একজন মিসেস নন্দী

একজন মিসেস নন্দী

মুখ না তুলেও ডক্টর বসু টের পেলেন আর একজন কেউ ঘরে এলেন।

ছোট মেয়েটার হাতসুষ্ঠু একটা আঙুল তাঁর এক হাতের থাবার মধ্যে। অন্য হাতে গ্লাস-স্লাইডে আঙুলের রক্ত লাগিয়ে নিচ্ছেন। মুখও চলছে। ছোট মেয়েটিকে ভোলাবার জন্যে অনেক হাসির কথা বলছেন। কিন্তু আঙুলে আচমকা পিনের খোঁচা খেয়ে আর রক্ত দেখে মেয়েটা ভরসা করে হাসতে পারছে না। ডক্টর বসু আর একটা গ্লাস-স্লাইডে ঘষে ঘষে এই স্লাইডের রক্তটা শুকিয়ে নিয়ে জোড়া-স্লাইড দুটো সামনের চামড়ার বাক্সের খুপরিতে রাখলেন। তারপর আগন্তুক দাঁড়িয়েই আছে মনে হতে ঘাড় ফেরালেন।

একজন মহিলা! বছর ত্রিশ-বত্রিশ হবে বয়েস।

এখানে অবারিত-দ্বার সকলের। পুরুষ আসে, মহিলা আসে–যার প্রয়োজন। সে-ই আসে। রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষা করানোর চার্জ এখানে কিছু বেশি। এই বেশিটুকু দেবার যাঁদের সংগতি আছে, বা কিছু বেশি দিয়েও যাঁরা সতোর ওপরে নির্ভর করেন।–তারাই আসেন। রোগের ব্যাপারে এ-রকম লোকের সংখ্যাই বেশি।

ডক্টর বসুর চকিত-বিভ্রান্ত, প্রায়-বিমূঢ় অভিব্যক্তিটুকু মহিলার পদার্পণের দরুন নয়। তার সামনেই তো আর এক মহিলা বসে। যে ছোট মেয়েটার রক্ত নিচ্ছেন, তার মা। ডক্টর বসুর পরিবর্তন এই একজনকে দেখেই।

-বসুন।

ঈষৎ ব্যগ্রমুখে মহিলা বলতে গেলেন–আমার বিশেষ একটু

-বসুন।

অর্থাৎ হাতের কাজ শেষ না করে তার শোনার অবকাশ নেই। ডক্টর বসু রাশভারী মানুষ। কম কথা বলেন। এক কাজের ফাঁকে আর এক কাজের কথা শুনে নেওয়ার অভ্যেস নেই। কিন্তু যেভাবে বললেন, নিজের কানেই বিসদৃশ লাগল। কণ্ঠস্বর ঈষৎ অসহিষ্ণু রূঢ় শোনাল। এমন কি, বাচ্চা মেয়েটির মাও একবার ফিরে নবাগতাকে দেখলেন।

বিব্রত মুখে মহিলা একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।

ধীরে-সুস্থে হাতের কাজ সারতে লাগলেন ডক্টর বসু। তিন জোড়া স্নাইডে রক্ত লাগানো, দুটো সরু টিউবে রক্ত টেনে আরকে মেশানো–এসব কাজে এমনই অভ্যস্ত যে চোখ বুজে করতে পারেন। অত গম্ভীর নিবিষ্টতায় সম্পন্ন করার মতো কিছুই নয়। আসলে মনটা তার এই কাজের দিকে নেইও। সুশ্রী রমণীটিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার অন্দরমহলে দুর্বোধ্য আলোড়ন শুরু হয়েছে একটা। তিনি কিছু স্মরণ করতে চেষ্টা করছেন। কিছু হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।– কোনো একদিনের কোনো এক পুঞ্জীভূত বিরূপতার উৎসে হঠাৎ নাড়া পড়েছে যেন। অথচ এই উৎসটার সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন না আদৌ। এ-রকম বাত রাগের হেতু নিজেই জানেন না। নিজের অগোচরে স্মৃতির আয়নায় কোনো একখানি। মুখ ধরা আছে হয়ত। কিন্তু ধরা যে আছে সেটা অনুভব করলেন এই সুযৌবনা রমণীটিকে একনজর দেখে। দেখামাত্র একটা বিমুখ প্রতিক্রিয়া অনুভব করলেন। অথচ আশ্চর্য, কাজের ফাঁকে নিজের নিভৃতে বিচরণ করেও তিনি ওই স্মৃতি-তটে পৌঁছুতে পারলেন না। কিছুই মনে করতে পারলেন না ডক্টর বসু।

ঘুরে বসে আর একবার সুন্দর মুখখানা দেখার ইচ্ছে। সুন্দর কিন্তু সুবাঞ্ছিতা নয়। ঘুরে বসলেন না। দেখার অবকাশ এক্ষুণি মিলবে। কিন্তু কার সঙ্গে কাকে মেলাবেন মনে না পড়লে দেখে কি করবেন? মনে পড়ছে না।

হাতের কাজ সারলেন। সরঞ্জামগুলো চামড়ার বাক্সয় গুছিয়ে রাখলেন। ছোট মেয়েটার মায়ের কাছ থেকে ফী নিলেন। পেশেন্টের বাড়ি যেতে হলে ডবল চার্জ, এখানে এলে অর্ধেক। তাকে বললেন, বিকেলে লোক পাঠিয়ে রিপোর্ট নিয়ে যেতে। মেয়ের হাত ধরে মা চলে গেলেন।

ডক্টর বসু ঘুরে বসলেন।

…সেই রকমই দীর্ঘাঙ্গী স্বাস্থ্যবতী।…গৌর তনু, রূপসী…সেই রকমই ঢলঢলে মুখ। সেই রকম বাঁকা সিঁথি।

কিন্তু কোন রকম? কার মতো?

-হ্যাঁ, বলুন।

সুন্দর মুখখানি ভারি শুকনো, ক্লান্ত, উৎকণ্ঠাভরা। এই রূপের আড়ালে –অনেকদিনের একটা দুশ্চিন্তা যেন থিতিয়ে বেঁধে আছে। স্বল্প প্রতীক্ষার দরুন ঈষৎ অধীরও। বললেন–আপনাকে দয়া করে এক্ষুণি একবার আমার বাড়িতে আসতে হবে, আমার ছেলেটির

-বাড়ি কোথায়?-কথার মাঝেই বাধা পড়ল।

–বেশি দূর নয়, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে–

ডক্টর বসু চেয়ে আছেন। লক্ষ্য করছেন। বাঁকা সিথির ফাঁকে সিঁদুরের আঁচড়, কমনীয় ভুরু, টানা চোখ। বললেন–গাড়ি একটা আমারও আছে, আপনি বাড়ির ঠিকানা। বলে যান, যাব–

 মহিলা থতমত খেলেন একটু। এ-রকম গম্ভীর নির্লিপ্ততার কারণ খুঁজে পেলেন না। ঠিকানা দিলেন। তারপর সানুনয় অনুরোধ করলেন–কেসটা খুব আরজেন্ট ডাক্তারবাবু, আপনার ব্লাড-রিপোর্টের ওপর আমার ছেলের প্রাণ নির্ভর করছে।

বলতে বলতে টানা চোখের কোণদুটো একবার কেঁপে উঠল বুঝি। সামলে নিয়ে বললেন–বড় ডাক্তার বিশেষ করে আপনাকে দিয়ে ব্লাড় করানোর কথা বলে দিয়েছেন

ডক্টর বসু প্যাথলজিস্ট। রোগীর চিকিৎসা করেন না। রোগের বীজাণুর হদিস দেন। কিন্তু এই কাতরোক্তি শুনেই হোক বা তাকে আর একটু বসিয়ে, আরো একটু লক্ষ্য করে কোনো ভুলে-যাওয়া স্মৃতির দরজা খোলার তাড়নাতেই হোক, জিজ্ঞাসা করলেন–কি হয়েছে?

মহিলা সাগ্রহে জানালেন কি হয়েছে। জানিয়ে যেন ভরসা পেতে চাইলেন। কিন্তু ডক্টর বসু যা শুনলেন সত্যি হলে ভয়ের ব্যাপার। সাত বছরের ছেলে। রক্তের শ্বেত কণিকা অসম্ভব রকম বেড়ে যাচ্ছে। লিউঁকিমিয়া। এই রোগ হলে বাঁচেই না বলতে গেলে। আগে অন্যত্র ব্লাড় করানো হয়েছিল। সেখানকার ওই রিপোর্ট ছিল। আজ আবার। একজন ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। তিনি একটু সংশয় প্রকাশ করেছেন, ওই রোগ নাও হতে পারে। অবিলম্বে তিনি আর একবার রক্ত-পরীক্ষা করাতে বলেছেন। আর বিশেষ করে ডক্টর বসুরই নাম করেছেন।

ডক্টর বসু শুনলেন। মায়ের ব্যাকুলতা দেখলেন। সুন্দর মুখে একমাত্র ছেলের মৃত্যুর ছায়া কাঁপছে। ডক্টর বসুর মনে হল তবু মেয়েটি যুঝছে–ছেলে বাঁচবে না বিশ্বাস করতে চাইছে না, মুখের ওপর ওই ছায়াটাকে বসতে দিতে চাইছে না।

কিন্তু তবু এই আকুতি যেন মর্মস্থলে পৌঁছুচ্ছে না ডক্টর বসুর। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে, তিরিশ-বত্রিশের এই স্থিরযৌবনে দোলা লাগলে, এই সুন্দর মুখে হাসি ঝরলে, ওই টানা বিষণ্ণ চোখের গভীরে কটাক্ষের বিদ্যুৎ ঝলসালে কার সঙ্গে যেন মিলবে। যার স্মৃতি বাঞ্ছিত নয় আদৌ, যার স্মৃতি একরাশ বাষ্পীয় ক্ষোভের মতো অবচেতন মনের তলায় জমাট বেঁধে আছে।

কিন্তু কার স্মৃতি? ভেবে না পেয়ে ডক্টর বসু নিজেই অবাক!

-আপনি যান, আমি যাচ্ছি।

মহিলা এবারে হয়ত অন্যরকম আশা করেছিলেন। ভেবেছিলেন তার সঙ্গেই আসবেন। আবার অনুরোধের ভরসা না পেয়ে কাতর মিনতি-ভরা চোখে তাকালেন

-আপনি যান, আমার দেরি হবে না।

চলে গেলেন। গেট পর্যন্ত দেখা গেল। ডক্টর বসু দেখলেন। এই রমণীর চলা ফেরা, গাড়িতে ওঠা–মাধুর্য-ভরাই বটে। কিন্তু ডক্টর বসু তা দেখলেন না। মায়ের বিষণ্ণ করুণ মাধুর্য দেখলেন। আর, কি ঐক মস্ত মিলের মধ্যে ঠিক ততবড়ই একটা বিপরীত অমিল দেখলেন।

ডক্টর বসু মানুষটা বাইরে রুক্ষ হলেও নির্দয় নন আদৌ। বরং উলটো। তার কাজের নিষ্ঠা আর একাগ্রতা সুবিদিত বলেই বড় বড় ডাক্তাররা তার কাছে কেস পাঠান, তার রিপোর্টের ওপর অসংশয়ে নির্ভর করেন। যা শুনলেন, হাতের সব কাজ ফেলে তার তক্ষুণি ছোটার কথা, তবু উঠতে একটু দেরিই হল।

ডক্টর বসু ভাবছেন। ভাবা ঠিক নয়, অতীত হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের এমন। অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার দরুন নিজেই হতভম্ব তিনি। ছেলেবেলায় অবশ্য খুবই আবেগপ্রবণ ছিলেন। একটু কিছু হলেই ভিতরে ভিতরে চাপা অভিমানে গজরাতেন। বাবাকে মনেও পড়ে না। শুধু মা ছিল। এই মাকে ঘিরেই যত মান-অভিমান। অথচ দু-দণ্ড ওই মা চোখের আড়াল হলে অন্ধকার দেখতেন চোখে।

বিগত দিনের পরিচিত মুখগুলো মনে করতে চেষ্টা করলেন ডক্টর বসু। কিন্তু এই মুখ মনে পড়ছে না। তার পরিচিতের সংখ্যাও মুষ্টিমেয়, তাদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ নেই বললেই চলে। দিবারাত্র কাজে ডুবে থাকেন, সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দেবার ফুরসতও মেলে না। অনভ্যাসের দরুন এখন অবকাশ পেলেও যান না কোথাও।

কোনো পেশেন্টের বাড়িতে কেউ তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল কিনা ভাবতে চেষ্টা করলেন। দু-দশটা বাড়ি থেকে রোজই কল আসে। গিয়ে রক্ত নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু এই ঠিকানায় কখনো গেছেন বলে মনে পড়ল না।

এ-ধরনের স্থূল ব্যাপার কিছু নয়, ডক্টর বসু নিজেই ভালো জানেন। সামান্য ঝগড়া-বিবাদে বা কারো দুর্ব্যবহারে এ-রকম প্রতিক্রিয়া তাঁর হয় না। নিজের যে চাপা আবেগটাকে তিনি খুব ভালো করে চেনেন, সেটাই কোনো কারণে আঘাত খেয়ে জখম হয়েছিল। অন্যথায় এ-রকম হতে পারে না। কিন্তু ও-ভাবে আঘাত দেওয়া দূরে থাক, ওই মেয়েও তো জীবনে তাকে এই প্রথম দেখল মনে হয়। অথচ এমন বিরূপতার মূলে এই মেয়ের সঙ্গেই যে নিবিড় যোগ কোথাও আছে, ডক্টর বসুর তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।

ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে সচকিত হলেন। আরো আগেই ওঠা উচিত ছিল। তাড়াতাড়ি গাড়ি বার করলেন।

.

বাড়ির নম্বর মিলিয়ে গাড়ি থেকে নামতে প্রথমেই দোতলার দিকে চোখ গেল। বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তারই প্রতীক্ষায় উদগ্রীব মনে হল। চোখাচোখি হতে ওপরে উঠে আসতে ইঙ্গিত করলেন তিনি। নিজেও রেলিং থেকে সরে গেলেন।

 বাঙ্গালী-অবাঙ্গালীর মিশেল অভিজাত এলাকা এটা। ছবির মতো ছোট বাড়ি। বাড়ির গায়ে শুধু নম্বর ছাড়া কারো নামের চিহ্ন নেই। ভিতরে ঢুকেও মালিকের রুচির পরিচয় মেলে। বসার ঘরের ভিতর দিয়েই ঢুকলেন তিনি। পরিপাটি করে সাজানো। সুপরিচিত শৌখিন আসবাবপত্র। দেওয়ালে অজ্ঞাত শিল্পীর দুই-একটা হালকা রঙিন ছবি। মেঝেতে পুরু নরম কার্পেট।

ডক্টর বসু এগিয়ে যাবার আগে তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য মহিলাটি নিজেই তরতর করে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে এলেন। তার আগে আরো একটি মাঝবয়সী রমণী সামনে। এসে দাঁড়িয়েছিল। খুব সম্ভব পরিচারিকা। কত্রীকে দেখে সে সসস্ত্ৰমে সরে দাঁড়াল।

আসুন ডাক্তারবাবু।

মহিলা আগে আগে ওপরে উঠতে লাগলেন। ডক্টর বসু তার দুই সিঁড়ি পিছনে। আবারও তাকে দেখামাত্র সেই অস্বস্তি, সেই বিরূপ অভিব্যক্তি। মনের এই অবস্থাটা যেন তার দখলের বাইরে। কোনো সুশ্রী মহিলার বাঁকা সিঁথি দেখলে এই রকম হয় কিনা। চিন্তা করে নিলেন। তক্ষুণি নিজেই আবার বাতিল করলেন চিন্তাটা। সিঁড়ি দিয়ে এভাবে নেমে আসা, ধীর পায়ে এভাবে ওঠা–এও যেন অচেনা নয়, অথচ তিনি চিনতে পারছেন না। তার চোখে এই তনুমাধুর্যও যেন অপরাধ।

 ডক্টর বসু নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করলেন। ভদ্রমহিলা ছেলের অসুখে চিন্তাগ্রস্ত, কাতর। আর তিনি কর্তব্যের ডাকে এসেছেন–এ-কথাই ভাবতে চেষ্টা করলেন। ওপরে উঠেও আরো জনা-দুই মেয়েছেলের মুখই দেখলেন, কোনো পুরুষের মুখ দেখা গেল না।

চারদিক খোলা একটা পরিচ্ছন্ন ঘরের মাঝামাঝি পুরু গদির খাটে রোগী শয়ান। সাত বছরের ফুটফুটে ছেলে। রোগের ধকলে বিবর্ণ, কিন্তু তাও সুন্দর। শিয়রের কাছে নার্স দাঁড়িয়ে।

ব্যাগ রেখে ডক্টর বসু তার সামনে বসলেন। চোখের কোল টেনে পরীক্ষা করলেন, আঙুলের ডগা টিপে দেখলেন। একটুখানি আশ্বাসের আশায় তার মা সশঙ্ক নেত্রে চেয়ে আছেন অনুভব করলেন। যেমনটা তখনো খোঁজায় মগ্ন, তাকে ডক্টর বসু জোর করেই যেন এবারে কাজের দিকে ফেরালেন।

ব্যাগ খুলে ধীরে-সুস্থে কর্তব্য সম্পন্ন করলেন। রক্ত নেওয়া হল। ডক্টর বসু উঠে দাঁড়ালেন। এবারে মহিলার সঙ্গে চোখোঁচাখি হতে মৃদু গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করে বসলেন–আপনার নাম?

যেন রিপোর্ট লেখার জন্যই নামটা জানা দরকার।

–মিসেস নন্দী।

মিস্টার নন্দী কে বা কোথায় থাকেন জিজ্ঞাসা করাটা আর রিপোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত মনে হবে না। তাই জিজ্ঞাসা করা হল না, নইলে জানার ইচ্ছে ছিল।

মহিলা বিনীত অনুরোধ করলেন–ডাক্তারবাবু রিপোর্টটা যদি একটু তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়–যাবে না?

মায়ের এই কাতরতা আর উদ্বেগে তো ভেজাল নেই, তবু যেন কি দেখতে চেষ্টা করছেন ডক্টর বসু!

–তিনটে সাড়ে-তিনটেয় লোক পাঠাবেন।

–আমি নিজেই যাব, ওটা নিয়ে তক্ষুণি আবার–

বলতে বলতে ফীয়ের কথা মনে পড়ল। তক্ষুণি প্রায় ছুটেই ওধারের কোণের একটা টেবিলের ড্রয়ার খুলে কয়েকটা নোট হাতে ফিরে এলেন।–কত দিতে হবে। আমি তো

ডক্টর বসু জানালেন কত দিতে হবে। টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। বারান্দা, সিডি, সেই বসার ঘর, রাস্তা, নিজের গাড়ি। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আর একবার দোতলার বারান্দার দিকে তাকালেন। কেউ নেই। ডক্টর বসু নিজের ওপরেই বিলক্ষণ বিরক্ত। হয়ত কিছুই না, নিছক একটা কাল্পনিক আবেগের ধকল চলছে সেই থেকে। আর, কিছু হলেও এ-রকম আবেগপ্রবণতা ডাক্তারের অন্তত থাকা উচিত নয়।

– বাড়ি ফিরে ল্যাবরেটারিতে ঢুকলেন। এই কাজটাই আগে সারবেন। কাজ নিয়ে বসলেন। তন্ময় হলেন। যত পরীক্ষা করছেন, মায়ের মুখ সরে গিয়ে ছেলেটার মুখই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। বুকের ভিতরটা কেমন খচখচ করছে ডক্টর বসুর।

শেষ হল। তার পরেও চুপচাপ বসে রইলেন খানিক। তারপর রিপোর্ট লেখায় মনোযোগী হলেন। হাতে লেখেন না, ছাপা ফর্মে একবারে টাইপ করে ফেলেন। টাইপ শেষ হল। খামও টাইপ হয়ে গেল।…মায়ের মুখখানাই চোখে ভাসল এবার।

সঙ্গে সঙ্গে কোন মন্ত্রবলে চোখের সামনে থেকে একটা কালো পর্দা সরে গেল যেন। আশ্চর্য, এতক্ষণ এত হাতড়েও যার হদিস মেলে নি, এক মুহূর্তে তাই যেন দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ স্পষ্ট হয়ে উঠল। একটা ঘটনাস্রোত যেন পর পর চোখের সামনে দেখতে পেলেন ডক্টর বসু। খুব অভিনব ঘটনাও কিছু নয়, উলটে মামুলিই বলা চলে। কিন্তু যৌবনস্বরূপিণী রমণীর হিংস্র নির্মম প্রভাবটুকুই বোধ করি ওই ঘটনার অন্তরালে বুকের তলায় দুর্ঘটনার মতো চেপে বসেছিল ডক্টর বসুর। অবচেতন মন থেকে এতকালেও সেটা যায় নি।

দৃশ্যগুলো একে একে আবার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন যেন!…একটি মেয়ে, ওই মিসেস নন্দী, সেদিন কি তার পরিচয় সেটা আজ আর মনে নেই–জীবন বাস্তবে আর যৌবন-বাস্তবে এক পুরুষকে সে চেয়েছিল। চাইতে গিয়ে চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে কিছু ফারাক আছে, সেই প্রথম অনুভব করেছিল। একটা কটাক্ষে, একটুখানি ভঙ্গিতে, ঠোঁটের এক টুকরো বিলোল হাসিতে যে দুনিয়া জয় করতে পারে, এই পরাজয় আগুন হয়ে তার বুকের তলায় ধিকি ধিকি জ্বলছিল। যাকে পেল না  তার সুখের ঘরে আগুন ধরাবার জন্য সেই জ্বালা সে সন্তর্পণে পুষেছে। তারপর আগুন ধরিয়েছে। কামনার নগ্ন পঙ্কিলতার মধ্যে সে একদিন সেই ভাগ্যহত পুরুষকে টেনে নামিয়েছে, নামিয়ে তারপর জাহান্নমের পথে ঠেলে দিয়েছে। পুরুষের অসহায় স্ত্রীটি ছেলে-কোলে করে তার কাছে এসে নতজানু হয়ে স্বামীকে ভিক্ষা চেয়েছে –ভিক্ষা মেলে নি। সুন্দরী রমণীর হিংসা, মাতৃত্বের সঙ্গেও তার আপোষ নেই।

সত্যি ঘটনা নয়, অবাস্তব বাংলা ছবি একটা।

কিন্তু এক যুগ আগে এই ছবি দেখেই ভিতরে ভিতরে ভয়ানক অস্বস্তি আর গ্লানি বোধ করেছিলেন ডক্টর বসু, তার ভিন্ন কারণ। রমণীর মাতৃত্ববোধশূন্য এই অসুন্দরের দিকটা এত দর্শকের মধ্যে শুধু তাকেই হয়ত বিশেষভাবে আঘাত করেছিল।

একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন তিনি। সিনেমা-টিমো বড় দেখেন না, কিন্তু নতুন বউ নিয়ে দৈবক্রমে সেদিন এই ছবিটাই দেখতে এসেছিলেন। আর দেখার পরে মনে হয়েছিল, এটা যেন তাঁর জীবনেই একটা কালো ছায়া বিস্তার করতে এগিয়ে আসছে।

প্রেম নয়, একটি মেয়েকে মনে ধরেছিল। ভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন গোত্রের মেয়ে। সুশ্রী, সপ্রতিভ, মিষ্টি মেয়ে। সেও তাঁকে অপছন্দ করত না। কিন্তু মা বেঁকে বসেছিলেন। মা-ছেলে দুজনারই অভিমান বড় কম নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলে আর বিয়েই করে না দেখে মা-ই প্রথম ভেঙে পড়লেন একদিন। কেঁদে ফেলে বললেন–তোর যাকে খুশি নিয়ে আয়, ঘর সংসার কর, আমি আর বাধা দেব না, বউ এলে আমাকে কাশী পাঠিয়ে দিস।

ডক্টর বসু তারপর বউ ঘরে এনেছেন। নিজের যাকে খুশি তাকে নয়, মায়ের যাকে খুশি তাকে। মা পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন–তোদের জীবন খুব সুখের হবে দেখিস।

 ডক্টর বসু বিশ্বাস করেছিলেন, মায়ের কথার থেকে বড় কিছু নেই। অ-সুখেরও নয় তার সংসার।

 কিন্তু সেদিন ওই ছবি দেখে একটা বড় রকমের নাড়া-চাড়া খেয়েছিলেন ডক্টর বসু। বিয়েতে সেই মেয়েও এসেছিল, হাসিমুখে উপহার দিয়েছে, অভিনন্দন জানিয়েছে, নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে। ততটা তো এগোন নি ডক্টর বসু, কোনোরকম দাগ পড়ার। কথা নয়। তবু সেই মেয়ের চোখ-দুটো এক-একবার যেন বেশি চকচকিয়ে উঠছিল মনে হয়েছে। কদিনের মধ্যে এই ছবির প্রতিক্রিয়া। যাকে একদিন মনে ধরেছিল তাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করতেন ডক্টর বসু। সেই শ্রদ্ধার মেয়েকে ছবির এই মেয়ে কেমন করে যেন গ্রাস করেছিল। ভীতি-বিহ্বল চোখেই ছবিটা দেখেছিলেন। শেষে ছেলে নিয়ে এসে ভিক্ষা চাওয়া সত্ত্বেও যখন আর এক রমণীর মাতৃত্ববোধ বড় হয়ে উঠল না, সেদৃশ্য আর যেন সহ্য করে উঠতে পারছিলেন না ডক্টর বসু।

অভিনেত্রীটি অর্থাৎ আজকের মিসেস নন্দী এই ধরনের ভূমিকার সুপরিচিতা সেই আর্টিস্টই হবেন বোধ করি। কারণ, ছবি শেষ হতে অনেকের, বিশেষ করে স্বল্প মাসুলের দর্শকদের, অনেকরকম চটুল রসালো মন্তব্য শোনা গিয়েছিল। ছবির কষ্ট-কল্পিত আবেদনের থেকেও ছলা-কলাময়ী রমণী-যৌবনের সেই নির্মম স্থল দিকটার আকর্ষণ যাদের কাছে অনেক বেশি।

ছবিটা দেখার পর থেকে ডক্টর বসু সেই মনে-ধরা মেয়েটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগই আর রাখেন নি।

.

সাড়ে-তিনটের দু-পাঁচ মিনিট আগেই মিসেস নন্দী রিপোর্ট নিতে এলেন। শুকনো উদগ্রীব মুখ, আশায় আশঙ্কায় চাপা অস্থিরতা সুস্পষ্ট।

ডক্টর বসু নিঃশব্দে রিপোর্টের খামটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

খামটা হাতে নিলেন তিনি। চোখে কাতর প্রশ্ন, কি শুনবেন সেই শঙ্কায় সাহস করে মুখ ফুটে জিজ্ঞাসাও করে উঠতে পারছেন না। কিন্তু চুপচাপ ফিরে যেতেও পারলেন না শেষ পর্যন্ত।

–কি দেখলেন?—

আগের সেই প্রতিক্রিয়া আর অনুভব করছেন না ডক্টর বসু। বরং একটু বিচলিত বোধ করছেন।

–তেমন ভালো মনে হল না, আপনার ডাক্তারবাবুকে দেখান, তিনি বুঝবেন।

এক নিমেষে সমস্ত আশা যেন নির্মূল হয়ে গেল। স্থাণুর মতো মহিলা দাঁড়িয়ে রইলেন খানিক। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। নিঃশব্দ কান্না। নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

গাড়িটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত ডক্টর বসু ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন।

.

প্রায় বছরখানেক পরে।

ডক্টর বসু বাংলা ছবি দেখতে এসেছেন আবার একটা।

কতকাল বাদে সিনেমা দেখছেন ঠিক নেই। হঠাৎ আসেন নি, অবকাশ বিনোদনের জন্যেও নয়, কাগজে এক রমণীমূর্তির বিজ্ঞাপন আর নাম চোখে পড়তে এসেছেন।

বহুকাল আগের সেই গোছেরই একটা ভূমিকা। তবে এই ছবিতে কিছুটা আত্মত্যাগের মিশেল আছে। হাস্যলাস্যময়ী এক রমণী নিজের যৌবনের অস্ত্রে এক প্রবল প্রমত্ত পুরুষকে বশীভূত করে তার কোপ থেকে এক সাধারণ মানুষকে রক্ষা করছে। ওই সামান্য মানুষটিই একদা তার অনুরাগের পাত্র ছিল।

ছবির প্রগলভ মুহূর্তগুলিতে অনেক হাসাহাসি, স্থূল মন্তব্য, কটুক্তি এমন কি সামনের দিক থেকে শিসও শোনা গেছে। কিন্তু ডক্টর বসু নির্বিকার চিত্তে দেখে গেছেন, দেখার পরে তেমনি নির্বিকার মুখেই প্রেক্ষাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এবারেও চটুল উক্তি কানে এসেছে দুই-একটা। কে একজন তার তরুণ সঙ্গীকে কনুইয়ের গুতো দিয়ে বলছে-কেমন রঙ-ঢঙ দেখলি–একখানা পার্ট দেখালে বটে!

সঙ্গী পালটা উচ্ছ্বাস জ্ঞাপন করল–তার থেকেও চোখের ভাষা দেখেছিস? মাইরি, যেন কটকট করে।

ডক্টর বসু নির্লিপ্ত মুখে নিজের গাড়িতে এসে উঠলেন। তিনি কিছুই দেখেন নি। আর দেখে থাকলেও এরই মধ্যে সব মুছে গেছে। তার চোখে শুধু একটা দৃশ্যই লেগে আছে। সে-দৃশ্য তারই বাড়ির নিচের একটা ঘরের। ছেলের ব্লাড-রিপোর্ট হাতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে এক রমণী ঝরঝর করে কাঁদছে।

সেই মুখের সঙ্গে সকলের মায়ের মুখই খানিকটা করে মেলে বোধ করি।