১৩. শৈলজা-ঠাকুরানীই বিচার করিলেন

শৈলজা-ঠাকুরানীই বিচার করিলেন। উদ্ধত প্রজা বেণী মণ্ডল এবং রূপলাল বাগদীর অন্যায় আচরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও তিনি করিলেন। কিন্তু বাড়ি ফিরিলেন রূদ্ধমুখ অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরির মত রূপ লইয়া। অগ্ন্যুর নাই, কিন্তু অসহনীয় উত্তাপ চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে। জ্যোতির্ময়ী—শিবুর মা যে কৌশলে তাহার মাথায় সর্বময় কর্তৃত্বের কণ্টক মুকুট পরাইয়া দিয়া তাহাকেই লঙ্ন করিয়া চলিয়া আসিয়াছেন, তাহাতে সমস্ত অন্তর ক্ষোভে ক্রোধে পুড়িয়া গেলেও মুখে সে ক্ষোভ, সে ক্রোধ প্রকাশ করিবার পথ ছিল না।

অপরাহ্রে তিনি ভ্রাতৃজায়াকে ডাকিয়া বলিলেন, দেখ বউ, কিছুদিন থেকেই মনে মনে সঙ্কল্প করেছি, কিন্তু বলি নি, বলতে পারি নি। তুমি বুদ্ধিমতী হলেও ছেলেমানুষ, তার ওপর বাড়ির বউ ছিলে। এখন তুমি একটু ভারিক্কিও হয়েছ, আর এখন তুমি শিবনাথের মা। তুমি নিজে এবার। বিষয়-সম্পত্তি বেশ চালাতে পারবে। আমাকে ভাই, এইবার ছেড়ে দাও, আমি কাশী যেতে চাই।

জ্যোতির্ময়ী অল্পক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, বেশ, তা হলে আমাকেও নিয়ে চল। আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, তুমি কোথায় যাবে আমার সঙ্গে?

ম্লান হাসি হাসিয়া জ্যোতির্ময়ী বলিলেন, না গেলে আমি এখানে কার ভরসায় থাকব।

কী, কী, কী বললে তুমি ব?—শৈলজা-ঠাকুরানী গর্জন করিয়া উঠিলেন, এতবড় অমঙ্গলের কথা তুমি বললে! কার ভরসায় তুমি থাকবে? একা শিবু তোমার শত পুত্রের সমান, শতায়ু হয়ে বেঁচে থাক সে; তুমি বলছ, কার ভরসায় থাকবে?

শিবু এখনও ছেলেমানুষ, তার ওপর সাত-আট বছর এখন তাকে বিদেশে থাকতে হবে, সেইজন্যে বলছি ভাই। এ সম্পত্তি তো আমার চালাবার ক্ষমতা নেই।

খুব আছে। তুমি নিজে কাল বলেছ, তোমার সে ক্ষমতা আছে, আজ আমি দেখেছি, তোমার সে ক্ষমতা আছে।

জ্যোতির্ময়ী চুপ করিয়া রহিলেন। ননদের প্রকৃতির সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল; তিনি বুঝিলেন, এইবার অগ্নার আরম্ভ হইবে এবং এই অগ্নি নিঃশেষে বাহির হইয়া গেলেই সব শান্ত হইবে।

শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, তুমি নিজের জেদ বজায় রাখবার জন্যে নিজে গিয়ে কাছারিবাড়িতে দাঁড়ালে। ডি ছি ছি! তোমার একটু সমীহ হল না! জান, তুমি কে? আজ দাদা থাকলে কী হত, তুমি জান?

মৃদুস্বরে জ্যোতির্ময়ী এবার বলিলেন, আমার দোষ আমি স্বীকার করছি ঠাকুরঝি।

দোষ স্বীকার করিলে, বিশেষত অপরাধীর মত নতমস্তকে দোষ স্বীকার করিলে, সে দোষ। লইয়া আর মানুষকে দণ্ড দেওয়া যায় না; কিন্তু শৈলজা-ঠাকুবানীর মনের ক্ষোভ তখনও মেটে নাই। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া তিনি আবার আরম্ভ করলেন, দোষ তোমার নয়, দোষ আমার। তোমার ঘরে তোমার বিষয়ে কর্তৃত্ব করতে যাওয়া আমার দোষ। আমি নির্লজ্জ, আমি বেহায়া, তাই এত কথার পরেও আজ নায়েব-চাপরাশীর ঝগড়ার কথা শুনে আমি দেখতে গেলাম, কেন, কিসের জন্যে ঝগড়া! তুমি শিবুকে উঠিয়ে নিয়ে এলে। কেন, আমি যখন সেখানে উপস্থিত রয়েছি, তখন শিবু অন্যায় বিচার করবে, এমন ভয় তোমার হল কেন? লেখাপড়া! লেখাপড়া না শিখলে যেন–

তাঁহার বাক্যস্রোতে বাধা পড়িল। নায়েব রাখাল সিং হন্তদন্ত হইয়া আসিয়া বলিলেন, পিসিমা! তাহার হাতে একখানা লালরঙের খাম।

জ্যোতির্ময়ীর দৃষ্টি প্রথমেই সেখানার উপর পড়িয়াছিল, তিনি শঙ্কিত কণ্ঠে প্ৰশ্ন করিলেন, ওটা কী সিংমশায়? টেলিগ্রাম?

হ্যাঁ মা। আমি তো পড়তে জানি না, পিয়নটা বললে, বাবু পাস হয়েছে ফার্স্ট ডিভিশনে। সে দাঁড়িয়ে আছে বকশিশের জন্যে।

মুহূর্তে শৈলজা-ঠাকুরানী ভ্রাতৃজায়াকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, লক্ষ্মী লক্ষ্মী—আমার লক্ষ্মী তুমি বউ। শিবু তোমার ছেলে, আমার বাপের বংশের মুখ উজ্জ্বল করলে।

জ্যোতির্ময়ীর চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল, তিনি সজল চক্ষে হাসিমুখে বলিলেন, শিবু কই, শিবু?

নিত্য-ঝি ছুটিয়া উপরে শিবুর পড়ার ঘরের দিকে চলিয়া গেল, আমি খবর দিয়ে আসি দাদাবাবুকে, বকশিশ নোব দাদাবাবুর কাছে।

বকশিশ শব্দটা কানে আসিতেই পিয়নের কথাটা জ্যোতির্ময়ীর মনে পড়িয়া গেল, তিনি বলিলেন, পিয়নকে কী দেওয়া হবে ঠাকুরঝি?

একটা টাকাই ওকে দিয়ে দিন সিংমশায়।

দুড়দুড় শব্দে সিঁড়ি অতিক্ৰম করিয়া শিবু নিচে আসিয়া ছোঁ মারিয়া টেলিগ্রামখানা লইয়া খুলিয়া পড়িল, পাস্ ইন দি ফাষ্ট ডিভিশন, মাই বেস্ট ব্লেসিংস—রামরতন।

শিবুর উচ্ছ্বাস যেন বাড়িয়া গেল। সে বলিল, মাস্টারমশায়—আমার মাস্টারমশায় টেলিগ্রাম করেছেন পিসিমা। রামরতন–রামরতন লেখা রয়েছে।

মাস্টার-আমাদের মাস্টার?—বিস্মিত হইয়া পিসিমা প্রশ্ন করিলেন, মাস্টার কলকাতা গেল কী করে?

জ্যোতির্ময়ী বলিলেন, কোনো কাজে গিয়ে থাকবেন হয়ত।

পিসিমা বলিলেন, টাকা দিলে তো মাস্টার নেবে না, তাকে আমি সোনার চেন আর ঘড়ি দোব এবার। সে গরিব মানুষ, তবু খবরটা পেয়ে খরচ করে টেলিগ্রাম করেছে তো!

আমি গোঁসাইবাবাকে খবর দিয়ে আসি পিসিমা। আমার বাইসিটা? নিত্য, ছুটে গিয়ে বল তো কাছারিতে আমার বাইসিক্লটা বের করতে। আমার জামা?

শিবু তাড়াতাড়ি আবার উপরে উঠিয়া গেল।

শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, ঠাকুরদের সব পুজো দিতে হবে বউ, বাবা বৈদ্যনাথের পুজোর টাকাটা এখুনি কাপড় ছেড়ে তুলে ফেলি। আর সব দেবতার পুজো, সে তো কাল ভিন্ন হবে। না।

জ্যোতির্ময়ী বলিলেন, বৈশাখ মাস, গ্রামের ঠাকুর-দেবতার সব সন্ধ্যের শীতল-ভোগের ব্যবস্থা কর না ঠাকুরঝি।

বেশ বলেছ বউ, ও কথাটা আমার মনেই ছিল না। আর তোমার মত বুদ্ধি আমার নেই, সে কথা মন খোলসা করে স্বীকার করছি ভাই।

জামা গায়ে দিয়া শিবু নামিয়া আসিয়া বলিল, আমার বন্ধুদের কিন্তু ফিস্ট দিতে হবে। তিরিশ টাকা লাগবে, তারা সব হিসেব করে রেখেছে।—বলিতে বলিতেই সে বাহির হইয়া গেল। পিসিমা পূজার টাকা পৃথক ভাগে চিহ্নিত করিয়া রাখিয়া দিয়া বাহিরে আসিয়া বলিলেন, আমার পাগলী বউমা আজ বাড়িতে নেই ভাই, সে থাকলে তার আবদারটা একবার দেখতে। সেও হয়ত বলত, আমাকে এই দিতে হবে, ওই দিতে হবে।  জ্যোতির্ময়ী কোনো উত্তর দিলেন না, শুধু একটু মেহের হাসি হাসিলেন। রতন অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিল, মামীমা, এইবার কিন্তু বউকে নিয়ে এসো বাপু, বউ না হলে আর ঘর মানাচ্ছে না। বউও তো আর নেহাত ছোটটি নেই, এগার বছর বোধহয় পার হল।

শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, একখানা চিঠি লেখ তো ভাই বউ। এই বোশেখ মাসেই আমার বউ পাঠিয়ে দিতে হবে।

জ্যোতির্ময়ী তাঁহার অভ্যাসমত হাসি হাসিয়া বলিলেন, কাল লিখব ঠাকুরঝি।

শৈলজা-ঠাকুরানী বিরক্ত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, তোমার ওই হাসি দেখে সময় সময় আমার রাগ ধরে ভাই বউ। কেন, কাল লিখবে কেন? আজ লিখলে দোষটা কী শুনি?

জ্যোতির্ময়ী বলিলেন, শিবুর এখন পড়ার সময়, বউমাও এখন ছেলেমানুষ থাকুক না সে আরও কিছুদিন। আর আমরা তো বউমাকে পাঠাই নি ভাই, তারাই নিয়ে গেছেন জোর করে। পাঠিয়ে তারাই দেবেন নিজে থেকে।

শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, সে কথা সত্যি। কিন্তু–। কথাটা না বলিয়াই তিনি চুপ করিয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার বলিলেন, বেশ বউমাকে আমার শিবুর পাসের খবরটা দাও। লিখে দাও, বাবা বিশ্বনাথের কাছে যেন পুজো দেয়। আর কিছু টাকা-পঁচিশটা টাকা তাকে পাঠিয়ে দাও। তার দিদিমার যেন টাকার অভাব নেই, কিন্তু আমাদের বউ তত।

সত্য সত্যই শৈলজা-ঠাকুরানীর চিত্ত আজ ছোট্ট নান্তির জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে। আশ্চর্যের কথা, নান্তি চোখের সম্মুখে থাকিলে সামান্য ক্রটিতে তাহার উপর রাগ হইয়া যায়, কিন্তু চোখের আড়ালে গেলে শিবনাথের বধূর উপর তাহার মমতার আর সীমা থাকে না। মনে হয়, শিবুর বউ একটু আদরিণী চঞ্চলা না হইলে মানাইবে কেন? আর একটু দুরন্ত জেদী অভিমানিনী না হইলে শিবু বশ্যতা স্বীকার করিবে কেন?

প্রখর গ্রীষ্মের রৌদ্রের তেজ তখনও কমে নাই, বাতাস যেন অগ্নিসাগরে স্নান করিয়া বহিয়া। আসিতেছে। তাহার মধ্যে শিবু চলিয়াছিল। বাইসিটা বেশ জোরেই চলিতেছিল, কিন্তু শিবনাথের যেন তাহাতেও তৃপ্তি হইতেছিল না। সে রেসের ঘোড়ার জকির মত বাইসিটার উপর গুড়ি হইয়া পড়িয়া প্ৰাণপণে প্যাডল করিতেছিল। সহজ অবস্থাতেই বাইসি অথবা ঘোড়ায় চড়িয়া কখনও ধীর গতিতে চলিতে চায় না, দুরন্ত গতিতে অবাধ প্রান্তরে গাড়ি চালাইয়া অথবা ঘূর্ণির মত পাক দিয়া ফেরা তাহার অভ্যাস। সেই অভ্যাসের উপর আজ মনের গতি উৎসাহের আতিশয্যে দুর্নিবার হইয়া উঠিয়াছে।

তাহার মনে পড়িতেছিল হেডমাস্টার মহাশয়ের কথা। যেদিন তাহারা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবার জন্য স্কুল হইতে বিদায় গ্রহণ করে, সেদিন তিনি বলিয়াছিলেন, ওয়েল, মাই বয়েজ, আই উইশ ইউ সাকসেস ইন দি একজামিনেশন, গুড লাক ইন লাইফ! আজ দশ বছর ধরে তোমরা এই স্কুলটির মধ্যে অ্যাঁচার পাখির মত বন্দি হয়ে ছিলে, আজ তোমাদের পাখায় উপযুক্ত বল সঞ্চিত হয়েছে, কণ্ঠে স্বর-লয়-তান পেয়েছে; তাই তোমাদের পৃথিবীর বুকে মুক্তি দিচ্ছি। সম্মুখে তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে গিয়ে তোমরা কৃতকার্য হও। গ্রামকে জেনেছ, দেশকে জান, পৃথিবীকে জান, আপন জীবনের পথ করে নাও। তারপর হাসিয়া আবার বলিয়াছিলেন, তোমরা আর বয়েজ থাকবে না, এবার জেন্টলমেন অ্যাট লার্জ হবে।

সে এখন জেন্টলম্যান, বালক নয়, কিশোর নয়, জেন্টলম্যান-ভদ্রলোক। একটি সম্মানের আসন তাহার জন্য নির্দিষ্ট হইয়া গিয়াছে। গাড়িটার দ্রুতবেগহেতু উভয় পার্শ্বের পারিপার্শ্বিক শনশন করিয়া পিছনের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে, ভাল করিয়া কিছু দেখা যায় না। কিন্তু শিবুর মনে হইল, সকল লোক সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া আছে। সহসা আপনা হইতেই তাহার গতিবেগ শিথিল হইয়া আসিল। একটা বিশ্ন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া গাড়ির উপর সে সোজা হইয়া বসিল। তাহার বধূকে মনে পড়িয়া গিয়াছে—নান্তি, গৌরী। সে থাকিলে আজ বিস্ময়ে পুলকে বারবার তাহার দিকে অবগুণ্ঠনের অন্তরাল হইতে সহাস্য দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিত। সে নিশ্চয় বলিত, হ্যাঁ, ও পাস করতে পারত কিনা, আমার পয়ে পাস হয়েছে। তাহাকে আজ একখানা চিঠি। দিতে হইবে। মন আবার চকিত হইয়া উঠিল, শুধু নাস্তিকে নয়, অনেক জায়গায় চিঠি দিতে হইবে। যেখানে যত–

হো সবুজ গাড়িকা আসোয়ার!—পিছন হইতে কাহার কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল, হো সবুজ গাড়িকা আসোয়ার!

শিবু হাসিয়া ব্রেক কষিল। কমলেশ, এ কমলেশ ছাড়া আর কেহ নয়। কমলেশ ও তাহার। গাড়ি একসঙ্গে আসিয়াছিল, কমলেশের গাড়ির রঙ চকোলেট রঙের, তাহার গাড়ির রঙ সবুজ। কমলেশ পিছনে পড়িলে ওই বলিয়াই হাঁক দেয়। বেচারা কমলেশ! নান্তিকে লইয়া এই বিরোধের পর হইতে তাহাদের বাড়িতে যাইতে পারে না। আর তাহারও কেমন বাঁধ-বাধ ঠেকে।

সশব্দে কমলেশের গাড়িখানা পাশে আসিয়া থামিল। শিবু সহাস্যে বলিল, শুনেছ?

নিশ্চয়। নইলে পলাতক আসামিকে এমনিভাবে ধরার জন্যে ছুটি! তারপর, এমন উর্ধ্বশ্বাসে চলেছ কোথায়?

দেবীমন্দিরে। মাকে প্রণাম করে আসি, গোঁসাইবাবাকে প্রণাম করে আসি।

চল।

চলিতে চলিতে কমলেশ বলিল, চল না, দিনকতক বেড়িয়ে আসি। মামা এসেছেন কিনা, তিনি বললেন, যাও না, শিবুকে নিয়ে কাশী ঘুরে এস না দিনকতক।

শিবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বলতে পারছি না এখন।

এতে ভাববার কী আছে?

অনেক। সে পরে হবে এখন। বলিতে বলিতেই সে গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িল। দেবীর স্থানে তাহারা আসিয়া পড়িয়াছে। কমলেশও নামিয়া পড়িল।

নিবিড় জঙ্গলে ঘেরা আশ্রম—বহুকালের প্রাচীন তন্ত্রসাধনার স্থান। রামজী সাধু সদাপ্ৰজ্বলিত ধুনির সম্মুখে একটি ছোট বাঁধানো আসনের উপর বসিয়া ছিলেন। দেবীমন্দিরের পূজক পুরোহিত কয়েকজন পাশে বসিয়া গল্প করিতেছিল। শিবু ঝড়ের মত আসিয়া বলিল, গোঁসাই-বাবা, আমি পাস হয়েছি, ফাষ্ট্র ডিভিশনে পাস হয়েছি।

সাধু মুহূর্তে আসন ছাড়িয়া উঠিয়া শিবুকে শিশুর মত বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, জিতা রহো বেটা; বাবা হামার।

শিবু বলিল, ছাড়, তোমাকে প্রণাম করি। মাকে প্রণাম করি।

সন্ন্যাসী আশীর্বাদ করিয়া দেবীর আশীর্বাদী বিপত্রের মালা শিবুর গলায় পরাইয়া দিয়া বলিলেন, বাস, এখন আপনা রাজ করো বেটা, বাপ-দাদাকে গদ্দিমে বৈঠো, জিমিদারি দেখো, দুষ্টকে দমন করো, শিষ্টকে পালন করো।

কমলেশ মৃদু মৃদু হাসিতেছিল। শিবু আরক্তিম মুখে সন্ন্যাসীকে বলিল, এখন আমি পড়ব গোঁসাই-বাবা।

হাঁ! বাহা বাহা, বেটা রে হামার! উ তো ভাল কথা রে বাবা। তা তুমার জিমিদারি কৌন্‌ চালাবে বাবা?

এখনই আমার জমিদারি দেখবার সময় হয়েছে নাকি?

হা-হা করিয়া হাসিয়া সন্ন্যাসী বলিলেন, আরে বাপ রে বাপ রে! এখনও তুমি ছোট আছ বাবা! জানিসরে বাবা, আকবর বাদশা বারো বরষ উমরসে হিন্দুস্থানকে রাজ চালায়েছেন। লিখাপড়িতি না শিখিয়েছিলেন আকবর শা। তবভি কেতনা লড়াই উনি জিতলেন, তামাম হিন্দুস্থান উনি জয় করিয়েছিলেন।

কমলেশ বলিল, ছত্রপতি শিবাজীও লেখাপড়া জানতেন না।

করজোড়ে নমস্কার করিয়া সন্ন্যাসী বলিলেন, আরে বাপ রে, মহারাজ শিউজিমায়ী ভবানীকে বরপুত্র। জিজ্জাবাই মা-ভবানীকে সহচরী জয়া কি বিজয়া কোই হোবে। হিন্দুধরমকে উনি রাখিয়েছেন রে বাবা। হামার পল্টন যব পুনামে ছিলো, তখুন দেখিয়েছি হামি উন্‌কে কীর্তি।

শিবু বলিল, আজ সন্ধেবেলায় কিন্তু যেতে হবে, লড়াইয়ের গল্প বলতে হবে।

সন্ন্যাসী সৈনিকের মত বুক ফুলাইয়া দাঁড়াইয়া হাকিয়া উঠিলেন, টানান্‌শান।

কমলেশ হাসিয়া বলিল, অ্যাটেনশন।

শিবু মুখ না ফিরাইয়া বলিল, জানি। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সন্ন্যাসীর বীরভঙ্গিমার দিকে চাহিয়া ছিল। সন্ন্যাসী আবার হাকিলেন, রাট বাট ট্রান। সঙ্গে সঙ্গে রাইট অ্যাবাউট টার্ন করিয়া হাসিয়া বলিলেন, সনঝাতে কুইক মাচ করিয়ে যাবে হামি বাবা। এখুন তুমি লোক কুইক মাচ করো। এহি বাজল বিউগল। মুখে তিনি অতি চমৎকার বিউগলের শব্দ নকল করিতে পারেন। কিন্তু বিউগল বাজানো আর হইল না, তিনি বিস্মিত হইয়া কাহাকে প্ৰশ্ন করিলেন, আরে আরে, তুমি কাঁদছিস কেনে মায়ী?

শিবু ও কমলেশ বিস্মিত হইয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল, একটি প্রৌঢ়া নিম্নজাতীয়া স্ত্রীলোক পিছনে দাঁড়াইয়া নিঃশব্দে কাঁদিতেছে। কমলেশ ব্যগ্ৰভাবে প্ৰশ্ন করিল, ফ্যালার মা, কাঁদছিস কেন তুই?

ফ্যালা কমলেশের বাড়ির মাহিন্দার, গরুর পরিচর্যা করে। ফালার মা কমলেশকে দেখিয়া ড়ুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ওগো বাবু গো, ফেলা আমার সরদ-গরম হয়ে মাঠে পড়ে রইছে গো। ওগো, গোঁসাইবাবাকে বলে দাও একবার গাড়িখানি দিতে।

অনেক প্ৰশ্ন করিয়া বিবরণ জানা গেল, ফ্যালা কমলেশদেরই আদেশক্রমে মাটির জালা আনিবার জন্য তিন ক্রোশ দূরবর্তী গ্রামে কুমোর-বাড়ি গিয়াছিল, ফিরিবার পথে সহসা অসুস্থ হইয়া এই দেবীমন্দিরের অনতিদূরে জ্ঞানশূন্যের মত পড়িয়া আছে। সংবাদ পাইয়া বিধবা মা ও তরুণী পত্নী সেখানে গিয়াছিল, কিন্তু ফ্যালার মত জোয়ানকে তুলিয়া আনিবার মত সাধ্য তাহাদের হয় নাই। তাই পুত্রবধূকে সেখানে রাখিয়া সে এই নিকটবর্তী দেবীস্থানেই ছুটিয়া আসিয়াছে। ফ্যালার মা কমলেশের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া কহিল, ওগো বাবু, তুমি গোঁসাইবাবাকে বলে দাও গো।

কমলেশকে বলিতে হইল না, সন্ন্যাসী বলিলেন, আরে হারামজাদী বেটি, তু কানসি কেনে? চল, কাহা তুমার লেড়কা, হামি দেখি।—বলিয়া নিজেই বলদ দুইটা খুলিয়া গাড়িতে জুতিয়া ফেলিলেন।

শিবু বলিল, দাঁড়াও গোঁসাই-বাবা, কতকগুলো খড় দিয়ে দিই। বাঁশগুলো বেরিয়ে আছে, পিঠে লাগবে যে।

 

প্ৰকাণ্ড জোয়ান, মাটিতে পড়িয়া আছে একটা সদ্য-কাটা গাছের মত। মাথার শিয়রে তরুণী বধূটি ভয়ে উদ্বেগে মাটির পুতুলের মত বসিয়া আছে। মধ্যে মধ্যে রোগী অনুনাসিক সুরে চাহিতেছে, জঁল।

চারিদিকে লাল কাকরের প্রান্তর ধু-ধু করিতেছে। বৈশাখের বিশেষ করিয়া এ বৎসরের নিদারুণ গ্রীষ্মের উত্তাপ মানুষের দেহেরও জলীয় অংশ শোষণ করিয়া লইতেছে। কোথাও জলের চিহ্ন নাই। সন্ন্যাসী বলিলেন, কঁহাসে জল আনলি রে মায়ী?

বধূটি নীরব হইয়া রহিল, ফ্যালার মা বলিল, আজ্ঞে জল কোথা পাব বাবা?

শিবু তিরস্কার করিয়া বলিল, ওখানে বললি না কেন যে, জল খেতে চাচ্ছে? যাই, আমি সাইক্লে করে নিয়ে আসি।

সন্ন্যাসী আঙুল দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তব ও জল কাঁহাসে আইলো রে? ওহি রে মাটি

ভিঁজা।

উ মাশায় বমি করেছে। আখের রস খেয়েছে কিনা, ওই রোদে মেতে উঠেছে প্যাটে। তাই তুলে ফেলিয়েছে। মাঠেও যেয়েছে কবার আশায়।

ফ্যালা অসাড়ের মত পড়িয়াই কহিল, চার বার। হাতখানা তুলিয়া বুড়া আঙুলটা মুড়িয়া চারিটা আঙুল মেলিয়া ধরিল, কিন্তু পরক্ষণেই হাতখানা আপনি এলাইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।

হাঁ, বমিভি হইয়াছে। সন্ন্যাসী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, হায় হায় বেটা, এতনা বড় বীর, এক পরশমে-আঃ, হায় হায় রে!

জল—শিবু বাইসিক্লের ব্রেক কষিয়া নামিয়া জলপাত্রটা বাড়াইয়া দিল।

ফ্যালা আকুল আগ্রহে দুই হাত বাড়াইয়া চাহিল, জঁল অ্যাঁল, পেঁপেঁ, আমাকে পেঁ।

মায়ের হাত হইতে পাত্ৰটা কাড়িয়া লইয়া ঢকটক করিয়া জল পান করিতে আরম্ভ করিল। সে তৃষ্ণা যেন মিটিবার নয়, ওই দগ্ধ প্রান্তরের তৃষ্ণার মত যেন একখানা মেঘ সে নিঃশেষে পান করিতে পারে।

ফ্যালার মা বলিল, এইবার উঠতে পারবি বাবা ফ্যালা? আস্তে আস্তে গাড়িতে ওঠ দেখি।

শিবু ও কমলেশ একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, না না, আমরা ধরি, উঠিস নি তুই।

মুহূর্তে সন্ন্যাসী তাঁহার বিশাল বাহু প্রসারণ করিয়া পথরোধ করিয়া বলিলেন, রহো। হাম উঠা দেতা হ্যায়। অবলীলাক্রমে ফ্যালার বিশাল দেহখানি দুই হাতে শিশুর মত গাড়িতে উঠাইয়া দিলেন। তারপর বলিলেন, তুমি গাড়ি নিয়ে যেতে পারবি রে ফ্যালাকে মায়ী?

একটু লজ্জিতভাবেই ফ্যালার মা বলিল, তা পারব আজ্ঞে, আমরা ছোটনোকের মেয়ে।

সন্ন্যাসী গম্ভীরভাবে শিবু ও কমলেশকে বলিলেন, বাড়ি চলে যাও তুমি লোক। উসকে মত পরশ করো।

কেন?

কলেরা হয়েছে উসকো বেটা।

কলেরা? তবে তুমি ছুঁলে যে?

হাসিয়া সন্ন্যাসী বলিলেন, হামি যে সন্ন্যাসী রে বেটা। হামি যদি ম যাই, তব কৌন্ ক্ষতি হেহাবে রে বেটা? কৌ দুখ পাবে?

শিবুর চোখ মুহূর্তে জলে ভরিয়া উঠিল। সে মুখ ফিরাইয়া লইয়া সঙ্গে সঙ্গে বাইসিক্লের প্যাড়লে পা দিল। সন্ন্যাসী ডাকিলেন, শুন রে, এ বাবা হামার, শুন শুন।

শিবু পিছন ফিরিয়াই অপেক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সন্ন্যাসী বলিলেন, নেহি রে বাবা, হামি যায়কে খুব গরম পানিসে সব ধো দেবে—আচ্ছা করকে, থোড়া চুনা দেকে মর্দন কর দেবে। উসকো বাদ ভস্ম ডলেগা অঙ্গমে।

শিবু ও কমলেশ আশ্চর্য হইয়া গেল। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের কথা তাহাদের মনে পড়িয়া গেল।

শিবু ঘাড় নাড়িয়া বলিল, তুমি তা হলে মিছে কথা বল, তুমি নিশ্চয় লেখাপড়া জান।

হা-হা করিয়া হাসিয়া সন্ন্যাসী বলিলেন, লেখাপড়ি-ক খ, ইংরি এ বিউ হামি জানে না রে বেটা। ই সব হামি পল্টনমে শিখিয়েছিলো বেটা।

শিবু বাইসিক্লে উঠিতে উঠিতে বলিল, যে সন্ধেবেলা। মাফ করো বাবা। আজ হামি যাবে না।

শিবু আপত্তি করিতে যাইতেছিল, কিন্তু কমলেশ বলিল, আজ সন্ধেতে আমাদের সমিতির সকলকে একবার ডাকলে হয় না?

ঠিক কথা। শিবুর মন উদ্যমে ভরিয়া উঠিল। সে সানন্দে সন্ন্যাসীকে বলিল, তা হলে কাল।

সন্ন্যাসী নিষ্কৃতি পাইয়া যেন বাঁচিয়া গেলেন। মরণের স্পৰ্শতাহাকে কি বিশ্বাস আছে, যদি কোথাও কোনোখানে একবিন্দু লুকাইয়া থাকে! গেলেই তো শিবু কঁপ দিয়া বুকে আসিয়া পড়িবে। দেবীর আশ্রমে প্রবেশ করিয়া তিনি হাঁকিলেন, আরে ভোলা লে আও (তা থোড্রসে চুনা। আওর গরম পানি বানাও তো এক কলস।

ভোলা ট্ৰাতে দাঁত ঘষিয়া আপন মনেই বলিল, দেখ, ব্যাটা শেয়ালমারার খেয়াল দেখ। এই গরমে এক কলস গরম পানি!

সন্ন্যাসী অপর একজনকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, এ ভাগনা শিরপত, বানাও তো ভাই আচ্ছা তরেসে এক ছিলম গাঁজা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *