কী চান, বলুন তো?”

হেসে ফেললো আশেক মাহমুদ। “দ্যাটস গুড,” একটু থেমে সরাসরি বন্দীর চোখের দিকে তাকালো। “হাসিব আমার বড়বোনের ছেলে ছিলো, ঐ বোনই আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। আর তুই তাকে…” অসমাপ্ত রাখলো কথাটা।

সুস্মিতার কপালে ভাঁজ পড়লো আবার।

“আমি জানতে চাই, ওকে খুন করলি কেন?”

মাথা দোলালো সুস্মিতা। ভঙ্গুর কণ্ঠে জোর দিয়ে বললো সে, “আমি মুশকান না!”

পিএস আর সুস্মিতার দৃষ্টি আঁটকে রইলো কয়েক মুহূর্ত পর্যন্ত। অবশেষে চোখটা সরিয়ে নিলো বন্দী, কিছুই বললো না। চোখ বন্ধ করে রাখলো কয়েক মুহূর্ত। যেনো নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না।

“ওকে,” মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না মনে হচ্ছে।”

সুস্মিতা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

“আসলাম?” বেশ জোরেই ডাকলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলো পুলিশের সাবেক এসআই। “আঙুল বাঁকা করতে হবে।”

মুচকি হাসি দিলো ষণ্ডাটা। ঘরের এককোণে গিয়ে একটা কাগজের ব্যাগের ভেতর থেকে পলিথিনের ব্যাগ আর চওড়া স্কচটেপ বের করে নিয়ে এলো। জিনিসগুলোর দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো বন্দী।

আশেক মাহমুদ ঘর থেকে চলে যাবার আগে সুস্মিতার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আক্ষেপে মাথা দোলালো।

পিএস ঘর থেকে চলে যেতেই আসলাম এসে দাঁড়ালো সুস্মিতার ঠিক পেছনে। মেয়েটা আসন্ন বিপদ টের পেয়ে ছটফট করতে শুরু করে দিলো। সে পেছনে ফিরে তাকানোর আগেই আসলাম মেয়েটার মাথা গলিয়ে পলিথিনের ব্যাগটা ঢুকিয়ে দিলো, তারপর গলার কাছে পলিথিন ব্যাগের মুখটা চেপে ধরে চারদিক স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে রোল থেকে এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেললো সেটা।

উদভ্রান্তের মতো মাথা ঝাঁকাতে শুরু করে দিলো সুস্মিতা, বুঝে গেছে কী হতে যাচ্ছে তার সাথে। সামনে এসে আগ্রহভরে চেয়ে রইলো আসলাম।

এখন পলিথিন ব্যাগের ভেতরে সুস্মিতার মাথাটা, সে চিৎকার দিলেও ভোঁতা গোঙানি ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। কয়েক মুহূর্ত পরই সে হাসফাঁস করতে শুরু করে দিলো অক্সিজেনের অভাবে। দম নেবার চেষ্টা করতেই পলিথিনের ব্যাগটা লেপ্টে যেতে শুরু করলো তার মুখে। মুখ হা করে অক্সিজেন নেবার চেষ্টা করেও কিছুই পাচ্ছে না। তার চোখ দুটো বিস্ফারিত হবার উপক্রম হলো।

আসলামকে দেখে মনে হলো, দৃশ্যটা বেশ উপভোগ করছে সে।

.

অধ্যায় ৭৩

বার কয়েক মৃত্যুর খুব কাছে চলে এসেছিলো সুস্মিতা, তবে সে জানতো তাকে মেরে ফেলা হবে না, ভয় দেখানোর জন্যই মৃত্যুর স্বাদ দিচ্ছে কেবল।

পলিথিন ব্যাগের ভেতরে আবদ্ধ থেকে তার দম যখনই ফুরিয়ে যাচ্ছিলো, নিশ্বাস নেবার জন্য ফুসফুস ফেঁটে যাবার উপক্রম হচ্ছিলো, ঠিক তখনই তার অপহরনকারী পলিথিন ব্যাগটা দু-হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। একটু আগেও তাই করেছে লোকটা।

উদভ্রান্তের মতো বুকভরে নিশ্বাস নিলো সে, তারপর শ্বাসপ্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে ঘৃণাভরে তাকালো অপহরনকারীর দিকে। আস্ত একটা পিশাচ। তার সুতীব্র যন্ত্রণা উপভোগ করেছে পশুটা। অসূর বোধহয় এমনই হয়!

“এখনও বলবি না?” আসলাম মুচকি হেসে বললো। “নাকি আরো ব্যাগ নষ্ট করতে হবে?”

“তোকে আমি ছাড়বো না, ইউ ব্লাডি মাদার ফাকার!”

হা-হা করে হেসে উঠলো আসলাম। “আমিও চাই না তুই আমাকে ছেড়ে দে।” কথাটা বললো লম্পটের মতো হাসি দিয়ে। তারপর সুস্মিতার খুব কাছে এসে, তার চোখে চোখ রেখে বললো, “আমি চাই…আমাকে ধরে রাখবি…অনেকক্ষণ! ধরবি আর ছাড়বি! ছাড়বি আর ধরবি! অনেকক্ষণ ধরে করবি এটা!”

অসহায়ের মতো তাকালো সুস্মিতা। এরকম পারভার্ট আর সাইকোপ্যাথের খপ্পরে যে পড়বে কখনও ভাবেনি।

বেশ শান্তকণ্ঠে বললো গানম্যান, “ভেবে দেখ, এখন যদি স্বীকার না করিস তো অন্য মেথড ইউজ করবো। সেটা কিন্তু তোর জন্য ভালো হবে না।” কথাটা বলার সময় জিপারে হাত রাখলো ইঙ্গিতপূর্ণভাবে।

কয়েক মুহূর্ত তার দিকে চোখ কুঁচকে চেয়ে রইলো বন্দী। সে জানে তথ্যটা আদায় না করে তাকে হত্যা করবে না এরা। সুতরাং নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তথ্যটা বলে দেয়া মানে মৃত্যুকে স্বাগত জানানো। গভীর করে দম নিয়ে নিলো। আমার একটা সামান্য শর্ত ছিলো, ওটা মানলে আমি সব বলে দেব।”

মেয়েটার এমন দৃঢ়তা দেখে দারুণ অবাক হলো আসলাম।

“তোর বসকে বল, এসব করে করে শুধু সময় নষ্ট করছে…মরে গেলেও কিছু বলবো না।”

“খানকি মাগি!” দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো আসলাম। সজোরে চড় মারলো একটা। সেই চড়ের জোর এতোটাই যে, কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করলো বন্দী। আরেকটা চড় মারার জন্য যেই না হাত তুলবে, অমনি পিএসের কণ্ঠ শুনে থমকে গেলো আসলাম।

“দরকার নেই।”

আশেক মাহমুদ ঘরে ঢুকেছে এইমাত্র। আসলাম সরে এলো বন্দীর কাছ থেকে।

“ছেলেটার জন্য তার অনেক দরদ!” শান্তকণ্ঠে বললো পিএস। “কতো দরদ সেটাও একটু পরই জানা যাবে,” মুচকি হাসলো সে। “নীচে গিয়ে ঐ ছেলেটার একটা আঙুল কেটে এনে ওকে দেখাও। তারপরও যদি না বলে তাহলে আরেকটা আঙুল কাটবে। দেখি, কতোক্ষণ এসব সহ্য করে সে।”

সুস্মিতা তীব্র আতঙ্কে চেয়ে রইলো। শ্যামলের জন্যে তার মমত্ব প্রকাশ করে যে বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আসলাম মাথা নেড়ে সায় দিলো।

উদভ্রান্তের মতো বলে উঠলো বন্দী, “ওকে টর্চার করে আমার কাছ থেকে কথা আদায় করার চেষ্টা ভুলেও করবেন না, করলে আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবো।”

অবাক হলো পিএস। “কি সিদ্ধান্ত নিবি তুই?”

“আমি তখন ধরেই নেবো, শ্যামল এবং আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন না আপনারা। সুতরাং যা জানতে চান সেটাও আমি বলবো না। যতো ইচ্ছে টর্চার করুন।”

বন্দীর এমন দৃঢ়তা দেখে পিএস একটুও হতোদ্যম হলো না, মুচকি হাসি দিলো শুধু। “আসলাম, তুমি নীচে যাও। যা বললাম তাই করো।”

পিএসের কৌশলটা বেশ ভালো লাগলো গানম্যানের। হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হবে অমনি বন্দী হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে উঠলো। “প্লিজ! ঐ ছেলেটার কিছু করবেন না। প্লিজ! আমি সব বলবো আপনাকে!”

হাত তুলে আসলামকে থামিয়ে দিলো আশেক মাহমুদ। তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।

“তাহলে দেরি করছিস কেন? বল!” ধমক দিয়ে বললো আসলাম।

এমন সময় পিএসের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কলার আইডি দেখে থমকে গেলো সে। “আমি একটু আসছি,” আসলামকে বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো আশেক মাহমুদ।

কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো গানম্যান। প্রায় মিনিটখানেক পর বাইরে থেকে পিএসের কণ্ঠটা ভেসে এলো।

“আসলাম…একটু বাইরে আসো।”

সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে গেলো আসলাম। পিএসের চোখেমুখে অসন্তুষ্টি।

“কি হয়েছে, স্যার?”

“নুরে ছফা চলে আসার আগেই যা করার করতে হবে।”

আসলাম জানে, করার মতো দুটো কাজই আছে : মুশকানের কাছ থেকে একটা তথ্য আদায় করা আর তার সঙ্গে যে ছেলেটা আছে তাকে সরিয়ে দেয়া।

অরিজিনাল রোলেক্স ঘড়িতে সময় দেখে নিলো পিএস। “আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। তুমি এখানেই থাকো, আমি একটু একা ওর সঙ্গে কথা বলবো।”

.

অধ্যায় ৭৪

আশেক মাহমুদকে ঘরে একা ঢুকতে দেখে সুস্মিতা অবাক হলো একটু। অপহরণকারী লোকটা কোথায় গেছে অনুমাণ করতে পেরে ভড়কে গেলো সে।

বন্দীর দিকে ধীরপায়ে হেঁটে এসে পিএস বললো, “এখন বল, ঠিক কোন জিনিসটা তুই খাস? আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবি না।”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো সুস্মিতা।

“শেষ পর্যন্ত তুই কিন্তু বলবি…ভালো হয় ওই ছেলেটার সাথে খারাপ কিছু করার আগেই বলে দিলে।”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো সুস্মিতা। নিজের সাথে কঠিন সংগ্রাম করছে যেনো।

“বল!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো আশেক মাহমুদ।

নিজেকে ধাতস্থ করে স্থিরচোখে তাকালো পিএসের দিকে। “আমি সেটা বললেই কি আপনি ওই জিনিস সংগ্রহ করতে পারবেন? কী করে পারবেন?” সুস্মিতা কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো যেনো।

“সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না,” দাঁতে দাঁত পিষে বললো আশেক মাহমুদ। “আমি যা জানতে চাইছি সেটা ব!” ধমক দিয়ে উঠলো আবার।

“ধমক দিচ্ছেন কেন?” শান্তকণ্ঠে বললো সুস্মিতা। “বলছি তো, ওটা আমি বলবো।”

“জাস্ট নেইম ইট!” চোয়াল শক্ত করে বললো পিএস।

সুস্মিতা কিছু একটা বললো প্রায় অস্কুটস্বরে।

“কী বললে!?” মেয়েটা থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে পিএস, তার বলা কথাটা শুনতে পায়নি স্পষ্ট করে।

“বেশি জোরে বলতে পারবো না, তাহলে ও শুনে ফেলবে,” দরজার বাইরে থাকা আসলামের দিকে ইঙ্গিত করলো।

“ও শুনবে না,” জোর দিয়ে বললো পিএস।

“যদি শুনে ফেলে?”

গভীর করে নিশ্বাস নিলো আশেক মাহমুদ। “শুনলে কী হবে? ও আমার অনেক বিশ্বস্ত।”

“আপনি শিওর, ও শুনে ফেললে কিচ্ছু হবে না?”

সুস্মিতার হেয়ালিটা মোটেও ভালো লাগলো না পিএসের। রেগেমেগে কাছে এসে তার চুলের কুঁটিটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিলো। “জাস্ট সে ইট…ইউ বিচ!”

বন্দী বেশ শব্দ করে নিশ্বাস নিলো, যেনো আশেক মাহমুদের শরীরের গন্ধ নিচ্ছে! মেয়েটার এমন আচরণে ভড়কে গিয়ে চুলের মুঠিটা ছেড়ে দেবে পিএস, তার আগেই দেখলো ফিসফিসিয়ে কী যেনো বলে উঠলো সে।

“কী বললে?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো আশেক মাহমুদ।

“অত জোরে বলতে পারবো না…কাছে এসো!”

পিএস দেখতে পেলো, বন্দীর অভিব্যক্তি পাল্টে গেছে, নেশাগ্রস্তের মতো দেখাচ্ছে তাকে।

“আমি চাই না এটা অন্য কেউ জেনে যাক!” নীচু কণ্ঠে বললো সে।

আশেক মাহমুদ বন্দীর খুব কাছে চলে এলো। হাত-পা বাঁধা এক মেয়ে কীই বা করতে পারবে! সুতরাং মেয়েটা মুশকান জুবেরি জানা সত্ত্বেও পিএস বিন্দুমাত্র ভয় পেলো না। ঘরের বাইরে তার গানম্যান আসলাম আছে, উল্টাপাল্টা কিছু করলে একে ছিঁড়ে খুবলে খাবে সে।

“আবার বল!” তাড়া দিলো পিএস।

বন্দী খুবই নীচুকণ্ঠে বলে দিলো যেটা জানার জন্য আশেক মাহমুদ উতলা হয়ে আছে। কান খাড়া করে শুনে গেলো সেটা, তারপর একটু পিছিয়ে গেলো সে। তার চোখেমুখে বিজয়ীর অভিব্যক্তি, যেনো মহার্ঘ্য কিছু জানতে পেরেছে।

“ঐ ষণ্ডাটা জানলে কিন্তু তোমাকেই খেয়ে ফেলবে!”

কথাটা শুনে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ, তবে নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হলো। “ওকে নিয়ে তোর চিন্তা না করলেও হবে, ডাইনি কোথাকার!”

“ডাইনি বলে গালি দেবে না, বলে দিচ্ছি,” নেশাগ্রস্তের মতো করে বললো মেয়েটি। যেনো দীর্ঘ সময় ধরে বন্দী অবস্থায় থেকে, টর্চার হতে হতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। তারপর হেসে ফেললো। “গাণ্ড কোথাকার!”

আশেক মাহমুদ সন্দেহগ্রস্ত দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। এই গালিটার মানে তার জানা নেই। “কী বলতে চাচ্ছিস, তুই?” অবশেষে বললো সে।

সুস্মিতা আরো কিছু বলতে যাবে, অমনি তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। ফোনের ডিসপ্লেতে কলার আইডি দেখেই ভুরু কুঁচকে গেলো তার। আস্তে করে উঠে ঘরের বাইরে চলে গেলো আবার। আসলামকে ইশারা করলো ঘরে ভেতরে যাবার জন্য।

“হ্যাঁ, বলুন…” সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে এসে বললো পিএস। তাকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলটা করেছে।

“ডাক্তার আসকারের সাথে আপনার সমস্যাটা কি, একটু বলবেন? তাকে আপনি দেশের বাইরে যেতে দিচ্ছেন না কেন? তিনি তো খুব অসুস্থ, বিদেশে যাওয়াটা খুবই জরুরী।”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো প্রধানমন্ত্রীর পিএস। তার দল ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আর উপমন্ত্রী রিক্রুট করার সময় অনেকেই জোর লবিং শুরু করেছিলো, আশেক মাহমুদকে ধরেওছিলো অনেকে, যেনো তাদের ভাগ্যে মন্ত্রীত্বের শিকে ছেড়ে। পিএস তখন এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হয়ে তদবির করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তবে এটাও ঠিক, তার তদবিরে ভদ্রলোক মন্ত্রীত্ব পায়নি, প্রধানমন্ত্রীর গুডবুকে আগে থেকেই নামটা ছিলো। সম্ভবত মন্ত্রীত্ব লাভের পর ভদ্রলোক এটা জেনেও গেছে, তাই পিএসের প্রতি খুব একটা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে না।

“আমি আপনার সাথে দেখা করে সব খুলে বলবো। আপনি ডাক্তারকে নিয়ে চিন্তা করবেন না…পুরোপুরি সুস্থ আছে, অসুস্থতার ভান করে বিদেশে যেতে চাইছে সে।”

ফোনের ওপাশে নীরবতা নেমে এলো। “উনার মেয়ে…” কয়েক মুহূর্ত পর দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললো মন্ত্রী, “…বাড়ি থেকে বের হবার পর আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না তার।”

“তাই নাকি।” রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দটাই ব্যবহার করলো সে।

“মেয়েটার ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার সাথে আরেকটা ছেলেও আছে…একেবারেই নিরীহ একটা ছেলে।”

পিএস আরো কিছু শোনার জন্য চুপ মেরে রইলো। মন্ত্রীর ইঙ্গিতটা ধরতে বেগ পেতে হলো না তার নিরীহ কারোর ক্ষতি যেনো না করা হয়।

“ওদের সাথে খারাপ কিছু হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া খুবই কঠিন হয়ে যাবে।”

“আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন?” এবার একটু আগ্রাসি না হয়ে পারলো না আশেক মাহমুদ।

ফোনের ওপাশে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো। “ডাক্তার আসকারের সন্দেহ, যে লোক তাকে বিদেশে যেতে বাধা দিয়েছে সে-ই তার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে।”

আশেক মাহমুদ নিজের ক্রোধ সংবরন করে নিলো দ্রুত। এরকম পরিস্থিতি যে হবে ধারণাও করতে পারেনি। তবে সমস্যা মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদতে নিজেদেরই লোক, তারা সবাই একে অন্যকে চেনে। এমন নয় যে, সরকারের এক মন্ত্রী কোনো কিছু করলো আর বাকিরা সেটা জানতে পারলো না-এটা আসলে ওপেন সিক্রেট ক্লাব। প্রায় সবাই সবার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিবহাল থাকে। সুতরাং তার কাছে মুখোশ পরে থাকার কোনো দরকার নেই।

“শুনুন, আশফাঁকসাহেব,” শান্তকণ্ঠে বললো পিএস। “আগেই বলেছি, দেখা করে আপনাকে সব খুলে বলবো। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত একটি ব্যাপার। তবে আপনাকে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ডাক্তার আসকার যাকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করছে, আদতে সে তার মেয়ে তো দূরের কথা, কোনো রিলেটিভও নয়।”

“বলেন কি!” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আৎকে উঠলো। “তাহলে ডাক্তার কেন এটা বলছেন?”

“কারণ সে একজন অপরাধীকে বাঁচাতে চাইছে।”

“কীসের অপরাধী? কার কথা বলছেন আপনি?”

এবার পিএস দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “বললাম তো, আমি আপনাকে খুলে বলবো…খুব জলদি।” একটু থেমে আবার বললো, “আপনি শুধু আপাতত কয়েকটা দিন ঐ ডাক্তারকে অ্যাভয়েড করুন। বুঝতে পেরেছেন?”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “কিন্তু উনি যদি কেসটেস করে বসেন?”।

মাথা দোলালো আশেক মাহমুদ, যদিও ফোনের ওপাশে যে আছে সে এটা দেখতে পাচ্ছে না। “ট্রাস্ট মি, ডাক্তার এটা করবে না…ভুলেও না!”

ফোনের ওপাশ থেকে আবারো নেমে এলো নীরবতা। “ঐ নিরীহ ছেলেটা…” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশফাঁক মিম্রয়মান কণ্ঠে বললো, “…আমি চাই না কোনো রকম কোলাটেরাল ড্যামেজ হয়, বুঝতে পেরেছেন তো?”

আশেক মাহমুদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। “ডোন্ট ওরি।” কলটা ওপাশ থেকে কেটে দেয়া হলে উদাস হয়ে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর সম্বিত ফিরে পেতেই ফোনটা পকেটে রেখে আবারো ফিরে গেলো ঘরে।

.

অধ্যায় ৭৫

কততক্ষণ ধরে যে অন্ধকার ঘরে পড়ে আছে শ্যামল জানে না। সেই দুপুর থেকে তার হাত-মুখ-পা বেঁধে নীচতলার পরিত্যক্ত একটি ঘরে ফেলে রেখে গেছে লোকগুলো, তারপর আর খোঁজ করতে আসেনি। প্রথম কয়েক ঘণ্টা তীব্র আতঙ্কে অসাড় হয়ে পড়ে ছিলো সে। গ্রামের সহজ সরল ছেলে, জীবনে প্রথম বার ঢাকায় এসেই কিনা এমন পরিস্থিতির শিকার হলো!

প্রচণ্ড খিদে আর পানির পিপাসায় জিভ শুকিয়ে গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মৃত্যুভয়ে তটস্থ সে। তার মনে হচ্ছে না এ বাড়ি থেকে পৈতৃক প্রাণটা নিয়ে বের হতে পারবে, ফিরে যেতে পারবে না সুন্দপুরে।

দুপুরে যখন এখানে, এই পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটের বড় একটা ঘরের এককোণে তাকে ফেলে গেলো তখন সে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলো। মশার কামড়ে জ্ঞান ফিরে এলে দেখতে পায় কিছুটা আলো তখনও আছে। এরপর নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

এখন, এই কয়েক ঘণ্টা পর গাঢ় অন্ধকারে চোখ মেলে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।

রাত?

অবশ্যই। কিন্তু কয়টা বাজে তার কোনো ধারণাই নেই। এ কয় ঘণ্টায় তার মানসিক অবস্থার উত্থান-পতন দুটোই ঘটেছে। প্রাথমিক ভীতিটা তাকে একেবারে শেষ করে দিয়েছিলো। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে সেই ভীতি অনেকটাই কেটে গেছে, এখন পালানোর চিন্তা করার মতো সাহসও দেখাচ্ছে সে! অন্তত বিষয়টা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিগত এক ঘণ্টা ধরে।

শ্যামল খেয়াল করেছে, তাকে একবারের জন্যেও কেউ দেখতে আসেনি। সম্ভবত সুস্মিতাদিকে নিয়েই লোকগুলো ব্যস্ত।

দিদিকে ওরা কী করছে? চিন্তাটা মাথায় আসতেই কান্না পেলো তার। নিশ্চয় খারাপ কিছু করছে। এই দিদি শ্যামলকে খুব স্নেহ করে, তার খারাপ কিছু হোক সে চায় না। কিন্তু যারা তাদেরকে তুলে নিয়ে এসেছে এই বিরাণ বাড়িতে তারা যে দিদির সাথে খারাপ কিছু করবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে।

শ্যামল কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে নিলো। দিদিকে রক্ষা করতে হলে তাকেই করতে হবে। ছোটোবেলায় পড়া রবিঠাকুরের বীর পুরুষ কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেলো। সেই ছোট্ট খোকা যদি মাকে রক্ষা করতে পারে কতোগুলো ডাকাতের হাত থেকে, তাহলে সে-ও পারবে। তবে এ কাজ সে ঐ খারাপ লোকগুলোর সাথে মারামারি করে পারবে না। এই জীবনে ঐ একটা কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। সে হলো রমাকান্ত মাস্টারের হাতে মানুষ হওয়া ছেলে, ছোটোবেলা থেকেই মাস্টার তাকে শিক্ষা দেবার পাশাপাশি ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। অন্যান্য ছেলেদের মতো মারামারি করার অভিজ্ঞতা তার নেই। এ জীবনে কারো সাথে ঝগড়াও করেনি কখনও। খুবই নরম স্বভাবের মানুষ সে।

সুতরাং একটাই উপায় আছে-তাকে এখান থেকে পালাতে হবে।

টের পেলো পায়ে মশা কামড়াচ্ছে। মশাদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাঁধা পা দুটো নড়াচড়া করার চেষ্টা করছে একটু পর পর। এভাবে করতে গিয়ে ধারালো কিছুতে পা লেগে গেলো। টের পেলো ওটা এই ঘরের একটি পিলার। তার পা-টা সেই পিলারের খুব কাছেই, পিলারের নীচের দিকের অনেকটা অংশে প্লাস্টার খসে আছে, ফলে সেখানে পা লেগে ছিলে গেছে খানিকটা।

শরীরটা গড়িয়ে সেই পিলারের কাছে নিয়ে গেলো শ্যামল, অনেক কষ্টে পিলারে ঠেস দিয়ে উঠে বসলো সে। তার পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হাতদুটো পিলারের সেই ধারালো অংশের নাগাল পাচ্ছে এখন। এরপর ধীরে ধীরে হাতের বাঁধন দড়িরটা পিলারের ধারালো অংশের সাথে ঘষে ঘষে ছেঁড়ার চেষ্টা করে গেলো।

খুব আস্তে আর দেবে দেবে করলো যেনো দড়িটা ছিঁড়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই পায়ের শব্দ শুনে থমকে গেলো সে। সারাটা দিন কেউ এখানে আসেনি। আর যখন সিদ্ধান্ত নিলো পালাবে, তখনই কিনা লোকজন চলে এলো!

নিজেকে খুব অসহায় লাগলো শ্যামলের, খুব কান্না পেলে তার।

.

অধ্যায় ৭৬

ঘরে ঢুকেই বন্দীর দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো নুরে ছফা।

সে ভাবতেই পারছে না, এই মেয়েটাই আসলে মুশকান জুবেরি! চেহারা পুরোপুরি পাল্টে ফেলেছে! তাকে যারা চেনে তারা যদি এখন দেখে, বিশ্বাসই করতে চাইবে না। আগের মুশকানের সাথে এখনকার চেহারার একটুও মিল নেই। সার্জন ডিপি মল্লিককে যে প্রচুর সার্জারি করতে হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ছফার ধারণাই ছিলো না, এভাবে সার্জারি করে চেহারা আমূল পাল্টে ফেলা সম্ভব।

কিন্তু অসম্ভব কাজটাই করেছে দয়াল প্রসাদ মল্লিক। মনে মনে সার্জনের প্রশংসা না করে পারলো না। বেচারা যদি জানতো কার চেহারাটা পাল্টে দেবার কাজ নিয়েছিলো!

মাস্টার আর গানের শিক্ষিকার ফোন নাম্বার পেলেও তার সব মনোযোগ ছিলো রমাকান্তকামারের উপরে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, যাকে হন্যে খুঁজছে সে একেবারে নাগালের মধ্যেই আছে!

“আপনার কথাই ঠিক,” পিএস বললো বেশ সন্তুষ্ট হয়ে। ঘরের একমাত্র ডাবল সোফাটায় বসে আছে সে, তার মুখে প্রসন্ন হাসি। আসলাম দাঁড়িয়ে আছে বন্দীর পাশেই। “এই মেয়েটাই মুশকান। প্রথমে কোনো কিছুই স্বীকার করছিলো না, তবে একটু আগে সব স্বীকার করে নিয়েছে।”

নুরে ছফা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে এগিয়ে গেলো বন্দীর দিকে।

“বার বার নিজেকে ডাক্তার আসকারের মেয়ে বলে দাবি করছিলো। শি ওয়াজ অ্যা হার্ড নাট টু ক্র্যাক!”

এ ব্যাপারে ছফার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। তারপরই সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো সে, “হ্যালো, রুখসান!”

অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে ফেললো বন্দী। পিএস আশেক মাহমুদ আর আসলাম একে অন্যের দিকে তাকালো। তারাও যারপরনাই অবাক।

“ছফা, আপনি এসব-”

হাত তুলে পিএসকে থামিয়ে দিলো নুরে ছফা। তার দিকে ফিরে আশ্বস্ত করার ভঙ্গি করলো সে। বন্দীর দিকে ফিরলো আবার। “তোমার নাম তো রুখসানই…তাই না?”

“বুল শিট! আমি সুস্মিতা…সুস্মিতা সমাদ্দার!” বেশ চেঁচিয়েই বললো।

মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ছফার ঠোঁটে। তবে সেই হাসিতে প্রশান্তিও আছে। “তাহলে তুমি রুখসান নও?”

অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করে দৃঢ়তার সাথে বললো বন্দী, “এই রুখসানটা আবার কে? আপনি কার কথা বলছেন?”

ভুরু কপালে উঠে গেলো ছফার। “কেন, ডাক্তার আসকার তো আমাকে এ কথাই বলেছেন…তুমি আসলে রুখসান!”

বন্দীর চোখ কুঁচকে গেলো।

আশেক মাহমুদ কিছু বুঝতে না পেরে আসলামের দিকে তাকালো। সে কাঁধ তুললো কেবল, মুখে কিছুই বললো না। ছফার এমন কর্মকাণ্ডে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে সেটা কারোর কাছেই পরিস্কার নয়।

“আমি সুস্মিতা সমাদ্দার! ওকে? ইউ বাঞ্চ অব ব্লাডি ফুস!” তিক্তমুখে বললো সে। “একজন এসে আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে বলাতে চাইছে, আমি মুশকান…আরেকজন এসে বলছে, আমি রুখসান! হোয়াট দ্য হেল ইউ আর ট্রাইং টু ডু?”

মুচকি হাসলো ছফা। স্থিরচোখে চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। “তোমার মায়ের নাম কি, বলো তো?”

বিস্মিত হলো সুস্মিতা।

“আমি জানতে চাচ্ছি, তোমার মায়ের নাম কি?” এবার ধমকের সুরে করা হলো প্রশ্নটা।

গভীর করে দম নিয়ে নিলো বন্দী। “শুভমিতা সমাদ্দার।”

ভুরু কপালে তুলে অবাক হবার ভান করলো ছফা। “অবশ্য কলকাতা থেকে এরকমটাই শুনে এসেছি, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, তুমি বলবে তোমার মায়ের নাম মুশকান সোহেলি!”

ঘরে আলোড়ন তুললো কথাটা। একই সাথে সুস্মিতা, পিএস আর আসলাম অবাক হলো।

“মুশকান আমার মা!? ইউ পিপল গন ম্যাড!” অবিশ্বাসে বললো বন্দী।

মাথা দোলালো ছফা। “আমি না, পাগল তোমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ডাক্তার আসকার। ভদ্রলোক কখন কী বলেন নিজেও জানেন না বোধহয়।”

চোখ কুঁচকে তাকালো সুস্মিতা, কী বলবে ভেবে পেলো না। নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে।

“এসব কী হচ্ছে?” অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো পিএস।

ছফা তাকালো তার দিকে। “সরি, স্যার। আমি আসলে একটা তথ্য যাচাই করছিলাম।”

আসলাম মাথা নেড়ে সায় দিলো। এতোক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। ডাক্তার আসকার তার সামনেই এই গল্পটা করেছিলেন, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলো না তখন।

এদিকে সুস্মিতা কিছুই বুঝতে পারছে না, সে চেয়ে আছে ছফার দিকে। “কীসের তথ্য?” জানতে চাইলে পিএস।

“ডাক্তার আসকার আমাকে বলেছিলেন, যে মুশকানকে আমি খুঁজছি, সে আসলে রুখসান। আর রুখসানের মা হলো মুশকান।”

“কী বলছেন এসব?”

“বাদ দিন, স্যার। ওটা ছিলো ডাক্তার আসকারের আরেকটি ধোঁকা।”

“হুম, তা ঠিক আছে, কিন্তু এই মেয়েটা…ও-ই তো মুশকান?”

মাথা নেড়ে পিএসকে আশ্বস্ত করলো ছফা। “এ ব্যাপারে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই এখন। কলকাতা থেকে সব জেনে এসেছি।”

“কী জেনে এছেন?” চেঁচিয়ে উঠলো সুস্মিতা।

বাঁকা হাসি দিয়ে মেয়েটার দিকে ফিরলো সে। “তোমার সমস্ত কীর্তিকলাপ!”

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো বন্দী।

“প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিককে দিয়ে নিজের চেহারাটা বদলে ফেলার পর তাকে হত্যা করেছে,” একটু থেমে পিএসের দিকে তাকালো। “তারপরও থেমে থাকেনি, স্যার, সুকুমার রঞ্জন নামের আরেকজনকে শিকার বানিয়েছে এই ডাইনি।”

আশেক মাহমুদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।

“ডাক্তার আসকার ওকে কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন নিজের শ্বশুড় বাড়িতে। এমন কি, যে ডিপি মল্লিককে দিয়ে চেহারাটা বদলে ফেলেছে এই ডাইনি, তার খোঁজও ডাক্তারই দিয়েছেন।”

“ঐ ডাক্তার ওর সব অপকর্মের সঙ্গি,” বললো পিএস। “অসুস্থতার ভান করে দেশ ছাড়তে চেয়েছিলো, আমি আটকে দিয়েছি।”

সুস্মিতা স্থিরচোখে তাকিয়ে রইলো পিএসের দিকে। লোকটা কে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। তবে সে বুঝতে পারছে, ক্ষমতাবান কেউই হবে।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “স্যার, আপনি চাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে আপনার বোনকে এখন দেখাতে পারেন, হাসিবের হত্যাকারী-”

ছফার কথা শেষ হবার আগেই আক্ষেপে মাথা দোলালো আশেক মাহমুদ। “এই ডাইনি তো চেহারাটাই পাল্টে ফেলেছে…আমার বোন তাকে দেখলে বিশ্বাস করতে চাইবে না, ভাববে…” কথাটা শেষ করলো না সে।

এবার ছফা বুঝতে পারলো। মৃত্যুপথযাত্রি হাসিবের মা মুশানের এই চেহারা দেখলে হয়তো ভাবতে পারে, তার ভাই তাকে শেষ সময়ে এসে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে চাইছে। মাথা থেকে চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিলো সে। “আচ্ছা, ওর সঙ্গে যে ছেলেটা ছিলো সে কোথায়?” আসলামের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো।

“নীচতলায় আছে,” ছোট্ট করে জবাব দিলো সাবেক এসআই।

“নিরীহ একটা ছেলে, ওকে ছেড়ে দিলেই ভালো হয়।”

পিএস তাকালো আসলামের দিকে।

“ওকে ছেড়ে দিলে সমস্যা হবে না?” গানম্যান সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো।

“কী সমস্যা করবে ও?” পাল্টা জানতে চাইলে ছফা। “আমরা যাকে খুঁজছিলাম তাকে পেয়ে গেছি। এই আসামীকে এখন হাসিবের কেসে অ্যারেস্ট দেখাবো, এর সাথে ঐ ছেলেটার কোনো সম্পর্ক নেই।”

কিছুই বললো না আসলাম।

“ওকে একটা সিএনজিতে তুলে বাসস্টেশনে পাঠিয়ে দিলেই ভালো হয়,” ছফা প্রস্তাব দিলো। “কিছু টাকা দিয়ে দিলে সুন্দরপুরে চলে যেতে পারবে ছেলেটা।”

কথাটা শুনে কিছুটা আশান্বিত হলো সুস্মিতা।

সম্মতির জন্য পিএসের দিকে তাকালো আসলাম। আশেক মাহমুদের মধ্যে দ্বিধা দেখা দিলেও কী যেনো ভেবে ছফার কথাটা মেনে নিলো অবশেষে।

“ঠিক আছে…ছেড়ে দাও ওকে।”

এটা পছন্দ হলো না গানম্যানের, তারপরও কোনো প্রতিবাদ না করে নীচে চলে গেলো।

“এ পর্যন্ত কয়জনকে শিকার বানিয়েছে কলকাতায়?” বন্দীকে জিজ্ঞেস করলো ছফা।

গভীর করে দম নিলো সুস্মিতা, কিন্তু কিছুই বললো না।

“আর হাসিবকে কী করেছে সেটাও বলো। এখন তোমাকে বলতেই হবে, না বলে উপায় নেই।”

সুস্মিতা মুখটা সরিয়ে নিলো অন্যদিকে।

“তুমি ভেবেছিলে আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে?” বন্দীর দিকে একটু ঝুঁকে এলো সে। “কলকাতায় গিয়ে নতুন চেহারা আর নতুন পরিচয় নিয়েছিলে কি সুন্দরপুরে ফিরে আসার জন্যই? ওখানকার পুলিশের নজরে পড়ে যাও বলে কলকাতা থেকে পালিয়ে আবার পুরনো জায়গায় ফিরে গেছিলে?”

বাঁকা হাসি দিলো সুস্মিতা। “আমি তো ভেবেছিলাম ওঁ-ই পালের গোদা,” পিএসকে ইঙ্গিত করে বললো। “এখন দেখছি নতুন আরেকজন এসে হাজির!”

ছফা ভুরু কুঁচকে তাকালো। “আমাকে তুমি চেনো না? নাকি না চেনার ভান করছো?”

ছফাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো সুস্মিতা। “চিনবো না কেন, আমাদের স্কুলে…মাস্টারমশাইয়ের অফিসে দেখেছি না ক-দিন আগে।”

অবাক হলো নুরে ছফা। “ক-দিন আগে!” কপট প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললো সে। “দারুণ। তিন বছর আগের স্মৃতি তাহলে বেমালুম ভুলে গেছে? নাকি ভুলে যাওয়ার ভান করছো?”

এবার সুস্মিতার অবাক হবার পালা। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ছফার দিকে। কিছুই বুঝতে পারছে না যেনো।

পিএস কিছু বলতে যাবে অমনি ঘরে ঢুকলো আসলাম। তার চোখেমুখে অস্থিরতা। “কী হয়েছে?”

“ঐ ছেলেটা…” ইতস্তত করলো গানম্যান।

ছফা আর সুস্মিতাও আগ্রহী হয়ে তাকালো।

“ছেলেটা তো নেই!”

“কি!” পিএস আৎকে উঠলো।

“নেই মানে কি?” জানতে চাইলো ছফা।

একটু কাচুমাচু খেলে আসলাম। “ওকে নীচ তলায় রেখেছিলাম, ওখানে গিয়ে দেখি নেই…পালিয়েছে। সেলিম আর বদরুল কিছুই বলতে পারছে না।”

সুস্মিতা অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। কথাটা বিশ্বাসই হচ্ছে না তার।

“হাত-পা-মুখ বাঁধা ছিলো,” ব্যাখ্যা করলো আসলাম। তাকে খুবই লজ্জিত দেখাচ্ছে এখন। “দড়ি খুলে পালিয়েছে।”

“মিথ্যে কথা!” প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো সুস্মিতা।

ঘরের বাকি তিনজন পুরুষ অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে।

“ওরা শ্যামলকে খুন করেছে!”

.

অধ্যায় ৭৭

সুস্মিতার অভিযোগের কথা শুনে পিএস আশেক মাহমুদ আর আসলাম রেগেমেগে একাকার হলেও নুরে ছফার কেনজানি মনে হচ্ছে, আসলেই ছেলেটাকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে।

উইটনেস এলিমিনেশন? হতে পারে।

“আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিলো,” সুস্মিতা কাঁদতে কাঁদতে বললো। “ওরা ওকে মেরে ফেলবে।”

“চুপ কর্!” ধমক দিয়ে উঠলো আসলাম। “ন্যাকামি চোদাবি না, মাগি! ওই ছেলে পালিয়েছে।”

“আমি বিশ্বাস করি না!” চেঁচিয়ে উঠলো বন্দী। “ও খুবই সহজ-সরল একটা ছেলে, জীবনে প্রথম এ শহরে এসছে।”

পিএস গভীর করে দম নিলো, নিজের রাগ দমন করতে বেগ পাচ্ছে। সে। কিন্তু ছফা কিছু না বলে পিএস আর তার গানম্যানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে।

“আমি অনেক চেষ্টা করেছি শ্যামলকে বাঁচাতে…পারলাম না,” অশ্রুপাত করতে করতে বললো। “আমাকে ক্ষমা করে দিস, শ্যামল।”

“মাগি, তুই নাটক বন্ধ করবি নাকি…” বলেই আসলাম তেড়ে গেলো বন্দীকে মারতে।

“আসলাম!” বাধা দিলো ছফা। পিএসের গানম্যানকে সরিয়ে দিয়ে বন্দীর সামনে এসে দাঁড়ালো সে। “ওই ছেলেকে এরা খুন করবে কেন? আশ্চর্য!” কিন্তু কথাটা নিজের কাছেই কেমন দুর্বল শোনালো।

“আপনি আসার আগে এই লোক আমাকে হুমকি দিয়েছিলো শ্যামলকে খুন করবে বলে!” কান্নার দমকে হাপাচ্ছে সুস্মিতা।

“ওকে খুন করার হুমকি কেন দেবে?”

“কারণ,” পিএসের দিকে তাকালো বন্দী। “এই লোক কী সব জানতে চাইছিলো আমার কাছে। যদি না বলি তাহলে শ্যামলকে খুন করার ভয় দেখিয়েছিলো তখন।”

ভুরু কুঁচকে গেলো ছফার, পিএসের দিকে তাকালো সে। কেমন বিব্রত বোধ করছে আশেক মাহমুদ।

তারপর আবার মেয়েটার দিকে ফিরলো। “কী জানতে চেয়েছিলো?”

“ওর কথা বিশ্বাস করবেন না,” রেগেমেগে বললো পিএস। “উল্টা পাল্টা বলে আপনাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে ডাইনিটা।”

পিএসের দিকে অবিশ্বাসে তাকালে বন্দী। রাগে ঘেন্নায় চিৎকার করে বলে উঠলো, “লায়ার!”

আসলাম আবারো তেড়ে আসতে চাইলো কিন্তু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো ছফা। স্থিরচোখে বন্দীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “উনি কী জানতে চেয়েছেন তোমার কাছে?”

“এই লোক কী সব বলছিলো আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, বিশ্বাস করুন,” সুস্মিতা সমাদ্দার বললো। “শেষে শ্যামলকে বাঁচানোর জন্য কিছু একটা বানিয়ে বলে দিয়েছি। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আমার।”

পিএস কথাটা শুনে নিজের অভিব্যক্তি লুকাতে পারলো না, দাঁতে দাঁত পিষে চেয়ে রইলো কেবল।

“উনি কী জানতে চেয়েছেন, বলো?” তাড়া দিলো ডিবির ইনভেস্টিগেটর।

“এই লোকটা বার বার জানতে চাইছিলো, মানুষের শরীরের কোন্ অগ্যানটা খেলে…” বমির উদ্রেক করছে এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে।

সুস্মিতা কথাটা শেষ না করলেও ছফার বুঝে নিতে কোনো সমস্যা হলো না। অবিশ্বাসে তাকালো পিএসের দিকে।

.

অধ্যায় ৭৮

রাতের খাবার খেয়ে আবার বই নিয়ে বসেছে কেএস খান। এই বইটা চুম্বকের মতো টেনে রেখেছে তাকে। প্রায় শত বর্ষের পুরনো একটি ক্লাসিক। এক বন্ধু কানাডা থেকে পাঠিয়েছে গত সপ্তাহে-সেভেন পিলার্স অব উইজডম। লরেন্স অব অ্যারাবিয়াখ্যাত স্যার টিই লরেন্সের আত্মজৈবনিক এই বইটি আকারে যেমন বিশাল তেমনি সুখপাঠ্য। চোখের সামনে এরকম বই মেলে রাখতে পারলে অন্য রকম ভালো লাগে তার। কিন্তু পাশের ঘর থেকে মটু পাতলু নামের নিম্নমানের একটি হিন্দি কার্টুনের শব্দ বার বার বিরক্ত করছে তাকে। আইনস্টাইনের নতুন নেশার নাম এই মটু পাতলু। পারে তো সারা দিনই টিভিতে এই কার্টুন দেখে সে। টিভির শব্দের পাশাপাশি আইনস্টাইনের বালখিল্য হাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে একটু পর পর। ছেলেটার এই শিশুতোষ বিনোদনে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে চায় না সে, কিন্তু বার বার তার পড়ায় মনোযোগ নষ্ট করছে এটা।

“আইনস্টাইন?” জোরে ডাক দিলো। “সাউন্ডটা একটু কমা!”

কাজ হলো এতে। টিভির ভলিউম কমিয়ে দিলো ছেলেটি।

সন্তুষ্ট হয়ে খোদাদাদ শাহবাজ খান আবারও মনোযোগ দিলো বইয়ের পৃষ্ঠায়। লরেন্সের রোমাঞ্চকর কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে ডুবে গেলো সে। এই বই থেকেই বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র লরেন্স অব অ্যারাবিয়া নির্মাণ করা হয়েছিলো, স্কুল পালিয়ে সেই ছবি মধুমিতা সিনেমা হলে গিয়ে দেখার স্মৃতিটা মনে পড়ে গেলো তার। পিটার ওটুলের অসাধারণ অভিনয়, বেদুইন শেখের চরিত্রে ওমর শরীফের অদ্ভুত অ্যাকসেন্টে বলা ইংরেজি, মরুভূমির চমৎকার দৃশ্য, মরুঝড়, মরিচীকা, বেদুইনদের সাথে যুদ্ধ-ডেভি লিনের বিশাল ক্যানভাসের মহাকাব্যিক চলচ্চিত্রটিকে পরিণত করেছে অল টাইম ক্লাসিকে।

এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠলে একই সাথে বিরক্ত এবং অবাক হলো কেএস খান। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত দশটার পর কে এলো?

আইনস্টাইনকে কিছু বলতে হলো না বলে খুশিই হলো। দরজা খোলার শব্দ শুনে বুঝতে পারলো, ছেলেটা তার প্রিয় কার্টুন রেখে দেখতে গেছে এই অসময়ে কে এসেছে।

ভাড়াটেদের কেউ হতে পারে। এরা পান থেকে চুন খসলেই সোজা তার কাছে চলে আসে। কারোর দরজার নব লুজ হয়ে গেছে তো, কারোর বাথরুমের ট্যাপ কাজ করছে না। কেউ এসে বলবে, ফ্ল্যাশটা নষ্ট, কেউ জানাবে এ মাসে ভাড়া দিতে একটু দেরি হবে, কী একটা সমস্যা হওয়াতে হাত খালি হয়ে গেছে। মালিক হিসেবে সে যথেষ্ট উদার, অন্য সব বাড়িওয়ালাদের মতো আচরণ করে না। আইনস্টাইনও যথেষ্ট সজাগ থাকে সব সময়, আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ভাড়াটেরা-রাত-বিরাতে এসে হাজির হয় সমস্যার কথা নিয়ে। যেনো এক্ষুণি সমস্যার সমাধান করে দিতে হবে!

তিক্ততায় মুখ বিকৃত হয়ে গেলো আনমনেই। বইটা বুকের উপর রেখে শোনার চেষ্টা করলো অসময়ে কে এলো, কী অভিযোগ নিয়ে এলো। কিন্তু কোনো কিছুই তার কানে গেলো না, শুধুমাত্র পাশের ঘর থেকে মটু পাতলু’র মৃদু শব্দটা ছাড়া। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যে-ই না আইনস্টাইনকে ডাকতে যাবে, তখনই তার মনে হলো শিয়রের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে!

চমকে পেছন ফিরে তাকাতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেলো! এতোক্ষণ ধরে আত্মজৈবনিকমূলক একটি বই পড়ছিলো-কিন্তু এখনকার বাস্তবতাটা হরর গল্পের চেয়েও বেশি ভীতিকর!

.

অধ্যায় ৭৯

প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে, গুলশানের সেই গোপন আস্তানার এক ঘরে পড়ে ছিলো শ্যামল। চেষ্টা করছিলো হাতের বাঁধনটা ছিঁড়ে ফেলতে কিন্তু কারোর পায়ের শব্দ শুনে থেমে যায়। একটু পরই টের পায় সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যাবার শব্দ। হাফ ছেড়ে বাঁচে, আবারো মনোযোগ দেয় হাতের বাঁধনটা ছিঁড়ে ফেলার কাজে।

পনেরো-বিশ মিনিটের সাধনার পর দড়িটা ছিঁড়ে যায় অবশেষে। সঙ্গে সঙ্গে হাতের বাঁধনটা খুলে ফেলে। তারপর মুখের বাঁধন খুলতেই বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে নেয়। দীর্ঘ সময় ধরে শুধু নাক দিয়ে নিশ্বাস নিতে নিতে হাপিয়ে উঠেছিলো, নিজেকে ধাতস্থ করতেই পায়ের বাঁধনটা খুলে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যায়। পরক্ষণেই নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়-এই বাড়ি থেকে যতোক্ষণ বের না হচ্ছে সে আসলে বন্দী!

সব সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করবে-রমাকান্তকামারের এই কথাটা স্মরণ করে শ্যামল। কিন্তু ঢাকায় এসে যে পরিস্থিতিতে পড়েছে, সেরকম কোনো কিছু তার গোটা জীবনে ঘটেনি। মানুষসহ সকল প্রাণীকেই সব কাজ প্রথম বারের মতো করতে হয়-মাস্টারের আরেকটি কথা তার মাথার ভেতরে উচ্চারিত হয় তখন।

গভীর করে দম নিয়ে নিঃশব্দে, পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়। শ্যামল। একটা সুবিধা আছে এই বিরাণ বাড়িতে-নীচতলার কোনো ঘরেরই দরজা-জানালা নেই, সবগুলোই চৌকাঠসহ খুলে নেয়া হয়েছে। তাকে রাখা হয়েছে একেবারে ভেতরের দিকে একটা ঘরে। সামনের দিকে যে ঘরটা আছে সেখানে আসতেই দরজার খোলা অংশ আর জানালার ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে বাইরের দৃশ্যটা দেখতে পায়। একটা বাতি থাকার কারণে ওখান থেকে মেইনগেটটা দেখতে পেয়েছিলো-গেটের সামনে এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিনতে পারে সে। দুপুরে এই লোকই তার হাত-পা মুখ বেঁধেছিলো। তার মানে, কমপক্ষে আরো দু-জন লোক আছে।

যে ঘরে তাকে বন্দী করে রেখেছিলো সেখানে আবারও ফিরে আসে শ্যামল। বুঝতে পারে, এটাই বাড়ির পেছন দিক। বড় দুটো জানালা ছিলো যেখানে, সেটা একদমই ফাঁকা, সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে দেখতে পায় বাড়ির পেছন অংশের সীমানা প্রাচীরটি মাত্র চার-পাঁচ হাত দূরেই। জায়গাটা অন্ধকার আর ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ। ঘর থেকে প্রাচীরের ওপাশে কী আছে দেখা যায় না। দেয়ালটা আট ফুটের মতো উঁচু। গ্রামের ছেলে সে, বড় বড় গাছ তর তর করে বেয়ে উঠতে পারে, আর এটা তো একটা দেয়াল!

জানালার ফাঁকা অংশ দিয়ে ঘরের বাইরে চলে যায়, দু-হাত মাথার। উপরে তুলে দেয়ালের উপরের প্রান্তটা ধরতে পারে কোনোমতে। এটাই যথেষ্ট ছিলো তার জন্য। দেয়ালটা শক্ত করে ধরে, পুরো শরীরটা উপরে তুলে দিতেই ডান পা-টা উঁচু করে দেয়ালের উপরে রাখে, এরপর খুব অনায়াসেই উঠে আসে দেয়ালের উপরে। সেখান থেকে নীচের অন্ধকারে ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারে, দুটো বাড়ির সীমানা প্রাচীরের মাঝখানে পাঁচ-ছয় ফুটের মতো যে খালি জায়গাটা আছে সেটা একটা ড্রেন। জায়গায় জায়গায় কংক্রিটের স্ল্যাব বসানো থাকলেও অনেক জায়গাই উন্মুক্ত।

শ্যামল আস্তে করে দেয়ালের প্রান্ত ধরে শরীরটা নামিয়ে দেয়, তার পা নীচের স্ল্যাবটা ছুঁই ছুঁই করতেই হাতদুটো ছেড়ে দিয়ে প্রায় বিনা শব্দে নেমে আসে। স্ল্যাবের উপর নেমেই দু-দিকে তাকায়। ড্রেনটা কিছু দূর গিয়ে বাঁয়ে নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিয়ে সোজা চলে গেছে ছোট্ট একটি টিনের দরজার দিকে, খাটো সেই দরজার উপর দিয়ে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। শ্যামল ওই দরজাটাই বেছে নেয় পালানোর জন্য।

কয়েক মিনিট পরই নীচু গেটটা খুলে ড্রেন থেকে ফুটপাতে উঠে আসে, বুঝতে পারে না কোন্ রাস্তা দিয়ে গেলে কোথায় যাওয়া যায়, কিন্তু এটা বুঝতে পারে, সে এখন পুরোপুরি মুক্ত। বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে রাস্তার ডান দিক দিয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটতে থাকে। রাস্তাটা বেশ সুনশান, দু-পাশের সারি সারি বাড়িগুলো আলোকিত। মাঝেমধ্যে রাস্তা দিয়ে কিছু প্রাইভেট কার আসা যাওয়া করছিলো। রাস্তার বাম দিকে জ্বলজ্বলে একটি নিয়ন সাইন দেখতে পায় সে : তান্দুরি হাউজ। তার পাশের বাড়িটার হোল্ডিং আর রোড নাম্বার মুখস্ত করে নিয়ে হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। তার পকেটে কিছু টাকা আছে, আর সেটাই যথেষ্ট একটা ফোন কল করতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *