ক্যাভিয়ারের জার

ক্যাভিয়ারের জার

উত্তর চিনে বক্সার বিদ্রোহ তখন শুকনো তৃণভূমিতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ইউরোপীয়রা ছোট-ছোট দলে তাদের বাসস্থানের কাছাকাছি কোনও শক্ত ঘাঁটিতে আশ্রয় নিচ্ছেন। উদ্দেশ্য, সীমিত সামর্থ্য দিয়ে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করে কোনওরকমে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা, যতক্ষণ না উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছোয়। বক্সার বিদ্রোহীদের অমানুষিক নিষ্ঠুরতার কাহিনি এতই প্রচলিত যে, তাদের হাতে জীবন্ত ধরা পড়লে ভয়ংকর পরিণতি অনিবার্য,–একথা সবাই জানে।

কয়েকজন ইউরোপীয়ের একটি ছোট দল উত্তর চিনে ইচাও বলে একটি জায়গায় একটা ঘাঁটিতে চারদিন হল আশ্রয় নিয়েছেন। খাদ্য, অস্ত্রশস্ত্র সবই প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। পঞ্চাশ মাইল দূরে সমুদ্রতট। সেখানে ইউরোপীয় সেনাদের একটা ছোট ঘাঁটি আছে। সেই সৈন্যদল এসে উদ্ধার করবে এই আশায় অবরুদ্ধ ইউরোপীয় কজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত।

অবরুদ্ধদের দলে আছেন কয়েকজন ইউরোপিয়ান, একজন আমেরিকান ও কয়েকজন রেলকর্মী যাঁরা দেশি খ্রিস্টান। এই ছোট দলের নেতা একজন জার্মান কর্নেল ড্রেসলার।

বিদ্রোহীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ঘাঁটির ভাঙা দেওয়ালের গায়ের ছোট-ঘোট ফোকরের মধ্য দিয়ে মাঝে মাঝেই গুলি চালাচ্ছে এই দলটি। এতক্ষণে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে। এঁদের কাছে যে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ আছে। তাতে হামলাকারীদের আর একদিনের বেশি ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সুতরাং একদিনের মধ্যেই উদ্ধারকারীরা এসে পৌঁছবে, এই আশায় বেঁচে থাকা ছাড়া এঁদের আর কোনও উপায় ছিল না। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সকলেই মোটামুটি নিশ্চিত যে উদ্ধারের একটা ব্যবস্থা হবেই।

কিন্তু বুধবার সকাল থেকে তাদের আশায় ও বিশ্বাসে একটু চিড় ধরল। পাহাড় থেকে নীচে সমুদ্র অবধি ঢালু জমিতে কোনও ইউরোপীয় সেনার চিহ্ন নেই। অন্যদিকে বিদ্রোহীরা বিরামহীন চিৎকার করতে করতে ক্রমাগত এগিয়ে আসছে। তাদের মুখভঙ্গি ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর। ফরেন সার্ভিসের এক কর্মচারী এইন্সলি, তার শিকারের বন্দুক থেকে মাঝে মাঝেই বিদ্রোহীদের দিকে গুলি ছুড়ছে। যে-কোনও সময়ে বিদ্রোহীদের কেউ একজন নিঃশব্দে তরোয়াল হাতে ভাঙা দেওয়াল টপকে ঘাঁটিতে ঢুকে পড়তে পারে।

বুধবার সন্ধেবেলায় এই পরিস্থিতিতে দলের সকলেই একটু হতাশ হয়ে পড়লেন।

অবরুদ্ধ এই কটি মানুষের মতো কর্নেল ড্রেসলারের মুখে অবশ্য উদ্বেগের ছাপ নেই, কিন্তু তার মনে পাষাণের বোঝ। রেলওয়ের অফিসার র‍্যালস্টন আত্মীয়স্বজনকে বিদায়ী চিঠি লিখেছেন। কীট-পতঙ্গের বিষয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী বৃদ্ধ প্রফেসর মার্সার নীরব ও চিন্তামগ্ন। যুবক এইন্সলি-ও তার সহজাত চপলতা হারিয়ে ফেলেছে। মহিলারাই কেবল শান্ত ও স্থির। তাদের মধ্যে আছেন স্কটিশ মিশনের নার্স মিস সিনক্লেয়ার, মিসেস প্যাটারসন ও তার মেয়ে জেসি। ফরাসি মিশনের ফাদার পিয়ের-ও শান্ত। আর আছেন স্কটিশ মিশনের মিঃ প্যাটারসন–খ্রিস্টধর্মের নীতিগত ব্যাপারে ফাদার পিয়ের-এর সঙ্গে যার সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। দুজনেই করিডোরে পায়চারি করছেন।

বুধবার রাতটা শেষ পর্যন্ত বিনা সমস্যায় কেটে গেল। বৃহস্পতিবারের সকালটা ছিল উজ্জ্বল ও মনোরম। দূরে একটা বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল। তার পরেই দূর থেকে কে যেন জোরে চেঁচিয়ে বলল–সবাই আনন্দে থাকো, সাহায্য আসতে আর দেরি নেই। মনে হল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সমুদ্রতটের সেই উদ্ধারকারী সেনাদল এসে পৌঁছবে। এদিকে কার্তুজ প্রায় শেষ। আধপেটা খাবারের বরাদ্দ আরও কম হওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু এখন আর উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। মেঘের ফাঁকে জীবনের এক ঝলক বিদ্যুৎ দেখা যাচ্ছে। সকলেই উৎফুল্ল আর প্রগলভ হয়ে উঠেছেন। সবাই জড় হলেন খাবার টেবিলে। এইন্সলি চেঁচিয়ে উঠল,–প্রফেসর, আপনার ক্যাভিয়ারের জারটা কোথায়? ওটা খুলুন, সবাই মিলে সেলিব্রেট করা যাক।

কর্নেল ড্রেসলারও বললেন,–ঠিকই তো! এই আনন্দের সময় ক্যাভিয়ারই উপযুক্ত খাবার।।

মহিলারাও সকলে ক্যাভিয়ার খেতে চাইলেন।

ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রফেসর মার্সারের জন্য কিছু জিনিস এসেছিল। তার মধ্যে ছিল এক জার ক্যাভিয়ার আর তিন বোতল দামি ওয়াইন। সবাই ঠিক করেছিলেন যে বিপদ কেটে গেলে এগুলি সদ্ব্যবহার করা হবে। বাইরের গুলির আওয়াজ এখন সঙ্গীতের মতো মধুর লাগছিল–কেন না গুলি চালাচ্ছিল উদ্ধারকারীরা। সুতরাং বাসি রুটির সঙ্গে সেই মহার্ঘ ক্যাভিয়ার খাওয়ার এই তো উপযুক্ত সময়।

কিন্তু প্রফেসর মাথা নাড়লেন, মুখে রহস্যময় হাসি। বললেন,–ওটা পরে খাওয়া যাবে। উদ্ধারকারী দলের এখানে পৌঁছতে আরও অনেক সময় লাগবে।

তখন রেলওয়ে কর্মচারী, ছোটখাটো চেহারা র‍্যালস্টন বললেন,–ওরা এখন মাত্র দশ মাইল দূরে আছে। ডিনারের আগেই এখানে এসে পড়বে।

এইসব আলোচনার মধ্যে এইন্সলি বলে উঠল, বিদ্রোহীদের তো আগ্নেয়াস্ত্র বলতে কিছু নেই। আমাদের সৈন্যরা ওদের উড়িয়ে দিয়ে এক্ষুনি চলে আসবে। সুতরাং, প্রফেসর, ক্যাভিয়ারটা বের করুন না!

কিন্তু প্রফেসর তার সিদ্ধান্তে অনড়। বললেন, না। অন্তত ডিনার পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক।

মিঃ প্যাটারসনও বললেন, উদ্ধারকারীদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে তাদের ভালোভাবে আপ্যায়ন করা উচিত। ডিনারের সময় তাদের সঙ্গে সবাই মিলে ক্যাভিয়ারটা খাওয়া যাবে।

এই সিদ্ধান্ত সবাইয়েরই মনঃপূত হল। কেউ আর তারপর ক্যাভিয়ারের কথা তুললেন না।

প্যাটারসন বললেন,–আচ্ছা প্রফেসার, আপনি তো আগেও এইরকমভাবে একবার আটকে পড়েছিলেন। বলুন না সেই অভিজ্ঞতার কথা!

গম্ভীরভাবে প্রফেসর বললেন,–সেটা আঠারোশো উননব্বই সালের কথা। তখন আমি দক্ষিণ চিনের সুং-টোং এ ছিলাম।

ফাদার পিয়ের জিগ্যেস করলেন, কীভাবে আপনারা মুক্ত হয়েছিলেন?

প্রফেসরের ক্লান্ত মুখের ওপর যেন কালো ছায়া পড়ল, আমরা মুক্তি পাইনি।

–তার মানে বিদ্রোহীরা জায়গাটা দখল করে নেয়?

–হ্যাঁ।

–আর আপনি বেঁচে রইলেন?

–কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করা ছাড়াও পেশায় আমি ডাক্তার। অনেকেই আহত হয়েছিল তাদের চিকিৎসা করার জন্য ওরা আমায় প্রাণে মারেনি।

–আর সকলের কী হল? প্রফেসর উত্তর দিলেন না, কিন্তু তার নিষ্প্রভ চোখের ওপর বিভীষিকার ছায়া দেখে মহিলারাও অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলেন।

ফাদার পিয়ের বললেন,-থাক! থাক! কিছু বলতে হবে না। আমাদের ওই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার ব্যাপারে জানতে চাওয়া ঠিক হয়নি।

প্রফেসর ধীরে-ধীরে বললেন,–এসব কথা না জানাই ভালো।…ওই শুনুন, খুব কাছেই মনে হয় বন্দুক চালানো হচ্ছে।

সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে চলে গেলেন ব্যাপারটা কী হচ্ছে দেখতে। ভৃত্যেরা এসে খাওয়ার টেবিল পরিষ্কার করে দিল। কিন্তু বৃদ্ধ প্রফেসর টেবিলের কাছেই বসে রইলেন–সাদা চুলে ঢাকা মাথাটা দু-হাতে ধরে। অতীতের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞাতর স্মৃতি তাকে বোধহয় গ্রাস করেছে। বাইরে বন্দুকের আওয়াজ থেমে গেলেও তিনি তা বুঝতে পারলেন না।

সেই সময় মুখে নিশ্চিন্ত হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন কর্নেল ড্রেসলার। দু-হাত ঘষতে-ঘষতে বললেন, জার্মানির কাইজার নিশ্চয়ই খুশি হবেন। অবশ্যই আমি একটা বীরচক্র পাব। বার্লিনের কাগজে লেখা হবে-কর্নেল ড্রেসলারের নেতৃত্বে অল্প কয়েকজনের একটা ছোট্ট দল কীভাবে এই ভয়ঙ্কর বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করেছে।

প্রফেসর নিরাসক্তভাবে বললেন, আমার দীর্ঘ জীবনে আমি ভাগ্যের এত অদ্ভুত খেলা দেখেছি যে, প্রকৃত পরিস্থিতি না জেনে আমি খুশিও হই না, দুঃখিতও হই না। কিন্তু আপনি বলুন ব্যাপারটা কী।

পাইপ ধরিয়ে বেতের চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে কর্নেল বললেন,–উদ্ধারকারীরা এসে পড়ল বলে। গুলির আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। তার মানে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ শেষ। এইন্সলিকে বলে রেখেছি, উদ্ধারকারীদের দেখতে পেলেই ও তিনবার গুলি ছুড়বে; তখন আমরা বেরিয়ে আসব।

একটু পরে কর্নেল বললেন,–আচ্ছা প্রফেসর এখন তো এখানে মহিলারা বা অন্য কেউ নেই। সুং-টাং-এর ঘটনাটা বলুন না আমাকে।

–সে অভিজ্ঞতা বিভীষিকায় ভরা।

–না, আমি অন্য কারণে জানতে চাইছি। এই যে এখানে আমরা শত্রুদের কোনওরকমে আটকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছি, সুং-টোং-এ কি এরকম কিছু করা যেত না?

–সবকিছুই করা হয়েছিল। খালি ভুল হয়েছিল একটা ব্যাপারে। বিদ্রোহীদের হাতে মহিলাদের পড়ে যাওয়া। আগে বুঝতে পারলে ওদের হাতে ধরা পড়ার আগে আমি নিজেই মহিলাদের হত্যা করতাম। জানেন, ওই ঘটনার পরে আমি আজ পর্যন্ত কোনও রাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি। আমাকে ওরা একটা পোল-এ বেঁধে রেখে আমার চোখের আশেপাশে এমনভাবে কাটা বিঁধিয়ে দিয়েছিল যে আমি যেন চোখ বন্ধ না করতে পারি। মহিলাদের ওপর সেই অমানুষিক অত্যাচার নিরুপায়ভাবে দেখতে-দেখতে আমি ভাবছিলাম যে মাত্র কয়েকটা ট্যাবলেটের সাহায্যে সম্পূর্ণ বেদনাহীন মৃত্যু উপহার দিয়ে ওই মহিলাদের সেই অত্যাচার থেকে বাঁচাতে পারিনি কেন। এই পাপের জন্য ভগবানের কাছে জবাবদিহি করতে আমি প্রস্তুত। এইরকম ঘটনা আবার হলে যদি মহিলাদের হত্যা না করে বিদ্রোহীদের হাতে ছেড়ে দিই, তা হলে নরকেও আমার স্থান হবে না।

কর্নেল প্রফেসারের হাত চেপে ধরে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এখানেও যদি আমরা শত্রুদের কবলে পড়তাম, তা হলে আপনারই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই ব্যবস্থা করতে হত।…কিন্তু এইন্সলির বন্দুকের আওয়াজ এখনও শুনতে পাচ্ছি না কেন? দেখে আসি কী ব্যাপার।

এরপর অনেকক্ষণ কেটে গেল। প্রফেসর চুপচাপ বসে আছেন। না কোনও বন্দুকের আওয়াজ, না উদ্ধারকারীদের আগমনবার্তা। বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই উঠে বাইরে দেখতে যাবেন, এমনসময় ঘরে ঢুকলেন কর্নেল ড্রেসলার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। কয়েক ঢোক ব্র্যান্ডি খেয়ে কর্নেল বললেন,–সর্বনাশ হয়েছে। বিদ্রোহীরা উদ্ধারকারীদের আটকে দিয়েছে। উদ্ধারকারীদের গোলাবারুদও প্রায় শেষ। আগামী তিনদিনের মধ্যে ওদের এখানে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। ব্রিটিশ কমোডোর ওয়াইন্ডহ্যাম একজন স্থানীয় সেপাইকে দিয়ে এই খবর পাঠিয়েছেন। গুরুতর আহত ওই সেপাই আমায় সবকিছু বলল। আপাতত আমি আর আপনি ছাড়া এই ব্যাপারটি কেউ জানে না।

–সেই সেপাইটা কোথায়?

–অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য সে এইমাত্র মারা গেল। লাশটা গেটের কাছেই পড়ে আছে।

–কেউ ওকে দেখেছে কি?

–এইন্সলি হয়তো দেখে থাকবে। সেক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই আমাদের দলের সবাই জেনে যাবে। আমাদের হাতে দু-এক ঘণ্টার বেশি সময় নেই। বিদ্রোহীরা তার মধ্যেই এসে এই ঘাঁটি দখল করে নেবে আর আমরা বন্দি হব।

–আমাদের কি কোনও আশাই নেই?

–বিন্দুমাত্র না।

হঠাৎ তখন ঘরের মধ্যে দলের পুরুষেরা সকলে ঢুকে পড়লেন। সবায়ের এক প্রশ্ন, কর্নেল, আপনার কাছে কি কিছু খবর আছে?

কর্নেল জবাব দেওয়ার আগেই প্রফেসর বললেন, সবকিছু ঠিক আছে। উদ্ধারকারীরা আপাতত একটু আটকে পড়েছে কাল ভোরেই পৌঁছে যাবে। বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই।

খুশিতে ঝলমল করে উঠল সকলের মুখ। কর্নেল তবুও প্রত্যেককে সাবধান থাকতে ও নিজের নিজের পাহারার জায়গায় ফিরে যেতে বললেন। সবাই চলে গেলে কর্নেল প্রফেসারের দিকে তাকালেন। দৃষ্টির অর্থ পরিষ্কার : এখন সবকিছুই আপনার হাতে। প্রফেসরের মুখে সামান্য হাসি– কিছুটা বিষাদের, কিছুটা কাঠিন্যের।

পুরো দুপুরটা কাটল নিস্তব্ধতায়। কর্নেল বুঝতে পারলেন যে, বিদ্রোহীরা চুপচাপ তৈরি হয়ে এখন অন্তিম আক্রমণের অপেক্ষায়। কিন্তু দলের আর সকলে ভাবল যে, বিদ্রোহীরা এতক্ষণে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত হয়েছে।

সান্ধ্য আহারের জন্যে দলের সবাই টেবিলে এলেন। সবাই খুশিতে ডগমগ। প্রথমেই দামি ওয়াইনের তিনটে বোতল খোলা হল। তারপরে সেই বিখ্যাত, মহার্ঘ ক্যাভিয়ারের জারটা। জারটা বেশ বড়–সবাই বড় এক চামচ করে ক্যাভিয়ার নেওয়ার পরেও অনেকটা ক্যাভিয়ার রইল। র‍্যালস্টন আর এইন্সলি আরও এক চামচ করে নিলেন। প্রফেসর ও কর্নেল পরস্পরের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে এক চামচ করে ক্যাভিয়ার নিলেন। মহিলারাও আনন্দ করে খেতে লাগলেন। নিল না খালি মিস প্যাটারসন–ক্যাভিয়ারের নোনতা ঋজালো স্বাদ তার ভালো লাগে না।

প্রফেসরের অনেক অনুরোধেও মিস প্যাটারসন যখন ক্যাভিয়ার খেল না, তখন হঠাৎ খানিকটা উত্তেজিত হয়ে প্রফেসর বললেন,–আজ রাতে ক্যাভিয়ার না খাওয়াটা স্রেফ বোকামি।

পরিস্থিতি সামলালেন মা মিসেস প্যাটারসন। উনি মেয়ের প্লেটের ক্যাভিয়ারটুকু ছুরি দিয়ে চেঁছে নিজের প্লেটে তুলে নিলেন। বললেন,–প্রফেসর, এবার তো আপনি খুশি?

প্রফেসর কিন্তু মোটেই খুশি হলেন না। হঠাৎ কোনও বাধার সম্মুখীন হলে মানুষের মনে যে বিরক্তি মেশানো হতাশার অনুভূতি হয়, তাঁর মুখের ভাব অনেকটা সেইরকম।

সবাই জমিয়ে গল্প করতে লাগলেন। এখান থেকে মুক্তির পরে কে কী করবেন–সেই নিয়ে আলোচনা চলতে লাগল। ফাদার পিয়ের চিনের অন্য শহরে যাবেন আর একটা মিশন গড়তে। মিঃ প্যাটারসন মাস তিনেকের জন্য ফিরবেন স্কটল্যান্ডে-মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে।

নার্স মিস সিনক্লেয়ার বললেন,–এই ধকলের পর সকলেরই একটু বিশ্রাম দরকার। দেখুন না, আমার শরীরটা কীরকম করছে কানের মধ্যে যেন অসংখ্য ঝিঁঝি পোকা ডাকছে।

এইন্সলি বলল, আরে! আমারও তো তাই হচ্ছে। যেন বড় একটা নীল মাছি কানের মধ্যে ঢুকে দাপাদাপি করছে। যাই হোক, এখান থেকে আমি পিকিং-এ চলে যাব ভাবছি। র‍্যালস্টন, তোমার কী প্ল্যান?

–আমি তো মৃত্যু নিশ্চিত জেনে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের চিঠি লিখে ফেলেছিলাম। শুধু চিঠিগুলো ডাকে দেওয়া হয়নি। ওগুলোকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নিজের কাছে রাখব-মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে আসার স্মৃতি। আর ভাবছি। কোনও রৌদ্রোজুল জায়গায় গিয়ে কিছুদিন ছুটি কাটাব।

এইন্সলি বলল, কী হল কর্নেল? আপনাকে কেমন যেন স্রিয়মাণ লাগছে!

–না, না, আমি ঠিক আছি।

–আসুন, আমরা সকলে কর্নেলের স্বাস্থ্য কামনা করি। ওঁর জন্যেই আমরা আজ এই পরীক্ষায় সফল হয়েছি।

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াইনের গ্লাস উঁচু করে কর্নেলকে ধন্যবাদ জানালেন।

কর্নেল বললেন, আমি যথাসাধ্য করেছি। আজকে যদি আমরা নিজেদের বাঁচাতে ব্যর্থ হতাম, তা হলেও আপনারা আমাকে দোষ দিতে পারতেন না।

মিঃ প্যাটারসন বললেন,-কর্নেল, আমাদের সকলের পক্ষ থেকেও কী! র‍্যালস্টনের কী হল?

হাতদুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন ব্যালস্টন।

প্রফেসর তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন,–চিন্তার কিছু নেই। আমাদের সবাইয়ের যে অবস্থা, তাতে ক্লান্তির জন্যে ওরকম নেতিয়ে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষত আজ রাতে।

মিসেস প্যাটারসন বললেন,–আমারও ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। মাথা তুলে রাখতে পারছি না। বলতে-বলতেই চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝলেন তিনি।

মিঃ প্যাটারসন বললেন,–এইরকম ওর কখনও হয়নি– আশ্চর্য! খাওয়ার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘরের ভেতরটা কেমন যেন বদ্ধ লাগছে। আর খুব গরম লাগছে। আমিও আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব।

এইন্সলি কিন্তু ফুর্তিতে বকবক করেই যাচ্ছিল। হাতে ওয়াইনের গ্লাসটা নিয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে বলল,–আসুন, সবাই মিলে আর একটু ওয়াইন খেয়ে গানটান করি। এক সপ্তাহ ধরে আমরা বিভিন্ন দেশের লোক হয়েও বন্ধুর মতো থেকেছি, পরস্পরকে জানার সুযোগ পেয়েছি। কর্নেল জার্মানির প্রতিনিধি। ফাদার পিয়ের ফ্রান্সের। প্রফেসর আমেরিকার লোক। আমি আর র‍্যালস্টন ব্রিটেনের। আর এই মহিলারা এই বিপদের দিনে এঁরা ছিলেন করুণা ও সহনশীলতার প্রতিমূর্তি। আসুন, মহিলাদের স্বাস্থ্য কামনা করে ওয়াইনে চুমুক দিই। আরে! এ কী! কর্নেলকে দেখুন! উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।

কথা বলতে-বলতেই এইন্সলির হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে। গেল আর ও বিড়বিড় করে কী বলতে-বলতে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ল। নার্স মিস সিনক্লেয়ারও মূছাহত ফুলের মতো চেয়ারের হাতলের দিকে ঝুঁকে বসে–কোনও সাড় নেই।

মিঃ প্যাটারসন হঠাৎ উঠে পড়ে চারদিকে তাকিয়ে মেয়েকে বললেন,–জেসি, ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক না। সকলেই কেন একে-একে ঘুমিয়ে পড়ছে? ওই দ্যাখো, ফাদার পিয়েরও নিদ্রামগ্ন। জেসি, তোমার মায়ের গা এত ঠান্ডা কেন? ও কি ঘুমোচ্ছে? না কি মারা গেছে? কে কোথায় আছ-জানলাগুলোও খুলে দাও!

জানলার দিকে টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে মাঝপথে হাঁটু মুড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন মিঃ প্যাটারসন।

আতঙ্কে বিহ্বল মিস প্যাটারসন চারদিকে ছড়ানো নিষ্পন্দ দেহগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,–প্রফেসর মার্সার! কী হয়েছে বলুন তো? এরা কি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? না-না, মনে হচ্ছে সকলেই মারা গেছে।

বৃদ্ধ প্রফেসরের চোখেও তখন মৃত্যুর অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে উঠে জড়িয়ে-জড়িয়ে বললেন,–জেসি, তোমাকে এসব কিছুই দেখতে হত না। শরীর বা মনে কোনও বেদনা বা যন্ত্রণা হত না। সায়ানাইড! ক্যাভিয়ারে মিশিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি কিছুতেই খেলে না।

আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে পিছোতে-পিছোতে জেসি বলল, শয়তান! রাক্ষস! তুমি ওদের সবাইকে বিষ খাইয়েছ!

–না, না, আমি ওদের বাঁচিয়েছি। তুমি তো বিদ্রোহীদের জানো না–তারা কী ভয়ানক! আর এক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ওদের হাতে ধরা পড়তাম। এসো, এখন খেয়ে নাও একটু ক্যাভিয়ার।

ঘরের জানলার বাইরেই এমন সময় গুলির আওয়াজ শোনা গেল।

–ওই শোনো! ওরা এসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি করো। এখনও ওদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারো।

কিন্তু প্রফেসরের পুরো কথা শোনার আগেই জেসি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। বৃদ্ধ প্রফেসর কান পেতে বাইরের আওয়াজ শুনতে লাগলেন। কিন্তু, হে ভগবান, এ কীসের আওয়াজ শুনছি? আমি কি পাগল হয়ে গেলাম? না কি এ বিষক্রিয়ার ফল? এ তো ইউরোপিয়ানদের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে! ইংরেজিতে কেউ নির্দেশ দিচ্ছে। না, সন্দেহের আর কোনও অবকাশ নেই। কোনও অবিশ্বাস্য উপায়ে আশাতীতভাবে উদ্ধারকারীরা এসে পড়েছে। হতাশায় দু-হাত ওপরে তুলে প্রফেসর মার্সার আর্তনাদ করে উঠলেন,–হায় ঈশ্বর! এ আমি কী করলাম!

.

কমোডোর ওয়াইল্ডহ্যাম-ই প্রথম ঢুকলেন সেই মৃত্যুপুরীতে। খাওয়ার টেবিলের চারদিকে নিস্পন্দ সাদা চামড়ার কিছু মানুষ। কেবলমাত্র একটি মেয়ে সামান্য গোঙানির মতো আওয়াজ করছে আর একটু যেন নড়াচড়া করছে। ঘরের মধ্যে এমন একজনও নেই যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শেষ কাজটি করতে পারে। তখনই বাকরুদ্ধ কমোডোর দেখলেন যে পাকা চুলে ঢাকা মাথা টেবিল থেকে তুলে এক মুহূর্তের জন্য টলতে-টলতে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর মার্সার। তার গলা থেকে কোনওরকমে একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোল–সাবধান! ভগবানের দোহাই! ওই ক্যাভিয়ার ছোঁবেন না!

তার পরেই ঢলে পড়লেন প্রফেসর। সম্পূর্ণ হল মরণ বৃত্ত।

The Pot of Caviare গল্পের অনুবাদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *