৪১. জেফরি গ্রিমস

৪১.

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

জেফরি গ্রিমস এইমাত্র তার একান্ত সেক্রেটারি সিনথিয়া’র সাথে রোমান্টিক মুহূর্ত সেরে আরাম করে বসল এক্সিকিউটিভ চেয়ারে। ওর শার্টের উপরের দুটো বোম খোলা। জেফরির অনেক বয়স হলেও এখনও বিয়ে করেনি। প্রচুর অর্থের অধিকারী, হ্যান্ডসাম ব্যাচেলর হয়েই দিন পার করে দিচ্ছে। বিয়ে করে একজন নারীর কাছে বন্দি হয়ে থাকবে আর্থিকভাবে দুর্বল পুরুষেরা। জেফরি’র মতো বিত্তশালীরা কেন একজন নারীর কাছে দিনের পর দিন বছরের পর বছর নিজের যৌবন অপচয় করবে?

হঠাৎ জেফরি’র সেল ফোন একটা বিশেষ রিংটোনে বেজে উঠল। চমকে উঠল জেফরি গ্রিমস। এই রিংটোন শুনলেই ওর রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসে। অবশ্য এটা জেফরি ইচ্ছে করেই সেট করেছে। ফোনটাকে কানের কাছে নিল ও।

হ্যালো,

‘আগামীকাল দ্বীপে আরেকটা ঘটনা ঘটানো হবে। দ্বীপের ভাগ্য লেখা হয়ে যাবে কাল। বরাবরের মতো যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে।

অনেক সময় লাগছে। আমি ভেবেছিলাম শেষ যে ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তাতেই কাজ হয়ে যাবে। আপত্তি তুলল জেফরি।

‘এত সহজ নয়। অনেক বাধা ঠেলে এগোতে হচ্ছে।

‘এদিকে আমার অবস্থা শোচনীয়। ব্যাংকের লোকজন বারবার টাকা চেয়ে তাগাদা দিচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে টাকা দরকার। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। জানেন তো আমার যাবতীয় অর্থ আপনি আপনার কথামতো খরচ করেছি।’

হুম। আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সব হয়ে যাবে। তারপর আপনি দ্বীপ থেকে আপনার খরচ হওয়া অর্থের চেয়ে অনেক গুণ বেশি অর্থ তুলে নিতে পারবেন। তৈরি থাকুন, খুব শীঘ্রই আপনাকে যাত্রা শুরু করতে হবে।’

‘গত এক সপ্তাহ ধরে তৈরি হয়ে বসে আছি।

“ঠিক আছে। আপনাকে আর অপেক্ষা করতে হবে না। ওপাশ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

আজকের ফোন কলটা পেয়ে জেফরি বেশ খুশি। কাজ গুছিয়ে আনা হয়েছে তাহলে। খুশিতে পিংপং বল নিয়ে রুমের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত খেলতে শুরু করল সে।

একবার দ্বীপের যাবতীয় খনিজ পদার্থের স্বত্ত্ব তার হাতে চলে এলেই কেল্লাফতে! রাতারাতি ওর কোম্পানীর শেয়ারের দাম রকেটগতিতে বেড়ে যাবে। দ্বীপের জঙ্গল-টঙ্গলে কত খনিজ পদার্থ আছে কে জানে। গ্রিমসের সামনে অঢেল অর্থ লাভের হাতছানি।

সিডনি হারবারে রাখা নিজের ইয়টের ক্যাপ্টেনকে ফোন করল গ্রিমস। জানাল, সবধরনের রসদ নিয়ে তৈরি থাকতে। জরুরী কাজে সমুদ্রে নামতে হতে পারে।

শার্টের বোম লাগিয়ে গায়ে স্যুট চড়াল জেফরি। একটু পর কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে ওর মিটিং আছে। তারাও ওর লাভের ভাগীদার। কারণ জেফরি তাদের কাছ থেকে অর্থসংগ্রহ করেছে।

দ্বীপে বিদ্রোহীদের জয় হয়েছে এই বিষয়টা তাদেরকে জেফরি এখুনি জানাতে চায় না। খুশির খবর একটু দেরিতে দিলে ক্ষতি নেই।

***

গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যান্ড

‘তাহলে এদেরকে বন্দি করা হয়েছে? কঙ্কালগুলোর হাতে থাকা প্লাস্টিকের বাঁধনগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল লিও।

‘হুম, তাই তো মনে হচ্ছে। স্যাম কঙ্কালগুলোর দিকে ঝুঁকে নিচুগলায় বলল।

‘কিন্তু বন্দি করেছিল কারা?’ প্রশ্ন করল রেমি

 ‘বিদ্রোহীরা… নাকি?’ লিও বলল।

হতে পারে। ল্যাজলো সায় দিল। “বিদ্রোহীরা এখানে কতদিন ধরে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে?

‘জানি না।’ বলল স্যাম। তবে যতদূর বুঝেছি অল্প কিছুদিন হলো তাদের উদয় হয়েছে।

‘ঠিক। এদের সম্পর্কে ২০০০ সাল থেকে এপর্যন্ত সেরকম কোনো খবর চাউর হয়নি। রেমি বলল।

 গুহার দূরবর্তী অংশের দেয়ালের দিকে ফ্ল্যাশলাইট তাক করল ল্যাজলো। ‘এখন ওসব বাদ দিয়ে আমাদের মূল কাজে মনোযোগ দিলে ভাল হয়। গুপ্তধন খুঁজতে এগোই আমরা? নাকি?”

কঙ্কালগুলোর দিকে তাকাল লিও। ল্যাজলো সাহেবের সাথে আমি একমত। চলো, গুপ্তধন খুঁজতে যাই। এগুলো পরেও দেখা যাবে। পালিয়ে তো যাচ্ছে না।

‘চলুন, ল্যাজলল, আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলুন। বলল রেমি।

‘দাঁড়াও!’ স্যাম থামাল ওদের। ওর দৃষ্টি সেই জলাশয়ের দিকে। আমি দেখতে চাই এটার গভীরতা কতটুকু।’

কী দরকার?’ লিও প্রশ্ন করল।

 ‘এমনও হতে পারে, জাপানিরা এই পানির নিচে গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছে। হাঁটু গেড়ে বসে হাতের ম্যাচেটি পানিতে চুবালো স্যাম। পাথরের সাথে বাড়ি লাগল সেটার। আস্তে আস্তে স্যাম জলাশয়ের মাঝখানে হাজির হলো। গভীরতা মাত্র ৩ ইঞ্চি। যাক, এখানে গুপ্তধন রাখেনি নিশ্চিত হলাম।’

এগিয়ে চলল ওরা। গুহার আরও গভীরে একটা সরু প্যাসেজে চলে এলো সবাই। এখানকার দেয়ালে ওর ফ্ল্যাশলাইটের আলোতে নীল-সাদা রঙ খেলা করছে। সবার সামনে আছে ল্যাজলো। হঠাৎ থামল সে।

কী হলো, মিস্টার ল্যাজলো? ছোট্ট করে প্রশ্ন করল রেমি।

 ‘এখানে আরও অনেক লাশ দেখতে পাচ্ছি। সে জবাব দিল।

 আগেরটার চেয়ে এই চেম্বার আকারে ছোট হলেও এখানে লাশের সংখ্যা বেশি। লাশ না বলে কঙ্কাল বলা ভাল। কম করে হলেও ত্রিশটা আছে। সবগুলো কঙ্কালের মাঢ়ি উন্মুক্ত। ওগুলোর দাঁত দেখে মনে হচ্ছে বিদ্রূপ হাসি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে অভিযাত্রী দলকে।

রীতিমতো নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে দেখছি।’ বলল রেমি।

 ‘এগুলোর আকার দেখো। লিও বিড়বিড় করল।

মাথা নাড়ল স্যাম। সবগুলো বাচ্চাদের কঙ্কাল। পরীক্ষা করল স্যাম। ‘কিন্তু মারা যাওয়ার সময় এদের হাত বাঁধা ছিল না।’

কিন্তু কয়েকজনের হাতে ছিল। একপাশের দেয়ালের কাছে থাকা তিনটা কঙ্কাল দেখে বলল ল্যাজলো। আগের মতো প্লাস্টিকের বাঁধন এখানে। হাত দুটো পেছন করে বাধা ছিল।’

 ‘কিন্তু এদেরকে কীভাবে খুন করা হয়েছিল তার কোনো চিহ্ন নেই। স্যাম মন্তব্য করল। হয়তো বড় কোনো বিপর্যয় হয়েছিল এখানে। তারপর বোধহয় স্থানীয়রা গণকবর দিয়েছে?

‘তাহলে এদের হাতে বাঁধন কেন?’ প্রশ্ন ছুড়ল রেমি।

 ‘এখানে কয়েকটা জুতো আছে। আধুনিক জুতো। স্যাম বলল।

‘ধরলাম, বিদ্রোহীরা এই কাজ করেছে। কিন্তু আমার মাথায় ঢুকছে না, বিদ্রোহীরা কেন বাচ্চাদেরকে খুন করবে?’ কোনো মোটিভ পাচ্ছি না।’ বলল ল্যাজলো।

গুহার গভীরে আরও সরু অংশের দিকে পা বাড়াল স্যাম। এটা দেখো। ডাকল সে।

সবাই এগিয়ে গিয়ে দেখল আরেকটা কঙ্কাল। অবশ্য এটা এখনও পুরোপুরি কঙ্কাল হয়নি। জায়গায় জায়গায় এখনও পচন ধরা মাংস দেখা যাচ্ছে। পাজরের ওখানটায় কিলবিল করছে বিভিন্ন পোকা।

 ‘এটা অল্পদিনের’ পোকা দেখে ঘেন্না লাগছে রেমি’র তাই ঠোঁট চেপে বলল কথাটা।

হুম, এটা সম্ভবত প্রাপ্তবয়স্ক কারও লাশ। তবে প্রাপ্তবয়স্ক না হলেও অন্যান্য কঙ্কালগুলোর চেয়ে এর বয়স বেশি সেটা নিশ্চিত। লাশের সাইজ দেখে বলল স্যাম। কিন্তু ঘাড় খেয়াল করে দেখো। ওটা ভেঙ্গে গেছে। আমার মনেহয় ঘাড় ভেঙ্গে মারা গেছে। বাঁ হাত আর পায়ের গোড়ালী দেখো, এগুলোও ভাঙ্গা।

স্যাম ফ্লাশলাইট নিয়ে গুহার আরও ভেতরে ঢুকল। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে। রেমি ওর পিছু পিছু গিয়ে দৃশ্যটা দেখে স্যামের হাত ধরল। ইতিমধ্যে ল্যাজলো আর লিও-ও চলে এসেছে।

‘সর্বনাশ!’ বলল ল্যাজলো।

সামনে আরও কম করে হলেও ১০০ টা কঙ্কাল পড়ে আছে। ওরা সাবধানে এগোল সেদিকে। এবার ওদেরকে পথ দেখাচ্ছে স্যাম। একটা খুলি পরীক্ষা করতে শুরু করল ও। এটার বয়স বেশি মনে হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক কারো হবে। বেশ বড়। মাথায় গুলি লেগে মৃত্যু হয়েছিল। খুলিতে আঘাতের দাগ দেখা যাচ্ছে।’

‘এটাতেও একই অবস্থা। রেমি জানাল।

‘এই বাচ্চার কঙ্কালটা দেখুন,’ বা পাশ থেকে বলল ল্যাজলো। এর দুই। পা ভাঙ্গা।

‘ওটা কী?’ একটা কঙ্কালের দিকে লাইট তাক করে রেমি প্রশ্ন করল। স্যামও তাকাল সেদিকে।

‘মনে হচ্ছে, হাতকড়া। মরিচা ধরে তো চেনাই যাচ্ছে না। অনেক পুরানো। সম্ভবত যুদ্ধের সময়কার জিনিস।

 ‘আর কঙ্কালগুলো সে-সময় খুন হওয়া গ্রামবাসীর? ল্যাজলো জানতে চাইল।

 ‘সন্দেহ আছে।’ বলল স্যাম। নাউরুর ভাষ্যমতে, তখন যে যেখানে মারা গিয়েছিল সেখান থেকে আর কেউ সরিয়ে সত্ত্বার করার সুযোগ পায়নি। আর জাপানিরা কষ্ট করে লাশগুলো এত ভেতরে আনবে না সেটা নিশ্চিত। এখানে অন্য কাহিনি আছে।

‘তাহলে মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের সময় যারা আহত হয়েছিল এগুলো কি তাদের কঙ্কাল?’ রেমি বলল।

 “ হতে পারে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল স্যাম। গুহার ভেতরে নতুন আরেকটা প্যাসেজ শুরু হয়ে সেটা আরও ভেতরে চলে গেছে। স্যাম সেদিকে এগোল। কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো দলের কাছে।

 ‘সামনে আর কিছু নেই। পথ বন্ধ। হয়তো ওপাশে গুহার আরও অংশ আছে কিন্তু এখান দিয়ে আর সেদিকে যাওয়া সম্ভব না।

‘আমরা যদি যেতে না পারি তাহলে নিশ্চয়ই জাপানিরাও যেতে পারেনি। অন্য পথ ধরতে হবে। কিন্তু ভয়ঙ্কর বিষয়টা হলো, এই কঙ্কালগুলোর সাথে গুপ্তধনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে কীসের সম্পর্ক আছে?’ বলল রেমি।

‘আপাতত আমাদের হাতে উত্তর নেই। বরং আরও বেশ কয়েকটা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। রহস্যের সমাধান না হয়ে রহস্য আরও বাড়ছে। স্যাম জানাল।

‘সবকিছুর উত্তর বের করতে হবে।’

‘আমি তোমার সাথে একমত।

ল্যাজলো তাকাল স্যামের দিকে। এই কঙ্কালগুলোকে যুদ্ধের আমলের ধরে নিতাম। কিন্তু বাচ্চাদেরগুলোই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। আমি ভাবছি, জায়ান্টের গল্পগুলো সত্য কিনা! আপনি বলে ছিলেন না, গ্রামে গল্প প্রচলিত আছে জায়ান্টরা গ্রামবাসীদেরকে ধরে এনে খায়?

 রেমি ল্যাজলো’র দিকে তাকাল। ‘মিস্টার ল্যাজলো, জায়ান্ট বলে কিছু নেই। কী যে বলেন না!

‘ঠিক। কিন্তু তারপরও অপশন হিসেবে বললাম আরকী। বলা হয়, যা রটে তার কিছু তো ঘটে! যাক গে, এমনও হতে পারে এই কঙ্কালের পেছনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু সৈনিকদের হাত আছে যারা যুদ্ধের পরও অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেনি। কোন এক সিনেমায় যেন এরকম কাহিনি দেখেছিলাম। এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। সেই সিনেমায় দেখানো হয়েছিল, বিচ্ছিন্ন এলাকায় থাকায় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও তাদের কাছে কোনো বার্তা আসেনি। তাই তারা যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল! কেউ থামতে বলেনি। তারা থামেওনি।’

ল্যাজলো’র দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাল রেমি। এখন তারা থুড়থুড়ে বুড়ো। তাহলে কীভাবে সম্ভব?

‘আইকিউ কম থাকলে যা হয় আরকী।’ সুযোগ পেয়ে লিও খোঁচা মেরে দিল।

সবাই বেরিয়ে এলো গুহার ভেতর থেকে। ঘড়ি দেখল স্যাম। কর্নেলের নোটবুক মতে, এই ধার দিয়ে আর কোনো গুহা নেই।’

মাথা নাড়ল ল্যাজলো। তাহলে আমরা কী করব? চারিদিকে তো লাইমস্টোনে ভরপুর। আচ্ছা, কঙ্কালগুলোর কী হবে? আমাদের উচিত বিষয়টা দ্বীপের কাউকে রিপোর্ট করা।

‘আমরা রিপোর্ট করলেই প্রশাসন এই অংশ চষে ফেলবে। লিও জানাল। “আর সেটার পর গুপ্তধন পাওয়ার আশা করা সম্ভব না।

“কিন্তু এতগুলো মানুষের খুন…’ আমতা আমতা করল ল্যাজলো।

 ‘তা ঠিক আছে। আমরা রিপোর্ট করব, তবে এখানে আমাদের কাজ শেষ হওয়ার পর। গুপ্তধন পাওয়ার পর পুলিশকে জানাব। বাকিটা তারা করবে। এখন আমাদের কাজ শেষ করতে হবে। স্যাম ব্যাখ্যা করল বিষয়টা। কী? রাজি?’ জিজ্ঞেস করল ল্যাজলোকে।

মাথা নেড়ে সায় দিল ল্যাজলো। দিনের আলো আর কতক্ষণ থাকবে?

 ‘আরও আধবেলা পড়ে আছে। মাত্র সাড়ে এগারটা বাজে।

‘তাহলে আমরা এক কাজ করি। আরেকটা ঝরনার কাছে গিয়ে দেখি ওখানে কোনো গুহা পাওয়া যায় কিনা।

রওনা হলো সবাই। এবার রেমি আছে সবার আগে। স্যাম পেছনে তাকাল। ওর মনে হচ্ছে, আড়াল থেকে কেউ দেখছে ওদের।

‘আমি জানি, কথাটা বোকার মতো শোনাবে, কিন্তু তারপরও কেন যেন মনে হচ্ছে, আমরা এখানে একা নই। আস্তে করে বলল ও।

ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল রেমি? কেন? তুমি কি আবার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছ?’

মশকরা কোরো না, রেমি। আমি সিরিয়াস।

 “আরে বুদ্বু, শোনো, এখানে আমরা আর জায়ান্ট ছাড়া আর কেউ নেই।’

ইয়ার্কি করে তো উড়িয়ে দিচ্ছ আমার কথা। ঠিক আছে, দেখব।

.

 ৪২.

আরও আধাঘণ্টা চড়াই এগোনোর পর দেখা গেল জঙ্গল এখানটায় একটু হালকা হয়েছে। ক্রমশ পূর্বদিকে সরে এসেছে ওরা। রেমি থেমে বলল, ‘দেখো, আরেকটা গুহা। একটু দূরে গাছপালার আড়ালে থাকা দিকটায় নির্দেশ করল ও। সেদিকে এগোল সবাই। গুহাটা দেখতে বেশ ছোট। ভেতরে একজন মানুষ ঢোকাই কষ্টসাধ্য।

ঠিক বলেছ। বলল স্যাম। চলো বন্ধুরা, এটাই হবে হয়তো।

গুহার দিকে পা বাড়াল সবাই। জায়গাটা বিভিন্ন পাথরের টুকরোয় ভরা। হঠাৎ একটা টালমাটাল পাথরের উপর পা পড়ল স্যামের। কিন্তু দক্ষতার সাথে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে পতন ঠেকাল ও। পাথরটাকে সরাল সামনে থেকে। সাবধানে পা ফেলো। কিছু কিছু পাথর আলগা হয়ে আছে। সম্প্রতি কোনো পাহাড়ী ধ্বসের ফলে হয়তো এই আলগা পাথরগুলোর ছিটকে এসেছে।

জঙ্গল থেকে গুহাটার অবস্থান একটু উঁচুতে। সবার আগে স্যাম পৌঁছে গেল। ওর পিছে পিছে রেমি আর ল্যাজলোও উঠে গেল। বেচারা ল্যাজলো একটু হাপিয়ে গেছে। স্যাম ওদেরকে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় নিচের ঢালু জায়গা থেকে লিও’র চিৎকার ভেসে এলো।

‘গেছি রে!

স্যাম আর রেমি ছুটল লিও’র কাছে। দেখল দুটো বড় সাইজের পাথরের মাঝখানে লিও’র বাঁ পা আটকে গেছে। পাথরের কিনারের সাথে ঘষা লেগে ছিলে যাওয়ায় রক্ত ঝরছে। কীভাবে হলো? প্রশ্ন করল রেমি।

 ‘আমি একটা রামছাগল! নিচের দিকে না তাকিয়ে আশেপাশের দৃশ্য দেখার তালে ছিলাম। দাঁত দাঁত চেপে বলল লিও।

‘অবস্থা কী বেশি খারাপ? স্যাম জানতে চাইল।

‘ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, পা ভাঙেনি। টান দিয়ে পা-টা বের করার চেষ্টা করল লিও। ভাল মতো আটকে গেছে দেখছি।

‘ল্যাজলো, আমরা ম্যাচেটি দিয়ে কিছু পাথর সরিয়ে জায়গা বের করতে পারি। তাহলে লিও’র পা মুক্ত হয়ে যাবে। লিও’র দিকে তাকাল স্যাম। ‘আমরা কাজ শুরু করছি। যখন পায়ে চাপ কম অনুভব করবে তখন টান নিয়ে পা বের করে ফেলবে, ঠিক আছে?

হুম। ব্যথায় বেচারার চোখ দিয়ে পানি বেরোচ্ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই মিলে হাত লাগিয়ে লিও’র পা মুক্ত করে ফেলল। এখনও রক্ত বেরোচ্ছে পা থেকে। পায়ের উপর শরীরের ভার চাপিয়ে টেস্ট করল লিও। যাক, ভাঙেনি। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আগুন ধরে গেছে।

 ‘তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ করে ফেলি। রক্তপড়া বন্ধ করতে হবে।’ বলল রেমি। ওর ব্যাকপ্যাকে থাকা ফাস্টএইড কিটটা বের করে তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়ল।

লিও’র পায়ে থাকা বুটের রং বদলে রক্তাভ হয়ে গেছে। সাদা মোজা রক্তে ভিজে একাকার। দুই মিনিটের মধ্যে এসব পরিষ্কার করে রেমি একটা স্ট্রিপ দিয়ে ঢেকে দিল ছড়ে যাওয়া অংশটুকু। তারপর জখম হওয়া স্থানে অ্যান্টিসেপটিক লাগানোর পর বাটারফ্লাই ব্যাণ্ডেজ করে দিল। ব্যস, আপাতত এতেই চলবে।

কী অবস্থা?’ লিও-কে ধরে দাঁড় করাল স্যাম।

 ‘আরও কিছুক্ষণ তোমাদের সাথে থেকে বিরক্ত করতে পারব।

 ‘হাঁটতে পারবে?’ রেমি জানতে চাইল।

‘কোনমতে।’

গুহামুখের দিকে তাকাল স্যাম। ল্যাজলো, আপনি আর রেমি গুহা দেখে আসুন। আমি লিও’র কাছে থাকি।

 মুখ ব্যাদান করল। আমি দুঃখিত। আমার আরও সতর্ক হওয়া দরকার ছিল।

ব্যাপার না। গুপ্তধন হাতে চলে এলে এসব কিছুই মনে থাকবে না। বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল ল্যাজলো। রেমি এখন একটু নার্ভাস। তারপরও মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখল।

‘তাহলে তুমি এখানেই থাকছো?’

‘যদি দরকার পড়ে অবশ্যই আসব।’

‘আশা করছি, পড়বে না।’ রেমি বলল।

‘তুমিও যেতে পারো।’ স্যামকে বলল লিও। আমি এখানে চুপচাপ বসে থাকব। সমস্যা হবে না।’

“শিওর? জিজ্ঞেস করল স্যাম।

হুম। তবে তোমরা যদি কয়েকদিন পরে ফেরো তাহলে ভিন্ন কথা।’

‘উল্টাপাল্টা কথা! ল্যাজলো আর স্যামকে নিয়ে এগোল রেমি। শেষবারের মতো তাকাল রাশিয়ানের দিকে।

গুহার কাছে পৌঁছুনোর পর ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালো সবাই। নাক কুঁচকাল রেমি। গন্ধ আসছে। সালফার মনে হয়।’

‘এই জঙ্গলে কি ভালুক আছে নাকি?’ ল্যাজলো বলল ফিসফিস করে।

মনে হয় না। কিন্তু নিশ্চিত করে কিছু বলাও যাচ্ছে না। জাপানিরা এখানে কী কী করে গেছে কে জানে।

হুম। এমনও হতে পারে জাপানিরা ভালুক পুষেছিল যাতে শত্রুদেরকে আক্রমণ করতে পারে।’

‘ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।’ বলল ল্যাজলো।

এবারও সামনে যাবে নাকি রেমি? স্ত্রীকে বলল স্যাম।

না। এবার তুমি যাও।’

স্যাম মাথা নিচু করে গুহার ভেতরে ঢুকল। গুহার ভেতরে উচ্চতা মাত্র ৪ ফুট। বুড়ো মানুষের মতো ঝুঁকে এগোচ্ছে ওরা। তবে প্রস্থে বেশ জায়গা আছে। আগের গুহার মতো এই গুহাটা বড় নয়। মাত্র একটা অংশ আছে এতে। ব্যস।

একটা ভাল খবর দিচ্ছি। এখানে কোনো কঙ্কাল নেই।’ বলল স্যাম।

ল্যাজলো বলল, ‘গুপ্তধনও নেই।

 হুম। আমরা তাহলে এখান থেকে বেরোতে পারি।’ বলল রেমি।

গুহার ভেতরে আরেকটু চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে এলো সবাই। দিনের আলো ওদের চোখে বেশ সজোরে আঘাত হানল। চোখ ছোট করে ফেলল সবাই।

এবার? ল্যাজলো প্রশ্ন করল।

চারদিকে তাকিয়ে দেখল স্যাম। তারপর তাকাল লিও’র দিকে। একটু দূরে বেচারা আহত পা নিয়ে বসে আছে। স্যাম ঘড়িতে সময় দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আমার ইচ্ছা ছিল আরও কিছুক্ষণ ঘুরে দেখার। কিন্তু ৫ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা নামবে। এদিকে লিও আহত। ওকে নিয়ে টানাটানি করলে পায়ে ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। তারচে বরং আমরা ফিরে যাই। গাড়িতে করে ওকে হাসপাতালে রেখে আসি। তারপর আবার অভিযান শুরু করা যাবে। জিপিএস-এ পথের মার্কিং করে রেখেছি। এই জায়গা খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না।’

‘তার মানে দাঁড়াচ্ছে আমরা এখন ফিরে গেলেও এই খুনের বিষয়গুলো কাউকে রিপোর্ট করছি না, তাই তো?’ বলল ল্যাজলো।

‘ঠিক ধরেছেন। স্যাম সায় দিল। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর আমরা অবশ্যই রিপোর্ট করব। এবার চলুন, আগের কাজ আগে সেরে ফেলি।

লিও-কে নিয়ে ফিরতি পথ ধরল ওরা। ধীরে ধীরে সময় নিয়ে এগোলো। লিও-র পায়ের অবস্থা বেশ নাজুক। অবশেষে যেখানে গাড়িটা পার্ক করে রেখে গিয়েছিল সেখানে এসে দেখল গাড়ির চারটা টায়ার পাংচার হয়ে আছে।

‘গাড়িটা গেল।’ বলল স্যাম। একটা টায়ারের কাছে গিয়ে বসল ও। কেউ এসে ভাল্ব খুলে দিয়ে গেছে। খুব খারাপ কথা।’

কার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, এই কুকাজটা করল? কে বা কারা করল এটা?’ রেমি বেশ রেগে গেছে।

 ‘আমাদেরকে যারা পছন্দ করছে না তারাই করেছে। বলল ল্যাজলো। ‘অবশ্য দুষ্টুমি করে বাচ্চারাও এটা করতে পারে।’

‘তাহলে এবার আমরা কী করব? গাড়ির চাকা পাংচার হওয়াতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে লিও।

 ‘চিন্তার কিছু নেই। স্যাম আশ্বস্ত করল। আমি ডেস-কে ফোন করছি। সে একটা গাড়ি ভাড়া করে এখানে হাজির হয়ে যাবে। লিও, তোমাকে জাস্ট একটু কষ্ট করে আর মাইলখানেক হেঁটে মেইন রোড পর্যন্ত যেতে হবে। পারবে তো?’

‘আরও আগে ফোন করা উচিত ছিল।’

‘আরে বাবা, আমরা কি জানতাম এখানে এসে গাড়ির এই অবস্থা দেখব? রেমি বুঝিয়ে বলল। এখন সামনে একটা কঠিন কাজ আছে। ডেস-কে এখানকার মেইনরোডটা কোথায় সেটার দিক-নির্দেশনা দিতে হবে। ডেস এরআগে কখনও এখানে আসেনি। বিষয়টা অতটা সহজ হবে না।’

 লিও মাথা নাড়ল। তা পারব। আমাদের তো এখন তো কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সময় নিতে পারব তো?

 গাড়ি নিয়ে এখানে আসতে আসতে ডেস-এর রাত হয়ে যাবে। জাহাজ থেকে বন্দরে আসবে। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে আসবে এখানে। অনেক সময় লাগবে। কিন্তু রাতে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগোনো নিয়ে ভাবছি। স্যাম বলল।

সমস্যা কী? আমাদের কাছে ফ্ল্যাশলাইট আছে। মনে করিয়ে দিল ল্যাজলো।

‘সেটাই তো সমস্যা। যেকোন জন্তু-জানোয়ারের কাছে আমরা সহজ টার্গেটে পরিণত হব। আর বিদ্রোহীদের কথা তো বাদই দিলাম।’

‘আর কিছু বলার নেই। চুপ মেরে গেল ল্যাজলো।

স্যাটেলাইট ফোন অন করে স্যাম ডেস-কে ফোন করল। জানাল সবকিছু। তারপর তাকাল দলের দিকে। আমরা এখন মেইনরোডের উদ্দেশে রওনা হব। একদম চুপচাপ এগোতে হবে। এমনও হতে পারে আমাদের জন্য কেউ ওঁত পেতে বসে আছে।

‘এক কাজ করলে কেমন হয়? গ্রামের ওই ছেলেটাকে আরও ২০ ডলার ধরিয়ে দিয়ে ওকে বলি বিকল্প কোন রাস্তা দিয়ে যেন আমাদেরকে মেইনরোডে পৌঁছে দেয়। বিষয়টা নিরাপদ হতে পারে।’ পরামর্শ দিল রেমি।

স্যাম হাসল। আইডিয়াটা চমৎকার। গ্রামের ভেতরে কয়েক পা এগোলো স্যাম। কয়েকজন বাসিন্দা বসে আছে সাথে সেই ছেলেটাও আছে। হাত দিয়ে ইশারা করে তাকে ডাকল স্যাম। বুলেটের গতি ছুটে এলো ছেলেটা। স্যামের একবার সন্দেহ হলো গাড়ির চাকার এই হালের পেছনে এই ছেলেটার হাল আছে কিনা, টাকার লোভে কাজটা করে থাকতে পারে। কিন্তু সন্দেহটা ঝেড়ে ফেলে দিল।

ডলারের লোভে রাজি হলো ছেলেটা। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অপরিচিত এক রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল দলকে। আধাঘণ্টা যেতেই মেঘ ডেকে বৃষ্টি নামতে শুরু করল। ওরা এখন ঢালু অংশ বেয়ে নামছে। সব পিচ্ছিল হয়ে গেছে বৃষ্টির পানিতে। চলার গতি কমে গেল। কয়েকবার বেকায়দায় পা পড়ল লিও-র। গুঙিয়ে উঠল বেচারা। বিড়বিড় করে অভিশাপ দিল। কিন্তু কাকে দিল সেটা বোঝা গেল না।

অবশেষে মেইনরোডে পৌঁছুল সবাই। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল লিও, বসে পড়ল রাস্তায়। ওর দেখাদেখি রেমি, ল্যাজলোও বসল। স্যাম ফোন করল ডারউইন এ। খবর পেল ডেস ইতিমধ্যে রওনা হয়ে গেছে। এরপর ছেলেটাকে ডলার বুঝিয়ে দিয়ে বিদেয় করল স্যাম। ছেলেটা চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল।

শুরু হলো অপেক্ষার পালা। ডেস কখন গাড়ি নিয়ে হাজির হবে।

.

 ৪৩.

রাত ১০ টার দিকে ডেস গাড়ি নিয়ে হাজির হলো মেইনরোডে। স্যাম ডেসকে জানাল ওদেরকে হাসপাতালে যেতে হবে। লিও’র চিকিৎসা প্রয়োজন।

‘আজ রাতে ডারউইনে ফেরার দরকার নেই। বরং আমি এখানেই থাকব। ‘হাসপাতালের পার্কিং লটে গাড়ি রাখতে রাখতে বলল ডেস। তাছাড়া গাড়িটা অফিসে ফেরত দিলে হলেও সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সকাল ৮ টার আগে তো আর অফিস খুলবে না।’

তাহলে আপনি নিশ্চিন্তে আমাদের হোটেলে থাকতে পারেন। রেমি বলল। হাঙ্গামার কারণে হোটেল প্রায় খালি পড়ে আছে।

‘বেশ। ডেস হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে দেখল ইমার্জেন্সি সেকশনে ঢোকার অংশে স্রেফ একটা মাত্র লাইট জ্বলছে। হাসপাতাল চালু আছে তো? নাকি বন্ধ?

‘চালু আছে। এখানকার একমাত্র হাসপাতাল এটা। চালু না থেকে উপায় নেই।’ বলল স্যাম।

লিওকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকল ওরা। রেজিস্ট্রেশনের কাজ সারার পর লিওকে একটা হুইলচেয়ারে বসিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। স্যাম ও রেমি গেল লিও’র সাথে। রিসিপশন এরিয়ায় বসে রইল ল্যাজলো আর ডেস।

হাসপাতালের ভেতরে ডা. বেরি ফারগো দম্পতির সাথে ক্লান্তভঙ্গিতে হাত মেলালেন।

কীভাবে হলো? লিও-কে টেবিলের উপর শোয়ানোর পর বললেন তিনি।

‘পাহাড়ে উঠতে গিয়ে…’ লিও জবাব দিল।

“ঠিক আছে। দেখছি কী করা যায়…’ কাঁচি নিয়ে ব্যাণ্ডেজ কাটার পর জখম পরীক্ষা করলেন ডাক্তার। ওহ… বেশ ব্যথা হচ্ছে নিশ্চয়ই?’

 ‘তা তো হচ্ছে। আমি অবশ্য এই অবস্থায় হাঁটতে পেরেছি। তাই মনে হচ্ছে, কোনোকিছু ভাঙেনি।’

 ‘ভাল। কিন্তু তারপরও একটা এক্সরে করাতে হবে। হাড়ের কোনো ক্ষতি হেয়ছে কিনা দেখে রাখা ভাল। স্যাম ও রেমি’র দিকে ঘুরলেন ডাক্তার। ‘ব্যাণ্ডেজটা সুন্দর হয়েছিল।

‘ধন্যবাদ।’ বলল রেমি। আচ্ছা, ডা. ভ্যানা আজকে ডিউটিতে নেই?

না। তাকে চেনেন নাকি?’

 ‘হ্যাঁ। আমাদের বন্ধু।

‘ও আচ্ছা। উনি ডাক্তার হিসেবেও বেশ ভাল। ডাক্তার লিও’র দিকে মনোযোগ দিলেন। এই জখম দুই-তিন দিনেই সেরে যাবে। এখন জায়গাটা আমি একটু পরিষ্কার করব। লিও সাহেব, আপনার এখন হালকা ব্যথা লাগতে পারে।

‘হাতিকে সূঁচ ফোঁটানোর ভয় দেখাচ্ছেন, ডাক্তার?’ বলল লিও।

দশ মিনিট পর লিও’র জখমে ট্রিটমেন্ট করার পর ওকে এক্স-রে করার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। রিসিপশন এরিয়ার ফিরে গেল ফারগো দম্পতি। দেখে, ডেস আর ল্যাজলো জমিয়ে গল্প করছে।

 ‘আমাদের রাশিয়ান বন্ধুর কী অবস্থা? ওদেরকে আসতে দেখে ডেস জানতে চাইল।

‘খুব শীঘ্রই নাচতে পারবে না। তবে আঘাত গুরুত্বর নয়। সেরে যাবে। বলল স্যাম।

‘তাহলে তো ভালই। আচ্ছা, আপনাদের গাড়ির টায়ার তো পাংচার। ওটার জন্য কী করবেন ভাবছেন?

 ‘ওখান থেকে গাড়িটাকে নিয়ে আসার জন্য একটা টো-ট্রাক (দূর্ঘটনায় আক্রান্ত গাড়িকে সরানোর বিশেষ বাহন) পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।

কাজটা হয়তো বাচ্চারা করেছে। এসব অকর্ম করাটাই ওদের প্রধান কর্ম। ডেস মন্তব্য করল। সারা দুনিয়ায় একই অবস্থা। বিচুগুলোর খেয়েদেয়ে কাজ থাকে না। এসব করে বিনোদন নেয়।

হতে পারে।’

‘তাহলে আপনাদের অভিযান বন্ধ?’ ল্যাজলোকে প্রশ্ন করল ডেস।

 ‘সেটাই তো প্রশ্ন।

‘আমি ভাবছি, কালকে একজন ডাইভারকে সাথে নিয়ে যাব। আমাদের গাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য তাকে বসিয়ে রেখে অভিযানে গেলে আশা করি আর এরকম সমস্যা হবে না। স্যাম জানাল।

‘ঠিক আছে। সমস্যা নেই। ওখানে আমাদের কাজ একটা ছন্দে এগোচ্ছে। একজন সরে গেলেও খুব একটা ক্ষতি হবে না।’

“শুনে খুশি হলাম। একটা নিউজ আপনাকে এখনও জানানো হয়নি। একটা বড় জাহাজ আসছে। খুব শীঘ্রই এখানে আপনাদের বোরিং দিন শেষ হবে।

‘আমি জানি। সেলমা আমাদের হেডঅফিসে জানিয়েছে বিষয়টা। আমরা শনিবার রওনা হচ্ছি। হাসল ডেস। আমরা চলে গেলে লিও সাহেব বোধহয় খুশিই হবেন?

হেসে উঠল সবাই।

হাসি বন্ধ করে স্যাম সিরিয়াস হলো। মিস্টার ডেস, পাহাড়ী অভিযানে আমাদের সাহায্য লাগতে পারে। সাহায্য করতে পারবে এরকম কারও সাথে আপনার যোগাযোগ আছে?’

‘আছে। কালকে এই বিষয়টা নিয়ে সেই অফিসের সাথে কথা বলব।’ ডেস একটা অফিসের নাম বলল। সৌভাগ্যবশত সেই অফিসের সাথে ফারগো দম্পতি এখনও কাজ করেনি।’

‘দ্বীপে আমাদের ভাগ্য এপর্যন্ত খুব একটা ভাল নয়। যে গাড়ি নিয়েছি। সেটাই কোনো না কোনো বিপদে পড়েছে। আশা করি, সামনে আর ওরকম হবে না।’ বলল রেমি।

 ২০ মিনিট পর লিওকে দেখা গেল। ওর হুইলচেয়ারের পেছনে আছেন ডা. বেরি। আপনাদের বন্ধুর ভাগ্য ভাল। কোথাও হাড় ভাঙেনি। তবে রক্তক্ষরণ হয়েছে। বেশি করে পানি আর ফলের রস খাওয়াতে হবে। বা পা দিয়ে কোনো কাজ করা যাবে না। এক সপ্তাহ পর আবার চেকআপ করাতে আসবেন।

তাহলে আর ডাইভিং করতে হবে না? লিও বেশ খুশি।

রাতে হোটেলে ফিরল সবাই। নতুন অতিথিদের জন্য রুম নেয়া হলো। রেস্টুরেন্ট খোলা ছিল তখনও। ডিনার সেরে যে যার রুমে চলে গেল।

পরদিন সকালে ডেস ভাড়া করা গাড়িটা অফিসে ফেরত দিল, ওর সাথে ছিল স্যাম। অফিস থেকে গাড়িটা স্যাম নিজের নামে ভাড়া নিল। ডেসকে পৌঁছে দিল বন্দরে। রেমি, লাজলো, আর লিওকে হোটেলে রেখে এসেছে। আড্ডা দিচ্ছে ওরা।

‘আপনারা চলে যাওয়ার আগে আরেকবার দেখা করব আমি।’ বলল স্যাম।

 ‘গুহায় অভিযান চালাতে আবার যাচ্ছেন তাহলে?

‘যেতে তো হবেই। স্যাম এখনও ডেসকে কঙ্কাল পাওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলেনি।

‘ঠিক আছে। গুড লাক। আর হ্যাঁ, আপনাদের একজন লোক লাগবে বলেছিলেন। কখন লাগবে জানাবেন। পাঠিয়ে দেব।’

“আচ্ছা, গ্রেগ আসতে পারবে?

 ‘যদি রাজি না হয় আমার পক্ষে জোর করা সম্ভব হবে না।’

 “ঠিক আছে। যাকে সম্ভব হয় পাঠিয়ে দেবেন।

 ‘আপনারা কি আজই আবার অভিযানে যাচ্ছেন?

না। আজকে আর যাব না। সম্ভবত কালকে বের হব। একটা টো-ট্রাক যোগাড় করতে হবে। এই দ্বীপে যেকোনো কাজ করতে হলে সময় দরকার। সমস্যা নেই, জানাব আপনাকে।

“ঠিক আছে।

স্যাম রওনা হলো হোটেলের দিকে আর ডেস চড়ল ছোট নৌকায়। গন্তব্য: ডারউন।

***

‘স্যাম তোমার বন্ধুকে বলল সে যেন আমাদের সাথে অভিযানে যাওয়ার বায়না না ধরে। হোটেলে ফিরে প্রথমেই রেমি’র নালিশ হজম করল স্যাম।

কী ব্যাপার? লিও কি যেতে চাচ্ছে? অসম্ভব! স্যাম জবাব দিল।

‘তোমরা কী ভেবেছ? আমাকে এখানে ফেলে রেখে তোমরা গুপ্তধন উদ্ধার করে মজা নেবে আর আমি সেটা চুপচাপ মেনে নেব? কক্ষনো না!’ দাবি জানাল লিও।

ডাক্তার কী বলেছে শোনোনি? বা পায়ে কোনো চাপ দেয়া যাবে না। স্যাম বলল।

যাবে, যাবে। বারো ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ফেলেছি। তোমরা এখুনি বেরোবে নাকি?

না। কাল…’

তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই। আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাব। রাশিয়ান রক্ত বইছে শরীরে। সুস্থ হতে সময় লাগবে না।

স্ত্রীর সাথে দষ্টি বিনিময় করল স্যাম। বন্ধু, এখানে ব্যক্তিগত কোনো চাপ নেই। আমরা চাই তুমি যেন আর আহত না হও। বুঝতে চেষ্টা করো।

হাত নেড়ে স্যামের কথা উড়িয়ে দিল লিও। কী হয়েছে আমার? একটু কেটে-ছড়ে গেছে। ভাঙেনি তো। কালকের মধ্যে আমি একদম ফিট হয়ে যাব। দেখে নিয়ো।

সিদ্ধান্তটা বোধহয় ভাল হচ্ছে না।’ রেমি বলল।

 ‘আমরা আর কী বলব। লিও তো আর বাচ্চা খোকা নয়।’ বলল স্যাম।

 ‘হ্যাঁ, বাচ্চা নয়। কিন্তু আর একটু হলেই তো সর্বনাশ হয়ে যেত।

ঘোঁতঘোঁত করল লিও। আমি একটু বেখেয়ালি হয়ে পড়েছিলাম তাই আরকী। তবে কথা দিচ্ছি, এরকম ঘটনা আর হবে না।’

 রেমি মাথা নাড়ল। ঠিক আছে। খুব ভাল কথা। আমি তোমার সাথে ঝগড়া করতে চাই না। তবে তুমি যদি আমাদেরকে দেরি করিয়ে দাও, তাহলে কিন্তু তোমাকে কুমীরের কাছে দিয়ে আমরা চলে যাব। হুম!

‘আমি শুনেছি কুমীর এক মাইল দূর থেকেই রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে যায়! ফোড়ন কাটল ল্যাজলো।

ব্যাপার না। তাহলে কয়টার সময় বের হচ্ছে তোমরা? লিও জানতে চাইল।

‘খুব সকাল সকাল।’ জবাব দিল স্যাম।

‘আমি রেডি হয়ে থাকব।

স্যামের দিকে তাকাল রেমি। আমাদেরকে এখন টো-ট্রাকের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই না?

স্যাম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না করতে হলেই ভাল হতো। কিন্তু উপায় নেই।’ ল্যাজলো’র দিকে তাকাল ও। কয়েক ঘণ্টা আপনি আমার রাশিয়ান বন্ধুকে সঙ্গ দিন, আমরা একটু কাজ সেরে আসি কেমন?

‘এই কাজটা আমি খুব ভাল পারি।’ ল্যাজলো সম্মতি দিল চওড়া হাসি দিয়ে।

টো-ট্রাক ম্যানেজ করতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হলে ওদের। বনের ভেতরে গিয়ে গাড়ি আনতে হবে শুনে কেউ টো-ট্রাক ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে একজনকে কোনমতে রাজি করানোর পর হাসপাতালের দিকে পা বাড়াল ফারগো দম্পতি।

আজ ভ্যানাকে পাওয়া গেল। রিসিপশন কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ডা. ভ্যানা।

 ‘কী ব্যাপার? কী মনে করে?’ ফারগো দম্পতিকে দেখে ভ্যানা হাসিমুখে প্রশ্ন করল।

‘এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম উঁকি দিয়ে যাই।

‘আমি গতকালের এন্ট্রিগুলো দেখছিলাম। আপনাদের এক বন্ধুকে এখানে এনেছিলেন। ডা. বেরি ট্রিটমেন্ট দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে আহত হয়েছিল। রেমি জানাল।

এখানে এরকম দূর্ঘটনা প্রায়ই হয়। আপনাদের উচিত সহজ পথ ধরে এগোনো। এই দ্বীপে কখন কোনদিক দিয়ে বিপদ আসে কেউ বলতে পারে না। কোন পাহাড়ে উঠছিলেন আপনারা?

দ্বীপের ওইপাশে…’

 ‘ওদিককার পাহাড়ে ওঠা তো বেশ চ্যালেঞ্জিং।

‘আমাদেরও তা-ই মনে হয়। স্যাম বলল। ডা, ভ্যান, আপনার সাথে কিছু কথা বলা দরকার। সময় হবে?

 ‘অবশ্যই। ভাগ্যক্রমে আজকে রোগীদের চাপ নেই। দেখুন, ওয়েটিং এরিয়া ফাঁকা। অবশ্য ভরে যেতে খুব বেশি সময়ও লাগে না।’ রুমে থাকা সিটের দিকে ইশারা করল সে। কী ব্যাপার?

বসল সবাই। স্যাম গলার স্বর নিচু করে বলতে শুরু করল। আমার মনে আছে, আপনি একদিন এক মহিলার মেয়ে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলছিলেন।

‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। এরকম পালিয়ে যাওয়ার কাহিনি এখানে অনেক আছে।

‘আসলেই অনেক।

 ‘এবং সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে।

 ‘এপর্যন্ত কতজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বলতে পারেন?

ভ্যানা মাথা নাড়ল। নাহ। আমি তো ডাক্তার, সমাজকর্মী হলে হয়তো বলতে পারতাম। আসলে সত্যি বলতে ডাক্তারি করায় এত ব্যস্ত থাকি যে সমাজের খবর নেয়ার মতো আর সময় থাকে না। ওসব খবর নিয়ে আমার কোনো কাজও নেই, আমার কাজ রোগীর সেবা করা। কথাগুলো একটু স্বার্থপরের মতো শোনালেও এটাই সত্যি।

মাথা নেড়ে সায় দিল রেমি। ঠিকই আছে। আপনি আপনার কাজে গুরুত্ব দিচ্ছেন সেটাই স্বাভাবিক। আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি এপর্যন্ত কতগুলো বাচ্চা হারিয়েছে।

 ভ্যানা চোখ সরু করল। আপনারা কী কোনো খারাপ কিছুর আশংকা করছেন?

 না, না। এখানকার স্থানীয় কিছু ইস্যুর খোঁজ-খবর নিচ্ছি আরকী। ক্লিনিকে যেহেতু অনুদান দেব তাই একটু এখানকার ইস্যু সম্পর্কে জানাশোনা থাকা দরকার।’ বলল স্যাম।

‘আমি এব্যাপারে তেমন সাহায্য করতে পারছি না। আপনি বরং পুলিশের সাথে যোগাযোগ করুন। আমার চেয়ে তারা এ-বিষয়ে বেশি জানে।’

“ঠিক। কিন্তু ওখানে আমাদের পরিচিত কেউ নেই। তাছাড়া দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর বিদ্রোহীদের নিয়ে পুলিশ বেশ চাপে আছে…’ রেমি বলল।

উঠে দাঁড়াল ভ্যানা। পুলিশ চিফের নাম ফ্লেমিং। তার সাথে আমার একটু পরিচয় আছে। আপনারা চাইলে একটা মিটিঙের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তবে একটা কথা, লোকটা একটু বেশিই জাতীয়তাবাদী।

 স্যাম ও রেমিও উঠে দাঁড়িয়ে হাত মেলাল ভ্যানা’র সাথে। ওটা সম্ভব হলে উপকার হবে।

 ‘আমি ফোন করে দেখব। তবে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।’

পার্কিংলটে গিয়ে গাড়ি চড়ল ফারগো দম্পতি। স্যামের হাতটা রেমি ধরল। খুব একটা লাভ হলো না, তাই না?

হুম। এখন পুলিশের কাছ থেকে তথ্য পেতেই হবে। নইলে চলবে না।

‘দেখা যাক। তবে তার আগে লাঞ্চটা সেরে নিলে ভাল হবে।

 “ঠিক আছে। চলো।’

রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করার পর মুখ খুলল রেমি। আচ্ছা, ম্যানচেস্টার হয়তো এব্যাপারে কিছু জানতে পারে। উনি তো সবসময় আমাদের সাথে কথা বলতে আগ্রহী।

‘চলো তার অফিসে যাই। দেখি, সে লাঞ্চ কিংবা অফিসের কাজে ব্যস্ত কিনা।

ভাগ্য ভাল বলতে হবে। রাজনীতিবিদ ম্যানচেস্টার সাহেব কোনো কাজে ব্যস্ত ছিল না। হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়কে ফিরে পেলে মানুষ যেরকম সমাদর করে সেরকম সমাদর করল ফারগো দম্পতিকে।

 ‘আপনারা এসে তো আমাকে বেশ চমকে দিয়েছেন। ভালই হলো। তা আপনাদের আর্কিওলজি’র কী খবর?’ বলল ম্যানচেস্টার।

 ‘গতি ধীর। তবে কাজ এগোচ্ছে। রেমি জবাব দিল। আমরা নতুন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের নিয়ে।

‘আমি কি কখনও এই ব্যাপারে কিছু বলেছি? কই মনে পড়ছে না তো?

“হয়তো বলেননি। কিন্তু এই ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?’ স্যাম জানতে চাইল।

‘বিশেষ কিছু বলার নেই। যে সমাজেই যান না কেন… সেখানে এরকম বাচ্চা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা পাবেন। দ্বীপের জন্য এটা কোনো বড় সমস্যা নয়। খুব সাবধানে জবাব দিল ম্যানচেস্টার।

 ‘আপনি এই বিষয়ে ঠিক কতদূর জানেন?

হঠাৎ? কিছু মনে করবেন না, আপনারা কেন জানতে চাইছেন, জানতে পারি?

‘এমনি। আমরা ডা. ভ্যানারি ক্লিনিকে অনুদান দিতে যাচ্ছি। তাই দ্বীপের বিভিন্ন ইস্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছি আরকী। বাচ্চাদের হারিয়ে যাওয়াটা অবশ্যই একটা ইস্যু। রেমি বলল।

‘আপনাদের কথা মেনে নিলাম। কিন্তু বিদ্রোহীজনিত সমস্যাই এখন সবচেয়ে বড় ইস্যু। তাছাড়া বেকারত্ব, চিকিৎসা ইত্যাদি বড় বড় সমস্যা তো আছেই…’

‘অস্বীকার করছি না। আমরা আসলে এই বাচ্চা হারানোর ব্যাপারে একটু তথ্য চাচ্ছিলাম। কে দিতে পারবে, বলতে পারেন?

 ‘সত্যি বলতে এটাকে আমি কোনো সমস্যা হিসেবে ধরি না। তারপরও যখন বলছেন… কোথায় আর পাঠাব আপনাদের? পুলিশের কাছে যেতে পারেন।

আমরা ইতিমধ্যে মনস্থির করেছি যাব। কিন্তু কার আছে যাব? বলতে পারেন?’ রেমি আর তাকে ভ্যানার কথা বলল না।

 ম্যানচেস্টারকে দেখে মনে হলো সে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। দেখছি কী করা যায়। আসলে আমি জানি, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের কেসগুলো কে দেখাশোনা করে। মাথার চুলে ভালুকের মতো বিশাল থাবা চালাল সে। তবে ভ্যানা’র ক্লিনিকে অনুদান দেবেন শুনে খুবই খুশি হয়েছি। দ্বীপের বাসিন্দাদের অনেক উপকার হবে।

 ‘জি, স্যাম বুঝতে পারল ম্যানচেস্টার প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছে।

 ‘বিদ্রোহীদের ব্যাপারে নতুন কিছু শোনা গেছে? জনগণ কী বলে?

‘সবাই বিদ্রোহীদের বিপক্ষে। অন্তত আমার সহকর্মীরা তো সেটাই বলছে। তবে এরমাঝেও কিছু লোক বিশ্বাস করে দ্বীপ থেকে বিদেশিদের তাড়ানো জরুরী। আশা করছি, সামনে আর খারাপ কিছু ঘটবে না।’

‘আচ্ছা, আপনি কি আপনার কোনো সহকর্মীর সাথে আমাদের আর্কিওলজি’র প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলেছিলেন?

‘না, এখনও বলা সম্ভব হয়নি। বিদ্রোহীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম সবাই। সুযোগ হয়নি। ভুলে গিয়েছিলাম।’

কথা শেষ করে বেরিয়ে এলো স্যাম ও রেমি। ম্যানচেস্টার তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। অস্বস্তিবোধ করছে। এক রিসিপশনিস্ট এলো ওর রুমে। বলল, ‘স্যার, গর্ডন রোলিন্সের সাথে কিন্তু আজ ৫ টায় আপনার একটা মিটিং আছে।’

 ‘ও, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। সাধারণত ম্যানচেস্টার রোলিন্সের সাথে যত মিটিং করে সব লুকিয়েই করে। কিন্তু সামনে নতুন দিন আসছে। জনতা যদি হঠাৎ করে ওদের দুজনের খাতির সম্পর্কে জানতে পারে তাহলে সন্দেহ করবে। তারচে’ এখন থেকে একটু একটু করে খাতির প্রকাশ করা ভাল। তখন সবাই ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেবে। আর ওরা যা পরিকল্পনা করেছিল এখন পর্যন্ত সব বেশ ঠিকঠাকভাবেই এগিয়েছে।

.

 ৪৪.

হনিয়ারায় গর্ডন রোলিন্সের বাড়ি হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর জায়গায়। ওর বাসা থেকে সাগরের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। তাজা বাতাস আসে উন্মুক্ত সাগর থেকে। ম্যানচেস্টার গাড়ি নিয়ে এসে দেখল একটা নীল রঙের ১৯৬৩ ই টাইপ জাগুয়ার দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির পাশে। রোলিন্সের খুব পছন্দের গাড়ি। যদিও অনেক পুরানো। জীবনে বারবার সঠিকভাবে বিনিয়োগ করে রোলিন্স অনেক অর্থ উপার্জন করেছে। এই গাড়ি সেই উপার্জনের একটা ছোট্ট নিদর্শন। নিজের গাড়ি পার্ক করে এগোলে ম্যানচেস্টার।

‘আরে অরউন, চলে এসেছেন! কী অবস্থা?’ ম্যানচেস্টারকে আসতে দেখে বলল রোলিন্স। স্ত্রী সাশ্লাকে নিয়ে বারান্দায় বসেছিল। কিছু একটা বলল স্ত্রীকে। ম্যানচেস্টারের দিকে চেয়ে একটা হাসি দিয়ে ওর স্ত্রী বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

‘এই তো, রোলিন্স চলে এলাম। দিনটা দারুণ। কী বলেন?’ জবাব দিল ম্যানচেস্টার।

 ‘ঠিকই বলেছেন। ওর হাতে একটা রূপোলি চাবি আছে। গাড়িতে একটু সমস্যা হয়েছিল, বুঝলেন? সারিয়েছি কিন্তু এখনও টেস্ট করে দেখিনি। চলুন, দু’জন একটু ঘুরে আসি।’

‘চলুন, যাই।’ হাসতে হাসতে বলল ম্যানচেস্টার। তবে প্রস্তাবটা কি বন্ধু হিসেবে দিচ্ছেন নাকি স্রেফ কাজের স্বার্থে?

‘দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, কাজের স্বার্থে দিচ্ছি না।’ হেসে ফেলল গর্ডন।

ম্যানচেস্টার পেছনের সিটে বসল, গর্ডন বসল ড্রাইভিং সিটে।

‘আমরা বেশ ভালই কাজ দেখিয়েছি। অনেক কিছু উৎসর্গও করেছি। এবার সামনে কী করব?’ বলল ম্যানচেস্টার।

 ‘বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিষয়টা আশংকাজনক। এদিকে একটু নজর রাখতে হবে।’

রোলিন্স চাবি ঢুকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতেই মুহূর্তের মধ্যে চোখ ধাঁধানো বিস্ফোরণ হয়ে আগুনের কুণ্ডলী আকাশে উঠে গেল। গাড়ির একটা দরজা ছিটকে গেল কয়েক ফুট উপরে। একটু পর বাতাসে ভর দিয়ে অলসভঙ্গিতে মাটিতে আছড়ে পড়ল। কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে জাগুয়ার থেকে।

 কয়েক মিনিট পর দূরে ফায়ার সার্ভিসের সাইরেন শোনা গেল। তারা এসে কাউকে বাঁচাতে পারবে না। কোনমতে ভাঙ্গারিতে পরিণত হওয়া জাগুয়ারের আগুন নেভাবে মাত্র।

***

স্যাম ও রেমি থানায় এসে বসে আছে। পুলিশ চিফ সেবাস্টিয়ান ফ্লেমিঙের বয়স ৮০-এর একটু বেশি। মার মার কাট কাট চেহারা। এই লোকের সাথে কথা বলে ফারগো দম্পতি মোটেও সুবিধা করতে পারছে না।

“তারমানে, গত ৫ বছরে এখান থেকে গত বাচ্চা গায়েব হয়েছে সেসবের কোনো হিসেব আপনাদের কাছে নেই? রেমি জানতে চাইল। কম্পিউটার নেই আপনাদের?’

 ‘মিসেস ফারগো, এখানে এভাবে কাজ হয় না। আমাদের সিস্টেম আলাদা। পুলিশ চিফ শুকনো কণ্ঠে জবাব দিল।

রেমি’র গা জ্বলে যাচ্ছে এই লোকের কথা বলার ভঙ্গি দেখে। অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করল ও। তাই? আপনি একজন পুলিশ চিফ। বাচ্চারা হারিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে। অথচ এপর্যন্ত কতজন হারিয়ে গেছে সেটা বলতে পারছেন না?

 স্যাম অবশ্য রেমি’র সাথে সংসার করার ফলে বেশ ভাল করেই জানে এটা হচ্ছে রেমি’র রাগ দমন করার সর্বোচ্চ পর্যায়। এরপর রেমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটাবে। আসন্ন বিপর্যয় ঠেকাতে নাক গলাল স্যাম।

‘আসলে অফিসার, আমার স্ত্রী বলতে চাচ্ছে, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের কোনো রেকর্ড আছে কিনা?

 ‘হ্যাঁ, এতক্ষণে ঠিকঠাক প্রশ্নটা করেছেন। হ্যাঁ, অবশ্যই আছে।

‘আমরা একটু জানতে চাই, বিগত ৫ বছরে কতগুলো বাচ্চা হারানোর রেকর্ড আছে?

‘আমি আপনার প্রশ্নটা বুঝেছি। কিন্তু উত্তরটা দেয়া সম্ভব না।

 ‘কেন না? কী সমস্যা?’ রেমি’র মুখ লাল হয়ে গেছে।

কারণ এটা পুলিশের ব্যাপার, ম্যাম। আর আপনারা পুলিশ নন।’

 ‘এত গোপনীয়তা কেন?’ স্যাম প্রশ্ন করল। স্যামও রেগে যাচ্ছে।

‘গোপন জিনিস তাই গোপনীয়।’ সোজাসাপ্টা জবাব দিল ফ্লেমিং।

‘থামুন। আমরা জনতার হয়ে একটা সরাসরি প্রশ্ন করেছি। আর আপনি বলছেন সেটার উত্তর দেবেন না?’ রেমি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।

 ‘আমি উত্তর দিতে পারব কিন্তু দেব না। কারণ আমি উত্তরটা দিতে চাচ্ছি না। আপনারা তো অনেক মেজাজ দেখালেন। এবার আমার কথা শুনুন। আপনারা এখানকার পর্যটকমাত্র। এখানকার নাগরিক নন। আর আমার বেতনটা আপনারা দেন না। প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমি উপযু দেব। আর এরকম অসভ্যতার মাধ্যমে প্রশ্ন করলে তো উত্তর দেয়ার প্রশ্নই আসে না। আপনারা ডা. ভ্যানা’র পরিচয় দিয়েছেন তাই খাতির করেছি। তবে আপনাদের কথার সুরটা সংশোধন করলে ভাল হয়। আমি আবার বাজে ব্যবহার ঠিক হজম করতে পারি না।

স্যাম বুঝে গেল এবার রেমি তাণ্ডব শুরু করবে। তাই আবারও নিজেই বলির পাঠা হতে সামনে এগিয়ে এলো। অফিসার ফ্লেমিং…’

‘চিফ ফ্লেমিং বলুন…’

“জি, চিফ ফ্লেমিং, একটু সাহায্য করুন প্লিজ।

‘অবশ্যই করব। কোর্ট থেকে অর্ডার নিয়ে আসুন। তারপর সব জানতে পারবেন। এভাবে তথ্য দেয়া যাবে না। কারণ আপনারা এই দ্বীপের নাগরিক নন। আর কিছু বলবেন?

বাচ্চাগুলোর প্রতি আপনার কোনো দরদ নেই?” ঠাণ্ডাস্বরে রেমি জানতে চাইল।

‘অবশ্যই আছে। কিন্তু দু’জন বিদেশি এসে এখানে গোয়েন্দাগিরি করবে আর আমি তাদেরকে এরকম স্পর্শকাতর তথ্য হাসতে হাসতে দিয়ে দেব সেটা হতে পারে না। দেখুন, আমার অন্যান্য কাজ আছে। থানায় আসার জন্য ধন্যবাদ। আপনারা আপনাদের কাজে চলে যান। আমাকে আমার কাজ করতে দিন।

অগত্যা হোটেলে ফিরল ফারগো দম্পতি।

‘বাচ্চাদের নিয়ে এখানকার কারও মাথাব্যথা নেই। রাগে রেমি গজগজ করছে। যদি আমার বাচ্চা এখানে হারিয়ে যেত আমি থানায় নরক গুলজার শুরু করে দিতাম।

 ‘তা ঠিক আছে। তুমি তো দেখলে চিফ কীরকম আচরণ করল। আমার মনে হয়, উনি আমাদেরকে পছন্দ করেন না।’

‘গুহাভর্তি বাচ্চাদের কঙ্কাল অথচ গর্দভরা আমাদেরকেই পছন্দ করে না।’

 ‘শান্ত হও, রেমি। কঙ্কালগুলোর কথা তো শুধু আমরা জানি। পুলিশ জানে। যদি জানতো হয়তো এরকম আচরণ করত না।

‘আচরণ ঠিক করা ওদের কাজ। কারণ তথ্য আমাদের কাছে।

মানছি। কিন্তু এখন কিছু করার নেই।

 ট্যাব হাতে নিয়ে জিপিএস দেখছে রেমি।

‘বাদ দাও। আমি একটা পুরানো রাস্তা দেখতে পাচ্ছি। ঝরনা থেকে আধামাইল দূরে গিয়ে শেষ হয়েছে। যদি ওটা ব্যবহার করা যায় তাহলে আমাদের প্রায় ১ ঘণ্টা বেঁচে যাবে।’

ভাল খবর। লিও’র জন্য সুবিধে হবে।’

 ‘এখুনি নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। ওখানে গিয়ে দেখতে হবে কী অবস্থা।

হঠাৎ স্যামের স্যাটেলাইট ফোন বেজে উঠল। দ্রুত রিসিভ করল ও।

 ‘হ্যালো।’

 ‘খবর শুনেছ?’ ওপাশ থেকে সেলমা’র উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ভেসে এলো।

কী খবর, সেলমা?’

 ‘আবারও হামলা। এবার হামলা হয়েছে গর্ভনর জেনারেল আর এক এমপি’র উপর।

‘এমপি’র নাম কী?

 ‘অরউন ম্যানচেস্টার।

‘স্যাম চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল। তারপর খুলল চোখ। একবার রেমি’র দিকে তাকিয়ে বলল, কখন?

‘খবর পেয়েছি কয়েক মিনিট আগে।

কীভাবে হলো?”

‘গাড়ি বিস্ফোরণ। বিদ্রোহীরা হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের ভাষ্য, এই এমপি আর গর্ভনর জেনারেল ওদের কথামতোই চলছিল এতদিন। কিন্তু দ্বীপের উন্নতির জন্য এরকম পুতুলমার্কা লোকজন প্রয়োজন নেই। এই যুক্তিতে খুন করা হয়েছে। তারা আরাও বলেছে এসব কিছুর জন্য দায়ী বিদেশিরা।

‘তাহলে ম্যানচেস্টার মারা গেছে, শিওর? রেমি পাশের বিছানায় বসে আছে। তাই গলার আওয়াজ নিচু করে বলল স্যাম। কিন্তু রেমি ঠিকই শুনে ফেলেছে।

কী? ফোনটা আমাকে দাও!’

ঝট করে স্যামের কাছ থেকে ফোনটা নিল রেমি।

কী কী হয়েছে ঠিকঠাক করে বলো, সেলমা। ভয়ঙ্কর শান্তভাবে বলল ও। সব শুনে রেমি চুপচাপ বসে রইল।

রেমি।

‘তুমি ঠিক আছে তো?’ ওপাশ থেকে সেলমা জানতে চাইল।

হ্যা… তিনঘণ্টাও হয়নি ম্যানচেস্টারের সাথে দেখা করে এসেছি। আর এখন…’

‘আমি দুঃখিত।’ সান্তনা দিল সেলমা।

‘ধন্যবাদ। আমি ভাবছি, তার পরিবার ছিল কিনা?

 ‘খবরে সেরকম কিছু বলেনি।

‘অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। ম্যানচেস্টার ছিল জনতার কণ্ঠ। আর এখন সে-ই নেই। খবরটা ছড়িয়ে পড়লে যে কী তাণ্ডব শুরু হবে…’।

‘তোমরা দু’জন ওখান থেকে সরে এসো। এখুনি!’ বলল সেলমা। এখনও সময় আছে।

 এখুনি সম্ভব না। কয়েক মুহূর্ত ভাবল রেমি। আচ্ছা, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছ?’ রেমি গুহা অভিযান শেষ করে এসে বিস্তারিত জানিয়ে ই-মেইল করেছিল সেলমাকে।

না। ইন্টারনেটে ওই ব্যাপারে তেমন কিছু নেই। গোয়াডালক্যানেল আসলে তথ্যপ্রযুক্তির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। ওখানকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইট পর্যন্ত নেই!

‘আমারও সন্দেহ হয়েছিল তুমি কিছু পাবে না।’

 ‘এসব বাদ দিয়ে নিজেদের কথা ভাব। আবার দাঙ্গা লাগলে…’

‘বুঝেছি। স্যামের সাথে কথা বলব এব্যাপারে।

 ‘কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে কল করো। আর প্লিজ… সাবধানে থেকো।

“ঠিক আছে, সেলমা। অনেক থ্যাঙ্কস।

কথা শেষ করে ফোনটা স্যামের হাতে দিল রেমি? ‘সেলমা আমাদেরকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। বলছে এখুনি দ্বীপ ছেড়ে সরে যেতে। দাঙ্গা শুরু হতে পারে।’

‘তাহলে কী করবে? এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেন ধরবে নাকি আপাতত ডারউইনে গিয়ে উঠবে?’ স্যাম জানতে চাইল।

‘ডারউইনে যাওয়া যাক। এক রাত কাটিয়ে আসি। তারপর কালকে ভোরে উঠে অভিযানে বেরোনো যাবে। কী বলো?’

 ‘আমি রাজি। ল্যাজলো আর লিও-কে রেডি হতে বলছি। ১৫ মিনিটের মধ্যে রওনা হব।

 ‘এদিকে আমি ডেসকে ফোন করি। অনেকগুলো মেহমান হাজির হবে ওর জাহাজে।’

২০ মিনিট পর ওরা চারজন মিতশুবিসি গাড়িতে চড়ে রওনা হয়ে গেল বন্দরের দিকে। অস্ট্রেলিয়ান নিরাপত্তারক্ষী বাহিনিরা বেশ সতর্কতার সাথে রাস্তায় টহল দিচ্ছে। ইতিমধ্যে সবাই বুঝে গেছে বিদ্রোহীরা খুব উগ্র, কাউকে কোনো ছাড় দিচ্ছে না।

ডারউইন-এ পৌঁছে কাকড়া দিয়ে ডিনার সারতে সারতে রেডিও শুনল সবাই। দ্বীপে কোনো দাঙ্গা শুরু হয়নি। তবে বেশ কয়েকটা বিচ্ছিন্ন লুটপাট আর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

 সরকারী কর্মকর্তারা সবাই আতঙ্কিত। সবচেয়ে বড় খবর, অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানীগুলো এখানে আর বিনিয়োগ করতে চাইছে। সবাই বিনিয়োগ বন্ধ করে এখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যেতে চাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ানদের প্রজেক্টগুলোতে কাজ করার জন্য বিল উত্থাপন করেছে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতারা।

ম্যানচেস্টার মারা গেছে ২৪ ঘণ্টাও হয়নি। ইতিমধ্যে তার আশংকাগুলো বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে।

.

 ৪৫.

ওরা যখন মিতসুবিশিটা নিয়ে পাহাড়ী এলাকায় পৌঁছল তখন সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সামনে ঘন বন। গাড়ি নিয়ে এগোনোর রাস্তা নেই। জিপিএস হাতে নিয়ে স্যাম দেখতে শুরু করল।

এখান থেকে আধা মাইল এগোলেই আমরা কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছে যাব।’ বলল স্যাম। লিওর দিকে তাকাল। এতটুকু যেতে পারবে তো?

‘আমি হলাম কৈ মাছের প্রাণ। পারব না মানে!

‘শুনে খুশি হলাম। গ্রেগ, এখানে আপনার কাজ হচ্ছে গাড়িটাকে পাহারা দেয়া।

ডারউইন থেকে গ্রেগ-কে আনা হয়েছে। যাতে আগেরবারের মতো এবার কেউ গাড়ির কোনো ক্ষতি না করতে পারে। স্যামের কথা শুনে গ্রেগ মাথা নেড়ে সায় দিল। গ্রেগ খুব একটা কথা বলে না। তবে কাজ বোঝে। একটা ম্যাচেটি, আর ১২ গজ রেঞ্জের ফ্লেয়ার গান আছে ওর সাথে। আশা করা যায়, গ্রেগ-এর তত্ত্বাবধানে ওদের গাড়িটা অক্ষত থাকবে।

গ্রেগ-কে রেখে পা বাড়াল অভিযাত্রী দল।

‘আমাদেরকে তাহলে ঝরনার পেছনে যেতে হবে? তাই না? কিছুদূর এগোনোর পর রেমি প্রশ্ন করল।

‘নোটবুক তো তা-ই বলছে।’ জবাব দিল ল্যাজলো।

কিন্তু কথা হচ্ছে, ঝরনার পেছনে তো খুব বেশি জায়গা থাকে না। কত পেছনে যেতে হবে তাহলে? নাকি ঝরনার পাশ দিয়ে যেতে বলেছে? হয়তো পাশ দিয়ে এগোলো কোনো গুহামুখ পাওয়া যাবে?’ স্যাম বলল।

 ‘পাওয়া যাবে কিন্তু প্রচুর খুঁজতে হবে।’ বলল রেমি। লিও, তোমার পায়ের কী অবস্থা এখন?

‘খুবই ভাল। একদম তাগড়া ঘোড়ার মতো। এখন আমার মাথায় একটাই চিন্তা গুপ্তধনটা কখন উদ্ধার করব। লিও’র বলার ভঙ্গির দিকে রেমি তাকিয়ে রইল। বিষয়টা খেয়াল করল লিও। হেসে ফেলল দু’জন।

‘তাগড়া ঘোড়া না বলে আহত ঘোড়া বললে বোধহয় বেশি মানানসই হয়।’ মুচকি হেসে বলল স্যাম।

মন্দ বলেননি। ল্যাজলো সায় দিল।

‘আচ্ছা, এখন কাজের কথায় আসি। গতকাল রাতে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। যদি এমন হয় জাপানিরা গুহার ভেতরে গুপ্তধন রাখার পর গুহামুখ বন্ধ করে দিয়ে গেছে? বিষয়টা কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়। গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার জন্য এটাই সবচেয়ে ভাল উপায় বলে আমর মনে হয়। তাছাড়া পরে এসে একটা গ্রেনেড কিংবা মর্টার মেরে গুহামুখ পরিষ্কার করে ফেলাটা হয়তো খুব বেশি কঠিন কিছু না।

 ‘চমৎকার বলেছেন। কিন্তু কোনো না কোনো চিহ্ন তো থাকবে…’ বলল ল্যাজলো।

‘হুম, হতে পারে। আমার এসব বলার উদ্দেশ্য হলো, কোনো অস্বাভাবিক বিষয় সেটা যত ছোটই হোক না কেন সেটা যেন আমরা অবহেলা না করি। রেমি বলল।

 ‘অর্থাৎ- যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন!’ বলল ল্যাজলো, হাসতে হাসতে।

‘আন্দাজে উড়াইলে ছাই, পরে দেখিবে কিছুই নাই, দিনশেষে হইয়া যাইবে বিশাল মদন!’ লিও সুযোগ পেয়ে ল্যাজলোকে ফোড়ন কাটতে ছাড়ল না।

***

কথা বলতে বলতে আগেরবার এসে ঘুরে যাওয়া দুটো গুহা পার হলো ওরা। আরও সামনে এগোনোর পর লিও একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, “দেখেছ ওটা?”

বেশ কয়েকটা বড় বড় পাথর পড়ে আছে। পাহাড়ের ঢালের পাশেই পড়ে থাকায় বোঝা যাচ্ছে পাহাড়ধ্বসের ফলে ওখানে অবস্থান করছে ওগুলো।

স্যাম মাথা নাড়ল। চলল, এটা দিয়েই ছাই উড়ানো শুরু করি।

হাত লাগাল স্যাম ও ল্যাজলো। ম্যাচেটি আর হাতের সাহায্যে ১০ মিনিটের মধ্যে মোটামুটি পরিষ্কার করে ফেলল।

‘সেরেছে! ভেতরে তো বাড়তি জায়গা আছে দেখছি। স্ত্রীর দিকে তাকাল ও। তুমি আসলেই একটা চিজ!

এবার সবাই মিলে হাত লাগাল। ভেতরে ঢোকার জন্য পথ তৈরি করতে হবে। কয়েক মিনিট লাগল ওদের কাজটা করতে।

‘এটা একটা গুহা, কোনো সন্দেহ নেই। বিড়বিড় করে বলল ল্যাজলো।

‘ল্যাজলো সাহেব, আগে যাওয়ার সম্মানটুকু গ্রহণ করবেন নাকি?’ রেমি জানতে চাইল।

‘আসলে হয়েছে কী, আপনার মতো আমার মাথাতেও একটা আইডিয়া এসেছে। যদি এমন হয় এখানে বুট্রিাপ রাখা আছে?

যদি থাকেও আমার মনে হয় না সেটা এতদিন পরেও সেটা কাজ করবে।’ স্যাম বলল।

‘তাহলে ঠিক আছে। ফলে মি! জোর করে সাহস দেখাল ল্যাজলো।

আগের দুটো গুহার চেয়ে এটা বড়। গুহার গা বেয়ে পা চোয়াচ্ছে।

 যাক, ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। এগোতে এগোতে বলল স্যাম।

 “কিন্তু কোনো ‘বাক্স তো দেখতে পাচ্ছি না।’ রেমি বলল।

 ‘ভাল কথাটাও বল। দেখ, কোনো কঙ্কালও নেই।’

একটু পর ওরা সবাই একটা চেম্বারে এসে উপস্থিত হলো। চেম্বারটা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে।’

‘এখানেও কোনো গুপ্তধন নেই দেখছি।’ মুখ হাঁড়ি করে বলল লিও।

সবুরে মেওয়া ফলে। স্যাম চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল।

‘ওদিকটায় দেখুন…’ ডান দিকে নির্দেশ করল ল্যাজলো। ওদিকে আরেকটা ছোট্ট মুখ দেখা যাচ্ছে। ওটা দিয়ে যাওয়া যাবে মনে হচ্ছে।’

কিন্তু এভাবে কত ভেতরে যাওয়ার পর গুপ্তধন পাওয়া যাবে? কেউ জানো তোমরা? লিও হতাশ।

‘তাগড়া ঘোড়া এত তাড়াতাড়ি হাঁপিয়ে উঠল নাকি?’ খোঁচা মারল স্যাম।

‘শব্দটা “আহত ঘোড়া” হবে, মশাই। ল্যাজলোও স্যামের সাথে যোগ দিল।

ল্যাজলো সবার সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার পেছনে রেমি ও স্যাম। সবার পেছনে আছে লিও। ওরা যে পথ ধরে এগোচ্ছে এটা বেশ চওড়া। এটার ঠিক পাশেই একটা সরু পথের মতো আছে। অন্ধকার।

 হঠাৎ লিও’র লাইট আছড়ে পড়ল। চিৎকার করে উঠল লিও। বেচারা অন্যদিকে টর্চ ধরে এগোতে গিয়ে অন্ধকার পথের ভেতরে পড়ে গেছে বুঝতে পারেনি।

চিৎকার শুনে ঘুরে দাঁড়াল স্যাম। “লিও।

 হাঁটু গেড়ে বসে নিচে দেখার চেষ্টা করল।

‘নিচে কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’ ল্যাজলো নিচ দিকে লাইট ধরে জিজ্ঞেস করল।

‘না। বোধহয় নিচের পথটা কোনদিকে মোড় নিয়ে ঘুরে গেছে। তাই দেখা যাচ্ছে না। হাতের টর্চটা ডান হাতে নিল স্যাম। রেমি রশিটা দাও। আমি ওটা আমার শরীরে বেঁধে নিচে নামব। দেখি, লিও কোথায় আছে…’

‘স্যাম… আস্তে করে বলল রেমি।

‘আবার কী? শোনননি কী বললাম? বেচারা এমনিতেই আহত। এখন হয়তো আরও বেশি আহত হয়েছে।

‘স্যাম…’ রেমি আবার বলল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা তুলল স্যাম। তাকিয়ে দেখে বেশ লম্বা এক স্থানীয় বাসিন্দা, একটা পিস্তলের ব্যারেল তাক করে রয়েছে। একদম ওর দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *