৪.০১ ইরাক ছিল ইরানের একটি প্রদেশ

এক ॥

সে সময় ইরাক ছিল ইরানের একটি প্রদেশ। প্রখ্যাত যুদ্ধবাজ এবং নির্ভীক সেনাপতি হুরমুজ ছিল তার গভর্নর বা শাসক। জালেম এবং দুশ্চরিত্রবাজ হিসেবেও সে সমান কুখ্যাতি লাভ করেছিল। জুলুম এবং অভদ্রতার প্রবাদে পরিণত হয় তার নাম। সমাজে কেউ অভদ্রতা কিংবা অসদাচারণ করলে মানুষ তাকে এই বলে ভর্ৎসনা করত যে, “সে হুরমুজ থেকেও অভদ্র ও জঘন্য।”

দজলা এবং ফোরাতের মোহনায় পুনর্বাসিত সংখ্যালঘু মুসলমানরাই ছিল হুরমুজের অকথ্য নির্যাতনের করুণ শিকার। মুসলমান হওয়াটাই ছিল হুরমুজের দৃষ্টিতে তাদের অপরাধ। কোন ইরানীর হাতে কোন মুসলমান নিহত হওয়া কিংবা কোন মুসলিম নারীকে অপহরণ হুরমুজের কাছে কোন অপরাধই ছিল না। মুসলমানদের কষ্ট দিয়ে, সামান্য বাহানায় তাদের ঘর-বাড়ী লুট এবং জ্বালিয়ে দিয়ে খ্রিস্টানদের মত ইরানীরাও পৈশাচিক স্ফুর্তি করত। মুসলমানদের জীবন কাটত ভীতি আর আতংকের মধ্য দিয়ে।

মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার জমি স্বর্ণ প্রসব করত। তরি-তরকারী এবং ফল-মূল উৎপাদনে এলাকাটি বড়ই উর্বর ও উপযোগী ছিল।

সবুজের সমারোহ, বৈচিত্র্য ফুলের বাহার, ফলের মিষ্টি সুবাস, পাখিদের কলকাকলি, আকাশের নিলীমা, মৃদুমন্দ হাওয়া, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, দজলার কলতান, ফোরাতের উর্মিমালা ছাড়াও প্রাকৃতিক অপূর্ব শোভার কারণে ৩০০ মাইল আয়তনের সেই এলাকাটি নয়নাভিরাম নৈসর্গিক একটি ভূখণ্ড ছিল। মানুষ রাজধানীতে বাস করলেও তাদের হৃদয়ে গাঁথা থাকত এই এলাকার ভূবনমোহিনী রূপ। তাই শাসকশ্রেণী সুযোগ পেলেই এই এলাকায় অবকাশ যাপন করতে আসত এবং দীর্ঘদিন তার মায়ায় কাটিয়ে দিত। আরাম-আয়েশ আর স্বাচ্ছন্দময় জীবনযাপন করতে মুসলমানদের এখানে পুনর্বাসিত করা হয় নাই; বরং চাষাবাদের মাধ্যমে এলাকাকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখতে তাদের এখানে রাখা হয়। তারা রাত-দিন কঠোর পরিশ্রম আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটির বুক চিরে সোনার ফসল ফলাত, তরি-তরকারি আর ফল-মূল উৎপাদন করত। কিন্তু এ ফসল তাদের বাড়ী-ঘরে যেত না। জীবিত থাকার জন্য যতটুকু না হলে নয় ঠিক ততটুকুই তারা লাভ করত মাত্র। অবশিষ্ট ফসলের সবই চলে যেত শাসকের ঘরে এবং ইরানী ফৌজের পেটে। মুসলমান চাষীদের জন্য দরিদ্রতা এবং ইরানীদের ঘৃণাই শুধু রয়ে যেত।

মুসলিম সংখ্যালঘুরা যুবতী কন্যাদেরকে গৃহে লুকিয়ে রাখত। কারণ, কোন ইরানী সৈন্যের দৃষ্টি যদি কোন মেয়ের উপর পড়ত আর তাকে তার ভাল লাগত তবে যে কোন বাহানা দিয়ে অথবা সে পরিবারের প্রতি কোন অপবাদ আরোপ করে তাকে সাথে নিয়ে চলে যেত। কোন বাহানা ছাড়াই ইরানী সৈন্যরা মুসলিম যুবতীদের জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু গোলামীর জিঞ্জিরে শৃঙ্খলিত এবং নির্যাতনের পাত্রে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের মাঝে আত্মমর্যাদাবোধ ঠিকই জাগ্রত ছিল। প্রথম দিকে জোরপূর্বক অপহরণের ঘটনা ঘটতে থাকলে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধভাবে দু’তিন সৈন্যকে ধরে হত্যা করে ফেলে। কন্যা বাঁচাতে গিয়ে ফৌজ হত্যার মত গুরুতর অপরাধের জন্য তারা কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হলেও জোরপূর্বক অপহরণের প্রক্রিয়া এখানেই থেমে যায়।

অগ্নি উপাসক ইরান সম্রাট ফৌজদেরকে ষাঁড়ের মত পালত। প্রতিটি সৈন্য বর্মাচ্ছাদিত হত। মাথায় ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ এবং বাহুতে লোহার পোষাক এমনভাবে ফিট করত যে, বাহু নাড়াতে কোনরূপ অসুবিধা হত না। তাদের হাঁটুর নিম্নাংশও ভারী চামড়া অথবা অন্য কোন ধাতুর মাধ্যমে হেফাজত করত।

অস্ত্র-শস্ত্র ছিল বিপুল। প্রতিটি সৈন্যের কাছে একটি তলোয়ার, একটি বর্শা এবং একটি লৌহগদা অবশ্যই থাকত। লৌহগদা চালনায় ইরানীরা অত্যন্ত দক্ষ ছিল। এছাড়া প্রত্যেক সৈন্যের কাছে একটি ধনুক আর ৩০টি তীর সমৃদ্ধ একটি তূণীর থাকত। আয়েশী জীবন-যাপন, যথেচ্ছা পানাহার ও লুটতরাজের অবাধ অনুমতি ছিল তাদের। বীরত্ব এবং রণযোগ্যতায় তারা বাস্তবিকই প্রশংসার উপযুক্ত ছিল। তাদের দুর্বলতা বলতে যা ছিল তা হলো, তারা সামনা-সামনি যুদ্ধ করতে বেশ পারঙ্গম ছিল এবং যুদ্ধও করত প্রাণপণে। কিন্তু এত যুদ্ধাস্ত্র সাথে থাকায় তারা স্বাচ্ছন্দে নড়াচড়া করতে পারত না। একটি ইউনিট কিংবা একটি বাহিনী তড়িৎ এক স্থান হতে অপর স্থানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে তারা কাঙ্ক্ষিত সময়ে সেখানে পৌঁছতে পারত না। এত অস্ত্রপাতির বোঝা তাদেরকে অতি দ্রুত ক্লান্ত করে ফেলত। কিন্তু সৈন্য সংখ্যার বিপুলতার দরুণ তাদের এই দুর্বলতা ধরা পড়ত না।

দজলা এবং ফোরাতের মোহনার দক্ষিণে ইরাক এবং আরবের সীমান্তবর্তী এলাকা ছিল ‘উবলা’। তৎকালে উবলা একটি বড় নগরী ছিল। এর আশেপাশের অঞ্চল অত্যন্ত শস্য-শ্যামল ও উর্বর ছিল। সেখানে সুন্দর-সুন্দর গাছপালা এবং আকর্ষণীয় পাহাড়ও ছিল। ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান এটা। আজও সেখানে বিধ্বস্ত ভবনের অংশ বিশেষ কালের ইতিহাস আগলে ধরে অসহায়ভাবে দাড়িয়ে আছে। এ সমস্ত বিরান ধ্বংসাবশেষ নীরব ভাষায় ইতিহাস বর্ণনা করে শোনায়। প্রত্যেকটি ইতিহাস শিক্ষনীয় ছবকে ভরপুর।

যারা ভোগ-বিলাসকে জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছিল এবং প্রজাদেরকে মানুষের কাতার থেকে বের করে দিয়েছিল এ এলাকায় সে সমস্ত জাতির ধ্বংস এবং বিপর্যয়ের নিদর্শনও আছে। আল্লাহ তাদের হেদায়েতের উদ্দেশ্যে রাসূল প্রেরণ করলে তারা তাদেরকে বিদ্রূপের পাত্র বানায় এবং বলে, তুমি তো আমাদের মতই একজন মানুষ বৈ নও। দুনিয়ায় তোমার কোন প্রতিপত্তি বা সামাজিক মর্যাদাও নেই। তাহলে কিভাবে তুমি আল্লাহ্‌র পয়গম্বর হয়ে গেলে?

পরিশেষে আল্লাহপাক তাদেরকে এমনভাবে পাকড়াও ও ধ্বংস করেছেন যে, তাদের মহল আর বসতি এলাকা লণ্ডভণ্ড এবং ভগ্ন প্রাসাদে পরিণত হয়েছে। আল্লাহপাক তাদের কথা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন। এক স্থানে এসেছেঃ

“তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি? করলে দেখত, তাদের পূর্ববর্তীদের কি পরিণাম হয়েছে। তারা তাদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি এবং কীর্তিতে অধিক প্রবল ছিল…।”(সূরা মুমিন-৮২)

“বলুন, পৃথিবী পরিভ্রমণ কর এবং দেখ অপরাধীদের পরিণতি কি হয়েছে।” (সূরা নমল-৬৯)।

“তোমরা কি প্রতিটি উচ্চ স্থানে অযথা নিদর্শন স্থাপন করছ এবং বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করছ, যেন তোমরা চিরকাল থাকবে?” (সূরা শোআরা-১২৮-১২৯)

সেদিন তাদের অবাধ্যতার কারণে গযব নাযিল হওয়ায় তাদের যে প্রাসাদ ও মহল ভূতলে ধসে গিয়েছিল আজ সে সমস্ত জীর্ণ মহল ও বিধ্বস্ত স্মৃতিসৌধ জ্বলন্ত ইতিহাস হয়ে বের হচ্ছে।

তাদের পরেও অনেক অর্বাচীন সম্রাট এসেছে এবং একের এক ভগ্ন প্রাসাদ উপহার দিয়ে প্রস্থান করেছে। ড়গাবেল প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ভূখণ্ডে অতীতে আশুরী এসেছে, সামানী এসেছে। তারা দোর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব করে ইতিহাস হয়ে গেছে। বর্তমানে মদীনায় হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফত চলাকালে দজলা এবং ফোরাতের এই অপরূপ নৈসর্গ ও ঐতিহ্যবাহী ভূখণ্ডে ইরানীদের একচ্ছত্র দাপট চলছিল। অগ্নি উপাসক এই অর্বাচীন জাতিও প্রাগুক্ত জাতিদের মত বিদ্যমান ঐশ্বর্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তিকে চিরস্থায়ী জ্ঞান করতে থাকে। ক্ষণস্থায়ী দাপটে তাদের মাঝে অহমিকার সৃষ্টি হয়। প্রজাদের রীতিমত খোদা বনে যায়।

দুই

এক তরুণী স্বীয় বান্ধবীকে জিজ্ঞাসা করছিল–“বিনতে সাউদ! খুদ্দাম এখনও আসেনি?”

জোহরা বিনতে সাউদের চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

বান্ধবী জোহরাকে বলে–“তুমি বলেছিলে সে তোমাকে ধোঁকা দিবে না। আল্লাহ্ না করেন, সে যেন ঐ নরপিশাচ ইরানীর খপ্পরে আবার না পড়ে।”

জোহরা বিনতে সাউদ বলে–আল্লাহ্ পাক না করুন, সে নিশ্চয়ই আসবে।… চারদিন পার হয়ে গেছে।…ঐ ইরানীর সাথে যাওয়া আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না। মৃত্যুকে বরণ করে নিব তবুও তাকে গ্রহণ করব না। খুদ্দাম আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না।”

বান্ধবী বলে–জোহরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ইরানী কমান্ডারকে মেনে নেওয়াই কি সঙ্গত নয়? তোমার পরিবারের জন্যও এটা মঙ্গলজনক হবে। মূল সমস্যা যেটা তাহলো তোমার ধর্ম-বিশ্বাস পরিবর্তন করতে হবে, তবে সারাটা জীবন কিন্তু বেশ আয়েশেই কাটিয়ে দিতে পারবে।”

জোহরা দৃঢ় কণ্ঠে বলে–“আমি যে আল্লাহ্‌র পরিচয় পেয়েছি কেবল তারই ইবাদত করে যাব। অগ্নি আল্লাহ তায়ালাই সৃষ্টি করেছেন। সে নিজে সৃষ্টি হয়ে আবার স্রষ্টা হয় কিভাবে? আমি আল্লাহ্‌র বর্তমানে অন্য কোনকিছুর পূজা করব না।”

“ভেবে দেখ জোহরা!” বান্ধবী বলে–তুমি স্বেচ্ছায় তাকে বরণ না করলে সে তোমাকে জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাকে বাধা দেয়ার সাধ্য কারো নেই। শাহী ফৌজের কমান্ডার সে। তোমার পরিবারের শিশুদেরও পর্যন্ত সে বন্দী করাতে পারে। আমিও তো মুসলিম কন্যা। আমি আল্লাহরই ইবাদত করি এবং তার নামেই শপথ করি। কিন্তু আল্লাহ আমাদের কোন সাহায্যে এলেন? তুমি নিশ্চিত বলতে পার যে, আল্লাহ অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবেন?

শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য না পেলে নিজের প্রাণ নিজে হরণ করব” জোহরা বলে– এবং আল্লাহকে বলব, এই নিন। আমার দেহে আপনি প্রাণ সংহার করে থাকলে তা ফিরিয়ে নিন। এরপর অঝোর ধারায় তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।

জোহরা তার মত এক সুন্দর নবযুবক খুদ্দাম বিন আসাদের প্রতি আসক্ত ছিল। খুদ্দামও তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। তাদের বিবাহ হতে পারত কিন্তু শিমুর নামে এক ইরানী কমান্ডার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি জোহরা বিনতে সাউদের উপর পড়েছে। সে তাকে বিবাহ করার ইচ্ছা করে। শিমুর জোহরার পিতাকে বলেছে, সে চাইলে যে কোন সময় তার মেয়েকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সে এমনটি করতে চায় না।

শিমুর বলেছে–“তোমার মেয়েকে মালে গণিমত হিসেবে নিয়ে যাব না। দু’ঘোড়া বিশিষ্ট গাড়ীতে করে নিয়ে যাব, যাতে বর বধূকে নিয়ে যায়। তুমি বুক ফুলিয়ে মানুষকে বলবে, তোমার কন্যা এক ইরানী কমান্ডারের স্ত্রী।”

“কিন্তু কমান্ডার সাহেব। সাধ্যানুযায়ী আপনার যত্ন খায়ের করা আমাদের কর্তব্য। মেয়ে আপনার বধূ হতে চাইলে আমরা বাধা দিব কেন? জোহরার পিতা বলে।

ইরানী কমান্ডার ঘৃণার দৃষ্টি হেনে স্বভাবজাত কণ্ঠে বলে–“তোমরা বর্বর আরব। কন্যা জীবিত গ্রোথিতকারী জাতি তোমরা। অথচ বলছ, মেয়ে তার নিজের বিবাহের সিদ্ধান্ত নিজেই নিবে। বাহ্! চমৎকার। জরথুস্ত্রের শপথ! তোমার কন্যা যদি আমাকে বরণ না করে তবে তোমাকে এবং তোমার কন্যাকে কুষ্ঠরোগী যেখানে আবদ্ধ থাকে সেখানে বন্দী করে রাখব।…দ্রুত সিদ্ধান্ত নাও। বেশী সময় তোমাকে দিব না বুড়ো!”

কমান্ডারের সাথে আরো তিন অশ্বারোহী সৈন্য ছিল। তারা বিকট আওয়াজে অট্টহাসি হেসেছিল।

এক সেপাই তাকে ধাক্কা দিয়ে বলেছিল–“মদীনা অনেক দূর অপদার্থ বুড়ো! তোমার আমীরুল মু‘মিনীন তোমাকে সাহায্য করতে আসবে না।”

জোহরার পিতা আর তার ভাই ভাল করেই জানত যে, ইরানের এক সামান্য সেপাইয়ের নির্দেশ লঙ্ঘন করার ক্ষমতা তাদের নেই। আর এ তো এক কমান্ডার। বড় মাপের লোক। তারা এও জানত যে, শিমুর তাদের আদরের দুলালীকে জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে গেলেও তাদের করার কিছু থাকবে না। কিন্তু অত্র এলাকার মুসলমানদের অন্তরে অগ্নিপূজকদের প্রতি যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছিল সংখ্যালঘু হিসেবে তারা ইরানী সরকারের গোলাম হলেও এই নরপিশাচদের গোলামী না করতে তারা তাদের জোর বাধা দিচ্ছিল। তাই এর পরিণাম যতই ভয়াবহ হোক না কেন, আল্লাহর উপর তাদের অগাধ আস্থা ছিল।

***

জোহরা এবং খুদ্দামের প্রীতি সাক্ষাৎ রুখবার কোন উপায় ছিল না। তারা উভয়ে ক্ষেতে কাজ করত। যেদিন শিমুর জোহরাদের বাড়ীতে গিয়েছিল তার আগের দিন জোহরা খুদ্দামের সাথে দেখা করে এবং ভীতকণ্ঠে খুদ্দামকে জানায় যে, ইরানী কমান্ডার তাকে ও তার পিতাকে বিভিন্ন হুমকি প্রদান করছে।

জোহরা জিজ্ঞাসা করে–“আমরা এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারি?”

খুদ্দাম গম্ভীরভাবে জবাব দেয়–“না। আমরা দু’জন অজানার পথে পাড়ি দিলে এই ইরানী নরপিশাচ তোমার এবং আমার পরিবারের ছোট-বড় সকল সদস্যকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করবে।”

জোহরা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করে–“তাহলে উপায় কি হবে?”

জোহরা দাঁতে দাঁত চেপে আওড়ায় এবং বলে–“খোদা! খোদা! যে খোদা আমাদের সাহায্য করতে পারে না…।”

খুদ্দাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে–“জোহরা! খোদা অনেক সময় বান্দাকে পরীক্ষায় ফেলেন, বান্দা কখনো খোদার পরীক্ষা নিতে পারে না।” এরপর খুদ্দাম গভীর চিন্তায় ডুবে যায়।

জোহরা উদাস কণ্ঠে বলে–“এটা তো সম্ভব নয় যে, তুমি এই অগ্নিপূজকদের মোকাবিলা করবে।”

খুদ্দাম গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে। কোন উত্তর দেয় না। যেন জোহরার কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশই করেনি।

কি চিন্তা করছ? জোহরা তার পক্ষ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে বলে–“তুমি লোকটিকে হত্যা তো করতে পার! আমাদের সামনে পথ এখন এই একটিই খোলা।

খুদ্দাম তাকে আশ্বস্ত করে বলে–“আল্লাহ্ পরিস্থিতি উত্তরণের পথ দেখিয়ে দিবেন।”

জোহরা বলে–“আরেকটি পথের সন্ধান তোমাকে আমি দিতে পারি। নিজের তলোয়ার দ্বারা আমাকে মেরে ফেলে তুমি বেঁচে থাক।”

খুদ্দাম বলে–“একটু কুরবানী তো করতেই হবে। শিমুর প্রতি তোমার অন্তরে পুঞ্জীভূত ঘৃণার অনুমান আমি ঠিকই করছি। কিন্তু আপাতত তুমি তার সাথে কৃত্রিম এই আচরণ করে যাও যে, তুমি তাকে ভালবাস। কটা দিন তাকে প্রতারণায় ফেলে ঠেকিয়ে রাখ। কিছুদিনের জন্য আমি গায়েব হয়ে যাব।”

জোহরা চমকে জিজ্ঞাসা করে কোথায় যাবে? আর কি করতেই বা যাবে?

খুদ্দাম সতর্ক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে–সব কথা জানতে চেয়ো না জোহরা! খোদায়ী সাহায্য লাভ করতে আমি যাচ্ছি।

জোহরা তার কাঁধে হাত রেখে বলে–“খোদার কসম খুদ্দাম! তুমি আমাকে ধোঁকা দিলে আমার প্রেতাত্মা তোমাকে নিশ্চিত বেঁচে থাকতে দিবে না। আমৃত্য তোমাকে পেরেশান করতে থাকবে। একদিনের জন্য আমি ঐ কাফেরের স্ত্রী হতে পারব না। তার সাথে বিবাহ হওয়ার অর্থ আমার থেকে শুধু তুমিই নও, আমার ধর্মবিশ্বাসও হারিয়ে যাবে।”

খুদ্দাম দৃঢ়তার সাথে বলে–“ধর্মের প্রতি তুমি এত আস্থাশীল ও মজবুত হয়ে থাকলে নিঃসন্দেহে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন।”

জোহরা নিরাশ কণ্ঠে বলে–“খুদ্দাম! ধর্মের প্রতি আমি ঠিকই মজবুত কিন্তু আল্লাহর ব্যাপারে আমার বিশ্বাস ক্রমেই শিথিল হয়ে যাচ্ছে।”

খুদ্দাম আরো কিছু বলতে মুখ খুলেছিল কিন্তু এরই মধ্যে বাগিচায় কর্মরত শ্রমিকদের মাঝে হুটোপুটি শুরু হয়ে যায়। তিন-চার সাথী শ্রমিক খুদ্দামকে ডাক দেয়। জোহরা দ্রুত উঠে পড়ে ঘন গাছ-গাছালির মধ্য দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। খুদ্দাম দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি জানতে চেষ্টা করে। কিছু দূরে ইরানী কমাণ্ডারকে ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখে। সে দূর থেকেই শ্রমিকদের লক্ষ্য করে হাঁক ছাড়ে যে, খুদ্দামকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। খুদ্দাম শম্ভুক গতিতে শিমুরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

খুদ্দামকে ধীরগতিতে আসতে দেখে শিমুর ঘোড়া থামিয়ে দূর থেকে বলে–“দ্রুত আস।”

খুদ্দামের চলনে পরিবর্তন আসে না। যথারীতি শ্লথ। শিমুর পুনরায় গর্জে ওঠে তাকে দ্রুত পা চালাতে বলে। খুদ্দাম নিজ গতিতেই চলতে থাকে। শিমুর ঘোড়া থেকে লাফিয়ে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ায়। বাগিচার অসহায় শ্রমিকরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আজ শিমুর খুদ্দামের হাড়-গোড় ভেঙ্গে এক করে দিবে। কিন্তু পরক্ষণে সবাই রাজ্যের বিস্ময় চোখ করে অবলোকন করে যে, খুদ্দাম তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে শিমুর তাকে আক্রমণ করা তো দূরের কথা তার প্রতি হাত পর্যন্তও তোলে না।

শিমুর অবজ্ঞার কণ্ঠে খুদ্দামকে বলে–“শোন্ ইতর প্রাণী! আমি তোর বাপ এবং তোর যৌবনের উপর রহম করছি। এর পরে আর কোনদিন যেন তোকে ঐ মেয়ের সাথে না দেখি।”

খুদ্দাম সাহসে ভর দিয়ে জানতে চায়–“দেখলে কি করবেন?”

শিমুর বলে– তাহলে তোর মুখে কেবল এক-দুই থাপ্পড়ই মারব না। তোকে গাছের সাথে উল্টে ঝুলিয়ে বেঁধে রাখব। দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে।”

শিমুর এ কথা বলে আর অপেক্ষা করে না। এক লাফে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে এবং ঘোড়া হাঁকিয়ে দেয়। খুদ্দাম সেখানেই দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে থাকে। যতক্ষণ তার ঘোড়া চোখের আড়াল না হয়ে যায় অপলক নেত্রে তার গমন পথে চেয়ে থাকে।

তাকে এভাবে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটি কণ্ঠ ডেকে বলে–“খুদ্দাম! এদিকে এস।”

এদিক-ওদিক থেকে আরো ৩/৪টি কণ্ঠের আহবান তার কানে পৌঁছে–“এসে পড় খুদ্দাম! চলে আস।”

সে উল্টো পায়ে পিছনে ঘোড়ে এবং আহবানকারী সাথী শ্রমিকদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। শিমুর তাকে কি বলে গেল তা সবাই জানতে চায়। খুদ্দাম সব খুলে বলে। ইরানী কমান্ডার খুদ্দামের প্রতি কেন এত বিরাগ তা সকলের জানা ছিল। যদি তারা পরাধীন না হয়ে স্বাধীন জাতি হত, ইসলামী রাষ্ট্র হত এবং সামাজিক কালচার মুসলিম ঐতিহ্যবাহী হত, তবে এক তরুণীকে এভাবে কাছে বসিয়ে আলাপচারিতার জন্য অবশ্যই তারা খুদ্দামকে ভর্ৎসনা করত। কিন্তু এখানকার পরিবেশ ছিল ভিন্ন। বিধর্মী কালচার গড়ে উঠেছিল এবং চলত সবকিছু। জোহরার সাথে খুদ্দামের প্রণয় চললেও সকলের কাছে খুদ্দাম একজন সচ্চরিত্রবান যুবক ছিল। সবাই তাকে ভাল বলেই জানত। তাই খুদ্দামের প্রতি ইরানী কমান্ডারের অন্যায় আচরণে সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের মাঝে ক্ষোভ দানা বেঁধে ধূমায়িত হতে থাকে। ইরানীর বিপক্ষে সকল মুসলমান ছিল ঐক্যবদ্ধ। হঠাৎ কর্মরত এক শ্রমিক আলোচনার টেবিলে এই বলে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে যে, এই অগ্নিপূজক এ অসময়ে এখানে কি কাজে এসেছিল?

এই প্রশ্নে আলোচনা জমে ওঠে এবং কেঁচো খুড়তে সাপ বেরুনোর মত অবস্থা সৃষ্টি হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে অনেক রহস্য।

এক বিজ্ঞ কণ্ঠ বলে–“নিশ্চয়ই তাকে আনা হয়েছে। আর যে নিয়ে এসেছে সেও আমাদেরই লোক হবে নির্ঘাত।”

অভিজ্ঞ এক বয়োঃবৃদ্ধ আহবান করে বলে–“তদন্ত করে বের কর সে কে? এটি একটি ছেলে কিংবা মেয়ের প্রশ্ন নয়, জালিম আর মজলুমের ব্যাপার। এটা আজ রীতিমত আমাদের স্বাধীনতা এবং ঐতিহ্য-স্বকীয়তার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সামান্য বিষয়ে আজ যে গোয়েন্দাগিরি করেছে সে ভবিষ্যতে বড় গাদ্দারী করতে পারে।”

বিষয়টির গভীরতা ও স্পর্শকাতরতা সকলেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। এমন বিশ্বাসঘাতকতা তাদের কেউ করতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস হতে চায় না। গাদ্দারকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে-এমন দৃঢ় প্রত্যয় সকলের চোখে মুখে। হয়ত প্রত্যেকেই এর সুরাহা নিয়ে ভাবছিল। সকলের মাঝে পিনপতন নিরবতা। পুরুষের পিছনের সারিতে দাঁড়ানো এক আধা বয়সী মহিলার জবান চলমান নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিয়ে সরব হয়ে ওঠে।

মহিলা সবাইকে চমকে দিয়ে উপস্থিত সকলের চেহারায় নজর বুলায়। “আমি বলছি সে কে। সেখানে উপবিষ্ট এক ব্যক্তির প্রতি মহিলার সন্ধানী দৃষ্টি আটকে যায়। হঠাৎ সে হাত লম্বা করে তর্জনী উঁচিয়ে তার দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞাসা করে–“আবু নসর! তুমি ওখানে টিলার পশ্চাতে দাঁড়িয়ে কি করছিলে?”

আবু নসর থতমত খেয়ে যায়। সে সন্দেহ এড়াতে মুখ খুলে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। এতে সবাই বুঝতে পারে যে, ইরানী কমান্ডারের গোয়েন্দা সেই। কিন্তু সে দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় এবং অপরাধ স্বীকার করে না।

মহিলাও নাছোড় বান্দা সে অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ পেশ করে।

মহিলা বলে–“আমি তোমাকে ফলো করতে থাকি। তুমি হঠাৎ কাজ ছেড়ে উঠে গেলে আমার সন্দেহ হয়। টিলার আড়ালে চলে গেলে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। এরপর আমার কাছে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যায় যখন ঐ স্থান থেকে শিমুরকে বেরিয়ে আসতে দেখি।”

এক বৃদ্ধ বলে–“শোন আবু নসর! আমরা এ ভয় করি না যে, তুমি শিমুরকে এ কথাও জানিয়ে দিবে যে, আমরা তোমাকে গোয়েন্দা এবং গাদ্দার বলেছি। কিন্তু মনে রেখ ঐ অগ্নিপূজক তোমাকে মর্যাদার চোখে দেখবে না; বরং সে বলবে, তুমি তাদের গোলাম বিধায় তাদের হয়ে গোয়েন্দাবৃত্তি ও গাদ্দারী করা ফরজ।”

আবু নসরের মস্তক অবনত। সত্যের কাছে তার মিথ্যার দেয়ালের এক একটি ইট খুলে খুলে তার চোখের সামনে পড়তে থাকে। এদিকে ভর্ৎসনা আর গালির শত তীরও চতুর্দিক থেকে এসে তার সারা দেহে বিদ্ধ হতে থাকে। যার মুখে যা আসে তাই ফেলতে থাকে তার ঘাড়ে। বিদ্রূপ আর গালির তীর বর্ষণের মাধ্যমে জনতার ক্ষোভ আর ঘৃণা খতম হলে আবু নসর ধীরে মাথা উঁচু করে। তার চেহারা অশ্রুস্নাত ছিল এবং বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত দু’চোখের কোণ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে বেয়ে যাচ্ছিল। অনুতাপ-অনুশোচনা আর দগ্ধ বিজরিত এ অশ্রুর ফোয়ারা দেখে সবার মাঝে আবার নীরবতা নেমে আসে। সকলেই মনে করে, আবু নসর এখন মুখ খুলবে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত হলেও আবু নসরের কণ্ঠ কারো কানে ভেসে আসে না। থমথমে পরিবেশ। বাকরুদ্ধ কণ্ঠ। অবনত চাহনী।

মুরুব্বী পর্যায়ের এক লোক জিজ্ঞাসা করে–“তুমি কত মূল্য পেতে?”

দীর্ঘশ্বাস নেয়ার ভঙ্গিতে আবু নসর বলে–“কিছুই নয়। আমার জীবনে এটাই প্রথম গোয়েন্দাগিরি। তোমরা এর জন্য আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চাইলে আমি প্রস্তুত।”

একজন বলে–“আমরা জানতে চাচ্ছি, কেন? শেষ মেষ তুমি এমনটি কেন করতে গেলে?”

আবু নসর জবাবে বলে–“বাধ্য হয়ে। গত পরশুর ঘটনা। ইরানী কমান্ডারের সাথে রাস্তায় আমার দেখা হলে সে আমাকে জোহরার বাড়ীর উপর নজর রাখার নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশের অর্থ ছিল জোহরা যেন বাড়ী ছেড়ে পালাতে না পারে এবং তার সাথে কোন যুবক একাকী কথা বললে আমি যেন তাকে অবহিত করি।…আমি তাকে বলি যে, জোহরার উপর নজর রাখতে আমার কোন সমস্যা নেই কিন্তু প্রশ্ন হল আমার দুই মেয়েকে কে নজরে রাখবে? আমি তাকে বুঝিয়ে বলি যে, শাহী ফৌজের কমান্ডার এবং সেপাইরা আমাদের মেয়েদের প্রতি কুনজরে তাকায়।…

শিমুর আমার মনের ভাব বুঝতে পারে। সে বলে ভবিষ্যতে কোন কমান্ডার বা সৈন্য তোমার মেয়েদের প্রতি চোখ তুলে তাকাবে না। সে আমাকে পাক্কা ওয়াদা দেয় যে, আমার কন্যাদের সম্ভ্রম রক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থা সে করবে।…

বৃদ্ধ মন্তব্য করে–“খোদার কসম! তুমি মুসলমান কথিত হওয়ারও যোগ্য নও। তুমি নিজ কন্যাদের ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে অপর ভাইয়ের কন্যার ইজ্জতের ব্যাপারটি চিন্তা করনি।”

আরেকজন ক্ষুব্ধ মন্তব্য করে তোমার উপর খোদার গযব পড়ুক আবু নসর! তুমি জাননা, এই অগ্নি পূজকদের ওয়াদার কোন দাম নেই। তাদের একজনও খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যে মুসলমানদের সাথে কৃত ওয়াদা রক্ষা করেছে।” আরেকজন বলে–“কন্যাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য আমরা নিজেরা প্রস্তুত। তোমার কন্যা আমাদের সকলেরই কন্যা।”

জোহরার পিতা সাউদ বলে–“আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।”

খুদ্দাম বলে–“আমিও তাকে ক্ষমা করে দিলাম। খোদার কসম! আমি শিমুর হতে কড়ায়-গণ্ডায় প্রতিশোধ নিব।”

মুরুব্বী তাকে সতর্ক করে বলে–“আবেগে অধীর হয়ো না বৎস! কিছু করতে চাইলে বাস্তবে করে দেখাও। কিন্তু সাবধান! আবেগতাড়িত হয়ে মুখে কিছু বলো না। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাব।”

পরদিন সকালে বাগিচার-শ্রমিকদের মাঝে খুদ্দাম ছিল না। প্রায় প্রত্যেকেই খুদ্দামের পিতার কাছে জানতে চায়, খুদ্দাম কোথায়? পিতা নিজেও চিন্তিত ছিল। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে সে জানতে পারে যে, খুদ্দাম গায়েব।

খুদ্দামের পিতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে–“জরথুস্ত্রের এই পূজারী আমার পুত্রকে উধাও করে দিয়েছে। হয়ত সে ধোঁকা দিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।”

অতঃপর সন্দেহ বিশ্বাসে রূপ নেয়। তার পিতার সম্ভাবনাই সকলের কাছে একমাত্র সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু জোহরা। খুদ্দামের সাথে তার সর্বশেষ যে আলোচনা হয়েছিল তার আলোকে সে এই বিশ্বাসই লালন করে যে, খুদ্দামকে কেউ গায়েব করেনি; বরং সে নিজেই কোথাও চলে গেছে। কেননা, সে তাকে বলেছিল, কয়েকদিনের জন্য সে লাপাত্তা হয়ে যাবে। জোহরা এ রহস্য কারো কাছে ফাঁস করে না; বরং উল্টো সে এ কথার উপর জোর দেয় যে, ইরানীরাই খুদ্দামকে গায়েব করে দিয়েছে। জোহরা প্রাণের সখীর কাছে পর্যন্ত মুখ খুলে না। বরং তাকে এ কথা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় যে, সে আগামী দু’তিন দিন খুদ্দামের অপেক্ষা করবে। এর মধ্যে সে না এলে দরিয়ায় ডুবে মরবে।

***

তিন-চার দিন পরের ঘটনা। এক রাতে শিমুর নিকটস্থ একটি ফাঁড়িতে বসে মনের আনন্দে দুই উঠতি তরুনীর চোখ ধাঁধানের নৃত্য দেখছিল। সুন্দর, সুশ্রী এবং আকর্ষণীয় তরুণীদের এমন নাচ-গান ইরানের শাহী দরবারের সাধারণ ব্যাপার ছিল। এদেরকে নর্তকী বলা হত। বিবস্ত্র প্রায় পোশাকে সাজানো হত তাদের। পাতলা এবং সংক্ষিপ্ত পোশাকে তাদের যৌনাঙ্গগুলো দর্শকের চোখে মাদকতা জাগাত। প্রতিটি পুরুষের পৌরুষ চাঙ্গা ও উৎকীর্ণ হয়ে উঠত।

শিমুর শাহী বংশের লোক ছিল। ঘটনার দিন রাতে সিপাহীদের চিত্তবিনোদনের জন্য সে এই নর্তকী দ্বয়কে ভাড়া করে এনেছিল। মদ পানের পর্ব চলতে থাকে। সিপাহীরা নর্তকী দ্বয়কে চিৎকার করে করে সাবাস দিচ্ছিল। নেশায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দু’তিন সিপাহী মঞ্চে উঠে নর্তকীদের সাথে নাচতে শুরু করে দেয়। শিমুরের নির্দেশে অন্য সিপাহীরা এই মাতাল সিপাহীদের ধরে ফাঁড়ির বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসে।

ছোট আকারের এই ফাঁড়িটি একটি মিনি কেল্লা ছিল। কিন্তু কেল্লার দ্বার রাতেও উন্মুক্ত থাকত। অপর কোন শত্রুর আক্রমণের আশংকা তাদের ছিল না। তারা নিজেদেরকে হামলার ঊর্ধ্বে জ্ঞান করত। একদিকে নৃত্য-গীত যখন তুঙ্গে পৌঁছে এবং অপরদিকে মদের নেশা শিমুর ও তার সাথীদের চেতনা লোপ করতে থাকে, তখন শা শা আওয়াজ তুলে বিদ্যুৎ বেগে একটি তীর এসে শিমুরের গর্দানের এক দিক দিয়ে ঢুকে অপর দিকে তার ফলা বেরিয়ে যায়। শিমুর দুই হাত গলায় চেপে ধরে উঠে পড়ে। সিপাহীদের মাঝে হুলস্থূল আর ছুটোছুটি পড়ে যায়। যে যেখানে ছিল সবাই শিমুরের পাশে এসে জমা হয়। আবার তিন চারটি তীর ছুটে আসে। সাথে সাথে তিন-চারবার আর্তচিৎকারও ওঠে। যারা তীরবিদ্ধ হয় তারা লুটিয়ে পড়ে। এরপর ইরানীদের মাঝে কেয়ামতের বিভীষিকা সৃষ্টি হয়। অস্ত্রহীন থাকায় তারা মোকাবিলার মোটেও সুযোগ পায় না। প্রাণ রক্ষারও সুযোগ তাদের ছিল না। তীব্র আক্রমণে তারা শুধু আহত আর নিহত হতে থাকে। যারা পালিয়ে দরজার দিকে ছুটে গিয়েছিল তারা দরজাতেই মৃত্যুর শিকার হয়।

ফাঁড়ির সিপাহীদের সাহায্যের সকল পথ রুদ্ধ ছিল। কারো পক্ষে দরজা গলিয়ে বাইরে বের হওয়া সম্ভব হয় না। অস্ত্রাগার হতে অস্ত্র আনার সুযোগও তারা পায় না।

এটি একটি মরুঝড় ছিল, যা হঠাৎ উত্থিত হয়ে মুহূর্তে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। প্রস্থানকালে ফাঁড়িস্থ সকল মালামাল সাথে নিয়ে যায়। শুধু রয়ে যায় লাশের সারি, অসংখ্য আহত এবং কতক অক্ষত সিপাহী। যারা প্রলয়ের সময় জীবন বাঁচাতে লাশ আর আহতদের সাথে মাটি কামড়ে পড়েছিল।

তিন

পরের প্রভাত। স্নিগ্ধ সকাল। প্রাত্যহিক কাজ শেষে মুসলমানরা অন্যান্য দিনের মত নিজ নিজ ক্ষেত বা বাগিচায় যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এরই মধ্যে ইরানী সৈন্য এসে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। অজ্ঞাত হামলাকারীরা হামলা শেষে যখন নিরাপদে ফিরে যায় তখন অন্যান্য ফাঁড়ির সৈন্যরা আক্রান্ত ফাঁড়ি সম্পর্কে অবগত হয়। কিন্তু ততক্ষণে অজ্ঞাত শত্রু বহুদূরে চলে যায়। কাছে মুসলিম বসতি থাকায় প্রধান সন্দেহ ভাজনের টার্গেটে অটোমেটিক তাদের নাম চলে আসে। তাই সকালের পাখি না ডাকতেই ঘোড়া ছুটিয়ে ইরানী ফৌজ হাজির। তারা এলাকা সিল করে মুসলমানদেরকে কর্মস্থলে যেতে বাধা দেয়। পুরুষদের আলাদা স্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়। ঘর থেকে মহিলাদের বের করে এনে তাদেরও পুরুষদের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে। কিছু সৈন্য তাদের পাহারায় থেকে বাকীরা ঘরে ঘরে ঢুকে ব্যাপক তল্লাশী চালায়। তারা ঘরের বিছানা, বেডসীড পর্যন্ত উল্টিয়ে দেখে।

তাদের চিরুণী অভিযান ব্যর্থ হয়। এমন কোন জিনিস উদ্ধার করতে পারে না, যা তাদের সন্দেহের উদ্রেক করে। অবশ্য তল্লাশী চালাবার সময় তাদের পছন্দসই বস্তু পকেটস্থ করতে তারা ভুলে না। এরপর তারা পুরুষ-মহিলাদের জমা করে কড়া হুমকি-ধমকি দেয়। মুসলমানদের সাথে তাদের এই ব্যবহার কোন নতুন ঘটনা নয়। যে কোন তুচ্ছ বাহানায় যখন তখন তাদের বাড়ী ঘরে এভাবে তল্লাশী চলত। অন্য সময়ে কৃত্রিম ইস্যু নিয়ে এলেও এবার তাদের হাতে বাস্তব ইস্যু ছিল।

এক ইরানী কমান্ডার মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলে–“উবলার সীমান্তবর্তী সেনাফাঁড়িতে গতরাতে অজ্ঞাত অস্ত্রধারীরা গেরিলা হামলা চালিয়েছে। উক্ত হামলায় আমাদের এক কমান্ডার এবং ষাটজন সিপাহী মারা গেছে। আর আহতের সংখ্যা অসংখ্য। তোমাদের কোন পুরুষ বা মহিলা তাদের একজনকেও যদি ধরিয়ে দিতে পার, তবে বিরাট অঙ্কের নগদ পুরস্কার দেয়া হবে। এ ছাড়া আগত ফসলের অর্ধেক তাকে দিয়ে দেয়া হবে।”

এরপর সে দ্রুত সবার প্রতি নজর বুলিয়ে বলে–“একে অপরকে দেখে বল, তোমাদের মধ্যে কে অনুপস্থিত।”

সকলে একে অপরের দিকে চায়। কিন্তু কেউ অনুপস্থিত আছে কিনা তা খেয়াল করে না। কয়েকটি চোখ খুদ্দামকে খোঁজে। সে গত তিন-চারদিন ধরে অনুপস্থিত ছিল। সকলে অবাক হয়ে দেখে যে, খুদ্দাম সেখানে বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। এতে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এরপর অনেকগুলো কণ্ঠ একসাথে বলে ওঠে যে, তাদের কেউ অনুপস্থিত নেই।

ইরানী সৈন্য চলে গেলে যারা খুদ্দামের গায়েব হওয়ার কথা জানত তারা এক এক করে তার কাছে জিজ্ঞাসা করতে থাকে যে, সে কোথায় চলে গিয়েছিল।

খুদ্দাম সকল প্রশ্নকারীকে একই জবাব দেয়–“আমি শিমুরের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।”

খুদ্দামের পিতা সবাইকে জানায় যে, গতকাল রাতের শেষ প্রহরে খুদ্দাম বাড়ীতে ফেরে।

সেদিন বাগিচায় কাজ করতে করতে খুদ্দাম আর জোহরা সকলের চোখ ফাকি দিয়ে হঠাৎ সরে পড়ে। তারা এমন স্থানে গিয়ে বসে তাদের দেখার সম্ভাবনা ছিল না। জোহরা আনন্দে দিশেহারা হয়ে যেতে থাকে। সে বারবার গভীর আবেগে খুদ্দামের নাম ধরে ডাকছিল।

সে হর্ষ-তরঙ্গায়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে–“এটা কিভাবে ঘটল খুদ্দাম? এটা হল কিভাবে?”

খুদ্দাম বলে–“এটাকে আল্লাহর সাহায্য বলো জোহরা। এখন আর বলতে পারবে না যে, আল্লাহ সাহায্য করে না।”

জোহরা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়, যেন সে জীবনে কখনো হাসেনি এবং তার ঠোঁট মুচকি হাসি কাকে বলে তাও চেনে না। খুদ্দামের চেহারায় গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিঞ্চিত চিন্তার স্বরে বলে–“সত্য করে বল খুদ্দাম! শিমুরের ঘাতক তুমি নও তো?…শুনেছি মরু ডাকাতের এক বিরাট দল রাতে শিমুরের ফাঁড়িতে ঐ সময় গেরিলা হামলা চালায় যখন সে মদ আর নৃত্য-গীতে মাতাল হয়ে গিয়েছিল। এমন তো নয় যে, তুমি ঐ ডাকাতদের সাথে মিলে…।”

খুদ্দামের আকস্মিক অট্টহাসি বিনতে সাউদের কথা শেষ করতে দেয় না। সে হাসতেই থাকে এবং জোহরার কোমরে হাত দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। এতে জোহরার শরীরে এমন উষ্ণ শিহরণ সৃষ্টি হয় যে, খুদ্দামকে সে কি বলতেছিল তা বেমালুল ভুলে যায়।

***

খুদ্দাম অট্টহাসির মাঝে একটি রহস্য লুকিয়ে ফেলে। জোহরাকে গভীর আবেগে ঠেলে দিয়ে স্পর্শকাতর রহস্যটি তার মনের মুকুর ও দৃষ্টিপথ হতে সরিয়ে নেয়। খুদ্দাম অসাধারণ সাহসী, আত্মমর্যাদাশীল এবং দৈহিক দিক দিয়েও শক্তিশালী ও স্বাধীনচেতা হওয়ায় জোহরার নারী হৃদয়ে এই আতঙ্ক দোলা দেয় যে, প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে শিমুরকে হত্যার জন্য দুর্ধর্ষ অপরাধী চক্রের সাথে হাত মেলায়নি তো! সেকালে মরু ডাকাতরা বড়ই দুঃসাহসী হত। ইরানী সৈন্যদের মত তারা বিভিন্ন স্থানে ঝড়-তুফান উঠাত। পথচারীদের সম্পদ লুট করাই ছিল তাদের পেশা। ফৌজের সাথেও তারা লিপ্ত হত এবং যুদ্ধ করতে করতে এমনভাবে গায়েব হয়ে যেত, যেন মরুভূমির বালু এবং টিলা তাদের আস্ত গিলে ফেলেছে।

জোহরা কিছুদিন ধরে গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, তাদের এলাকায় কয়েকজন অপরিচিত লোক এসে নিজেদেরকে অনেক দূরের মুসাফির পরিচয় দিয়ে কোন এক মুসলমানের বাড়ীতে রাতে অবস্থান করে এবং অতি প্রত্যুষে উঠে চলে যায়। তারা যখনই আসে খুদ্দাম এবং তার মত আরো ৩/৪জন যুবক তাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে। মুসাফিররা তাদের এলাকা ছেড়ে চলে গেলে এই যুবক গ্রুপটিকে ভীষণ তৎপর দেখা যায়।

জোহরা আরো লক্ষ্য করে যে, ভীন দেশীরা চলে গেলে মুসলমানদের বয়োবৃদ্ধ নেতাকে গভীর চিন্তামগ্ন এবং কানাকানি করে কথা বলতে দেখা যায়। এরপর যখন মুসলমানরা নিজেদের ক্ষেত-খামার, বাগ-বাগিচাসহ অন্যান্য কাজে লিপ্ত হয় তখন তাদের মাঝে ঘুরাফেরা করে এবং উপদেশ দানের ভাষায় কথা বলে।

মুরুব্বী মানুষের মাঝে এই জাতীয় কথা বলে–“স্বীয় ধর্মচ্যুত হবে না। যে মহান খোদার প্রেরিত রাসূলের আদেশ মান্য করে, তোমরা চল তাঁর সাহায্য আসছে।… অগ্নিপূজারীরা শক্তিশালী, খুব বলবান; কিন্তু তাই বলে তারা আল্লাহর চেয়ে অধিক শক্তিশালী নয়।…দৃঢ় অবিচল থাকবে।… জালিমের দিন শেষ প্রায়।… মজলুমদের সাথে আল্লাহ্ আছেন।”

“কবে?…সাহায্য কবে নাগাদ আসবে শুনি?”–একদিন এক ব্যক্তি ঝাঁঝালো কণ্ঠে উপদেশদাতা মুরুব্বীর কাছে জানতে চায়–“আপনি তো এটাই চান যে, আমরা মুখ বুজে শত জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে থাকি এবং আপনার আশ্বাস বাণী শুনে ব্যথা-বেদনার কথা ভুলে যাই। আজ যদি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেই যে, আমরা মুসলমান নই; ইসলামের সাথে আমাদের কোনই সম্পর্ক নেই, তাহলে এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে সাথে সাথে মুক্ত হয়ে যাব।… আল্লাহর সাহায্য আসছে…কবে নাগাদ আসছে?” “তাকে বল” মুরুব্বী তার পাশে কর্মরত আরেক লোককে বলেন “তাকে ভালভাবে বুঝাও… তাকে জানাও যে, অত্র এলাকায় শত বছর পূর্বের যে সমস্ত জরাজীর্ণ ও বিধ্বস্ত প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে আল্লাহ তা‘য়ালার পরাশক্তির বহিঃপ্রকাশ এর মধ্য হতে ঘটবে এবং তা জালিমের শক্তি নিশ্চিন্ন করে দেবে।” বয়োবৃদ্ধ লোকটির অন্তরে ঐ রহস্য লুক্কায়িত ছিল, যা খুদ্দাম জোহরা বিনতে সাউদ থেকে গোপন রেখেছিল।

ইরানী কমান্ডার শিমুরের সেনাচৌকিতে যে দুর্ধর্ষ গেরিলা হামলা চালানো হয় তা নতুন কোন ঘটনা ছিল না। অবশ্য উবলা এলাকায় এমন ঘটনা এই প্রথম। এ ফাঁড়িটি বসতি এলাকার সন্নিকটে থাকায় মুসলমানরা আক্রমণের খবর জানতে পারে। এই ঘটনার পরে মুসলমানদের বাড়ী-ঘর তল্লাশী না করা হলে হয়ত এ ঘটনাও তাদের অজানা থেকে যেত। ইরাকের সীমান্ত এলাকায় দ্বিতীয়, তৃতীয় রাতে কোন না কোন ফাঁড়িতে নিয়মিত গেরিলা হামলা চলতে থাকে। হামলাকারীরা মুহূর্তে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও রক্তপাত ঘটিয়ে সেখানে যা কিছু পেত তা নিয়ে উধাও হয়ে যেত।

দু’বার ইরানী সৈন্যরা অদৃশ্য শত্রুর পিছু নেয়। হামলাকারীদের পদচিহ্ন ধরে ধরে অনেক দূর এগিয়ে যায়। কিন্তু তারা তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে না। কারণ খানিক দূর এগিয়ে যেতেই সবুজ-শ্যামল ভূমি শেষ হয়ে বিস্তীর্ণ মরু এলাকা শুরু হয়ে যেত। মরু এলাকাটি মোটেও সমতল ছিল না; যত্রতত্র অসংখ্য বালুর ঢিবি ও উঁচু উঁচু টিলা ছিল। সামনে বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল থাকলেও সেখানে বিচিত্র আকৃতির অসংখ্য টিলা ভয়ঙ্কর রূপ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। এখানে-সেখানে বালুর পাহাড় ছিল। আগুনের লেলিহান ফুলকি তার অভ্যন্তর হতে উদগত হচ্ছে মনে হত। মাইলের পর মাইল জুড়ে এই ভয়ঙ্কর মরু এলাকায় চৌকস মরুভেদী ব্যক্তিই কেবল যেতে পারত। কোন নতুন লোকের পক্ষে এখানে যাওয়াই সম্ভব ছিল না। আর গেলেও প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব।

ইরানী সৈন্যরা মরুভূমির গোলক ধাধার সাথে পরিচিত ছিল না। তারা প্রতিশোধ স্পৃহায় গেরিলা বাহিনীর পিছু পিছু এই মরু অঞ্চলে গিয়ে করুণ পরিণতির সম্মুখীন হয়। ইরানের অশ্বারোহী বাহিনী পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে মানুষ ও ঘোড়ার পদচিহ্ন পেয়ে পুলকিত হয়ে ওঠে। তারা এটাকে গেরিলা বাহিনীর পদচিহ্ন মনে করে চিহ্ন ধরে ধরে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু এই চিহ্নের অনুসরণ তাদেরকে সরাসরি মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করে। দুর্গম অঞ্চলে ইরানী সৈন্যরা পা দিতেই তাদের উপর তীরের বৃষ্টি হতে থাকে। প্রথম চোঁটেই কতক অশ্বারোহী এবং কয়েকটি ঘোড়া ঘায়েল হয়। আহত ঘোড়া নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে এদিক-ওদিক ভেগে যায়। পুরো বাহিনীতে হুলুস্থুল পড়ে যায়। এদিকে তীর মুষলধারায় আসতে থাকে কিন্তু ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবার কারণে তীর অধিকাংশই লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে থাকে।

দুর্গম এই নিম্নাঞ্চল থেকে কয়েকজন অশ্বারোহী বেরিয়ে আসে। তাদের হাতে বর্শা ছিল। তাদের পরনে লম্বা কোর্তা এবং মাথায় কালো কাপড় এমনভাবে বাঁধা ছিল যে, তাদের গর্দান এবং চেহারাও ঢাকা পড়েছিল। চোখ দু‘টো খোলা ছিল মাত্র। কারো সাধ্য ছিল না তাদের চেনা কিংবা চিহ্নিত করা। অশ্বের পায়ে এবং অশ্বারোহীদের বাহুতে এমন ছন্দময় বিদ্যুৎ গতি ছিল যে, পূর্ব হতেই আতঙ্কিত ইরানী বাহিনী অস্ত্র ধরার কথা ভুলে যায়। তারা অসহায়ভাবে নেকাবধারীদের বর্শার আঘাতে আঘাতে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়তে থাকে। কতক প্রাণ বাঁচাতে ছুটে পালায়। তারা টিলা এবং ঢিবি অধ্যুষিত নিম্নাঞ্চল থেকে বের হতে পারলেও বিস্তীর্ণ মরুভূমির গোলক ধাঁধায় গিয়ে পতিত হয়। টিলাগুলো একই ধরনের হওয়ায় দিশেহারা হয়ে চক্কর খেতে থাকে। বিপদজনক এ ধরনের টিলা অসংখ্য এবং মাইলের পর মাইল জুড়ে থাকায় কোন নতুন ব্যক্তি এর মধ্যে একবার পা দিলে তার পক্ষে এ মরুফাঁদ মুক্ত হয়ে বের হওয়া সম্ভব হত না। ক্রমে সে গভীর থেকে গভীর মরু অঞ্চলে হারিয়ে যেত। একসময় ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে হাল ছেড়ে দিত। পিপাসায় কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। অতঃপর মরুভূমির এই অদ্ভুত, বালিফাড়ি বড় নির্দয় ও করুণভাবে তার প্রাণ সংহার করত।

আরেকবার ইরানী সৈন্যরা গেরিলা বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবনে গেলে নতুন এক স্থানে তারা আক্রমণের শিকার হয়। প্রচণ্ড তীরবৃষ্টির মুখে সৈন্যরা দিগ্বিদিক হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় তাদের কণ্ঠকুহরে একটি আওয়াজ ভেসে আসে “যরথুস্ত্রের ভক্তরা; আমি মুসান্না বিন হারেছা।…যরথুস্ত্রেকে আসতে বলবে।… মুসান্না বিন হারেছা।… হুরমুজকে এ নামটি জানিয়ে দিবে… মুসান্না বিন হারেছা।” ইরানী সৈন্যদের মধ্য হতে যারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয় তারাও আধামরা ছিল। তারা পরে তাদের কমান্ডারকে মরুভূমির এই রহস্যময় কণ্ঠ সম্পর্কে অবহিত করে।

এরপরে ইরানীদের সীমান্তবর্তী চৌকিতে লাগাতার গুপ্ত হামলা চলতে থাকে। কিন্তু তারা গেরিলা বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন এবং তাদের অনুসন্ধান করার সাহস করেনি। কোন কোনদিন গুপ্ত হামলার সাথে সাথে এই আওয়াজও শোনা যেত “আমি মুসান্না বিন হারেছা।… আগুন পূজারীরা শোন! আমার নাম মুসান্না বিন হারেছা।”

এরপর থেকে মুসান্না বিন হারেছা নামটি ভীতি, ভূত-পেত্নী-প্রেতাত্না ইত্যাদি নামে পরিণত হয়। ইরানী সৈন্যরা এ নামটি শুনলেই আঁৎকে উঠতে থাকে। তারা মুসান্না বিন হারেছা কিংবা তার গ্রুপের কোন এক সদস্যকে ধরতে প্রাণান্তচেষ্টা চালায় কিন্তু অসীম সাহসী হওয়া সত্ত্বেও যখন তারা গেরিলা বাহিনীর কবলে পড়ত, চরম আতঙ্ক এবং ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেত।

চার

৬৩৩ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের কোন একদিনে মুসলিম জগতের খলীফা হযরত আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে এক সাধারণ দূরদেশীর মত যিনি বসা ছিলেন তিনিই হলেন এই হযরত মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি দক্ষিণ ইরাকের অধিবাসী এবং স্বীয় গোত্র-বনূ বকরের নেতা ছিলেন। তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ও নেপথ্যের বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। শুধু নিজ গোত্র নয়; বরং অত্র এলাকায় অবস্থানরত প্রত্যেকটি গোত্রের ইসলাম গ্রহণ তাঁরই অনবদ্য কৃতিত্বের ফল ছিল।

ইয়ামামা যুদ্ধের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে যখন মুরতাদ ফেতনার অবসান ঘটে দক্ষিণ ইরাকে তখন হযরত মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু ইরানীদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড জিহাদ শুরু করেন। ইরান সাম্রাজ্যের মুসলিম প্রজাদের তিনি নিজের পক্ষে টেনে নেন এবং তাদের নিয়ে একটি শক্তিশালী বাহিনী তৈরি করেন। গেরিলা হামলার মাধ্যমে তিনি জিহাদের সূচনা ঘটান। লক্ষ্যস্থল ও টার্গেট হিসেবে প্রাথমিকভাবে সীমান্তবর্তী সেনা ব্যারাকগুলো নির্বাচন করেন। প্রতি রাতে কোন না কোন চৌকিতে গুপ্ত হামলা চলতেই থাকে। তাদের গেরিলা আক্রমণ এত তীব্র ও দ্রুত হত যে, ব্যারাকের সৈন্যরা ঘুরে দাঁড়াবার ফুসরৎ পেত না। চোখের পলকে কার্য সিদ্ধি করে তারা নিরাপদে বেরিয়ে হাওয়া হয়ে যেত।

হযরত মুসান্না বিন হারেছার নেতৃত্বাধীন দুর্ধর্ষ জিহাদী দলটি মরুভূমির বেশ ভেতর এক দুর্গম স্থানকে নিজেদের আস্তানা হিসেবে বেছে নেয়।

ক’দিনের সফল অপারেশনেই আস্তানা গনীমতের মালে টইটুম্বর হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা কেবল ইরানী অধ্যুষিত এলাকায় গেরিলা আক্রমণ চালাতে শুরু করে। মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু সীমান্ত এলাকায় ইরানী সৈন্যদের ব্যাপক নাকানি-চুবানি খাইয়ে ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করে ছাড়ে। ইরানী বাহিনীর একাধিক সিনিয়র কমান্ডার এক এক করে মুসান্নার হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। ফলে সৈন্যরা ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাদের পিছু নেয়া ছেড়ে দেয়।

হযরত মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু আরেকটি পদক্ষেপ নেন। দক্ষিণ ইরাকে যে সমস্ত মুসলিম গোত্র ইরানীদের নির্যাতনে মানবেতর জীবন-যাপন করছিল তাদের মাঝে সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তার করে সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন। তিনি অধীনস্ত দেরকে দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করেন। একদল ছিল গেরিলা হামলার দায়িত্বে নিয়োজিত আর অপর দলটিকে তিনি মুসলিম আবাসিক এলাকায় রাখেন। তাদের দায়িত্ব ছিল পারস্পরিক একতা টিকিয়ে রাখা এবং রণাঙ্গনের ফলাফল সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানদের অবগত করিয়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করা। গেরিলা বাহিনীর প্রতিনিয়ত সফলতার সংবাদ এলাকাবাসী এভাবে জানতে পারছিল। ফলে অনাস্থা দূর হয়ে তাদের মাঝে ক্রমে আস্থা সৃষ্টি হতে থাকে। তারা মুক্তির সূর্যোদয় দেখতে বড়ই উন্মুখ ও পাগলপারা ছিল। এটাই ছিল খোদায়ী মদদ, যার প্রতীক্ষায় তারা ইরানীদের সকল নির্যাতন-নিপীড়ন মুখ বুজে সহ্য করে আসছিল এবং ইসলাম ধর্ম বুকে আঁকড়ে রেখেছিল। নতুবা ইসলাম ত্যাগ করে অগ্নিপূজারী হওয়ার মাধ্যমে তারা অতি সহজে ইরানীদের নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারত।

‘তিন-চার দিন সে গায়েব হয়ে যাবে’– খুদ্দাম জোহরাকে একথা বলে মুসান্না বিন হারেছার নেতৃত্বাধীন গেরিলা বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে চলে গিয়েছিল এবং তাদেরকে ইরানী কমান্ডার শিমুর বাড়াবাড়ির ঘটনা সব খুলে বলেছিল। গেরিলা বাহিনী খুদ্দামের আহ্বানে সাড়া দেয়। ইরানীদের বিনোদনের দিনকে তারা অপারেশনের জন্য বেছে নেয়। খুদ্দাম নিজেই গেরিলা বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। গেরিলা বাহিনী অতি নিপুণতা ও দক্ষতার সাথে সফল হামলা চালায়। গেরিলা দল হামলা করেই দ্রুত মারকাজে ফিরে যায়। এদিকে খুদ্দামও তৎক্ষণাৎ নিজের বাড়ী ফিরে আসে।

পারস্য উপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা এবং ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে আরব মুসলিম গোত্রসমূহের উপর প্রভাব বিস্তার এবং তাদেরকে ইসলামের উপর দৃঢ়-অবিচল রেখে ইরানীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তোলার বিস্তারিত রিপোর্ট হযরত মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু কে প্রদান করেন।

“আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন ইবনে হারেছা।” খলীফা তার নাতিদীর্ঘ বিবরণ শুনে বলেন “তুমি ইরানীদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণের পরামর্শ দেয়ার উদ্দেশ্যে এলে আমাকে এর জন্য ভাবতে হবে। তুমি কি জাননা ইরানী সৈন্যসংখ্যা যেমন বেশী তেমনি তাদের যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ সামগ্রীর কোন অভাব নেই? উপায়-উপকরণ বিহীন এবং হেড কোয়ার্টার থেকে এত দূরে গিয়ে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শক্তিধর বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করার যোগ্য এখনো আমরা হয়ে উঠিনি। কিন্তু তাই বলে পারস্য সাম্রাজ্যের বিষয়টি আমার বিবেচনাধীন নেই তা নয়।”

“আমীরুল মু’মিনীন!” মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বুকে হাত রেখে বলেন–“যদি এক ব্যক্তি এত বড় রাষ্ট্রের সৈন্যদের সাথে টেক্কা দিতে পারে এবং তাদের অন্তরে মুসলিম সৈন্যদের ব্যাপারে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে তাহলে আমি আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রেখে বলতে পারি যে, একটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতে পারে। আমি ঐ আগুনপূজারী সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ করুণ অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত। শাহী খান্দানের লোকেরা রাজ সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে ভীষণ অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আপনার জানা আছে যে, ইতোমধ্যে সম্রাট হিরাক্লিয়াস পারস্য বাহিনীকে নিনওয়া এবং দস্তাযারদ দুই রণাঙ্গনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে। হিরাক্লিয়াসের সৈন্যরা পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী মাদায়েনের ফটক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল প্রায়। এরপর ইরানীরা তাদের হারানো গৌরব আর পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। তাদের আয়েশী জীবন ও বিলাসিতার প্রতি তাকালে মনে হয় তারা নিজেদেরকে সামলে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখন তাদের মাঝে রাজমুকুট নিয়ে রশি টানাটানি চলছে। ইয়ামান তাদের হাত থেকে খসে গেছে। ইয়ামানের গভর্নর বাযান ইসলাম গ্রহণ করেছে। তার অধীনস্থ প্রজারা ইরানী জিঞ্জির ভেঙ্গে ফেলতে ভীষণ উদগ্রীব। ইরানীদের শাসনাধীন দক্ষিণ অঞ্চলের মুসলমান গোত্রগুলো আমার ইশারা এবং মদীনার সৈন্যদের প্রতীক্ষায় অপেক্ষমাণ।”

“তোমার উপর আল্লাহর রহমত অঝোর ধারায় বর্ষিত হোক মুসান্না!” আমীরুল মু‘মিনীন বলেন “নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিটি কথা আমার অন্তরে গেঁথে যাচ্ছে। তুমি যা চাচ্ছ আমি তাই করতে চাই। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সেনাপতিদের সাথে আলোচনা করলে ভাল হয় না?”

“সম্মানিত আমিরুল মু’মিনীন!” মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন–“পরামর্শ সাপেক্ষে সিদ্ধান্তই সর্বোত্তম। তবে আমিরুল মু’মিনীনের কাছে আমার কথা শেষ করার অনুমতি চাইব এবং বিনীত অনুরোধ জানাব যেন তিনি আমার কথাগুলো সেনাপতিদের বৈঠকে তুলে ধরেন।…

দজলা এবং ফোরাতের মিলন মোহনার নিকটবর্তী একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় আরব গোত্রসমূহের বসবাস। সকলেই মুসলমান। ধর্মীয় পরিচয়ে তারা মুসলমান হওয়ায় তারা অগ্নি উপাসক সম্রাটের জুলম-নির্যাতনের ব্লাকবোর্ডে পরিণত হয়েছে। ন্যূনতম মসজিদেও তাদের কোন অধিকার স্বীকৃত নেই। ইরানীদের হাতে তাদের জান নিরাপদ নয়। ইজ্জত-আবরু সতত হুমকির সম্মুখীন।…

সেখানে মুসলমানরা প্রচুর রবিশস্য ও ফল-ফলাদি উৎপন্ন করে কিন্তু বেচারাদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না। ক্ষেতের ফসল এবং বাগিচার ফল পাকতেই আগুন পূজারী ভূস্বামী এবং ইরানী সৈন্যরা জোরপূর্বক সমস্ত ফসল ও ফল নিয়ে যায়। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমকারী মুসলমানদেরকে তারা সাধারণ শ্রমিক ও ধিকৃত জাতি বলে মনে করে। তারা সারাক্ষণ ভীত ও তটস্থ থাকে। মুসলমান হওয়াই তাদের একমাত্র অপরাধ। তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হল, তারা কুফরীর সয়লাবের মাঝেও ইসলামের চেরাগ জ্বালিয়ে রেখেছে। তারা মদীনাকে আলোর মিনার মনে করে।…

“আমিরুল মু’মিনীন! দুশমন শক্তিশালী-এই প্রশ্ন মনে জায়গা দিলে ক্রমে তাদের শক্তি বাড়বে বৈ কমবেনা। অপরদিকে নির্যাতিত মুসলমানদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় তারা নিরাশ হয়ে নিজেদের মুক্তির স্বার্থে এমন পন্থা অবলম্বন করতে পারে যা ইসলামের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। আমার গেরিলা বাহিনী যে সফলতা অর্জন করেছে এবং আপনার সৈন্যদের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ করেছে তা শত্রুর করতলগত হয়ে যেতে পারে।… রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজলুম মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে যেতেন না?”

“আল্লাহর কসম! আমি তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাব” খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন এবং পাশে বসা এক সেনাপতির কাছে জানতে চান যে, ওলীদের পুত্র খালিদ বর্তমানে কোন এলাকায় আছে?”

“ইয়ামামায় আপনার পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় আছেন সেনাপতি উত্তরে বলেন।

“দ্রুতগামী কোন দূত মারফৎ খালিদকে জরুরী নির্দেশ দিয়ে পাঠাও যে, সে যেন জলদি মদীনা এসে পৌঁছে।” খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আল্লাহর তরবারী ছাড়া ইরান সম্রাটের সাথে আমরা টক্কর লাগাতে পারি না।” এরপর তিনি হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সম্বোধন করে বলেন “আর তুমি মুসান্না এখনই তোমার দেশে ফিরে যাও এবং আরব গোত্র হতে লড়াইয়ের যোগ্য যত লোক সংগ্রহ করা সম্ভব করে ফেল। এখন তোমাদেরকে প্রকাশ্য ময়দানে যুদ্ধ করতে হবে। অবশ্য তোমরা গেরিলা পন্থায়ও লড়াই অব্যাহত রাখতে পার। কিন্তু এখন তুমি নিজ ইচ্ছায় লড়তে পারবে না। খালিদ সর্বাধিনায়ক থাকবে। তুমি তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলবে।”

“যথা আজ্ঞা আমিরুল মু’মিনীন!” মুসান্না বিন হারেছা বলেন “আরেকটি আবেদন করতে চাই।… ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে আরব গোত্রসমূহের মধ্যে কিছু খৃষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম-বিশ্বাসের লোকও আছে। তারা সবাই অগ্নিপূজারীদের বিরোধী। পারস্যের অগ্নিপূজকরা মুসলমানদের সাথে যে নির্দয় আচরণ করে তাদের সাথেও ঠিক তেমন নির্মম ব্যবহার করে। যদি আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করেন তবে আমার অনুরোধ থাকবে অমুসলিম আরবদের সাথে যেন তেমন সদয় আচরণ করা হয়, মুসলমানদের সাথে যেমন করা হবে।”

“ঠিক আছে; এমনটিই হবে” আমীরুল মু’মিনীন বললেন–“যারা ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি ইসলাম তাদের মাথাব্যাথার কারণ হবে না।… তুমি আজই রওয়ানা হয়ে যাও।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন ইয়ামামায় অবস্থান করছিলেন। হেড কোয়ার্টার থেকে তার প্রতি এ নির্দেশই ছিল। লায়লা উরফে উম্মে তামীম এবং বিনতে মুযাআ-দুই নববধূ তাঁর সঙ্গেই ছিল। দূত মারফৎ আমীরুল মুমীনিনের জরুরী তলব পেয়েই হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইয়ামামা থেকে রওয়ানা হয়ে যান এবং সোজা মদীনায় গিয়ে পৌঁছেন।

“মুসান্না বিন হারেছার নাম কখনো শুনেছ?” খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কাছে জানতে চান।

“জ্বী শুনেছি,” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন–“এ কথাও আমার কানে এসেছে যে, ইরানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সে সীমিত পর্যায়ের যুদ্ধ শুরু করেছে তবে আমার সঠিক স্থান জানা নেই যে, তার এ সীমিত পর্যায়ের যুদ্ধ নিছক ব্যক্তিস্বার্থ নাকি ইসলামের স্বার্থে সে এ যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছে।”

“সে এখানে এসেছিল”– আমীরুল মু’মিনীন বললেন–“যে জিহাদের অবতারণা সে শুরু করেছে তাতে তার কিঞ্চিৎ ব্যক্তিস্বার্থ নেই। আমি তোমাকে এ ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছি যে, মুসান্নার সাহায্যে আমরা এখনই লাব্বায়েক বলব নাকি পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে টক্কর দেয়ার মত শক্তি সঞ্চয়ের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করব?”

“সে কোন ধরনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এ তথ্য জানিয়ে বলেন যে, মুসান্না বর্তমানে গেরিলা ধরনের আক্রমণ চালাচ্ছে এবং সে ইতোমধ্যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

“তার সবচেয়ে বড় সফলতা হলো” খলীফা বলেন–“সে যরথুস্ত্রের প্রজাধীন মুসলমানদেরকে এক প্লাটফর্মে সমবেত করে রেখেছে এবং তাদের মাঝে এমন প্রেরণা সৃষ্টি করেছে যে তারা যরথুস্ত্রের চরম নির্যাতন নিপীড়নের মধ্য দিয়েও ইসলামকে বুকে আগলে রেখেছে। উবলা এবং ইরাকের মুসলিম জনবসতি এলাকা ইরানীদের বর্বরতা অনুশীলনস্থলে পরিণত হয়েছে। চরম এ সংকটময় মুহূর্তে নিজের ধর্ম-বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে থাকা অর্থহীন প্রতিভাত হয়। তারা মুখে শুধু এতটুকুই যদি বলে দেয় যে, ইসলাম এবং মদীনার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই তবে মুহূর্তে তাদের সকল বিপদ-দুর্দশার অবসান ঘটবে। এটা সম্পূর্ণ মুসান্না এবং তার কয়েকজন সাথীর কৃতিত্ব ও অবদান যে, তারা এ ক্রান্তি লগ্নেও তথাকার মুসলমানদেরকে ইসলাম চ্যুত হতে দেয়নি। বরং উল্টো তাদের চেতনা-বিশ্বাসকে এমন দৃঢ় ও পরিপক্ক করে দিয়েছে যে, তারা যরথুস্ত্রের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর এ্যাকশন ও অপরেশানে সদা তৎপর থাকে।”

“আমিরুল মু’মিনীন!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “মুসান্না কি করল না করল এটা বড় কথা নয়; আসল কথা হলো মুসলমান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো যারা মুসলমান হওয়ার কারণে অমুসলিমদের লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার তাদের ভরপুর সাহায্য করা।”

“তুমি কি বলতে চাও, এখনই আমাদের ইরানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত?” খলীফা জিজ্ঞাসা করেন।

“জ্বী হ্যাঁ, আমীরুল মু’মিনীন! হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “ইরানীদের বিরুদ্ধে লড়তে আমাদের অসুবিধা কোথায়? সেখানকার পরিস্থিতিই তো ভিন্ন; আমাদের অনুকূলে, আপনার বর্ণনা হতে জানা গেছে যে, মুসান্না ইতোমধ্যে সেখানে কিছুটা সফলতা লাভ করেছে এবং আক্রমণের জন্য সে আমাদের পথকে সুগম করে দিয়েছে। নৈশ হামলাকারী এবং গেরিলা বাহিনীর দ্বারা ঠিক ততটুকু সম্ভব যা মুসান্না করেছে। তাদের দ্বারা কোন এলাকা অধিকার করা সম্ভব নয়; এটা নিয়মিত সৈন্যবাহিনীর কাজ। এ কাজটি যে কোন মূল্যে আমাদের করতেই হবে। মুসান্নার সফলতাকে আমরা এগিয়ে না নিলে তার ক্ষতি দু’টি। একটি হলো, তার সকল সফলতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। দ্বিতীয় হলো যরথুস্ত্ররা মুসান্না এবং মুসলমানদের থেকে এর জন্য প্রতিশোধ নিবে। তা ছাড়া ইরানীদের সাহস বেড়ে যেতে পারে।…

মুসান্না তো আপনাকে জানিয়েছে যে, সে ইরানীদের এমন ক্ষতিসাধন করেছে যে, তাদের আবেগে বিরাট ভাটা পড়েছে। এমতাবস্থায় যদি তাদেরকে হাফ ছাড়ার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে তারা নবোদ্যমে জেগে উঠবে এবং মুসলমানদেরকে পাইকারী হারে হত্যা করবে। তারা সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে এবং ভবিষ্যৎ কন্টকমুক্ত করতে আলোচ্য সীমান্তবর্তী এলাকার নিয়ন্ত্রণ মজবুত করবে। তারা তাদের সীমান্ত এলাকা ঝুঁকিমুক্ত করতে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলও অধিকার করে নিতে পারে। এই বিপদ মোকাবিলার একটিই মাত্র পথ খোলা ; আর তা হলো কালক্ষেপণ না করে মুসান্নার সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া এবং যরথুস্ত্র আমাদের উদ্দেশে সৈন্য মার্চ করার পূর্বেই তাদের দেশে আমাদের পৌঁছে তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করা।”

অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে জলদি ইরাক অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিয়ে খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বিদায় জানান।

“খালিদের বিদায় মুহূর্তে খলীফা বলেন “তোমার অধীনস্থ সৈন্যদের অধিকাংশই দীর্ঘদিন স্বীয় পরিবার-পরিজন থেকে দূরে এবং অনেক যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করেছে। ইরানীদের মত শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের দ্বারা যুদ্ধ করানো মনে হয় ঠিক হবে না। এর জন্য চাই তেজোদ্যম বাহিনী। জিহাদী জযবায় উজ্জীবিত একঝাক সৈন্যের। কেবল এমন সৈন্যই পারবে জানের বাজি দিতে। পাহাড়ের মত অবিচল হয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে। বাধ্য করে কাউকে রণাঙ্গনে পাঠানোর পক্ষপাতী আমি নই। সবচেয়ে ভাল হয় তুমি নিজেই একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করে নাও। তাদের মধ্যে এমন ধরনের লোক রাখবে যারা মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তোমার বাহিনীতে হয়ত এমন লোকও আছে যারা পূর্বে মুরতাদ বাহিনীতে ছিল। পরে পরাজিত হয়ে ইসলামী বাহিনীতে ঢুকে পড়ার মাঝে মঙ্গল দেখে সামিল হয়ে গেছে। এমন লোকদেরকে তোমার বাহিনীতে রাখবে না। আমরা বিরাট শক্তিধর শত্রুর সাথে মোকাবিলা করতে যাচ্ছি। ফলে আমি কোনরূপ বিপদের ঝুঁকি নিতে চাই না।”

“আমিরুল মু‘মিনীন!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞাসা করেন–“মুরতাদ বাহিনী হতে যারা আমার বাহিনীতে ঢুকেছে তাদেরকে আমার বাহিনী হতে বিদায় করে দেবার অনুমতি দিচ্ছেন?” “বিদায় করে দেয়া ভিন্ন কথা ওলীদের বেটা!” খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন–“তুমি গিয়ে সৈন্যদের বলবে, যারা ঘরে ফিরে যেতে চায় তাদের যাবার অনুমতি রয়েছে। এরপর দেখবে তোমার সাথে কতজন থাকে। যদি থেকে যাওয়া সৈন্যদের সংখ্যা খুবই কম হয় তাহলে খেলাফত এই কমতি কোন না কোন উপায়ে পূর্ণ করবে।… যাও ওলীদের পুত্র। আল্লাহ তোমার সহায় হোন।” খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু দৃঢ় ইচ্ছা এবং ঈমানে বলীয়ান ছিলেন। ইরাকে হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি যে কোন মূল্যে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চান। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এরও আন্তরিক চাহিদা ছিল তাঁর একের পর এক লড়াইয়ের সুযোগ আসুক। তিনি খলীফার ইচ্ছাকে আরো সুদৃঢ় ও মজবুত করে দেন।

পাঁচ

ইরাকের দজলা এবং ফোরাত নদীর মিলন মোহনার নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে মুসলমানদের আবাস ছিল। জুলুম এবং নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তারা কালাতিপাত করত। এখন সেখানকার হালচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদেরকে পূর্বের মতই নির্যাতিত এবং চলাচলকারী লাশ বলেই মনে হত। কিন্তু ঘরে ঘরে তাদের শুরু হয়েছিল ব্যাপক তৎপরতা। তারা গোপনে তীর-ধনুক এবং বর্শা তৈরি করতে থাকে। মুসান্না বিন হারেছার পক্ষ হতে যে নির্দেশ তারা পেত তা কানে কানে সকলের পর্যন্ত পৌঁছে যেত। দিনে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতি ঘরে ঘরে যে তীর বর্শা তৈরি হত রাতের আঁধারে তা মরুভূমির দুর্গম অঞ্চলে মুসান্নার হেড কোয়ার্টারে পাচার করা হত। এলাকার যুবক শ্রেণীর লোকও উধাও হতে থাকে। ইরানীদের সীমান্তবর্তী চৌকিতে এবং তাদের সেনাবহরে মুসলমানদের গেরিলা হামলা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। মুসলমানরা শত্রুদের অগোচরে নিয়মিত সেনারূপে সুসংগঠিত হচ্ছিল এবং দৈনন্দিন তাদের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

ইয়ামামায় হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীর অবস্থা ছিল এর সম্পূর্ণ উল্টো। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইয়ামামায় গিয়ে সৈন্যদেরকে ঘরে ফেরার ইখতিয়ার দিলে ১০ হাজার সৈন্যের মধ্যে মাত্র ২ হাজার রয়ে যায়। আর বাকী ৮ হাজার সবাই সাধারণ অনুমতি পেয়ে স্বদেশের উদ্দেশে রওয়ানা হয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খলীফার নামে পত্র লিখে পাঠান। তিনি পত্রে সমস্ত বৃত্তান্ত উল্লেখ করে লেখেন যে, এখন তার সাথে মাত্র ২ হাজার সৈন্য রয়েছে। তিনি বিশেষভাবে তাগাদা দিয়ে আরো লেখেন যে, অচিরেই তার সেনা সাহায্যের প্রয়োজন।

আমীরুল মু’মিনীন হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজের আসনে উপবিষ্ট। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর দূত এসে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু কে তার প্রেরীত পত্র হস্তান্তর করেন। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু পত্র পেয়েই জোরে জোরে পড়তে শুরু করেন। উপস্থিত পরামর্শদাতা ও অন্যান্যদের বিষয়টি শুনানো এবং এ ব্যাপারে তাদের অভিমত জানাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

“আমীরুল মু’মিনীন।” পত্র পাঠ শেষ হলে এক পরামর্শদাতা বলেন–“খালিদের জন্য সেনা সাহায্য দ্রুত পাঠানো দরকার। মাত্র ২ হাজার সৈন্য নিয়ে যরথুস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ার কল্পনাও করা যায় না।”

“কা‘কা বিন আমরকে ডাক!” আমিরুল মু’মিনীন নির্দেশ দেন। একটু পরে বলিষ্ঠ দেহবিশিষ্ট মধ্যমাকৃতির এক সুদর্শন যুবক খলীফার সামনে এসে দাঁড়ায়।

“কা‘কা!” আমীরুল মু‘মিনীন আগত যুবকের উদ্দেশে বলেন–“খালিদের সাহায্যের খুবই প্রয়োজন। দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে ইয়ামামার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যাও। সেখানে পৌঁছে খালিদকে বলবে, আমিই তোমার সাহায্য।”

“শ্রদ্ধাবর আমীরুল মু‘মিনীন!” এক পরামর্শদাতা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলেন “জানি আপনি উপহাস করছেন না। কিন্তু যে সেনাপতির ৮ হাজার সৈন্য চলে গেছে তাকে সাহায্য হিসেবে মাত্র এক ব্যক্তি প্রদান করা উপহাসই লাগছে।”

আমীরুল মু’মিনীন অস্বাভাবিক গভীর ছিলেন। তিনি হযরত কা’কা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আপাদ-মস্তক একবার গম্ভীর নিরীক্ষণ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন “যে মুজাহিদ বাহিনীতে কা’কা-এর মত টগবগে যুবক থাকবে তারা পরাজিত হবে না।”

হযরত কা’কা রাযিয়াল্লাহু আনহু তৎক্ষণাৎ ঘোড়ায় চেপে বসেন এবং মদীনা ছেড়ে বেরিয়ে যান। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল্লামা তবারী, ইবনে ইসহাক, ওকিদী এবং সাইফ বিন উমর এই ঘটনা বর্ণনা করে লেখেন যে, এর পূর্বেও এমন ঘটনা আরেকবার ঘটেছিল। হযরত ইয়াম বিন গনাম রাযিয়াল্লাহু আনহু নামক এক সেনাপতি এক রণাঙ্গন হতে জরুরী সেনা সাহায্য চেয়ে মদীনায় দূত পাঠালে খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু শুধু হযরত আবদ ইবনে আউফ আল হিময়ারী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সাহায্য হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তখনও উপস্থিত লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের ঐ জবাবই দিয়েছিলেন, যা তিনি কা’কা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উদ্দেশে প্রেরণের সময় দেন।

আসল ঘটনা হলো, খলীফা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নিরাশ করতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু তাকে ব্যাপক সাহায্য করার মত মদীনায় তখন সৈন্য ছিল না। কেননা রণাঙ্গন এই একটি মাত্র ছিল না। প্রখ্যাত সেনাপতিদের সকলেই বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধরত ছিলেন। এ সকল যুদ্ধ মুরতাদদের বিরুদ্ধে জারী ছিল। ইসলামের শত্রুরা যখন নিশ্চিত হয়ে যায় যে, যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদের পরাজিত করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয় তখন তারা ইসলামকে দুর্বল করে করে শেষ করে দিতে এই পন্থা অবলম্বন করে যে, কিছু লোক নবুওয়াতের দাবী করে বসে এবং চানক্য পন্থায় মানুষদেরকে নিজের ভক্ত ও অনুসারী বানাতে থাকে। ইসলাম গ্রহণকারী কতক গোত্রও ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় এবং ইসলাম বিচ্যুতির এই ধারাবাহিকতা দ্রুত প্রসার লাভ করতে থাকে। ধর্মান্তরিতের প্রাদুর্ভাবের পশ্চাতে ইহুদীবাদীর হাত ছিল। তারাই নেপথ্যে থেকে এ ফেৎনা ছড়ায়।

খলীফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতের পুরো সময়টা এই ফেৎনার মূলোৎপাটনের পিছনে ব্যয় হয়। কেবল ওয়াজ-নসিয়ত আর তাবলীগের দ্বারা এই ফেৎনা দমানো যেত না। এর জন্য সশস্ত্র জিহাদের প্রয়োজন ছিল। এ পর্যায়ে কয়েকটি রণাঙ্গন একই সময়ে সৃষ্টি হয়। মদীনায় আপাতত কোন সৈন্য ছিল না। কোন রণাঙ্গনে সৈন্য ঘাটতি দেখা দিলে অপর রণাঙ্গন হতে সৈন্য এনে সে ঘাটতি পূরণ করা হত।

আমীরুল মু’মিনীন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাহায্যে তৎক্ষণাৎ এক ব্যক্তি প্রেরণ করলেও এটাই সাহায্যের শেষ ছিল না। তিনি মুজার এবং রবীয়া নামক পার্শ্ববর্তী দু’গোত্রের উদ্দেশে এ মর্মে পত্র প্রেরণ করেন যে, তারা যেন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অধিকহারে সৈন্য সরবরাহ করে।

***

“মাত্র এক জন?” হযরত কা’কা’ বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সমীপে পৌঁছলে খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজ তাবুতে রাগে পায়চারি করতে করতে বলেন “এক ব্যক্তি মাত্র?…আমীরুল মু’মিনীনকে তো আমি স্পষ্টভাষায় জানিয়েছি যে, আমার অধীনে বর্তমানে মাত্র ২ হাজার সৈন্য রয়েছে। খেলাফতও আমার থেকে এই আশা রাখে যে, আপাদমস্তক বর্মাচ্ছাদিত ইরানী সৈন্যদের সাথে আমি সংঘর্ষে লিপ্ত হব।”

“শ্রদ্ধেয় সেনাপতি!” হযরত কা’কা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “৮ হাজার সৈন্যের স্থান আমি পুরো করতে না পারলেও অপূর্ণ রাখব না। সময় আসতে দিন। যে আল্লাহর রাসূলের কালেমা উচ্চারণ করি তার পবিত্রাত্মার সামনে আপনার মস্তক অবনত হতে দিব না।”

“ধন্যবাদ আরব রত্ন!” অনিন্দ্য সুন্দরী লায়লা হযরত কা’কা’ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কাঁধে জোরে হাত রেখে বলেন “তুমি যে ধর্মের পূজারী তোমার মত নব যুবকরা তা কেয়ামত পর্যন্ত জিন্দা রাখবে।”

“খোদার কসম!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দ্বিতীয় স্ত্রী বিনতে মুযাআ অত্যন্ত আবেগের সাথে বলেন “এই নওজোয়ান ৮ হাজার সৈন্যের শূন্যতা পূরণ করতে পারে।”

“আমি ইয়ামামায় বসে থাকব না” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজের মনের সাথে কথা বলার ভঙ্গিতে উচ্চারণ করতে থাকেন, “মুসান্না নিশ্চয়ই আমার পথ চেয়ে আছে। আমি তাকে নিঃসঙ্গ হতে দেব না। …” এটুকু বলেই তিনি চুপ করে যান এবং ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলেন “জগতের মালিক প্রভু ওগো! আমি তোমার নামে শপথ করছি স্বীয় নামের খাতিরে অন্তত আমাকে সাহায্য কর। আমাকে পাহাড়সম হিম্মত এবং দৃঢ়তা দান কর, যেন আমি ঐ আগুনে ঝাঁপ দিয়ে তাকে নির্বাপিত করতে পারি যরথুস্ত্রে যার ইবাদত করে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার রাসূল।”

“জনাব খালিদ! আপনি সাহস হারিয়ে ফেলছেন?”–লায়লা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ভেঙ্গে পড়তে দেখে বলেন–“আপনি কি বলতেন না যে, যারা আল্লাহর রাহে জিহাদ করে স্বয়ং আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন?”

“আমি সাহস হারাব না”–হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু লায়লার সান্ত্বনার জবাবে বলেন– “কিন্তু কথা হলো, আমি পরাজিত হতে অভ্যস্থ নই।… আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবেন। খোদার কসম! আমি সম্মান-মর্যাদা ও সুনাম-সুখ্যাতির আকাঙ্ক্ষী নই। ইরান সম্রাটের শাহী সিংহাসনও আমি চাইনা। আমি চাই আল্লাহর জমিন ইসলামের অধীনে চলে আসুক এবং আল্লাহর জমীনে বসবাসরত প্রত্যেকটি লোক আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ বিশ্বাসী ও তাঁদের অনুগত হোক।

***

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পাশে রয়ে যাওয়া দু’হাজার সৈন্য ইয়ামামার একটি ময়দানে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে দণ্ডায়মান। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়ার পিঠে আসীন।

“বীর মুজাহিদ সেনানীরা!”–হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুষ্টিমেয় সৈন্যদের উদ্দেশে তেজস্বীকণ্ঠে বলেন–“ইসলামের সুমহান বাণী দূর-দূরান্ত পৌঁছে দিতে আল্লাহপাক আমাদের নির্বাচন করেছেন। পরিবার-পরিজন এবং পার্থিব ধন-সম্পদ যাদের অতি প্রিয় তারা চলে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষোভ কিংবা অভিযোগ নেই। তারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে জান বাজি দিয়ে আমাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করেছে। এক দীর্ঘ সময় ধরে তারা আমাদের সঙ্গ দিয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে যথাযথ পুরস্কৃত করুন।… তোমরা আমার সঙ্গ ছাড়নি। এই ত্যাগের বিনিময় আমি নই ; আল্লাহ নিজেই তোমাদের দিবেন। আমরা বড়ই পরাক্রমশালী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলেছি। আমাদের সংখ্যার স্বল্পতার দিকে তাকাবে না। বদরে তোমরা কতজন আর কুরাইশদের সংখ্যা কত ছিল? উহুদেও মুসলমানরা সংখ্যায় কম ছিল। আমি সে সময় শত্রু পক্ষের একজন ছিলাম। তোমাদের মাঝেও অনেক এমন আছে যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বদর প্রান্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়েছিলে। তখন আমরা বড়ই আস্ফালন করে বলেছিলাম যে, আমরা এই মুষ্টিমেয় মুসলিম সৈন্যদেরকে ঘোড়ার পায়ের তলায় পিষে মারব। তোমাদের মনে নেই সেদিন সংখ্যায় যারা বেশী ছিল তারাই এক সময় স্বল্প সংখ্যক বাহিনীর হতে চরম মার খেয়ে পিছু হটে গিয়েছিল?… কেন এমন হয়েছিল?… কারণ ছিল একটাই, আর তা হলো মুসলমানরা হকের উপর ছিল; আর আল্লাহ হকপন্থীদের সাথে থাকেন। আজ তোমরা হকের ঝাণ্ডাবাহী।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে একটি কাগজ ছিল। তিনি এ সময়ে সেটি খুলে নিজের সামনে রাখেন।

আমীরুল মু’মিনীন আমাদের উদ্দেশে একটি পত্র লিখে পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন : “ইরানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমি খালিদ বিন ওলীদকে পাঠালাম। খেলাফতের পক্ষ হতে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত তোমরা খালিদের নেতৃত্বে যুদ্ধ অব্যাহত রাখবে। যে কোন পরিস্থিতিতে খালিদকে ছেড়ে যাবে না। শত্রু যতই শক্তিশালী হোক না কেন। কাপুরুষতা প্রদর্শন করবে না। তোমরা তো তারাই, যারা ঘরে ফেরার ইখতিয়ার পেয়েও ‘আল্লাহর তরবারী’–খালিদের সঙ্গ ছাড়নি। তোমরা সবকিছুর উপরে ঐ রাস্তা অবলম্বন করেছ যাকে আল্লাহর রাস্তা বলা হয়। কল্পনা কর ঐ বিরাট সওয়াবের কথা আল্লাহর রাহে জিহাদকারীরা যা প্রাপ্ত হয়। আল্লাহ তোমাদের সহায় ও সহায়ক হবেন। তোমাদের সৈন্য ঘাটতি তিনিই পূর্ণ করবেন। সকল অবস্থায় তাঁর সন্তুষ্টি ও সন্তোষ অর্জনে সচেষ্ট থাকবে।”

এই দু’হাজার মুজাহিদকে কোনরূপ ওয়াজ কিংবা উত্তেজিত করার প্রয়োজন ছিল না। তারা প্রথম থেকেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে ছিল। তাদের অধিকাংশই এমন ছিল যে, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে বিভিন্ন যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর তাদের মধ্যে এই ভাবধারা কাজ করে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্রাত্মা এখনও তাদের নেতৃত্ব দিয়ে চলছে।

রাসূল প্রেমে দিওয়ানা এই সৈন্যরা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুমতিক্রমে এক নয়া কৌশল অবলম্বন করে। তারা ঘোড়ায় চেপে ইয়ামামার আশে-পাশের অঞ্চলে বেরিয়ে পড়ে এবং বসতিতে গিয়ে গিয়ে অশ্বারোহণের বিভিন্ন কৌশলী মহড়ার প্রদর্শন করে ফেরে। ছুটন্ত ঘোড়া হতে নামা এবং খানিক পর আবার তার পিঠে সওয়ার হওয়া, ধাবমান ঘোড়ার পিঠে বসেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে তীর নিক্ষেপ, বর্শা নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা, ছুটন্ত ঘোড়ায় থেকে অস্ত্রচালনা মহড়ার অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল। এভাবে মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা যুবক শ্রেণীকে ফৌজে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করত এবং জিহাদের ফযিলত ও লাভ সম্পর্কে তাদের জানাত।

সাথে সাথে তারা তাদেরকে এ ব্যাপারেও সতর্ক করত যে, যদি তারা মুসলিম ফৌজে ভর্তি না হয় তবে ইরানীরা এসে তাদের গোলামে পরিণত করবে। তাদের থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম নিবে কিন্তু বিনিময়ে দেবেনা কিছুই। উপরন্তু তাদের বোন, কন্যা এবং স্ত্রীদেরকে ভোগের সামগ্রিতে পরিণত করবে। এই অঞ্চলের লোকদের তিন শাসনামলের তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল। তারা ইরানীদের শাসনামল দেখেছিল। ভণ্ড নবীর ভেল্কিবাজিও তাদের সামনে ছিল। বর্তমানে তারা মুসলমানদের শাসনাধীন। মুসলমানরা অত্র এলাকা করায়ত্ত করে তাদের গোলাম বানায়নি। জনগণ গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করে যে, মুসলমানদের চাল-চলন, আচরণ ও শাসন রাজা-বাদশাহ কিংবা দুনিয়ার অন্যান্য শাসকদের মত নয়। ক্ষমতাধর হয়েও তারা সাধারণ জীবন-যাপন করে। সকলের সাথে মিলেমিশে থাকে। সবার কথা শুনে এবং সবার সাথে কথা বলে। তাদের নারী জাতির ইজ্জত-সম্ভ্রম সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল।

ইয়ামামার জনতার মাঝে কিছু লোক এমনও ছিল যারা ইতোপূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু মুসাইলামা ভেল্কিবাজি দেখিয়ে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে ফেলেছিল। ফলে ভণ্ড নবীর খপ্পরে পড়ে তারা ইসলাম থেকে সরে গিয়েছিল। মুসলমানদের হাতে মুসাইলামার নবুওয়াতের ভণ্ডামী উন্মোচিত হতে তারা দেখেছিল। মুসাইলামার বিশাল সমরশক্তি স্বল্প সংখ্যক মুসলমানের বীরত্বের সামনে চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার দৃশ্য তাদের সামনে ছিল। মুসাইলামার পরাজয় তাদের অন্তর্চক্ষু খুলে দিয়েছিল। তাদের অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস জমেছিল যে, যারা সংখ্যায় স্বল্প হয়েও এত বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করতে পারে তারা নিশ্চয়ই সত্যপন্থী এবং সঠিক আদর্শবাদী হবে। তারা আরো বিশ্বাস করে যে, যে অদৃশ্য শক্তি সত্যকে মিথ্যার উপর এবং হককে বাতিলের উপর বিজয়ী করে তা একমাত্র ইসলামেই নিহিত। ফলে তারা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর ফৌজে নাম লিখাতে থাকে। এটা মুজাহিদদের মেহনত আর চেষ্টার ফসল ছিল।

***

ইয়ামামায় হঠাৎ শোরগোল পড়ে যায়। কিছু লোক উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে বসতি এলাকার বাইরে চলে যায়। মহিলারা নিজ নিজ ঘরের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দূরের খোলা আকাশে ধুলোর মেঘমালা উড়ছিল। জমিন হতে উৎক্ষিপ্ত ধুলো ক্রমশ ঊর্ধ্বপানে উঠছিল এবং অতি দ্রুত ইয়ামামার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।

“ধূলিঝড় আসছে।”

“সৈন্য তারা… কোন সেনাবাহিনী আসছে”

“সাবধান!…হুসিয়ার!!…প্রস্তুত হও।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কেল্লা সদৃশ একটি ভবনে ওঠেন। গভীর নিরীক্ষণের পর তিনি নিশ্চিত হন যে, এটা কোন মরুঝড় নয়; বরং সশস্ত্র সেনাফৌজ। মুরতাদ শ্রেণী ছাড়া অন্য কারও সৈন্য হতে পারে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর আফসুস হতে থাকে যে, তিনি কেন তার সৈন্যদের ঘরে ফিরে যাবার ইখতিয়ার দিলেন। উড়ন্ত ধূলিমেঘ স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, এক বিশাল বাহিনীই ইয়ামামা পানে ধেয়ে আসছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অধীনে মাত্র দুই হাজার সৈন্য কিংবা সর্বোচ্চ ঐ সৈন্যরা ছিল যারা সবেমাত্র ফৌজে যোগ দিয়েছে। তাদের উপর আস্থা রাখার মত এখনও তারা হয়ে উঠেছিল না। তাদের ব্যাপারে আশঙ্কা ছিল যে, অবস্থা প্রতিকূল দেখলে তারা শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলাতে পারে কিংবা নিজেরাই শক্ত হয়ে পশ্চাৎ হতে আক্রমণ করতে পারে।

“মুজাহিদগণ!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কেল্লাসদৃশ ভবনের ছাদ হতে উচ্চস্বরে বলেন–“চুড়ান্ত পরীক্ষার সময় দ্বারপ্রান্তে। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তোমাদের সহায় নেই।” এটুকু বলেই হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নীরব হয়ে যান। কারণ ইতিমধ্যে তার কানে আগত বাহিনী হতে সমরসঙ্গীত ও ঢোলের আওয়াজ ভেসে আসে।

আক্রমণকারীরা কখনো যুদ্ধ-সঙ্গীত বাজাতে বাজাতে আসে না। সঙ্গীতের সুর ক্রমে উচ্চকিত হতে থাকে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দূরে দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন। ধুলোও ততক্ষণে নিকটে এসে গিয়েছিল। ধুলোর চাদর ভেদ করে উট ঘোড়া দেখা যেতে থাকে। ধুলোর পর্দার অন্তরাল হতে আগত বাহিনী ‘নারায়ে তাকবীর’ দিচ্ছিল।

“ইসলামের কাণ্ডারীগণ!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উপর থেকে চিৎকার করে জানাল ‘আল্লাহর সাহায্য আসছে।… সামনে এগিয়ে যাও। তাদের অভ্যর্থনা জানাও। খোঁজ নাও তারা কারা।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এক প্রকার ছুটে নীচে চলে আসেন। ঘোড়ায় চেপে বসে বাতাসের বেগে বসতি এলাকা থেকে বেরিয়ে যান। ওদিকে আগন্তুক বাহিনীও বসতির কিছু দূরে এসে থেমে যায়। সেখান থেকে দুটি ঘোড়া সামনে অগ্রসর হয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ততক্ষণ তাদের পর্যন্ত পৌঁছে যান এবং সামনে দু’অশ্বারোহীকে দেখে ঘোড়া হতে নেমে আসেন। অপর অশ্বারোহীয়ও নেমে আসে। তারা মুজার এবং রবীয়া গোত্রের নেতা ছিল।

“মদীনা থেকে খবর আসে আপনার সাহায্যের খুব প্রয়োজন।” –হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে চিনতে পেরে এক নেতা তাকে বলে–“আমি চার হাজার সৈন্য এনেছি। তাদের মাঝে উষ্ট্রারোহী, অশ্বারোহী এবং পদাতিকও আছে।”

“আর চার হাজার সৈন্য আমার গোত্রের আছে”–অপর নেতা জানায়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু আনন্দের আতিশয্যে উভয়কে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করেন এবং প্রচণ্ড খুশীতে কম্পিত কণ্ঠে বলেন “আল্লাহর কসম। তিনি কখনো আমাকে নিরাশ করেননি।”

***

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অধীনে এখন দশ হাজারের এক বিশাল বাহিনী। তিনি মুজার এবং রবীয়া গোত্রপতিকে উত্তমরূপে বুঝিয়ে দেন যে, তাদের গন্তব্য কোথায় এবং শত্রু কেমন শক্তিধর।

“আমরা আপনার সাহায্যার্থে এসেছি জনাব খালিদ!” এক নেতা বলেন “আমাদের মঞ্জিল তথায় যেখানে আপনি যেতে চান।”

মদীনা হতে আমাদের এটাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, “সম্মিলিত সৈন্যের আমীর আপনি”–অপর নেতা বলেন, “অতএব যেখানেই যেতে বলবেন সেখানেই আমরা যাব। শত্রু যেমনই হোক না কেন লড়ব।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইরান সাম্রাজ্যের এক গভর্নর–হুরমুজের নামে একটি পত্র লেখেন। তৎকালে ইরাক ইরান সাম্রাজ্যেরই একটি প্রদেশ ছিল। তার গভর্নর বা প্রশাসক ছিল হুরমুজ। বর্তমান কালের জেলা প্রশাসকের মত অবস্থান ও ক্ষমতা ছিল তার। ইতোপূর্বেও তার সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা হয়েছে। সে বড়ই জঘন্য প্রকৃতির, মিথ্যাবাদী এবং ধোঁকাবাজ ছিল। অভদ্রতার ক্ষেত্রে তার নাম প্রবাদবাক্য স্বরূপ ব্যবহৃত হত।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার নামে নিম্নোক্ত ভাষায় পত্র লিখেন :

আপনি ইসলাম গ্রহণ করে নিলে নিরাপদে থাকবেন। এতে সম্মত না হলে আপনার শাসনাধীন এলাকা ইসলামী রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত করে দিন। এর প্রশাসক আপনিই থাকবেন। ইসলামী খেলাফতের রাজধানী মদীনাতে নির্ধারিত কিছু কর প্রেরণ করবেন। এর বিনিময়ে আমরা আপনার জনগণ এবং এলাকার শান্তি স্থিতিশীলতা ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিব। এটাও মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে তখন নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনার নিজের কাঁধেই থাকবে। আল্লাহই ভাল জানেন আপনার পরিণতি কি হবে। জয়-পরাজয় আল্লাহর হাতে; কিন্তু আমি আপনাকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া জরুরী মনে করছি যে, আমরা ঐ জাতি যাদের কাছে মৃত্যু ততধিক প্রিয় যেমন বেঁচে থাকা আপনাদের কাছে প্রিয় … আমি আল্লাহর পয়গাম আপনার পর্যন্ত পৌঁছে দিলাম।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পত্রটি এক দূতের হাতে দিয়ে বলেন, দু‘মুহাফিজ সাথে নিয়ে দ্রুত রওয়ানা হয়ে যাও এবং পত্রটি হুরমুজকে হস্তান্তর করে তার জবাব নিয়ে আসবে।

“তোমার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় আমি ইয়ামামায় বসে থাকবো না।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দূতকে বলেন, “ইরাকের সীমান্তবর্তী এলাকার কোথাও আমাকে খুঁজবে। উবলা নামটি মনে রাখবে। সেখানে গেলে তুমি আমার ঠিকানা পেয়ে যাবে।”

দূত রওয়ানা হয়ে যাবার পর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ১০ হাজার বাহিনীকেও মার্চ করার নির্দেশ দিলেন।*

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর জানা ছিলনা যে, তার জন্য আল্লাহর আরো সাহায্য অপেক্ষমাণ। আমীরুল মু’মিনীন হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু উত্তর-পূর্ব আরব এলাকায় বসবাসরত তিন গোত্রের প্রধান মাজউর বিন আদী, হুরমুলা এবং সুলামা–বরাবর পত্র প্রেরণ করেন যে, নিজ নিজ গোত্রের অধিক সংখ্যক যোদ্ধাদেরকে মুসান্না বিন হারেছার কাছে নিয়ে যাও। এ সমস্ত লোক যেন যুদ্ধ-অভিজ্ঞ এবং বীর বাহাদুর হয়। তাদেরকে এ কথাও জানিয়ে দেয়া হয় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ফৌজ নিয়ে আসছে। সেই হবে সকল বাহিনীর সর্বাধিনায়ক।

উবলা সহ ইরানের শাসনাধীন অন্যান্য আরব মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার চিত্র কিছুটা ভিন্নতর ছিল। প্রথমদিকে মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্র এলাকার কতক আগ্রহী যুবককে ইরানী সেনাচৌকি এবং ফৌজ কাফেলায় গুপ্ত হামলা চালাবার জন্য নিজের সাথে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন তার প্রয়োজন পড়ে ঐ এলাকা হতে একটি বাহিনী তৈরি করার। কিছু সৈন্য তিনি নিজ গোত্র বকর ইবনে ওয়ায়েল থেকে সংগ্রহ করেন। এ সকল সৈন্য হযরত আলী ইবনে হাজরনী রাযিয়াল্লাহু আনহু নামক মদীনার এক সেনাপতির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইরাকের সীমান্তবর্তী এলাকায় মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু আরো সৈন্য সংগ্রহ করতে ইরান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে এক গোপন বার্তায় জানান যে, যুবক শ্রেণীর মধ্য হতে যারা ইরানীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুর্গম আস্তানায় আসতে পারে তারা যেন শীঘ্রই চলে আসে।

মুসলমানদের পক্ষে এলাকা ছেড়ে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ যরথুস্ত্রের সেনারা মুসলিম বসতিগুলোর উপর কড়া নজর রাখত। তাদের বিশ্বাস ছিল, বিভিন্ন চৌকিতে গেরিলা হামলার পশ্চাতে অবশ্যই মুসলমানদের হাত আছে। এখন সেই সাথে আবার যোগ হয় হেড কোয়ার্টার থেকে আগত নতুন নির্দেশ। এই নির্দেশদাতা ছিল ইরাক প্রদেশের শাসনকর্তা হুরমুজ।

হুরমুজের এই নয়া নির্দেশের পশ্চাতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দূত ছিল অন্যতম কারণ। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হুরমুজের উদ্দেশে এক পত্র লিখে দূত মারফত পাঠিয়ে দেন। দূত যথাসময়ে পত্র নিয়ে পৌঁছে। দূত এখন ইরান সাম্রাজ্যের এক প্রাদেশিক শাসনকর্তার দরবারে। হুরমুজকে যখন জানানো হয় যে, মদীনার সেনাপতি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দূত এসেছে; সে আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী, তখন হুরমুজের চেহারায় ঘৃণা ও তুচ্ছতার ছাঁপ ফুটে ওঠে।

“কোন মুসলমানের চেহারা আমি দেখতে চাই না” হুরমুজ বলে–“কিন্তু আমি জানতে চাই তার আসার উদ্দেশ্য কী?

“যরথুস্ত্রের কসম!” এক মন্ত্রী দাড়িয়ে হুরমুজকে বলে–“খালিদের দূত নিশ্চয় এমন কোন পয়গাম নিয়ে এসেছে, যা তার মৃত্যুর পয়গাম হিসেবেই বিবেচিত হবে।”

“তাকে ভিতরে নিয়ে এসো”– হুরমুজ বলে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দূত দুই সশস্ত্র দেহরক্ষীর সাথে অত্যন্ত দ্রুতবেগে হুরমুজের দরবারে প্রবেশ করে এবং সোজা হুরমুজের দিকে এগিয়ে যায়। দুই বর্শাধারী এসে তার পথরোধ করে দাঁড়ায়। কিন্তু দূত তাদের এড়িয়ে হুরমুজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“আসসালামু আলাইকুম!” দূত বলে–“অগ্নি পূজারী হুরমুজকে মদীনার সেনাপতি হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সালাম। আমি তাঁর এক পত্র নিয়ে এসেছি” “আমরা ঐ সেনাপতির সালাম গ্রহণ করব না যার দূতের মাঝে আমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি অনুধাবনের যোগ্যতা পর্যন্ত নেই” হুরমুজ তাচ্ছিল্যভরে বলে”– মদীনায় কি সব জংলী আর গোঁয়ার বসবাস করে? তোমাকে আসার সময় কেউ বলে দেয়নি যে তুমি এক শাহী দরবারে যাচ্ছ? দরবারের ভদ্রতা ও রীতি-নীতি তোমাকে শিক্ষা দেয়া হয়নি?”

“মুসলমান একমাত্র আল্লাহর দরবারের শিষ্টাচার সম্বন্ধে অবহিত হয়।” দূত অসীম সাহসে মাথা আরেকটু উঁচু করে বলে “ইসলামের দৃষ্টিতে তার কোনই মর্যাদা নেই যে মানুষের মাঝে দরবারের প্রভাব সৃষ্টি করতে চায়। আমি আপনার দরবারী (আমত্য) নই। আমি ঐ সেনাপতির দূত যাকে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আল্লাহর তরবারী আখ্যা দিয়েছেন’।

“হুরমুজের সামনে ঐ তরবারি ভোঁতা হয়ে যাবে” হুরমুজ খোদাদ্রোহীর ভঙ্গিতে বলে এবং হাত বাড়িয়ে দিয়ে নির্দেশের সুরে বলে “দাও, দেখি তোমাদের আল্লাহর তরবারি কি লিখে পাঠিয়েছে?”

দূত তার বাড়িয়ে দেয়া হাতে পত্র উঠিয়ে দিলে হুরমুজ এমনভাবে পড়তে থাকে যেন তামাশা বশত সে হাতে একটি কাগজ নিয়েছে। পত্র পড়ে সে পত্রটি মুঠোর মধ্যে এমনভাবে দলা মোচড় করে, যেন এটা একটি ময়লা আবর্জনা যাকে সে এখনি ছুড়ে ফেলবে।

“পোকা মাকড় কি এই স্বপ্নে বিভোর যে, সে একপাহাড়ী ভূমির সাথে টক্কর লাগাতে পারবে?” হুরমুজ বলে–“মদীনাবাসীদের কেউ জানায়নি যে, হিরাক্লিয়াসের মত মানুষও ঐ পাহাড়ে মাথা ঠুকে কেবল নিজের মাথাই ক্ষত বিক্ষত করেছে? আমাদের সৈন্যদের এক ঝলক তোমাদের দেখিয়ে দিব, যাতে তোমরা সেনাপতি এবং বৃদ্ধ খলীফাকে গিয়ে বলতে পার যে, তারা যেন ইরাকের সীমান্ত এলাকার প্রতি চোখ তুলে তাকাবারও সাহস না করে।”

“সেনাপতি আমাকে শুধু এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি আপনার বরাবর পত্র হস্তান্তর করে তার জবাব নিয়ে আসব” দূত বলে “আমি আপনার কোন কথার জবাব দিতে পারি না। কারণ, আমাকে এ ব্যাপারে কোন নির্দেশ দেয়া হয় নি।” “তোমাদের মত দূতের সাথে আমরা এ আচরণ করি যে, তাকে বন্দীশালায় নিক্ষেপ করি”, হুরমুজ বলে–“আমাদের মনে দয়ার উদ্রেক হলে তাকে কয়েদখানার নির্যাতন থেকে বাঁচাতে জল্লাদের হাতে তুলে দিই।”

“আমার প্রাণ আমার আল্লাহর হাতে” দূত পূর্বের চেয়েও অধিক সাহসিকতার সাথে বলে “আপনি মুসলমান হলে জানতেন একজন অতিথির সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু একজন নাস্তিক এবং অগ্নিপূজারির থেকে এর বেশী আশা করা যায় না। আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিন। কিন্তু মনে রাখবেন, মুসলমানরা আমার এবং আমার নিরাপত্তা কর্মীদের রক্তের প্রতিটি ফোটার প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়বে।”

হুরমুজ সহসা সোজা হয়ে বসে। রাগে তার চোখ লাল হয়ে যায়। রাগের এই চিহ্ন তার মুখাবয়ব ছেঁপে যায়। মনে হয় এখনই সে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই দূতকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।

“আমার দরবার থেকে তাকে বের করে দাও” হুরমুজ গর্জে ওঠে বলে। বর্শা ধারী চার পাঁচ সভাষদ দ্রুত সামনে অগ্রসর হয়। দূতের দুই মুহাফিজও চোখের পলকে তলোয়ার কোষমুক্ত করে। ইতোপূর্বে তারা দূতের পশ্চাতে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন তারা দূতের দুই পাশে এমনভাবে পজিশন নিয়ে দাঁড়ায় যে, তাদের পিঠ দূতের দিকে ছিল। “হুরমুজ!” দূত গম্ভীর কণ্ঠে বলে–“বীর ময়দানে যুদ্ধ করে। শক্তির দাপট নিজ দরবারে দেখাবেন না। আমার সেনাপতির কাঙ্ক্ষিত জবাব আমি পেয়ে গেছি। আমাদের কোন প্রস্তাব আপনি গ্রহণ করেননি। এটাই কি আপনার জবাব?”

“বের হয়ে যাও এই দরবার থেকে”–হুরমুজ ক্রোধকম্পিত উচ্চস্বরে বলে “তোমার সেনাপতিকে বলবে, রণাঙ্গনে আমার শক্তির পরীক্ষা নিতে।”

হুরমুজের বর্শাধারী সভাষদরা হুরমুজের ইশারায় থেমে গিয়েছিল। দূতের মুহাফিজরা তলোয়ার কোষে চালান দেয়। দূত পিছন দিকে ঘুরে দাড়ায় এবং দ্রুত কদমে দরবার ছেড়ে বেরিয়ে আসে। দুই মুহাফিজ তার পিছু পিছু চলতে থাকে।

দূত চলে গেলে হুরমুজ মুষ্টিবদ্ধ হাত খোলে। সেখানে তখনও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া পত্র ছিল। পত্রটি একটি পাতলা চামড়ায় লিখিত থাকায় হাতের মুঠো খুলতেই পত্রটি সোজা হয়ে আবার সামনে ভেসে ওঠে। হুরমুজ পত্রটি পারস্য সম্রাট উরদুশাহের বরাবর এই সংবাদ যোগ করে প্রেরণ করে যে, সে মুসলমানদের মোকাবিলার জন্য এ মুহুর্তেই সীমান্ত এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং সীমান্তের অদুরেই সে মুসলমানদের খতম করে আসবে।

“হুরমুজের জয় হোক”–তার এক মন্ত্রী বলে, “যে শত্রু আপনি সীমান্তের বাইরে খতম করতে চান তারা পূর্ব হতেই সীমান্তের মধ্যে অবস্থানরত।” হুরমুজ প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তার কথার ব্যাখ্যা জানতে চায়। “তারা হচ্ছে আরব মুসলমান।” মন্ত্রী তার কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে দজলা এবং ফোরাতের মিলন মোহনায় তারা অবস্থান করে। উপকূলীয় এ এলাকাটি উবলা পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। তারা অনেক পূর্ব হতেই ইরান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মদীনাবাসীরা আমাদের উপর আক্রমণ করলে এ অঞ্চলের মুসলমানরা নিশ্চিতভাবে তাদের সাথে গিয়ে মিলিত হবে।”

“অভয় দিলে আমি একটি কথা পেশ করতে চাই” প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলে–“কয়েকদিন ধরে লাগাতার খবর আসছে যে, যুদ্ধসক্ষম অর্থাৎ যুবক শ্রেণীর মুসলমানরা নিজ নিজ এলাকা হতে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস তারা মুসান্না বিন হারেছার সাথে গিয়েই মিলিত হচ্ছে। এ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, তারা এখন ফৌজরূপে সুসংগঠিত হচ্ছে।”

“উধাও হয়ে যাওয়ার এই ধারাবাহিকতা বন্ধ করতে আপনি কোন পদক্ষেপ নেননি?” হুরমুজ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

“সেনা বহর নিয়মিত টহল দিচ্ছে এবং কড়া নজরদারী করছে” প্রতিরক্ষামন্ত্রী জবাব দেয়।

“তারপরেও মুসলমানরা উধাও হয়ে যাচ্ছে?” হুরমুজ তাচ্ছিল্য ভরা ক্রোধ কণ্ঠে বলে “সীমান্তবর্তী চৌকিতে এখনই নির্দেশ পাঠাও, যেন তারা মুসলিম বসতিতে গেরিলা হামলা চালাতে থাকে। প্রত্যেকটি বসতির সমস্ত লোককে বাইরে বের করে দেখ, কতজন অনুপস্থিত এবং কতদিন ধরে অনুপস্থিত। যে পরিবার ও ঘরের লোক অনুপস্থিত পাবে তা জ্বালিয়ে দিবে। কোন মুসলমানকে সীমান্তের দিকে যেতে দেখলে তাকে বন্দী করে হত্যা করে ফেলবে। দূর হতে তীর নিক্ষেপ করবে।”

সীমান্তের গা ঘেঁষে একটি মুসলিম বসতি ছিল। কয়েকজন ইরানী সৈন্য সেখানে গিয়ে ঘোষণা করে যে, ছোট্ট শিশু থেকে নিয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই যেন বাইরে বেরিয়ে আসে। সৈন্যরা ঘরে ঘরে ঢুকে টেনে হিঁছড়ে লোকদের বাইরে বের করতে থাকে। মহিলাদের এক স্থানে আর পুরুষদেরকে আরেক স্থানে দাঁড় করানো হয়। সৈন্যদের মেজাজ ছিল রুক্ষ্ম এবং মূর্তি ছিল উগ্র। তারা কথায় কথায় বিশ্রি ভাষায় গালি দিচ্ছিল এবং ধাক্কা মেরে মেরে মানুষ এদিক ওদিক নিচ্ছিল। তারা বারবার এ কথা বলছিল যে, অত্র এলাকার যারা যারা অনুপস্থিত তাদের নাম বল এবং বাড়ী-ঘর দেখিয়ে দাও। সমস্ত জনতা নিরব নিশ্চুপ। কেউ মুখ খোলে না।

“জবাব দাও। বল কে কে নেই” ইরানী কমান্ডার রাগে গরগর করতে করতে চিল্লাতে থাকে।

কোন জবাব আসেনা। কমান্ডার এগিয়ে গিয়ে এক বৃদ্ধ লোকের ঘাড় ধরে নিজের দিকে টেনে এনে জিজ্ঞাসা করে যে, বল্ এই জনতার মাঝে কে কে অনুপস্থিত।

“আমার জানা নেই” বৃদ্ধ জবাব দেয়।

কমান্ডার খাপ থেকে তরবারী বের করে বৃদ্ধের পেটে আমূল বসিয়ে দেয় এবং ঝটকা দিয়ে তরবারী বের করে আনে। বৃদ্ধ দুই হাত পিঠে রেখে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কমান্ডার আরেকবার জনতার দিকে চায়। সহসা এক প্রান্ত হতে ৮/১০ টি ঘোড়া ছুটে আসে। প্রত্যেক আরোহীর হাতে বর্শা ছিল। তারা এত দ্রুত এসে উপস্থিত হয় যে, ইরানী বাহিনী ঠিকমত তাদের দেখতেও পায়না। অথচ এরই মধ্যে তাদের অধিকাংশের শরীর বর্শাবিদ্ধ করে অশ্বারোহীরা যে গতিতে আসে সে গতিতে বেরিয়ে যায়। ইরানীদের সংখ্যা ৪০ /৫০ জন ছিল। তাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ৮/১০ জন মাটিতে লুটিয়ে ছট ফট করছিল।

ছুটন্ত অশ্বের খুরধ্বনি শোনা যেতে থাকে, যা ক্রমশ দূরে সরে যেতে যেতে আবার নিকটে আসতে থাকে। এবার ফৌজের লোকেরা বর্শা এবং তলোয়ার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে অশ্বারোহীদের পথের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু আচমকা পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। বসতির লোকেরা পশ্চাৎ হতে এক যোগে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কল্পনাতীত এ অতর্কিত আক্রমণ হতে এক মাত্র তারাই জিন্দা থাকে, যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। অতর্কিত আক্রমণকারী আগন্তুকরা যখন আবার ফিরে জনতার কাছে আসে তখন তাদের বাধ্য হয়ে ঘোড়া থামাতে হয়। কারণ উপস্থিত জনতা ইরানীদের খতম করতে করতে তাদের সামনে এসে পড়ে।

ইতোপূর্বে মুসলমানরা এভাবে সামনাসামনি ইরানীদের মোকাবিলা করার সাহস করেনি। কোন ইরানীকে কিছু বললে তাকে তার গোত্রসহ উচ্ছেদ ও নির্মূল করে দেয়া হত। এবার মুসলমানরা এ কারণে সাহসী হয়ে ওঠে যে, তারা জানতে পেরেছিল যে, মদীনার সৈন্য এসে গেছে, যে অশ্বারোহীরা অতর্কিত এসে আক্রমণ করেছিল তাদের কতক ছিল অত্র অঞ্চলের আর কিছু ছিল অন্য বসতির। এটা দৈবাৎ ঘটনা ছিল যে, তারা মুসান্না বিন হারেছার আস্তানার উদ্দেশে যাবার জন্য এই বসতির কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা দূর থেকে এলাকাবাসীকে ঘর ছেড়ে বাইরে দাঁড়াতে এবং সেখানে ইরানীদের উপস্থিতি দেখতে পায়। তারা চাইলে ইরানীদের চোখ এড়িয়ে চলে যেতে পারত। কিন্তু ইরানী কমান্ডার কর্তৃক বৃদ্ধের পেটে তরবারী ঢুকিয়ে দেয়ার দৃশ্য দেখে তারা পরস্পর পরামর্শ ছাড়াই ঘোড়ার মুখ ইরানীদের দিকে ফিরায়। ইরানীরা তাদের আগমনের কথা বিন্দুমাত্র টের পায় না। এটা ছিল সম্পূর্ণ আল্লাহর সাহায্য, যা তারা ঠিক সময়ে অযাচিতভাবে লাভ করে।

এ এলাকার লোকদের সৌভাগ্যবানই বলতে হয়। কেননা তারা এভাবে গায়েবী সাহায্যের ফলে এবারের মত ইরানীদের নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু অন্যান্য বসতির অবস্থা ছিল কেয়ামত সদৃশ। তাদের উপর নেমে এসেছিল কেয়ামতের বিভিষীকা। প্রতিটি বসতির প্রত্যেকটি ঘর চেক করা হচ্ছিল। কতজন পুরুষ অনুপস্থিত তার তদন্ত নেয়া হতে থাকে। প্রতিটি বস্তিতে তারা এ সময় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল কোন কোন ঘরে আগুন লাগিয়ে ভস্ম করে দেয়।

তিন-চার দিন ধরে এই অমানবিক নিষ্ঠুরতা ও অপরাধচর্চা চলে। এর পরে বসতির দিকে খেয়াল দেয়ার সুযোগ ইরানীদের আর হয় না। হুরমুজ সসৈন্যে চলে আসে। সীমান্তে অবস্থানরত সৈন্যদেরকেও সে সাথে নিয়ে নেয় এবং সীমান্ত বর্তী এলাকা থেকে সামনে এগিয়ে যায়। তার ইচ্ছা ছিল সীমান্তের বহু দূরেই হযরত খালিদ বাহিনীর গতিরোধ করা। হুরমুজের অগ্রাভিযান দ্রুতগতির ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *