১.১ পর্দার আড়াল থেকে

এম্পায়ার অভ দা মোগল – রুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড
মূল : এ্যালেক্স রাদারফোর্ড
অনুবাদ : এহসান উল হক

প্রধান চরিত্রসমূহ

আকবরের পরিবার

হুমায়ূন, আকবরের পিতা এবং দ্বিতীয় মোগল সম্রাট।

হামিদা, আকবরের মাতা।

 গুলবদন, আকবরের ফুফু এবং হুমায়ূনের সৎবোন।

 কামরান, আকবরের চাচা এবং হুমায়ুনের জ্যেষ্ঠ সৎভাই।

আসকারী, আকবরের চাচা এবং হুমায়ূনের মেজ সৎভাই।

 হিন্দাল, আকবরের চাচা এবং হুমায়ুনের সর্বকনিষ্ঠ সৎভাই।

হীরা বাঈ, আকবরের প্রথম স্ত্রী, অম্বরের রাজকুমারী এবং সেলিমের মাতা।

সেলিম(জাহাঙ্গীর), আকবরের জ্যেষ্ঠ পুত্র।

 মুরাদ, আকবরের মেজ পুত্র।

দানিয়েল, আকবরের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র।

মান বাঈ, সেলিমের স্ত্রী, খোসরুর মাতা এবং অম্বরের রাজা ভগবান দাশের কন্যা।

যোধ বাঈ, সেলিমের স্ত্রী এবং খুররমের মাতা।

সাহেব জামাল, সেলিমের স্ত্রী এবং পারভেজের মাতা।

 খোসরু, সেলিমের জ্যেষ্ঠ পুত্র।

পারভেজ, সেলিমের মেজ পুত্র।

 খুররম, সেলিমের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র।

আকবরের পরিষদবর্গ

বৈরাম খান, আকবরের অভিভাবক এবং প্রথম প্রধান সেনাপতি(খান-ই খান)।

আহমেদ খান, প্রথমিক পর্যায়ে আকবরের প্রধান তথ্য সংগ্রাহক এবং পরবর্তীতে প্রধান সেনাপতি।

মাহাম আঙ্গা, আকবরের দুধমা।

আদম খান, আকবরের দুধভাই।

 জওহর, হুমায়ূনের পরিচারক এবং পরবর্তীতে আকবরের গৃহস্থালী রসদভাণ্ডারের প্রধান।

আবুল ফজল, আকবরের প্রধান ঘটনাপঞ্জিকার এবং উপদেষ্টা।

তারদি বেগ, দিল্লীর প্রশাসক।

মোহাম্মদ বেগ, আকবরের সেনাপতি।

আলী গুল, আকবরের তাজিক সেনাকর্তা।

আব্দুল রহমান, আকবরের আহমেদ খান পরবর্তী প্রধান সেনাপতি।

আজিজ কোকা, আকবরের একজন তরুণ সেনাপতি।

মোগল রাজসভার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি

আতগা খান, আকবরের প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক।

 মায়ালা, আকবরের একজন প্রিয় রক্ষিতা।

আনারকলি, আকবরের ইটালীয় রক্ষিতা।

 শেখ আহমেদ, একজন গোড়া সুন্নি এবং ওলামা পরিষদের প্রধান।

 শেখ মোবারক, উচ্চপদস্থ ওলামা এবং আবুল ফজলের বাবা।

 ফাদার ফ্রান্সিসকো হেনরিকস, জেসুইট পুরোহিত।

ফাদার এ্যান্টোনিও মনসেরেট, জেসুইট পুরোহিত।

 জন নিউবেরি, ইংরেজ বণিক।

সুলায়মান বেগ, সেলিমের দুধভাই এবং বন্ধু।

জাহেদ বাট, সেলিমের দেহরক্ষীদের অধিনায়ক।

জোবায়দা, সেলিমের শৈশবের সেবিকা এবং হামিদার পরিচারিকা।

দিল্পী

হিমু, হিন্দু সেনাপতি যে আকবরের কাছ থেকে অল্প সময়ের জন্য দিল্লী ছিনিয়ে নেয়।

ফতেহপুর শিক্রি

শেখ সেলিম চিশতি, একজন সুফি সাধক।

তুহিন দাশ, আকবরের স্থপতি।

গুজরাট

ইব্রাহিম হোসেন, গুজরাটের রাজ পরিবারের একজন বিদ্রোহী সদস্য।

 মির্জা মুকিম, গুজরাটের রাজ পরিবারের একজন বিদ্রোহী সদস্য।

 ইত্তিমাদ খান, গুজরাটের রাজ পরিবারের একজন বিদ্রোহী সদস্য।

কাবুল

সাইফ খান, কবুলের প্রশাসক।

গিয়াস বেগ, কাবুলের কোষাধ্যক্ষ।

 মেহেরুন্নেসা, গিয়াস বেগের কন্যা।

বাংলা

শের শাহ, বাংলা থেকে আগত শাসক যে হুমায়ূনের আমলে মোগলদের হিন্দুস্তান থেকে বিতাড়িত করেছিলো।

ইসলাম শাহ, শের শাহ্ এর পুত্র।

 শাহ দাউদ, আকবরের শাসনামলে বাংলার জায়গিরদার।

রাজস্থান

রানা উদয় সিং, মেওয়ার এর শাসক এবং বাবরের শত্রু রানা সাঙ্গার পুত্র।

 রাজা রবি সিং, আকবরের একজন জায়গিরদার।

রাজা ভগবান দাশ, অম্বরের শাসক, হীরা বাঈ এর ভাই এবং মান বাঈ এর পিতা।

মান সিং, রাজা ভগবান দাশের পুত্র।

মোগলদের পূর্বপুরুষ

চেঙ্গিস খান

তৈমুর, পশ্চিমে পরিচিত তামুরলাইন হিসেবে যা তৈমুর-ই-ল্যাং(খোঁড়া তৈমুর) এর অপভ্রংশ।

 উলাগ বেগ, তৈমুরের নাতি এবং বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ।

.

‘উদগিরণরত তীর এবং তলোয়ারের আঘাত
হাতির মজ্জা এবং বাঘের নাড়িভুড়ি বিদীর্ণ করে’
—-আবুল ফজলের আকবরনামা

*

প্রথম খণ্ড – পর্দার আড়াল থেকে

০১. অপ্রত্যাশিত বিপদ

উত্তর-পশ্চিম ভারত, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ

এ্যাকাসিয়ার জঙ্গলের প্রায় ত্রিশ ফুট গভীর থেকে নিচু কিন্তু গম্ভীর গর্জন। ভেসে এলো। গর্জন শোনা না গেলেও আকবর বুঝতে পারছিলেন সেখানে বাঘ থাকতে পারে। কারণ পশুটির গায়ের উগ্র গন্ধ ঐ স্থানের বাতাসে ভাসছিলো। খেদাড়েরা (শিকারকে তাড়ানোর জন্য নিযুক্ত লোক) তাদের দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করেছে। দিল্লী থেকে একশ মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে যে পাহাড়ে আকবরের সৈন্যদল তাবু গেড়েছিলো সেখানে পুরো এলাকার উপর তখন চাঁদের রূপালী আলো ছড়িয়ে পড়ছে। তারা একটি ছোট বনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো যেখানে একটি বড় আকারের পুরুষ বাঘ দেখা গেছে। যে গ্রাম-প্রধান বাঘটির খবর আকবরের তাবুতে বয়ে এনেছিলো সে বলেছিলো সে শুনেছে, তরুণ মোগল সম্রাট শিকার করতে ভালোবাসেন এবং এটাও দাবি করে যে বাঘটি মানুষখেকো। বাঘটি পানি আনতে যাওয়া দুটি শিশু ও ক্ষেতে কর্মরত এক বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে গেছে।

গ্রাম-প্রধানটিকে আকবর উত্তমরূপে পুরস্কৃত করেছেন, সে চরম উত্তেজনা নিয়ে তাবুস্থল ত্যাগ করে। আকবরের অভিভাবক এবং প্রধান সেনাপতি খান-ই-খানান উপাধির অধিকারী বৈরাম খান এই যুক্তি দিয়ে আকবরকে বাঘ শিকার করা থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন যে, মোগল সাম্রাজ্যের শত্রুরা যখন অগ্রসরমান তখন এই শিকারের চিন্তা চরম বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আকবরের কাছে তখন অন্য কোনো বিষয় বাঘ শিকারের আকর্ষণ ও উত্তেজনার তুলনায় তুচ্ছ। কিছুতেই তাঁর মতো পরিবর্তন করা গেলো না। অবশেষে বৈরাম খান তাঁর শীর্ণ ও বহু ক্ষতচিহ্ন সমৃদ্ধ মুখে অনেক কষ্টে মৃদু হাসি টেনে শিকারে সম্মতি দিলেন।

খেদাড়েরা মোগলদের আদিনিবাস থেকে মধ্য-এশিয়ায় বয়ে আনা বহু পুরানো শিকারের কৌশল প্রয়োগ করছিলো। তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে অন্ধকার বনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো, আটশ জন লোকের তৈরি একমাইল প্রস্থের এক বিশাল বৃত্তের আকারে। সেই সাথে তারা পেতলের ঘন্টা এবং গলায় ঝোলানো সরু আকৃতির ঢোল পেটাচ্ছিলো। তারা বৃত্তটি ছোট করে আনতে শুরু করলো যার ফলে তাদের মানব-বেষ্ঠনী দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে লাগলো এবং সেই সঙ্গে বনের অন্যান্য জীবজন্তু যেমন-হরিণ, নীলগাই, বুনো-শূকর প্রভৃতি তাঁদের বৃত্তের কেন্দ্রে জড়ো হচ্ছিলো। একসময় বেড়ে উঠা আলোতে কয়েকজন খেদাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ দেখলো এবং আকবরকে খবর পাঠালো যিনি তাঁদের পিছু পিছু হাতির পিঠে চড়ে আসছিলেন।

আকবর যে বিশাল হাতিটির পিঠে মণি-মাণিক্য খচিত হাওদায় বসে ছিলেন সেই জানোয়ারটিও বুঝতে পারছিলো বাঘটি কাছেই রয়েছে। বিপদের আশংঙ্কায় জানোয়ারটি তার বিরাট মাথাটি দুপাশে দোলাচ্ছিলো এবং বারবার শুড় গুটাচ্ছিলো। পেছনে যে হাতিগুলি আকবরের দেহরক্ষী ও পরিচারকদের বহন করছিলো সেগুলির বিশাল পায়ের অস্থির পদক্ষেপও তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। আকবর তাঁর হাতির ঘাড়ের উপর কায়দা করে বসে থাকা শীর্ণ দেহের লাল পাগড়ী পরা লোকটিকে ফিসফিস করে বললেন, মাহুত, হাতিটাকে শান্ত কর। মাহুত তৎক্ষণাৎ তার হাতে থাকা লোহার ঈষৎ বাঁকা দন্ড দিয়ে হাতিটির বাম কানের পিছনে টোকা দিলো। উত্তম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতিটি তার পরিচিত সংকেত পেয়ে ধীরে শান্ত হয়ে এলো এবং স্থিরভাবে দাঁড়ালো। পেছনের হাতিগুলিও সামনেরটিকে অনুসরণ করে স্থির ও নিশ্চল হয়ে দাঁড়ালো এবং চারদিক ভীষণ নিস্তবদ্ধ হয়ে পড়লো।

চমৎকার, আকবর ভাবলেন। এই মুহূর্তে তিনি নিজের মধ্যে চরম উদ্দীপনা অনুভব করলেন। তাঁর শিরায় রক্ত ছলকে উঠলো এবং তিনি নিজ হৃৎপিণ্ডের ধু ধু শব্দ শুনতে পেলেন, তবে সেটা ভয়ে নয় উত্তেজনায়। যদিও তাঁর বয়স এখনো চৌদ্দ পূর্ণ হয়নি, ইতোমধ্যেই তিনি অনেকগুলি বাঘ মেরেছেন। বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তির খেলা, অনিশ্চয়তা ও বিপদের আশঙ্কা সর্বদাই তার মাঝে শিহরণ জাগিয়েছে। তিনি জানেন বাঘটি যদি আচমকা বেরিয়ে আসে, একমুহূর্তে তিনি পিঠে থাকা তূণীর থেকে তীর নিয়ে তাঁর দ্বি-বক্র ধনুকের ছিলায় পরিয়ে ফেলতে পারবেন-বেশিরভাগ শিকারী এধরনের পরিস্থিতিতে এই অস্ত্রই ব্যবহার করে। কিন্তু আকবরের জানতে কৌতূহল হচ্ছিলো তাঁর গাদাবন্দুকের সামর্থ কতোটুকু, বিশেষ করে এই কুখ্যাত বড় আকারের বাঘটার বিরুদ্ধে। গাদাবন্দুক ব্যবহারে তার নৈপুণ্যের বিষয়ে তিনি গর্ব বোধ করেন এবং মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও লেখাপড়ার তুলনায় বন্দুক নিয়ে অনুশীলনেই অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন। বন্দুক ছোঁড়ার নৈপুণ্যে যদি তিনি তার সৈন্যদলের যে কোনো সৈনিককে পরাজিত করতে পারেন তাহলে অশিক্ষিত হওয়া কি দোষের? বাঘটির গর্জন থেমে গেছে এবং জানোয়ারটি তার বাদামী চোখে তাকে লক্ষ করছে বলে আকবর অনুভব করতে পারলেন। খুব ধীরে তিনি তাঁর ম্যাচলক মাস্কেট (গাদাবন্দুক) এর কারুকার্য খচিত ইস্পাতের নলটি তার আসনের পার্শ্বে নিচু করে ধরলেন। বন্দুকে গুলি ও বারুদ আগেই ভরে রেখেছেন, এখন এর ছোট পলিতাটি (ফিউজ, যাতে আগুন ধরিয়ে এই বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে হয়। পরীক্ষা করলেন। তাঁর অনুচর তার পাশেই নিচু হয়ে পলিতায় অগ্নিসংযোগের জ্বলন্ত কাঠি ধরে রেখেছে।

সব ঠিক আছে নিশ্চিত হয়ে আকবর তার গাদাবন্দুকটি এ্যাকাসিয়ার জঙ্গলের সবচেয়ে ঘন ঝোঁপের দিকে তাক করলেন, তাঁর অনুমান বাঘটি ওখানেই লুকিয়ে আছে। হাতির দাঁতের কারুকাজ করা বন্দুকের কাঠের বাটটি তার কাঁধে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলেন। অনুচরকে ফিসফিস করে বললেন, অগ্নিসংযোগের কাঠিটা দাও এবং খেদাড়েদের সংকেত দাও। সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতির পিছনে অর্ধবৃত্তাকারে জড়ো হয়ে থাকা খেদাড়েরা উচ্চশব্দে চিৎকার করতে লাগলো এবং তাঁদের ঘন্টা ও ঢোলের তীব্র শব্দ তুললো। কয়েক মুহূর্ত পর যেনো প্রত্যুত্তর দিতেই বিকট গর্জন করে বাঘটি জঙ্গলের অন্ধকার চিড়ে বেরিয়ে এলো। বন্দুকের পলিতায় আগুন দেয়ার সময় আকবর বাঘটির বড় বড় সাদা দাঁত আর শরীরের সোনালী-কালো একটি ঝলক দেখতে পেলেন, ইতোমধ্যেই তাঁর হাতি লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিয়েছে। বিস্ফোরণের তীব্র আলো ঝলসে উঠলো, সেইসাথে কানে তালা দেয়া গুড়ম শব্দ। বন্দুকের বিস্ফোরণের ধাক্কায় উল্টো ডিগবাজি খেয়ে আকবর তার আসনের একপাশে ছিটকে পড়লেন কিন্তু তার আগমুহূর্তে বাঘটিকেও ধরাশায়ী হতে দেখলেন দশগজ দূরে। ধোঁয়া সরে গেলে আকবর দেখলেন জানোয়ারটি নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে এবং সেটির ডান চোখের উপরে সৃষ্ট অমসৃণ ফুটো থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।

আকবর বিজয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন। তিনি মাহুতের সাহায্য ছাড়াই হাতিটির হাঁটুতে ভর দিয়ে মাটিতে নামলেন, তার মুখে তখন আকর্ণ বিস্তৃত হাসি। তিনি চমৎকার দক্ষতায় বাঘটিকে হত্যা করেছেন। যারা সন্দেহ করতে গাদাবন্দুক এধরনের শিকার করার জন্য অত্যন্ত ধীর গতি সম্পন্ন, তাঁদের ধারণাকে তিনি ভুল প্রমাণিত করলেন। একজন ভালো বন্দুকবাজের জন্য এই অস্ত্র যথেষ্ট দ্রুত কাজ করতে পারে। মৃত জানোয়ারটিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করার জন্য তিনি এগিয়ে গেলেন। বাঘটির গোলাপি জ্বিহা সেটার মুখের একপাশে শিথিলভাবে নেতিয়ে আছে, তার উপর সবুজ-কালো বর্ণের মাছির দল ভন ভন করা শুরু করেছে। কিন্তু বাঘটির পেটে দুধের বাঁট লক্ষ্য করে তিনি অবাক হলেন। যে বাঘটিকে তিনি শিকার করতে এসেছেন সেটাতো পুরুষ হওয়ার কথা! এই ভাবনাকে অনুসরণ করে তার মনে যে ভাবনাটি এলো তার প্রতিক্রিয়ায় তার কিশোর বয়সী ঘাড়ের পিছনের চুলগুলি প্রায় দাঁড়িয়ে গেলো। তিনি কম্পিত আঙ্গুলে একঝটকায় কাঁধ থেকে ধনুক টেনে নিলেন এবং পিঠের তূণ থেকে একটি তীর ছিলায় পরানোর সময়ই বিশাল আকারের দ্বিতীয় বাঘটি আচমকা জঙ্গল থেকে ছিটকে বেরিয়ে সোজা তার দিকে এগিয়ে এলো। কোনোক্রমে আকবর তার তীরটি ছুঁড়তে পারলেন এবং সেইমুহূর্তে সময় যেনো তার কাছে স্থির হয়ে গেলো। তার পেছন থেকে আসা সতর্কতাসূচক চিৎকার ও কোলাহলো যেনো অস্পষ্ট হয়ে এলো এবং তাঁর মনে হলো এখানে তিনি এবং বাঘটি ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি তাঁর ছোঁড়া তীরটিকে খুব ধীরে বাতাস চিড়ে ছুটে যেতে দেখলেন। তার মনে হলো লাফ দিতে উদ্যত বাঘটি স্থির হয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ সময় যেনো আবার সচল হয়ে উঠলো এবং বাঘটি প্রায় তার উপর এসে পড়লো। আকবর লাফিয়ে একপাশে সরে গেলেন, তার চোখ প্রায় বন্ধ এবং তার মনে হলো যেকোনো মুহূর্তে বাঘটির ধারালো নখ তার শরীরের মাংস চিরে ঢুকে যাবে এবং সেটার দুর্গন্ধযুক্ত মুখের ধারালো দাঁতগুলি তাঁর গলা কামড়ে ধরবে। পক্ষান্তরে ধুপ করে আছড়ে পড়ার শব্দে তিনি চোখ মেলে দেখলেন বাঘটি তার পাশে নিথর পড়ে আছে, তীরটি সেটার গলা এফোড় ওফোড় করে ঢুকে আছে। এক মুহূর্ত আকবর স্তব্ধ হয়ে রইলেন, অনুভব করলেন এটা এমন অভিজ্ঞতা যার সাক্ষাৎ তিনি আগে কখনোও পাননি-আতঙ্ক এবং সেইসঙ্গে ভাগ্যের সহায়তা। তখনো স্তম্ভিত, আকবর অগ্রসরমান ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেলেন এবং পিছন ফিরে দেখলেন। সরু ডালপালা ও ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে একজন অশ্বারোহী তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই শিবির থেকে আগত দূত, সন্দেহ নেই বৈরাম খান তাকে পাঠিয়েছেন তাগাদা দেবার জন্য। পাঁচ মিনিট আগে হলে এধরনের উৎপাতে তিনি বিরক্ত হতেন তার শিকারে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু এখন তিনি কৃতজ্ঞবোধ করলেন একটু আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার পরিণতি বিষয়ে তার চিন্তায় ছেদ টানার জন্য। খেদাড়েদের দল, রক্ষী এবং সেবকরা দুপাশে সরে দূতকে পথ করে দিলো। তার সবল উঁচু ঘোড়াটি ঘামে ভিজে গেছে এবং সে নিজে ধূলার আস্তরণে এমনভাবে আচ্ছাদিত হয়েছে যে তার পরনের উজ্জ্বল সবুজ রঙ্গের মোগলাই উৰ্দিটি প্রায় খয়েরি বর্ণ ধারণ করেছে। আকবরকে কুর্ণিশ করে সে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলো, সংক্ষিপ্ত অভিবাদন শেষে এক নিঃশ্বাসে বললো, সম্রাট, বৈরাম খান অনুরোধ করেছেন আপনি যেনো এক্ষুণি শিবিরে ফেরেন।

 কেনো? বিদ্রোহী হিমুর সেনাবাহিনীর একটি অগ্রবর্তী সৈন্যদলের কাছে দিল্লীর পতন হয়েছে।

*

চার ঘন্টা পর, আকবর এবং তাঁর শিকারের সঙ্গীরা শিবিরের প্রথম নিরাপত্তা বেড়া অতিক্রম করলো। সূর্য তখন পরিচ্ছন্ন নীল আকাশে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। যদিও ছাতার ছায়ায় রয়েছেন, তারপরও আকবরের মাথা ব্যথা করছিলো। ঘামে তার পোষাক শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে, তবুও এইসব অসুবিধা তাঁকে খুব একটা কষ্ট দিচ্ছিলো না রাজধানী দিল্লীর পতনের ভয়াবহ সংবাদ তাকে যতোটা ভাবাচ্ছিলো। শাসনকার্য শুরুর আগেই কি তাঁর শাসন আমলের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে?

দশ মাসও পার হয়নি এক মোগল শিবিরে অস্থায়ীভাবে ইটের তৈরি সিংহাসনে তড়িঘড়ি করে হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার পিতা সম্রাট হুমায়ূনের আকস্মিক মৃত্যুর শোক এখনো তাঁর হৃদয়ে জাগ্রত। কিছুটা বিব্রত কিন্তু গর্বিত ভঙ্গীমায় তিনি বৈরাম খান এবং অন্যান্য সেনাপতিদের অভিবাদন গ্রহণ করার জন্য শিবিরের সম্মুখে টাঙ্গানো রেশমের চাঁদোয়ার নিচে দাঁড়ালেন।

বর্তমানে যে দুঃসময় তারা অতিক্রম করছেন এর গুরুত্ব তাঁর মা হামিদা তাকে বুঝাতে পেরেছিলেন। পারসিক হওয়া সত্ত্বেও বৈরাম খান অন্য যে কোনো উপদেষ্টার চেয়ে তার নিরাপত্তা বিধানে অনেক বেশি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। বৈরাম খান আঁচ করতে পেরেছিলেন আকবরের পিতার মৃত্যুর পর তার জন্য বিপদ সৃষ্টি হবে ভিতর থেকেই-উচ্চাকাক্ষী সেনাপতিরা ভাবছে এখন যখন হুমায়ূন মৃত এবং সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে গেছেন একটি মাত্র বালক পুত্রসন্তান, এটাই সিংহাসন দখলের উপযুক্ত সময় তাঁদের জন্য। তাদের অধিকাংশের মধ্যেই ভাবাবেগের অস্তিত্ব নেই। তাঁদের অনেকেই পুরানো মোগল গোত্র গুলির সদস্য যারা হিন্দুস্তানের শুষ্ক সমভূমিতে একটি নতুন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে আকবরের পিতামহ সম্রাট বাবরের সঙ্গী ছিলো। সিংহাসন অথবা খাঁটিয়া সর্বদা এই মনোভাব দ্বারাই তারা চালিত হয়েছে। যে কেউ নিজেকে যোগ্য এবং শক্তিশালী ভেবেছে সেই সিংহাসন অধিকারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। বিগত বছর গুলিতে অনেকেই এমন অনেকেই এমন প্রয়াস চালিয়েছে। এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে সন্দেহ নেই।

 আকবর ভাবছেন যদি দিল্লীর পতনের দুঃসংবাদ সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তার মা এবং বৈরাম খান তার জন্য এতোদিন যা কিছু করেছেন সব ব্যর্থতায় পর্যবশিত হলো। মূল্যবান সময়ের সদ্ব্যবহার করার জন্য তারা হুমায়ূনের মৃত্যু সংবাদটি প্রায় দুসপ্তাহ গোপন রেখেছিলেন। মৃত সম্রাটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রায় একই দৈহিক গড়নের একজন বিশ্বস্ত অনুচরকে হুমায়ূনের ভূমিকায় নিয়োজিত করেছিলেন তাঁরা। রীতি অনুযায়ী সে প্রতিদিন ভোরে সম্রাটের রেশমের সবুজ পোষাক এবং রত্নখচিত পাগড়ি পড়ে দিল্লীর রাজপ্রাসাদ পুরানো-কেল্লার যমুনা তীরবর্তী বারান্দায় হাজিরা দিয়েছে প্রজাদের বোঝানোর জন্য যে সম্রাট এখনো জীবিত আছেন।

ইতোমধ্যে, মা হামিদা এবং ফুফু গুলবদন অনিচ্ছুক আকবরকে গোপনে দিল্লী ত্যাগ করতে রাজি করান। প্রদীপের কম্পিত আলোয় মায়ের উদ্বিগ্ন মুখটি এখনো তার চোখে ভাসছে যখন তিনি তাঁর শয়ন কক্ষে এসে তাকে ডেকে তুলেন এবং ফিসফিস করে বলেন, তাড়াতাড়ি করো, সঙ্গে কিছু নেবার দরকার নেই-জলদি! আচমকা ঘুম ভেঙ্গে উঠে আকবর দেখেন মা তার গায়ে মস্তক আবরণ যুক্ত একটি কালো আলখাল্লা পড়িয়ে দিচ্ছেন, তিনি নিজেও অনুরূপ একটি আলখাল্লা পড়ে আছেন। তখনো ঘুমের রেশ কাটেনি, মাথায় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে প্রসাদের গুপ্ত সিঁড়ি পথে (যে সম্পর্কে আগে তিনি জানতেন না) তিনি তার মাকে অনুসরণ করে একটি অপরিচ্ছন্ন উঠানে উপস্থিত হোন। সেখানকার বাতাসে মানুষ অথবা পশুর প্রস্রাবের যে তীব্র গন্ধ ভাসছিলো-সেটা এখনো তার মনে আছে।

সেখানে একটি বড় টানা-গাড়ি অপেক্ষা করছিলো এবং আঁধারের ছায়ায় ফুফু গুলবদন এবং প্রায় বিশজন বৈরাম খানের অনুগত সৈন্য দাঁড়িয়ে ছিলো। গাড়িতে উঠে পড় হামিদা ফিসফিস করে বলে ছিলেন।

 কেনো, আমরা কোথায় যাচ্ছি? তিনি জিজ্ঞেস করেন।

 এখানে থাকা তোমার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর কোনো প্রশ্ন করো না। যা বলছি করো।

আমি পালাতে চাই না। আমি কাপুরুষ নই। ইতোমধ্যেই রক্ত এবং যুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে… তিনি প্রতিবাদ করেন।

 গুলবদন এগিয়ে এসে তার বাহু আকড়ে ধরে বললেন, যখন তুমি শিশু ছিলে এবং তোমার জীবন বিপন্ন হয়েছিলো তখন তোমাকে বাঁচাতে আমি নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছি। আমার উপর আস্থা রাখো এবং তোমার মা যা বলছে করো…।

তর্ক করা অব্যাহত রেখেই আকবর টানা-গাড়িতে চড়লেন, হামিদা ও গুলবদন তার পিছুপিছু গাড়িতে উঠে এলেন এবং তারা দ্রুত গাড়িটির পর্দা টেনে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা গাড়ি টানার হাতল কাঁধে তুলে নিয়ে রাতের নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে যাত্রা শুরু করলো। গুলবদন ও হামিদা চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন এবং তাঁদের দুশ্চিন্তার অংশবিশেষ অবশেষে আকবরের মাঝে সঞ্চারিত হলো, যদিও তিনি ঠিক বুঝতে পারছিলেন না এসব কি হচ্ছে। এক সময় তারা যখন রাজপ্রাসাদ থেকে অনেক দূরে শহরের শেষ সীমায় পৌঁছালেন তখন তার মা মুখ খুললেন। জানালেন সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহনের আগেই তাকে হত্যা করার এক গোপন ষড়যন্ত্রের কথা।

দিল্লীর সীমান্তে বৈরাম খানের অনুগত আরো সৈন্য তাঁদের সঙ্গে মিলিত হলো এবং নিরাপত্তা প্রদান করে তাঁদের শহর থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরবর্তী একটি শিবিরে নিয়ে এলো। এক সপ্তাহ পর বৈরাম খান তার মূল সেনাবাহিনীসহ তাঁদের সঙ্গে মিলিত হলেন এবং আকবরকে তার ইটের সিংহাসনে বসিয়ে দিল্লীর সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দিলেন। তারপর ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে উপযুক্ত নিরাপত্তা প্রদান করে বৈরাম খান আকবরকে দিল্লীতে ফিরিয়ে আনেন এবং শুক্রবারের জুম্মার নামাজের সময় তাঁর নামে খুদ্বা পাঠ করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে নতুন সম্রাট হিসেবে আকবরের পরিচিতি সমগ্র বিশ্বের কাছে ঘোষিত হয়। তখনো যাদের নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বোনার সময় ছিলো তাদের বিরুদ্ধে এটি ছিলো। কৌশলগত পদক্ষেপ। এই ঘোষণার পর সকল মোগল নেতারা আকবরের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করলো।

 এর ফলে আভ্যন্তরীণ শত্রুদের মোকাবেলা করা হলো, কিন্তু সাম্রাজ্যের দূরবর্তী রাজ্য গুলিতে আকবরের অভিষেক সংবাদের প্রভাব ততোটা জোড়াল ভাবে পড়লো না। পারতপক্ষে হিন্দুস্তানের উপর মোগলদের প্রভাব তখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যেসব রাজা এবং জায়গিরদারগণ অল্প সময় আগে আকবরের পিতা হুমায়ুনের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করেছিলো তারা স্বাধীন হতে চাচ্ছিলো এবং সাম্রাজ্যের বাইরের শত্রুরা সীমান্ত এলাকায় আক্রমণ চালাচ্ছিলো। কিন্তু তাদের সবার উপরে সবচেয়ে বিপদজনক হুমকি স্বরূপ দেখা দিলো হিমু। আগে তাকে শত্রু হিসেবে ততোটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সে ছিলো ছোটখাট গড়নের মিষ্টভাষী একটি লোক। তবে তার চেহারাটি কুৎসিত এবং সে নিচু বংশোদ্ভূত এক অজ্ঞাত চরিত্র, যে বলতে গেলে প্রায় শূন্য থেকে একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী গঠন করে ফেলতে সক্ষম হয় এবং মোগল শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। ইতোপূর্বে আকবর হিমুর ব্যাপারে বিন্দু মাত্র মাথা ঘামাননি কিন্তু এখন তিনি ভাবছেন বাস্তবে সে কেমন ধরনের মানুষ এবং কোনো মন্ত্রবলে সে তার যোদ্ধাদের দলে টানলো। তাঁর এ সাফল্যের পিছনে কি রয়েছে?

*

আকবরের শিবির হিসেবে গড়ে তোলা বিশাল তাবুশহরের প্রাণকেন্দ্রে তিনি প্রবেশ করছিলেন। বিশালদেহী হাতিটির পিঠে নিরাপদ উচ্চতায় অবস্থিত হাওদা (হাতির পিঠে নির্মিত আসন) থেকে তিনি সামনে তাকালেন, কেন্দ্রস্থলে তার নিজের তাবুটি দেখলেন-সেটি উজ্জ্বল রক্তিম বর্ণের যা সম্রাটের প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে-সেটির পাশে প্রায় একই দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণীয়তায় তৈরি বৈরাম খানের তাবুটি অবস্থিত। প্রধান সেনাপতি তাঁর জন্য তাবুর বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন, তাকে দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো আকবরের সেখানে পৌঁছানোর জন্য তিনি কতোটা অস্থির হয়ে ছিলেন।

আকবর হাতির পিঠ থেকে নামতে না নামতেই বৈরাম খান মুখ খুললেন। সম্রাট, আপনি খবরটা শুনেছেন-হিমুর সৈন্যরা দিল্লী দখল করে নিয়েছে। ইতোমধ্যেই আপনার তাবুতে যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কার্যক্রম শুরু করেছে এবং এখন আমাদের কি করণীয় সে সম্পর্কে বাকবিতণ্ডা চলছে। আকবর বৈরাম খানকে অনুসরণ করে তাবুতে ঢুকে দেখলেন অন্যান্য সেনাপতি এবং পরামর্শদাতারা তার বসার জন্য নির্ধারিত সবুজ মখমলে আচ্ছাদিত সোনার পাত মোড়া একটি টুলের চারপাশে পুরু লাল-নীল বর্ণের শতরঞ্জিতে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে। আকবর আসন গ্রহণ করার পর সকলে দাঁড়িয়ে তাকে সংক্ষিপ্ত অভিবাদন জানালো, কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন পুনরায় আসন গ্রহণ করার সময় তাঁদের নজর কতোটা সমীহের সঙ্গে তাঁর পাশে দাঁড়ানো বৈরাম খান কে প্রত্যক্ষ করলো। তারদি বেগকে তলব করো, সে তার বক্তব্য সম্রাটকে পুনরায় অবহিত করুক, বৈরাম খান আদেশ দিলেন। কয়েক মুহূর্ত পর দিল্লীর দায়িত্বে নিয়োজিত মোগল প্রশাসক সেখানে উপস্থিত হলো। আকবর তারদি বেগকে চিনতেন এবং পছন্দও করতেন। সে ছিলো উত্তর কবুলের পাহাড়ী এলাকায় জন্মলাভ করা এক অসীম আত্মবিশ্বাসী যোদ্ধা, পেশীবহুল বিশাল দেহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভরাট কণ্ঠের অধিকারী। তাঁর চোখজোড়া সর্বদা হাস্যকরভাবে মিটমিট করে কিন্তু এই মুহূর্তে সেগুলি রোদে-পোড়া, শুষ্ক এবং বিষণ্ণ রূপ ধারণ করেছে।

তারদি বেগ, ম্রাট এবং মন্ত্রীসভার সম্মুখে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করো। বৈরাম খানের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত ঠাণ্ডা শোনালো। বলো কীভাবে তুমি একজন যবক্ষার (নাইট্রিক এ্যাসিড) বিক্রেতা এবং তার অনুগত বিদ্রোহীদের কাছে সাম্রাজ্যের রাজধানীকে আত্মসমর্পণ করে পালিয়ে এলে।

তারা কোনো মামুলী বিদ্রোহী নয়, বরং অত্যন্ত শক্তিশালী, উত্তমভাবে অস্ত্রসজ্জিত এক সেনাবাহিনী। হিমু ছোট বংশোদ্ভূত হতে পারে কিন্তু যে কেউ তাকে ভাড়া করেছে তার জন্যই সে সফলভাবে যুদ্ধ জয় করেছে বহুবার। কিন্তু এখন সে আর ভাড়াটে সৈন্য নয়, সে এখন নিজের স্বার্থে লড়ছে। সম্রাটের পিতামহ যে পুরানো লোদী সাম্রাজ্যকে বিতাড়িত করেছিলেন হিমু তাদের অনুসারীদের আমাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, বহু সৎ এবং গর্বিত ব্যক্তিও তাকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। আমাদের গুপ্তচরেরা খবর দিয়েছে একটি বিশাল অগ্রবর্তী বাহিনী পশ্চিমের সমভূমি থেকে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, আর হিমুর মূলবাহিনীর আরো বিশাল, তাঁদের রয়েছে তিনশত যুদ্ধ-হাতি এবং তাদের অবস্থান দিনের (প্রতিদিন তারা যততা দূর অগ্রসর হচ্ছে) হিসাবে বেশি দূরেও নয়। এই অবস্থায় রাজধানী ত্যাগ না করলে আমরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতাম।

 বৈরাম খানের মুখ রাগে কঠিন হয়ে উঠলো। দিল্লী থেকে পালিয়ে এসে তুমি প্রতিটি বিদ্রোহী এবং গোত্রপতিদের কাছে এমন ইঙ্গিত পাঠিয়েছে যে তারা আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে দ্বিধা করবে না। আমি তোমার সঙ্গে বিশ হাজার সৈন্যের একটি দল রেখে এসেছিলাম….

সেটা যথেষ্ট ছিলো না।

 তাহলে তোমার উচিত ছিলো আমাকে বার্তা পাঠানো এবং রাজধানী রক্ষা করা যতোক্ষণ পর্যন্ত না আমি অতিরিক্ত সেনা পাঠাতাম।

তারদি বেগের চোখ জোড়া জ্বলে উঠলো এবং তার ডান হাতের আঙ্গুল গুলো কোমরবন্ধনীতে গুঁজে রাখা রত্নখচিত খাপ যুক্ত খঞ্জরটির (ড্যাগার বা ছোরা) হাতলের দিকে এগিয়ে গেলো। বৈরাম খান আপনি আমাকে বহু বছর ধরে চেনেন এবং আমরা পাশাপাশি যুদ্ধ করেছি ও রক্ত ঝরিয়েছি। আপনি কি আমার বিশ্বস্ততার প্রতি সন্দেহ পোষণ করছেন?

তোমার আচরণের জন্য ভবিষ্যতে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে, তারদি বেগ। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো তোমার হারানো রাজধানী কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়। আমাদের উচিত… একজন বাদামি দাড়ি বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তাবুতে ঢুকতে দেখে বৈরাম খান থেমে গেলেন। আহমেদ খান, তুমি নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছো দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। কি খবর এনেছে আমাদের বলো?

আকবর সর্বদাই আহমেদ খানের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন, সে তার পিতা হুমায়ূনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচরদের মধ্যে অন্যতম ছিলো। হুমায়ূন তাকে আগ্রার প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু হিমুর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর বৈরাম খান তাকে ডেকে পাঠান এবং তার সাবেক পদ-প্রধানদূত ও গোপন তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তার ধূলিমলিন অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে সে সদ্য শিবিরে পৌঁছেছে।

হিমু তার মূল সেনাবাহিনীর দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যদি তার বর্তমান গতি বজায় থাকে তাহলে সে আনুমানিক দুই সপ্তাহের মধ্যে রাজধানীতে পৌঁছে যাবে। হিমুর দলের সঙ্গে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা একদল সৈন্যকে আমার সেনারা পাকড়াও করে, তাদের কাছ থেকেই এই তথ্য উদ্ধার করা গেছে। তারা আরো জানায় রাজধানীতে পৌঁছে হিমু নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করছে। ইতোমধ্যে সে নিজে পাদশাহ উপাধি ধারণ করেছে এবং নিজ নামে মুদ্রা (টাকা) তৈরির আদেশ প্রদান করেছে। আরো জানা গেছে, এই মর্মে বক্তব্য প্রদান করছে যে হিন্দুস্তানে মোগলরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, সেই মোগলদের উত্তরসূরি এক বালক এখন শাসন ক্ষমতার অধিকারী এবং এই সাম্রাজ্যের শিকড় এতো নাজুক যে খুব সহজেই এর মূল উৎপাটন করা যাবে।

আহমেদ খানের বক্তব্যে মন্ত্রিসভার মধ্যে যেনো আচমকা প্রাণসঞ্চার হলো। আকবরের মনে হলো সকলে পরস্পরের দিকে ভীত দৃষ্টি বিনিময় করলো। আমাদের এখনই আঘাত করা প্রয়োজন-হিমু দিল্লীতে পৌঁছে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করার আগেই, বৈরাম খান বললেন। তাড়াতাড়ি অগ্রসর হলে সে দিল্লীতে পৌঁছানোর আগেই আমরা তার নাগাল পাবো।

কিন্তু সেটা খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে, হেরাত থেকে আগত এক সেনাপতি আপত্তি জানালো। আমরা যদি পরাজিত হই তাহলে আমাদের সবকিছু হারাতে হবে। আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে আমাদের আরো একটু সময় নেয়া উচিত…।

বাজে কথা। এমন শক্তিশালী অবস্থানে থেকে হিমু আলোচনার প্রস্তাবকে পাত্তা দিতে যাবে কেনো? বললেন মোহাম্মদ বেগ, তিনি বারাকসানি এলাকার একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা। আমি বৈরাম খানের সঙ্গে একমত।

তোমরা সকলে ভুল করছো, মুখ খুললেন আলী গুল, যে একজন তাজাক। আমাদের সামনে একটাই পথ খোলা রয়েছে-আমদের লাহোরে যাওয়া উচিত, সে স্থানটি এখনো মোগল নিয়ন্ত্রণে আছে এবং সেখানে আমরা শক্তিসঞ্চয় করতে পারি। তারপর যখন আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী হবো, তখন শত্রুদের বিতাড়িত করতে পারবো।

কেউ তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না, আকবর ভাবলেন-যখন ক্রুদ্ধ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সভাসদরা তার চারপাশে শোরগোল তুললো। বৈরাম খান এসব বরদাশত করতে পারছিলেন না এবং একাগ্রভাবে আকবরের দিকে তাকিয়েছিলেন। আকবর বুঝতে পারছিলেন তিনি তার পরবর্তী পদক্ষেপ বিবেচনা করছেন। তিনি এব্যাপারেও নিশ্চিত ছিলেন যে বৈরাম খানের প্রস্তাবই সঠিক-আক্রমণ করাই সেই মুহূর্তে শত্রুদের প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ উপায়। তাঁর পিতাও পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারকালে অনেক ক্ষেত্রে দেরির কারণে শত্রুরা শক্তিবৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে। সেই মুহূর্তে আকবর মনস্থির করে ফেললেন। তাঁর বাবার মতো নিজেকে তিনি হিন্দুস্তান থেকে বিতাড়িত হতে দিবেন না। হিন্দুস্তান শাসন করা মোগলদের নিয়তি, তারচেয়েও বড় সত্য এটা তার নিয়তি এবং তিনি এখানে টিকে থাকার চেষ্টাই অব্যাহত রাখবেন।

আকবর নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ালেন, সকলের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হলো। যথেষ্ট হয়েছে! এই সাম্রাজ্য ত্যাগ করে পালানোর চিন্তা করার স্পর্ধা তোমরা কোথায় পেলে? তিনি উচ্চস্বরে বললেন। তোমাদের কোনো অধিকার নেই অত্মসমর্পণ করার। এখানে আমিই ন্যায়সঙ্গত। শাসক এবং সম্রাট। আমার দায়িত্ব-আমাদের দায়িত্ব-নতুন ভূ-খন্ড জয় করা এবং যেসব ভূ-খন্ড আমাদের পূর্বপুরুষ আমাদের জন্য জয় করে গেছেন সেগুলিকে শত্রুর কাছে সমর্পণ করে পালিয়ে যাওয়া নয়। এখনই আমাদের উচিত হিমুকে আক্রমণ করা এবং হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া তরমুজের মতো তাকে ধ্বংস করা। আমি নিজে সৈন্যদের নেতৃত্ব দেবো।

 আকবর বক্তব্য শেষ করে আসন গ্রহণ করার সময় এক মুহূর্ত বৈরাম খানকে লক্ষ্য করলেন, তিনি প্রায় দুর্বোধ্য মস্তক হেলানের মাধ্যমে আকবরের কঠোর বক্তব্যের প্রতি তাঁর সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। অন্যান্য উপদেষ্টা এবং সেনাপতিরা তখন দাঁড়িয়ে আছেন এবং হঠাৎ তাদের সম্মিলিত কণ্ঠের উচ্চ শব্দে তাবু প্রকম্পিত হলো, সকলে একই বাক্য উচ্চারণ করছেন: মির্জা আকবর! মির্জা আকবর! তিনি প্রথমে আশ্বস্ত হলেন এবং তারপর গর্ববোধ করলেন। তারা কেবল তাঁকে তৈমুরের বংশধর একজন আমিরজাদা হিসেবেই মেনে নিলো না- বরং সম্রাট হিসেবে তাঁর প্রথম যুদ্ধাভিযানে তাঁকে অনুসরণ করার ইচ্ছাও প্রকাশ করলো। তিনি কিশোর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বক্তব্যকে তারা গুরুত্ব প্রদান করেছে, ফলপ্রসূ নির্দেশনা দিতে পেরে তিনিও তৃপ্তিবোধ করছেন।

 একঘন্টা পর আকবর মহিলাদের জন্য নির্ধারিত অন্দর মহলে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তাঁদের শয়ন এবং গোসলের তাবুগুলি সোনার পাতে মোড়া উঁচু কাঠের তৈরি ঝাঁঝরি দিয়ে সুরক্ষিত যেগুলি ষাঁড়ের চামড়ার ফিতা দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা। একটিমাত্র প্রবেশ পথ উত্তম ভাবে সুরক্ষিত। তিনি যখন মায়ের তাবুতে প্রবেশ করলেন চন্দনের মিষ্টি গন্ধ তাঁর নাকে ভেসে এলো।

হামিদা রেশমের ফুল সজ্জিত একটি কোলবালিশে শুয়ে ছিলেন এবং তাঁর পরিচারিকা জয়নাব তার লম্বা কালো চুল আচড়ে দিচ্ছিলো। আরেক দিকে ফুফু গুলবদন একগ্রচিত্তে একটি বীণার তারে সুর মূর্ঘনায় মগ্ন ছিলেন। হামিদার বিপরীত দিকে আকবরের দুধমা মাহাম আঙ্গা একটি কামিজের উপর নশা সূচিকর্ম করছিলেন। মোগল রীতি অনুযায়ী রাজপুত্র এবং দুধমার সম্পর্ক আজীবন অবিচ্ছিন্ন থাকে। একইভাবে আকবরের তুলনায় কয়েক মাসের বড় মাহাম এর নিজ পুত্র আদম খান তার দুধ-ভাই এর মর্যাদা প্রাপ্ত এবং এই সম্পর্ক আপন ভাইয়ের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।

 আকবরকে দেখে এই তিনজন মহিলার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তার মা হামিদার বয়স তখনো ত্রিশ পেরোয়নি এবং তাঁর শরীর হালকা-পাতলা। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আকবরকে জড়িয়ে ধরলেন। গুলবদন বীণা রেখে মৃদু হাসলেন। মাহাম আঙ্গাও তাঁকে উষ্ণ আলিঙ্গন করার জন্য এগিয়ে এলেন।

আকবর তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী তিন মহিলাকে একত্রে দেখে খুশি হলেন যাদের তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন মনে করেন। আমি যুদ্ধ সংক্রান্ত সভা থেকে সরাসরি তোমাদের এখানে এসেছি। হিমুর অগ্রবর্তী সৈন্যরা দিল্লী দখল করে নিয়েছে কিন্তু তারা বেশিদিন দখলে থাকতে পারবে না। আগামীকাল আমার নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনী হিমু ও তার মূল সৈন্যদল এর গতিরোধ করবে তারা দিল্লীতে পৌঁছানোর আগেই। আমরা হিমুকে পরাজিত করে আমাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করবো।

বাছা আমার, আবেগসিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন হামিদা, আমি সর্বদাই জানতাম, এমনকি যখন তুমি আমার পেটে ছিলে, যে একদিন তুমি এক মহান যোদ্ধা এবং নেতা হবে। আমার সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হতে যাচ্ছে দেখে আমার হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ। আমি তোমাকে কিছু জিনিস দিতে চাই। তিনি জয়নাবকে ফিসফিস করে কিছু বললেন, সে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলো। যখন ফিরে এলো দেখা গেলো তার হাতে সবুজ মখমলে জড়ানো কিছু রয়েছে যা সে হামিদার পায়ের কাছে শতরঞ্জির উপর রাখলো। হামিদা নিচু হয়ে মখমলের আচ্ছাদন সরিয়ে দিলেন, আকবর দেখলেন সেখানে তাঁর পিতার সোনালী বক্ষবর্ম (ব্রেস্টপ্লেট) এবং ঈগলাকৃতির হাতল বিশিষ্ট তলোয়ার-আলমগীর, যার খাপে নীলা পাথরের অলঙ্করণ রয়েছে।

বর্ম এবং তলোয়ার প্রত্যক্ষ করে আকবরের মনের পর্দায় এতেঠ স্পষ্টভাবে তাঁর পিতার অবয়ব ভেসে উঠলো যে তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন যাতে তার মা তার চোখের অশ্রু দেখতে না পান। হামিদা এবং মাহাম আঙ্গা তাঁর বক্ষে বর্ম পরিয়ে দিলেন। হুমায়ূন লম্বা এবং পেশীবহুল ছিলেন কিন্তু আকবরও ইতোমধ্যে সেই গড়ন লাভ করেছেন। বক্ষবর্মটি তাঁর শরীরে ভালোই মানিয়ে গেলো। এবারে হামিদা তাঁর দিকে আলমগীর এগিয়ে দিলেন। আকবর ধীরে তলোয়ারটি খাপমুক্ত করলেন এবং শূন্যে সেটা কয়েকবার চালালেন। সেটার ওজন এবং ভারসম্য তিনি সন্তুষ্টিবোধ করলেন।

 তোমার প্রস্তুতির জন্য আমি এতোদিন অপেক্ষা করছিলাম, হামিদা বললেন, যেনো তিনি আকবরের মনের কথা বুঝতে পারছেন। এখন তুমি প্রস্তুত। আগামীকাল যখন তুমি রওনা হবে, আমি মাতাসুলভ দুশ্চিন্তা অনুভব করবো ঠিকই কিন্তু সেই সঙ্গে একজন সম্রাজ্ঞীর গর্বও। আল্লাহ্ যেনো তোমার সহায় হোন আমার বাছা।

.

০২. একটি কাটা মাথা

মধ্যাহ্ন শেষে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে দিগন্ত ঝিকমিক করছিলো যখন দাঁড়িয়ে থাকা আকবর বিচলিত মনে এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর দিলেন। দিল্লীর উত্তর-পশ্চিম দিকের এক বৈচিত্রহীন ছোট ছোট পাহাড় বেষ্ঠিত এলাকার সমভূমিতে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন তপ্ত বায়ুমণ্ডলের স্বচ্ছ পর্দা ভেদ করে প্রায় পঞ্চাশ জন সৈন্যের একদল অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে। তাদের আগমন লক্ষ্য করতে করতে তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৈরাম খানকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওদের সম্মুখে ওটা আহমেদ খান তাই না?

আমি নিশ্চিত নই। আপনার তরুণ চোখগুলি আমার থেকে ভালো, কিন্তু ওদের একজন যে পতাকাটি বহন করছে সেটা নিঃসন্দেহে আমাদেরই সবুজ রঙ চিহ্নিত মোগল পতাকা।

অল্পসময় পরেই বোঝা গেলো সেটা আহমেদ খানই, বৈরাম খানের পরামর্শে আকবর তাকে হিমুর অবস্থান ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে অধিক নিশ্চিত হওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে পাঠিয়েছিলেন তিন দিন আগে। প্রায় পনেরো মিনিট পর সে তাঁদের কাছে পৌঁছালো এবং আকবরের সম্মুখে বিনীতভাবে অবনত হলো।

 সোজা হউন, আহমেদ খান, কি সংবাদ এনেছেন বলুন?

 কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা হিমু এবং তার মূল সেনাবহিনীকে খুঁজে পেয়েছি। তারা পানিপথে শিবির স্থাপন করেছে, এখান থেকে মাত্র বার মাইল উত্তর দিকে। পানিপথ নামটি আকবরের পরিচিত এবং এরসঙ্গে তার খানিকটা গৌরবও জড়িয়ে আছে। ত্রিশ বছর আগে তাঁর পিতামহ বাবর দিল্লীর লোদী বংশীয় সুলতান ইব্রাহিমকে এই পানিপথের যুদ্ধেই পরাজিত করে মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। এবার আকবরের পালা পানিপথের আরেকটি যুদ্ধে মোগল বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার। বয়সে তরুণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে বংশীয় ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার জন্য।

 হিমুর বাহিনীতে কতোজন সৈন্য আছে আহমেদ খান? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

 আমরা ধারণা করছি প্রায় একলক্ষ বিশ হাজার, তাঁদের অর্ধেক অশ্বারোহী এবং উত্তম মানের। আর প্রায় পাঁচশত যুদ্ধ-হাতি রয়েছে।

আমরা যা ভেবেছিলাম সেটাই সত্যি হলো, আমাদের তুলনায় তার বিশ হাজার সৈন্য বেশি আছে। তাঁর কামান এবং বন্দুকের সংখ্যা কতো? আমরা যা ভেবে ছিলাম তার তুলনায় কম সংখ্যক কামান আছে ওদের, সর্বমোট ত্রিশটি হতে পারে, সেগুলির বেশিরভাগই ছোট আকারের। দূর থেকে যতোটা বুঝতে পেরেছি তার পদাতিক সৈন্যদের হাতে বন্দুকের পরিবর্তে তীর-ধনুক রয়েছে। তবে অল্পসংখ্যক বন্দুকধারী তার দলে রয়েছে।

 বন্দুকের দিক থেকে আমরা ওদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছি, কি বলেন বৈরাম খান? আকবর তার প্রধান সেনাপতির দিকে ফিরলেন। পানিপথে যুদ্ধ না করার মতো আমাদের তেমন কোনো যুক্তি নেই, আছে কি? সেটি আমাদের সৈন্যদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনা একটি স্থান। সেখানে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে আমাদের যোদ্ধারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস পাবে, আমাদের সৈন্যসংখ্যা যদিও তুলনামূলকভাবে কম।

 বৈরাম খান তাঁর অনুগ্রহভাজন তরুণ সম্রাটের উৎসাহ দেখে মৃদু হাসলেন। জ্বী সম্রাট, সেটি নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধ করার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান। আমরা এই বন্ধ্যা সমভূমির উপর দিয়ে গুপ্ত আক্রমণের আশঙ্কা ছাড়াই দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারবো।

আকবর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই আহমেদ খান বলে উঠলেন, মহামান্য সম্রাট, আপনি পানিপথকে মোগলদের বিজয়ের জন্য সৌভাগ্যজনক বলছেন। সেটা সত্যি-কিন্তু হিমুর জন্য এর কোনো তাৎপর্য নেই। হিমুর শিবিরে ব্যবসা করেছে এমন একজন সওদাগরকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি এবং তার কাছে একটি গল্প শুনেছি। সে দাবি করেছে যে হিমুর একান্ত ব্যক্তিগত এক সেবকের কাছে সে এই গল্পটি শুনেছে। কিন্তু এই গল্পটি হিমুর দলের সকলেই জানে। কারণ পরবর্তীতে আমাদের হাতে বন্দী আরেকজন সৈনিক একই গল্পের পুনরাবৃত্তি করেছে।

গল্পটি কি? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন।

 সেটা হলো বেশ কিছু রাত আগে হিমুর হস্তিদলের একটি বিশাল হাতি বজ্রপাতের আঘাতে মারা যায়। আস্তাবলের অন্য হাতিগুলি সামান্য আহতও হয়নি। পরদিন সকালে হিমু যখন সংবাদটি জানলো তখন সে স্বীকার করলো যে, একই রাতে সে একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সে দেখেছে সে তার হাতির পিঠ থেকে একটি খরস্রোতা নদীতে পড়ে গিয়েছে। সে যখন ডুবে যাচ্ছিলো তখন একজন মোগল যোদ্ধা তাকে টেনে তীরে তুলে। তারপর তাকে শিকল দিয়ে বাঁধে এবং তার গলায় একটি দড়ি পেচিয়ে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। হিমু তার অনুসারীদের কাছে স্বপ্নটি ব্যাখ্যা করে এভাবে-সে বলে তার বংশে এমন ঐতিহ্য রয়েছে যে তারা স্বপ্নে যা দেখে তাদের বাস্তব জীবনে তার বিপরীত ঘটনা ঘটে। অতএব শীঘ্রই সে মোগলদের তাঁদের হাতির উপরের সুরক্ষিত আসন থেকে ভূমিতে ধরাশায়ী করবে এবং আমরা সকলে তার কাছে বন্দীত্ব বরণ করবো। যদিও পরবর্তীতে পরিষ্কার বোঝা গেছে সে ভীষণ চিন্তিত এবং সে তার হিন্দু দেব-দেবীর প্রতি মুক্তহস্তে উৎসর্গ প্রদান করছে।

এটা নিঃসন্দেহে একটি দৈব সংকেত, আকবর ভাবলেন। এসময় বৈরাম খান বলে উঠলেন, এই গুজব যদি সত্যি নাও হয়, এর প্রচার হিমুর শিবিরের যোদ্ধাদের মনোবল কমিয়ে দেবে। এই জন্যই আমি মনে করি এখনই আমাদের পানিপথের দিকে অগ্রসর হওয়া।

*

দুইদিন পরের ঘটনা। ভোর হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রন্ধন কাজের জন্য জ্বালা আগুনের উজ্জ্বল কমলা রঙের শিখায় ভোরের ধূসর আধো-অন্ধকার অপসারিত হচ্ছিলো। আকবরের লোকেরা তড়িঘড়ি করে খাবার খেয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। কিছুটা বিচলিত মনে আঙ্গুলের সাহায্যে তারা তাদের তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করছে এবং বারংবার ঘোড়ার পিঠে বাঁধা জিন যথেষ্ট শক্তভাবে এটে আছে কিনা দেখছে। সেইসঙ্গে বিড়বিড় করে আসন্ন যুদ্ধে সাফল্য লাভের জন্য তাদের স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছে। অন্যদিকে যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ছোট কামানগুলিকে চব্বিশটি ষাঁড়ের সঙ্গে জোতা হয়েছে যাতে সেগুলি সৈন্যদের সঙ্গে একই গতিতে অগ্রসর হতে পারে। অন্যদিকে হস্তী বাহিনীর মাহুতেরা হাতিগুলিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছিলো। সেগুলিকে ইস্পাতের বর্ম পড়ান হচ্ছিলো এবং তাঁদের দাঁতে বাঁকা খঞ্জর বাঁধা হচ্ছিলো। এই সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পরেই তাদের পিঠে হাওদা বসান হবে যার উপর সৈন্যরা অবস্থান নেবে। হেকিমরা তাদের তাবুতে প্রয়োজনীয় মলম এবং ছোট ছোট শিশিতে ব্যাথা উপষমকারী ওপিয়াম ভরে সৈন্যদের জন্য প্রস্তুত রাখছিলো। সেই সঙ্গে মারাত্মক জখমের চিকিৎসার জন্য করাতো এবং ছ্যাকা দেয়ার দণ্ডও গুছাচ্ছিলো।

 আকবরের ভালো ঘুম হয়নি। গৌরব ও বিজয়ের বিক্ষিপ্ত কল্পনা এবং দুঃশ্চিন্তা মিলেমিশে তাঁকে কেবলই সতর্ক করেছে বারবার, যেনো তাকে বলেছে- সাবধান! নিজের এবং তোমার পূর্বপুরুষের অমর্যাদা করোনা। শুধু শুধু শুয়ে না থেকে দুঘন্টা আগেই তিনি উঠে পড়েছেন। এখন তিনি পিতার বক্ষবর্ম এবং তলোয়ারে সুসজ্জিত। মাথায় পড়েছেন ঘাড়ের কাছে ধাতব পাত যুক্ত শিয়োস্ত্রাণ (হেলমেট)। তাঁর পাশে রয়েছেন বৈরাম খান এবং চওড়া কাঁধের অধিকারী তারদি বেগ, তারাও অস্ত্রে সজ্জিত এবং শিরোম্রাণ পরিহিত। আকবর অনেক কষ্টে বৈরাম খানকে রাজি করিয়েছেন তারদি বেগকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দিয়ে আরেকবার তার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দেয়ার জন্য।

দেড়ঘন্টা পর একটি অগ্রবর্তী দলকে অনুসরণ করে আকবর তার দুধ-ভাই আদম খানকে পাশে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁর অবস্থান প্রায় একমাইল চওড়া অগ্রসরমান বাহিনীর মাঝামাঝি স্থানে। তার ঘোড়াটিও যেনো তাদেরই মতো যুদ্ধ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। বৈরাম খান তাদের থেকে অল্প দূরে ঘোড়া ছোটাচ্ছেন। তিনি আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী আশ্বারোহী বাহিনী এবং অগ্রবর্তী দলটি যেনো কোনোক্রমেই ষাঁড়-টানা গোলন্দাজ বাহিনী এবং হস্তী বাহিনীর কাছ থেকে বেশি দূরে সরে না যায়। আর পায়ে হেঁটে অগ্রসরমান তীরন্দাজ বাহিনীকেও তারা যেনো কাছাকাছি রাখে।

 মোঘাচ্ছন্ন আকাশ নিয়ে ভোর হলো, নিচু মেঘগুলি বায়ুতাড়িত হয়ে ছুটে চলেছে। কিন্তু আকবর যখন উপরদিকে তাকালেন তখন মেঘগুলির মাঝে ফাঁক সৃষ্টি হয়ে সূর্য উঁকি দিলো, সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মি তাঁর বর্মের উপর পড়ে ঝলসে উঠলো। নিজের ঊর্ধ্বমুখী মুখের উপর তিনি আচমকা উষ্ণতা অনুভব করলেন, তিনি বৈরাম খানকে লক্ষ্য করে বললেন, এটা আমাদের সৌভাগ্যসূচক আরেকটি দৈব সংকেত, তাই না? এই সংবাদটি আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিন। উদিত সূর্য আজ একমাত্র আমার উপরই আলো ছড়াচ্ছে। আর হিমু কালো মেঘ দ্বারা আচ্ছাদিত। জয় আমাদেরই হবে। পরবর্তীতে আরো বিজয় আমরা অর্জন করবো। আমাদের সাম্রাজ্য চন্দ্রগ্রহণের মতো অন্য সব রাজ্যকে আচ্ছাদিত করবে এবং তার চমৎকারিত্বে সকলের চোখ ঝলসে যাবে।

বৈরাম খান আকবরের বক্তব্যকে সমর্থন জানাতে যখন তার দিকে ফিরলেন, সেই মুহূর্তে আকবর তার বাবার তলোয়ারটি কোষমুক্ত করে মাথার উপর ঘুরালেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢুলিদের যুদ্ধ-ঢাকের আওয়াজ জোরাল হলো এবং শিঙ্গার আর্তনাদে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। জয় আমাদেরই হবে, আকবরের এই চিৎকার তার সমান্তরাল সকল যোদ্ধার মুখে উচ্চ স্বরে প্রতিধ্বনিত হলো।

কিন্তু সম্মুখ থেকে এর উত্তর ভেসে এলো, হিমুর যোদ্ধাদের সাহসী চিৎকার। হিমু, হিমু, হিমুপাদীশাহ! রেকাবে (ঘোড়ার পাদানী) ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আকবর দেখলেন তার সৈন্যদলের বাহিত সবুজ পতাকা ছাড়িয়ে প্রায় একমাইল দূরত্বে হিমুর হাতিগুলির বর্ম সূর্যের আলোয় ঝলসে উঠছে। তিনি হিমুর কৌশল বুঝতে পারলেন। হিমু তার যোদ্ধাদের আশেপাশের ছোট ছোট পাহাড় গুলিতে স্থাপন করেছে, বহু বছর আগে আকবরের পিতামহ বাবর একই কৌশলে তাঁর মহান বিজয় অর্জন করেছিলেন। আকবরের মতো হিমুও সম্মুখ আক্রমণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।

 আকবর বিস্ফোরণ উনুখ আগ্নেয়গিরির মতো উত্তেজনা অনুভব করলেন। তিনি তাঁর উঁচু কালো ঘোড়াটির পেটে লাথি মেরে সম্মুখে অবস্থিত যোদ্ধাদের মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে এগিয়ে গেলেন, আদম খান এবং তার ঘাবড়ে যাওয়া দেহরক্ষীরা প্রাণপণে তাঁকে অনুসরণ করলো।

সম্রাট, আমাদের ডান-পার্শ্বস্থ যোদ্ধারা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে, এক সেনাকর্তা আধঘন্টা পর আকবরের কাছে এগিয়ে এসে বললো। তার মুখমণ্ডল ধূলা আর ঘামে মাখামাখি হয়ে গেছে এবং তার শিরোস্ত্রাণটি খোয়া গেছে। তার সাদা ঘোড়াটি জোড়ালো শ্বাস ফেলছিলো এবং সেটার পশ্চাদদেশে(পাছা) তলোয়ারের আঘাত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। বৈরাম খান ইতোমধ্যে সম্মুখ সেনাদের অতিক্রম করা আকবরের উন্মত্ত গতি প্রতিরোধ করেছেন, এখন তিনি ও আদম খান তার পাশাপাশি আগাচ্ছেন। তারা তিনজন ছোট আকারের একডজন ব্রোঞ্জের কামানের বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করছে। কামানগুলি দাগার প্রস্তুতি চলছে। যেখানে সংঘর্ষ চলছে তার থেকে প্রায় একশ গজ পেছনে রয়েছেন তারা।

কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে আকবরের সম্মুখে বৈরাম খান সেনা কর্তাটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তারদি বেগের ভূমিকা কি আশাব্যঞ্জক?

অবশ্যই জনাব, কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে সে জবাব দিলো। যুদ্ধের কেন্দ্রস্থলে তার পতাকা এখনো সমুন্নত। তারদি বেগ হিমুর সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ হাতিগুলির সামনে পড়ে গেছেন। সেগুলি তারদি বেগের যোদ্ধাদের প্রায় পিষ্ট করে ঢুকে গেছে। আমাদের বন্দুকধারীদের ছোঁড়া গুলি হাতিগুলির ইস্পাতের মস্তক-আবরণ ভেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। হাতিবাহিনীর আক্রমণকে অনুসরণ করে হিমুর পদাতিক সৈন্যরাও আক্রমণ করেছে। তাঁদের অনেকে পুরানো লোদী বংশীয় পতাকা বহন করছে। সর্বশেষ আমি দেখি তারদি বেগ প্রবল প্রতাপে শত্ৰু যোদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে গেছেন। কিন্তু ডান দিকে অবস্থিত আমাদের অশ্বারোহী সেনারা পিছু হটছে, কেউ কেউ তাদের সহযোদ্ধাদের ত্যাগ করে অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছে। যারা প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে তাদেরকে ঘিরে ফেলে হত্যা করছে শত্রুরা।

 উদ্বিগ্ন আকবর পুনরায় রেকাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ডান-পার্শ্বস্থ সেনাদের দিকে তাকালেন। তার পদাতিক বাহিনী সত্যিই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ছে। বৈরাম খান, আমাদের এক্ষুনি কিছু করা উচিত। আমি কি অতিরিক্ত সেনা নিয়ে ওদের সাহায্যে এগিয়ে যাবো?

না। এতে আরো বেশি প্রাণহানি হবে-আপনিও মারা যেতে পারেন কিন্তু তেমন কোনো ফল পাওয়া যাবে না। হিমুর সেনাদের আমাদের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসতে হবে, যেখানে আমরা এখনো অনেক শক্তিশালী। তারপর বাম দিক থেকে আমরা সেনা সমাগম বাড়াতে পারি।

এই কামান গুলির মাঝে আমরা কি যথেষ্ট শক্তিশালী? আকবর প্রশ্ন করলেন।

নিশ্চয়ই সম্রাট। আমি সেনাকর্তাদের নির্দেশ দিচ্ছি তারা যাতে পদাতিক তীরন্দাজদের কামানের বেষ্টনীর মধ্যে জড়ো করে। বৈরাম খান তার পার্শ্ববর্তী এক সেনা কর্তাকে হুকুম করলেন, মালবাহী গাড়িগুলিকে কামানগুলির ফাঁকে ফাঁকে জড়ো করে ফেলো সেগুলিকে আড়াল করার জন্য। অগ্রবর্তী সৈন্যদের আমাদের এখানে পিছিয়ে আসতে বলো এবং বাম দিকে যুদ্ধরত সৈনিকদের মধ্যে যারা অতিরিক্ত রয়েছে তাদেরও আসতে বলো।

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আকবর তখন মরিয়া হয়ে চিন্তা করছেন, তার মাথায় একটি চিন্তা এলো। বৈরাম খান, ডান পাশের যোদ্ধাদের মধ্যে যারা রক্ষা পেয়েছে তাদেরকেও আদেশ করা যায় আমাদের দিকে পালিয়ে আসতে-তারা যখন আতঙ্কিতভাবে পালানোর ভান করবে হিমু তাদেরকে অধিক উৎসাহে অনুসরণ করে আমাদের পাল্টা আক্রমণের আওতায় চলে আসতে পারে।

বৈরাম খান একটু ভেবে সম্মতি জানালেন। আপনি যুদ্ধ-শিক্ষা ভালোই আয়ত্ত করেছেন। হিমুর সেনাদের প্রচণ্ড শক্তিতে আক্রমণ করার জন্য এখনো আমাদের হাতে অব্যবহৃত অশ্বারোহী এবং হস্তীবাহিনী রয়েছে। আদম খান, একডজন সৈন্য নিয়ে এগিয়ে যাও এবং ডান পাশের সেনাকর্তাদের মধ্যে যাকেই পাও বলে তারা যেনো আতঙ্কের ভান করে আমাদের দিকে পিছিয়ে আসে।

আদম খান একদল অশ্বারোহী নিয়ে ঘোড়া ছোটালো এবং বিশৃঙ্খল যুদ্ধ ক্ষেত্রের মাঝে হারিয়ে গেলো।

দশ মিনিট পরের ঘটনা। আকবর তখনো কামান ঘেরা বৃত্তের মাঝখানে তাঁর কালো ঘোড়াটির পিঠে বসে আছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তাঁর দলের কিছু অশ্বারোহী তাঁর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসছে। তাদের শীর্ষে রয়েছে আদম খান। যেনো ভীষণ আতঙ্কিত, সে তার হাতে থাকা সবুজ রঙের মোগল পতাকাটি ছুঁড়ে ফেললো এবং ঘোড়ার ঘাড়ের কাছে উবু হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সেটাকে ছোটাল। তাকে অনুসরণকারী অশ্বারোহীরাও তীব্র বেগে এগিয়ে আসছে। এসময় তিনি কয়েকটি বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেন এবং দেখলেন কয়েকজন অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো। কিন্তু আদম খানের কিছু হলো না দেখে তিনি আস্বস্ত হলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রের ধূলা এবং বন্দুকের ধোঁয়ার আস্তরণের উপর দিয়ে তিনি হিমুর কয়েকটি যুদ্ধ-হাতির হওদাকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। তারা আকবরের আপাতদৃষ্টিতে পলায়নরত যযাদ্ধাদের বিপুল উৎসাহে তাড়া করে আসছে।

 প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীকে গোলা ছুঁড়তে বলল, আকবল বৈরাম খানের হুকুম শুনতে পেলেন। বন্দুকধারীরা, শত্রু পক্ষের হাতিগুলির মাহুতদের লক্ষ্য করে গুলি চালাও। আর তীরন্দাজেরা, সকলে একত্রে তীর ছোঁড়ার জন্য আমার হুকুমের অপেক্ষায় থাকো।

শত্রুদের দিকে তাক করা প্রতিটি কামানে অগ্নিসংযোগ করা হলো। পরপর ছয়টি প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেলো, সেই শব্দে আকবর প্রায় কালা হয়ে গেলেন এবং বারুদের ঝাঝালো গন্ধে তার প্রায় দম আটকে এলো, ধোঁয়ার কারণে স্পষ্টভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ধোয়া খানিকটা সরে গেলে তিনি দেখলেন, হিমুর পাঁচটি হাতিকে কামানের গোলা আঘাত করেছে। প্রথম হাতিটি করুণভাবে ড় তুলে আর্তনাদ করছে এবং তিন পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। সেটার চতুর্থ পাটি হাঁটুর নিচে রক্তাক্ত একটি খুঁটিতে পরিণত হয়েছে। বাকি তিনটি হাতি মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে আছে। তাঁদের মধ্যে একটি হঠাৎ মৃত্যুযন্ত্রণায় সেটার পিঠে থাকা হাওদার সৈন্যসহ গড়ান দেয়ায় সেনারা সেটার দেহের নিচে পিষ্ট হয়ে গেলো।

পঞ্চম হাতিটির পেটে সৃষ্টি হওয়া গভীর ক্ষত দিয়ে সেটার নীলচে-ধূসর বর্ণের নাড়িভুড়ি প্রায় বেরিয়ে এসেছে। আকবর দেখলেন সেটার হাওদাটি প্রায় মাটি ছুঁয়েছে, একজন সৈন্য মাটিতে পড়ে গেলো, কিন্তু কিছু অক্ষত তীরন্দাজ তখনো সেটার মধ্যে রয়ে গেছে। হাতিটি পালাচ্ছে এবং সৈন্যসহ হাওদাটি সেটার পেছনে মাটিতে ছেচড়ে যাচ্ছে। আতঙ্কিত হাতিটি আক্রমণ করতে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসতে থাকা অন্য হাতিগুলির সামনে পড়ে গেলো। একটি বিশাল হাতির সঙ্গে আহত হাতিটির প্রচন্ড সংঘর্ষ হলো এবং আহত হাতিটি সেটার দাঁতে আটকানো খঞ্জরের ফলায় বিদ্ধ হলো এবং তারা উভয়েই মাটিতে আছড়ে পড়লো। এগিয়ে আসা আরেকটি হাতি আহত হাতিটির ছেচড়ে নেয়া হওদার উপর হোঁচট খেয়ে ভূপাতিত হলো, ফলে সেটার হাওদায় থাকা সৈন্যরা ছাতু হয়ে গেলো। হিমুর হাতিগুলির আক্রমণের গতি শ্লথ হয়ে এলো, তারা তাদের ভূপাতিত স্বজাতীয়দের এড়িয়ে যেতে সচেষ্ট হলো।

 তীর চালাও! যুদ্ধক্ষেত্রের গোলযোগ ছাড়িয়ে বৈরাম খানের আদেশ শোনা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে হিমুর বাহিনীর উপর বৃষ্টির মতো তীর বর্ষিত হতে লাগলো। আকবর দেখলেন হওদার উপর থেকে শত্রুবাহিনীর বহু সৈন্য হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে। একটি হাতি সেটার চোখের ঠিক নিচের অরক্ষিত অংশে তীর বিদ্ধ হয়ে সেটার পাশে থাকা আরেকটি হাতির দিকে হেলে পড়ে সেটার পথরোধ করে দিলো। তখনই দ্বিতীয়বার কামান দাগার ফলে চারদিক অবার ধোঁয়ায় অস্পষ্ট হয়ে উঠলো এবং বিস্ফোরণের শব্দে আকবর কয়েক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ কালা হয়ে গেলেন। তিনি আদেশ দিতে থাকা বৈরাম খানের মুখ নড়তে দেখলেন কিন্তু কিছুই শুনতে পেলেন না। ধোঁয়া সরে গেলে তিনি বুঝতে পালেন বৈরাম খান কি আদেশ দিচ্ছিলেন। তার তীরন্দাজেরা শেষবারের মতো একযোগে তীর নিক্ষেপ করলো এবং আকবরের যুদ্ধহাতি ও আশ্বারোহী সৈন্যরা হিমুর বিশৃঙ্খল সেনাদের দিকে প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করতে ছুটে গেলো। তাঁর হাতিগুলির পিঠে থাকা সবুজ পাগড়ি পড়া বন্দুকধারীরা গুলি ছুড়ছে। হিমুর হাতির পিঠে থাকা এক মাহুত গুলি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। সে মুচড়ে হামাগুড়ি দিয়ে আগানোর চেষ্টা করলো একবার, তারপর স্থির হয়ে গেলো।

আরেকদিকে আকবর দেখলেন একজন মোগল অশ্বারোহী কেবল একটি বর্শা নিয়ে অসীম সাহসে হিমুর একটি বিশাল যুদ্ধ-হাতিকে আক্রমণ করলো। একহাতে লাগাম ধরে থেকে অন্যহাতে সে বর্শাটি হাতিটির চোয়ালের মাঝখানে ঢুকিয়ে দিলো। হাতিটির মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো এবং সেটি ঘুরে পেছন দিকে দৌড় দিলো।

আকবর এই মুহূর্তে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উত্তেজনায় ফেটে পড়ছেন এবং আদম খান এর বীরত্বপূর্ণ লড়াইকে অতিক্রম করে যুদ্ধে নিজের ভূমিকা রাখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন। তিনি তার অবস্থান থেকে অল্প দূরে আদম খানের রণনৈপুণ্য দেখতে পাচ্ছিলেন। বৈরাম খান, আমরা কি এখন লড়াইএ প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে পারি না?

না, আপনি আপনার ধৈর্য বজায় রাখুন। একজন ভালো সেনাপতি অথবা একজন কৌশলী সম্রাটকে বুঝতে হবে কোনো মুহূর্তটি তার আক্রমণ করার জন্য আদর্শ। এই মুহূর্তে পেছনে থেকে আমাদের আক্রমণের ফলাফল বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তলোয়ারের পাশাপাশি উত্তম বুদ্ধি এবং কৌশলও যুদ্ধ জয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেখুন হিমুর বাহিনী কেমন বিভ্রান্ত, তাদের আক্রমণ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।

 আমরা এই সুযোগ কীভাবে কাজে লাগাতে পারি এবং হিমুর বাহিনীকে ধ্বংস করে পারি? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর মন আক্রমণে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া অন্যকোনো পরামর্শ মানতে চাইছে না।

এখন আমাদের বামপার্শ্বের সৈন্যদের সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দিতে পারি, তারা যেনো শত্রুদের ঘিরে ফেলতে পারে। যেহেতু তারা এখনো যুদ্ধে পুরোপুরি অংশ নেয়ার সুযোগ পায়নি ফলে তারা অধিক সতেজ এবং উৎসাহী হয়ে আছে। এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারলে ওদের সহায়তায় নিশ্চিতভাবেই আমরা বিজয়ী হবো যখন কিছু সময় আগে আমরা পরাজয়বরণ করতে যাচ্ছিলাম। যুদ্ধে এমনটাই ঘটে।

 আকবরের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে বৈরাম খান হুকুম দিলেন। নির্দেশ পেয়ে তাঁদের অশ্বারোহী সেনারা হস্তীবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে শত্রুদের ঘিরে ফেলতে এগিয়ে গেলো। ইতোমধ্যে হিমুর একদল অশ্বারোহী সেনা পালানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। তাঁদের কেউ কেউ থেমে তাঁদের দলের মাটিতে পড়ে থাকা আহত যোদ্ধাদের তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে। আকবর দেখলেন হিমুর প্রায় বিশটি হাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাদলও পালায়ন শুরু করেছে। তাঁদের বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজেরা পেছন থেকে তখনো গুলি এবং তীর ছুড়ছে। কেউ কেউ অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করছে।

সেই সময় প্রায় আধ মাইল দূরে হিমুর সৈন্য দলের প্রায় একহাজার অশ্বারোহী সৈন্যকে কিছু ভূ-লুষ্ঠিত হাতিকে ঘিরে সাহসের সঙ্গে লড়াই করতে দেখা গেলো। হাতিগুলির মৃতদেহকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছিলো এবং মোগল বাহিনীকে পিছু হটানোর চেষ্টা করছিলো। আকবর অনুভব করলেন এখনো তার বিজয় অর্জিত হয়নি।

বৈরাম খান কিছু বলতে পারার আগেই আকবর তার ঘোড়ার পেটে লাথি মেরে সেই দিকে তীব্র বেগে ধাবিত হলেন। তিনি যখন সেই স্থানের কাছাকাছি পৌঁছালেন তার দেহরক্ষীরাও তাকে অনুসরণ করে সেখানে উপস্থিত হলো। হিমুর কিছু যোদ্ধা আকবরকে চিনতে পারলো। কমলা পাগড়িধারী এক সেনাকর্তার নেতৃত্বে তারা মৃত হাতিগুলির আড়াল থেকে বের হয়ে আকবরকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো।

আকবর দিক পরিবর্তন না করে তাদের দিকেই ঘোড়া ছোটালেন, তার রক্তে তখন লড়াই এর উন্মাদনা। মোগলদের ছোঁড়া গুলিতে শত্রু পক্ষের কয়েকজন ধরাশায়ী হলো কিন্তু সেনাকর্তাটি অক্ষত অবস্থায় এগিয়ে এলো। এই মুহূর্তে আকবর তার দেহরক্ষীদের কাছ থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে চলে গেছেন। তিনি তার তলোয়ারটি সম্মুখে প্রসারিত করে সেনাকর্তাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। যোদ্ধাটি হঠাৎ একপাশে সরে গিয়ে আকবরকে লক্ষ্য করে তার তালোয়ার চালালো, আকবর তখন অনেকটা অরক্ষিত। তার তলোয়ারের ফলা আকবরের শিরোস্ত্রাণ (হেলমেট) ছুঁয়ে ঘুরে যাওয়ার সময় সেটায় যুক্ত ময়ূরের পলকটি দ্বিখণ্ডিত করলো। তারা উভয়ে তীক্ষ্ম বাঁক নিয়ে আবার পরস্পরের দিকে ছুটে এলো। এইবার যোদ্ধাটির চালানো তলোয়ার আকবরের বক্ষ-বর্মের উপর আচড় কেটে বেরিয়ে গেলো এবং এই আঘাতে তিনি একপাশে কাত হয়ে গেলেন। তার একটি রেকাব (পাদানী) ছুটে গেলো এবং কোনোক্রমে তিনি ঘোড়ার পিঠ আকড়ে থাকলেন। হিমুর সেনাকর্তাটি আবার আক্রমণ করার জন্য তার ঘোড়াটি ঘুরিয়ে নিলো। তার আঘাত ফলপ্রসূ হচ্ছে এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে দ্রুত লড়াইটার ইতি টানার জন্য তড়িৎ বেগে সে আকবরের দিকে ছুটে এলো এবং তার মস্তক বিচ্ছিন্ন করার জন্য গলা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালো।

আকবর তার পরিকল্পনা অনুমান করতে পারলেন, তিনি শেষ মুহূর্তে একপাশে সরে গেলেন কিন্তু সেনাকর্তাটির তলোয়ারের অগ্রভাগ তার গলার কণ্ঠমণির (এ্যাডামস এ্যাপেল) ঠিক উপরে আঁচর কেটে ঘুরে গেলো। কিন্তু আকবর সেটা খেয়াল করলেন না। তিনি তাঁর তলোয়ারটি সেনাকর্তাটির ডান বগল বরাবর গভীরে ঢুকিয়ে আবার বের করে নিলেন, আকবরের গলা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালানোর সময় শত্রুর ঐস্থানটি অরক্ষিত হয়ে পড়েছিলো। যোদ্ধাটি তার ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে রইলো, তার বাহুসন্ধি থেকে পাথুরে মাটির উপর কালচে লাল রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিলো। দরদর করে ঘামতে থাকা আকবর বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন। নিজ প্রাণ রক্ষা করতে পেরে তিনি অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করলেন এবং নিজের চারদিকে নজর বোলালেন। দেখলেন তাঁর দেহরক্ষীরা সেনাকর্তাটির অন্য সঙ্গীদের হত্যা করেছে। অল্প দূরে হিমুর কিছু সৈন্য তাঁদের ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, বাকিরা আত্মসমর্পণ করছে।

আকবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং কমলা পাগড়ী পড়া সেনাকর্তাটির দিকে ছুটে গেলেন। সে তখনো বেঁচে ছিলো। তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একহাতে তিনি তার মাথাটি তুললেন। তুমি খুব ভালো লড়েছ আকবর তাকে বললেন।

আমি আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। আমি আপনার উপর আমার প্রভু হিমুর পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, সেনাকর্তাটি উত্তর দিলো। সে খুব কষ্ট করে কথা বলছে।

হিমুর পক্ষ থেকে আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে? তুমি কি বোঝাতে চাইছো?

আহত লোকটি ঘরঘর শব্দ করে শ্বাস নিলো এবং কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু প্রথমে তার মুখ দিয়ে কথা নয়, রক্ত বেরিয়ে এলো। অবশেষে সে বলতে পারল, আমরা আপনার ডান-পার্শ্বস্থ সৈন্যদলকে ছত্রভঙ্গ করার ঠিক পরপরই আপনার সেনাদের ছোঁড়া একটি তীর আমার প্রভুর চোখে ঢুকে তাকে আহত করে। তিনি এখান থেকে সামান্য দূরে আমার সমমর্যাদার কিছু ব্যক্তিগত রক্ষীর তত্ত্বাবধানে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। লোকটির মুখে আবার রক্ত উঠে এলো এবং তার মাথাটি একদিকে নেতিয়ে পড়লো। স্পষ্ট বোঝা গেলো সে মারা গেছে। আকবর তাকে যত্নের সাথে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। ইতোমধ্যে তার রক্ষীরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। তিনি তাঁদের বললেন, এই লোকটির ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করো। যদিও প্রভু নির্বাচনে সে ভুল করেছে, সে একজন উত্তম যোদ্ধা ছিলো।

আকবর বুঝতে পারলেন তিনি বিজয়ী হয়েছেন, তার ধূলিমাখা মুখে চওড়া আকৃতির হাসি ফুটে উঠলো। তিনি তাঁর প্রথম পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। তার ভবিষ্যৎ-মহান সম্রাটের ভবিষ্যৎ-নিশ্চিতভাবেই উজ্জ্বল। তার পরবর্তী অভিযানগুলি হবে সাম্রাজ্য বিস্তারের লড়াই। আকবর বৈরাম খানকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন কিন্তু কাছে আসার পর লক্ষ্য করলেন তার চেহারায় বিজয়ের উচ্ছ্বাস অনুপস্থিত।

 আকবর, কেনো আপনি লড়াই এ যোগ দিলেন যখন আমি আপনাকে পেছনে থেকে যুদ্ধে নির্দেশনা প্রদানের পরামর্শ দিলাম? বৈরাম খান কোনো আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন ছাড়াই শুষ্ক কণ্ঠে বললেন।

 আকবরের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠলো, তিনি তীব্র ক্রোধ অনুভব করলেন। তিনি একজন সম্রাট। যদিও বৈরাম খান তার অভিভাবক এবং প্রধান সেনাপতি, কিন্তু তিনি তার সঙ্গে এভাবে কথা বলার স্পর্ধা কোথায় পেলেন? এভাবে তার বিজয়ের মুহূর্তটিকে মাটি করে দিলেন। এটাতো সম্রাট হিসেবে তার প্রথম যুদ্ধ! তার পিতামহ বাবর তাঁর মতো বয়সেই নিজ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারপর, তিনি উপলব্ধি করলেন বৈরাম খানের কাছে তিনি কতোটা ঋণী। তিনি তার ক্রোধ সংবরণ করে শান্ত গলায় বললেন, আপনি কি এমন একজন ব্যক্তিকে সম্রাট হিসেবে গ্রহণ করবেন, যে যুদ্ধ ক্ষেত্রের ভয়াবহতার মাঝে টগবগে রক্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিবর্তে কাপুরুষের মতো শীতলতা অনুভব করবে?

এবার বৈরাম খানের মুখমণ্ডল থেকে কঠোরতা সরে গিয়ে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠলো। না সম্রাট, অবশ্যই না।

 ঐ সেনা কর্মকর্তাটি মৃত্যুর আগে আমাকে জানিয়েছে মৃত হাতিগুলির আড়ালে কোথাও আহত হিমু পড়ে আছে। চলুন আমরা অনুসন্ধান করে দেখি।

 উন্মুক্ত তলোয়ারধারী দেহরক্ষীদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থান নিয়ে আকবর এবং বৈরাম খান মাটিতে পড়ে থাকা মৃত হাতিগুলির দিকে হেঁটে গেলেন। কামানের গোলার আঘাতে যে হাতিগুলির নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসেছিলো সেগুলি থেকে তখন উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আকবর এবং বৈরাম খান একটি হাতিকে অতিক্রম করার সময় হঠাৎ সেটি যন্ত্রণায় মাথা ঘুরালো এবং ঔড় দিয়ে মাটিতে আঘাত করলো। নিজের অজান্তেই আকবর তলোয়ারের দিকে হাত বাড়ালেন কিন্তু দেখলেন ঘাড়ের উপর বিশাল ক্ষত নিয়ে প্রাণীটি মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

 হাতিটাকে তার মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রেহাই দাও, তিনি একজন দেহরক্ষীকে আদেশ দিলেন। এবং আহত অন্যান্য হাতিগুলির একই ব্যবস্থা করো। এই আদেশ প্রদানের সময় আকবর লক্ষ্য করলেন সামান্য দূরে বিধ্বস্ত একটি কারুকার্য খচিত হাওদার পাশে একজন তরুণ যোদ্ধা মাটিতে শুয়ে থাকা ছোটখাট আকৃতির একজন ব্যক্তির দিকে ঝুঁকে আছে। মাটিতে শুয়ে থাকা ব্যক্তিটির মিনা করা নক্শা শোভিত বর্ম দেখে বোঝা গেলো সে হিমু ছাড়া আর কেউ নয়। তরুণটি একটি রক্তাক্ত কাপড় দিয়ে তার মুখের বাম পাশটা মুছে দিচ্ছে আর লোকটি তাকে চিৎকার করে বলছে, আমাকে এখানেই মরতে দাও। কিছুদিন পর কোনো মোগল কয়েদখানায় মৃত্যুবরণ করার চেয়ে এই যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করাই আমার জন্য সম্মানজনক হবে।

তরুণটিকে বন্দী করো, বৈরাম খান আদেশ দিলেন। সাথে সাথে দুজন লম্বা দেহের দেহরক্ষী তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলো এবং দুদিক থেকে তরুণটির বাহু জাপটে ধরে তাকে আহত লোকটার কাছ থেকে সরিয়ে আনলো। এইবার আকবর আহত লোকটিকে পরিষ্কার দেখতে পেলেন। যেখানে তার বাম চোখটি ছিলো সেখানে একটি তীরের অগ্রভাগ বিধে আছে এবং তীরটির বাকি অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তার মুখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে নিশ্চয়ই অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করছে, কিন্তু মনে হলো তার যন্ত্রণা উধাও হয়েছে যখন আকবর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি হিমু?

 নিশ্চয়ই। আর কে হতে পারে?

তোমার ন্যায়সঙ্গত সম্রাটকে তোমার কি বলার আছে?

আমি বলতে চাই আমার কোনো ন্যায়সঙ্গত সম্রাট নেই এবং আমি তোমাকে ঘৃণা করি মোগল অনুপ্রবেশকারী। হিমু আকবরকে লক্ষ্য করে একপ্রস্থ রক্তাক্ত থুথু ছুঁড়ে দিলো কিন্তু তা আকবরের কাছে পৌঁছালো না।

 এখনই তাকে হত্যা করুন, সম্রাট, বৈরাম খান বললেন।

আকবর তার তলোয়ার উঠালেন কিন্তু কোনো কারণে তিনি আহত লোকটাকে আঘাত করতে ইতস্তত করলেন। এটা ঠিক হবে না বৈরাম খান। আমার বাবা আমাকে সর্বদাই বলতেন হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার তুলনায় ক্ষমাই একজন সম্রাটের জন্য বেশি মর্যাদাকর…

একথা শুনে হিমু অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো এবং আকবরের দিকে এগিয়ে এলো। কিন্তু আকবরের দুজন রক্ষী সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে ফেললো। কিন্তু নিজের ক্ষুদ্র খ্যাতি ও মারাত্মক জখম যেনো তাকে হঠাৎ ভীষণ বল প্রদান করলো, হিমু প্রচণ্ডভাবে মোচড় খেয়ে এক মুহূর্তের জন্য রক্ষীদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো। টলমল পায়ে আকবরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে চিৎকার করে বললো, তোমরা আমাদের ভূ-খণ্ডকে কলুষিত কত ছো। তুমি স্বৈরাচারী তৈমুরের বংশধর, তুমি নিশ্চিতভাবে জানো না কে তোমার বাবা। আমি শুনেছি তোমার বাবা তোমার মাকে তার সেনাপতিদের ভোগে ব্যবহার করতে বেশ্যার মতো, যাতে তারা তার প্রতি অনুগত থাকে এবং তোমার মা- উট-মুখো বেশ্যা, সেটা উপভোগও…

হিমু আর কিছু বলতে পারলো না। তলোয়ারের এক কোপে আকবর তার ধড় থেকে মস্তক আলাদা করে দিলেন। ক্রোধে তার সর্বাঙ্গ থরথর করে। কাঁপছে, তার মুখ হিমুর ছিটকে আসা উষ্ণ রক্তে রঞ্জিত। কয়েক মুহূর্ত তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না, কিন্তু তারপর তিনি তলোয়ার কোষবদ্ধ করে মুখের রক্ত মুছলেন এবং বৈরাম খানের দিকে ফিরলেন। শান্ত গলায় বললেন, আপনার কথাই ঠিক। অযোগ্য ব্যক্তিকে আমাদের ক্ষমা প্রদর্শন করা উচিত নয়। ঐ নোংরা প্রাণীটির দেহটাকে শিবিরে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করুন। আর ওর মাথাটা দিল্লীতে পাঠান, কোনো জনসমাবেশে সেটা ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দিন। অন্যান্য প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহীদের জন্য সেটা একটা ভয়াবহ নিদর্শন হয়ে থাকুক।

 আকবর বৈরাম খানকে নিয়ে শিবিরে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরলেন, এসময় আদম খান তাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। তার বাম হাতের আঙ্গুলে পট্টি বাঁধা। তুমি খুব ভালো লড়েছো দুধ-ভাই। আমি তোমার রণনৈপুণ্য দেখেছি।

 শুনলাম তুমিও রক্তের স্বাদ লাভ করেছো, হিমুর দেহরক্ষী প্রধানকে হত্যা করে। কিন্তু একটি দুঃসংবাদ আছে। তারদি বেগ নিহত হয়েছেন।

 কি?…কীভাবে উনি মারা গেলেন?

যখন তুমি আমাকে নির্দেশ দিলে তার সৈন্যদের অতঙ্কে পালানোর অভিনয় করিয়ে তোমার দিকে নিয়ে আসার তখন আমি এবং আমার সঙ্গীরা লড়াই করতে করতে তারদি বেগের অবস্থানে পৌঁছাই। আমরা দূর থেকে দেখতে পাই কয়েক জন ছাড়া তার অধিকাংশ দেহরক্ষীই মাটিতে লুটিয়ে আছে, আহত অথবা নিহত। সে নিজে ঘোড়া হারিয়ে ভূমিতে অবস্থান করছে এবং তাকে ঘিরে থাকা হিমুর যোদ্ধাদের সঙ্গে প্রাণপণে লড়াই করছে। আমরা যখন তাকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে যাই শুনতে পাই শত্রু যোদ্ধারা তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলছে। কিন্তু সে চিৎকার করে বললো, না! আমি একজন মর্যাদাবান মানুষ, আমার সাম্রাজের প্রতি বিশ্বস্ত। আমি দেখলাম শেষ বারের মতো তিনি তার শত্রুদের দিকে ছুটে গেলেন এবং একজন শত্রু একটি বর্শা তার পেটে ঢুকিয়ে দিলো। আরেকজন হিমুর যোদ্ধা তার মাথা টেনে ধরে পশুর মতো তাকে জবাই করলো।

 তুমি বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছ, তারদি বেগ, আমার ভাই, আমার তুগান। আজ রাতেই যেনো তোমার আত্মা জান্নাত লাভ করে এই কামনা করছি, বৈরাম খান বিড়বিড় করে বললেন। তোমাকে সন্দেহ করার জন্য আমি দুঃখিত।

দীর্ঘ বিরতির পর আকবর বৈরাম খানের সঙ্গে কথা বললেন। তারদি বেগকে শাস্তি বা মৃত্যুদন্ড প্রদান না করাটাই আমাদের জন্য উত্তম সিদ্ধান্ত ছিলো, তাই না? হিমুকে ক্ষমা প্রদর্শন করা ভুল ছিলো কিন্তু তারদি বেগকে মার্জনা করে আমরা তাকে তার হারানো সম্মান পুনরুদ্ধারের সুযোগ দিতে পেরেছি। আমার পিতা সঠিক ছিলেন, কি বলেন? ক্ষমা এবং নিষ্ঠুরতা উভয়ই একজন মহান শাসকের জন্য উপযুক্ত।

 জ্বী সম্রাট, বৈরাম খান বললেন এবং আকবর দেখলেন তার প্রধান সেনাপতির গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

.

০৩. বয়সের পূর্ণতা

লাহোরের দুর্গপ্রাসাদের মার্বেল পাথরের মঞ্চ থেকে আকবর নিচের দিকে তাকালেন। তিনি উঁচু পৃষ্ঠদেশ বিশিষ্ট সোনার সিংহাসনে বসে ছিলেন। বৈরাম খানের পরামর্শে হিমুর কোষাগারে সঞ্চিত স্বর্ণমুদ্রা গলিয়ে সিংহাসনটি নির্মাণ করা হয়েছে। গত ছয়মাস ধরে হিন্দুস্তানের যেখানেই। তিনি অবস্থান করেছেন সেখানেই সিংহাসনটি বয়ে নেয়া হয়েছে। প্রথম যুদ্ধ জয়ের পর প্রজাদের সম্মুখে নিজেকে উপস্থাপন করার বুদ্ধিটি তার নিজেরই, কিন্তু বৈরাম খানের পরামর্শে এই মোগল শক্তি প্রদর্শনের উদ্যোগ আরো চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে।

এই সফর আকবরের মনোবাসনা পূরণ করতে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। প্রিয় কালো স্ট্যালিয়ন ঘোড়াটির সোনা মোড়ান জিনে বসে লাগাম ধরে, পিতার ঝলমলে বক্ষ-বর্ম এবং তলোয়ার নিয়ে নিজ সাম্রাজ্য প্রদক্ষিণ করার সময় তাঁর নিজেকে ভীষণ শক্তিশালী এবং গর্বিত মনে হয়েছে। তাঁর পাশে ছিলেন বৈরাম খান এবং পেছন থেকে তাঁদের অনুসরণ করছিলো সেইসব সেনাপতি যারা হিমুর বিরুদ্ধে তাঁর অভিযানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তাদের মাঝে তাঁর দুধভাই আদম খানও ছিলো। এই দলের পিছনে রণ তূর্য এবং ঢাক বাজিয়ে এগিয়ে আসছিলো তার অশ্বারোহী সৈন্যরা। তাঁদের হাতে ছিলো সবুজ পতাকা এবং ইস্পাতের ফলা যুক্ত উঁচিয়ে ধরা বর্শা। অশ্বারোহী বাহিনীকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসছিলো তীরন্দাজ বাহিনী, বন্দুকধারী সৈন্য এবং গোলন্দাজ বাহিনী। তাঁদের কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ে আর বাকিরা পায়ে হেঁটে।

 তীরন্দাজ, বন্দুকধারী এবং অশ্বারোহীদের পেছনে এগিয়ে আসছিলো বড় বড় টানা গাড়ি। সেগুলিতে ঠাসা ছিলো হিমুর শিবির থেকে বাজেয়াপ্ত করা মুদ্রা, অলঙ্কারের সিন্দুক এবং রেশমী বস্ত্রের গাঁট- একদল বিশিষ্ট রক্ষী সেগুলির পাহারায় নিযুক্ত ছিলো। তাঁদের থেকে প্রায় পৌনে একমাইল পেছনে ছিলো আকবরের যুদ্ধ-হাতির দল, কারণ সেগুলি সম্মুখে থাকলে তাদের পদাঘাতে সৃষ্ট ধূলিমেঘ সম্রাটের গতিপথ আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। হাতিগুলি এখনো যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম পড়ে আছে, তাঁদের দাঁতে এখনো শোভা পাচ্ছে বাঁকা ফলা যুক্ত খঞ্জর, প্রদর্শনীর জন্য। হিমুর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হাতিগুলি নিয়ে আকবরের হাতি সংখ্যা এখন ছয়শোর উপরে দাঁড়িয়েছে। তাদের পিছনে ছিলো কামান বহনকারী ষড়টানা গাড়ি। সর্বশেষে ছিলো তাবু, তৈজসপত্র, খাদ্য এবং জ্বালানী বহনকারী গাড়িবহর-রাজকীয় শিবির স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু তাতে মজুত ছিলো।

সর্বত্রই উৎসুক জনতা তাদের একনজর দেখার জন্য এমন ধাক্কাধাক্কি করছিলো যে রক্ষীরা তাঁদের ঠেকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলো। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও লোকজন ছুটে আসছিলো তাদের জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করার জন্য এবং সম্রাটকে তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করার জন্য। আকবরের ইচ্ছা ছিলো লাহোরে এসে এই মহড়ার সমাপ্তি টানা-অবশেষে তাই সেখানে পৌঁছে তিনি সন্তুষ্ট বোধ করলেন। লাহোর হলো সেই শহর যেখানে দুই বছর পূর্বে ১৫৫৬ সালের এক স্নিগ্ধ ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর পিতা হুমায়ূন হিন্দুস্তান পুনরায় জয় করার অভিযানে যাওয়ার সময় বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেছিলেন। আকবর তাঁর সঙ্গেই ছিলেন এবং তখনকার সবকিছু তার স্পষ্ট মনে আছে।

নিজ পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আকবর পুনরায় একই সাজে লাহোরের প্রবেশপথ সাজানোর আদেশ দেন। এই মুহূর্তে উঁচু সিংহাসনে বসে নিচে সারিবদ্ধভাবে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা গোত্রপতি এবং রাজাদের দিকে তাকিয়ে তিনি গভীর সন্তুষ্টি অনুভব করলেন। হিমু তাঁর হাতে পরাজিত হয়েছে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তারা যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে তাঁর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে পারেনি। প্রতিদিন তাদের প্রেরিত দূতেরা তাঁদের কাছ থেকে বাহারী প্রশংসা বাক্য এবং অপরিমিত উপহার বয়ে নিয়ে এসেছে- শিকারী কুকুর, রত্নহার পরিহিত ঘুঘু পাখি, রংধনু বর্ণিল পালক, পান্নাখচিত ছোরা, হাতির দাঁতে বাধাই করা গাদাবন্দুক, পদ্মরাগমণি খচিত বাতিদান, কাছিমের খোলে তৈরি বাক্সে ভরা সুগন্ধী প্রভৃতি। এমনকি একটি খুব বড় আকারের চুনি পাথরও তিনি উপহার হিসেবে পেয়েছেন যেটা উপহারদাতার পরিবারের কাছে প্রায় পাঁচশ বছর ধরে ছিলো।

এই সব উপহার তিনি উদার চিত্তে গ্রহণ করেছেন কিন্তু ইতোমধ্যেই তিনি এমনটা বোঝার মতো যথেষ্ট বিচক্ষণতা অর্জন করেছেন যে, উপহার যতো বেশি মূল্যবান উপহার দাতার বিশ্বাসঘাতকতাও ততোই মারাত্মক। বৈরাম খানের সঙ্গে পরামর্শ করে আকবর এই সব আপাতদৃষ্টিতে অনুগত মিত্রদের লাহোরে তার সঙ্গে সাক্ষাত করার আদেশ দেন।

 সকলে উঠে দাঁড়ান।

তারা সংখ্যায় প্রায় ষাট জনের মতো হবে, কেউ মসৃণ চকচকে চেহারার, কেউবা হৃষ্টপুষ্ট, রেশম এবং রূপার কারুকাজ করা জোব্বা বা আলখাল্লা পড়ে আছে, সেগুলির রং নীলার নীল থেকে শুরু করে জাফরানী হলুদ পর্যন্ত সকল বর্ণে বর্ণিল-কেউ কেউ পাহাড়ী অঞ্চল থেকে আগত গোত্রপতি, তারা মোটা হাতে বোনা কাপড়ের আলখাল্লা ও পাজামা পড়ে রয়েছে, সকলে উঠে দাঁড়ালো। তাদের হাত করোজোড়বদ্ধ এবং মাথা নিচু।

 আমার হুকুম পালন করার জন্য এবং আমার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অল্প সময় আগে আমার পিতা লাহোর অতিক্রম করার সময় আপনারা তাঁকে যে আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন সে ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আপনাদের অনেকের চেহারাও আমি চিনতে পারছি। আকবর তাদের সকলের উপর একবার দৃষ্টি বুলালেন। বৈরাম খান এখানে আকবরের কি করা উচিত সে সম্পর্কে বিস্তারিত আগেই বুঝিয়েছেন। আকবর জানতেন এই গোত্রপতিদের মধ্যে এমন ব্যক্তি কমপক্ষে দশজন রয়েছে যারা তাঁর পিতার প্রতি অনুগত্যের শপথ নিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কর প্রদান বন্ধ করে দেয়। এমনকি তাদের মধ্যে দুইজন হিমুর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। তারা হয়তো ভাবছে আকবর তাঁদের কর্মকান্ড সম্পর্কে কতোটা জানেন? কাছাকাছি অবস্থিত মুলতান থেকে আগত ঐ বসন্তের দাগ বিশিষ্ট ভুড়িওয়ালা গোত্রপতিটি, যে একটু আগে তাকে একটি বাদামী রঙের চমৎকার স্ট্যালিয়ন ঘোড়া উপহার দিয়েছে এবং এই মুহূর্তে তাঁর পায়ের নিচে থাকা শতরঞ্জির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে, সেকি জানে আকবরের কাছে তার বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ রয়েছে? আহমেদ খানের লোকেরা তার একজন দূতকে আটক করে যে হিমুর কাছে তার পাঠানো একটি চিঠি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো।

যাদের আনুগত্য প্রশ্নবিদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় এ বিষয়ে লাহোরে আসার পথে আকবর বৈরাম খান এবং তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে বহু সময় ধরে আলোচনা করেছেন। কেউ বলেছে তার পিতামহ বাবরের সময় এসব ক্ষেত্রে কোনো ক্ষমা প্রদর্শন করা হতো না। অপরাধীকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করা হতো অথবা তাদের হাত-পা ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে দুদিক থেকে টেনে দ্বিখণ্ডিত করা হতো। কিন্তু আকবর তারদি বেগের প্রতি তাঁর ক্ষমা প্রদর্শনের ফলাফল ভুলতে পারছিলেন না। এছাড়া তাঁর পিতা হুমায়ূন বলতেন, যে কোনো মানুষই প্রতিশোধ পরায়ণ হতে পারে। কিন্তু কেবল একজন মহান ব্যক্তিই ক্ষমাশীল হতে পারে।

আকবর তাঁর পিতার অনেক বিচার কাজ প্রত্যক্ষ করেছেন-এমনকি তার মা হামিদাও মনে করতেন যে তার পিতা কখনো কখনো অতিমাত্রায় দয়া প্রদর্শন করতেন। তবে আকবরের অনুভূতি বলে তাঁর পিতাই সর্বদা সঠিক ছিলেন। মোগলরা সর্বদাই নির্ভিক যোদ্ধা বলে বিবেচিত হবে এবং প্রয়োজনের সময় রক্ত ঝরাতে একটুও দ্বিধাগ্রস্থ হবে না। কিন্তু হিন্দুস্তানের মানুষের উপর শাসন ক্ষমতা বজায় রাখতে হলে তাদের ভীতি প্রদর্শনের পাশাপাশি তাদের শ্রদ্ধাও অর্জন করতে হবে। অতিরিক্ত হত্যাকান্ড অতিমাত্রায় শত্রুতার জন্ম দেয়। বৈরাম খান গভীর মনোযোগের সঙ্গে তার যুক্তি শ্রবণ করেছেন এবং শেষে একমতও হয়েছেন কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁকে সতর্কও করেছেন।

মনে রাখবেন, আপনার শত্রুদের চিনে রাখতে ভুল করবেন না এবং গুপ্তচরেরা যা বলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। আপনি ক্ষমা প্রদর্শনের পরেও যদি তারা বিশ্বাসঘাতকতা অব্যাহত রাখে তাহলে তাদেরকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।

 আকবর তাঁর মনকে আবার বর্তমানে ফিরিয়ে আনলেন। উপস্থিত কেউ সরাসরি তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলো না। তিনি অনুভব করলেন এই মুহূর্তে তাদেরকে সামান্য ভীতি প্রদর্শন করা প্রয়োজন। আমি জানি কেনো আপনারা এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আপনারা বুঝতে পেরেছেন যুদ্ধের হাওয়া আমার অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি ভাগ্যের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। আমার পূর্বপুরুষ তৈমুর হিন্দুস্তান জয় করেছিলেন এবং এই ভূ-খণ্ডের উপর মোগলদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার পিতামহ বাবর এবং পিতা সেই অধিকার দৃঢ়ভাবে বজায় রেখেছিলেন এবং আমিও তার ব্যতিক্রম করবো না। যে কেউ আমার এই অধিকারের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করবে, তাকে ভয়ানক মূল্য দিতে হবে। যেমনটা হিমু দিয়েছে। আকবর একটু থামলেন তারপর দৃঢ়ভাবে পরিষ্কার কণ্ঠে আবার বলা শুরু করলেন, যদিও বহু প্রশংসা বাক্য এবং উপহার আপনাদের কাছ থেকে আমি লাভ করেছি, আমি জানি আপনাদের মধ্যে অনেকেই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। হয়তো এই মুহূর্তেও কারো কারো মনে ষড়যন্ত্র খেলা করছে। আপনারা সকলে আমার দিকে তাকান, যাতে আমি আপনাদের দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করতে পারি।

ধীরে সকলে মাথা তুলে তাকালো, সকলের মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ, এমনকি যারা কোনো অপরাধ করেনি এবং সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলো তারাও আতঙ্কগ্রস্ত। আকবরের বয়স কম হলেও তিনি তার বাবার সংগ্রাম পর্যবেক্ষণ করে শিখেছিলেন যে অধিকাংশ মানুষই ক্ষমতা লোভী। তার সম্মুখে বিব্রতভাবে দাঁড়ানো অনেকেই তখন দরদর করে ঘামছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো হিমুর বিদ্রোহের সময় মোগলদের উপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহারের কথা কল্পনাও করেনি।

আপনাদের মধ্যে অনেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন, সেই প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমার রক্ষীরা আমার মুখ থেকে একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণের অপেক্ষায় প্রস্তুত রয়েছে যার সঙ্গে সঙ্গে তারা ন্যায়দণ্ড কার্যকর করবে। তিনি লক্ষ্য করলেন গোত্রপতিদের দৃষ্টি বেদির দুদিকে অবস্থানরত কালো পাগড়িধারী এবং সবুজ জোব্বা পড়া লোকগুলির দিকে নিবদ্ধ হলো। লাহোরে পৌঁছানোর পর থেকেই আমি ভাবছি এবিষয়ে আমার কি করা উচিত… আকবর থামলেন। বসন্তের দাগ বিশিষ্ট ভুড়িওয়ালা লোকটি তখন কাঁপতে শুরু করেছে। কিন্তু আমি এখনো তরুণ, আমার শাসনকালও তরুণ। এই মুহূর্তে আমি আর রক্ত ঝরাতে চাই না, তাই আমি ক্ষমাশীল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনাদের অতীতের সকল অপরাধ আমি ভুলে যাবো এবং আশা করবো এখন থেকে আপনারা আমার প্রতি অবিচলভাবে বিশ্বস্ত থাকবেন। যদি তা পারেন তাহলে আমি আপনাদের প্রতি সদয় থাকব। আর যদি না পারেন তাহলে কোনো শক্তিই আপনাদের আর রক্ষা করতে পারবে না।

আকবর উঠে দাঁড়ালেন, উপস্থিত গোত্রপতি এবং নেতারা তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আবারও মাথানত করলো, তিনি তাদের মাঝে স্বস্তির ভাব প্রত্যক্ষ করলেন। তিনি নিজের উপর সন্তুষ্টি অনুভব করলেন। তিনি স্পষ্টভাবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তার বক্তব্য শেষ করেছেন এবং তিনি নিজের প্রচণ্ড ক্ষমতাও উপলব্ধি করতে পারছেন। একটি মাত্র ইঙ্গিতে তিনি উপস্থিত যে কাউকে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করতে পারতেন। তিনি নিজে যেমন এটা জানতেন, তারাও সেটা জানতো। এই অনুভূতি তাঁকে পুলকিত করছিলো যে, যে কোনো মানুষের জীবনের গতি পরিবর্তনের ক্ষমতা তার রয়েছে। এজন্য তিনি ক্ষমাশীল হওয়ার প্রেরণাও অনুভব করলেন।

 সেই দিন রাতে নিজ শয়নকক্ষে ফেরার সময়ও আকবর গভীরভাবে চিন্তামগ্ন ছিলেন। তিনি দেখলেন একজন বৃদ্ধা মহিলা তার শয়ন কক্ষের প্রবেশ দ্বারে তার একজন পরিচারকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সম্রাট এই মহিলাটিকে আপনার হেরেমের তদারকে নিযুক্ত করা হয়েছে এবং সে আপনাকে কিছু বলতে চায়, পরিচারকটি বললো।

বৃদ্ধাটির কুঁচকে যাওয়া মুখের দৃষ্টি এই বয়সেরও উজ্জ্বল এবং তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমি আপনার পিতারও খেদমত করেছি সম্রাট এবং তাঁর রক্ষিতাদের দেখাশোনা করেছি যখন তিনি তরুণ যুবরাজ ছিলেন, বৃদ্ধাটি মুখ খুললো। তারপর সে একটু বিরতি নিলো, আকবর অনুভব করলেন বৃদ্ধাটি সাগ্রহে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

তুমি আমাকে কি বলতে চাও? রাতের আবহাওয়া আকবরের কাছে উষ্ণ ও ভারী বলে অনুভূত হচ্ছিলো এবং তিনি ক্লান্তি বোধ করছিলেন। কেনো যেনো তিনি পরিস্থিতি ঠিক ঠাহর করতে পারছিলেন না এবং বৃদ্ধাটির অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সম্মুখে অস্বস্তি বোধ করছিলেন।

সম্রাট, বর্তমানে আপনার হেরেমে অনেক মেয়ে রয়েছে, আপনার আনুকূল্য লাভের আশায় বিভিন্ন গোত্রপতি এবং রাজারা তাদের পাঠিয়েছে। আপনার দৈহিক গড়ন বহু প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ঈর্ষার বিষয় এবং সকল তরুণী এর প্রশংসায় অজ্ঞান। তাই ভাবলাম আপনার মর্জি হলে কোনো তরুণীকে আপনার কাছে পাঠাই অথবা আপনি নিজেই কাউকে বেছে নিতে পারেন। আকরব সরাসরি বৃদ্ধার দিকে তাকালেন, লজ্জায় তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ইদানিং তার দুধভাই আদম খান প্রায়ই তাকে নিয়ে কৌতুক করতো এই জন্য যে-যদিও আকবরের বয়স সেসময় পনেরোর কাছাকাছি, তখনো তার কৌমার্য বজায় আছে। বহু তরুণী-এমনকি তার মায়ের সেবিকারা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্ট করেছে। প্রতিবার তিনি ভীষণ লজ্জাবোধ করেছেন। তিনি বুঝতে পারেননি কি কারণে তার এমন অনুভূতি হয়েছে। সেটা কি এই জন্য যে, সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিনি নারী সংক্রান্ত বিষয়ে অনভিজ্ঞ? এবং সেটা প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা? এমনকি একজন রক্ষিতার কাছেও? কিন্তু সময় গড়িয়ে যাচ্ছিলো। তিনি সম্রাট হিসেবে তার প্রথম যুদ্ধ লড়েছেন এবং পূর্ণাঙ্গ পুরুষে পরিণত হচ্ছেন। তার তখন সময় হয়েছে একজন পুরুষের সুখানুভূতির স্বাদ নেয়ার। আদম খানের কৌতুক থেকে সৃষ্ট কৌতূহল এবং নিজস্ব যৌন অনুভূতি তাঁকে উদ্দীপিত করে তুললো। হেরেম তদারককারিনী বৃদ্ধাটির দৃষ্টি তার উপর তখনো নিবদ্ধ এবং তিনি অনুভব করলেন সম্ভবত সেও জানে তিনি ইতোপূর্বে নারীসঙ্গ লাভ করেননি।

 আমি একটি মেয়েকে আপনার জন্য পছন্দ করে দেবো, সম্রাট? সে জিজ্ঞেস করলো।

আকবর ইতস্তত করলেন, তার রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলো, এক মুহূর্তের জন্য। ঠিক আছে, ভাবছেন অত্যন্ত মেপে ও অভিজ্ঞভাবে তিনি কথা বলতে পারছেন।

 আপনি নিজেই কি হেরেমে আসবেন জাঁহাপনা?

 আকবরের মনে হলো তিনি সেখানে যাওয়ার সময় সকলের দৃষ্টি এবং কান তার গতিবিধির উপর নিবদ্ধ হবে। লাহোরের এই রাজপ্রাসাদের হেরেমে রাজপরিবারের সকল মহিলা অবস্থান করছিলো, তাদের মধ্যে তাঁর মা, ফুফু এবং দুধমাও আছেন। নিজের উপর তাদের অনুমান ও কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি যতোই স্নেহসিক্ত হোক না কেনো-সেটা কল্পনা করে আকবর আবার লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। এটাই তার জন্য উপযুক্ত সময়।

না, আমি হেরেমে যাবো না, মেয়েটিকে আমার শয়ন কক্ষে পাঠিয়ে দাও। দেয়ালে মশাল জ্বালা করিডোর দিয়ে মহিলাটি অন্দর মহলের দিকে চলে গেলো। সে একসময় হয়তো নিজেই খুব সুন্দরী ছিলো, হয়তো তার পিতার রক্ষিতাঁদের একজন। আকবর শুনেছেন মায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহের পূর্বে হুমায়ূন একজন মহা নারী-প্রেমিক ছিলেন এবং তাঁর বহু রক্ষিতা ছিলো।

পরিচারকদের বিদায় করে দিয়ে আকবর একা অপেক্ষা করতে লাগলেন। এক অজানা উত্তেজনা এবং উৎকণ্ঠার মিশ্রণ তাকে নিষ্পেষণ করতে থাকলো। যতোই সময় গড়াচ্ছে ততোই তিনি অস্বস্তিতে আক্রান্ত হতে থাকলেন। তিনি ঠিক করলেন যে, হেরেমে খবর পাঠাবেন এই বলে যে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু যেনো মুহূর্তে তিনি উঁচু দুভাগ বিশিষ্ট দরজার দিকে অগ্রসর হতে নিলেন, সেগুলি হঠাৎ খুলে গেলো এবং তার পরিচারক কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করলো। সম্রাট, মেয়েটি এসেছে। হেরেম তত্ত্বাবধানকারিনী বৃদ্ধাটি বলেছে সে রাজা তাল্ক এর সাবেক রক্ষিতা। রাজা তার খুব কদর করতেন এবং তাকে পাঠিয়েছেন এই আশা করে যে আপনাকেও সে পরিতৃপ্ত করতে পারবে। ওর নাম মায়ালা। আমি কি তাকে ভিতরে পাঠাবো?

 আকবর মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। এক মুহূর্ত পর একটি লম্বা, ছিপছিপে আকৃতি মাথা ঢাকা ঢিলে পোষাকে আবৃত অবস্থায় কক্ষে প্রবেশ করলো। তার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। তার মাথার ঘোমটা এতো নিচু ছিলো যে তার মুখ দেখা যাচ্ছিলো না। এগিয়ে এসে সে কুর্ণিশ করলো। আকবর একটু ইতস্তত করে আলতোভাবে তার হাত ধরে তাকে সোজা করলেন। মেয়েটি তার সম্মুখে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তিনি তার নরম ও দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ পেলেন। তিনি যখন তার ঘোমটাটি পেছনে ঠেলে দিলেন তার লম্বা কালো চুল রেশমের মতো তার মসৃণ কাঁধে ছড়িয়ে পড়লো, আকবর জেসমিন ফুলের গন্ধ পেলেন। সে তখনো নতমুখ ছিলো, আকবর তার চিবুক ধরে মুখটা উপরে তুললেন।

আবলুস কালো একজোড়া চোখ তার দিকে পাল্টা দৃষ্টি হানলো। তিনি তার লাল প্রলেপ যুক্ত পূর্ণঠোঁট দেখতে পেলেন-সেখানে মৃদু হাসি। কয়েক মুহূর্ত পর আকবরের আড়ষ্ঠতা বুঝতে পেরেই যেনো, সে মোলায়েম ভাবে আকবরের হাতটি নিজের বুকের কাছে পোষাকের ফিতার উপর পৌঁছে দিলো। তিনি ফিতা খুলে দিলেন, মেয়েটির পোষাক মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো। সে সম্পূর্ণ নগ্ন, কেবল তার কোমরে একটি সোনার শিকলি জড়িয়ে আছে যার মাঝে ছোট ছোট চুনি পাথর বসান। তার ঠোঁট জোড়া ভীষণ আকর্ষণীয়, তার স্তনযুগল সুডৌল এবং উন্নত, স্তনের বোটাদ্বয় মেহেদি রাঙা।

আকবর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বাক্য হারিয়ে ফেলেছেন, মেয়েটি দুপা পিছিয়ে গেলো। তারপর আকবরের সম্মুখে ধীরে একপাক ঘুরলো। মনে হচ্ছে আপনার আমাকে পছন্দ হয়েছে জাহাপনা, সে ফিসফিস করে বললো। আকবর মাথা নাড়লেন। সে এবার তার দিকে এগিয়ে এলো এবং তিনি অনুভব করলেন সে খুব ধীরে দুষ্টুমিচ্ছলে তার পোষাক গুলি আলগা করে দিচ্ছে, যতোক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নিজেও নগ্ন হয়ে পড়লেন। আকবরের পেশীবহুল দীর্ঘ শরীর একপলক প্রত্যক্ষ করে সে আবার হাসলো। আসুন সম্রাট আমার মাঝে পরিভ্রমণ করুন। আকবরকে তার পেলব আঙ্গুলে আকড়ে ধরে সে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। আকবর যখন তার পাশে শায়িত হলেন সে আকবরের হাতটি নিয়ে নিজের উরুসন্ধির মাঝে পৌঁছে দিলো। অনুভব করছেন সম্রাট, প্রেমের আদ্র মন্দির, যেখানে শীঘ্রই আপনি প্রবেশ করবেন। আপনাকে যা করতে হবে তা হলো….।

ছয় ঘন্টা পর, আকবর বিছানার উপর চিৎ হয়ে শায়িত, মেয়েটি তার পাশেই শুয়ে আছে, তাদের উভয়ের শরীরই ঘামে আবৃত। মেয়েটি তখন ঘুমাচ্ছে, তার হাত-পা ছড়িয়ে আছে, বক্ষ উঁচু-নিচু হচ্ছে এবং ঠোঁটজোড়া অর্ধউন্মুক্ত। তিনি তাকে দেখার জন্য মাথা ঘুরালেন, ভাবছেন কতো অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেলো। মেয়েটি তাঁকে সম্পূর্ণ অজানা এক অভিনব ইন্দ্রিয় সুখের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো যেখানে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারা ইতোমধ্যে তিনবার মিলিত হয়েছে। প্রথমে মৃদু অনুমান নির্ভর এবং তারপর আগ্রহী প্রবল ধাক্কা এবং হঠাৎ চরম পরিণতি। একসময় মেয়েটির নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি তার উপরে উঠলেন যা আরো অধিক সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন ও দীর্ঘস্থায়ী বলে সে তাকে বুঝিয়েছিলো। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর মতো মেয়েটিও প্রতিটি মুহূর্ত চরম সংবেদনশীতায় উপলব্ধি করছে এবং আনন্দ পাচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে তার মাঝে আবারো কামনা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। তিনি মেয়েটির নিতম্বে মৃদু ধাক্কা দিলেন। মায়ালা ঘুমাচ্ছন্ন গাঢ় চোখ মেলে তাকালো। মিষ্টি করে হাসল। কেউ আর কখনোও তার পৌরুষ নিয়ে ঠাট্টা বা সন্দেহ পোষণ করবে না, আকবর ভাবলেন-তাঁর তরুণ নিতম্ব তীব্র সুখে আন্দলিত হতে লাগলো যখন তিনি পুনরায় মেয়েটির উপর সওয়ার হলেন।

*

আগ্রার দূর্গ-প্রাচীরের নীচ দিয়ে সর্পিলভাবে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর উপর বাঁকা আকৃতির নতুন চাঁদ যে হালকা আলো ছড়াচ্ছিলো তা প্রতিফলিত হয়ে অস্পষ্ট মায়াবী দ্যুতির জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু আকবর নিরাপত্তা পাঁচিলের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রাতের সেই মোহনীয় সৌন্দর্য খেয়াল করলেন না। হিমুকে পরাজিত করার পর বিজয়গৌরবের সঙ্গে তিনি হিন্দুস্তান পরিভ্রমণ করেছেন দুবছর আগে। এই বিশাল বালু-পাথর নির্মিত দূর্গে দশদিন আগে ১৫ই অক্টোবরে তিনি তাঁর সতেরো তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করেছেন। দিল্লীর পরিবর্তে সেখান থেকে উজানে একশ বিশ মাইল উত্তরে অবস্থিত এই আগ্রাকে তিনি তার নতুন রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগ্রা তাঁর পিতামহ বাবর এর রাজধানী ছিলো। পিতা হুমায়ূন বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো একে তাঁর রাজধানী বানাতেন। আকবরের মা, ফুফু এবং দুধমা এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, তাঁর সকল সেনাপতি এবং উপদেষ্টারাও। একমাত্র বৈরাম খান এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেন। তিনি যুক্তি দেখান যেকোনো বিদ্রোহ বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য কৌশলগত ভাবে দিল্লীই আদর্শ স্থান। সভাসদগণের সম্মুখে আকবরের সঙ্গে তর্ক এড়ানোর জন্য তিনি পরে আকবরের ব্যক্তিগত কক্ষে এসেছিলেন। কিন্তু আকবর তাঁর পরামর্শ কানে তোলেননি। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। বৈরাম খান আকবরের সঙ্গে তাঁর সর্বপ্রথম সত্যিকার বিরোধ থেকে ফ্যাকাশে মুখে ধীর পদক্ষেপে ফিরে যান।

স্মৃতি রোমন্থনের সময় আকবর দ্রুকুটি করলেন। পরবর্তী মাস গুলিতে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যায়নি। তিনি অনুভব করছিলেন বৈরাম খানের আচরণ ক্রমশ বিরক্তিকর এবং অনধিকারচর্চামূলক হয়ে উঠছে। তার মনে হচ্ছিলো তিনি যতোই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন এবং শাসনকার্যে অধিক সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাইছেন, বৈরাম খান ততোই তাকে নিরুৎসাহিত করতে চাইছেন। বৈরাম খানের প্রতিটি বিরোধীতার সাথে তালমিলিয়ে শাসনকার্যে তাঁর নিজের স্বাধীন হস্তক্ষেপের আকাক্ষা বর্ধিত হচ্ছিলো।

সাম্রাজ্যের দুর্বল হয়ে পড়া সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় বৈরাম খানের ভূমিকা স্মরণ করে এখনো পর্যন্ত তিনি তাঁর এই ভাবনাগুলি কাউকে জানাননি। কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করে তাঁর এই গোপন অনুভূতি প্রকাশ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তিনি অনুভব করছিলেন। হয়তো তার মায়ের বিচক্ষণ মন তাঁকে এ ব্যাপারে উপদেশ প্রদান করতে সক্ষম হবে।

 নিরাপত্তা পাঁচিল থেকে চক্রাকার সিঁড়ি বেয়ে নেমে তিনি একটি ফুলবাগান শোভিত উঠান পেরিয়ে প্রধান হেরেমের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে সম্রাটের মায়ের উপযুক্ত সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং বিলাসবহুল কক্ষে তাঁর মা হামিদা থাকেন। কক্ষটির বারান্দা যমুনা নদীর উপর প্রসারিত যেখানে তিনি নদীর টাটকা বাতাসে শ্বাস নিতে পারেন। হামিদা তাঁর শয়ন কক্ষে বসে তাঁর প্রিয় পারসিক কবিতার বই পাঠ করছিলেন। আকবরকে ঢুকতে দেখে তিনি বইটা রেখে দিলেন। কক্ষটির চারদিকের দেয়ালের ফোঁকরে একাধিক সুগন্ধি-তেলের প্রদীপ এবং মোমবাতি জ্বলছে।

 কেমন আছো তুমি? মায়ের শরীরের চন্দনের উষ্ণ সুগন্ধ আকবরকে আবৃত করলো যখন তিনি তাকে আলিঙ্গন করলেন। উত্তর না পেয়ে হামিদা একটু পিছিয়ে গেলেন এবং ভালো করে পুত্রের মুখের দিকে তাকালেন।

কি হয়েছে? তোমাকে ভীষণ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

সত্যিই তাই মা।

বসো, আমাকে সবকথা খুলে বল।

আকবর তাঁর সমস্ত ক্ষোভ এবং নৈরাশ্যের কথা বলতে শুরু করলেন এবং হামিদা একান্তচিত্তে সেসব শুনতে লাগলেন। আকবরের বক্তব্য যখন শেষ হলো তিনি এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তার মাথা আবৃত করে থাকা পান্না শোভিত সোনার অলঙ্কারটির নিচে সুন্দর কপালটিতে কুঞ্চন দেখা গেলো। আকবরের পিতার তাকে দেয়া শেষ উপহার। অবশেষে বিষণ্ণ মুখে তিনি কথা বললেন।

 যদিও তোমার কিছু অভিযোগ ন্যায়সঙ্গত তবুও তোমার পরিবারের প্রতি বৈরাম খান যে উপকার করেছেন সেসব তুমি ভুলতে পারো কি? হয়তো আমার তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। এক যুদ্ধে তোমার পিতা তাঁর প্রাণ বাঁচানোর পর তিনি আজীবন মোগলদের পক্ষে লড়াই করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন। এমনকি যখন আমাদের ভাগ্যাকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিলো তখনো তিনি আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। সেসময় সহজেই তিনি পারস্যে তাঁর শাহ্ এর চাকরিতে ফিরে যেতে পারতেন। তোমার পিতার মৃত্যুর পর তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা এবং সাহসের দ্বারাই তুমি রক্ষা পেয়েছে এবং আমাদের সাম্রাজ্য অক্ষত আছে।

আমি তা জানি কিন্তু…।

হামিদা তাকে থামার জন্য হাত তুলে ইশারা করলেন। এটা স্বাভাবিক, যখন তুমি বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে, তাঁর নির্দেশনা তোমার বিরক্তি উৎপাদন করছে এবং এটাও সত্য কখনো কখনো তিনি সহ্যের সীমা অতিক্রম করেন। কিন্তু এমন উপদেষ্টা যিনি প্রয়োজনের সময় সত্যি কথাটি বলতে দ্বিধা করেন না, তাদের তুলনায় উত্তম যারা তোমার প্রতিটি খেয়ালের প্রতি মধুমাখা সমর্থন প্রদান করে। তোমাকে ধৈর্যশীল হতে হবে। যখন তোমার বয়স আঠারো হবে তখনোই তুমি সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়ার কথা চিন্তা করতে পারো কোনো অভিভাবকের সাহায্য ছাড়া। তার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করো, পর্যবেক্ষণ করো এবং শিখো। হিমুকে পরাজিত করার পর থেকেই কেবল তুমি প্রশাসনিক বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। তার আগে আমি এবং বৈরাম খান বহু চেষ্টা করেও তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারিনি। যেসব সভায় তোমার উপস্থিত থাকা জরুরি ছিলো সেসব উপেক্ষা করে তুমি উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছো অথবা আদম খানের সঙ্গে বাজপাখি উড়িয়েছে। এখনো তুমি সাম্রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে তোমার প্রিয় নারীদের সঙ্গে সময় কাটাও। আমি তোমাকে দোষারোপ করছি না। হেরেমের আনন্দ সত্যিই খুব মিষ্টি। একজন তরুণের কামনা বাসনা পরিতৃপ্ত করার প্রয়োজন থাকতেই পারে এবং এতো সংখ্যক সুন্দরী নারী যখন তোমার সকল বাসনা পূরণ করার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত-সেটা নিঃসন্দেহে তোমার জন্য তৃপ্তিদায়ক। কিন্তু নিজেকেই জিজ্ঞাসা করো সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়ার জন্য তুমি সত্যিই প্রস্তুত কিনা অথবা এটা নিছক তোমার তরুণ হৃদয়ের উদ্ধত আচরণ এবং ধৈর্যের অভাব কিনা। আমি প্রস্তুত…।

 আমার বক্তব্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করোনা। শোন। তোমার ধৈর্যহীনতা বলতে আমি এই অস্থিরতাকেই বুঝিয়েছি। তোমার মধ্যে মনোযোগের অভাব রয়েছে-সে কারণে তুমি এখনো পড়তে শিখোনি। তোমার লেখাপড়ার জন্য যতোজন শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে সকলে ব্যর্থ হয়েছেন। বৈরাম খান নিজেও চেষ্টা করেছেন কিন্তু তুমি এড়িয়ে গেছে। তোমার পিতা এবং পিতামহ বিদ্বান ছিলেন এবং উত্তম যোদ্ধাও ছিলেন। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারা একজন ভালো শাসকের প্রধান গুণ, এমনকি তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকাও গুরুত্বপূর্ণ।

 এটা আমার প্রতি অন্যায় হচ্ছে। বলে উঠলেন আকবর। ভাবছেন কেনো তাঁর মা বিষয়বস্তু পরিবর্তন করলেন? তিনি বহুবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, যখনই তিনি বই এর পাতার দিকে তাকান, তাতে লেখা অক্ষরগুলি তার চোখের সামনে নড়াচড়া করে এমন তালগোল পাকিয়ে যায় যে তিনি সেগুলির অর্থ বুঝতে পারেন না। কিন্তু তার মা যিনি নিজেও একজন আদর্শ পাঠক- তিনি তার এই সমস্যার বিষয়টি কিছুতেই বুঝতে পারেন না। আকবর উঠে দাঁড়ালেন। হামিদার সঙ্গে তার আলোচনা তার অভিপ্রায় পূরণ করতে পারেনি। তাই দ্রুত এর সমাপ্তি টানাই মঙ্গল। তিনি মায়ের প্রশ্নাতীত সমর্থন আশা করেছিলেন, অথচ তার পরিবর্তে তিনি তাকে পাল্টা আক্রমণ করলেন। তোমার উপদেশের জন্য ধন্যবাদ, তিনি আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন।

রাগ করোনা আকবর। আমি কেবল তোমার মঙ্গলের জন্যই এসব কথা বললোম। আমি তোমার জন্য গর্বিত এবং তুমি একদিন একজন মহান সম্রাট হবে। সব ধরনের অস্ত্রে তুমি পারদর্শী। তোমার চেয়ে দক্ষ কোনো ঘোড়সওয়ার, কুস্তিগির, তীরন্দাজ অথবা তলোয়ারবাজ নেই। তুমি নির্ভীক এবং উদার মনের অধিকারী। প্রজাদের ভালোবাসা অর্জনের যোগ্যতা তোমার আছে। কিন্তু তোমাকে ধৈর্যের শিক্ষা নিতে হবে এবং তোমার নিকটবর্তী সেই সব মানুষের সঙ্গে সতর্কভাবে বোঝাঁপড়া করতে হবে যারা তোমার ইচ্ছার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে মাথা নত করে না। আর সবকিছুর উপরে তোমাকে স্মরণ রাখতে হবে তোমার জীবনে আগত যাবতীয় মঙ্গলের জন্য তোমার কাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত।

আকবর নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন যখন তার মা এগিয়ে এসে তার কপাল চুম্বন করলেন। মা তাকে অমনোযোগী এবং অকৃজ্ঞ বলছেন এই বোধ তাঁর মাঝে হতাশা এবং ক্রোধের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁকে চিন্তাহীন আরাম-সন্ধানী মনে করেন। তিনি কি সত্যিই এমন একজন তরুণ যে অসময়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়, সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছাড়াই? তার মেধা সম্পর্কেও মা কটাক্ষ করলেন। বৈরাম খানও তার প্রতি অনুরূপ মনোভাব পোষণ করেন। সজোরে দরজা খুলে বের হয়ে তিনি দ্রুত নিজের কক্ষে চলে গেলেন। মায়ের কথায় তাঁর অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয় কিন্তু তিনি কিছুতেই নিজের ভাবাবেগ সামলাতে পারছেন না। মা কেনো তাকে বুঝলেন না? তিনি তাকে সম্পূর্ণ অপদস্থ করেছেন।

তিনি তখনো গভীবভাবে চিন্তামগ্ন একটু পরে যখন তাঁর পরিচারক তার কক্ষে প্রবেশ করলো।

কি ব্যাপার?

 মাহাম আঙ্গা আপনাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।

তাঁর দুধমা আবার তাকে কি বলতে চায়? রুক্ষমুখে আকবর ভাবলেন মাহাম আঙ্গার কক্ষের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়। মা কি তাকে আকবরকে সংযমী এবং ধৈর্যশীল হওয়ার উপদেশ দিতে বলেছেন? যদি তাই হয় তাহলে তিনি বৈঠক সংক্ষিপ্ত করবেন-এই মুহূর্তে তিনি আর কোনো বক্তৃতা শুনতে প্রস্তুত নন। কিন্তু মাহাম আঙ্গা যখন আকবরকে সম্ভাষণ জানালেন তখন তার মুখে আকবরের প্রতি শুধুমাত্র ভালোবাসা এবং দুর্ভাবনার আভাস দেখা গেলো।

 আমি লক্ষ করেছি ইদানিং তুমি ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকছে। আমার পরিচারিকা বলেছে কিছুক্ষণ আগে কুদ্ধভাবে তুমি তোমার মায়ের কক্ষ থেকে বের হয়ে এসেছে। আকবর, কি সমস্যা হয়েছে? তার স্বচ্ছ বাদামি চোখ আকবরের চোখের উপর নিবদ্ধ হলো এবং তাঁর কণ্ঠস্বর তেমনই কোমল আর মিষ্টি যেমনটা আকবর শৈশবে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি সর্বদাই তাঁর কথা শ্রবণ করেছেন, তাঁকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। আকবর নতুন উদ্যমে তাঁর ক্ষোভের কাহিনী বর্ণনা করতে শুরু করলেন। মাহাম আঙ্গা গভীর মনোযোগে কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সম্পূর্ণটা শ্রবণ করলেন। আকবর যখন নিরব হলেন মাহাম আঙ্গা প্রশ্ন করলেন, তোমার মা এসব শুনে কি বললেন?

 ধৈর্যধারণ করতে।

 তিনি ঠিকই বলেছেন। তাড়াহুড়া করে কিছু করা বিচক্ষণতার লক্ষণ নয় এবং তোমার এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।

 তাঁর দুধমা তার মাকে সমর্থন করতে যাচ্ছেন, আকবর ভাবলেন।

 এই জন্যই আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। আমার নিজের মাঝেও দুর্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি তুমি শাসন করার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠছে, কিন্তু বৈরাম খান-একজন মহান ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও সেটা স্বীকার করতে চাইছেন না। তিনি তার হাতে থাকা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইছেন না।

আমার পিতার মৃত্যুর পর শুধু নামে ছাড়া আর সবক্ষেত্রেই তিনি সম্রাটের ভূমিকা পালন করছেন… আকবর দ্রুত বলে যাচ্ছেন। এখন তিনি ভাবছেন তার ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছু বললে তিনি অসন্তুষ্ট হোন-যেমন আগ্রাকে রাজধানী করতে চাইলে তিনি এর বিরোধীতা করেন।

হয়তো সত্যিই তিনি নিজেকে সম্রাট ভাবছেন। আমি শুনেছি তিনি তাঁর অনুগামীদের মধ্য থেকে রাজপদের জন্য তোক নিয়োগ করেন তোমার অনুমতি ছাড়াই। আমি আরও জেনেছি, তার কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে এলো, ইদানিং তিনি একজন সম্রাটের চেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। আকবর, একটা বিষয় তোমার জানা দরকার, কিন্তু তোমাকে শপথ করতে হবে যে এই কথা আমি তোমাকে বলেছি সেটা তুমি কাউকে বলবে না।

নিশ্চয়ই বলবো না। বৈরাম খানের সম্রাটের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগের বিষয়টা বুঝিয়ে বলুন।

আমি জেনেছি রাজকীয় কোষাগার থেকে সম্পদ আত্মসাৎ করে তিনি নিজের ভাণ্ডার ভরছেন। বিশেষ করে তিনি একটি মহামূল্যবান ময়ূর আকৃতির রত্নখচিত হীরার হার আত্মসাৎ করেছেন যেটা হিমুর কোষাগারে ছিলো। পানি পথের বিজয়ের পর হিমুর উজির তার প্রভুর মালিকানাধীন মূল্যবান সম্পদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। সেই তালিকায় এই হারটির উল্লেখ ছিলো। কিন্তু তোমার সেনাকর্তাদের কেউ হারটি পায়নি। ফলে হিমুর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত সম্পদের পাহারায় নিয়োজিত সৈন্যদের শাস্তি মূলক চাবুকপেটা করা হয় অবহেলার দোষারোপ করে।

 আপনি নিশ্চিত যে বৈরাম খানই হারটি নিয়েছেন?

হ্যাঁ। প্রথমে আমি এই গল্প বিশ্বাস করিনি-কারণ রাজপ্রাসাদে কতোরকম ভিত্তিহীন গুজবই না প্রচলিত থাকে, বিশেষ করে হেরেমে গালগল্প ছাড়া আর তেমন কিছু করার থাকে না। কিন্তু কিছু সপ্তাহ আগে তোমার দুধভাই আমাকে বলে সে এমন একটা গল্প জানে-যা শুনে আমি মজা পাবো। সে আমাকে একজন রক্ষিতার কথা বলে যে অল্প কিছুদিন আগে বৈরাম খানের হেরেমে ছিলো এবং নিজের চোখে হারটি দেখেছে। অবশ্যই সে সেটা পড়েছে। আমার ধারণা বৈরাম খান বিশেষ মুহূর্তে তাঁর প্রিয় নারীটির নগ্ন দেহে হারটি পড়া দেখতে ভালোবাসেন। আদম খান গল্পটির তাৎপর্য বুঝতে পারেনি- সে মনে করেছে বৈরাম খানের এই গোপন স্বভাবের কথা জানতে পেরে আমি হাসবো। আমিও তাকে কিছু বলিনি এবং সে ধারণা করতে পারেনি যে হারটির বর্ণনা শুনে আমি সেটাকে চিনতে পেরেছি।

আমি বিশ্বাস করতে পারছি না বৈরাম খান এধরনের কাজ করতে পারেন। হয়তো এটাকে তিনি চুরি মনে করছেন না। হয়তো তিনি ভাবছেন এটা তার ন্যায্য অধিকার। তিনি চার বছর ধরে তোমার অভিভাবকত্ব করছেন এবং ক্ষমতা মানুষের উপর বিস্ময়কর প্রভাব ফেলে আকবর।

 কিন্তু তিনি গোপনে হারটি নিলেন কেনো? নির্দোষ রক্ষীদের ভোগান্তিতে ফেললেন কেনো?

 খুব ভালো প্রশ্ন করেছো আকবর।

আকবর এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। মাহাম আঙ্গার তাঁকে মিথ্যা কথা বলার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আকবর বৈরাম খানের ব্যাপারে দুর্ভাবনায় ছিলেন বলেই তিনি তাঁকে গল্পটা বললেন। এটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছিলো যে বৈরাম খান ক্ষমতার প্রতি এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত উপরি সুবিধাগুলির প্রতি ক্রমশঃ আসক্ত হয়ে পড়ছিলেন। আকবর মনস্থির করে ফেললেন। মাহাম আঙ্গা, আপনি আমাকে যা বললেন তার ফলে আমি এ ব্যাপারে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি যে বৈরাম খানের প্রভাব থেকে আমার নিজেকে মুক্ত করতে হবে।

সম্রাটের প্রতি এই ধরনের প্রতারণা যদি তোমার পিতামহের আমলে ঘটতো তাহলে দোষী ব্যক্তিকে এর জন্য জীবন দিতে হতো।

 কি বললেন? আকবর বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। না, সে ধরনের কোনো চিন্তাই আমি করবো না। আমি আমার সবকিছুর জন্য বৈরাম খানের কাছে ঋণী এবং আমি এখনো আমার জীবন বাজি রেখে তাকে বিশ্বাস করি। যতোই দামি হোক না কেনো, ঐ হীরার হারটির জন্য আমি তার প্রতি মোটেই অসন্তুষ্ট নই। কিন্তু আমাকে তার নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাকে একাই সাম্রাজ্য শাসনের দায়িত্ব নিতে হবে।

মনে হলো মাহাম আঙ্গা একমুহূর্ত কিছু ভাবলেন। তাহলে তাই হোক…তোমার পিতা যখন তোমার বিশ্বাসঘাতক চাচাঁদের প্রভাব থেকে নিজকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তখন তিনি তাদেরকে মক্কায় তীর্থ যাত্রায় পাঠিয়েছিলেন। বৈরাম খান এখন দিল্লীতে, সেখানে তিনি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করছেন তাই না? তাঁর কাছে একটা চিঠি পাঠাও। বলো তোমার স্বার্থ রক্ষায় তার বিশ্বস্ত অবদানের জন্য তুমি তার প্রতি কতোটা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তিনি সাম্রাজ্যের সেবা করতে গিয়ে নিজে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন দেখে তুমি ভীষণ উদগ্রীব। বলল তোমার ইচ্ছা তিনি যাতে হজ্জ্ব পালন করেন, কারণ এর ফলে তার শরীর ও মন প্রশান্তি লাভ করবে। তাছাড়া তিনি যাতে এই সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করেন যাকে সুসংহত করার জন্য তিনি দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন। তুমি সম্রাট। তোমার এই আদেশ সে পালন করতে বাধ্য।

 আকবর একটি গাঢ় কমলা রঙের রেশমের কোলবালিশে হেলান দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। বৈরাম খানকে বিতাড়িত করার জন্য মাহাম আঙ্গার এই পরামর্শ নিঃসন্দেহে উত্তম। হজ্জ্ব পালন করতে তাঁর প্রায় একবছর লেগে যাবে। স্থল পথে গুজরাট গিয়ে সেখান থেকে জাহাজে চড়ে আরব দেশে পৌঁছাতে হবে। তারপর দীর্ঘ মরুপথ পারি দিয়ে তাকে মক্কায় পৌঁছাতে হবে। যখন তিনি ফিরে আসবেন তততদিনে নিশ্চয়ই আকবর সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারবেন। তখন তিনি তাঁর পরামর্শদাতা সাবেক অভিভাবককে কোনো সমৃদ্ধ রাজ্য নির্বাচন করে সেখানে আরামদায়ক অবসরে পাঠাতে পারবেন।

কিন্তু একই সময়ে আকবরের মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ তাঁকে বললো এই পরিকল্পনা খুবই অসম্মানজনক। তাঁর নিজের দিল্লীতে গিয়ে সামনাসামনি বৈরাম খানকে তাঁর অনুভূতির কথা বলাটাই যুক্তিসঙ্গত। তবে ইতোমধ্যে তিনি এধরনের চেষ্টা অনেকবারই করেছেন। সর্বদাই বৈরাম খান কথা ঘুরিয়ে ফেলেছেন এবং কৌশলে তাঁর ইচ্ছাকে দমন করেছেন। তার মোকাবেলা করার জন্য তিনি যদি মায়ের সমর্থন পেতেন তাহলে হয়তো ভিন্ন কিছু ঘটতো। কিন্তু হামিদা তার অনুভূতি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন….অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো…হয়তো এখন সময় হয়েছে মাকে এবং বৈরাম খানকে বোঝানোর, যে তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি নিজেই এখন চিন্তা করতে পারেন এবং কর্ম সম্পাদন করতে পারেন।

 মাহাম আঙ্গা, আমার পত্র লেখকের ভূমিকাটি আপনিই পালন করুন এবং এতোক্ষণ যা বললেন তা লিখুন বৈরাম খানকে। সেই সঙ্গে এটাও যুক্ত করবেন যে আমি তাকে সর্বদাই সম্মান করবো…তিনি আমার কাছে একজন পিতার মতোন।

নিশ্চয়ই। আকবর দেখলেন মাহাম আঙ্গা একটি পিতল দিয়ে বাঁধানো নিচু গোলাপ কাঠের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে একটি কালির দোয়াত এবং ময়ূরের পালক রাখা ছিলো। তিনি টেবিলের সামনে হাঁটুমুড়ে বসলেন। একটি কাগজ টেনে নিয়ে মোমের কম্পিত আলোয় তিনি চিঠি লেখা শুরু করলেন যেটিকে আকবর নিজের মুক্তির সনদ বলে মনে করছেন। আকবর অনুভব করলেন সবকথা সঠিকভাবে লেখার ব্যাপারে তিনি তাকে বিশ্বাস করতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *