৬. যায়েদ বিন কুসাদা

০৬.

যায়েদ বিন কুসাদাকে তারিক বিন যিয়াদ যেদিকে প্রেরণ করেছিলেন, সেদিকে ছিল আন্দালুসিয়ার এক বড় শহর গ্রানাডা। আন্দালুসিয়ার বিখ্যাত জেনারেল থিয়োডুমির তারিক বিন যিয়াদের হাতে কাকা উপত্যাকায় পরাজিত হয়ে পালিয়ে গ্রানাডা এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সে মুসলিম বাহিনীর বিজয়-সংবাদ শুনতে পাচ্ছিল। সে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে গ্রানাডার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্ভেদ্য করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছিল।

গ্রানাডার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমনিতেই অত্যন্ত দুর্ভেদ্য ছিল। শহর-রক্ষা প্রাচীরের কোথাও কোন ক্রটি ছিল না। দুর্গে সৈন্যও ছিল প্রচুর। শুধু একটি অভাবই থিয়োডুমিরকে বিচলিত করছিল। আর তা হল, সেনাবাহিনীর লড়াই করার কোন স্পৃহাই ছিল না। তারা একেবারেই হীনমনোবল হয়ে পড়েছিল। মুসলিম বাহিনীর একের পর এক বিজয় আন্দালুসিয় বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল। দুর্গের সিপাহীদের মনোবল ভাঙ্গার জন্য পিছনের রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে আসা সিপাহী ও সাধারণ লোকজনই যথেষ্ট ছিল। মুসলিম বাহিনী সম্পর্কে তারা এমনভাবে কথাবার্তা বলত যে, মনে হত, মুসলিম বাহিনী কোন জিন-ভূতের দল।

রডারিকের মৃত্যু সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষ রডারিককে বীরপুরুষ ও অকুতোভয় যোদ্ধা মনে করত। তার ব্যাপারে মশহুর ছিল, সে মহলে জালিম বাদশাহ, আর রণাঙ্গনে মহাবীর। কোন বাদশাহই তাকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে না। এ জন্য মানুষের প্রবল ধারণা ছিল, রডারিক মারা যাইনি; সে এখনও জীবিত আছে। দ্রুতই সে ফিরে আসবে। অনেকে তো এমনও বলছিল, সে যদি মরেও গিয়ে থাকে তাহলেও সে ফিরে আসবে। তবে প্রত্যেকেই এমন ধারণা করত না। যারা এমনটি ধারণা করত না তারা বলত, মুসলিম বাহিনীর প্রতিটি সৈনিকই ভয়ঙ্কর রকম যুদ্ধবাজ। তারা শুধু রডারিককে পরাজিতই করেনি; বরং তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।

আন্দালুসিয় বাহিনীর এই মানসিক অবস্থা থিয়োডুমিরের জন্য অনেক বড় চিন্তার কারণ ছিল। সে একবার মুসলিম বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়েছিল। সেই পরাজয়কে বিজয়ে পরিণত করার জন্য সে অস্থির ছিল। সেই সাথে আন্দালুসিয়ার বাদশাহ হওয়ার খোয়াবও তার মনে উঁকি দিচ্ছিল। ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, থিয়োডুমির বাদশাহ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তার অধীনস্থ সেনা-অফিসারদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখাচ্ছিল। সে তারদেরকে বলছিল,

‘এখন দেশে কোন বাদশাহ নেই। যে বিজয় অর্জন করতে পারবে, সেই বাদশাহ হবে। আফ্রিকার বার্বাররা লুটতরাজের জন্য এসেছে। তারা একটি জায়গায়ও যদি পরাজিত হয় তাহলেই পালিয়ে যাবে। তখন এই রাজ্য হবে আমাদের। তোমরা আমার স্থলাভিষিক্ত হবে, আর আমি হব রডারিকের স্থলাভিষিক্ত। তোমাদের সকলকেই সেনাবাহিনীর বড় বড় অফিসার বানাব। রডারিকও এভাবেই বাদশাহ হয়েছিল। তবে প্রথম শর্ত হল, হানাদার বাহিনীকে এই রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে হবে।’

ফৌজি অফিসারদের জন্য এতটুকু ইঙ্গিতই যথেষ্ট ছিল। তারা বড় বড় পদের আশায় হানাদার বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করার জন্য পূর্ণরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগল।

‘তোমরা সকলেই ওছেন যে, বার্বারদের বাহিনী গ্রানাডার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। থিয়োডুমির বলল। এখন তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল, তারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তিন দিকে অগ্রসর হচ্ছে। একটি দল গ্রানাডার দিকে আসছে। তাদেরকে সমুলে ধ্বংস করতে হবে। যদি আমরা এই বাহিনীকে ধ্বংস করতে পারি তাহলে আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের দ্বিতীয় অংশের উপর আক্রমণ করব, যারা কর্ডোভার দিকে গেছে। তারপর টলেডোর দিকে যে দল গেছে তাদেরকে সহজেই খতম করতে পারব।

এই বার্বার বাহিনীকে পরাস্ত করার একটি পদ্ধতি আমি চিন্তা করে রেখেছি। তা হল গ্রানাডার দিকে যে দলটি অগ্রসর হচ্ছে, আমরা তাদরেকে পথিমধ্যে স্থানে স্থানে আক্রমণ করে এতটাই ব্যতিব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করব যেন, তারা গ্রানাডা পৌঁছতেই না পারে। আর যদি গ্রানাডা পৌঁছেও যায় তাহলে তাদের সৈন্যসংখ্যা হবে খুবই কম এবং তারা থাকবে ক্লান্ত-শ্রান্ত। তখন আমরা তাদেরকে দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে পারব।’

‘আপনার পরিকল্পনা খুবই উত্তম।’ একজন উচ্চপদস্থ সেনা-অফিসার বলল। ‘আমরা বার্বারদের গ্রানাডা অবরোধ করার সুযোগই দেব না। গ্রানাডা থেকে দূরে উন্মুক্ত প্রান্তরে তাদের সাথে যুদ্ধ হবে।’

‘আপনি রডারিকের আসনে আসীন হবার কথা বলছিলেন, আপনি কি ভুলে গেছেন যে, রডারিকের একজন নওজোয়ান পুত্র আছে? তার নাম হল, রাচমান্ড। তার বর্তমানে আপনি আন্দালুসিয়ার মুকুট কীভাবে পরিধান করবেন?

‘রাচমান্ড তো পাগল।’ থিয়োডুমির জবাব দিল।

‘তার মা তো আর পাগল নয়।’ অফিসার বলল। তাছাড়া ইউগুবেলজিও আপনার মতো জেনারেল। সে সবসময় টলেডো থেকেছে। রডারিকের রানী তাকে সব সময় নিজের কাছে রাখতে পছন্দ করে। তাছাড়া সিপাহীদের মাঝেও তার জনপ্রিয়তা খুব বেশি। সে সেনাবাহিনীকে আপনার বিরুদ্ধে এবং রানীর পক্ষে উসকে দেবে। সে রাচমান্ডকেই সিংহাসনে বসাবে। আপনি যদি তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেন তাহলে আপনাকে হত্যা করা হবে। অন্যথায় গৃহযুদ্ধ শুরু হবে।

এদিকে হানাদার বাহিনী যখন একের পর এক যুদ্ধে বিজয় লাভ করে সামনে অগ্রসর হয়ে আসছে, এমন সময় আপনি কি চান যে, রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হোক? জেনারেল থিয়োডুমির! আপনি কি শত্রুবাহিনীর জন্য গোটা রাজ্য দখল করা সহজ করে দিতে চান?

থিয়োডুমির অফিসারের কথা শুনে এমনভাবে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল যেন মনে হল, অফিসার একজন বদ্ধপাগল। থিয়োডুমির তার কথার কোন জবাবই দিতে চাচ্ছিল না।

‘এটা পরে দেখা যাবে। থিয়োডুমির বলল। এখন প্রথম বিষয় হল, সেনাবাহিনীকে সুবিন্যস্ত করা। গ্রানাডা পর্যন্ত পৌঁছতে হানাদার বাহিনীকে যে কয়টি দুর্গ ও শহর অতিক্রম করতে হবে সেগুলোর হিসাব করে সে অনুপাতে সেখানে সৈন্য পাঠাতে হবে।

গ্রানাডা পৌঁছতে পথে চারটি গুরুত্বপূর্ণ শহর পড়ে। সেগুলো হল, আটিডোনা, মালাগা, মুরসিয়া, ওরিহুয়েনা। ওরিহুয়েনার অবস্থান ছিল গ্রানাডার উপকণ্ঠে।

থিয়োডুমির এসকল জায়গায় ঝটিকা সফর করল। সে প্রতিটি শহরের সৈন্যদের খোঁজ-খবর নিল এবং তাদেরকে লক্ষ্য করে একই রকম জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করল :

‘ঐ শাহানশা রডারিক মৃত্যুবরণ করেছে, যে আন্দালুসিয়াকে নিজের পৈত্রিক জায়গির মনে করত। আর তোমাদেরকে মনে করত তার কেনা গোলাম। আন্দালুসিয়া তোমাদের রাজ্য। আন্দালুসিয়ার জমিতে উৎপাদিত প্রতিটি শস্যদানা তোমাদের। রক্ত পানি করে উপার্জন করা প্রতিটি পয়সার মালিকও তোমরা। এখন থেকে তোমাদের জমির উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক আর কেউ জোর করে নিয়ে যেতে পারবে না। তোমাদের হাতে তৈরী প্রতিটি বস্তুর সম্পূর্ণ মূল্য তোমরাই পাবে। তোমরা যারা সেনাবাহিনীতে আছ, তোমাদের বাপ-ভাই ও সন্তানদের থেকে কোন প্রকার কর আদায় করা হবে না। কোন সিপাহী যদি লড়াই এ আহত হয় তাহলে আজীবন তাকে তার নির্ধারিত বেতন-ভাতা প্রদান করা হবে। আর কেউ যদি নিহত হয় তাহলে তার বাবা-মা বা তার স্ত্রী কিংবা সন্তানদেরকে এক সাথে মোটা অংকের টাকা প্রদান করা হবে।’

 প্রতিটি স্থানে সিপাহীরা ধিয়োডুমিরের ভাষণ শুনে সমস্বরে চিৎকার করে তাকে মোবারকবাদ জানাত, আর বলত :

‘থিয়োডুমির জিন্দাবাদ, আন্দালুসিয়া জিন্দাবাদ।‘

তাদের প্রশংসা-ধ্বনি শেষ হলে থিয়োডুমির পুনরায় তার ভাষণ শুরু করত :

 ‘আফ্রিকার বাবার মুসলিম বাহিনী তোমাদের মুলুক ও তোমাদের ঘর-বাড়ী লুট করতে এসেছে। তারা তোমাদের মেয়ে-বোন ও যুবতী স্ত্রীদেরকে ধরে নিয়ে যাবে এবং তাদেরকে তোমাদের সামনে বেআবরু করবে। এ ডাকাতরা দশ-বার বছরের বাচ্চাদেরকেও ধরে নিয়ে যায়। যদি তোমরা তাদের হাত থেকে তোমাদের ধন-সম্পদ, আর মান-ইজ্জত বাঁচাতে চাও তাহলে জীবনবাজি রেখে লড়াই কর। দুশমনের ভয় অন্তর থেকে বের করে দাও। তারা এত বড় বাহাদুর নয়, যতটা তোমরা শুনেছ। যেসব সিপাহী পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছে তারা তো বলবেই যে, মুসলিম বাহিনী মানুষ নয়; জিন-ভূত। এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা, তারা তোমাদের মতোই মানুষ। পৃথিবীতে যদি কোন বাহাদুর থেকে থাকে তাহলে তোমরাই আছ।‘

 থিয়োডুমির যাদের সামনে ভাষণ দিচ্ছিল, তারা জানত না যে, সে সর্বপ্রথম মুসলিম বাহিনীর সাথে লড়াই করে পরাজিত হয়েছে এবং কোন রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে। সে তার বাহিনীকে বার্বারদের দয়া-দক্ষিণার উপর ছেড়ে এসেছে। রডারিকের সাথেও সে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল। রডারিকের বাহিনী পরাজিত হলে সে অতি গোপনে পালিয়ে গ্রানাডা এসে আশ্রয় নিয়েছে। আর এখন সে বড় বড় কথা বলে ভাষণ দিচ্ছে। এখন সে বলছে, মুসলিম বাহিনী জিন-ভূতের বাহিনী নয়। অথচ সে-ই প্রথম মুসলিম বাহিনীকে জিন-ভূতের বাহিনী আখ্যায়িত করে রডারিকের নিকট চিঠি লেখেছিল।

সেই খিয়োড়মিরই এখন গ্রানাডা থেকে বের হয়ে তার বাহিনীর মাঝে সাহস ও মনোবল সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

***

থিয়োডুমির গ্রনাডা পৌঁছার পূর্বেই যায়েদ বিন কুসাদা দুর্ভেদ্য প্রাচীরে ঘেরা উপশহর আটিডোনা পৌঁছে যান। তিনি তার বাহিনীকে সামান্য বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে তুফানের বেগে দুর্গ অবরোধ করেন। প্রাচীরের উপর তীরন্দাজ ও বর্শা নিক্ষেপকারী বাহিনী প্রস্তুত ছিল। তারা অবিরাম তীর-বর্শা নিক্ষেপ করতে লাগল।

মুসলিম বাহিনীর ধনুক ছিল অত্যন্ত মজবুত। এসকল ধনুক দ্বারা বহুদূর থেকে তীর নিক্ষেপ করে লক্ষ্য ভেদ করা সম্ভব ছিল। প্রাচীরের উপর থেকে যে তীর নিক্ষেপ করা হচ্ছিল, তা মুসলিম বাহিনীর কাছে এসে পৌঁছত না। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর সঠিক লক্ষ্যে আঘাত হানত।

মুসলিম বহিনীর রণহুঙ্কার আর তাকবীর ধ্বনি আন্দালুসিয়দের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করত। মুসলিম বাহিনী পাঁচ-ছয়জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দৌড়ে দুর্গের কাছে পৌঁছে যেত। উপর থেকে কোন তীরন্দাজ কুঁকে তাদের দিকে তীর ছুঁড়তে চেষ্টা করলে বার্বার সেনাদের তীর তাকে সোজা হতে দিত না। তীরবিদ্ধ হয়ে সেই সিপাহী দুর্গপ্রাচীরের উপরই লুটিয়ে পড়ত, কিংবা নিচে পড়ে যেত। মুসলিম বাহিনীর একমাত্র চেষ্টা ছিল রশির সাহায্যে প্রাচীরের উপর আরোহণ করা বা প্রাচীর ভাঙ্গার মতো সুযোগ সৃষ্টি করা।

মুসলিম সিপাহীদের ছোট ছোট কয়েকটি দল দুর্গের ফটক পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তারা ফটক ভাঙ্গার চেষ্টা করল।

মুসলিম বাহিনী অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে লড়াই করছিল। মনে হচ্ছিল, তারা গোটা দুর্গ প্রাচীরসহ উপড়ে ফেলে দেবে। মুসলিম বাহিনী সম্পর্কে আন্দালুসিয়দের মনে যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল, তা পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। দুর্গের সিপাহীদের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে লাগল।

মুসলিম বাহিনী যে তীর নিক্ষেপ করছিল তার কিছু কিছু লক্ষভ্রষ্ট হয়ে দুর্গের ভিতর গিয়ে পড়ছিল। এ কারণে শহরের অধিবাসীদের মাঝেও ত্রাস ছড়িয়ে পড়ল। তারা দুর্গের মাঝে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করল যে, দুর্গের সিপাহীদের মনোবল যতটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও নিঃশেষ হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে দুর্গপতি ফটক খোলে দেওয়ার হুকুম দিল।

মুসলিম বাহিনী দুর্গে প্রবেশ করল। বড় ধরনের রক্তপাত ও ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই অটিডোনার দুর্গ মুসলিম বাহিনীর করতলগত হল।

****

সামনে আছে আরও দুটি বড় শহর মালাগা ও মুরসিয়া। মালাগার সিপাহীরা অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দিল। মুসলিম বাহিনী যখন মালাগা দুর্গের সামনে এসে পৌঁছল তখন তারা দেখতে পেল, আন্দালুসিয়ার বাহিনী দুর্গের বাইরে এসে রণসাজে সজ্জিত হয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

থিয়োভুমিরের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা এই যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করেছিল। অনেকটা থিয়োডুমিরের প্রলোভনের কারণেও তারা দুর্গবন্দী হয়ে যুদ্ধ করার পরিবর্তে উন্মুক্ত রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু তাদের জানা ছিল না যে, তারা এমন এক সম্প্রদায়ের সাথে লড়াই করতে নামছে, যুদ্ধ-বিগ্রহ যাদের মজ্জাগত ব্যাপার। জন্মের পর থেকেই যাদেরকে যুদ্ধকৌশল শিক্ষা দেওয়া হয়।

যায়েদ বিন কুসাদা ছিলেন আরবী। এটা সেই সময়ের ইতিহাস বলা হচ্ছে যখন অন্যান্য জাতি-গোষ্টির অন্তরে আরবদের আক্রমণাত্মক হামলার আতঙ্ক বিরাজ করত। সালার যায়েদ বিন কুসাদা তারিক বিন যিয়াদের মতো বিশেষ রণকৌশলে আন্দালুসিয় সৈন্যদেরকে এমনভাবে পিছন দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেলেন যে, তাদের পিঠ দেয়ালে লেগে গেল। আন্দালুসিয় সৈন্যরা নিজেদের ঘোড়ার খুড়ের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগল। মুসলিম সৈন্যরা তাদেরকে কেটে টুকরো টুকরো করতে লাগল।

সালার যায়েদ বিন কুসাদা আন্দালুসিয় বাহিনীকে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখে কিছু সৈন্যকে ফটক ভাঙ্গার জন্য পাঠিয়ে দিলেন।

আন্দালুসিয় সৈন্যরা দুর্গ থেকে বের হয়ে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু তারা দুর্গ রক্ষা করার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ভুলে গিয়েছিল। দুর্গের বাইরে আন্দালুসিয় সৈন্যরা মুসলিম সৈন্যদের হাতে কচুকাটা হচ্ছিল। আর ওদিকে কয়েকজন জানবাজ সিপাহী দুর্গের ফটক ভেঙ্গে দুর্গ দখল করে নিল। সাথে সাথে সকল সিপাহী হাতিয়ার ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করল।

জেনারেল থিয়োডুমিরের জ্বালাময়ী ভাষণ কোন কাজে এলো না। আসলে তীর-তলোয়ারের ঝনঝনানির সামনে বাক্য-বান লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।

এই শহর দুটি বিজিত হওয়ার পর মুসলিম বাহিনীর সামনে একমাত্র লক্ষ্য ছিল গ্রানাডা। জেনারেল থিয়োডুমির স্বয়ং এই শহরে উপস্থিত ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, সে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। কারণ, প্রথমত সে তার পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করতে চাচ্ছিল। দ্বিতীয়ত তার দৃষ্টি ছিল, আন্দালুসিয়ার রাজমুকুট আর শাহীসিংহাসনের উপর। মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করার সব রকম প্রস্তুতিই সে গ্রহণ করেছিল। সে নিজেও দুর্গবন্দী হয়ে যুদ্ধ করতে পছন্দ করত না, তাই সে তার বাহিনীকে গ্রানাডা থেকে কয়েক মনজিল দূরে অবস্থিত ওরিহুয়েনা নামক উপশহরে নিয়ে এলো এবং সেখানেই যুদ্ধ করার মনস্থ করল।

কোন ঐতিহাসিকই থিয়োডুমির ও যায়েদ বিন কুসাদার সৈন্যসংখ্যা লেখেননি। তারা শুধু এতটুকুই উল্লেখ করেছেন যে, আন্দালুসিয়ার সৈন্যবাহিনীর তুলনায় যায়েদ বিন কুসাদার সৈন্যসংখ্যা ছিল একেবারেই অপ্রতুল। আন্দালুসিয় বাহিনীর সাথে সাধারণ মানুষও বিপুল সংখ্যায় যোগ দিয়েছিল। সংখ্যার সল্পতা সত্ত্বেও মুসলিম বাহিনীর আরেকটি বড় দুর্বলতা ছিল এই যে, তারা লাগাতার যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। তাদের দেহে যুদ্ধ করার মতো উদ্যম ছিল না। তারা তাদের আধ্যাত্মিক শক্তির বলে বলিয়ান হয়ে গ্রানাডার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছল।

গ্রানাডা পৌঁছে যখন তারা দেখল যে, শত্রুবাহিনী যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে তাদের অপেক্ষা করছে তখন তারা কোন রকম বিশ্রাম করা ছাড়াই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।

যায়েদ বিন সাদা শত্রুবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত দেখতে পেয়ে তার বাহিনীকে থামিয়ে দিলেন। তারপর সামান্য উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আন্দালুসিয় বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ও তাদের যুদ্ধকৌশল অনুমান করতে চেষ্টা করলেন।

থিয়োভূমির জানত যে, মুসলিম বাহিনীর আল্লাহু আকবার ধ্বনি আর রণহুঙ্কার তার বাহিনীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলে। এর প্রতিকার স্বরূপ সে তার বাহিনীর জন্য বিশেষ ধরনের রণহুঙ্কারের ব্যবস্থা করল। সেই সাথে তার জুনিয়র কমান্ডাররা মুসলিম বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য আহ্বান করতে শুরু করে দিল। সেনাপতি যায়েদ বিন কুসাদা বুঝতে পারলেন যে, শত্রুপক্ষ দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। প্রতিটি সৈন্যই যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য টগবগ করছে। তাদের উৎসাহ-উদ্দিপনাই বলে দিচ্ছে, তারা জীবন দিতে ও জীবন নিতে প্রস্তুত। যায়েদ বিন কুসাদা এই ভেবে কিছুটা চিন্তিত ছিলেন যে, তার বাহিনীর প্রতিটি সিপাহীই ক্লান্ত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়। আর পালিয়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তাই যায়েদ বিন কুসাদা সেই উঁচু স্থান থেকেই চিৎকার করে তাঁর সিপাহীদেরকে বলতে লাগলেন,

‘বাবার ভায়েরা আমার! তোমাদের যুদ্ধ-স্পৃহা ও ঈমানী শক্তির পরীক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে। আমি আরব, কিন্তু আজ তোমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে, যুদ্ধের ময়দানে আরবদের চেয়ে বার্বাররা বেশি সাহসী ও জানবাজ। মনে রেখো, তোমাদের সঙ্গি-সাথীরা অন্য শহরের দিকে গেছে। তাদের কাছ থেকে তোমাদেরকে এমন তিরস্কার যেন শুনতে না হয় যে, গ্রানাডার দিকে যারা গেছে, তারা ভীরু ও কাপুরুষ। সবচেয়ে বড় কথা হল, তোমরা যদি পরাজিত হও তাহলে আল্লাহর সামনে তোমরা কী জবাব দেবে?’

যায়েদ বিন কুসাদা এতটুকু বলার সাথে সাথে বার্বার সিপাহীরা উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘যায়েদ! আমরা আপনার সাথে আছি…, আমরা আপনার সম্মুখেই থাকব…, আমরা কখনই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করব না…।’

এই যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ঐতিহাসিক প্রফেসর ডোজি লেখেন, যায়েদ বিন কুসাদা ঘোড়ায় সওয়ার ছিলেন, তিনি ঘোড়াকে কেবলামুখী করে অবনত মস্তকে দুআর জন্য হাত উঠালেন। তার ঠোঁট নড়ছিল। জানা নেই, তিনি কী বলে আল্লাহর কাছে বিজয় কামনা করেছিলেন। ধীরে ধীরে তার মাথা আসমানের দিকে উঁচু হতে লাগল। সেই সাথে তিনি উভয় হাত আসমানের দিকে প্রসারিত করে ধরলেন। কিছুক্ষণ পরই তার হাত ও মাথা তরিগতিতে নিচের দিকে নেমে এলো। মুনাজাত শেষ না করেই তিনি উচ্চ আওয়াজে বলতে লাগলেন, “হে ইসলামের রক্ষকগণ! আল্লাহ তাআলা আমাকে বিজয়ের সুসংবাদ দান করেছেন।’

তারপর তিনি নিচে নেমে এসে প্রায় একশত জানবাজ বাবার মুজাহিদকে পৃথক করে তাদেরকে বিশেষ নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ অনুযায়ী তারা যে রাস্তা দিয়ে এখানে এসেছিল সে রাস্তা দিয়ে পিছনে চলে গেল। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা একদিকে মোড় নিয়ে উঁচু-নিচু টিলার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জেনারেল থিয়োডুমির ইতিপূর্বে দুইবার মুসলিম বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তারিক বিন যিয়াদ যে কৌশল অবলম্বন করে তার বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিলেন, সে কৌশল এখনও তার মনের পর্দায় ভেসে বেরাচ্ছিল। তাই সে তার জুনিয়র কমান্ডারদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করে বলল, ‘মুসলিম বাহিনী হামলা করার পর যদি পিছু হটে যায় তাহলে তোমরা তাদের পিছু নিবে না; তোমরা পিছনের দিকে চলে আসবে।‘

থিয়োডুমির তার কমান্ডার ও সৈনিকদেরকে এ ধরনের আরও কিছু নির্দেশনা দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার হুকুম দিলেন।

অপর দিকে যায়েদ তার সৈন্যদেরকে বললেন, ‘তোমরা যে ক্লান্ত-শ্রান্ত এটা যেন দুশমনের কাছে প্রকাশ না পায়। দুশমনের যে সৈন্য এখানে রয়েছে তার অধিকাংশ রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে এসেছে। তারা সকলেই বার্বারদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। সুতরাং এমনভাবে লড়তে হবে যেন তাদের সে ভয় আরও বেড়ে যায়। এমন যেন না হয় যে, উল্টো আমাদের মাঝেই তাদের সম্পর্কে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।’

ঐতিহাসিক লেনপোল এবং সবচেয়ে সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিক উইলিয়াম স্কাট সর্বসম্মতক্রমে লেখেন যে, উভয় বাহিনীর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, মুসলিম বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে। মুসলিম বাহিনীর বিজয় শুধু এভাবেই হতে পারে যে, তাদের সেনাপতি কোন বিশেষ কৌশল অবলম্বন করবেন। তবেই থিয়োডমির বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব। এমন কোন সম্ভাবনা আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছিল না। বিজয়ের সকল সম্ভাবনা থিয়োডুমিরের পক্ষেই ছিল। থিয়োডুমিরও একশ ভাগ নিশ্চিত ছিল যে, বিজয় তারই হবে।

জেনারেল থিয়োডুমির তার বাহিনীকে এমন এক জায়গায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, যার ডানে-বায়ে উঁচু উঁচু ঢিলা ও বড় বড় পাথর ছিল। ফলে তার বাহিনীর উভয় বাহু নিরাপদ ছিল।

যায়েদ বিন কুসাদা তার বাহিনীকে তিনভাগে ভাগ করলেন। তিনি মধ্যভাগকে সম্মুখে পাঠালেন, আর নিজে পিছনে থাকলেন। বিপরীত দিক থেকে গ্রানাডার দ্বিগুণসংখ্যক সৈন্য সামনে অগ্রসর হল। তাদের একেবারে পিছনে ছিল থিয়োডুমির।

মুসলিম বাহিনী রণহুঙ্কার ছেড়ে আল্লাহু আকবার বলে দ্রুতগতিতে সামনে অগ্রসর হল। বিপরীত দিক থেকে আন্দালুসিয় বাহিনীও তেড়ে এলো। উভয় বাহিনী মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হল। আন্দালুসিয় সৈন্যরা বুঝতে পারছিল না যে, মুসলিম বাহিনী ধীরে ধীরে পিছনে চলে যাচ্ছে। আন্দালুসিয় বাহিনী যুদ্ধের তালে তালে সামনে অগ্রসর হয়ে চলছিল। থিয়োডুমির বহুদূর পিছন থেকে চিৎকার করছিল এবং কাসেদের মাধ্যমে সংবাদ পাঠাচ্ছিল, তারা যেন সামনে অগ্রসর না হয়।

তুমুল তালে যুদ্ধ চলছে। হঠাৎ ডান ও বামের টিলা আর বড় বড় পাথরের পিছন থেকে আন্দালুসিয় বাহিনীর উপর তীরবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, আশপাশের টিলা আর পাথরখণ্ডগুলো আগ্নেয়গিরির লাভা উদ্‌গিরণ করছে। সেই সাথে টিলার পিছন থেকে বার্বার অশ্বারোহী বাহিনী বের হয়ে দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আন্দালুসিয় বাহিনীর পিছনে চলে গেল। পিছন দিক থেকে তারা অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ আক্রমণ করল। টিলার পিছন থেকে ছুটে আসা তীর ও বর্শার আঘাতেই আন্দালুসিয় বাহিনী নাকাল হচ্ছিল বেশি। তীর থেকে বাঁচার জন্য সৈন্যরা দিগবিদিক ছুটতে লাগল। অবশিষ্ট কাজ মুসলিম অশ্বারোহীরা পূর্ণ করল।

ঐতিহাসিক লেনপোল এবং উইলিয়াম স্কাট লেখেন, আন্দালুসিয় সৈন্যদের মনে মুসলমানদের ব্যাপারে যে ত্রাস ছড়িয়ে ছিল, তা তীর-বর্শার চেয়েও বেশি ক্রিয়াশীল ছিল। অন্য রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যরা এতটাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল যে, মুহূর্তের মাধ্যে যুদ্ধের চিত্ৰই পাল্টে গেল।

যুদ্ধের শুরুতে যায়েদ বিন কুসাদা একশ জানবাজ সিপাহীকে আত্মগোপন করে থাকার জন্য রণাঙ্গনের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ছিলেন। তারা বহু দূরের পথ ঘুরে শহরের পিছনে পৌঁছে গেল। সেখানে গিয়ে তারা দেখতে পেল, দুর্গপ্রাচীরের উপর একজন প্রহরীও নেই।

সালার যায়েদ বিন কুসাদা এই ভেবে তাদেরকে দুর্গের দিকে পাঠিয়ে ছিলেন যে, গ্রানাডার সকল সিপাহী দুর্গের বাইরে চলে এসেছে। সম্ভবত দুর্গের ভিতর কোন সিপাহী নেই। যদি থাকে তাহলে তাদের সংখ্যা খুবই কম হবে। একশ সদস্যের সেই বাহিনীকে বলা হয়েছিল যে, তারা যেন দুর্গের ফটক ভাঙ্গার চেষ্টা করে, কিংবা রশির সাহায্যে দুর্গপ্রাচীরের উপর আরোহণ করে।

একশ সদস্যের এই জানাবাজ দলটি যখন শহরের পিছনে পৌঁছল তখন প্রাচীরের উপর দাঁড়ানো এক ব্যক্তি তাদেরকে দেখতে পেল। সে দ্রুত নিচে নেমে ঘোড়ায় চড়ে থিয়োড়মিরের কাছে গিয়ে খবর দিল যে, কিছু সংখ্যক মুসলিম সৈন্য পিছন দিক হতে শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। থিয়োডুমির প্রায় তিনশ অশ্বারোহীকে শহরের পিছন দিকে পাঠিয়ে দিল, আর যেসব সৈন্য এখনও যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি তাদেরকে হুকুম দিল, তারা যেন শহরের ভিতর চলে যায়।

আন্দালুসিয় সিপাহীরা শহরের দিকে যাওয়ার জন্য পিছন দিকে ফিরতেই যায়েদ বিন কুসাদা তার রক্ষিত সৈন্যদের নিয়ে আন্দালুসিয় বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পিছন দিক থেকে হামলা হওয়ার কারণে আন্দালুসিয় বাহিনীর অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হল।

লেনপোল এবং উইলিয়াম স্কাট লেখেন, আন্দালুসিয় বাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হল। এমন বিপুল পরিমাণ প্রাণহানী ইতিপূর্বের কোন যুদ্ধে হয়নি। থিয়োডুমির যে তিনশ সিপাহীকে শহরের পিছনে পাঠিয়ে ছিল বার্বার মুজাহিদগণ তাদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলল। এই যুদ্ধে আন্দালুসিয় কোন সিপাহী যদি প্রাণে বেঁচে থাকে তাহলে নিশ্চিতরূপে বলা যায়, সে শহরের দিকে যায়নি, বরং জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেছিল বলেই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।

***

থিয়োডুমিরকে রণাঙ্গনে পাওয়া গেল না। দুর্গের খোলা ফটক বন্ধ করে দেওয়া হল। অনেকক্ষণ হয় আন্দালুসিয় বাহিনীর পতাকা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। যায়েদ বিন কুসাদার নির্দেশ ছিল কোন দুশমনকে যেন জিন্দা রাখা না হয়।

রণাঙ্গন থেকে গ্রানাডা বেশ দূরে অবস্থিত। আন্দালুসিয় বাহিনীকে পূর্ণরূপে ধ্বংস করে সালার যায়েদ বিন কুসাদা গ্রানাডার দিকে রওনা হলেন। তিনি তাঁর বাহিনীকে সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিজয় দান করেছেন। এখন আমরা দুর্গে প্রবেশ করে শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করব। শহরে হয়তো কেউ আর প্রতিরোধ করার মতো নেই।

মুসলিম বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে দুর্গের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। তারা দেখতে পেল, দুর্গপ্রাচীরের উপর মানুষের একটি প্রাচীর তৈরী হয়েছে। অন্যান্য দুর্গ অবরোধের সময় দেখা গেছে, সকল দুর্গেই কম-বেশি সিপাহী থাকে, কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক সিপাহী ইতিপূর্বে আর কোন দুর্গে দেখা যায়নি। তাদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, একজনের বাহু আরেকজনের বাহুর সাথে লেগে ছিল। তাদের দেহের উর্ধ্বাংশ ছিল মজবুত লৌহবর্মে আবৃত, আর মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ।

‘না, এখনই নয়। যায়েদ তার সহকারী সালারকে লক্ষ্য করে বললেন। ‘আমরা তো মনে করেছিলাম, গ্রানাডার সকল সৈন্যকে আমরা খতম করে দিয়েছি। কিন্তু শহর রক্ষার জন্য তো দেখছি, রণাঙ্গনের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি সৈন্য এখনও রয়ে গেছে।’

শেষ বিকেলে দিগন্তজোড়ে সূর্যের আবছা আলো তখনও কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। যায়েদ বিন কুসাদা দুর্গ অবরোধ করার নির্দেশ দেন। বেশ কয়েকজন মুজাহিদ শহীদ হওয়ার কারণে মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল। অনেক মুজাহিদ আহতও হয়েছিলেন। মোটকথা, সার্বিক পরিস্থিতি ছিল হতাশাজনক। তারপরও সালার যায়েদ বিন কুসদা প্রাচীরের নিকট গিয়ে ঘোষণা করালেন,

 ‘হে দুর্গবাসী! তোমরা তোমাদের বাহিনীর করুন পরিণতি লক্ষ্য করো। তোমরা যদি যুদ্ধ ছাড়াই দুর্গের দরজা খুলে দাও তাহলে সকলকে নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। অন্যথায় প্রত্যেককে হত্যা করা হবে।

দুর্গের ভিতর থেকে কোন ধরনের উত্তর আসছিল না। সাধারণত অবরোধকারীদের পক্ষ থেকে অল্প সময়ের মধ্যে দুর্গ খোলে দেওয়ার জন্য আলটিমেটাম দেওয়া হয়ে থাকে। আর অবরুদ্ধ বাহিনীর পক্ষ থেকে তিরস্কার ও দাম্ভিকতাপূর্ণ জবাব দেওয়া হয়। কিন্তু যায়েদ বিন কুসাদার ঘোষণার কোন প্রতিউত্তর এলো না।

অপ্রত্যাশিতভাবে দুর্গের দরজা খুলে গেল। থিয়োডুমির সাদা পতাকা হাতে বেরিয়ে এলো। প্রথম আশ্চর্যের বিষয় হল, থিয়োডুমির নিজে সন্ধির পতাকা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। দ্বিতীয় আশ্চর্যের বিষয় হল, থিয়োডুমিরের সাথে মাত্র একজন দেহরক্ষী ছিল। সাধারণত কোন জেনারেল বা বাদশাহ যখন বাইরে বের হয় তখন বড়সড় একটি রক্ষী বাহিনী নিয়ে বাইরে বের হয়।

থিয়োডুমিরের সাথে যে দেহরক্ষী ছিল, নিকটে আসার পর জানা গেল যে, সে দেহরক্ষী নয়; বরং সে হল থিয়োডুমিরের ব্যক্তিগত চাকর। খ্রিস্টান বাদশাহ ও জেনারেলরা রক্ষীবাহিনী ছাড়াও এধরনের দুই-একজন চাকর নিজেদের সাথে রাখতেন। থিয়োডুমিরকে দুর্গ থেকে বের হয়ে আসতে দেখে যায়েদ বিন কুসাদা সামনে অগ্রসর হলেন।

‘আমার চেয়েও বড় কমান্ডারের নির্দেশে আমি আপনার কাছে এসেছি।’ থিয়োডুমির বলল। এই কমান্ডার এখানকার সকল সৈন্যের কমান্ডার। তিনি আপনার কাছে পয়গাম পাঠিয়েছেন যে, দুর্গের ভিতর এত বিপুল সংখ্যক সৈন্য আছে যে, আপনি যদি দুর্গ অবরোধ করেন তাহলে কমপক্ষে এক বছর অতিবাহিত হয়ে যাবে। দুর্গপ্রাচীরের দিকে তাকালেই আপনি বুঝতে পারবেন যে, দুর্গের অভ্যন্তরে কত বিপুল সংখ্যক সৈন্য মওজুদ আছে।

‘এত বিপুল সংখ্যক সৈন্য থাকতে সন্ধির প্রয়োজন কি?’ যায়েদ বিন কুসাদা দুভাষীর মাধ্যমে জবাব দিলেন। আমার বাহিনী তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ। পূর্বের তুলনায় আমার সৈন্যসংখ্যা এখন আরও কমে গেছে।

‘আমাদের জেনারেল খুবই দয়ালু।’ থিয়োডুমির বলল। তিনি দেখেছেন, তার বাহিনী কত নির্মমভাবে মার খেয়েছে। আপনার বাহিনীরও সমূহ ক্ষতি হয়েছে। তাই তিনি বলেছেন, আর কোন রক্তপাত তিনি বরদত করতে পারছেন না। এজন্য তিনি সন্ধি করতে চাচ্ছেন। এখন আপনি যদি সন্ধি করতে না চান তাহলে আমি তো আপনাকে বলেছিই, আমাদের কাছে এখনও যে পরিমাণ সৈন্য আছে, তাতে দুর্গ দখল করা আপনার জন্য মোটেই সম্ভব হবে না।’

যায়েদ বিন কুদার সন্দেহ হচ্ছিল যে, থিয়োডুমির হয়তো তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। কিন্তু সে এমনভাবে কথা বলছিল যে, যায়েদ বিন কুসাদা তার কথায় প্রভাবিত হয়ে সন্ধি প্রস্তাবে সম্মত হয়ে গেলেন।

তবে সন্ধির শর্ত আমাদের পক্ষ থেকে পেশ করা হবে।’ থিয়োডুমির বলল। ‘সবচেয়ে বড় শর্ত হল, শহরবাসীদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু হেফাজত করার দায়িত্ব হবে আপনার। আপনার কোন সৈন্য কোন শহরবাসীর ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। দ্বিতীয় শর্ত হল, রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারে যা কিছু আছে তা আমরা নিজেরাই আপনার কাছে পেশ করব। তৃতীয় শর্ত হল, আপনি আমাকে যুদ্ধবন্দী বানাবেন না। আমি দুর্গেই থাকব এবং আপনার পক্ষ হতে এলাকার গভর্নর নিযুক্ত হব। আমি আপনার আনুগত্য গ্রহণ করছি। ওয়াদা করছি, আমি আপনার সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলব এবং কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করব না।

সন্ধির শর্তাবলী লিপিবদ্ধ করা হল। যায়েদ বিন কুসাদা দলিল-দস্তাবেজে স্বাক্ষর করে নিজের সীল-মোহর লাগিয়ে দিলেন।

‘কাল ভোরে আপনি দুর্গের ফটক খোলা পাবেন।’ থিয়োডুমির এ কথা বলে দুর্গের ভিতর চলে গেল।

 ‘ইবনে কুসাদা? যায়েদ বিন সাদার এক সহকারী কমান্ডার একটু গোসার স্বরে বলল। আপনি আমাদের সকলের মৃত্যু-পরওনার উপর দস্তখত করে সীল-মোহর লাগিয়েছেন।’

‘সে ঠিকই বলেছে, বিন কুসাদা!’ আরেকজন কমান্ডার বলল। মনে হচ্ছে, আপনি খুব ক্লান্তড় হয়ে পড়েছেন, তাই আপনার বুদ্ধি কাজ করছে না।

‘আল্লাহর উপর আমার পূর্ণ ভরসা রয়েছে। যায়েদ বিন কুদা বললেন। ‘তোমরা কি আশঙ্কা করছ যে, থিয়োডুমির আমাদেরকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে? আমরা যদি দুর্গের ভিতর প্রবেশ করি তাহলে দুর্গের সকল সিপাহী এবং অধিবাসী আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং আমাদের নাম-নিশানা মিটিয়ে দেবে?

‘হ্যাঁ, এমনই হবে। কমান্ডাররা বলল।

‘তোমরা নির্বোধের মতো কথা বলছ। যায়েদ বিন কুসাদা বললেন। কোন দুর্গপতিই শত্রুবাহিনীর অল্প কয়েকজন সিপাহীকেও দুর্গের ভিতর প্রবেশ করার অনুমতি দেয় না। অথচ আমাদের গোটা বাহিনীর জন্যই তো তারা কাল সকালে দুর্গের ফটক খুলে দেবে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, বার্বার মুসলমানগণ সংখ্যায় কম হলেও তাদরেকে পরাজিত করা তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।

***

সারারাত যায়েদ বিন কুসাদা ঘুমোতে পারলেন না। তিনি ও বার্বার জেনারেলগণ এ কথা চিন্তা করে খুবই পেরেশান হচ্ছিলেন যে, না জানি, তাদেরকে কোন ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যায়েদ বিন কুসাদা তার কমান্ডারদেরকে রাতে নিদ্রাহীন ও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে বললেন, সকালে দুর্গে প্রবেশ করার সময় চতুর্দিকে চোখ খোলা রেখে দুর্গে প্রবেশ করবে।

রাত ভোর হল। একজন মুজাহিদ ফজরের নামাযের আযান দিলেন। গোটা বাহিনী যায়েদ বিন কুদার পিছনে নামায আদায় করল। যায়েদ পুনরায় তার অধীনস্থ কমান্ডারদেরকে বললেন, ‘দুর্গে প্রবেশ করার সময় সকলেই যেন সতর্ক থাকে।

ভোরের আলোয় চারদিক ফর্সা হয়ে উঠল। এমন সময় দুর্গ থেকে একজন লোক এসে যায়েদ বিন কুসাদাকে বলল, জেনারেল থিয়োডুমির আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। যায়েদ তাঁর বাহিনীকে তাঁর পিছে পিছে আসার নির্দেশ দিয়ে নিজে আগন্তুকের সাথে রওনা হয়ে গেলেন।

গোটা বাহিনী পূর্ব হতেই প্রস্তুত ছিল। যায়েদ বিন কুসাদার নির্দেশ পাওয়ামাত্র পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী রওনা হয়ে পড়ল। তারা ধারণা করছিল, দুর্গপ্রাচীরের উপর পূর্বের ন্যায় সিপাহী অপেক্ষা করবে। কিন্তু দেখা গেল, প্রাচীরের উপর একজন সিপাহীও নেই।

থিয়োডুমির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে যায়েদ বিন কুসাদার জন্য অপেক্ষা করছিল। থিয়োডুমিরের সাথে তার সেই চাকর উপস্থিত ছিল। সে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক যায়েদ বিন কুসাদাকে স্বাগত জানাল এবং তাঁকে দুর্গের ভিতরে নিয়ে গেল।

‘আমার বাহিনীও কি দুর্গের ভিতরে আসতে পারবে?’ যায়েদ বললেন।

‘হা, অবশ্যই।’ থিয়োডুমির বলল। আমি কি সন্ধিপত্রে উল্লেখ করিনি যে, দুর্গ আপনাকে সোপর্দ করব?’

যায়েদ ইশারা করামাত্র সকল সিপাহী দুর্গের ভিতর প্রবেশ করল এবং পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী তারা পূর্ণরূপে সতর্ক রইল। মুসলিম বাহিনী চতুর্দিকে চোখ-কান খোলা রাখল। কিন্তু দুর্গের ভিতর কোথাও কোন সিপাহী তাদের চোখে পড়ল না। ঘর-বাড়ীর ছাদে ও আঙ্গিনায় শুধু নারী ও শিশুদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। ঘরের বাইরেও কয়েকজন বৃদ্ধ পুরুষ ছাড়া বেশিরভাগ নারী ও শিশুদেরকে দেখা যাচ্ছিল। এসব দেখে যায়েদ বিন কুসাদার সন্দেহ আরও প্রবল হল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, নিশ্চয় এটা কোন ফাঁদ হবে।

“আপনার বাহিনী কোথায়?’ যায়েদ বিন সাদা বললেন। দুর্গপতিই কোথায়?

এখানে কোন সৈন্যবাহিনী নেই।’ থিয়োডুমির বলল। এখানে আপনি ফৌজের একজন সদস্যকেও পাবেন না। এখানে আমি একাই আছি। কোন দুর্গপতিও নেই। আমি আপনার সাথে মিথ্যা বলেছিলাম যে, আমার বড় জেনারেল আমাকে সন্ধির জন্য পাঠিয়েছেন। এখানে আমার একজন দেহরক্ষীও নেই। আপনি যে ব্যক্তিকে আমার সাথে দেখেছেন, সে আমার ব্যক্তিগত চাকর। একমাত্র সেই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে রাজী হয়নি।’

 ‘আমি তোমার এ কথা কীভাবে বিশ্বাস করব?’ যায়েদ বিন কুসাদা বললেন।

‘সৈন্যবাহিনী এমন কোন ছোট বস্তু নয়, যা লুকিয়ে রাখা যায়।’ থিয়োডুমির বলল। ‘আমি এই শহর আপনার নিকট সোপর্দ করছি। আপনার কাছে সিপাহী আছে। আপনি গোটা শহর তল্লাশী করে দেখতে পারেন। আমাকে ছাড়া এখানে আপনি কোন সিপাহী দেখতে পাবেন না। আমার সম্পূর্ণ বাহিনী আপনার হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। অল্প কিছুসংখ্যক যারা জীবিত ছিল, তারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছে।’

‘তুমি মিথ্যা কথা বলছ। যায়েদ বিন কুসাদা বললেন। আমি সেই বাহিনীকে দেখতে চাই, যাদেরকে আমি দেয়ালের উপর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।’

থিয়োডুমির নিজেকে আর সংবরণ করতে পারল না। সে হাসতে হাসতে বৃদ্ধ পুরুষ ও নারী-শিশুদের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,

‘এরাই হল সেই বাহিনী, যাদেরকে আপনি প্রাচীরের উপর দেখেছিলেন। আপনি চাইলে আমি আবারও তাদেরকে দুর্গপ্রাচীরের উপর দাঁড় করিয়ে দেখাতে পারি। আমি আপনাকে ধোঁকা দিয়ে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছি। আমার কাছে একজন সৈন্যও ছিল না। এমন অবস্থায় আমি পালিয়ে না গিয়ে বৃদ্ধ পুরুষ, নারী ও কিশোরদেরকে সিপাহীর পোশাক পরিয়ে তাদের মাথায় শিরস্ত্রাণ রেখে তাদেরকে দুর্গপ্রাচীরের উপর দাঁড় করিয়ে দেই, যেন আপনি মনে করেন, দুর্গের ভিতর বিপুল সংখ্যক সৈন্য রয়েছে।’

‘এই প্রতারণার কি প্রয়োজন ছিল? যায়েদ বিন কুসাদা জিজ্ঞেস করলেন। “তুমি কি এই বৃদ্ধ ও অবলা নারী-শিশুদেরকে আমাদের হাতে মারতে চেয়েছিলে? আমি যদি দুর্গ আক্রমণের ইচ্ছে করতাম তাহলে এ নিষ্পাপ কিশোররা আমাদের তীর-বর্শার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেত। তখন আমাদেরকে এই পাপের বুঝা মাথায় নিয়ে আল্লাহর দরবারে মাথা কুটে মরতে হত। তুমি মনে করো না, আমি দুর্গপ্রাচীরের উপর তোমার বাহিনী দেখে ভয় পেয়ে এই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেছি।’

‘আমি এমনটা কখনই মনে করিনি।’ থিয়োভুমির বলল। আমি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছিলাম না। আমি চাচ্ছিলাম, আপনি দুর্গ দখল করুন, যেন আর রক্তপাত না ঘটে। আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, আপনার সাথে আমি যে চুক্তি করেছি তা কোন সামরিক চুক্তি নয়, যেমনটা দু’টি সেনাবাহিনীর মাঝে হয়ে থাকে। আমি আন্তরিকভাবেই আপনার আনুগত্য স্বীকার করছি। আমি ওয়াদা করছি, আমার নিজস্ব কোন বাহিনী আমি তৈরী করব না; বরং পরিপূর্ণভাবে আপনার অধীন থাকব।’

ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, থিয়োডুমিরের বুদ্ধিমত্তা দেখে যায়েদ বিন কুসাদা এত বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে, প্রধান সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের অনুমতি ছাড়াই তিনি থিয়োডুমিরকে গ্রানাডার গভর্নর নিযুক্ত করেন। তবে তাকে একজন আরব প্রশাসকের অধীনে রাখেন।

গ্রানাডার অধিবাসীদের মাঝে ইহুদিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। ইহুদি সম্প্রদায় যেহেতু রডারিকের শাসনে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল, তাই তারা মুসলমানদের অধীনতা স্বীকার করে নিল। গ্রানাডার প্রশাসনিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য যায়েদ বিন কুসাদা মুসলমানদের সাথে ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকেও নিয়োগ করলেন।

প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এমন লোক মুসলিম বাহিনীতে বেশ কম ছিল। মুসলিম বাহিনীতে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানোর মতো লোক কম থাকার কারণেই ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হল। পরবর্তীতে ঐসকল ইহুদি ও খ্রিস্টানরাই ইসলামী সালতানাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং ইসলামী সালতানাতের সর্বপ্রকার ক্ষতি সাধনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়।

***

মুগীস আর-রুমী ও যায়েদ বিন কুসাদা নিজ নিজ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদও টলেডোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। জুলিয়ান ও আউপাস তার সাথেই ছিলেন। টলেডো হল আন্দালুসিয়ার রাজধানী ও বাদশাহর আবাসস্থল। তাই তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও দুর্ভেদ্য।

জুলিয়ান ও আইপাস তারিক বিন যিয়াদকে টলেডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তা থেকে এই শহরের যে চিত্র ভেসে উঠে তা নিম্নরূপ।

টলেডোর চতুর্দিকে বয়ে চলছে টাইগিস নদী। টাইগিস নদীর শেষ প্রান্তে আছে একটি গভীর ও প্রশস্ত ঝিল। এই ঝিলে নদীর পানি জমা হয়। বিশাল বড় একটি পাথরকে ছিদ্র করে সেই ছিদ্র দিয়ে নদীর পানি এই ঝিলে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এটাই সেই ঝিল যেখানে আউপাস পাগলের ছদ্মবেশ নিয়ে মেরিনার সাথে সাক্ষাৎ করেছিল।

প্রথমত টাইগিস নদীই টলেডোকে সুরক্ষিত রেখেছে। দ্বিতীয়ত টলেডোর দুর্ভেদ্য দুর্গ বেশ উঁচুতে অবস্থিত। দুর্গ ও শহর রক্ষাপ্রাচীর অত্যন্ত মজবুত পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। কোন কোন পাথর এত বিশাল যে, তাকে পাহাড় বলে ভ্রম হত।

শহরের চতুর্দিকে আছে প্রাচীর সংলগ্ন অত্যন্ত প্রশস্ত ও গভীর পরিখা। পরিখার নিচে তীক্ষ্ণ ফলাবিশিষ্ট কাঠ গেড়ে রাখা হয়েছে। কেউ যদি পরিখায় নামতে চায় তাহলে এই তীক্ষ্ণ কাঠের আঘাতে সে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। পরিখা থেকে বের হয়ে আসা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না।

যে বাদশাহই টলেডোর সিংহাসনে আরোহণ করেছে, সেই টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করেছে। গোথ বংশের রাজত্বকালে টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এতটাই মজবুত করা হয়েছিল যে, টলেডোকে অপরাজেয় শহর মনে করা হত।

তারিক বিন যিয়াদ খোলা ময়দানে ও পাহাড়-পর্বতে সামনা-সামনি লড়াই করছিলেন। তিনি মাত্র বার হাজার সিপাহী নিয়ে এক লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করেছেন। কিন্তু দুর্গ দখল করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। দুর্গ দখল করার কৌশল সম্পূর্ণ আলাদা। তার উপর টলেডোর মতো একটি অপরাজেয় দুর্গ দখল করা তো একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যই তারিক বিন যিয়াদ আল্লাহর উপর ভসরা করে সামনে অগ্রসর হলেন।

***

টলেডো শহরে বাদশাহ রডারিকের মৃত্যুতে মাতম চলছিল। শুধু শাহীমহলেই শোকের ছায়া নেমে এসেছিল না; বরং গোটা শহর বিতার চাদরে ঢেকে গিয়েছিল। সেই সাথে প্রতিটি মানুষের চেহারা ভয়ে পাংশুবর্ণ ধারণ করেছিল। রডারিকের এক লাখ সৈন্যের মধ্যে যারা জীবন নিয়ে পালিয়ে টলেডো এসে পৌঁছেছিল তাদের মধ্যে সেসকল বেসামরিক লোকও ছিল, যারা রডারিকের ঘোষণা শুনে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। এ ছাড়াও অন্যান্য যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যরাও সেখানে একত্রিত হয়েছিল। তারা সেখানে পৌঁছে মুসলমানদের ব্যাপারে মানুষের মাঝে এমন প্রচারণা চালাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, মুসলিম বাহিনী বাঘ-সিংহের দল, যাকে সামনে পায় তাকেই টুকরো টুকরো করে ফেলে।

গোয়াডিলেট যুদ্ধের পূর্বে টলেডো গুজবের শহরে পরিণত হয়। রডারিক যুদ্ধের জন্য যখন সৈন্য সংগ্রহ করছিল তখন আউপাস ছদ্মবেশ ধারণ করে পুরো শহরে গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছিল। ফলে মুসলমানদের সম্পর্কে শহরের অধিবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। এই গুজব ছড়ানোর পিছনে গোথ সম্প্রদায়ের বিরাট ভূমিকা ছিল। এর পর যখন সংবাদ পৌঁছল যে, তাদের বীরপুরুষ ও অসম সাহসী বাদশাহ রডারিক মৃত্যুবরণ করেছে এবং তাদের এক লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনী মাত্র বার হাজার সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে মার খেয়ে একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে, তখন তারা ভয় ও আতঙ্কে একেবারে মুষড়ে পড়ে।

যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পালিয়ে আসা সৈন্য ও স্বেচ্ছাসেবকরা মুসলিম বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার কথা এমনভাবে বর্ণনা করছিল যে, গোথদের ছড়ানো গুজব এখন শহরের অধিবাসীদের নিকট সত্য বলে মনে হতে লাগল। তারা একে অপরকে বলতে লাগল,

‘তারা মুসলমান হোক বা অন্য কোন সম্প্রদায় হোক–এটা নিশ্চিত যে, তারা মানুষ নয়; অন্য কোন সৃষ্টি।

‘ঠিকই বলেছ, ঠিকই বলেছ, একজন মানুষের পক্ষে দুজনের মোকাবেলা করা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু তাদের একজনই তলোয়ারের এক আঘাতে বিশজন সিপাহীকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে।

 ‘ওরা হিংস্র নেকড়ে, ওরা আজদাহা, সামনে যা পায় তাই গ্রাস করে চলে।

লোকেরা ঠিকই বলেছিল, ওরা সমুদ্রে সাঁতার কাটে না; পানির উপর দিয়ে হেঁটে চলে, ডুবে না।’

‘বাদশাহ রডারিকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

 ‘তার ঘোড়া উরলিয়াকেও হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।

 ‘অনেকেই বলছে, ওরা আমাদের বাদশাহকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে।

‘এটা হয়তো ওদের নিয়ম, ওরা যে বাদশাহকে পরাজিত করে তার গোত খেয়ে ফেলে।’

‘ওরা এদিকেও এগিয়ে আসছে। এখানে ওরা সীমাহীন লুটতরাজ করবে।

মেয়েদেরকে ওরা নিজেদের সাথে নিয়ে যাবে।’

এ ধরনের অসংখ্য গুজব টলেডোর অধিবাসীদের মাঝে লোমহর্ষক ও ভয়ঙ্কর ত্রাস সৃষ্টি করে চলছিল। ঘরে ঘরে অল্প বয়স্ক যুবতী মেয়েরা ছিল। ধন-সম্পদের কারো কোন কমতি ছিল না। সকলের নিকট সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু ছিল তার নিজের জীবন। ধনী-গরীব সকলেই নিজের জান বাঁচানোর চিন্তা করছিল।

মানুষের মুখে মুখে সবচেয়ে বেশি যে কথাটি আলোচিত হচ্ছিল, তা হল, হানাদার বাহিনী যুবতী মেয়ে এবং যুবক ছেলেদেরকে দাস-দাসী বানিয়ে নিয়ে যায় এবং তাদের উপর অনেক জুলুম করা হয়।

সেই যুগে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম ছিল। বিজয়ী বাহিনী বিজিতদের ঘর-বাড়ী লুটতরাজ করত। মেয়েদের ইজ্জত-আবরু হরণ করত। ফলে মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেত। টলেডো বাসীদের জন্য এধরনের গুজব কোন আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল না। এধরনের কথাকে মানুষ সত্যই মনে করত। তাই টলেডো বাসীরাও শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করল। কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো শহর জনমানব শূন্য হয়ে পড়ল। সেনাবাহিনীর সদস্যরাই শুধু সেখানে রয়ে গেল। কিন্তু বীরত্ব ও সাহসিকতার দিক থেকে তারা ছিল একেবারেই মৃত।

সেনাবাহিনী ছাড়া শহরে আর যারা ছিল তারা সকলেই ছিল ইহুদি বা গোথ সম্প্রদায়ের লোক। তারা মুসলমানদের পক্ষে ছিল। মুসলমানদের ব্যাপারে উদ্ভট গুজব ছড়িয়ে তারাই মানুষের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করছিল।

***

টলেডো শহরে কয়েকটি গির্জা আছে। একটি গির্জা খুবই বড়। সেই গির্জায় অসংখ্য যাজিকা ও বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ আছে। পূর্বেও বলা হয়েছে, গির্জার পাদ্রিরা নিজেদেরকে খোদা প্রেরিত ফেরেশতা ও দুনিয়াত্যাগী বলে দাবি করত। বাস্তবে তারা ছিল ভোগ-বিলাসী ও প্রবৃত্তি-পূজারী। প্রত্যেক বাদশাহর কাছ থেকেই তারা বিশাল জায়গির গ্রহণ করত। জায়গিরের বিপুল আমদানি ছাড়াও গির্জার নামে তারা মানুষের উপর বিভিন্ন প্রকার চাঁদা ধার্য করে রেখেছিল। এভাবে তারা সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিল।

বর্তমান পরিস্থিতে সকল পাদ্রি বড় পাদ্রির নিকট গিয়ে বলল, ‘এত বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ সোনা-দানা, টাকা-পয়সা কোথায় লুকানো যায়?

‘কোথাও লুকানোর ব্যবস্থা তো অবশ্যই করতে হবে।’ বড় পাদ্রি বলল। ‘এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ তো আর সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সাথে নিয়ে গেলে তো আমাদের লোকেরাই তা লুট করে নিবে। সুতরাং সমস্ত স্বর্ণ-রোপা, মণি-মুক্তা, টাকা-পয়সা একত্রিত করে এখানে নিয়ে এসো। ভূ-গর্ভস্থ ঘরে গর্ত করে সবকিছু সেখানে পুঁতে রাখা যাবে।’

রাতের অন্ধকারে বেশ বড় বড় কয়েকটি বাক্স প্রধান গির্জার ভূ-গর্ভস্থ ঘরে নিয়ে আসা হল। ভূ-গর্ভস্থ ঘরের মেজে খুঁড়ে সমস্ত বাক্স মাটি চাপা দিয়ে রাখা হল। এর পাশেই আরেকটি গর্ত করা হল। গর্তটি প্রায় ছয় ফুট লম্বা এবং তিন ফুট চওড়া ও গভীর। এই গর্তে কোন কিছু রাখা হল না।

গর্ত খননকারী ছিল তিনজন। তাদের কাজ প্রায় শেষে হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় বড় পাদ্রির ইশারায় আরও তিনজন ব্যক্তি নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে সেখানে প্রবেশ করল। গর্তধননকারীরা উপরে উঠে এলে বড় পাদ্রি তাদেরকে বলল,

‘গর্ত থেকে যে মাটি উঠানো হয়েছে, তা বাইরে ফেলে দিয়ে এসো। পাদ্রির নির্দেশ অনুযায়ী তারা মাটি উঠানোর জন্য মাথা ঝুঁকানোর সাথে সাথে তলোয়ারধারীরা ক্ষিপ্রগতিতে তলোয়ার বের করে গর্ত খননকারীদের গর্দান উড়িয়ে দিল। তারপর সেই খালি গর্তে তাদের লাশ নিক্ষেপ করা হল।

‘মাটি দিয়ে গর্ত ভরে দাও।’ বড় পাদ্রি বলল। এখন এই সম্পদ সম্পর্কে আর কেউ জানতে পারবে না।’

গর্ত খননকারীদের হত্যাকারী সকলেই ছিল পাদ্রি।

ভূ-গর্ভস্থ ঘরের দরজা সাধারণ ঘরের দরজার মতো ছিল না। বরং তা ঢাকনার মতো ছিল। ভূ-গর্ভস্থ ঘরের উপর ঢাকনা ফেলে দিলে তা ফ্লোরের সাথে মিশে যেত। তার উপর কিছু আসবাব-পত্র রেখে দিলে কারো বুঝার উপায় থাকত না যে, এই ফ্লোরের নিচে একটি ভূ-গর্ভস্থ কক্ষ আছে।

বড় পাদ্রি ধন-সম্পদের বাক্স এবং তিনটি লাশ দাফন করে ভূ-গর্ভস্থ ঘরের ঢাকনা বন্ধ করে দিল। তারপর সে অপর তিন পাদ্রিকে সাথে নিয়ে ঢাকনার উপর গির্জার কালিন বিছিয়ে দিল। যে জায়গাটিতে ভূ-গর্ভস্থ ঘরের দরজা ছিল ঠিক সে বরাবর একটা টেবিল রেখে তার উপর ক্রুশবিদ্ধ হযরত ঈসা আ.-এর মূর্তি রেখে দিল। এই ক্রুশ আর টেবিল ছিল কাঠের তৈরী।

 ‘এখন আমাদের এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। বড় পাদ্রি বসল। নতুন বিজয়ীদের আসতে দাও। তারপর পরিস্থিতি শান্ত হলে আমরা ফিরে আসব। আমাদের সম্পদ হেফাজতে থাকবে। আর শোন, একজন যাজিকাও যেন এখানে না থাকে, তা হলে মুসলিম বাহিনী তাদেরকে দাসী বানিয়ে নিবে।

***

অনেকক্ষণ হয় সূর্য অস্ত গেছে। তারিক বিন যিয়াদ টলেডো থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে অবস্থান করছিলেন। তিনি মুগীস আর-রুমী ও যায়েদ বিন সাদা সম্পর্কে কোন সংবাদই পাচ্ছিলেন না।

টলোডো থেকে তের-চৌদ্দ মাইল উত্তরে প্রায় আড়াইশ নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরের একটি কাফেলা অবস্থান করছিল। তবে এ কাফেলা কোন সেনাবাহিনীর কাফেলা ছিল না। বড় পাদ্রি আরও ছয়-সাতজন পাদ্রিসহ সে কাফেলার সাথে ছিল। কাফেলা খোলা আকাশের নিচে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিল। তাদের বাহনগুলো পাশেই বাঁধা ছিল।

রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর। কাফেলার অদূরে একটি গাছের আড়ালে আইনামেরী নামের এক যুবতী মেয়ে নিস্পলক নেত্রে কাফেলার দিকে তাকিয়ে আছে। সে একজন যাজিকা। তের-চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে গির্জায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন তার বয়স বাইশ-তেইশ বছর। বাহ্যিকভাবে তাকে ধর্মযাজিকা বানানো হয়ে ছিল, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাকে পাদ্রিরা রক্ষিতা বানিয়ে রেখেছিল। আর এটা কোন গোপন বিষয় ছিল না। পাদ্রিরা এসকল যাকিজাদেরকে রক্ষিতা বানানোকে নিজেদের অধিকার মনে করত, যে অধিকার তারা গির্জার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হয়েছিল।

ঘুমন্ত কাফেলার থেকে একটি ছায়ামূর্তি ধীরেধীরে আইনামেরির কাছে এসে দাঁড়াল।

‘সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছি। আইনামেরী বলল। “জিম! তুমি এভাবে কেন এলে? ঘোড়া কোথায়? এখনই ঘোড় নিয়ে এসো, এখান থেকে আমাদের ফিরে যেতে হবে।’

‘সব কিছু খুলে বল মেরী। জিম বলল। “দিনের বেলা তুমি তো শুধু বলেছিলে, গভীর রাতে দুটি ঘোড়া নিয়ে এসে এই গাছের নিচে অপেক্ষা করতে।

জিমের পুরো নাম হল, জিম সেবরিন। মেরী যে গির্জার যাজিকা ছিল জিম ছিল সেখানের কর্মচারী। জিমের বয়স ছিল পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর। আইনামেরী তাকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। জিম সেবরিন প্রায় ছয় মাস পূর্বে এই গির্জার কর্মচারী হয়ে এসেছিল। সে গির্জার ভিতরেই থাকত। মেরী তাকে দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। এই গির্জায় আরও চার-পাঁচজন যাজিকা ছিল, কিন্তু মেরীর বদকিসমত হল, সে ছিল সকলের চেয়ে রূপসী ও লাবণ্যময়ী। বড় পাদ্রি তাকে রক্ষিতা বানিয়ে রেখেছিল।

জিমের সাথে যখন মেরীর প্রথমবার সাক্ষাৎ হয় তখনই মেরী অনুভব করতে পেরেছিল যে, তার হৃদয়ে যেমন জিমের জন্য ভালোবাসা আসন গেড়ে বসেছে; ঠিক তেমনি জিমও তাকে জান-প্রাণ দিয়ে কামনা করে। প্রথম সাক্ষাতেই আইনামেরী জিমকে তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দেখিয়েছিল। সে জিমকে বলেছিল, কীভাবে তাকে তের-চৌদ্দ বছর বয়সে জোর করে গির্জায় নিয়ে আসা হয়েছিল এবং তাকে বুঝানো হয়েছিল যে, খোদা তাকে তার বন্দেগীর জন্য নির্বাচন করেছেন, সুতরাং দুনিয়ার সাথে সকল সম্পর্কই তার শেষ হয়ে গেছে। সে জিমকে বলেছিল,

‘পাদ্রিরা আমার সাথে যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তা আমাকে ধর্ম-বিদ্বেষী করে তুলেছে। ঈসা মসীকে তো একবার শুলে চড়ান হয়েছিল, আর আমাকে প্রত্যেক রাতে শুলে চড়ানো হয়। ঈসা মসীর হাত-পায়ে কীল বিদ্ধ করা হয়েছিল, আর আমার হৃদয়ে, আমার অন্তরে কীল বিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতি রাতে, প্রতিটি মুহূর্তে আমি ধুকে ধুকে মরি। মরেও আবার বেঁচে থাকি। আমারও স্বপ্ন ছিল কারো স্ত্রী হওয়ার। আমি খোদার মহব্বত চাই না, আমি একজন প্রকৃত মানুষের ভালোবাসা চাই। কিন্তু কেউ কি আমাকে ভালোবাসবে? এখন আমি আমার নিজেকেই ঘৃণা করি। জিম! তুমিও হয়তো আমাকে ঘৃণা করবে।’

‘তোমার শরীরের প্রতি আমার সামান্যতম মোহও নেই, মেরী। জিম বলল। ‘আমি শুধু চাই, তুমি আমাকে হৃদয়-মন উজাড় করে ভালোবাসবে।’

প্রথম সাক্ষাতেই জিম আইনামেরীকে সেই প্রেম-ভালোবাসার আশ্বাস দিয়েছিল, যার সম্পর্ক হৃদয়ের সাথে শরীরের সাথে নয়।

এতদিন আইনামেরী যে ভালোবাসার জন্য কাতর ছিল, আজ সে তার সেই কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার সন্ধান পেল। তারা দুজনেই গির্জা থেকে পালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্ত গির্জা থেকে কোন যাজিকার বের হওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল। প্রতিটি গির্জার যাজিকারা কয়েদীর মতো বসবাস করত। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ এমন ব্যতিক্রমধর্মী হত যে, কোন যাজিকা পালিয়ে গেলেও সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারত না। তাছাড়া যাজিকাদের উপর সবসময় নজর রাখা হত।

জিম বহু দূরের বাসিন্দা। চাকরির সন্ধানে সে টলেডো এসেছিল। এখানে তার এমন কারো সাথে পরিচয় ছিল না, যার সাহায্যে সে আইনামেরীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারত। তার পরও সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, আইনামেরীকে সে এই জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করবে।

ছয় মাস যাবৎ তারা এভাবে চুপেচুপে মন নেওয়া-দেওয়া কলি। এই দীর্ঘ ছয় মাসে তাদের প্রেম-ভালোবাসা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যেন থেকে ফিরে আসা তাদের কারো পক্ষেই সব ছিল না। তাদের ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে, তারা একে অপরের জন্য অসি মুখে জীবন বিলিরে দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করত না।

তারপর যখন টলেডোতে মুসলমানদের আক্রমণের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল এবং লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে টলেডো থেকে পালাতে শুরু করল তখন জিম মেরীকে বলল,

‘মেরী! এখন সুযোগ এসেছে, শহরের ফটক সর্বদা খোলা থাকে। দলে দলে মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমরাও আমাদের পোশাক পালটিয়ে পালিয়ে যেতে পারি।’

‘বুড়ো পাদ্রি এখন আমার প্রতি খুব বেশি নজর রাখছে।’ মেরী বলল। আমি সামান্য এদিক-সেদিক হলে সে পাগলের মতো আমাকে তালাশ করতে থাকে।

‘পাদ্রির কামরায় অন্য কাউকে পাঠিয়ে দাও। জিম বলল।

‘আমাকে ছাড়া সে অন্য কোন মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না।’ মেরী বলল। আমাকে ছাড়া তার এমন অবস্থা হয়, যেমন তোমাকে ছাড়া আমার, আর আমাকে ছাড়া তোমার।’; ::

‘তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমি তাকে হত্যা করতে পারি। জিম বলল। তারপর আমরা দুজন নিরাপদে শহর থেকে বের হয়ে যাব।’

‘না, জিমা না, তুমি ধরা পড়ে যাবে।’ মেরী বলল। ‘আমি নিজের জন্য কোন চিন্তা করি না, আমি তো মরতেই চাই। কিন্তু তোমাকে আমি এভাবে মরতে দিতে পারি না।’

এভাবে বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। জিম বারবার কেবল পাদ্রিকে হত্যা করার কথাই বলত। আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডোতে কোন বাদশাহ ছিল না। নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজকর্ম সম্পাদন করার মতো কেউ ছিল না। সাত সকালে শহরের ফটক খোলে দেওয়া হতোঁ, আর গভীর রাত পর্যন্ত ফটক ঐভাবে খোলাই থাকত।

টলেডোর এ অবস্থা সম্পর্কে তারিক বিন যিয়াদ অবগত ছিলেন না। জুলিয়ান ও আউপাস তাকে বলেছিল, টলেডোতে প্রবেশ করা খুবই কঠিন হবে। রডারিকের উত্তরসুরীরা জীবনবাজি রেখে শহর হেফাজতের জন্য লড়াই করবে। দীর্ঘ দিন দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকতে হবে।

***

দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আজ মেরীর স্বপ্ন পূরণের সময় উপস্থিত হয়েছে। মেরী গাছের নিচে দাঁড়িয়ে জিমের অপেক্ষা করছিল। জিম পৌঁছতেই মেরী তাকে লক্ষ্য করে বলল,

দিনের বেলা আমি তোমাকে সব কথা বলতে পারিনি। বড় পাদ্রি প্রধান গির্জায় ধন-সম্পদ শুকিয়ে এসেছে। সে আমাকে এত বেশি মহব্বত করে যে, আমাকে বলেছে, প্রধান গির্জার ভূ-গর্ভস্থ ঘরে টলেডোর সকল গির্জার ধন-সম্পদ লুকিয়ে রাখা হয়েছে।’

‘সেই সম্পদের সাথে আমাদের কি সম্পর্ক? জিম বলল।

সে সম্পদ আমাদের হস্তগত করতে হবে।’ মেরী বলল।

 ‘তোমার মাথা ঠিক নেই।’ জিম বলল। আমরা সম্পদ নিয়ে কোথায় যাব?

‘সমস্ত সম্পদ আমরা উঠাব না, জিম!’ মেরী বলল। তুমি আমার সাথে ফিরে চল, আমাদের যতটুকু প্রয়োজন আমরা ততটুকুই নেব। তার পর আমরা শহরেই থাকব। গির্জায় থাকব না। আমাদের বাড়ী খালী পড়ে আছে। বাড়ীর সকলে অনেক আগেই চলে গেছে।

‘মুসলিম বাহিনী এসে পড়লে কি করবে?’ জিম বলল।

‘আমরা উভয়ে মুসলমান হয়ে যাব।’ মেরী বলল। শুনেছি, যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম বাহিনী তাদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করে।

জিম তো কোন ফেরেশতা ছিল না যে, সম্পদের লালসা তার মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না। বিপুল সম্পদ ছাড়াও মেরীর প্রেম তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মেরী তাকে এমন এক সুখের সন্ধান দিয়েছিল যে কারণে সে টলেডো ফিরে যেতে প্রস্তুত হয়ে গেল।

কাফেলা গভীর ন্দ্রিীয় নিমজ্জিত। জিম ধীরপদে তার ঘোড়র নিকট গেল এবং বাঁধন খোলে ঘোড়র উপর জিন লাগিয়ে মেরীর কাছে চলে এলো। মেরী ঘোড়ায় উঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে জিম কুঁকে তার হাত ধরে টেনে ঘোড়ায় উঠিয়ে নিল। তারপর সুতীব্র বেগে টলেডোর উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

ঘুমন্ত কাফেলার কেউ জানতে পারল না যে, একটি ঘোড়া দুজন সওয়ারীকে নিয়ে কাফেলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

***

রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটার সাথে সাথে কাফেলা রওনা হবার জন্য তৈরী হয়ে গেল। মেরী ও জিমকে দেখতে না পেয়ে বড় পাদ্রি হৈচৈ শুরু করে দিল। তার সঙ্গী পাদ্রিরা তাকে তিরস্কার করে বলল,

‘ঐ মেয়ে তোমার স্ত্রী নয়, সে তোমার মেয়ে বা বোনও নয়। সুতরাং সে চলে গেছে বলে এতো হৈচৈ করার কি আছে? সে যদি তার পছন্দের কারো সাথে চলে গিয়ে থাকে তাহলে তাকে চলে যেতে দাও। ভালোই হয়েছে, ওর মতো একটি রূপসী মেয়ে চলে গেছে। এমন অনিশ্চিত সফরে ওর মতো রূপসী মেয়ে থাকলে যে কোন ধরনের বিপদ হতে পারে। আমাদের কাফেলায় আরও অনেক মেয়ে আছে, তারাও যদি ভেগে যায় তাহলে মন্দ হয় না।‘

অন্যান্য পাদ্রিদের এসব কথা শুনে বড় পাদ্রি চুপ হয়ে গেল। কাফেলা রওনা হয়ে গেল। ঐতিহাসিকগণের মত অনুযায়ী এসকল পাদ্রিরা রোমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। রোমে রয়েছে বিশ্বের কেন্দ্রিয় গির্জা ও পোপদের হেড কোয়ার্টার ভ্যাটিক্যানসিটি।

কাফেলা যখন সামনের দিকে অগ্রসর হল, ঠিক সেই সময় মেরী ও জিম টলেডের প্রধান ফটক খোলর অপেক্ষা করছিল। রাতের অন্ধকার থাকতেই তারা তের-চৌদ্দ মাইলের মধ্যে দূরত্ব অতিক্রম করে শহর রক্ষাপ্রাচীরের নিকট এসে। পৌঁছল। ফটক খোলার সাথে সাথে তারা শহরে প্রবেশ করল।

মেরী জিমকে নিয়ে তার নিজ বাড়ীতে উঠল। তারা ঘরে প্রবেশ করে দেখল, ঘরের আসবাবপত্র, খাট-পালঙ্ক, বিছানাপত্র এমনভাবে রাখা আছে, যেন ঘরের লোকজন কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেছে। এখনই ফিরে আসবে।

সারাদিন উভয়ে ঘরের মধ্যেই কাটাল। লোকজন একে একে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। বাড়ী-ঘর লোকশূন্য হয়ে যাচ্ছিল। কারো খালি ঘরে যদি কেউ প্রবেশ করত তাহলে বলার কেউ ছিল না। জিম ও আইনামেরীর এমন কোন আশঙ্কা ছিল যে, কেউ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে, এই ঘরে তোমরা কি করছ?

তখনও রাতের অর্ধ প্রহর শেষ হয়নি। মেরী ও জিম ঘর থেকে বের হয়ে প্রধান গির্জার দিকে চলতে শুরু করল। জিমের হাতে ছিল ঘোড়ার লাগাম। তারা। উভয়ে পায়ে হেঁটে পথ চলছিল। তাদের ধারণা ছিল, গির্জার গেইটে তালা লাগান থাকবে। কিন্তু তারা গেইট উন্মুক্ত দেখতে পেল। গির্জার ভিতর ছিল ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। এর চেয়ে বেশি অন্ধকার হলেও জিম আর মেরীর জন্য গির্জার আনাচে-কানাচে পৌঁছা অসম্ভব ছিল না। কারণ, গির্জার প্রতিটি ইট-পাথর সম্পর্কে তারা অবগত।

তাদের হাতে একটি মশাল। ভূ-গর্ভস্থ ঘরে মশালের প্রয়োজন হতে পারে ভেবে তারা তা সাথে করে নিয়ে এসেছে। তারা উভয়ে গির্জায় প্রবেশ করল। তারা সে স্থানে গিয়ে পৌঁছল যেখানে ভূ-গর্ভস্থ ঘরের ঢাকনা ছিল। জিম আইনামেরীর ঘর থেকে একটি কোদাল নিয়ে এসেছিল। জিমের সাথে ছিল একটি তলোয়ার ও একটি খর। আর মেরীর সাথে ছিল একটি খঞ্জর।

মেরী ও জিম ভূগর্ভস্থ ঘরের ঢাকনার উপর এসে দাঁড়াল। জিম সতর্কতার সাথে মশাল জ্বালাচ্ছিল, আর মেরী দ্রুতহাতে ঢাকনার উপর বিছানো কালিনের উপর থেকে সবকিছু সরিয়ে ফেলল। মেরী জানত, কীভাবে ভূ-গর্ভস্থ ঘরে প্রবেশ করতে হয়। জিম ও মেরী উভয়ে মিলে ঢাকনা উঠিয়ে ভূ-গর্ভস্থ ঘরে প্রবেশ করল।

ভূ-গর্ভস্থ ঘরে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে মাটি এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এক স্থানে পাকারে মাটি রাখাছিল। মেরী এক দিকে ইঙ্গিত করে বলল,

 ‘এখানেই গুপ্তধন আছে। জিম! আমরা অনেক সহজেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছতে পেরেছি।’

‘কিন্তু আমরা তো খুব বেশি সম্পদ নিতে পারব না।’ জিম বলল।

‘যা পারব তাই নিয়ে যাব। মেরী বলল।

‘আমি এখানে কিছুই রেখে যাব না।’ জিম খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল। ‘একবারে যা পারব, তা নিয়ে তোমাদের ঘরে রেখে আবার আসব। তারপর আবার আসব। এভাবে কয়েকবারে সমস্ত সম্পদ নিয়ে গিয়ে তোমাদের ঘরে পুঁতে রাখব। মুসলিম বাহিনী যদি এসে পরে তাহলে আমরা এই সম্পদ বাঁচানোর জন্য মুসলমান হয়ে যাব। তখন মুসলিম বাহিনী আমাদের ঘর লুণ্ঠন করবে না। বাড়ীতে আমরা খ্রিস্টধর্ম পালন করব এবং নিজেদের ইবাদত করব।’

‘ধর্মের প্রতি আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই।’ মেরী বলল। মুসলমান হোক বা খ্রিস্টান–সকলেই আমার কাছে সমান।

***

মাটি খোঁড়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। আলগা মাটিগুলো সরিয়ে ফেললেই চলত। জিম অতি দ্রুত মাটি সরাতে লাগল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে একটি গর্ত থেকে প্রায় তিন ভাগ মাটি সরিয়ে ফেলল। মাটি সরাতে সরাতে সে হঠাৎ লাফিয়ে পিছু হটে এলো। মনে হল, কোন ফনাতুলা সাপ তার উপর হামলা করেছে।

“কি হল? মেরী জিজ্ঞেস করল।

‘সামনে গিয়ে গুপ্তধন দেখে এসো।’ জিম বলল।

মেরী মশাল হাতে নিয়ে গর্তের কাছে গিয়ে চিৎকার করে উঠল। গর্তে তিনটি লাশ পড়ে ছিল। লাশ দেখে ভয় পাওয়ারই কথা। কিন্তু এই লাশগুলোর সাথে মাথা ছিল না। তিনটি মাথা প্রতিটি লাশের বুকের উপর রাখাছিল। এ দৃশ্য দেখে মেরী কাঁপতে কাঁপতে জিমকে জড়িয়ে ধরল।

 ‘লাশগুলোর রক্ত দেখছি এখনও শুকায়নি।’ জিম বলল। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণ আগে তাদেরকে হত্যা করে দাফন করা হয়েছে।

‘এদেরকে কেন হত্যা করা হয়েছে?’ মেরী জানতে চাইল।

এরা হয়তো জানত-এখানে গুপ্তধন আছে।’ জিম বলল। এরা মনে হয়, গুপ্তধন নেওয়ার জন্য এসেছিল। পাদ্রি নিশ্চয় এখানে প্রহরী রেখে গেছে। প্রহরীরাই এদেরকে হত্যা করেছে, কিংবা এরা বেশি সংখ্যক লোক এসেছিল গুপ্তধন নেওয়ার জন্য। অংশিদার কমানোর জন্য নিজেরাই নিজেদের তিনজন লোককে হত্যা করেছে।’

‘তাহলে তো গুপ্তধন আর নেই।’ মেরী বলল।

***

‘তুমি সরো।’ জিম বলল। আমি দ্বিতীয় গর্ত থেকে মাটি সরিয়ে দেখছি।’

মেরী দূরে গিয়ে দাঁড়াল। জিম দ্বিতীয় গর্তের মাটি সরাতে শুরু করল। জিমের পিঠ সিঁড়ির দিকে ছিল। সে দ্বিতীয় গর্ত থেকে মাত্র মাটি সরানো শুরু করেছে, এমন সময় সিঁড়ির দিক থেকে এক ব্যক্তি তলোয়ার হাতে নিয়ে দৌড়ে এসে জিমর উপর আক্রমণ করে বসল।

‘এ সম্পদ আমার।’ লোকটি জিমের পিঠে তলোয়ার সমূলে বিদ্ধ করে বলল। ‘এই সম্পদের কারণেই আমি একাকী এখানে রয়ে গেছি।’

তলোয়ারের আঘাতে জিম মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হামলাকারী মেরীর দিকে তাকাল। সে মেরীকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। মেরীর কাছেও খঞ্জর ছিল, কিন্তু সে খঞ্জর চালাতে পারত না। হামলাকারী মেরীর উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হতেই মেরী তার হাতের জ্বলন্ত মশাল হামলাকারীর মুখের উপর ছুঁড়ে মারল। মশালের আগুনে হামলাকারীর চেহারা ঝলসে গেল। হামলাকারী তলোয়ার ফেলে দিয়ে দু’হাতে চেহারা ধরে মাটিতে বসে পড়ল।

মেরী মশাল তুলে নিয়ে দ্বিতীয়বার তার চেহারার উপর ছুঁড়ে মারল। মশালের আগুন হামলাকারীর হাতে লাগলে সে হাত সরিয়ে নিল। ফলে চেহারা আরও ঝলসে গেল। হামলাকারীর পিছনে জিম মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল। হামলাকারী মশাল থেকে বাঁচার জন্য পিছনে সরে এলে জিমের শরীরের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে গেল। জিম মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল। তার কাছেই একটি কোদাল পড়ে ছিল। জিম কোদালটি উঠিয়ে শুয়ে থেকেই হামলাকারীর মাথা লক্ষ্য করে আঘাত করল। সাথে সাথে মেরী দৌড়ে এসে হামলাকারীর বুকে খর বসিয়ে দিল। তারপর খঞ্জর টেনে বের করে আবার আঘাত করল।

‘মেরী! জিম মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে বলল। দ্রুত এখান থেকে পালিয়ে যাও। তোমার ঘরে গিয়ে আত্মগোপন করে থাক।’

“না, জিম! আমি তোমাকে এখানে রেখে কোথাও যাব না। মেরী কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল।

মেরী জিমের কাছে গিয়ে তার মাথা কোলে তুলে নিতেই জিম শেষ নিঃশাস ত্যাগ করল। জিমের মাথা একদিকে হেলে পড়ল। হামলাকারীও মারা গেল।

মশাল মেজের উপর পড়ে জ্বলছিল। ভূ-গর্ভস্থ ঘরের দেয়াল ও ছাদে মশালের আলোতে ছায়া নড়াচড়া করছিল। মনে হচ্ছিল, ঐ মৃত ব্যক্তিদের প্রেতাত্মা সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গুপ্তধন অন্য গর্তে ছিল। গুপ্তধনের স্তূপের উপর দুটি লাশ পড়ে ছিল। তাদের শরীর থেকে তখনও রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।

আইনামেরী ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। মশালের আলোর রহস্যময় ছায়া তাকে আরও বেশি ভীত করে তুলল। হঠাৎ তার মনে হল, আরও কেউ এখানে চলে আসতে পারে। হয়তো গির্জাতেই কেউ আছে। সে মশাল সেখানে ফেলে রেখে ভূ-গর্ভস্থ ঘর হতে বের হয়ে উপরে উঠে এলো। ভূ-গর্ভস্থ ঘরের সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে সে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। সে যদি গির্জা সম্পর্কে অবগত না হত তাহলে সে এই অন্ধকারে দেয়াল, পিলার ও অন্যান্য বস্তুর সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেত। গির্জা হতে বের হওয়ার কোন রাস্তাও সে খুঁজে পেত না। ভয়ের কারণে তার পাও চলছিল না। গির্জা হতে বের হতেই তার ভয় করছিল।

আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডোর রাত নীরবে-নিবৃত্তে কেটে যাচ্ছিল। গোটা শহরে ভূতুরে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। শহরের অধিকাংশ বাড়ী মানবশূন্য হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থা একজন সুন্দরী যুবতী মেয়ের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ছিল। গির্জায় আত্মগোপন করে থাকাও সে নিজের জন্য নিরাপদ মনে করছিল না। সে সাহসে বুক বেঁধে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। তারপর ভয়ে-আতঙ্কে জড়সড় হয়ে দেওয়ালের আড়াল নিয়ে তার বাড়ীতে পৌঁছে গেল। বাড়ীতে পৌঁছে ভিতর থেকে সে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।

***

রাতের আধার কেটে যখন ভোরের আলো ফুটে উঠল তখন তারিক বিন যিয়াদ তার বাহিনীকে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। টলেডো পৌঁছার আগ পর্যন্ত তারিক বিন যিয়াদের বাহিনীর জন্য এটাই ছিল শেষ যাত্রা বিরতি। সফরও খুব দীর্ঘ ছিল। তারিক বিন যিয়াদ তার সকল সালারদেরকে নিয়ে টলেডোর মতো গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ সফলভাবে দখল করার জন্য মহড়ার ব্যবস্থা করলেন।

৭১২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৯৩ হিজরীর শেষ দিনগুলোর ঘটনা। আফ্রিকার সম্মানিত আমীর মুসা বিন নুসাইর ১৮ হাজার সিপাহীর এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আন্দালুসিয়ার দক্ষিণ সীমান্তবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে অবতরণ করেন।

অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ তো সবসময় মুসলমানদের দোষ খুঁজে বেড়ান, কিন্তু এক্ষেত্রে মুসলিম ঐতিহাসিকগণও লেখেছেন যে, মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে সাহায্য করার জন্য আন্দালুসিয়া পৌঁছেননি; বরং তিনি আন্দালুসিয়ার বিজয়-মুকুট অর্জন করতে চাচ্ছিলেন।

তারিক বিন যিয়াদকে সকলেই আন্দালুসিয়ার বিজেতা আখ্যায়িত করছিল। তার বিজয়ের বিভিন্ন সংবাদ খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেকের নিকট পৌঁছানো হচ্ছিল। খলীফার পক্ষ থেকে তারিক বিন যিয়াদের নিকট পয়গামও পাঠানো হত। এটা মুসা বিন নুসাইর পছন্দ করছিলেন না। আরব মুসলমানরা বার্বার মুসলমানদেরকে সেকেলে ও গোঁয়ার মনে করত। মুসা বিন নুসাইর এটা মেনে নিতে পারছিলেন না যে, তাঁর আযাদকৃত একজন গোলামকে আন্দালুসিয়ার বিজেতা বলা হবে।

কোন কোন ঐতিহাসিক লেখেছেন, সে সময় মুসা বিন নুসাইরের বয়স হয়েছিল আশি বছর। তাই তিনি পূর্ণ বিচক্ষণতার সাথে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে পারছিলেন না। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তিনি তাঁর অধীনস্থ উপদেষ্টাদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এসকল উপদেষ্টারা তাঁকে তাদের হাতের মুঠোয় ভরে নিয়েছিল। তারাই তাকে বুঝিয়ে ছিল যে, একজন গোলামকে আন্দালুসিয়ার মতো বিশাল সাম্রাজ্যের বিজেতা বলা মনিবের জন্য অপমানজনক।

এমন কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়, যদ্বারা মুসা বিন নুসাইরের মানসিকতা বুঝা যায়। তিনি যখন তারিক বিন যিয়াদকে আন্দালুসিয়ায় পাঠিয়েছিলেন তখন তার সাথে মাত্র সাত হাজার সৈন্য দিয়েছিলেন। সেই বাহিনীতে অশ্বারোহীর সংখ্যাছিল খুবই কম। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর যখন নিজে আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তখন তাঁর সাথে ছিল আঠার হাজার সিপাহী। তন্মধ্যে দশ হাজার অশ্বারোহী, আর আট হাজার পদাতিক। তিনি যদি তারিক বিন যিয়াদের প্রতি হিতাকাক্ষী হতেন তাহলে নিজে আন্দালুসিয়া না এসে এই আঠার হাজার সৈন্যের বাহিনীকে তারিক বিন যিয়াদের সাহয্যে পাঠিয়ে দিতেন।

দ্বিতীয়ত তিনি যখন আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন তখন তিনি তাঁর দুই পুত্র আবদুল্লাহ এবং মারওয়ানকে সালার বানিয়ে নিজের সাথে রাখেন। বড় ছেলে আবদুল আযিযকে আফ্রিকার আমীর নিযুক্ত করেন।

তৃতীয়ত তিনি কুরাইশের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেও সাথে নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আলী বিন আবিল হুমা ও হায়াত বিন তামিমী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার বাহিনীতে দুই-তিনজন বয়োবৃদ্ধ সাহাবায়ে কেরামও ছিলেন, যাদের শারীরিক অবস্থা লড়াই করার মতো ছিল না। এছাড়া তিনি কয়েকজন সাহাবায়ে কেরামের সন্তানকেও তার বাহিনীর সাথে নিয়ে যান। তার উদ্দেশ্য ছিল, বাবার সম্প্রদায়ের উপর আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা।

মুসা বিন নুসাইরের মনের কথা এভাবেই প্রকাশ হয়ে পড়েছিল যে, তিনি আঠার হাজার সৈন্য নিয়ে আন্দালুসিয়া গেছেন, কিন্তু তিনি তারিক বিন যিয়াদকে তাঁর আগমন সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ার কোন প্রয়োজনও মনে করেননি, বরং তিনি তারিক বিন যিয়াদকে এই নির্দেশ পাঠিয়ে ছিলেন যে, তারিক যেখানে আছে সেখানেই যেন অবস্থান করে; সামনে অগ্রসর না হয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা হয়, তাহলে স্পষ্টই বুঝে আসে যে, এই নির্দেশও ছিল ক্ষতিকর। কারণ, সেই পরিস্থিতিতে একমাত্র তারিক বিন যিয়াদই বুঝতে পারছিলেন, তাঁকে কী পদক্ষেপ নিতে হবে? তারিক তার সালারদের সাথে পরামর্শ করেই সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাদের একজনও তাঁকে এই রামর্শ দেয়নি যে, অগ্রযাত্রা বন্ধ করে এখানেই বসে থাকা উচিৎ।

মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে মাত্র সাত হাজার সৈন্য দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বাহিনীর সকলেই ছিল বার্বার। বাবার সম্প্রদায় যদিও লড়াকু ছিল, কিন্তু নিয়মিত যুদ্ধ করার নিয়ম-কানুন তাদের জানাছিল না। তাদের নিকট গুপ্তচর বৃত্তির কোন ব্যবস্থা ছিল না। অথচ একটি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তার গুপ্তচর ইউনিট। বার্বাররা শুধু লড়াই করতে জানত। কিন্তু মুসা বিন নুসাই যখন আন্দালুসিয়া যান তখন তার সাথে ছিল গুপ্তচর বাহিনীর শক্তিশালী ইউনিট। এই গুপ্তচর ইউনিটের কারণে পূর্বেই তিনি জানতে পারতেন, সামনের রণাঙ্গনে তাঁকে কী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং শত্রুপক্ষের শক্তি কতটুকু?

***

তারিক বিন যিয়াদ যেসব এলাকা জয় করে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন তার মাধ্যে প্রসিদ্ধ দুটি এলাকা হল মেডোনাসেডোনা ও কারমুনা। মুসা বিন নুসাইরের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক তাঁকে এই সংবাদ দিল যে, তারিক বিন যিয়াদ এই শহরগুলোর প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য খ্রিস্টানদের নিয়োগ দিয়েছিলেন।

তারিক বিন যিয়াদের এটাও একটা অপারগতা ছিল যে, তাঁর নিকট প্রশাসন চালানোর মতো কোন যোগ্য লোক ছিল না। তাই তিনি বাধ্য হয়ে খ্রিস্টান ও ইহুদি প্রশাসক নিযুক্ত করেন।

মুসা বিন নুসাইর জানতে পারলেন যে, এই শহর দুটিতে খ্রিস্টানরা বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অতিসত্বর তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করবে।

মুসা বিন নুসাইর হঠাৎ এই শহর দুটিতে প্রবেশ করে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমতা যেহেতু মুসলমানদের ছিল, তাই মুসলিম বাহিনীকে শহরে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করা হল না। মুসা বিন নুসাইর শহরগুলোর উপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে আরব প্রশাসক নিযুক্ত করলেন।

এই শহর দুটিতে মুসা বিন নুসাইরের কৃতিত্ব শুধু এতটুকু ছিল যে, শহর দুটিতে বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠার আগেই তিনি বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ নির্বাপিত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দামেস্কে খলীফার দরবারে এই সংবাদ পাঠানো হল যে, মুসা বিন নুসাইর ঐ শহর দুটি জয় করেছেন।

এরপর মুসা বিন নুসাইর যখন এ্যাশবেলিয়া শহরের দিকে অগ্রসর হন তখন তাঁর যুদ্ধ-পারঙ্গমতা ও নেতৃত্বের পরীক্ষা হয়। এ্যাশবেলিয়া আন্দালুসিয়ার একটি বড় শহর। তারিক বিন যিয়াদ এই শহর আক্রমণ করেননি। কারণ, তিনি সর্বপ্রথম আন্দালুসিয়ার প্রাণকেন্দ্র ও রাজধানী টলেডো দখল করতে চাচ্ছিলেন। তিনি মনে করতেন, রাজধানীতে বাদশাহর সিংহাসন এখন খালি পড়ে আছে। মূলত আন্দালুসিয়ায় এখন কারো বাদশাহী নেই। তাই টলেডো দখল করতে পারলে অন্যান্য এলাকা দখল করা সহজ হবে। তারিক বিন যিয়াদ কর্ডোভা ও গ্রানাডাকেও টলেডোর মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর মনে করতেন।

প্রফেসার ডোজি লেখেন, এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হস্তগত হয়ে গেলে অন্যসব এলাকার কোন গুরুত্ব থাকবে না। তখন সেসব এলাকার সৈন্যরা এমনিতেই হাতিয়ার সমর্পণ করবেন। এটাই ছিল তারিক বিন যিয়াদের সামরিক বিচক্ষণতা ও যুদ্ধজয়ের নিগুঢ় তথ্য। তিনি সর্বোচ্চ রণকৌশল প্রয়োগ করে অল্প সংখ্যক সৈন্যের মাধ্যমে বিশাল সাফল্য অর্জন করতে চাচ্ছিলেন।

মুসা বিন নুসাইর পূর্বেই তাঁর গুপ্তচর ইউনিটের সদস্যদেরকে এ্যাশবেলিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি মেডেনাসেডোনা ও কারমুনার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের থেকে এ্যাশবেলিয়ার যাবতীয় তত্ত্ব সংগ্রহ করেছিলেন। অবশেষে তিনি এ্যাশবেলিয়া অবরোধ করে বসেন। তার ধারণা ছিল, এই বিশাল বাহিনীর মাধ্যমে তিনি অতি সহজে এ্যাশবেলিয়া দখল করে নিতে পারবেন। কিন্তু সেখানকার সৈন্যবাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের পরিচয় দিল এবং এমন রণকৌশল অবলম্বন করল যে, মুসা বিন নুসাইর অল্প সময়ের মধ্যে বুঝতে পারলেন, এই দুর্গ জয় করা খুব একটা সহজ হবে না।

এ্যাশবেলিয়ার অধিবাসীরা এমন প্রতিরোধের ব্যবস্থা করল যে, সকাল বেলা তারা হঠাৎ করে দুর্গের দুটি ফটক খোলে দিত। তারপর বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় অশ্বারোহী বাহিনী দুর্গ থেকে বের হয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর অতর্কিতে হামলা করে বসত। তারা এক স্থানে জমে লড়াই করত না, বরং তলোয়ার ও বর্শা দ্বারা আঘাত হানতে হানতে ঘুরে দুর্গের ভিতর ঢুকে যেত। কখন কোন দিক থেকে তারা আক্রমণ করবে তা কিছুই বুঝা যেত না।

মুসা বিন নুসাইর এ অবস্থার মুকাবেলা করার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোন উপায়ই কাজে লাগল না। অবরোধ দীর্ঘায়িত হতে লাগল। এভাবে অবরোধ করে বসে থাকতে থাকতে এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল।

মুসা বিন নুসাইর ছিলেন অভিজ্ঞ সেনাপতি। তিনি জীবনে অনেক দুর্গ জয় করেছেন। যুদ্ধের ময়দানে নিজেও একজন সাধারণ সৈন্যের মতো লড়াই করতেন। কিন্তু এখন তিনি জীবনের শেষ বেলায় উপনীত হয়েছেন। তাঁর বার্ধক্যপীড়িত শরীরে আগের মতো সেই শক্তি ছিল না, যা তাকে দুর্গপ্রাচীরের উপর আরোহণ করতে সহায়তা করত। খ্রিস্টান বাহিনী একের পর এক তাঁর বাহিনীর ক্ষতি করছিল, কিন্তু তিনি তাদেরকে কোন কিছুই করতে পারছিলেন না। তাই তিনি গভীরভাবে চিন্তা করছিলেন, এখন কী করা যায়?

অবশেষে তাঁর দুই ছেলে আবদুল্লাহ ও মারওয়ান অত্যন্ত বীরত্ব প্রদর্শন করলেন। খ্রিস্টান বাহিনী যখন দুর্গের বাইরে এসে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করল তখন তারা দুজন তাদের অশ্বারোহী বাহিনীকে দ্রুত হাঁকিয়ে একেবারে দুর্গপ্রাচীরের কাছে নিয়ে গেলেন। এভাবে তারা খ্রিস্টান বাহিনীর দুর্গে ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিলেন। মুসলিম বাহিনীর জন্য ভয়ের কারণ ছিল, তাদের উপর দুর্গপ্রাচীর থেকে তীরন্দাজ বাহিনী তীর-বর্শার আক্রমণ করতে পারে। মুসলিম বাহিনী এই বিপদকে উপেক্ষা করে দুর্গের প্রাচীর ঘেষে অবস্থান গ্রহণ করে। তার পর খ্রিস্টান অশ্বারোহী বাহিনীকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে তাদেরকে খতম করে দেয়।

এ ধরনের যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করলে অনেক বেশি প্রাণহানীর সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এ ছাড়া বিকল্প কোন উপায়ও ছিল না। এমন বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে তিন-চারবার প্রতিরোধ গড়ে তুলার ফলে দুর্গের সৈন্যসংখ্যা অনেক কমে গেল। মুসা বিন নুসাইর এই সিন্ধান্তে অটল থাকলেন যে, যত বেশি রক্তের প্রয়োজনই হোক না কেন-এই শহর জয় করতেই হবে। অবশেষে দেড় মাস পর এ্যাশবেলিয়া মুসলিম বাহিনীর হাতে বিজিত হয়।

***

আন্দালুসিয়ার আরেকটি বড় শহর মেরিডা। কোন কোন ঐতিহাসিক লেখেছেন, টলেডোর চেয়েও মেরিডার গুরুত্ব ছিল বেশি। মুসা বিন নুসাইর এই শহরের দিকে রওনা হলেন।

তারিক বিন যিয়াদ টলেডোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এই যুদ্ধের ব্যাপারে তিনি এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে, ইতিপূর্বের কোন যুদ্ধের ব্যাপারে তিনি এতটা চিন্তিত ছিলেন না। টলেডোর প্রাকৃতিক ও সামরিক প্রতিরক্ষার যে বিবরণ তিনি শুনেছিলেন, তা তাকে পেরেশান করে তুলেছিল। তারিক বিন যিয়াদ তার সালারদের নিকট কয়েকবার মুসা বিন নুসাইরের ব্যাপারে অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করলেন। তিনি তাদেরকে বললেন :

‘মুসা বিন নুসাইর কোন নতুন সেনা-সাহায্য ও যুদ্ধরসদ পাঠাচ্ছেন না। অথচ যুদ্ধরসদ ও সেনা-সাহায্যের প্রয়োজন খুবই তীব্র। আমাদের সৌভাগ্য এই যে, কয়েক হাজার বার্বার মুসলমান স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছে। তা না-হলে এত কম সংখ্যক সৈন্যদল নিয়ে এই অল্প সময়ে এত বড় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হত না।

তারিক বিন যিয়াদ তো জানতেনই না যে, খোদ মুসা বিন নুসাইর দশ হাজার অশ্বারোহী ও আট হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে আন্দালুসিয়া প্রবেশ করেছেন।

টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত মজবুত–এটাই তারিক বিন যিয়াদ জানতেন, কিন্তু বর্তমানে টলেডোর অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না।

টলেডোর শাহীমহলে অন্য রকম এক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল। শাহীমহলে কোন বাদশাহ ছিল না। রডারিকের বেশ কয়েকজন সন্তান ছিল। তাদের মধ্যে একমাত্র রাচমাভই ছিল তার বৈধ সন্তান। তার বয়স ছিল আঠার-উনিশ। নিয়ম অনুযায়ী সেই ছিল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। কিন্তু এই বয়সেই সে অত্যন্ত বিলাসপ্রিয় হয়ে পড়েছিল। মা-বাবা তাকে রাজকর্মের প্রতি মনোযোগী করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের কোন চেষ্টাই সফল হয়নি।

রাচমান্ডের সবচেয়ে প্রিয় সখ ছিল শিকার করা, আর সুন্দরী রূপসী মেয়েদের সান্নিধ্য লাভ করা। সে কোন সুন্দরী যুবতী মেয়েকে দেখলেই তাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসত। তারপর কিছুদিন তাকে নিজের কাছে রেখে বিদায় করে দিত।

রডারিক ছিল আন্দালুসিয়ার শাহানশা। সে তার শাহীমহলে হেরেম বানিয়ে রেখেছিল। তার হেরেমে শুধু আন্দালুসিয়ার মেয়েরাই থাকত না; বরং আশ-পাশের রাজ্যের সুন্দরী মেয়েরাও সেখানে থাকত। এদের দুই-তিনজনকে সে এমনভাবে হেরেমে স্থান দিয়েছিল যে, মনে হত তারা তার বৈধ স্ত্রী। তার বৈধ স্ত্রী শুধু একজনই ছিল। আর সেই স্ত্রীর ঘরেই জন্ম নিয়েছিল তার বিলাসপ্রিয় ছেলে রাচমান্ড। এছাড়া অন্য রমণীদের ঘরে রডারিকের যে ছেলে-সন্তান হয়েছিল তারা সকলে অবৈধ হওয়ার কারণে তাদেরকে রাজপুত্র বলা হত না। হেরেমের অন্যান্য রমণীদেরকে কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পরই বের করে দেওয়া হত। তাদের জায়গায় নতুন রমণীদেরকে নিয়ে আসা হত। কিন্তু তাদের মধ্যে দুই-তিনজন রমণী রডারিকের প্রিয়ভাজন হয়ে গেয়েছিল। মধ্য বয়সেও তারা শাহীমহলেই অবস্থান করত। তাদের সন্তানরা যৌবনে পদার্পণ করেছিল। রডারিকের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত কে হবে, তা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। এ সময় রডারিকের উপপত্নিরাও তাদের ছেলেদেরকে আন্দালুসিয়ার বাদশাহ বানানোর জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করল। কিন্তু রডারিকের বৈধ সন্তান রামান্ডের বর্তমানে অন্য কেউ সিংহাসনে বসতে পারছিল না।

টলেডোতে সেনাবাহিনীর জেনারেল ছিল ইউগোবেলজি। সে রডারিকের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিল। সেনাবাহিনীর লোকেরা মনে করত যে, ইউগোবেলজি অত্যন্ত যোগ্য ও অভিজ্ঞ জেনারেল। তাই রডারিক তাকে টলেডোতেই রাখত।

কখনও কোন যুদ্ধে টলেডোর বাইরে পাঠাত না। প্রকৃত সত্য হল, সে ছিল রানীর একান্ত প্রিয় মানুষ। রডারিকের উপর রানীর প্রভাব ছিল খুব বেশি। রানীর কোন কথাই রডারিক অমান্য করতে পারত না। রানীর প্রতি রডারিকের এই আনুগত্যের প্রতিদানও রানী যথাযথভাবে আদায় করত। কোথাও কোন সুন্দরী-রূপসী মেয়ে পেলে রানী তাকে উপহারস্বরূপ রডারিকের নিকট পেশ করত।

***

রডারিকের ছেলে রাচমান্ড ঐ সকল যুবতী মেয়েদেরকে তার শয্যাসঙ্গী বানাত, যারা রডারিকের উপপত্নিদের গর্ভজাত ছিল। এসকল মেয়েদের মাধ্যে লিজা নামের একটি যুবতী মেয়ে ছিল। তার বয়স বাইশ কি তেইশ হবে। বারাগসান নামে তার একজন ভাইও ছিল। সে ছিল পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক। শাহীমহলে তার বেশ ভালো প্রভাব ছিল।

জেনারেল ইউগোবেলজিও রডারিকের মতোই বিলাসপ্রিয় ছিল। রডারিকের মৃত্যুর পর শাহীমহলে সেই ছিল অঘোষিত সম্রাট। তার নির্দেশই শাহীমহলে কার্যকর হত। সে লিজার প্রতি অনেকটা দুর্বল ছিল। রডারিকের মৃত্যুর পর সে লিজাকে কাছে পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু লিজা তাকে কোন পাত্তাই দিল না। অবশেষে জেনারেল লিজাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিল, কিন্তু লিজা তাতে সম্মত হল না। ফলে জেনারেল তাকে কঠিন ধমকি দিল। লিজাও জেনারেলকে পাল্টা ধমকি দিয়ে বলল, সে যদি তাকে আর কখনও বিরক্ত করতে চেষ্টা করে তাহলে সে রানীর কাছে সব বলে দেবে। লিজা হয়তো জানত যে, জেনারেল রানীকে খুব ভয় পায়। শাহীমহলে রানীর প্রভাব ছিল সবার উপর। রানীর অনুগ্রহে মহলে এই জেনারেলকে সবাই সমীহ করে চলত।

তারিক বিন যিয়াদ যখন টলেডোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন এক রাতে লিজা জেনারেল ইউগোবেলজির ঘরে এসে উপস্থিত হল।

‘তুমি? কেমন আছো?’ জেনারেল ইউগোবেলজি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

আপনার কাছেই এসেছি। লিজা বলল। আপনি এত আশ্চর্য হচ্ছেন কেন?

 ‘তোমাকে এখানে আসতে কেউ দেখেনি তো?’ জেনারেল জিজ্ঞেস করলা।

 “না, কেউ দেখেনি। লিজা বলল।

লিজা জানত না যে, এক ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করছে এবং তার পিছু নিয়ে এখানে এসেছে। সে হল, রাচমান্ড।

‘আমি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও বেকুফ নই।’ জেনারেল বলল। তোমার চেহারা ও তোমার অঙ্গভঙ্গি বলে দিচ্ছে, তুমি অন্য কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছ, তোমার সে উদ্দেশ্য কি বল?

 ‘আমি অল্প বয়সী ও অনভিজ্ঞ। লিজা বলল। আমার অভিজ্ঞতা নেই কাউকে আয়ত্তে আনার জন্য কীভাবে কথা বলতে হয়। এ জন্য আমি খোলাখুলি কথা বলছি, আপনি আমাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আমার স্থলে যদি আপনি হতেন তাহলে আপনিও তাই করতেন। আমার ও আপনার মাঝে বয়সের বিস্তর পার্থক্য। এখন আমি নিজেকে আপনার কাছে সমর্পণ করতে চাই। আপনি চাইলে আমাকে বিয়ে করে স্ত্রী হিসেবে রাখতে পারেন, কিংবা উপপত্নি হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।

‘তুমি কি জন্য এসেছ, তা আগে বল।’ ইউগোবেলজি বলল।

 ‘আপনি জানেন, বারগাসান আমার ভাই।’ লিজা বলল। আপনি এও জানেন যে, আমরা দুই ভাই-বোন শাহানশা রডারিকের সন্তান। আপনি কি মনে করেন না যে, আমার ভাইও সিংহাসনের হকদার?’

‘কিন্তু বারগাসান তো বাদশাহর বৈধ সন্তান নয়। ইউগোবেলজি বলল। ‘ধর্মও তাকে রডারিকের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না। তোমার এ অভিলাস ছোট বাচ্চাদের মতো। এ আশা তুমি পরিত্যাগ কর।’

জেনারেল ইউগোবেলজি শরাব পান করছিল। লিজা তার কোলে এসে বসে বাচ্চাদের মতো তাকে আদর করতে লাগল। শরাব ও সুন্দরী মেয়ের স্পর্শ বৃদ্ধ জেনারেলের মনে নতুন যৌবনের স্পন্দন এনে দিল। সে অবিবেচকের মতো বলতে শুরু করল,

‘তুমিই বল, আমি কীভাবে তোমার ভাইকে সিংহাসনে সমাসীন করতে পারি?

‘রাচমান্ডকে হত্যা করে ফেলুন। লিজা বলল। “রাজ মুকুট ও রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তো একমাত্র সেই। ঘোষণা হোক বা না হোক; বাদশাহ সেই। সেই যখন মারা যাবে তখন আপনি বারগাসানকে বাদশাহ ঘোষণা করতে পারবেন।’

‘তুমি শুধু নিজের ভাইয়ের মাথায় আন্দালুসিয়ার রাজমুকুট রাখার জন্যই কি এক মায়ের একমাত্র সন্তানকে হত্যা করতে চাও? বৃদ্ধ জেনারেল শরাবের নেশায় টলতে টলতে বলল।

‘শুধু এজন্যই নয়।’ লিজা বলল। আমি শাহজাদা রাচমান্ডকে হত্যা করতে চাই, কারণ তার দ্বারা রাজ্যের অনেক বড় লোকসান হবে। আপনি অবশ্যই দেখছেন, অর্ধেক রাজত্ব হাতছাড়া হয়ে গেছে। হামলাকারী বাহিনী তুফানের মতো ধেয়ে আসছে। শাহজাদার বাবা মারা গেছে। কিন্তু সে পূর্বের মতোই ভোগ-বিলাসে ডুবে আছে। গত রাতে সে আমাকে জোর করে তার বাগানবাড়ী নিয়ে যায়। আমি নিজেকে তার হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি। যদি সম্ভব হত তাহলে আমি নিজ হাতে তাকে বিষ খাইয়ে দিতাম। আমি অনেকবার বলেছি, দেখ আমি তোমার বাবার মেয়ে, তোমার বোন। তবুও সে আমাকে রেহায় দেইনি। তার পরও কি আপনি মনে করেন, তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার আছে?

 ‘হা মনে করি।’ ইউগোবেলজি বলল। তাকে আমি হত্যা করতে পারব না। আর অন্য কাউকে দিয়েও তাকে হত্যা করানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

‘আপনি কি রানীকে ভয় করেন?’ লিজা বলল।

 ‘না।’ ইউগোবেলজি বলল। কোন বাবার পক্ষে নিজের সন্তানকে হত্যা করা সম্ভব নয়। রাচমান্ড আমার ছেলে, রডারিকের ছেলে নয়। রডারিকের থেকে রানীর কোন সন্তান হয়নি।’

লিজার জন্য এটা কোন আশ্চর্যের কথা ছিল না। শাহীমহলে এমনটিই হতো। কে কার সন্তান? এ প্রশ্নের উত্তর কেবল সন্তানের মা-ই দিতে পারতো।

একজন জার্মান ঐতিহাসিক আগস্ট মেবিল লেখেন, রডারিক একজন যোদ্ধ ছিল ঠিকই; কিন্তু সে তার প্রজা সাধারণকে ক্ষুধা ও দারিদ্রের মাঝে রেখে নিজে ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকত। কোন সেনাবাহিনীই এমন বাদশাহর মঙ্গল কামনা করে না, যে বাদশাহ তার প্রজা ও অধীনস্থদের মঙ্গল কামনা করে না। রডারিক যে এত অল্প সংখ্যক বাহিনীর হাতে পরাজয় বরণ করেছিল, তার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এটাই।

রডারিকের আপন বিবিও তাকে বিশ্বাস করত না। রডারিক যখন মারা যায় তখন জেনারেল ইউগোবেলজি তার বিবির সামনে বসে শরাব পান করছিল।

লিজা জেনারেল ইউগোবেলজিকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি মুসলমানদের হাত থেকে এই শহরকে রক্ষা করতে পারবেন?

জেনারেল জবাব দিতে যাচ্ছিল এমন সময় দরজা খোলে এক নওজোয়ান প্রবেশ করল।

‘হেলুলো রাচমান্ড!’ জেনারেল আদর করে রাচমাভকে ডাকল। এসো, এসো, বসো।’

রাচমান্ড লিজাকে এখানে আসতে দেখেই তার পিছু নিয়েছিল। এতক্ষণ সে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে লিজা ও জেনারেল ইউগোবেলজির কথাবার্তা শুনছিল। রাচমান্ড নিজেকে রডারিকের একমাত্র সন্তান মনে করত।

‘আমার বাবা তুমি?’ রাচমান্ড জেনারেলকে লক্ষ্য করে বলল। অথচ আমি নিজেকে বাদশাহর ছেলে মনে করতাম।

এ কথা বলেই সে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে বর বের করল। ইউগোবেলজি শরাবের নেশায় উন্মাদ হয়েছিল। কোন কিছু বুঝার আগেই রাচমান্ড তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দিল। তারপর খঞ্জর টেনে বের করে দ্বিতীয়বার একই জায়গায় খঞ্জরের আঘাত হানল। বৃদ্ধ জেনারেল তৎক্ষণাৎ মুখ থুবরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

লিজা চিৎকার করে পালাতে চাইল, কিন্তু রাচমান্ড তাকে ধরে তার বুকেও পর বসিয়ে দিয়ে চিরতরে খতম করে দিল।

তারিক বিন যিয়াদ তার বাহিনী নিয়ে টাইগিস নদীর তীরে পৌঁছে গেলেন। তাঁর ধারণা ছিল, পুলের ঐ পাড়ে টলেডোর সেনাবাহিনী উপস্থিত থাকবে। তারা মুসলিম বাহিনীকে পুল পার হতে দেবে না। ফলে নদীর তীরেই প্রচণ্ড লড়াই হবে, কিন্তু তারিক বিন যিয়াদ নদীর তীরে কাউকে দেখতে পেলেন না।

‘এত বড় ধোকা ইতিপূর্বে আর কখনও দেখিনি।’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। টলেডোর বাহিনী আমাদেরকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।

‘হ্যাঁ, বিন যিয়াদ! সালার আবু যুর’আ তুরাইফ বললেন, এটা ধোকা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। এই নদী এই শহরের চারদিক ঘিরে প্রবাহিত হয়। আমরা সামনে অগ্রসর হলে নদীর বেষ্টনীতে আটকা পড়ব। তখন অপর দিক থেকে শহরের সৈন্যবাহিনী এসে অতর্কিতে আমাদের উপর আক্রমণ করে বসবে। তখন এখান থেকে বের হওয়াই আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।

কিন্তু এখান থেকে তো ফিরেও যাওয়া যাবে না। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমরা সামনে অগ্রসর হব।’

তারিক বিন যিয়াদ তার বাহিনীকে যেভাবে পুল পার করে ওপারে নিয়ে গিয়েছিলেন ইতিহাসে তার বর্ণনা এভাবে এসেছে। তিনি প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনীকে পাঠিয়েছিলেন। তারপর পদাতিক বাহিনীকে। তারিক বিন যিয়াদের নির্দেশ অনুযায়ী অশ্বারোহী বাহিনী পদাতিক বাহিনীকে চুতর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। আক্রমণ হলে সর্বপ্রথম অশ্বারোহী বাহিনী আক্রমণ প্রতিহত করবে। তীরন্দাজ বাহিনীকে ডানে-বায়ে ও পিছনে সদা সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছিল। অতর্কিতে হামলা হলে হামলাকারী বাহিনীকে দ্রুত তীর নিক্ষেপ করে প্রতিহত করার দায়িত্ব ছিল তাদের উপর।

যতটা সতর্কতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল তারিক বিন যিয়াদ তার বাহিনীকে পুল পার করার ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই সতর্কতা অবলম্বন করলেন। তারপর কয়েকজন অশ্বারোহীকে দুর্গের আশপাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন।

শহরে রব পড়ে গেল, ‘ওরা এসে গেছে। এ আওয়াজ দ্রুত সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। শহরের লোক সংখ্যায় খুবই কম ছিল। যারা ছিল তাদের অধিকাংশই ছিল গোথ ও ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক।

তারিক বিন যিয়াদের পাঠানো অশ্বারোহী দল শহরের চতুর্দিকে চক্কর লাগিয়ে ফিরে এলো। তারা এসে রিপোর্ট দিল, দুর্গের আশপাশে কোথাও কোন সিপাহী নেই। তারিক বিন যিয়াদ দূর থেকেই দেখেছিলেন যে, দুর্গ রক্ষাপ্রাচীরের উপর কোন সিপাহী নেই। তিনি মনে করলেন, আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা এবং অপেক্ষা করা প্রয়োজন। তিনি তার অধীনস্থ জেনারেল এবং জুলিয়ান ও আউপাসকে পরামর্শের জন্য আহ্বান করলেন। তিনি ফয়সালা করে নিয়েছিলেন যে, শহর অবরোধ করবেন এবং দেখবেন, টলেডোর সিপাহীরা কী করে? তারিক বিন যিয়াদের উদ্দেশ্য ছিল অবরোধ দীর্ঘায়িত করা।

অশ্বারোহী দল ফিরে এলে তাদের কমান্ডার বলল, ‘আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আমরা দেখলাম, শহরের দরজা খোলা। লোকজন সে দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে দেখে কয়েকজন লোক শহরের ভিতরে চলে গেল, আর কয়েকজন ভেগে গেল।

তারিক বিন যিয়াদ তার বাহিনীর সালারদের সাথে এ বিষয়ে শলাপরামর্শ করছিলেন, ইতিমধ্যে একজন সিপাহী উচ্চ আওয়াজে ঘোষণা করল, “ঐ দেখ, শহরের সদর দরজা খোলে দেওয়া হয়েছে।’

সকলেই সেদিকে তাকাল। তারা দেখতে পেল, পাঁচ-ছয়জন সম্রাপ্ত ব্যক্তি ঘোড়ায় আরোহণ করে দুর্গ থেকে বের হয়ে আসছে। তারা সেনাবাহিনীর লোক ছিল না। তারা মুসলিম বাহিনীর দিকেই এগিয়ে আসছিল।

তারিক বিন যিয়াদ তাঁর সালারদের সাথে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। শহর থেকে যারা বের হয়েছিল তারা তারিক বিন যিয়াদের সামনে এসে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল।

‘আমরা সন্ধি ও দোস্তির পয়গাম নিয়ে এসেছি।’ শহর থেকে আগত লোকদের একজন বলল। আপনারা আমাদের সাথে আসুন এবং শহরের দায়িত্ব গ্রহণ করুন।’

জুলিয়ান ও আউপাস তাদেরকে চিনতে পারল। তাদের দু’জন ইহুদি আর বাকীরা হল গোথ সম্প্রদায়ের লোক। তারা সকলে ঘোড়া থেকে নেমে জুলিয়ান ও আউপাসকে জড়িয়ে ধরল। তারা তারিকের সাথেও করমর্দন করল।

 ‘তারিক বিন যিয়াদআপনি মহান। আগত লোকদের প্রধান বলল। আজ থেকে আন্দালুসিয়া আপনার।

 ‘আমার নয়। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। বরং এটা আল্লাহর সেই রাসূলের মুলুক, যিনি আমাকে বিজয়ের সু-সংবাদ প্রদান করেছিলেন। ইসলামে কেউ বাদশাহ হয় না। বাদশাহী একমাত্র আল্লাহর। তাঁর বাদশাহীতে সকল মানুষের মর্যাদা ও অধিকার সমান।

‘আমরা কি এ আশা করতে পারি যে, আমরা আমাদের অধিকার পূর্ণরূপে পাব? গোথ সম্প্রদায়ের একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি বলল।

‘যে অধিকার আপনারা পাবেন, আপনাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তা স্মরণ রাখবে।’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন।

পরবর্তীতে তারিক বিন যিয়াদের এই প্রতিশ্রুতি পূর্ণরূপে আদায় করা হয়েছিল। অর্টিজা এবং তার ভাই আউপাসের সন্তানদেরকে বিপুল পরিমাণ জায়গির প্রদান করা হয়েছিল। এ সমস্ত জায়গির বংশপরম্পরায় তারা ভোগ করেছে।

‘আপনারা কেন এসেছেন?’ তারিক বিন যিয়াদ আগত লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। শহরে কি কোন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা বা শাহীখান্দানের দায়িত্বশীল কোন ব্যক্তি নেই?

‘শহর তো একেবারেই খালি। আগত লোকেরা বলল। সকল সিপাহী শহর থেকে বের হয়ে গেছে। ইউগোবেলজি নামে একজন জেনারেল ছিল। তাকে রডারিকের ছেলে হত্যা করে ফেলেছে। শাহীমহলে আপনাকে ইস্তেকবাল জানান হবে।

শহরের এ প্রতিনিধি দলের সাথে যদি জুলিয়ান ও আইপাসের পূর্ব পরিচয় না থাকত তাহলে তারিক একে ধোঁকা মনে করতেন। যাহোক, তারিক তার বাহিনী নিয়ে দুর্গের দিকে অগ্রসর হলেন।

***

মুসলিম বাহিনী শহরে প্রবেশ করতেই শহরে যেসব লোক তখনও ছিল তারা আনন্দ-ধ্বনির মাধ্যমে তাদেরকে স্বাগত জানাল। শহরের ফৌজ যেখানে বিশ্রাম করত মুসলিম ফৌজকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। তারিক বিন যিয়াদ ও তাঁর অন্যান্য সালার এবং জুলিয়ান ও আউপাসকে শাহীমহলে নিয়ে যাওয়া হল।

ঐ শহরে যেসব ধন-দৌলত হীরা-জহরত মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হল, তা ছিল অপরিসীম। শহরের অধিবাসীদের যারা চলে গিয়েছিল তাদের ঘরসমূহে তল্লাশী নেওয়া হল। সেখান থেকেও বিপুল পরিমাণ হীরা-জহরত বের হল। স্বর্ণ-রোপার অসংখ্য পাত্র পাওয়া গেল। কর্তিত হীরা ও নকশা করা মণি-মুক্তার দুটি পও পাওয়া গেল।

তারিক বিন যিয়াদের নির্দেশে শাহীমহলের তামাম মণি-মুক্তা ও হীরা-জহরত এক কামরায় একত্রিত করা হল। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, মণি-মুক্তা ও হীরা-জহরত এত বেশি ছিল যে, বড় ধরনের একটি কামরা একেবারে ভরে গেল। রত্নভাণ্ডারের আধিক্য দেখে তারিক বিন যিয়াদের চেহারার রং পাল্টে গেল। এই মহামূল্যবান সম্পদের তূপের মাঝে রডারিক পর্যন্ত আন্দালুসিয়ার সকল বাদশাহর মাথার মুকুটও ছিল। প্রত্যেক বাদশাহর জন্যই পৃথক স্বর্ণের মুকুট তৈরী করা হত। বাদশাহর মৃত্যুর পর স্মৃতি হিসেবে তার সেই মুকুট সংরক্ষণ করা হত। নতুন বাদশাহর জন্য নতুন মুকুট তৈরী করা হত। শাহীমহল থেকে পঁচিশটি রাজমুকুট পাওয়া গেল, যা ছিল সম্পূর্ণ স্বর্ণের।

ঐতিহাসিক প্রফেসার ডোজি লেখেন, বাদশাহর মৃত্যুর পর তার রাজমুকুট বড় গির্জাকে নাযরানা স্বরূপ প্রদান করা হত। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক লেখেছেন, রডারিকের শাহীমহল থেকে পঁচিশটি রাজমুকুট তারিক বিন যিয়াদের হস্তগত হয়েছিল।

ঐতিহাসিক লেনপোল কয়েকজন ঐতিহাসিকের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেছেন, টলেডোতে শুধু একজনই জেনারেল ছিল। সে তার অবৈধ ছেলের হাতে নিহত হয়েছিল। টলেডোতে কোন প্রশাসক ছিল না। শাহীখান্দানের কাউন্ট এবং অন্যান্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা পালিয়ে গিয়েছিল। শাহীমহলে শুধু রানী ও তার নওজোয়ান ছেলে ছিল। আর ছিল কয়েকজন মধ্য বয়স্ক মহিলা ও কয়েকজন যুবতী মেয়ে। অন্য সব মেয়েরা চলে গিয়েছিল।

আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডোর উপর তারিক বিন যিয়াদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। গোথ ও ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকেরা তার পাশে একত্রিত হল। তারিক বিন যিয়াদ তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন ব্যক্তিকে নির্বাচন করে তাদের উপর শহরের প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করলেন।

মুসলিম বাহিনী এমন কোন ঘরে প্রবেশ করল না, যে ঘরের অধিবাসী রয়েছে এবং কোন প্রকার লুটতরাজও করল না। তারা কেবল সেসব ঘরে প্রবেশ করল, যেসব ঘর খালি পড়েছিল। সেসব ঘরের মূল্যবান আসবাবপত্র ও ধন-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হল।

***

সকাল হয়েছে অনেক্ষণ হয়। ধীরে ধীরে টলেডো শহর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে। নতুন দিনে নতুন উদ্যমে তারিক বিন যিয়াদ প্রশাসনিক কাজের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁকে সংবাদ দেওয়া হল যে, একটি যুবতী মেয়ে তার সাথে দেখা করতে চায়।

তারিক বিন যিয়াদ দেখা করার অনুমতি দিলে একটি সুন্দরী যুবতী মেয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটির চেহারায় ভয়ের ছাপ সুস্পষ্ট ছিল। সে পাও টেনে টেনে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল।

‘তাকে বল, আমি তার মতোই একজন সাধারণ মানুষ। তারিক বিন যিয়াদ দোভাষীকে বললেন। তাকে জিজ্ঞেস কর, সে কেন এসেছে? কোন মুসলমান কি তাকে বিরক্ত করেছে?

‘না। মেয়েটি নিচু আওয়াজে মাথা হেলিয়ে বলল। কোন মুসলমান আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। আমার নাম আইনামেরী। জোরপূর্বক আমাকে যাজিকা বানানো হয়েছিল। আমি শুনেছি যে, আপনার লোকেরা গির্জায় গিয়ে ছিল, তারা সেখানে কিছুই পায়নি। আপনার লোকদেরকে আমার সাথে পাঠান। বড় গির্জার ভূ-গর্ভস্থ ঘরে গুপ্তধন লুকিয়ে রাখা হয়েছে। আপনাদের আগমনের পূর্বেই যদি কেউ তা বের করে নেয় তাহলে সে জন্য আমাকে কোন শাস্তি দেবেন না। আপনি বড় গির্জার ভূ-গর্ভস্থ ঘরে গেলে, সেখানে ফ্লোরে দুটি লাশ দেখতে পাবেন এবং একটি গর্তে আরও তিনটি লাশ দেখতে পাবেন। এই গর্তের পাশেই আরেকটি গর্ত আছে, তা মাটি দিয়ে ভরে রাখা হয়েছে, দেখতে কবরের মতো দেখা যায়। গুপ্তধন এই গর্তেই আছে।’

তারিক বিন যিয়াদ কয়েকজন সিপাহীকে মেরির সাথে পাঠিয়ে দিলেন। মেরি তাদেরকে বড় গির্জার ভূ-গর্ভস্থ ঘরে নিয়ে গেল। মেরির বিবরণ অনুযায়ী তারা ভূ-গর্ভস্থ ঘরের মেজেতে দু’টি লাশ এবং একটি গর্তের ভিতর তিনটি লাশ দেখতে পেল। তারপর অন্য গর্তটি খুঁড়ে সেখান থেকে গুপ্তধনের দুটি বাক্স বের করা হল। এ সকল গুপ্তধন পাদ্রিরা অন্য গির্জা থেকে এনে এখানে লুকিয়ে রেখেছিল।

বড় গির্জা থেকে যখন গুপ্তধন সগ্রহ করা হচ্ছিল তখন আউপাস মেরিনার কামরায় বসাছিল। মেরিনা ও আউপাস যৌবনে একে অপরকে ভালোবাসত। তখন আউপাসের বড় ভাই অর্টিজা ছিল আন্দালুসিয়ার বাদশাহ। অর্টিজা আউপাস ও মেরিনার বিবাহ এই জন্য মেনে নেয়নি যে, মেরিনা ইহুদির মেয়ে। তাছাড়া আউপাস বাদশাহর ভাই। আর মেরিনা একটি সাধারণ ঘরের মেয়ে। এর কিছু দিন পর তাদের দুজনের প্রেমের মাঝে বিশাল এক পাহাড় অন্তরাল হয়ে দাঁড়ায়। রডারিক অর্টিজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাকে হত্যা করে। তারপর রডারিকের দৃষ্টি মেরিনার উপর পড়লে সে তাকে হেরেমের রক্ষিতা বানিয়ে নেয়।

আউলাস ও মেরিনার সেই যৌবনকাল শেষ হয়ে গেছে। এখন তারা মধ্য বয়সের নারী-পুরুষ। মেরিনার তো বিয়েই হয়নি। সে ছিল রডারিকের রক্ষিতা। আর আউপাস সিউটা গিয়ে বিয়ে করেছিল। তার ছেলে-সন্তান আছে।

সে রাতে আউপাস মেরিনার কামরায় প্রবেশ করল। আউপাসের ধারণা ছিল মেরিনা ভালোবাসার আকর্ষণে নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করবে। কিন্তু আউপাস মেরিনাকে খুব নীরব দেখতে পেল। তার ঠোঁটে একটু মুচকি হাসিও দেখতে পেল না। সে যখন কথা বলত তখন তার কথা বলার ধরন হত গাম্ভির্যপূর্ণ। মনে হচ্ছিল মেরিনা দুনিয়া ত্যাগী সন্নাসী হয়ে গেছে। পার্থিব ভোগ-বিলাসের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।

‘মেরীনা! বাকী জীবনটা আমার সাথে কাটাবে কি? আউপাস জিজ্ঞেস করল।

“না, আউপাস!’ মেরিনা উদাস কণ্ঠে বলল। আমার বাকী জীবন এখন উপাসনালয়ে অতিবাহিত হবে। যেন আমার আত্মা পুত-পবিত্র হতে পারে। এখন আমি আল্লাহর নিকট নিজেকে অর্পণ করতে চাই।’

 ‘যাজিকা হয়ে যেয়ো না।’ আউপাস মুচকী হেসে বলল। “তুমি তো এখনও যুবতী। স্বাধীন জীবনের সাধ উপভোগ করে নাও।’

 ‘না, আউপাস!’ মেরিনা বলল। আমার জীবনে যা ঘটে গেছে তা তুমি ভালো করেই জান। এখন তুমি আমাকে তোমার ভালোবাসার বন্ধন থেকে মুক্তি দাও। এক কাজ কর আউপাস! আমি আন্দালুসিয়া বিজয়ী সিপাহসালার তারিক বিন যিয়াদকে একটা তোহফা দিতে চাই, তুমি আমাকে তাঁর সাথে দেখা করার সুযোগ করে দাও।’

‘কালই তোমাকে তাঁর নিকট নিয়ে যাব।’ আউপাস বলল। কী তোহফা দেবে তাকে?

‘একটি ভারী বক্সি। মেরিনা বলল। আগামীকাল তিন-চারজন লোক নিয়ে এসো, তারা বাক্স বহন করে নিয়ে যাবে।’

পরদিন সকালে যখন তারিক বিন যিয়াদের পাঠানো লোকেরা গির্জার ভূ-গর্ভস্থ ঘর থেকে গুপ্তধন উদ্ধার করছিল তখন আউপাস শাহীমহলের এক কামরা থেকে একটি বাক্স উঠাচ্ছিল। এই কামরা এক বছরেরও কিছু বেশি সময় ধরে তালাবদ্ধ হয়ে আছে।

বাক্স নেওয়ার জন্য আটপাস যখন লোকজন নিয়ে মেরিনার কাছে এলো তখন মেরিনা কামরা খোলে দিলে তারা দ্রুত পিছু হঠে গেল।

‘মেরিনা! এই কামরায় কি আছে? এত দুর্গন্ধ কিসের? আউপাস জিজ্ঞেস করল। ‘এই কামরায় কি কোন মানুষ, কিংবা কোন প্রাণী মরে পচে আছে নাকি?

‘কামরা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে এ দুর্গন্ধ হচ্ছে। মেরিনা বলল। ‘তাছাড়া এই কামরায় কত কি পড়ে আছে। এটা ইহুদি জাদুকর বোসজনের কামরা। সে এখানে মানুষের মস্তক, কলিজা ও হাড়-গৌড় রাখত। এখানে সে সাপ-বিচ্ছুও রাখত। এছাড়া এমন কিছু গাছ-গাছালির লতা-পাতাও রাখত, যার দুগন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে।

‘সে এখন কোথায়? উপাস জিজ্ঞেস করল।

‘মরে গেছে।’ মেরিনা উত্তর দিল। আমি তার এই বাক্স তারিক বিন যিয়াদকে তোহফা হিসেবে দিতে চাই।’

এর মাঝে কি আছে? আউপাস জানতে চাইল। তুমি কি অনুভব করতে পারছ না যে, এ থেকে কি পরিমাণ দুর্গন্ধ বের হচ্ছে?

‘আউপাস!’ মেরিনা বলল। এতে কি আছে, তা শুধু তারিক বিন যিয়াদই দেখবেন। তিনি যদি অসন্তুষ্ট হন তাহলে তিনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন আমি তা মাথা পেতে নেব।’

চারজন ব্যক্তি বাক্সটি নিয়ে রওনা হল। তাদের পিছনে পিছনে আউপাস মেরিনাকে নিয়ে তারিক বিন যিয়াদের সামনে এসে উপস্থিত হল।

‘বিন যিয়াদ!’ আউপাস তারিক বিন যিয়াদকে লক্ষ্য করে বলল। এই হল সেই নারী, যিনি আপনাকে হাজার হাজার গোথ ও ইহুদি সিপাহী প্রদান করেছিল। গোয়াডিলেটের যুদ্ধে যে হাজার হাজার গোথ ও ইহুদি সিপাহী রডারিকের পক্ষ ত্যাগ করে আমাদের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, তার নেপথ্য কারণ ছিল এই নারী।

আউপাস তারিক বিন যিয়াদকে পূর্বেই বলেছিল, মেরিনা গোথ ও ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতাদেরকে কীভাবে তার পক্ষে নিয়ে এসেছিল এবং তারা কীভাবে রণাঙ্গনে মুসলিম বাহিনীর পক্ষে কাজ করেছে।

‘আমরা এই নারীকে তার আকাক্ষার চেয়ে ঢের বেশি উপহার দেব।’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন।

‘হে সিপাহসালার! মেরিনা বলল। আমি উপহারের আশায় এ কাজ করিনি। আমি রডারিক থেকে প্রতিশোধ নিয়েছি। আমি আপনার অনুগ্রহ চাই না। আমি আমার আত্মাকে শান্ত করেছি। এখন আমি আপনার জন্য একটি হাদিয়া নিয়ে এসেছি।

কাঠের বাক্স তারিক বিন যিয়াদের সামনে রাখা হল। মেরিনা চাবি বের করে তার তালা খোলে ঢাকনা উঠাল। সাথে সাথে তারিক বিন যিয়াদ ও তার সাথে আর যারা বাক্সের সামনে ছিলেন, সকলেই ছিটকে দূরে সরে গেলেন। তারা সকলেই নাকে হাত ও কাপড় চেপে ধরলেন। বাক্স থেকে যে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল তার কারণে কামরায় থাকাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।

এই বাক্সে কি আছে?’ তারিক বিন যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

 ‘এক ব্যক্তির লাশ।’ মেরিনা বলল। এক বছর যাবৎ এই লাশ বাক্সে তালা বদ্ধ হয়ে আছে।

‘রডারিকের লাশ নয় তো?’ জুলিয়ান বলল।

‘না।’ মেরিনা উত্তর দিল। শাহ রডারিককে আমরা যেতে দেখেছি, ফিরে আসতে দেখিনি। কাউন্ট জুলিয়ান! এ লাশ যার, তাকে আপনি চিনেন। রডারিকের প্রিয় জাদুকর বোসজানের লাশ এটা। সিপাহসালারকে বলুন, এই জাদুকর যদি জীবিত থাকত তাহলে সিপাহসালার আজ এখানে বিজয়ীর বেশে দাঁড়িয়ে থাকতেন না। এখানে থাকত রডারিক, আর সিপাহসালার তার সামনে জিঞ্জিরাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন।

‘এই নারীকে বল, পুরো ঘটনা বর্ণনা করতে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন।

‘এই ব্যক্তির নাম বোসজান। জুলিয়ান মেরিনার কথা তরজমা করে শুনাল। সে রডারিককে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংবাদ দিত। এই ব্যক্তি জ্যোতিষশাস্ত্রে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল। রডারিক তার ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য মনে করত। রডারিক সর্বদা তাকে কাছে কাছে রাখত। তাকে জিজ্ঞেস না করে রডারিক কোন কাজই করত না। বোসজান ছিল একজন পাকা জাদুকর।

সে কি ইহুদি ছিল?’ তারিক বিন যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

 ‘হ্যাঁ, বিন যিয়াদ! সে ইহুদি ছিল। জুলিয়ান বলল।

 ‘জাদুবিদ্যা ইহুদিদেরই আবিষ্কার। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। ইহুদিরাই এ ব্যাপারে বেশি পারদর্শী।

‘মেরিনা এখন তুমি বল, এ ব্যক্তি কীভাবে মৃত্যুবরণ করেছে?’ আউপাস বলল।

‘রডারিক যখন আপনার সাথে মুকাবেলা করার জন্য যাচিছল তখন সে কিছু অশুভ লক্ষণের সম্মুখীন হয়েছিল।’ মেরিনা তারিক বিন যিয়াদকে লক্ষ্য করে বলল। ‘তখন সে এই জাদুকরকে ডেকে বলেছিল, এই অশুভ লক্ষণকে পরিবর্তন করে তার অনুকূলে নিয়ে আসতে। সে জাদুবিদ্যার মাধ্যমে আপনার উপর বিজয় অর্জন করতে চাচ্ছিল।

রডারিকের ইচ্ছাকে বাস্তবায়নের জন্য জাদুকর রডারিকের নিকট একটি ষোল-সতের বছরের কুমারী মেয়ের আবেদন করল। সে রডারিককে বলল, ঐ মেয়ের কলিজা বের করে এমন আমল করবে যে, রডারিক বিজয়ী হবে, আর হামলাকারীরা তার হাতে পরাজিত হবে।

শাহ রডারিক আমাকে হুকুম দিল, আমি যেন এই জাদুকরের নিকট তার কাঙ্ক্ষিত কোন মেয়েকে পাঠিয়ে দেই। জাদুকর যেমনটি চাচ্ছিল আমার নিকট ঠিক তেমনি একটি মেয়ে ছিল। আমি ঐ দিন রাতে মেয়েটিকে নিয়ে জাদুকরের কাছে গেলাম। জাদুকর মেয়েটির বুক চিড়ে কলিজা বের করার জন্য যেই তাকে টেবিলের উপর শুয়ালো তখন আমি একটি মজবুত লাঠি দ্বারা তার মাথায় তিনবার আঘাত করলাম। সে বেহুশ হয়ে পড়ে গেল। তারপর আমি তাকে গলাটিপে হত্যা করে ফেলি। তারপর ঐ মেয়েটির সাহায্যে তার লাশ এ বাক্সে ভরে রাখি। পরদিন সকালে রডারিক রওনা হয়ে গেলে আমি ঐ মেয়েটিকে তার ঘরে পৌঁছে দেই। সেই রাত হতে জাদুকরের লাশ এই বাক্সে বন্দী হয়ে আছে। সে যদি তার তদবির পূর্ণ করতে পারত তাহলে রডারিকেরই বিজয় হতো।

‘তার লাশ আমার কাছে কেন নিয়ে এসেছ?’ তারিক বিন যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

এর চেয়ে উত্তম কোন তোহফা আমার নিকট ছিল না। মেরিনা বলল। ‘লাশ কোথায়; এখন তো শুধু হাড়ের স্কুপ রয়েছে। এগুলো জ্বালিয়ে ফেলুন, কিংবা দাফন করে রাখুন–এখন থেকে আমি মুক্ত।

মেরিনা তার কথা শেষ করে ঝুঁকে তারিক বিন যিয়াদকে সালাম করল। তারপর এ কথা বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে গেল, আমি এখন মুক্ত, আমি এখন মুক্ত।

এই ঘটনার পর আউপাস মেরিনাকে অনেক তালাশ করেছে, কিন্তু কোথাও তার কোন সন্ধান পায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *