৯. স্রোতের টান

স্রোতের টান থেকে বাঁচার জন্য একটা ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড় আঁকড়ে ধরল রামোন। ধারালো শামুকের খোসায় কেটে গেল হাত। কিন্তু একটুও ব্যথা টের পেল না রামোন মাচাদো। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে নদীর দিকে।

জ্বলন্ত কম্পাউন্ডের ছায়া পড়েছে পানিতে; সোনার মত চকচক করছে নিকষ কালো নদী।

 মাত্র পঞ্চাশ ফুট দূর দিয়ে চলে গেল শনে’র নৌকা বহর। চিবুক পর্যন্ত কাঁদায় ডুবিয়ে গাছ আঁকড়ে বসে রইল রামোন। রাতের বীরবতার মাঝে নরম গুণগুণ এক ধরনের আওয়াজ করছে মোটর। অন্ধকারে কারো চেহারাই আলাদাভাবে বোঝা না গেলেও কল্পনার চোখে ধূসর রঙা টি-শার্ট পরা ছোট্ট একটা দেহ দেখতে পেল সামনের নৌকায়।

আর তখনই অনুভব করল যে ও নিজেও আসলে একজন বাবা। জীবনে প্রথমবারের মতো স্বীকার করতে বাধ্য হলো এই ভালোবাসার অস্তিত্ব। নিজের ছেলেকে হারিয়ে গুঙ্গিয়ে উঠল রামোন।

ভেতরে দানা বেঁধে উঠা ক্রোধের কাছে হেরে গেল বাকি সব অনুভূতি। এর জন্য দায়ী সকলের উপর প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল। সামনের শূন্য আঁধারের দিকে তাকিয়ে সর্বাঙ্গে যেন আগুন ধরে উঠল। ইচ্ছে করে চিৎকার করে অভিশাপ দেয়, মেয়েটাকে চুলের মুঠি ধরে নামিয়ে আনে, কিন্তু কিছুই করল না। এভাবে কখনো করে’ও না। এখন তাকে হতে হবে লোহার মতই শীতল আর তীক্ষ্ণ। প্রতিশোধ নেবার জন্য পরিষ্কারভাবে ভাবতে হবে সবকিছু।

প্রথমেই মনে হলো যে লাল গোলাপের উপর আধিপত্য হারিয়ে গেল। তার মানে রামোনের কাছে মেয়েটার এখন আর কোনো মূল্য নেই। এখন ও’কে তাই উৎসর্গ করার সময় এসেছে। রামোন ভালো করেই জানে কিভাবে তাকে আর তার চারপাশকে ধ্বংস করতে হবে।

 ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ ছেড়ে দিয়ে পানিতে ভেসে পড়ল রামোন। নদীর মোড়ে এসে ব্রেস্ট-স্ট্রোক দিয়ে ফিরে এলো তীরে।

 পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কমুনিকেশনস সেন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে রামোনের জন্য অপেক্ষা করছে রালেই তাবাকা। দ্রুত হাতে ট্রাউজার আর জ্যাকেট শরীরে জড়িয়ে নিল রামোন। ভেজা চুলে এখনো লেগে আছে নদীর কাদা।

অঙ্গার হয়ে যাওয়া দালানের ধোঁয়ার মাঝেই দেখা গেল প্রভাতের প্রথম সূর্য রশ্মি। রালেই তাবাকা’র লোকেরা মৃতদেহগুলো জড়ো করে তাল গাছের নিচে এক সারিতে রেখে দিয়েছে। যেভাবে মৃত্যু হয়েছে সে ভঙ্গিতেই পড়ে আছে মৃতেরা। প্যারাট্রুপার জোসে, মুখের উপর এক হাত এমনভাবে ফেলে, রেখেছে যেন চোখ দুটোকে বাঁচাতে চাইছে। গ্রেনেডের শার্পনেল টুকে মোরব্বা হয়ে গেছে ওর বুক। আদ্রা হাত দুটোকে এমনভাবে ছড়িয়ে রেখেছে। যেন ওকে ক্রুশে দেয়া হয়েছে। মেয়েটার মাথার এক পাশ নেই হয়ে গেছে। আবেগহীন চোখে তাকিয়ে দেখল রামোন; যেন পুরোন কোনো কাপড়ের ছেঁড়া অংশ যার এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই।

“কতজন?” রালেই তাবাকা’কে প্রশ্ন করল রামোন।

“ছাব্বিশ জন। উত্তরে জানালেন রালেই। “সবাই মারা গেছে। কেউ বেঁচে নেই। যেই এসে থাকুক না কেন, পরিষ্কার একটা কাজ করে গেছে। জানেন ওরা কারা?”

“হ্যা” মাথা নাড়ল রামোন। “ভালো করেই জানি।” রালেই তাবাকা আর কিছু বলার আগেই জানাল : “এখন থেকে সিনডেক্স প্রজেক্টের সব দায়িত্ব আমার।”

“কমরেড জেনারেল”-গ্রুকুটি করে উঠলেন রালেই, “প্রথম থেকেই তো এটা আমার অপারেশন। দুই ভাইকে এতদিন আমিই সামলে এসেছি।”

“হ্যা” অধৈর্য হয়ে মাথা নাড়ল রামোন, “ভাল কাজ দেখিয়েছেন। এর সমস্ত কৃতিত্বই আপনার। কিন্তু এখন থেকে এ দায়িত্ব থেকে আপনাকে অব্যাহতি দেয়া হলো। এয়ারক্রাফট পাওয়া গেলেই আমি দক্ষিণে উড়াল দিব আর আপনিও আমার সাথে যাবেন।”

***

“এখানেই এর শেষ নয় বেলা” চিন্তিত ভঙ্গিতে জানালেন শাসা, “এমন ভাব করে লাভ নেই যে আর কিছু কখনো ঘটেনি। যাই হোক, এখন যেহেতু নিকোলাস ওয়েল্টেভ্রেদেনের নিরাপত্তায় চলে এসেছে তখন এ ব্যাপারে আরো কথা বলা প্রয়োজন। তোমার আর নিকোলাসের জন্য পারিবারের সকলেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছে শ’নের রেজিমেন্টের একজন ট্রুপার অপরিচিত টগবগে সেই তরুণ তোমাকে বাঁচাবেই প্রাণ দিয়েছে। এখন তাই আমাদেরকে সত্যি কথাটা খুলে বলো।”

আরো একবার গান রুমে এসে জড়ো হলো পুরো কোর্টনি পরিবার।

ফায়ারপ্লেসের একপাশে চেয়ারে বসে আছেন দাদি। একেবারে সিধে হয়ে বসে আছেন বৃদ্ধা। পাতলা দেহত্বক ভেদ করে দেখা যাচ্ছে হাতের নীল শিরা। একদা ঘন চুলের গোছা এখন রুপালি রঙ ধারণ করেছে; কিন্তু অভিব্যক্তি এতটুকু নরম হয়নি।

“আমরা সবকিছু শুনতে চাই ইসাবেলা। বিস্তারিতভাবে সবকিছু না বলা পর্যন্ত তুমি এ রুম থেকে বাইরে যেতে পারবে না।”

“নানা, আমি অনেক লজ্জিত; কিন্তু কিছু করার ছিল না।”

“আমি তো কোন অজু হাত কিংবা অনুশোচনা শুনতে চাইনি, মিসি। আমি শুধু সত্যটা জানতে চাই।”

“বুঝতে চেষ্টা করো বেলা, আমরা জানি যে তুমি দেশের স্বার্থ, পরিবার কিংবা নিজের ব্যাপারেও কোনো কিছুই চিন্তা করো নি। কিন্তু এবারে এই ক্ষতির ভরপাই করা আমাদের দায়িত্ব।” মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত নিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শাসা। এবারে খানিকটা নরম করলেন গলার স্বর, “আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই বেলা; কিন্তু সেটা করতে হলে সত্যটা অবশ্যই জানতে হবে।”

ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকাল বেলা, “আমি, তুমি আর নানা একাকী কথা বলতে পারি না?” ভাইদের দিকে তাকাল, বেলা। জানালার নিচে আর্মচেয়ারে বসে আছে গ্যারি। আগুন না ধরিয়েই মুখের একপাশ থেকে আরেক পাশে নাড়াচাড়া করছে সিগার। জানালার নিচে বসে গ্যারি’র সামনে পা ছড়িয়ে দিয়েছে শন্। বুকের উপর আড়াআড়ি করে রেখেছে রোদে পোড়া পেশি বহুল দুই হাত।

“না”, দৃঢ় স্বরে জানালেন সেনটেইন। “তোমার আর নিকি’র জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখেছে ওরা। যদি তুমি নিজের আর পরিবারের জন্য আরো কোনো ক্ষতির ব্যবস্থা করে রাখো তাহলেও ওরাই এগিয়ে যাবে তোমাকে বাঁচাতে। তাই এত সহজে তোমাকে ছাড়া যাবে না। ওদেরও সবকিছু শোনার অধিকার আছে। কিছুই বাদ দেবে না-বুঝেছ?”

 আস্তে আস্তে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নিল বেলা, “ওরা আমার কোড নেইম দিয়েছিল লাল গোপাল। “

“ঠিক করে কথা বলো, আমতা আমতা করবে না” বেলা’র পায়ের কাছে নিজের লাঠি ঠুকলেন সেনটেইন, সন্ত্রস্ত্র ইসাবেলা চোখ তুলে তাকিয়েই গড়গড় করে বলে দিল, “ওরা আমাকে যা যা বলেছে আমি করেছি” তাকিয়ে আছে দাদিমার মুখের দিকে, “নিকি তখনো একেবারে ছোট, মাত্র এক মাস বয়স; ওরা একটা ফিল্ম বানিয়ে আমাকে দেখিয়েছে। আরেকটু হলে আমার বেবি ডুবিয়েই মেরে ফেলেছিল। পা ধরে ওকে চুবিয়ে…থেমে গেল বেলা। তারপর গভীরভাবে দম নিয়ে আবার শুরু করল, “আমাকে সতর্ক করে দিয়েছে যে পরের ফিল্মে নিকির একেকটা অংশ কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে-ওর আঙুল, পা, হাত আর তারপর…” বহুকষ্টে উচ্চারণ করল বেলা, তারপর ওর মাথা।”

বিমূঢ় হয়ে শুনছে সবাই। অতঃপর নীরবতা ভাঙ্গলেন সেনটেইন, “বলে যাও।”

“আমাকে ড্যাডির সাথে কাজ করার কথা বলেছে। যেন আর্মসকোরের কাজে পুরোপুরি যোগ দেই।” শাসা চোখ কুঁচকে তাকাতেই নিজের আঙুল মোচড়াতে লাগল বেলা, “অ্যায়াম সরি, ড্যাডি। আমাকে আরো বলেছে পারিবারিক কানেকশন কাজে লাগিয়ে যেন রাজনীতিতে ঢুকে পড়ি, সংসদের আসনের জন্য লড়াই করি।”

“হঠাৎ করেই রাজনীতিতে তোমার আগ্রহ দেখে আমার আসলে সন্দেহ করা উচিত ছিল।” উত্তপ্ত কণ্ঠে মন্তব্য করলেন সেনটেইন।

“আই অ্যাম সরি, নানা।”

“বারে বারে সরি বলো না তো।” খেঁকিয়ে উঠলেন শাসা, “এতে এখন আর কিছু যাবে আসবে না। বরঞ্চ শুনতেই বিরক্ত লাগছে। শুধু যা বলার বলে যাও।”

“কিছুদিনের জন্য আমার কাজ থেকে ওরা আর কিছুই চায়নি। প্রায় দুই বছর। এরপরই একের পর এক আদেশ আসতে লাগল। প্রথমটা ছিল সিমেন্স রাডার চেইন।”

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন শাসা। হাত বাড়িয়ে ব্লেজারের বুক পকেট থেকে রুমাল তুলে নিলেন।

 “এরপর আরো বেশি বেশি অর্ডার দিতে লাগল।”

“দ্যা স্কাইলাইট প্রজেক্ট?” জানতে চাইলেন শাসা। বেলা মাথা নাড়তেই মায়ের দিকে তাকালেন শাসা।

 “তুমি ঠিকই ধরেছিলে, মা?” আবারো মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি এক কাজ করো, সবকিছু লিখে ফেলো। যা যা ওদেরকে দিয়েছ, সব। আমি একটা লিস্ট চাই-তারিখ, কাগজপত্র, মিটিং সবকিছু। আমাদের কী কী গেল তার সবকিছু জানা প্রয়োজন।”

“ড্যাডি… ইসাবেলা বলা শুরু করলেও কেন যেন খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না।

“চুপ করে আছে কেন? বলো” সাপের মতো ফণা তুললেন সেনটেইন।

 “সিনডেক্স-২৫” উচ্চারণ করল বেলা।

 “ওহ্ গড!” মনে হল যেন দম বন্ধ হয়ে মারা যাবেন শাসা।

“এই কারণেই নিকি’র কাছে যেতে পেরেছি এবার-সিনডেক্সের বিস্তারিত বিবরণ আর বেন।”

“বেন?” নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসল গ্যারি। “বেন কে?”

“বেন গামা” কর্কশ স্বরে জানালেন সেনটেইন, “তারা’র লিটল ব্ল্যাক বাস্টার্ড, মোজেস গামা’র ছেলে। যে লোকটা আমার ব্লেইনকে মেরে ফেলেছে, এই পরিবারকে কলঙ্কিত করেছে।” ইসাবেলার দিকে তাকালেন সেনটেইন।

“হ্যাঁ, নানা। আমার সৎ ভাই বেন।” ভাইদের দিকে তাকাল বেলা, “তোমাদেরও সৎ ভাই। শুধু পার্থক্য হলো এখন আর নিজেকে বেন গামা বলে না; ওর নাম এখন বেনজামিন আফ্রিকা।”

“এই নাম জেনে আমি কী করব?” জিজ্ঞেস করল গ্যারি। “কারণ ও তোমার জন্যই কাজ করে।” জানাল বেলা। “ওরা আমাকে দিয়ে বেনের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেছে। লন্ডনে থাকার সময়েই ওকে আমি ক্যাপরিকর্ণে নিয়োগ দিয়েছি। পয়জনস ডিভিশনে ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ানের কাজ করছে।”

 “সিনডেক্স প্ল্যান্টে?” বিশ্বাস করতে পারছেন না শাসা। “তুমিই তাকে এখানে ঢুকিয়েছো?

 “হ্যাঁ, বাবা।” আবারো ক্ষমা চাইতে গিয়ে দাদিমার মুখের দিকে তাকাল বেলা।

লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েই জেস্কর দিকে দৌড় দিল গ্যারি। টেলিফোন তুলে নিয়ে কথা বলল ওয়েল্টেভ্রেদেনের একচেঞ্জের সঙ্গে।

 “ক্যাপরিকর্ণ কেমিকেলসে ফোন করতে চাই-নাম্বার আছে তো, তাই না? এক্ষুণি আমি ম্যানেজিং ডিরেকটরের সাথে কথা বলতে চাই-খুব দরকার, আর্জেন্ট। লাইনে পাবার সাথে সাথে আমাকে ফোন করবে।”

টেলিফোন আবার আগের জায়গায় রেখে দিল গ্যারি। “বেন’কে এখনি ধরতে হবে। তারপর জিঙ্গাসাবাদ করতে হবে। যদি ওরা তাকে প্ল্যান্টে ঢুকিয়ে থাকে নিশ্চয় এর পেছনে কোনো জঘন্য কারণ থাকবে।”

“ও তাদেরই একজন।” ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন। কেউই এর আগে কখনো বৃদ্ধার কণ্ঠস্বরে এতটা তিক্ততা কিংবা চেহারাতে এতটা ঘৃণা দেখেনি। আতঙ্ক নিয়ে সবাই সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে রইল। “ও’ ও সেসব ধ্বংসকারী বিপ্লবীদের একজন। ওই কালো শয়তানটা ওর বাবা আর এত বছর ধরে তারা ওর মানসিক জগৎ দখল করে থাকাতে ও ওদের না হয়ে আর পারেই না। এটা ঈশ্বরেরই ইচ্ছে যে বদমাশগুলোর ভয়ংকর কোন বদমতলব থাকলেও আমরা তা নসাৎ করে দেব।”

ব্যাপারগুলো কল্পনা করে শিউরে উঠল উপস্থিত সকলে। বুঝতে পারলো কতটা নিষ্ঠুর এরা।

টেলিফোনের শব্দে সবার ঘোর কাটতেই ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে নিল গ্যারি। “আমি ক্যাপরিকর্ণের ম্যানেজিং জিরেকটর’কে লাইনে পেয়েছি।”

“গুড। হ্যালো পল। থ্যাঙ্ক গড় যে তোমাকে পেয়েছি। হোল্ড অন ওয়ান সেকেন্ড” বলেই টেলিফোনের কনফারেন্স কী চেপে ধরল গ্যারি। ফলে রুমের সবাই শুনতে পেল পুরো আলাপচারিতা।

“শোন পল, পয়জনস্ ডিভিশনে তোমার একজন কর্মচারী আছে, নতুন কীটনাশক প্ল্যান্টে, বেনজামিন আফ্রিকা।”

“ইয়েস, মিঃ কোর্টনি, আমি ওকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও নামটা পরিচিত। হোল্ড অন, ওর উপরে কম্পিউটার প্রিন্ট নিয়ে আসি। ইয়েস, পেয়েছি, বেনজামিন আফ্রিকা। এপ্রিলে জয়েন করেছে।”

“ও’কে পল। কোম্পানির সিকিউরিটি গার্ডস দিয়ে ওকে এখনি অ্যারেস্ট করাও। তবে খেয়াল রাখবে যেন কোথাও যোগাযোগ করতে না পারে। বুঝতে পেরেছ? কোনো ফোন কল, ল, ইয়ার, প্রেস কিছু না।”

“সত্যি এটা করব মি: কোর্টনি?”

“আমি যা করতে চাই তাই আমি পারব, পল। এটা মাথায় রাখবে সবসময়। এখন ওকে অ্যারেস্ট করার অর্ডার দাও। আমি লাইনে অপেক্ষা করছি।”

“দুই সেকেন্ড লাগবে মাত্র।” সম্মত হলেন ম্যানেজিং ডিরেকটর। ফোনের এ পাশ থেকে গ্যারি শুনল ইন্টারন্যাল সার্কিটে সিকিউরিটির সাথে কথা বলছেন ভদ্রলোক। “অল রাইট মিঃ কোর্টনি, ওরা আফ্রিকাকে গ্রেফতার করতে যাচ্ছে।”

“এখন শোন, পল, সিনডেক্সম্যানুফ্যাকচারির প্রোগ্রামের বর্তমান অবস্থা কী? সেনাবাহিনীর কাছে পাঠানো শুরু করেছ?”

“এখনো না, মি: কোর্টনি। আমাদের প্রথম শিপমেন্ট যাবে পরবর্তী মঙ্গলবার। সেনাবাহিনী নিজেদের ট্রাক পাঠাবে।”

 “ওকে পল। এ মুহূর্তে তোমার হাতে কতটুকু স্টক আছে?”

“আচ্ছা, কম্পিউটার চেক করে দেখছি। এই মুহূর্তে পাঁচ কিলো আর্টিলারী ক্যানিস্টারের মাঝে ৬৩৫টা ফর্মুলা এ আর বি আছে। এছাড়া পঞ্চাশ কিলো এরিয়াল সিলিন্ডারের মাঝে উভয় ফর্মুলাই আছে ছাব্বিশটা করে। আগামী সপ্তাহ শেষে এয়ার ফোর্সের কাছে”।

পলকে থামিয়ে দিল গ্যারি। “পল, আমি প্রতিটি ক্যানিস্টার আর সিলিন্ডারের হিসাব চাই। তোমার কয়েকজন সিনিয়র কর্মীকে এখনি স্টোরেজ এরিয়াতে পাঠিয়ে দাও যেন প্ল্যান্ট ম্যানিফেস্টের সাথে মিলিয়ে দেখে প্রতিটা সিরিয়াল নাম্বার আর এক ঘণ্টার মধ্যেই এ কাজ শেষ হওয়া চাই।”

“কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে মিঃ কোর্টনি?”

“তুমি তোমার স্টকের হিসাব জানালেই তোমাকে জানাব আমি। এই নাম্বারেই অপেক্ষা করছি। যত দ্রুত সম্ভব আমাক জানাও-অথবা পারলে তার চেয়েও দ্রুত।”

গ্যারি ফোন রাখার সাথে সাথেই জানতে চাইল শন্ : “তুমি আমাদেরকে কত দ্রুত ক্যাপরিকর্ণে পৌঁছে দিতে পারবে?”

“লিয়ার এখন পুরোপুরি অকেজো। মিসাইল স্ট্রাইকের পরে ডিসি এ পুরো এয়ারফ্রেম পাল্টে আকাশে উড়ার উপযোগী হবার সার্টিফিকেট চাইছে।

“কত দ্রুত, গ্যারি?” চাপ দিল শন; চিন্তায় পড়ে গেল গ্যারি, “কুইন এয়ার বেশ ধীর গতির হলেও জোহানেসবার্গের শিডিউল ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে তাড়াতাড়ি হবে। অন্তত সোজা ক্যাপরিকর্ণের এয়ারস্ট্রিপে নামা যাবে। যদি ঘণ্টাখানেক পরেই রওনা হতে পারি তাহলে বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাবো।”

“পুলিশকে জানাতে হবে না?” শাসার প্রশ্ন শুনে অধৈর্যভাবে নিজের লাঠি ঠুকলেন সেনটেইন। “নো পুলিশ। এখনি না আর যদি আমরাই সামাল দিতে পারি। তাহলে কখনোই না। তারা’র কালো বদমাশটাকে ধরে দরকার হলে সত্যিই ওর পেট থেকে বের করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন পরিবারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে পুরো ব্যাপার।” টেলিফোনের শব্দে থেকে গেলেন বৃদ্ধা।

রিসিভার তুলে কয়েক সেকেন্ড ওপর প্রান্তের কথা শুনল গ্যারি। তারপর উত্তর দিল : “আই সি, থ্যাঙ্ক ইউ পল। আমি এখনি প্লেনে উঠছি। দুপুর একটার মাঝে ক্যাপরিকর্ণের এয়ারস্ট্রিপে থাকব।” ফোন রেখে উদ্বিগ্ন চেহারাগুলোর দিকে তাকাল গ্যারি। “ছোট্ট পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেছে। গত চারদিন ধরে বেনজামিন আফ্রিকা প্ল্যান্টে আসছে না। কেউ জানে না কী হয়েছে। কিংবা কোথায় আছে জানতে চাইলেন শাসা।

“ওরা এখনো চেক করছে। আমরা ক্যাপরিকর্ণে ল্যান্ড করার মধ্যে পেয়ে যাবে।” জানাল গ্যারি। “বাবা আর নানা এখন তোমরা ওয়েল্টেভ্রেদেনেই থাকো। যদি কিছু জানাতে চাও তো জ্যান সুটস্ এয়ারপোর্ট কন্ট্রোলে টেলিফোন করলে ওরা আমার কাছে রিলে করে দিবে।” ভাইয়ের দিকে তাকাল গ্যারি। “শন আমার সাথে আসুক। মনে হচ্ছে বাহুবলের দরকার পড়তে পারে।”

বাবার সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল শন। “গান সেফের চাবি দাও, বাবা?”

শাসা চাবি দিতেই তালা খুলে ফেলল শন। হাট করে খুলে গেল ভারী স্টিলের দরজা।

 সেফের ভেতরে ঢুকে রিভলবার আর পিস্তলের তাকগুলোকে খানিক পরীক্ষা করে তুলে নিল পয়েন্ট ৩৫৭ ম্যাগনাম স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলবার। এক প্যাকেট গুলিও নিয়ে জিন্সের বেল্টে গুঁজে নিল রিভলবার।

“আমারও একটা নেয়া উচিত” সেফে ঢুকে পড়ল গ্যারি।

“গ্যারি” পেছন থেকে বলে উঠল বেলা, “আমিও যাবো তোমাদের সাথে।”

 “ভুলে যাও, যা বলেছ।” হেকলার অ্যান্ড কোর্চ ৯ মিলিমিটার বেছে নিতে ব্যস্ত গ্যারি মুখ ফিরিয়ে বোনের দিকে তাকালো না পর্যন্ত। “ঐ ব্যাপারে তোমার আর করার কিছু নেই।”

“হ্যাঁ আছে। তুমি জানোনা বেন দেখতে কেমন। আমি ওকে দেখলেই চিনে ফেলব-আর আরেকটা কথা বাকি আছে, যা আমি এখনো তোমাদেরকে বলিনি।

“তো এখন বলো”।

“আমাকে সাথে নিলে যেতে যেতে বলব।”

***

টুইন ইঞ্জিন বীচ ক্রাফট কুইন এয়ারের হেডিং উত্তরদিকে ঠিক করে নিল গ্যারি। এরপর নিজের সিটে বসেই তাকাল মেইন প্যাসেঞ্জার কেবিনে বসে থাকা বেলা’র দিকে।

সিট বেল্ট খুলে ককপিটে উঠে এলো বেলা। গ্যারির সিটের উপর ঝুঁকে তাকাতেই শুনতে পেল ভাই বলছে,

“ওকে বেলা। এবারে তাহলে ঝটপট বলে ফেলো আর কী বলতে চাও।”

 কো-পাইলটের সিটে বসে থাকা শনের দিকে তাকাল বেলা। “সে রাতের কথা মনে আছে যখন চিকাম্বা নদী তীরে নিকি হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইল আর তুমি আর আমি মিলে তাকে ধরে ফেললাম?”

 শন মাথা নাড়তেই বেলা বলে চলল, ফাস্ট ট্রাকের গেরিলা অফিসারটার কথা মনে আছে যে রোড ব্লক সুপারভাইজ করছিল? যাই হোক, আমি লোকটাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি যে আগেও তাকে দেখেছি। আমি তখন পর্যন্ত নিশ্চিত হলেও এখনকার মতো গুরুত্ব দিয়ে আর ভাবিনি।”

“কবে আর কোথায় দেখেছিলে?”

 “বেনের সাথে ছিল-কিন্তু যাচ্ছিল ফারগ্রোভে মাইকেলে’র ফার্মে।”

 “মাইকেল?” বেলা’কে থামিয়ে দিল গ্যারি, “আমাদের মাইকেল?”

 “হ্যা” ঘোষণা করল বেলা, “মাইকেল কোর্টনি।”

 “তোমার ধারণা এসবের মাঝে মাইকেলও জড়িত আছে?”

“হ্যাঁ, তাই যদি না হয় তো এএনসি টেরোরিস্ট কমান্ডার আর বেনের সাথে কী করছিল সে?”

 খানিকক্ষণের জন্য চুপ করে গেল সকলে। আর তারপর বেলা আবারো শুরু করল : “গ্যারি তুমি নিশ্চয় ভাবছ যে বেন সিনডেক্সের একটা কী দুটো সিলিন্ডার চুরি করেছে? যদি সে টেরোরিস্টদের সাথে মিলেও যায় তাহলে এটা কিভাবে ব্যবহার করবে? নিশ্চয়ই কোনো এয়ারক্রাফট থেকে স্প্রে করবে?”

“হ্যাঁ, এটা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।”

“ফারগ্রোভে মাইকেলের প্লেন আছে।”

“ওহ শিট” ফিসফিস করে উঠল গ্যারি, “প্লিজ, এমনটা যেন না হয়। মিকি নয়–অন্তত মিকি নয়।”

“মাইকেল গত কয়েক বছর ধরেই এসব ছাইপাশ পাবলিস করছে আর এ কারণে নিশ্চয় এ ভূতগুলোর সাথেও হাত মেলাতে হয়েছে।” কঠোর হয়ে উঠল শনের চেহারা।

বাকিরা কেউই কোনো উত্তর দিল না। বদলে গ্যারি বলে উঠল, ‘বেলা, আমাদের প্রত্যেকের জন্য কোক নিয়ে এসো, প্লিজ।”

বারের রেফ্রিজারেটরে গিয়ে দুটো ক্যান নিয়ে এলো বেলা। কোক শেষ করার পর ক্যান নামিয়ে শন্ মোলায়েম স্বরে জানাল, “আজ সকালে দেখছি র‍্যান্ড ইস্টার শো শুরু হলো।” ভাইয়ের দিকে তাকাল গ্যারি।

“এর সাথে ওটার কী সম্পর্ক?”।

“কিছুই না” গ্যারি’র দিকে তাকিয়ে হাসল শন। “এই শো’তে এক জায়গাতেই জড়ো হয় হাফ মিলিয়ন লোক। ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত পণ্য, কৃষক আর ব্যবসায়িদেরকে দেখানো হয়-গয়না বিক্রেতা, টেইলর এমনকি ইন্ডিয়াল চিফ পর্যন্ত থাকে। সন্ধ্যা আটটায় গ্র্যান্ড অপেনিং হবার কথা। সাথে থাকবে ফায়ারওয়ার্কস ডিসপ্লে, মিলিটারি ট্যাটু আর স্টক কার রেসিং। বক্তব্য দেবেন প্রাইম মিনিস্টার। সাথে থাকবে কালো স্যুট পরা সব হোমড়া-চোমড়া। হেল, এর মানে তো কিছু নয়, তাই না।”

“এরকম হেয়ালি করে কথা বলো না, শন।” ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে গ্যারি।

“তুমি ঠিকই বলেছ, গ্যারি” এখন হাসছে শন্। “মানে, এ এনসি বদমাশগুলোর মনোভাব আসলে খারাপ নয়। ওরা কয়েকটা কার বোমা ফাটালো কি মোটর কার জ্বালিয়ে দিল তার মানে তো এই যে ওরা সবাই খারাপ। কিন্তু ভেবে দেখো তো, একটা ভিড়ে ভিড়াক্কার সুপারমার্কেটে রাশান’রা লিস্পেট মাইন ছুড়লেও কখনো নিশ্চয় ব্যান্ডইস্টার শো’তে সিনডেক্স-২৫ স্প্রে করেনি। তাই না?”

“না” মাথা দোলালো গ্যারি। “মানে বেন আর মিকি তো আমাদেরই ভাই। ওরা নিশ্চয়-না…” কথা শেষ করতে পারল না গ্যারি। কিন্তু একটু পরেই রেগে উঠল, “ধুত্তোরি, লিয়ার থাকলে এতক্ষণে সেখানে পৌঁছে যেতাম।”

মাথার উপরে রেডিও খসখস করে উঠতেই হেডফোন অ্যাডজাস্ট করে নিল গ্যারি। “চার্লি সিয়েরা এক্স-রে, জান সুটস ইনফর্মেশন থেকে বলছি, ক্যাপরিকর্ণ থেকে তোমার জন্য রিলে আছে। কপি করার জন্য তৈরি আছো?”

 “গো অ্যাহেড, ইনফর্মেশন।”

“মেসেজে লেখা আছে : ট্যালি অনুযায়ী মিলে গেছে সমস্ত স্টক আর সিরিয়াল নাম্বার। মেসেজ শেষ।”

“থ্যাঙ্ক গড?” জোরে শ্বাস ফেলল গ্যারি।

“তাদেরকে বলো সিলিন্ডারের ভেতরে কী আছে সেটাও যেন চেক করে দেখে নেয়। পরামর্শ শুনতেই বদলে গেল গ্যারির চেহারা।

“ইনফর্মেশন, প্লিজ ক্যাপরিকর্ণকে মেসেজ পাঠাও : সবকটি কন্টেইনারের স্যাম্পল চেক করো। মেসেজ শেষ।”

হেডফোন নামিয়ে ফেলল গ্যারি। “ওহ্, ঈশ্বর এটা যাতে কোনো মতেই সত্য না হয়। কিন্তু তোমার কথাই ঠিক শন্। ওরা বোকা নয়। কয়েকটা খালি সিলিন্ডারের গায়ে ফলস্ নাম্বার লিখে স্টক রুমে ফেলে রাখা ওদের জন্য কোনো ব্যাপারই না।”

“আর কত দেরি আছে?” নেভিগেশন চেক করল গ্যারি। “আরো এক ঘণ্টা-ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে হাওয়া পেছন দিক থেকে বইছে।”

ঘুরে বোনের দিকে তাকালো শন। “আমার একটা উপকার করো সুইট হার্ট। এর পরের বার কারো সাথে রোমাঞ্চ করতে চাইলে জ্যাক দ্য রিপার টাইপের কাউকে ধরো।”

দূর থেকেই চেনা যায় ক্যাপরিকর্ণের এয়ারস্ট্রিপ। সাদা কোয়াটজের উপর পড়ে আছে একটা ছাগল। পাঁচ মাইল দূর থেকেই দেখা যায় এ দানবাকৃতির স্ট্রিপ। মসৃণভাবে মাটি স্পর্শ করল গ্যারি। হ্যাংগারের দিকে যেতে যেতে দেখা গেল চারটা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ম্যানেজিং ডিরেক্টর পলসহ ক্যাপরিকর্ণের একদল কর্মচারী।

কুইন এয়ার থেকে লাফ দিয়ে নামল শন্ আর গ্যারি। তারপর বেলা’র দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই ছুটে এলো পল।

“মি: কোর্টনি, ইউ ওয়্যার রাইট। ছোট দুটো ক্যানিস্টারে কেবল কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ঢোকানো আছে। উধাও হয়ে গেছে দশ কিলো সিনডেক্স ২৫।

আতঙ্কিত হয়ে পলের দিকে তাকিয়ে রইল সকলে। দশ কিলো সিনডেক্স পুরো একটা সেনাবাহিনীকে মুছে দিতে পারবে।

 “পুলিশে ফোন দেয়ার সময় হয়েছে। ওরা বেন আফ্রিকাকে ধরে ফেলুক। ওর কোন ঠিকানা আছে আমাদের কাছে?” জানতে চাইল শন্।

“আমি এরই মাঝে ওর বাসায় লোক পাঠিয়েছিলাম।” উত্তর দিলেন পল। “বেন নেই, বাড়িঅলা জানিয়েছেন গত কয়েকদিন ধরেই ওকে দেখছেন না। বাড়িতে বেন খেত’ওনা ঘুমাতোও না।”

নরম স্বরে “ফারগ্রোভ” বলে উঠল বেলা।

“রাইট” চড়া গলায় বলে উঠল গ্যারি। “শন তুমি এখনি ওখানে চলে যাও। বেলা’কেও সাথে নিয়ে যাও। বেন’কে দেখিয়ে দেবে; যদি পিছু নিতে হয়। আমি এদিককার কাজ সামলাচ্ছি। বোর্ডরুমেই থাকব। ফারগ্রোভে যাবার সাথে সাথে কল করবে। তোমাদের জন্য পুলিশ ব্যাক আপের ব্যবস্থা করছি। মিসিং ক্যানিস্টারগুলোকে পেতেই হবে।”

পলের দিকে তাকাল শন, “আমার খুব দ্রুত গতির একটা গাড়ি লাগবে।”

“আমারটা নিয়ে যান।” হ্যাঁভারের পাশেই পার্ক করে রাখা নতুন বি এম ডব্লিউ দেখালেন পল। “ট্যাঙ্ক ফুল আছে, এই যে চাবি।”

“কাম অন বেলা, লেটস গো।” বি এম ডব্লিউ’র দিকে দৌড় দিল ভাই বোন।

“ট্রাফিক পুলিশ দেখলেও থামবে না” সতর্ক করে দিল বেলা। বি এন ডব্লিউ ছোটাল শন। “কেপ টাউন ছাড়ার আগেই ফারগ্রোভের পুলিশকে পাঠিয়ে দেয়া উচিত ছিল। গড়, এরই মাঝে তিনটা বেজে গেছে।”

“কিন্তু কেউ সিনডেক্সের ট্যাঙ্ক নিয়েছে নিশ্চিত হবার আগে আমরা কিছু করতে পারব না।” বুঝিয়ে বলল শন।

 ঝুঁকে পড়ে কার রেডিও অন করল শন্। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেলা।

“বেলা তিনটার খবর।” হাই ভেল্ডের রেডিও ছাড়ল।

“আজ সকাল থেকেই দলে দলে মানুষ ঢুকছে র‍্যান্ড ইস্টারের গেইট দিয়ে। আজই অপেনিং হবে। শো কমিটির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, দুপুরের ভেতরে পৌঁছে যাবে দুই কোটি দর্শক।”

রেডিও’র সুইচ অফ করে বি এম ডব্লিউ’র ড্যাশবোর্ডে ঘুষি মারল শন।

“মাইকেল!” চিৎকার করে উঠল শন, “মরিয়া হলেই মানুষ কেবল দুঃসাহসী হয়ে উঠে। ঈশ্বর, শান্তি আর মানুষে মানুষে সম্প্রীতির নামে কত যে নিরপরাধ মানুষের জীবন গেছে?” আবারো মুঠি পাকিয়ে ড্যাশবোর্ডে ঘুষি মারল শন। ভাইয়ের বাহুতে হাত রাখল বেলা।

“স্লো ডাউন শন। সামনে গিয়ে ডানে মোড় নাও।” রাস্তার বাঁকে গিয়ে শন এত জোরে টার্ন নিল যে ডোর হ্যাঁন্ডেল ধরে নিজেকে সামলাল বেলা।

“আর কত দূর?”

 “আর কয়েক মাইল মাত্র।”

কোটের প্রান্ত সরিয়ে বেল্ট থেকে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন খুলে নিল শন। বুড়ো আঙুল দিয়ে চেক করে খেল চেম্বার।

“তুমি এটা দিয়ে কী করবে?” নার্ভাস হয়ে গেল বেলা। “বেন আর মিকি

“বেন আর মিকি’র কয়েকজন চমৎকার দোস্ত আছে।” আবারো বেল্টের সাথে রিভলবার ঝালিয়ে নিল শন।

“এই তো এসে গেছি” নিজের সিটে এগিয়ে বসল বেলা। সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই তো মিকি’র বাড়ির গেইট দেখা যাচ্ছে।”

বি এম ডব্লিউ’র গতি ধীর করে কাদামাটির রাস্তায় নেমে গেল শন। বিল্ডিং’এর সামনে এসে তারপর আবার আড়াআড়ি ঘুরিয়ে ফেলল বি এম ডব্লিউ’র নাক। “কেন এরকম করছ?” জানতে চাইল বেলা।

“আমি পায়ে হেঁটে যাবো। আমার আগমনবার্তা জানাবার কোনো মানে হয় না।” জানাল শন্।

“কিন্তু তুমি রাস্তার উপর পার্ক করছ কেন?”

“যাতে কেউ তাহাহুড়া করে পালাতে না পারে।” ইগনিশন থেকে চাবি বের করে লাফ দিল শন্।

 “তুমি এখানেই থাকো। না, গাড়ির ভেতরে না। ওদিকের গাছগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকো। আর আমি না ডাকা পর্যন্ত মাথা বের করবে না, ঠিক আছে?”

“ইয়েস শন।”

“আর দরজা ঠাস করে আটকাবে না।” প্যাসেঞ্জার সিট থেকে পিছনে বের হয়ে গেল বেলা। “এখন বলল, মিকি ওর প্লেন কোথায় রাখে?”

“ফুল বাগানের শেষ মাথায়, বাড়ির পেছনে।” বুঝিয়ে দিল বেলা, “এখান থেকে না দেখতে পেলেও ভেতরে গিয়ে মিস্ করার উপায় নেই। বেশ বড় করোগেটেড টিন শেড আর সবকিছুই ভাঙ্গা-চোড়া, জং ধরা।”

“ঠিক আমাদের মিকির মত।” দাঁত কিড়মিড় করে উঠল শন্। “আমি যা বলেছি মনে রাখবে কিন্তু। যাও, এখন সরে যাও।” দৌড় দিল শন।

রাস্তার থেকে নেমে ফল বাগান আর চিকেন শেডের ওপাশ দিয়ে দৌড়াতে লাগল শন। এপাশে মূল দালান। মাত্র কয়েকশ গজ গেলেই মেইন বারান্দা। দেয়ালের পিছনে হামাগুগি দিয়ে বসে খুব দ্রুত পুরো বিল্ডিং দেখে নিল শন্। সদর– দরজা আর সবকটি জানালা হাট করে খোলা; কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

দেয়ালের উপর চড়ে বসে সহজেই এপাশে নেমে এলো শন। তারপর সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। সিটিং রুম আর কিচেন শূন্য হলেও সিঙ্কের উপর পড়ে আছে নোংরা বাসন কোসনের স্তূপ। তিনটা বেডরুমের প্রতিটা দেখেই বোঝা গেল যে বাসিন্দারা মাত্রই কোথায় গেছে বিছানা এলেমেলো। মেঝের উপর ছড়িয়ে আছে কাপড়। বাথরুম আর ড্রেসিং টেবিলের উপর মেনস টয়লেট আইটেমস। ‘

একটা শার্ট তুলে নিয়ে কলার দেখল শন্। ভেতরের দিকে লাল সুতা দিয়ে নাম সেলাই করা আছে : “বি. আফ্রিকা।”

শার্ট ফেলে দিয়ে নিঃশব্দে রান্নাঘরের দরজায় গেল শন পোকায় খাওয়া ফল বাগানের গাছগুলোর দিকের দরজাটা খোলা। এগুলোর পেছনেই দেখা গেল করোগোটেড শেড়অলা বিশাল শেড।

দৌড় দিয়ে ফল বাগানের ভেতর গিয়ে গাছগুলোর পেছনে লুকিয়ে পড়ল শন। তারপর এভাবেই চলে গেল শেড় অব্দি। পাতলা করোগেটেড গ্যালভানাইজড শিটের গায়ে কান পাততেই শোনা গেল কয়েকজন পুরুষের গলা। কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। বেল্টের রিভলবার চেক করে নিল শন। দরকার পড়লেই যেন দ্রুত টেনে নিতে পারে হাতল। এরপর সহজ ভঙ্গিতে শেডে’র পিছনের দেয়াল ধরে এগিয়ে গেল ছোট্ট সবুজ দরজাটার দিকে। কিন্তু শন পৌঁছবার আগেই খুলে গেল দরজা। ঝকমকে রোদে বেরিয়ে এলো দু’জন পুরুষ।

***

নিজের কর্মদক্ষতা নিয়ে বেশ গর্ব বোধ করে বেন আফ্রিকা। সেসনা সেঞ্চুরিয়ন এয়ারক্রাফটের পাইলটের সিটে হাটু গেড়ে বসে ডান দিকের প্যাসেঞ্জার সিটের সামনের ডেকে বেধে ফেলল জোড়া সিলিন্ডার।

বোল্ট-হোলগুলো খুব সাবধানে ড্রিল করল যেন কন্ট্রোল কেবলস্ এর কোনো ক্ষতি না হয়। চাইলে সিরিল্ডারগুলোকে কেবিনের ফ্লোরে এমনিতেই শুইয়ে রাখতে পারত; কিন্তু তার ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা এ কাজ করতে দেয়নি। ফ্লাইটের সময় জোর বাতাসের ধাক্কা খেলেই ভালব অথবা টিউবের ক্ষতি হবে। স্টিলের বোতলগুলোকে এমনভাবে বসালো যেন পাইলট কিংবা তার প্যাসেঞ্জার যে কেউ চাইলেই ভালব-হ্যান্ডেল ধরতে পারবে।

যে বোতলটাতে এলিমেন্ট এ আছে সেটার গায়ে, মাঝখানে তিনটা লাল রিংঅলা সাদা-কালো চেক প্যাটার্নের রঙ করা হয়েছে। আর এলিমেন্ট বি হল শুধু একটা কালো রিংঅলা লাল টকটকে সিলিন্ডার। প্রতিটি বোতলের গায়েই লেখা আছে নির্দিষ্ট সিরিয়াল নাম্বার।

মেডিকেলের দুটো সাধারণ অক্সিজেনের বোতলকে এমনভাবে কাজে লাগানোর বুদ্ধিও বে’নের মাথা থেকেই বেরিয়েছে। নিজ হাতে খোদাই করেছে সিরিয়াল নাম্বার। এছাড়া বোতলগুলো এতই ছোট যে বিশেষভাবে সেলাই করা ওভারকোর্টের পকেটে করে ক্যাপরিকর্ণ কেমিকেলস থেকে বের করে আনতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। অসম্ভব চতুরতার আশ্রয় নিয়েই পার করে এনেছে প্ল্যান্টের মেইন গেইটের সিকিউরিটি চেক।

 দু’টো বোতলকে স্টেইনলেস স্টিলের টি-পিস দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে যা আবার মুখের কাছে স্পেশ্যাল লেফট-হ্যান্ড থ্রেড দিয়ে আটকে দেয়া আছে। এগুলোকে ব্যবহার করার জন্য প্রথমেই স্কুর গায়ে টোকা দিয়ে খুলে যাবে প্রতিটা বোতল। তারপর ভালব হ্যাঁন্ডেল ধরে হাফ-টার্ন দিলেই টি-পিসের মাধ্যমে একসাথে মিশে যাবে দুই বোতলের গ্যাস। হোসের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে নার্ভ গ্যাস। পেছনের লাগেজ কম্পার্টমেন্টের সামনের দুটো সিটের মাঝখানে লাগানো হয়েছে হোস।

কম্পার্টমেন্টের ফ্লোরবোর্ডস আর সেঞ্চুরিয়নের আউটার মেটাল স্কিনের গায়ে তিন সেন্টিমিটার গর্ত করেছে বেন! গ্যাস হোসের শেষাংশ এই ড্রিল করা গর্তের মাঝখান দিয়ে পৌঁছে গেছে দশ সেন্টিমিটার রাস্তা; ফিউজিলাজ। প্রাটলি’র পুডিং লাগিয়ে হোস’কে জায়গামতো বসিয়ে রাখা ছাড়াও ছোটখাট গ্যাপ ভরে দিয়েছে। শুকিয়ে যা লোহার চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে।

এয়ারক্রাফটের নিচ থেকে গ্যাসটাকে স্প্রে করতে কোন সমস্যাই হবে না। একই সাথে অক্ষত থাকবে সেঞ্চুরিয়নের আরোহীরা। তবে বাড়তি নিরাপত্তা হিসেবে সেফটি স্যুট পরা ছাড়াও গ্যাস ছাড়ার মুহূর্তে বোতল ভর্তি অক্সিজেন থেকে নিঃশ্বাস গ্রহণ করবে সেঞ্চুরিয়নের প্যাসেঞ্জার।

হ্যাঙ্গারের দেয়ালে ঝুলতে থাকা সুট যে কোনো মুহূর্তে চাইলেই গায়ে চাপানো যাবে। ফায়ার ডিপার্টমেন্টের অ্যাপ্রুভ করা এসব সুট গোল্ড মাইনে রেসকিউ টিম হরহামেশা ব্যবহার করে থাকে।

দ্বিতীয় বারের মতো হোসের ভেতরে কোন লিক আছে কিনা চেক্ করে দেখল বেন। অবশেষে সন্তুষ্ট হয়ে খোলা কেবিনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। তুলার মাঝে হাত মুছে কাছাকাছি দেয়ালের সাথে লাগানো ওয়ার্কবেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল।

অন্য দু’জন বেঞ্চের উপর ঝুঁকে পড়ে ম্যাপ স্টাডি করছে। মাইকেল কোর্টনির পিছনে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখল বেন। “অল সেট,. মিকি।” দক্ষিণ লন্ডনি টানে জানাল বেন।

এরপর মনোযোগ দিল রামোন মাচাদোর দিকে। এই লোকটাকে প্রায় পূজা করে বেন; রামোনের এতটাই অন্ধ ভক্ত সে। মাঝে মাঝে যখন মাইকেলের সাথে একা থাকে তখন তো যেন ধর্মীয় বিশ্বাসের মতই রামোনকে নিয়ে আলোচনা করে। অন্যদিকে মাইকেল অনুভব করে তাদের মিশনের বিভৎস দিক। লড়াইকে সফল করার জন্য যে এরকম কিছু করার প্রয়োজন আছে সে কথা নিজের মনকে বোঝাতেই তার লেগে গেছে বহু মাস।

 মাইকেলের বিতৃষ্ণা অনুভব করে ওর দিকে তাকাল রামোন। মাইকেল, তুমি মেটকে ফোন করে আজ সন্ধ্যায় ফাইনাল ওয়েদার ফোরকাস্টটা জেনে নিও।”

সামনের বেঞ্চে থাকা টেলিফোন তুলে জান সুটস্ এয়ারপোর্টের ওয়েদার ইনফর্মেশনের নাম্বার ডায়াল করল মাইকেল। প্রি-রেকর্ডেড অ্যানাউসেমন্টটা শুনল মন দিয়ে, “বাতাস এখনো পাঁচ নট গতিতে ২৯০ ডিগ্রি কোণে বইছে; উত্তর দিল মাইকেল। “সকাল থেকে কোনো পরিবর্তন নেই। বায়ুমণ্ডলের চাপও স্থির আছে।”

“যাক, ভালোই হল।” নিজের রেড় মার্কার পেন্সিল তুলে নিল রামোন। লার্জ স্কেল অ্যারোনটিক্যাল ম্যাপের উপর পডিশন সার্কেল করল। তারপর বাতাসের গতিপথও মার্ক করল। “ওকে। এটাই হবে তোমার লাইন অব অ্যাপোচ। টার্গেটের এক মাইল পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী বাতাস পাবে। চেষ্টা করবে মাটি থেকে হাজার ফুট উঁচুতে থাকতে। ওয়াটার টাওয়ার পার হয়ে গেলেই গ্যাস ভালব খুলে দেবে। এগুলোর গায়ে বেশ স্পষ্ট নেভিগেশনলি ওয়ার্নিং লাইটস জ্বলছে।”

“ইয়েস” জানাল মাইকেল। “আমি ওই এলাকা দিয়ে গতকালও উড়ে এসেছি। স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইট জ্বলবে। লেজার শো’ও হবে-মিস্ করার কোনো মানেই হয় না।”

 “ওয়েল ডান, কমরেড।” নিজের সবচেয়ে দুস্পাপ্য হাসিগুলোর একটি মাইকেলকে উপহার দিল রামোন, “তুমি বেশ অসাধারণ প্রস্তুতি নিয়েছ।”

নিচের দিকে তাকাল মাইকেল আর বেন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আমি তো একটা’র খবরে শুনেছি যে দুপুরের মধ্যেই ওখানে আরো দুই কোটি দর্শক জমে যাবে। তাই ভরসটার ওপেনিং স্পিচ দিতে আসতে আসতে আরো হাফ মিলিয়ন। স্বাধীনতার জন্য আমাদের আজকের আঘাত কেউ ঠেকাতেই পারবে না।”

 “সন্ধ্যা সাতটায় ভরস্টারের বক্তৃতা দেবার কথা।” শো কমিটির ইস্যু করা বিজ্ঞাপনের পুস্তিকাৰ্প তুলে নিল রামোন। বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ল শুরুর দিককার প্রোগ্রামগুলো। কিন্তু কয়েক মিনিট দেরি তো হতেই পারে। আর সম্ভবত চল্লিশ মিনিট থেকে শুরু করে ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দেবে। মিলিটারি ট্যাটু শুরু হবে রাত আটটায়। তুমি কখন রওনা দেবে?”

“যদি আমি ১৮৪৫ ঘণ্টায় রওনা দেই তাহলে আটচল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যাবো। গতকালও সময় হিসাব করে দেখেছি। তার মানে সাতটা তেত্রিশে টার্গেটের উপর থাকব।”

“তাহলেই চলবে।” একমত হলো রামোন। “ভস্টার নিশ্চয় তখনো কথা বলতে থাকবে। দু’বার ঘুরে যাবে রেঞ্জের মধ্যে। তারপর পশ্চিমে ঘুরে সোজা বতসোয়ানা বর্ডার। রালেই তাবাকা’র সাথে কতটা নাগাদ দেখা করতে পারবে?”

 “তিন ঘণ্টা পনের মিনিট” উত্তরে জানাল মাইকেল। “আজ রাতে প্রায় এগারেটার দিকে পৌঁছে যাবো। এই সময়ের মধ্যে বাড়তি কোনো গ্যাস থাকলেও তা নষ্ট হয়ে যাবে।”

“ফ্লেয়ার ছেড়ে এয়ারস্ট্রিপে আলো জ্বালিয়ে রাখবে রালেই তাবাকা। ল্যান্ড করার সাথে সাথে গ্যাস ইকুপমেন্ট সরিয়ে প্লেনে আগুন ধরিয়ে দিও। সেখান থেকে রালেই তোমাকে জাম্বিয়া দিয়ে বের করে টার্সিও বেসে নিয়ে যাবে।

দুই ভাইয়ের দিকে তাকালো রামোন। “তো, তাহলে এই হলো ব্যাপার। জানি এরই মাঝে ডজনখানেক বার বলা হয়ে গেছে, তবুও আর কোনো প্রশ্ন আছে?”

মাথা নাড়ল ভাতৃদ্বয়। মুখ বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল রামোন। গায়ের রঙ আর চুলের দিক থেকে আলাদা হলেও এ দুই ভাইয়ের মাঝে অদ্ভুত কিছু মিল আছে।

এই ধরনের বাধ্যতা আর দ্বিধাহীন বিশ্বাস ব্যতীত বিপ্লব আসলে কখনো সফল হতে পারত না; আপন মনেই ভাবল রামোন। কেমন যেন ঈর্ষা হলো ওদের দেখে। থাকুক, ওরা না হয় বিশ্বাস করুক যে এই একটামাত্র দায়িত্ব পালন করলেই বদলে যাবে পৃথিবী আর সমাজতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় হবে। কিন্তু রামোন জানে যে কোনো কিছুই এত সহজ নয়।

দুই ভাইয়ের অন্ধ বিশ্বাস দেখে খুশি হলেও রামোন বুঝতে পারছে না যে হাফ মিলিয়ন মানুষ মেরে ফেলে এর পরের ধাপ রেড টেরর হজম করার মতো এদের কলজের জোর আছে কিনা।

শক্তিশালীরাই কেবল টিকে থাকবে। কিন্তু এই দুজনের মনোভাব ততটা শক্ত নয়। তাই আজ রাতের পরে তাদের প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে।

আস্তে করে মাইকেলের কাঁধে হাত রাখল রামোন। ভালভাবেই জানে যে পুরুষের স্পর্শ কতটা উপভোগ করে মাইকেল।

“তুমি আসলেই চমঙ্কার কাজ করেছ। এখন গিয়ে খেয়ে রেস্ট নাও। সন্ধ্যায় তুমি টেক অফ করার আগেই আমি চলে যাব। দুজনের জন্যই রইল আমার স্যালুট।”

তিনজন মিলে একসাথে এগোল শেডের দরজার দিকে; কিন্তু খানিক গিয়ে থেমে গেল মাইকেল।

“আমি একবার নিজের হাতে বেনের কাজ চেক করে দেখতে চাই।” দৃঢ় কণ্ঠে বলল মাইকেল। কোনো অনিশ্চয়তা রাখতে চাই না।”

“তোমার এটা অধিকার কমরেড। সম্মত হলো রামোন। “এই ফাঁকে আমরা তোমার খাবার তৈরি করে ফেলছি।”

সেঞ্চুরিয়নের ককপিটে উঠে গেল মাইকেল আর বাকি দুজন এগোল দরজার দিকে।

“হ্যাঙ্গারের দেয়ালের গায়ে লাগানো ছোট্ট দরজাটা খুলে ফেলল রামোন। আর বেনসহ বের হতেই দেখল তাদের দিকে তাকিয়ে আছে শন কোর্টনি।

মাত্র ছয় ফুট দূরে দাঁড়িয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে, শন্ আর রামোন। প্রতিক্রিয়া হলো দেখার মত। কোর্টের নিচে হাত দিয়েই বিশাল ম্যাগনাম রিভলবার বের করে আনল শন। সেকেন্ডেরও কম সময় লাগল ট্রিগার কাজ করতে আর এরই ফাঁকে বেন আফ্রিকাকে টেনে এনে নিজের দেয়াল বানিয়ে ফেলল রামোন। উজ্জ্বল দিনের আলোতে আরো অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল মাজলের ফ্ল্যাশ; শনের গুলি ছিন্নভিন্ন করে দিল বে’নের শরীর।

বাম কনুই ভেদ করে হলো-পয়েন্ট বুলেট চলে গেল হাত থেকে দেহের এক পাশ পর্যন্ত। শেষতম পাঁজরে ঢুকতেই ভাঙ্গতে শুরু করল বুলেট। ফুসফুসে ভরে গেল বুলেটের খানিক অংশ। একটা তামার জ্যাকেট পরা স্পিন্টার মেরুদণ্ডের ভাট্রেবার মাঝখানে ঢুকে স্পাইনাল কর্ডকে প্রায় চুরমার করে দিল।

বুলেটের আঘাতে একপাশে দেয়ালের উপর ছিটকে পড়ল বেন। জং ধরা কারাগেটেড টিনের গায়ে ছিটিয়ে পড়ল রক্ত। শন আবারো রিভলবার ভোলার আগেই মাথা নিচু করে হ্যাঙ্গারে চলে গেল রামোন মাচাদো। লাথি মেরে পেছনে দরজা আটকেই শোল্ডার হোলস্টার থেকে তুলে নিল তোকারেভ পিস্তল।

পাতলা দেয়াল লক্ষ্য করে দ্রুত দু’বার গুলি ছুড়ল রামোন; ভাবল শন্ বুঝি এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আগে থাকতেই সন্দেহ করে মেঝের উপর সোজা হয়ে পড়ে গড়িয়ে গেল শন। গুলির শব্দ আর টিনের দেয়ালে বুলেটের গর্ত দেখে আন্দাজ করে নিল রামোনের অবস্থান। জোড়া হাতে ফায়ার করতেই ভারী বুলেটের আঘাতে দেয়ালে গর্ত হয়ে গেল; তবে এক ফুটের জন্য মিস্ হলো রামোনের মাথা।

হ্যাঙ্গারে কয়েকটা ড্রামের পেছনে লুকিয়ে থাকা রামোন এয়ারক্রাফটের কন্ট্রোলে বসে থাকা মাইকেলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, স্টার্ট আপ!”

সেঞ্চুরিয়নের পাইলটের সিটে বসে আতঙ্কে যেন জমে গেল মাইকেল। কিন্তু রামোনের নির্দেশ শুনেই সম্বিত ফিরে পেয়ে দুটো মাস্টার সুইচ জ্বেলে চাবি ঘুরিয়ে দিল। খক খক করে কাশতে লাগল সেঞ্চুরিয়নের ইঞ্জিন, থ্রটল খুলে দিল মিকি গর্জন করে উঠল সেঞ্চুরিয়ন।

“গেট হার রোলিং” চিৎকার করে উঠেই দেয়াল লক্ষ্য করে এলোপাথারি আরো দুবার গুলি ছুড়ল রামোন।

 খোলা হ্যাঙ্গারের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেঞ্চুরিয়ন; গতি বাড়ছে দ্রুত। দৌড় দিল রামোন। উইং এর নিচে লুকিয়ে খুলে ফেলল প্যাসেঞ্জার জোর।

 “বেন কোথায়?” রামোন’কে দেখেই চিৎকার করে জানতে চাইল মাইকেল।

“বেন শেষ” চিৎকার করেই উত্তর দিল রামোন, “স্কীপ গোয়িং।”

 “শেষ মানে কী?” সিটের উপর মোচড় দিয়ে বসে থ্রটল বন্ধ করে দিল . মাইকেল, “আমরা ওকে এভাবে রেখে যেতে পারি না।”

“বেন মারা গেছে, ম্যান।” খ্রটলের উপর মাইকেলের হাত ধরল রামোন। “বেনের গায়ে গুলি লেগেছে। আমাদেরকে দ্রুত এখান থেকে চলে যেতে হবে।”

“বেন-”

 “প্লেন চালাও।”

আবারো থ্রটল খুলে দিল মাইকেল। রানাওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করল সেঞ্চুরিয়ন। প্রচণ্ড শোকে কাতর হয়ে পড়েছে মাইকেল।

“বেন” ফিসফিস করেই সেঞ্চুরিয়নের ট্যাক্সিইং শুরু করল মিকি। একেবারে শেষ মাথায় পৌঁছে ব্রেক আর ইঞ্জিন ব্যবহার করে রানওয়ে ছেড়ে ওঠে পড়ল বাতাসে। “ইঞ্জিন একেবারে ঠাণ্ডা” জানাল মাইকেল, “ওয়ার্ম। আপের চান্স পায়নি তো।”

“কিন্তু ওকে চলতেই হবে” জোর গলায় বলে উঠল রামোন। “এখুনি এসে পড়বে পুলিশ। কে জানে কিভাবে খবর পেয়েছে।”

“বেন?”

 “বেনের কথা ভুলে যাও” খেঁকিয়ে উঠল রামোন, “প্লেন চালাও।”

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?-বতসোয়ানা?” এখনো দ্বিধা করছে মাইকেল।

“হ্যা” জানাল রামোন, “কিন্তু তার আগে এই অপারেশন শেষ করতে হবে। শো-গ্রাউন্ডের দিকে চলো।”

 “কিন্তু…তুমি তো বললে যে পুলিশ আমাদের পিছু নিয়েছে” প্রতিবাদ করে উঠল মাইকেল। “এখন ওরা আর কিভাবে থামাবে? এয়ারফোর্স ইম্পালা আকাশে উঠতেও ঘন্টাখানেক লেগে যাবে। গো-ম্যান-গো!”।

এমন সময় হ্যাঙ্গারের পিছন থেকে দৌড়ে এলো কেউ একজন। ভাইকে দেখে চিনতে পারল মাইকেল।

“শন!” সবিস্ময়ে বলে উঠল মিকি।

“কিপ গোয়িং” আদেশ দিল রামোন।

রানওয়ের শেষ মাথায় এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল শন। সামনে থেকে ছুটে আসা সেঞ্চুরিয়নকে লক্ষ্য করে ক্ল্যাসিক ডাবল-হ্যান্ডেড গ্রিপ করে তিনবার গুলি করল।

একেবারে শেষ গুলিটা উইন্ডস্ক্রিনে লাগতেই মাথা নিচু করে ফেলল মাইকেল আর রামোন। সেঞ্চুরিয়নের নাক ঘুরিয়ে ফেলল মাইকেল। সীমানা প্রাচীর দুমড়ে-মুচড়ে স্বচ্ছ নীলাকাশে উড়ে গেল এয়ারক্রাফট।

 দুইশ ফুট উপরে উঠেও খানিক কাশি দিয়ে তোতলাতে লাগলো শীতল মোটর। এরপরই মসৃণ গতিতে ছুটে চলল।

“শো-গ্রাউন্ডসের দিকে চলো” আবারো বলে উঠল রামোন, “ভরসটার’কে না পেলেও টার্গেট একেবারে খারাপ না। এখনো দুইশ কোটি মানুষ আছে ওখানে।”

এক হাজার ফুট উপরে উঠে এয়ারক্রাফট লেভেলড করল মাইকেল! উড়ে চলল নিজ গন্তব্যের দিকে।

***

মাথার উপর দিয়ে আকাশে উঠে যাওয়া সেঞ্চুরিয়নের পেট লক্ষ্য করে রিভলবার খালি করে ফেলল শন। কিন্তু কোথাও লাগল না তার বুলেট; বরঞ্চ ল্যান্ডিং হুইলস তুলে ফেলে অক্ষতভাবে ভেসে গেল সেঞ্চুরিয়ন।

ঝট করে দাঁড়িয়ে হ্যাঁঙ্গার ধরে ছুটল শন। ওয়াকবেঞ্চের উপরে থাকা টেলিফোনটাকে দেখতে পেয়েছে। “থ্যাঙ্ক গড়!” বেঞ্চের কাছে গিয়েই ছো মেরে ফোন তুলে নিল শন্।

ক্যাপরিকর্ণের নাম্বার ডায়াল করতে করতেই হাতের নিচে খোলা ম্যাপ আর ব্যান্ড ইস্টার শো’র ব্রোশিউর দেখতে পেল। শো-গ্রাউন্ডের লোকেশন আর বাতাসের গতি’কে রেডমার্ক দিয়ে সার্কেল করা আছে।

তৃতীয় বার রিং হতেই উত্তর দিল সুইচবোর্ডের অপারেটর “ক্যাপরিকর্ণ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ’ গুড ডে, হাউ মে আই হেল্প ইউ?”।

“আমি বোর্ডরুমে মি: গ্যারি কোর্টনির সাথে কথা বলতে চাই। আমি উনার ভাই আর দিস ইজ অ্যান ইমারজেন্সি।”

“উনি আপনার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছেন। এক্ষুণি লাইন দিচ্ছি।”

 অপেক্ষা করতে করতে দ্রুত হ্যাঙ্গারের চারপাশে চোখ বোলালো শন্। দরজার পাশে দেয়ালে ঝুলে থাকতে দেখল সেফটি স্যুটস।

“শন, তুমি?” গ্যারির গলায় টান টান উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেল।

“হ্যাঁ, আমি। এখনো ফারগ্রোভে। যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হয়েছে। মাইকেল, বেন আর শিয়ালটা। টার্গেট হচ্ছে শো-গ্রাউনড।”

“ওদেরকে থামাতে পারোনি শন?”

“না। মাইকেল আর ফক্স প্লেন নিয়ে ভেগে গেছে। দুই মিনিট আগেই টেক অফ করেছে। নিশ্চিত শো-গ্রাউন্ডের দিকেই যাচ্ছে।”

“তুমি নিশ্চিত, শন?”

“অফ কোর্স অ্যায়াম ব্লাডি সিউর। আমি এখন মিকি’র হ্যাঙ্গারে, ম্যাপের দিকে তাকিয়ে আছি। শো, গ্রাউন্ডস আর বাতাসের গতি মার্ক করে রাখা হয়েছে। দেয়ালে ঝুলছে দুটো স্মোক-প্রুফ স্যুট। এগুলোকে তুলে নেয়ার সুযোগ পায়নি।”

“আমি পুলিশ আর এয়ারফোর্সকে সতর্ক করে দিচ্ছি।”

“বোকার মতো কথা বলো না, গ্যারি। ফাইটার অথবা হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠানোর জন্য ডিফেন্স ফোর্সের চিফ আর মিনিস্টারের অর্ডার লাগবে আর তা করার জন্য মাসখানেক কেটে যাবে। এই ফাঁকে মারা যাবে দুই কোটি মানুষ।”

“এখন তাহলে কী করব, শন?” এতক্ষণে পথে এসেছে গ্যারি! “কুইন এয়ার নিয়ে আকাশে উঠে পড়ো” জানাল শন। “ছোট্ট সেঞ্চুরিয়নের চেয়ে এটা বেশি বড়, শক্তিশালী আর দ্রুত। তাই সেঞ্চুরিয়নের গতি রোধ করে নিচে নামতে বাধ্য করতে পারবে।”

“মিকি’র সেঞ্চুরিয়ন দেখতে কেমন?” ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল গ্যারি।

“উপরে নীল। পেট সাদা। মার্কিংস হলো জেড এস-আর আর ডব্লিউ। রোমিও রোমিও হুইস্কি। ফারগ্রোভের লোকেশন জানো তুমি, আর সেই কোর্স ধরে শো’র দিকে যাও।”

“আমি এক্ষুণি রওনা দিচ্ছি।” ক্লিক করে কেটে গেল গ্যারির কানেকশন।

বেঞ্চের উপর থেকে নিজের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন তুলে নিল শন চেম্বার থেকে ফেলে দিল খালিকেস। পকেট থেকে গুলির বক্স বের করে দ্রুত আবার রিলোড করে নিল। হাতে উদ্যত রিভলবার নিয়েই দৌড়ে দিয়ে লাথি মেরে খুলে ফেলল দরজা। আর সাথে সাথে হাটু গেড়ে বসে বসে রিভলবার তাক করল সামনের দিকে।

 মারা যাবার আগে অথর্ব পা দুটোকে টেনে নিয়ে মাত্র কয়েক গজ যেতে পেরেছে বেন। তারপরই দলা মোড়া পাকিয়ে পড়ে গেছে পিচ গাছের নিচে। অসম্ভব রক্তপাত হওয়াতে ভিজে গেছে শার্ট আর ট্রাউজারের উপরিভাগ। তাল পাকানো মাংসের মতো ঝুলছে বাম হাত কাটা চামচের মতো দেহের মাঝে গেঁথে গেছে ভাঙ্গা হাড়ের টুকরো।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন তুলে নিল শন্। দরজা দিয়ে বেরিয়ে তাকাল বে’নের দিকে।

 এখনো বেঁচে আছে বেন। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে তাকালো শনের দিকে। পোড়া চিনির মতো বাদামি চোখ জোড়া যেন জ্বলছে।

“ওরা চলে গেছে, তাই না?” ফিসফিস করে বলে উঠল বেন, “ওরা সফল হবেই, তুমি আমাদেরকে থামাতে পারবে না। ভবিষ্যৎ এখন আমাদের হাতে।”

 গাছপালার মধ্য দিয়ে দৌড়ে এলো বেলা। শ’কে দেখতে পেয়েই ওর দিকে দৌড় লাগালো।

“আমি না তোমাকে লুকিয়ে থাকতে বলেছিলাম” গর্জন করে উঠল শন্। “কথা শোন না কেন কখনো?”

বেন’কে দেখতে পেয়েই থেমে গেল বেলা।

“ওহ্ গড! ইটস বেন। তুমি ওর সাথে কী করেছ?” শনের পায়ের কাছে পড়ে থাকা বে’নের দিকে এগোতে গিয়ে হাঁটু ভেঙে ধপ করে বসে পড়ল বেলা।

আস্তে করে কোলের উপর বে’নের মাথা তুলে নিল; কিন্তু এই সামান্য নড়াচড়াতেই আহত ফুসফুস নিয়ে কাশতে শুরু করল বেন। ভোলা মুখ আর চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল মুখ ভর্তি রক্ত।

“ওহ্ গড, শন। তুমি ওকে মেরে ফেলেছ!” ফুফিয়ে উঠল বেলা।

“তাই তো মনে হচ্ছে” নরম স্বরে জানাল শন। “সমস্ত হৃদয় দিয়েও আমি তাই চাই।”

 “শন, ও আমাদের ভাই”

“না” সোজা-সাপ্টা জবাব দিল শন, “ও আমার ভাই নয়; কেবল একটা জঘন্য মাংসের দলা।”

***

কুইন এয়ারের ইঞ্জিন চালু করতে করতেই হিসাব করে ফেলল গ্যারি কোর্টনি।

ফারগ্রোভের চেয়েও শোগ্রাউন্ডস ক্যাপরিকর্ণের ষাট মাইল কাছাকাছি আর কুইন এয়ার সেঞ্চুরিয়নের চেয়ে সতুর কিংবা আশি নট দ্রুততর হওয়াতে মাত্র নয় মিনিটে মিকি আর কতটা গেছে!

তার মানে প্রায় মাইকেলের কাছে চলে এসেছে। অন্য কোনো কথা ভাবার দুঃসাহস না করে সোজা শো গ্রাউন্ডের কোর্স ধরল গ্যারি। তারপর ঘুরে গিয়ে মাইকেলের গতি রোধ করার চেষ্টা করবে।

 থ্রটল খুলে রানওয়ে ধরে কুইন এয়ার নিয়ে ছুটতে গিয়েও খানিকটা আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল যে দাঁতের ফাঁকে আটকে আছে হাফ স্মোকড় সিগার। এয়ারক্রাফটের পিছু ধাওয়া করার কথা ভাবতে ভাবতে ভুলে গেছে বাকি সবকিছু। জোড়া ইঞ্জিনের বিশাল মেশিন আকাশে তুলেই গভীরভাবে সিগারে টান দিল গ্যারি। হাভানা থেকে অত্যন্ত উৎকৃষ্টমানের সিগারাটা যেন ভাগ্যেরই পরিহাস। ধোয়ার সুগন্ধে খানিকটা শান্ত হলো নার্ভ।

“শনের মতো এ ব্যাপারে আমি ততটা দক্ষ নই” নিজেকেই যেন শোনাল গ্যারি, “এর চেয়ে স্টক একচেঞ্জ কিংবা ব্লাডি টেক ওভার ডি দিয়েই দেখুক না।” ম্যানুয়ালের উপর চাপ দিয়ে কুইন এয়ারের ভেতর থেকে নিংড়ে বের করে নিল আরো বাড়তি পনের নট।

 প্রায় সাত মাইল দূর থেকেই দেখতে পেল শো গ্রাউন্ডস। রঙিন তিমি’র মতো উড়ছে বেলুনের বিশাল একটা স্তূপ। কারপার্কে থাকা হাজার হাজার গাড়ির গা থেকে ঠিকরে পড়ছে সূর্যরশ্মি।

ঘুরে গিয়েই কুইন এয়ার নিয়ে সোজা ফারগ্রোভের দিকে ছুটল গ্যারি। নিজের আসনে ঝুঁকে বসে উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে আর কষে টান দিচ্ছে পুরু সিগারে। মাথার ভেতরে বইছে চিন্তার ঝড়। এখনো হিসাব করছে গতি, সময় আর দূরতু। “যদি ওদের সাথে দেখা হয় তাহলে সেটা পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মধ্যেই হবে-” গ্যারি’র চিন্তায় ছেদ পড়ল। সামনের দিক থেকে এগিয়ে আসা কিছু একটাতে সূর্যের আলো পড়তেই ঝলসে উঠল চোখ। নাকের উপরে ভালো করে বসিয়ে দিল হর্ণ-রিমড় চশমা। ভেতরে ভেতরে মায়োপিক চোখজোড়া নিয়ে রেগে উঠলেও চেষ্টা করল বস্তুটাকে খোঁজার।

আবাসিক এলাকা পেছনে ফেলে এসে এখন খোলা গ্রাম্য এলাকা দিয়ে উড়ে চলেছে গ্যারি। নিচে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট গ্রাম আর আঁকাবাঁকা রাস্তা। ফসলের জমি আর গাছপালার জন্য ফোকাস করতে কষ্ট হচ্ছে। উম্মাদের মতো চারপাশে খুঁজছে গ্যারি; আর তারপরই বুঝতে পারল সেঞ্চুরিয়ন ঠিক তার নিচে।

 প্রথমেই দেখতে পেল ছায়া। মাঠের উপর ঘাসফড়িং’র মতো লাফ দিচ্ছে। এর খানিক পরেই ছোট্ট নীল এয়ারক্রাফটটা চোখে পড়ল গ্যারি’র চেয়ে হাজার ফুট নিচে থাকলেও ঠিক দু’মাইল সামনে। বিপদজনকভাবে কুইন এয়ারের নাক নিচের দিকে নামিয়ে ডাইভ দেয়ার জন্য তৈরি হলো গ্যারি।

প্রায় পাঁচশ নট গতিতে পরস্পরের দিকে ছুটে আসছে দুটো এয়ারক্রাফট। কিন্তু কুইন এয়ার সেঞ্চুরিয়নের মতই একই উচ্চতাতে নামার আগেই নীল একটা আলোর ঝলকানির মতো পার হয়ে গেল মিকি’র এয়ারক্রাফট।

 একটা উইং’কে যতদূর সম্ভব ঘুরিয়ে সেঞ্চুরিয়নের পিছনে চলে এলো গ্যারি। চাইছে কুইন এযারের সর্বোচ্চ গতি ব্যবহার করে ছোট্ট এয়ারক্রাফটের নাগাল পেতে।

***

“দশ মিনিটের ভেতরেই পৌঁছে যাবো” রামোন’কে সতর্ক করে দিল মাইকেল। “তৈরি হয়ে যাও।”

সামনের দিকে ঝুঁকে পায়ের ফাঁকে আটকে থাকা সিলিন্ডার দুটো ধরল রামোন। খুব সাবধানে প্রতিটা বোতলের গলার কাছে থাকা ট্যাপ খুলে ফেলল। টের পেল কানেকটিটি-পিসের মেইন ভালভের গেইটে গিয়ে আটকে গেল ভেতরের বাতাস।

এবারে ভালব-লিভারে বুড়ো আঙুল ছড়িয়ে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ঘোরালেই নার্ভ গ্যাস মিক্সড হয়ে হিসহিস করে লম্বা হোস দিয়ে ছুটে সেঞ্চুরিয়নের পেট থেকে ছিটিয়ে পড়রার জন্য তৈরি হয়ে যাবে।

সিধে হয়ে বসে পাশেই পাইলটের সিটে বসে থাকা মাইকেলের দিকে তাকাল রামোন।

“অল সেট-” বলতে গিয়েও কথা শেষ করতে পারল না রামোন। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল মাইকেলের মাথার পাশের সাইড উইন্ডোর দিকে।

 পুরো জানালা জুড়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল বড় একটা রুপালি ফিউজিলাজ। তাদের সাথে একই সমান্তরালে উড়ছে আরেকটা এয়ারক্রাফট। এদিকেই তাকিয়ে আছে পাইলট। বাচ্চাদের মতো চেহারার বড়-সড় মানুষটার চোখে হর্ণ-রিমড চশমা আর মুখের এক কোণায় ঝুলছে সিগার।

“গ্যারি?” চিৎকার করে উঠল আতঙ্কিত মাইকেল। ডান হাত তুলে বুড়ো আঙুল দিয়ে নিচের দিকে ইশারা করল গ্যারি।

হঠাৎ করেই সেঞ্চুরিয়ন নিয়ে নিচের দিকে টার্ন নিল মাইকেল। উপর থেকে ছেঁড়া পাথরের মতো ধপ করে নেমে এলো গাছের মাথা বরাবর।

রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়ে দেখল মাত্র একশ গজ দূরে থাকা কুইন এয়ারের রুপালি নাকটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে। এরপর এক ধাক্কায় সেঞ্চুরিয়ন নিয়ে উপরে উঠেই আবার ঘুরে গেল। কিন্তু ততক্ষণে পাশ থেকে গুতো দিল রুপালি মেশিন। পাইলট হিসেবে গ্যারি ওর চেয়ে অনেক দক্ষ আর কুইন-এয়ারের উইং’কেও এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।

“ওর কাছ থেকে কিছুতেই পালাতে পারব না।”

“সোজা টার্গেটে উড়ে যাও।” রূঢ়ভাবে আদেশ দিল রামোন, “ওর আর কিছুই করার নেই।”

মাইকেল আশা করেছিল যে রামোন হয়ত অপারেশনটা বাতিল করবে। কিন্তু তা না করে নিজের প্ল্যানেই অটল আছে। সেঞ্চুরিয়ন নিয়ে সবচেয়ে লম্বা গাছটারও দুইশ ফুট নিচে নেমে এলো মাইকেল। ওকে অনুসরণ করে পাশেই চলে এলো গ্যারি। মাত্র এক গজ দূরত্বে সমান হয়ে আছে দুটো এয়ারক্রাফটের ডানা।

আবারো মাইকেলকে ল্যান্ড করার সিগন্যাল দিল গ্যারি। কিন্তু ওকে উপেক্ষা করে নিজের রেডিও মাইক্রোফোনটা ছোঁ মেরে তুলে নিল মাইকেল। জানে গ্যারি’র রেডিও হল ১১৮.৭ মেগাহার্টজ। “অ্যায়াম সরি, গ্যারি।” চিৎকার করে উঠল মাইকেল, “আমাকে এটা করতেই হবে, অ্যায়াম সরি।”

কেবিনের মধ্যে রেডিও স্পিকারে গর্জে উঠল গ্যারির গলা,

“এক্ষুণি ল্যান্ড করো, মিকি, একটুও কোনো দেরি হয়নি। তোমাকে এখনো এর ভেতর থেকে বের করে আনতে পারব আমরা। বোকার মতো কাজ করো না। ম্যান।”

প্রচণ্ডভাবে মাথা নাড়ল মাইকেল। ইশারায় সামনের দিক দেখাল।

শক্ত হয়ে গেল গ্যারির চোখ-মুখ। খানিকটা পিছিয়ে এসেই মাইকেল কিছু করার আগে কুইন-এয়ারের ডানার মাথা ঢুকিয়ে দিল সেঞ্চুরিয়নের লেজের ভেতর। এরপর কন্ট্রোল হুইল চেপে ধরে লম্বালম্বিভাবে সামনের দিকে ডাইভ দিল।

সেঞ্চুরিয়ন অসম্ভব নিচে থাকাতে আর ডাইভটাও বেশ খাড়া হওয়াতে কোনো কিছু করার আগেই লম্বা একটা ব্লু-গাম গাছের ডালে আছড়ে পড়ল ছোট্ট প্লেন।

হাত দুটো বাড়িয়ে দিল মাইকেল। কিন্তু পুরুষের পেশিবহুল হাতের মতই শুকনো আর মোটা একটা ডাল এসে বাড়ি খেল উইন্ডস্ক্রিনের গায়ে একটু আগেই সেখানে লেগেছিল শ’নের বুলেট। মাইকেলের গলার নিচে ঢুকে গেল গাছের ডাল। কলার বোনসের ভেতরে ঢুকে বেরিয়ে এলো শোল্ডার ব্লেডের মাঝখান দিয়ে।

এয়ারক্রাফট নিচে পড়ে যেতেই আবার সাৎ করে বাইরে বেরিয়ে গেল গাছের ডাল।

দুর্বার গতিতে গাছের মাথা দুমড়ে মুছড়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেঞ্চুরিয়ন। প্রথমে একটা আর একটু পরেই খসে পড়ল দ্বিতীয় ডানা। কমে গেল গতি। অবশেষে মাটিতে আছড়ে পড়ল ডানাবিহীন ফিউজিল্যাজ। তারপরেও ঘষে ঘষে চলে গেল ভুট্টা ক্ষেত্রে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।

বহুকষ্টে হাচোড় পাচোড় করে সিটের উপর উঠে বসল রামোন মাচাদো। এখনো বেঁচে আছে দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল। মাইকেলের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল নিঃশব্দে চিৎকার করছে খোলা মুখ। তছনছ হয়ে যাওয়া উইন্ডস্ক্রিনের উপর রক্তের ফোয়ারা ছুটছে।

সিট বেল্ট খুলে সিট থেকে উঠে পড়তে চাইল রামোন। কিন্তু না পেরে নিচের দিকে তাকাতেই দেখল বাম পা ভেঙে গেছে সিট আর গ্যাস সিলিন্ডারগুলোর মাঝখানে জড়িয়ে আছে সেদ্ধ স্প্যাগেটির মত। হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে ট্রাউজারের পা আর গোড়ালির ভেতরে এটে বসেছে স্টেইনলেস স্টিলের ভালব-হ্যান্ডেল।

 নিচের দিকে তাকাতেই গ্যাস নির্গত হওয়ার হিসহিস শব্দ শুনতে পেল রামোন। ভাঙ্গা পা খুলে দিয়েছে ভালব-হ্যান্ডেল। হোস পাইপের ভেতর দিয়ে গিয়ে ফিউজের নিচের নজল দিয়ে স্প্রে হচ্ছে সিনডেক্স-২৫।

ডোর হ্যান্ডেল ধরে নিজের সারা শরীরের ভার দিয়ে ধাক্কা দিল রামোন। কিন্তু একেবারে পাথরের মতো শক্ত হয়ে আটকে গেছে দরজা।

আহত পায়ের হাঁটুর নিচে দুই হাত রেখে বহুচেষ্টা করল বের করে আনতে। কিন্তু কোনো কাজ হল না। হাড় ভেঙে যাবার শব্দ শুনতে পেলেও ভাল-হ্যান্ডেল ছেড়ে বের হল না পা।

হঠাৎ করেই রামোনের নাকে ধাক্কা দিল আমন্ডের গন্ধ। জ্বালা করে উঠল নাক। রুপালি মিউকাস ঝরতে লাগল নাকের ফুটো দিয়ে। ঠোঁট বেয়ে চিবুকে গড়িয়ে পড়ল সিকনি। কয়লার মতো জ্বলে উঠল চোখ জোড়া, ম্লান হয়ে গেল দৃষ্টিশক্তি।

অন্ধকারের ভেতর গুঙ্গিয়ে উঠল। আর কখনো বোধ করেনি এরকম ব্যথা। আত্ম-চিৎকার শুরু করল রামোন মাচাদো। পড়ে রইল নিজের মল মূত্রের মাঝে। আর এভাবে চিৎকার করতে করতে একসময় নিঃশেষ হয়ে গেল ফুসফুসের শক্তি। নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ।

***

বনের কিনারে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ির উপর বসে আছেন সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন কুকুরের বাচ্চাটাকে নিয়ে খেলছে। নিকি।

এই কুকুর ছানাটা ওয়েল্টেভ্রেদেনের ড্যান্ডি ল্যাসের সর্বশেষ নিদর্শন। বয়স হয়ে যাওয়ায় সেনটেইন বাধ্য হয়েছেন মাদী কুকুরটাকে কবর দিতে। তবে মায়ের সমস্ত ভালো দিকগুলোই পেয়েছে ছানাটা। একদিন যে এটাও চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই।

পাপি’র মতই দ্রুত সব কিছু শিখে নিতে পারে নিকি আর কুকুর। ঘোড়ার সাথে বেশ মিশে যেতে পারে।

আসলে এটা ওর রক্তেই আছে, আপন মনে ভাবলেন সেনটেইন। ও হচ্ছে সত্যিকারের কোর্টনি, হাস্যকর স্প্যানিশ একটা নাম আর পদবী থাকলেই বা কি আসে যায়।

অন্যান্য কোটনিদের কথা ভাবতে লাগলেন সেনটেইন।

অত্যন্ত যত্ন সহকারে মেরামত করে নেয়া ছোট্ট স্লেভ চার্চে আগামীকাল বিয়ে করবেন শাসা আর এলসা পিগনাটেলি। অন্তত এক দশকের মাঝে এত বড় আর কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি উত্তমাশা অন্তরীপে। ইংল্যান্ড, ইউরোপ, ইস্রায়েল আর আমেরিকা থেকেও আসবেন সব অতিথি।

মাত্র কয়েক বছর আগে হলেও বিয়ের সমস্ত পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাপনা সেনটেইন নিজ হাতে করতে চাইতেন; কিন্তু এবারে সবকিছু বেলা আর এলসা’র হাতে ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত হয়েছেন।

 “ওরাই সামলাক সবকিছু” দৃঢ় কণ্ঠে নিজেকে শোনালেন সেনটেইন। “এবারে আমি আমার গোলাপ, কুকুর আর নিকি’কে নিয়েই ব্যস্ত থাকব।”

 বেলার কথা ভাবলেন সেনটেইন। নিজের কাজের জন্য অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়েছে বেলা। কিন্তু মাত্র এতটুকুতেই সন্তুষ্ট হননি সেনটেইন। নিজের এবং শাসা’র সাথে বহু তর্ক-বির্তকের পর সম্মত হয়েছেন আইনের হাত থেকে মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য।

 তারপরেও ওকে প্রায়শ্চিত করতেই হবে। এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর সেনটেইন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বেলা নিজের বাকি জীবনটা বিভিন্ন ভালো কাজ করেই শোধরাবে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য আর এই সুন্দর দেশটা যার সাথে ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তার সেবা করেই নিজের জীবন কাটাবে বেলা। প্রতিটি ঋণ যেন কানায় কানায় পরিশোধ হয়, সে ব্যাপারে আমি নিজে দেখভাল করব। ভাবলেন সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস্। নিকি’র দিকে তাকাতেই দেখলেন ওর লুকিয়ে রাখা পালকের ব্যাগটা ঠিকই খুঁজে বের করেছে কুকুর ছানা। বিজয়নীর ভঙ্গিতে লম্বা সিল্কের লেজখানা নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এলো ইয়াং মাস্টারের কাছে।

অবশেষে কুকুর ছানা আর নিকি এসে বসল সেনটেইনের পায়ের কাছে। রোদে পোড়া উদোম হাত দিয়ে পাপি’র গলা ধরে আছে নিকি। আরেক হাত দিয়ে সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরল। “তুমি পাপি’র জন্য এখনো কোন নাম ঠিক করোনি?” জানতে চাইলেন সেনটেইন। প্রায় দুই বছর লেগে গেছে ছেলেটার মন পেতে আর এখন অনুভব করলেন যে অবশেষে আদ্রা আর তার গত জীবনের স্মৃতি ভুলতে পেরেছে নিকি

“হ্যাঁ, নানা। আমি ওকে টুয়েন্টি সিক্স ডাকতে চাই” ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স জুনিয়র স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবার পর থেকে নিকি’র ইংরেজি খুব দ্রুত আরো উন্নত হচ্ছে।

 “এটা তো বেশ অদ্ভুত একটা নাম, এই নামটাকেই কেন বেছে নিলে?”

“অনেক আগে আমার একটা কুকুর ছিল-ওটার নাম ছিল টুয়েন্টি সিক্স।” অথচ সে সময়কার স্মৃতি আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে।

“হুম, ঠিক আছে-বেশ সুন্দর নাম। ড্যান্ডি টুয়েন্টি সিক্স অব ওয়েল্টেভেদেন।”

“ইয়েস! ইয়েস!” টুয়েন্টি সিক্সের গলা জড়িয়ে ধরল নিকি? “ড্যান্ডি টুয়েন্টি সিক্স।”

নিকি’র প্রতি স্নেহে আদ্র হয়ে উঠল সেনটেইনের হৃদয়। ছেলেটার মানসিক অবস্থা এখনো বেশ অগোছাল হলেও ওর শিরা-উপশিরায় বইছে চ্যাম্পিয়নদের রক্ত।

 খানিকটা সময় লাগবে, ভাবলেন সেনটেইন। ওর সাথে আরেকটু বেশি সময় কাটাতে হবে।

 “তোমাকে একটা গল্প শোনাব, নিকোলাস?” সেনটেইনের কাছে আছে মজার সব পারিবারিক কাহিনী; সিংহ আর হাতি শিকারের গল্প; বোয়া, জুলু আর জার্মানদের সাথে যুদ্ধের কথা; হারিয়ে যাওয়া হীরের খনি আর ফাইটার প্লেন সহ এমন হাজারো ঘটনা যা ছোট্ট একটা ছেলের মাঝে গড়ে তুলবে উত্তেজনা আর বিস্ময়বোধ।

এবারে নিকি’কে এক ভাঙ্গা জাহাজ আর সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া মানুষের গল্প শোনালেন সেনটেইন। শোনালেন নিষ্ঠুর মরুভূমির মধ্যে ছোট ছোট হলুদ খুদে পরীদের ভ্রমণের কাহিনী-আর ওদের সাথে সাথে হেঁটে গেল গল্পে বিভোর নিকি।

অবশেষে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন সেনটেইন : “আজকের জন্য যথেষ্ট হয়েছে, ইয়াং মাস্টার নিকোলাস। আমাদের কী হয়েছে ভেবে ভেবে চিন্তায় পড়ে যাবে তোমার মা।”

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নানা’কে উঠতে সাহায্য করল নিকি। দু’জনে মিলে পাহাড়ের নিচ দিয়ে হেঁটে চলল বিশাল বড় বাড়িটার দিকে। মাঝখানে তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে টুয়েন্টি সিক্স।

 সেনটেইনের পায়ে ব্যথা থাকাতে সকলেই আস্তে আস্তে হাঁটছে। উঁচু নিচু পথে নানা’র হাত ধরে সাহায্য করছে নিকি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *