৩. তারিক বিন যিয়াদের নির্দেশ

০৩.

তারিক বিন যিয়াদের নির্দেশে চারটি জাহাজের সবকটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। প্রতিটি জাহাজই ছিল বিশাল আকৃতির। এ সকল জাহাজের মাধ্যমে সাত হাজার সৈন্য, বিপুল পরিমাণ যুদ্ধ-রসদ ও কয়েকশ’ ঘোড়া বহন করে নিয়ে আসা হয়েছিল।

এই বিশাল আকৃতির জাহাজগুলোতে আগুন লাগানোর সাথে সাথে আগুনের শিখা দাউ দাউ করে উপরে উঠতে লাগল। ধোঁয়ায় গোটা সীমান্ত আচ্ছন্ন হয়ে গেল।

যে স্থানটিতে যুদ্ধ-জাহাজগুলো জ্বলছিল তার অনতিদূরেই জেলেদের একটি গ্রাম ছিল। সমুদ্রসৈকতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশের দিকে উঠতে দেখে জেলেদের বসতিতে হৈচৈ পড়ে গেল, তারা একজন আরেকজনকে চিৎকার করে বলতে লাগল, ঐ দেখো, কোন বিদেশী বণিকের জাহাজে হয়তো আগুন লেগেছে। জলদি চলে, সবকিছু জ্বলে যাওয়ার পূর্বেই আমরা নিজেদের জন্য কিছু নিয়ে আসি।

বসতির নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর সকলে মিলে আগুন লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল। যে স্থানটিতে আগুন লেগে জাহাজগুলো জ্বলছিল, উৎসুক নারী-পুরুষ যখন সেখানে এসে পৌঁছলো তখন তারা স্বশস্ত্র সৈন্যদেরকে দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারিক বিন যিয়াদ তখন সৈন্যদেরকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিচ্ছিলেন।

আগুন দেখতে আসা উৎসুক লোকেরা যে জায়গায় ভিড় করছিল সেখানে মুগীস আর-রুমী তার বাহিনী নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মুগীস আর-রুমী তাঁর অশ্বারোহীদেরকে নির্দেশ দিলেন,

‘কৌতূহলী ও উৎসুক এই লোকদেরকে ঘিরে ফেলল। একটি শিশুও যেন পালিয়ে যেতে না পারে।’

অশ্বারোহী সৈন্যরা তৎক্ষণাৎ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। কৌতূহলী লোকদের মধ্যে উঠতি বয়সের কিশোরী ও যুবতী মেয়েও ছিল। তারা হৈচৈ করে পালানোর চেষ্টা করল। শিশুরাও ভয়ে চিৎকার করতে লাগল। পুরুষরা নারী ও শিশুদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করল। অশ্বারোহী সৈন্যরা তাদের সকলকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে এক পার্শ্বে নিয়ে একত্রিত করলো।

তারিক বিন যিয়াদের ভাষণ শেষ হলে মুগীস আর-রুমী ঘোড়া ছুটিয়ে তার নিকট এসে দাঁড়াল।

‘আমি জানি, তুমি তাদেরকে কেন আটকে রেখেছ। তারিক বিন যিয়াদ মুগীসকে বললেন। তাদেরকে ফিরে যেতে দিলে আন্দালুসিয়ার অধিবাসীরা আমাদের আগমন সম্পর্কে জেনে যাবে, কিন্তু আমরা তাদেরকে অজ্ঞতার মাঝে রাখতে চাই। তারা যেন আমাদের গতিবিধি সম্পর্কে কিছুই জানতে না পারে। তাদেরকে এখানেই আটকে রাখো। আমরা এই স্থান ছেড়ে অনেক দূর চলে যাওয়ার পর তাদেরকে ছাড়বে। শুন মুগীস, ভালোভাবে লক্ষ্য রাখবে, কোন নারীর সাথে যেন অসদাচরণ করা না হয়।’

 ‘ঠিক আছে, ইবনে যিয়াদ! মুগীস বললেন। তবে আমাদের সম্পর্কে এই গরীব-অসহায় লোকদের অন্তরে যে ভীতি জন্মেছে তা এখনই বিদূরিত করতে হবে। আপনি হয়তো জানেন না, এরা আন্দালুসিয়ায় কত বড় জুলুমের শিকার। আমি তাদের সাথে এমন আচরণ করব যে, তারা আমাদের সাহায্যকারী হয়ে যাবে। আমি তাদের থেকে জেনে নিতে পারব, এখানে আন্দালুসিয়ার বাহিনী কোথায় অবস্থান করছে।

মুগীস আর-রুমী একজন নওমুসলিম ছিলেন। তাঁর বাবা-মা ছিল ইহুদি। কয়েক বছর পূর্বে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার স্বভাব-প্রকৃতি ইহুদিদের মতো ছিল না। ফেত্না সৃষ্টি করা, ষড়যন্ত্র পাকানো, ইবলিসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করাই হল ইহুদি স্বভাব-প্রকৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

মুগীস আর-রুমী হয়তো এজন্যই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যে, তাঁর বিবেক ইহুদিবাদকে মেনে নিতে পারছিল না। তিনি মুসা বিন নুসাইরের ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার মাঝে নেতৃত্ব প্রদানের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল।

ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ থেকে জানা যায়, মুগীস আন্দালুসিয়ার অধিবাসী ছিলেন। সে সূত্রে জুলিয়ানের সাথে তার পরিচয় ছিল। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি সিউটা এসে বসবাস করতে থাকেন।

আগুন দেখতে আসা কৌতূহলী লোকদেরকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল, মুগীস সেখানে ফিরে আসেন। তাঁকে দেখতে পেয়ে জেলেপাড়ার এক বৃদ্ধ সামনে অগ্রসর হল। বার্ধক্যজনিত রোগে বৃদ্ধের মাথা ও হাত কাঁপছিল।

বৃদ্ধ মুগীসের ঘোড়ার নিকটে এসে বলল, “হে ফৌজীদের সরদার, তোমরা যেই হওনা কেন, আর যেখান থেকেই আসনা কেন, আমাকে বলো, তোমরাও কি গরীবদের মান-সম্মানকে এতটাই তুচ্ছ মনে করো যেমন এদেশের ধনীরা তুচ্ছ মনে করে? আমি জানি, এখন তুমি নির্দেশ দেবে, পুরুষদেরকে বন্দী করতে, আর মেয়েদেরকে তাদের থেকে পৃথক করতে। তোমরা কি আমাদের উপর অনুগ্রহ করবে না? আমরা তো এজন্য দৌড়ে এসেছিলাম যে, তোমাদের জাহাজে আগুন লেগেছে, তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন।’

‘ভয় পেয়ো না, হে বৃদ্ধ! মুগীস বললেন। আমাদের জাহাজে আগুন লাগেনি, আমরা নিজেরাই আমাদের জাহাজে আগুন লাগিয়েছি।

 ‘তাহলে তো তোমাদেরকে আরো বেশি ভয় করা উচিত। বৃদ্ধ বলল। ‘তোমরা নিশ্চয় ডাকাত বা লুটেরা, অন্যের জাহাজ ডাকাতি করে এনে তাতে আগুন দিয়েছ। নিজেদের জাহাজে কি কখনও কেউ আগুন দেয়?

 ‘আমাদেরকে ডাকাত-লুটেরা, যা ইচ্ছা তাই বলতে পার।’ মুগীস বললেন। ‘কিন্তু আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমাদের কেউ তোমাদের মেয়েদের শরীরে হাত লাগাবে না।’

‘তোমাদের কথা আমরা বিশ্বাস করলাম। বৃদ্ধ বলল। কিন্তু আমরা এতটাই ভাগ্যহত যে, আমাদের ভাগ্য-বিড়ম্বনার কথা শুনলে হয়তো তোমরা আমাদের প্রতি অনুকম্পা দেখাবে। তাই বলছি, আমাদের মান-ইজ্জতের হেফাতকারী ফৌজই হল, আমাদের মান-ইজ্জত লুণ্ঠনকারী। আমাদের নিজ দেশের ফৌজ যখন এদিকে আসে তখন আমাদের যুবতী মেয়েদেরকে জোর-জবরদস্তী উঠিয়ে নিয়ে যায়। পরের দিন তাদেরকে ফিরত পাঠায়।

মুগীস আর-রুমী তাদেরকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন। এখন থেকে তোমাদের মান-সম্মান ও ইজ্জত-আবরু রক্ষা করা হবে।’

‘তাহলে অশ্বারোহীরা আমাদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে কেন?’ বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

 ‘তোমরা যেন তোমাদের ফৌজকে এই সংবাদ দিতে না পার যে, অন্য দেশের ফৌজ তোমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। তাই তোমাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। মুগীস বললেন। আমরা বেশ কিছু দূর অগ্রসর হলে তোমরা তোমাদের বাড়ি-ঘরে চলে যেও। নিকটে কোথাও তোমাদের ফৌজ আছে কি?

বৃদ্ধের নিকট আরো কয়েকজন জেলে ও মাঝি এসে দাঁড়াল। তাদের মধ্য থেকে আরেক বৃদ্ধ সামনে অগ্রসর হয়ে বলল, তোমাকে এই নৌসেনাদের সরদার মনে হচ্ছে, তোমরা আমাদের ইজ্জত রক্ষা করার ওয়াদা করেছ, তাই আমরাও তোমাদেরকে স্থানীয় সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা করার ওয়াদা করছি। তোমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে, কেননা আমাদের ফৌজ এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

বৃদ্ধ মুগীস আর-রুমীকে বলল, এই এলাকায় কয়েক জায়গায়ই ফৌজী চৌকী রয়েছে। সবচেয়ে নিকটতম চৌকী এখান থেকে ছয় মাইল দূরে। এটাই এখানকার জেনারেলের হেডকোয়াটার। এই এলাকার সকল চৌকী মিলে সৈন্যসংখ্যা আট-দশ হাজার হবে। এখানকার জেনারেলের নাম হল, থিয়োডুমির।

ঐতিহাসিকদের মতে এই জেনারেল ছিল অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ।

***

তারিক বিন যিয়াদ মনে করেছিলেন, আন্দালুসিয়ার বাহিনী তাদের আগমন সম্পর্কে অবগত হওয়ার পূর্বেই তিনি আচমকা তাদের উপর আক্রমণ করে তাদেরকে পর্যুদস্ত করে দেবেন। কিন্তু এটা ছিল তার একটা ভুল ধারণা। মুগীস যখন জেলে ও মাঝিদেরকে এই বলে সান্তনা-বাক্য শুনাচ্ছিলেন যে, তাদের নারীদের ইজ্জতের উপর হামলা করা হবে না, সেই সময় আন্দলুসিয়ার এক ফৌজী গুপ্তচর হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের জেনারেল থিয়োডুমিরের নিকট এসে পৌঁছল। সে তাকে অত্যন্ত হতভম্ব কণ্ঠে সংবাদ দিল :

এইমাত্র আমি দেখে এসেছি, আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে চারটি বিশাল রণতরী থেকে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী অবতরণ করেছে।

মুসলিম বাহিনীর জাহাজগুলো যখন সমুদ্রসৈকতে নোঙর করে তখন এক গুপ্তচর ক্যাপেলো নামক স্থানে এক পাহাড়ী চূড়ায় পাহারারত ছিল। এই গুপ্তচর থিয়োডুমিরের নিকট বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করল।

সে তাকে বলল, আমি দেখলাম, সিউটার দিক থেকে চারটি বিশাল রণতরী আমাদের সমুদ্রসৈকতে এসে নোঙর ফেলল। তারপর সৈন্য-সামন্ত, যুদ্ধ-রসদ ও ঘোড়া নামানো হলে তারা নিজেরাই নিজেদের রণতরীগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিলো।

‘আগুন লাগিয়ে দিয়েছে?’ থিয়োডুমির হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘আমি নিজ চোখে জাহাজগুলো জ্বলতে দেখেছি।’ গুপ্তচর বলল। তারা সকলেই সৈনিক। তাদের সংখ্যা দশ হাজারের চেয়ে কিছু কম হবে।’

 ‘তাহলে তো তারা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর সৈনিক।’ থিয়োডুমির হতভম্ব হয়ে বলল। ‘মনে হয়, এই সৈনিকদের সকলেই উন্মাদ। একমাত্র উন্মাদরাই নিজেদের জাহাজে আগুন দিতে পারে।’

থিয়োডুমির তৎক্ষণাৎ কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে এই নির্দেশ দিয়ে চৌকীগুলোর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলো, যেন পদাতিক ও অশ্বারোহীসহ সকল বাহিনী তাদের যুদ্ধ-সামগ্রী ও রসদপত্র নিয়ে অতিসত্বর হেডকোয়ার্টারে একত্রিত হয়।

***

অল্প সময়ের মধ্যেই সকল বাহিনী হেডকোয়ার্টারে এসে একত্রিত হল। এদের সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় পনের হাজার। যুদ্ধ-রসদ ও অস্ত্রসস্ত্রের বিবেচনায় এই বাহিনী তারিক বিন যিয়াদের বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল।

আন্দালুসিয়ার বাহিনীর সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল, তারা আপন দেশে অবস্থান করছে। সব সময় তাদের নিকট যুদ্ধ-রসদ ও সাহায্য পৌঁছা সম্ভব। তাছাড়া তাদের সকলের উর্ধাঙ্গ কঠিন লৌহবর্মে আবৃত ছিল।

তারিক বিন যিয়াদের সৈন্যসংখ্যা হল মাত্র সাত হাজার। অশ্বারোহী মাত্র তিনশ’। তাদের কেউই লৌহবর্ম পরিহিত নয়। তারিক বাহিনীর অস্ত্রসস্ত্রও হল পুরনো ও অনুন্নত। তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল, তারা শত্রুভূমিতে অবস্থান করছে, যেখানের প্রতিটি ধূলিকণা, আকাশ-বাতাস, এমনকি ছোট ছোট শিশুরাও তাদের শত্রু। কোথাও থেকে যুদ্ধ-রসদ পাওয়ার কোন সম্ভাবনাও তাদের নেই। সেনাসাহায্য পৌঁছাও অনেকটা অসম্ভব। কারণ, তাদের পিছনে বার মাইল বিস্তৃত সুবিশাল উত্তাল সমুদ্র।

তারিক বিন যিয়াদের সাথে অর্টিজার ভাই আউপাস এবং জুলিয়ানও এসেছিলেন। তারা উভয়েই গাইডের কাজ করছিলেন। আন্দালুসিয়ার প্রতিটি অলিগলি ছিল তাদের নখদর্পণে।

তারিক বিন যিয়াদ তাদেরকে নিকটে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছিলেন আন্দালুসিয়ার কোথায় কী আছে? কোথায় কোথায় দুর্গ আছে? এখান থেকে শহর কত দূর? এক শহর থেকে আরেক শহরের দূরত্ব কেমন? ইত্যাদি। আউপাস ও জুলিয়ান তাঁর প্রতিটি প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ উত্তর দিচ্ছিলেন।

‘আমাদের প্রথম সংঘর্ষ হবে সমুদ্রসৈকতের নৌসেনাদের সাথে। জুলিয়ান বললেন। আমাদের আক্রমণের পূর্বেই এই সৈনিকরা যদি সংঘবদ্ধ হয়ে যায় তাহলে আমাদের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তাদের সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি; তাদের অস্ত্রসস্ত্রও উন্নত। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা আমাদের আগমনের সংবাদ পায়নি। আশা করি, আমরা প্রতিটি প্রতিরক্ষা চৌকী পৃথক পৃথকভাবে ধ্বংস করতে সক্ষম হব।’

মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ-জাহাজ থেকে অবতরণ করে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম গোছগাছ করে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারিক বিন যিয়াদ তাদেরকে বললেন, ‘এখানে অল্প সময়ের জন্য আমরা অবস্থান করব। তাঁবু টনানো হবে না।’

এমন সময় একজন অশ্বারোহী ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে তারিক বিন যিয়াদের সামনে এসে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল। আগন্তুক দ্রুতপদে ঘোড়া থেকে নেমে তারিককে লক্ষ্য করে বলল,

‘এখনই প্রস্তুত হয়ে নিন। আগন্তক হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চস্বরে বলল। ‘আন্দালুসিয়ার বাহিনী আমাদের আগমন সম্পর্কে জেনে গেছে। প্রতিরক্ষা চৌকীগুলোর সৈন্যরা একত্রিত হচ্ছে, তারা আমাদের থেকে বেশি দূরে নয়, এখনই এখানে পৌঁছে যাবে।

কে এই ব্যক্তির তারিক বিন যিয়াদ জুলিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন। কোন বার্বার সৈনিক তো মনে হচ্ছে না।’

‘এ আমার লোক। জুলিয়ান বললেন। তার নাম হেনরি।

জুলিয়ান হেনরিকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি এখানে কীভাবে এলে? ‘আমি আপনাদের সাথে আসতে চাচ্ছিলাম, তাই মুসলমানদের পোশাক পরিধান করে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। হেনরি বলল। পদাতিক বাহিনী ও অশ্বারোহীরা যখন জাহাজে আরোহণ করছিল তখন আমি সুযোগ বুঝে অশ্বারোহীদের জাহাজে উঠে পড়ি।

এখানে পৌঁছে দেখি, সৈনিকরা যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে। এখানকার ফৌজ যে আমাদের পথ আগলে বসে আছে, সেদিকে কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। এই এলাকা আমার পরিচিত। আমি এক পাহাড়ী ঝোঁপের আড়ালে আমার ঘোড়া রেখে সামনে অগ্রসর হই। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পরই এখানকার ফৌজ আমার দৃষ্টিগোচর হয়। আমি এটা দেখতে চাচ্ছিলাম যে, এখানকার বাহিনী আমাদের আগমন সম্পর্কে অবগত আছে কি না?

***

এ বিষয়টি তারিক বিন যিয়াদের মতো জাদরেল সেনাপতির দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তিনিও এখানকার বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। তাই তিনি এই এলাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তত্ত্ব সংগ্রহ করছিলেন। কিছুক্ষণ পূর্বেই মুগীস আর-রুমী জেলে ও মাঝিদের থেকে এই অঞ্চলের নৌবাহিনী সম্পর্কে যে তত্ত্ব পেয়েছিল, তা তারিক বিন যিয়াদকে অবহিত করা হয়েছিল। তিনি হেনরির তত্ত্ব শুনে অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে মোবারকবাদ জানান।

এই সেই হেনরি যাকে ফ্লোরিডা মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। সেও ফ্লোরিডাকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসত। ফ্লোরিডার বিরহ-বেদনা সইতে না পেরে সে টলেডো চলে গিয়েছিল। আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিক ফ্লোরিডার শ্লীলতাহানী করলে হেনরি শাহী আস্তাবলের ঘোড়া চুরি করে টুলেডো থেকে পালিয়ে যায়। তারপর সিউটা পৌঁছে ফ্লোরিডার বাবা জুলিয়ানকে সবকিছু খুলে বলে।

এই ঘটনার পর জুলিয়ানের আহ্বানে যৌথবাহিনী যখন আন্দালুসিয়ার মাটিতে পরীক্ষামূলক আক্রমণ চালায় তখন ফ্লোরিডাও সেই বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে নিজ হাতে আপন শ্লীলতাহানীর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু জুলিয়ান তাকে অনুমতি দেয়নি। এরপর যখন তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে আন্দালুসিয়া আক্রমণের জন্য মুসলিম বাহিনী প্রেরণ করা হয় তখন জুলিয়ান ও আউপাস মুসলিম বাহিনীর সাথে রওনা হন।

ফ্লোরিডা ভালো করেই জানত যে, জুলিয়ান কিছুতেই তাকে সাথে নিবেন না। উপায়ন্তর না দেখে সে হেনরিকে বলল, আমি মুসলিম বাহিনীর সাথে যেতে চাই।’

 হেনরিকেও মুসলিম বাহিনীর সাথে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই যুদ্ধে জুলিয়ানের বাহিনীর অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকলে হেনরিকে অনুমতি দেওয়া হতো। কারণ, তার বাবা ছিল শাহী আস্তাবলের বড় অফিসার।

‘তুমি আমাকে মুসলিম বাহিনীর পোশাক এনে দাও।’ ফ্লোরিডা হেনরিকে বলল। আমি সেই পোশাক পরে জাহাজে আরোহণ করব। আমি নিজ হাতে রডারিক থেকে প্রতিশোধ নেব।’

হেনরি তাকে বুঝাতে চেষ্টা করল, কিন্তু সে আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠল। হেনরি প্রমাদ গণলো। তার ধারণা হল, এই মেয়ে যা বলছে, তা করেই ছাড়বে।

‘ফ্লোরা!’ হেনরি তাকে বলল। উত্তেজিত হয়ো না। আমি তোমার মনের কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি একরোখা চিন্তা করছ। অন্য দিকটি এখনও ভেবে দেখনি। তুমি কীভাবে মনে করলে যে, তুমি রডারিক পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে এবং নিজ হাতে তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে?’

‘আমি মুসলিম সেনাদের পোশাক পরে থাকব।’ ফ্লোরিডা বলল।

‘আবেগ নয়; বিবেক দিয়ে চিন্তা কর, ফ্লোরা! হেনরি বলল। তুমি কি ভেবে দেখেছ, যুদ্ধের ময়দানে তুমি আহত হতে পার, এমন কি নিহতও হতে পার। আর যদি তুমি জীবিত গ্রেফতার হও তাহলে তুমি নিজেই ভেবে দেখ, রডারিকের ফৌজ তোমার সাথে কী আচরণ করবে? তারাও তোমার সাথে রডারিকের মতোই আচরণ করবে। তখন তুমি কয়জন থেকে তোমার শ্লীলতাহানীর প্রতিশোধ নিবে?

ফ্লোরিডা কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে গেল। মনে হল, সে বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।

‘তা হলে এক কাজ কর হেনরি, তুমি নিজ হাতে রডারিককে হত্যা কর। আমি তোমার আমানত ছিলাম। সে তোমার আমানতের খেয়ানত করেছে। আমার সতীত্ব, আমার দেহ-মনের একমাত্র অধিকারী তুমি। চরিত্রহীন রডারিক আমার এই দেহকে অপবিত্র করেছে। আমার মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। বল হেনরি! তুমি আমার অশান্ত আত্মাকে শান্ত করবে?

‘হ্যাঁ করব, আমি তোমার মনের শান্তি ফিরিয়ে আনব ফ্লোরা, আমি অবশ্যই তোমার ইজ্জতের বদলা নেব।’

হেনরি ফ্লোরিডার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে গভীরভাবে চুমো খেল। তারপর নিজের বুকের উপর ফ্লোরিডার হাত দুটি রেখে বলল। ‘তোমার ভালোবাসার কসম, রডারিকের মৃত্যু আমার হাতেই হবে।

 ‘কথা দাও, আমার জন্য আরেকটা কাজ করবে?’ ফ্লোরিডা মিনতিভরা কণ্ঠে বলল। “তুমি রডারিকের মাথা কেটে এখানে নিয়ে আসবে। আমি তার মাথা পাগলা কুকুরের সামনে নিক্ষেপ করব।’

‘কথা দিলাম, রডারিকের মাথা নিয়েই আমি ফিরে আসব।’ হেনরি বলল।

***

হায়রে প্রেম! হায়রে ভালোবাসা! রূপের রানী ফ্লোরিডা নির্দ্বিধায় এক শক্তিধর বাদশাহর প্রেম-প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করল। অপর দিকে তারই আস্তাবলের এক সাধারণ কর্মচারীকে তার হৃদয়মন্দিরে সাদরে গ্রহণ করল।

একেই বলে ভালোবাসা! একেই বলে প্রেম! সেই প্রেমের দাবি পূরণ করার জন্য হেনরি জীবনবাজি রাখতেও প্রস্তুত হয়ে গেল। সেই প্রেমের বলে বলিয়ান হয়ে সে তার প্রেমিকাকে কথা দিল, তার শ্লীলতা হরণকারী এক প্রতাপশালী বাদশাহর মাথা কেটে এনে তার পদতলে রাখবে।

হেনরি তার প্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য এক মুসলিম সৈনিকের বেশে জাহাজে চড়ে আন্দালুসিয়া এসে পৌঁছল। মুসলিম বাহিনী আন্দালুসিয়া পৌঁছার পর যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম বাঁধাঘাদার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লে সে সুযোগ বুঝে সেখান থেকে সরে পড়ে। তারপর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সামনে অগ্রসর হয়।

তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী রওনা হওয়ার পর থেকে ফ্লোরিডা প্রতিদিন নিয়মিত উপাসনালয়ে যেত, আর উপাসনা শেষে শুধু এই প্রার্থনাই করত, হে ঈশ্বর! মুসলমানরা যেন বিজয়ী হয়, আর হেনরি যেন রডারিকের কর্তিত মস্তক নিয়ে জীবিত ফিরে আসে।

***

আন্দালুসিয়ার বাহিনী একত্রিত হওয়ার সংবাদ পাওয়ামাত্রই তারিক বিন যিয়াদ তৎক্ষণাৎ তাঁর বাহিনীকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি নিজে জাবালুতারিকের একটি উঁচু টিলার উপর উঠে গভীর দৃষ্টিতে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করেন। সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টি তড়িগতিতে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছিল।

তাঁর সাথে মুগীস আর-রুমী এবং অভিজ্ঞ সেনাপতি আবু যারু’আ তুরাইফ বিন মালেকও উপস্থিত ছিলেন। তারা নিজেদের পছন্দনীয় যুদ্ধ ক্ষেত্র নির্বাচনে ব্যস্ত ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ এমন একটি স্থানের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যে স্থানটি উঁচু উঁচু টিলা এবং সবুজ গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত ছিল।

‘সকল অশ্বারোহীকে টিলা ও গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত ঐস্থানটিতে পাঠিয়ে দাও। তারিক তার অধীনস্থ সেনাপতিদেরকে বললেন। অশ্বারোহীদের কমান্ডারকে বলে দাও, সে যেন অশ্বারোহীদেরকে নিয়ে ইঙ্গিতের অপেক্ষায় থাকে।

তারিক তাঁর সেনাপতিদেরকে নিজ নিজ বাহিনী বিন্যস্ত করার নির্দেশনা দিয়ে নিচে চলে এলেন। যে সকল জেলে ও মাঝিদেরকে আটকে রাখা হয়েছিল তাদেরকে এই বলে ছেড়ে দেওয়া হল যে, তোমরা নিজ নিজ গৃহে চলে যাও, সেখান থেকে বের হয়ো না।’

তীরন্দাজ বাহিনীর কমান্ডারকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হল। ইতিমধ্যেই সংবাদ এলো, আন্দালুসিয়ার বাহিনী এসে গেছে। তারিক বিন যিয়াদ তাঁর সাথে কয়েক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন।

কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর থিয়োডুমিরের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হল। নিরাপত্তারক্ষীরা থিয়োডুমিরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখে ছিল। তারা উন্নতমানের রণপটু ঘোড়ায় চড়ে এসেছিল।

‘তোমরা কারা? কোত্থেকে এসেছো?’ থিয়োডুমির বুলন্দ আওয়াজে জানতে চাইল। এখানে কি জন্য এসেছ?

‘এই লোক কি বলছে?’ তারিক বিন যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

‘থামুন, ইবনে যিয়াদ!’ জুলিয়ান তারিক বিন যিয়াদকে বললেন। আমিই তার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।’

জুলিয়ান তার ঘোড়া সামনে অগ্রসর করে বুলন্দ আওয়াজে বললেন, ‘জানতে চাচ্ছ, আমরা কে, কোত্থেকে এসেছি, আর কেন এসেছি? শুনে রাখ, আমরা আন্দালুসিয়া দখল করার জন্য এসেছি।’

‘নিমক হারাম!’ থিয়োডুমির হুঙ্কার ছেড়ে বলল। ‘তুই আমাদের করদ-রাজা হয়ে আমাদের রাজ্যে হামলা করতে এসেছিস। তুই কাদেরকে তোর সাথে করে এনেছিস। এরা তোর বাহিনী নয়। তুই ইতিপূর্বে এখানে এসে লুটতরাজ করেছিস। তাই তোর সাহস বেড়ে গেছে। ভেবেছিস, এবারও জান নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবি। এখনও সুযোগ আছে, তোর এই নির্বোধ সৈন্যদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যা। আমার বাহিনীর দিকে তাকিয়ে দেখ, তোর কাছে তো দেখছি, কোন অশ্বারোহীও নেই। আমার বাহিনী তোর বাহিনীর চেয়েও সংখ্যায় দ্বিগুণ।

তারিক বিন যিয়াদকে দোভাষীর মাধ্যমে জুলিয়ান ও থিয়োডুমিরের কথোপকথন তরজমা করে ওনানো হচ্ছিল। তারিক বিন যিয়াদ যুদ্ধের ডঙ্কা বাজাতে বললেন। যুদ্ধের ডঙ্কা বাজার সাথে সাথে তারিক তার বাহিনীকে হামলার নির্দেশ দিলেন।

থিয়োডুমির এই আত্মপ্রশান্তিতে নিমগ্ন ছিল যে, তার নিকট মুসলিম বাহিনীর তুলনায় দ্বিগুণ সৈন্য ও এক হাজার অশ্বারোহী আছে। মুসলিম পদাতিক বাহিনী নারায়ে তাকবীর বলে সামনে অগ্রসর হল।

থিয়োডুমির তার রক্ষী বাহিনীর সাথে পিছে হটে এলো। তার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কোন প্রয়োজন ছিল না। তার বিশ্বাস ছিল, বিজয় তার বাহিনীরই হবে। অপর দিকে তারিক বিন যিয়াদ আক্রমণকারী বাহিনীর সর্বাগ্রে ছিলেন। থিয়োডুমির তার এক হাজার অশ্বারোহীকে পদাতিক বাহিনীর পিছনে রেখে দিল।

উভয় বাহিনী সংঘর্ষে লিপ্ত হল। মুসলিম বাহিনীর জানা ছিল, এই যুদ্ধে তাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। ফিরে যাওয়ার কোন উপায়ই তাদের নেই। তারা নিজ হাতে তাদের রণতরীগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে।

সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের জ্বালাময়ী ভাষণ তাদের প্রাণে নতুন এক আশার সঞ্চার করেছিল। সৈন্যদের সকলেই ছিল উদ্দীপ্ত ও উৎসর্গিতপ্রাণ।

তারিক বিন যিয়াদ অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে প্রচণ্ড বিক্রমে শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি পিছু হটতে বাধ্য হলেন। তার অধীনস্থ কমান্ডারগণও পিছু হটতে লাগলেন।

‘এদেরকে জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে দিওনা।’ ঢাল-তলোয়ারের বিকট আওয়াজ আর আহত সৈনিকদের মর্মবেদী আর্তনাদ ছাপিয়ে থিয়োডুমির হুঙ্কার ছেড়ে বলতে লাগল। এরা পালিয়ে যাচ্ছে, এরা যেন কিছুতেই পালাতে না পারে। এদের পিছু ধাওয়া কর। প্রত্যেককে টুকরো টুকরো করে ফেল।’

তারিক বিন যিয়াদ আরো ক্ষিপ্রগতিতে তার বাহিনী পিছে সরিয়ে আনলেন। শত্রুবাহিনীও ততোধিক ক্ষিপ্রগতিতে পিছু ধাওয়া করে সামনে অগ্রসর হতে লাগল।

তারিক তার বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে ছিলেন। মধ্যভাগের কমান্ড ছিল তাঁর নিজের হাতে। এই অংশের সৈন্যদের দিয়েই তিনি আক্রমণ রচনা করে ছিলেন। এদেরকে নিয়েই তিনি পিছু হটে আসছিলেন। সৈন্যরা দ্রুত পিছু হটে আসছিল। তাদের মুখের ‘নারায়ে তাকবীর’ ধ্বনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিম বাহিনী পিছু হটতে হটতে এমন এক স্থানে এসে পৌঁছল, যেখানে গাছগাছালির আধিক্য ছিল। আর অপর দিকে ছিল উঁচু উঁচু পাহাড়ী টিলার সারি।

আন্দালুসিয়ার বাহিনী যখন মুসলিম বাহিনীকে পিছু ধাওয়া করতে করতে সেই গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত স্থানে এসে পৌঁছল তখন গাছের আড়াল থেকে তাদের উপর তীরবৃষ্টি শুরু হল। টিলার পিছনেও মুসলিম তীরন্দাজরা আত্মগোপন করেছিল। তারাও শত্রুবাহিনীর উপরে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করল।

আন্দালুসিয়ার এই বাহিনীতে পদাতিক সৈন্যদের সাথে অশ্বারোহীও ছিল। তীরন্দাজ বাহিনী একেবারে নিকট থেকে তীর নিক্ষেপ করছিল। তাই তাদের কোন তীরই লক্ষ্য ভ্রষ্ট হচ্ছিল না। প্রতিটি তীরই উদ্দিষ্ট শত্রুর বুকে সমূলে বিদ্ধ হচ্ছিল।

আন্দালুসিয়ার বাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনে তারিক বিন যিয়াদ তীরন্দাজ বাহিনীকে যে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন–এটাই হল তার নিগুঢ় রহস্য। তারিক বিন যিয়াদের নির্দেশমতো তীরন্দাজ বাহিনীর সদস্যগণ পূর্ব থেকে গাছের আড়ালে, টিলার পিছনে ওঁতপেতে ছিল।

তারিক বিন যিয়াদের পিছু হটার উদ্দেশ্য ছিল, শত্রুবাহিনীকে তীরন্দাজদের তীরের নিশানার মধ্যে নিয়ে আসা। তার এই কৌশল সফল হল। পিছু ধাওয়া করে আসা সৈনিকদের সকলেই বেঘোরে মারা পড়ল।

‘ঘোষণা করে দাও, ঘোড়াগুলোকে যেন নিশানা বানানো না হয়। তারিক বিন যিয়াদ নির্দেশ দিলেন। আমাদের ঘোড়ার প্রয়োজন আছে। তবে একজন সওয়ারীও যেন জীবন নিয়ে ফিরে যেতে না পারে।

সুউচ্চ আওয়াজে তারিক বিন যিয়াদের নির্দেশ ঘোষিত হল। থিয়োডুমির তার পদাতিক ও অশ্বারোহীদের করুণ পরিণতি নিজ চোখে অবলোকন করল। তার নিকট তখনও অনেক সৈন্য ছিল।

এদিকে মুসলিম বাহিনীর অন্য দুই অংশের একটি ডাইনে ও অপরটি বায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। থিয়োডুমির একই সাথে তিন বাহিনীর উপর আক্রমণের নির্দেশ দিল। তারিক বিন যিয়াদের পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী ডান পার্শ্ব ও বাম পার্শ্বের বাহিনী আরো পিছু হটে এলো। উদ্দেশ্য হল, রণাঙ্গন যেন প্রশস্ত হয় এবং শত্রুপক্ষ যেন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

বার্বার জাতি ছিল রক্তপিপাসু যোদ্ধা। প্রতিপক্ষের রক্ত ঝড়ানোই ছিল তাদের নেশা। ইসলাম তাদেরকে লড়াই করার জন্য নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। তাদের সামনে তুলে ধরে ছিল জীবনের এক নতুন উদ্দেশ্য। ফলে তাদের লড়াই করার ভঙ্গিই পাল্টে গিয়েছিল। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন :

‘আন্দালুসিয়ার বাহিনীর মাঝে লড়াই করার সেই উদ্যম আর উদ্দিপনা ছিল না, যে উদ্যম আর উদ্দিপনা মুসলিম বাহিনীর মাঝে ছিল। আন্দালুসিয়ার সৈনিকরা বাদশাহর অধীনস্থ চাকর ছিল। তারা বেতন পেয়ে লড়ত, আর বেতন পাওয়ার জন্য বেঁচে থাকতে চাইতো। তাদের বড় বড় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও পাদ্রিরা রাজা-বাদশাহ ও আমীর-উমারাদের মতো বিলাসবহুল জীবন যাপন করত।

আন্দালুসিয়ায় ইহুদি সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক বসবাস করত। কিন্তু খ্রিস্টানরা তাদেরকে গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। ইহুদি নারীদের মান-ইজ্জতের কোন নিরাপত্তা ছিল না। কোন রূপসী ইহুদি মেয়ের প্রতি পাদ্রির কুদৃষ্টি পড়লে তাকে গির্জার সম্পত্তি গণ্য করা হতো। বলা হতো, এই মেয়েকে গির্জার ‘নান বানানো হবে, কিন্তু বাস্তবে তাকে পাদ্রির রক্ষিতা করে রাখা হতো।

উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ধর্মগুরুদের স্বভাব-আচরণ সাধারণ সৈনিকদের মাঝেও মন্দ প্রভাব বিস্তার করেছিল। জেলে ও মাঝিরা একারণেই মুগীস আর-রুমীকে বলেছিল, তাদের রাজ্যের সৈন্যরা কোন সুশ্রী যুবতী মেয়েকে দেখলে জবরদস্তি তাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতো।’

মুসলিম বাহিনী অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে আন্দালুসিয়ার বাহিনীর মোকাবেলা করছিল। তারা সংখ্যায় ছিল অল্প, কিন্তু সুশৃঙ্খল রণকৌশল, আর অসম সাহসিকতার কারণে তারা শত্রুপক্ষের নিকট মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

থিয়োডুমিরের ধারণা ছিল, তার বিশাল বাহিনী অল্প সংখ্যক মুসলিম সৈন্যদেরকে কেটে টুকরো টুকরো করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবে; কিন্তু পিছন দিকের অতর্কিত হামলা থিয়োডুমির বাহিনীর মাঝে কেয়ামতের বিভীষিকা ছড়িয়ে দিল।

তারিক বিন যিয়াদ পূর্বেই এর ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তিনি অশ্বারোহী বাহিনীকে শত্রুপক্ষের পিছনে অবস্থিত টিলাসমূহের মাঝে আত্মগোপন করে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে যে সকল সৈনিক রণাঙ্গন থেকে পিছু হটে এসেছিল, তিনি তাদেরকে ঘুরপথে টিলার আড়ালে অপেক্ষারত অশ্বারোহী বাহিনীর নিকট নিয়ে এলেন। অশ্বারোহী বাহিনীর সদস্য ছিল মাত্র তিনশ’। তিনি পদাতিক ও অশ্বারোহী উভয় বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন, তারা যেন অতি ক্ষিপ্রগতিতে টিলার আড়াল থেকে বের হয়ে আন্দালুসিয়ার বাহিনীর পিছনের অংশে আক্রমণ চালায়।

তারিক বিন যিয়াদের এই যুদ্ধ-কৌশল থিয়োডুমিরের ধারণার অতীত ছিল। তার ধারণা ছিল, তার পিছন দিক নিরাপদ। এই হামলার নেতৃত্ব তারিক বিন যিয়াদ নিজেই দিচ্ছিলেন। তাঁর অন্য দুই সেনাপতি মুগীস আর-রুমী, আর আবু যারু’আ তুরাইফ সম্মুখভাগে আন্দালুসিয়ার বাহিনীর মোকাবেলা করছিলেন। তারা পিছন দিক থেকে তারিকের আক্রমণের অপেক্ষা করছিলেন।

তারিক বিন যিয়াদ তিনশ’ অশ্বারোহী আর প্রায় দুই হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে পিছন দিক থেকে আন্দালুসিয়ার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই আচানক বিপদ সম্পর্কে থিয়োডুমির অবগত হওয়ার পূর্বেই তার বাহিনীর প্রায় দুই হাজার যোদ্ধা মৃত্যুর শিকারে পরিণত হল। আর যারা আহত হল, তাদের ভয়ঙ্কর চিৎকার, আর মর্মভেদী আর্তনাদ অন্যান্য সৈনিকদেরকে হতবিহ্বল করে তুলল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই আন্দালুসিয়ার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। তারা উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটোছুটি করতে শুরু করল। তারিক বিন যিয়াদের প্লান অনুযায়ী মুগীস আর-রুমী, আর আবু যারু’আ তুরাই তাদের বাহিনীকে পূর্বের চেয়ে অধিক বিক্রমে আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন।

আক্রমণের তীব্রতায় দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আন্দালুসিয়ার বাহিনী রণাঙ্গন ছেড়ে ভাগতে লাগল। অশ্বারোহীরা আহত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলে আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করে এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করল।

এ সময় তারিক বিন যিয়াদ নির্দেশ দিলেন, ‘শত্রুপক্ষের ঘোড়াগুলোর যেন কোন ক্ষতি না হয়। ঘোড়াগুলোকে অক্ষত অবস্থায় ধরতে হবে। এগুলো পরবর্তীতে আমাদের কাজে লাগবে।’

মুহুর্মুহু রণহুঙ্কার আর ঢাল-তলোয়ারের ঝনঝনানিতে ভীতসন্ত্রস্ত ঘোড়াগুলো এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করছিল। ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের আঘাতে অনেক পদাতিক সৈন্য নিহত হল।

তারিক বিন যিয়াদের তীরন্দাজ বাহিনী আন্দালুসিয়ার সৈন্যদের জন্য মৃত্যুদূত হয়ে আবির্ভূত হল। তারা এক গাছ থেকে নেমে অন্য গাছে আরোহণ করত, আর একেবারে কাছ থেকে তীর নিক্ষেপ করত।

থিয়োডুমির বাহিনীর শৃঙ্খলা একেবারেই তছনছ হয়ে গেল। সৈনিকরা একজন একজন করে রণাঙ্গন ছেড়ে ভাগতে শুরু করল। কোন সৈনিকই থিয়োডুমিরের নির্দেশের প্রতি ক্ষেপও করল না। তার বাহিনীর প্রায় অর্ধেক সৈন্য মারা পড়ল। কোন সৈনিক যদি আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যেতো তাহলে সেও পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করত।

***

‘মুগীস!’ জুলিয়ান ও আউপাস হন্তদন্ত হয়ে মুগীস আর-রুমীর নিকট এসে বললেন। কয়েকজন জানবাজ যযাদ্ধাকে নির্দেশ দাও, তারা যেন থিয়োর্ভুমিরকে জীবিত গ্রেফতার করে।’

‘রণাঙ্গনের পরিস্থিতি দেখছেন?’ মুগীস বলল। এই পরিস্থিতিতে তার নিকট পৌঁছা সম্ভব নয়।’

‘পাঁচ-ছয়জন বার্বার যোদ্ধা আমাকে দাও।’ আউপাস বলল।

‘আমি আপনাকে আমার বাহিনীর চারজন অশ্বারোহী দিচ্ছি।’ মুগীস আউপাসকে বললেন।

আউপাস চারজন অশ্বারোহী যোদ্ধাকে সাথে নিয়ে চলে গেল।

আন্দালুসিয়ার সেনাবাহিনীর এক সহকারী সেনাপতি থিয়োডুমিরকে লক্ষ্য করে বলল, “থিয়োডুমির, আপনি কি শক্রর হাতে নিহত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন? আমাদের আর কী করার আছে?

‘তুমি কি আমাকে রণাঙ্গন থেকে পলায়নের পরামর্শ দিচ্ছ?’ থিয়োডুমির তার সহকারীকে বলল।

 ‘এখনই পতাকা গুটিয়ে এখান থেকে সরে পড়ন। সহকারী সালার বলল। ‘আমাদের অর্ধেক সৈন্য নিহত হয়েছে। অন্যরা রণাঙ্গন ছেড়ে পলায়ন করছে।

থিয়োডুমির সবকিছুই দেখতে পাচ্ছিল। মুসলমানদের প্রবল বিক্রম আর শৌর্য-বীর্যও সে স্বচক্ষে অবলোকন করছিল। সে খোলা চোখেই দেখতে পাচ্ছিল, কীভাবে মুসলমানরা তাদের তুলনায় দ্বিগুণ সৈন্যের বিশাল বাহিনীর উপর আতঙ্ক ছড়িয়ে তাদেরকে অবলিলায় হত্যা করে চলছে।

থিয়োডুমির নিজেও ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিল। তার বাঁচার একটি মাত্র উপায়ই অবশিষ্ট ছিল, আর তা হল রণাঙ্গন ছেড়ে পলায়ন করা। সে পরিস্থিতির নাযুকতা মেনে নিয়ে পতাকা বাহককে নির্দেশ দিল, পতাকা গুটিয়ে নেওয়ার জন্য। কারণ, উত্তোলিত পতাকা শত্রুপক্ষের নিকট তার অবস্থান চিহ্নিত করছিল।

পতাকা গুটিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে থিয়োডুমিরের অবশিষ্ট সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলল। তারা তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলল। দেখতে দেখতে গোটা রণাঙ্গন লাশের স্তূপে পরিণত হল। যারা আহত হয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, তারা কোন রকমে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। আবার পরক্ষণেই মাটিতে আছড়ে পড়ছিল। যারা উঠে দাঁড়াতে পারছিল না, তারা হামাগুড়ি দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। আন্দালুসীয়দের আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো সেই ভয়ানক দৃশ্য থেকে উদাসী হয়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছিল, আর খড়কুটা কুড়িয়ে খাচ্ছিল।

‘ঘোড়াগুলো ধরে নিয়ে এসো। তারিক বিন যিয়াদ নির্দেশ দিলেন। আর গনিমতের সম্পদ একত্রিত কর।

আন্দালুসিয়ার অভিজ্ঞ জেনারেল থিয়োডুমির রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হল।

***

কয়েকদিন পরের কথা। আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিক জেনারেল থিয়োডুমিরের পলায়নের সংবাদ শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। রডারিক সে সময় রাজধানী টলেডোতে ছিল না। সে তখন পাম্পালুনা শহরে অবস্থান করছিল। পাম্পালুনা রাজধানী টলেডো থেকে কয়েক দিনের দূরত্বে অবস্থিত একটি ছোট্ট শহর। সেখানে জার্মান বংশোদ্ভূত কিছু লোক বসবাস করত। তারা স্থানীয় লোকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, ফলে সেখানকার পরিস্থিতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছিল।

রডারিক বিলাসপ্রবণ ও চরিত্রহীন হলেও যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষের জন্য ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্ক। শক্তিধর শত্রুর উপরও সে বজ্রের ন্যায় হুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত। তার শাহী গাম্ভির্য বিনষ্ট হয় এমন কোন আচরণ সে বরদাস্ত করতে পারত না। বিদ্রোহীদের জন্য সে ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। পাম্পালুনায় বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে কোন জেনারেলকে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ না দিয়ে সে নিজেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল।

বিদ্রোহীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ঠিকই, কিন্তু রডারিকের বিক্রম আর প্রতাপের সামনে তারা একেবারে অসহায় হয়ে পড়ল। যুদ্ধে পরাজিত একজন বিদ্রোহীকেও রডারিক প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে দিল না।

বিদ্রোহীদের লিডারকে গ্রেফতার করা হল। সে আন্দালুসিয়ার অধিবাসী ছিল না। তার কয়েকজন সঙ্গী-সাথীকেও গ্রেফতার করা হল। গ্রেফতারের পর তাদের উপর যে গজব নেমে এসেছিল, তা থেকে তাদের ঘরের নারীরাও বাঁচতে পারেনি। বন্দী বিদ্রোহীদের উপর এমন নির্মম নির্যাতন চালানো হতো যে, তাদের বেঁচে থাকার কোন আশা করা যেতো না। কিন্তু তাদেরকে মরতেও দেওয়া হতো না।

রডারিক তাদেরকে নির্যাতন করে আধমরা করে রাখত। বিদ্রোহীরা যখন রডারিকের অসহনীয় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বেহুঁশ হয়ে পড়ত তখন তাদেরকে এক উন্মুক্ত প্রান্তরে নিক্ষেপ করা হতো। তার পর শহরের অধিবাসীদের সেখানে একত্রিত করে একজন ঘোষকের মাধ্যমে ঘোষণা করা হতো,

এরা রাষ্ট্রদ্রোহী, এরা গাদ্দার, আন্দালুসিয়ার মহামান্য বাদশাহর শৌর্য-বীর্য সম্পর্কে এরা অবগত ছিল না। প্রতিদিন এসে এদের করুণ পরিণতি দেখে যেয়ো। এদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। এরা রাষ্ট্রদ্রোহী এরা গাদ্দার …।

এসকল বিদ্রোহীদের স্ত্রী-কন্যাদের সাথে অত্যন্ত লজ্জাজনক আচরণ করা হতো। রাতের অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে এ সকল নারীদেরকে উলঙ্গ করে রডারিকের সাধারণ মজলিসে নাচতে বাধ্য করা হতো। সামান্য অবাধ্য হলে তাদেরকে চাবুকের আঘাত সহ্য করতে হতো।

রডারিক স্বয়ং সেই মজলিসে উপস্থিত থাকত। সেখানে সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও সেনা অফিসাররাও উপস্থিত থাকত। এ সকল লোকেরা নির্যাতিতা মহিলাদের সাথে অশোভন আচরণ করত, আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত। অবশেষে মদ খেয়ে উন্মাদ হয়ে সকল অফিসারই একজন করে মহিলাকে ধরে নিয়ে যেতো।

ঐতিহাসিক ওয়েলম্যাকার ‘উসতোরিয়া নামক এক অল্প বয়স্কা বালিকার ঘটনা সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি লেখেছেন,

‘উসতোরিয়ার বয়স তখন চৌদ্দ কি পনের হবে। সে ছিল বিদ্রোহীদের সরদারের কন্যা। এই অল্প বয়স্কা বালিকাকে রডারিক নিজের জন্য রেখে দিয়েছিল। সে তার সাথে এমন পাশবিক আচরণ করত যে, বনের পশুরাও লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিত। পাম্পালুনার যে স্থানটিতে সে ছাউনি গেড়ে ছিল সেখান থেকে প্রায়ই সেই অল্প বয়স্কা বালিকার মরণচিত্তার শুনা যেতো।

***

কিছুক্ষণ হয় সূর্য অস্ত গেছে। রাতের অন্ধকার অতিদ্রুত যুদ্ধ বিধ্বস্ত পালুনাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। রোজকার মতো আজও সাধারণ মজলিসের আয়োজন জমকালোরূপ ধারণ করছিল। বিদ্রোহীদের স্ত্রী-কন্যাদেরকে উলঙ্গ অবস্থায় নাচতে বাধ্য করা হচ্ছিল। অল্প বয়স্কা উসতোরিয়াকে রডারিক তার কোলে বসিয়ে রেখেছিল। উপস্থিত সকলের হাতেই ছিল পানপাত্র। দাস-দাসীরা সূরাহী হাতে শরাব পরিবেশন করছিল। এমন সময় রডারিককে সংবাদ দেওয়া হল, টলেডো থেকে থিয়োডুমিরের বার্তাবাহক এসেছে। সে এখনই রডারিকের সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়।

রডারিকের ইঙ্গিতে বার্তাবাহককে তার সামনে এনে দাঁড় করানো হল। বার্তাবাহক লিখিত ফরমান তার নিকট সোপর্দ করল। সে তার এক সভাসদকে বলল, বার্তাটি পড়ে শুনানোর জন্য। আর অন্যদের লক্ষ্য করে সে তালি বাজাল। সাথে সাথে সেখানে এমন পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেল যে, মনে হল সেখানে কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই।

সভাসদ বার্তাটি পড়তে লাগল, ‘আন্দালুসিয়ার মহামান্য শাহানশাহের দরবারে শত সহস্র ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, মহানুভবের এই অধম গোলাম আজীবন শাহীখান্দানের মান-মর্যাদা ও রাজত্বের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। এই অধম সকল যুদ্ধেই বিজয়ের মালা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সভাসদ কিছুটা উচ্চ আওয়াজে বার্তাটি পড়ে শুনাচ্ছিল।

‘যেখানেই বিদ্রোহীরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, শাহীখান্দানের এই আজ্ঞাবাহী গোলাম সেখানেই মৃত্যুদূত হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। সে বিদ্রোহীদেরকে জীবনের পরপারে পৌঁছে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে। অতিবড় নিন্দুকও বলতে পারবে না যে, থিয়োডুমির কোন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু তারা হয়তো কোন জিন-ভূত হবে। তারা আমার অর্ধেক সৈন্যকে হত্যা করেছে, আর বাকি অর্ধেক তাদের ভয়ে রণাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

 ‘তুমি ঠিক পড়ছ তো? রডারিক তার কোলে বসিয়ে রাখা মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। অর্ধেক সৈন্য নিহত হয়েছে, আর অন্যরা পালিয়ে গেছে, কী আবোল-তাবোল পড়ছ? তারা জিন-ভূত ছিল! ভালো করে পড়।’

সভাসদ পুনরায় পড়তে শুরু করল,

 ‘তারা চারটি বিশাল আকৃতির রণতরীতে করে এসেছিল। সমুদ্রসৈকতে অবতরণ করামাত্রই তারা সেগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ আমাকে সংবাদ দেওয়া হয়। আমি আমার সকল সৈন্য নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। শত্রুবাহিনীর সংখ্যা আমার বাহিনীর অর্ধেক ছিল। সংখ্যাধিক্যের কথা বিবেচনা করলে আমার সৈন্যদের উচিত ছিল, তাদেরকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা। কিন্তু তারা এমন সুশৃঙ্খলভাবে লড়াই করছিল যে, আমার সৈন্যরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

তারা গাছের আড়াল থেকে, পাথরের আড়াল থেকে অনরবত তীর নিক্ষেপ করে চলছিল। তাদের একটি তীরও লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল না। তাদের একজন অশ্বারোহী দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না; কিন্তু হঠাৎ পিছন দিক থেকে তাদের অশ্বারোহীরা আমার বাহিনীর উপর আক্রমণ করে বসে। তারা আমাদের উপর এমন চূড়ান্ত আঘাত হানে যে, আমরা তাদের আঘাত প্রতিহত করে পিছু হটে আসার মতো কোন অবকাশই পাইনি।’

বিয়োডুমির তার এই পত্রে পরাজয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার পর এমন একটি তথ্য উল্লেখ করে, যা আজও ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত হয়ে আছে। সে লেখেছে :

‘এটা জানা সম্ভব হয়নি যে, এরা কারা? আর কোথা থেকেই বা এসেছে? তারা যেই হোক, আর যেখান থেকেই আসুক, বাস্তব সত্য হল, তারা অত্যন্ত রক্তপিপাসু ও ভয়ঙ্কর এক জাতি। হতে পারে তারা দস্যুবাহিনী, লুটতরাজ করাই তাদের কাজ। লুটতরাজ শেষে হয়তো তারা তাদের রাজ্যে ফিরে যাবে; কিন্তু এখানেই তাদেরকে নিঃশেষ করে দেওয়া উচিত। আমার সৈন্যসংখ্যা তাদের দ্বিগুণ ছিল। এখন আমার আরো বেশি সৈন্যের প্রয়োজন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, আমাদের করদ-রাজা সিউটার জুলিয়ান, আর অর্টিজার ভাই আউপাসও এই অদ্ভুত বাহিনীর সাথে আছে।

‘জুলিয়ান! রডারিক অবাক হয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বলল। উপাস! মৃত্যু তাদেরকে এখানে টেনে এনেছে। আমি বুঝতে পেরেছি।

রডারিক রাগে-গোসায় লম্বা লম্বা পা ফেলে কামরার এক কোণ থেকে আরেক কোণে পায়চারী শুরু করল।

‘থিয়োডুমির কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে। রডারিক দাঁত কিড়মিড় করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। আক্রমণকারী কারা–এটা দেখার মতো হুঁশও তার ছিল না। জুলিয়ান আর আউপাস আমার থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এসেছে। তাদের নিজস্ব বাহিনীর সাথে তারা বার্বারদেরকেও হয়তো নিয়ে এসেছে। থিয়োড়িমিরের সাহায্যে সেখানে আমি আর কোন সৈন্য পাঠাব না। আমি নিজেই ওখানে যাব। জুলিয়ানের মেয়ে ফ্লোরিডারকে আমার মহলে নিয়ে আসব। এসব বদনসিবদের জানা নেই, আমি গাদ্দারীর কী শাস্তি দিয়ে থাকি?’

রডারিক হঠাৎ নীরব হয়ে বিদ্রোহীদের উলঙ্গ স্ত্রী-কন্যাদের দিকে ফিরে তাকাল। তারপর কঠিনম্বরে নির্দেশ দিল, ভোর হওয়ার সাথে সাথে এ সকল বিদ্রোহীদেরকে ময়দানে জড়ো করে তাদের উপর ঘোড়া ছুটিয়ে দাও। ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট করে এদেরকে মেরে ফেল। আর মেয়েদেরকে এখানকার গির্জার পাদ্রির নিকট সোপর্দ কর।’

রডারিকের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সকল মেয়েরা আহাজারী শুরু করে দিল। দুই-তিনজন রডারিকের পা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল। আপনি আমাদেরকে অনেক শাস্তি দিয়েছেন। এবারের জন্য আমাদেরকে মাফ করেদিন।’

‘বাদশাহ সালামত। আমার বাবার অপরাধের শাস্তি আমাকে কেন দিচ্ছেন? একটি যুবতী মেয়ে মিনতিভরা কণ্ঠে বলল। আমার বাবার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি তো কিছুই জানতাম না। আমাকে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট করে মেরে ফেলুন, তবুও আমাকে পাদ্রিদের হাতে সোপর্দ করবেন না।’

আরেকটি মেয়ে বলল, ‘আমার ভাইকে ছেড়ে দাও, তার পরিবর্তে আমাকে মেরে ফেলো।

রডারিক সকলকে লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দিল।

‘আন্দালুসিয়ার বাদশাহ! আমাদের উপর আরও বেশি করে জুলুম কর।’ অল্প বয়স্কা উসতোরিয়া চিৎকার করে বলল। তোমার পাপের বোঝা আরো রি করে নাও। আমাদের লোকদের উপর ঘোড়া ছুটিয়ে দাও। তোমার যা ইচ্ছা তুমি তাই করে নাও। তবে এক অসহায় মেয়ের আর্তনাদ শুনে রাখো, তোমার এই বাদশাহীর উপরও একদিন ঘোড়া দৌড়ানো হবে। তোমার নাম-নিশানাও সেদিন অবশিষ্ট থাকবে না। তোমার আর তোমার বাদশাহীর দিন শেষ হয়ে এসেছে।

 ‘সাব্বাস!’ রডারিক অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠল। আমি তোমার সাহসিকতার প্রশংসা করছি। তুমি এক বিশাল সাম্রাজ্যের বাদশাহকে ভয় পাওনি। কাছে এসো মেয়ে! আমি তোমাকে পুরস্কৃত করব।’

মেয়েটি রডারিকের সামনে এসে দাঁড়ালো।

 ‘লোকদের দিকে মুখ ফিরাও। রডারিক বলল। সকলেই দেখুক, এই মেয়ে কতটা সাহসী?

মেয়েটি রডারিকের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো। রডারিকের সভাসদবর্গ তাকে দেখতে পাচ্ছিল। রডারিকের তরবারী তার শাহীকুরসির পাশেই রাখা ছিল। সে হঠাৎ তরবারী কোষমুক্ত করে পিছন দিক থেকে এক আঘাতে মেয়েটির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল।

মুণ্ডহীন দেহটি কিছুক্ষণ ছটফট করতে থাকল। তার পর চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পরদিন সকালে বিদ্রোহীদেরকে ময়দানে এনে একত্রিত করা হল। তাদের বিপরীত দিকে পঞ্চাশ-ষাটজন ঘোড়সওয়ার দাঁড়িয়ে ছিল। ইঙ্গিত পাওয়ার সাথে সাথে অশ্বারোহীরা বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল। বিদ্রোহীরা আত্মরক্ষার জন্য এদিক-সেদিক দৌড়াতে লাগল। অশ্বারোহীরাও তাদের পিছু নিয়ে ঘোড়ার গতি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তাদেরকে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট করে হত্যা করে ফেলল।

***

উত্তর আফ্রিকার রাজধানী কায়রোয়ান। মিসরের আমির মুসা বিন নুসাইর তাঁর পরিষদবর্গকে নিয়ে কায়রোয়ানে এক জরুরি মিটিংয়ে বসেছেন। তিনি তারিক বিন যিয়াদের পয়গাম পাঠ করে তাদেরকে শুনাচ্ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ প্রথম যুদ্ধ জয়ের কথা উল্লেখ করে লেখেছেন :

 ‘আল-হামদুলিল্লাহ্! আমরা আমাদের চেয়েও দ্বিগুণ সৈন্যবাহিনীর উপর প্রথম যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি। আমাদের তিনশ অশ্বারোহীর মোকাবেলায় তাদের এক হাজার অশ্বারোহী ছিল। আন্দালুসিয়ার প্রতিটি সৈন্যের মাথায় লৌহনির্মিত শিরস্ত্রান ছিল। তাদের অস্ত্রসস্ত্র আমাদের হাতিয়ারের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। আল্লাহ তাআলার প্রত্যক্ষ মদদে আমরা বিজয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছি।

আমি তীরন্দাজ বাহিনীকে গাছগাছালি ও পাহাড়ের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকার নির্দেশ দেই। আর অশ্বারোহীদেরকে পাহাড়ী টিলার পিছনে পালিয়ে থাকতে বলি। অতঃপর পশ্চাৎপসারণের ছলে শক্র বাহিনীকে সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দিয়ে তাদেরকে মরণফাঁদের দিকে টেনে নিয়ে আসি। তারা আমাদের ফাঁদে পা দেওয়ার সাথে সাথে আমাদের তীরন্দাজ বাহিনী তাদের উপর তীরবৃষ্টি শুরু করে দেয়। তীরন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় শত্রুবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।

এমন সময় ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’র মতো আমাদের আত্মগোপন করে থাকা অশ্বারোহী বাহিনী পিছন দিক থেকে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনি সুপরিকল্পিত আক্রমণের ফলে সাত হাজার মৰ্দেমুজাহিদ পনের হাজার কাফেরের উপর বিজয় লাভ করতে সক্ষম হয়।

রণাঙ্গনের যে বিজয়-দৃশ্য আমি দেখেছি, সম্মানিত আমীর সে দৃশ্য দেখলে আপনি আনন্দিত হতেন। খলীফাতুল মুসলিমীন ওলিদ বিন আবদুল মালেক সে দৃশ্য দেখলে অভিভূত হতেন। শত্রু পক্ষের এতো অধিক সংখ্যক যোদ্ধা মারা পড়েছে যে, তাদের লাশ গুনে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। যুদ্ধবন্দীরা সেসব লাশ উঠিয়ে সমুদ্রে নিক্ষেপ করছে। খানা-খন্দকগুলো লাশে পরিপূর্ণ করে তার উপর মাটি ফেলে সমতল করা হয়েছে। তারপরও লাশের সংখ্যা কমছে না। চতুর্দিকে শুধু লাশ আর লাশ। যুদ্ধলব্ধ ছয়শত ঘোড়া আমাদের হস্তগত হয়েছে। নিহত শত্রু সেনাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসস্ত্রও আমরা জমা করেছি।

এখন সামরিক সাহায্যই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। আমার নিকট সংবাদ পৌঁছেছে যে, আন্দালুসিয়ার সৈন্যসংখ্যা অনেক বেশি। সামনের প্রতিটি শহরই দুৰ্গসদৃশ। আমি সামনে অগ্রসর হচ্ছি, তবে সেনা-সাহায্যের অপেক্ষায় আছি। আমাদের সফলতার জন্য দুআ করবেন। আমরা যদি পরাজিত হই তাহলে আর ফিরে আসব না। কেননা, ফিরে আসার কোন উপায়ই আমাদের নিকট অবশিষ্ট নেই। যে চারটি রণতরীতে আরোহণ করে আমরা এসেছিলাম, সেগুলো আমি আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছি।’

 ‘সাব্বাস! মুসা বিন নুসাইর অবচেতন মনে বলে উঠলেন। এই ব্যক্তিকে কোন শক্তিই পরাস্ত করতে পারবে না।’

মুসা বিন নুসাইর তৎক্ষণাৎ খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেকের উদ্দেশ্যে একটি পয়গাম লেখান, তাতে তিনি তারিক বিন যিয়াদের প্রথম সফলতার পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরেন এবং সেনাসাহায্য পাঠানোর অনুরোধ করেন।

.

***

পাম্পালুনায় রডারিকের নির্দেশে ঘোষণা করা হল যে, আন্দালুসিয়ায় একটি ভিনজাতি অনুপ্রবেশ করেছে। তারা এতটাই হিংস্র ও রক্তপিপাসু যে, তারা তাদের থেকে দ্বিগুণ সৈন্যবাহিনীকে কেটে টুকরো টুকরো করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে।

রডারিক স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে বহিঃশত্রু সম্পর্কে ভীতি ছড়ানোর নির্দেশ দেয়। সে জনসাধারণকে এই বলে সতর্ক করে দিতে বলে যে; এই লুটেরা বাহিনী তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের কন্যা সন্তানদেরকে নিয়ে যাবে। আর তোমাদেরকে হত্যা করে তোমাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে।’

নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে সরকারি বার্তাবাহকরা গ্রাম-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে সর্বত্র এই সংবাদ পৌঁছে দিতে লাগল। রাজধানী টলেডোতেও এই সংবাদ এসে পৌঁছল। প্রত্যেক গির্জায়, প্রতিটি জনসমাগম স্থলে এবং সকল চায়ের আসরে এই একই বার্তা ঘোষিত হতে লাগল।

‘হে লোক সকল! অজানা এক রাজ্য থেকে লুণ্ঠনকারী ও হত্যাকারীদের বিশাল এক বাহিনী আমাদের রাজ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা আমাদের এক বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করেছে। প্রলয়ঙ্করি ঝড়ের ন্যায় তারা সম্মুখ দিকে অগ্রসর হয়ে চলছে। তারা জবরদস্তি ঘরে প্রবেশ করে স্বর্ণ-অলঙ্কার-টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিচ্ছে। যুবতী মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হত্যা ও লুণ্ঠনের পর ঘর-বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। উপাসনালয় ধ্বংস করে ফেলছে। তারা এতটাই নিষ্ঠুর যে, নিষ্পাপ শিশুদেরকে বর্ষাবিদ্ধ করে উদ্দাম নৃত্য করে, আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।’

আন্দালুসিয়ার মহামান্য বাদশাহ এই ভয়ঙ্কর বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধে রওনা হয়েছেন। বাদশাহ রডারিক বলেছেন, যে ব্যক্তি তীর ও বর্ষা নিক্ষেপ করতে পারে এবং তরবারী চালাতে পারে, সে যেন সৈন্যবাহিনীতে অংশগ্রহণ করে। যে সৈন্যবাহিনীতে অংশগ্রহণ করবে তাকে বেতন-ভাতা দেওয়া হবে। তাকে লুটেরাদের থেকে উদ্ধারকৃত সম্পদের অংশীদার করা হবে। সবচেয়ে বড় পাওনা হল, আমাদের জান-মাল ও ঘর-বাড়ি নিরাপদ থাকবে এবং আমাদের স্ত্রী-কন্যাদের সতীত্ব সংরক্ষিত হবে।

হে লোক সকল! তোমরা প্রস্তুত হয়ে যাও, অস্ত্র ধর, তোমাদের ধন-সম্পদ লুটেরাদের হাত থেকে রক্ষা কর। আর যদি তোমরা এজন্য প্রস্তুত না হও তাহলে আজই বাল-বাচ্চা নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যাও। দুর্বল পশুর ন্যায় পালিয়ে পালিয়ে দিন অতিবাহিত কর। পরে যখন ফিরে আসবে তখন তোমাদের ঘর-বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।’

যুবক শ্রেণী ও মধ্যবয়স্ক পুরুষরা ভিনদেশী শত্রুদের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। তাদেরকে বলা হল, বাদশাহ রডারিক পাম্পালুনা থেকে অমুক রাস্তা দিয়ে টলেডো যাচ্ছেন। সৈন্যবাহিনীতে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক লোকেরা যেন সেই রাস্তায় বাদশাহর আগমনের অপেক্ষা করে।

***

কোন কোন উপাসনালয় থেকে এ জাতীয় কোন ঘোষণাই প্রচার করা হল। এগুলো ছিল ইহুদিদের উপাসনালয়। এ সকল উপাসনালয়ের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। আন্দালুসিয়ায় ইহুদিরা ছিল সবচেয়ে নির্যাতিত। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কারিগরি বিদ্যায় ইহুদিদের একচেটিয়া প্রভাব ছিল। কিন্তু কোন অর্থ-সম্পদ তাদের ছিল না। তাদের থেকে এত বেশি টেক্স ও রাজস্য আদায় করা হতো যে, পেট ভরে খাওয়ার জন্য তাদের নিকট খুব সামান্য উপার্জনই অবশিষ্ট থাকত। আন্দালুসিয়ায় ইহুদিদেরকে অশ্বাস্য মনে করা হতো।

অর্টিজা যখন আন্দালুসিয়ার বাদশাহ ছিলেন তখন ইহুদি ও খ্রিস্টানরা সমান মর্যাদার অধিকারী ছিল। তিনি ইহুদিদের টেক্স কমিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার এক আদেশের মাধ্যমে এই কালো আইনও নিষিদ্ধ করে দেন যে, জবরদস্তি ইহুদি সুন্দরী মেয়েদেরকে গির্জায় সোপর্দ করা যাবে। শুধু ইহুদিদের জন্যই নয়, বরং জনসাধারণের জন্যও অর্টিজা জীবন যাপনের মান অনেক উন্নত করেছিলেন।

অর্টিজার এই সংস্কারনীতি ও জনসাধারণের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভূতিই তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও পাদ্রিদের সহায়তায় রডারিক অর্টিজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সে আন্দালুসিয়ার সিংহাসন দখল করে বাদশাহ বনে বসে। রডারিক বাদশাহ হওয়ার সাথে সাথে অর্টিজাকে হত্যার নির্দেশ দেয়।

ভিনদেশী শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ফলে যখন প্রতিটি পাড়া ও মহল্লায় ঘোষণা করা হচ্ছিল, ভিনদেশী হানাদার বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান করুন তখন ইহুদি উপাসনালয়গুলোতে ভিন্ন ধরনের চিন্তা-ভাবনা চলছিল। একদিন ইহুদিদের পাঁচ-ছয়জন ধর্মগুরু এক উপাসনালয়ে একত্রিত হয়ে ভাবতে লাগল, কীভাবে ইহুদিদেরকে সৈন্যবাহিনীতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা যায়। তারা যে কোন মূল্যে রডারিককে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকতে চাচ্ছিল।

‘রডারিকের বাহিনীতে শামিল হওয়াই প্রধান সমস্যা নয়। ইহুদিদের এক ধর্মগুরু বললেন। বরং এ ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত যে, কীভাবে আমরা রডারিকের ক্ষতিসাধন করতে পারি।’

‘সেনাবাহিনীতে তো পূর্ব থেকেই ইহুদি সৈন্য রয়েছে। অন্য জন বললেন। ‘তাদেরকে সেনাবাহিনী থেকে কীভাবে বের করা যায়–এ ব্যাপারে চিন্তা করা হোক।

‘আমি ভিন্ন কিছু চিন্তা করছি।’ আরেকজন বলল। ইহুদি সৈনিকদেরকে সেনাবাহিনীতেই থাকতে দেওয়া হোক এবং তাদেরকে রডারিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হোক।

‘এটা কি জানা গিয়েছে যে, আক্রমণকারী কারা? ধর্মগুরুদের মধ্যে অন্য আরেকজন জিজ্ঞেস করলেন।

‘এটা এখনও কেউ বলতে পারছে না। তাদের একজন উত্তর দিলেন।

প্রশ্নকারী পুনরায় বললেন, ‘আক্রমণকারীদের পরিচয় জানা গেলে আমি তাদের সাথে মিলে বড় সুন্দর একটা নীলনকশা তৈরি করতে পারতাম।

ইহুদি মস্তিষ্ক ষড়যন্ত্র পাকানোর জন্য অতি উর্বর ক্ষেত্র। পর্দার অন্তরালে থেকে আঘাত হানতে তারা এতটাই পারঙ্গম যে, অন্য কোন সম্প্রদায়ের পক্ষে সেই পারঙ্গমতা প্রদর্শন করা একেবারেই অসম্ভব।

সমবেত এই ধর্মগুরুগণ–যাদেরকে রব্বানী বলা হতো–এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, প্রত্যেক ইহুদির ঘরে এই সংবাদ পৌঁছে দেওয়া হবে, যেন কোন ইহুদি রডারিকের বাহিনীতে যোগদান না করে।

এই সিন্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা নিয়ে সেদিনের মতো ধর্মগুরুদের পরামর্শসভা মুলতবি ঘোষণা করা হল।

***

মেরিনা এক মধ্যবয়সী নারী। তার যৌবনে ভাটার টান ধরেছে, কিন্তু তার লম্বা শারীরিক গঠন আর অতুলনীয় দেহ-সৌষ্ঠব অনেক নারীর জন্য ঈর্ষার কারণ ছিল। তার চেহারার আকর্ষণীয় রূপ-লাবন্যের মাঝে তখনও এমন জাদুকরী প্রভাব ছিল যে, তার চোখের রহস্যময় চাহনি যে কোন পুরুষের মন কেড়ে নিতো।

মেরিনা কোন সাধারণ মেয়ে মানুষ নয়। সে শাহীমহলের একজন বেগম হিসেবে পরিগণিত হতো। সে রডারিকের স্ত্রী ছিল না, ছিল রক্ষিতা। সেই ছিল একমাত্র রক্ষিতা, যে মধ্যবয়স্কা হওয়া সত্ত্বেও শাহীমহলেই অবস্থান করত।

শাহীমহলের যে সকল রক্ষিতার বয়স ত্রিশ বছরের নিকটবর্তী হতে তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হতো অথবা কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে উপহার হিসেবে প্রদান করা হতো।

মেরিনা ছিল ইহুদি। অন্যান্য ইহুদিদের মতো তার মস্তিষ্কও ছিল ষড়যন্ত্রের উর্বর ক্ষেত্র। সে ছিল অতুলনীয় রূপের অধিকারিনী, আর তীক্ষ্ণ মেধা ও সূক্ষ্ম বিবেক-বুদ্ধির মালিক। এ কারণে শাহীমহলে সে এক বিশেষ সম্মানের অধিকারিনী ছিল। রানী না হয়েও সে রাজরানীর মতো সম্মানের পাত্রী ছিল। সে তার চোখের চাহনি, আর ঠোঁটের দুই হাসিতে রডারিককে তার অনুরাগী করে রেখেছিল।

টলেডোর শাহীমহল থেকে এক-দেড় মাইল দূরে একটি ঝিল ছিল। সেই ঝিলের চতুর্দিকে ছিল ঘন বৃক্ষরাজি। ঝিলের এক পার্শ্বে সজুজ পত্র-গুলো আচ্ছাদিত একটি টিলাও আছে। কোন পুরুষের এই ঝিলের নিকটবর্তী হওয়ার অনুমতি ছিল না। এটি শাহীমহলের প্রমোদবালাদের জন্য নির্ধারিত ছিল। সাঁঝের বেলায় তারা সেখানে জলকেলি খেলতে ও নৃত্য-গীত করতো।

একদিন সাঁঝের বেলা। তখনও সূৰ্য্য অস্ত যায়নি। পঁচিশ-ত্রিশজন অপরূপ রূপসী রমণী ঝিলের মধ্যে জলকেলি খেলছিল, আর হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের শরীরে গড়িয়ে পড়ছিল। তাদের মধ্যে যুবতী মেয়েও আছে, মধ্যবয়স্ক নারীও আছে। এটাই হল এখানকার সাধারণ চিত্র। এ সকল রমণীর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল মেরিনার উপর। সেই সন্ধ্যায় মেরিনাও সেখানে উপস্থিত ছিল।

ঝিল থেকে সামান্য দূরে ঘন বৃক্ষরাজির আড়ালে রমণীদের ঘোড়াগাড়ি রাখা আছে। কোচোয়ানদের সকলেই পুরুষ। একজন কোচোয়ান দেখতে পেল বাগানবাড়ির সীমানায় একজন অপরিচিত লোক প্রবেশ করেছে। কোচোয়ান তাকে ইঙ্গিতে সামনে অগ্রসর হতে নিষেধ করল। কিন্তু লোকটি বাধা উপেক্ষা করে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। কোচোয়ান তাকে বাধা দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। সে রাস্তা পরিবর্তন করে ঝিলের দিকে তার গতি বাড়িয়ে দিল। কোচোয়ান তার নিকট পৌঁছার আগেই সে ঝিলের নিকট পৌঁছে গেল। কোচোয়ান দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলল।

আগন্তুক তার মুখমণ্ডল চাদর দ্বারা ঢেকে রেখেছিল। শুধু চোখ দেখা যাচ্ছিল। সে চটের দ্বারা তৈরি লম্বা জুব্বা পরে ছিল। কোচোয়নি তাকে ধরার সাথে সাথে সে চিৎকার করতে শুরু করল। অদূরে জলকেলিরত রমণীদের কানে চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছলেও তারা সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ করল না। তারা আনন্দ-ফুর্তি আর উচ্ছলতায় বিভোর হয়ে রইল।

মেরিনার দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হল। সে কাপড় পাল্টিয়ে আওয়াজ লক্ষ্য করে অগ্রসর হল। অগ্রসর হয়ে সে দেখতে পেল, কয়েকজন কোচোয়ান পাগল মতো দেখতে এক ব্যক্তিকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর সে ব্যক্তি অদ্ভুতভাবে চিৎকার করছে।

মেরিনাকে দেখতে পেয়ে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তারপর ঐ তো রানী এসে গেছে বলে সজোরে কোচোয়ানদেরকে ধাক্কা মেরে মেরিনার দিকে দৌড়ে গেল। কোচোয়ানরা তার পিছনে দৌড় লাগাল। সে অতি দ্রুতগতিতে মেরিনার নিকট পৌঁছে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ল। মেরিনা দু-এক পা পিছে সরে এলো।

‘মেরিনা!’ আগন্তুক মাথা উঠিয়ে বলল। আমি আউপাস, তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।’

ইতিমধ্যে কোচোয়ানরা সেখানে পৌঁছে গেল। তারা তাকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল।

থামো, মেরিনা কোচোয়ানদেরকে লক্ষ্য করে বলল। বেচারা পাগল মানুষ, কারো কোন ক্ষতি করবে না; তোমরা চলে যাও।’

‘আমি পাগল নই, রানী! আউপাস করুণ কণ্ঠে বলল। আমি মাজলুম, ফরিয়াদি হয়ে আপনার নিকট এসেছি।’

***

রডারিক যখন বিদ্রোহের মাধ্যমে বাদশাহ অর্টিজাকে সিংহাসনচ্যুত করে হত্যা করে তখন অর্টিজার ভাই আউপাসের বয়স ছিল সতের বা আঠার। আর মেরিনার বয়স ছিল ষোল।

মেরিনা এক ইহুদি ব্যবসায়ীর মেয়ে। আউপাস তাকে এক পলকের জন্য দেখেই তার হৃদয়-মন্দিরে ঠাই দিয়েছিল। কিন্তু মেরিনা নিজেকে আউপাসের যোগ্য মনে করত না। সে তার ভালোবাসা গ্রহণ করতে ভয় পেতো। তাই সে একদিন আউপসিকে বলেছিল,

‘ক্ষণিকের এই মোহকে ভালোবাসা বলছ কেন? আমি এক ইহুদি কন্যা, তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত শাহীখান্দানের সুলোপ দৃষ্টি থেকে কীভাবে বেঁচে আছি–তা আমি নিজেও জানি না। তুমি তোমার গোলামদেরকে হুকুম করলেই তো পার। তারা আমাকে জবরদস্তি তোমার স্বপ্নপুরিতে পৌঁছে দেবে। তুমি রাজপুত্র, তুমি বর্তমান বাদশাহর ভাই; ভবিষ্যৎ বাদশাহ। তোমাকে বাঁধা দেয়–এমন ক্ষমতা কার আছে?

‘কেন, তুমি কি জান না? শাহীখান্দানের লুলোপ দৃষ্টি থেকে তুমি কেন এখনও বেঁচে আছ?’ আউস বলল। “তোমার কি জানা নেই, আমার ভাই সিংহাসনে আরোহণ করার পরই এ নির্দেশ জারি করেছেন যে, ইহুদি কোন কন্যাকে জবরদস্তি কোন গির্জায় বা শাহীখান্দানের কোন সদস্যের গৃহে অর্পণ করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এ নির্দেশ অমান্যকারীদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।

আমি তোমাকে এ জন্য শাহীমহলে নিয়ে যাব না যে, আমি বাদশাহর ভাই, আর তুমি একজন সাধারণ ইহুদির কন্যা। আমি সেদিনই তোমাকে শাহীমহলে নিয়ে যাব যেদিন আমি তোমাকে পবিত্র গির্জায় নিয়ে গিয়ে বিবাহ করতে পারব। মেরিনা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। যত দিন আমার এ স্বপ্ন পূরণ না হবে তত দিন শাহীমহলের বাহিরে আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব।’

মেরিনার হৃদয়েও আউপাসের জন্য ভালোবাসা জন্মেছিল। এর পর থেকে তারা দুজন শাহীমহলের বাহিরে দেখা-সাক্ষাৎ করতো। একদিন আউপাসের ভাই বাদশাহ অর্টিজা তাদের এ দেখা-সাক্ষাৎ সম্পর্কে জানতে পারলেন। তিনি আউপাসকে ডেকে বললেন,

‘তোমার কি এতটুকু অনুভূতিও নেই যে, তুমি শাহীখান্দানের একজন সদস্য? কে সেই মেয়ে, যার সাথে তুমি প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ কর।

সে এক ইহুদির মেয়ে। আউপাস বিনীত স্বরে বলল। আমাদের এ সম্পর্ক দৈহিক নয়। আমি যখন তার সাথে সাক্ষাৎ করি তখন আমি নিজেকে বাদশাহর ভাই মনে করি না।’

 ‘না, তুমি কেবল সেই মেয়ের সাথেই মেলামেশা করবে, যার সাথে আমরা তোমাকে বিবাহ দেব বলে স্থির করেছি।’ অর্টিজা বললেন। আর তুমি ভালোভাবেই জান, আমরা কার সাথে তোমার বিবাহ ঠিক করেছি।’

‘যে মেয়ের সাথে আপনারা আমার বিবাহ ঠিক করেছেন, আমি সেই মেয়ের সাথে মেলামেশা করব না। আউপাস বিনীত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলল। আমি সেই ইহুদি মেয়েকেই বিবাহ করব।’

‘তা হলে তুমি এই শাহীমুকুট, আর এই শাহীসিংহাসন থেকে বঞ্চিত হবে। অর্টিজা ক্রুদ্ধস্বরে বললেন। তুমি হয়তো ভুলে গেছ, আমার পর তুমিই হবে এই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। তোমার রানী হবে গোথ বংশীয়া। সে কোন ইহুদি-কন্যা হতে পারবে না।’

‘আমি রাজমুকুট ও রাজসিংহাসনের দাবি পরিত্যাগ করব।’ আউপাস অবিচল কণ্ঠে বলল। ‘তবুও আমি মেরিনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।’

অর্টিজা হলেন বড় ভাই। তিনি বাদশাহও ছিলেন। তাই বংশীয় মান-মর্যাদা ও শাহীদরবারের প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা বিবেচনা করে তিনি আউপাসকে নির্দেশ দিলেন, আইপাস যেন মেরিনার সাথে মেলামেশা না করে। তার নির্দেশ অমান্য করে সে যদি মেরিনার সাথে মেলামেশা করে তাহলে তাকে কয়েদখানায় বন্দী করে রাখা হবে। কিন্তু আউলাস বড় ভাইয়ের হুমকির কোন পরোয়া না করে সে তার শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে দিল। সে বলল, ‘আমি মেরিনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।

এ ঘটনার কয়েকদিন পর আউপাসের সাথে মেরিনার সাক্ষাৎ হলে মেরিনা আউপাসকে বলল, ‘শহীদরবারের এক লোক বাবাকে বলেছে, বাবা যেন আমাকে শাহীখান্দানের কোন ব্যক্তির সাথে দেখা করতে না দেয়। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে যেন বিয়ে দেওয়া হয়।

অর্টিজা ছিলেন বাদশাহ। সামান্য এক ইহুদি-কন্যা তার শাহী সম্ভ্রমবোধে আঘাত হানবে–এমন মেয়েকে শেষ করে দেওয়া তার জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু অর্টিজা ছিলেন এক মহানুভব বাদশাহ। সকল মানুষই তার নিকট সমান মর্যাদার অধিকারী। তিনি তার স্বভাব-বিরুদ্ধ কোন পদক্ষেপ নেওয়া পছন্দ কতেন না।

বাদশাহর নির্দেশমতো মেরিনার বাবা তাকে গৃহবন্দী করে রাখল। কিন্তু আউপাসকে বাধা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আউপাস রাতের অন্ধকারে মেরিনার সাথে দেখা করার জন্য চলে আসতো। মেরিনার বাবা তাড়াহুড়া করে এক জায়গায় মেরিনার বিবাহ ঠিক করে। কিন্তু মেরিনা অন্য কোথাও বিয়ে বসতে অস্বীকার করে।

বাদশাহ অর্টিজা তাঁর ভাই ও মেরিনার সব খবরই রাখতেন। তিনি তাঁর স্বভাবসূলভ উদারতার কারণে মেরিনার ব্যাপারে কোন কঠোর সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি মেরিনার বাবার ব্যাপারেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। কিন্তু তিনি তার ভাই আউপাসকে অনেক কঠিন শাস্তি দেন। তারপরও আউপাস মেরিনাকে ভুলে যেতে অস্বীকার করে।

একবার আউপাস ও মেরিনা রাজ্য ছেড়ে পালাতে চেয়েও পালাতে পারেনি। পথিমধ্যেই ধরা পড়ে যায়। সেদিন থেকে অর্টিজা ছোট ভাই আউলাসের উপর নজরদারী আরোপ করেন, যেন সে শাহীমহল থেকে বের হতে না পারে।

আউপাস তার ভাই অর্টিজার জন্য, আর মেরিনা তার বাবার জন্য এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের প্রেমকাহিনী গোটা টলেডোতে মশহুর হয়ে পড়ে। এমনিভাবে দুই বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। হটাৎ একদিন শাহীমহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সংবাদ পৌঁছে, সেনাবাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে সেনাবাহিনীর কমান্ডার রডারিক।

অর্টিজা তার রক্ষীবাহিনী ও টলেডোর রিজার্ত বাহিনীকে নিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য বের হয়ে পড়েন। তার ধারণা ছিল, তিনি বিদ্রোহীদেরকে দমন করতে পারবেন। তাদেরকে সমূলে বিনাশ করতে সক্ষম হবেন; কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তার ধারণার চেয়ে ভিন্ন ছিল। তার জানাই ছিল না যে, তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও গির্জাসমূহে এ প্রপাগাণ্ডা চালানো হয়েছে, তিনি দেশ ও জাতির দুশমন। তিনি অন্য রাজার কাছে দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন।

অর্টিজা ছিলেন জনদরদি বাদশাহ। তিনি ইহুদিদেরকে সম্মানজনক জীবন যাপনের অধিকার প্রদান করেছিলেন। এ কারণে রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, উযির-নাযির, জাগিরদার ও ধনী শ্রেণীর লোকেরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পাদ্রিরা তার প্রতি একটু বেশিই অসন্তুষ্ট ছিল। কারণ, তারা গির্জায় বসে সুন্দর সুন্দর ইহুদি মেয়েদেরকে ভোগ করতে পারত। অর্টিজা তাদের এই ভোগ-বিলাসের পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

বিত্তশালী ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ তাঁর বিরুদ্ধে চলে যায়, ফলে তাঁর পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অর্টিজার বাদশাহী এমনই এক পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়ে যে, অর্টিজা যে বাহিনী নিয়ে টলেডো থেকে বের হয়েছিলেন, সে বাহিনীকে তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত মনে করতেন; কিন্তু বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হয়ে তাঁর এই বিশ্বস্ত বাহিনীই তার সাথে প্রতারণা করে বসে। তারা বিদ্রোহীদের সাথে হাত মিলায়। যার ফলে তিনি রডারিকের হাতে বন্দী হয়ে নিহত হন।

অর্টিজার বান্দানের কিছু লোক জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়। তারা সমুদ্র পার হয়ে সিউটা গিয়ে পৌঁছে। জুলিয়ান তাদেরকে সেখানে আশ্রয় দেন। জুলিয়ান হলেন অর্টিজার মেয়ের জামাই। অন্যথায় তারা এখানেও কোন আশ্রয় পেতে না। কারণ, জুলিয়ান হলেন আন্দালুসিয়ার একজন সাধারণ করদ-রাজা।

***

প্রায় বিশ বছর পর মেরিনা ও আইপাস একজন আরেকজনকে সামনে থেকে দেখছে। মেরিনার নির্দেশে কোচোয়ানরা যার যার গাড়ির নিকট চলে গেল। মেরিনা আউপাসকে নিয়ে টিলার পিছনে এক নির্জন স্থানে চলে এলো। তাদের কারো পক্ষেই হৃদয়ের আবেগ-উচ্ছ্বাস গোপন রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তাদের চোখে ছলকে উঠা তপ্ত আঁস্ অনেক্ষণ পর্যন্ত তাদের হৃদয়াবেগের ধারাভাষ্য দিচ্ছিল। আবেগের আতিশয্যে তারা পারস্পরকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেরিনাই প্রথমে নীরবতা ভাঙ্গল। সে আউপাসকে জিজ্ঞেস করল,

‘তুমি কীভাবে জানলে যে, আমি টলেডোতে আছি?

‘আমি তোমার সম্পর্কে সব খবরই রাখি। আউপসি বলল। ‘জুলিয়ানের লোকজন তোমাদের এখানে প্রায়ই আসা-যাওয়া করে। তাদের একজন আমাকে বলেছে, যে মেরিনার জন্য তুমি আপন বড় ভাইকে অসন্তুষ্ট করেছিলে, যার জন্য তুমি রাজমুকুট আর রাজসিংহাসন ত্যাগ করতে চেয়েছিলে, সেই মেরিনা এখন রডারিকের বাগানবাড়ির শুভা বর্ধন করছে। তোমার ব্যাপারে সব খবরই আমার নিকট পৌঁছত।

মেরিনা, এখানে বোধহয় আমাদের বেশিক্ষণ কথা বলা ঠিক হবে না। এতে করে আমাদের উভয়েরই বিপদ হতে পারে।

‘হ্যাঁ, আউপাস! মেরিনা বলল। দ্রুত আমাদের পৃথক হয়ে যাওয়া উচিত। তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি একজন অভিজ্ঞ গুপ্তচর। তুমি তো জানই এ সময় আমি ঝিলে অবস্থান করি।’

‘না, মেরিনা, আমি ঠিক গুপ্তচর নই। আউপাস বলল। আমি এ অঞ্চলের একজন অভিজ্ঞ গুপ্তচরের সন্ধান পেয়েছি। সে সোথ সম্প্রদায়ের লোক। সেই আমাকে বলেছে, তুমি শাহীমহলেই অবস্থান কর। দুই-তিন দিন পর পর চিত্তবিনোদনের জন্য ঝিলে এসে থাক। তোমার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য গত পরশু থেকে এই বেশে আমি উভ্রান্তের ন্যায় ঘোরাফেরা করছি। আজই আমার গুপ্তচর আমাকে সংবাদ দিয়েছে যে, তুমি মেয়েদের নিয়ে ঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছ।

মেরিনা, প্রতিশোধ নেওয়ার সময় এসেছে। আমি কিসের প্রতিশোধ নিতে চাই তুমি তা জান। সেই নরাধম, চরিত্রহীন রডারিক থেকে তোমারও তো প্রতিশোধ নেওয়া উচিত। যৌবনের প্রারম্ভে সে তোমাকে যৌনদাসী বানিয়ে তোমার জিন্দেগী বরবাদ করে দিয়েছে। আমি তো বিয়ে-শাদী করে সংসারী হয়েছি। আমার ছেলেমেয়েও আছে। আর তুমি…, তোমার সকল স্বপ্ন-সাধ সে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে।’

‘ঠিকই বলেছ, আউপাস!’ মেরিনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল। আমাকেও প্রতিশোধ নিতে হবে। আমি তো তোমার জীবন-সঙ্গিনী হতেই পরিনি, অন্য কারো স্ত্রীও হতে পারিনি। ছেলে-সন্তান নিয়ে সুখের ঘরও বাঁধতে পারিনি; বরং আমি সাক্ষাৎ শয়তানে পরিণত হয়েছি। নিকৃষ্ট স্বভাব-চরিত্র আমার মাঝে জন্ম নিয়েছে। নারীলিন্দু পুরুষদেরকে আমি চোখের ইশারায় নাচিয়ে বেড়াই। শাহীমহলের কর্মচারী-কর্মকর্তা ও রাজ্যের আমীর-উমারাগণ আমাকে মুকুটহীন রানী মনে করে।

‘মেরিনা! কথা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।’ আউপাস বলল। তোমার ভাবাবেগ আমাকেও স্পর্শ করছে। মেরিনা, মন চায় বিশ বছর পূর্বের সেই না বলা কথাগুলো এখনই বলে নেই। হায়! বিশ বছর পূর্বে ফিরে যাওয়া যদি সম্ভব হতো তাহলে আমি তোমাকে সেই দুঃস্বপ্নের কথা শুনাতাম যে দুঃস্বপ্ন তোমার বিচ্ছেদের দিন থেকে আমার নিত্যসঙ্গী।

মেরিনা বলল, “সত্যি কথা কি জান? এতদিন পর তোমাকে দেখে আমি আত্মসংবরণ করতে পারছি না।’

এ মুহূর্তে আত্মহারা হলে চলবে না মেরিনা!’ আউস বলল। এখন আমাদের প্রতিশোধ নেওয়ার সময়। ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা গ্রহণ করে আমাদেরকে সামনে অগ্রসর হতে হবে।’

‘আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি আক্রমণকারীদের সাথে এসেছ।’ মেরিনা বলল। ‘তারা কারা?’

‘তারা বাবার সম্প্রদায়।’ আউপাস বলল। তারা আফ্রিকান মুসলিম।

আউপাস মেরিনার নিকট ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করল। জুলিয়ান কীভাবে মুসলমানদেরকে এই হামলার জন্য প্রস্তুত করেছে, সে কথাও বলল। সবশেষে আউপাস মেরিনাকে বলল,

‘আন্দালুসিয়ার সেনাবাহিনীতে গোথ সৈন্যও আছে, ইহুদি সৈন্যও আছে। মেরিনা, তুমি কি এক কাজ করতে পারবে, যখন রডারিকের বাহিনী আর মুসলিম বাহিনী মুখোমুখি হবে তখন গোথ ও ইহুদি সৈন্যরা মুসলিম বাহিনীর সাথে মিশে যাবে–পারবে এমনটা করতে?

‘তুমি যা চাইছে, তাই হবে।’ মেরিনা বলল। এ ব্যাপারে আর কোন কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।’

‘এ মুহূর্তে তুমি আমাকে কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিতে পারবে? আউস বলল।

 ‘হ্যাঁ,’ মেরিনা বলল। রডারিক এখন পাম্পালুনায় আছে। সে সৈন্য সংগ্রহ করছে। লোকদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলা হচ্ছে। মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা কত?

‘সাত হাজার। আউপাস বলল। এখন কিছু কম হবে। প্রথম লড়াইয়ে কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়েছে।

 ‘উহ্! এতো কম সংখ্যক সৈন্য!’ মেরিনা বিস্মিত হয়ে বলল। “নির্ঘাত মুসলমানরা মার খেয়ে পিঠটান দেবে।

‘জেনারেল থিয়োডুমিরকে জিজ্ঞেস করে দেখো। আউপাস মুচকি হেসে বলল। তুমি এই মুসলিম সৈনিকদের লড়াই করতে দেখলে হতভম্ব হয়ে যাবে। এরা কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে ‘জিহাদ’ বলে, যার অর্থ হল, পবিত্র যুদ্ধ। মুসলমানগণ জিহাদকে ইবাদত মনে করে। তারা তাদের এই ইবাদতে আপন জীবনকে নাযরানা হিসেবে পেশ করতে পারাকে পরম সৌভাগ্য মনে করে। কিন্তু তারা অবিবেচকের মতো জীবন বিসর্জনও দেয় না।

প্রথম আক্রমণেই তারা শত্রুপক্ষের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতে পরিণত হয়। তাদের অন্তরে যেহেতু মৃত্যুর কোন ভয়ই থাকে না, তাই তারা নির্ভয়ে শুক্রব্যুহ ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। তাদের জেনারেল এমন সব রণকৌশল প্রয়োগ করেন, যা শত্রুপক্ষ তখনই বুঝতে সক্ষম হয় যখন তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। আমার চোখের সামনে মাত্র সাত হাজার মুসলিম সৈন্য থিয়োডুমিরের লৌহবর্ম পরিহিত পনের হাজার সৈন্যের যে করুন অবস্থা করেছে, তা আর বলে লাভ নেই। সম্ভবত তুমি ইতিমধ্যেই এ সম্পর্কে জানতে পেরেছ।

ভালো করে ভেবে দেখ, আউপাস!’ মেরিনা বলল। রডারিক যে বাহিনী প্রস্তুত করছে তার সৈন্যসংখ্যা এক লক্ষেরও বেশি হবে।

‘এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, মেরিনা!’ আউপাস বলল। এখনও যদি তোমার অন্তরে আমার জন্য সামান্য ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে আমি তোমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছি, তা পূর্ণ করে দাও।’

“ঠিক আছে, তাই হবে।’ মেরিনা বলল। এখন তুমি পাগলের মতো আচরণ করতে করতে এখান থেকে বের হয়ে যাও।

‘আমি তোমার সাথে আবারও সাক্ষাৎ করব।’ এ কথা বলে আউপাস সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়ল।

***

জেনারেল থিয়োডুমিরকে পরাজিত করার কয়েকদিন পরের ঘটনা। সেনাসাহায্য পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত তারিক বিন যিয়াদ মুসলিম বাহিনীকে বর্তমান রণাঙ্গনের আশেপাশেই অবস্থানের নির্দেশ দেন।

শত্রুপক্ষের নিহত সৈনিকদের লাশ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু রক্ত এতো বেশি পরিমাণে প্রবাহিত হয়েছে যে, মাটির উপরে জমাটবাঁধা রক্ত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দিন-রাত বিভিন্ন প্রকার জীব-জন্তু সেখানে ঘোরাফেরা করছে, আর রক্ত চেটে চেটে খাচ্ছে। সাপ ও অন্যান্য বিষাক্ত সরিসৃপের আনাগোনা বেড়ে গেছে।

তারিক বিন যিয়াদ পরবর্তী আক্রমণের জন্য যে অঞ্চল নির্ধারণ করেছিলেন, তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ঘোড়ায় চড়ে একদিন সেদিকে রওনা হলেন। গাইড হিসেবে তার সাথে জুলিয়ানও ছিলেন। তার সাথে আরো ছিলেন, মুগীস আর-রুমি ও আবু যারু’আ তুরাইফ

‘আউপাস কবে নাগাদ ফিরে আসবে বলে মনে করছেন?’ তারিক বিন যিয়াদ জুলিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন। ধরা পরে যাবে না তো?

সে এতোটা আনাড়ি নয়।’ জুলিয়ান উত্তর দিলেন। কিছু একটা করে তবেই ফিরে আসবে। সে এমন ছদ্মবেশ ধারণ করেছে যে, কেউ তাকে চিনতেই পারবে না। তার ধরা পরার সম্ভাবনাও খুবই কম। যুদ্ধবন্দীদের থেকে আপনি শুনেছেন, রডারিক এখন টলেডোতে নেই। যথাসম্ভব উযির-নাযিররাও তার সাথেই আছে। এই অবস্থায় আউপাসের জন্য কাজ করা অনেক সহজ হবে।

তারিক বিন যিয়াদরা কথা বলতে বলতে জেলে পাড়া অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হয়ে গেলেন। তারিক বিন যিয়াদকে বলা হয়েছিল যে, এখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত কোন শহর বা উপশহর নেই। এ জন্য কোন সেনাক্যাম্পও আশেপাশে কোথাও নেই। তারা আরও কিছু দূর অগ্রসর হয়ে একটি ছোট বসতি দেখতে পেলেন।

চারদিকে সবুজের সমারোহ। বসতিটিকে ঘিরে প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়েছে। দূর থেকে লোকদের প্রাণচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তারিক বিন যিয়াদ তাঁর সাথীদের নিয়ে সেই বসতির নিকট পৌঁছলেন। তাদেরকে দেখে লোকজন যার যার ঘরে দৌড়ে পালাল।

‘জুলিয়ান!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এরা হয়তো জানতে পেরেছে, আমরা তাদের বাহিনীকে পরাজিত করেছি। তাদেরকে কে বুঝবে যে, আমরা সেইসব বিজয়ী সম্প্রদায়ের মতো নই, যারা কোন শহর বিজয় করার পর জোরপূর্বক সেখানকার বাসিন্দাদের গৃহে প্রবেশ করে লুটতরাজ করে, রক্তের হোলি খেলে, আর যুবতী মেয়েদেরকে বেআবরু করে।

“ইবনে যিয়াদ!’ জুলিয়ান বললেন। তাদেরকে বুঝানোর কী দরকার? তারা যখন আমাদের থেকে এমন কোন আচরণ না পাবে তখন তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে।

এমন সময় একজন অতসীপর বৃদ্ধা বসতির কোন এক ঘর থেকে বের হয়ে তারিক বিন যিয়াদের সামনে এসে দাঁড়াল। তারিক তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেন, অন্যরাও ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেন।

‘তোমাদের মধ্যে তোমাদের কমান্ডারও কি আছেন, যিনি আমাদের বাহিনীকে পরাজিত করেছেন?’ বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ, বুড়ি মা!’ এনিই হলেন সেই কমান্ডার, যিনি আন্দালুসিয়ার বাহিনীকে পরাজিত করেছেন। জুলিয়ান তারিক বিন যিয়াদের দিকে ইঙ্গিত করে বৃদ্ধার ভাষায় উত্তর দিলেন।

 ‘বৎস, ঘোড়া থেকে নেমে এসো, তারপর তোমার শিরস্ত্রাণ খুলে ফেল।’ বৃদ্ধা। কোন রকম প্রভাবান্বিত না হয়ে তারিক বিন যিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

মুগীস আর-রুমি আন্দালুসিয়ার ভাষা বুঝতেন। তিনি তারিক বিন যিয়াদকে বৃদ্ধার কথা তরজমা করে শুনালে তারিক বিন যিয়াদ ঘোড়া থেকে নেমে তাঁর পাগড়ী খুলে ফেললেন।

‘ওহো, তুমি এসে গেছ! বৃদ্ধা তারিক বিন যিয়াদের মাথায় হাত রেখে আনন্দিত হয়ে বললেন। আমার স্বামী একজন গণক ছিলেন। তার ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা অনেক দূর-দূরান্তের মানুষও স্বীকার করত। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি আমাকে কয়েকবারই বলেছেন, এক ভিন জাতি আন্দালুসিয়া বিজিত করে তাদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করবে। তাদের কমান্ডারের পরিচয়-চিহ্ন হল, তাঁর দাড়ি ও মাথার চুল হবে লালচে রঙ্গের। ললাট হবে প্রশস্ত।

আমার বিশ্বাস তুমিই সেই ব্যক্তি। তোমার চুল লালচে রঙ্গের, আর তোমার ললাট প্রশস্ত। আরেকটি চিহ্ন আছে, তোমার বাম কাঁধের কাপড় সরাও। সেখানে একটি মোটা তিল থাকার কথা। তিলের চতুরপার্শ্বে পশম থাকবে।’

মুগীস আর-রুমী তারিক বিন যিয়াদকে বৃদ্ধার কথা তরজমা করে বললেন, ‘বৃদ্ধ আপনাকে বাম কাঁধের কাপড় সরাতে বলছেন।’

 ‘বৃদ্ধা ঠিকই বলেছেন। তারিক তার বাম কাঁধ উন্মুক্ত করতে করতে বললেন। ‘আমার এ কাঁধে একটি মোটা তিল আছে। তিলের চতুরপার্শ্বে পশমও আছে।’

‘তুমিই আন্দালুসিয়া জয় করতে পারবে।’ বৃদ্ধা তারিকের বাম কাঁধের তিল ও তার চতুরপাশের পশম দেখে বললেন, ‘তুমিই সেই ব্যক্তি, যে এই রাজ্যের হতভাগা লোকদেরকে বাদশাহ ও তার পরিষদবর্গের জুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্তি দিতে পারবে।’

‘প্রিয় বন্ধুগণ!’ তারিক বিন যিয়াদ তার সাথী-সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বললেন। ‘আমি ইতিপূর্বে আপনাদেরকে এবং গোটা বাহিনীকে আমার স্বপ্নের কথা শুনিয়েছি। স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, বিজয় আমাদেরই হবে। এখন এই বৃদ্ধা ভবিষ্যত্বাণী শুনাচ্ছেন যে, আমিই হবো আন্দালুসিয়ার বিজেতা। তবে সকলকে মনে রাখতে হবে, এখানে আমাদেরকে জীবনবাজি রেখে লড়তে হবে।

***

ঐদিন রাতেই আউলাস ফিরে এলো। পথের দূরত্ব আর সফরের ক্লান্তি সত্ত্বেও সে জুলিয়ানের সাথে সাক্ষাৎ করল। জুলিয়ান তাকে তারিক বিন যিয়াদের নিকট নিয়ে এলেন। সেখানে অন্যান্য সেনাপতিগণও উপস্থিত ছিলেন। সে তার সফরের পূর্ণ বিবরণ তাদেরকে শুনাল। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ ছাড়া মেরিনার সাথে তার যেসব কথা হয়েছে, তাও তাদেরকে শুনাল।

‘তোমার কি বিশ্বাস হয়, সেই নারী এতো বড়, আর এতো স্পর্শকাতর একটি কাজ করতে সক্ষম হবে?’ তারিক বিন যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

 ‘তার উপর আমার ভরসা আছে। আউপাস বলল। তারপরও মেরিনা যদি সেই কাজ না করে বা ব্যর্থ হয় তাহলে অন্যরা সেই কাজ করবে। গোখ সম্প্রদায়ের কয়েকজন সরদার সেখানে উপস্থিত আছে, আমি তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছি।

তবে ইবনে যিয়াদ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, রডারিক এক লক্ষেরও বেশি সৈন্য নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করবে। পাম্পানা থেকে টলেডো পর্যন্ত সামর্থবান সকল লোকজন তার বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে।

‘এটা আমার জন্য অত্যন্ত ভালো সংবাদ। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। ‘বেসামরিক লোকজন যারা সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, তারা এলোপাথারিভাবে লড়াই করবে। তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ সৈন্যদের মতো লড়াই করতে পারবে না। তারা সামরিক ডিসিপ্লেন ও যুদ্ধনীতি সম্পর্কেও অজ্ঞ থাকবে।

 ‘তথাপি আমাদেরকে আত্মপ্রশান্তিতে ডুবে থাকা ঠিক হবে না।’ সেনাপতি আবু যারু’আ তুরাইফ বললেন। আমাদের নিকট এত বিপুল সংখ্যক সৈন্য কখনই হবে না। ইতিমধ্যে যদি সেনাসাহায্য এসে পৌঁছেও যায় তাহলে তা সাত হাজারের বেশি হবে না।’

‘আমি আপনাদের সকলকে আশ্বস্ত করার জন্য বলতে চাই। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আল্লাহ আমাদের বিজয়ের উপায়-উপকরণ তৈরি করছেন মাত্র। আউপাস টলেডোতে যা কিছু করে এসেছে, তা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহই বলতে হবে।

***

মিসর ও আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইর খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেককে তারিকের প্রথম বিজয় সম্পর্কে অবগত করার জন্য পত্র লেখেন, সে পত্রে তিনি অতিরিক্ত সেনাসাহায্যের কথাও উল্লেখ করেন। প্রতিউত্তরে খলীফা পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি দল প্রেরণ করেন।

কোন ঐতিহাসিক সূত্রে এ বিষয়ে ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়নি যে, পাঁচ হাজার সৈনিকের সেই বাহিনীতে অশ্বারোহী কতজন ছিল, আর পদাতিক কতজন ছিল। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এই সেনাসাহায্য এত নগণ্য ছিল যে, বাস্তবতার নিরিখে তা ছিল এক ধরনের প্রকাশ্য বিদ্রূপ।

তারিক বিন যিয়াদের সাথে ছিল সাত হাজার সৈনিক। প্রথম যুদ্ধে কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। সেনাসাহায্য পৌঁছার পর সে সংখ্যা দাঁড়াবে বার হাজারের কিছু কম। অপরপক্ষে রডারিকের ঘোষণা অনুযায়ী দলে দলে লোকজন সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছিল। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই রডারিকের সৈন্যসংখ্যা দাঁড়াল পঞ্চাশ হাজার। এ সংখ্যা অতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

উপদেষ্টাবৃন্দ রডারিককে বলল, ‘আক্রমণকারী বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা মাত্র সাত হাজার। এত অল্প সংখ্যক দুশমনের মোকাবেলায় এতো বিশাল বাহিনী গঠন করার কি প্রয়োজন আছে? এতে করে একদিকে সময় নষ্ট হচ্ছে, অপরদিকে ব্যয়ভারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

 ‘থিয়োডুমির আক্রমণকারীদেরকে জিন-ভূত বলেছে।’ রডারিক গর্জে উঠে বলল। আমি এক লক্ষেরও বেশি সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করব, যেন দুনিয়াবাসী অবগত হতে পারে, আন্দালুসিয়ার বাদশাহ কত বিশাল শক্তির অধিকারী। এরপর কখনও কেউ আন্দালুসিয়া আক্রমণের দুঃসাহস করবে না।

আমি বিপুল সংখ্যক সৈন্যের মাধ্যমে সেই সাত হাজার সৈন্যকে পদদলিত করে মারব। তাদের মৃত লাশের উপর বিশ-পঁচিশ হাজার ঘোড়া ছুটিয়ে তাদের শরীরের গোস্তগুলো হাড়ি থেকে পৃথক করে ফেলব। আমি জিন-ভূতকে ভয় পাওয়ার মতো ব্যক্তি নই।’

রডারিক ছিল অকুতোভয় ও ভয়ঙ্কর এক যোদ্ধা। সে জিন-ভূতকে ভয় পাওয়ার পাত্র ছিল না। তার ডর-ভয়হীন মনোভাব, আর অসম সাহসিকতা এমন এক ঘটনার জন্ম দেয়, যা আজও ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।

***

তারিক বিন যিয়াদের আন্দালুসিয়া আক্রমণ করারও অনেক দিন আগের কথা। একদিন রডারিক টলেডোর শাহীদরবারে রাজ-সিংহাসনের উপর বসেছিল। এমন সময় সম্ভ্রান্ত দু’জন বৃদ্ধ লোক দরবারে প্রবেশ করলেন। তারা প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী আলখেল্লা পরিহিত ছিলেন। তাঁদের দীর্ঘ সফেদ দাড়ি, আর মার্জিত ও গাম্ভির্যপূর্ণ চাল-চলন দেখে মনে হচ্ছিল, তারা সুউচ্চ সম্মানের অধিকারী কোন গণক বা ধর্মযাজক হবেন। তাঁদের কমরে কাপড়ের চওড়া ফিতা বাঁধা ছিল। সে ফিতায় অনেকগুলো চাবির ছড়া ঝুলছিল।

রডারিকের মতো আত্মগর্বিত, অহংবোধসর্বস্ব বাদশাহও তাদের সম্মানে উঠে দাঁড়াল। বৃদ্ধদের একজন হাতের ইশারায় রডারিককে বসতে বললেন। রডারিক বসে পড়ল।

‘হে আন্দালুসিয়ার বাদশাহ!’ বৃদ্ধদের একজন বললেন। আমরা তোমাকে একটি গোপন কথা বলতে এসেছি, প্রত্যেক নতুন বাদশাহকেই এই গোপন কথা শুনতে হয়। অনেক দিন হয়ে গেছে তুমি সিংহাসনে আরোহণ করেছ। তোমার ক্ষমতা সুসংহত হয়েছে।

‘এই গোপন কথা শুনতে আমি অস্থির হয়ে আছি।’ রডারিক বলল। কোন ভূমিকার প্রয়োজন নেই, যা বলার সরাসরিই বলে ফেলুন।

‘বেশি অস্থির হয়ো না, হে বাদশাহ!’ বৃদ্ধ বলল। এই গোপন কথা শুনার পরও ধৈর্যহারা হয়ো না, অন্যথায় পস্তাতে হবে। হিরাক্লে যখন এই মুলুকের বাদশাহ ছিলেন তখন তিনি আন্দালুসিয়ার সমুদ্রপ্রণালীতে একটি স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। আর টলেডো শহরের বাইরে বিশাল বড় এক দুর্গ তৈরী করেছিলেন। সেই দুর্গে তিনি এক রহস্যময় জাদুর প্রহরা নিযুক্ত করেন। সেই দুর্গের একটি মাত্র ফটক। ফটকটি অত্যন্ত মজবুত লৌহ দ্বারা নির্মিত। তিনি নিজ হাতে সেই ফটকে তালা লাগান।

তিনি বলে গেছেন, আন্দালুসিয়ার প্রত্যেক নতুন বাদশাহই যেন সিংহাসনে আরোহণের কিছুদিনের মধ্যে এই লৌহফটকে তালা লাগিয়ে চাবি আমাদের নিকট দিয়ে দেয়।

বৃদ্ধ রডারিককে চাবির ছড়াগুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলো সেসব তালার চাবি, যা হিরাক্কেলের পর থেকে তোমার পূর্ববর্তী বাদশাহগণ দুর্গের লৌহফটকে লাগিয়েছেন। এখন তোমার পালা। লৌহফটকে তোমার তালা লাগিয়ে দাও। আমরা অন্য আরেকদিন এসে চাবি নিয়ে যাব।’

‘আমি এই দুর্গ দেখেছি। রডারিক বলল। আমি ওটাকে প্রাচীন কোন প্রাসাদ মনে করতাম। আপনারা উভয়ই কি সেই দুর্গে অবস্থান করেন?

‘না, আন্দালুসিয়ার বাদশাহ!’ প্রথম বৃদ্ধ বললেন। আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি। এই চাবিগুলো আমাদের বাব-দাদা আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। এই দুর্গের হেফাযত করা আমাদের খান্দানের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও আদায় করতে থাকবে।’

‘আমি আপনাদের এই দায়িত্ব এখানেই খতম করে দিতে চাই।’ রডারিক বলল।

“হে বাদশাহ। দ্বিতীয় বৃদ্ধ বললেন। আমাদের দুজনকে তোমার প্রজা মনে করো না। তোমার ইচ্ছা যদি এই হয় যে, তুমি দুর্গের ফটক খুলবে তাহলে শুনে রাখো, তোমাকে পস্তাতে হবে। তোমার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। এমন অনেক বাদশাহই অতিবাহিত হয়েছে, যারা এই ফটক খুলতে চেয়েছিল। কোন প্রবীণ প্রত্যক্ষদর্শীকে ডেকে জিজ্ঞেস করে দেখ, সে সকল বাদশাহর পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হয়েছিল।

জুলিয়াস সিজারের চেয়ে প্রবল প্রতাপশালী বাদশাহ আর কে ছিল? সেও এই ফটক খোলার চেষ্টা করেনি। আমরা এখন যাচ্ছি। খবরদার, হে বাদশাহ! এটা কোন কল্পকাহিনী নয়। আমরা বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করছি, কয়েক দিন পর এসে আমরা সেই তালার চাবি নিয়ে যাব, যা তুমি দুর্গের ফটকে লাগাবে।’

কথা শেষ হতেই বৃদ্ধ দু’জন দরবার থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।

***

‘রডারিক যদি এই মুলুকের শাহানশা হয়ে থাকে তাহলে এই মুলুকের কোন রহস্যই তার নিকট গোপন থাকতে পারবে না।’ বৃদ্ধ দুজন চলে যাওয়ার পর রডারিক ঘোষণা করল। আমি ঐ দুর্গে তালা লাগাব না, বরং সবকটি তালা ভেঙ্গে ফটক খুলে দেখব ভিতরে কি আছে।

 ‘বাদশাহ নামদার, গোস্তাখি মাফ করবেন। একজন দরবারী বিনীত স্বরে বলল। আমাদের কারোই এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, বাদশাহ হুজুরের সাহসিকতা ও ভয়হীনতা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। বাদশাহ হুজুরকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা আমাদের কর্তব্য। বৃদ্ধ ধর্মযাজক বলে গেছেন, হিরাক্কেল দুর্গের ভিতর জাদুর প্রহরা নিযুক্ত করেছেন। আর কোন মানুষের পক্ষে জাদুর মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বাদশাহ হুজুরের নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, হুজুর দুর্গের লৌহফটকে তালা লাগিয়ে সে বিষয় বেমালুম ভুলে যাবেন।

‘তা হলে আজ থেকে আমাকে বাদশাহ বলা পরিত্যাগ কর। রডারিক চিৎকার করে বলল। এই মুলুক আমার, এই মুলুকের প্রতিটি গোপন রহস্য আমাকে জানতে হবে। ইতিপূর্বে আমি এই দুর্গের ব্যাপারে মনযোগ দেইনি। এখন আমার উপলব্ধি হচ্ছে, সেই রহস্যময় দুর্গ আমার বুকের উপর জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসেছে।’

‘বাদশাহ রডারিকা’ রাজ্যের প্রধান পাদ্রি দাঁড়িয়ে বলল। আন্দালুসিয়া, ফ্রান্স এবং জার্মানের পর্বতমালা পর্যন্ত রডারিকের নাম শুনে কেঁপে উঠে; কিন্তু এমন কিছু রহস্যময় শক্তি আছে, যার সামনে মানুষ কিংকর্তব্যবিমোঢ় হয়ে পড়ে। বাদশাহ নামদার যদি আমাকে আপন ধর্মের ধর্মীয় গুরু মনে করেন তাহলে তিনি যেন আমাকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত না করেন যে, আমি তাকে দুর্গে প্রবেশ করা থেকে বাধা প্রদান করব।’

‘হিরাক্বেল আমার মতোই একজন বাদশাহ ছিলেন। রডারিক বলল। তিনি যদি কোন রহস্যময় শক্তি দুর্গের মাঝে বন্দী করে রেখে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে, ওটা তার আয়ত্তে ছিল। আমিও সেই রহস্যময় শক্তি করায়ত্ত করতে চাই।’

রডারিক সামান্য সময়ের জন্য নীরব হয়ে দরবারে উপবিষ্ট লোকদের উপর তার দৃষ্টি একবার ঘুরিয়ে আনল। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, কাপুরুষের দল! সেই দুর্গে রোমানরা গুপ্তধন গচ্ছিত রেখেছে। সেখানে অবশ্যই অতি মূল্যবান হীরা-জহরত ও মণি-মাণিক্য রয়েছে। ভয় শুধু একটাই হয়তো সেখানে অনেক বিষাক্ত সাপ আছে। অথবা মাত্র এক জোড়া বিষাক্ত সাপ আছে। তোমাদের মধ্যে এমন বীরপুরুষ কি নেই, যারা আমাকে সেই দুর্গের রহস্য উদঘাটনে সাহায্য করবে?

রডারিক তার দরবারে উপস্থিত জেনারেলদের প্রতি দৃষ্টিপাত করল। তারা কেউই বাদশাহর চোখে কাপুরুষ হতে চাচ্ছিল না। তাই সকলেই একে একে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি বাদশাহ নামদারের সাথে যাব।’

রডারিকের উপদেষ্টাবৰ্গ, রাষ্ট্রের বড় বড় পাদ্রি এবং তার পরিবারের সদস্যরাও তাকে তার সংকল্প ত্যাগ করার জন্য অনেক অনুরোধ করল, কিন্তু সে কারো অনুরোধ-উপরোধ শুনার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

তিন-চার দিন পর দেখা গেল, সে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে সেই দুর্গের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে তিন-চারজন নামকরা জেনারেলও ছিল, যারা বিভিন্ন যুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের সাথে নিজ নিজ রক্ষীবাহিনীর সেরা অশ্বারোহীরাও উপস্থিত ছিল।

প্রকাণ্ড চওড়া এক পাথরের উপর দুর্গটি অবস্থিত। দুর্গের চতুর্পাশে স্তম্ভের ন্যায় উঁচু উঁচু পাথর মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভগুলো উচ্চতায় দুর্গকেও ছাড়িয়ে গেছে। প্রথম পলকেই মনে হবে, স্তম্ভের ন্যায় উঁচু পাথরগুলোই বুঝি দুটাকে স্থির করে রেখেছে। দুর্গটি মরমর পাথরে নির্মিত। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য স্থানে স্থানে ধাতব পদার্থের টুকরা লাগানো হয়েছে। সামান্য আলো পেলেই সেগুলো ঝলমল করে উঠে।

ভিতরে প্রবেশের জন্য পাথর কেটে সুরঙ্গ বানানো হয়েছে। দুর্গের প্রবেশদ্বার এতটাই প্রশস্ত ও উঁচু যে, ঘোড়ার উপর আরোহণ করে দুর্গে প্রবেশ করা যায়। সুরঙ্গের শেষ মাথায় বিশাল আকৃতির লৌহফটক। সেই ফটকে অসংখ্য তালা ঝুলছে। তালার রং বিকৃত হয়ে গেছে। এগুলো হিরাকেল থেকে অর্টিজা পর্যন্ত সকল বাদশাহ নিজ হাতে লাগিয়ে ছিলেন।

যে দুজন বৃদ্ধ ধর্মাষক রডারিকের দরবারে গিয়েছিলেন তারা সেই দুর্গের সামনে দাঁড়ানো ছিলেন। দুজন ফটকের দুই পার্শ্বে প্রহরীর মতো অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

‘আমরা তোমাকে শেষবারের মতো সতর্ক করছি।’ দু’জন বৃদ্ধের একজন বললেন।

‘এদের থেকে চাবি নিয়ে নাও।’ রডারিক নির্দেশ দিল। সকল তালা খুলে দাও।

বৃদ্ধ দুজন শক্তিশালী সৈন্যদেরকে প্রতিহত করতে সক্ষম হলেন না। সৈন্যরা তাদের থেকে চাবি ছিনিয়ে নিল। অসংখ্য জং পড়া তালা। কোন তালার চাবি কোনটা সেটা জানাও ছিল অসম্ভব, সারা দিন ধরে তালা খোলার চেষ্টা করা হল। অবশেষে সূর্য ডুবার কিছু পূর্বে সমস্ত তালা খোলা সম্ভব হল। তালা খোলার সাথে সাথে লৌহকপাটও খুলে গেল।

রডারিক ভিতরে প্রবেশ করল। তার সাথে আসা জেনারেল ও রক্ষীসেনারাও ভিতরে প্রবেশ করল। লৌহকপাট পার হয়ে তারা এক বিশাল হলরুমে এসে পৌঁছল। হলরুমের এক দিকে একটি দরজা। সেই দরজা ভিতর দিক থেকে বন্ধ। দরজার সামনে রাং ও তাম্র মিশ্রিত ধাতু দ্বারা নির্মিত এক বিশাল আকৃতির মানব-মূর্তি দাঁড়ানো। তার এক হাতে লৌহ নির্মিত এক বিশাল মুগুর।

আশ্চর্যের বিষয় হল, মূর্তিটি সেই লৌহ-মৃগুর মাথার উপর উঠিয়ে মাটির উপর আঘাত করছে। তার বুকের উপর স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে। আমি আমার কর্তব্য আদায় করছি।’

 ‘আমি মন্দ কোন উদ্দেশ্যে এখানে আসিনি। রডারিক মূর্তিটিকে লক্ষ্য করে বলল। কোন কিছুতেই আমি হাত দেব না। কেবল এখানের রহস্য জানার জন্যই এসেছি। তার পর যেভাবে এসেছি, সেভাবেই ফিরে যাব। আমাকে বিশ্বাস কর, আমাকে সামনে যাওয়ার রাস্তা দাও।

রডারিকের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে মূর্তিটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মূর্তির মুগুর ধরা হাত উপরে উঠে রইল। রডারিক তার বাহুর নিচ দিয়ে দ্বিতীয় কামরায় প্রবেশ করল। তার সাথে আগত লোকেরাও তার পিছনে পিছনে ঐ কামরায় প্রবেশ করল।

দ্বিতীয় কামরাটি অত্যন্ত পরিপাটি ও সাজানো-গুছানো। রডারিকের দেহরক্ষীরা মশাল জ্বালিয়ে এনেছিল। মশালের হলুদ আলোতে কামরার দেয়ালগুলো থেকে আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হতে লাগল। আসলে সেগুলো ছিল মহামূল্যবান পাথর ও হীরার টুকরো। সেগুলো দ্বারা দেয়ালের মাঝে নকশা অঙ্কিত করা হয়েছিল।

কামরার মধ্যভাগে একটি টেবিল রাখা আছে। তার উপর একটি বড়সড় বাক্স রাখা। তাতে লেখা আছে, “এই বাক্সে দুর্গের রহস্য সংরক্ষিত আছে। কোন বাদশাহ ব্যতীত এই বক্স অন্য কেউ খুলতে সক্ষম হবে না। তবে সেই বাদশাহকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, তার সামনে আশ্চর্যজনক ঘটনাবলীর পর্দা উন্মোচিত হবে। আর সেসব ঘটনা সেই বাদশাহর জীবদ্দশায় বাস্তবায়িত হবে।”

রডারিক নির্ভয়ে সেই বাক্সের ঢাকনা খুলে ফেলল। বাক্সে চামড়া দ্বারা নির্মিত এক ফুট দৈর্ঘ ও এক ফুট প্রস্থ একটি কাগজ রাখা ছিল। তাম্র নির্মিত একটি প্লেট সে কাগজের উপর রাখা আছে, আরেকটি প্লেট তার নিচে রাখা আছে।

রডারিক চামড়ার সেই কাগজটি হাতে নিয়েই যুদ্ধবাজ সৈনিক দলের একটি চলমান চিত্র দেখতে পেল। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে সৈনিকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তীর-ধনুক ও অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত সেই সৈনিকরা সকলেই অশ্বারোহী। তারা সকলেই বিশাল আকৃতি ও ভয়ঙ্কর দর্শন চেহারার অধিকারী। সেই চলমান চিত্রের উপর লেখা আছে :

‘হে অবাধ্য মানুষ! দেখে নাও, এরা সেই অশ্বারোহী, যারা তোমাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। তোমার বাদশাহীর অবসান ঘটাবে।’

রডারিক অবাক হয়ে সেই চলমান চিত্রের দিকে তাকিয়ে রইল। তার সাথে আগত জেনারেলদের দৃষ্টিও সেই কাগজের উপর নিবদ্ধ। তারা অতি নিকট থেকে লড়াইরত দুটি বাহিনীর শোরগোল শুনতে পাচ্ছে। সৈনিকদের চিৎকার চেঁচামেচি, ঘোড়ার হেষাধ্বনি, আর ক্ষুরের আঘাতে ময়দান প্রকম্পিত হয়ে উঠছে।

রডারিক এতোটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে, তার মনে হচ্ছিল অন্য কোন রাজ্যের বাহিনী তার রাজ্যে আক্রমণ করে বসেছে। তারা হয়তো টলেডো পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজেকে সামলে নিল। সে তার চোখের সামনেই এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছিল।

যুদ্ধের এই দৃশ্য ছায়াছবির ন্যায় এতটাই জীবন্ত লাগছিল যে, মনে হচ্ছিল দুর্গের মজবুত প্রাচীর অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেই প্রাচীরের স্থানে বিশাল বিস্তৃত যুদ্ধক্ষেত্র দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। আকাশে পেঁজা পেঁজা কালো মেঘ জমা হয়ে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করছে।

উভয় পক্ষের বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। একদল খ্রিস্টানদের। আরেক দল উত্তর আফ্রিকার মুসলমানদের। উভয় পক্ষের সৈন্যরাই সমানতালে প্রতিপক্ষের রক্ত প্রবাহিত করে চলছে। ঢাল-তলোয়ারের ঝনঝনানি আর তীর-বর্ষার সাঁ সাঁ শব্দ ভেসে আসছে। মুহুর্মুহু যুদ্ধডঙ্কা বেজে উঠছে। পদাতিক সিপাহী ও অশ্বারোহী সৈন্যরা আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।

সওয়ারিহীন ভীত-সন্ত্রস্ত ঘোড়াগুলো আহত সৈন্যদেরকে পদদলিত করে এলোপাথারি ছোটাছুটি করছে। সৈনিকদের বজ্রনিনাদে আকাশ ফেটে পড়ছে। ঘোড়ার পদাঘাতে জমিন কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর কিছুক্ষণ পর পর বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত হচ্ছে :

হে রাসূলুল্লাহর অনুসারীগণ! কাফেরদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দাও। আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন।

হে মুসলমানগণ, তোমাদের পিছনে অথৈ সমুদ্র। তোমাদের রণতরী পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে।

আল্লাহর রাসূল তোমাদের বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছেন।

রডারিক ও তার জেনারেলরা খোলা চোখে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখছিল। তারা সৈনিকদের রণহুঙ্কার আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছিল। রক্তাক্ত এই ভয়ানক ছায়াচিত্রের যুদ্ধকে একেবারেই বাস্তব মনে হচ্ছিল। রডারিকের চেহারায় চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠল। তার জেনারেল ও রক্ষীদের চেহারাও ভয়ে পাংশু বর্ণ ধারণ করল। রডারিক যদি না থাকত তাহলে তারা এখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করত।

যুদ্ধের শুরুতে খ্রিস্টানদের যে সকল যুদ্ধ-নিশান স্বগৌরবে পত পত করে উড়ছিল সেগুলো একে একে ভূপাতিত হতে লাগল। মুসলমানদের ঝাণ্ডা আকাশে মাথা উঁচু করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করছিল। অবশেষে খ্রিস্টানদের কুশ অঙ্কিত যুদ্ধ-নিশানও ভূপাতিত হল। সাথে সাথে খ্রিস্টান সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। আর মুসলিম সৈন্যরা তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করতে লাগল।

রডারিক খ্রিস্টান সৈন্যদের মাঝে এক যোদ্ধাকে দেখতে পেল। তার পিঠ রডারিকের দিকে ছিল। তার মাথায় এমন শিরস্ত্রাণ ছিল যেমনটি স্বয়ং রডারিক ব্যবহার করত। তার লৌহবর্মও ছিল রডারিকের লৌহবর্মের ন্যায়। সে যোদ্ধা যেই সাদা ঘোড়ায় আরোহণ করেছিল, সেটাও দেখতে রডারিকের ঘোড়ার মতোই মনে হচ্ছিল। মোটকথা, সেই অশ্বারোহী যোদ্ধা আর রডারিকের মাঝে পূর্ণ সামঞ্জস্য ছিল।

ছায়াচিত্রের যোদ্ধাকে রডারিক লক্ষ্য করছিল। তাকে বাদশাহ মনে হচ্ছিল। হঠাৎ সে যোদ্ধা ঘোড়া থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার সাদা ঘোড়া এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করতে লাগল।

রডারিক ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠল। সে দ্রুত পিছন ফিরে ছুটতে শুরু করল। দৌড়ে সে ঐ কামরায় এসে পৌঁছল, যেখানে কাঁসার মূর্তিটি মুগুর নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখা গেল, মূর্তিটি সেখানে নেই।

রডারিক ও তার সঙ্গীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তারা দৌড়ে সেই কামরা থেকে বের হয়ে দুর্গের লৌহফটক পেরিয়ে দুর্গের বাহিরে এসে পৌঁছল। দুর্গের বাহিরে এসে দেখল, সেই বৃদ্ধ ধর্মযাক দুজন মরে পড়ে আছেন।

রডারিক দুর্গ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, ধোয়ার ন্যায় কালো মেঘ দুৰ্গটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মুহূর্তের মধ্যে মেঘের ভিতর থেকে বিদ্যুৎ চমকাল, সেই সাথে গোটা দুর্গ এক লেলিহান অগ্নিশিখায় পরিণত হল। দুর্গের মর্মর পাথরগুলোও জ্বলতে লাগল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই দুর্গের বাহিরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাথরগুলোতেও আগুন জ্বলে উঠল। বাতাস দ্রুত বেগে বইতে শুরু করল। দুর্গের ভস্মাবশেষ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সাথে ছিটকে এসে জমিনের যে স্থানটিতে পড়ত, সেখানে ফুটা ফুটা রক্তের ছাপ লেগে থাকত। রডারিক অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে জেনারেল ও রক্ষীদেরসহ সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়ল।

এই ঘটনার পর রডারিক ধর্মগুরুদের, রাষ্ট্ৰীয় পণ্ডিতদের ও জাদুকরদের নিকট জিজ্ঞেস করল, এই রহস্যময় দুর্গের অর্থ কি? দুর্গে দেখা সেই যুদ্ধের উদ্দেশ্যই বা কি? তারা সকলেই যার যার মতো উত্তর দিল; কিন্তু রডারিক কারো উত্তরেই আশ্বস্ত হতে পারল না। প্রত্যেকেই তার অসম সাহসিকতার প্রশংসা করল, আর শত্রুপক্ষের উপর তার বিজয়ের সুসংবাদ শুনালো। একজনমাত্র জাদুকর তাকে সুস্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে দিয়ে বলল,

‘শাহানশাকে সতর্ক থাকতে হবে। কারো পক্ষেই এটা বলা সম্ভব নয় যে, হিরাকেল কেন সেই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। তবে আমি এতটুকু বলতে পারি, সেই দুর্গের মাঝে অভিশপ্ত ও অশুভ কিছু শক্তিকে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই দুর্গে প্রবেশ করাই আপনার ঠিক হয়নি। যুদ্ধের যে ইঙ্গিত আপনাকে দেওয়া হয়েছে, সেটা কোন শুভ লক্ষণ নয়।

 ‘আমি কি সেই অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে বাঁচতে পারব?’ রডারিক জিজ্ঞেস করল।

‘হে আন্দালুসিয়ায় বাদশাহ, একটি মাত্র উপায় আছে। জাদুকর বলল। ‘আপনি যখন কোন শত্রুপক্ষের সম্মুখীন হবেন তখন আপনার সৈন্যসংখ্যা এত বেশি হতে হবে, যেন শত্রুপক্ষ আপনাকে দেখেই পালিয়ে যায়। অথবা যুদ্ধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে।

এই ঘটনার পর পাম্পালুনা এলাকায় বিদ্রোহ দেখা দিলে রডারিক অনেক বেশি সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। পাম্পালুনার বিদ্রোহীদেরকে সে নির্মমভাবে দমন করে। সেখানেই সে জানতে পারে যে, আফ্রিকার দিক থেকে আন্দালুসিয়ার উপর আক্রমণ করা হয়েছে।

থিয়োডুমির তাকে সংবাদ দিয়েছে, আক্রমণকারীদের সংখ্যা সাত-আট হাজার হবে। রডারিক এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বিপুল পরিমাণ সৈন্য জমায়েত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে টলেডোর দিকে রওনা হয়ে যায়।

রডারিক টলেডো আসার পথে স্থানে স্থানে যাত্রা বিরতি করে সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকে। অবশেষে সে যখন টলেডো এসে পৌঁছে তখন তার সৈন্যসংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। তাদের মধ্যে ছিল কয়েক সহস্র অশ্বারোহী। রডারিক টলেডোতে যাত্রা বিরতি না করে উত্তরের সেই রণাঙ্গনের দিকে রওনা হয়ে যায়, যেখানে মুসলমান সৈন্যরা জেনারেল থিয়োডুমিরকে পরাস্ত করেছে।

ওদিকে তারিক বিন যিয়াদের নিকট মাত্র পাঁচ হাজার সেনাসাহায্য এসে পৌঁছেছে। এখন তাঁর সৈন্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র বার হাজার।

রডারিকের এক লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনী মুসলমানদের বার হাজার সৈন্যের ক্ষুদ্র বাহিনীকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড ঝাবায়ুর ন্যায় সুতীব্র বেগে ধেয়ে আসতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *