২৭. মাস চারেক পরের কথা

মাস চারেক পরের কথা। আষাঢ়ের প্রথম। দ্বিপ্রহরের প্রারম্ভেই সমস্ত সৃষ্টিটা যেন ভয়ে নিস্তব্ধ হইয়া ঘরে লুকাইয়া বসিয়া আছে। আকাশে দ্বাদশ সূর্যের যেন একসঙ্গে উদয় হইয়াছে; নির্মেঘ রুক্ষ আকাশ, পৃথিবীর বুক হইতে বহুদূর পর্যন্ত ঊর্ধ্বলোক ধূলিকণায় সমাচ্ছন্ন, চোখের সম্মুখে ক্ষীণ কুয়াশার আস্তরণের মত সে ধূলিস্তরটা ভাসিয়া রহিয়াছে, দিকচক্রবাল দৃষ্টিপথ হইতে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয়, সেখানে দেখা যায় গাঢ় ধূমপুঞ্জের মত জমাট ধুলার রাশি। পৃথিবীর বুকের মাটি স্তরের পর স্তর গুঁড়া হইয়া উড়িয়া গেল। বৈশাখে দুই-এক পসলা বৃষ্টি হইয়া আবার মেঘ মুখ লুকাইয়াছে; আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ হইয়া গেল, এখনও বৃষ্টি নাই; এখনও মাঠে বীজধান বোনা হয় নাই, ঘাস একবার দেখা দিয়া আবার শুকাইয়া গিয়াছে, পৃথিবীর সুশ্যাম লাবণ্যময়ী রূপের কথা ভাবিয়া আজ মাঠের দিকে চাহিলে মনে হয়, কেহ যেন তাহার চর্মোৎপাটিত করিয়া লইয়াছে। দেশ জুড়িয়া হাহাকার, ভিক্ষুকে ভিক্ষুকে গ্রামখানা ছাইয়া গিয়াছে; দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছে।

এই উত্তপ্ত নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরেও সেদিন শিবনাথ একা কাছারিতে বসিয়া ছিল। মুখে গভীর উদ্বেগ ও চিন্তার ছায়া, মাথার চুলগুলি বিপর্যস্ত, চিন্তিতভাবে ক্রমাগত চুলের মধ্যে আঙুল চালাইয়া চালাইয়া নিজেই সে এমনই করিয়া তুলিয়াছে। এতবড় কাছারি-বাড়িতে সে একা, সে ছাড়া জনমানব নাই। সময় নির্ণয়ের জন্য পিছনের দেওয়ালের দিকে সে অভ্যাসমত চাহিয়া দেখিল, কিন্তু ব্র্যাকেটের উপর ঘড়িটা নিস্তব্ধ, কখন থামিয়া গিয়াছে। অয়েল করানোর অভাবে ঘড়িটা মাঝে মাঝে বন্ধ হইয়া যাইতেছে। ইজিচেয়ারের বেতের ছাউনিটা ছিঁড়িয়াছে, সদর হইতে বেত ও কারিগর আনাইয়া ওটাকে মেরামত করা প্রয়োজন, কিন্তু সেও হয় নাই। ওসব পরের কথা, এখন সম্পত্তি থাকিলে হয়। আগামী সরকারি নিলামে বাকি রাজস্বের দায়ে সম্পত্তি নিলামে উঠিয়াছে। পাঁচ শত টাকা লাগিবে; না দিতে পারিলে সমস্ত নিলাম হইয়া যাইবে। নায়েব গোমস্তা চাপরাসী, এমনকি চাকর ও মাহিন্দার পর্যন্ত বাহিরে গিয়াছে, মহলে মহলে টাকার জন্য তাহারা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। শিবনাথ নীরব উৎকণ্ঠা বহন করিয়া এখানে একা বসিয়া তিলে তিলে সে উৎকণ্ঠার যন্ত্ৰণা সহ্য করিতেছে। চেষ্টার ফল যাহা হইবে, সে জানে; তবুও চেষ্টা না করিয়া উপায় কী? রাখাল সিং কেষ্ট সিং পাগলের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আজ কয়েকজন প্ৰজা আসিয়া কাঁদিয়া পড়িয়াছে। কোনোরূপে যেন সম্পত্তি রক্ষা করা হয়, পুরুষানুক্রমে তাহারা এই বাড়ির ছত্ৰছায়াতলে বাস করিয়া আসিতেছে, আজ যেন তাহাদের ভাসাইয়া দেওয়া না হয়—এই ছিল তাহাদের বক্তব্য। জমিদার তাহারা চায়, অথচ নতুন জমিদার তাহারা চায় না কেন—এই কথা খইয়া দেখিতে গিয়া দেখিতে পাইল, প্রজাদের অফুরন্ত মমতা আর তাহার পিতৃপুরুষের উদার মহত্ত্ব।

অথচ কয়েকদিন আগেই সে পড়িয়াছে Joseph Prudhone-এর বাণী; পড়িয়াছে Property is theft, because it enables him, who has not produced, to consume the fruits of other peoples toil. জমিদারি-ব্যবস্থা অক্ষরে অক্ষরে তাই। গভীর বিস্ময় এবং ঐকান্তিক শ্রদ্ধার সহিত এ সত্যকে স্বীকার করিয়া লইয়াও আজ কিন্তু প্রজাগুলির এই অনুরাগআসক্তি এবং নূতন জমিদারের অধীনে তাহাদের ভবিষ্যতের শঙ্কার কথা বিবেচনা করিয়া সে বিচলিত হইয়া উঠিয়াছে; বাঁচাইতেই হইবে, যেমন করিয়া হউক, সম্পত্তি রাখিতেই হইবে। এই উৎকণ্ঠার সময় মাস্টার মহাশয় থাকিলে বড় ভাল হইত। সকল দুঃখ, সকল সংঘাতের মধ্যে ওই মানুষটি তাহাকে সুস্থ করিয়া তোলেন। রামরতনবাবুও আজ সকালে ঢাকার সন্ধানে গিয়াছেন। সকালেই তিনি বলিলেন, তাই তো শিবু, উপায় কী করবি বল্ দেখি?

শিবু অভ্যাসমত ম্লান হাসি হাসিয়া উত্তর দিল, কী আর করব?

অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া তিনি বলিলেন, বউমা তো তার মায়ের উইলের দরুন টাকা পেয়েছেন, তাকে বললেই তো হয়। তুই একটা ডঙ্কি।

শিবনাথ বিচলিতভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না স্যার, সে হয় না। ওকথা আমাকে বলবেন না।

অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া রামরতনবাবু বলিলেন, কেন বল্ দেখি?

শিবনাথ কোনো উত্তর দিল না।

রামরতনবাবু আপন মনে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, দিস ইজ ভেরি ব্যান্ড। ইট মিন্‌স–

শিবনাথ বাধা দিয়া বলিল, টাকা তো তার হাতে নেই মাস্টার মশায়, টাকা আছে কলকাতায়, ওর মামার ব্যবসায় খাটছে। সেখানে আমার অভাব বলে টাকা চাইতে যাওয়া কি যায়?

হুঁ, তা বটে। সেটা তুই ঠিক বলেছিস। আমি ভাবলাম অন্য রকম ভাবলাম নট ইন গুড টার্মস উইথ বউমা।

শিবনাথ সহসা ব্যর্থ হইয়া উঠিল, বলিল, বোলপুরে তো অনেক মহাজন আছে, আপনার সঙ্গে আলাপও আছে অনেকের; আপনি পাঁচশো টাকা আমাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। না?

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া রামরতন উঠিয়া পড়িলেন, আপনার ছাতা ও বাঁশের লাঠি লইয়া বলিলেন, অল রাইট, চললাম আমি; দেখি কী হয়। সেই তিনি রওনা হইয়া গিয়াছেন।

রাখাল সিং কিন্তু শুনিয়া বলিলেন, ধারের উপায় থাকলে কি সে উপায় আমি না করতাম বাবু? সে উপায় নেই। মানে, সাবালক হন নি যে এখনও আপনি। একুশ বছর না হলে তো আর সাবালক হয় না জমিদারের ছেলে।

রামরতনবাবু রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিবনাথের অন্তরে একটি ক্ষীণ আশার সঞ্চার হইয়াছিল, রাখাল সিংয়ের কথায় সে আশা নির্মূল হইয়া গেল। ইহার চেয়ে তিনি এখানে থাকিলে ভাল হইত, সান্ত্বনা দিবার একজন থাকিত। আরও একজনকে মনে পড়িল—পিসিমাকে, তিনি এখানে থাকিলে এ দুশ্চিন্তাই বোধহয় তাহাকে ভোগ করিতে হইত না।

রাখাল সিং কে সিং, গোমস্তা কুড়ারাম মিশ্র প্রজাদের সকলকে এখানে হাজির করিবার জন্য মহলে গিয়াছে। তাহাদের অনুরোধের বিনিময়ে সেও অনুরোধ জানাইবে, চারি আনা, আট আনা, এক টাকা, যে যেমন পার, যাহা পার তাহাই দাও। হাজার প্রজায় চারি আনা করিয়া দিলেও আড়াই শত টাকা হইবে, আর আট আনা করিয়া দিলে পাঁচ শত টাকা। সতীশ, শম্ভু, মতিলাল-ইহারাও গিয়াছে অন্য একখানা গ্রামে।

একা বসিয়া চিন্তা করিতে করিতে উদ্বেগে শিবনাথের যেন হপ ধরিয়া উঠিল। প্রপার্টি ইজ থেফুট জানিয়াও ক্রমশ সে বিচলিত হইয়া পড়িতেছে, সম্পত্তির মমতায় সে ব্যাকুল হইয়া উঠিতেছে। প্রজাদের অনুরোধ, পিতৃপুরুষের সম্পত্তি, এই দুইটা কথা মনে পড়িলে চোখে জল আসে। গৌরীর কথা মনে করিয়া সে শিহরিয়া ওঠে। সম্পত্তি গেলে গৌরী যে রূপ গ্ৰহণ করিবে, সে বিক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ রূপ কল্পনা করিয়া সে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর অন্য উপায় খুঁজিয়া পায় না।

শিবনাথ কাছারি-বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিয়া পথের উপর দাঁড়াইল। রৌদ্রের উত্তাপে পৃথিবী যেন দগ্ধ হইতেছে; জনহীন পথ, একটা পাখির ডাক পর্যন্ত শোনা যায় না। পথের উপর ব্যগ্র প্রত্যাশায় চাহিয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল। ওই দিক হইতে রাখাল সিং কেষ্ট সিংয়ের প্রজাদের লইয়া ফিরিবার কথা। কিন্তু কেহ কোথাও নাই। সে পিছনের দিকে ফিরিল, এদিক হইতে গোমস্তা কুড়ারাম মিশ্র, সতীশ চাকর ও মাহিন্দারদের ফিরিবার কথা। যতদূর দৃষ্টি চলে কোথাও কোনো মানুষের দেখা নাই। সে আবার ফিরিল। এবার সে দেখিল, এদিক হইতে টলিতে টলিতে একটা কঙ্কাল যেন চলিয়া আসিতেছে।

একটা জীৰ্ণ কঙ্কালসার মেয়ে। সে আসিয়া অনুনাসিক সুরে কহিল, বাবু মাৰ্শায়।

তাহার দিকে চাহিয়া শিবনাথের সর্বশরীর যেন কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। আঠার-উনিশ বছরের মেয়ে, কিন্তু সর্ব অবয়বের মধ্যে কোথাও একবিন্দু তারুণ্যের লেশ নাই; যেন একটা চর্মাবৃত কঙ্কাল; করকরে জিভ দিয়া কোনো শ্বাপদ যেন মেয়েটার সর্বাঙ্গ লেহন করিয়া লইয়াছে।

বাঁবু মাশাঁয়, চাঁরটি ভাঁত।

মেয়েটির গায়ের দুর্গন্ধে শিবনাথের কষ্ট হইতেছিল; সে মুখ ফিরাইয়া লইয়া বলিল, বাড়ির মধ্যে যাও বাপু, দেখ, যদি থাকে তো পাবে। কিন্তু আর কি আছে?—বলিতে বলিতেই তাহার মনে পড়িয়া গেল, এই মেয়েটাই কাল অপরাত্নে মেথরের কাজ করিয়া চারিটা পয়সা লইয়া গিয়াছে, সন্ধ্যায় খাইয়া কিছু উচ্ছিষ্টও লইয়া গিয়াছে। ইহারই মধ্যে সে আবার অন্ন অন্ন করিয়া ফিরিতেছে। তবে এ উহার স্বভাব, না সত্যই অভাব?

মেয়েটি চলিয়া গেল; তাহার পদক্ষেপের মধ্যেও সমতা নাই, পায়ে পায়ে টোক্কর খাইতে খাইতে সে চলিয়াছে। শিবনাথ সহসা ক্ষণপূর্বের মনোভাবের জন্য লজ্জিত হইয়া পড়িল, নিজের কাছেই নিজে অপরাধ বোধ করিল। তাহার মনে হইল, লক্ষ লক্ষ যুগের ক্ষুধা ওই মেয়েটির উদরে জ্বলিতেছে। সে ক্ষুধার অন্ন তাহারাই পুরুষানুক্ৰমে কাড়িয়া খাইয়া আসিয়াছে, সে নিজেও খাইতেছে। নতমস্তকে সে সম্মুখের পথেই অগ্রসর হইয়া চলিল, সম্মুখের ওই বাকটায় দাঁড়ালেই। আরও অনেকটা দেখা যাবে। খানিকটা অগ্রসর হইতেই একটা কলরবের আসি পাওয়া গেল; রামকিঙ্করবাবুদের ঠাকুরবাড়ির দরজায় ভিক্ষুকদলের কলরব উঠিতেছে। উচ্ছিষ্ট অন্নের জন্য পঙ্গপালের মত বসিয়া বসিয়া সব চিৎকার করিতেছে।

ঠাকুরবাড়ির সম্মুখে যেখানে যেটুকু ছায়া পড়িয়াছে, উচ্ছিষ্টপ্রত্যাশী ভিক্ষুকের দল সেই স্থানটুকুর মধ্যে জটলা বধিয়া বসিয়া আছে। কেহ কাহারও উকুন বাছিতেছে, কোথাও গল্প চলিতেছে, ঝগড়া চলিয়াছে। একটা খেজুরগাছের সঙ্কীর্ণ একটুখানি ছায়াকে আশ্ৰয় করিয়া বসিয়া। প্রায়-অন্ধ এক বুড়ি আপন মনেই বকিতেছিল, ভদ্রনোকের ছেলের ওই করণ! ওইগুলা আবার কথা নাকি? আমি দেখতে পাই চোখে? মিছে করে আবার কানা সেজে কেউ থাকে নাকি? না তাই থাকতে পারে? দেখতে পেলে কেউ দিনে একশো বার করে পড়ে মরে নাকি?

এত উৎকণ্ঠার মধ্যেও শিবনাথ না হাসিয়া পারিল না। সে বুঝিতে পারিল, কেহ বুড়িকে অন্ধত্বের ভান করার অভিযোগে অভিযুক্ত করিয়াছে, তাই বুড়ি এমন ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। এ সংসারে এখন উহার বাঁচিয়া থাকার মূলধন ওই অন্ধত্ব। ঈষৎ হাসিয়া শিবনাথ বলিল, হ্রা রে বুড়ি, কে কী বললে তোকে? বকছিস কেন?

বুড়ি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া অঙ্গভঙ্গি সহকারে বলিয়া উঠিল, অ্যাঃ, বকছি কেনে! আবার লক্সা করা দেখ ছেলের! তুমি বললে না, বুড়ি বেশ দেখতে পায় চোখে, কানা সেজে থাকে

একজন চক্ষুষ্মন তাহার কথায় বাধা দিয়া বলিল, এই বুড়ি, এই কাকে কী বলছিস? উনি যে আমাদের উ বাড়ির বাবু। সে নোেক জাের চলে গিয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে বুড়ি সেইখানে একটি প্রণাম করিয়া কাতরস্বরে বলিল, বাবু মশায়, আপনকাকে। আমি বলি নাই মাশায়। আমি কানা মানুষ, মানুষ চিনতে লারি বাবা। ওই সাদা কাপড় শুধু চোখের ছামুতে ফটফট করে। তাতেই আমি বলি, বুঝি–

শিবনাথ বলিল, না রে বুড়ি আমি কিছু মনে করি নি।

বুড়ি সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করিয়া বলিল, তবে একখানি তেনা দিও মাশায় এই কানাকে। ধৰ্ম্ম হবে আপনার।

শিবনাথ হাসিয়া বলিল, আচ্ছা।

মুহূর্তে চারিদিক হইতে রব উঠিল, আমাকে মাশায়, আমাকে মাশায়, বাবু মশায়। যাহারা বসিয়া ছিল, তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইল। সেদিকে চাহিয়া শিবনাথ শিহরিয়া উঠিল, মুহুর্তে তাহার মনে পড়িয়া গেল—মা যাহা হইয়াছেন।

মেয়েরা প্রায় বিবস্ত্ৰা, মাত্ৰ কটিতটটুকু জীৰ্ণ শতচ্ছিন্ন বস্ত্ৰে কোনোরূপে ঢাকা, বস্ত্রহীন নগ্ন বক্ষে সন্তানের অক্ষয় অমৃতভাণ্ডার পয়োধর শুষ্ক। চর্মাবৃত পঞ্জরশ্রেণী একটি একটি করিয়া গোনা যায়, সে চর্মাবৃত পঞ্জরের নিচে হৃৎপিণ্ডস্পন্দন পর্যন্ত বাহির হইতেও যেন দেখা যাইতেছে। তৈলহীন রুক্ষ বিশৃঙ্খল চুল মৃতের চুলের মত বিবৰ্ণ; দ্বিপ্রহরের উত্তপ্ত বাতাসে সেগুলা বিভীষিকাময়ীর ধ্বজা-পতাকার মত উড়িতেছে। চোখে ক্ষুধার্ত লোলুপ দৃষ্টি। সারি সারি নারীর দল কলরব করিয়া উঠিল, আমাকে মাশায়, আমাকে মাশায়। ওদিকে কতকগুলি কঙ্কালসার পুরুষ, দীর্ঘ দেহ জীৰ্ণ হইয়া কুজ হইয়া পড়িয়াছে। শিবনাথ বিভ্রান্ত হইয়া গেল। পরনে কেবলমাত্র কৌপীন। তাহারাও সকলে শীর্ণ বাহু বাড়াইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, আমাকে মাশায়, আমাকে মাশায়। মাথার উপরে দগ্ধ বিবর্ণ আকাশ, মধ্যে ধূলিমাখা অগ্ন্যুত্তপ্ত বায়ুস্তর, নিম্নে মরুভূমির মত তৃষিত ধূসর ধরিত্রী, তাহার মধ্যে মানুষের এই রূপ মুহূর্তে তাহার চোখের উপর যেন মূর্ত হইয়া উঠিল আনন্দমঠের সেই মূর্তি—মা যাহা হইয়াছেন।

শিবনাথ নতমস্তকে ভাবিতে ভাবিতে সেখান হইতে ফিরিল, কেমন করিয়া, কোন্ সাধনায় মাকে আত্মস্থ করিয়া, মা যাহা হইবেন—সেই মূর্তিতে প্রকটিত করা যায়! কোন্ সে মন্ত্ৰ!

তাহার ইতিহাস মনে পড়িল, A long line of the poorest women of Paris, riotous with hunger and rage, screaming Bread! Bread! Bread! proceeded on—! কিন্তু ইহারা চিৎকার করিতেও পারে না। চিন্তা করিতে করিতে সে বোধ করি আপনার অজ্ঞাতসারেই বাড়ির ভিতর আসিয়া উপস্থিত হইল। দুরন্ত উত্তপ্ত দ্বিপ্রহরে গৌরী ঘুমাইতেছে, রতন নিত্য তাহারাও ঘরের ভিতর আশ্ৰয় লইয়াছে। শুধু কয়টা কাক উচ্ছিষ্ট পাত্রগুলি লইয়া কলকল করিতেছে। শিবনাথ বারান্দায় বসিয়া রৌদ্রদগ্ধ আকাশের দিকে চাহিয়া ওই কথাই ভাবিতেছিল। গভর্নমেন্টের কাছে আবেদন করা বৃথা। যুদ্ধের জন্য সরকার হইতেই ওয়ার লোন ঘোষিত হইয়াছে। তোমা সবাকার ঘরে ঘরে আমার ভাণ্ডার আছে ভরে—এই একমাত্র পথ।

আচ্ছা, দেশের লোক এই রোদে গরমে ঘরের মধ্যে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে রয়েছে, আর তোমার এ কী ধারা বল তো? ভাল মানুষ কিন্তু তুমি! সারাটা দুপুর এই রোদে এবাড়ি আর ও-বাড়ি! আর দরজা নিয়ে হুট আর হাট!

শিবনাথ মুখ ফিরাইয়া চাহিয়া দেখিল, দোতলায় সিঁড়ির মুখে দাঁড়াইয়া গৌরী। তাহার আবেশ ভাঙিয়া গেল, আত্মস্থ হইয়া গৌরীর মুখের দিকে চাহিয়া সে একটু হাসিল মাত্র, কোনো উত্তর দিল না। গৌরী এ নীরবতায় আহত না হইয়া পারিল না। শিবনাথ না বলিলেও সম্মুখের সঙ্কটের কথা সে জানে, শুনিয়াছে। প্রতিদিন সে প্রত্যাশা করে, শিবনাথ তাহাকে টাকার জন্য বলিবে। তাহার টাকা তো রহিয়াছে। শিবনাথের অবস্থার অনটনের আভাস পাইয়া তাহার কান্না আসে, আপনার পিতৃকুলের অবস্থার সঙ্গে, অন্যান্য বোনদের শ্বশুরবাড়ির অবস্থার সঙ্গে তাহার স্বামীর অবস্থার তুলনা করিয়া তাহার লজ্জা হয়। উপায় থাকিলেও শিবনাথ সে উপায় প্রত্যাখ্যান করে, সেজন্য তাহার ক্রোধ হয়। এও তো সে কোনোদিন বলে নাই যে, আমার টাকায় তোমার কোনো অধিকার নাই। আর তাহাকে এমন করিয়া গোপন করারই বা প্রয়োজন কী? শিবনাথের নীরবতায় তাই সে আহত না হইয়া পারিল না, বলিল, কথার একটা জবাবই দেন দেবতা। তাতে মান্যি ক্ষয় হবে না।

কী বলব, বল? শিবনাথ আবার একটু হাসিল।

কী বলবে? কেন, কী হল তোমার, তাই বলবে।

হয় নি তো কিছু। কাজেই জিজ্ঞেস করছি, কী বলব?

উঃ, খুব কথা ঢাকতে শিখেছ যা হোক! কিন্তু মুখের চেহারাটা এমন হল কেন, শুনি?

ওটা রোদে ঘুরে ঘুরে হয়েছে।

গৌরী একটু নীরব থাকিয়া বলিল, শাক দিয়ে কখনো মাছ ঢাকা যায় না, চেহারা চাপা দিলেও গন্ধে টের পাওয়া যায়, বুঝলে? শেষ পর্যন্ত সেই আমাকেই বলতে হবে সে আমি বেশ বুঝতে পারছি। তবে সময়ে বললে দোষ কী?

শিবনাথ অপলক দৃষ্টিতে গৌরীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার দৃষ্টিতে, কথায়, মুখের রেখায় কোথাও কি এতটুকু স্নেহ লুকাইয়া নাই? গৌরী সে দৃষ্টির সম্মুখে অস্বস্তি বোধ করিল, বলিল, অমন করে তুমি চেয়ে থেকো না বাপু। ওই এক কী ধারার চাউনি তোমার! আমি জানি, চৈত্র মাসে লাটের টাকা দেওয়া হয় নি বলে মহাল সব নিলেমে উঠেছে। আমার কাছে কিন্তু সেই শেষ সময়ে গয়না কি টাকা চেয়ো না যেন; আমি দোব না, বলে রাখছি।

শিবনাথ উত্তপ্ত হইয়া উঠিতেছিল, সে গম্ভীরভাবে বলিল, আমি তো তোমার কাছে চাই নি গৌরী।

চাও নি, কিন্তু টাকা না হলেই চাইতে হবে তো?

না।

আহা, সে তো খুব সুখের কথা।-বলিয়া সে নিজের মনেই বোধ করি বলিল, মাগো, একেই বুঝি জমিদারি বলে! এ জমিদারি করার চেয়ে মুটেমজুর খেটে খাওয়া ভাল; জমিদারি, না জমাদারি!

শিবনাথের আর সহ্য হইল না, সে কঠোর স্বরে বলিল, গৌরী!

সমান তেজে গৌরী উত্তর দিল, কেন, ধরে মারবে নাকি?

শিবনাথ কঠোর সংযমে আত্মসংবরণ করিয়া কাঠের মত দাঁড়াইয়া রহিল। গৌরী সহসা কেঁপাইয়া কেঁপাইয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল।

ঠাঁকরুন!

শিবনাথ দেখিল, দুয়ারের সম্মুখে দুর্ভিক্ষের প্রকটমূর্তি সেই খোনা মেয়েটা দাঁড়াইয়া ডাকিতেছে ঠাকরুন!

নিত্য, রতন বোধ করি জাগিয়াও ঘরের মধ্যে বসিয়া ছিল, স্বামী-স্ত্রীর এই দ্বন্দ্বের মধ্যে বাহিরে আসিতে পারে নাই, এবার ওই মেয়েটার ডাকটাকেই উপলক্ষ করিয়া নিত্য দরজা খুলিয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিল, কী, কী বটে কী তোর? দুপুরবেলাতেও রেহাই নাই বাবা? যত মড়া কি উদ্ধারণপুরের ঘাটে জড়ো, সব ভিখিরি কি এখানেই এসে জুটেছে! মেয়েটা ইহাতেও লজ্জা পাইল না, ভয় পাইল না, অনুনয় করিয়া বলিল, টুকচে অ্যাঁচার দাও ঠাকরুন পায়ে পঁড়ি।

রতন বলিয়া উঠিল, হেঁকা নিগে জিভে, হেঁকা নিগে। পায় না দড়িমুড়ি, চায় মেঠাই মণ্ডা ছড়াছড়ি।

সকলের আবির্ভাবে গৌরী চোখ মুছিয়া আত্মসংবরণ করিয়াছিল, সে বলিল, আহা একটু দাও রতন-ঠাকুরঝি; আহা, জিভ তো ওদেরও আছে।

শিবনাথ বাহির হইয়া গেল।

অন্দর হইতে বাহির হইয়া একটা বড় রাস্তা-ঘর অতিক্ৰম করিতে হয়, শিবনাথকে সেখানে থমকিয়া দাঁড়াইতে হইল। দরজার মুখেই কতকগুলি বোরকা-পরা মেয়ে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। মর্যাদাশালী মুসলমান-ঘরের স্ত্রীলোক, তাহাতে সন্দেহ নাই। এখানকার সাধারণ চাষীমুসলমানদের মেয়েরা তো বোরকা পরিয়া বাহির হয় না। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর দ্বিপ্রহরে ইহারা কোথায় আসিয়াছেন, এখানেই বা দাঁড়াইয়া আছেন কেন? শিবনাথ ফিরিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিবে অথবা নিত্যকে ডাকিবে ভাবিতেছিল, এমন সময় একটি মহিলা বোরকার একাংশ মোচন করিয়া বলিল, বাপ!

শিবনাথ সসম্ভ্ৰমে বলিল, বলুন মা, আমাকে বলছেন? এই দুপুরে আপনারা কোথায় এসেছেন?

বৃদ্ধা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, এ ধূপের চেয়েও জ্বালায় জ্বলছি যি বেটা, আর এ সময় ভিন্ন। পথঘাট দিয়ে চলবারও যে যো নাই।—বলিয়া একটা পোটলা খুলিয়া কতকগুলি রুপার অলঙ্কার ও খানকয়েক সেকেলের জীর্ণ শাল বাহির করিয়া বলিল, জান বচাও বেটা, খোদা তোমার মঙ্গল করবেন। কচি বাচ্চারা না খেয়ে মরে যাবে বেটা, আর আমাদের দুশমনও বাগ মানছে না, পেট জ্বলে খাক হয়ে গেল বাপ। এ রেখে কিছু টাকা-দশটা টাকা আমাদের দাও বেটা।

শিবনাথ স্তম্ভিত হইয়া গেল, চোখে তাহার জল আসিতেছিল। এই সময়ে খোনা মেয়েটা একটা পাতায় মুড়িয়া আচার লইয়া বাহির হইয়া গেল। চোখে তাহার লালসাব্যগ্র জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। দৃষ্টি দিয়া লেহন করিতে করিতে সে চলিয়াছে, খাইলে যে ফুরাইয়া যাইবে!

বৃদ্ধা মুসলমানী বলিল, বাপ!

শিবনাথ বলিল, মা!

জান বাঁচাতে পারবি বেটা? ভুখের ভাত দিতে পারবি মানিক?

শিবনাথ বলিল, এগুলো আপনারা নিয়ে যান মা, আমি দশটা টাকা আপনাদের দিচ্ছি।

মাত্র বারটি টাকা আজ তাহার মজুত আছে, কিন্তু সে না বলিতে পারিল না।

বৃদ্ধা বলিল, বাপ, খোদা তোমার উপর বিশ থাকবেন, কিন্তু ওই শাল আমরা একদিন গায়ে দিতাম; ভিখ তো মাগতে পারব না মানিক।

বেশ তো, আপনাদের হলে আমাকে দিয়ে যাবেন ফের।

না বেটা, এমন বছরে কে বাঁচবে কে থাকবে, ঠিক তো কিছু নাই বাপ। দেনদার হয়ে গিয়ে খোদার দরবারে কী জবাব দিব বেটা? এগুলো তুমি রেখে দাও।

শিবনাথ তাহাদের আহ্বান করিয়া অন্দরে লইয়া গিয়া সসম্ভ্ৰমে বসাইল।

নিত্য বলিল, দাদাবাবু, বউদিদি বলছেন, উনি টাকা দিচ্ছেন এগুলো রেখে।

শিবনাথ কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু মুখে তাহার বিচিত্ৰ হাসি খেলিয়া গেল; গৌরী শুধু টাকাই বোঝে না, সুদও বোঝে, লাভ লোকসানে তাহার জ্ঞান টনটনে! সে টাকা দশটি বৃদ্ধার হাতে দিয়া বলিল, সুদ আমি নেব না মা, সুদ আপনাদের শাস্ত্রে নিষেধ, আমাদেরও পূর্বপুরুষদের নিষেধ আছে।

বৃদ্ধার মুখে এতক্ষণে হাসি দেখা দিল, সে হাসিয়া বলিল, আচ্ছা বেটা, আচ্ছা। মঙ্গল হবে তোমার বাপ। আচ্ছা বাপ, তুমি বাহিরে চল থোড়া, আমরা বহুমার সঙ্গে একটু আলাপ করে নিই।

শিবনাথ বাহিরে চলিয়া গেল। পথের উপর আবার আসিয়া দেখিল, ঠাকুরবাড়ির সম্মুখে ক্ষুধার্তের দল এখনও তেমনই গোলমাল করিতেছে। রাখাল সিং কেষ্ট সিং, কুরাম, সতীশ। কেহ এখনও ফেরে নাই, পথেও যতদূর দৃষ্টি যায় কাহাকেও দেখা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *