০১. দিনটা সকাল থেকেই মেঘলা

দিনটা সকাল থেকেই মেঘলা। দুপুরের দিকে বেশ একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল। তারপর আর বৃষ্টি নেই বটে, কিন্তু আকাশ থমথম করছে কালো মেঘে। জোলো বাতাস দিচ্ছে।

এমন দিনে মনে একটা কি-করি কি-করি ভাব হয়। দু-একখানা বিলিতি ম্যাগাজিন বন্ধুদের কাছ থেকে চেয়ে এনে পরে পড়ব বলে জমিয়ে রেখেছিলাম। এখন সেগুলো উলটে–পালটে দেখলাম বাদলার দিনের মেজাজের সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছে না।

কি করা যায়? স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করব? নাঃ, সাত বছর বিয়ে হয়ে যাবার পর আর বাদলার দিনে খোলা জানলার ধারে স্ত্রীকে নিয়ে কাব্য চলে না। যতই নিষ্ঠুর শোনাক, কথাটা সত্য। মহাকালের নির্মমতা এবং অতীত সুখের দিন সম্বন্ধে বিমর্ষ ভাবে চিন্তা করছি, এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠল।

উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি কিশোরী সেন। ভেতরে ঢুকে কাদামাখা রবারের পাম্প ছাড়তে ছাড়তে সে হেসে বললে, এই বর্ষার দিনে বাড়ি বসে করছ কি?

বললুম, যে অশ্ব নেই তার তৃণ সংগ্রহ করছিলুম। খুব ভাল হয়েছে তুমি এসেছ। একেবারে মিয়োনো দিন, না?

কিশোরী বললে, আর বসে কাজ নেই। একটা জামাটামা যাহোক কিছু গলিয়ে নাও। চল, তারানাথ জ্যোতিষীর বাড়ি ঘুরে আসি। আর কিছু না হোক, দুএকটা আজব গল্প তো শোনা যাবে। এমন দিনেই তো উদ্ভটগল্প জমে–

তারানাথের কথা আমার যে কেন আগেই মনে পড়েনি তা ভেবে অবাক লাগল। বললুম, বসো, ধুতিটা বদলে নিই—

পথে বেরিয়ে বললুম, ট্রামে উঠে কাজ নেই। মাসের শেষ, সেই আট পয়সা দিয়ে বরং। সিগারেট কেনা যাবে। হেঁটে মেরে দিই চল। এইটুকু তো পথ—

কিশোরীরও মাসের শেষ। আট পয়সার পাশিং শো কিনে হাঁটতে হাঁটতে দুজনে মট লেনে তারানাথের বাড়ি হাজির হলুম।

দরজা খুলে দিল তারানাথের মেয়ে চারি। আমাকে দেখেই বললে, কাকাবাবু, আজ আমার লেসের ডিজাইন ভোলেননি তো? রোজরোজ-ই আপনি ভুলে যান–

আজ ভুলিনি। আগে থেকেই পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। বের করে হাতে দিতে চারি হাসিমুখে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে বললে, বসুন, বাবাকে ডাকি–

খবর পেয়ে তারানাথ খুব খুশী হয়ে বেরিয়ে এল। বহুদিনের মধ্যে তারও এমন একনিষ্ঠ শ্রোতা ও ভক্ত জোটেনি। গল্পে লোক শ্রোতার মর্ম বোঝে। তক্তাপোশে বসতে বসতে তারানাথ বললে, তারপর, হঠাৎ যে?

বললুম, ভাল লাগছিল না বাড়ি বসে। তাই আড্ডা দিতে চলে এলুম। দু’একখানা গল্প হবে নাকি?

তারানাথ স্পষ্টতই খুশী হল, বললে, বসো, বসো জমিয়ে আগে। কি খাবে বল? ও চারি, চারি। এদিকে শোন দিকি একবার–

চারি এসে দাঁড়াতে তারানাথ বললে, যা দিকি চট করে তেল-নুন-কাঁচালঙ্কা দিয়ে মুড়ি মেখে নিয়ে আয়। পরে চা দিবি।

তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললে, কি গল্প বলব? তোমরা তো এসব বিশ্বাস করো না—

কিশোরী বললে, অমনি বলে বসলেন বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস যদি না-ই করব, তাহলে এই বাদলায় এতখানি পথ ঠেঙিয়ে এলুম কি করতে?

—সে গল্প শোনার লোভে। নাস্তিক আর অবিশ্বাসীরাই অলৌকিক গল্পের ভাল শ্রোতা হয়। আমি বললুম, আপনার কাছে এতদিন আসছি, আপনি কিন্তু আমাদের অলৌকিক কিছু দেখালেন না—

তারানাথ উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, মানে শূন্যে হাত নেড়ে সন্দেশ রসগোল্লা আনা? জলকে মন্ত্র পড়ে সরবৎ করে দেওয়া? তোমাকে তো একদিন বলেছি, ওসব খুব নিম্নশ্রেণীর শক্তি—ভেলকি ও করায় গুরুর বারণ ছিল। তবে করিনি কি? করেছি। কম বয়েসে ভক্তদের অবাক করার জন্য, পয়সা রোজগারের ফিকিরে করেছি কিছু কিছু। বাকি শক্তিও তাতেই গেল। ওতে কিছু নেই বাপু-আসল তান্ত্রিক কখনো ভেলকি দেখায় না।

কিশোরী বললে, আচ্ছা, সাধুরা যে চোখ বুজে ত্রিভুবন ত্রিকাল সামনে দেখতে পান, এখানে বসে বিলেতে কি হচ্ছে সব বলে দিতে পারেন, এসব কি বিশ্বাসযোগ্য।

তারানাথ জোর দিয়ে বললে, নিশ্চয়। সদগুরু পেলে আর প্রকৃত সাধনা করতে পারলে তুমিও পারবে।

—যেমন?

—যেমন ধর, সদ্যোমৃত কোনো চণ্ডালের শব থেকে মুণ্ড কেটে এনে অমাবস্যা বা সংক্ৰাত্তি তিথিতে শ্মশানে গর্ত করে তাতে সেই মুণ্ড নিক্ষেপ করতে হবে। পরে গভীর রাতে সেই গর্তের ওপর পদ্মাসনে বসে মাথার ওপরে মরা দাঁড়কাকের বঁদিকের ডানা রেখে এক লক্ষ বার বীজমন্ত্র জপ করলে তুমিও সর্বজ্ঞ হতে পার।

কিশোরী বললে, বীজমন্ত্রটি কি?

তারানাথ বললে, সেটি বলা যাবে না। তন্ত্রে অদীক্ষিত লোকের কাছে সাধনার গুহ্যমন্ত্র বলা নিষেধ। বীজমন্ত্ৰই আসল কিনা—

চারি তেলে জবজবে করে মুড়ি মেখে নিয়ে এল। খেতে খেতে বললুম, আপনি কখনও সত্যিকারের কাপালিক দেখেছেন?

কিশোরী জিজ্ঞেস করলে, তান্ত্রিক আর কাপালিকে পার্থক্য আছে নাকি কিছু?

তারানাথ বললে, পার্থক্য আছে। তবে সে সব তোমাদের বোঝানো কঠিন, জেনেও তোমাদের কোন কাজ নেই। হ্যা, কাপালিক দেখেছি কিছু। কিন্তু একবারের স্মৃতি কখনও ভুলতে পারব না।

তারানাথ যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে গেল।

বললুম, বলুন না সে গল্প, বেশ লাগবে শুনতে।

–বলছি এখন। তোমরা খেয়ে নাও আগে। সে এক ভয়াবহ কাহিনী হে অনেকদিন বাদে মনে পড়ে গেল। এখনও মনে হলে গায়ে কাটা দেয়।

আমি বললুম, এ ঘটনা কি মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাবের আগের?

–বটেই। আমার ভবঘুরে জীবনের একেবারে প্রথম দিকে ঘটেছিল। তখনও আমি বীরভূমের মাতু পাগলীকে দেখিনি। চা এনেছিস? রাখ এই তক্তাপোশেই—নাও, চা খাও—

আমরা চায়ে চুমুক দিলাম। তারানাথ গল্প শুরু করলে।

আমার বয়েস তখন বাইশ-তেইশ। বাড়িতে আর ভাল লাগে না। আমাদের গ্রামের ধারে বাঁধানো বটতলায় একবার এক বিচিত্রদর্শন সাধু এসে সাত-আটদিন বাস করেছিল। সামনে ধুনি জ্বালিয়ে চুপ করে বসে থাকে। মাথায় চূড়ার মত উচু জটার ভার। চোখ দুটো বেশ শান্ত। গ্রামের অনেকেই তার কাছে গিয়ে দুধ, ফলমূল এসব দিয়ে আসত। বৌ-ঝিরা বায়ন করত মাদুলিতাবিজের জন্য। সাধু কিন্তু কখনও ভড়ং দেখায়নি, অলৌকিক শক্তি দেখিয়ে ভক্ত যোগাড়ের চেষ্টা করেনি। কেউ বেশি বিরক্ত করলে বলত—আমি কিছু জানি নে মা, আমার কোন ক্ষমতা নেই। ভগবানকে ডাক, ভগবান সব ঠিক করে দেবেন। বেশি ধরাধরি করলে বলত—আচ্ছা যা, আমি তোর হয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবো। এই সততার জন্য এবং কারো কাছ থেকে পয়সা না নেওয়ায় সাধুর ওপর আমার কেমন একটা আকর্ষণ জন্মালো। গেলাম একদিন সাধুর বটতলায়।

একদিকে বসে আছি। নানারকম লোক এসে নানান বায়না করছে সাধুর কাছে। সাধু সবাইকেই হেসে বিদায় করছে। এসব মিটতে মিটতে বিকেল গড়িয়ে অন্ধকার নেমে এল। এবার আমি আর সাধুই কেবল রয়েছি বটতলায়।

পাশ থেকে একখানা চালাকাঠ তুলে ধুনিতে গুজে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সাধু বলল, আয়, এগিয়ে এসে বোস।

আমি সাধুর সামনে ধুনির এপাশে গিয়ে বসলাম। ধুনির আলোয় সাধু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সন্ন্যাসী হবার ইচ্ছে আছে, না?

আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।

–তোর সে-সব হবে না। তবে তোর কপালে অনেক সাধুসঙ্গ আছে দেখছি। কিছু শক্তিও পাবি। কিন্তু সংসারে থাকতেই হবে তোকে।

আমি বললাম, আপনি তো কাউকে কিছু বলেন না। আমাকে এত কথা বলছেন। কেন?

সাধু একটু চুপ করে বসে থেকে বলল, তোর কপালে তন্ত্রসাধনার চিহ্ন আছে— কিন্তু অস্পষ্ট। তার অর্থ কিছুদূরে গিয়ে তারপর ফিরে আসতে হবে। এ চিহ্ন না দেখতে পেলে তোকে এসব কথা বলতাম না। তোর অধিকার আছে জানার।

আমি উৎসুক হয়ে উঠলাম। বললাম, আর কি দেখতে পাচ্ছেন সাধুজী?

—আর যা দেখতে পাচ্ছি তা খুব ভাল নয়।

—কি রকম?

–বছরখানেকের ভেতর তোর খুব বড় বিপদ আসছে। ভালই হয়েছে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে তোর। নইলে প্রাণসংশয় হতে পারত।

বললাম, কি রকম বিপদ কিছু বলবেন না? তাহলে তার থেকে বাঁচব কি করে?

সাধু বলল, তা আমিও ঠিক বলতে পারছি না। জানলে নিশ্চয় বলতাম। তুই এসে বসবার পর থেকেই আমার মনে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। এখন তোর দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি তোর পেছনে একটা অন্ধকারের স্তুপ যেন চাপ বেঁধে আছে।

আমি চমকে পেছন দিকে তাকাতেই সাধু হেসে বলল, তুই দেখতে পাবি না, আমি দেখতে পাচ্ছি।

আমি বললাম, এক বছরের মধ্যেই যে বিপদ ঘটবে তা কি করে বলছেন? আগে বা পরেও তো হতে পারে।

–-ওটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বোধ হয় ভুল করিনি।

চুপ করে বসে রইলাম। বলা বাহুল্য সাধুর কথা শুনে একটু গা শিরশির করছিল। কেউ যদি জানতে পারে তার পেছনে একটা অদৃশ্য চাপবাধা অন্ধকার ঘুরছে তাহলে তার ভাল লাগার কথা নয়। তার ওপর নির্জন জায়গা–গ্রামের বাইরের দিকে বটগাছটা। ধুনিতে পটপট করে কাঠের গাট পোড়বার শব্দ হচ্ছে। সাধু আর আমি ছাড়া কোনোদিকে আর কেউ নেই।

সাধু বলল, তোকে আমি একটা জিনিস শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ভাল করে শিখে রাখ। যদি কোনোদিন কখনও বিপদ আসছে বলে মনে হয়, কি কোনো অস্বস্তি বোধ করিস, তাহলে এই প্রক্রিয়াটা করবি। যতই বিপদ আসুক, প্রাণটা বেঁচে যাবে।

বললাম, কি প্রক্রিয়া সাধুজী?

সাধু বলল, নে, ভাল করে দেখ। আর এই মন্ত্রটা মুখস্থ করে নে। একে বলে গাত্রবন্ধন।

শিখতে বেশিক্ষণ লাগল না। বললাম, কিন্তু বিপদ যে আসছে, তা বুঝতে পারব কি করে?

সাধু একটু হাসল, তারপর বলল, তুই ঠিক বুঝতে পারবি। তোর কপালে তন্ত্রসাধনার চিহ্ন আছে, বললাম না? সময় হলে আমার মত মনের মধ্যে বিপদের ঘণ্টা বেজে উঠবে। আমি যেমন আজ তোর বিপদ বুঝতে পারলাম।

বললাম, কিন্তু আমি তো পারিনি।

—আজ থেকে তোকে কিছুটা শক্তি দিলাম। যা, ভালমন্দ যাই আসুক, তুই আগে থেকে আন্দাজ করতে পারবি।

আমি হাতজোড় করে বললাম, আমাকে আপনার শিষ্য করে নিন। আমি দীক্ষা নেব আপনার কাছে।

সাধু ভ্রূ কুঁচকে বলল, ওসব হবে-টবে না। আমি কাউকে শিষ্য করি না। আবদার করিস না—যা, কেটে পড়।

—আবার কবে আপনার দেখা পাব?

—এমনিতে দেখা পাবি না। তবে যদি সত্যি কখনও তোর প্রাণসংশয় ঘটে, তাহলে তোকে সাবধান করে দেব।

তারপরেই একটা আধপোড়া কাঠ তুলে নিয়ে ধুনি খুঁচিয়ে দিতে দিতে বলল—যা যা, ভাগ—পালা!

বাড়ি ফিরে এলাম। পরদিনই সেই সাধু আস্তানা ভেঙে কোথায় চলে গেল কে জানে। পরদিন বিকেলে বটতলায় গিয়ে দেখি শুধু নিভে যাওয়া ধুনির ছাই আর কতগুলো আধপোড়া কাঠ পড়ে আছে।

মাসখানেক কাটল। কিছুই যেন আর ভাল লাগে না। কেবলই বাড়ির বের হয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। পথ যেন দারুণ আকর্ষণে টানছে। কেবল যে ধর্মের স্পৃহা তা নয়, একটা ভবঘুরেমি পেয়ে বসল। আরো কিছুদিন এভাবে কাটাবার পর একদিন সত্যিই কয়েকটা জামাকাপড় আর দশটা টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

বাড়ির লোক খোঁজাখুঁজি করবে এবং সন্ধান পেলেই ধরে নিয়ে যাবে বাড়িতে। এজন্য সারাদিনই প্রায় হাঁটতাম, যতটা দূরে গিয়ে পড়া যায়। রাত্তিরে আশ্রয় নিতাম কোন গৃহস্থের বাড়িতে। তখনকার লোকজন ছিল ভাল। অভাব ছিল না, গোলাভর্তি ধান, পুকুরভর্তি মাছ নিজের গরুর দুধ। অতিথিকে যত্ন করতে সে যুগের লোক ক্রটি করত না। অব্রাহ্মণ গৃহস্বামী হলে গোয়ালঘরের একপাশ পরিষ্কার করে রান্নার আয়োজন করে দিত। সেখানে বসে রাধতাম। তারা আবার অপেক্ষা করত ব্রাহ্মণের প্রসাদ পাবার।

কিশোরী প্রশ্ন করল, জিনিসপত্রের দাম তখন কি রকম ছিল?

তারানাথ বলল, গায়ের দিকে বেশির ভাগ জিনিসই কিনে খেতে হত না। সবই তো গ্রামেই উৎপন্ন হত। তবে হ্যাঁ, মনে আছে একবার আমি আর আমার বন্ধু হরমোহন মাংস খাবার শখ হওয়ায় পাশের গ্রাম থেকে দশ আনা দিয়ে একটা পাঠা কিনে এনে দুজনে রান্না করে খেয়েছিলাম। তাও হরমোহন বার বার বলছিল আমরা ঠকেছি, আর একটু দরাদরি করলে আট আনার ভেতরেই হয়ে যেত।

আমি অবাক হয়ে বললাম, দশ আনায় একটা আস্ত পাঁঠা?

–বটেই। সে-সব সস্তাগণ্ডার বাজার তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।

—দুজনে মিলে গোটা পাঁঠাটা খেয়ে ফেললেন?

-তা পারব না কেন? গাঁয়ের ছেলে, আমাদের খিদেও ছিল আর অম্বলের ব্যামোতেও ভুগতাম না। আমার খাওয়ার কথা আর কি শুনছ? আমার বাবার খাইয়ে হিসেবে দশটা গায়ের মধ্যে নামডাক ছিল। সে গল্প বলব এখন পরে একদিন।

কিশোরী বলল, হ্যাঁ, যে গল্প হচ্ছিল সেটা হোক।

তারানাথ বলতে শুরু করল।

এভাবে কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়ে বিরক্তি ধরে গেল। রোজ রোজ অকারণে পথ হাটা, লোকের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া, তাদের দাক্ষিণ্যে ভাল ভাল খাওয়া—শুধু খাওয়ার জন্যই কি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি? বাড়িতে কি আমার ভাতের অভাব ছিল? কিন্তু যা চাই তা পাই কই?

যাই হোক, পথ হেঁটে ক্লান্ত অবস্থায় একদিন সন্ধ্যেবেলা এক গ্রামে এসে পৌঁছলাম। গ্রামটায় ঘনবসতি নেই, একটু ছাড়া ছাড়া বাড়িঘর। আম-জাম বাঁশবাগানে ভরা। একটা বড় আমবাগানের পাশে কাদের বেশ সুন্দর বাড়ি দেখে সেখানেই আশ্রয় নেব ভাবলাম। সুন্দর বলতে পাকা বাড়ি নয়, পোড়ো চালের বড় বড় আট-দশখানা ঘর মাঝখানে উঠোনকে ঘিরে। বিরাট উঠোনে ধানের গোলা, একপাশে গোয়ালে ক’খানা গরু সাজালের ধোয়ার মধ্যে বসে বসে জাবর কাটছে। আমি উঠোনে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মধ্যে শাঁকে ফুঁ পড়ল। সব মিলিয়ে সম্পন্ন গৃহস্থের লক্ষণ ফুটে বেরুচ্ছে।

উঠোনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, একজন কালোমত মধ্যবয়স্ক লোক এগিয়ে এসে বলল, কি চাই?’

বললাম, আমি বিদেশী লোক, রাত্তিরটা একটু থাকবার সুবিধে হবে কি?

—আপনারা?

–ব্রাহ্মণ।

লোকটা আসুন আসুন করে ব্যস্ত হয়ে আমায় নিয়ে দাওয়ায় বসাল, পা ধোয়ার জল দিল। তার নাম মাধব ঘোষ, সে-ই বাড়ির মালিক। চাষ-বাস আছে প্রায় পঞ্চাশ বিঘের। মাধব লোক বেশ ভাল, আমাকে রান্নার ব্যবস্থা করে দিয়ে সে ঠায় বসে রইল সামনে। বসে গল্প করে, আর একটু বাদে বাদে হুকো-টিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, সাজুন, ব্রাহ্মণের প্রসাদ পাব।

কথায় কথায় আমি বললাম, আমাদের বাংলাদেশের আতিথেয়তা বড় সুন্দর, না? এই যে তুমি আমাকে এত যত্ন করছ, এতে তোমার লাভ কি?

জিভ কেটে মাধব বলল, আজ্ঞে ও কথা বলবেন না। ব্রাহ্মণ-দেবতার হাড়িতে দুটি চাল দিতে। পারছি—সে তো আমার সৌভাগ্য। তবে কথা কি জানেন, সব অতিথি তো আবার সমান হয় না—এই তো, দিন সাতেক আগে আমাদের বাড়িতে সে এক কাণ্ড।

ধোয়া সুগন্ধি আতপচাল হাড়িতে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে ফিরে বললাম, কেন, কি হয়েছিল? চুরি-টুরি নাকি?

-–তাহলে তো বরং ছিল ভাল। শুনুন না কাণ্ড। এই ঠিক গেল সোমবার বিকেলের দিকে এক লাল কাপড় পরা সন্নোসী এসে বলে তোমার এখানে থাকব। আমার সাদা মনে কাদা নেই, বললুম—থাকুন। গোয়ালঘরে রান্নার ব্যবস্থা করে দিলুম। দিব্যি চেহারা তার—ফর্সা রঙ, এই মোটা পৈতের গোছা, দেখে কিছু বোঝবার উপায় নেই।

নিঃশেষিত কলকেটি উপুড় করে তামাকের গুল ঝেড়ে কলকেটি একপাশে রেখে মাধব বলল, সে রাত্তিরে কিছু হল না। পরের দিন সকালে সন্ন্যেসী যাওয়ার সময় আমাকে বললে—কাল যে মেয়েটি রান্নার জিনিসপত্র এগিয়ে দিচ্ছিল, সে তোমার কে হয়?

আমি বললাম–আমার মেয়ে। কেন বলুন তো?

তারপর, কি বলব আপনাকে, সন্ন্যেসী যা বলল তা শুনে তো নিমেষে আমার। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছে। বলে কি, তোমার ওই মেয়েটি আমাকে দাও, আমি ভৈরবী করব। ওর শরীরে ভৈরবীর চিহ্ন রয়েছে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, তারপর?

মাধব ঘোষ বলল, তারপর আর কি, আমার চেচামেচিতে পাড়ার লোক জড় হয়ে গেল। বললুম, যাও ঠাকুর, ব্রাহ্মণ বলে শুধু পার পেয়ে গেলে। নইলে মাধব ঘোষের মেয়ের দিকে নজর দিয়ে এ গ্রাম থেকে আর বেরুতে হত না। সন্ন্যেসী আমার দিকে কম করে তাকিয়ে যাবার সময় বলে গেল, কাজটা ভাল করলি না, তোর মেয়ে উদ্ধার হয়ে যেত। প্রতিফল হাতে হাতে পাবি।

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম, বললাম, বল কি হে, এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! লোকটা আর আসেনি তো?

মাধব ঘোষ হেসে বলল, আর তার আসতে সাহস হবে না। সন্ন্যেসী হলেও প্রাণের মায়া তো আছে।

মাধব ঘোষের যত্নের সত্যি তুলনা নেই। খাওয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, একটা বড় জামবাটিভর্তি দুধ এনে সে একটু দূরে নামিয়ে রাখল। আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আবার দুধ কেন?

–আজ্ঞে, খান ওটুকু। ব্রাহ্মণ-সেবা করলে আমার কল্যাণ হবে।

পরের দিন সকালে উঠে আমি মাধবের কাছে বিদায় নিলাম। সে ছাড়তে চায় না কিছুতেই। আমি প্রায় জোর করে চলে এলাম বলা যায়। কারণ আগেই বলেছি, আমি দুটো ভাতের জন্য পথে বের হইনি। সরল মানুষের ঘাড়ে চেপে অকারণে অনুধ্বংস করতে আমার খারাপ লাগল। এই পথে আবার কখনও এলে তার বাড়িতে আশ্রম নেব কথা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

দুপুরে একটা গঞ্জ মত জায়গায় চিড়ে-দই কিনে খাই, তারপর আবার হাটি। সারাদিনে প্রায় মাইল পনেরো-ষোল হেঁটে সন্ধ্যে নাগাদ একটা এমন জায়গায় এসে পৌঁছলাম যার ত্রিসীমানায় কোন গ্রাম বা জনবসতি নেই। রুক্ষ, পাদপহীন প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে একটা ছোট্ট কি নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। কি করব ঠিক করতে না পেরে নদীর ধার ধরে হেঁটে এগুতে লাগলাম। মিনিট পনেরো হেঁটে দেখি সামনে এক শ্মশান। বেশ বড় শ্মশান। অন্তত যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখলাম কেবল পোড়া পোড়া কাঠের গুড়ি, ছেড়া মাদুর—কাথা, ভাঙা কলসী—এইসব পড়ে আছে।

কিশোরী বললে, ওই নিজন শ্মশানে সন্ধ্যেবেলা আপনার ভয় করল না?

—নাঃ। ভয় করবে কেন? শ্মশান অতি পবিত্র স্থান, সেখানে মানুষের সমস্ত পাপ শেষবারের মত মুছে যায়, তার উধ্বলোকে প্রস্থানের পথ সুগম হয়। শ্মশানে ভয় কিসের?

যাই হোক, দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখছি, হঠাৎ গম্ভীর ভারী গলায় পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল—এখানে কি চাই?

কি ভয়ানক গলার স্বর! লোহার ড্রামে পাথরকুচি ঢাললে এমন শব্দ হতে পারে। চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি একজন সাধু দাঁড়িয়ে। মাথায় পাকা তেঁতুলের মত অজস্র জটা। মুখময় অযত্নবর্ধিত দাড়িগোঁফের জঙ্গল। লম্বায় আমার মাথা ছাড়িয়ে আর এক হাত। পরনে রক্তাম্বর, পায়ে বউল দেওয়া কাঠের পুরু খড়ম।

–কি দরকার এখানে?

সাধুকে প্রণাম করে বিনীতভাবে জানালাম আমার বিশেষ কোন দরকার নেই, পথ হাটতে হাঁটতে এসে পৌছিয়েছি—এই মাত্র।

—কোথায় যাওয়া হবে?

—কোথাও না।

–মানে?

—ঠিক নেই।

—সাধু কি বুঝলে জানি না। কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকল, তারপর তার দাড়ির জঙ্গলে খুব সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে বলল, আয় আমার সঙ্গে।

সেই ঘনায়মান অন্ধকারে আমি সাধুর পেছনে চললাম। বেশ খানিকটা হাটবার পর দেখি একটা গাব বা ওই জাতীয় কোন গাছের নীচে সাধু মড়ার মাদুর, কাঁথা ইত্যাদি টাঙিয়ে বেশ ঝুপড়ি মত বানিয়েছে। বললাম, এইখানে আপনি থাকেন?

-–কেন, অসুবিধেটা কি?

সাধুর কথাবার্তা যেন কেমন কেমন। আমি বললাম—না, অসুবিধে আর কি? তাই বলছি—

সাধু আমাকে ঝুপড়ির বাইরে বসতে বলে নিজে ভেতরে ঢুকল। বেরিয়ে এল দুটো পাকা কলা হাতে নিয়ে। বলল, এই নাও, খাও—

নিলাম।

-–কি উদ্দেশ্যে বেরুনো হয়েছে বাড়ি থেকে? সাধু হবার ইচ্ছে নাকি?

আমি উত্তর না দিয়ে কলা হাতে চুপ করে বসে রইলাম।

–তুই আমার কাছে থেকে যা। আমি তোকে চেলা করে নেব। থাকবি?

তারপর সাধু একটা কথা বলল যা আমাকে আমাদের গ্রামের বটতলার সেই সাধুও বলেছিল। বলল, তোর কপালে তন্ত্রসাধনার চিহ্ন আছে। থেকে যা তুই আমার কাছে।

আমি একটু ফাপরে পড়লাম। এই সাধুকে দেখে আমার তেমন ভক্তির উদয় হয়নি, বরং কেমন একটু অস্বস্তিই হয়েছে। এত সহজে নিজে থেকে চেলা করে নিতে চাইল দেখে সে ভাব বেড়েছে বই কমেনি। ভাল সাধু কখনও কথায় কথায় শিষ্য করে বেড়ায় না। অবশ্য আমার আর চিন্তা কি? থাকি ক’দিন, ভাল না লাগলে কেটে পড়ার বাধা কোথায়? সাধুসঙ্গের জন্যই তো বেরিয়েছি, বাজিয়ে দেখতে দোষ কোথায়?

বললাম, থাকব।

সাধু বলল, বেশ। আমি একটা বিশেষ সাধনা করছি। সেটা ক’দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর তোকে দীক্ষা দেব।

—কি সাধনা?

—সে আছে। সময় হলেই জানাব। তাছাড়া তোর সাহায্যও আমার দরকার হতে পারে। থেকে গেলাম সাধুর কাছে। দু-চারদিন কেটে গেল।

সাধু আমাকে একলা ফেলে রেখে সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে কি সব সংগ্রহ করে আনে। বোধ হয় নিজের সাধনার জিনিসপত্র। রাত্তিরে বসে অনেকক্ষণ ধরে পুজো সে সময়টা আচ্চা আর জপতপ করে।-আমি একটু দূরে কাঠকুটো দিয়ে আগুন জেলে মাটির হাড়িতে ভাতেভাত রান্না করি। অনেক রাত্তিরে খাওয়া হয়।

ক্রমে সাধুর কাণ্ডকারখানা দেখে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস হল সাধু একজন কাপালিক। একদিন একটা মরা চড়ুইপাখি কোথা থেকে ঠাং ধরে ঝুলিয়ে এনে হাজির। কুপড়ি থেকে ছুরি এনে চড়ইটার পেট চিরে নড়িভূড়ি বের করল সাধু। তারপর কি একটা জিনিস আমাকে না দেখিয়ে টুক করে ভরে দিল পাখিটার পেটে। আবার ঝুপড়িতে ঢুকে দুখানা একই মাপের মাটির সরা এনে একটায় মরা পাখিটা–রেখে অন্যটা দিয়ে চাপা দিয়ে দিল, তারপর একটু আটা মেখে সেই আটা দিয়ে দুটো সরাই মুখে মুখে জুড়ে দিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, এ দিয়ে কি হবে?

সাধু সংক্ষেপে বলল, কাজ আছে।

তারপর আমার হাতে মুখবন্ধ সরাটা দিয়ে বলল, আগুনে পোড়াও তো এটা। এক ঘণ্টা ধরে পোড়াবে। এইভাবে তিনদিন এক ঘণ্টা করে পোড়াবে। নাও–

রান্না হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আগুন তখনও জুলছে। আমি কথা না বলে সরাটা সাধুর কাছ থেকে নিয়ে আগুনে রেখে দিলাম।

সাধু বললে, দ্রব্যগুণ, বুঝলে? দ্রব্যগুণ এক বিরাট জিনিস। তুমি মানো?

বললাম, নিজে প্রত্যক্ষ দেখিনি কখনও। গাছপালা থেকে ওষুধ তৈরি হয় দেখেছি, খেলে অসুখ সেরে যায় তাও দেখেছি। কিন্তু যেসব কথা শুনতে পাওয়া যায়—যেমন বশীকরণ, স্তম্ভন—সেসব দেখিনি।

সাধু হেসে উঠে বলল, বশীকরণ ও আবার একটা কঠিন কিছু নাকি? ওর অনেকরকম উপায় আছে। বেশি জটিল প্রক্রিয়ায় যাবার দরকার কি? একটা সোজা উপায় শিখিয়ে দিই, শোন। চেষ্টা করলে তুমিও পারবে–

-–আজ্ঞে কি?

—যে কোন মাসের অমাবস্যা তিথিতে যদি দুপুরবেলা ঘূর্ণিঝড় ওঠে কিংবা জোরালো হাওয়া দেয়, তাহলে সেই হাওয়ায় উড়ে যাওয়া কোন শুকনো গাছের পাতা একটা মন্ত্র বলতে বলতে বা হাতে ধরে ফেলতে হবে। সেই পাতা গুড়ো করে পান বা দুধ বা যাহোক কিছুর সঙ্গে খাইয়ে দিতে পারলে সেই লোক কুকুরের মত তোমার পায়ে পায়ে ঘুরবে। আছে আমার কাছে, দেখবে?

সাধু ঝুপড়ি থেকে একটা শুকনো অশ্বখপাত হাতে করে বেরিয়ে এল, বললভাদ্রমাসের অমাবস্যায় ধরেছিলাম। থাক আমার কাছে, এর গুণ দেখিয়ে দেব–

দিনদুয়েক আগে সাধু একটা বেশ মোটা নিমের ডাল নিয়ে এসেছিল। একদিন সকালে দেখি বসে বসে ছুরি আর দা দিয়ে কেটে তার থেকে একটা পুতুল বানাচ্ছে। নাক, মুখ, চোখ সবসুদ্ধ একটা মানুষের মূর্তি। এদিনও অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এ দিয়ে কি হবে?

এদিনও সাধু রহস্যময় হেসে বলল, কাজ আছে।

তখনও আমি সাধুর আসল উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে আর এক মুহুর্তও সেখানে থাকতাম না।

আরো তিনচারদিন কাটল। একদিন বিকেলে আমি রান্নার জন্য কাঠকুটো এক–জায়গায় জড়ো করছি, সাধু এসে কাছে বসল। বলল, তুমি প্রকৃতির সংহার শক্তিতে বিশ্বাস কর?

বললাম, আজ্ঞে, ঠিক বুঝতে পারলাম না।

–প্রকৃতির অনেকরকম শক্তি আছে। যেমন প্রকৃতি আমাদের শস্য দান করে, বাতাস দান করে, বৃষ্টি দান করে—এগুলিতে আমাদের প্রাণ বাঁচে। এগুলি শুভ শক্তি। আবার মহামারী, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, যুদ্ধ—এগুলি হল সংহারক শক্তি। এছাড়াও নানা ধরনের অদৃশ্য, অদ্ভুত মারক শক্তি আছে, সাধনার দ্বারা তাদের জাগ্রত করা যায়। যেমন বেতাল জাগানো। বেতাল হচ্ছে এক ধরনের ক্রুর নিষ্ঠুর অপশক্তি, তার মারক ক্ষমতাও অমোঘ। একবার জাগ্রত হলে কাজ শেষ না করা অবধি তার নিদ্রা নেই।

আমার গা শিরশির করছিল, বললাম, আর যদি কাজ শেষ না করতে পারে? যদি বাধা পায়?

সন্ন্যাসীর চোখ জ্বলে উঠল, বলল, বেতালকে বাধা দেওয়া খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বাধা পেলে সে ফিরে এসে যে তাকে জাগিয়েছে, তাকেই হত্যা করে। এসব আগুন নিয়ে খেলা।

সাধু একটু চুপ করে থেকে বলল, আজ রাত্তিরে তোমাকে বেতাল জাগানোর পদ্ধতি দেখাব। তুমি ভয় পাবে না তো?

প্রথমে ভাবলাম বলিয়—হ্যাঁ। তারপর জিনিসপত্র পোটলা করে পালাই। কিন্তু কেমন একটা আকর্ষণ হল, বললাম, না। আপনি কি এরই সাধনা করছিলেন?

সন্ন্যাসী হেসে বললে, তাই।

সেদিন রাত্তির যখন গভীর, সাধু তার ক্রিয়াকর্ম শুরু করল। জবাফুলের মালা, রক্তচন্দন— এসব আগে থেকেই যোগাড় করা ছিল। সাধু সেই নিমকাঠের পুতুলটা এনে তাতে বেশ করে তেল সিঁদুর মাখাল, তারপর সেটাকে কোমর অবধি পুতল মাটিতে। তার চারদিকে বেড়ার মত করে মাটিতে রেখে দিল একটা জবাফুলের মালা। পদ্মাসনে বসে বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়তে পড়তে পুতুলটায় চন্দনের ছিটে দিতে লাগল। এসব হলে ঝোলা থেকে বের করল একটা মদের বোতল। সাধুর ঝুপড়িতে একটা মড়ার খুলি ছিল আগেই দেখেছি, সেটাতে খানিকটা মদ ঢেলে সাধু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সেই বন্ধ সরাটা কই?

আমি সরা এনে দিলাম। সাধু আটাগুলো নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলে সরাটা খুলল। দেখলাম তিনদিন পোড়ানোতে ভেতরের পাখিটা একদম ছাই হয়ে গিয়েছে। সেই ছাই একচিমটি নিয়ে মদে মেশাল সাধু, তারপর ঢক্‌ করে মদটা গলায় ঢেলে দিল।

খাওয়ার পরেই সাধুর আশ্চর্য পরিবর্তন দেখলাম। সাধুর চোখ দুটো ছোট ছোট কোটরে গিয়ে যেন দুটুকরো কয়লার মত জ্বলতে লাগল। আমার দিকে ফিরে সাধু বলল, শুকনো কাঠ দিয়ে একটা ধুনি করো—

করলাম। ধুনি বেশ জ্বলে উঠতে সাধু রক্তচন্দন দিয়ে ধুনি পুজো করল। তারপর তামার কোষায় গাওয়া ঘি, একটা জবাফুল, আরো কি যেন মিশিয়ে মন্ত্র পড়ে আগুনে আহুতি দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিকট পোড়া গন্ধে ভরে গেল চারদিক। সাধু বিকৃত গলায় হেসে উঠল। আর আমার মনে হল সেই ধোয়া আর অন্ধকারের ভেতরে ধুনির মধ্যে থেকে একটা যেন জমাট অন্ধকার দিয়ে তৈরি মূর্তি উঠে বাতাসে ভর করে ভেসে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে সেইদিকে তাকিয়ে রইলাম। মূর্তিটাকে খুব পরিষ্কারভাবে যে দেখেছিলাম, তা বলতে পারি না। তবে যেটুকু দেখতে পেয়েছিলাম, তাতেই বুক ঠাণ্ডা হয়ে আসে। বিশাল, স্থল রাত্রির অন্ধকার দিয়ে তৈরি যেন একটা অপছায়া।

সাধু বলল, দেখলে? ওই বেতাল—

আমি বললাম, কোথায় গেল ও?

সাধু বসে বলল, এদিকে সরে এস। আমি আসল কথাটা এতদিন তোমাকে বলিনি। আজ বলি। আজ থেকে পনেরো-কুড়িদিন আগে এখান থেকে মাইল কুড়ি দূরে এক গ্রামে আমি মাধব ঘোষ বলে একজন লোকের বাড়ি রাত্তিরে আতিথ্য গ্রহণ করি।

আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। মাধব ঘোষ! তাহলে এই কাপালিকই সেদিন মাধব ঘোষের বাড়িতে হাঙ্গামা করেছিল! বটে।

সাধু বলে চলেছে—সেই মাধব ঘোষের বড় মেয়েটির দেহে প্রকৃত সাধন-সঙ্গিনী হবার উপযুক্ত সমস্ত লক্ষণ বর্তমান ছিল। আমার বর্তমানে কোনো ভৈরবী নেই। আমি পরদিন সকালে মাধব ঘোষের কাছে সাধনার জন্য মেয়েটিকে চাইলাম। মাধব দিল তো নাই, উপরন্তু আমাকে অকথ্য অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। সে অপমান আমার বুকে কাটার মত বিঁধে আছে। বেরিয়ে আসবার সময় মাধব আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে একটা ধাক্কাও দিয়েছিল। আমার গায়ে হাত! আচ্ছা! মাধব ঘোষ এইবার দেখব তোমাকে–

আমি ভয় পেয়ে বললাম—কি করবেন আপনি?

–করবো কি? করেছি—এই যে বেতাল জাগিয়ে পাঠালাম, কোথায় গেল সে? পাঠালাম ওই মাধব ঘোষের বাড়ি। এইবার সে বুঝবে কাকে সে অপমান করেছিল।

-–কি হবে মাধব ঘোষের?

—আজ তার নিজের ক্ষতি কিছু হবে না। আজ তার বাড়িতে একটা কিছু করে আসবে বেতাল। এক পক্ষ ধরে আমি বেতাল মন্ত্র জপ করে আজ আহুতি দিয়েছি। কাল অমাবস্যা, কাল পূর্ণাহুতি দেব হোম করে। ওই যে নিমকাঠের পুতুল দেখছ, ওটা হচ্ছে মাধব ঘোষের প্রতিমূর্তি। ওই পুতুলে কাল প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে বেতালকে চিনিয়ে দেব! তারপর বেতাল আবার কাল যাবে মাধবের বাড়ি। তারপর? তারপর পরশু মাধব ঘোষের মৃতদেহ পড়ে থাকবে উঠোনে, কি আমবাগানের মধ্যে। ভয়ঙ্কর–বীভৎস অপমৃত্যু! কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না কোথা দিয়ে কি হল।

সাধুর মুখখানা এখন আমার কাছে নেকড়ে বাঘের মত লাগছিল। আমি আর সহ্য না করতে পেরে বললাম, কিন্তু এ আপনি অন্যায় করছেন। এ ঠিক নয়।

সাধুর চোখ আবার ধ্বক করে জ্বলে উঠল। পৈশাচিক ক্রোধে মুখ বিকৃত করে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি বলতে চাস তুইঃ আমি অন্যায় করছি?

আমার যেন কেমন সাহস এসে গেল। বললাম, নিশ্চয় অন্যায়। আপনি এই কুকর্মে লিপ্ত আছেন জানলে আমি একদিনও থাকতাম না এখানে প্রতিহিংসা সাধনের জন্য নরহত্যা মহা অধর্ম।

-মূর্খ। কাপালিকের পক্ষে প্রতিহিংসা সাধন অধর্ম নয়। তুই তার কি বুঝবি?

—থামুন। আপনার মত নরকের কৃমিকীটের কাছে আর নয়। আমি চললাম। আপনি থাকুন আপনার কুৎসিত সাধনা নিয়ে–

হনহন করে হেঁটে সেই রাত্তিরেই রওনা দিলাম শ্মশান থেকে। পেছনে সাধু ডেকে বলল, যাচ্ছিস যা! কিন্তু শুনে যা—আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে অপমান করে বেশিদিন পৃথিবীর আলো দেখেনি। মনে রাখিস–

অনেক দূর চলে এসেছি, তখনও পেছন থেকে রাত্তিরের নির্জনতা ভেদ করে সাধুর উন্মাদের মত হাসি শুনতে পাচ্ছিলাম।

পরের দিন দুপুর গড়িয়ে গেলে অবিশ্রান্ত হেঁটে আমি মাধব ঘোষের বাড়ি পৌঁছলাম। দেখি, সমস্ত বাড়িটা যেন কেমন ঝিমিয়ে আছে। ভেতরে কেউ যেন জেগে নেই। আমার বুকটা ছাৎ করে উঠল। না জানি বেতাল কাল রাত্তিরে কি করে গিয়েছে।

উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলাম, মাধব! মাধব।

ডাক শুনে ভেতর থেকে মাধব বেরিয়ে এল। আমাকে দেখে সে যেন হাতে চাঁদ পেল। এগিয়ে এসে পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, ঠাকুরমশায়! ওঃ আপনি এসেছেন। আমি যেন একটু বল পেলাম। ভগবান পাঠিয়েছেন আপনাকে—

দেখলাম মাধবের চোখ বসে গিয়েছে, মুখ শুকনো। বললাম, কি হয়েছে? কোন বিপদআপদ হয়নি তো?

—আর বিপদ! গতকাল রাত্তিরে আমার দু-খানা গাই-গরু মরে গেল ঠাকুরমশাই!

—সে কি! গরু মারা গেল কি করে?

—তা কি করে বলি বলুন দিকনি ঠাকুরমশাই? আশ্চর্য ব্যাপার! তখন অনেক রাত, হঠাৎ গোয়ালে কেমন একটা শব্দ শুনলাম, মনে হল গরুগুলো যেন ভয় পেয়ে ছটফট করছে। উঠে বাইরে যাবার আগেই মুংলি গাইটা চিৎকার করে উঠল। গিয়ে দেখি রাঙি আর মুংলি দুটোই মাটিতে শুয়ে ছটফট করছে। কি হল কে জানে! তক্ষুনি লোক পাঠালাম পাশের গায়ে গো-বদ্যির জন্য। সে এল বটে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলে না| আজ সকালে মারা গেল গরু দুটো।

মাধবের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বলল, আজ সকাল থেকে আবার মেয়েটার জুর, গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। এসব তো ভাল কথা নয় ঠাকুরমশাই। আপনি এলেন ভালই হল। ব্রাহ্মণ মানুষ, ভিটেয় বাস করলে আমার ভয় কেটে যাবে।

বুঝলাম সবই। কিন্তু আমার কি করার আছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি থাকলে যদি মাধব শান্তি পায়, তাহলে থাকতে পারি—এই মাত্র।

একটু পরেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।

তখন বিকেল বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। মাধব ঘোষ বেশ করে ফলারের আয়োজন করে দিয়েছিল। ফলার করে আমার একটু বাগানে যাবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। মাধবের কাছ থেকে গড় চেয়ে বাগান সারলাম। গড় হাতে ফিরছি, হঠাৎ মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি জেগে উঠল। ঠিক কি রকম তা বোঝাতে পারব না। যেন আমার খুব বড় একটা বিপদ আসছে। খুব কাছে এসে গিয়েছে সে বিপদ। ভয়ের একটা বিচিত্র অনুভূতি বুকের মধ্যে ঠেলে উঠল। সেই অন্ধকার নির্জন আমবাগানে। দাঁড়িয়ে হঠাৎই আমার বুক যেন হিম হয়ে গেল। কেন এরকম হচ্ছে আমার?

তাড়াতাড়ি ফেরবার জন্য এগুতে গিয়ে মনে হল কয়েক হাত দূরে একটা আমগাছের গুড়ির পাশে কে যেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

আর একটু হলে বোধহয় ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠতাম, কিন্তু ততক্ষণে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আমি চিনতে পেরেছি।

আমাদের গাঁয়ের বটতলার সেই সৌম্যমূর্তি সাধু। যিনি বলেছিলেন আমার বিপদ ঘনিয়ে এলেই আমাকে দেখা দেবেন। তাহলে কি সত্যিই আমার আজ সেই বিপদের দিন এসেছে?

দূর থেকেই আমি সাধুকে প্রণাম করলাম। সাধু হেসে হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। তারপর হঠাৎ কোথায় সাধু কোথায় কি কেউ নেই কোথাও? আমি এক অন্ধকারে গড় হাতে দাঁড়িয়ে।

ফিরে এসে মাধব ঘোষকে ডাকলাম। বললাম, দেখ, আজ তোমার আমার দুজনেরই খুব বিপদ। কি বিপদ তা আমি তোমাকে বলব না। তোমার জেনেও কাজ নেই। মোট কথা আজ আর তুমি বা তোমার বাড়ির কেউ বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে পা দেবে না। চুপ করে বাড়িতে বসে ভগবানের নাম কর। আর আমাকে এক ঘটি জল এনে দাও তো—

মাধবের মুখ শুকিয়ে আরো ছোট হয়ে গেল। দৌড়ে এক ঘটি জল নিয়ে এল সে। আমি সাধুর দেওয়া গাত্রবন্ধনের মন্ত্র দিয়ে জলটা শোধন করে বাড়ির চারদিকে ঘুরে ছিটিয়ে গণ্ডি কেটে দিলাম।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম বিপদ শুধু আমার আর মাধবের। কাপালিক আমাকেও ছাড়বে না। আজ অমাবস্যা, আজই সে আমাদের দুজনকে বেতাল পাঠিয়ে শেষ করবে। অন্যরা হয়তো নিরাপদ! তবু সাবধানের মার নেই জেনে সারাবাড়ির চারদিকেই গণ্ডি দিয়ে দিলাম।

রাত্তিরে খাওয়া হলে আমি মাধবকে ডেকে বললাম, তুমি আমি আজ এক ঘরে থাকব। বাড়ির সবাই শুয়েছে?

—আজ্ঞে ঠাকুরমশাই।

—বেশ, এস আমার সঙ্গে।

ঘরে গিয়ে আমি মাধবকে বললাম, ওই ঘটি থেকে খানিকটা জল ঢাল মাটিতে। এই যে, খাটের পায়ার কাছে—এইখানটায় ঢাল–আচ্ছা, এবার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ওই জল থেকে রেখা টেনে খাটের চারদিকে একটা জলের গণ্ডি কাট। নাও, শুরু কর, আমি তোমার সঙ্গে মন্ত্র পড়তে পড়তে ঘুরছি। তুমি গৃহস্বামী, তোমাকেই করতে হবে। নইলে আমি করে দিতাম।

সেই গণ্ডির ভেতরে খাটে উঠে আমরা দুজন বসে রইলাম। সে কি ভয়ঙ্কর রাত। আমার বুকের ভেতরে এই বিচিত্র বিপদের ঘণ্টা বেজে চলেছে। কি যেন ঘটবে, কে যেন আসছে। আমার পাশে চুপ করে বসে মাধব।

ঠিক মাঝরাত পেরিয়ে যাবার পর হঠাৎ যেন একঝলক হাওয়ায় বাইরের আমবাগান কেঁপে উঠল। ঝড়ের সময় নয়, কিছু নয়—হাওয়া এল কোথা থেকে?

ক্রমে সেই হাওয়া বেড়ে রীতিমত ঝড়ে পরিণত হল। সমস্ত আমবাগান যেন ভেঙে পড়বে, বাড়ির জানলা-দরজা দড়াম দড়াম করে বন্ধ হতে আর খুলতে লাগল। বাড়ির ভেতর মেয়েরা শব্দ করে কেঁদে উঠল—আমি চেচিয়ে বললাম, কেউ বাইরে আসবেন না। সব ভেতরে বসে থাকুন।

ঝড়ের শব্দের মধ্যে কার যেন বীভৎস হুঙ্কার—বিকৃত জাস্তব গলায় কে যেন অমানুষিক হুঙ্কার করছে। কে যেন ঝড়ের ছদ্মবেশে প্রাণপণ চেষ্টা করছে বাড়িতে ঢোকবার, বার বার অদৃশ্য কিসে বাধা পেয়ে ফিরে যাচ্ছে।

খানিকক্ষণ এরকম চলার পর হঠাৎ ঝড়টা যেন এক মুহুর্তে থেমে গেল। আবার শাস্ত আমবাগান, মৃদু হাওয়ায় বাড়ির কলাগাছের পাতা নড়ছে। যে বাড়িতে ঢোকবার চেষ্টা করছিল, সে যেন উদ্দেশ্য সফল হবে না বুঝে ফিরে গিয়েছে। আমার বুকের ভেতরে বিপদের ঘণ্টাও হঠাৎ থেমে গেল।

মাধব ঘোষ আতঙ্কিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি বললাম—আর ভয় নেই, বেঁচে গেলাম বোধ হয়।

সেদিন রাত্তিরটা আমরা খাটেই বসে রইলাম। পরের দিন সকালেই খবর পেলাম মাধবের মেয়ের জ্বর নেমে গিয়েছে। আমি সকালেই বিদায় চেয়েছিলাম, মাধব ঘোষ কিছুতেই ছাড়ল না। খালি বলে—আপনার দয়াতেই রক্ষা পেলাম। বেঁধে রাখতে পারব না জানি, তবু এ বেলাটা থেকে যেতেই হবে।

থেকে ভালই করেছিলাম। নইলে ঘটনার শেষটুকু জানতে পারতাম না।

বিকেলে মাধবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে প্রায় মাইলখানেক চলে এসেছি, দেখি ঘোড়ায় চড়ে এক দারোগাবাবু কোথায় যেন চলেছেন, পেছনে দুজন পাগড়ীওয়ালা সেপাই। আমার কাছ দিয়ে যখন তারা যাচ্ছেন, কি মনে হতে একজন সেপাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় চলেছ বাপু?

সেপাইটা বলল, সামনে বিরামখালিতে একটি শ্মশান আছে, জানেন? সেই শ্মশানে এক কাপালিক থাকত। সে খুন হয়েছে।

ধরা গলায় বললাম, খুন হয়েছে বোঝা গেল কি করে?

—মাথাটা নাকি একেবারে মুচড়ে উলটোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। অনেকে মিলে করেছে আর কি। একজনের কাজ না।

আমি তখন সব বুঝতে পেরেছি। কাপালিকই তো বলেছিল বেতাল বাধা পেলে ফিরে গিয়ে যে জাগিয়েছে তাকেই আক্রমণ করে। কি ভয়ঙ্কর মৃত্যু!

একবার তাদের সঙ্গে গিয়ে মৃতদেহটা দেখে আসবার ইচ্ছে হয়েছিল। পরে সে ইচ্ছে দমন করি। মনে মনে আমাদের গায়ে দেখা সৌম্য সাধুকে প্রণাম জানিয়ে আবার রওনা দিলাম।

গল্প শেষ করে তারানাথ বললে, কি রকম শুনলে?

আমরা বললাম, ভালই।

পথে বেরিয়ে কিশোরীকে বললাম, বিশ্বাস হল?

সে-কথার জবাব না দিয়ে কিশোরী হেসে বললে, দিনটা তো ভাল কাটল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *