১০. কেএস খানের খোলা দরজা

অধ্যায় ১০

নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে কেএস খানের খোলা দরজার সামনে।

তাকে দেখেই ফোনটা ক্রাডলের উপরে রেখে দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “আরে, ছফা যে,” এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। “আপনে যে আসবেন জানতাম না তো।”

নুরে ছফা ঘরের ভেতরে পা ফেললো। “আমি আপনার মোবাইলফোনে কল দিয়ে দেখি সেটা বন্ধ, তারপর ল্যান্ডফোনেও কল দিয়েছিলাম। আইনস্টাইন বললো, আপনি একটু বাইরে গেছেন হাটাহাটি করতে।”

“হ…রোজ বিকালে একটু হাটাহাটি করি পার্কে।”

“তাকে আমি বলেছিলাম, আমি আসছি…সে আপনাকে বলেনি?”

হেসে ফেললো কেএসকে। “পোলাপান মানুষ, মনে হয় ভুইলা গেছে।” একটু থেমে আবার বললো, “বসেন।” নিজেও বসে গেলো সোফায়। “আজকে কি আপনার অফ ডিউটি?”

“না, স্যার…ছুটি পেয়েছি।”

কেএস খান বুঝতে পারলো না। তাদের পেশায় ছুটি নিয়েছি’ পরিচিত শব্দ কিন্তু ছুটি পেয়েছি,’ এটা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। “আচ্ছা,” কোনো রকমে নিজের কৌতূহল দমিয়ে বললো সাবেক ডিবি অফিসার।

“ইয়াল্লা!” দরজার দিক থেকে একটা অল্প বয়েসী কণ্ঠ বলে উঠলে তারা দু-জন সেদিকে তাকালো।

আইনস্টাইন জিভে কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা চায়ের ফ্লাস্ক।

“আমি ভুইল্যা গেছিলাম…স্যারে আমারে ফোনে কইছিলো আইবো।”

“থাক, তরে আর কিছু কইতে হইবো না। যা, দুই কাপ চা দে তাড়াতাড়ি।”

আইনস্টাইন দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যাবার সময় নুরে ছফার দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে গেলো। ছফাও হেসে আশ্বস্ত করলো তাকে।

“ছুটি পাইছেন মানে বুঝলাম না?” উৎসুক কেএসখান অবশেষে প্রশ্নটা করেই ফেললো।

নুরে ছফা গম্ভীর হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য।

সাবেক ডিবি অফিসার ভাবলো, ছফা কোনো কারণে পানিশমেন্টের শিকার হয়েছে কিনা।

“আমাকে স্পেশাল ছুটি দেয়া হয়েছে, স্যার।”

সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেএস খান।

“মুশকান জুবেরিকে ট্র্যাক ডাউন করার জন্য।”

“এরজন্যই কি পয়লা বৈশাখে আপনে ছায়ানটের প্রোগ্রামে গেছিলেন?”

মাথা দোলালো ছফা। “না, স্যার। ছুটি আমি পেয়েছি আজকে।”

“ও।”

“ঐদিন গিয়েছিলাম এমনি। হঠাৎ করেই মনে হয়েছিলো মুশকান জুবেরি ওখানে থাকতে পারে।”

“বলেন কি?” অবাক হলো কেএস খান। “এইটা আপনের মনে হইলো কেন?”

কাঁধ তুললো ছফা। “তা তো জানি না। কেনজানি মনে হলো মহিলা ওখানে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বিরাট বড় ভক্ত। তার মুখ থেকেই শুনেছিলাম, ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নাকি কখনও মিস করেনি।”

“বুঝছি।” মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “মজার ব্যাপার কি জানেন, স্যার? আমার ধারণা মোটেও মিথ্যে ছিলো

“মানে?!” ডিবির সাবেক অফিসারকে বিস্মিত দেখালো।

“ফেরার পথে ঐ মহিলাকে আমি এক ঝলক দেখেছি…শাহবাগের দিকে।”

“কি!”

“একটা প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছিলো…আমি ছিলাম রিক্সায়।”

গাল চুলকাতে শুরু করলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর। “তারপর?”

“গাড়িটা ধরা সম্ভব হয়নি।”

“নম্বরটা দেখেন নাই? ওইটা ট্রেস করলে তো–”

“না, স্যার…ওটার কথা খেয়াল ছিলো না তখন,” উৎসুক কেএস খানকে মাঝপথে দমিয়ে দিলো ছফা।

“ওহ্,” একটু হতাশ হলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

এমন সময় দু-কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো আইনস্টাইন।

“কীরে, আইজকাল তোর চা আনতে এতো দেরি হয় ক্যান?” জানতে চাইলো কেএস খান।

চায়ের কাপ দুটো সোফার সামনে কফি টেবিলের উপর রাখতে রাখতে জবাবদিহি করলো ছেলেটা, “নিচের দোকান থিকা তো এহন আর চা আনি না…ঐ হালারপুতে মুর্দালাশে যে চা-পাতা দেয় ওইগুলা সস্তায় কিইন্যা আনে…ওয়াক থু! চিন্তা করছেন কারবারটা!”

“তরে এইসব কথা কে কইলো?”

কেএসকের দিকে বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকালো আইনস্টাইন। “ওই হালারপুতেরে আমি এক বেটার কাছ থিইক্যা চা কিনতে দেখছি…পাঁচ কেজি কিনলো মাত্র দুইশো ট্যাকা দিয়া। আপানেই কন, অরিজিনাল চা কি এতো সস্তা? তহনই আমি বুইজ্যা হালাইছি, হালারপুতে দুই নম্বরি করে।”

“আইজকাল দেহি কথায় কথায় হালারপুত কস্…ঘটনা কি?” কেএস খান ভুরু কপালে তুলে বললো।

জিভে কামড় দিলো পিচ্চিটা। একটু শরমিন্দা হয়েছে সে, আর কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো।

“চা নেন, ছফা,” নিজের কাপটা নেবার আগে বললো কেএস খান। “আপনে তারে খুবই অল্প সময়ের জন্য দেখছেন,” কাপে চুমুক দিলো মি, খান। “এইটা তো রিলায়েবল হইতে পারে না…অন্য কিছুও হইবার পারে।”

“কী রকম?” ভুরু কুঁচকে তাকালো ছফা।

অমায়িক হাসি দিলো কেএসকে। “আপনের তো হেলুসিনেশানও হইবার পারে, পারে না?”

ছফা একটুখানি বিষম খেলো যেনো। “হেলুসিনেশান?”

“অবাক হওনের কিছু নাই,” ছফাকে আশ্বস্ত করে চায়ে চুমুক দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “আপনের ধ্যান-জ্ঞান হইলো ঐ মহিলা, তারে তিনটা বছর ধইরা পাগলের মতো খুঁজছেন। এরকম সিচুয়েশনে হেলুসিনেশান তো হইবারই পারে।”

ছফা চায়ের কাপটা তুলে নিলো। “কিন্তু আমার মনে হয় না হেলুসিনেশান ছিলো ওটা।”

খোদাদাদ শাহবাজ খানকে দেখে মনে হলো আশ্বস্ত হতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “সার্ভিসে জয়েন করার পর আমার তিন নম্বর কেসটা খুব ভুগাইছিলো, বুঝলেন?”

নুরে ছফা বুঝতে পারলো অতীত রোমন্থনের মেজাজে চলে গেছে মি. খান। জোর করে আগ্রহী হবার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললো চোখেমুখে।

“একটা মার্ডার কেস ছিলো। আমি খুব দ্রুত বাইর করতে পারছিলাম খুনটা কে করছে, কিন্তু সাসপেক্ট ততোক্ষনে পগাড় পার।”

ছফা কিছু বললো না। জানে, গল্পটা শেষ হয়নি। চায়ে চুমুক দিলো সে।

“এরপর কী হইলো জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো আবার, “আমি যেইখানেই যাই ঐ ব্যাটারে খুঁজি। এক পর্যায়ে তারে দেখতেও শুরু করলাম!”

“দেখতে শুরু করলেন মানে?”

“এই ধরেন, মানুষজনের ভীড়ে, পথেঘাটে মনে হইতো তারে দেখছি।” একটু থেমে আবার বললো সে, “আসলে পুরাটাই ছিলো হেলুসিনেশন। এইটারে আপনে ডিশনও কইবার পারেন।”

কাঁধ তুলে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা। “হতে পারে ওটা হেলুসিনেশান। কিন্তু আমি আজকে সেজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। আসলে, আপনার সাথে জরুরী একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছি, সেই সঙ্গে একটা জিনিসও দেখাতে এসেছি, স্যার।”

“কি জিনিস?” কৌতূহলি হয়ে উঠলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

কোনো কথা না বলে চায়ের কাপটা রেখে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে আনলো নুরে ছফা। “এই যে, স্যার।”

কেএস খান আগ্রহভরে ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে দেখলো কয়েক মুহূর্ত। “মুশকান জুবেরির ছবি??” বিস্ময়ে বলে উঠলো সাবেক ডিবি অফিসার।

“জি, স্যার। এটাই মুশকান জুবেরি। অবশেষে তার ছবি আমি পেয়েছি।”

“কইত্থেন পাইলেন এই জিনিস?”

“একেবারেই অবিশ্বাস্য গল্প। আপনার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে।” ছফার মুখে রহস্যময় হাসি।

উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইলো খোদাদাদ শাহবাজ খান।

.

অধ্যায় ১১

“তাজ্জব ব্যাপার!”

নুরে ছফার কাছ থেকে সবটা শুনে বললেন কেএস খান।

বিশাল কাকতালীয় ঘটনাই বটে! মুশকান জুবেরির এক ভিক্টিম, হাসিবের মরণাপন্ন মা আবিষ্কার করেছে সতুর দশকের মাঝামাঝিতে আমেরিকায় যখন স্বামীর সঙ্গে থাকতো তখন তাদের প্রতিবেশী ছিলো মুশকান।

কেএস খানের বিস্ময়ের ঘোর যেনো কাটছেই না। “পুরাই ড্রামা?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। এ ব্যাপারে তার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। “আশেক মাহমুদ এখন চাচ্ছেন আমি যেনো আবার নতুন করে কেসটা নিয়ে কাজ করি।”

মুশকানের ছবিটা একহাতে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে কেএস খান।

“উনার বোন আর বেশি দিন বাঁচবে না। সম্ভবত উনি চাইছেন এই সময়ের মধ্যে আমি যেনো মুশকানকে ধরার ব্যবস্থা করি। এরজন্যে আমাকে সব ধরণের সাহায্য করবেন।”

ছবিটার দিকে তাকিয়েই বললো মি. খান, “এইভাবে টাইম-ফ্রেম কইরা দিলে কিন্তু ইনভেস্টিগেশন করাটা খুব টাফ হয়া যায়। তাছাড়া, আবেগ টাবেগ দিয়া কোনো ইনভেস্টিগেশন করাও ঠিক না। ভদ্রলোক ইমোশনাল হয়া গেছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “ঠিক বলেছেন, স্যার। কিন্তু আমি এই সুযোগটা নেবো।”

ছফার দিকে তাকালো কেএস খান। “কিছু মনে কইরেন না, একটা কথা বলি।”

“জি, স্যার…বলেন?”

“পলিটিশিয়ানদের সাথে কাজ করনের ঝক্কি থাকে, আর এইটা বেশি ভোগায় সৎ অফিসারগো। কথাটা মাথায় রাইখেন।” তারপর একটু থেমে আবার বললো, “বেসিক্যালি, অল অব দেম আর বাস্টার্ডস! আপনে তো এখনও সার্ভিসে আছেন, আপনেও এইটা জানেন।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। তদন্তে রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ, নাক গলানো, প্রভাব বিস্তার করা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা এ দেশে। এ নিয়ে তার নিজের মধ্যেও কম তিক্ততা নেই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করে, তাতে করে এই বাহিনীতে কর্মরতদের মধ্যে কেএস খানের বলা কথাটার বেশ প্রচলন আছে।

“আমি সেটা জানি, স্যার। তারপরও, যেভাবে কেসটা এগোচ্ছিলো তাতে করে তো কোনো কূলকিনারা করা যাচ্ছিলো না, এখন যদি ক্ষমতাবান কারোর কাছ থেকে সব ধরণের সাপোর্ট পাওয়া যায় তাহলে কি সেটা কাজে লাগানো উচিত না?”

ডিবির সাবেক কর্মকতা কিছুই বললো না। যাই হোক, এখন আপনের কাছে মুশকান জুবেরির একটা ছবি আছে…যদিও অনেক পুরানা কিন্তু মহিলার তো তেমন একটা চেঞ্জ হয় নাই, একই রকম আছে, তাই এই ছবিটা অনেক কাজে দিবো।”

“হুম,” সায় দিয়ে বললো ছফা। “ছবিটা হাতে পাবার পরই দ্রুত কাজে নেমে পড়েছি, স্যার। আমার দেখাটা হেলুসিনেশান নাকি সত্যি, সেটা যেহেতু নিশ্চিত করে জানি না তাই আমি আজকেই এয়ারপোর্টে গিয়ে সবগুলো সরকারী-বেসরকারী এয়ারলাইন্সে ছবি দিয়ে এসেছি। দেশের সবগুলো স্থলবন্দরে ফ্যাক্স করে দিয়েছি ছবিটা।”

“ভালো করূছেন,” একটু থেমে আবার বললো কেসকে। “ছবিটা সাকুলেট করা জরুরী ছিলো। ঐ মহিলা যদি দেশে ঢোকে কিংবা বাইর হওনেরও চেষ্টা করে, তাইলে সে ধরা পড়বো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “এখন তো আমি হাত-পা গুটিয়ে। বসে থাকতে পারি না। কিন্তু কোত্থেকে শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।”

কেএস খানের মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো। সেই হাসি যেনো বহু অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। “সব সময় যেইটা আমি কই,” লম্বা করে সশব্দে চায়ে চুমুক দিলো সে। “যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইকাই আপনেরে উঠতে হইব।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো নুরে ছফা।

“আপনেরে ফিরা যাইতে হইবো সুন্দরপুরে।”

“সুন্দরপুরে?!” বিস্মিত ছফা ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিলো। মুশকান পালিয়ে যাবার পর সুন্দরপুরে এমন কী আছে যে, ওখান থেকে মহিলাকে ট্র্যাক করবে? সুন্দরপুর থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলো ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের উপরে। কিন্তু ভদ্রলোক তার হাত থেকে বাঁচতে বিদেশে চলে যান।

“ওখানে গিয়ে আমি কী খুঁজব?” প্রশ্নটা না করে পারলো না। “ঐ মহিলার সাথে সুন্দরপুরের কারোর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। ঘটনার পর পরই ওখানকার মাস্টারের পেছনে আমার এক বিশ্বস্ত লোককে লাগিয়েছিলাম, কিছু পাইনি। ভদ্রলোক ট্রাস্টি হবার পর স্কুল বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমার মনে হয় না, মুশকান জুবেরি তার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ রাখে।”

“তারপরও, আপনেরে যদি এই কেসটা আবার শুরু করতে হয়, তাইলে ওইখান থেইকাই শুরু করন লাগবো,” পুণরায় জোর দিয়ে বললো কেএস খান।

নুরে ছফা চুপ মেরে রইলো। অভিজ্ঞ এই ডিবি অফিসারের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারছে না সে, কিন্তু এটা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে।

“আপনের কথায় লজিক আছে…তয় পুরানা বাংলা প্রবাদটায় যদি আস্থা রাখেন, তাইলে সেইখান থেইকাই আপনেরে শুরু করতে হইবো আবার।”

.

অধ্যায় ১২

এক সময় দূর দুরান্ত থেকে যে রেস্তোরাঁয় ছুটে আসতো লোকজন, সেটার উল্টোদিকে, রাস্তার ওপারে চায়ের ছোট্ট টঙ দোকানের মালিক রহমান মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো। কালো মেঘের পুঞ্জ জড়ো হচ্ছে, শেষ বিকেলে ধেয়ে আসছে কালবোশেখি ঝড়। চোখমুখ বিকৃত হয়ে উঠলো তার। ওয়াক থু শব্দ করে এক দলা থুতু ফেললো দোকানের পাশে।

আজ সারাটা দিন খুব গরম পড়েছিলো, কাস্টমারও খুব বেশি পায়নি। বিকেলের দিকে, সন্ধ্যার পর গ্রামের মানুষজন রোদের তাপ কমলে যে আড্ডা দিতে আসবে, কালবোশেখি মনে হয় সেটা হতে দেবে না। আখের গুড়ের যে পিণ্ডটা আছে তার উপরে কিছু মাছি বসেছে কিন্তু অন্য সব দিনের মতো সেগুলো তাড়িয়ে দেবার তাগাদা অনুভব করলো না। মনে মনে ঠিক করলো, আকাশের অবস্থা আরেকটু খারাপ হলেই দোকানের ঝাপি ফেলে বাড়ি চলে যাবে।

আকাশের দিকে আরেকটু ভালো করে তাকালো রহমান। সে নিশ্চিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় হবে, সেই সাথে হবে বৃষ্টিপাত। এরইমধ্যে গুড়গুড় শব্দ তুলে মেঘ জানান দিচ্ছে সেটা। কালো কালো মেঘ ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশে, পাগলা ষাড়ের মতো ফুঁসে উঠছে যেনো।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে আনতেই একটা দৃশ্য দেখে তার চোখ আটকে গেলো। তার টঙ দোকানের পাশ দিয়ে যে সড়কটা চলে গেছে তার ঠিক বামদিকে, পরিত্যক্ত পেট্রল পাম্পটার কাছে একটা ট্যাক্সিক্যাব এসে থেমেছে। গত আড়াই বছরে এটা বিরল ঘটনা। পাম্পটা বন্ধ হবার পর কোনো গাড়ি সেখানে থামতে দেখেনি।

উৎসুক হয়ে দেখলো, একটু পরই গাড়ি থেকে নামলো একজন। লোকটাকে দূর থেকে দেখেই চিনতে পারলো সে। যদিও প্রায় তিন বছর পর দেখলো তাকে। ক্ষমতাবান সেই লোকটি গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে হেঁটে দাঁড়িয়ে রইলো রবীন্দ্রনাথের সামনে।

কয়েক বছর আগে এই লোক ঠিক এভাবেই এক বিকেলে এসে হাজির হয়েছিলো সুন্দরপুরে, তারপর এখানে ঘটে যায় কিছু ঘটনা-জমিদার অলোকনাথ বসুর পৈতৃক বাড়িটা আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়; গোরখোদক ফালু পালিয়ে যায় সুন্দরপুর থেকে; রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি নামের রেস্টুরেন্টটি রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়; পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় এর মালেকিন; এরপরই সুন্দরপুরের এমপি ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে মৃত্যুবরণ করে।

রহমান মিয়ার মতো এলাকাবাসিও জানে না এসব ঘটনার পেছনে আসল কারণগুলো কী। তারা কেবল নিজেদের মতো করে ঘটনাগুলো বয়ান করে। তবে এসবের পেছনে প্রয়াত এমপির কালোহাত যে ছিলো সে ব্যাপারে কারোর মধ্যে সন্দেহ নেই।

জমিদারের নাতবৌ সেজে সুন্দরপুরে জেঁকে বসেছিলো মুশকান নামের ঐ মহিলা। তার রেস্টুরেন্টে মানুষের মাংস রান্না করে বিক্রি করা হতো। গোরখোদক ফালুকে দিয়ে কবরস্তান থেকে কঙ্কাল তুলে ব্যবসাও করাতো সে!-এ ধরণের কথা প্রথম দিকে সুন্দরপুরের অনেকে বিশ্বাস করলেও এখন খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা এসবে বিশ্বাস করে। বরং ইদানিং মানুষজন বলে বেড়ায়, সুন্দরপুরের আগের এমপি আসাদুল্লাহ ঐ মহিলাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলো, যাতে করে জমিদার অলোকনাথের সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নিতে পারে। এমন কি ঢাকা থেকে এক ভাড়াটে পুলিশ এনে লেলিয়ে দিয়েছিলো মহিলার পেছনে। শেষে, ঐ লোক জমিদার বাড়িতে আগুন দিয়ে মহিলাকে হত্যা করারও চেষ্টা করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়ে সুন্দরপুর ছেড়ে পালিয়ে যায় জমিদারের নাতবৌ। তার আগে এমপির আশার গুড়ে বালি দিয়ে জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি দান করে গেছে সুন্দরপুরে একটি স্কুল করার জন্য। ওদিকে হতাশ আর ব্যর্থ এমপি ঢাকায় বসে রাগে-ক্ষোভে, হতাশায় মদ্যপান করতে গিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলে, তার নাজুক হৃদপিণ্ড আর সহ্য করতে পারেনি, মদে ডুবেই সাঙ্গ হয়েছে তার ভবের লীলা।

রহমান দেখতে পাচ্ছে, এমপির ভাড়া করা সেই পুলিশ, যার পেছনে ইনফর্মার আতর লাট্টুর মতো ঘুরতো, সেই লোক এখন রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবল বাতাসে লোকটার শার্ট-প্যান্ট লেপ্টে আছে শরীরের সাথে, চুলগুলো উড়ছে সেই বাতাসের ঝাপ্টায়।

রহমান মিয়ার কাছে এটা এক ধরণের অশনি সংকেত। তার অন্তরাত্মা বলে উঠলো, এই লোক সঙ্গে করে ঝড় নিয়ে এসেছে সুন্দরপুরে! খারাপ। কিছু হবার আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠলো তার মনে।

*

একটু আগেও রোদের উত্তাপ ছিলো, কোত্থেকে যে মেঘ এসে ভর করলো আকাশে! এখন রীতিমতো প্রবল বাতাস বইছে। সূর্য ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে, কমে এসেছে আলো। প্রকৃতির যে রূপ সেটা দেখে ভোরের মতো লাগছে নুরে ছফার কাছে।

একটু আগে দূর থেকে পেট্রল পাম্পটা দেখতে পেয়ে ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভারকে বলেছিলো, রাস্তার বামপাশে রাখতে গাড়িটা। ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সে। পেট্রল পাম্পটা যে পরিত্যক্ত সেটা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি তার। যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে, দীর্ঘদিন থেকেই ওটা আর সচল নেই। মাঝারি আকারের ফ্রিজের মতো দেখতে ফুয়েল ডিসপেন্সরগুলো ধুলোয় মলিন। অফিস ঘরটিও বন্ধ, বাইরে থেকে বিশাল তালা ঝুলছে। প্রবল বাতাসে পাম্প স্টেশনের পাকা ছাউনির উপরে কোনোমতে ঝুলে থাকা সাইনবোর্ডটা দুলছে ক্যাচক্যাচ শব্দ করে। সামনের প্রাঙ্গনে ছোটোখাটো ধুলোর ঝড় বয়ে যাচ্ছে এখন।

পেট্রল পাম্প স্টেশনটা পেরিয়ে, আরেকটু সামনে গিয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখেছিলো তিন বছর আগের পরিচিত জায়গাটা-এখনও ‘রবীন্দ্রনাথ’ টিকে আছে!

এখন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সেই অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টের সাইনটা বেশির ভাগ অংশ হারিয়ে এখনও টিকে আছে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ হয়ে! আগে যেটা রেস্টুরেন্টের সামনের প্রাঙ্গন আর পার্কিং এরিয়া ছিলো সেটা এখন ছোটোখাটো বাগান। সেই বাগানের মাঝখান দিয়ে দশ-বারো ফুটের মতো প্রশ্বস্ত একটি রাস্তা চলে গেছে প্রধান ফটক পর্যন্ত। দু-পাশের ফুলের বাগানটি বড়জোর কয়েক মাস আগে করা।

ছফা ভেবেছিলো এই স্থাপনাটি আর দেখতে পাবে না। কিংবা সেটা হয়তো পরিত্যক্ত অবস্থায় পাবে।

তিন বছর পর নুরে ছফা আবারো পা বাড়ালো রবীন্দ্রনাথের দিকে!

.

অধ্যায় ১৩

“ওইদিকে তাকায়া আছে ক্যান, মিয়া?”

কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠলো রহমান, রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেলো ইনফর্মার আতর আলী দাঁড়িয়ে আছে তার দোকানের সামনে। লোকটাকে দেখে অবাক হলো না সে। মাথা যখন দেখা গেছে লেজটা তো দেখা যাবেই!

“এক কাপ চা দাও,” টঙ দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চটায় বসে বললো আতর। “আর একটা বেনসনও দিও।”

আতর আর সেই আতর নেই, তার বেশভূষাও বেশ বদলে গেছে। আড়ালে আবডালে তাকে ইতর বলার লোকজনও দিন দিন কমে আসছে এখন। তবে রহমান মিয়ার কাছে সে সব সময়ই আস্ত একটা ইতরের বাচ্চা।

“এই অবেলায় এইহানে কী মনে কইরা?” প্রশ্নটার জবাব জানা সত্ত্বেও বেনসনের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো রহমান। “এটু বাদে তো তুফান আইবো।”

“কাম না থাকলে এই আতর মুততেও আইতো না তোমার দোকানে, তাচ্ছিল্যের সাথে বললো সুন্দরপুর থানার ইনফর্মার।

“তা, কী কাম তুমার এই ঝড়-তুফানের দিনে?” সিগারেটটা আতরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো দোকানি। “আজকাইল তো এইহানে বেশি আহো না…টাউনেই নাড় গাঁড়ছে।”

সিগারেটটা লাইটার দিয়ে ধরালো আতর, দীর্ঘ একটা টান দিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো। “এতো কিছু তোমার জানোনের দরকার নাই, তুমি চা বানাও।”

বাঁকাহাসি দিলো রহমান। দ্রুত এক কাপ গুঁড়ের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। কমদামি বিড়ি সিগারেট আর গুল খাওয়া আতর আলী এখন বেনসন ছাড়া অন্য কিছু মুখেই তোলে না। বিগত তিন বছরে তাকে কেউ গুল খেতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। সবটাই কপাল। শহর থেকে এক লোক এসে এই ইতরের ভাগ্যটাই বদলে দিয়েছে। এখন একটা বাইকও কিনেছে সে। সারাদিন ওটা নিয়েই ছুটে বেড়ায় সুন্দরপুরসহ আশেপাশের এলাকায়। এক শ’ সিসির ছোটোখাটো পুরনো সেই বাইকটা যখন ইনফর্মার চালায় তখন রহমানের কাছে মনে হয়, দুর্বল আর নিরীহ ছাগলের পিঠে বুড়ো একটা শেয়াল সওয়ার হয়েছে।

“তুমার ভটভটি কই?”

ভুরু কুঁচকে রহমানের দিকে তাকালো আতর। এই বদটা তার মোটরসাইকেলকে ভটভটি বলে ডাকে সব সময়। এটা যে ঈর্ষা থেকে করে তা ভালো করেই জানে। রাগ দমন করে বললো, “মিস্তিরির কাছে দিছি…এটু টেরাবল দিতাছিলো।”

রহমান মিয়া দাঁত বের করে হাসলো। “পুরানা জিনিস কিনলে তো টেরাবল দিবোই।”

কিছু বলতে গিয়েও বললো না আতর। মানুষের এমন ঈর্ষা উপভোগ করে সে। কিন্তু এ মুহূর্তে সেটা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে না নিজের ভেতরে থাকা অস্থিরতার কারণে।

রহমান আড়চোখে দেখতে পেলো ইনফর্মার বার বার সড়কের দিকে তাকাচ্ছে। পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করেও একবার দেখে নিয়েছে এরমধ্যে।

“ক্যাঠায় আইবো?” চামচ দিয়ে চায়ের সাথে গুড় মেশাতে মেশাতে জানতে চাইলো দোকানি। “কার লাইগ্যা এতো পেরেশান হয়া আছো?”

সিগারেটে টান দিয়ে একটু ঝারি মেরেই বললো আতর, “এতো কথা কও ক্যান, অ্যাঁ? আদার বেপারী তুমি…খালি জাহাজের খবর নিতে চাও!”

মুখে সেই বাঁকাহাসি ধরে রেখেই চায়ের কাপটা আতরের দিকে বাড়িয়ে দিলো রহমান মিয়া। “আমি বেপারী অইতে যামু কুন দুঃখে! তয় আমি কইলাম আন্ধা না, সব কিছু দেখবার পারি।”

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো আতর, “কী দেখছো তুমি?” তারপর পিরিচে চা ঢেলে সশব্দে আয়েশ করে চুমুক দিলো।

“এই অবেলায় এইহানে ক্যান আইছো আমি জানি, বিজ্ঞের মতো বললো রহমান।

আতর আলী পায়ের উপর পা তুলে একহাতে সিগারেট আর অন্য হাতে পিরিচ ধরে রেখেছে। চায়ের কাপটা রেখেছে তার পাশে বেঞ্চের উপরে। “কও কি, মিয়া!” কৃত্রিম বিস্ময়ের ভাব করলো সে। “তুমিও কি নিজেরে বিবিচি ভাবোনি?”

পিরিচটা রেখে পকেট থেকে আবারো ফোনটা বের করে দেখে নিলো, একটা নাম্বারে কল দিয়ে কানে ফোনটা ঠেকিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ, একটু পর চিন্তিত ভঙ্গিতে নামিয়ে রাখলো সেটা। রহমান মিয়াকে হাসতে দেখে অবাক হলো সে।

“ওই মিয়া…হাসসা ক্যান?” একটু রেগেই বললো।

“না…এমনেই,” দোকানি বললো হাসিমুখে।

“ঠিক কইরা কও তো, হাসতাছো ক্যান…মিজাজ খারাপ করবা না। কইলাম!” মৃদু হুমকি দিয়ে বললো ইনফর্মার।

“আমি হইলাম আদার বেপারী, জাহাজের খবর জানাই কেমতে!”

ভুরু কুঁচকে ফেললো আতর। “বুঝলাম না, কী কও তুমি?”

“যার লাইগ্যা পেরেশান হয়া আছে সে তো বেটির হুটেলে ঢুকছে এটু আগে, রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে বললো রহমান।

অবাক হয়ে রাস্তার ওপারে তাকালো আতর। “ঐটা কি এহন আর হোটেল আছেনি, অ্যাঁ?” তারপরই টনক নড়লো তার। “কার কথা কইতাছো তুমি? কে ঢুকছে ওইখানে?”

“কইলাম না, তুমি যার লাইগ্যা পেরেশান হয়া আছে।”

আতর আলী কয়েক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো দাঁত বের করে হাসতে থাকা দোকানির দিকে, তারপর হুট করেই উঠে দাঁড়ালো। “ধুর মিয়া! খালি ফালতু পেচাল পাড়ো…আগে কইবা না!” কথাটা বলেই চলে যেতে উদ্যত হলো সে।

“আরে, আমার ট্যাকা?”

রহমান জোরে বলে উঠলো পেছন থেকে কিন্তু আতর সে-কথা কানেই তুললো না, হনহন করে ছুটে গেলো রবীন্দ্রনাথের দিকে। এক কাপ চা আর সিগারেট বিক্রি করবে বলে সে আসল কথাটা দেরি করে বলেছিলো, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বাকির খাতায় যোগ হলো আরো কিছু টাকা।

“ইতরের বাচ্চা ইতর!” চোখমুখ বিকৃত করে বললো সে। “কয়লা, ধুইলেও যায় না ময়লা। খাইসলত এহনও আগের মতোই আছে।”

.

অধ্যায় ১৪

প্রায় তিন বছর আগে সুন্দরপুরে এসে যেখানে প্রথম প্রবেশ করেছিলো সেখানে পা রাখতেই বিস্মিত নুরে ছফা।

তখন তাকে প্রলুব্ধ করেছিলো মাদকতাপূর্ণ খাবারের গন্ধ আর সুতীব্র কৌতূহল। এখনও তার মনে কৌতূহল রয়েছে, তবে সুস্বাদু খাবারের কোনো গন্ধ পাচ্ছে না। যদিও পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী খাবারে পরিপূর্ণ আছে ঘরটা!

বই।

রবীন্দ্রনাথের ভেতরটা আর আগের মতো নেই। আগের মতো যে থাকবে সে আশাও করেনি, তবে চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি! পাতা ওল্টানোর খসখসে শব্দটা শুনতে পেলো। হাতেগোনা কিছু পাঠক একমনে বই পড়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরির চিরায়ত দৃশ্য।

নুরে ছফা দরজা খুলে ঢুকতেই সেই ঝড়ো বাতাসের কিছুটা ঢুকে পড়েছিলো ঘরের ভেতরে, বই পড়ুয়ারা মুখ তুলে তাকালেও আবারো ফিরে যায় শব্দের জগতে। এক সময়কার রেস্টুরেন্টের দেয়ালগুলো দখল করে আছে বইয়ের শেল্ফ, আর সেগুলোতে ঠাঁই করে নিয়েছে অসংখ্য বই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তিন বছর আগের দৃশ্যটার সাথে এক ধরণের সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিলো সে-প্রথমবার দেখেছিলো চার-পাঁচজন ভোজনরসিক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে খাবারের আস্বাদন নিচ্ছে, আর এবার দেখেছে। অল্প বয়সী কিছু পাঠক ডুবে আছে বইয়ের পাতায়। চারপাশে বইয়ের শেঙ্কের মাঝে দুটো বিশাল রিডিং টেবিলে বসে আছে নিবিষ্ট পাঠকের ছোট্ট দলটি। মাথার উপরে ঘুরছে সিলিংফ্যান। সেগুলোর গুঞ্জন ছাড়া আর কিছুই নেই।

একটু আগে রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে ছফা খুবই অবাক হয়েছিলো, রেস্টুরেন্টের সুদীর্ঘ নামটি একটিমাত্র শব্দে রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে এখনও টিকে আছে বলে।

সুন্দরপুরে এতো কিছু ঘটে যাবার পর কী করে নামটা টিকে আছে।

যেহেতু এটা আর এখন রেস্টুরেন্ট হিসেবে নেই, তাই শুধু ‘খেতে’ নয়, ‘এখানে কখনও আসেননি’ও বাদ দেয়া হয়েছে-যদিও সুন্দরপুরের জন্য এটাই সত্যি।

পুরনো ‘রবীন্দ্রনাথ’ সাইনটার নীচে ছোট্ট করে যুক্ত করা হয়েছে ‘স্মৃতি গ্রন্থাগার’ লেখাটি।

রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি গ্রন্থাগার!

সুন্দরপুরের মতো কোনো অঞ্চলে এরকম একটি লাইব্রেরি আছে দেখে খুশিই হলো ছফা। কাজটা যে মাস্টার রমাকান্তকামারের সেটা বুঝতে বাকি। রইলো না। মুশকান জুবেরি যতো বড় ক্রিমিনালই হোক না কেন, জায়গা জমি যোগ্য একজনের হাতেই দিয়ে গেছে।

ছফা দেখতে পেলো ঘরের এককোণে বিশাল আকারে একটি গ্লোবও রাখা আছে। ঘরে বই ছাড়াও আছে বেশ কিছু মনীষীর ছবি। তার মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে বড় আর প্রধান ছবিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে চোখ গেলো এবার। ওটাও একটা ছবির ফ্রেম তবে তাতে কোনো ছবি নেই। বিশাল একটি বাদামি কাগজে কিছু লেখা। ছফা যেখানে আছে সেখান থেকে লেখাটা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। এই প্রথম সে টের পেলো চল্লিশের আগেই চালশে অবস্থা তার। ছোটো ছোটো অক্ষরগুলো পড়তে বেগ পাচ্ছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে চোখ কুঁচকে তাকালো। লেখাটা যেই না পড়তে যাবে অমনি একটা কণ্ঠ পেছন থেকে বলে উঠলো :

“স্যার! কখন আইলেন?”

কথাটা এতো জোরে উচ্চারণ করা হলো যে, নুরে ছফাসহ লাইব্রেরিতে থাকা চার-পাঁচজন পাঠকের প্রায় সবাই চমকে ঘুরে তাকালো।

“আমি তো আপনেরে ফোন দিসিলাম কিন্তু ফোন-”

“আস্তে!” মৃদু ধমকের সুরে আতর আলীকে চুপ করিয়ে দিলো ছফা। ভ্যাবাচ্যাকা খেলো ইনফর্মার। তাকে নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে গেলো ছফা।

“কী হইছে, স্যার?” আতর বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো বাইরে এসে। তাকে কেন আস্তে কথা বলতে বলছে বুঝতে পারলো না।

“আরে, দেখছো না…এটা একটা লাইব্রেরি,” বললো ছফা।

“তো কী হইছে!” আতর এখনও বুঝতে পারছে না।

এই লোককে লাইব্রেরি কালচার নিয়ে জ্ঞান দেবার কোনো ইচ্ছে নেই ছফার।

“কিছু না,” বলেই রবীন্দ্রনাথের সামনের খোলা প্রাঙ্গনে কাছে এসে দাঁড়ালো সে। প্রবল বাতাসের সাথে ধুলো উড়ছে এখন। বৃষ্টি আসি আসি করছে। অনেক দিন পর দেখা হলো…এখন বলল, কেমন আছো?”

দাঁত বের করে হেসে ফেললো আতর আলী। “আমি ভালাই আছি, স্যার, আপনের ফোন বন্ধ পাইয়া আমি তো অস্থির হয়া গেছিলাম।”

“আসার পথে আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিলো, তাই তোমাকে কল দিতে পারিনি।” এর আগে ইনফর্মারের সাথে তার কথা হয়েছিলো, সুন্দরপুর ঢুকেই তাকে কল দেবে।

বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই তারা দু-জন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রবেশদ্বারের সামনে শেডের নীচে এসে দাঁড়ালো।

“আপনে কিমুন আছেন, স্যার?” জিজ্ঞেস করলো ইনফর্মার। “এইদিকে তো আর আসেনই না।”

“ঢাকায় কাজের অনেক চাপ, ছফা বললো। “অনেকগুলো কেস তদন্ত করছি, দম ফেলার সময় পাই না।”

“আপনেরে দেইখ্যা কী যে ভালা লাগতাছে!” আন্তরিক ভঙ্গিতেই বললো আতর।

মুচকি হাসলো ছফা। সুন্দুরপুরের ইনফর্মারের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়ে তার জামা-কাপড় একটু গোছালো আর দামি। মাথার চুলগুলোও পরিপাটি। নিয়মিত গোসল করে বলেও মনে হচ্ছে।

“তা, বলো…এখানকার খবর কী?” এমনি জানতে চাইলো।

“খবর তো ভালাই,” বললো আতর, “কতো কিছু যে হয়া গেছে, কী আর কমু আপনেরে।”

সুন্দরপুর থেকে চলে যাবার পর আতরের সাথে কয়েক মাস যোগাযোগ ছিলো ছফার। মাস্টারের পেছনে লেলিয়ে দেবার পরও যখন দেখা গেলো উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া যাচ্ছে না তখন ধীরে ধীরে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে সে, আতরের সাথেও যোগাযোগ কমে যেতে শুরু করে। এরপরও ইনফর্মার তাকে মাঝেসাঝে ফোন দিয়ে জানাতো মাস্টারের স্কুল নিয়ে ব্যস্ততার কথা, সেসবের প্রতি কোনো আগ্রহ তার ছিলো না। এক পর্যায়ে আতরের ফোন ধরাও বন্ধ করে দেয়-সময়ে অসময়ে ফোন দিতো সে নানান ধরণের তদবির নিয়ে। উপরন্তু দু-বছর আগে পুরনো ফোন নাম্বারটা পাল্টে ফেলায় আতরের পক্ষে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি দীর্ঘদিন।

“রহমান মিয়ার টঙ দোকানটা দেখলাম আগের মতোই আছে।”

ছফার মুখ থেকে রহমান মিয়ার নামটা শুনে ভেতরে ভেতরে মর্মাহত হলো আতর। প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার জন্য সে বললো, “মাস্টরের কিন্তু এখন বিরাট অবস্থা। এই যে দেখতাছেন…” রবীন্দ্রনাথের দিকে ইঙ্গিত করলো, “…এইটা তো মাস্টরেরই কাম। বিরাট বড় একটা স্কুলও দিছে, কতো কী যে…”

আতরকে এভাবে কথার মাঝখানে থেমে যেতে দেখে অবাক হলো নুরে ছফা। ইনফর্মারের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকালো। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, চোখে মোটা কাঁচের চশমা আর গালে শুভ্র লম্বা দাড়ি-গোঁফ-সৌম্যকান্তির অবয়বটি দেখেই চিনতে পারলো সে।

মাস্টার রমাকান্তকামার বগলে চামড়ার ব্যাগ আর হাতে একটি কালো রঙের ছাতা নিয়ে বের হয়ে আসছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে।

ছফা বুঝতে পারলো, লাইব্রেরির ভেতরে যে ছোট্ট একটি অফিস ঘর আছে, এতোক্ষণ নিশ্চয় সেখানে ছিলেন।

মোটা কাঁচের চশমার ভেতর দিয়েও বোঝা যাচ্ছে, ছফাকে দেখতে পেয়ে রমাকান্তকামারের চোখদুটোতে নেমে এসেছে বিস্ময়।

“আদাব, মাস্টারসাহেব…ভালো আছেন?” বললো ছফা।

আনমনেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন ভদ্রলোক। “আপনি?…এখানে?!” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি।

.

অধ্যায় ১৫

নুরে ছফা চায়নি সুন্দরপুরে পা রাখতেই মাস্টার রমাকান্তকামারের সাথে দেখা হয়ে যাক। সে জানতো না লাইব্রেরিতে এ সময় মাস্টার থাকবেন। ভদ্রলোকের মুখোমুখি হবার চেয়েও বেশি অস্বস্তিকর ছিলো তার করা প্রশ্নটি।

আপনি…এখানে?

ছফা এর জবাবে কী বলবে ভেবে পায়নি। কয়েক মুহূর্ত লেগে গেছিলো জবাব দিতে। “এইতো…একটা কাজে আসতে হলো আবার।” একটু সময় নিলেও বলতে পেরেছিলো সে। “বৃষ্টির কারণে এখানে আটকা পড়ে গেছি।”

রমাকান্তকামার অবশ্য বেশি কিছু জানতে চাননি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ ছাতা ফুটিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে যান।

“বিকালবেলা মাস্টর এইহানেই থাকে,” রমাকান্তকামার চলে যাবার পর বললো আতর আলী। “দুনিয়ার যতো বই আছে কিইন্যা ভইরা ফালাইতাছে, পোলাপানের মাথা খায়া ফালাইছে এক্কেবারে।”

ছফা এ কথার জবাবে কিছু বললো না। আতর আলীর মতো লোকের কাছে কেন, অনেক দ্র আর সজ্জন মানুষও বই পড়াকে ফালতু কাজ হিসেবে দেখে এ দেশে। তার ছোটোবেলার একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার আগে গল্পের বই পড়তে গিয়ে বাবার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়, তারপর সে কী বকুনি! যেনো বিশাল এক গর্হিত কাজ করে বসেছে।

আতর আরো বক বক করে গেলো। সুন্দরপুরে বিগত তিন বছরে কী কী ঘটেছে তার সবটাই যেনো এক লহমায় উগলে দিতে চাইছে সে। বাইরের বৃষ্টি দেখে দেখে কিছুটা আনমনা হয়ে ছফা তার কথা শুনে গেলো।

এমপির মৃত্যু সুন্দরপুরের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। তিন মাস পর উপনির্বাচনে নতুন যে এমপি নির্বাচিত হয়েছে, মানুষ হিসেবে সে বেশ সজ্জন। নতুন এমপি বয়সে তরুণই বলা চলে। রমাকান্তকামারের সাবেক ছাত্র সে। স্নেহধন্য ছাত্র এমপি হবার পর তার সাহায্যে খুব দ্রুতই জমিদার বাড়িতে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সুন্দরপুর শান্তিনিকেতন উচ্চবিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল। এ অঞ্চলের সবচাইতে বড় আর অন্য রকম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ-গান-ছবি আঁকাসহ অনেক কিছুই শেখানো হয়।

“আগের এমপির যেইসব জায়গা-জমি দখলে রাখছিলো সেইগুলা নয়া এমপি দখল কইরা স্কুরে দিয়া দিছে, আর বলতে লাগলো। “বেটা তো মরছেই, হের জায়গা-জমিও সব গেছে। ঐ যে, পেট্রল পাম্পটা আছে না…ঐটাও বন্ধ কইরা দিছে এমপিসাবে। হুনতাছি, ওইটা নিজেই লিজ নিবো।”

“আগের এমপির ছেলেমেয়েরা বাধা দেয়নি, মামলা-মোকদ্দমা করেনি?”

“হেরা তো বিদেশে থাকে, এইসব নিয়া হাউকাউ ক্যামনে করবো। কইরা কোনো লাভ হইবো? কাগজপত্রে ঘাপলা আছে না?”

“আচ্ছা, ফালুর কোনো খবর জানো? সে আর সুন্দরপুরে আসেনি?”

আতরের মুখ তিক্ততায় ভরে উঠলো। “চুতমারানির পোলায়…” গালিটা দিতেই সামলে নিলো সে। “আইছিলো তো রাইতের বেলায়… বইনের লগে দেহা করতে! চোরের মতো আইছে আবার চোরের মতোই। কাইট্টা পড়ছে। আমি যদি ওরে পাইতাম মাটিতে পুইত্যা ফালাইতাম!” শেষ কথাটা দাঁতে দাঁত পিষে বললো ইনফর্মার। ফালু যে তাকে জিন্দা কবর দেবার ব্যবস্থা করেছিলো সেটা এখনও ভোলেনি।

“ঐ রাতকানা মেয়েটা এখনও আছে?” একটু অবাক হলো ছফা।

“হ। ঐ মাইয়া এহন মাস্টরের স্কুলে কাম করে। স্কুলটা ম্যালা বড়…কতোজন যে কাম করে জানেন না।”

“ফালু যে এখানে এসেছিলো সে-কথা তুমি জানলে কিভাবে?”

দাঁত বের করে হেসে ফেললো আতর। “মাস্টরের স্কুলে আমার এক লোক আছে, স্যার,” খুবই গর্বিত ভঙ্গিতে জানালো কথাটা। “হে আমারে কইছে।”

গোরখোদক ফালুকে নিয়ে অবশ্য ছফার কোনো আগ্রহ নেই, যেমনটা আগ্রহ আছে তার সিনিয়র কেএস খানের মধ্যে।

“আচ্ছা, এখানে আসার পর দেখলাম রহমান মিয়া আগের জায়গাতেই আছে,” প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললো সে। “তার ব্যবসা কেমন চলে। এখন? রেস্টুরেন্টটা তো নেই, মানুষজন আসে এখানে?”

“পাম্পটাও তো বন্ধ,” আতর বললো। “এই রোডে এহন আর গাড়িঘোড়া থামে না…হের ব্যবসা উঠছে চাঙ্গে। তয় অন্য কিছু তো করবার পারে না, পারে খালি গুড়ের চা বানাইতে আর গপসপ করতে। হেরে কইছিলাম, নতুন হোটেল দুইটার সামনে গিয়া নাড় গাঁড়ো, এইখানে তো কেউ মুততেও আহে না সারাদিনে। কিন্তু হে তো আইলসা, বইস্যা বইস্যা

“নতুন দুটো হোটেল হয়েছে মানে?” ইনফর্মারের কথায় বাধা দিয়ে জানতে চাইলো ছফা।

জিভে কামড় দিলো আতর আলী, যেনো মূল্যবান একটি তথ্য জানাতে ভুলে গেছিলো। “আপনেরে তো কই নাই, বেটির হোটেলের দুই পোলায় বিরাট বড় আকাম করা ফালাইছে। গত বছর হিটলু হারামজাদা বেটির হোটেলটা আবার দিছে, তারে দেইখ্যা ফজলুও আরেকটা দিছে। হালারপুতেগো মাথায় চিকনা বুদ্ধি গিজগিজ করে!”

.

অধ্যায় ১৬

নিজের বাড়ির বারান্দায় ভেজা ছাতাটা মেলে রাখলেন রমাকান্তকামার। বৃষ্টির প্রকোপ এখন কমে এসেছে, আর কিছুক্ষণ পরই থেমে যাবে। এরইমধ্যে নেমে গেছে সন্ধ্যা। তবে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে রাত বলেই মনে হচ্ছে।

পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার তালাটা খুলে ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি। বিদ্যুৎ চলে গেছে, ঘরে ঢুকে পুরনো হারিকেনটা জ্বালিয়ে দিলেন। অন্ধকার তার কাছে সব সময়ই অপ্রিয়। তিনি পছন্দ করেন আলো, সেই আলোয় অন্যকে আলোকিত করতে। সারাটা জীবনই চলে গেছে এ কাজ করে করে। এখন জীবন সায়াহ্নে এসে হাতে একটি আলোকবর্তিকা পেয়ে গেছেন, সেটা দিয়ে যতোটুকু সম্ভব অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মনেপ্রাণে চাইছেন, তার অনুপস্থিতিতেও যেনো এই কর্মযজ্ঞ থেমে না যায়। কয়েক বছর ধরে দিনরাত পরিশ্রম করে অবশেষে নিজের স্বপ্ন বাস্তাবায়ন করতে পেরেছেন। কিন্তু সবকিছু যখন গুছিয়ে নিয়ে এসেছেন, তখনই সুন্দরপুরে এসে হাজির হয়েছে ঐ লোকটি।

নুরে ছফা।

একটু আগে তাকে লাইব্রেরির সামনে দেখামাত্র এক ধরণের আশঙ্কা জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। মনে হচ্ছে, অশুভ কিছু ঘটবে আবার। বিগত তিন বছর ধরে এই লোকের কোনো টিকিটাও দেখা যায়নি সুন্দরপুরে। তাহলে কী কারণে আবার এসেছে এখানে?

ভাবনাটা মাস্টারের মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। তিনি এমন কিছু করেননি, এমন কিছুতে জড়িত নন যে, একজন পুলিশ কর্মকতার আগমনে বিচলিত হয়ে উঠবেন। এসবই নিছক আশঙ্কা। সম্ভবত, তিল তিল করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পর তার মধ্যে সবকিছু হারানোর ভয় জেঁকে বসেছে। আগে তার কিছুই ছিলো না, হারানোরও কোনো ভয় ছিলো না তখন।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। এই এক জীবনে কম তো দেখলেন না। উত্থান আর পতনের খেলাটা যেনো তার কাছে ঋতুচক্রের মতোই-ঘুরে ফিরে আসে বার বার।

ঘরের জানালাটা খুলে দিয়ে বাইরে তাকালেন। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার ভাবনায় খেলা করে যাচ্ছে অনেক কিছু। স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন তিনি।

এক সময় তার অনেক কিছুই ছিলো, তারপর সবকিছু কেড়ে নিলো পাক হানাদারেরা। আবারো তিনি কিছু ফিরে পেলেন স্কুলের ছোটোছোটো বাচ্চাগুলোকে আলোকিত করার কাজ পেয়ে। সেগুলোও এক সময় হাতছাড়া হয়ে গেলো। সারাজীবনের যে ব্রত ছিলো শিক্ষকতা করার, সেখান থেকেও বিতাড়িত করা হলো তাকে। অবশেষে জীবনের শেষ সময়ে এসে, অনেকটা আচমকাই, জাদুমন্ত্রের মতো সবকিছু পাল্টে গেলো চোখের নিমেষে। তিনি পেয়ে গেলেন তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সোনার চাবিকাঠি! আর সেটা এমন একজনের কাছ থেকে, যার ব্যাপারে তার মনে ছিলো যথেষ্ট সন্দেহ, সংশয়। শঠ আর ধান্দাবাজ মানুষজন তিনি সারাটা জীবন এড়িয়ে চলেছেন, কিন্তু তার স্বপ্ন এতোটাই বড় ছিলো যে, তিনি আর এসব পরোয়া করেননি। নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছেন, যা করছেন বৃহত্তর স্বার্থেই করছেন। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কিছু করছেন না।

তাছাড়া মুশকান জুবেরি যা করেছে সেটা জমিগুলোর আসল মালিকের ইচ্ছের বাস্তবায়ন ছাড়া আর কিছু না। জমিদার বাড়ির সম্পত্তিগুলো কখনও তার ছিলো না, যখন বুঝতে পেরেছে ভবিষ্যতেও থাকবে না, তখন সেগুলো যাকে দেবার তাকে দিয়ে চলে গেছে। রাশেদ জুবেরি মৃত্যুর আগেই বলে গেছিলো, তার নামে থাকা বিশাল সম্পত্তির প্রায় সবটাই যেনো ট্রাস্টে দিয়ে দেয়া হয়। ঐ মহিলা চাইলে তার রেস্টুরেন্টের জায়গাটাসহ আরো কিছু জমি রেখে দিতে পারতো কিন্তু সুন্দরপুরে যখন আর থাকা সম্ভব নয় তখন ঐ সম্পত্তিগুলোও স্কুলের ট্রাস্টে দিয়ে দিয়েছে সে।

রাশেদ জুবেরির কথা মনে পড়ে গেলো। বেশ সখ্যতা ছিলো মাস্টারের সাথে। তিনি ভালো করেই জানেন, মায়ের বাপের কাছ থেকে পাওয়া সুন্দরপুরের জমিজমাগুলো নিয়ে রাশেদের মধ্যে কোনো আগ্রহ ছিলো না কোনো কালে। মনেপ্রাণে চাইতো জমিগুলো যেনো ভালো কাজে ব্যবহার করা হয়-মাস্টারের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় বেশ কয়েক বার রাশেদ তাকে বলেছিলো, এখানকার জয়াগাজমিগুলোর প্রতি তার কোনো আগ্রহ না থাকলেও তার ঠাকুরদার বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। সে চায় না, ওগুলো খারাপ লোকের খপ্পরে পড়ে থাকুক। বিশেষ করে যে লোক তার মা-সহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করিয়েছে তারই কুপুত্র ওগুলো ভোগদখল করবে এটা কোনোভাবেই হতে দেবে না সে। জমিগুলো উদ্ধার করে ভালো কাজের জন্য দান করে দেবে। কী কাজে দান করা হবে সেটা জানতে ইচ্ছে করলেও মাস্টার জিজ্ঞেস করেননি কখনও। তবে রাশেদ নিজে থেকেই বলেছিলো, সময় হলে নাকি মাস্টারই সবার আগে সেটা জানতে পারবেন।

মুশকান জুবেরি যে উদ্দেশ্যেই এখানে এসে থাকুক, যা-ই করে থাকুক, তার সাথে রমাকান্তকামারের কিংবা অলোকনাথ বসুর সম্পত্তিগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। ওগুলোর নিয়তিই হয়তো এমন ছিলো। কতোগুলো কালোহাত ঘুরে শেষমেষ ভালো কাজের জন্যই ব্যবহৃত হবে।

মহিলা সুন্দরপুর না এলে অবশ্য এতো কিছু ঘটতো কিনা সন্দেহ আছে। জমিগুলো হয়তো ঐ কোলাবরেটরের ছেলে আসাদুল্লাহর করায়ত্তেই থাকতো। আবার এ-ও ঠিক, নুরে ছফা নামের লোকটা না এলেও মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর থেকে সহসা পালাতো না, জমিগুলোও মাস্টারের কাছে দিয়ে যেতো কিনা সন্দেহ আছে। সেদিক থেকে দেখলে ছফার কাছেও মাস্টার কিছুটা ঋণী। কিন্তু লোকটার চাতুর্য তার কাছে ভালো লাগেনি শুরু থেকেই। সুন্দরপুরে এমনও গুজব আছে, ঐ লোক আসলে আসাদুল্লাহর হয়েই কাজ করেছে। ঢাকা থেকে উড়ে এসে মহিলাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছিলো, শেষে উপায় না দেখে জমিদার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টাও করে। কিন্তু মহিলা প্রাণ নিয়ে সুন্দরপুর ছেড়ে চলে যায়।

অবশ্য অন্য রকম গুজবও আছে, মুশকান জুবেরি নাকি বিরাট বড় এক অপরাধী। কী অপরাধ করেছে সে-ব্যাপারে সুন্দরপুরের কারোর কোনো ধারনা নেই। তারা এমপির চক্রান্তের গল্পটাকেই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে বিশ্বাস করে এখন।

আজ প্রায় তিন বছর পরে আবারো সেই লোক এসে হাজির হয়েছে। সুন্দরপুরে। আবারো অশুভ কিছু ঘটবে বলেই আশঙ্কা করছেন মাস্টার। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, তাকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ঘটনাই যেনো তার স্বপ্নের স্কুল আর লাইব্রেরিটাকে ছুঁতে না পারে।

.

অধ্যায় ১৭

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি।

তিক্ততার সাথেই সাইনবোর্ডের লেখাটা পড়লো নুরে ছফা। বেশ বড় করেই লেখা হয়েছে নামটা, সাইনের ফন্ট অবিকল আগেরটার মতোই, তবে সেটার নীচে ছোট্ট করে লেখা : রেস্টুরেন্ট।

রবীন্দ্রনাথের উল্টোদিকে তাকালো সে।

মুশকান রেস্টুরেন্ট!

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। সুন্দরপুর টাউনে, সুরুত আলীর নোংরা হোটেল থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে, রাস্তার দু-পাশে এই দুটো রেস্টুরেন্ট ঝড়বাদলা শেষে, ভর সন্ধ্যায়ও কাস্টমারের ভীড়ে গমগম করছে। দেখলেই বোঝা যায় বেশ নতুন। আকার এবং আকৃতিও প্রায় সমান। যেনো অলিখিত একটি প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছে তারা।

আতর আলী তাকে বলেছে, এ দুটো রেস্টুরেন্ট দিয়েছে মুশকান জুবেরির সাবেক দুই কর্মচারী হিটলু আর ফজলু-অন্য সব কর্মচারীর মতো রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি বন্ধ হবার পর বেকার হয়ে পড়েছিলো তারা। একজন আগের রেস্টুরেন্টের নামটা প্রায় হুবহু বগলদাবা করলেও অন্যজন খোদ মুশকান জুবেরিকেই আত্মসাৎ করে ফেলেছে। চতুর ঐ কর্মচারী আগের নাম থেকে ‘খেতে’ শব্দটা বাদ দিয়েছে সম্ভবত আইনী ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য। যদিও ছফা নিশ্চিত, মুশকান কখনও রেস্টুরেন্টের নামটা দাবি করে আইনী পদক্ষেপ নেবে না, ফিরে আসবে না সুন্দরপুরে।

তিন বছর আগে, সুন্দরপুর ছেড়ে চলে যাবার পর রবীন্দ্রনাথের কর্মচারীরা রাতারাতি বেকার হয়ে পড়েছিলো। চাকরিহারা মানুষগুলোর সবাই নতুন কাজ জুটিয়ে নিতে পারেনি, বেশির ভাগই বেকার হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে কিছু দিন। এই অঞ্চলে এমন রেস্টুরেন্ট নেই যেখানে কাজ করে তারা আগের মতো বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা পাবে। তো তাদের মধ্যে প্রথমে হিটলু নামের এক কর্মচারী এগিয়ে আসে, সাহস করে দিয়ে বসে নতুন একটি রেস্টুরেন্ট-প্রায় হুবহু আগের নামটার মতোই।

দ্বিতীয়জনের বুদ্ধি খুলেছে একটু দেরিতে। সে রেস্টুরেন্টের নামটা করায়ত্ত করতে না পারলেও স্বয়ং এর মালেকিনকেই নিয়ে নিয়েছে!

কর্মচারী দুজন যেমন চালাক, তেমনি সৃজনশীলও বটে!

বাইরে থেকেও দেখা যাচ্ছে, অল্প খরচেই ছিমছাম সাজগোজ করা হয়েছে রেস্টুরেন্ট দুটোর। সাধারণত অন্য রেস্টুরেন্টগুলোতে সামনের দিকটায় চুলা রাখা হয় গরম গরম পরোটা, লুচি, পুরি, ডিম ভাজার জন্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি আর মুশকান একটু ব্যতিক্রম, আগেরটার মতোই।

সামনের এক চিলতে যে খালি জায়গাটুকু আছে, সেখানে ফুলের টব বসানো হয়েছে। বাঁশের বেড়া দিয়ে জায়গাটার দু-পাশ ঘেরা। সেই বেড়াতে আবার সাদা-লাল রঙে রঙ করা। রেস্টুরেন্ট দুটো জমজ ভাই বোনের মতোই দেখতে, শুধু ললাটের তিলক দুটো আলাদা-আর সেটাই তাদেরকে বিভক্ত করে রেখেছে!

“দ্যাখছেন?” আতর আলী বলে উঠলো পাশ থেকে। “দুইটাতেই কাস্টমারে গিজ গিজ করতাছে।”

“কিন্তু ওদের খাবার কি আগের রেস্টুরেন্টটার মতো হয়?”

আতর দাঁত বের করে হাসলো। “হয় তো…নাইলে কি অ্যাতো। মাইনষে খাইতে আহে?”

অবাক হলো ছফা। তার ধারণা ছিলো, মুশকান জুবেরির সমস্ত রেসিপিই সিক্রেট, কেউ সেটা নকল করতে পারে না।

“তুমি না বলেছিলে, এর আগে ওই রেস্টুরেন্টের কিছু কর্মচারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরা রেস্টুরেন্ট করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে ওরকম স্বাদের খাবার তৈরি করতে?”।

আবারো দাঁত বের করে হাসলো ইনফর্মার। “ঠিকই কইছিলাম, স্যার…তয় হিটলু আর ফজলুর কপাল ভালা। বেটি যে রাইতে পলাইলো, তার আগে ওগোর কাছে মেডিচিনগুলা দিয়া গেছিলো…ওইগুলান দিয়াই তো খাওনের স্বোয়াদ বাড়ায়।”

বুঝতে পারলো ছফা। মুশকান জুবেরির রেসিপিগুলো সিক্রেট ছিলো, তবে রান্না করার পর প্রতিটি খাবারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সিরাপ মেশাতো, আর সেটাই খাবারের স্বাদকে অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যেতো। এই সিরাপগুলো কী দিয়ে তৈরি সেটা ঐ মহিলা ছাড়া আর কেউ জানতো না।

“ওই দুই বাটপার বহুত মাথা খাটায়া মেডিচিনগুলার নকল বানাইছে। মেডিচিনগুলা নিয়াই দুই হালারপুতের মইদ্যে যতো ক্যাচাল।”

নুরে ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি একটা কণ্ঠ শুনে চমকে তাকালো তারা।

“আরে, আতরভাই যে!”

ছফা আর ইনফর্মার দেখতে পেলো মাঝবয়সী হালকা-পাতলা গড়নের এক লোক এগিয়ে আসছে তাদের দিকে, মুখে এঁটে রেখেছে কৃত্রিম হাসি। কিন্তু হাসির আড়ালে যে আশঙ্কা জেঁকে বসেছে সেটা পুরোপুরি লুকাতে পারেনি।

“স্লামালেকুম।”

“ফজলুমিয়া নাকি,” আতর মুখ বেঁকিয়ে বললো। “ব্যবসা তো জমজমাট তোমার।”

ফজলু নামের লোকটি অমায়িক হাসি দিলো। “সব আপনাগোর দোয়া।”

“ধুর মিয়া, কী কও!” বাঁকাহাসি দিলো আতর। “আমাগো দোয়া হইবো ক্যান, সব তোমার চিকনা বুদ্ধির খেইল। ভালাই খেল দেখাইছে তোমরা…বেটির নাম ভাঙ্গাইয়া পকেট ভরতাছো!”

বিব্রত বোধ করলো ফজলু। “কী যে কন, আতরভাই।”

চোখমুখ নাচিয়ে নুরে ছফার দিকে তাকালো ইনফর্মার। “ইনি আমাগো ছফাস্যার…বিরাট বড় ডিবি অপিসার…ঢাকা থিকা আসছেন…তগো বেটি যার ডরে হোগার কাপড় মাথায় তুইল্যা পলাইছিলো!”

রবীন্দ্রনাথের সাবেক কর্মচারি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো একটু। সম্ভ্রমের সাথে বলে উঠলো, “স্লামালাইকুম, স্যার…ভালো আছেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।

“হিটলু কই, দেখতাছি না যে?” রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননির দিকে ইঙ্গিত করে বললো ইনফর্মার।

“হের খবর আমি রাখি না!” তিক্তমুখে জবাব দিলো ফজলু।

মুখোমুখি দুই রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রতিযোগীতাটি যে ব্যক্তিগত রেষারেষিতে গড়িয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না ছফার।

“আমাগো এই ফজলুমিয়া একটু লেট কইরা ফালাইছিলো, স্যার, বুঝলেন?”

ছফা কিছু বললো না।

“বেটি ভাগনের পর বেকার হয়া ঘুইরা বেড়াইতো, তারপর গত বছর যখন দেখলো তার ইয়ারদোস্ত হিটলু কাম সাইরা ফালাইছে, তহন হের বুদ্ধি খুললো।” ফজলু কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আবার বলতে লাগলো সে, “হিটলু তো হিটলারি বুদ্ধি নিয়া চলে…বেটির হোটেলের নামটাই মাইরা দিছে।” বিচ্ছিরি হাসি দিলো ইনফর্মার। যেনো ফজলুর এই বোকামিতে সে ভীষণ মজা পেয়েছে। “হেয় আর কী করবো, চোর ভাগনের পর বুদ্ধি খুলছে। তয়, হে-ও কম যায় না, এক্কেবারে বেটিরেই মাইরা দিছে!” শেষ কথাটা মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে অদৃশ্য কোথাও প্রবলভাবে ঢুকিয়ে দেবার মতো বিচ্ছিরি একটা ইঙ্গিত করে বললো আতর।

ফজলু একটু কাচুমাচু খেলো। “আরে না, ভাই…আমি তো আমার মাইয়ার নামে এইটা রাখছি। আমার মাইয়ার নাম—”

“রাখো মিয়া!” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো ইনফর্মার। “মিছা কও ক্যান! তোমার মাইয়া যহন পয়দা হইলো, নাম তো রাখছিলা গুলনাহার, হে আবার মুশকান হইলো কবে থিকা?” ছফার দিকে তাকালো। “ওয় মনে করছে আমি এইসব বাইর করতে পারুম না। আরে, আমার নাম হইলো বিবিচি…সুন্দরপুরে কী হয় না-হয় সব আমি জানি!” গর্বিত ভঙ্গিতে বললো সে।

“আতরভাই, আপনে ভুল কন নাই। গুলনাহার তার আসল নাম, ডাক নাম কিন্তু মুশকানই রাখছি।”

“এইসব বুজ আমারে দিয়া কাম হইবো না, আমারে মদনা পাইছোনি!”

“আহ,” ইনফর্মারকে থামিয়ে দিলো ছফা। “বাদ দাও তো এসব কথা।” সে বুঝতে পারছে, ফজলুর চিকন বুদ্ধির কাজকারবার। মুশকান জুবেরির খাবারের সুনাম ছিলো, এটা অস্বীকার করবার জো নেই। মহিলার অনুপস্থিতিতে তার সুনাম ব্যবহার করার মতো কেউ থাকবে না তা কি হয়? এই দেশে এরকমটা আশা করা যায় না। এখানে সফলতাকে অনুসরণ নয়, অনুকরণ করার চেষ্টা করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে পুরোপুরি হাইজ্যাকও করে কেউ কেউ। রবীন্দ্রনাথের সাবেক দুই কর্মচারী সেটাই করেছে।

“স্যার, ফজলুর লগে কিন্তু আমাগো মাস্টরের হট টেরাম,” আঙটার মতো করে দুই তর্জনি আঁটকে দেখালো আতর।

ছফা অবাক হয়ে তাকালো লোকটার দিকে।

মুশকানের মালিক ব্যাখ্যা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। “আতরভাই ভুল বুঝছে, স্যার। উনার স্কুলে তো অনেক বাচ্চা…তিনবেলা খানা দিতে হয়, বিরাট আয়োজন করা লাগে। মাস্টারসাব আমারে এই কাজের দায়িত্ব দিসেন। আমি তারে হেল্প করি।”

ছফা কিছু বললো না।

“উনি হইলেন এই এলাকার মুরুব্বি, মাইন্যগণ্য মানুষ। এমপিসাবে যখন আমারে বললেন, আমি যেন মাস্টারসাবরে হেল্প করি তখন কি না কইরা পারি, কন?”

এবার আতরের দিকে তাকালো নুরে ছফা, “চলো, যাই।”

“কিছু না খাইয়া যাইবেন, তা কি হয়?” ফজলু বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেও ছফার কাছে মনে হলো লোকটা খাতির করে ভাব জমাতে চাচ্ছে। “গরীবের হোটেলে আসছেন, একটু খানাপিনা কইরা যান?”

“এখন না, মাত্র এলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে নেই তারপর আসবো।” কথাটা বলেই আতরকে নিয়ে চলে গেলো ছফা। ফজলু আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করার সুযোগ পেলো না।

“আপনে উঠবেন কই? এসপির বাসায়?” হাঁটতে হাঁটতে আরেকটু সামনের দিকে যেতেই আতর আলী বলে উঠলো।

“না, টাউনের হোটেলেই উঠবো,” নুরে ছফা বললো।

“সুরুত আলীর হোটেলে?” ইনফর্মার বিস্মিত হলো। “ঐটা তো এহন পুরা খান” জিভে কামড় দিয়ে দিলো সে। আরেকটু হলে বেফাঁস কথাটা বলেই ফেলতো। “যাউক গিয়া, আপনে যে-কয়দিন আছেন হোটেলটা ঠিকঠাকমতোই চলবো, চিন্তার কিছু নাই।”

সুন্দরপুরের আগের এসপি বদলি হয়ে গেছে বহু আগেই। নতুন এসপির বাংলোতে ওঠার কথা ভেবেছিলো ছফা কিন্তু ভদ্রলোক সপরিবারে থাকেন, তাই ওখানে ওঠার কোনো ইচ্ছে নেই তার।

“দুইটার খাওন-দাওনই ভালা,” বললো আতর। “আমি মাজেমইদ্যে খাই। তয়, হিটলুর চায়া ফজলুর হাত বেশি ভালা।”

ছফা কিছু বললো না। তার ধারনা, এই নতুন হোটেলে নিয়মিত খায়দায় ইনফর্মার, আর সেটা অবশ্যই বিনে-পয়সায়। তবে এখানে খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তার। নাম দুটো তাকে একটি ব্যর্থতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা এক ধরণের পুরনো ক্ষত, যেটার উপশম এখনও হয়নি।

যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইকাই আপনেরে উঠতে হইবো-কেএস খানের কথাটা যেনো মাথার ভেতরে উচ্চারিত হলো আরেকবার। মনের অজান্তেই হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেলো তার।

এখানেই আমি ব্যর্থ হয়েছি, এখান থেকেই আমাকে আবার শুরু করতে হবে…নতুন করে, মনে মনে বলে উঠলো নুরে ছফা।

.

অধ্যায় ১৮

সুন্দরপুরে রাত নেমে এসেছে। নিরিবিলি হয়ে গেছে এর মহাসড়ক। থানা থেকে বেশ কিছুটা দূরে পরিত্যক্ত একটি বসত বাড়ির উঠোনের সিঁড়িতে বসে আছে আতর আলী। এককালে এখানকার সম্ভ্রান্ত ভট্টাচার্য পরিবারের বাস ছিলো। একাত্তরে তাদের যে কয়জন বেঁচে ছিলো, সবাই চলে গেছিলো কলকাতায়। কেউ আর ফিরে আসেনি। এরপর থেকে নানাজনের হাত ঘুরেছে এটা। কখনও কোনো সারের ডিলারের গোডাউন, তো কখনও আগের এমপির পোলাপানদের আখড়া। এখন অবশ্য পরিত্যক্ত হয়েই পড়ে আছে। তবে শোনা যাচ্ছে, এই বাড়িটা সুন্দরপুরের ফেকু সরকারের অরিন্দম নাট্যসংঘের কাছে দিয়ে দেবে বর্তমান এমপি।

সিগারেটে আয়েশ করে টান দিচ্ছে আতর। একটু আগে নুরে ছফাকে হোটেল সানমুনে রেখে এসেছে, তখন বিস্তারিত কথা হয়েছে তার সাথে। তাকে যে কাজ করতে বলেছে সেটা খুবই অবমাননাকর। তবে সমস্যা নেই, সব ধরণের কাজের জন্যই মানুষ আছে এই দুনিয়াতে। একটু আগে আতর সেরকম একজনকে খবরও দিয়েছে। তারপরই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দুটো কল দেয় সে। এখন সেই দু-জন মানুষের অপেক্ষায় আছে।

পনেরো-ষোলো বছরের এক কিশোর এলো এ সময়। মলিন জিন্স আর টি শার্ট গায়ে। তার হাতে একটা ব্যাগ।

আতরের কাছে এসে চুপচাপ সালাম ঠুকে ব্যাগটা দিয়ে দিলো তাকে, সেই সাথে পকেট থেকে কিছু টাকাও। টাকাগুলো না শুনেই পকেটে ভরে নিলো সে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে বের করে আনলো কেরু অ্যান্ড কেরু কোম্পানির একটি বোতল।

“কতত দিছোস?”

“দুইশো।”

“আইজকা আমদানি এতো কম ক্যারে, হারামজাদা?”

গালিটা গায়েই মাখলো না কিশোর, যেনো হররোজ এরকমটা শুনতে হয় তাকে। “আইজ তো টাউনের বাইরে যাই নাই।”

“ক্যান, আলেকবর মেম্বারের মাইয়ার না বিয়া হইতাছে…ওইখানে যাস নাই?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো সে।

মলিন মুখ করে মাথা দোলালো কিশোর। “ওই বাড়ির বেবাক্‌তে আমারে চিনে, গেলেই ধরা খামু।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো আতর। বয়স কম হলেও ছেলেটা যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন। “কাইলকার কামটা কিন্তু টাইম মতোন করন লাগবো, মনে থাকে যে। একটু এদিক ওদিক হইছে তো পুটকি দিয়া বাঁশ ঢুকামু।”

মাথা নেরে সায় দিলো ছেলেটা। “ওইটা নিয়া আপনে এটুও টেনশন নিয়েন না, ওস্তাদ।”

আতর রেগেমেগে তাকালো। “ওই হালারপুত, আমারে ওস্তাদ কস্ ক্যান?” হারুকাটা মারা যাবার পর এই পিচ্চি কিছু দিনের জন্য ওস্তাদ বানিয়েছিলো গঞ্জের কাঙ্গালি মজিদকে-বছর গড়াতে না গড়াতেই মজিদও পটল তুলেছে কম দামি স্পিরিট পান করে। সেই থেকে আতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর যাই হোক, বল্টুর ওস্তাদ হওয়া যাবে না!

গাল চুলকালো ছেলেটা। ইনফর্মারের রাগের কারণটা ধরতে পারলো না। “কিন্তু এহন তো আপনেই আমার–”

কথার মাঝখানে হাত তুলে থামিয়ে দিলো ছেলেটাকে। “আমি তোর বস্…ওস্তাদ না। কথাটা খিয়াল রাখবি। এহন যা।”

চুপচাপ চলে গেলো ছেলেটা।

প্রথম সিগারেটটা যখন প্রায় শেষ তখনই পরিত্যক্ত বাড়িতে ঢুকলো হ্যাংলা মতোন এক লোক। তার পরনের জামা-কাপড় অবশ্য পরিপাটি। চুলগুলো বেশ ছোটো করে ছাটা। পাতলা গোঁফেও যত্নের চিহ্ন সুস্পষ্ট।

“সালাম, আতর ভাই।”

বোতলটা পাশে রেখে নিঃশব্দে সালামের জবাব দিলো ইনফর্মার। আগে এই বেয়াদপটা তাকে সালাম দিতো না, কিন্তু এখন শুধু সালামই দেয় না, সম্ভ্রমও করে আর সেটা অবশ্যই ভয় থেকে।

সবই হলো ক্ষমতা। এটা থাকলে মেথরও রাজা, না থাকলে রাজাও মেথর।

“কিছু হইছেনি? এতো জরুরী তলব করলেন যে?”

বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো আতরের ঠোঁটে। এ ধরণের কাজের সময় তার ভাবভঙ্গি একটু বেশি নাটকীয় হয়ে যায়। “ট্যাকা কামাইতে কামাইতে তো আন্ধা হয়া গেছো…সুন্দরপুরে কী হইতাছে না হইতাছে, কুনো খবর রাখো?”

লোকটা কিছুই বুঝতে পারলো না, চেয়ে রইলো ইনফর্মারের দিকে।

“উনি তো আবার আইছেন!” গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বললো। “এহন কী করবেন কে জানে!”

“কার কথা কইতাছেন?” অবাক হলো হ্যাংলা মতোন লোকটি।

“যার ডরে তোমাগো ম্যাডাম হোগার কাপড় মাথায় তুইল্যা সব ফালায়া-ফুলায়া পলাইছিলো।” একটু থেমে আবার বললো, “তোমার হিটলারি মাথায় এহনও ঢুকতাছে না, হিটলুমিয়া?”

লোকটা ঢোঁক গিললো আলগোছে। “আবার কী হইছে?”

চোখ কপালে তুললো আতর। “কী হইছে মাইনে?” আক্ষেপে মাথা দোলালো। “এহনও বুঝবার পারো নাই?” পাশ থেকে বোতলটা তুলে নিয়ে মুখটা খুলতে শুরু করলো সে। “বেটির নামটা তো পুরা মাইরা দিয়া বইয়া আছো…এইবার ঠ্যালা সামলাও!” বোতল থেকেই দুই ঢক পান করে গলাটা ভিজিয়ে নিলো। কেরু মদের তেঁতো স্বাদে সাময়িক চোখমুখ কুঁচকে ফেললো সে। “স্যারে আমারে কইছে, ঐ ডাইনি পলানোর পর কার এতো বড় সাহস হইলো, তার হোটেলটা আবার দিছে!”

হিটলু বোঝার চেষ্টা করছে আতরের কথার মমার্থ।

“তুমাগো দুইজনের লুঙ্গি তুইল্যা পলানোর টাইম হয়া গেছে, বুঝলা?” বোতলটা পাশে রেখে দিলো ইনফর্মার।

“ভাই, আমরা কী অন্যায়টা করছি, ক? চুরি চামারি তো করি নাই, কর্ম কইরা খাইতাছি।”

কথাটা আতরের আঁতে ঘা বসালো। মনে হলো তাকেই ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে। একে তো সাবেক চোর, তার উপরে এই জীবনে নির্দিষ্ট কোনো কাজকর্ম করেনি কখনও। আর পুলিশের ইনফর্মারগিরি যে কোনো পেশা নয়, সেটা কে না জানে।

“চুরি করো নাই মাইনে?!” একটু তেঁতে উঠলো আতর। “ঐ হোটেলটা কি বেটি তুমারে লেইখ্যা দিয়া গেছে, অ্যাঁ?”

হিটলু ঢোঁক গিললো আবার। “না…তা দিবো ক্যান।”

“তাইলে তার হোটেলের নাম তুমি নিলা কুন সাহসে?”

“আমি তো তার নাম নেই নাই। আমার হোটেলের নাম রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি। আর ওইটার নাম আছিলো”।

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো আতর। “রাখো তোমার দুই নম্বরি কথাবার্তা। এইসব বুজ আমারে দিবা না, সুন্দরপুরের আবলা-ভ্যাবলা মানুষজরে দিবা, তারা লুঙ্গির নীচ দিয়া পুটকি খাউজ্যাইতে খাউজ্যাইতে হ-হ কইরা তোমার কথা বিশ্বাস করবো।”

হিটলু একটু কাচুমাচু খেলো। নামের এই বুদ্ধিটা সে পেয়েছিলো মাস্টারের দেয়া নতুন লাইব্রেরির ভেতরে রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে একটি লেখা থেকে। কবি যে এই সুন্দরপুরে কখনও আসেননি সেটা নিয়েই ছিলো লেখাটা।

“কিন্তু শহর থেইক্যা যে আইছে, তারে যদি তুমি এইসব কইতে যাও…” কথাটা শেষ না করে ঢুলু ঢুলু চোখে চেয়ে রইলো শিকারের দিকে।

হিটলু একটু ভেবে নিলো। “ভাই, তার লগে তো আপনের বহুত খাতির, আপনে একটু দেখেন না ব্যাপারটা?”

আতর আলী বাঁকাহাসি দিলো। “সব কিছু আমি দেখুম ক্যান? আমার কি ঠ্যাকা পড়ছে, অ্যাঁ?”

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি’র মালিক একটু কাছে এগিয়ে এলো। “আপনের দিকটা আমি দেখুম, ভাই। আপনে খালি আমার দিকটা একটু দেখেন।”

আতর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।

“হাজার দুয়েক দিমুনে, ঠিক আছে?”

কৃত্রিম আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো ইনফর্মার। “এতো হিটলারি বুদ্ধি মাথায় রাখো আর এইটা বোঝো না, এই কাম দুই-তিনে হইবো না?”

চেহারাটা মলিন করে ফেললো হিটলু।

“তুমি আসলেই একটা খাইষ্টা,” বোতলটা আবার তুলে নিলো হাতে, ঢক ঢক করে পান করলো। “তোমার চায়া ফজলু অনেক চিকন বুদ্ধি মাথায় রাখে, দিলদরিয়াও আছে। তারে আমি কিছুই বলি নাই, নিজ থেইক্যাই পাঁচ দিয়া গেলো।”

একটু গাল চুলকে নিলো হিটলু। “হেয় তো দাগি আসামির নামে হোটেল দিসে…বেশি দিবারই পারে।”

চোখমুখ খিচে ফেললো আতর। “হে দাগি আসামির নামে দিছে, আর তুমি নাটকিরপোলা ঐ আসামির হোটেলটার নামই মাইরা দিছো। ক্রিমিনাল তো কেউ কারোর চায়া কম না।”

হিটলু একটু ভেবে নিলো। “তাইলে আমিও পাঁচ দিমুনে, কী ক?” কথা আর বাড়াতে চাইলো না সে।

“এতোক্ষণে লাইনে আইছো, বোতলটা পাশে রেখে দিলো আবার। “এই জিনিস খালি খাইতে ভাল লাগে না, বুঝছো?”

হিটলু কিছুই বললো না।

“তোমার হোটেলের গরুর ভুনা তো ফেমাচ…একটা পোলারে দিয়া এক প্লেট পাঠায়া দিও এইখানে।”

“আচ্ছা, ভাই।”

“আর ট্যাকাটা কাইলকার মইদ্যে দিতে হইবো, তেড়িবেড়ি করবা না।” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেলো হিটলু।

আতরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। একটু পর ফজলু আসবে, তাকেও একই কথা বলবে। পাঁচ পাঁচ দশ! এক দানে এতোগুলো টাকা পাবার পর গঞ্জে যাবে সে খুব জলদি। গত সপ্তাহে শেফালি নামের নতুন যে মেয়েটা এসেছে, ঐ শালি সুন্দরপুরের আশেপাশে যতো লুঙ্গি আর গামছার বেপারী আছে, সব শালাকে যেনো গলায় গামছা বেঁধে টেনে আনছে। খুব ডিমান্ড তার। আর এবার তার ডিমান্ড মেটাবে!

বোতলটা তুলে নিয়ে লম্পট ঠোঁটটা ছোঁয়ালো, আবারো পান করলো ঢক ঢক করে।

.

অধ্যায় ১৯

ভ্রমণের ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও রাতে ভালো ঘুম হলো না ছফার। সুরুত আলীর নোংরা আর জঘন্য আবাসিক হোটেলকে এজন্যে দায়ী করা যায় না। বৈশাখ মাসের খামখেয়ালি আবহাওয়া এমনই যে, বিকেলের ঝড় সন্ধ্যার পর পরই উধাও হয়ে যায়, রাতের বেলায় সুন্দরপুরে নেমে আসে ভ্যাপসা গরম। ওদিকে হোটেলের পাশে সদ্য দেয়া জনপ্রিয় দুটো রেস্টুরেন্টের খাবার পরিহার করার মাশুলও দিতে হয়েছে তাকে। নামবিহীন এক খাবারের দোকানের খাবার খেয়ে পেট ফেঁপে গেছিলো তার। এটাই তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।

ভোরের দিকে ক্লান্তি থেকে আসা ঘুম ভাঙলো সকাল নয়টারও পরে। তারপরও বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল রাতে এই হোটেলে ওঠার আগে আতরের সাথে একটা জরুরী কাজ নিয়ে আলাপ করেছে সে। তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে, বেশ সতর্কতার সাথে কাজটা করতে হবে, একদমই সময় নষ্ট করা যাবে না।

“এইসব কাম তো আমি কবেই ছাইড়া দিছি,” অপারগতা প্রকাশ করে বলেছিলো ইনফর্মার। “তয় চিন্তা কইরেন না, অন্য একজরে দিয়া করামুনে।”

“আরে না,” সঙ্গে সঙ্গে ছফা বলে উঠেছিলো। সে চায়নি অন্য কেউ এ কাজ করুক। গোপন জিনিস যত কম জানা যায় ততো ভালো। “যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ করানো যাবে না…বুঝতে হবে এটা। “

“ওয় আমার হাতের মুঠিতে থাকে,” আশ্বস্ত করে বলেছিলো ইনফর্মার। “ওরে নিয়া কুনো চিন্তা কইরেন না, স্যার।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ছফা জানতে চেয়েছিলো, “কে সে?”

“বল্টু। আমাগো সুন্দরপুরের আলী বাবা! চল্লিশ চোরের কাম একাই করবার পারে সে। কব্বরে গেলেও এই কথা কাউরে কইবো না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলেও সন্দেহটা পুরোপুরি যায়নি ছফার।

“কিন্তু লোকটা যদি ধরা পড়ে যায়?”

“লোক না তো…পোলা,” শুধরে দিয়ে বলেছিলো আতর। “ওর বয়স চৌইদ্দ-পরো অইবো।”

“কি!” অবাকই হয়েছিলো সে। “তুমি একটা পিচ্চিকে দিয়ে এরকম কাজ করাবে?”

“বয়সে পিচ্চি হইলেও ওর মতো সেয়ানা এই সুন্দরপুরে দুইটা নাই। এই বয়সেই খানকি পাড়ায়…” কথাটা শেষ না করে আবার বলে, “আপনে যেইটা চাইতাছেন ওইটা বই করবার পারবো। মাইনষের ভীড়ে কাম সাইরা ফালায় সে, আর এইটা তো খালি বাড়ি…ওর কাছে ডাইলভাত।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলো ছফা।

আতর আলী দাঁত বের করে হেসে বলে, “তাইলে ধইরা লন, আপনের কাম হয়া যাইবো।”

এখন বিছানা থেকে নিজেকে জোর করে তুলে নিয়ে টয়লেটে চলে গেলো ছফা। সে টের পেয়েছে, এই হোটেলে ওঠার সাথে সাথে এখানকার ‘ব্যবসায় মন্দাভাব শুরু হয়ে গেছে। নতুন ম্যানেজারের বেজার করা মুখ দেখে বুঝতে পেরেছে, তার উপস্থিতি যতো প্রলম্বিত হবে এই মুখ ততোই চুপসে যেতে থাকবে। নিশ্চয় ভদ্রলোককে সাবধান করে দিয়েছে আতর।

যাই হোক, হোটেল থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতেই সে চলে এলো রবীন্দ্রনাথ আর মুশকানের সামনে। পথের দু ধারে দুটো রেস্টুরেন্টে এই সাত সকালেও কাস্টমারের বেশ সমাগম হয়েছে। আতরের কাছ থেকে এখানকার খাবারের বেশ সুনাম শুনেছে সে। দেখেও মনে হচ্ছে, এদের খাবার-দাবার শুধু সুস্বাদুই নয়, বেশ স্বাস্থ্যসম্মতও হবে-যদি তারা মুশকান জুবেরিকে সত্যি সত্যি অনুকরণ করে থাকে তো!

হাতঘড়িতে সময় দেখলো ছফা, এখনও বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় হাতে আছে। গতকালের নামবিহীন খাবারের দোকানে নাস্তা করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। তাছাড়া, দুটো রেস্টুরেন্ট থেকে যে ঘ্রাণ ভেসে আসছে সেটা তার ক্ষিদেটাকে চাগিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে প্রবোধ দিলো-নামে কী আসে যায়! রেস্টুরেন্ট দুটোর মালিক ব্যবসায়িক দিক মাথায় রেখে নামদুটো নিয়েছে, এর সাথে আগের রেস্টুরেন্ট কিংবা তার মালেকিনের কোনো সম্পর্ক নেই। অগত্যা, অনেকটা হুট করেই সে ঢুকে পড়লো মুশকানের ভেতরে!

রেস্টুরেন্টের প্রায় সব সিটই দখল করে রেখেছে ভোজন রসিকেরা, তারপরও একটা সিট খালি পেয়ে বসে পড়লো সে। ওয়েটারকে দ্রুত অর্ডার দিলে নাস্তার জন্য-সজি, রুটি আর ডিম ভাজি, সেই সাথে এক কাপ চা।

রবীন্দ্রনাথের খাবারের মতো সুস্বাদু না-হলেও মুশকানের স্বাদ বেশ ভালো। তৃপ্তি নিয়েই খেলো নুরে ছফা। ঝটপট নাস্তা সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগোতেই একটা শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকালো সে।

আতর আলী বাইক নিয়ে চলে এসেছে। বাইক থামিয়ে হাসিমুখে বললো ইনফর্মার, “নাস্তা করতে আইছিলেননি?”

সত্যিটা বলবে কিনা বুঝতে পারলো না ছফা, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই আতর আবার বলে উঠলো।

“এগোর খাওন-দাওন কিন্তু মাশাল্লাহ। কিন্তু ভুলেও ইমামুদ্দির হোটেলে খায়েন না…হাতে এক্কেবারে লোটা ধরায়া দিবো।”

ইমামুদ্দির ব্যাপারে আতর আলীর কথাটা যে সত্যি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে গত রাতে।

“দেখছেন, সকাল সকাল পীপড়ার মতো ভীড় লাইগ্যা গেছে, রাস্তার দু-পাশে রেস্টুরেন্ট দুটোর দিকে ইঙ্গিত করে বললো ইনফর্মার। “এইহানেই খাওন-দাওন কইরেন। আমি ফজলুরে

“এটা কবে কিনলে?” প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বাইকটার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলো ছফা।

“কিনছি তত তিন মাস হইলো। আমাগো টাউনের সেকান্দার মিয়ার আছিলো এইটা, ওর আবার ট্যাকার খুব দরকার পড়লো…আমারে কইলো, দোস্ত, কিছু টাকা দেও…হুন্ডাটা রাখো। আমি দেখলাম, এতো সস্তায় এই জিনিস আর পামু না, তাই কিইন্যা ফালাইলাম।” নিজে থেকেই বাইক কেনার গল্পটা বলে গেলো আতর।

ছফা চাচ্ছে না, এইসব বানোয়াট গল্পের পরিসর আরো বাড়ুক। “চলো, আমাদের কাজে নেমে যেতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

দাঁত বের করে হেসে ফেললো ইনফর্মার। “উইঠ্য পড়েন, স্যার।” ছফা চুপচাপ উঠে বসলো আতরের বাইকের পেছনে।

ইনফর্মারের চোখেমুখে গর্বিত ভঙ্গি ফুটে উঠলো। এলাকার অনেকেই দেখবে, ঢাকা থেকে আসা মহাক্ষমতাধর পুলিশ অফিসার তার বাইকের পেছনে বসেছে।

সুন্দরপুরের মহাসড়ক দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আতরের বাইকটা চলে এলো রহমান মিয়ার টঙ দোকানের সামনে।

“অনেকদিন বাদে আইলেন…আছেন কিমুন?” তাকে দেখে গদগদ হয়ে বললো দোকানি।

“আছি ভালোই। আপনি কেমন আছেন?” ছফা বাইক থেকে নেমে জানতে চাইলো।

দাঁত বের করে চওড়া একটা হাসি দিলো রহমান। “আছি আর কি…গরীব মানুষ।”

আতরের চোখমুখ বিরক্তিতে সামান্য কুঁচকে গেলো। টঙের সামনে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লো ছফা।

“তা, এতোদিন পর আইলেন যে, কিছু হইছেনি আবার?”

“দুই কাপ চা বানাও, মিয়া, বাইকটা স্ট্যান্ডের উপর রাখতে রাখতে বললো আতর। তার চোখেমুখে বিরক্তি। “খালি বেশি কথা কও।”

রহমান আর কিছু না বলে চা বানাতে মনোযোগি হলো। “আপনার ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?” জানতে চাইলো ছফা।

রহমান মিয়া মুখ কালো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আর ব্যবসা! ঐ হুটেল বন্ধ হওনের পর আমার ব্যবসা উঠছে চাঙ্গে।” রবীন্দ্রনাথের দিকে ইঙ্গিত করলো। “এহন তো এইদিকে কেউ খাইতে আহে না, যারা আহে তারা সব পণ্ডিত, খালি বই পড়ে।”

আতর আলী ছফার পাশে এসে বসলো। “বেটির হোটেলটারে তো দুই চক্ষেও দেখবার পারতা না, ওইটা যখন বন্ধ হয়া গেলো ঈদের মতো খুশি হইছিলা, এহন আবার এই গীত গাইতাছছা ক্যান, মিয়া।”

বিরক্ত হয়ে তাকালো রহমান। “আমি খুশি হইছি তুমারে কে কইলো? খালি আজাইরা কথা!”

ইনফর্মার দাঁত বের করে হাসলো।

“আপনি নতুন রেস্টুরেন্ট দুটোর পাশে টঙটা সরিয়ে নিলেই পারেন, বললো ছফা। “ওখানে তো ভালো কাস্টমার পাবেন।”

রহমান কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আতর আলী কথা কেড়ে নিলো। “আপনে ওরে যতো বোকা ভাবেন ওয় আসলে অতো বোকা না, স্যার। ইচ্ছা কইরা এইহানে পইড়া আছে। এতো সহজে ওইখানে যাইবো না।”

রহমান মিয়া ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো আতরের দিকে।

অবাক হলো ছফা। “কেন?”

“এইহানে থাকলে তো বইসা বইসা কামাইতে পারে, বুঝলেন না?”

“কি কও এইসব?” প্রতিবাদ করে উঠলো দোকানি।

বিজ্ঞের মতো হাসি দিলো ইনফর্মার। “মনে করো আমি কুনো খবর রাখি না,” তারপর গর্বিত ভঙ্গিতে ছফার কাছে বয়ান করলো সে, “হিটলুর লগে হের হট টেরাম, বুঝলেন? হেয় ওরে কইছে, খিচ মাইরা যেইহানে আছো সেইহানে পইড়া থাকো, রহমান। শহর থিকা লোকজন বেটির হোটেলের খুঁজ করলে তুমি আমার নতুন হোটেলটার কথা কইবা। ফজলুরটা নকল…আমারটা আসল।”

“সব মিছা কথা!” প্রতিবাদ করে উঠলো টঙ দোকানি। “এইসব কথা ক্যাঠায় কইছে তুমারে?”

“আরে, আমি সব খবরই রাখি। তুমি হিটলুর কাছ থিকা কমিশন পাও।”

বিস্মিত রহমান মাথা দোলালো। ছফার দিকে ফিরে তাকালো সমর্থন পাবার আশায়, “ছার, বিশ্বাস করেন মিছা কথা–”

হাত তুলে থামিয়ে দিলো নুরে ছফা। আতর আলীর দিকে তাকালো সে, “এসব বাদ দাও তো।” তারপর আবার দোকানির দিকে ফিরলো, “এক প্যাকেট বেনসন দিন।”

রহমান মিয়া ঝটপট সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলো ছফার দিকে, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লো চা বানাতে। কমিশনের আলাপ থেকে মুক্ত হতে চাইছে যেনো।

একটা সিগারেট ঠোঁটে নিতেই আতর আলী নিজের পকেট থেকে লাইটার বের করে বাড়িয়ে দিলো। মুচকি হেসে সিগারেটটা ধরালো ছফা।

রহমান মিয়া গুঁড়ের চা বানিয়ে দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিলে নিজের কাপটা হাতে নিয়ে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিতে শুরু করলো ছফা। আতরের দিকে আড়চোখে তাকালো একবার। জোরে জোরে চুমুক দিয়ে চা-টা দ্রুত শেষ করে উঠে দাঁড়ালো ইনফর্মার।

“স্যার, আমি তাইলে যাই,” ছফার উদ্দেশ্যে বললো। “আমার একটা কাম আছে টাউনে।”

“আচ্ছা। পরে দেখা হবে।”

পকেট থেকে টাকা বের করে রহমান মিয়াকে দিয়েই চুপচাপ বাইকটা স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো আতর।

“এখনকার এমপি মানুষ হিসেবে কেমন?” ইনফর্মার চলে যাবার পর রহমান মিয়াকে জিজ্ঞেস করলো ছফা।

“মানুষ ভালাই, তয় বয়স অনেক কম,” জানালো দোকানি। “আসাদুল্লাহ যহন বাঁইচ্যা আছিলো তহন হে সুবিধা করবার পারে নাই। মামলা-মুমলা দিয়া বহুত পেরেসানে রাখছিলো…তহন হে ঢাকায় থাকতো। ফেরাউনটা মরনের পর গেরামে ঢুকছে, তারপর কেমনে কেমনে এমপিও হইয়াও গেলো। সবই কপাল।”

“তারা দু-জন কি একই পার্টি করতো না?” সিগারেটে টান দিয়ে জানতে চাইলো ছফা।

“হ, একই পার্টি করতো কিন্তু বনিবনা আছিলো না। আসাদুল্লাহ এন্টি পাটির লুকজনরে যিমুন পেরেসানিতে রাখতো, নিজের পাটির অনেরেও দৌড়ের উপর রাখছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “শুনলাম মাস্টারের সাথে নাকি নতুন এমপির খুব খাতির?”

“হ। জোনায়েদভাই তো মাস্টরের কাছে ছুটকালে পড়ছে…খুবই মাইন্যগণ্য করে তারে।”

“মাস্টারের এখন কী অবস্থা?”

“সুন্দরপুর তো এহন মাস্টরই চালায়,” হেসে বললো রহমান। “পুলিশ-ডিচি-এচপি-টিনও, সব হের পকেটে থাহে। আমাগো নয়া এমপিও হের কথায় উঠে আর বহে।”

ছফী বুঝতে পারলো আবারো ক্ষমতাধর একজনকে মোকাবেলা করতে হবে তাকে। তবে এদের চেয়েও প্রবল ক্ষমতাধর মানুষ আছে তার মাথার উপরে। বাধাবিপত্তি যতোই আসুক না কেন, সব কিছু সামলাবে ঐ লোক। যদিও স্থানীয় ক্ষমতাবানদের কিছু সুবিধা থাকে। অনেক সময় তাদেরকে ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে ওঠে না। তাই ছফাকে এবারও সতর্ক থাকতে হবে।

“তয় মাস্টর মাটির মানুষ, হে আগের মতোই আছে,” বললো। দোকানি। “চাইলে, সুন্দরপুরে যা খুশি করবার পারে কিন্তু স্কুল আর লাইবেরি লইয়াই পইড়া থাহে সারা দিন, কারো আগে পিছে কুনোকালেই হে ছিলো না, এহনও নাই।”

কথাটা মেনে নিতে কষ্টই হলো ছফার। মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার আগে এই ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে কথা বলেছে। তার ধারনা, এখনও এই লোকটার সাথে মহিলার কোনো না কোনো যোগাযোগ আছে-তবে সেটা

তিনি করেন খুবই সঙ্গোপনে। ভদ্রলোক নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট থাকেন।

“মাস্টরের স্কুল খালি আমাগো গেরামেই না, বাইশ গেরামের মইদ্যে সেরা।”

রহমান মিয়ার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো ছফা।

“বাপ-মায়েরা পোলাপান নিয়া আইস্যা পড়ে মাস্টরের কাছে। ছার, আমার পোলাটারে মানুষ কইর‍্যা দেন…ওরে আপনের কাছেই দিয়া গেলাম।” দোকানি এমনভাবে কথাটা বললো যেনো ঘটনাগুলো তার চোখের সামনেই ঘটে। “স্কুলের আবার হুস্টেলও আছে। এত্ত বড় জমিদার বাড়ি…জায়গার অভাব আছেনি?”

কপট প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটে উঠলে ছফার মুখে। “স্কুল দিতে না দিতেই এতো সুনাম!”

“স্কুল নতুন হইবার পারে, মাস্টর তো নতুন মানুষ না। হেরে চেনে না এমুন মানুষ আছে এই এলাকায়? পোলাপানগো হে গানও শিখায়, ছবি আঁকায়…কত্তো কী যে করায়। ঢাকা-কলিকাতা থেইক্যাও মাস্টর নিয়া আসছে। এলাহি কাজ-কারবার।”

নুরে ছফা উঠে দাঁড়ালো। “আসলেই বিরাট কাজকারবার।”

ছফার কথাটার সুর বুঝতে পারলো রহমান। এই লোক যে মাস্টারকে খুব একটা পছন্দ করে না, সেটাও তার অজানা নয়।

“কতো হয়েছে আমার?” চওড়া হাসি দিলো দোকানি। “আতর তো বিল দিয়া দিছে।”

“ওহ্।” ছফা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে টঙ দোকান থেকে পা বাড়ালো রাস্তার দিকে।

রহমান ঘাড় উঁচু করে সেদিকে চেয়ে রইলো। রাস্তা পার হয়ে নতুন স্কুলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নুরে ছফা।

“মাস্টারের কথা শুনলে তো মুখ কালা হয়া যায়,” বিড় বিড় করে বললো দোকানি। “আবার দেহি হের কাছেই যায়!”

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *