১. ঘোর বর্ষা

এই আঁধারে ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়

০১.

ঘোর বর্ষা। টানা তিনদিন ধরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। কখনও টিপটিপ, কখনও ঝমঝম। ৫N সঙ্গে শাঁইশাই ঝোড়ো হাওয়া। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে।

আকাশ একেবারে কালো স্লেটের মতো।

অনাথবাবুর কোনও উপায় নেই। এই যাচ্ছেতাই আবহাওয়াতেও ওঁকে বেরোতে হবে। পেনশন তোলার আজ শেষ দিন। গত দুদিন অপেক্ষা করেছেন। আজ না গেলে পেনশন ফেরত চলে যাবে।

সবচেয়ে আতঙ্ক, রাস্তায় জল জমা। অনাথবাবু বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে তিরিশ বছরের বাসিন্দা। একটু জোর বৃষ্টি মানেই এখানে হাঁটুজল। বন্ধুবান্ধবরা মজা করে বলেন, তোমাদের পাড়া, বাপরে! ওখানে তো আকাশে মেঘ ডাকলেই জল জমে যায়।

আজ এখনও পর্যন্ত জল জমেনি। দুয়া দুগ্ন বলে অনাথবাবু রওনা হলেন ডালহৌসির দিকে। ভালোয় ভালোয় পেনশনটা তুলে ফিরতে পারলে বাঁচেন। হাতে ফেয়ারওয়েলে পাওয়া কালো ছাতা।

কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে খণ্ডায় কে! এমনিতেই গত দুদিনের বৃষ্টির দরুন অফিসে গিজগিজে ভিড় ছিল। তার উপর একের পর এক বাদুড়ঝোলা বাস ছেড়ে ফাঁকা বাস ধরতে গিয়ে পৌঁছতে দেরিও হয়ে গেছিল।

চারটে নাগাদ পাঞ্জাবির ভিতরের বুকপকেটে টাকাগুলো সযত্নে ঢুকিয়ে সবে অফিসের বাইরে পা বাড়িয়েছেন অনাথবাবু, আবার তোড়ে বৃষ্টি নামল।

বাব্বা, কী বৃষ্টি! যেমন মুষলধারা, তেমনি দমকা হাওয়া। অনাথবাবু দু-একবার এগোনোর চেষ্টা করেও থমকে দাঁড়ালেন। অসম্ভব! এই ঝোড়ো বৃষ্টিতে ছাতাসুদু তাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

অসহায় চোখে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ঝাড়া একঘণ্টা বর্ষণের পর বৃষ্টির বেগ কমল। ততক্ষণে ডালহৌসির রাস্তায় পায়ের পাতা পর্যন্ত জল ছপছপ করছে।

অনাথবাবু বেরিয়ে পড়লেন। আমহার্স্ট স্ট্রিট এতক্ষণে নদী হয়ে গেছে। যেতে হবে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড দিয়েই।

মেঘ-মেঘে সন্ধের আঁধার বিকেলেই ঘনিয়ে এসেছে। অনাথবাবু ট্রামে চেপে বসলেন। বুকপকেটে টাকাগুলো খচ্খচ্‌ করছে। এই চৌষট্টি বছর বয়সে আজ কতটা জল ঠ্যাঙাতে হবে, কে জানে!

কপালটা সত্যিই খারাপ অনাথবাবুর। ট্রাম রাজাবাজার অবধি এগিয়ে আটকে গেল। টিকির তার ছিঁড়ে গেছে।

হাতে জুতো, বগলে ছাতা নিয়ে অনাথবাবু টতে আরম্ভ করলেন।

রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের পাশ দিয়ে পার্শিবাগান লেন। একদিকে সায়েন্স কলেজের পাঁচিল, অন্যদিকে বড় বড় বনেদি বাড়ি। বরাবর পাড়াটা নিঝুম থাকে। আজ তো একেবারে জনশূন্য। তার উপর রাস্তায় একটাও হ্যালোজেন জ্বলছে না।

বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল অনাথবাবুর। এই অন্ধকার রাস্তায় ঢুকবেন? আর উপায় কী, এখান দিয়েই যা একটু শটকার্ট হয়। জলও কম জমে। পেট্রল পাম্পের পাশের বিদ্যাসাগর স্ট্রিট তো এতক্ষণে নির্ঘাত কোমরজলে থইথই।

মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে জলের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকেন অনাথবাবু। একটু একটু জল বাড়ছে। হাঁটু পেরিয়ে এবার উরু ছুঁয়েছে।

টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। কী যন্ত্রণা! জুতো হাতে ছাতাটা কীভাবে খুলবেন? যাকগে! সব ভিজে যাক, বাড়িতে গিয়ে জামা কাপড় ছেড়ে গা মুছে ফেললেই হবে।

চশমার কাচ জলে ঝাপসা। প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না অনাথবাবু।

ওদিক থেকে কারা এগিয়ে আসছে না? বুকপকেটে সারাটা মাসের টাকা! ধড়াস্ ধড়াস করছে হৃদপিণ্ড।

হঠাৎ-আরে, আরে! একী একী! এ যে গর্ত! ম্যানহোল খোলা!

ম্যানহোলে ডুবতে ডুবতে অনাথবাবু প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠেন, বাঁচাও! বাঁচাও!

ছাতা জুতো কোথায় ভেসে যাচ্ছে! কোমর অবধি ঢুকে গেছে গর্তে, জলে কপাল পর্যন্ত ডুবে গেছে অনাথবাবুর। দুহাত তুলে খাবি খাচ্ছেন! দম বন্ধ হয়ে আসছে।

ছপছপ শব্দ। কারা দৌড়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কয়েকটা সবল হাত হ্যাঁচকা টান মারল অনাথবাবুকে। নেতিয়ে পড়া শরীরকে টেনে দাঁড় করাল রাস্তায়।

–দাদু, চোট লাগেনি তো?

চশমা মুছে নিয়ে অনাথবাবু দেখলেন, জনা পাঁচেক যুবক। মজবুত শরীর। অনাথবাবু হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন,না বাবা! তোমাদের জন্যে বেঁচে গেছি। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন।

আরেকজন যুবক ছাতা জুতো এগিয়ে দিল। বলল,–এই নিন দাদু! সাবধানে চলে যান। কোথায় থাকেন?

–এই সামনেই বাবা। ডানদিকে ঘুরে দুটো বাড়ি ছেড়ে।

যুবকরা অনাথবাবুকে ছেড়ে এগিয়ে এল। অনাথবাবু বুকপকেটে একবার হাত ঠেকালেন। নাহ্! ভিজে গেলেও সব ঠিক আছে।

ধীরে-ধীরে দু-পা হেঁটেছেন, হঠাৎ কানে ভেসে এল ফিসফিস কণ্ঠ,–আসছে!….

অনাথবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, যুবকরা সাঁৎ করে পাঁচিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মেন রোডের দিক দিয়ে, এগিয়ে আসছে এক মনুষ্যমূর্তি। ভালোভাবে ঠাহর করতে স্পষ্ট হল, শাড়ি পরা কোনও মহিলা।

অনাথবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন।

সঙ্গে সঙ্গে চাপা শাসানি ভেসে এল,–দাদু! কী হল? একদম এদিকে না! যেদিকে যাচ্ছেন, চলে যান।

অনাথবাবুর পা এগোচ্ছে না।

কী করবেন? এরা নির্ঘাত মহিলাকে টার্গেট করেছে! কী করা উচিত? চোখ বুজে বাড়ির পথে হাঁটা দেবেন?

না না, এ তো কাপুরুষতা। চৌষট্টি বছরের প্রবীণ অনাথবাবুর মধ্যে একটা অদ্ভুত সাহস এসে জড়ো হল। চেঁচিয়ে বললেন, কিছু বলছ বাবারা?

যাঃ শ্লা, বুড়োটা তো হেভি কেঁটিয়া! এখনও ফুটছে না।–একজনের চাপা গলা।

আরেক যুবক শাসিয়ে উঠল,–দাদু! বেকার কথা বাড়িও না। জলদি ফুটে যাও।.. যা-ও!…

আরেক কণ্ঠ,–বস্! রেডি।

 মহিলা কাছে এসে পড়েছে।

আকাশ জুড়ে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। চোখধাঁধানো আলোয় অনাথবাবু দেখলেন, মেয়েটির বয়েস তিরিশের আশেপাশে। গলায়, কানে, হাতে সোনার গয়না। শাড়িটাও বেশ দামি। দেখলেই বোঝা যায়, অবস্থাপন্ন ঘরের। হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ।

যুবকেরা পাঁচিলের পাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে।

আবার বিদ্যুৎ চমকাল।

যুবকদের হাতে কীসব যেন চকচক করে উঠেছে। ঘিরে ধরেছে মেয়েটিকে। তার কাঁপা কণ্ঠ শুনতে পেলেন,–আ-আপনারা কী চান?

একজন যুবক হ্যাঁচকা টানে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিল। আরেকজন চাপাগলায় ধমকে উঠল, গায়ে যা আছে, শিগগির খুলে দাও!

অনাথবাবু আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। পকেটে সারামাসের খরচের টাকা, বয়েস, দুর্বল শরীর…স্থানকাল ভুলে চেঁচিয়ে উঠলেন,–অ্যাই! কী হচ্ছে? ওকে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও বলছি।

একঝটকায় যুবকটা ঘুরে দাঁড়াল। একজন বলল,–বস, সুড্ডাটাকে টপকে দোবো? বড্ড বাওয়ালি করছে।

দাঁড়া।

.

০২.

অনাথবাবু নড়ার সময় পেলেন না। মুশকো শরীরের বিস গটমটিয়ে এগিয়ে এল তার কাছে।

তার কঠিন হাত চেপে ধরল অনাথবাবুর পাঞ্জাবির গলা,–অ্যাই! কী চাই, অ্যাঁ! মাজাকি হচ্চে? দোবো সেস করে?

অনাথবাবুর দম আটকে আসছে। দু-চোখে তারার ফুলকি।

চাপ একটু আলগা হল। হিসহিস করে ফের বলল, এবারের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। আর একটা কথা বলেছ কি,–যা-ও!

ইতিমধ্যে অনাথবাবুর বাঁ-হাত আপনা থেকে বুকপকেটের কাছে চলে এসেছে। পকেটটা চেপে ধরেছেন। ওখানে যে সারা মাসের সম্বল।

কিন্তু তাতেই হল কাল! শকুন-দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গেল। এক টানে ফাস করে ছিঁড়ে গেল পাঞ্জাবিটা, পকেটের সবসুদ্ধ উঠে এসেছে মাস্তানটার হাতে।

আরে ইয়ার!–উল্লাসে সে ফেটে পড়ল, কেয়া বাত! এ বুঢঢাও চিপ্পুস মাল। পকেট ভর্তি পাত্তি!

দুচোখে অন্ধকার দেখছেন অনাথবাবু। যাঃ! এবার তিনি সর্বস্বান্ত! মহিলাকে বাঁচানোর মুরোদ নেই তাঁর এতটুকু, শুধু শুধু নিজের সর্বনাশটাও নিজেই করে ফেললেন। এখন কী হবে? ওদের হাতে পায়ে ধরবেন?

কী নিয়ে বাড়ি ফিরবেন? স্ত্রী বসে আছেন তাঁর পথ চেয়ে! সারা মাস চলবে কী করে?

সেকেন্ডে সেকেন্ডে মনের মধ্যে ভেসে আসছে চিন্তাগুলো। অনাথবাবু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন।

পাঁচটা হায়েনা আনন্দে খলবল করছে। অপ্রত্যাশিত উপরি প্রাপ্তি জুটে গেছে।

হঠাৎ অনাথবাবুর পিছন থেকে ভেসে এল কঠিন কণ্ঠস্বর, কুত্তারা! সব ফেরত দিয়ে দে।

অনাথবাবু ফের শিউরে উঠলেন। ঘাড় ঘোরালেন। সাড়ে ছফুট লম্বা কালো পাহাড়ের মতো এক মানুষ। দুহাত কোমরে, জল তার হাঁটুর নীচে।

নীচুগলায় মানুষটি বলল, দাদু, একটু সরে যান।

পাঁচজনও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একজন বলল,তুই কে রে…বাচ্চা?

–তোর বাপ।

বলেই মানুষটা শূন্যে ঝাঁপ দিল। অনাথবাবু বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, জেট প্লেনের মতো কালো শরীরটা সমান্তরাল গতিতে ধেয়ে গেল সামনের দিকে।

তারপর এক অলৌকিক লড়াই। অন্ধকারে বিশেষ কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না অনাথবাবু। তবে শব্দ শুনছিলেন। উঃ, আঃ, ধুপ, গদ্দাম–বিকট সব শব্দ।

মনে হচ্ছিল, কালো কালো চারটে প্রত্যঙ্গ যেন বিদ্যুতের মতো ছিটকে ছিটকে উঠছিল বিভিন্ন দিকে।

মিনিটখানেকের মধ্যেই সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

ঠিক নিস্তব্ধ নয়, অস্ফুট কিছু কাতরানি তখনও শোনা যাচ্ছিল।

অনাথবাবু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চৌষট্টি বছরের জীবনে এমন দৃশ্য তিনি কখনও দেখেননি। নাঃ, ইংরেজি সিনেমা কিংবা টিভিতেও না!

অনাথবাবুর সব অবসাদ মুছে গেছে।

উনি ধীরপায়ে হাঁটলেন অকুস্থলের দিকে।

পাঁচটা বদমাসই জলের মধ্যে আধডোবা হয়ে পড়ে আছে। মহিলার হাতে ব্যাগ ফেরত চলে এসেছে। কালো মানুষটি তারের মতো কিছু দিয়ে সবকটাকে পিছমোড়া করে বাঁধছে। মহিলা চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

অনাথবাবু বললেন–ভাই, তোমাইয়ে, আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব, বুঝতে পারছি না। আপনি আপনি–

না না, এ আর এমনকী।–মানুষটি বলল, এটা আমাদের ডিউটি। আপনার কোনও চোট লাগেনি তো?

ও কিছু না।–অনাথবাবু বললেন, আপনি না থাকলে আজ কী যে হত!

কিছুই হত না। আর আমি তো থাকবই। থাকারই কথা। বি, তুমি ভদ্রলোকের টাকাটা দিয়ে দাও।

অনাথবাবু চমকে উঠলেন, এরা দুজন কী পূর্বপরিচিত?

ভদ্রমহিলা ব্যাগ থেকে অনাথবাবুর পকেটের টাকা, কাগজপত্র সব বের করে বাড়িয়ে ধরেছেন। অনাথবাবুর হাত কাঁপছে। উনি কম্পিত হাতে সেসব নিয়ে ঝুলপকেটে ঢোকালেন।

মানুষটি কি থটরিডিং জানে? মনের কথা পড়তে পারে? হ্যাঁ, নির্ঘাত পারে। তাই চটপট বাঁধাছাদা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ। আপনি ঠিক ধরেছেন। আমরা দুজনেই দুজনের পরিচিত। এক টিমে কাজ করি।

অনাথবাবু এতক্ষণে খুব কাছ থেকে দেখলেন মানুষটাকে। ইস্পাতের মতো সুঠাম শরীর। পরনে টাইট কালো প্যান্ট, কালো শার্ট। মাথায় হেলমেট গোছের কিছু।

তবে চোখদুটো স্বাভাবিক নয়। অন্যরকম। চোখে চোখ ফেলতেই অনাথবাবুর শরীর জুড়ে শিহরন বয়ে গেল।

কী অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! মনে হল, যেন তাঁর মনের খবর নিমেষে শুষে নিল চোখ দিয়ে।

অনাথবাবু তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন, তাহলে ভাই, এবার তো থানায়। খবর দিতে হয়।

তার কোনও দরকার নেই।–লোকটি বলল, এদের আমরাই নিয়ে যাব।

আপনারা নিয়ে যাবেন! কোথায়?

আমাদের সঙ্গে। লোকটি বলল, স্যার, কিছু মনে করবেন না, আপনার কৌতূহল বড় বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। এর জন্যেই বিপদে পড়েন। যাক গে, এখন অবশ্য সে ভয় নেই। শুনুন, আমরা ক্রিমিনালদের নিয়ে একটা গবেষণা করছি। তাই ক্রিমিনালদের, যেমন ছিনতাইবাজ, পকেটমার, গুণ্ডা, মস্তান এদের বিভিন্ন টাইপের স্যাম্পল আমাদের রাখা দরকার। আর তাই মাঝেমাঝেই–

অমনি অনাথবাবু বেমক্কা বলে ফেললেন,–ইনি সেজেগুজে নির্জন গলি দিয়ে হাঁটেন। যাতে কেউ বা কারা এসে ওনার ওপর চড়াও হয়। তখন আপনি

বাঃ! আপনি তো বেশ বুদ্ধিমান। লোকটি বলল, এদিকে কোথায় থাকেন?

দুই বাই তিন বিদ্যাসাগর স্ট্রিট। এই গলি দিয়ে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে বাঁদিকের দুটো বাড়ি ছেড়ে। আপনারা?

আমরা?–মানুষটির মুখে কি হাসির আভাস খেলে গেল? ঘন অন্ধকারে বোঝা গেল না। বলল, যখন যেখানে থাকি, সেটাই আমাদের ঘর। এখন আপনাদের কলকাতাতেই আছি। কাঁকুড়গাছির কাছে।

অনাথবাবুর সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথামুণ্ডু বুঝতেই পারছেন না। তবু বললেন,ও আচ্ছা। দেখুন, আপনাদের নামই জানা হয়নি। আপনি ওনাকে বি বলে ডাকলেন!

–হ্যাঁ। ওর নাম বি, আমার নাম এ।

–এ বি? মানে…ইয়ে…আপনাদের পুরো নাম–

–পুরোটুরো কিছু নেই। ধরুন আমি এ, মানে অনিন্দ্য। আর উনি বি মানে বনানী! এইরকম নামেই আমরা একে অন্যকে চিনি। নামে কী এসে যায় অনাথবাবু! এই যে আপনার নাম, এটা আসলে কী? একটা চিহ্ন। আপনার আইডেন্টিফিকেশন কোড। ইচ্ছে করলেই আপনি পালটে ফেলতে পারেন। তাই না?

আশ্চর্য! লোকটা তাঁর নামও জানে?

কথাটা ভাবতেই লোকটা মানে অনিন্দ্য আবার বলে উঠল, হ্যাঁ, জানি অনাথবাবু। আপনার অনেকখানি জেনে ফেলেছি। যেমন আপনার পুরো নাম অনাথবন্ধু, পদবী মিত্র। স্বামী স্ত্রী থাকেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে কানপুরে। আরও শুনবেন?…থাক, তাতে আপনার। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আপনাকে আমাদের বেশ ভালো লেগেছে। আপনার খারাপ লাগেনি তো?

না না, ছিঃ ছিঃ! কী যে বলেন।

অনিন্দ্য এবার জামার পকেট থেকে একটা আংটির মতো বস্তু বের করল। এই অন্ধকারেও তার থেকে অদ্ভুত নীল আলো বেরুচ্ছে। বলল,–নিন, বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিন।

অনাথবাবু আঙুলে সেটাকে পরতে পরতে বললেন,–এটা কী?

এটা এক ধরনের খুদে সিগন্যাল মেসেঞ্জার। অনিন্দ্য বলল, আপনার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ থাকবে। আপনি ইচ্ছে করলেই হবে যোগাযোগ। আমরাও করতে পারব।

কীভাবে?

–এই দেখুন, এখানে দুটো ছোট্ট বোতাম আছে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছে হলে আপনি যে-কোনও একটা টিপবেন। আর খুব জরুরি হলে একসঙ্গে দুটো বোতাম টিপে দেবেন। সঙ্গে-সঙ্গে যোগাযোগ হবে।

-তারপর?

–তারপর দেখবেন বা শুনবেন। তবে খুব দরকার না হলে বা মারাত্মক বিপদে না পড়লে দুটো বোতাম একসঙ্গে টিপবেন না। বাড়িতে টিভি আছে?

–হ্যাঁ।

–ব্যস। ওতেই হবে। তাহলে অনাথবাবু, এবার গুডনাইট। অনেক রাত হয়ে গেছে। খবরদার, কাউকে কিন্তু বলবেন না আংটির কথা। আপনার স্ত্রীকেও নয়। বাই! আমরা যাই, আপনিও এগোন।

অনিন্দ্য কথা শেষ করতে না করতেই অন্ধকারের বুকে হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানি। অনাথবাবুর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কিছু দেখতে পেলেন না।

এক সেকেন্ড পরে উনি দেখলেন, আবার সব জমাট অন্ধকার। জল থইথই পার্শিবাগানে অনাথবাবু একা দাঁড়িয়ে আছেন। কোথাও কেউ নেই!

.

০৩.

দাদুন, ও দাদুন! কেয়া করতা হ্যায়?

ঘরে ঢুকে পড়ল বন্দিত। অনাথবাবু আধশোয়া হয়ে কাগজটা পড়ছিলেন। উঠে বসলেন।

–কেন রে? আমি তো মানে এই

 কাগজ। সারাটা দিন ধরে কাগজ চিবোচ্ছো! এদিকে যে মাত্র পাঁচ দিন টাইম, ইয়াদ হ্যায়?

–পাঁচ দিন! কীসের?

–এই দ্যাখো! একদম ভুলে গেছ। সায়েন্স সিটি যাবার কথা হয়েছিল না? ডাইনোসর দেখাতে হবে না? শো বন্ধ হয়ে যাবে তো!

অনাথবাবু মাথা নাড়লেন। বললেন,–ঠিক হ্যায় দাদুভাই। আজই যায়েগা।

–তব রেডি হো যাইয়ে! দুপুরে লাঞ্চ করে তুম অওর ম্যায় নিকাল যাউঙ্গা। মা, দিদা বলল, ওরা যাবে না।

যেমন এসেছিল, তেমনি হুট করে বেরিয়ে গেল বন্দিত।

কয়েকদিন হল, মেয়ে কানপুর থেকে এসেছে বারো বছরের নাতিকে নিয়ে। বন্দিত জন্মেছে। কানপুরে। বাংলার মধ্যে মাঝে-মাঝেই হিন্দি ঢুকে পড়ে। অনাথবাবুও মজা করে ওর সঙ্গে হিন্দি মিশিয়ে কথা বলেন।

বুড়োবুড়ির নিঝুম পুরোনো বাড়ি এখন সারাদিন সরগরম। বন্দিত একাই মাতিয়ে রেখেছে।

অনাথবাবু কাগজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন। স্নানে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে না পড়লে, ছুটির দিনে সায়েন্স সিটিতে যা লাইন পড়ে যাচ্ছে, ঢোকা মুশকিল।

হঠাৎ পিপ-পিপ-পিপ…

চমকে উঠলেন অনাথবাবু। তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ! কোত্থেকে আসছে? একটানা হয়েই চলেছে,… পিপ-পিপ-পিপ…

অনাথবাবু চতুর্দিকে তাকাতে থাকেন। ওঁর ভ্রু কুঁচকে গেছে। শব্দটা ঘরেই কোথাও হচ্ছে।

কান খাড়া করলেন অনাথবাবু। একটু-একটু করে এগোতে থাকেন কোণের টেবিলের দিকে। হ্যাঁ। ওখান থেকেই আসছে।

চকিতে মাথায় বিদ্যুৎঝিলিক! সেই আংটিটা থেকে নয়তো? ওটা–ওটা টেবিলের ড্রয়ারেই আছে।

ইস! আংটিটার কথা এক্কেবারে ভুলে গেছিলেন অনাথবাবু! তিনমাস আগে ঝড়জলের আঁধারে পার্শিবাগানে যে অবিশ্বাস্য নাটক উনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেটা কি আদৌ সত্যি ছিল? ওঁর নিজেরই মাঝে-মাঝে খটকা লাগে। ওই আংটিটাই একমাত্র প্রমাণ। যদিও কোনও কাজে আসেনি এতদিন পর্যন্ত।

সে রাতে বাড়িতে ফিরে স্ত্রীকে সবকথা বলতে তিনি প্রথমে হাঁ করে তাকিয়েছিলেন। অনাথবাবুর বিধ্বস্ত চেহারা, ছেঁড়া পাঞ্জাবি, কিছু একটা তো ঘটেইছে। কিন্তু তাই বলে সব ভ্যানিশ? এ আবার হয় নাকি? ঘোর অবিশ্বাসে মাথা নেড়েছিলেন স্ত্রী,–তুমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলে নির্ঘাত। তারপর স্বপ্ন দেখেছ!

–তাহলে আমার এই দশা হল কী করে?

জলের মধ্যে পিছলে পড়ে গেছিলে।

অনিন্দ্য মানা করা সত্ত্বেও অনাথবাবু বেঁকের মাথায় তখন আংটিটা দেখিয়েছিলেন, আর এটা? এটা পেলাম কোত্থেকে?

কুড়িয়ে। কার না কার, রাস্তায় পড়েছিল। শিগগির ফেলে দাও! যত্তোসব উদ্ভুট্টে পাগলামি।

অনাথবাবু মনে মনে খুব নির্জীব হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। তবে আংটিটা ফেলেননি। হাতে থাকলে গিন্নির চোখে পড়তই। তাই খুলে রেখে দিয়েছিলেন টেবিলের ড্রয়ারে।

ড্রয়ার খুলে ফেললেন। যা ভেবেছেন, তাই। আংটিটা থেকেই অদ্ভুত পিপপিপ শব্দ বেরুচ্ছে। নীলাভ আলোও এখন দারুণ উজ্জ্বল। শব্দের তালে তালে কমছে বাড়ছে। খুদে দুটো বোতামও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

অনাথবাবু হাতে তুলে নিলেন আংটিটা। কী করবেন? একটানা শব্দটা হয়েই চলেছে।

মনে পড়ল, অনিন্দ্য বলেছিল, দরকার হলে যে-কোনও একটা বোতাম টিপতে। খুব জরুরি হলে দুটো।

যা হয় হোক গে! অনাথবাবু নখ দিয়ে একটা বোতাম টিপে দিলেন।

ব্যস, অমনি শব্দ বন্ধ। আর সঙ্গে সঙ্গে আংটির ভেতর থেকে কী সব কথা ভেসে এল। কিছুই বোঝা গেল না।

অনাথবাবু আবার বোতামটা টিপলেন। আংটি ধরলেন কানের কাছে।

স্পষ্ট শুনলেন,–টিভি খুলুন! টিভি খুলুন!

ঠিক দুবার।

অনাথবাবু ভ্যাবাচাকা। ঠিক সে রাতের মতো। টেলিভিশনের সুইচটা শুধু অন্ করে দিলেন।

কয়েক সেকেন্ড স্ক্রিন ঝিলঝিল করল। তারপরেই সেখানে ভেসে উঠল অনিন্দ্যর মুখ।

নমস্কার অনাথবাবু। কেমন আছেন?

–ভ-ভালো।

–আমাদের একদম ভুলে গেলেন? এতটা সময় চলে গেল, একবারও যোগাযোগ করলেন না? আমরা কি খুব খারাপ?

না না। এ কী বলছেন! মানে, ইয়ে আপনারাই বলেছিলেন দরকার পড়লে খবর দিতে। তা তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি তো, তাই শুধুমুদু আপনাদের বিরক্ত করিনি।

–হুঁ। কিন্তু যদি ধরুন, আগাম কোনও অসুবিধে আসছে, যেটা আপনি জানেন না? সামনে আপনার ভয়ংকর সর্বনাশ?

–সেটা কী করে বুঝব? আমি তো আর জ্যোতিষী নই।

 –জ্যোতিষী! সে আবার কী?

–একধরনের লোক। তারা হাত দেখে, গ্রহনক্ষত্র মিলিয়ে ভবিষ্যৎ বলে দেয়।

–বোগাস্! হাতের সঙ্গে ভবিষ্যতের কী সম্পর্ক? ইয়েস!…এবার বুঝেছি। এই ইনফর্মেশনটার ইনপুট ছিল না। শুনুন মশাই, ভবিষ্যৎ বলার জন্যে হাতটাত বা গ্রহতারা, ওসব বিচার করতে হয় না। ওভাবে বলা যায়ও না। ওরা লোক ঠকায়। আমরা ভবিষ্যৎ বলি অতীত আর বর্তমানকে বিচার করে। সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট গতি আছে। নির্দিষ্ট পথ আছে। সেই পথ যখনই একচুল এদিক ওদিক হয়, সংঘর্ষ হয়, সর্বনাশ হয়। বুঝলেন কিছু?

না–মানে ঠিক…।

 বুঝবেন না। খুব জটিল ব্যাপার। শুনুন, সেদিনই আপনাকে বলেছিলাম, আপনাকে আমাদের ভালো লেগেছে। আপনার সব ইনফর্মেশন ডাটা আমাদের মেমরি ব্যাঙ্কে মজুত আছে। মনিটরিং হচ্ছে। সামনে আপনার বিপদ। বুঝলেন, খুব বিপদ।

–সে কী!

–হ্যাঁ। আজ নাতির সঙ্গে আপনার বেড়াতে যাবার কথা না?

–হ্যাঁ। ওকে সায়েন্স সিটি দেখাতে নিয়ে যাব।

যাবেন না। শরীর খারাপ লাগছে বলে শুয়ে পড়ুন। যে বাসে আপনারা যাবেন, সেই বাসটা অ্যাকসিডেন্ট হবে। অনেক মানুষ মারা যাবে।

অ্যাসিডেন্ট! অনাথবাবু ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন। শরীর ঘেমে উঠেছে।

স্ক্রিনে অনিন্দ্য বলে উঠল,–এত ঘাবড়াবার কিছু নেই। আর হ্যাঁ, আপনাকেও আমাদের দরকার। কয়েকটা ব্যাপার আপনার কাছ থেকে বুঝতে হবে।

–আ-আমার কাছে?

 –হ্যাঁ। এখন নয়। কাল রাতে আসব। বারোটার পরে। একটু কষ্ট করে জেগে থাকবেন।

 –আ-আচ্ছা।

–ঠিক আছে। তাহলে চলি। ভালো থাকুন। আংটিটা আঙুলে পরেই রাখুন। স্ত্রীর কথায় কান দেবেন না। বাই!

টেলিভিশন আবার ঝিলঝিল শুরু করে দিল। অনাথবাবু উঠে অফ করে বিছানায় গড়িয়ে পড়লেন। শরীরটা এখন সত্যিই খারাপ লাগছে।

একমিনিটের মধ্যে ঘরে ঢুকল বন্দিত।

–এ কী দাদুন! আভিতক শুয়ে আছ? রেডি হবে না?

–নারে দাদুভাই! শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছে। বুড্ডা হয়েছি তো, হাতে পায়ে মোটে বল পাচ্ছি না।

য-যাঃ। হয়ে গেল। বন্দিত হতাশভাবে বলল, তব কেয়া হোগা?

কাল যাব। আজকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাব। কাল নিশ্চয়ই যাব।..

বিকেলে টুকিটাকি কেনাকাটা করতে শ্রীমানী মার্কেট গেছিলেন অনাথবাবু। বাড়িতে পা দিতেই মেয়ে অসীমা চেঁচিয়ে উঠল,বাপি! অ্যাসিডেন্ট! এইমাত্র টিভি নিউজে দেখাল। উঃ! বীভৎস! দেখা যায় না।

অনাথবন্ধু মিত্র ড্যাবড্যাব চোখে তাকালেন। শরীর ফের অবশ লাগতে শুরু করেছে। বিড়বিড় করে বললেন,–কোথায়?

সরকারি বাস। ব্রেকফেল করেছিল। শিয়ালদা ফ্লাইওভারের ওপর থেকে উল্টে পড়েছে। দশজন স্পটডেড়, বাকি পঞ্চাশজনের অবস্থা এখন-তখন।

.

০৪.

নাতিকে নিয়ে সায়েন্স সিটি ঘুরে ফিরে এসেছেন সন্ধে নাগাদ। আর তারপর থেকেই রীতিমতো আনচান করছেন। বারবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। আজ রাত বারোটাতেই তো অনিন্দ্যর আসার কথা।

বন্দিত ঠিক লক্ষ্য করেছে দাদুকে।

দাদুন?

-উ?

–তোমার হয়েছে কী বল তো?

–কেন রে? কী আবার হবে?

 –এরকম বেচ্যায়েন হোচ্ছো কেন?

–বেচ্যায়েন! ধূৎ, কী যে বলিস! আজ কীরকম ধকলটা গেছে বল তো? তোর ওই রোবট ডাইনোসর দেখতে আড়াই ঘণ্টা ঠা-ঠা রোদ্দুরে–এই বুড়ো হাড়ে এত সয়? তাই ঘড়ি দেখছি, তোর দিদার রান্না হলেই দুটো মুখে গুঁজে শুয়ে পড়ব। শরীর আর দিচ্ছে না। দ্যাখ তো, হল কি না।

বন্দিত দাদুকে আপাদমস্তক খুটিয়ে দেখে রান্নাঘরে খোঁজ নিতে গেল। অনাথবাবু হাঁফ ছাড়লেন। বয়সে ছেলেমানুষ হলে হবে কী, তার দৌহিত্রটি খুব বুদ্ধিমান।

কিন্তু অনিন্দ্য আজ আসবে কোথায়? কীভাবে? রাস্তা দিয়ে রাত বারোটায় এসে নিশ্চয়ই ডাকবে না!

এই পুরোনো বাড়িতে অনাথবাবুর ভাগে ঘর মোটে দেড়খানা। দোতলার পনেরো বাই দশ একখানা ঘর, আর ছাদের একচিলতে চিলেকোঠা। অন্যসময় ওঁরা বুড়োবুড়ি দোতলায় থাকেন। চিলেকোঠা জিনিসপত্রে ভর্তি। বন্ধ থাকে।

মেয়ে, নাতি এলে ওরা সকলে দোতলার ঘরে থাকে। অনাথবাবু রাতটুকু কাটান চিলেকোঠায়। তো সেখানে তো টিভিও নেই। তাহলে অনিন্দ্য কী করে কথা বলবে?

তবে কি অনিন্দ্য সশরীরে আসবে দেখা করতে। কিন্তু কীভাবে? ও তো আর ভূতপ্রেত নয়, যে উড়ে এসে গেল!

তবে এতদিনে অনাথবাবু মোটামুটি কনফার্ম হয়ে গেছেন, অনিন্দ্যরা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো নয়। ভেবেছেন, জিগ্যেস করবেন। সাহস হয়নি। নিশ্চয়ই ও একদিন-না-একদিন বলবে।….

রুটি-দুধ তড়িঘড়ি খেয়ে সাড়ে দশটার মধ্যেই অনাথবাবু বিছানা বালিশ নিয়ে চলে এলেন। ছাদে। বন্দিত পিছু নিতে চেয়েছিল। তাকে নিবৃত্ত করা গেছে।

রোজকার মতো চিলেকোঠার শিকল নামিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছেন, হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ পড়ল। চমকে উঠলেন। যা ব্বাবা! কালো আকাশ মেঘে মেঘে লালচে হয়ে উঠেছে।

অদ্ভুত ব্যাপার! সারাটা দিন ফটফটে রোদ্দুর। আকাশ একেবারে নীল। এত মেঘ এসে জমল কোত্থেকে? আবার বৃষ্টি নামবে নাকি? চিলেকোঠার পুরোনো জানলাটা আবার ভালো বন্ধ হয় না। জল ঢুকে দফারফা হয়ে যাবে।

একটু-একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এর চেয়ে নীচে শোওয়া ভালো ছিল। মেঝেয় বিছানা পেতে নিতেন।

কিন্তু অনিন্দ্য? ও যে দেখা করবে বলেছে।

হঠাৎ পিপ.পিপ.পি্প…! অদ্ভুত আংটি বাজতে শুরু করল। নীলাভ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

অনাথবাবু তাড়াতাড়ি নখ দিয়ে টিপে দিলেন উপরের একটা বোতাম। কান নামিয়ে আনলেন।

শব্দটা বন্ধ হল। বিনবিনে কণ্ঠ শোনা গেল, সব ঠিক হয়ে যাবে।…এখন বৃষ্টি হবে না। নীচে যাবেন না।

দুগগা! দুগগা! অনিন্দ্য সব দেখতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে! এসব হচ্ছে কী? ওরা কি আশপাশেই আছে? অনাথবাবুর গাটা ছমছম করে উঠল। অনিন্দ্য অশরীরী নয় তো?

অনাথবাবু নিজেকে প্রাণপণে সাহস দিলেন। অনিন্দ্যদের ওনাকে পছন্দ হয়েছে, বলেছে। নিশ্চয়ই ওর কোনও ক্ষতি করবে না।

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। নিস্তব্ধ কলকাতা। মাঝে মাঝে হুস্ হুস করে দু-একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে আমহার্স্ট স্ট্রিট দিয়ে।

অন্ধকার ছাদে, চিলেকোঠায় দোরগোড়ায় অনাথবাবু চুপচাপ বসে আছেন।

বৃষ্টি এখনও নামেনি। তবে একটু-একটু হাওয়া দিচ্ছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে মাঝে-মাঝে চিরে-চিরে উঠছে বিদ্যুৎ, বাজের মৃদু শব্দও শোনা যাচ্ছে।

ছাদের দক্ষিণে বিদ্যাসাগর স্ট্রিট। রাস্তার ওধারে একটা আঁকড়া অশ্বত্থাগাছ। সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলো তার শরীরে পড়ে রাস্তায় আলো আঁধারির নকশা কেটেছে। হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো কাঁপছে। তার ভূতুড়ে ছায়া নাচছে ছাদে।

অনাথবাবু খুব শক্ত করে নিজেকে ধরে রেখেছেন। কিছুতেই উনি ভয় পাবেন না।

ঢং…ঢং…ঢং…।

পাশের মুখুজ্জেবাড়ির বারান্দার ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে।

হঠাৎ আকাশকে এফোঁড়-ওফেঁড় করে তীব্র বিদ্যুৎ ঝিলিক! অনাথবাবুর চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

তারপরেই শুনতে পেলেন,নমস্কার অনাথবাবু!

একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে সশরীরে অনিন্দ্য! অনাথবাবু একটু কেঁপে উঠে নিজেকে সামলে নিলেন। আজ অবশ্য ছিমছাম প্যান্টশার্ট পরা। মাথায় টুপি-হেলমেট কিছু নেই।

–একটু ভয় করছিল। তাই না? –না…তেমন…মানে…ওই আর কী!

কিছু করার নেই, জানেন।–অনিন্দ্য বলল, আমরা আবার মেঘ না জমলে আসতে পারি না। আসলে ওই বিদ্যুতের শিখা বেয়েই…যাক্ গে। ভালো আছেন তো?

ইয়ে…হ্যাঁ…নিশ্চয়ই। আপনি কাল না জানিয়ে দিলে এতক্ষণে–দাদু-নাতি কেউই আর কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব!

–কোনও দরকার নেই। সবসময় আংটিটা পরে থাকবেন। আমরা ঠিকসময়ে অ্যালার্ট করে দেব। আপনার মতো বুদ্ধিমান বন্ধু থাকা আমাদেরও খুব দরকার।

–হেঁ-হেঁ। কী যে বলেন।

–ঠিকই বলছি। শুনুন, কতকগুলো ইনফর্মেশন আমাদের খুব প্রয়োজন।

—বলুন।

–অনাথবাবু, আমরা একটা প্রশ্নের কিছুতেই জবাব পাচ্ছি না। মানে যুক্তি দিয়ে মেলাতে পারছি না। এই গোটা পৃথিবীটাতেই তো একটাই প্রাণী রাজত্ব করছে। মানুষ তাই তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

–তাহলে বলুন, পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে এত ভাগ কেন? এতগুলো দেশ, এতগুলো গোষ্ঠী, সবাই সবার থেকে আলাদা থাকতে চায়। কেন?

অনাথবাবু ফের চমকে উঠছেন। এই পৃথিবী মানুষ! অনিন্দ্যরা তাহলে কারা?

অনিন্দ্য বলে উঠল,বলব অনাথবাবু, সব আপনাকে বলব। আমাদের পরিচয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।

না…মানে…হ্যাঁ-হ্যাঁ বলছি। আমাদের মানুষদের নানা ভাগ। নানা জাত, ধর্ম, ভাষা সব আলাদা-আলাদা তো।

উঁহু! তেমন ভাগ থাকুক, তাতে ক্ষতি নেই। মূল ভাগ তো দুটো। একদলের প্রচুর আছে, আবার অন্যদের অবস্থা এমন যে খেতেই পায় না। আবার একটা দলকে দেখছি, যাদের মগজভর্তি হিংসা, রাগ, সব কুৎসিত বস্তু। অনেকটা আপনাদের বনের হিংস্র জন্তুদের মতো। ছিঁড়ে কামড়ে খায়। সেদিন আপনার সামনে থেকে যেগুলোকে ধরে নিয়ে গেছিলাম, তারা ওই ধরনের।

হ্যাঁ! আসলে ওরা, যারা খেতে পায় না, তাদের মধ্যে থেকেই তৈরি হয়। ওদের আবার পোযে প্রচুর ধনীরা। দরকার পড়লে গরিবদের দিকেই লেলিয়ে দেয়।

–ভারী অদ্ভুত তো অনাথবাবু! একটাই জাত আপনারা! এতবড় পৃথিবী, তার কত সম্পদ, মানুষরা যথেষ্ট উন্নতিও করেছে। তবুও সকলে মিলেমিশে ভালোভাবে থাকবে না? আঁচড়াবে, কামড়াবে?

কী বলব বলুন। আসলে গোলমালটা অন্য জায়গায়, অনিন্দ্য। মানুষের চাহিদার শেষ নেই। আমি মুখ্যসুস্থ মানুষ, তবু যতটুকু বুঝি, বলছি। এই চাহিদাই কিন্তু আমাদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা পৃথিবীকে শাসন করছি। তার সম্পদকে কাজে লাগিয়েছি। আবার এই চাহিদারই খারাপ দিক নিজের জন্যে চাওয়া। আরও টাকা চাই, আরও সুখ চাই, কিছুতেই কেউ খুশি হয় না।

বুঝলাম। খুব মুশকিল। আচ্ছা একটা কাজ করা যায় না অনাথবাবু? মানুষের মধ্যে থেকে এই আমি-আমি ব্যাপারটাকে যদি মুছে ফেলা যায়? যদি রাগ, লোভ, হিংসা, ঘেন্না মানুষের মধ্যে না থাকে, তাহলে? জিনিসগুলো যদি উড়িয়ে দেওয়া যায়? তাহলে তো পৃথিবীটা পালটে যাবে, নাকি?

অনাথবাবুর হাসি পেল। বললেন,–সে কি কখনও সম্ভব? পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ। তাদের ব্রেন থেকে এইসব বদগুণ বের করা যায় নাকি? তাহলে তো সবাই সাধুপুরুষ হয়ে যাবে! কী যে বলেন মশাই! আমি তো দেখছি, যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবীটা বাজে লোকে ভরে যাচ্ছে।

কী!–অনিন্দ্য উত্তেজিতভাবে বলল, বাজে লোক বাড়ছে? তার মানে…তার মানে… আপনাদের সভ্যতা এখন নীচের দিকে নামছে? তাতে তো ভয়ংকর ব্যাপার হবে। নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি মারামারি করে আপনারা সব শেষ হয়ে যাবেন। এঃ, এমন চমৎকার জায়গাটা ধ্বংস হয়ে যাবে? একমিনিট দেখি!

বলতে বলতে অনিন্দ্য পকেট থেকে একটা ছোট্ট টিভির মতো যন্ত্র বের করল। তাতে কীসব বোম টিপছে আর ঘনঘন মাথা নাড়ছে।

আস্তে-আস্তে অনিন্দ্যর হাবভাব বদলে গেল। খুব চিন্তিতভাবে বলল, হ্যাঁ অনাথবাবু। ঠিক বলেছেন। আপনাদের ভবিষ্যৎ বেশ খারাপ। কিন্তু…

একটু থেমে বলল, কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। অন্তত আমাদের ইনফর্মেশন ব্যাঙ্ক-এর অ্যানালিসিস অনুযায়ী মানুষের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে। অন্য কোথাও…কোনও ষড়যন্ত্র হচ্ছে?

অনিন্দ্য, একটা কথা জিগ্যেস করব? কিছু মনে করবেন না তো?

না-না, বলুন।

আপনাদের পরিচয় কিন্তু পাইনি। মানে আপনারা ইয়ে…মানে মানুষ তো নিশ্চয়ই…কিন্তু মানে…

–অত মানে মানে করছেন কেন বলুন তো? অনাথবাবু, আমরা এই পৃথিবীর নই। এমনকী মানুষও নই। আমরা, বরং বলতে পারেন একরকম ভাইরাস!

ভাইরাস! অনাথবাবু স্তম্ভিত।

–যাচ্চলে! এত ঘাবড়ে গেলেন কেন? আপনাদের পৃথিবীতে বিবর্তনের ধারায় সবশেষে এসেছেন আপনারা, মানুষরা, তাই তো? তেমনি আমাদের ওখানে বিবর্তন আবার উলটোদিকে বয়ে গেছে। জীবন আকারে ছোট হতে হতে সব শেষে অতি ছোট কণিকা হয়ে গেছে। সেই কণিকারা সর্বশক্তিমান। পারে না এমন কিছু নেই। আমরা আলোয় ভেসে যেতে পারি এ জগৎ থেকে ও জগতে, আমরা যে-কোনও সময় যে-কোনও রূপ ধরতে পারি, আমরা শক্তিতে দেশ কে দেশ উড়িয়ে দিতে পারি। ওই যে তখন বললাম না, চাইলে কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাদের। পৃথিবীর সব মানুষের ব্রেনও শুধরে দিতে পারি। স্রেফ প্রোগ্রাম বদলের মতো।… বিজ্ঞানে আমরা নিজেদের ওই জায়গাতেই নিয়ে গেছি। আমাদের সঙ্গে আপনি জীবন্ত পরমাণুর তুলনা করতে পারেন। পরমাণুর যেমন অশেষ শক্তি, তেমনি আমাদেরও। বুঝলেন?

পরমাণু! ভাইরাস! অনাথবাবু পুরো তালগোল পাকিয়ে গেছেন। অনিন্দ্য একটা পরমাণু! অবিশ্বাস্য।

বেশ কিছুক্ষণ লাগল ধাতস্থ হতে। তারপর নির্জীব গলায় বললেন,অ-আপনারা কোত্থেকে…মানে কোনও গ্রহ থেকে নিশ্চয়ই এসেছেন?

হ্যাঁ।–অনিন্দ্য বলল, কিন্তু কী করে বোঝাই বলুন তো আপনাকে! আমাদের নক্ষত্রের নাম S। এই পৃথিবী থেকে, যাকে আপনারা বলেন ছায়াপথ, সেইরকম একশোটা ছায়াপথ পেরিয়ে।

অনাথবাবু এখন আর নতুন করে অবাক হচ্ছেন না। উনি যেন জেগে স্বপ্ন দেখছেন বা কোনও সায়েন্স ফিকশন শুনছেন। বললেন, কী করে এলেন? মহাকাশযানে চেপে?

নাঃ! আমাদের কোনও স্পেসশিপ লাগে না। আমরা এসেছি মহাজাগতিক কণায় ভেসে। এভাবেই এই গ্রহ, ওই নক্ষত্র ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেখছি, শিখছি, শেখাচ্ছি।

–এখানে ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণ দেখেছেন?

হাঃ হাঃ হাঃ। অনিন্দ্য অবিকল মানুষের মতোই হেসে বলল, বলেন কী মশাই, প্রাণ? সে তো ভূরিভূরি। প্রতি দশ নক্ষত্রমণ্ডলে অন্তত একজায়গায় প্রাণ আছে। কতরকম প্রাণী যে দেখেছি, বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের কাছে স্যাও রাখা আছে। জ্যান্ত এনে দেখাতে পারি। দেখবেন? ভয় পাবেন না তো?

না না। ওসবের দরকার নেই। এরপর আপনাদের প্রোগ্রাম কী অনিন্দ্য? আমাদের পৃথিবীকে শোধরাতে পারবেন? ভেবেছেন কিছু?

ভাবিনি কিছুই। আপনার কথাগুলো শুনে মনটা বড় খারাপ হয়ে গেছে অনাথবাবু। দেখতে হবে, কোনও চক্রান্ত হচ্ছে কিনা আপনাদের পৃথিবী নিয়ে…। বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে দেখি।

–আচ্ছা, সেদিন যে ছেলেগুলোকে ধরে নিয়ে গেলেন ওদের কী খবর? আপনাদের কাছেই রেখেছেন?

না। ওদের মেরামত করে ছেড়ে দিয়েছি। তবে এখানে না, এখন ওরা তিব্বতে। একটা খামারে কাজ করছে। তিব্বতী ভাষাও মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছি। ভালোই আছে।

প্রবল জোরে হঠাৎ হাওয়া বইতে শুরু করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আকাশের দিকে তাকাল অনিন্দ্য। অস্থিরভাবে বলে উঠল,আরে, আরে! এটা কী হচ্ছে? মেঘ হঠাৎ কেটে যাচ্ছে কেন? এমন তো কথা নয়। ডানহাতটা উপরের দিকে তুলল।নাঃ!..কাজ করছে না!..আশ্চর্য! আমার শক্তি চলে যাচ্ছে!..

অনাথবাবু দেখলেন, ঝোড়ো হাওয়ায় আকাশের উত্তরকোণে মেঘ অনেকখানি ফাঁকা হয়ে গেছে। কয়েকটা তারা ঝিকমিক করছে।

সর্বনাশ অনাথবাবু! বুঝেছি…ষড়যন্ত্র..চক্রান্ত! দেখছি, সময় নেই..আটকে পড়ব…পরে কথা বলব…চলি…

অনিন্দ্যর কথাগুলো দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। ছাদের ওপর ফের বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল!

অনিন্দ্য অদৃশ্য!

 হাওয়ায় অশ্বত্থাগাছের ডালপালা দুলছে, আবার আলোর নানারকম ছায়া নাচছে ছাদে।

অনাথবাবু বিছানা বালিশ বগলে করে গুটিগুটি নীচে নেমে এলেন। এরপর ছাদে একা থাকা ঠিক হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *