• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১০. ঘটনাটা হয়ত সামান্য

লাইব্রেরি » তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় » ধাত্রী দেবতা (১৯৩৯) » ১০. ঘটনাটা হয়ত সামান্য

ঘটনাটা হয়ত সামান্য এবং নগণ্য, বৈশাখের অপরাহ্রের ছোট সামান্য একটুকরা মেঘের মত দেখিতে দেখিতে বিপুল পরিধিতে পরিণতি লাভ করিয়া যেন কালবৈশাখীর সৃষ্টি করিয়া তুলিল, এক দিকে পিসিমা, অন্য দিকে নান্তির দিদিমা। পিসিমার সমস্ত আক্রমণ বধুর ওপর; তিনি বলেন, পরকে বলবার আমার অধিকার কী? তারা তো আমার কি আমার বংশের অপমান করে নি, করেছে ওই বউ।

নান্তির দিদিমা বলেন, ঘর তো আমার নান্তির, নান্তির শাশুড়ি বললে নান্তি সইতে পারত, কিন্তু ও কোথাকার কে?

শিবনাথের মা বারবার দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ করিয়াছিলেন, না, এ বাড়ির মালিক ঠাকুরঝি। আমি শিবনাথকে দশ মাস দশ দিন গৰ্ভে ধরেছি, কিন্তু ঠাকুরঝি তাকে পনের বছর পালন করেছেন বুকে করে। ও রকম কথা যে বলবে, তার ভুল।

পিসিমা ডাকিলেন, শিবনাথ!

শিবনাথ পাশেই দাঁড়াইয়া ছিল। সে যেন অকস্মাৎ বড় হইয়া উঠিল, গভীর আন্তরিকতাপূর্ণ স্বরে সে উত্তর দিল, তোমার হুকুমও যা, আমার বাবার হুকুমও তাই পিসিমা।

পিসিমা সেদিন এক নিমেষে যেন জল হইয়া গেলেন। মা সস্নেহ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চাহিয়া রহিলে, তাহার চোখে জল আসিতেছিল। পিসিমা শিবুকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, আমার দাদা কী বলতেন জান বউ, বলতেন ভগ্নী আর যজ্ঞােপবীতে কোনো তফাত নেই।

পরিতুষ্টির আর তাহার সীমা ছিল না। হাসিমুখেই দিন চলিতেছিল। দিন কয় পর তিনি বলিলেন, বউমাকে আমি নিয়ে আসব বউ। আমার বউ

শিবনাথও কাছেই বসিয়া ছিল, সে বলিল, না। সে হবে না পিসিমা। ওরা নিয়ে গেছে, ওরাই দিয়ে যাবে।

শিবনাথের মা বলিলেন, শিবনাথ ঠিক বলেছে ঠাকুরঝি।

পিসিমা চুপ করিয়া রহিলেন।

নিত্য-ঝি আসিয়া বলিল, এক গামলা গুড় বের করলাম, আর করব?

পিসিমা হা-হা করিয়া হাসিয়া গড়াইয়া পড়িলেন, তাহার হাস্যধ্বনির মধ্যে নিত্যর অবশিষ্ট কথা ঢাকা পড়িয়া গেল। হাসিতে হাসিতেই তিনি বলিলেন, পোড়ারমুখীর মুখটা দেখ!

নিত্যর মুখে কয় স্থানে গুড় লাগিয়া মুখখানা বিচিত্রিত হইয়া উঠিয়াছে।

মা ও শিবনাথ মৃদু একটু হাসিল মাত্র।

নায়েব বাহির হইতে ডাকিলেন, নিত্য!

পিসিমা বলিলেন, দূরদালানে আসন পেতে দে মতির মা। আসুন সিংমশায়।

তিনি উঠিয়া গেলেন।

নায়েব বলিলেন, মহলের প্রজারা এসেছে সব ধানের জন্যে।

পিসিমা প্রশ্ন করিলেন, ধানের জন্যে।

আজ্ঞে হ্যাঁ, অধিকাংশ লোকেরই ঘরে এবার খাবার নেই। গত বৎসর অজন্মা গেছে।

হুঁ। যা হয়েছিল, সেটুকু জমিদার মহাজনেই গ্রাস করেছে।

তারপর জানালার ফাঁক দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া বলিলেন, এবার তো দেখছি অনাবৃষ্টি হল। শ্ৰাবণের পনের দিন চলে গেল, এখনও বর্ষা নামল না।

নায়েব বলিলেন, সেই কথাই আমি ভাবছিলাম। এই সম্পত্তি মাথায়, তার ওপর সংসার খরচ, ধান হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।

কিন্তু এ সময়ে প্রজাকে না রাখলে তো চলবে না, সে যে অধর্ম হবে। তারপর একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, একটা হামার সংসার-খরচের জন্যে রেখে দুটো আমার খুলে দিন।

নায়েব বলিলেন, আশ্বিনের লাট তো মাথার ওপর, অষ্টম আছে কার্তিক মাসে।

পিসিমা বলিলেন, ভগবান আছেন সিংমশায়। ওগো রতন, আর একবার ভাত চড়াতে হবে, মহল থেকে প্রজারা এসেছে।

নায়েব চলিয়া যাইতেছিলেন, পিসিমা বলিলেন, দাঁড়ান একটু। ওপাড়ার চাটুজ্জেদের মেয়ের বিয়ে, আধ মন মাছ, দু গাড়ি কাঠ তাদের দিতে হবে। মহলে গোমস্তাকে বরাত করে দিন।

নায়েব চলিয়া গেলেন। জল খাওয়া শেষ করিয়া শিবনাথ কাছে আসিয়া বলিল, আমাকে কিছু ধান দিতে হবে পিসিমা।

ধান? ধান নিয়ে কী করবি?

শিবনাথ বলিল, আমরা একটা দরিদ্রভাণ্ডার করব। সবারই কাছে কিছু কিছু ধান চাল ভিক্ষে করে–

পিসিমা বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন, ভিক্ষে করে?

হ্যাঁ, চেয়ে নিয়ে এক জায়গায় জমা করব গরিবদের জন্যে।

পিসিমা রূঢ়ভাবে ভ্ৰাতৃজায়ার দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, এসব বুঝি তোমার শিক্ষা বউ?

শিবনাথের মা হাসিয়া বলিলেন, এ তো কুশিক্ষা নয় ভাই।

পিসিমা বলিলেন, এ বাড়ির ছেলের পক্ষে সুশিক্ষা নয় ভাই।

তারপর শিবুকে বলিলেন, ধান আমি তোমায় দিচ্ছি শিবু, তুমি নিজের কাছারিতে বসে নিজে হাতে দান কর।

শিবনাথ বলিল, একা আমরা কজনের দুঃখ দূর করব পিসিমা? একটা গল্প বলি শোন পিসিমা, একজন চাষার সাত ছেলে ছিল। কিন্তু ভাই-ভাইয়ের মধ্যে একবিন্দু মিল ছিল না। একদিন তাদের বাপ কতকগুলো সরু সরু কাঠি এনে–

পিসিমা বলিলেন, ও গল্প আমি জানি শিবনাথ, কিন্তু আমাদের বংশ আগাছার ঝাড় নয়, এ বংশ আমাদের শালগাছের জাত। যতক্ষণ খাড়া থাকবে, একা একাই ছায়া দেবে, ডালে পাতায় বহু পাখিকে আশ্রয় দেবে।

শিবনাথ বলিল, অহঙ্কার করা ভাল নয় পিসিমা।

পিসিমা বলিলেন, অহঙ্কার কার কাছে করলাম? এ তোমাকে আমি শিক্ষা দিচ্ছি। আমাদের বংশে প্রকাশ্যে দান কেউ করে নি। বাবা বলতেন, নামের লোভে দানে পুণ্য হয় না। অভাবী গেরস্থের বাড়িতে সকালে মুটেতে মাথায় করে তত্ত্ব নিয়ে যেত, বলত—আপনাদের অমুক কুটুমবাড়ি থেকে আসছি।

শিবনাথ চুপ করিয়া রহিল।

পিসিমা বলিলেন, আচ্ছা, ধান আমি দেব, কিন্তু তুমি ওসবের মধ্যে থাকতে পাবে না, যারা করছে করুক।

শিবনাথ বলিল, আমাকে যে সেক্রেটারি করেছে সব।

মা বলিলেন, বেশ তো শিবু, সেক্রেটারি অন্য কেউ হবে। নামটাই তো বড় নয়। আর তোমার এবার পরীক্ষার বৎসর, ওতে পড়ারও ক্ষতি হবে।

শিবনাথের কথাটা বোধহয় মনঃপূত হইল না, সে নীরবে কম্পাসের কাটার অগ্রভাগ দিয়া দেওয়ালে একটা পরিকল্পনাহীন চিত্র অ্যাঁকিতে আরম্ভ করিল।

পিসিমা বলিলেন, লোহার দাগ দিও না, ঋণ হয়।

নায়েব রাখাল সিং বহুদৰ্শী ব্যক্তি। তাহার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হইল। আশ্বিনের মালখাজনা কোনোরূপে মহাল হইতে হইলেও কার্তিক যষমাহের টাকার কিছুই আদায় হইল না। গত বৎসর অজন্মা গিয়াছে, এ বৎসরও অধিকাংশ কৃষিক্ষেত্র বন্ধ্যার মত কঠিন ঊষর হইয়া পড়িয়া আছে। অথচ অষ্টমে বাঁড়ুজ্জেবাবুদের অনেক টাকা দেয়। ঘরের ধান পর্যন্ত প্রজাদের দেওয়া হইয়াছে। পিসিমা চিন্তার গাম্ভীর্যে গভীর হইয়া উঠিলেন। কপালের চিন্তারেখাগুলি সর্বদাই সুস্পষ্টরূপে প্রকটিত হইয়া থাকে।

নায়েব বলিলেন, ঋণ ছাড়া আর কোনো উপায় তো নেই মা।

শিবনাথের মা বলিলেন, না, আমার গয়না বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করুন।

পিসিমা তিরস্কারপূর্ণ স্বরে বলিয়া উঠিলেন, ছি বউ, আমাকে তুমি এ কথা শোনালে? তুমি আমার দাদার স্ত্রী, আমার ঘরের লক্ষ্মী, ভগবান তোমায় আভরণহীনা করেছেন, তার ওপরে আমার হাত নেই। আমি তোমার অলঙ্কার বেচব? ছি!

মা হাসিয়া বলিলেন, এটা নেহাত মিথ্যে অপমানবোধ ঠাকুরঝি। ঋণ করার চেয়ে সে অনেক ভাল। তুমিও তো তোমার গয়না তোমার ভাইয়ের বিপদের সময় বিক্রি করে টাকা দিয়েছ।

দিয়েছি, তুমি আর আমি সমান নয় ভাই। আর ভগবান করুন, ভবিষ্যতে যেন আমার কথার দাম কখনও বুঝতে না হয়। নইলে আমার কথা একেবারে মূল্যহীন নয়। আপনি ঋণের ব্যবস্থা দেখুন সিংমশায়, যোগীন্দ্রবাবু উকিলকে পত্র দিন।

নায়েব বলিলেন, তিনি বিয়ের দরুন কিছু টাকা পাবেন। আর সুদের হার যোগীন্দ্রবাবুর বড় বেশি। আমি বলছিলাম, বাবুর মামাশ্বশুরকে

পিসিমা কটাক্ষ দৃষ্টিতে নায়েবের দিকে চাহিয়া বলিলেন, আপনি যোগীন্দ্রবাবুকে চিঠি লিখুন। গিয়ে।

নায়েব বলিলেন, বাবুকে একবার জিজ্ঞাসা—

মা বলিলেন, না।

নায়েব চলিয়া গেলেন।

 

শিবনাথ দোতলায় খাটের উপর বসিয়া আঙ্কল টমস্ কেবিন পড়িতেছিল। বইখানা সে স্কুলে প্রাইজ পাইয়াছে। এতদিন পড়িবার অবকাশ হয় নাই। পূজার ছুটি পাইয়া সে বইখানা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল। প্রথমবার পড়িয়া সমস্ত বেশ বুঝিতে পারে নাই, আখ্যানভাগ একবার পড়িয়া তৃপ্তিও হয় নাই, সে আবার বইখানা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল।

জীবনে সে প্রথম উপন্যাস পড়িয়াছে—আনন্দমঠ। পড়িয়াছে নয়, শুনিয়াছে মা তাহাকে পড়িয়া শুনাইয়াছিলেন। সেদিন পিসিমা বাড়িতে ছিলেন না। কোনো পর্বোপলক্ষে গঙ্গাস্নানে গিয়াছিলেন। মায়ের কাছে শিবনাথের ঘুম আসিতেছিল না।

মা হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী রে, ঘুম আসছে না?

শিবনাথ বলিয়াছিল, না।

মা বলিয়াছিলেন, গল্প বলি একটা, শোন্।

শিবনাথ বিরক্ত হইয়া বলিয়াছিল, না। আর এক ছিল রাজা শুনতে ভাল লাগে না আমার।

মা আলমারি খুলিয়া একখানি বই টানিয়া লইয়া বসিলেন, তবে এ বই পড়ি, শোন্। বঙ্কিমবাবুর আনন্দমঠ।

রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া গেল, বই শেষ হইলে মা প্রশ্ন করিয়াছিলেন, কেমন লাগল?

শিবুর চোখে জল ছলছল করিতেছিল। তখন শিবু থার্ড ক্লাসে পড়িত। তারপর বঙ্কিমচন্দ্রের সমস্ত বই পড়িয়াছে। রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু পড়িয়াছে; কিন্তু আনন্দমঠ তাহার জীবনের আনন্দ। এতদিন পর আজ আল টমস্ কেবিন পড়িয়া সেই ধারার আনন্দ পাইয়াছে।

একটা হুইল বাঁশি তীব্রস্বরে কোথায় বাজিয়া উঠিল। শিবনাথ চকিত হইয়া সম্মুখের দিকে চাহিল, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইল না। বাকিটা আবার বাজিল।

আবার শিবনাথ চারিদিক ভাল করিয়া দেখিল। সঙ্গে সঙ্গে বশিটা আবার বাজিয়া উঠিল। এবার শিবনাথের নজরে পড়িল, রামকিঙ্করবাবুদের মুক্ত জানালায় দাঁড়াইয়া নান্তি হাসিতেছে। নান্তিই বাঁশি বাজাইয়া তাহাকে ইঙ্গিত করিয়াছে।

শিবনাথের মুখেও হাসি ফুটিয়া উঠিল। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই সে গম্ভীর হইয়া জানালাটা বন্ধ করিয়া দিল।

শিবু!–পিসিমা ঘরে প্রবেশ করিলেন।

শিবনাথ জানালাটা বন্ধ করিয়া তখনও খাটের উপর ফিরিয়া আসিতে পারে নাই।

পিসিমা বলিলেন, জানালাটা বন্ধ করলি কেন? ঘরে আলো আসুক না।

শিবনাথ বিব্রতভাবেই বলিল, না, থাক্।

তোর ওই এক ধারা, যেটি আমি বলব, সেইটিতেই—না।

তিনি নিজে গিয়া জানালাটা খুলিয়া দিলেন, বউ তখনও জানালায় দাঁড়াইয়া ছিল। পিসিমা দেখিয়া বলিলেন, বউমা দাঁড়িয়ে নয়?

শিবু নীরব হইয়া রহিল।

পিসিমা বলিলেন, তাই বুঝি জানালা বন্ধ করে দিলি?

শিবনাথ এ কথারও কোনো জবাব দিল না।

বউ তখন পলাইয়াছে। পিসিমা বলিলেন, বউমার কী ছিরি হয়েছে। ছি ছি! মাথার চুলগুলো উড়ছে; কালো কাপড়! কেই বা দেখে, যত্ন করে! বুড়ো দিদিমা, সে নিজে অক্ষম, তারই যত্ন কে করে, সে আর কত করবে! শুধু ঝগড়া করতেই পারে!

শিবনাথকে কী বলিতে আসিয়াছিলেন, সে আর তাহার বলা হইল না। নিচে নামিয়া যাইতে যাইতেই তিনি ডাকিতে আরম্ভ করিলেন, নিত্য! নিত্য! নিত্য কোথায় গেল বউ?

নিত্য ওদিক হইতে সাড়া দিতেছিল, যাই পিসিমা।

নিত্য আসিতেই বলিলেন, এক কাজ কর দেখি, ঠাকুরবাড়ির দরজায় তুই চুপ করে বসে থাক। বউমা যখন এই পথ দিয়ে যাবে, আমায় ডেকে দিবি।

ঘণ্টাদুয়েক পরই বধূ বন্দিনী হইল। বেচারি খেলা করিতে বাহির হইয়াছিল, নিত্যর নিকট সংবাদ পাইবামাত্র তিনি বাহির হইয়া গিয়া ডাকিলেন, বউমা, দাঁড়াও।

নান্তির পা দুইটি যেন মাটিতে পুঁতিয়া গেল। পিসিমা তাহার হাত ধরিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিলেন। বউ ভয়ে কাঁপিতেছিল।

শিবনাথের মা দরদালানে সেলাইয়ের কাজ করিতেছিলেন, পিসিমা বউকে আনিয়া কাছে। বসাইয়া দিয়া বলিলেন, মাথার শ্ৰী দেখ, কাপড়ের দশা দেখ!

বউ ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল। পিসিমা আবার বলিলেন, চুল বেঁধে দাও, আর তোমারই শাড়ি একখানা পরিয়ে দাও।—বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।

শিবনাথের মা বউয়ের চুল বাঁধিতে আরম্ভ করিলেন, দেখ মা, হিন্দুর ঘরের মেয়ে তুমি, হিন্দুর ঘরের বউ, শ্বশুর-শাশুড়ি এঁদের দেখতে হয় বাপ-মায়ের মত।

নান্তির এইখানেই যত ভয়, সে উপদেশ কিছুতেই শুনিতে পারে না, সে রূঢ়ভাবেই হউক, আর মিষ্ট কথাতেই হউক। কিন্তু আজ উপায় ছিল না, পিছনে শাশুড়ি, হাতে চুলের মুঠি। অগত্যা সে ঘাড় নাড়িয়া পোষা পাখিটির মত উত্তর দিল, হুঁ।

শিবনাথের মা বলিলেন, নড়ছ কেন এত? স্থির হয়ে বস, সিঁথি বেঁকে যাচ্ছে যে! তুমি সাবিত্রীর গল্প জান?

নান্তি বলিল, জানি, কিন্তু আপনি বলুন না, গল্প আমার ভারি ভাল লাগে। সাবিত্রীর উপাখ্যান আরম্ভ হইল, শেষ হইল। চুল বাধা শেষ করিয়া শাশুড়ি একখানি ঢাকাই শাড়ি বাহির করিয়া বউকে পরাইয়া মুখ মুছাইয়া সিঁদুরের টিপ পরাইয়া দিলেন।

কিছুক্ষণ পর পিসিমা ফিরিয়া আসিয়া চারিদিক চাহিয়া বলিলেন, বউমা চলে গেছে?

রতন বলিল, বোধহয় গিয়েছে। এইখানেই ছিল, কই, নেই তো!

বউ তখন সন্তৰ্পণে পানের ঘরে ঢুকিয়া পানের বাটা খুলিয়া পান চুরি করিতেছিল। পিসিমার কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে তাড়াতাড়ি দুই গালে দুইটা পান পুরিয়া অ্যাঁচলে আরও দুইটা বধিয়া লইল, তারপর নিঃশব্দে উপরে উঠিয়া শিবনাথের ঘরের মধ্যে লুকাইয়া পান চর্বণ করিতে বসিল।

সাবিত্রী-উপাখ্যানেরই ফল না মনের খেয়াল—কে জানে! নান্তির মনে হইল শিবনাথের ঘরখানা পরিষ্কার করা দরকার। কুঁচিকাঠির সরু ঝাটা উপরের দরদালানেই থাকে, নান্তির তাহা জানা ছিল। সে ঝাঁটা-গাছটা আনিয়া ঘর পরিষ্কার করিতে আরম্ভ করিল। ঘর পরিষ্কার শেষ করিয়া বিছানা ও টেবিল গুছাইয়া ফেলিল। তারপর চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, দেওয়ালে ছবিগুলোর গায়ে বড় ঝুল জমিয়া আছে। সে একটা চেয়ারের উপর দাঁড়াইয়া ছোট ঝাটাগাছটা দিয়া ঝুল ঝাড়িবার মনস্থ করিল। কিন্তু চেয়ারের উপর উঠিয়াও নান্তির হাতের ঝাটা ততদূর পৌঁছিল না। চেষ্টা করিয়াও হতাশ হইয়া বেচারি অনেক মাথা খাটাইয়া আলনা হইতে একখানা চাদর টানিয়া লইল। সেটার একপ্রান্ত গুটাইয়া ছবির গায়ে ঘুড়িয়া মারিল। তাহাতেই কাজ হইল, গুটানো চাদর খুলিয়া ছবির গায়ের স্কুল পরিষ্কার হইয়া গেল। গঙ্গাবতরণখানা পরিষ্কার হইল। অহল্যা-উদ্ধারখানা পরিষ্কারই আছে। শিবাজীর ছবিখানার উপর এবার নান্তি চাদরের তালটা ষ্টুড়িয়া মারিল। সঙ্গে সঙ্গে ছবিখানা স্থানচ্যুত হইয়া মেঝের উপর ঝনঝন শব্দে ভাঙিয়া পড়িল।

নিত্য-ঝি দোতলাতেই অন্য ঘরে কাজ করিতেছিল, শব্দ শুনিয়া সে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই চিৎকার করিয়া উঠিল, ওগো, বউদিদি খুন হয়েছে গো, কাচে কেটে রক্তগঙ্গা হয়েছে গো!

নান্তি হতভম্বর মত দাঁড়াইয়া ছিল। নিচের তলা হইতে পিসিমা ছুটিয়া আসিলেন; তাহারাও যেন হতভম্ব হইয়া গেলেন। নান্তির বুকের কাপড়খানা রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। এক মুহূর্ত নিস্তব্ধ থাকিয়া শিবনাথের মা তাড়াতাড়ি আসিয়া নান্তিকে নাড়া দিয়া ডাকিলেন, কোথায় কেটে গেছে। বউমা? এত রক্ত

নান্তি কাঁপিতেছিল, সে সভয়ে বলিল, পানের পিচ, রক্ত নয়।

চারিটা পান মুখে পুরিয়া ঝাঁট দিতে নান্তির মুখ হইতে উছলিয়া পানের রস ক্রমাগত বুকের কাপড়ে পড়িয়া এমন হইয়াছে। শিবনাথের মা হাসিয়া বলিলেন, ভয় নেই, রক্ত নয়।

পিসিমা বধূর কথা শুনিতে পাইয়াছিলেন, তিন রূঢ়কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, ছবি ভাঙল কী করে?

নান্তি ভয়ে চুপ করিয়া রহিল। পিসিমা আবার বলিলেন, মাথায় এত ঝুল কোথা থেকে লাগল, মুখে হাতে এত ধুলোই বা লাগল কী করে?

নান্তি এবার সভয়ে বলিল, ঘর ঝাঁট দিতে–

বধূর কথা শেষ হইতে না হইতে পিসিমা কঠিনভাবে বলিয়া উঠিলেন, গৌরীর তপস্যা হচ্ছিল! পতিব্ৰতার স্বামীসেবা হচ্ছিল।

সত্যই নান্তির নাম গৌরী।

বাহিরে দিনান্তের অন্ধকার ছায়ামূর্তিতে তখন পৃথিবীর বুকে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, ঘরখানার মধ্যে সে যেন কায়া গ্ৰহণ করিতেছিল। মুহূৰ্তে মুহূর্তে ঘরখানাও নীরবতায় রাত্রির মত গভীর হইয়া উঠিতেছিল; কাহারও মুখে কথা ছিল না, শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া জীবনের অন্য সমস্ত স্পন্দন যেন বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।

পিসিমা বলিলেন, নিত্য, বউমাকে সঙ্গে করে ওর দিদিমার বাড়ি দিয়ে আয়।

 

কয়দিন পরই নান্তির দিদিমা নান্তিকে লইয়া তাঁহাদের কলিকাতার বাসায় চলিয়া গেলেন। সেখান হইতে যাইবেন কাশী। তিনি নান্তির সম্পর্কে শিবুর মা ও পিসিমার যে একটা সম্মতি লওয়ার প্রয়োজন অথবা পালনীয় রীতি ছিল, সেটুকুও মানিলেন না।

পিসিমা গর্জন করিয়া উঠিলেন। মা হাসিলেন।

কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাতেই পিসিমা বলিলেন, বউমাকে আমাদের ছেড়ে দেওয়া ভাল হল না বউ। শিবুর মনখারাপ হবে।

মা হাসিয়া বলিলেন, তুমি পাগল ভাই ঠাকুরঝি।

পিসিমা বলিলেন, না ভাই বউ, তুমি লক্ষ্য করে দেখো, শিবু আমার কত বড় হয়ে উঠেছে। কেমন গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে, দেখেছ?

মা আবার হাসিলেন।

Category: ধাত্রী দেবতা (১৯৩৯)
পূর্ববর্তী:
« ০৯. শিবুকে লইয়া পিসিমা বাড়িতে ফিরিলেন
পরবর্তী:
১১. পিসিমার একাগ্র সতৃষ্ণ দৃষ্টি »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑