2 of 3

০৮।১ অষ্টম কাণ্ড : প্রথম অনুবাক

অথর্ববেদসংহিতা অষ্টম কাণ্ড
প্রথম
অনুবাক
প্রথম সূক্ত : দীর্ঘায়ুঃপ্রাপ্তি

[ঋষি : ব্রহ্মা দেবতা : আয়ু ছন্দ : ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ প্রভৃতি ]

মন্ত্রঃ অন্তকায় মৃত্যবে নমঃ প্রাণা অপানা ইহ তে রমন্তাম্। ইহায়মস্তু পুরুষঃ সহাসুনা সূর্যস্য ভাগে অমৃতস্য লোকে। ১। উদেনং ভগগা অগ্রভীদুদেনং সোমো অংশুমান। উদেনং মরুততা দেবা উদিভ্রাগ্নী স্বস্তয়ে। ২৷৷ ইহ তেহসুরিহ প্রাণ ইয়ুরিহ তে মনঃ। উৎ ত্বা নিঋত্যাঃ পাশেভ্যো দৈব্যা বাঁচা ভরামসি ৷৩৷৷ উৎ কামাতঃ পুরুষ মাব পথা মৃত্যোঃ পড়ীশমবমুঞ্চমানঃ। মা চ্ছিখা অস্মাল্লোকাদগ্নেঃ সূর্যস্য সংদৃশঃ ॥৪॥ তুভ্যং বাতঃ পবতাং মারিশ্যা তুভ্যং বর্ষমৃতান্যাপঃ। সূর্যস্তে তন্থে শং তপাথি ত্বাং মৃত্যুদয়ং মা প্র মেষ্ঠাঃ ॥ ৫৷৷ উদ্যানং তে পুরুষ নাবয়ানং জীবাতুং তে দক্ষতাতিং কৃণোমি। আ হি রোহেমমমৃতং সুখং রথমথ জিবিৰ্বিদথমা বদাসি ॥ ৬৷ মা তে মনস্তত্র গাম্মা তিরা ভূন্মা জীবেভ্যঃ প্র মদো মানু গাঃ পিতৃন। বিশ্বে দেব অভি রক্ষন্তু ত্বেহ৷ ৭৷৷ মা গতানামা দীধীথা যে নয়ন্তি পরাবত। আ বোহ তমসো জ্যোতিরেহ্যাঁ তে হস্তৌ রভামহে৷ ৮শ্যামশ্চ ত্বা মা শবলশ্য প্রেষিতৌ যমস্য যৌ পথিরক্ষী শ্বানৌ।। অর্বাঙেহি মা বি দীধ্যো মাত্র তিষ্ঠঃ পরাঙ্গনাঃ ॥ ৯৷৷ মৈতং পন্থমনু গা ভীম এষ যেন পূর্বং নেয়থ ত্বং ব্রবীমি। তম এতৎ পুরুষ মা প্র পন্থা ভয়ং পরস্তাদভয়ং তে অর্বাক। ১০

 বঙ্গানুবাদ –অন্তক, অর্থাৎ সর্বপ্রাণীর অন্ত করেন যিনি, সেই মৃত্যুনামক প্রাণিবিয়োজক দেবতাকে নমস্কার। এঁরই কৃপায় প্রাণ ও অপান জীবের শরীরে বিহার করে থাকে। হে আয়ুষ্কাম মাণবক! এই প্রাণত্যাগের শঙ্কাশীল পুরুষ (সেই মৃত্যুদেবতার কৃপায়) সূর্যের ভাগরূপ পৃথিবীর উপরে প্রাণ ও প্রজাসমূহের (পুত্রপৌত্র ইত্যাদির) সাথে যুক্ত হয়ে নিবাস করুক। (সুর্যের ভাগরূপ অর্থে বোঝানো হচ্ছে–সূর্যের ব্যাপ্তির বিষয়ভূত তিনটি ভাগ–দ্যৌ, অন্তরিক্ষ ও ভু)। ১।

সর্বপ্রাণীর ভজুনীয় ভগ নামক দেবতা, যিনি আদিত্যের মূর্তিবিশেষ, তিনি মূছালক্ষণ অন্ধকারে প্রবেশ করে এই পুরুষকে উদ্ধার করেছেন। চন্দ্রমা ও মরুৎ-বর্গও এই পুরুষকে রক্ষা করেছেন এবং ইন্দ্র ও অগ্নিদেবও একে রক্ষার্থে স্বীকার করে নিয়েছেন ॥ ২॥

হে আয়ুষ্কাম পুরুষ! তোমার– মুখ্য প্রাণ, চক্ষু ইত্যাদি এই শরীরে থাকুক। তোমার পঞ্চবৃত্ত্যাত্মক বায়ুও এবং আয়ু ও মনও এই শরীরে বিদ্যমান থাকুক। নির্ঋতি কর্তৃক অধোগতির পাশবদ্ধ তোমাকে আমরা দৈব বাক্যের (অর্থাৎ মন্ত্রের) দ্বারা উর্ধ্বে রক্ষা করছি (বা পাশমুক্ত করছি) ॥ ৩৷৷

হে পুরুষ! তুমি মৃত্যুর পাশনিচয় (ফঁদগুলি) হতে উক্রমণ করো (অর্থাৎ বহির্গত হয়ে এসো), এর বন্ধনগুলিকে ছিন্ন করে দাও এবং কখনও অগ্নি ও সূর্যের দর্শন রহিত হয়ো না এবং পৃথিবীকেও ত্যাগ করো না। (অর্থাৎ চিরজীবন লাভ করো) ॥ ৪।

হে মুমূষু পুরুষ! অন্তরিক্ষে শ্বাসগ্রহণের নিমিত্ত প্রবাহিত মাতরিশ্বা বায়ু তোমার নিমিত্ত সুখময় হোক, জল তোমার নিমিত্ত পীযুষ-বর্ষক হোক (অর্থাৎ অমৃত সিঞ্চন করুক); সূর্যদেবতা তোমার শরীরের পক্ষে যাতে সুখ হয়, তেমন তাপ বিকিরণ করুন। মৃত্যুদেবতার দয়ায় মরণরহিত হয়ে থাকো, মৃত্যুগ্রস্ত হয়ো না। ৫৷৷

 হে পুরুষ! তুমি মৃত্যুর পাশ হতে উমিত হও; তোমার নিম্ন গমন নেই। আমি তোমার জীবনের নিমিত্ত ঔষধি প্রযুক্ত করছি। তোমার নিমিত্ত বল প্রদান করছি। তুমি ইন্দ্রিয়সুখের কারণভূত শরীররূপ রথে আরোহণ করে অজীর্ণ হয়ে ঘোষণা করো–আমি লব্ধসংজ্ঞ হয়েছি (অর্থাৎ আমি চেতনা লাভ করেছি) ৬

তোমার মন যমের বিষয়ের দিকে যেন গমন না করে এবং যমের বিষয়ে যেন অন্তর্হিত (অর্থাৎ বিলীন) না হয়। তুমি বন্ধুরূপ মনুষ্যগণের প্রতি অযত্নপরায়ণ (অনবধান) হয়ো না (অর্থাৎ বিরক্ত হয়ো না)। তুমি পরলোকগত পিতৃপুরুষগণের অনুগামী হয়ো না। ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতাগণ সকল দিক। হতে তোমার শরীরকে রক্ষা করুন ॥ ৭৷

পিতৃগণের মার্গকে ধ্যান করো না; তারা মৃত্যুপ্রাপ্ত হলেও তোমাকে যেন পুনরায় প্রত্যাবর্তন করিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম না হন। তুমি জ্ঞাননাশরূপ অন্ধকার হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে প্রকাশরূপ জ্ঞানে আরোহণ করো, আমরা তোমার হস্ত ধারণ করে আরোহণের অনুকূল প্রযত্ন করছি। (আরোহণানুকূলপ্রযত্নং কুৰ্ম্ম ইত্যর্থ) ॥ ৮ ৷

 হে মুমূর্ষ পুরুষ! সর্বপ্রাণীর প্রাণাপহর্তা যমের মার্গকে রক্ষাকারী শ্যাম (কৃষ্ণবর্ণ) এবং শবল (বিবিধ বর্ণযুক্ত) নামক কুকুরদ্বয় (দিন ও রাত্রি) তোমাকে যেন বাধা প্রদান না করে। তুমি সেই কুকুরদ্বয়ের দ্বারা সন্দষ্ট (দংশিত) না হয়ে এই স্থানে আগত হও। এই ভূলোকের বিষয় সম্পর্কে নিবৃত্তচিত্ত হয়ে এখানে প্রত্যাবর্তন না করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করো (অর্থাৎ এই ভূলোকের প্রতি আসক্তচিত্ত হয়ে নিবাস করো) ॥ ৯।

 হে আসন্নমৃত্যু পুরুষ! তুমি মৃতগণের মার্গ অনুসরণ করো না। এই মার্গ কত ভয়ঙ্কর, তা মৃত্যুর পূর্বে জানা যায় না। তুমি মরণাত্মক তন্দ্রাকে প্রাপ্ত হয়ো না। যমালয় ভয়াবহ, এবং আমাদের অভিমুখে আগমনের পথ তোমার পক্ষে ভয়হীন (অর্থাৎ মঙ্গলময়–ক্ষেমং ভবতীত্যর্থঃ) ॥ ১০৷৷

সূক্তস্য বিনিয়োগঃ –অন্তকায় মৃত্যবে ইত্যাদি সূক্তং অর্থসূক্তং ইত্যুচ্যতে। অনেন উপনয়নকর্মণি মাণবকস্য নাভিং সংস্পৃশ্য আচার্যো জপং কুর্যাৎ…তথা আয়ুষ্কামস্য অন্তকায় ইতি সূক্তেন শরীরং অভিমন্ত্রয়েত। তথা ঋষিহস্তেন আয়ুষ্কামস্য শরীরং অভিমন্ত্রয়েত সূত্রিতং হি।…তথা ত্রিংশন্মহাশান্তিতন্ত্রভূতায়াং মহাশান্তৌ অন্তকায় ইত্যনেন জপং কুর্যাৎ। উক্তং নক্ষত্রকল্পে। ….ইত্যাদি। (৮কা, ১অ. ১সূ১-১০ ঋ)।

টীকা –অষ্টম কাণ্ডের প্রথম সূক্তের এই ১-১০ ঋকের অন্তকায় মৃত্যবে ইত্যাদি এবং এর পরবর্তী ১১-২১ ঋকের অংশটি মিলিত ভাবে অর্থসূক্ত নামে অভিহিত। এই প্রথমাংশের দ্বারা উপনয়ন কর্মে মাণবকের নাভি স্পর্শ পূর্বক আচার্য জপ করে থাকেন। এই অন্তকায় সূক্তাংশের দ্বারা আয়ুর কামনাশালীর শরীর ঋষি হস্তে অভিমন্ত্রণ করণীয়। মহাশান্তি কর্মে এই অন্তকায় ইত্যদি মন্ত্র জপ করণীয় ॥ (৮কা, ১অ. ১সূ১-১০ঋক)।

মন্ত্রঃ রক্ষন্তু ত্বগ্নয়ো যে অস্বন্তা রক্ষতু ত্বা মনুষ্যা যমিন্ধতে। বৈশ্বানররা রক্ষতু জাতবেদা দিব্যা মা প্র ধাগ বিদ্যুতা সহ ৷ ১১। মা বা ব্যাভি মংস্তারাৎ সংকসুকাচ্চর। রক্ষতু ত্বা দ্যৌ রক্ষতু পৃথিবী সূর্যশ্চ ত্ব রক্ষতাং চন্দ্রমাশ্চ। অন্তরিক্ষং রক্ষতু দেবহেত্যাঃ ॥ ১২৷৷ বোধশ্চ ত্বা প্রতীবোধশ্চ রক্ষতামস্বপ্নশ্চ নবদ্রাণশ্চ রক্ষতা। গোপায়ংশ্চ ত্ব জাগৃবিশ্চ রক্ষতাম্ ॥ ১৩৷৷ তে ত্ব রক্ষন্তু তে ত্বা গোপায়ন্তু। তেভ্যো নমস্তেভ্যঃ স্বাহা। ১৪। জীবেভ্যস্থা সমুদ্রে বায়ুরিন্দ্রো ধাতা দধাতু সবিতা ত্ৰায়মাণঃ। মা ত্বা প্রাণো বলং হাসীদসুং তেনু হুয়ামসি। ১৫৷৷ মা ত্বা জম্ভঃ সংহনুর্মা তমো বিদম্মা জিহ্বা বহিঃ প্রময়ুঃ কথা স্যাঃ। উৎ ত্বাদিতা বসবো ভরদিন্দ্রাগ্নী স্বস্তয়ে ॥ ১৬৷৷ উৎ ত্বা দৌরুৎ পৃথিব্যুৎ প্রজাপতিরগ্রভীৎ। উৎ ত্বা মৃত্যোররাষধর সোমরাজ্ঞীরপীপর। ১৭৷৷ অয়ং দেবা ইহৈবায়ং মামুত্র গাদিতঃ। ইমং সহস্রবীর্যেণ মৃত্যোরুৎ পারয়ামসি। ১৮ ৷৷ উৎ ত্ব মৃত্যোরপীপরং সং ধমন্তু বয়োধসঃ। মা ত্বা ব্যস্তকেশ্যো মা ত্বাঘরুদো রুদন্ ॥ ১৯৷৷ আহামবিদং ত্বা পুনরাগাঃ পুনৰ্ণবঃ। সর্বাঙ্গ সর্বং তে চক্ষুঃ সর্বমায়ুশ্চ তেহবিদ ৷৷ ২০৷ ব্যবাৎ তে জ্যোতিরভূদপ ত্বৎ তমো অক্রমীৎ। অপ মৃত্যুং নির্ঋতিমপ যক্ষ্মং নি দসি ॥ ২১।

বঙ্গানুবাদ –হে রক্ষাকামী রাজা! যে অগ্নি বাড়বা ইত্যাদিরূপে জলের মধ্যে অবস্থিত, সেই বড়বানল তোমাকে রক্ষা করুক। আহ্বানীয় অগ্নি ও বৈশ্বানর অগ্নিও তোমাকে রক্ষা করুক। হে রক্ষার কামনাশালী পুরুষ! বৈদ্যুতাগ্নিও তোমাকে যেন হিংসা না করে। ১১।

 মাংসাশী ক্রবাদ অগ্নি যেন তোমাকে তার আহার রূপে মান্য না করে। তুমি সংকসুক নামক শবভক্ষণকারী অগ্নি হতেও দূরস্থ হয়ে বিচরণ করো। সূর্য, চন্দ্র, আকাশ ও পৃথিবীও তাদের আপন আপন সম্বন্ধীয় ভীতি ই হতে তোমাকে রক্ষা করুন। দৈবপ্রেরিত আয়ুধসমূহ হতে অন্তরিক্ষ তোমাকে রক্ষা করুন। ১২।

বোধ, প্রতিবোধ, অস্বপ্ন, অনিদ্রা, গোপায় (সর্বদা দেহের রক্ষণক) জাগৃবি (জাগরণশীল) নামক ঋষি বা দেহাশিত প্রাণ-অপান-মন-বুদ্ধি ও চক্ষুদ্বয় রূপ ইন্দ্রিয়াভিমানী দেবতা তোমাকে রক্ষা করুন। (৫ম কাণ্ডের ৩০ সূক্তের ১০ম মন্ত্রে বোধ ও প্রতিবোধ নামক ঋষির কথা উক্ত হয়েছে। বোধ অর্থে সর্বদা প্রতিবুধ্যমান এবং প্রতিবোধ অর্থে প্রতিবন্তু বা প্রতিক্ষণে বুধ্যমান)। ১৩।

 সেই হেন বোধ ইত্যাদি তোমাকে সর্বদা রক্ষা করুন। সেই ঋষি নামে অভিহিত দেবতাগণকে নমস্কার। তাদের উদ্দেশে এই হব্য স্বাহুত হোক ॥ ১৪৷

বায়ু, ইন্দ্র, ধাতা ও সূর্য তোমাকে মৃত্যুর গ্রাস হতে নিষ্কাসিত করে তোমার পুত্র-ভার্যা ইত্যাদিকে তাদের আনন্দের নিমিত্ত প্রদান করুন। প্রাণ ও বল তোমায় যেন ত্যাগ করতে সক্ষম না হয়। তাদের আমরা তোমার আনুকূল্যে আহ্বান করছি ॥ ১৫

 জম্ভ নামক সংহতহনু অস্কুলদন্তশালী রাক্ষস যেন তোমাকে ভক্ষণার্থে না প্রাপ্ত হতে সমর্থ হয়। রাক্ষসের জিহ্বাও যেন তোমার নিকট উপনীত হতে না পারে এবং অজ্ঞানতাও যেন। তোমার নিকট না থাকে ॥ ১৬৷

 ধাতা, অষ্টবসু, ইন্দ্র, অগ্নি, আকাশ ও পৃথিবী তোমাকে মৃত্যুর মুখ হতে নিষ্ক্রান্ত করুন। সর্বদেবতার পিতৃস্বরূপ প্রজাপতি তোমাকে মরণ হতে রক্ষা করুন এবং সোমরাজ্ঞী (অর্থাৎ সোমের পত্নীস্বরূপা) ঔষধিদেবীগণ তোমার পোষণ করুক ॥ ১৭৷

 হে অদিতির পুত্র দেবগণ! এই পুরুষ এই পৃথ্বী লোকেই অবস্থান করুক, যেন স্বর্গলোকে না গমন করে। আমরা অত্যন্ত শক্তিশালী (বা সহস্রবীর্যসম্পন্ন) রক্ষা-সাধনের দ্বারা একে মৃত্যুর নিকট হতে আকর্ষণপূর্বক আনয়ন করছি। (অর্থাৎ মৃত্যু যাতে একে তার আপন অধিকারে রক্ষা করতে না পারে, তেমন করছি)। ১৮

হে আয়ুর কামনাকারী পুরুষ! মৃত্যুর কবল হতে তোমাকে রক্ষার উদ্দেশে অন্নের বা আয়ুর ধারণকর্তা দেবগণ তোমাকে সন্ধান করুন (বা ধারণ করুন)। তোমার ব্যাপ্তকেশা (অর্থাৎ কেশবন্ধন উন্মুক্তকারিণী) বন্ধুপত্নীগণ যেন (তোমার শোকে অভিভূত হয়ে) অশ্রুপাত না করে। তোমার বান্ধবগণও যেন রোদনরহিত হয়ে থাকে। ১৯

হে মৃত্যুগ্রস্ত পুরুষ! আমি তোমাকে মৃত্যুর মুখ হতে আহরণ বা আকর্ষণ করে (অর্থাৎ ছিনিয়ে নিয়ে) পুনরায় প্রাপ্ত হয়েছি। তোমার পুনর্জন্ম হয়েছে, অতএব তুমি পুনরায় নবীন হয়ে গিয়েছে। তোমাকে আমি শত সম্বৎসরের আয়ুর দ্বারা লব্ধবান করিয়েছি। এইবার সবকিছু তোমার চক্ষুগোচর হোক এবং সকল ইন্দ্রিয় আপন আপন কার্যে সক্ষম হোক। (মৃত্যু না হলেও দৃঢ়রোগগ্রস্তের প্রায়ই অঙ্গবৈকল্য ঘটে থাকে, সেই নিমিত্তই নিরাময়ের সাথে সাথে তার সকল অঙ্গ পূর্ণ-সমর্থ হয়ে উঠুক, এটাই বক্তব্য)। ২০৷

 হে চৈতন্যতাহীন (বিসংজ্ঞ) পুরুষ! তুমি জ্ঞানহীনতার কারণে তমসাচ্ছন্ন হয়ে ছিলে, এক্ষণে জ্ঞান বা চৈতন্যের প্রাপ্তির ফলে সেই তমসা তোমার নিকট হতে অপসারিত হয়ে গিয়েছে। আমরা তোমার নিকট হতে পাপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী নির্ঋতিকে এবং প্রাণাপহত্রী দেবতা মৃত্যুকে দূর করে দিয়েছি এবং সেই সঙ্গে নিঃশেষে দূর করে দিয়েছি তোমার অন্তরস্থ ও বাহ্যিক সকল ব্যাধিকেও। ২১।

বিনিয়োগঃ –রক্ষন্তু ত্ব ইত্যস্য মন্ত্রস্য উপনয়নকর্মাদিযু পূর্বৰ্মন্ত্রেণ সহ উক্তো বিনিয়োগঃ। তথা হিরণ্যগর্ভাখ্যে মহাদানে রক্ষন্তু ত্ব ইত্যনেন কর্তৃ রক্ষাং কুর্যাৎ।…তথা অশ্বরথাখ্যমহাদানে অনেন অনেন যজমানং অভিমন্ত্রয়েত।….ইত্যাদি। (৮কা, ১অ. ১সূ-১১-২১ ঋক)।

 টীকা— প্রথম অনুবাকের প্রথম সূক্তের এই একাদশটি মন্ত্রের বিনিয়োগ পূর্ববর্তী মন্ত্রগুলির সাথেই উক্ত। যেমন, রক্ষন্তু, ত্বা ইত্যাদি মন্ত্র উপনয়ন কর্মে বিনিয়োেগ করণীয়। সেই সঙ্গে এই মন্ত্রগুলির দ্বারা হিরণ্যগর্ভাখ্য মহাদানে রক্ষাবিধান করণীয়। অশ্বরথাখ্য মহাদানেও এই মন্ত্রের দ্বারা যজমানকে সূত্রোক্ত প্রকারে অভিমন্ত্রিত করণের বিধান আছে।…ইত্যাদি ৷ (৮কা, ১অ. ১-১১-২১ঋক)।

.

 দ্বিতীয় সূক্ত : দীর্ঘায়ুঃপ্রাপ্তিঃ

[ঋষি : ব্রহ্মা দেবতা : আয়ু ছন্দ : ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ, পংক্তি, জগতী, বৃহতী ]

মন্ত্রঃ (তত্র আ রভস্বেতি প্রথমসূক্তে প্রথমা।] আ রভস্বেমামমৃতস্য মুষ্টিমচ্ছিদ্যমানা জরদষ্টিরস্তু তে অসুং তে আয়ুঃ পুনরা ভরামি রজস্তমো মোপ গা মা প্র মেষ্ঠাঃ ॥১॥ জীবতাং জ্যোতিরভ্যেহ্যবাঙা ত্বা হরামি শতশারদায়। অবমুঞ্চ মৃত্যুপাশানশস্তিং দ্রাঘীয় আয়ুঃ প্রতরং তে দমি। ২। বাতাৎ তে প্রাণমবিদং সূর্যাচ্চক্ষুরহং তব। যৎ তে মনয়ি তৎ ধারয়ামি সং বিস্বার্বৈদ জিহুয়ালপ। ৩ প্রাণেন ত্বা দ্বিপদাং চতুষ্পদামগ্নিমিব জাতমভি সং ধমামি। নমস্তে মৃত্যো চক্ষুষে নমঃ প্রাণায় তেইকরম্ ৷৷ ৪৷৷ অয়ং জীবতু মা মৃতেমং সমীরয়ামসি। কৃপোম্যস্মৈ ভেষজং মৃত্যো মা পুরুষং বধীঃ ॥ ৫৷৷ জীবলাং নৃঘারিষাং জীবন্তীমোষধীমহম। ত্রায়মাণাং সহমানাং সহস্বতীমিহ হুবেম্মা অরিষ্টতাতয়ে ৷৷ ৬৷৷ অধি ব্রহি মা রভথাঃ সৃজেমং তবৈব সর্বহায়া ইহাস্তু। ভবাশবৌ মুড়তং শৰ্ম যচ্ছতমপসিধ্য দুরিতং ধৰ্ত্তমায়ুঃ ॥৭॥ অস্মৈ মৃত্যো অধি ব্রহীমং দয়স্বাদিতোয়মেতু। অরিষ্টঃ সর্বাঙ্গঃ সুশ্রুজ্জরজা শতহায়ন আত্মনা ভুজমতাম্ ॥ ৮৷৷ দেবানাং হেতিঃ পরিত্ব বৃণ পারয়ামি জ্বা রজস উৎ জ্বা মৃত্যোরপীপর। আরাদগ্নিং ক্ৰব্যাদং নিরূহং জীবাতবে তে পরিধিং দধামি। ৯৷৷ যৎ তে নিয়ানং রজসং মৃত্যো অনবধ্যম। পথ ইমং তস্মাদ রক্ষন্তো ব্রহ্মাস্মৈ বর্ম কৃশ্মসি ॥ ১০

বঙ্গানুবাদ –হে আয়ুর কামনাশালী পুরুষ! আমাদের দ্বারা ক্রিয়মান অমৃতের (অমরণত্বের) প্রস্রবণ অনুভব করতে উপক্রম করো। এই উদকধারা অপরের দ্বারা অচ্ছিদ্যমান এবং তোমার বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত স্থায়ী থাকুক। তুমি রজঃ ও তমঃ গুণকে প্রাপ্ত না হয়ে অহিংসিত হয়ে থাকো। তোমার নিমিত্ত আমি মৃত্যুর দ্বারা অপহরিত প্রাণ ও আয়ুকে পুনরায় আনয়ন করছি। (রজঃ– আমাদের সত্ত্বগুণের প্রতিবন্ধক এবং তমঃ-আবরক অর্থাৎ হিতাহিতবিবেকপ্রতিরোধক) ॥ ১।

হে পুরুষ! তুমি আমাদের সম্মুখে জীবিত মনুষ্যের জ্যোতি বা দীপ্তি বা জ্ঞান (অর্থাৎ চৈতন্যতা) প্রাপ্ত হও। তুমি নিন্দা রহিত হয়ে থাকো; আমি তোমাকে, জ্বর-শিরোরোগ ইত্যাদি মৃত্যুর নানাবিধ পাশবন্ধন ছিন্ন করে আনয়ন করছি। আমি তোমাতে শত সম্বৎসর লক্ষণ (দীর্ঘ) আয়ু স্থাপনা করছি৷৷ ২

হে আসন্ন মৃত্যু পুরুষ! আপন আশ্রয়ভূত বাহ্যবায়ুর নিকট হতে (সকাশাৎ) আমি তোমার প্রাণবায়ুকে, প্রাপ্ত করে নিয়েছি। সূর্য হতে তোমার নেত্রকে প্রাপ্ত করে নিয়েছি, (কারণ, পূর্বে মৃত্যু সময়ে চক্ষুষঃ সূর্যপ্রাপ্তেঃ এবং উৎপত্তিসময়েও সূর্যাদেববাৎপত্তেঃ–এমনই বলা হয়ে থাকে)। তোমার যে মন মৃত্যুর সময়ে বহির্গত হয়ে গিয়েছিল, তাকে তোমার দেহে পুনঃ প্রবিষ্ট করাচ্ছি। তুমি সর্বাঙ্গসম্পন্ন হয়ে জিহ্বা আন্দোলিত করে স্পষ্ট আলাপন করো। ৩।

 হে নিঃসৃতপ্রাণ পুরুষ! যেমন মন্থন হতে জাত অতি ক্ষীণ বা মৃদু অগ্নি মুখায়ুর ফুকারে সমিদ্ধ (জ্বালিত) করা হয়, তেমনই তোমাকে দ্বিপদ-চতুষ্পদ ইত্যাদি সকল প্রাণীর প্রাণের দ্বারা প্রভূত প্রাণবন্ত করছি। হে মৃত্যু! তোমার প্রকৃষ্ট প্রাণবল ও ক্রুর দর্শনশক্তিকে নমস্কার। ৪

এই পুরুষ যেন মৃত্যুপ্রাপ্ত না হয়। আমরা এই পুরুষের চিকিৎসায় সচেষ্ট হয়ে আছি। হে মৃত্যু! তুমি একে বিনাশ করো না ॥ ৫॥

পাঠা নামে আখ্যাত মহিমোপেত ঔষধিকে আমি শান্তি কর্মের নিমিত্ত আহূত করছি। এই ঔষধি জীবনদায়িনী, চির-অশুষ্কা, রোগপরিহারের দ্বারা রক্ষাকর্তী, এবং বলদাত্রী। আমি এই হেন ঔষধিকে এই পুরুষের অমৃতত্বের নিমিত্ত গ্রহণ (বা প্রয়োগ) করছি। ৬।

 হে মৃত্যু! তুমি অধিকার নিয়ে বলো–এ আমার জন (মদীয়োয়ং ইতি বদ) একে হিংসিত (বা বিনাশ) করতে উদ্যত হয়ো না। এ তোমারই, অতএব এর প্রাণকে গ্রহণ করো না। এ এই পৃথিবীর উপর সকল প্রকার গতি প্রাপ্ত হোক। হে ভব! হে শর্ব! তোমরা উভয়ে সুখী হয়ে (অর্থাৎ সন্তুষ্ট হয়ে) এই পুরুষকে সুখ প্রদান করো। এর উপস্থিত ব্যাধি ইত্যাদি লক্ষণসমন্বিত পাপ নিরাকৃত করে একে আয়ুষ্মন করো ৭

হে মৃত্যু! তুমি অধিকার নিয়ে বলো–এ আমার অনুগ্রহের যোগ্য (অসৌমদনুগ্রহার্য ইতি শব্দং কুরু)। এর উপর কৃপা করো। এ মরণহীন ও চক্ষু ইত্যাদি ও সুষ্ঠু শ্রবণশক্তি সহ সকল অঙ্গসম্পন্ন হয়ে থাকুক। এ যথাকালে বৃদ্ধাবস্থা প্রাপ্তি পূর্বক অনন্যাপেক্ষ হয়ে (অর্থাৎ নিজ সামর্থেই) শত সম্বৎসরের আয়ু ভোগ করুক ॥ ৮

হে পুরুষ! দেবতাগণের অস্ত্র যেন তোমার উপর পতিত না হয়, তোমাকে যেন হিংসা না করে। আমি তোমাকে মূছলক্ষণযুক্ত আবরণ হতে রক্ষা করছি (পারয়ামি বা পালয়ামি); আরও, তোমাকে মৃত্যুর সমীপ হতে উদ্ধার করছি এবং দূরদেশবর্তী ক্ৰব্যাদ নামক মাংসভক্ষী অগ্নি হতে অপসারিত করিয়ে দিচ্ছি। তোমার জীবনের নিমিত্ত দেবযজন অগ্নিকে স্থাপনারূপ প্রাচীর নির্মাণ করে দিচ্ছি। ৯।

হে মৃত্যু! তোমার রজোময় মার্গে ধর্ষণ করণে কেউ সমর্থ হবে না। এই মূৰ্হিত পুরুষকে রক্ষা করতে আমরা একে এই মন্ত্ররূপ কবচ ধারণ করিয়ে দিচ্ছি। ১০

বিনিয়োগঃ –আ রভস্ব ইতি সূক্তত্ৰয়ং অর্থসূক্তং। তেন উপনয়নকর্মণি মাণবকস্য নাভিং সংস্পৃশ্য আচার্য জপং কুর্যাৎ। সূত্রিতং হি।…তথা আয়ুষ্কামঃ আ রভস্ব ইতি সূক্তত্রয়েণ শরীরং অভিমন্ত্রয়েত। তথা ঋষিহস্তেন আয়ুস্কামস্য শরীরং অনেন্যাভিমন্ত্রয়েত। সূত্রিতং হি।…তথা ন রণাখ্যে কর্মণি অনেনার্থসূক্তেন কুমারস্য হস্তে অবিচ্ছিন্নাৎ উদকধারাং নিনয়েৎ। তথা তস্মিন্নেব কর্মণি অনেনার্থসূক্তেন দেবদারুমণিং সম্পাত্য অভিমন্ত্র্য বর্ধীয়াৎ। তস্যৈব মণিং নিধৃষ্য পায়নং চ কুর্যাৎ। তৎ উক্তং কৌশিকেন।…অন্ত্যেষ্টৌ আরভস্ব ইতি ত্রিভিঃ প্রেতাগ্নিং আদীপয়েৎ। ত্রিংশন্মহাশান্তিতন্ত্রভূতায়াং মহাশূন্তৌ আ রভস্ব ইত্যেতজ্জপেৎ। উক্তং নক্ষত্রকল্পে।….ইত্যাদি। (৮কা, ১অ. ২সূ-১-১০ ঋক)৷৷  

টীকা –উপযুক্ত দ্বিতীয় সূত্তের প্রথম দশটি মন্ত্রাংশ পরবর্তী মন্ত্রাংশগুলির সাথে একত্রে অর্থসূক্ত নামে অভিহিত। (প্রথম সূক্তের অনুরূপ)। এখানেও এই.দ্বিতীয় সূক্তটি উপনয়নকর্মে মণবকের নাভি স্পর্শ করে আচার্য কর্তৃক জপনীয়। উপনয়নকর্মের প্রকরণ সূত্রে বর্ণিত আছে। এই সূক্তমন্ত্রগুলি প্রথম সূক্তের মতোই আয়ুষ্কামীর শরীর ঋষিহস্তে অভিমন্ত্রণে বিনিয়োগ করা হয়। এ ছাড়া কুমারের নামকরণ কর্মে, মৃতের অন্ত্যেষ্টিতে প্রেতাগ্নি-আদীপনে বা মহাশান্তি কর্মে এই মন্ত্রগুলির জপ ইত্যাদির বিনিয়োগ নক্ষত্রকল্পে উক্ত আছে।..ইত্যাদি। (৮কা, ১অ. ২সূ১-১০ঋ)।

মন্ত্রঃ কৃণোমি তে প্রাণাপানৌ জরাং মৃত্যুং দীর্ঘায়ুঃ স্বস্তি। বৈবস্বতেন প্রহিতান যমদূতাংশ্চরতোইপ সেমি সর্বান ॥ ১১ আরাদরাতিং নিঋতিং পরো গ্রাহিং ক্ৰব্যাদঃ পিশাচা। রক্ষো যৎ সর্বং দুর্ভূতং তৎ তম ইবাপ হম্মসি। ১২। অগ্নেষ্টে প্রাণমমৃতাদায়ুষ্মতো বন্ধে জাতবেদসঃ। যথা ন রিষ্যা অমৃতঃ সজুরসস্তৎ তে কৃণোমি তদু তে সমৃধ্যতাম্ ॥ ১৩ শিবে তে স্তাং দ্যাবাপৃথিবী অসংতাপে অভিশ্রিয়ৌ। শং তে সূর্য আ তপতু শং বাতো বাতু তে হৃদে। শিবা অভি ক্ষরন্তু ব্যাপো দিব্যাঃ পয়স্বতীঃ ॥ ১৪৷৷ শিবাস্তে সন্তোষধয় উৎ ত্বাহামধরস্যা উত্তরাং পৃথিবীমভি। তত্র ত্বদিত্যৌ রক্ষং সূর্যাচন্দ্রমসাবুভা ॥ ১৫ যৎ তে বাসঃ পরিধানং যাং নীবিং কৃণুষে ত্ব। শিবং তে তম্বৈ তৎ কৃন্মঃ সংস্পর্শেদ্ৰক্ষ্মমস্তু তে॥ ১৬৷ যৎ ক্ষুরেণ মৰ্চয়তা সুতেজসা বপ্তা বপসি কেশশ্মশ্রু। শুভং মুখং মা ন আয়ুঃ প্র মোষীঃ ॥ ১৭ ৷৷ শিবৌ তে স্তাং ব্রীহিযবাববলাসাবদোমধৌ। এতৌ যক্ষ্মং বি বাধেতে এতৌ মুঞ্চতে অংহসঃ ॥ ১৮ ৷৷ যদশ্নাসি যৎ পিবসি ধান্যং কৃষ্যাঃ পয়ঃ। যদাদ্যং যদনাদ্যং সর্বং তে অন্নমবিষং কৃপোমি। ১৯৷৷ অহু চ জ্বা রাত্ৰয়ে চোভাভ্যাং পরি দদ্মসি। অরায়েভ্যো জিঘসুভ্য ইমং মে পরি রক্ষত। ২০৷৷

বঙ্গানুবাদ –হে আয়ুর কামনাশালী পুরুষ! আমি তোমার দেহে ঊর্ধ্ব ও অবধাদিকে সঞ্চারিণী প্রাণ ও অপান বায়ুকে স্থিত করছি। তোমার নিমিত্ত দীর্ঘ আয়ু প্রযোজিত করে তোমাকে জরা ও মৃত্যুর অস্পৃশ্য করে দিচ্ছি। আমি যম-দূতগণকে মন্ত্রশক্তির দ্বারা দূর করে তোমার নিমিত্ত স্বস্তি প্রতিষ্ঠিত করছি। ১১।

আমরা শত্রুভূতা, সম্মুখস্থ হয়ে গ্রহণশীলা (পুরো গ্রাহিং), কলহ সৃষ্টিকারিণী পাপ দেবতা নির্ঋতিকে হিংসিত (অর্থাৎ হত) করছি। মাংসভক্ষক পিশাচবর্গকে হিংসা (হনন) করছি এবং অন্ধকারের ন্যায় আবরণ সৃষ্টিকারী রাক্ষসগণকে সংহার করছি ॥ ১২

হে  পুরুষ! নির্ঋতি ইত্যাদি কর্তৃক তোমার প্রাণ অপহৃত হয়েছে। আমি অমৃতত্বশালী জাবেদা অগ্নির নিকট হতে তোমার প্রাণ প্রার্থনা করছি। তুমি যাতে মৃত্যুপ্রাপ্ত না হও (অর্থাৎ হিংসিত না হও)। তেমনই শান্তি কর্ম অনুষ্ঠিত করছি। এই কর্ম তোমার পক্ষে সমৃদ্ধকারী হোক ॥ ১৩৷

হে কুমার! তোমার নিষ্ক্রমণ সময়ে (অথবা গো দান ইত্যাদির দ্বারা সংস্ক্রিয়মাণ হে পুরুষ!) তোমার নিমিত্ত আকাশ ও পৃথিবী মঙ্গলময়ী হোক, শ্রীবৃদ্ধি করণশালিনী হোক। সূর্যও তোমাকে সুখপ্রদ তাপ প্রদান করুন; বায়ুও তোমার মনের অনুকূলে (অর্থাৎ মনোমত রূপে সঞ্চারিত হোক; জলসমূহ স্বাদযুক্ত ও কল্যাণ করণশালী হয়ে প্রবাহিত এবং বর্ষিত হোক ॥ ১৪

হে কুমার! তোমার আহারার্থ উপযুজ্যমান ব্রীহি ইত্যাদি ঔষধিসমূহ তোমাকে সুখী করুক। তোমাকে নীচের পৃথিবী হতে উত্তরের পৃথিবীতে উধৃত করা হয়েছে। সেই স্থানে অর্থাৎ সেই উত্তরের পৃথিবীতে, হে বালক! অদিতি-পুত্র সূর্য-চন্দ্র দেবদ্বয় তোমাকে রক্ষা (বা পালন) করুন ॥ ১৫

হে বালক! তোমার পরিধানের উপরে যে আচ্ছাদনীয় (অর্থাৎ উত্তরীয়) বস্ত্র আছে, যে বস্ত্র তুমি নীবি বা নাভিদেশে বন্ধন করেছে, সেই দুপ্রকার বস্ত্রই তোমার শরীরের পক্ষে সুখকর করে দিচ্ছি। সেই বস্ত্রের সংস্পর্শে যাতে তুমি কোমলতা অনুভব করো, তেমন করছি। ১৬।

হে দেব সবিতা! বা হে সংস্কারক পুরুষ! বপ্তা (অর্থাৎ নাপিত) যখন তার সুন্দর ও তীক্ষ্ণ ক্ষুরের দ্বারা এই বালকের মস্তকের কেশ ও মুখমণ্ডলের শ্মশ্রু বপন বা মুণ্ডন করছে, তখন গোদান উপনয়ন ইত্যাদি সংস্কারসমূহকে প্রাপ্ত করিয়ে বালকের মুখ তেজস্বী (বা দীপ্ত) করে দাও। আমাদের পুত্রের আয়ুকে ছেদন করে নিও না (প্র মোষীঃ)। ১৭ ॥

 হে বালক! তোমার ভক্ষণের যোগ্য ব্রীহি, যব ইত্যাদি অন্নসমূহ মঙ্গলকর অর্থাৎ শরীরের বলকে অক্ষীণ কারক; এবং উপযোগের (অর্থাৎ ভোজনের) পরে মধুর হোক। এই ব্রীহি, ধান্য শরীরগত যক্ষ্মা ইত্যাদি ব্যাধির বিশেষরূপে বাধক হোক। এগুলি এই কুমারকে সকল পাপ হতে মুক্ত রাখুক ॥ ১৮ ॥

হে কুমার! যে ধান্য তুমি কাঠিন্যের সাথে ভক্ষণ করে থাকো এবং পয়োবৎ সারভূত পিষ্টময় যে অন্ন তুমি পান করে থাকো, সুখের বা সরলতার সাথে ঘা ভক্ষণীয় (আদ্য) বা অত্যন্ত কটুতিক্তত্বের জন্য যা অভক্ষণীয় (অনাদ্য), আমি তোমার সেই সকল অন্নকেই বিষরহিত (অর্থাৎ অমৃত) করে দিচ্ছি। ১৯৷৷

হে কুমার! আমরা তোমাকে রাত্রির অভিমানী দেবতা এবং দিনের অভিমানী দেবতার উদ্দেশে তোমার রক্ষণের নিমিত্ত সমর্পণ করছি। হে সকল দেবতাবৃন্দ! তোমরা এই বালককে (অর্থাৎ কুমারকে) ধনহীন বা ধনের অপহরণশালী এবং ভোজনেচ্ছু বা হননেচ্ছু (জিঘৎসু) রক্ষঃ-পিশাচ ইত্যাদির কবল হতে রক্ষা করো। ২০।

বিনিয়োগঃ— কৃণোমি তে প্রাণাপানৌ ইতি মন্ত্রস্য আ রভস্ব ইত্যনেন সহ উক্তো বিনিয়োগঃ 1…ইত্যাদি। (৮কা, ১অ, ২সূ-১১-২০ ঋক)৷৷

টীকা –মূল গ্রন্থে উপযুক্ত ১০টি মন্ত্র আ রভস্ব এই দ্বিতীয় সূক্তেরই অন্তর্গত। সুতরাং এই মন্ত্রগুলি ঐ অংশের মতোই উপনয়নকর্ম, নৈঋতকর্ম, গো-দান ইত্যাদির সংস্কার, বালকের নিষ্ক্রমণকর্ম, মহাশান্তি কর্ম, মিথ্যাভিশাপনিবৃত্তিকর্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশনকর্ম, ইত্যাদিতে সূত্রোক্তপ্রকারে বিনিয়োেগ করণীয়।.. ইত্যাদি। (৮কা, ১অ. ২সূ-১১-২০ঋক)।

মন্ত্রঃ শতং তেহযুতং হায়নান্ দ্বে যুগে ত্রীণি চত্বারি কৃশ্মঃ। ইন্দ্রাগ্নী বিশ্বে দেবাস্তেইনু মন্যন্তামরূণীয়মানাঃ। ২১।অথর্ববেদ-সংহিতা শরদে ত্বা হেমন্তায় বসন্তায় গ্রীষ্ময় পরি দসি। বর্ষাণি তুভ্যং স্যোনানি যে বর্ধন্ত ওষধীঃ ॥ ২২। মৃত্যুরীশে দ্বিপদাং মৃত্যুরীশে চতুষ্পদাম্। তস্মাৎ ত্বাং মৃত্যোগোপতেরুরামি স মা বিভেঃ ২৩৷৷ সোহরিষ্ট ন মরিষ্যসি ন মরিষ্যসি মা বিভেঃ। ন বৈ তত্র ম্রিয়ন্তে নো যন্ত্যধমং তমঃ ২৪৷৷ সর্বো বৈ তত্র জীবতি গৌরশ্বঃ পুরুষঃ পশু। যত্ৰেদং ব্রহ্ম ক্ৰিয়তে পরিধিজীবনায় কম। ২৫৷৷ পরি ত্বা পাতু সমানেডভ্যাভিচারাৎ সবন্ধুভ্যঃ। অমর্ভিমৃতোহতিজীবো মা তে হাসিমুরসবঃ শরীর৷ ২৬৷৷ যে মৃত্যব একশতং যা নাষ্ট্রা অতিতাৰ্যাঃ। মুঞ্চন্তু তস্মাৎ ত্বং দেবা অগ্নেবৈশ্বানরাদধি ॥ ২৭৷ অগ্নেঃ শরীরমসি পারয়িষ্ণু রক্ষোহাসি সপত্নহা। অথো অমীবচাতনঃ পূতুর্নাম ভেষজম্ ॥ ২৮৷৷

 বঙ্গানুবাদ –হে বালক! তোমার শত সম্বৎসরের পরমায়ুকে অযুতসংখ্যক করে দিচ্ছি। আমরা তোমার নিমিত্ত দাম্পত্য রূপে এক যুগ, সন্তান রূপে দ্বিতীয় বা দুই যুগ, এবং এইভাবে এরও অধিক যুগ করে দিচ্ছি। (অথবা সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি ইত্যাদি চতুযুগ সমন্বিত বহু বহু যুগ পর্যন্ত তোমার পরমায়ু করে দিচ্ছি। দেবগণ অক্রোধিত হয়ে আমাদের নিবেদনের উপর অনুমতি প্রদান করুন। (সায়ণের ভাষ্যে বলা হয়েছে–যদ্যপি একশত বর্ষ পর্যন্তও আয়ু মনুষ্যগণের পক্ষে ন সম্ভবতি, তথাপি আকল্প জীব কল্পায়ুশষ্যং অস্ত ইত্যাদি আশিস্ দানের ন্যায় এখানেও বালকের দীর্ঘ আয়ু কামনা করা হয়েছে–এটাই তাৎপর্য)। ২১।

 হে বালক! রক্ষার নিমিত্ত আমরা তোমাকে শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতুর অভিমানী দেবতাগণের উদ্দেশে সমর্পণ করছি। বৎসরের তিনশত ষাট (বা পয়ষট্টি) দিবস (ষষ্ঠুত্তরশতত্রয়দিনসংখ্যাকানি) তোমাকে সুখ দানশালী হয়ে থাকুক এবং তোমার ভোগসাধনভূত ঔষধি সমূহকেও বর্ধনশালী হয়ে থাকুক। ২২।

 মৃত্যু হলো দ্বিপদ মনুষ্য-পক্ষী ইত্যাদি এবং চতুষ্পদ গো-অশ্ব ইত্যাদি সকল প্রাণীর অধিপতি। আমি সেই হেন মৃত্যুরূপ ঈশ্বরের পাশবন্ধন হতে তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি; এই নিমিত্ত মৃত্যু হতে ভয়ভীত হয়ে তুমি ভীতি ত্যাগ করো ৷৷ ২৩৷

হে অরিষ্ট অর্থাৎ দৈববিমুখ অথবা নিরস্তহিংস পুরুষ! তুমি মৃত্যুকে ভয় করো না, কারণ তুমি মৃত্যুপ্রাপ্ত হবে না, অতএব আমি মরে যাবো এমন ভয় ত্যাগ করো। এই শান্তি কর্মের কারণে মনুষ্য মৃত্যু হতে রক্ষা প্রাপ্ত হয়ে থাকে, অথবা মরণকালীন দুঃসহ মূচ্ছাও প্রাপ্ত হয় না। অথবা শান্তিকর্ম-করণশালী জন মৃত্যুর পর দুষ্কর্কের নিমিত্ত প্রাপ্তব্য অধোলোকে স্থিত সবিতৃপ্রকাশশূন্য ঘোরান্ধকারকে প্রাপ্ত হয় না ॥ ২৪

যেস্থানে রাক্ষস পিশাচ ইত্যাদিকে নিবারণের নিমিত্ত প্রাচীর-রূপে শান্তিকর্ম অনুষ্ঠিত করা হয়, সেই স্থানে গো-অশ্ব ইত্যাদি পশু এবং মনুষ্য সকলে প্রাণময় হয়ে অবস্থিত থাকে ৷ ২৫।

 হে শান্তিকর্ম সাধনে ইচ্ছুক পুরুষ! আমার কর্ম তোমাকে সকল দিক হতে রক্ষিত রাখুক। সমান পুরুষ, সমান বান্ধব ইত্যাদির দ্বারা কৃত অভিচার ইত্যাদি হিংসা কর্ম হতেও এই শান্তিকর্ম তোমাকে রক্ষা করুক। তুমি অমামঃ অর্থাৎ অমরণশীল হও, অমৃত অর্থাৎ মরণহীন হও এবং অতিজীব অর্থাৎঅতিশায়িত জীবন ভোগ করো। তোমার চক্ষু ইত্যাদি ইন্দ্রিয়রূপ অমুখ্য প্রাণসমূহ এবং প্রসিদ্ধ মুখ্য প্রাণ তোমার দেহ হতে নিষ্ক্রান্ত হবে না; তুমি দীর্ঘজীবন লাভ করো ৷৷ ২৬৷৷

 যমের জ্বর-শিরোব্যথা ইত্যাদি একশত সংখ্যক মুখ্যভূত অস্ত্র আছে, এবং নাশকারী অতিতরীতব্যা শক্তি আছে; সেগুলি সেগুলি উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব হয় না। সেই মৃত্যু নাশক শক্তিসমূহ হতে ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতা রক্ষা করুন এবং তারা তোমাকে বৈশ্বানর অগ্নি হতেও রক্ষা করুন। ২৭।

হে পূত-নামক বৃক্ষ! তুমি অগ্নির পারয়িষ্ণু অর্থাৎ পারপ্রাপক শরীর হয়ে আছো। তুমি রাক্ষস ও শত্রুগণের সংহারক। তুমি রোগনাশক ও ঔষধি-স্বরূপ। সেই হেন পূত আমাদের কামনার পূর্ণতা সাধিত করুক। ২৮

বিনিয়োগঃ –শতং তেযুতং ইত্যস্য মন্ত্রস্য আ রভস্ব (৮/২) ইত্যনেন সহ উক্তো বিনিয়োগ। গোদানাদিষু কর্মসু ব্রীহিযবৌ শরদে ত্ব ইত্যভিমন্ত্ৰ কুমারস্য মূর্ধি দদ্যাৎ।…ইত্যাদি। (৮কা, ১অ. ২সূ-২১-২৮ ঋ)।

টীকা –উপযুক্ত ২১ হতে ২৮তম মন্ত্রগুলি দ্বিতীয় সূক্তেরই অন্তৰ্গত; সুতরাং এগুলির বিনিয়োগ পূর্ব সূক্তেরই অনুরূপ। পূত প্রসঙ্গে ভাষ্যে কথিত হয়েছে…পূতদ্রনামক হলো সকল অরিষ্ট নিবর্তক রক্ষামণির উপাদানভূত বৃক্ষবিশেষ। এই বৃক্ষের অভ্যন্তরে অগ্নির অবস্থান থাকায় এটিকে অগ্নির শরীর বলা। হয়ে থাকে। (বৃক্ষস্যান্তঃ অগ্নেরবস্থানাৎ শরীরত্বব্যপদেশঃ। বিশেষতঃ অস্য বৃক্ষস্য শরীরত্বাভিধানং। অথবা পারয়িষ্ণুরিতি পৃথদ্বিশেষণং।..ইত্যাদি। (৮কা, ১অ, ২সূ–২১-২৮ ঋক)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *