৩৫. লোহার দরজাটা

এই জেলখানাটির ঘর-দুয়ারের বন্দোবস্ত তেমন ভাল নয়। কয়েদিদের সহিত দেখা-সাক্ষাতের জন্য ঘরের কোনো ব্যবস্থা নাই। দেখা-সাক্ষাৎ হয় আপিস-ঘরে; কিন্তু সেও এত সঙ্কীর্ণ যে দুই জনের বেশি তিন জন হইলে আর স্থান সঙ্কুলান হয় না। শৈলজা দেবী বলিলেন, আমরা বাইরে থেকেই দেখা করব। সঙ্গে রাখাল সিং ও রামরতনবাবু গিয়াছিলেন; খোকাকে কোলে লইয়া গৌরীর সঙ্গে ছিল নিত্য।

জেলখানার ভিতর দিকের ফটক খুলিয়া শিবনাথকে আনিয়া আপিস-ঘরের জানালায় দাড় করাইয়া দিল। শিবনাথ বাহিরের দিকে চাহিয়াই বিস্ময়ে আনন্দে হতবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। পিসিমা, গৌরী! কে দেখা করিতে আসিয়াছে জানিতে চাওয়ায় তাহাকে বলিয়াছিল, বহুত আদমি আছে মশা, জেনানা-লোকভি আছে। সে ভাবিয়াছিল, রাখাল সিংয়ের সঙ্গে নিত্য ও রতনদিদি। আসিয়াছে। তাহারা তো আপনার জনের চেয়ে কম আপনার নয়।

পিসিমা রুদ্ধকণ্ঠে ডাকিলেন, শিবু!

স্বপ্নাচ্ছন্নের মতই শিবু উত্তর দিল, পিসিমা!

পিসিমারও কথা যেন হারাইয়া যাইতেছে। অনেক ভাবিয়াই যেন তিনি বলিলেন, বউমা এসেছেন, আমি এসেছি, খোকা এসেছে, এরা সব এসেছে তোকে দেখতে।

শিবনাথের বুক মুহূর্তের জন্য কাঁপিয়া উঠিল, তাহাকে কি বন্ড দিয়া ফিরিয়া যাইবার জন্য অনুরোধ করিতে আসিয়াছে? সে আত্মসংবরণ করিয়া দৃঢ় হইয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।

পিসিমাও ধীরে ধীরে আত্মসংবরণ করিতেছিলেন, তিনি বলিলেন, আমি তোকে আশীর্বাদ করতে এসেছি, বউমা প্রণাম করতে এসেছেন, খোকা বাপকে দেখতে এসেছে, চিনতে এসেছে, তুই ওকে আশীর্বাদ কর, যেন তোর মত বড় হতে পারে।

শিবনাথের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, বুক ভরিয়া উঠিল, তাহার মনে হইল, এত বড় পাওয়া সে আর জীবনে পায় নাই, তাহার সকল অভাব মিটিয়া গিয়াছে, সকল দুঃখ দূর হইয়াছে, তাহার শক্তি শত সহস্ৰগুণে বাড়িয়া গিয়াছে। সে এতক্ষণে গৌরীর দিকে ফিরিয়া চাহিল। অর্ধঅবগুণ্ঠনের মধ্যে গৌরীর মুখখানি স্পষ্ট দেখা যাইতেছে,তাহার মুখে হাসি, চোখে জল। ইঙ্গিতে-ভঙ্গিতে সারাটি মুখ ভরিয়া কত ভাষা, কত কথা, সোনার আখরে লেখা কোন্ মহাকবির কাব্যের মত ঝলমল করিতেছে! শিবনাথের মুখেও বোধ করি অনুরূপ লেখা ফুটিয়া উঠিয়াছিল। দুই জনেই মুগ্ধ হইল, কত কথার বিনিময় হইয়া গেল, তাহাদের তৃপ্তির সীমা রহিল না। যে কথা, যে বোঝাপড়া এই ক্ষণিকের দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে হইল, সে কথা, সে বোঝাপড়া দিনের পর দিন একত্রে কাটাইয়াও হইত না।

পিসিমা খোকাকে জানালার ধারে দাড় করাইয়া দিয়া বলিলেন, দাদুভাই, বাবা।

শিবনাথ তাহার চিবুকে হাত দিয়া আদর করিয়া বলিল, তুমি ওকে যেন আমার মত করেই মানুষ কোরো পিসিমা, ওদের ভার তোমার ওপরই আমি দিয়ে যাচ্ছি।

পিসিমা আৰ্টস্বরে বলিলেন, ও কথা আর বলিস নি শিবু। ওরে, এ ভার নিতে আর পারব না।

শিবনাথের অধররেখায় একটি মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল; সেই হাসি হাসিয়া সে শুধু দুইটি কথা বলিল প্রশ্নের ভঙ্গিতে, বলিল, পারবে না? তারপর আর সে অনুরোধ করিল না, সকলের দিক হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া লইয়া মুহুর্তের জন্য আকাশের দিকে চাহিল। পরমুহুর্তেই দৃষ্টি নামাইয়া জানালা দিয়া সম্মুখের মুক্ত ধরিত্রীর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করিল। জেলখানার ফটক হইতে দুই পাশের বড় বড় গাছের মধ্য দিয়া সোজা একটা রাস্তা জেলখানার সীমানার পর অবাধ প্রান্তরে গিয়া পড়িয়াছে। সেই প্রান্তরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া সে নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। সে আপনার মনকে দৃঢ় করিয়া তুলিতেছিল, সম্মুখের ওই দিগন্তে মিশিয়া-যাওয়া পথটার মত সুদীর্ঘ পথে সে যাত্ৰা করিয়া চলিয়াছে, পিছন ফিরিয়া চাহিবার তাহার অবসর কোথায়? অনাদিকালের ধরিত্রী-জননীর বুকে শিশু সৃষ্টি ধীরে ধীরে লালিত হইয়া বাড়িয়া চলিয়াছে, তাহারই হাতে সব কিছু সঁপিয়া নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় মানুষ অনন্তকাল অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে, মানুষের হাতে তাঁর দিয়া রাখিয়া যাওয়ার সকল মিথ্যার মধ্যে ওই রাখিয়া যাওয়াই তো আসল সত্য।

তাহার মনের চিন্তা চোখের দৃষ্টির মধ্যে রূপ লইয়া ফুটিয়া উঠিতেছিল। পিসিমা তাহার মুখের দিকেই চাহিয়া ছিলেন। শিবনাথের দৃষ্টি দেখিয়া তিনি শিহরিয়া উঠিলেন, মমতায় হৃদয় আচ্ছন্ন হইয়া গেল, তিনি বোধহয় পরকাল ভুলিয়া গেলেন, ইষ্ট ভুলিয়া গেলেন, সব ভুলিয়া গেলেন; শিবুই হইয়া উঠিল সব, তাহার ইষ্টদেবতা—গোপাল আর শিবু মিশিয়া যেন একাকার হইয়া গেল।

পিসিমা বলিলেন, আমি ভার নিলাম শিবু, তুই ভাবিস নি। ওরা আমার বুকেই রইল। ঝরঝর করিয়া চোখের জল ঝরিয়া তাহার বুক ভাসিয়া গেল। পিছন হইতে রাখাল সিং ব্যস্ত। হইয়া বলিয়া উঠিলেন, পড়ে গেল, খোকা পড়ে গেল!

মুহূর্তে আত্মসংবরণ করিয়া থোকাকে ধরিয়া পিসিমা বলিলেন, না আমি ধরে আছি।

পিছন হইতে জেলার বলিল, সময় হয়ে গেছে শিবনাথবাবু।

জানালার চৌকাঠে মাথা ঠেকাইয়া প্ৰণাম করিয়া শিবু বলিল, এখান থেকেই প্রণাম করছি পিসিমা। মনে মনে সে বলিল, সমস্ত জীবের ধাত্রী যিনি ধরিত্রী, জাতির মধ্যে তিনিই তো দেশ, মানুষের কাছে তিনি বাস্তু; সেই বাস্তুর মূৰ্ত্তিমতী দেবতা তুমি, তোমাকে যে সে বাস্তুর বংশের কল্যাণ করতেই হবে। এই তো তোমার ধর্ম। তুমিই তো আমায় বাস্তুকে চিনিয়েছ, তাতেই চিনেছি দেশকে। আশীর্বাদ কর, ধরিত্রীকে চিনে যেন তোমায় চেনা শেষ করতে পারি।

প্রদীপ্ত হাসিমুখে পরিপূর্ণ অন্তরে শিবনাথ ফিরিল। গৌরীর অবগুণ্ঠন তখন খসিয়া গিয়াছে, অনাবৃত মুখে, পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে সে ওই দিকে চাহিয়া ছিল। পিসিমা তাহার মাথার অবগুণ্ঠন টানিয়া দিয়া ডাকিলেন, বউমা, খোকা ডাকছে তোমাকে।

ওদিকে লোহার দরজাটা সশব্দে বন্ধ হইয়া গেল।

1 Comment
Collapse Comments

read {past participle }

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *