৩২. গরুরগাড়িতে

পরদিন সকালেই গরুরগাড়িতে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি বোঝাই করিয়া লইয়া দীর্ঘ আড়াই বৎসর পর আবার আপনার গ্রামের দিকে রওনা হইল। বাকি জিনিসপত্র পড়িয়া রহিল, কৃষিক্ষেত্র পড়িয়া থাকিল। ক্ষেত্রের নানাস্থানে ফসল ফলিয়াছিল, ঘনসন্নিবিষ্ট গাঢ় সবুজ ফসলের সমারোহ সকালের বাতাসে দুলিয়া দুলিয়া নাচিতেছিল, সেদিকে সে ফিরিয়াও চাহিল না। এখানে আসিবার সময় সে আসিয়াছিল ঘোড়ায়, ফিরিবার সময় চলিল গরুরগাড়িতে। সে ঘোড়া আর নাই, এখানে আসিয়া প্রথমেই ঘোড়াটাকে বেচিয়া দিয়াছে। ধনগত আভিজাত্যের সমস্ত কিছু সে বর্জন করিয়াছে।

মাঠের মাঝখান দিয়া কাঁচা সড়ক, তাহারই উপর মন্থর গমনে গাড়িখানা চলিয়াছিল। শিবনাথ নিবিষ্টচিত্তে ভাবিতেছিল ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতির কথা। গাড়িখানার ঝাঁকানিতে, দোলায় তাহার সমস্ত দেহ নড়িতেছে দুলিতেছে, তবু তাহার চিন্তাধারা খরস্রোতা নদীর মত বহিয়া চলিয়াছে।

গ্রামের কেহ কি সাড়া দিবে? ডাক শুনিয়া কেহ কি আসিবে? সঙ্গে সঙ্গে তাহার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়া উঠিল। গত রাত্রের সুশীলের কথা মনে পড়িল, সে যাইবার সময় মহাকবির গানের তিনটি শব্দ উচ্চারণ করিয়াছিল, সেই শব্দ তিনটি মনে পড়িল, একলা চল রে। চলিতে হইবে, সে একলাই চলিবে, লোকে তাহার ডাক শুনিয়া ঘরের দুয়ার বন্ধ করুক, অন্ধকার দুর্যোগে কেহ আলো না ধরুক, তাহার আপন বুকের পঞ্জরাস্থি জ্বালাইয়া লইতে কণ্টকাকীর্ণ পথ ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত পদে দলিয়া দলিয়া চলিতে হইবে।

বাধা দিবে রাখাল সিং কেষ্ট সিং। তাহারা প্রবল আপত্তি তুলিবে। মাস্টারমহাশয়না, মাস্টারমহাশয় বোধহয় বাধা দিবেন না, তিনি বাধা দিতে পারেন না, গোঁসাই-বাবা কোনো কথা বলিবেন না, নির্বাক হইয়া দেখিবেন। সহসা নদীর বন্যার উপর যেমন কখনও কখনও নূতন উচ্ছ্বসিত জলরাশি ছুটিয়া আসিয়া নিচের জলকে ঢাকিয়া দিয়া চলিয়া যায়, তেমনই ভাবে আর একজনের স্মৃতি সকলের কথা আবৃত করিয়া শিবনাথের মনে পড়িয়া গেল, পিসিমা তাহার পিসিমার কথা। আজ দীর্ঘ চার বৎসর পর পিসিমার কথায় তাহার অন্তর উদ্বেল আকুল হইয়া উঠিল। পিসিমার মূর্তির পাশেই আর একজনের মূর্তি ভাসিয়া উঠিল—গৌরীর মূর্তি, গৌরীর কোলে একটি শিশু। শিবনাথের চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। আজও সে তাহার সন্তানকে দেখে। নাই। জীবনের অশান্তি, দুর্ভাগ্যের স্মৃতি তাহাকে বিচলিত করিয়া তুলিল। এ দুর্ভাগ্য হইতে তাহাকে রক্ষা করিতে পারিতেন একজন, সে তাহার মহিমময়ী মা। পিসিমা ও গৌরীর মাঝখানে তাহার মা যেন এবার হাসিমুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। অগ্নিশিখার মত দীপ্তিময়ী, ধরিত্রীর মত প্রশান্ত ধৈর্যময়ী তাহার মা জীবনের অশান্তির দুর্বার স্রোতকে ঘুরাইয়া দিতে পারিতেন। আজ তিনি থাকিলে তাহাকে আশীর্বাদ করিয়া পঠাইয়া দিতেন জাতির জীবন-যুদ্ধে। তিনি থাকিলে পিসিমাও যদি আজ তাহার সম্মুখে বাধার সৃষ্টি করিয়া দাঁড়াইতেন, তবে সে বাধাও শিবনাথ জয় করিতে পারিত। মায়ের মধ্য দিয়া পিসিমার বুকে সে আজ প্রেরণার সৃষ্টি করিত, বলিত, এ তোমারই শিক্ষা, এ শক্তি যে তোমারই দান! তুমিই যে শিখাইয়াছিলে, না খাব উচ্ছিষ্ট ভাত, না দিব চরণে হাত! আজ চাহিয়া দেখ, সমগ্র জাতিটাই উচ্ছিষ্টভোজী, সে কি উদরের ক্ষুধায়, না মনের ক্ষুধায়! আর পায়ে হাত! মাথাই যে সমগ্র জাতির পদানত। তোমার দুঃখমোচনের মতই যে সমান গুরুভার দায়িত্ব আমার দেশের দুঃখমোচনের। মায়ের গর্ভ হইতে যখন আসিলাম, তখন প্রথম ধরিয়াছিল এই দেশমা-ধরিত্রী আর তুমি। পিসিমার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিত। মায়ের মুখে বরাভয়ের মত প্রদীপ্ত হাসি। সে বরাভয়ের স্পর্শে গৌরীও আজ গৌরবদীপ্ত মুখে নির্ভীক দৃঢ়তার সহিত বলিত, তোমার পাশেই যে আমার স্থান, আমাকে ফেলিয়া কোথায় যাইবে? তাহার মা তাহাদের সন্তানকে দেখাইয়া বলিতেন, না, শিবনাথের ভবিষ্যৎ তোমার হাতে, তুমি গেলে তাহাকে বাঁচাইবে কে?

তাহার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল, আপাদমস্তক শিরায় শিরায় রক্তস্রোত দ্রুততর গতিতে বহিয়া গেল।

গাড়োয়ানটা বলিল, গাঁ এসে গেইছি বাবু।

এতক্ষণে শিবনাথের চিন্তাধারা ব্যাহত হইল। ওই যে গ্রামের প্রথমেই পুরনো হাঁটতলায়। বড় আমগাছটা, তাহার পরই সরকার দিঘি, দিঘির পাড়ের উপর পচুইয়ের দোকান।

ইহারই মধ্যে পচুইয়ের দোকানে লোক আসিতে শুরু করিয়াছে। জনকয়েক সাঁওতাল দুইটা মরা গোসাপ লাঠির ডগায় ঝুলাইয়া লইয়া চলিয়াছে; চামড়াটা বেচিবে, মাংসটা পুড়াইয়া খাইবে। ওদিক হইতে আসিতেছে জনচারেক জেলে, শিবনাথ তাহাদের চিনিল বিপিন, নবীন, কুঞ্জ আর হরি। শিবনাথ জাতীয় পতাকা হাতে করিয়া গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িল। বন্দরের কাল শেষ হইয়াছে। যাত্ৰা করিবার আদেশ আসিয়াছে, সে শুনিয়াছে, প্রত্যক্ষ শুনিয়াছে। মুহূর্ত সময় অপব্যয় করিবার অবসর নাই।

সে গাড়োয়ানটাকে বলিল, গাড়ি নিয়ে তুই বাড়িতে চলে যা। আমি যাচ্ছি, কিছুক্ষণ হয়ত দেরি হবে।

গাড়োয়ান গাড়ি হাঁকাইয়া চলিয়া গেল, শিবনাথ হাতজোড় করিয়া আসিয়া ওই জেলে ও সাঁওতাল কয়টির সম্মুখে পথরোধ করিয়া দাঁড়াইল। সাঁওতালরা অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া গেল, জেলে কয়টি সসম্ভ্ৰমে ও সভয়ে শিহরিয়া উঠিয়া প্ৰণাম করিয়া বলিল, হেই মা রে! বাবু মশায়, আপুনি ই কী করছেন হুজুর? আমাদের মাথায় যে বজ্ৰাঘাত হবে, নরকেও ঠাঁই হবে না দেবতা।

 

পচুইয়ের দোকানের ভেণ্ডার ত্ৰিলোচন সাহা অল্প নিচু হইয়া প্ৰণাম করিয়া বলিল, এ আপুনি কী করছেন বাবু?

শিবনাথ মিষ্ট হাসি হাসিয়া বলিল, এদের মদ খেতে বারণ করছি ত্ৰিলোচন।

ত্ৰিলোচন জোড়হাত করিয়া বলিল, আজ্ঞে, আমরা কী অপরাধ করলাম বাবু?

অপরাধ নয় ত্ৰিলোচন। এই হল কংগ্রেসের হুকুম, আমি সেই হুকুমমত কাজ করতে এসেছি!

ত্ৰিলোচন শিহরিয়া উঠিল, বলিল, আপুনি পিকেটিং করতে এসেছেন বাবু?

হ্যাঁ।

আজ্ঞে, আপুনি বাড়ি যান বাবু, আপুনি বাড়ি যান। পুলিশে খবর পেলে এখুনি ধরে নিয়ে যাবে। হাসিয়া শিবনাথ বলিল, জানি।

চারিদিকে জনতা জমিতে শুরু করিয়াছিল, সকলেই গ্রামের লোক। প্রত্যেকেই শিবনাথকে চেনে, তাহারা ত্ৰিলোচনের কথা ও শিবনাথের কথা শুনিয়া চঞ্চল হইয়া উঠিল। নিশিচৌধুরী। আগাইয়া আসিয়া বলিল, বাবু, বাড়ি চলুন। শিবনাথ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, তোমরা ভয় করছ কেন? তোমরা জান না, আজ দেশের সমস্ত ভারতবর্ষের দিকে দিকেচারিদিকে হাজার হাজার জোয়ান ছেলে জেলে চলেছে, সমাজের দেশের যারা মাথার মণি, তারা হাসিমুখে যাচ্ছেন জেলে। কেন? দেশের মুক্তির জন্যে, জাতির মুক্তির জন্যে, তোমাদের মুক্তির জন্যে। সোনার দেশ শ্মশান হয়ে গেল, আজও কি মদ খেয়ে বিভোর হয়ে পড়ে থাকবার সময় আছে, না ভয় করে স্ত্রীলোকের মত ঘরের কোণে বসে থাকবার সময় আছে! আমাকে তোমরা ডাক, বলছ, পালিয়ে এস, ফিরে এস। কিন্তু আমি তোমাদের ডাকছি, তোমরা আর ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বসে থেকো না, বেরিয়ে এস, দেশের কাজে স্বরাজের যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়। বিলিতি কাপড়, বিলিতি জিনিস পোররা না, মদ খেয়ো না, সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা কোরো না।

এবার জনতা স্তব্ধ হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। শিবনাথ আবেগভরে আবার বলিল, বল–বন্দে মাতরম্।

তবুও জনতা স্তব্ধ। বরং পিছন হইতে দুই-চারি জন সরিয়া পড়িল। শিবনাথ আবার বলিয়া উঠিল, বল–বন্দে মাতরম্।

এবার জনতার পিছন হইতে সতেজ কিশোের কণ্ঠে কে বলিয়া উঠিল, বন্দে মাতরম্। সমগ্র জনতা সবিস্ময়ে পিছনের দিকে দৃষ্টি ফিরাইল,—একটি শ্যামবর্ণের কিশোর জনতার মধ্য দিয়া। পথ করিয়া লইয়া চলিয়া আসিতেছে। শিবনাথ তাহাকে দেখিয়া পুলকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, শ্যামু, তুই?

আমি এসেছি শিবনাথদা।

 

শ্যামু, কলেরায় সেবাকার্যের সেই সর্বকনিষ্ঠ ছেলেটি–সে আজ কিশোর হইয়া উঠিয়াছে, সে আসিয়া শিবনাথের পাশে দাঁড়াইল।

তুই কী করে খবর পেলি যে, আমি এখানে এসেছি?

শ্যামু বিপুল উৎসাহের সহিত বলিল, সমস্ত গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়েছে শিবনাথদা। আমি ছুটে বেরিয়ে এলাম।

অকস্মাৎ পিছন হইতে জনতা দ্রুতবেগে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই সমগ্র জনতা অপসারিত হইয়া গেলে শিবনাথ দেখিল, থানার অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব্‌ইন্সপেক্টর ও একজন কনস্টেবল তাহার দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। এ. এস. আই. মুখ বাঁকাইয়া হাসিয়া বলিল, এই যে এসেছেন আপনি। আমরা ভাবছিলাম, বলি এ হুজুগে শিবনাথবাবুটি রইলেন কোথায়?

শিবনাথ হাসিয়া তাহারই মুখের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এ. এস. আই. বলিল, আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।

শিবনাথ তাহার অনুসরণ করিয়া বলিল, চলুন। শ্যামু, তুই বাড়ি যা, রাখাল সিংকে খবরটা দিস।

এ. এস. আই. বলিল, হুঁ, এটিও এসে জুটেছে দেখছি। তারপর রূঢ়স্বরে বলিল, এই ছোঁড়া, সেঁপোমি করতে হবে না, যা, বাড়ি যা।

শ্যামু ঘুরিয়া দাঁড়াইল। শিবনাথ দেখিল, উত্তেজনায় তাহার মুখ আরক্ত, প্রদীপ্ত দৃষ্টি, দাঁড়াইবার ভঙ্গির মধ্যে সুকঠিন দৃঢ়তা প্রতি অঙ্গের ভঙ্গিগুলি মিলিয়া একটা অবিচল সঙ্কল্প যেন তাহার সর্বাঙ্গ হইতে শাণিত দীপ্তির মত ঠিকরিয়া পড়িতেছে। আনন্দে গৌরবে প্রেরণায় শিবনাথের অন্তর ভরিয়া উঠিল, তবু সে শ্যামুকে বাধা দিল, বলিল, আমি বলছি, তুই আজ বাড়ি যা শ্যামু। আজ যদি আমি যাই, তবে তোর যাবার দিন হবে কাল। তোর জায়গায় আর একজনকে দাঁড় করিয়ে তুই তবে যেতে পারি। বাড়ি যা।

শ্যামুর মুখ ছলছল করিয়া উঠিল, কিন্তু সে আর প্রতিবাদ করিল না, ফিরিল। শিবনাথ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া এ. এস. আই.-কে বলিল, চলুন।

এ. এস. আই. বলিল, থানায় নয়, আপনার বাড়িতে চলুন।

শিবনাথ বুঝিল, বাড়ি সার্চ হইবে। এক মুহূর্তে সে মনে মনে বাড়ির প্রতিটি কোণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সন্ধান করিয়া দেখিয়া লইল, তারপর হাসিমুখে বলিল, চলুন।

বাড়িতে আসিয়া কিন্তু এ. এস. আই. বলিল, কেন মিথ্যে মিথ্যে হাঙ্গামা করছেন। শিবনাথবাবু? আপনি বুদ্ধিমান পরোপকারী, যাকে বলে—মহাশয় লোক, তার ওপর আপনি জমিদারের ছেলে। আপনার দেশের সত্যিকার কাজ করুন, গভর্নমেন্ট আপনাকে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট করে দেবে, খেতাব দেবে। ওসব আপনি করবেন না।

শিবনাথ সবিস্ময়ে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, এই বলবার জন্যই আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এলেন বুঝি?

এ. এস. আই. হাসিয়া বলিল, আপনি স্নান করুন, খাওয়াদাওয়া করুন, তারপর ভেবেচিন্তে যা হয় করবেন। আচ্ছা, আসি তা হলে। নমস্কার।

শিবনাথ বুঝিল, পুলিশ সুকৌশলে তাহাকে উপস্থিত প্রতিনিবৃত্ত করিয়া গেল, খানিকটা কৌতুকও অনুভব করিল, কৌতুকে খানিকটা না হাসিয়া সে পারিল না। দাবাখেলার মত এ যেন কিস্তি সামলাইয়া কিস্তি দিয়া গেল। মুহুর্তে সে আপনার সঙ্কল্প ঠিক করিয়া লইল; পুনরায় সে পতাকা হাতে করিয়া পথে নামিবার জন্য অগ্রসর হইল। কিন্তু পথে নামিবার পূর্বেই পিছন হইতে রাখাল সিং ডাকিলেন, বাবু!

বাধা পাইয়া শিবনাথের ললাট কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, সে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিল, কিছু বলছেন?

হাতজোড় করিয়া রাখাল সিং বলিলেন, আজ্ঞে বাবু, আমাকে আপনি রেহাই দিয়ে যান।

শিবনাথ দেখিল, একা রাখাল সিং নয়, রাখাল সিংয়ের পিছনে কেষ্ট সিংও মাথা নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। রাখাল সিংয়ের কথা শেষ হইবামাত্র সেও বলিয়া উঠিল, আমিও ছুটি চাইছি দাদাবাবু, এ আমরা চোখে দেখতে পারব না।

শিবনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস না ফেলিয়া পারিল না। ওই পরমহিতৈষী ভৃত্য দুই জনের আকুল মমতার আবেদন অকস্মাৎ তাহাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিল। রাখাল সিং অত্যন্ত কাতরভাবে তাহার পায়ের কাছে বসিয়া পড়িয়া পা দুইটি ধরিয়া বলিলেন, আপনার পায়ে ধরছি বাবু, এমন করে সর্বনাশ আপনি করবেন না। পিসিমার কথা একবার ভাবুন, বউমার কথা একবার ভাবুন, খোকাবাবুর কথা একবার মনে করুন।

শিবনাথ ধীরে ধীরে আপনাকে সংযত করিয়া তুলিতেছিল, পিসিমা ও গৌরীর উল্লেখে অকস্মাৎ মুহূর্তের মধ্যে অবিচল দৃঢ়তায় তাহার মন ভরিয়া উঠিল, তাহার অন্তরের শক্তি ও সঙ্কল্প একটা প্রেরণার আবেগে যেনে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। শিবনাথ বলিল, রেহাই আপনাদের আমি দিলাম সিংমশায়, আপনি পা ছাড়ুন, আমাকে বাধা দেবেন না।

রাখাল সিং একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া বলিলেন, তা হলে হিসেব-নিকেশ—

সমস্তই আমি মঞ্জুর করে দিলাম সিংমশায়।

একবার দেখেশুনে–

দরকার নেই। সে বিশ্বাস আপনার উপর আমার আছে।

তা হলেও একটা ফারখত—

চলুন, আমি লিখে দিচ্ছি। শিবনাথ ফিরিয়া আসিয়া কাছারিতে বসিয়া বলিল, কাগজ-কলম নিয়ে আসুন।

কাগজ-কলম দিবার পূর্বেই রাখাল সিং কোমর হইতে চাবির থোলো খুলিয়া সম্মুখে নামাইয়া দিয়া বলিল, চাবি।

চাবির গোছাটা অতর্কিতে একটা শৃঙ্খলবন্ধনের মত তাহাকে জড়াইয়া ধরিল। বিব্রতভাবে মাথা নিচু করিয়া ভাবিতে বসিল। রাখাল সিং একটা থামের গায়ে ঠেস দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া নিস্পন্দের মত দাঁড়াইয়া ছিলেন, শুধু অতি মৃদু স্পন্দনে তাঁহার ঠোঁট দুইটি কাঁপিতেছিল ঘাসের পাতার মত। আড়ালে বসিয়া কেষ্ট সিং ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছিল। সতীশ গাঁজা টানিয়া বিভোর উদাসীনের মত বসিয়া ছিল।

এই বিচিত্র স্তব্ধতা ভঙ্গ হইল কাহার প্রচণ্ড সবল পদক্ষেপের শব্দে। শুধু শব্দই নয়, আগন্তুকের বিপুল শক্তি ও গতিবেগের মিলিত আবেগে কাছারি-বাড়ির শান-বাঁধানো মেঝের প্রান্তদেশ পর্যন্ত একটা স্পন্দন সঞ্চারিত করিয়া তুলিয়াছিল। শিবনাথের চিনিতে ভুল হইল না,

সে উঠিয়া পঁড়াইয়া আহ্বান করিল, গোঁসাই-বাবা!

অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে উত্তেজিত আরক্ত মুখে রামজী গোস্বামী আসিয়া দাঁড়াইলেন। চকিতের মধ্যে শিবনাথের এই আকস্মিক বন্ধন যেন শিথিল হইয়া আসিল, তাহার সঙ্কল্প স্থির হইয়া গেল, সে চাবির গোছাটি সন্ন্যাসীর দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল, এই চাবিগুলো তুমি রাখ গোঁসাই-বাবা।

 

সন্ন্যাসী যে প্রচণ্ড গতিতে প্রবেশ করিয়াছিলেন, সে তাহার মনের প্রচণ্ড আক্ষেপের প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছু নয়। সমস্ত গ্রামেই ইহারই মধ্যে সংবাদটা রটিয়া গিয়াছে। কিশোর যুবক সন্তানের মা-বাপেরা শিহরিয়া উঠিয়া শিবনাথকে অভিসম্পাত দিতে শুরু করিয়াছে, ব্যবসায়ীরা বিরক্তিতে ভয়ে চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে, শিক্ষিত একদল প্রশংসার গুঞ্জনে গৃহকোণ ভরিয়া তুলিয়াছে। শুধু জনকয়েক কিশোর ছেলে আকাশ-অভিসারী উপাত-পক্ষ পতঙ্গের মত খুঁজিতেছে—ঘর হইতে বাহির হইবার পথ ও সাহস।

সন্ন্যাসী আসিয়াছিলেন শিবনাথকে তিরস্কার করিতে, তাহাকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে। কিন্তু শিবনাথের সহিত মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আজ অকস্মাৎ তিনি অনুভব করিলেন, এ তো সেই শিশুটি নয়, যে তাহার বুকের উপর ঝাপ দিয়া পড়িত, যাহাকে তিনি, বাবা হামার, হামার বাবা বলিয়া বুকে জড়াইয়া আনন্দের আবেগে অধীর হইয়া উঠিতেন, এ তো সে নয়! সঙ্গে সঙ্গে এক মুহূর্তে তাহার অন্তরলোকে সর্বধ্বংসী ভূমিকম্পের কম্পনের মত একটা কম্পনে সব যেন ভাঙিয়া চুরিয়া একাকার হইয়া গেল। তাহার মনে পড়িয়া গেল একদিনের কথা। তিনিই বলিয়াছিলেন দিদিকে শৈলজা-ঠাকুরানীকে, মৃগশিশু তো ভাগবে, উ হামি জানি। মৃগশিশু পলাইয়াছে।

শিবনাথ সন্ন্যাসীকে প্রণাম করিয়া বলিল, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি গোঁসাই-বাবা, তুমি আশীর্বাদ কর।

সন্ন্যাসী শিবনাথের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন; তিরস্কার করিবার অধিকার নাই; ইচ্ছা হইল, শিশুর হাত দুইটি ধরিয়া অনুরোধ করেন, মৎ যাও বেটা, মৎ যাও। তুমি জানে না বেটা হামি জানে, ধবৃতি জয় করতে পারে আংরেজ। তাহার মনে পড়িয়া গেল যুদ্ধের কথা, কামানের কথা, বন্দুকের কথা, কাতারে কাতারে সুসজ্জিত সৈন্যদলের কথা। কিন্তু সেও তিনি পারিলেন

না।

শিবনাথের চোখ-মুখ দীপশিখার মত উজ্জ্বল, সে মুখের সম্মুখে এমন কথা তিনি বলবেন কী করিয়া?

শিবনাথ হাসিয়া বলিল, এমন যুদ্ধ নোমরা কখনও কর নি গোঁসাই-বাবা। এতে শুধু মরতে হয়, মারতে হয় না। অহিংস যুদ্ধ। নিরস্ত্র হয়ে বীরের মত বন্দুকের সামনে দাঁড়াতে হবে।

সন্ন্যাসী শিবনাথের মাথায় হাত দিয়া বলিলেন, দীরঘ জীবন তুমার হৌক, বেটা, শও বরিষ তুমার প্রমায়ু হোক। আর তিনি দাঁড়াইলেন না, চলিয়া যাইবার জন্য ফিরিলেন।

শিবু বলিল, চাবিটা তুমি রাখ গোঁসাই-বাবা, আমার মাস্টারমশায়কে বরং দিয়ে দিও তুমি। দু-এক দিনেই তিনি এখানে নিশ্চয় আসবেন।

এ অনুরোধে সন্ন্যাসী আর  বলিতে পারিলেন না, মিনিটখানেক চিন্তা করিয়া নীরবে দীর্ঘ হাতখানি প্রসারিত করিয়া দিলেন।

শিবনাথ পতাকা লইয়া আবার অগ্রসর হইল আপনার পথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *