৫.১ ব্যাপক প্রত্যাশা

পঞ্চম খণ্ড – ব্যাপক প্রত্যাশা

২০. অতল গহ্বর

আবারো প্রায় তিন বছরের বেশি সময় পরে তার প্রথম যাত্রার পর সেলিম একটি হাতির পিঠের হাওদার উপর বসে ছিলো যেটি দোদুল্যমান গতিতে কাশ্মীরের পথে এগিয়ে চলেছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের এই দীর্ঘ ভ্রমণের লক্ষ্য এখন শান্তি এবং প্রমোদ, যুদ্ধ বা বিজয়াভিযান নয়। সে এবং তার পিতা উভয়েই কাশ্মীরের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছে, এর শান্তিময় উপত্যকা, টলমলে স্বচ্ছ জল বিশিষ্ট হ্রদ, ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকা তৃণভূমি একং সবকিছুর উপরে এর স্বস্তিকর শীতল আবহাওয়া। সেলিমের সম্মুখে আরো এক ডজন হাতি রয়েছে, সেগুলি মোগল যোদ্ধাদের বহন করছে না, বহন করছে তার হেরেমের সদস্যদের। সবচেয়ে কাছের হাতিটিতে রয়েছে মান বাঈ, দুই বছর বয়সী খোসরুকে নিয়ে। পরের দুটি হাড়িতে রয়েছে সাহেব জামাল সঙ্গে পারভেজ, এই শিশুপুত্রটিকে সে তিন মাস আগে জন্ম দিয়েছে, তারপরে রয়েছে যোধ বাঈ। সেলিমের দল থেকে কিছুটা সামনে রয়েছে তার বাবার হেরেমের সদস্যরা। তাঁদের মধ্যে সেলিমের মা হিরা বাঈ ছিলেন না, কাশ্মীরের ঠাণ্ডা পাহাড়ী আবহাওয়াকে অবজ্ঞা করে তিনি নিজের রৌদ্রতপ্ত দেশে বেড়াতে গেছেন। কিন্তু সেলিমের দাদীমা হামিদা ছিলেন এবং সেলিম তাতেই সন্তুষ্ট। সেলিম বিয়ের পরেও তাঁকেই তার সবচেয়ে আস্থাভাজন আত্মীয় হিসেবে গণ্য করে। আকবর যথারীতি সবচেয়ে অগ্রভাগের হাতিটির পিঠে ভ্রমণ করছিলেন।

 যদিও সেলিম তার বাবার সকল আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, তার জন্য তাঁর পরিকল্পিত সকল বিয়েতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছে, তথাপিও কাশ্মীরের সুলতানকে দমন করার সময় বাবার সঙ্গে সে যে অন্তরঙ্গতা অনুভব করেছিলো তাতে ক্রমশ ভাটা পড়েছে। সে আশা করেছিলো আকবরের প্রথম নাতির জন্মদাতা হওয়ার সুবাদে আকবর তার প্রতি এবং তার সন্তানের প্রতি আরো উষ্ণ নৈকট্য প্রদর্শন করবেন। কিন্তু সেলিমকে ক্রমবর্ধমান হতাশার অন্ধকারে ডুবিয়ে তার বাবা সাম্রাজ্যবিস্তার এবং এর সাবলীল পরিচালনার বিষয়ে বেশি মনোযোগ প্রদান করেছেন এবং তাঁর দার্শনীক চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত থেকেছেন। জ্যেষ্ঠ পুত্রকে অধিক সময় দেয়া কিম্বা তাকে প্রশাসনিক কাজে অন্তর্ভূক্ত করার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ তার পিতার মাঝে সে দেখতে পাচ্ছে না। অথচ আবুল ফজলের সঙ্গে তাঁর অন্ত রঙ্গতা অনেক বেশি, সেলিমের দৃঢ় বিশ্বাস আবুল ফজল তার চাটুকারী জিহ্বার সাহায্যে উপকারের পরিবর্তে তার পিতার ক্ষতিই সাধন করছে। যে সব প্রশাসনিক উদ্যোগ এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সেলিমের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা উচিত ছিলো ভবিষ্যতের জন্য তাকে তৈরি করার জন্য সে সব বিষয়ে তিনি আবুল ফজলের সঙ্গে পরামর্শ করেন। বিভিন্ন পদে আবুল ফজলের বন্ধু ও আস্থাভাজনরাই নিয়োগ পায়। এমনও গুজব শোনা যাচ্ছিলো যে বিভিন্ন পদে তার বন্ধুদের নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করার জন্য সে প্রচুর পরিমাণে ঘুষও গ্রহণ করছিলো এবং তার ভোজন বিলাসিতাও চরমে পৌঁছেছে। আবুল ফজলের বাবুর্চি সেলিমের ভূত্যকে গর্ব করে বলেছে সে নাকি দৈনিক সাড়ে তেরো কেজি খাদ্য গ্রহণ করে এবং কোনো কোনো রাতে এর অতিরিক্ত নাস্তা খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে।

আবুল ফজল এবং তার পিতা সংক্রান্ত চিন্তায় বাধা পড়লো, সেলিম দেখলো তার সহযাত্রী সুলায়মান বেগ হাওদার পর্দাগুলি টেনেটুনে ঠিকঠাক করছে কারণ প্রবল উত্তরীয় হাওয়ার প্রভাবে বৃষ্টির ছাট হাওদার মধ্যে আসতে শুরু করেছে। কাশ্মীরের এই দ্বিতীয় অভিযানের উদ্দেশ্য যেমন ভিন্ন তেমনি আবহাওয়াও। এখানে এখন বসন্তকাল চলছে। যখন থেকে তারা সংকীর্ণ গিরিপথ এবং গিরিসঙ্কটের মধ্যে প্রবেশ করেছে তখন থেকেই অঝর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ভারে পাহাড়ের ঢালে জন্মে থাকা বেগুনি ফুল শোভিত রডোডেন গাছ গুলি নুয়ে পড়েছে। সেলিম হাওদার পর্দার ফাঁক দিয়ে ডান দিকে তাকালো, দেখলো পাহাড়ী ঢলের পানি কাশ্মীর মুখী সংঙ্কীর্ণ সর্পিল পথের উপর তীব্র বেগে আছড়ে পড়ছে। রাস্তার বাম পাশের ভূতল প্রায় পঞ্চাশ ফুট নিচু এবং সেখানে প্রবাহিত হচ্ছে খরস্রোতা বরফ গলা নদী যাতে বৃষ্টির পানি যুক্ত হয়ে স্রোতের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

 প্রতিবার যখন আমি তাকাচ্ছি দেখতে পাচ্ছি নদীর জলসীমার উচ্চতা বৃদ্ধি পায়েছে, সুলায়মান বেগ বললো।

হ্যাঁ। আমাদের সম্মুখে যারা রয়েছে তাবু খাটানোর জন্য শুকনো ভূমি খুঁজে পেতে তাঁদের অসুবিধা হবে।

হঠাৎ সামনের রাস্তার তীক্ষ্ম বাঁকের দিক থেকে একটি পতনের শব্দ সেলিমের কানে এলো সেই সাথে গুড় গুড় করে যেনো কিছু গড়িয়ে পড়লো এবং তারপর মানব কণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকার শোনা গেলো। ওটা কিসের শব্দ? নিশ্চয়ই কোনো ধরনের আক্রমণ হয়নি।

না, আমার মনে হয় ওটা ভূমিধ্বসের শব্দ। সুলায়মান বেগ উঠে দাঁড়িয়ে গভীর সঙ্কীর্ণ উপত্যকার দিকে তাকালো।

 সেলিম তার দুধভাই এর আঙ্গুল দ্বারা নির্দেশিত দিকে তাকালো। মাটি এবং পথের পড়ে নদীতে আংশিক বাধ সৃষ্টি হয়েছে। ওখানে কি একটি হাতি পড়ে রয়েছে না? মাহুত, তোমার হাতিকে হাঁটতে ভর দিয়ে বসাও! সেলিম আদেশ দিলো। হাতিটি পুরোপুরি বসতে পারার আগেই সেলিম ও সুলায়মান বেগ উভয়েই মাটিতে লাফিয়ে পড়ে কাদাপানি ছিটকে সম্মুখে দৌড়ে গেলো কি ঘটেছে দেখার জন্য।

রাস্তার বাঁক ঘুরে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের বহনকারী হাতিগুলি নিরাপদে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলো। তবে যে দুর্ঘটনাটি একটু আগে ঘটেছে তাও স্পষ্ট বোঝা গেলো। পাহাড়ের ঢাল থেকে পাথরের চাই খসে পড়ে ত্রিশ ফুটের মতো বিস্তৃত রাস্তা ভেঙ্গে নিয়ে নদীতে পড়েছে। ধ্বসে পড়া পাথর এবং মাটির মধ্যে একটি হাতির দেহের অংশ বিশেষ বের হয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে; দ্বিতীয় আরেকটি হাতির অর্ধেক দেহ নদীতে এবং অর্ধেক দেহ পারে পড়ে রয়েছে এবং সেটার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জল জানোয়ারটির রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে। সেটার ভগ্ন হাওদাটি পাশেই পড়ে রয়েছে, নদীতে ছড়ানো পাথরের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে টুকরো হয়ে গেছে। ধ্বসের পাশে জমে উঠা ভিড় ঠেলে অগ্রসর হতে হতে সেলিম জিজ্ঞাসা করলো, ঐ হাতিগুলির পিঠে কারা ভ্রমণ করছিলো?

 আপনার দাদীমার পরিচারিকাদের কয়েকজন জাঁহাপনা, ভিড়ের মধ্য থেকে একজন উত্তর দিলো।

আমি পরিতাপের সঙ্গে জানাচ্ছি তাঁদের একজন ছিলো বৃদ্ধা জোবায়দা, আপনার শৈশবের একজন পরিচর্যাকারী। আপনার দাদী ভেবেছিলেন পাহাড়ের ঠাণ্ডা আবহাওয়া তার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে, একজন শীর্ণ দেহের অধিকারী বৃদ্ধ মন্তব্য করলো। সেলিম তাকে তার দাদীর খেদমতগার হিসেবে চিনতে পারলো। মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি তার হাওদাটি কোথায় পড়েছে।

নদীর তীরে যেটা চৌচিড় হয়ে পড়ে রয়েছে সেটা?

 না, ওটাতে আপনার দাদীর অন্য চারজন ভৃত্য ছিলো এবং আমার ধারণা তারা সকলে মারা গেছে। তাদের একজনের দেহকে আমি নদীর স্রোতে ভেসে যেতে দেখেছি। জোবায়দার হাওদাটি সম্ভবত পতনের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতিটির পিঠ থেকে ছুটে যায়। আমি বোধহয় সেটাকেই পাহাড়ের একটি খাজে জন্মে থাকা কিছু গাছপালার সঙ্গে আটকে থাকতে দেখেছি, তবে সেখানকার মাটি ও পাথর ক্রমশ পানির তোড়ে খসে যাচ্ছে।

 সুলায়মান, আমার কোমর বন্ধনীটা ধরো, বলে সেলিম ঢালের কিনারে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল এবং যতোটা সম্ভব সামনে ঝুঁকে নিচে দেখার চেষ্টা করলো। সেলিম দেখতে পেলো হওদাটি পাহাড়ের খাঁজের কোথায় আটকে আছে। কিন্তু সেটার আরোহীরা কোথায়? ভূমিধ্বসের পাথর-মাটি জমে থাকার জন্য আর কিছু এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।

সুলায়মান, শক্ত করে আমাকে ধরো। আমি চেষ্টা করছি আরো একটু ভালোমতো দেখার জন্য। যখন সেলিম আরো সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো, সে নীচ থেকে অস্পষ্ট একটি চিৎকার শুনতে পেলো। কেউ বেঁচে রয়েছে। যারা খাদে পড়ে গেছে তাদের উদ্ধার করতে হলে দ্রুত কিছু করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি সেলিমের কাছে কিছুটা নৈরাশ্যজনক মনে হলো। পাহাড়ের ঐ খাজে কারো পক্ষে পৌঁছান সম্ভব নয়। কিন্তু তারপর তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। কাদায় আটকে যাওয়া গাড়ি টেনে তুলার জন্য যে দড়ি ব্যবহার করা হয় তা নিয়ে এসো। আমি দড়ির সাহায্যে ঝুলে ওখানে নামতে চাই।

 বরং আমি নামি সেলিম, সুলায়মান বেগ বললো।

 না, এটা আমার দায়িত্ব। আমি জোবায়দার কাছে ঋণী, তাই আমারই যাওয়া উচিত। শৈশবে তিনি আমার অনেক যত্ন নিয়েছেন। আমার এখনও মনে আছে আমার বয়স যখন তিন তখন আমি একটি কাঁটা গাছে পাখির বাসা সংগ্রহ করতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলাম। তখন জোবায়দা আমাকে অনেক কষ্ট করে উদ্ধার করেন।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেলিমের জন্য দড়ি নিয়ে আসা হলো এবং সে তার বহিঃপোশাক খুলে ফেলে দড়িটি তার বুকের উপর বাঁধলো। শক্ত করে ধরো, সে সুলায়মান বেগকে চিৎকার করে বললো। খাদে পড়ে যাওয়াদের টেনে তোলার জন্য আরো দড়ি তৈরি রাখো। তারপর সে ঢালের নিচে অদৃশ্য হলো।

 খাদের প্রথম দশ ফুট জায়গায় সেলিম ভেজা পাথরের বিভিন্ন স্থানে হাত এবং পা রাখার মতো খাজ পেলোলা। তারপর সে যেখানে পৌঁছালো সেখানে অবস্থিত পাথরের তাকের অংশ বিশেষ মাটিতে ভরে গেছে। সেখানে পা রাখতেই উপরের আলগা মাটি এবং পাথর তার ভারে খসে পড়লো। কয়েক মুহূর্তের জন্য সেলিম ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। দড়িতে বাঁধা থাকার কারণে সে পতন থেকে রক্ষা পেলো। সে ঝুলন্ত অবস্থায় দোল খেয়ে পাথরের খাঁজে জমে থাকা আলগা মাটি এবং পাথর গুলি পায়ের ধাক্কায় সরিয়ে দাঁড়ানোর মতো শক্ত অবস্থান বের করতে সচেষ্ট হলো। পা রাখার মতো শক্ত জায়গা বেরিয়ে আসতেই সেলিম সেখানে তার পা দুটি রাখলো এবং নিচের হাওদা আটকে থাকা খাজটির দিকে তাকালো।

 বর্তমানে সেলিমের দৃষ্টিপথে প্রতিবন্ধকতা অনেক কম এবং সে খাজটির উপরে দুটি মানুষকে দেখতে পেলো, উভয়েই নারী। একজন মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে এবং দ্বিতীয় জনের পাকা চুল দেখে সেলিম জোবায়দা হিসেবে চিনতে পারলো, সে উপুড় হয়ে থাকা দেহটির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।

জোবায়দা, সেলিম চিৎকার করে ডাকলো। কিন্তু বাতাস এবং বৃষ্টির শব্দে জোবায়দা সেলিমের ডাক শুনতে পেলো না। জোবায়দা, সেলিম আবার ডাকলো। এই বার বৃদ্ধাটি উপরের দিকে তাকাল এবং সেলিমকে লক্ষ্য করে হাত নাড়লো। আমি আসছি, সেলিম আবার চিৎকার করে বললো। পাহাড়ের গা ঘেষে থাকো, তাহলে অনেকটা নিরাপদ থাকবে।

 কয়েক মুহূর্ত পর সেলিম দেখলো জোবায়দা অন্য মহিলাটিকে টেনে পাহাড়ের দেয়ালের কাছে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। সেলিম বুঝতে পারছিলো কাজটি জোবায়দার জন্য দুঃসাধ্য, কিন্তু তবুও সে হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। সেলিম সময় নষ্ট করলো না, তার নড়াচড়ার কারণে যাতে আবারো পাথর বা মাটি ধ্বসে না পড়ে সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে সে নিচে নামতে লাগলো। সে যখন মহিলাদয়ের কাছ থেকে প্রায় বারো ফুট দূরে রয়েছে তখন উপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ পেলো। কোথা থেকে পাথর পড়ছে দেখার জন্য উপরের দিকে তাকাতেই একটি বড় পাথর খও তার মুখের পাশে আঘাত করলো এবং সে তার মুখের ভেতর রক্তের স্বাদ অনুভব করলো।

 সেলিম যখন তার মুখে জমে উঠা রক্তাক্ত থুতু ফেললো, শুনতে পেলো জোবায়দা তাকে চিনতে পেরে চিৎকার করে বলছে, জাহাপনা, আপনি ফিরে যান, নিজের জীবন রক্ষা করুন। আপনি তরুণ। আমরা দুজন বুড়ো হয়ে গেছি। এবং ইতোমধ্যেই আমাদের দীর্ঘ জীবন উপভোগ করা হয়ে গেছে। তার বক্তব্য অব্যাহত থাকতেই আরো পাথর এবং মাটি আলগা হয়ে গড়িয়ে পড়লো। ব্যস্তভাবে তাকিয়ে সেলিম দেখতে পেলো পাহাড়ের গা থেকে পাথর এবং মাটি আলগা হয়ে গড়িয়ে পড়াতে তার হাত এবং পা রাখার জন্য বেশ কিছু গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলির সাহায্যে সে সহজেই তাকটির উপর পৌঁছাতে পারবে। দ্রুত কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে সে তার ওজন সহ্য করতে পারবে কি না তা পরীক্ষা করে করে গর্ত গুলি ব্যবহার করে তাকটির দশ ফুট দূরত্বে পৌঁছালো, অবশিষ্ট দূরত্ব সে এখন লাফিয়ে নামতে পারবে। সে তাই করলো। এবং হাঁটু ভাজ করে জোবায়দার পাশে পতিত হলো।

 সেলিম যতোটা অনুমান করেছিলো জোবায়দার অবস্থা তার চাইতেও অনেক খারাপ। তার কপালের উপর বড় একটি কাটা দাগ ফুলে উঠেছে এবং সেখান থেকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। তার বাম হাতের অগ্রভাগের হাড় ভেঙ্গে চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে এবং সেখান থেকেও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অন্য মহিলাটির মাথা ফেটে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সে যদি মরে না গিয়ে থাকে তাহলে অজ্ঞান হয়ে আছে। শীঘ্রই তোমাদের দুজনকে উদ্ধার করে আমি হেকিমের হাতে সোপর্দ করবো, বাস্তবে যতোটা তার থেকে একটু বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেলিম বললো। সে খুব সাবধানে ভগ্ন হাওদাটির কাছে অগ্রসর হলো যে স্থানটি রাস্তার উপর থেকে চোখে পড়ে। তারপর সে দুহাত তুলে নাড়তে লাগলো পূর্বের ঠিক করা ইঙ্গিত স্বরূপ যা দেখে উপর থেকে আরো দড়ি ফেলা হবে। কয়েক মুহূর্ত পরে পাহাড়ের তাকটির কাছে আরো দুটি দড়ি নেমে এলো। সেগুলির একটি সেলিম ধরতে পারলো কিন্তু অন্যটি তার কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে রয়েছে। আরো দুইবার ইঙ্গিত দেয়ার পর তার হাতের নাগালের মধ্যে আরেকটি দড়ি নেমে এলো।

সেলিম প্রথম দড়িটির সঙ্গে জোবায়দাকে বাধলো, তবে ভুল করে সে তার আহত হাতটি ধরার ফলে জোবায়দার মুখ ব্যাথায় কুঁচকে উঠলো। সাহস বজায় রাখ। সেলিম তাকে উৎসাহ প্রদানের জন্য হাসলো। আমি ইঙ্গিত দেয়ার পরে রাস্তায় অবস্থিত লোকেরা তোমাকে টেনে তুলবে। তুমি তোমার পায়ের সাহায্যে ধাক্কা মেরে পাহাড়ের দেয়াল থেকে নিজেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখবে।

জ্বী জাহাপনা, আমি বুঝতে পেরেছি।

উপরে পৌঁছে তুমি লোকদেরকে বলবে তারা যেনো আমার দড়ি এবং অন্য দড়িটি একসঙ্গে টেনে তুলে।

 জোবায়দা মাথা ঝাঁকালো এবং সেলিম আবার হাওদাটির দিকে অগ্রসর হলো জোবায়দাকে টেনে তুলার ইঙ্গিত দেয়ার জন্য। শীঘ্রই সেলিমকে স্বাস্তি প্রদান করে জোবায়দার দেহটি উপরে উঠতে লাগলো এবং সেলিমের নির্দেশ অনুযায়ী সে তার খালি পায়ে ধাক্কা মেরে মেরে পাথরের দেয়াল থেকে নিজেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখছিলো।

এক সময় সেলিমের দৃষ্টিসীমা থেকে জোবায়দা অদৃশ্য হলো এবং সে দ্বিতীয় বৃদ্ধাটির কাছে এগিয়ে গেলো, এখনো তার শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে দেখে সেলিম কিছুটা অবাকই হলো। দড়ি দিয়ে তাকে বাঁধার সময় সেলিম লক্ষ্য করলো তার চোখের পাপড়ি কেঁপে উঠলো। সে দ্রুত তাকে বেঁধে নিজের দড়িটিও টেনেটুনে পরীক্ষা করে নিলো এবং তারপর বৃদ্ধাটিকে দুহাতে তুলে নিলো। কয়েক মুহূর্ত পরে তাঁদের দেহে বাধা রশি গুলি টানটান হয়ে উঠলো। ধীরে টেনে তাদেরকে উপরের দিকে তোলা হতে লাগলো, প্রয়োজনের সময় সেলিম তার পায়ের সাহায্যে ধাক্কা মেরে পাহাড়ের দেয়াল থেকে দূরত্ব বজায় রাখছিলো। মাঝে মাঝে পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসা পাথরের প্রসারিত অগ্রভাগের সঙ্গে সেলিম প্রবল ধাক্কা খাচ্ছিলো এবং পাথরের ঘষায় তার গায়ের চামড়া ছড়ে যাচ্ছিলো। তবে শীঘ্রই তারা উপরে পৌঁছে গেলো, রক্তে এবং কাদামাটিতে মাখামাখি হলেও এখন তারা নিরাপদ। হাকিমরা খাঁটিয়াতে করে বৃদ্ধা দুজনকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলো এবং সেলিম দেখতে পেলো তার বাবা তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, উপস্থিত সকলে দুভাগ হয়ে দুপাশে সরে দাঁড়িয়েছে। আকবরের সমস্ত মুখে একটি প্রশস্ত হাসি ছড়িয়ে রয়েছে এবং তিনি তাঁর পুত্রকে আলিঙ্গন করার জন্য তাঁর দুবাহু প্রসারিত করলেন।

সেলিম, আমি তোমার জন্য গর্বিত। আমার মনে হচ্ছে তোমার শক্তি ও সাহস আমার সমপর্যায়ে পৌঁছেছে।

সেলিমের কাছে তার পিতার প্রতিটি বাক্যকে স্বর্ণের মতো মূল্যবান মনে হলো।

*

তিন মাস পরের ঘটনা। আকবর এবং সেলিম নাসিমবাগে পাশাপাশি হাঁটছে। জায়গাটি কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের কাছাকাছি অবস্থিত। তাদের পাশের গোলাপকুঞ্জের উপর দিয়ে মৃদু বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে এবং সেই বাতাসে গোলাপের পাপড়ি ঝরে পড়ছে। ডাল হ্রদের পশ্চিম তীরে মাত্র বারো মাস আগে আকবরের নির্দেশে এই বাগানটি তৈরি করা হয়েছে। বাগানের শেষ প্রান্তের ক্রমশ নিচু হয়ে যাওয়া শানবাঁধানো ধাপ গুলিতে হ্রদের স্বচ্ছ নীল পানির ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে। জায়গাটি নিশ্চিয়ই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম স্থান গুলির একটি, সেলিম ভাবলো।

সেলিম কি ভাবছে সেটা যেনো আঁচ করতে পেরেই আকবর বললেন, আমার সভার পারসিকরা গর্ব করে বলে তাঁদের দেশের বাগানগুলি নাকি সবচেয়ে সুন্দর, সেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাগানটির নাম তারা দিয়েছে স্বর্গের বাগান। কিন্তু আমার মনে হয় সমগ্র কাশ্মীরটি এক বিশাল স্বর্গীয় বাগান। এর বিস্তৃত তৃণভূমি বসন্তকালে মৌভি, ক্রোকাস এবং অন্যান্য বহু বর্ণের মৌসুমি ফুলের শতরঞ্জিতে ঢাকা থাকে। এর পাহাড়গুলির মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট ছোট নদী, জলপ্রপাত এবং হ্রদগুলি কতো বৈচিত্রময়!

সেলিমের বহুবার মনে হয়েছে তার বাবা কাশ্মীরে অবসর যাপন করতে এলেই কেবল সম্পূর্ণ নিরুদ্বেগ ও উৎফুল্ল থাকেন। অবশ্য এর মধ্যেও তিনি হিন্দুস্তান থেকে ডাক যোগে আসা বার্তা সমূহ শ্রবণ করে সে সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন একং শ্রীনগরে নির্মানাধীন হরিপর্বত দূর্গ পরিদর্শন করছেন। সেই সঙ্গে পরিবারের সদস্যদেরও অধিক সময় দিচ্ছেন। অবশ্য সেলিমের ধারণা সেটা এই কারণে যে তারা শ্রীনগরে পৌঁছানোর প্রায় সাথে সাথেই তার বাবা আবুল ফজলকে লাহোরে ফেরত পাঠিয়েছেন প্রশাসনিক কাজে সৃষ্টি হওয়া কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য।

 আমিও তাই ভাবছিলাম বাবা। হিন্দুস্তানের বর্ষাকালের বৃষ্টি এবং গুমোট গরমের তুলনায় কাশ্মীরের এই মৃদুমন্দ বাতাস এবং সবুজ তৃণভূমি ঘেরা প্রকৃতি অনেক ভালো। এখানকার আবহাওয়া আমাকে অনেক প্রাণবন্ত করে তুলে। সেলিম একটু থামলো, বাবার খোশ মেজাজের সঙ্গে নিজের মনোভাবের মিল খুঁজে পেয়ে সে তৃপ্তি অনুভব করছে। তারপর আবার শুরু করলো, আমরা যখন এখানে আসি তখন আমি প্রকৃতির প্রতি আরো অধিক আকর্ষণ অনুভব করি। আমি কিছু শিল্পীকে দিয়ে ক্রকাস এবং অন্যান্য ফুলের স্বাভাবিক আকারের তুলনায় অনেক বড় কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র অংকন করাচ্ছি যাতে করে তাদের জটিল গঠনশৈলী বুঝতে পারি। তাছাড়া আমি কিছু পণ্ডিত ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়েছি পাখির ডানা ব্যবচ্ছেদ করে এটা উঘাটন করার চেষ্টা করার জন্য যে কীভাবে তারা উড়ে।

 তোমার গবেষণা সংক্রান্ত আগ্রহের বিষয়ে তোমার দাদীমা আমাকে জানিয়েছেন। ফুলের ছবিগুলি আমাকে দেখিও। কাশ্মীর আমাদের পরিবারের সকলের জন্যই একটি উত্তম স্থান। এর সীমারেখার মধ্যেই আমি জানতে পেরেছি তোমার সাহস কতোটুকু এবং তোমার মন কতোটা সবল।

সেলিম কিছুক্ষণ কোনো কথা বললো না, তারা উভয়ে হেঁটে নাসিমবাগের শানবাধানো ধাপগুলি পেরিয়ে ডাল হ্রদের দীপ্তি ছড়াতে থাকা পানির কাছে এগিয়ে গেলো। তারপর বর্তমান মুহূর্তের প্রবল অন্তরঙ্গতার প্রভাবে উদ্দীপ্ত সেলিম জিজ্ঞাসা করলো, আমরা যখন লাহোরে ফিরে যাবো তখন কি আমি আরো ঘন ঘন তোমার মন্ত্রণাসভার বৈঠকে অংশ গ্রহণ করতে পারবো, সেটা বেসামরিক বা সামরিক যে বিষয়েই হোক না কেনো, যাতে আমি আরো পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারি তুমি কীভাবে সাম্রাজ্য শাসন করো?

নিশ্চয়ই আমি এ বিষয়ে চিন্তা করবো। আমি আবুল ফজলের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করবো কখনো এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে তুমি সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে।

আবুল ফজল, সবসময় আবুল ফজল, সেলিম ভাবলো। সে মুখে কিছু বললো না। কিন্তু তার মনে হলো গ্রীষ্মের বেলাশেষের উষ্ণ সূর্যেটি কালো মেঘে আচ্ছাদিত হলো।

.

২১. রাজমুকুটে একটি নতুন অলঙ্করণ

এটা অত্যন্ত শুভ সংবাদ। এই উপলক্ষে আমাদের আনন্দ-ফুর্তি করা উচিত, সুলায়মান বেগ বললো। খোসরু এবং পারভেজের পরে এটি হয়তো তোমার তৃতীয় পুত্রসন্তান।

 সম্ভবত।

তোমার কি হয়েছে? তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তোমার বাবা তোমাকে লাহোরের শৌচাগার গুলির পরিদর্শকের পদে নিযুক্ত করেছেন।

অথচ এই মাত্র খবর এলো তোমার সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছে! সুলায়মান বেগ যে কোনো সময় তার মনকে হালকা করে তুলতে পারে, সেলিম ভাবলো। তোমার কথা ঠিক এবং আমি যথেষ্ট খুশি হয়েছি। যোধ বাঈও খুশি হয়েছে। ইতোমধ্যে আমি দুটি সন্তান লাভ করেছি যার কোনোটিই তার গর্ভজাত নয়, বিষয়টি তার জন্য খুবই বেদনা দায়ক ছিলো।

এবং এটাও তো সত্যি যে সে তোমার সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী, কি বলে?

হয়তো তাই। অন্তত সে আমাকে সব সময় হাসাতে পারে। তোমার মতো সেও আমার মনের অবস্থা অনুমান করতে পারে এবং ঠাট্টা তামাসা করে আমার মেজাজ ভালো করে দিতে পারে। তাছাড়া সে মান বাঈ বা অন্যান্য স্ত্রীদের মতো সর্বদা অভিযোগ করে না যে আমি তার সঙ্গে বেশি সময় কাটাই না।

 তাহলে তোমার সমস্যাটি কোথায়? তুমি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে ইতস্তত বোধ করছো কেনো?

সেলিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, কারণ তার দুধভাই এর প্রশ্নের উত্তরটি সে নিজেও ভালোভাবে ঠাহর করতে পারছে না। একাধিক পুত্রের পিতা হতে পারা খুবই উত্তম বিষয়। কিন্তু ওদের দেয়ার মতো আমার কি আছে?

আমি কি ওদের আমার মতো উদ্দেশ্যহীন জীবনই উপহার দেবো? বাবার সঙ্গে যখন কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিলো তিনি আমার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করেছেন। এটাও মনে হয়েছিলো আমার মতামত শ্রবণ করার বিষয়েও তিনি কিছুটা আগ্রহী। কিন্তু লাহোরে ফেরার পর থেকে তিনি আবার আমাকে উপেক্ষা করা শুরু করেছেন। এসবের জন্য আবুল ফজলই দায়ী। সে সর্বদা চাটুকারী বাক্যবাণ দিয়ে বাবার কান ভারী করছে এবং অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে আমি অধিক নিশ্চিত যে আমার প্রতি বাবার অবহেলার প্রধান কারণ সে। সে আমাকে এবং আমার সৎ ভাইদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে কারণ সে মনে করে বাবার উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে আমরা তার প্রতিদ্বন্দ্বী।

সুলায়মান বেগ কাঁধ ঝাঁকালো। হয়তো তোমার বাবা মনে করছেন প্রশাসনিক কাজে অংশ গ্রহণ করার জন্য যতোটা পরিপকৃতা প্রয়োজন তা তুমি এখনোও অর্জন করতে পারনি।

আমি এখন একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। আমি বাবাও হয়েছি। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আমার সাহসের প্রমাণ রেখেছি। আমি এতোদিন ধৈর্যধারণ করেছি এবং বাবার সব নির্দেশ পালন করেছি। তিনি এর বেশি আমার কাছ থেকে আর কি আশা করেন? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তিনি ইচ্ছা করে আমাকে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক গুলিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত করেন। তিনি এমন আচরণ কেনো করেন?

কারণ তিনি এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নন যে তিনি আমাকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচন করতে চান কি না। তিনি আমাকে সত্যিকার কোনো ক্ষমতা বা দ্বায়িত্ব দিতে অনিচ্ছুক কারণ তাঁর আশঙ্কা তাহলে সেটা আমার জন্য এবং অন্যদের জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত হবে- এই মর্মে যে তিনি আমাকেই তার ওয়ারিস হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।

তুমি এ বিষয়ে এতো নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে? হয়তো তিনি অন্য যে কাউকেই কোনো প্রকার ক্ষমতা প্রদান করার ব্যাপারে কুণ্ঠিত। বর্তমানে তাঁর বয়স কতো?

আগামী অক্টোবর মাসে তার বয়স ঊনপঞ্চাশ হবে।

এটাই তাহলে আসল কারণ। যদিও তিনি দেখতে সুগঠিত এবং শক্তিশালী কিন্তু বাস্তবে তিনি আর তরুণ নেই। ভেতরে ভেতরে এটা উপলব্ধি করে তিনি তোমাকে এবং ভবিষ্যতে যাদের তার স্থান দখল করার সম্ভাবনা রয়েছে তাদেরকে অপছন্দ করেন। তার অবস্থা এখন অনেকটা বুড়ো বাঘের মতো, যাকে বনের অন্য একটি তরুণ বাঘ শিকার করা থেকে বঞ্চিত করতে আরম্ভ করে।

এ বিষয়ে তুমি নিজেকে এতো বিজ্ঞ মনে করছো কেনো?

 সুলায়মান বেগ কাধ ঝাঁকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। আমার বাবার বয়সও প্রায় তোমার বাবার সমান এবং তিনি আমার সঙ্গে একই রকম আচরণ করেন। আমার দোষ উদঘাটন করাই যেনো তার একমাত্র কাজ এবং তিনি কোনো বিষয়ে কখনোই আমার মতামত জানতে চান না। আমিও তাকে এড়িয়ে চলি। তোমার বাবা যদি আবার তাকে বাংলায় পাঠান তাহলে ভালো হয়।

 তোমার কথাই বোধহয় ঠিক। আমার বাবা সম্ভবত আমাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে অবজ্ঞা করেন না। আর এটাও স্পষ্ট যে তিনি আমার অন্য সৎ ভাইদের প্রতিও আমার তুলনায় বেশি আনুকূল্য প্রদর্শন করছেন না। মুরাদ এবং দানিয়েল আমার মতোই উদ্দেশ্যহীন জীবন কাটাচ্ছে।

কিন্তু তারা তাদের সান্ত্বনার পথ ঠিকই খুঁজে নিচ্ছে।

 তার মানে?

সুলায়মান বেগের একটি ভ্রূ ধনুকের মতো বেঁকে কিছুটা উপরে উঠে গেলো। ইদানিং তারা যে রকম আনন্দ-ফুর্তি করে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে? মাঝে মাঝে তারা এতো মাতাল থাকে যে নিজেদের পায়ে হেঁটে বিছানায় পৌঁছাতে পারে না। তাদের পরিচারকরা ধরাধরি করে তাঁদের কক্ষে নিয়ে যায়। দুই সপ্তাহ আগে মুরাদ বাগানের একটি খালে পড়ে প্রায় ডুবতে বসেছিলো।

 তাদের এই সব আচরণ দেখে তুমি কি বুঝতে পারছো না আমার মনের অবস্থা কি? আমি চাই না আমার সন্তানরাও অর্থহীন জীবন যাপন করুক, ভবিষ্যতে তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকে। তাঁদের হতাশার সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা নানা প্রলোভনে তাঁদের বশীভূত করার সুযোগ পাবে। আমি নিজে সম্রাট হয়ে আমার সন্তানদের আমার সঙ্গে কাঁধে কাধ মিলিয়ে লড়াই করার সুযোগ দিতে চাই সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির জন্য।

তুমি অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তোমার বাবা হয়তো আরো বহু বছর বাঁচবেন।

আমিও প্রার্থনা করি তিনি আরো অনেক দিন বেঁচে থাকুন। তুমি যদি ভেবে থাকো আমি আমার বাবার মৃত্যু কামনা করছি তাহলে তুমি ভুল করছে। কিন্তু আমার পক্ষে আরো বহু বছর এরকম উদ্দেশ্যহীন জীবন কাটানো সম্ভব নয় কোনো প্রকার সত্যিকার কর্মোদ্যোগ ছাড়া। তাহলে আমার অবস্থা আমার রক্ষিতাদের মতো হবে যারা সারাদিন তাকিয়ায় হেলান দিয়ে অলস সময় কাটায় এবং উপাদেয় মিষ্টান্ন আহার করে দিন দিন নাদুসনুদুস হচ্ছে।

কিম্বা হেরেমের খোঁজাদের মতো দশাসই গড়নের অধিকারী হবো কিন্তু একটি ছোরা বা তলোয়ার হাতে তুলে নেয়ার সামর্থ থাকবে না। আমি একজন তরুণ, একজন যোদ্ধা, আমার এখন যোগ্যতা প্রমাণের জন্য সুযোগ দরকার। কিন্তু বাবা যদি আমাকে এভাবে অকেজো করে রাখেন তাহলে আমার জীবনের কোনো তাৎপর্য থাকে না। এখন আর সেই যুগ নেই যখন একজন মোগল যুবরাজ নিজের অনুসারীদের নিয়ে নতুন ভূখণ্ড জয় করার জন্য বেরিয়ে পড়তেন এবং নিজের জন্য নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতেন, যেমনটা আমার প্রপিতামহ বাবর করেছিলেন। ক্ষমতা লাভ করার পর তিনি প্রথমে ফারগানা, সমরকন্দ এবং কাবুল শাসন করেছেন হিন্দুস্তান আসার আগে। তিনি আমার অর্ধেক বয়সে পৃথিবীর বুকে তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছিলেন।

 জাহাপনা, আপনার স্ত্রী রাজকুমারী যোধ বাঈ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন, সেলিমের একজন কোৰ্চি এসময় সেখানে হাজির হয়ে জানালো।

 সেলিম মাথা ঝাঁকালো। যোধ বাঈ এর কথা মনে হতেই তার মনের বিষাদ অনেকটা কেটে গেলো। গর্ভবতী হতে পেরে তার এই গোলাকার মুখমণ্ডলের অধিকারী স্ত্রীটির চেহারা আরো বেশি গোলাকার ও আকর্ষণীয় রূপ ধারণ করেছে। তার ইতোমধ্যে যা রয়েছে তার জন্য তার সন্তুষ্টি বোধ করা উচিত। সুলায়মান বেগ ঠিক কথাই বলেছে, তার ধৈর্য ধারণ করা প্রয়োজন।

আমি এখনই ওর কাছে যাচ্ছি। আর সুলায়মান, আমি যখন ফিরে আসব তখন তোমার পরমর্শ অনুযায়ী আনন্দ-ফুর্তি করা যাবে।

এবং এ কথাও ভুলে যেও না যে একটা বিষয়ে তুমি তোমার বাবার তুলনায় এগিয়ে আছে। নিজের বংশধর পয়দা করতে ওনার তোমার চেয়ে অনেক বেশি সময় লেগেছিলো।

*

আকবর তাঁর নতুন নাতিটিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তোমার নাম রাখছি খুররম যার অর্থ উচ্ছল। তোমার জীবন আনন্দময় হোক এবং তোমার চারপাশের সকলের জীবনেও তুমি খুশি বয়ে আনতে সক্ষম হও এই কামনা করছি। এর থেকেও যা বড় তা হলো তুমি আমাদের সাম্রাজ্যকে আরো মাহান করে তুলতে সমর্থ হও। আকবর খুররমের ছোট্ট মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর তিনি তার সভাসদ এবং সেনাপতিদের দিকে ফিরলেন। তিন দিন আগে খুররমের জন্মের সময় গ্রহ-নক্ষত্রের যে অবস্থান ছিলো তা পর্যালোচনা করে রাজজ্যোতিষীগণ ঘোষণা করেছে যে তা আমার মহান পূর্বপুরুষ তৈমুরের জন্মক্ষণের অনুরূপ। সে কারণে এটা নিসন্দেহে একটি শুভক্ষণ, এবং আরো বিষয় রয়েছে: এটা ইসলামিক বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী সহস্রাব্দ এবং আমার এই নাতিটির জন্ম মাসেই আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই শিশুটি আমাদের সাম্রাজ্যের মুকুটে নতুন সংযোজিত একটি রত্ন এবং এর উজ্জ্বল্য সূর্যের চেয়েও বেশি।

 খুররমের দিকে তাকিয়ে সেলিমের চেহারা গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তার পিতা এই নতুন নাতিটিকে পেয়ে সীমাহীন আনন্দিত হয়েছেন। খুররমের জন্মের কয়েক ঘন্টা পর জ্যোতিষীরা যখন তৈমুরের সঙ্গে তার জন্মের যোগসূত্র নির্ণয় করে বিষয়টি আকবরকে জানায় তার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেলিমকে দুটি জুড়ি মেলানো কালো স্ট্যালিয়ন ঘোড়া উপহার পাঠান এবং যোধ বাঈকে সূক্ষ্ম রেশমী কাপড় এবং সুগন্ধি। খুররমকে কোলে নিয়ে তার পিতার চোখে মুখে যে উচ্ছলতা প্রকাশ পাচ্ছিলো তা প্রত্যক্ষ করে সেলিম নতুন আশায় উজ্জীবিত হলো। এই শিশুটির মাধ্যমে তার এবং তার পিতার মধ্যকার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হবে এবং তিনি হয়তো তাকে সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা করবেন। সেলিমের মনে হচ্ছে খুররমকে এমন দিনে পৃথিবীতে পাঠিয়ে স্বয়ং ঈশ্বর তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।

 আকবরের কোলে অবস্থানরত নিজের পুত্রের দিকে তাকিয়ে সেলিমের ইচ্ছা হলো দীর্ঘ বছর গুলিকে এক পলকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতে গিয়ে দেখতে ঐ ভজ বিশিষ্ট চামড়ার অধিকারী ছোট ছোট হাত পা বিশিষ্ট শিশুটির প্রাপ্তবয়স্ক রূপটি কেমন। জ্যোতিষীদের গণনা যদি ঠিক হয় তাহলে ঐ শিশুটি একদিন একজন বীর যোদ্ধা এবং মহান বিজেতায় পরিণত হবে, সে এমন একজন শাসকে পরিণত হবে যার নাম বহু শতাব্দী পর্যন্ত মানুষ স্মরণ রাখবে।

আকবর হাত তুলে সবাইকে চুপ হতে বললেন, বোঝা গেলো তার আরো কিছু বলার আছে। যেহেতু এই শিশুটির জন্মক্ষণ অত্যন্ত শুভ তাৎপর্য মণ্ডিত তাই ওর লালন পালনের দায়িত্ব স্বয়ং আমি নিলাম।

বাবার বক্তব্য হজম করতে সেলিমের রীতিমতো কষ্ট হলো, তিনি কি তার পুত্রকে তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চিন্তা করছেন? পিতার পরবর্তী কথা গুলি শ্রবণ করে তার উদ্দেশ্য সেলিমের কাছে স্পষ্ট হয়ে এলো।

  যুবরাজ খুররমকে আমার স্ত্রী রোকেয়া বেগমের তত্ত্বাবধানে আমার হেরেমে রাখা হবে যাতে দিন বা রাতের যে কোনো সময় আমি তার মুখ দর্শন করতে পারি। সে যখন বড় হতে থাকবে তখন আমি তার জন্য বিশেষ যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক নিযুক্ত করবো এবং আমি নিজেও তাকে কিছু কিছু প্রশিক্ষণ প্রদান করবো।

 সে তার সন্তানকে নিজেই মানুষ করতে পারবে এ আস্থাও কি তার পিতার নেই? সেলিম অনেক কষ্টে নিজের দৃষ্টিকে মেঝের দিকে নিবদ্ধ রাখল কারণ তার মনে হলো সরাসরি বাবার দিকে তাকালে হয়তো তার মুখ ফসকে কোনো বিরুপ মন্তব্য বেরিয়ে যাবে। রাজসভার সবচেয়ে প্রবীণ সদস্যগণ উপস্থিত রয়েছেন, সে নিজেকে বোঝালো, তার এক হাতের নখ আরেক হাতের তালুতে এমন জোরে এটে বসলো যে মনে হলো রক্ত বেরিয়ে যাবে। এই মুহূর্তে কোনো গোলযোগ সৃষ্টি করা অচিন্তনীয়। সে নিজের চিন্তাগুলিকে স্থির এবং শ্বাসপ্রশ্বাসকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে লাগলো, সেগুলি হঠাৎ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিলো এবং তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। তখন আরেকটি চিন্তা তীব্র শক্তিতে তার মাথায় আঘাত হানলো। বাবা কি পর্যায়ক্রমে খুররমকে নিজের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করবেন? নিশ্চয়ই না…পাশে তাকিয়ে সেলিম দেখতে পেলো আবুল ফজল তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ঘটনাপঞ্জিকারের ছোট ছোট চোখ গুলিকে কৌতূহলী মনে হচ্ছিলো, যেনো সে অনুধাবন করার চেষ্টা করছে সেলিম এই ঘোষণাটিকে কীভাবে গ্রহণ করলো। বাবার এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে আবুল ফজল কি ভূমিকা রেখেছে? নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য কি সে বাবাকে খুররামের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করতে উৎসাহ দিয়েছে? খুররম যদি অল্প বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করে তাহলে আবুল ফজল তার অভিভাবকত্ব করার সুযোগ পাবে। এই চিন্তাটি সেলিমের মনে আকস্মিক ভাবে এমন তীব্র ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটালো যে তার মনে হলো এই মুহূর্তে কোমর থেকে ছোরা বের করে দুই লাফে আবুল ফজলের কাছে পৌঁছে তার থলথলে গলায় সেটা সমূলে বসিয়ে দেয়।

কিন্তু না, তার বাবা তাকে যে মারাত্মক আঘাত করলেন সেই ক্ষত চিহ্নটি সে ঐ চাটুকারটির সামনে সে মেলে ধরবে না। সে জোর করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো কিন্তু তার মন বাধ মানলো না, বার বার চেষ্টা করলো কোনো উপায় উদ্ভাবনের যার ফলে বাবাকে তার সন্তান চুরি করা থেকে বিরত করা যায়। একটাই সান্ত্বনা, খুররম শ্রেষ্ঠ সেবা সমূহ লাভ করবে এবং রোকেয়া বেগম একজন দয়ালু মহিলা। সেলিম তাকে সমগ্র জীবন ধরে জানে। সাধারণ মুখমণ্ডল এবং পাকা চুল বিশিষ্ট এই মহিলাটি আকবরের এক চাচাতো বোন। তার বাবা অর্থাৎ আকবরের চাচা হিন্দাল অনেক আগে মারা গেছেন এবং তার বয়স আকবরের সমান ছিলো। রোকেয়া বেগম নিঃসন্তান। তার সঙ্গে আকবরের বিয়ে তাঁর অন্যান্য অনেক বাগদানের মতোই তেমন পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। না, খুররমকে নিয়ে তার আশঙ্কার কিছু নেই। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত সে নিজে এবং যোধ বাঈ, তারা প্রতিদিন নিজ সন্তানের মুখ দর্শন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

যোধ বাঈ এর কথা মনে হতেই সেলিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে একটি সন্তান লাভের জন্য বহু দিন অপেক্ষা করে ছিলো। সেই বহু প্রতীক্ষিত সন্তানকে অন্য কোনো নারীর কাছে সমর্পণ করা তার জন্য অসহনীয় বেদনা দায়ক হবে। তার সন্তান রোকেয়া বেগমের নিযুক্ত করা দুধমাদের স্তন্য পান করবে এবং খুররম রোকেয়া বেগমের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠবে। ভোজ উৎসব সমাপ্ত হতেই সেলিম সবার অলক্ষে যোধ বাঈ এর সঙ্গে দেখা করার জন্য হেরেমে উপস্থিত হলো। যোধ বাঈ এর চোখ ক্রমাগত ক্রন্দনের কারণে লাল হয়ে আছে। তার সন্তানের মতো খোসরুকে যদি মান বাঈ এর কোল থেকে কেড়ে নেয়া হতো তাহলে মান বাঈ শোকের আঘাতে উন্মাদ হয়ে যেতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যোধ বাঈ একটি হলুদ মখমলের আসনে নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলো। সেলিম কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে চুমু খেলো। আমি দুঃখিত। বাবার পরিকল্পনা সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিলো না।

 যোধ বাঈ এক মুহূর্ত কোনো কথা বললো না। যখন সে কথা বললো, তার কণ্ঠস্বর শান্ত শোনালো। তোমার বাবা আমাকে আরেকটি উপহার পাঠিয়েছেন। ধীরে সে তার হাতের মুঠি খুললো- তার হাতের তালুতে একটি চমৎকার সোনার হার দেখা গেলো যাতে পদ্মরাগমণি (রুবি) এবং বড় বড় মুক্তা জ্বল জ্বল করছে। সৈন্যরা এর চেয়েও কম মূল্যবান মণিমাণিক্যের জন্য লড়াই এ অবতীর্ণ হয়। এই হারটি অত্যন্ত সুন্দর কিন্তু সম্রাট যদি এটার পরিবর্তে আমাকে আমার সন্তান ফেরত দিতেন তাহলে আমি অনেক বেশি খুশি হতাম। উজ্জ্বল হারটি তার শিথিল হয়ে যাওয়া হাত থেকে পায়ের কাছে শতরঞ্জির উপর পড়ে গেলো।

আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, একদিন আমি এই বঞ্চনার উপযুক্ত মাসুল আদায়ের উপায় আবিষ্কার করবো এবং খুররমও তাই করবে। সে চিরদিন শিশু থাকবে না এবং তার পিতামহের দ্বারা বশীভূতও থাকবে না। তাছাড়া পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো একজন মায়ের সঙ্গে তার পুত্রের বন্ধন সর্বদাই অত্যন্ত দৃঢ়। অন্তত সে নিজে বিষয়টি গভীর ভাবে উপলব্ধি করে, সেলিম ভাবলো। তার কল্পনার দৃষ্টির সামনে হীরা বাঈ এর গর্বিত মুখটি ভেসে উঠলো।

 আমাদের কি কিছুই করার নেই? যোধ বাঈ জিজ্ঞাসা করলো, সে অন্তরে ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করছে। নিশ্চিতভাবেই নেই। তোমার বাবা হলেন মহামান্য সম্রাট এবং এটা অত্যন্ত সম্মানের বিষয় যে তিনি আমাদের সন্তানের লালন পালনের ভার নিয়েছেন। আমার অভিযোগ করা উচিত নয়।

যে মুখটি কৌতুকবোধে সর্বদা সজীব থাকে সেখানে এখন তীব্র শোকের ছায়া। সেলিম অনুভব করলো তার নিজের চোখের পাতাও ভিজে উঠেছে। এই অশ্রু স্ত্রীর প্রতি সহমর্মিতার অশ্রু, এই অশ্রু নিজের অক্ষমতা জনিত হতাশার। কিন্তু এই চোখের জল তার মাঝে নতুন উদ্দীপনাও সৃষ্টি করলো। নিজের আবেগকে গোপন করো, সে নিজেকে বললো; ধৈর্যশীল হও। একদিন তোমার সময়ও আসবে…তুমি শাসন ক্ষমতার অধিকারী হবে।

*

কিন্তু পরবর্তী মাস গুলিতে সেলিম যখন তার অশ্রুসিক্ত উদ্দীপনার কথা গুলি স্মরণ করতে লাগলো, সেগুলি তার কাছে নিতান্তই ফাঁকা বুলি মনে হতে লাগলো। ধৈর্য নয় বরং অক্ষমতাই তার অবস্থা ক্রমশ শোচনীয় করে তুলছে, সে উপলব্ধি করলো। প্রতিদিন একটি মাত্র বোধই তাকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলো, তার কিছুই করার নেই। সে আকবরের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল, নাতির প্রতি যার আগ্রহ এবং উৎসাহে ভাটা পড়ার কোনো লক্ষণই নেই। সেলিম বুঝতে পারছিলো খুররমের প্রতি তার বাবার এই ভালোবাসার জন্য তার খুশি হওয়া উচিত এবং তার নিজের প্রতি আকবর কখনোও এমন মমতা প্রকাশ করেননি এই বিষয়েও তার ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত নয়। কিন্তু তা মেনে নেয়া তার জন্য কঠিন। যোধ বাঈ এর সঙ্গে খুররমের বিরল সাক্ষাৎকার গুলির দৃশ্যও তার কাছে অসহনীয় লাগছিলো। কারণ খুররম তার আসল মায়ের অপরিচিত কোলে গিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করতো এবং ছোট্ট দেহটি মুচড়ে চিৎকার করে কেঁদে রোকেয়া বেগমের নিযুক্ত করা দুধমায়ের কোলে ফিরে যেতে চাইতো। যোধ বাঈ নিজের কষ্ট লুকাতে চেষ্টা করতো কিন্তু সেলিম জানতো বেদনার ঘুণপোকা ভেতরে ভেতরে তাকে ক্ষয় করে ফেলছিলো।

সেলিমের সকল রোষের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো আবুল ফজল, সেলিমের ধারণা ঐ লোকটিই তার আশাগুলিকে একে একে হত্যা করছে। লোকটি তার শত্রু এ বিষয়ে যদি কোনো চাক্ষুষ প্রমাণ দরকার হয়, সেলিম নিশ্চিত ইতোমধ্যেই সে তা পেয়ে গেছে, গ্রীষ্মের এক উষ্ণ বিকেলে লাহোর দূর্গে আবুল ফজলের কক্ষের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় সেলিম ভাবছিলো।

জাহাপনা, আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে আপনি আমাকে সম্মানিত করেছেন। আমি মহামান্য সম্রাটের আগ্রাদূর্গ পুনঃনির্মাণ কাজ পরিদর্শনের জন্য সেখানে গমনের বিষয়টি ঘটনাপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। সেলিম কক্ষে প্রবেশ করতেই আবুল ফজল উঠে দাঁড়িয়েছে। তার থলথলে মুখে বিগলিত হাসি ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু তার ছোট ছোট চোখ দুটিকে বেশ সতর্ক মনে হলো।

বাবার সঙ্গে আপনি যাননি দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছি।

মহামান্য সম্রাট প্রায় দুই মাসের জন্য আগ্রায় গিয়েছেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এমন বহু কিছু ঘটতে পারে যা তাৎক্ষণিক ভাবে তার জানা দরকার হতে পারে। সেই কারণে তিনি আমাকে এখানে রেখে গেছেন। আবুল ফজলের মসৃণ যুক্তিপূর্ণ বাক্য এবং তার অধিকতর মসৃণ বিগলিত হাসি সেলিমকে সর্বদাই ধৈর্যের শেষ সীমায় ঠেলে দেয়, তবে এই মুহূর্তে সে নিজের প্রকৃত অনুভূতি গোপন করার চেষ্টা করলো না।

 একটু আগে আমি জানতে পারলাম আমার সৎ ভাই মুরাদকে মালওয়া এবং গুজরাটের প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে।

আপনি সঠিক তথ্যই পেয়েছেন জাঁহাপনা। আগামী এক মাসের মধ্যে যুবরাজ মুরাদ লাহোর ত্যাগ করে তার কর্মস্থলে যোগ দিবেন।

 ঐ পদটি বাবার কাছে আমি চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন সে বিষয়ে তিনি চিন্তা ভাবনা করবেন। কিন্তু এটা কি হলো?

 এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর একমাত্র মাননীয় সম্রাটই দিতে পারবেন। আপনি তো জানেন, তিনিই আমাদের সকল প্রাদেশিক প্রশাসকদের নিয়োগ দান করেন।

 আমি নিজে তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারছি না। কারণ তিনি এখন লাহোরে নেই। সে জন্যই আমি আপনার কাছে জানতে চাইছি। আপনি তার মুখ ও কানের ভূমিকা পালন করেন। তাই আমার মনে হয়েছে সবকিছু আপনি ভালোই জানেন।

সেলিমের কণ্ঠস্বরে কিছুটা ঘৃণা মিশ্রিত ছিলো। সে অনুভব করছিলো আবুল ফজল তার আক্রমণে অসন্তুষ্ট হওয়ার পরিবর্তে নিজের অহংকার বজার রাখার চেষ্টা করছে। সে কিছু জানে না, এই মুহূর্তে এমন ভাব বজায় রাখা আবুল ফজলের জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে, তবে এই যুদ্ধে হার না মানার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও তাকে খুব একটা উৎসাহী মনে হলো না। তার গম্ভীর মুখ ক্রমশ সহজ হয়ে এলো এবং সেখানে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। আমি যতোদূর জানি তা হলো, মহামান্য সম্রাটের বিবেচনায় মনে হয়েছে যুবরাজ মুরাদ উক্ত পদটির জন্য উপযুক্ত।

 আমার তুলনায় বেশি উপযুক্ত? কিন্তু রাজসভার সবাইতো জানে মুরাদ সর্বদা এতো মাতাল থাকে যে, কারো সাহায্য ছাড়া ঠিক মতো দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না।

আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে আপনিও একজন উত্তম প্রশাসক হওয়ার সকল যোগ্যতা ধারণ করেন, প্রশ্নটির সোজা উত্তর এড়িয়ে গিয়ে আবুল ফজল মন্তব্য করলো।

 এই পদটিতে নিয়োগের বিষয়ে বাবা কি আপনার পরামর্শ চেয়েছিলেন?

আবুল ফজল এক মুহূর্ত ইতস্তত করলো। আমি আপনাকে পূর্বেই বলেছি জাহাপনা, মহামান্য সম্রাট এই সব সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে থাকেন। আমি কেবল সেগুলি আমার ঘটনাপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করার ভূমিকা পালন করি।

আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না।

জাহাপনা?

আবুল ফজলের চেহারা দেখে মনে হলো বাস্তবেই সে ভীষণ আহত হয়েছে। সেলিম একটি বিষয় উপলব্ধি করলো যে, ঘটনাপঞ্জিকার যে দীর্ঘ সময় ধরে তার পিতার চাকুরীতে নিযুক্ত রয়েছে এই সময়ের মধ্যে তারা দুজন আগে কখনোই এভাবে পরস্পরের মুখোমুখী হয়নি। আকবর যেহেতু রাজধানী থেকে বহু দূরে অবস্থান করছেন, এই পরিস্থিতি সেলিমকে অনেকটা স্বাধীনতা প্রদান করেছে। শুধু প্রশাসক নিয়োগ সংক্রান্ত হতাশাই নয়, আবুল ফজলকে কেন্দ্রকরে দীর্ঘ সময় ধরে তার মনে যে সন্দেহ এবং ঘৃণা পুঞ্জিভূত হয়েছে তার সবটুকু আজ সে তার সামনে উগরে দিতে চাইলো।

আমি তো বললোমই, আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না। আমার বাবা সব বিষয়ে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং আমি নিশ্চিত মালওয়া ও গুজরাটের প্রশাসক নিয়োগের বিষয়েও তিনি আপনার সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

 আবুল ফজলের মুখের হাসি ভাব ক্রমশ উধাও হলো। আমার সঙ্গে আপনার পিতার যে সব আলোচনা হয় তা অত্যন্ত গোপনীয়। সে সব বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করার অর্থ তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা। আপনি নিশ্চয়ই তা বোঝেন জাহাপনা।

আবুল ফজলের কণ্ঠে এখন আর অতিবিগলিত ভাব বজায় নেই এবং জীবনে প্রথম বারের মতো সেলিম উপলব্ধি করলো লোকটি কতোটা দুর্ধর্ষ। কিন্তু সে পরাজয় স্বীকার করবে না। আমি জানি বাবা আপনার সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করেন।

 আমিও তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। আমি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রজা। আবুল ফজলের কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা প্রকাশ পেলো।

কিন্তু আপনার বিশ্বস্ততা আমার পিতার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রতিও কি প্রসারিত হওয়া উচিত নয়? সেলিম আবুল ফজলের দুকাঁধ ধরে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালো। আমি তার জ্যেষ্ঠ পুত্র, কিন্তু শৈশব থেকেই আমি লক্ষ্য করছি নানা উপায়ে আপনি তার সঙ্গে আমার দূরত্ব সৃষ্টি করতে তৎপর। আপনি বাধা সৃষ্টি না করলে বাবা অবশ্যই তার যুদ্ধবিষয়ক সভা গুলিতে আমাকে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ দিতেন। এটা কি আপনি অস্বীকার করেন?

 আবুল ফজল বিচলিত না হয়ে শান্ত ভাবে উত্তর দিলো, আমি সর্বদাই মহামান্য সম্রাটকে উত্তম পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করি। আপনি যদি সত্যি কথাটি জানতে চান সেটা হলো, তিনি আপনাকে সভায় আমন্ত্রণ জানাননি কারণ তিনি মনে করেছেন আপনাকে সেখানে ডাকা অর্থহীন। উনি স্বয়ং আমাকে বলেছেন আপনার আচরণ তাঁকে হতাশ করে।

সেলিম আবুল ফজলের কাঁধ ছেড়ে দিলো। এই সংক্ষিপ্ত কথা গুলি তাকে যে কোনো অস্ত্রের চাইতে বেশি মারাত্মক ভাবে আহত করেছে। তার নিজের মনেও তো এমন আশঙ্কা ছিলো যে, সে তার বাবাকে সন্তুষ্ট করতে অপারগ, যততা ঐকান্তিক ভাবেই চেষ্টা করুক না কেনো? সে কিছুতেই চায় না আবুল ফজল তার আশঙ্কা এবং ভীতি গুলি সম্পর্কে অবহিত হয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠুক। এটাও প্রকাশ পেলে চলবে না তার মন্তব্য তাকে আহত করেছে। সে অন্তরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো, আপনি সর্বদা আমার এবং আমার পিতার মধ্যকার সম্পর্কে অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা করে গেছেন। আপনি সর্বদা তার কানে বিষ না ঢাললে তার এবং আমার মাঝে এতো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে না। আপনি ঠিকই বলেছেন, আপনি তার প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত। তবে এই বিশ্বস্ততা আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উপায় ব্যতীত আর কিছু নয়। সেটা আপনি ভালো করেই জানেন। আমি সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি সেই দিনটির অপেক্ষায় রইলাম যেদিন আমার বাবাও সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন।

 তারা বর্তমানে পরস্পরের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেলিম উপলব্ধি করছিলো ঘটনাপঞ্জিকারের সঙ্গে আরো বেশি নগ্ন তর্কে জড়িয়ে পড়ার অর্থ তার অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করা। কারণ এ বিষয়ে আবুল ফজল যখন তার ভাষ্য আকবরকে প্রদান করবে তখন তিনি তার প্রতি রুষ্টই হবেন। হয়তো ইতোমধ্যে যে সে সব কথা বলে ফেলেছে তা সঠিক হয়নি, কিন্তু এর জন্য সে কোনো অনুশোচনা বোধ করছে না। তবে এখন থেকে আবুল ফজল তার ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং সে নিজে তাকে সর্বদা পর্যবেক্ষণে রাখবে তার দুর্নীতি বা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির প্রমাণ উদ্বাটনের জন্য। সে রকম কিছু পেলেই সে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে সেলিম আবুল ফজলের কক্ষ থেকে প্রাসাদের রৌদ্র আলোকিত উঠানে বেরিয়ে এলো। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো জানালা দিয়ে আবুল ফজল তার দিকে চেয়ে রয়েছে।

.

২২. আগ্রার দূর্গপ্রাচীর

কি ব্যাপার? সারা বিকাল তোমাকে অন্যমনষ্ক মনে হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম আমাকে বলার জন্য তোমার মনে অনেক কথা জমে আছে।

তোমার ধারণা ঠিক। আমার বাবা আবুল ফজলকে দিল্লীতে পরিদর্শনের কাজে পাঠিয়েছিলেন, সে শীঘ্রই রাজধানীতে ফিরে আসবে, সেলিম সুলায়মান বেগকে বললো। বেশ কিছুক্ষণ রবি নদীর তীরে ঘোড়া ছুটানোর পর পশুগুলিকে ঠাণ্ডা হওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য তারা নদীর অগভীর জলে নেমেছে। সুলায়মান বেগ তার বাবার সঙ্গে পাঞ্জাবে গিয়েছিলো এবং গত কয়েক মাস দুই বন্ধুর মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।

 তাতে কি হয়েছে? আবুল ফজলকে নিয়ে তুমি এতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কেনো?

 এর পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

সে তোমার পিতার আস্থাভাজন এটা সত্যি কিন্তু এর অর্থ তো এই নয় যে সে তোমার শত্রু।

কিন্তু আমি নিশ্চিত সে আমাকে এবং আমার ভাইদেরকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। এ কারণেই সে মুরাদ এবং দানিয়েল এর প্রতিটি দোষ এবং অসতর্ক আচরণের কথা বাবাকে অবহিত করে। আমি নিজে তাকে এ ধরনের কাজ করতে দেখেছি।

হয়তো সে মনে করে এটা তার দ্বায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাছাড়া তোমার ভাইগুলিও আহাম্মক।

 তারা বোকা সেটা মূল কথা নয়। যেটা মূল বিষয় তা হলো সে আমাকেও বাবার কাছে অপদস্ত করার চেষ্টা করে।

তোমার সাঙ্গে তার সেই তর্ক হওয়ার পর দুই বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু সে বিষয়ে সে তোমার বাবাকে আজ পর্যন্ত কিছু জানায়নি। এটা তো সত্যি?

বাবা সে বিষয়ে আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু বিষয়টি আবুল ফজলের জন্যেও হয়তো তিকর ছিলো।

অথবা সে উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছে।

না। এখনো সে সবকিছু থেকে আমাকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করে। তুমি যখন রাজধানীতে ছিলে না তখন বাবা আমাকে বলেছিলেন যেহেতু ইতোমধ্যে সিন্ধু জয় করা হয়ে গেছে তাই এখন তার ইচ্ছা মোগল সৈন্য পাঠিয়ে কান্দাহার দখল করা। এ সময় সেলিমের ঘোড়াটি নদীর ঘোলা পানি পান করার জন্য মাথা নামালো এবং সেলিম সেটার ঘর্মাক্ত ঘাড়ে আলতো টোকা দিলো। আমি বাবাকে অনুরোধ করলোম এই সেনা অভিযানে আমাকে তার একজন সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করতে…আমি যুক্তি দেখালাম যে কাশ্মীর অভিযানের সময় আমি আমার যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছি তাই আমাকে আরো সুযোগ দেয়া উচিত। আমি তাকে আরো বলেছি যে এটা আমাদের পারিবারিক মর্যাদার বিষয়-আমার পিতামহ হুমায়ূনের মৃত্যুর পর আমরা পারসিকদের কাছে কান্দাহার হারিয়েছি এবং তার জেষ্ঠ্য নাতি পুনরায় তা অধিকার করবে এটাই সবদিক থেকে ন্যায্য।

 তিনি কি বললেন?

তিনি সিন্ধু জয়ের কারণে এতোটা উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে আমার মনে হয়েছিলো তিনি এক কথাতেই রাজি হয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি আমাকে বললেন বিষয়টি নিয়ে তিনি যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী সভায় আলোচনা করতে চান। কিন্তু পর দিন আবুল ফজল আমাকে বাবার সিদ্ধান্ত জানালো-আমাকে সে বললো বাবা জানিয়েছেন তিনি মনে করেন এতো দূরবর্তী যুদ্ধাভিযানের জন্য আমার পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। বাবার এই বার্তাটি আমার প্রতি তার গতানুগতিক উপদেশ বাক্য দিয়ে শেষ হয়েছে-ধৈর্য ধারণ করো। কিন্তু আমি জানি এটা প্রকৃতপক্ষে কার বার্তা।

তুমি এতো নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে? হয়তো তোমার বাবা তোমার নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন।

অথবা হয়তো আবুল ফজল চাচ্ছে না বিজয় গৌরবের মাঝে আমি কোনো অবদান রাখি…প্রায় প্রতিদিনই বার্তাবাহকরা খবর আনছে যে আমাদের সৈন্যরা সফল ভাবে কান্দাহারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং গিরিপথ দখল করে থাকা বেলুচিস্তানী গোত্র গুলিকে পরাজিত করছে। গতকাল রাতে বাবার প্রধান সেনাপতি আব্দুল রহমানের কাছ থেকে বার্তা এসেছে যে কান্দাহারের পারসিক সেনাপতি আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 এটা অত্যন্ত শুভ সংবাদ। যদি তা সত্যি হয়, এর অর্থ দাঁড়াবে তোমার বাবার উত্তর সীমান্ত আরো প্রসারিত হলো…এখন তার সাম্রাজ্য উত্তরে কান্দাহার থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত বিস্তৃত এবং পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে সিন্ধু পর্যন্ত…আমাদের সৈন্যরা অপরাজেয়। বর্তমানে আর কে মোগলদের বিরোধীতা করার সাহস পাবে? কিন্তু সুলায়মান বেগের চেহারার উচ্ছ্বাস ফিকে হয়ে এলো সেলিমের মলিন মুখ দেখে।

 এটা শুভ সংবাদ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার পিতা একজন মহান ব্যক্তি- আমি সেটা জানি এবং অন্য সকলের মুখের আমি একই কথা শুনি। তিনি আমাদের সাম্রাজ্যকে যে উচ্চতায় নিয়ে এসেছেন তা ইতোপূর্বে কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু আরো ভালো হতো এই বিজয় গৌরবের মাঝে যদি অমিও কিছুটা অবদান রাখতে পারতাম এমন নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে না থেকে এবং সেই সুযোগের আশায় না থেকে যা আমার ভাগ্যে ধরা দিচ্ছে না। বলতে বলতে সেলিম তার ঘোড়ার লাগাম ধরে এতো জোরে টান দিলো যে জানোয়ারটি প্রতিবাদ সূচক তীব্র হ্রেষাধ্বনি করে উঠলো। তারপর সে তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নদীর পারে উঠে এলো এবং সুলায়মান বেগের জন্য অপেক্ষা না করে লাহোরের দূর্গের দিকে সবেগে ঘোড়া ছুটালো। কোনো সন্দেহ নেই ইতোমধ্যেই তার বাবা কান্দাহার বিজয়ের উৎসব পালনের জন্য তোরজোর আরম্ভ করে দিয়েছেন। আকবরের মতো একজন মানুষ যিনি তরুণ বয়স থেকেই সাফল্য এবং গৌরব অর্জন করে অভ্যস্ত তার পক্ষে সেলিমের অনুপ্রেরণাহীন নিষ্ফল জীবনের দুঃসহ বেদনা অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

*

মে মাস চলছে। আর কয়েক দিনের মধ্যেই বর্ষাকাল শুরু হবে, চারদিকে গুমোট গরম। বাজিয়েরা লম্বা পিতলের বাঁশি এবং ঢোল বাজিয়ে রাজপ্রসাদ থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের পেছনে রয়েছে আট জন দেহরক্ষী যারা জন্মের পর থেকেই আকবরের সবচেয়ে প্রিয় নাতি খুররমকে নিরাপত্তা দিয়ে আসছে। তাদের পেছনে জুড়ি মেলানো ঘিয়া রঙের টাটুঘোড়ায় চড়ে অগ্রসর হচ্ছে আট বছর বয়সী খোসরু এবং ছয় বছর বয়সী পারভেজ, তাদের মাথায় শোভা পাচ্ছে সারসের পালক যুক্ত রেশমের পাগড়ি।

 রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য নির্মিত বিদ্যালয়ের কারুকাজ সম্বলিত বালুপাথরের প্রবেশ পথের বাম পাশে সেলিম আকবরের কিছু উচ্চপদস্থ সভাসদ এবং সেনাপতিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে ভাবছে তার বড় দুই পুত্রকে কতোই না গম্ভীর দেখাচ্ছে এবং কেমন স্থির ভাবে তারা তাদের ঘোড়ার উপর বসে আছে। অথচ এধরনের অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের পূর্বপরিচয় নেই। আকবর সেলিম বা সেলিমের অন্য ভাইদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা লগ্নে এমন জাঁকজমক পূর্ণ উৎসবের আয়োজন করেননি। কিন্তু মোগল ঐতিহ্য অনুযায়ী এই রাজবংশের যুবরাজদের বয়স চার বছর, চার মাস, চার দিন হওয়া মাত্রই এ ধরনের অনুষ্ঠান পালনের রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে এবং আজ খুররম ঐ বয়সে পদার্পন করেছে। খোসরু এবং পারভেজের পেছনে সেলিম একটি বাচ্চা হাতির পিঠে সওয়ার খুররমকে দেখতে পাচ্ছিল। এই হাতিটির মস্তক আবরণে আটকান সোনার শিকলটি আকবরের বাহনের সঙ্গে যুক্ত, তিনি স্বয়ং তাঁর প্রিয় নাতির পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বাচ্চা হাতিটির পিছন পিছন অগ্রসর হচ্ছে আকবরের দেহরক্ষী দলের অধিনায়ক।

খুররম তার হাতির পিঠে একটি উন্মুক্ত হাওদায় বসে ছিলো। হাওদাটি রূপা দিয়ে তৈরি এবং সেটি টাকোয়াজ পাথরে অলংকৃত- এই রত্নটি তৈমুরও পরিধান করতে পছন্দ করতেন। খুররমের পেছনে দাঁড়ানো একজন পরিচারক একটি মুক্তার ঝালর বিশিষ্ট সবুজ রেশমের তৈরি ছাতা তার মাথার উপর ধরে রয়েছে তাকে রোদ থেকে আড়াল করার জন্য। সেলিম অনুভব করলো তার কাধ বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, অবশ্য সেও রেশমের শামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সোভাযাত্রাটি যখন তার কাছাকাছি পৌঁছালো সেলিম বুঝতে পারলো এতো গরমের মাঝেও তার কনিষ্ট পুত্রটি বর্তমানের আনুষ্ঠানিকতার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারছে। স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজকীয় পোক- কিংখাবের কোট এবং সবুজ পালুনে তার বড় দুই ভাই যেমন অস্বস্তি প্রকাশ করছিলো তাকে দেখে সেরকম মনে হলো না। তার গলায়, হাতের আঙ্গুলে এবং কোমরে আটকানো ছোট আকৃতির আনুষ্ঠানিক ছোরাতে বিভিন্ন বর্ণের রত্ন শোভা পাচ্ছিলো। যদিও তাকে দেখাচ্ছিলো একটি রত্নখচিত পুতুলের মতো তবুও বোঝা যাচ্ছিলো সে অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উপভোগ করছে। সে সৈন্যদের ঘেরের বাইরে অবস্থিত উল্লাসরত জনতার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো এবং হাত নাড়ছিলো। বিদ্যালয়ের সিঁড়ির সামনে বড় আকারের লাল এবং নীল রঙের পারসিক শতরঞ্জি বিছান। সেখান থেকে বিশ পদক্ষেপ দূরে থাকতেই বাদক দল বাজনা থামিয়ে দিলো এবং শোভাযাত্রাটি দুদিকে বিভক্ত হয়ে আকবর এবং খুররমকে বিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ করে দিলো। আকবর অগ্রসর হয়ে শতরঞ্জিটির কেন্দ্রবিন্দুতে থামলেন এবং দ্রুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার কনিষ্ঠ নাতিটি নিজ আসনে নিরাপদে বসে আছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করে তাঁর বক্তব্য আরম্ভ করলেন। আমি তোমাদের সকলকে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য। আমার অতিপ্রিয় নাতি যুবরাজ খুররম আজ থেকে তার বিদ্যার্জন শুরু করবে। আমি রাজ্যের ভিতর এবং বাইরে থেকে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিৎ ব্যক্তিদের সংগ্রহ করেছি। তারা সাহিত্য এবং গণিত থেকে শুরু করে জ্যোতিবিদ্যা পর্যন্ত এবং আমাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস সহ সকল বিষয়ে আমার নাতিকে প্রশিক্ষণ দেবে। তাদের তত্ত্বাবধান এবং নির্দেশনায় আমার প্রিয় নাতি খুররম শৈশব থেকে তারুণ্যে পদার্পণ করবে।

ঠিক তাই, সেলিম ভাবলো এবং তার পিতা খুররমের শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে আবুল ফজলের পিতা শেখ মোবারককেও অন্তর্ভূক্ত করেছেন যে তাকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করবে। আবুল ফজল সেলিমের কাছ থেকে কয়েক পদক্ষেপ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো, যথারীতি তার চামড়ায় বাঁধাইকৃত খতিয়ান খাতাটি বগলের নিচে ধরা রয়েছে, সন্দেহ নেই অনুষ্ঠান সম্পর্কে কিছু অতি অলংকৃত বাক্য সেটাতে লিখে ফেলার জন্য সে প্রস্তুত। সেলিম তাকে পর্যবেক্ষণ করছে বুঝতে পেরেই হয়তো সেও সরাসরি এক পলক সেলিমের দিকে তাকালো তারপর অন্য দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সেলিম আবার তার পিতার দিকে মনোযোগ দিলো।

 যুবরাজ খুররম ইতোমধ্যেই তার অসাধারণ সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে, আকবর বলতে লাগলেন। আমার জ্যোতিষীগণ ভবিষ্যতবাণী করেছে সে একদিন বহু মহৎ কর্ম সমাধা করবে। এসো খুররম, সময় হয়েছে।

আকবর নিজে এগিয়ে গিয়ে খুররমের হাওদার ছিটকানি খুলে তাকে কোলে করে নামিয়ে আনলেন। তারপর শিশুটির হাত ধরে ধীরে উঁচু খিলান বিশিষ্ট প্রবেশ পথের দিকে অগ্রসর হলেন। তারা যখন সেলিমের কয়েক ফুট সামনে দিয়ে অগ্রসর হলো, খুররম সেলিমের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক হাসলো কিন্তু আকবর তার দৃষ্টি সম্মুখে স্থির রেখেই এগিয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত পর তারা বিদ্যালয়ের ভিতরে অদৃশ্য হলো। সেলিম তার মনের ভাবনা গুলির মাঝে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করলো। সন্তানের প্রতি যাবতীয় কর্তব্য পালনের সুযোগ তার পিতার থাকা উচিত। খুররমকে তার শিক্ষাজীবন শুরুর প্রথম দিনে আকবরের পরিবর্তে তারই নিয়ে আসাটা যুক্তিযুক্ত হতো। যেমনটা সে খোসরু এবং পারভেজের ক্ষেত্রে করেছে। আকবর নয় তারই উচিত ছিলো নিজ পুত্রের শিক্ষক নির্বাচন করা। কিন্তু আকবর তার এই সব অধিকার আত্মসাৎ করেছেন।

খুররমকে ঘিরে সেলিমের অতিপরিচিত হৃদয়বিদারক অনুভূতিটি আবারো তার হৃৎপিণ্ডটিকে গ্রাস করতে লাগলো। সেলিম তাকে ভালোবাসে কিন্তু তার সঙ্গে তার কোনো অন্তরঙ্গতা নেই এবং ভবিষ্যতেও হবে কি না সন্দেহ। জন্মের পর পরই যে সন্তানকে পিতামাতার কাছ থেকে পৃথক করে ফেলা হয় তার সঙ্গে আর কখনোই সম্ভবত বাবা মার দৃঢ় বন্ধন প্রতিষ্ঠিত হয় না। এক মুহূর্তের জন্য উঁচু খিলানটির দিকে তাকিয়ে সেলিমের সেখানে প্রবেশ করার লোভ হলো, কিন্তু তাতে কি লাভ? সে নিশ্চিত আকবর সেখানে তার উপস্থিতি কামনা করছেন না। আর খুররমেরও তাকে প্রয়োজন নেই।

জাহাপনা, আপনার অন্য পুত্ররা এবং শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী বাকি সদস্যরা রাজপ্রাসাদে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেবল আপনার পিতার দেহরক্ষীরা এখানে অবস্থান করবে। আমরাও কি ফিরতে পারি? সুলায়মান বেগের লঘু সম্ভাষণ সেলিমকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো। তার মতো তার বন্ধুটিও ভীষণ ঘামছে। দিনের উত্তাপ ক্রমাগত অসহ্য হয়ে উঠছে। সেলিম মাথা ঝাঁকালো। প্রাসাদের শীতল ছায়ায় ফিরে যাওয়াই এখন উত্তম, তাছাড়া তার পুত্রটি তার বিদ্যালয় যাত্রার প্রথম দিনে কেমন আচরণ করলো তা জানার জন্যেও নিশ্চয়ই যোধ বাঈ উদ্গ্রীব হয়ে আছে।

 দৃষ্টি নন্দন এবং আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান উদযাপন করার ব্যাপারে তোমার পিতা সত্যিই অত্যন্ত পারদর্শী। উপস্থিত জনতা উচ্ছ্বাস উদ্দীপনায় প্রায় বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। সুলায়মান বেগ মন্তব্য করলো।

তিনি তার সমৃদ্ধি এবং জাঁকজমক প্রজাদের প্রদর্শন করতে পছন্দ করেন। তিনি মনে করেন এর ফলে প্রজারা মোগল সাম্রাজ্যের নাগরিক হওয়ার মর্যাদা ধারণের জন্য গর্ব অনুভব করে।

 তোমার পিতার ধারণা সঠিক। তুমি উপস্থিত জনতার সম্মিলিত চিৎকার আল্লাহ আকবর ধ্বনি শুনতে পাওনি? প্রজারা তাকে সত্যিই ভালোবাসে।

হ্যাঁ, আমি জানি। সেলিমের মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে এবং সূর্যের প্রখর উজ্জ্বলতা সহ্য করতে তার কষ্ট হচ্ছে। সকলেই আকবরকে ভালোবাসে। সে অপেক্ষাকৃত দ্রুত বেগে হাঁটতে লাগলো। সেই মুহূর্তে নিজ কক্ষে ফিরে গিয়ে আপন ভাবনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাক্ষা অনুভব করলো সেলিম।

*

লাহোর থেকে দক্ষিণে অবস্থিত অধুনা পুনর্নির্মিত আগ্রা দূর্গ পরিদর্শনের জন্য শীতকালের আপেক্ষায় থেকে তার পিতা ভালো কাজ করেছেন, সেলিমের মনে হলো। ছয় মাস পর আকবর সদলবলে আগ্রাদূর্গ পরিদর্শনে এসেছেন। তারা হাতির পিঠে চড়ে খাড়া আকাবাকা ঢাল বেয়ে দূর্গের প্রবেশ দ্বারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই ঢাল এবং বাঁক তৈরি করা হয়েছে শত্রুর দূর্গমুখী আক্রমণের গতি ধীর করার জন্য। ঢালের শেষ প্রান্তে নির্মিত প্রবেশ দ্বারটি বিশাল আকৃতির এবং তাতে ধাতব শলাকা লাগানো হয়েছে, কেউ যদি হাতির সাহায্যে দ্বারটি ভাঙ্গার চেষ্টা করে তাহলে সেই হাতি আহত হবে। নেতৃত্ব দানকারী হাতিটির পিঠে রয়েছেন আকবর এবং যথারীতি খুররম তার পাশে বসে আছে।

জাহাপনা, আপনি অপনার নিজের অবদানকে অতিক্রম করেছেন, কিছুক্ষণ পরে হাওদা থেকে নামার সময় আবুল ফজল বলে উঠলো। তার দৃষ্টি সত্তর ফুট উঁচু বালুপাথরের দূর্গপ্রাচীরের দিকে নিবদ্ধ, পুনর্নির্মিত দূর্গকে ঘিরে যার পরিধি দেড় মাইল বিস্তৃত।

আবুল ফজলের বর্তমান বক্তব্যটি একটুও অতিরঞ্জিত নয়, সেলিম স্বীকার করতে বাধ্য হলো। আকবরের মতো সে দূর্গের কাজ চলার সময় পরিদর্শনে আসেনি কিন্তু সে আকবরের স্থপতিদের অঙ্কিত নকশা দেখেছে এবং সে কারণেই জানতো যে আকবর দূর্গটি প্রায় সম্পূর্ণ নতুন আদলে পুনর্নির্মাণ করছেন। তিনি এর বাহ্যিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো সুদৃঢ় করেছেন, অভ্যন্তরের অলংকরণ এবং সাজসজ্জা আরো আকর্ষণীয় করেছেন এবং সর্বোপরি একে আরো সম্ভ্রান্ত এবং রাজকীয় রূপ প্রদান করেছেন। পুরান ভবনটি লোদি রাজবংশের দ্বারা নির্মিত ছিলো যা বাবর তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন এবং সেটি ইট এবং বালুপাথরের সংমিশ্রণে তৈরি ছিলো। কিন্তু আকবর কেবল বালুপাথর ব্যবহার করেছেন এবং হিন্দু কারিগরদের দ্বারা নকশা কাটিয়েছেন যেমনটা তিনি ফতেহপুর শিক্রির ক্ষেত্রে করেছেন। নতুন উঠান এবং বাগান গুলি আলিশান স্তম্ভ দ্বারা পরিবেষ্টিত। নতুন দরবার ভবনটির ছাদ একশোর অধিক বালুপাথরে তৈরি খামের উপর স্থাপিত হয়েছে।

 বলো সেলিম, তোমার কি মতো? গর্বে প্রায় চাক্ষুশ ভাবেই ফুলে উঠে আকবর সেলিমকে জিজ্ঞাসা করলেন।

দূর্গটি সত্যিই চমৎকার দেখাচ্ছে!, সেলিম তার মনের কথাটি প্রকাশ করলো, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। তার আশেপাশে অবস্থিত লাহোর থেকে আগত আকবরের সফরসঙ্গী সভাসদগণ নিজেদের মধ্যে প্রশংসাসূচক গুঞ্জন তুলে ভাব বিনিময় করছে।

এই দূর্গের পেছনে আমি যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছি তার সঙ্গে এই চমৎকারিত্ব সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু আমাদের সিন্দুক গুলির গভীরতা অনেক, এ ধরনের একশটি দূর্গ নির্মাণ করার সামর্থ আমার আছে। আকবর অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে নকশা করা দেয়ালের আইরিস ও ড্যাফোডিল ফুলের অনুরূপ অলঙ্করণের উপর আলতো ভাবে হাত বুলালেন। নকশাটি এমন যেনো বহমান বাতাসের ধাক্কায় ফুলগাছ গুলি নুয়ে পড়েছে। তুমি কি বলল খুররম? তোমার কি মনে হয় কারিগরেরা ভালো কাজ করেছে?

খুররমের শিশুসুলভ দৃষ্টিকে দূর্গের আকর্ষণীয়তা খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। আপনি কারিগরদের যা করতে বলেছেন তারা ঠিক তাই করেছে দাদু।

আকবর তার মাথাটি পেছন দিকে হেলিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন। তোমাকে সন্তুষ্ট করা কঠিন; তবে এ ধরনের বৈশিষ্ট একজন যুবরাজের জন্য যথার্থ। কিন্তু আমার বিশ্বাস আমি তোমাকে ঠিকই সন্তুষ্ট করতে পারবো। আকবর তার রেশমের জোব্বা এবং এর নিচে পরিহিত সূক্ষ্ম মসলিনের পিরানটি খুলে ফেললেন। বয়স হওয়া সত্ত্বেও তাঁর শরীরের মাংসপেশী গুলি এখনোও মজবুত, কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত দেহের বাধুনী টানটান অনেকটা তার অর্ধেক বয়সী কোনো পুরুষের অনুরূপ। তোমরা দুজন, এদিকে এসো, আকবর উচ্চ স্বরে তাঁর দুজন তরুণ দেহরক্ষীকে কাছে ডাকলেন। তারা দুজন অবাক দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকালো, তারপর দ্রুত এগিয়ে এলো। তোমাদের অস্ত্র রেখে আমার মতো খালি গা হও।

লোক দুজন তাৎক্ষণিক ভাবে আদেশ পালন করলো। তার বাবা কি করছেন? সেলিম ভাবলো। উপস্থিত সকলে সপ্রশংস দৃষ্টিতে সম্রাটের দিকে তাকাচ্ছিল কিন্তু আকবর তখন দাঁত বের করে হাসছেন। আমার আরো কাছে এসো, আমি তোমাদের ভালো করে পরখ করতে চাই। দুই তরুণ যখন আকবরের মুখোমুখী দাঁড়ালো, তিনি তাদের কাঁধ এবং বাহুর উপর হাত বুলালেন তাঁদের মাংসপেশীর দৃঢ়তা পরখ করার জন্য। খারাপ নয়, কিন্তু আরো লম্বা ও শক্তিশালী লোক হলে ভালো হতো। তারপর, কোনো পূর্বধারণা না দিয়েই, দুজনের মধ্যে যে রক্ষীটি বেশি লম্বা চওড়া তার পেটে তিনি প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন। রক্ষীটি ওক শব্দ করে বেঁকে সামনে দিকে ঝুঁকে পড়লো, সে দুহাতে তার পেট চেপে ধরেছে এবং জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে। তোমার বাড়ি কোথায়?

 দিল্লী জাঁহাপনা, যন্ত্রণায় কাতর রক্ষীটি কোনো রকমে মুখ ফুটে বললো।

তুমি যদি পুরানো মোগল গোত্রগুলির একজন সদস্য হতে তাহলে এর থেকে দ্বিগুণ শক্তিশালি ঘুষি সহ্য করতে পারতে। এবার দেখো আমি নিজে কোনো ধাতুতে গড়া। আকবর এগিয়ে এসে তরুণটির কোমর নিজের বাম বাহুতে পেচিয়ে ধরে বোগলদাবা করে মাটি থেকে তুলে নিলেন। নিজ সামর্থে সন্তুষ্ট হয়ে রক্ষীটির পা আবার মাটি স্পর্শ করার সুযোগ দিলেন। তুমি, আমার ডান পাশে এসো, তিনি দ্বিতীয় তরুণটিকে আদেশ দিলেন, এক মুহূর্ত পর দেখা গেলো সে আকবরের ডান বাহুর আবর্তে বগলদাবা হয়ে আছে। আকবর তার পা দুটি ইষৎ ফাঁক করে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিলেন এবং একত্রে দুজনকে মাটি থেকে তুলে ফেললেন।

খুররম বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো, কিন্তু আকবর থেমে থাকলেন না। তিনি রক্ষী দুজনকে শূন্যের উপর আরেকটু সুবিধাজনক ভাবে আকড়ে ধরলেন, তার দেহের মাংসপেশী এবং সাদা হয়ে উঠা যুদ্ধের ক্ষতগুলির মধ্যস্থিত শিরাগুলি ফুলে উঠলো। তারপর তিনি খাড়া সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে দূর্গ প্রাচীরের দিকে উঠতে লাগলেন। দাঁড়িয়ে আছো কেনো খুররম? কাঁধের উপর দিয়ে মুখ ফিরিয়ে তিনি চিৎকার করে বললেন। আমার সাথে এসো। তৎক্ষণাৎ খুররম তার দাদার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলো। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে সেলিম তাকে অনুসরণ করলো, তার পেছনে তার অন্য পুত্ররা এবং সভাসদগণ। বাবা পাগল হয়ে গেছেন, ছুটন্ত আকবরের দিকে তাকিয়ে সেলিম ভাবলো। এ সময় দুর্ঘটনা বশত একজন রক্ষীর মাথা সিঁড়িতে ঠুকে গেলো।

 একগুয়ে ছুটন্ত মানুষটির দিকে তাকিয়ে সেলিম অনুমান করার চেষ্টা করলো আকবরের উদ্দেশ্য কি তিনি কি দূর্গের দেড় মাইল পরিধি এভাবে দৌড়াবেন? কিন্তু আত্মবিশ্বাসী আকবর কিছুটা ধীর গতিতে দৌড়ে দূর্গের সমগ্র পরিধি চক্কর মেরে যেখান থেকে আরম্ভ করেছিলেন সেই উঠানে ফিরে আসার আগপর্যন্ত একটুও টললেন না। তিনি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন এবং তাঁর গা বেয়ে দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিলো যখন থেমে তিনি দুই রক্ষীকে মুক্তি দিলেন। তাঁদের একজনের কপাল তখন দশাসই ভাবে ফুলে উঠেছে, কিন্তু তার মুখে ফুটে রয়েছে। গৌরবের হাসি।

 জাহাপনা আপনি এখনো আপনার যৌবনের শক্তির অধিকারী, আবুল ফজল বললো, সেও আকবরের পিছু পিছু পুরো দূর্গ চক্কর দিয়েছে এবং সেলিম যা ভেবেছিলো তার চেয়ে কম পরিশ্রান্ত হয়েছে। তার স্কুল গড়ন দেখে বোঝার উপায় নেই সে এতোটা সক্ষম।

এবার বলো খুররম, এখন তোমার মন্তব্য কি? তোমাকে কি আমি সন্তুষ্ট করতে পেরেছি?

শিশুটি মাথা ঝাঁকালো। আপনি আমার জানা মতে সবচেয়ে শক্তিশালী মনুষ দাদু। কিন্তু আপনি কবে আমাকে আপনার মতো শিকার করা শিখাবেন যার প্রতিশ্রুতি আপনি আমাকে দিয়েছেন?

 নিশ্চয়ই তুমি একদিন আমার মতো শিকার করা শিখবে। তোমাকে আমি আরো শিখাবো কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়। যখন তুমি আরেকটু বড় হবে তখন তুমি আমার যুদ্ধসভায় অংশ গ্রহণ করবে এবং আমি তোমাকে বিজয়াভিযানে নিয়ে যাবো। আমি একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছি, কিন্তু সবকিছু অর্থহীন হয়ে পড়বে যদি আমার বংশধরদের একে আরো সমৃদ্ধশালী করে তোলার যোগ্যতা না থাকে। আর সেই শিক্ষা এতো অল্প বয়সে আরম্ভ করা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *