দুঃখবাদ

দুঃখবাদ

অন্যান্য কালের মতো একালেও ভাবা হচ্ছে :প্রাজ্ঞ লোকেরা যখন এই ধারণায় উপনীত হয়েছেন যে, এই পৃথিবী দুঃখময়–এখানে বঁচবার মতো কিছুই নেই, তখন এখানে সুখ প্রত্যাশা না-করাই ভালো। যাদের কথা বলা হল তারা যদি বৈরাগী হতেন তো এক কথা ছিল, কিন্তু তারা যখন নিজেরাই ভোগী-শিরোমণি তখন তাদের কথায় আর আস্থা স্থাপন না করে থাকা যায় না। আপনি যদি সত্যি সত্যি একটা ফল মুখে দিয়ে থু করে মুখ বাঁকান তো আমার আর ও ফলটি চেখে দেখবার সাধ থাকতে পারে না। আপনার দেখাদেখি আমারও থু করে মুখ বাঁকাবার ইচ্ছে হবে। অতিভোগের পরে প্রতিষ্ঠ সংস্কৃতিবানরাই যখন মুখ বাঁকান–যেন তেতো কিছু খাচ্ছেন এমনিভাবে, তখন সংস্কৃতির নতুন দাবিদাররাও যে তা-ই করতে চাইবে তাতে আর আশ্চর্য কী? সকলেই তো উঁচু নাকের পরিচয় দিতে ভালোবাসে, আর উঁচুনাকঅলা সাজবার সহজ উপায় হচ্ছে পৃথিবীতে উপভোগ করবার মতো কিছুই নেই, এমনি ভাব দেখানো।

এই ধারণার বশবর্তীরা সত্যই দুঃখী। কিন্তু সাধারণের দুঃখ আর তাদের দুঃখের মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। সাধারণ লোকেরা তাদের দুঃখের জন্য গর্ববোধ করে না, কিন্তু তারা করে। জগতে উপভোগ্য কিছুই নেই, একথা বলে তারা একটা উন্নাসিক শ্রেষ্ঠতাবোধের পরিচয় দেয়। তাদের গর্ব দেখে সাধারণের মনে একটা খটকা লাগে :’দুঃখের জন্য গর্ব’, তা আবার কীরকম ব্যাপার? এ তো সোনার পাথরবাটির মতো একটা অসম্ভব কিছু। হয় তাদের গর্বটা মিথ্যা, নয় দুঃখটা–এই তাদের সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায়। সত্যি-কথা। দুঃখের মধ্যে যে আনন্দ পায়, তার আবার দুঃখ কিসের? তার শ্রেষ্ঠতাবোধের মধ্যেই তো একটা ক্ষতিপূরক দিক রয়েছে। কিন্তু তাই বলে তাকেই যথেষ্ট বলা যায় না। অহঙ্কারবোধ যে-সুখের যোগান দেয়, প্রকৃত সুখের তুলনায় তা অকিঞ্চিৎকর।

নিজেকে দুঃখী ভেবে গর্ববোধ করার মধ্যে কোনপ্রকার উন্নত ধরনের যৌক্তিকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। তা বিকৃত বুদ্ধিরই পরিচায়ক। দুঃখের জন্য গর্ব না করে বুদ্ধিমান মানুষ যতটা সম্ভব সুখ আদায় করে নিতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তারা যদি মনে করে জাগতিক চিন্তা একটা সীমা পেরিয়ে গেলেই সুখের কারণ না হয়ে দুঃখের কারণ হয়ে দঁড়ায় তো তারা জগতের চিন্তা না করে অন্য কিছুর চিন্তা করবে। মোটকথা, সুখের দিকেই তাদের ঝোঁক হবে, দুঃখের দিকে নয়। দুঃখই সত্য একথা প্রমাণ করতে গিয়ে যারা বিশ্বপ্রকৃতির মূলেই দুঃখের নিদান দেখতে পায়, তারা প্রকৃতপক্ষে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করে। আসল ব্যাপারটি এই যে, নিজের দুঃখের কারণটি বের করতে না পেরে তারা শেষে বিশ্বপ্রকৃতির ওপরেই সমস্ত দোষ চাপিয়ে দেয়। বিশ্বপ্রকৃতিতে যে-সকল নৈরাশ্যব্যঞ্জক দিক রয়েছে তাদের উপর আঙুল রেখে বলে : বিশ্বের মূলেই যখন নিষ্ঠুরতা, তথা দুঃখের খেলা তখন তার থেকে সুখ প্রত্যাশা না-করাই যুক্তিসঙ্গত। এসো, সুখের কামনা ভুলে গিয়ে নিজেকে দুঃখের জন্য প্রস্তুত করে তুলি; তা হলেই আর প্রবঞ্চিত হওয়ার ভয় থাকবে না। মিথ্যা খেয়ালি পোলাও খাওয়ার চেষ্টা না করে যা সত্য, নিষ্ঠুর হলেও তাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।

ওপরে যে-দুঃখবাদী দর্শনের উল্লেখ করা হল, আমেরিকার পাঠকদের জন্য তা পরিবেশন করেছেন জোসেফ উড ক্রুচ তাঁর ‘দি মডার্ন টেম্পার’ নামক গ্রন্থে। আমাদের পিতামহদের জন্য তা পরিবেশন করেছিলেন কবি বাইরন। আর সমস্ত কালের লোকদের জন্য তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন ‘ইকলেজিয়েটসের লেখক। ক্রুচ বলেছেন :

আমাদের কোনো ভরসা নেই। প্রাকৃতিক বিশ্বে আমাদের জন্য এতটুকু সুখের স্থানও নেই। তথাপি মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে আমরা দুঃখিত নই। পশু হিসেবে বাঁচার চেয়ে মানুষ হিসেবে মরে যাওয়া অনেক ভালো।

আর বাইরন যা বলেন তা তো সকলের জানা :

যে আনন্দ নিয়ে যায় কাল, কভু নাহি দেয় তাহা ফিরে,
যৌবনের ভাবের গরিমা ডুবে কা–যায়-সিন্ধু নীরে।

 এখন ইকলেজিয়েটসের লেখকপ্রবর কী বলেন, দেখা যাক। তিনি বলেন :

এইজন্যই আমি বেঁচে থাকা মানুষদের চেয়ে মরে যাওয়া মানুষদের অধিক গুণকীর্তন করি। হাঁ, তাঁদের চেয়েও ভালো হচ্ছেন তাঁরা যারা এখনও জন্মাননি। এবং সেহেতু সূর্যের আলোর নিচে যেসব মন্দ ব্যাপার ঘটে তা প্রত্যক্ষ করেননি।

 এই অশুভদর্শী ব্যক্তিত্রয়ের প্রত্যেকে প্রচুর সুখভোগের পরেই এই নিরানন্দ দর্শনে এসে পৌঁছেন। ক্রুচ বাস করেছিলেন নিউইয়র্কের সুখভোগী ইন্টেলেকচুয়ালদের মধ্যে। বাইন সঁতরে ছিলেন ভোগের নদী। ইকলেজিয়েটসের রচয়িতাও ভোগের ব্যাপারে কম যাননি। সুরা, সঙ্গীত ও অনুরূপ অন্যান্য ব্যাপারে তার জুড়ি ছিল না বললেই চলে। দাস-দাসী ছিল তার বিস্তর, সরোবরও তিনি খনন করিয়েছিলেন। ভোগের আয়োজনে কোনোকিছুই তিনি বাকি রাখেননি! তথাপি তিনি দেখতে পেলেন সকলই ফাঁকি, মায়া–এমনকি জ্ঞানও।

আর আমি জ্ঞান-আহরণে মনোনিবেশ করলুম, নির্বোধ মমতায় জীবনের স্বাদও নিলুম। কিন্তু ততঃ কিম? তাতে তো আত্মার বিক্ষোভই বাড়ে, কমে না। কারণ যতবেশি জ্ঞান বাড়ে, ততবেশি দুঃখও বাড়ে। জ্ঞান বাড়িয়ে তুমি দুঃখই বাড়াও।

 মনে হয়, তাঁর জ্ঞান তাকে ঘাবড়ে দিয়েছিল। জ্ঞান, প্রেম, ভোগবিলাস সমস্ত কিছুই তার কাছে ফাঁকি, অন্তঃসারশূন্য বোধ হল বলে জীবন তার কাছে ঘৃণার বস্তু হয়ে দাঁড়াল। সুখের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি দুঃখকেই মানব-ভাগ্য বলে মেনে নিলেন।

এখন এই-যে মনোভঙ্গি, এ সচেতন বুদ্ধিলোকের ব্যাপার নয়, অবচেতন ভাবলোকের ব্যাপার। অর্থাৎ এটি চিন্তার বিষয় নয়, ‘মুড’ বা মনোভাবের বস্তু। তাই এর পরিবর্তন ঘটতে পারে কেবল কোনো শুভ ঘটনার সংযোগে অথবা শরীরগত পরিবর্তনে তর্ক করে কখনো নয়। জীবন অনেকদিন আমার কাছেও ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়েছে। কিন্তু এই শোচনীয় অবস্থা থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি কোনো ফিলজফি পড়ে নয়–অনিবার্য কর্মপ্রেরণায়। আপনি যতই অবসাদ বোধ করেন না কেন, এমন সময় আসবেই যখন আপনি কাজ না করে থাকতে পারবেন না, আর কাজের সঙ্গে সঙ্গে আপনার অগোচরেই আপনার অবসন্নতা বাম্পের মতো মিলিয়ে যাবে। সূর্য যেমন মেঘের শত্রু, কাজও তেমনি অবসাদের দুশমন। আপনার ছেলে যদি পীড়িত হয়ে পড়ে তো নিশ্চয়ই আপনি দুঃখবোধ করবেন, কিন্তু আপনার কাছে জগৎ অসার মনে হবে না। বরং জীবনের মূল্য আছে কি নেই, এ কথা না-ভেবেই আপনি আপনার ছেলেকে সারিয়ে তুলতে চাইবেন। সত্যকার দুঃখীরা জীবনকে কোনোদিন কি মনে করে না। জীবনের প্রতি আকর্ষণ তাদের ষোলো আনা। জীবন ফাঁকি বলার প্রবণতা রয়েছে শুধু অবসরভোগী ধনী-সম্প্রদায়ের মধ্যে। কিন্তু ধনীলোকটি যদি ভাগ্যের চক্রান্তে সর্বস্ব খুইয়ে বসে তো পরের বেলার আহারটুকুকে সে আর ফাঁকি বলে উড়িয়ে দিতে পারবে না। জীবনের চাহিদাগুলি সহজে মিটলেই এ-ধরনের রুগণ মনোভাবের জন্ম হয়। অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষের জন্যও জীবনসংগ্রামের প্রয়োজন আছে। প্রচুর ধনাগমের ফলে মানুষ যখন সহজে, একরকম বিনা চেষ্টায়ই তার খেয়াল মেটাতে সক্ষম হয়, তখন সে আর জীবনের স্বাদ পায় না। চেষ্টার অভাবের দরুন সুখের উপাদানে ঘাটতি ঘটে। আকাঙ্ক্ষার পূর্তিতে সুখ নেই–এ উক্তি কেবল তারই হয়ে থাকে, কামনার বস্তুগুলি যে অত্যন্ত সহজে পায়। এই লোকটি যদি দার্শনিক গোছের হয় তো সহজে এ সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছে যে, যে ব্যক্তিটি অনায়াসেই তার শখ মেটাতে পারে সেই যখন সুখী নয়, তখন দুনিয়া স্বভাবতই দুঃখের। কোনো কোনো প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবই-যে সুখের হেতু, এ-কথাটা হতভাগ্য দার্শনিকটির মনে থাকে না।

এ গেল ‘মুড’ বা মনোভাবের ব্যাপার। যুক্তি-তর্কের ব্যাপারও ইকলেজিয়েটসে আছে। ইকলেজিয়েটস-কার জীবনের অসারতা সম্বন্ধে যেমতটি ব্যক্ত করেছেন, হালের দার্শনিকদের হাতে তা নিম্নরূপ অভিব্যক্তি পেত :

মানুষ অনবরত খেটে চলেছে, বস্তুও এক অবস্থায় স্থির হয়ে নেই। তথাপি এমন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে না যা চিরত্ব দাবি করতে পারে। বড় রকমের কোনো পরিবর্তনই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। পূর্বের ব্যাপারের সঙ্গে পরের ব্যাপারের পার্থক্য অল্পই। সেই থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়। মানুষ মরে যায়, ছেলে এসে তার পরিশ্রমের ফল ভোগ করে। আবার তার ছেলে তাকে অনুসরণ করে। নদী সমুদ্রের দিকে যায়, কিন্তু সেখানেও তার জল আটকে থাকে না–কেবলই সরে সরে যায়। বারবার উদ্দেশ্যবিহীন চক্রে মানুষ ও বস্তু ঘুরছে। অন্তহীন, পরিণতিহীন এই ঘূর্ণন। এতে কী লাভ? নদী যদি বুদ্ধিমান হত তো সে যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকত চপলতা দেখিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেত না। সোলেমান যদি বুদ্ধিমান হতেন তো ছেলের ভোগের জন্য গাছ লাগিয়ে যেতেন না। বুদ্ধিমান লোকের কাছে সব ফাঁকি সব মায়া। এই ফাঁকির ফাঁদে ধরা দেয় কেবল বোকারাই। অতএব, নিজের বুদ্ধির শ্রেষ্ঠতা যদি প্রতিপন্ন করতে চাও তো ওপথ মাড়িও না। অবজ্ঞা করো, পৃথিবীকে অবজ্ঞা করো-ফিরেও তার দিকে তাকিও না।

কিন্তু অন্যভাবে দেখতে গেলে পৃথিবী কত সুন্দর, কত বিচিত্র। কত নিত্যনতুন ব্যাপার ঘটছে এখানে। সূর্যের নিচে নতুন কিছু নেই, না? তাহলে এই-যে আকাশ ছোঁয়া ইমারত, উড়োজাহাজ, বেতারবার্তা–এসব কী? সোলেমান এসবের কী জানতেন? মনে করুন, শেবার রানী তার শাসনাধীন দেশসমূহ থেকে ফিরে এসে রেডিওর মারফত প্রজাদের কাছে বক্তৃতা দিচ্ছেন। সোলেমান তা শুনে কি খুশি হতেন না? না, তাও তার কাছে বৃক্ষ ও পুকুরের মতো একঘেয়ে মনে হত? তার কালে খবরের কাগজেরও চল ছিল না। কেউ যদি তাকে সংবাদপত্র থেকে তার হারেম ও ইমারতের প্রশংসা বাণী, অথবা তার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষিকুলের নাজেহাল হওয়ার কথা পড়ে শোনাতেন, তাহলে কি তিনি জীবনের নতুনতর স্বাদ পেতেন না? না, তাও তার কাছে জলো, অর্থবিহীন মনে হত? অবশ্য নৈরাশ্যবাদ দূর করবার জন্য এগুলিই যথেষ্ট নয়, এদের বর্তমানেও তা থেকে যেতে পারে। আর প্রকৃতপক্ষে হয়েছেও তাই। ইকলেজিয়েটস্ রচয়িতা মুখ কালো করেছিলেন নতুনত্বের অভাব দেখে, ক্রুচ করেছেন নতুনত্বের প্রাচুর্যের দরুন। দুই বিপরীত কারণ একই ব্যাপারের জন্ম দিতে পারে না। সুতরাং বুঝতে পারা যায়, কারণ হিসাবে তারা তেমন জোরালো নয়। নদী পড়ে গিয়ে সমুদ্রে, তথাপি সমুদ্র যেমনটি ছিল তেমনটিই থাকে, তার বৃদ্ধি হয় না; জলধারা যেখান থেকে আসে সেখানেই আবার ফিরে যায়। এটা যদি একটা দুঃখের কারণ হয় তো ভ্রমণে কেউ আনন্দ পেত না। লোকেরা গরমের দিনে হাওয়া বদলে যায় গরমের শেষে আবার ফিরে আসতেই। তাই বলে হাওয়া বদলটা দুঃখজনক, এমন কথা তো কেউ বলে না! বরং তা থেকে আনন্দই পাওয়া যায়। জলধারার যদি অনুভ-ক্ষমতা থাকত তো এই দৃর্ণনে সে শেলীর মেঘের মতো আনন্দই বোধ করত, দুঃখ নয়। জীবনের স্পন্দনই বড় কথা। বরাবরই একটি ব্যাপার ঘটলেও তা যদি জীবনের স্পন্দনে স্পন্দিত হয় তো তাকে আর বিরক্তিকর মনে হয় না। ভবিষ্যতের সুপরিণতির দিকে তাকিয়ে বর্তমানের বিচার করা ভুল। বর্তমানের নিজেরই একটা মূল্য আছে। অংশগুলির মূল্য না থাকলে সমগ্রেরও কোনো মূল্য থাকতে পারে না। জীবন আর যাই হোক, ‘মেলোড্রামা’ নয়। মেলোড্রামা হাজার দুঃখ-বিপদের মধ্য দিয়ে গিয়েও পরিণামে একটা সুপরিণতি তথা নায়ক-নায়িকার মিলন চোখে পড়ে। জীবনে তেমনটি হয় না। হলে তা একটা কৃত্রিম ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত। জীবনে কেবল সুপরিণতিরই মূল্য নেই, প্রতিটি মুহূর্তেরও মূল্য রয়েছে। আমার কালটি আমি ভোগ করলুম, আমার ছেলে তার কালটি ভোগ করবে, তারপর তাকে অনুসরণ করবে তার ছেলে–এই তো জীবন, এ-কথা বলে উন্নাসিকতা প্রদর্শনের কী আছে? বরং চিরকাল বেঁচে থাকলেই তো জীবনের স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা কমে আসে। ফলে পরিণামে জীবন বোঝার মতো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

জীবনের আঁচে তপ্ত করেছি দুহাত ভাই।
আগুন নিভিছে, এবার আমিও বিদায় চাই।

 নৈরাশ্যব্যঞ্জক মনোবৃত্তির মতো এ মনোবৃত্তিও যুক্তিসঙ্গত বটে। তাহলে দেখতে পাওয়া যায়, যুক্তি কেবল নৈরাশ্যবাদের পক্ষেই নয়, আশাবাদের পক্ষেও রয়েছে।

ইকলেজিয়েটসের দুঃখের কারণ দেখলুম। এবার কুচের দুঃখের কারণটা কী, ভেবে দেখবার চেষ্টা করছি। ক্রুচের দুঃখের গোড়ায় রয়েছে শাশ্বত আদর্শের অভাব। মধ্যযুগে, এমনকি আধুনিককালের শুরুতেও যে-সকল আদর্শের জন্ম হয়েছিল, তা আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বলেই তিনি দুঃখিত। তার মতে, আধুনিককালের সংকট আর যৌবন-উন্মুক্ত অবস্থায় সংকট প্রায় এক পর্যায়ের। যৌবন-উমুখ অবস্থায় যেমন মানুষ ছেলেবেলাকার পৌরাণিক কাহিনীর সহায়তা ছাড়া কোনো ব্যাপারেই সুরাহা করতে পারে না, আধুনিককালের সঙ্গে পূর্ণ পরিচিতি ঘটেনি বলে একালের মানুষও তেমনি সেকালের ভাবাদর্শকে এড়িয়ে চলতে পারছে না। মৃত-কালের ভাবাদর্শ তাকে ভূতের মতো চেপে ধরেছে, তার হাত থেকে সে আর মুক্তি পাচ্ছে না। তাই অভ্যন্তর-দ্বন্দ্ব তার ললাটলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুচের উক্তি উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কেবলমাত্র সাহিত্য-পড়া চেঁআধুনিকদের বেলা তাঁর উক্তি বাস্তবিকই সত্য। ভাবাবেগের উপর নির্ভরশীল বলে তারা বিজ্ঞানে আস্থা স্থাপন করতে পারে না, উল্টো বিজ্ঞানের খুঁত ধরে বেড়ায়। তাই অন্যান্য সাহিত্যপ্রিয় লোকের মতো কুচও বিজ্ঞানের ওয়াদ-খেলাপের অভিযোগ আনেন কিন্তু বিজ্ঞানের ওয়াদাটা যে কী ছিল, সে সম্বন্ধে কিছুই বলেন না। শুধু এই বলে আফসোস করেন যে, ষাট বছর আগে ডারউইন ও হাক্সলি বিজ্ঞান থেকে যা আশা করেছিলেন, বিজ্ঞান তা দিতে পারেনি। কিন্তু এ ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। ভাবমার্গী লেখক ও পুরোহিত শ্রেণীর লোকেরাই নিজেদের বুজরুগি রক্ষার জন্য এ ধরনের কথা বলে থাকেন। ক্রুচ সাহেবও তার দলে ভিড়েছেন।

বর্তমানে জগতে যে বহু অশুভদর্শী মানুষ রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। তবে তার কারণ বিজ্ঞানের ব্যর্থতা নয়, অন্য কিছু। যুদ্ধের জন্য যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তারই ফলে এই দুঃখবাদের জন্ম। দুঃখবাদ চিন্তার ব্যাপার নয়, ‘মুডের’ ব্যাপার। আর মুড সৃষ্টি করে বাস্তব ঘটনা, দর্শন বা জগৎ সম্বন্ধে ধারণা নয়। সুতরাং একালের দুঃখবাদী মনোভাবের জন্য একালের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে দায়ী না করে জগতের বাস্তব অবস্থাকে দায়ী করাই ভালো। ক্রুচ তো বলেছেন, কতকগুলি স্থির বিশ্বাস থেকে চ্যুত হয়েছে বলেই আধুনিককালে মানুষের এই দুরবস্থা। কিন্তু তার মতে সায় দেওয়া যায় না। ইতিহাস তার বিরুদ্ধে। ত্রয়োদশ শতকে তো স্থিরবিশ্বাসের কমতি ছিল না। অথচ সে যুগের মতো নৈরাশ্যব্যঞ্জক যুগ বিরল। রোজার বেকনের মতে, সে-যুগে কামুকতা ও লোভ কেবল সাধারণের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, যাজকশ্রেণীও এই পাপস্রোতে ভেসে চলেছিলেন। তিনি বলেন, সে-যুগের ধার্মিকদের তুলনায় প্যাগান-যুগের সাধু-পুরুষরা অনেক উন্নত চরিত্রের লোক ছিলেন। সংযম, সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। শুধু রোজার বেকন নন, তাঁর সমসাময়িক অপরাপর সাহিত্য-সেবকও তাদের কালকে ভালোবাসতে পারেননি বলে দুঃখ করে গেছেন। সুতরাং বেকন ত্রয়োদশ শতকের যে-ছবি এঁকেছেন, তাতে সহজেই আস্থা স্থাপন করা যায়।

ক্রুচের গ্রন্থের একটি পরিচ্ছেদে রয়েছে প্রেমের আলোচনা। তাতে প্রেমের অভাবের জন্য করুণ সুরে হায়-আফসোস করা হয়েছে। কুচের মতে ভিক্টোরীয় যুগে প্রেমের যে মূল্য ছিল, এযুগে তা নেই। এ যুগ প্রেমহীনতার যুগ। ভিক্টোরীয় যুগে স্কেপটিকগণ বা সন্দেহবাদীরা প্রেমকে আল্লাহর স্থানে বসিয়ে পূজা করত। একালে তেমনটি আর হচ্ছে না। মানুষের মনে পূজার ভাব রয়েছে! তার প্রকাশ না হলে অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায় না। যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা। সেকালের লোকেরা প্রেমের মারফতে পূজার ক্ষুধা মেটাত। প্রেমের সম্পর্কে এসে কঠিন হৃদয় লোকও মরমীভাবাপন্ন হয়েছে, এমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই। পরমাত্মা যেমন ত্যাগের প্রেরণা দেন, প্রেম থেকেও তেমনি ত্যাগের প্রেরণা পাওয়া যেত। প্রেমের জন্য সব খোয়াতে তারা প্রস্তুত ছিল।

আশ্চর্যের ব্যাপার, আমাদের যুগে তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে ভিক্টোরীয় যুগ যেরূপ প্রেমময় হয়ে দেখা দিয়েছে, সেকালের লোকদের কাছে সেরূপ প্রেমময় হয়ে দেখা দেয়নি। যুগের বিভিন্ন ভাবের প্রতিনিধি হিসাবে দাঁড়াতে পারেন, এমন দুটি বৃদ্ধমহিলাকে আমি জানতুম। তাদের একজন ছিলেন পিউরিটান আরেকজন ভটেরিয়ান। তাদের কথাবার্তার মারফতে আমি সেযুগটিকে ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করব। প্রথম মহিলা বললেন : প্রেমের মতো এমন বাজে জিনিস নিয়ে এত কাব্য লেখা হবে কেন, আমি বুঝতে পারিনে। দ্বিতীয় মহিলাটি উত্তর দিলেন : আমি তো বাইবেলের সপ্তম আদেশ ভাঙায় তেমন কিছু পাপ দেখতে পাইনে। অন্তত ষষ্ঠ আদেশ ভাঙার চেয়ে তাযে কম অন্যায় তাতো একরকম নিঃসন্দেহেই বলা যায়। সপ্তম আদেশ ভাঙার বেলা প্রতিপক্ষের অনুমতির যে প্রয়োজন হয় তাতেই অপরাধটি হাল্কা হয়ে পড়ে। মহিলা দুটির কথার সুরেই বুঝতে পারা যায়, প্রেমের প্রতি তারা কেউই শ্রদ্ধাসম্পন্ন নন। একজনের কাছে প্রেম ঘৃণার ব্যাপার, আরেকজনের কাছে হালকা ফুর্তির। তবে ক্রুচ সাহেব ভিক্টোরীয় যুগের প্রেম সম্বন্ধে এমন উঁচু ধারণায় উপনীত হলেন কী করে? তার ধারণার ভিত্তি কী? খুব সম্ভব, যুগের সঙ্গে মিল নেই এমন কোনো লেখকের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ রবার্ট ব্রাউনিঙের নাম করা যেতে পারে। তার প্রেমদর্শন হচ্ছে :

God be thanked, the meanest of His creatures
Boasts two soul-sides, one to face the world with,
One to show a woman when he loves her.

এর থেকেই বুঝতে পারা যায়, ব্রাউনিঙের মতে জগতের প্রতি একমাত্র যুক্তিসঙ্গত মনোবৃত্তি হচ্ছে দ্বন্দ্বপরায়ণতার। যে মন নিয়ে প্রিয়ার সঙ্গে মেশা যায়, সে মন নিয়ে সাধারণের সঙ্গে মিশতে গেলে ভুল করা হবে।

সাধারণের সঙ্গে সম্বন্ধ দ্বন্দ্বের, মিলনের নয়। এর কারণ কী? ব্রাউনি বলবেন : জগৎ নিষ্ঠুর বলে। আমরা বলব না, জগৎ আপনাকে আপনার নির্ধারিত মূল্যে গ্রহণ করতে চায় না বলে। আপনি চান আপনার অবিমিশ্র প্রশংসা। জগৎ তা দিতে নারাজ। সে আপনাকে বাজিয়ে নিতে চায়। তাই আপনি এমন একটি সঙ্গিনী বেছে নিতে চান যিনি কেবল আপনার প্রশংসাই করবেন, আপনার ত্রুটির দিকে তাকাবেন না। এই সমালোচনাহীন প্রেম কিন্তু খুব প্রশংসনীয় ব্যাপার নয়। অপক্ষপাত সমালোচনার শীতল বাতাস সইতে পারা স্বাস্থ্যের লক্ষণ। যার সে। ক্ষমতা নেই সে দুর্বল, রুগণ। তার কাছ থেকে জগৎ তেমন কিছু আশা করতে পারে না।

আমি নিজে প্রেমে বিশ্বাসী। অবশ্য আমার প্রেম ভিক্টোরীয় যুগের প্রেমের মতো অন্ধ নয়, মুক্তদৃষ্টি। এ কেবল সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ভালোর দিকেই তাকায় না, মন্দ দিকেও তাকায়। ভিক্টোরীয় যুগের লোকের মতো আমি প্রেমকে পূত পবিত্র মনে করে আকাশে তুলে রাখতে চাইনে। এই অতিরিক্ত শ্রদ্ধার মূলে রয়েছে ‘সেক্স-টেবু’ বা যৌন-নিষেধ। যৌন ব্যাপারকে খারাপ ভাবা হত বলেই সেকালের লোকেরা তাদের সমর্ধিত যৌন সম্বন্ধকে পূত পবিত্র প্রভৃতি বিশ্লেষণে বিশেষিত করে উচ্চাসন দিতে চাইত। নইলে সেকালে যৌনক্ষুধা যে একালের চেয়ে কম ছিল তা নয়। অধুনা মানুষ নূতন আদর্শ ভালোরূপে গ্রহণ করতে পারেনি বলে পুরোনো আদর্শের প্রভাব থেকে পুরাপুরি মুক্তি পাচ্ছে না। তাই মনোজগতে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই দ্বন্দ্বের ফলে নৈরাশ্য ও হতাশার জন্ম। আমার মনে হয়, এধরনের লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও গলাবাজিতে তারাই বড়। তাদের প্রচারের ফলে এ-যুগের কালো দিকটাই লোকের কাছে বড় হয়ে উঠেছে, আলোর দিকটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তারা যত মন্দ বলে প্রচার করতে চায়, আসলে কিন্তু যুগটা তত মন্দ নয়। এই যুগের সঙ্গতিসম্পন্ন তরুণরা যে প্রেমের ব্যাপারে অধিকতর সুখী, এ-কথা একরকম জোর দিয়েই বলা যায়। প্রাচীন আদর্শের অত্যাচার এবং যুক্তিধর্মী নীতির অভাবের দরুনই লোকেরা নৈরাশ্যব্যঞ্জক মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়ে থাকে। অতীতের মোহ ভুলে গিয়ে হালের আদর্শকে পুরোপুরি গ্রহণ না করলে এই নৈরাশ্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।

কেন যে প্রেমের মূল্য দেওয়া হয়, তা বলা সহজ নয়। তথাপি একবার চেষ্টা করে দেখছি। প্রথমত দেখতে পাওয়া যায়, প্রেম নিজেই একটা সুখের উৎস। সুখের তাগিদেই লোকেরা প্রেমের হাতে ধরা দেয়। এটাকে প্রেমের শ্রেষ্ঠ দিক হিসাবে ধরা না গেলেও প্রাথমিক ও অনিবার্য দিকরূপে সহজেই ধরে নেওয়া যায়। এটির অভাবে অপরাপর দিকগুলিরও ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা।

তোমার চেয়ে মিষ্টি কিছুই নেই।
এই ভুবনের মাঝে,
ওগো ও প্রেম, তাইতো তোমায় চাই
নিত্য সকাল সাঁঝে।
 নিন্দা তোমার রটায় যারা, জানি,
 পায়নি তোমার মধুর পরশখানি,
 অন্ধকারে কাটায় তারা বেলা
হিংসা-দ্বেষের কাজে।
 তোমার পরশ অন্তরেতে মোর
রাতের শেষে আনে সোনার ভোর
দিকে দিকে তাই যে কেবল শুনি
আনন্দ-গান বাজে।

কবি যখন এই পঙক্তিগুলি লেখেন তখন তিনি আল্লাহর জায়গায় প্রেমকে বসিয়ে নাস্তিক্যের সমাধান করতে চাননি, কিংবা বিষরহস্য উদ্ঘাটন করাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে খুশি করতে, নিজেকে উপভোগ করতে, এইমাত্র। প্রেমের উপস্থিতি যেমন সুখের, অনুপস্থিতিও তেমনি দুঃখের। তাই প্রেমের জন্যে মানুষ এত উতলা হয়ে ওঠে। প্রেমের দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে, তা জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখগুলির স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গীত, পর্বতের ওপরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত, পূর্ণিমা রাত্রে জোছনা-প্লাবিত সমুদ্র বক্ষ–প্রেমের সংস্পর্শ না হলে এসবের পুরো স্বাদ পাওয়া যায় না। প্রেয়সী নারীর সঙ্গ উপভোগ না করলে এসবের ইন্দ্রজাল অর্ধেকটাই অনুদঘাটিত থেকে যায়। তৃতীয়ত, ‘আমি’র চেয়ে ‘তুমিকে বড় করে তুলে’ প্রেম অহমিকার কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পথটি বাৎলে দেয়। একাকিত্বপ্রিয় দার্শনিক-যে সংসারে নেই, তা নয়। যথেষ্টই আছে। সৃটোইক ও প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টানরা তো মনে করতেন জীবনের কল্যাণসাধনের জন্য দরকার কেবল ইচ্ছাশক্তির–সেজন্যে অপরের সহায়তার কোনো দরকার হয় না। সকলের লক্ষ্যই যে কল্যাণ তা নয়। কেউ কেউ চায় শক্তিকে, কারো লক্ষ্য বা ব্যক্তিগত সুখ। কিন্তু সকলের মধ্যেই একটা সাধ দেখতে পাওয়া যায়, আর তা হচ্ছে, অপরের সাহায্য ছাড়া নিজের ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই কাজ ফতে করা যায়, এই বিশ্বাস। এই একাকিত্বপ্রিয় দর্শন-যে কেবল নীতির দিক দিয়ে মন্দ, তা নয়; জীবনের সহজ ও সার্থক বিকাশের পক্ষেও তা অন্তরায়। মানুষের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজনীয়। জোর করে একা থাকতে হলে স্বভাবের বিরুদ্ধে যেতে হয়। মানুষের প্রকৃতিতে যে অসম্পূর্ণতা রয়েছে, তা-ই তাকে বন্ধু ও সহযোগী খুঁজতে বাধ্য করে। প্রেমের স্বাদ যে পেয়েছে সে কখনও একাকিত্ব-দর্শনের সমর্থক হতে পারে না। সন্তান বাৎসল্যের মতো এমন জোরালো অনুভূতি আর কি আছে? এরও গোড়ায় রয়েছে কিন্তু জনক-জননীর পরস্পরের প্রতি প্রেম। প্রেম একটা সাধারণ ব্যাপার-যত্রতত্রই তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, এমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এই বলতে চাই যে, প্রেমের স্বাদ যে পায়নি, জীবন তার কাছে তার শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্য উদঘাটিত করেনি। সে হতভাগা জীবনকে পেয়েও জীবন থেকে বঞ্চিত। প্রেম এমন একটা ব্যাপার, সন্দেহবাদের স্পর্শে যা মলিন হয়ে যায় না। তা চিরসুন্দর চিরপ্রাণপ্রদায়ী।

প্রেম সে তো আগুনের শিখা, অন্তরেতে চির অনির্বাণ,
অবসন্ন নয় কভু তাহা, নহে কভু রুগণ, পরিম্লান।

 এখন ক্রুচ সাহেব ট্র্যাজেডি সম্বন্ধে যা বলেছেন, তার আলোচনা করছি। তার মতে ইবসেনের ‘গোসূটের চেয়ে শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়র অনেক বড়। আমার মতও তাই। কিন্তু তাই বলে সেকালের মানুষের তুলনায় একালের মানুষকে হীন বলা যায় না। এ-যুগে যে কিং লিয়রের মতো বই লেখা যায় না তার কারণ এযুগের মানুষের অবনতি নয়, উন্নতি। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই মানুষ ব্যক্তি বিশেষের রাজসিক বিষাদের গুণকীর্তন করতে অনিচ্ছুক। সেকালে অনেকগুলি মানুষ বাঁচত একটি মানুষের বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে। একালে তা আর হচ্ছে না। কিং লিয়র যে-মনোভঙ্গির সৃষ্টি, হালে সে মনোভঙ্গির কোনো মর্যাদা নেই বলেই ব্যক্তিতান্ত্রিক ট্র্যাজেডি সৃষ্টির চেষ্টা ব্যর্থ। শেক্সপিয়ার বলেছেন :

রাজা যখন মরে আকাশেতে ধূমকেতু ভায়,
ভিখারি যখন মরে কভু কিছু ঘটে না তথায়।

 একটি চাল টিপলে যেমন সমস্ত ভাতের অবস্থা জানতে পারা যায়, তেমনি এই একটি উক্তির দ্বারাই সেকালের সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। শেক্সপিয়ার যুগের ধারণার বশবর্তী না হয়ে পারেননি। তাই দেখতে পাওয়া যায় কবি ‘সিনা’র মৃত্যু কমিক হাস্যকর, আর ‘সিজার’ ‘ব্রুটাস’-এর মৃত্যু ট্র্যাজিক বিষাদাস্ত। যুগের ভাবনার সঙ্গে পুরোপুরি বুক মেলাতে পেরেছিলেন বলেও শেক্সপিয়ার কিং লিয়রের মতো অনবদ্য নাটক রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একালের নাট্যকার যদি তাদের যুগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যেতে পারেন তো তারাও অনুরূপ সার্থক গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম হবেন। একালে বড় হয়ে উঠেছে সমাজ, ব্যক্তি নয়। তাই এ-যুগে ট্র্যাজেডি লিখতে হবে সমাজকে নিয়ে ব্যক্তিকে নিয়ে লিখলে তেমন সার্থকতা পাওয়া যাবে না। তেমনি একটি গ্রন্থ হচ্ছে আরনেস্ট টলারের Massemensch (Massess & Man)। গ্রন্থটির মর্যাদা যে অতীতের শ্রেষ্ঠ নাটকসমূহের সমান, এ কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এই বলতে চাই যে, গাম্ভীর্য, মহত্ত্ব ও বীর্যে ওদের সঙ্গে এটির সাদৃশ্য রয়েছে। এরিস্টাটল-কথিত ‘দুঃখ ও ভীতির তাড়নায় মানবঅন্তরের নির্মলতা সাধনের ক্ষমতা এর আছে। এই ধরনের ট্র্যাজেডি খুব বিরল–’লাখে মিলে না এক। ট্রাজেডি লিখতে হলে ট্র্যাজেডি অনুভব করতে হবে। আর ট্রাজেডি অনুভব করতে হলে যুগের মর্মে প্রবেশ করা দরকার। শুধু বুদ্ধি দিয়ে নয়; রক্ত দিয়ে, শিরা-উপশিরা দিয়ে, স্নায়ু দিয়ে যুগকে জানতে হবে।

ক্রুচ সাহেব যেরূপ সাহসের সঙ্গে নিরানন্দ জগৎকে স্বীকার করে নেন তাতে পাঠকরা তার প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন না হয়ে পারেন না। বীরের মতনই তিনি সমস্ত দুঃখের বোঝা মাথায় তুলে নিতে চান। কিন্তু জগৎকে নিরানন্দ মনে করার সত্যকার কোনো কারণ আছে কি? নতুন অবস্থার সংস্পর্শে এসে পুরাতন মূল্যবান আবেগগুলির জন্ম দিতে পারছেন না বলেই ক্রুচ ও জুচের মতো অতীত প্রেমিক লেখকদের কাছে জগৎ নিরানন্দ। বর্তমানের সঙ্গে বুক মেলালে তারাও বুঝতে পারতেন শেক্সপিয়ার যে মহৎ আবেগের অধিকারী তারাও তা থেকে বঞ্চিত নন। শেক্সপিয়ারের পথটি অনুসরণ করছেন না বলেই তাদের এই দুর্দশা। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ যুগের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। মহৎ আবেগের উপাদান বর্তমানেও আছে। কিন্তু সমাজবোধ বর্জিত বলে সাহিত্যিকগোষ্ঠী তার স্বাদ থেকে বঞ্চিত। নইলে এ-যুগে বাঁচবার মতো কিছু নেই, এমন কথা তাঁরা বলতে পারতেন না। তাদের দুর্ভাগ্যের কারণ তারা নিজেরাই। যৌবনের অতিভোগ ও বাস্তববর্জিত অত্যধিক মননের ফলেই এই দুঃখবাদ। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। আর বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উপায় হচ্ছে কাজে নামা। কাজই আমাদের সুস্থ মানসিকতা দিতে পারে; আর কেউ না, আর কিছু না। যারা কাজ করে, তারাই আনন্দ পায়। জগতের স্বাদ-গন্ধ তাদের জন্য।

তাই, যাঁরা আর আনন্দ পাচ্ছেন না, জগতে বাচবার মতো কিছুই দেখছেন না, তাদের কাছে আমার অনুরোধ : লেখা ছেড়ে দিন, যদি সহজে ছাড়তে না পারেন তো জোর করে ছাড়ার চেষ্টা করুন। চিন্তার খোলস ত্যাগ করে জগতের পথে বেরিয়ে আসুন। নিজেকে এমন একটি অবস্থায় দাঁড় করান যেখানে প্রাথমিক শারীরিক প্রয়োজনগুলির দাবি মেটানোই হবে প্রথম ও প্রধান কাজ। তাহলেই দেখতে পাবেন আপনি পুনরায় জীবনে ফিরে এসেছেন, আর জীবনে ফিরে এসেছেন বলে সুখ পাচ্ছেন। মন নিয়ে অধিক নাড়াচাড়া করতে করতে আপনি মনকে বিগড়ে দিয়েছেন। এবার মনোবিহীন হয়ে বাস্তবের সুস্থ স্পর্শে আপনার সহজ ভোগ কামনাকে জাগিয়ে তুলুন।

লেখার সত্যকার আকুতি আপনার ভেতর থাকলে আপনি অবশ্যই আবার লেখায় ফিরে আসবেন। আর এবার লেখা আপনার কাছে বাজে মনে হবে না বলে আপনি লিখে প্রচুর আনন্দও পাবেন।* [* কোনো ইংরেজ লেখকের অনুসরণে। লেখক]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *