৫.২ বিস্ময়কর ঘটনা

৫.২ বিস্ময়কর ঘটনা

নয়শ’ সত্তর সালের ঘটনা। সুলতান মাহমুদের শায়খ ও মুর্শিদ শায়খ আবুল হাসান কিরখানী একদিন গযনী সুলতানের উদ্দেশ্যে বললেন–

যে যুগের মুসলমানরা হিন্দু ও ইহুদীদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, সেই যুগটি হবে মুসলমানদের পতনের যুগ। সেটি হবে ইসলামের কালো যুগ। সে যুগেই আল্লাহর এই যমীন মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত হবে।

তোমার শাসিত এলাকায় অমুসলিমরা দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। তাদের খেয়াল খুশী মতো শাসনের নামে দুঃশাসন চালাবে। গযনী কান্দাহার কাবুল গার দিজ বিধর্মীদের পায়ের চাপে পিষ্ট হবে। যাদের কাছে ন্যূনতম কোন নীতি নৈতিকতা ও মানবতাবোধ নেই, যারা মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর নির্মম তাদেরকে মুসলমানদের একটি অংশ শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে শুরু করবে। মাহমূদ! সেদিন তোমার কবর অমুসলিমদের কিছুই করতে পারবে না। বরং তোমার কবরের উপরেও চলবে রক্তের হোলি খেলা। তখন আমাদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব হবে না। তাই যদি কিছু করতে হয় তবে এখনই করতে হবে।

সুলতান মাহমূদ তার জীবনের সিংহভাগ বাতিলের বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে কাটিয়েছেন। অবশেষে এক সময় তার হৃদরোগ দেখা দিল। তিনি চিকিৎসককে কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন, তার এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটি যেন তার কাছ থেকে কেউ জানতে না পারে। সুলতানকে তার আধ্যাত্মিক গুরু বলেছিলেন, যেহেতু মৃত্যুর পর আমাদের আর করণীয় কিছু থাকবে না, তাই ভবিষ্যত করণীয় কাজটি এখনই করতে হবে। এজন্য সুলতান তার বর্তমানকে ভবিষ্যত রচনার কাজে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তিনি তার আরাম বিসর্জন দিয়ে বিশ্রাম শরীর দেহ মনকে মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যত বিনির্মাণের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমানে সেই মরণজয়ী বীরযোদ্ধা ও তার আধ্যাত্মিক গুরুর কবরের চারপাশে আস্তানা গেড়েছে বিদেশী হানাদার বাহিনী। এই হানাদার বাহিনী নিরীহ মুসলমানদের জীবন ও ইজ্জত নিয়ে হায়েনার মতো হিংস্র উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে। যাদের কোন নীতি নৈতিকতা নেই, নেই কোন মানবিক বিচারবোধ। অথচ এই দখলকার বাহিনীকেই কথিত মুসলমানরা তাদের ত্রাণকর্তা মেনে নিয়েছে।

কেন? কেন এমনটা হলো? স্বাধীনতা পাগল দীন ও ইসলামের প্রশ্নে আপসহীন এই জাতির আজ কি হলো? কোথায় হারিয়ে গেছে বিশ্বখ্যাত স্বাধীনচেতা মুসলমানদের পরাজয় পরাভব না মানার অমিত তেজ ও সাহস? কেন একদল আফগান সোনালী অতীতকে ভুলে বিলাসিতা ও পার্থিব স্বার্থের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিলো? কেন হাজার হাজার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আজ ভূলুণ্ঠিত?

আসলে স্বাধীনতার প্রদীপ জাতির রক্ত পুড়িয়ে আলো বিকিরণ করে। সেই রক্ত আজ বিক্রি হয়ে গেছে। তাদের ঈমানী চেতনা আজ মরে গেছে। শহীদানের রক্ত শুষ্ক মাটি শুষে নিয়েছে, আর নিজেদের অদূরদর্শিতা স্বার্থান্ধতা এবং দলবাজীর মূল্য আজ বিশ্বের মুসলিম উম্মাহকে কড়ায় গণ্ডায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। ইতিহাসের প্রতি আমরা মোটেও সুবিচার করিনি। কল্পিত ইতিহাস সুলতান মাহমুদের প্রতিও চরম অবিচার করেছে। মুসলিম বিদ্বেষী ইসলামের শত্রুদের চরম বিজয় হয়েছে। যারা ছিল পৃথিবীর অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ বীর পুরুষ তাদেকেই তারা খুনী, সন্ত্রাসী লুটেরা হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। তারা মূর্তি সংহারীকেই মূর্তি পূজারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ইসলাম বিদ্বেষীরা ইতিহাসের মুখে ছাই দিয়ে চরম মিথ্যাকে সত্য বলে এবং সত্যকে মিথ্যা বলে প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষাকে মুসলমানরা ভুলে গিয়েছে। আর মুসলিম বিদ্বেষী ইসলামের শত্রুরা এ বিষয়টিও মনে রেখেছে, কোন জনগোষ্ঠীকে তার অবস্থান থেকে নিচে নামাতে হবে এবং তাদের সুউচ্চ মর্যাদার আসন থেকে ভূতলে নিক্ষেপ করতে হবে। ইসলামের শত্রুরা সাফল্যের সাথে কঠোর পরিশ্রমী এবং আড়ম্বরহীন জীবন যাপনকারীদেরকে বিলাসী জীবনে অভ্যস্থ করেছে এবং জাগতিক জীবনকে ভোগবাদ ও বস্তুবাদের আধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।

ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের প্রকৃত ইতিহাস থেকেও বিমুখ রাখার মিশনে দারুণ সাফল্য অর্জন করেছে। অজস্র প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে যে ইতিহাস ইসলামের বীর সৈনিকেরা নির্মাণ করেছিলো, সেই ইতিহাসকে মদের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছে। সুন্দর ও স্বচ্চ আবেগকে পাশবিকতার মোড়কে ঢেকে দিয়েছে। ফলে মুসলমানরা ভুলে গেছে কি ছিল তাদের স্বরূপ এবং কি ছিল তাদের কর্তব্য। তাই মুসলমানরা তাদের আসল গন্তব্য ভুলে গিয়ে নিশ্চিত ধ্বংসের পথে চলতে শুরু করেছে। ফলে যে মাটি মুহাম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গীরা জয় করেছিল, যে মাটিতে গযনীর বীর সেনানীদের গন্ধ মিশে গিয়েছিল, বীর সেনানীদের রক্ত ও দেহের সেই গন্ধই তখনকার মুসলমানদেরকে কুফর ও বেঈমান শক্তির বিরুদ্ধে পাহাড়ের মতো দৃঢ়তায় মোকাবেলা করতে সাহস ও শক্তি যোগাতো।

সে জাতিই তার লব্ধ সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, যে জাতি তার শহীদানের রক্তে লেখা ইতিহাস ভুলে না গিয়ে শহীদানের গড়া ইতিহাস মিটে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। সে জাতিই তার ইতিহাসকে রক্ত ও আবেগ দিয়ে জীবন্ত রাখে, পূর্বসূরীদের ঐতিহ্যকে মুছে যেতে দেয় না। বরং পূর্বসূরীদের ঐতিহ্যকে উত্তরসূরীদের জন্য আরো স্থায়ী ও সমৃদ্ধ করে তোলে।

সুলতান মাহমূদ বাতিল ও ইসলাম বিদ্বেষীদের জন্যে ছিলেন এক জীবন্ত আতংক। সকল ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত যে, সুলতান মাহমূদ ছিলেন সর্বকালের সেরা যোদ্ধা। তার সময়ে বর্তমান পাকিস্তানের মুলতান অঞ্চল কেরামতী নামের একটি ভ্রান্ত ও শিরক মিশ্রিত অনৈসলামিক গোষ্ঠীর আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। কেরামতীরা ওই অঞ্চলে বিরাট সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। তারা সুলতান মাহমূদের জন্যে মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই বাতিল জনগোষ্ঠীর শিকড় উপড়ে ফেলার জন্যে সুলতান মাহমূদকে একজন সাধারণ যোদ্ধার মতোই জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতে হয়েছিল।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, কেরামতী বিরোধী লড়াইয়ে সুলতান মাহমূদ এমন কঠিন যুদ্ধ করেছিলেন যে, তার ডান হাত জমাটবাঁধা রক্তের কারণে তরবারীর বাটে আটকে গিয়েছিল। রক্তের পর রক্ত লাগতে লাগতে তা জমাট বেঁধে যায়। সুলতানের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তরবারীর বাট থেকে আলাদা করতে দীর্ঘ সময় গরম পানি ঢালতে হয়েছিল। দীর্ঘ সময় গরম পানি ঢালার পর জমাট বাধা রক্ত ধুইয়ে গেলে তরবারীর বাটে আটকে যাওয়া সুলতানের হাত আলাদা করা সম্ভব হয়।

আজো ইসলামের নামে কুফরী শক্তি মুসলিম বিশ্বকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। বিভ্রান্ত মুসলমানরা ইহুদী, খৃষ্টান ও পৌত্তলিকদের ক্রীড়নক হয়ে সত্যিকার মুসলমানদের বিনাস সাধনে লিপ্ত। সুলতান মাহমুদের কবর আজ খ্রিস্টান, ইহুদী শক্তির ট্যাংক বামারু বিমানের ছোঁড়া হাজারো বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত।

দুর্ভাগ্য ও পরিতাপের বিষয়, তৎকালীন ভারতে অসংখ্যবার অভিযান পরিচালনাকারী বীর মুজাহিদ সুলতান মাহমূদের অভিযানকে মাত্র সতেরোটি অভিযানে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার বিশাল কৃতিত্বকে মুছে ফেলা হয়েছে। বস্তুত একজন খাঁটি সৈনিকের কৃতিত্বকে খাটো করে দেখানোর জন্যেই ইতিহাসের নামে এসব গল্প ফাঁদা হয়েছে। যেগুলোর সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। আমাদের কর্তব্য, এই ক্ষণজন্মা বীর যোদ্ধার প্রতিটি পদক্ষেপকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে সঠিক ভাবে তোলে ধরা। তাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বুঝতে পারবে, কতোটা বৈরী পরিবেশ ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও ইসলামের জন্যে নিবেদিত প্রাণ এই মর্দে মুজাহিদ ইসলামের জন্য কি বিশাল অবদান রেখে গেছেন। যা কেয়ামত পর্যন্ত যে কোন মুসলমানের জন্যে অনুপ্রেরণার উৎস।

১০২০ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৪১২ হিজরী সনের বসন্তকালের শুরুর দিকে গযনী থেকে সুলতান মাহমুদের বাহিনী বন্যার মতো ভারতের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। গযনীর সেনা বাহিনীর গতি ক্ষিপ্র ছিল বটে। কিন্তু তাদের জনবল এতোটা ছিল না, যে পরিমাণ জনশক্তি নিয়ে গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্তী স্থানে কালাঞ্জর গোয়ালিয়র ও লাহোরের সম্মিলিত বাহিনী একত্রিত হয়েছিল। দৃশ্যত এই তিন রাজ্যের সেনা সংখ্যা ছিল গযনী বাহিনীর চেয়ে তিনগুণ বেশী।

সকল ঐতিহাসিকগণ এ ব্যাপারে একমত, তিন রাজার সেনাদের মধ্যে এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার ছিল পদাতিক সৈন্য, ছত্রিশ হাজার অশ্বারোহী এবং ছয়শ চল্লিশটি ছিল জঙ্গি হাতি। সেই সময়কার ঐতিহাসিক ফারখী লিখেছেন, কালা র, গোয়ালিয়র ও লাহোরের সম্মিলিত সৈন্যদের মধ্যে এক লাখ বত্রিশ হাজার ছিল পদাতিক সৈন্য, ছয়ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী এবং নয়শ জঙ্গি হাতি।

উল্লেখিত সংখ্যার যে কোন একটিকে সঠিক মনে করলেও একথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, গয়নী থেকে এবার সুলতান মাহমুদ যে সৈন্য নিয়ে ভারতের দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে অর্ধেকেরও কম ছিল।

সৈন্য সংখ্যা কম ছাড়াও সুলতান মাহমূদের জন্যে সবচেয়ে বেশী অসুবিধা ছিলো, এবার তিনি এমন এক জায়গায় মোকাবেলার জন্যে রওয়ানা হয়েছিলেন, যে জায়গাটি ছিল চতুর্দিক থেকে হিন্দুবেষ্টিত। এখানকার পরিবেশ, মাটি মানুষ সবই ছিল তার প্রতিকূলে।

কনৌজের রাজা রাজ্যপালের নিহত হওয়া এবং তিন রাজার ষড়।ন্ত্রের কথা শুনে সুলতান মাহমূদ তার সেনাদের অভিযানের নির্দেশ দিয়ে দেন। অবশ্য গযনী সেনাদের জন্যে হিন্দুস্তানের একজন পরাজিত রাজার মৃত্যু তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। কিন্তু রাজা রাজ্যপাল গযনী সুলতানের অনুগত এবং মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ থাকার কারণে ব্যাপারটির রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। তার চক্রান্তমূলক হত্যার ব্যাপারটি ছিল সুলতান মাহমূদের জন্যে একটি পরিতার বার্তা। যে বার্তা চোখে আঙুল দিয়ে বলে দিচ্ছিল, হিন্দুরা এবার সুলতান মা মূদকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করেছে। কনৌজে নিয়োজিত আব্দুল কাদের সেলজুকী তার পাঠানো সংবাদে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন যে, হিন্দুস্তানের হিন্দু রাজা মহারাজারা একত্রিত হয়ে গযনীর বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।

শায়খ আবুল হাসান কিরখানী ছাড়াও আবু সাঈদ আব্দুল মালেক নামের আরেকজন বিদগ্ধ আলেমেরও ভক্ত ছিলেন সুলতান মাহমুদ। তিনি গযনী থেকে অনেক দূরে বসবাস করতেন। সুলতান মাহমুদ তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্যে কয়েকবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তাঁর কাছে গেছেন।

এবার সুলতান যখন হিন্দুস্তানে যাত্রা করলেন, যাত্রার দ্বিতীয় দিন অগ্রবর্তী বাহিনী থেকে এক কমান্ডার উধ্বশ্বাসে ঘোড়া হাঁকিয়ে সুলতানের কাছে এসে জানালো– আবু সাঈদ আব্দুল মালেক নামের একজন আলেম ও বুযুর্গ আপনার সাথে সাক্ষাতের জন্যে পথিমধ্যে অপেক্ষা করছেন। এ খবর পেয়ে সুলতান তখনই ঘোড়ায় চড়ে আবু সাঈদের কাছে পৌঁছলেন এবং ঘোড়া থেকে নেমে তার কপালে চুমু দিয়ে মোসাফাহা করলেন।

গতকাল আমি জানতে পেরেছি আপনি হিন্দুস্তান যাচ্ছেন– বললেন আবু সাঈদ আব্দুল মালেক। দু’আ করছি আল্লাহ এ সফরে আপনাকে সাফল্য দান করুন। এখন আপনাকে আমি কিছু বলবো না। শুধু এতটুকু বলতে চাই, আপনি ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছেন। আপনার এই অভিযান আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য উজ্জ্বল অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই যুদ্ধকে আপনি ব্যক্তিগত যুদ্ধে পরিণত করবেন না। মনে রাখবেন, রাজত্ব ও বাদশাহী এককভাবে আল্লাহ তাআলার। ক্ষমতা ও রাজত্বের নেশা মন থেকে বের করে দিন।

ক্ষমতা ও রাজত্বের নেশা এমন ভয়ংকর যে, এই নেশা যদি কাউকে পেয়ে বসে তাহলে সে দীন ধর্ম সবই ভুলে যায়। ক্ষমতালোভী শাসকরা একথাও ভুলে যায় মুহূর্তের মধ্যে তার মৃত্যু ঘটতে পারে। তাদের কানে মজলুম আর্তের আর্তনাদ পৌঁছে না। তাদের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। প্রজাদের দুর্ভোগ দুর্দশা তাদের চোখে পড়ে না। ক্ষমতা পিপাসু শাসকেরা তাই দেখে এবং তাই শুনে যা তাদের তোষামোদকারী দরবারী মোসাহেবরা দেখায় এবং শোনায়। মোসাহেব ও তোষামে দকারীরা তাই শোনায় যার মধ্যে তাদের স্বার্থ জড়িত থাকে। সুলতান মাহমূদ মাথা নত করে আবু সাঈদ আব্দুল মালেকের কথা শুনছিলেন।

আবু সাঈদ আরো বললেন, আমি বেশী সময় আপনাকে আটকে রাখবো না সুলতান! আপনি কখনো ভুলে যাবেন না, দুনিয়ার সকল বেঈমানদের দৃষ্টি আপনার উপর। কুফরী শক্তি আপনার মৃত্যুর জন্যে প্রহর শুনছে। আপনার মুসলমান প্রতিবেশীরাও আপনার মৃত্যু কামনা করে। এজন্য আপনার এমন প্রতিজ্ঞা করা উচিত, আপনি মরে গিয়েও যাতে অমর থাকেন। আপনি আপনার কাজ কর্মে অনুকরণীয় আদর্শ রচনা করে মানুষের হৃদয়ে জীবিত থাকবেন। আপনার এমন কাজ করতে হবে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম আপনার আদর্শিক পথে চলে আপনাকে জীবন্ত রাখে। আপনি যদি হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকদের মাথা গুঁড়িয়ে দিতে না পারেন, তবে এরা যতত দিন পর্যন্ত হিন্দুস্তানে একজন মুসলমান জীবিত থাকবে ততো দিন পর্যন্ত মুসলিম নির্যাতন অব্যাহত রাখবে।

দুআ করুন হযরত! আল্লাহ তাআলা যেন আপনাদের প্রত্যাশা পূরণে আমাকে সফলকাম করেন– বললেন সুলতান মাহমুদ। এবার আমি সফল হলে হিন্দুস্তানে একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবো। সেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক সেনাবাহিনীকেও রেখে আসবো।

আল বিদা মাহমূদ! দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে সুলতানকে বিদায় জানিয়ে বললেন আবু সাঈদ। আপনার সাফল্যের জন্যে আমরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে। দু’আ করছি। দুআ করি আল্লাহ যেনো আপনার সঙ্গে থাকেন এবং আপনাকে সাহায্য করেন।

সুলতান মাহমূদ আবু সাঈদের হাতে চুমু খেয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে গেলেন।

সুলতান মাহমূদ জানেন, তার অগ্র-পশ্চাৎ ডানে বামে চতুর্দিকে শত্রু। তার সামনে দৃশ্যমান হিন্দু শত্রু আর পেছনে অদৃশ্য মুসলিম শত্রু। কিন্তু তার জানা ছিল না এবার প্রাণঘাতি শত্ৰু তার সফর সঙ্গী হয়ে তার কাফেলায় মিশে গেছে এবং তার সাথেই যাচ্ছে।

সুলতান মাহমূদ কয়েকজন সেলজুকীকে তার আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার কারণে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে ছিলেন। কারণ বংশানুক্রমে সেলজুকীরা ছিল লড়াকু। সেলজুকীরা ছিল বুখারার পাহাড়ী এলাকার অধিবাসী। সেলজুকীরা তুর্কি ও সামানীদের লড়াইয়ে সামানীদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। অন্যভাবে বলা চলে, সামানীরা সেলজুকীদের উস্কানিতেই লড়াই করেছিল। এর পর থেকে সেলজুকীরা একটি সামরিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়।

সেলজুকী সরদার লুকমান সেলজুকীর ছেলে ইসরাঈল সেলজুকী বুখারা শাসকদের কাছে যথেষ্ট মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী ছিল। বুখারার শাসক আলাফতোগীনের খুবই প্রিয় পাত্রে পরিণত হয় ইসরাঈল সেলজুকী। তাদের মধ্যে গড়ে উঠে গভীর হৃদ্যতা। সুলতান মাহমূদ যখন এই কুচক্রীদের দমন করার জন্যে বুখারা আক্রমণ করেন তখন এরা উভয়েই পাহাড়ী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

অপর দিকে পূর্ব তুর্কিস্তানের এলিকখান ছিল একটি শক্তিশালী রাজ্যের শাসক। সে সব সময় কাউকে না কাউকে সাথে নিয়ে সুলতান মাহমুদের বিরোধিতায় লিপ্ত থাকতো। কিন্তু যতো বার এলিকখান সুলতান মাহমুদের মুখোমুখী হয়েছে ততোবারই মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়েছে।

সর্বশেষ পরাজয়ের পর এলিকখান যখন তার পরিবার পরিজন নিয়ে পাহাড়ী এলাকায় আত্মগোপন করেছিল তখন ইসরাঈল সেলজুকী এলিকখানের সাথে সাক্ষাত করতে গেল। সর্বশেষ লড়াইয়ে ইসরাঈল সেলজুকীর নেতৃত্বাধীন সেলজুকী উপজাতিরাও এলিকখানের সহযোগী ছিল না।

এলিকখান সবুজ ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত পাহাড়ী এলাকায় তাঁবু গেড়ে অবস্থান করছিল। ইসরাঈল সেলজুকী তাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে পৌঁছে গেল। এলিকখানের তাঁবুতে সুন্দরী নারীও ছিল। নর্তকী ও গায়িকাও ছিল তার সাথে। রাজ প্রাসাদের বিলাসবহুল সব ধরনের আসবাব পত্র ছিল এলিকখানের তাঁবুতে। ইসরাঈল সেলজুকী যখন সেখানে উপস্থিত হলো, তখন এলিকখান তার তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। এলিকখানের তাঁবুটি ছিল ছোটখাটো একটা রাজ প্রাসাদের মতো।

এলিকখান পূর্ব থেকেই ইসরাঈল সেলজুকীকে চিনতেন। ইসরাঈল সেলজুকী একজন আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী তাগড়া যুবক। অত্যন্ত মোহনীয় দেহ সৌন্দর্যের অধিকারী ব্যক্তিত্ববান তরুণ। ইসরাঈল সেলজুকী ছিল তার গোত্রের সর্দার। তখন সেলজুকী গোত্র ছিল একটি আলোচিত সামরিক শক্তি।

এখন আমার কাছে কেন এসেছে ইসরাঈল? ইসরাঈল সেলজুকীকে জিজ্ঞেস করলেন এলিকখান।

রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে আসা নেতাদের অবস্থা নিজ চোখে দেখতে এসেছি। তারা কেমন থাকে কিছুটা তীর্যক ভাষায় জবাব দিলো ইসরাঈল।

আপনার হয়তো এজন্য আমার প্রতি ক্ষোভ আছে, আমি আপনার কোন উপকার করিনি, তাই না? আমিও কিন্তু একথা বলতে পারি, আপনিও আমার কাছে কোন ধরনের সহযোগিত চাননি। আপনি কি নিজেকে এতোটাই শক্তিশালী ভেবে বসেছিলেন যে, আমার সহযোগিতা ছাড়াই আপনি গযনীর মাহমূদকে পরাজিত করতে পারবেন?

আমার বলার প্রয়োজন হবে কেন? তোমার তো নিজ উদ্যোগেই আমার সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত ছিল–বললেন এলিকখান।

আসলে ব্যাপারটিতে আপনি এখন যে ভাবে বলছেন তেমন ছিল না। আপনি হয়তো তখন চেয়েছিলেন আমার সহযোগিতা ছাড়াই আপনি সুলতান মাহমূদকে পরাজিত করে গযনী ও বুখারার একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাবেন। অথচ সামানীরা আমার সহযোগিতা ছাড়া কখনো তুর্কিদের পরাজিত করতে পারেনি। সেলজুকীরা যখন সামানীদের সঙ্গ ত্যাগ করেছে তখন সামানীদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। সেই যে তুর্কিরা সেলজুকীদের হাতে মার খেয়েছিল আজ পর্যন্ত সেলজুকীদের নাম শুনলে তুর্কিদের ভয়ে শরীর কাঁপে।

.

তুমি কি আমাকে পরাজয়ের জন্য তিরস্কার করতে এসেছো? তুমি কি আমাকে দেখতে এসেছো আমি এই পরাজয়ের পর কতোটা দুর্বল হয়ে পড়েছি? বললেন এলিকখান।

না, না, এলিকখান! এতটুকু পরাজয়ে আপনি এতোটা হীনমন্যতার শিকার হবেন না যে, দোস্ত-দুশমনের ভেদাভেদ গুলিয়ে যাবে। মনে রাখবেন, আমাদের শত্রু অভিন্ন। গযনীর মাহমূদ উভয়ের শত্রু। আপনি একাকি ওকে পরাজিত করতে পারবেন না। ইচ্ছা করলে সেলজুকীরই তাকে পরাজিত করতে পারে। আমি এখন আপনার সাথে এজন্য সাক্ষাত করতে এসেছি মাহমুদের বিরুদ্ধে আপনি আমাদের কতটুকু সহযোগিতা করতে পারেন। আপনি কি আমাদের সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারবেন?

আপনি সহযোগিতা না করলেও আমি মাহমূদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো। আলাফতোগীন আছে আমার সঙ্গে।

মাথা ঠিক করে কথা বলো ইসরাঈল- কিছুটা তাচ্ছিল্যমাখা কণ্ঠে বললেন এলিকখান। এ পর্যন্ত তোমাদের ইতিহাস হলো অন্যদের তোমরা সহযোগিতা করেছো, এবং সহযোগী হিসেবেই লড়াই করেছে। মূল শক্তি হিসেবে লড়াই করোনি। তোমরা মাহমূদের সৈন্যদের সাথে কখনো মুখোমুখি লড়াই করোনি। মাহমূদ জঙ্গি চালে তার চেয়ে তিনগুণ বেশী শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম। তার সৈন্যরা কঠিন সংকটেও কখনো বেসামাল হয় না। দীর্ঘ প্রশিক্ষিত ঘোড়ার মতোই আমৃত্যু লড়াই করে। ওরা সামান্য ইঙ্গিতেই বিদ্যুতের গতিতে জায়গা বদল করে কিন্তু আমাদের সৈন্যদের এই গুণ নেই।

এলিকখান! আমি বুঝতে পারছি এবারের পরাজয়ের ক্ষত আপনার রগরেশায় ঢুকে পড়েছে। আতংক ভর করেছে আপনার মনে। মনে হচ্ছে আপনার কাছে সহযোগিতা প্রত্যাশা করাই উচিত হবে না। যদি খান সর্দারের মনেই এমন আতংক বাসা বেঁধে থাকে তবে খানদের সৈন্যরা তো ভয়ে কম্পমান।

জেনে রাখুন এলিকখান! আমি মাহমূদের বিরুদ্ধে লড়াই করবোই। ওকে আমি আর বাড়তে দেবো না। হিন্দুস্তানের ধন-দৌলত ওকে বিরাট শক্তিশালী করে দিচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে সমরকন্দ বুখারা বলখ তুর্কিস্তান খাওয়ারিজম সবই এক সময় তার দৌলতের গোলামী করতে শুরু করবে। আর অপরাধীর মতো দুর্গম পাহাড়ে আমাদেরকে লুকিয়ে থাকতে হবে।

আমি তো শুনেছি, তোমার সেলজুকী গোত্রের কিছু লোক মাহমূদের সেনা বাহিনীতেও নাকি ঢুকেছে? বললেন এলিকখান।

হ্যাঁ, কয়েকজন সেলজুকীকে ধনসম্পদের লোভ দেখিয়ে কিনতে সক্ষম হয়েছে মাহমূদ। এখন তো তার বাহিনীতে একজন সেনাপতিও সেলজুকী। আব্দুল কাদের নামের এই সেলজুকী শুধু সেনাপতি নয়, হিন্দুস্তানের শাসকও বটে।

তুমি স্বগোত্রের এই লোকগুলোকে নিজ গোত্রে ফিরিয়ে আনতে পারবে না?

আরে, একথা না বলে বলুন যে, তুমি এই সেলজুকীদের হাতে মাহমূদকে হত্যা করতে পারো না? আরে খান! লড়াই শুধু রণাঙ্গনেই হয় না, দেয়ালের আড়ালের লড়াই আরো বেশী শক্ত। আমি মাহমূদকে তার সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকীর হাতেই মারার আয়োজন করেছি। কিন্তু এর আগে একবার আমি তার সাথে ময়দানের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে চাই। যদি পরাজিত হই তাহলে মাহমুদকে হত্যা করার জন্যে সেলজুকী সৈন্যদের ব্যবহার করবো বললো ইসরাঈল সেলজুকী।

শরাবের পেয়ালা একের পর এক গলদকরণ করছে দুই সর্দার। এলিকখানের সুন্দরী রক্ষিতা দু’জন শরাবের পেয়ালা ভরে দিচ্ছে। এলিকখানের ডানে বামে আরো তিন চারজন রূপসী বসা। ইসরাঈল সেলজুকী এই সুন্দরীদের মতো এতোটা রূপ জৌলুসের অধিকারী না হলেও সুঠাম শক্তিশালী টবগে যৌবনের অধিকারী একজন আকর্ষণীয় যুবক। শরাবের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সে বললো– আমি স্বপ্নে জাগরণে সব সময় নিজেকে গযনীর শাহী কুরসীতে আসীন দেখতে পাই।

ঠিক আছে, দেখা যাবে গযনীর তখতে কে বসে? তুমি ক’দিন আমার এখানে আতিথ্য গ্রহণ করো। মেহমান হিসেবে কয়েক দিন তার এখানে থাকার জন্যে ইসরাঈলকে আমন্ত্রণ জানালেন এলিকখান।

চাঁদনী রাতে রকমারী বুনো ফুলের মনোমুগ্ধকর গন্ধে আনমনে পায়চারী করছিল ইসরাঈল। হাঁটতে হাঁটতে সে তার জন্যে নির্ধারিত তাঁবু থেকে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল। এক সময় ইসরাঈল অনুভব করলো, সে একাকী নয়, তার পেছনে কেউ না কেউ আছে।

অতি সন্তর্পণে সে তার খঞ্জরের উপর হাত রেখে আঁড় চোখে এপাশ ওপাশ দেখতে চেষ্টা করলো। সে অনুভব করলো, একটি ছায়ামূর্তি গাছগাছালির ভেতর থেকে এগিয়ে আসছে। তার মনে হলো, ছায়া মূর্তিটি কোন পুরুষের নয়। ইসরাঈল নিঃশংক গলায় জিজ্ঞেস করলো, কে তুমি?

আমি মারয়াম! এগিয়ে এসে বললো এক নারী মূর্তি।

ভয় পাওয়ার কিছু নেই! আমি এলিকখানের ভাতিজী মারয়াম। ইসরাঈল গভীরভাবে তার দিকে তাকিয়ে বললো– আমার তো মনে হয় গতকাল এলিকখানের পাশে যারা বসেছিল তাদের মধ্যে তুমিও ছিলে। তো এখানে কেন এসেছো?

এটা কি জিজ্ঞেস করার কোন বিষয় হলো? বললো মারয়াম। ভুল বোঝার আগেই আমি আপনার ভুল ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে বলছি আপনার সুঠাম দেহ আর সর্দারীর মোহে আমি আপনার কাছে আসিনি। আমি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি সূলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে আপনার সংকল্পে মুগ্ধ হয়ে আপনাকে মোবারকবাদ জানাতে এবং উৎসাহিত করতে। দেখুন, আমি একজন কুমারী মেয়ে। তা ছাড়া আমি খানদের আভিজাত্যের অংশ। কিন্তু খানদের আভিজাত্য মান-মর্যাদা সবই এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চাচা এলিকখান এবারের পরাজয়ের পর মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আমার আত্মমর্যাদাবোধ চাচার এই মনোবল হারানোকে মেনে নিতে পারছে না।

আচ্ছা? গযনীর মাহমূদ কি কোন জিন-ভূত না দৈত্য দানব? যে ব্যক্তি এই মাহমূদকে পরাজিত করে এমন পাহাড়ে পাহাড়ে লুকিয়ে বেড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারবে তার জন্যে আমার সব কিছু কুরবান করে দিতে প্রস্তুত আমি। আমি দেখেছি, আপনার মধ্যে সেই সংকল্প আছে। এজন্য আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে।

আচ্ছা, তাই নাকি? মাহমূদের সাথে শাহজাদীর দুশমনি কেন?

কেন নয়? ইসরাঈল সেলজুকীর সাথে মাহমূদের কি নিয়ে দুশমনী? আপনার সাথে যে কারণে মাহমূদের শত্রুতা, আমার সাথেও এ কারণেই মাহমূদের শক্রতা।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। এসো এসো, আমরা এক জায়গায় বসে কথা বলি। আসলে শত্রু শত্রুই। কেন শত্রুতা, কেন দুশমনি, এসব বিষয় শত্রুকে পরাজিত করার পরই কেবল আলোচিত হতে পারে।

মারয়াম! তুমি অল্প বয়সী কুমারী তরুণী বটে কিন্তু তোমার চিন্তা ভাবনা আনাড়ী নয়, তুমি তো বিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতো কথা বলছে। এতে বিদ্যা বুদ্ধি তুমি কোথায় পেলে?

আরে, প্রয়োজনেই মানুষ বিজ্ঞ হয়ে ওঠে। আমিও প্রয়োজনের তাকিদেই এমনটা হয়ে উঠেছি।

এরপর তারা দুজন একটি বড় গাছের নীচে বসে কথা বলতে শুরু করলো । দীর্ঘক্ষণ নানা বিষয়ে কথা বলার পর পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেল। এক পর্যায়ে ইসরাঈল মারয়ামকে বললো–

এলিকখানের সাথে কি তোমার ব্যাপারে কথা বলবো?

তোমার মন চাইলে বলল, আমার কোন সমস্যা নেই। তিনি সম্মত না হলেও আমি তোমার কাছে চলে আসবো। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। আমি আমার ভবিষ্যত তোমার সাথেই বেঁধে ফেলেছি ইসরাঈল! বহুদিন ধরে আমি তোমার মতো দৃঢ়চেতা একজন বীর পুরুষের খোঁজ করছিলাম। আমার স্বপ্নগুলো যার মাধ্যমে বাস্তব রূপ দেয়া সম্ভব। সুলতান মাহমুদকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্যে তুমি আমাকে যে ভাবে ইচ্ছা কাজে লাগাতে পারো, আমাকে সব সময় প্রস্তুত পাবে।

ইসরাঈল এলিকখানের সান্নিধ্যে তিন রাত থাকলো। তিন রাতেই মারয়াম অতি সংগোপনে ইসরাঈলের সাথে সাক্ষাত করলো। শেষ রাতে তারই এক সমবয়সী তরুণী আম্বরীকে মারয়াম ইসরাঈলের সাথে সাক্ষাতের সময় সঙ্গে নিয়ে এলো। মারয়াম যখন ইসরাঈলের সাথে কথা বলতে গেলো, তখন আম্বরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। তার পরের দিন ইসরাঈল সেলজুকী চলে গেল।

ইসরাঈল চলে যাওয়ার পর আম্বরী মারয়ামকে বললো তোমার পছন্দ ঠিকই আছে মারয়াম! ইসরাঈলই তোমার জন্যে যোগ্য ব্যক্তি। এমন পুরুষই তোমার প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু একটা কথা মারয়াম! ইসরাঈলকে বিয়ে করে তুমি সুলতান মাহমুদের সাথে শত্রুত তৈরী করছে। অথচ চাচা এলিকখান বলেছেন, তিনি প্রয়োজনে মাহমূদের খান্দানে মেয়ে বিয়ে দিয়ে হলেও তার সাথে মৈত্রী গড়ে তুলবেন। তুমি কি একথা শোননি?

আরে, রাখো এসব কথা। এসব কথাই তো প্রমাণ করে তিনি জীবনের জন্যে হার মেনে নিয়েছেন। এগুলো তার পরাজয়ের পরিণতি। চাচা সুলতান মাহমূদকে এতোটাই ভয় পাচ্ছেন যে, নিজ খান্দানের মেয়ে দিয়ে হলেও তার সঙ্গে আপস করতে চান। কিন্তু ইসরাঈল সেলজুকী আপসহীন। সে কোন অবস্থাতেই মাহমূদের সাথে মৈত্রী করবে না। বললো মারয়াম–

মৈত্রী হয়তো করার সুযোগই পাবে না, পরাজিত হয়ে দৌড়ে পালাবে। কিছুটা তীর্যক কণ্ঠে মারয়ামের উদ্দেশে বললো আম্বরী। দেখবে ইসরাঈলেরও সেই একই পরিণতি হবে যা এলিকখানের হয়েছে। যে পরিণতি কাদের খানের হয়েছে, খাওয়ারিজম শাহীর হয়েছে, কারামতীদের হয়েছে। তোমার সেলজুকী বাহাদুরেরও একই পরিণতি বরণ করতে হবে মারয়াম!

আরে দেখে নিয়ো, ইসরাঈল সবার পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবে। কিছুটা গর্বিত কণ্ঠে বললো মারয়াম। আম্বরী! তুমি এমন ভাবে কথা বলছো, যাতে গযনী শাসকদের গোলামী ও পরাজয়ের গন্ধ আসে।

আরে শাহজাদী! তুমি আমার কথায় গযনী শাসকদের গোলামী আবিষ্কার করছো কেন, এটা ইসলামের গোলামী বলল। দেখো, তোমরা এই পার্থিব দুনিয়ার কথা বলো, আর আমি সেই দুনিয়ার কথা বলি, মৃত্যুর পর যে দুনিয়াতে আমাদের সবাইকে যেতে হবে। দেখো, মুসলিম শাসকরা পরস্পর লড়াই করে কি পেয়েছে? আসলে তো সেই সম্ভাবনাময় শক্তিকেই বিনষ্ট করছে যে শক্তি ইসলামে শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যয় করার কথা ছিল। খান আর সেলজুকীরা মিলিত হয়ে যদি সুলতান মাহমুদকে পরাজিত করে তবুও প্রকৃত জয় খান আর সেলজুকীদের হবে না, শক্তিশালী হবে ইসলামের বিরোধী শক্তি।

হেসে ফেললো মারয়াম, তার হাসিতে বিদ্রূপ। সে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বললো– তোমার মুখে সব সময় ইসলাম ইসলাম। ইসলামের কথা বলতে বলতে তুমি মারা যাবে আম্বরী! তুমি বিশ্বাস করো, একদিন না একদিন আমি গযনী সিংহাসনের রাণী হব। আর তুমি হবে কোন বুড়ো সেনাপতির বিবি।

অবশ্য আমি সেটা হতে দেবো না। তোমাকে আমি তোমার মতোই সুন্দর সুপুরুষ কোন যুবকের সাথে বিয়ে দেবো। সে হবে এমন যুবক যার থাকবে অঢেল সম্পদ আর ক্ষমতা।

আর ইসরাঈল সেলজুকী হবে গযনীর বাদশা। তাই না? তীর্যক কণ্ঠে বললো আম্বরী।

হ্যাঁ আম্বরী! সে তো এখনো বাদশা। তবুও তার সেই সিংহাসন চাই যে সিংহাসনে সুলতান মাহমূদ বসে।

তুমি জেগে জেগে দিবা স্বপ্ন দেখছো মারয়াম!

তুমি হয়তো ঠিকই বলছো আম্বরী! আসলেও আমি স্বপ্নময় ঘোরের মধ্যে আছি। ইসরাঈলকে আমার স্বপ্নগুলোর বাস্তব রূপকার মনে হচ্ছে। জানো, সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আমি রানী হওয়ার স্বপ্ন দেখি। রাণী আমাকে হতেই হবে। মাথার উপর রাণীর মুকুট রাখার জন্যে আমি যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি।

* * *

তিন দিন এলিকখানের আতিথ্য গ্রহণ করার পর ফিরে যাওয়ার সময় মারয়ামকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিল ইসরাঈল সেলজুকী।

ইসরাঈলের কথা শুনে এলিক খান বললো–ঠিক আছে ইসরাঈল! মারয়াম তোমাকে পছন্দ করেছে এ খবর আমার অজানা নয়! মারয়ামের বাবাও তোমার কাছে তার মেয়েকে তোলে দেয়ার ব্যাপারে আমাকে অনুমিত দিয়েছে। কিন্তু ইসরাঈল! তোমাকে এই অঙ্গীকার করতে হবে, সুলতান মাহমূদকে পরাজিত করে আমার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তুমি সব ধরনের ঝুঁকি নিতে এবং ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকবে।

বয়সের কারণে আর বন্ধুরা আমার সাথে বেঈমানী করার কারণে আমার পক্ষে মাহমূদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া সম্ভব হয়নি। এক পর্যায়ে তো আমি একথাও চিন্তা করেছিলাম, মাহমূদের সাথে কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক করে বাকী জীবনটা নির্বিবাদে আরামে কাটানোর ব্যবস্থা করবো। কিন্তু শেষ জীবনে তুমি আমার কাছে আশার আলো হয়ে এসেছে। ইচ্ছা করলে তুমি আমার শেষ জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারো। আমাকে নতুন জীবন দান করতে পারো।

মারয়াম আমার খুব প্রিয়। ছোট্ট বেলা থেকেই সে বলে আসছে সে হবে রাজরাণী । আশা করি তুমি তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারবে।

আপনার প্রত্যাশা আর মারয়ামের রাণী হওয়ার স্বপ্ন আমি পূর্ণ করবো বললো–ইসরাঈল সেলজুকী। এখন পর্যন্ত আমি কখনো মাহমূদের মুখোমুখি হইনি। প্রথমবার তার মুখোমুখি হয়ে যদি সুবিধা করতে না পারি তবে পিছিয়ে আসবো। দ্বিতীয় বারেও যদি আমি তাকে পরাজিত করতে না পারি তাহলে অন্য কৌশল অবলম্বন করবো। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন! আপনার জীবদ্দশাই মাহমূদের পতন ঘটবে। আমার হাতেই তার পতন ঘটবে।

ইসরাঈল সেলজুকী দুঃসাহসী চাতুর্যপূর্ণ কিছু কথাবার্তা বলে এলিকখানের মন থেকে পরাজয়ের আতংক দূর করে দিল এবং মারয়ামকে তখনই বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো।

* * *

এদিকে নিজ কবিলায় ফিরে আসার আগেই সেলজুকী গোত্রের লোকেরা খবর পেয়ে গেল গোত্র সর্দার ইসরাঈল সেলজুকী নতুন বউ নিয়ে আসছে। আর এই বউ কোন সাধারণ কবিলার মেয়ে নয়, অভিজাত খান শাসক গোষ্ঠী এলিকখানের আপন ভাতিজী।

এলিকখান যদিও পরাজিত ও বিপথগামী এক সরদার ছিল, কিন্তু সেই সময় সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটাও বিরাট সম্মানের বিষয় ছিল। কারণ, সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া সাধারণ ব্যাপার ছিল না। কোন বীরপুরুষের পক্ষেই এমন দুঃসাহসিক উদ্যোগ নেয়া সম্ভব ছিল। এ জন্য তদঞ্চলে এলিকখানকেও একজন সাহসী যোদ্ধা হিসেবে সম্মানের চোখে দেখা হতো।

এদিকে পাহাড়ী এলাকায় সেলজুকীরা গোত্রপতির বিয়ের খবর শুনে গোত্রের সকল লোক একত্রিত হলো। সারি সারি ছাগল, বকরী, উট জবাই হলো। জবাইকৃত পশুর রক্তে নদী বয়ে গেল। রাতভর চললো আমোদ ফুর্তি ও খানাপিনা।

পানাহার ও আমোদ ফুর্তির পর মারয়ামকে সাথে নিয়ে ইসরাঈল একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে গোত্রের লোকদের বললো– হে সেলজুকী সম্প্রদায়ের লোকেরা! শোন, আজ আমি তোমাদের সামনে এমন এক মহান শাহজাদীকে হাজির করেছি, যে সুলতান মাহমূদের রাজ প্রাসাদের প্রতিটি ইট খোলে ফেলার অঙ্গীকার করেছে। শাহজাদী মারয়ামকে তোমরা যেমন রূপের অধিকারী দেখছো, সে ততোটাই গুণ ও দৃঢ় সংকল্পের অধিকারীনী। সেলজুকী সিংহরা! গযনীর প্রাসাদ থেকে প্রতিটি ইট খোলে ফেলার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে থাক?

একথা শোনে সেলজুকী গোত্রের লোকেরা শ্লোগানের শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুললো।

ইসরাঈল সেলজুকীদের উসকে দেয়ার জন্যে বললো– হিন্দুস্তানের লুণ্ঠনকারী আজও সেলজুকী সিংহদের রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। আজ তোমরা প্রতিজ্ঞা করো, মাহমূদকে চির নিদ্রায় না পাঠিয়ে তোমরা আর বিছানায় পিঠ লাগাবে না। এখন আমাদের গন্তব্য হবে গয়নী।

হে সেলজুকী সিংহরা! ভুলে যেয়ো না তোমাদের কোন ভূখণ্ড নেই। দুনিয়াতে এমন জায়গা নেই, যেটিকে সেলজুকীরা নিজের দেশ বলতে পারে। আমরা জংলী জীব জন্তুর মতো পাহাড়ে জঙ্গলে যাযাবরের মতো বসবাস করছি। অথচ অস্ত্র ও জনবলের দিক থেকে আমরা মোটেও দুর্বল নই। আমরা একটি শক্তি! আমাদের একটা জনগোষ্ঠী আছে। আমাদের আছে প্রচুর সংখ্যক সাহসী যোদ্ধা। আমাদের শক্তিকে অন্যেরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে। ইতোমধ্যে আমাদের জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে। কয়েকজন সেলজুকী গযনীর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে।

সুলতান মাহমূদ তাদেরকে হিন্দুস্তানের লুট করা সম্পদের লোভ দেখিয়ে কিনে নিয়েছে। মাহমূদ ইসলামের নামে সবাইকে ধোঁকা দিচ্ছে। অথচ ইসলামের প্রকৃত প্রহরী আমরা। তবে আমরা আগে সেলজুকী, তারপর মুসলমান। মাহমূদ ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন। সে নিজেকে মূর্তি সংহারী বলে প্রচার করে। অথচ বাস্তবে সে নিজেকেই জীবন্ত মূর্তিতে পরিণত করেছে। মাহমূদ আমাদের সবাইকে তার পায়ে সিজদা দিতে বাধ্য করতে চায়। আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করতে রাজি নই। সেলজুকী সিংহরা! আজ তোমরা তোমাদের তরবারীকে তীক্ষ্ণ করে তোলো। প্রস্তুত হয়ে যাও, আমাদের পরবর্তী উৎসব হবে বিজয় উৎসব।

গোত্রপতি ইসরাঈলের ভাষণের পর সেদিন থেকেই পাহাড়ে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ প্রস্তুতি। নিক্ষেপযোগ্য বর্শা তৈরী হতে থাকল। অনেকে তীর ধনুক বানাতে লেগে গেল। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেলজুকীদের একত্রিত করা শুরু হলো। এক মাসের মধ্যে তৈরী হয়ে গেল একটা বিরাট বাহিনী।

ইসরাঈল সেলজুকী এলিকখানের সেনাবাহিনী থেকেও কিছুসংখ্যক সৈন্য তার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করলো। এলিকখানের সৈন্যদের সাথে তার ছেলে আহমদ তোগাখান কমাণ্ডার হিসেবে যোগদান করলো।

গযনী বাহিনীতে আরবাব খান সেলজুকী নামের এক ব্যক্তি একটি সেনা ইউনিটের কমান্ডার ছিল। একদিন তার বাবা তার সাথে সাক্ষাত করতে এলেন। আরবাব খানের বাবা শুধু ছেলের সাথে সাক্ষাত করতে আসেননি, তিনি সাক্ষাতের পাশাপাশি একথাও জানাতে এলেন সেলজুকীরা সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই সাথে সেলজুকী নেতারা বলছে, যে সব সেলজুকী গযনী বাহিনীতে রয়েছে তাদের উচিত, গযনী বাহিনী ত্যাগ করে ইসরাঈল সেলজুকীর নেতৃত্বে মাহমূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। এরা যদি তা না করে তাহলে গোত্রের সাথে বেঈমানীর জন্যে কাফের হয়ে মারা যাবে।

আরবাব খান তার বাবার কাছ থেকে ইসরাঈল সেলজুকীর যুদ্ধ প্রস্তুতির বিস্তারিত শোনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আরবাব খান তার ঊর্ধ্বতন সেনাপতির কাছে গিয়ে জানাল–সেলজুকী গোত্রপতি ইসরাঈল সেলজুকী গযনী সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ খবর এখনই সুলতানকে জানানো উচিত মাননীয় সেনপতি!

কিছুক্ষণ পর আরবাব খান ও তার পিতাকে সুলতানের সামনে হাজির করা হলো।

আমি তোমার ছেলের নৈতিকতাকে শ্রদ্ধা জানাই। কারণ সে তার বাবাকে আসামী করে আমার সামনে হাজির করেছে। আমি বুঝতে পারছি না তাকে কি পুরস্কার দিব? অবশ্য প্রকৃত পুরস্কার তাকে আখেরাতে আল্লাহ তাআলা দিবেন। আরবাব খানের পিতার উদ্দেশ্যে বললেন সুলতান মাহমদু।

সেলজুকী বৃদ্ধ ভয় ও আতংকে কাঁপতে লাগলো। সে আশংকা করছিল কঠিনতম কোন শাস্তি তাকে দেয়া হবে।

যাকে কেউ সত্য পথের সন্ধান দেয়নি, সে যদি বিপথগামী হয়, তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায় না। আজ তোমার ছেলে তোমাকে সত্য পথ দেখিয়েছে। এখন তুমি আমাকে বলল, ইসরাঈল সেলজুকী কি ধরনের যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে? আরবাব খানের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন সুলতান। তিনি আরো বললেন, তুমি যদি সেলজুকীদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ও তাদের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে কোন কথাই না বল তবুও আমরা তোমাকে জেলখানায় বন্দি করবো না। কারণ, তুমি আমাদের সম্মানিত মেহমান। আমরা তোমাকে সম্মানের সাথে মেহমানদারী করবো। আমরা তোমাকে সসম্মানে বিদায় দেবো। যাতে তুমি বুঝতে পারো, কারা সত্যের অনুসারী। কারা ইসলামের সঠিক আদর্শের অনুগত। আর কারা ইসলামের নামে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তুমি কি সত্য গোপন করে আল্লাহর বিরুদ্ধে যাবে?

সুলতানের কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলো আরবাব খান। সে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো– গোস্তাখী মাফ করবেন সুলতান! আমার বাবা যদি সত্য কথা না বলে, ঐ তাহলে আপনার সামনেই তার মাথা কেটে আপনার পায়ে সোপর্দ করবো।

থামো আরবাব খান! তুমি আমার সাথে কোন গোস্তাখী করোনি। গোস্তাখী করেছো তোমার বাবার সাথে। বেচারা তো ইসলামের একটি দিক দেখেছে, তাকে ইসলামের প্রকৃতরূপ দেখার সুযোগ দাও। উচ্চ কণ্ঠে বললেন সুলতান।

বৃদ্ধ সুলতানের কথায় এতোটাই মুগ্ধ হলো যে, সামনে অগ্রসর হয়ে হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে পড়লো এবং কোমর থেকে তরবারী খোলে সুলতানের পায়ের কাছে রেখে বললো– সেলজুকী গোত্রপতি ইসরাঈল খান এলিক খানের ভাতিজীকে সম্প্রতি বিয়ে করে নিয়ে এসেছে এবং এলিকখানের কিছু সৈন্য সাথে নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল সেলজুকী উপজাতিদের একত্রিত করে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সুলতান মাহমূদ আরবাব খানের বাবার সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলে প্রয়োজনীয় সব তথ্য জেনে নিলেন এবং তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন- এই মুরুব্বীর জন্য শাহী মেহমান খানায় যাবতীয় আপ্যায়ন ও মেহমানদারীর ব্যবস্থা করা হোক।

বৃদ্ধকে মেহমানখানায় পাঠিয়ে দিয়ে সুলতান আরবাব খানকে কিছু পুরস্কার দিয়ে বললেন– তুমি নিজেকে ইসরাঈলের বিশ্বস্ত লোক ঘোষণা দিয়ে ওখানে কিছু দিন থাকবে। সব কিছু জানা ও দেখা হয়ে গেলে সুযোগ মতো চলে আসবে।

এই ঘটনার পনেরো দিন পর আরবাব খান সেলজুকীদের খবর নিয়ে সুলতানের কাছে ফিরে এলো। সে এসেই সুলতানকে ইসরাঈল সেলজুকীর যাবতীয় প্রস্তুতির কথা জানিয়ে দিল।

সুলতান মাহমুদের সেনাবাহিনীতে দু’জন ছিলেন সেলজুকী সেনাপতি। এদের একজন আরবাব খানের বিশ্বস্ততার ব্যাপারে প্রশংসা করলেন। আরবাব খান ছাড়াও আরো দু’জন সেলজুকী ছিলেন গযনী বাহিনীর কমান্ডার। একজন সেনাপতি তাদের বিশ্বস্ততার ব্যাপারে দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করলেন। সুলতান এই দু’জন সেলজুকী কমান্ডারকে ডেকে বললেন, তোমরা দু’জন ইসরাঈলের কাছে চলে যাও। তাকে কৌশলে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে এদিকে নিয়ে এসো।

দুই কমান্ডার সেলজুকীদের কাছে গিয়ে কি ভূমিকা রাখবে এবং কখন কি উদ্যোগ নেবে এ ব্যাপারে তাদের বিস্তারিত দিক নির্দেশনা দিয়ে ইসরাঈলের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে সুলতান সেনাপতিদের ডেকে নির্দেশ দিলেন, যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে সেনাদেরকে বুখারার পাহাড়ী অঞ্চলে রওয়ানার জন্য তৈরী করুন।

* * *

১০১৭ সালের ঘটনা। সেলজুকী বাহিনীর যোদ্ধারা তিরমুজ নামক স্থান দিয়ে ককেসাস নদী পার হলো।

সেলজুকীরা ছিল প্রকৃত অর্থেই লড়াকু জাতি। ফলে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে তারা বন্যার পানির মতোই ধেয়ে আসছিল। সেলজুকীরা ছিল উপজাতি। তাদের নিজস্ব কোন সরকার ব্যবস্থা ছিল না এবং ছিল না প্রথাদুরস্ত প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। ফলে সেলজুকীরা যে পথে অগ্রসর হচ্ছিল সকল জনপদ তারা লুণ্ঠন করে এবং লোকদের মাঠের ফসল তাদের ঘোড়া উট দিয়ে মাড়িয়ে আসছিল।

তিরমুজ থেকে ষাট মাইল এগুলে আহাঙ্গরা পাহাড়ী এলাকা। সেলজুকী বাহিনী সুলতান মাহমুদের পাঠানো টু’জন প্রশিক্ষিত কমান্ডারের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছিল। আহাঙ্গরা পাহাড়ী এলাকায় এসে সেলজুকী বাহিনী একটি জায়গায় তাঁবু ফেললো। সুলতানের দুই কমান্ডার ইসরাঈল সেলজুকীকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিল, যে এলাকায় সুলতানের সেনাবাহিনী নেই, তারা সেই এলাকা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সেলজুকীরা দীর্ঘ ক্লান্তিকর সফরের পর অসংখ্য তাঁবু ফেলে আহারাদি সেরে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে সবাই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল।

মাঝ রাতে তাঁবুগুলোর মাঝখান থেকে একটি মশাল উপরের দিকে উঠে ডানে বামে দোলে উঠলো। এটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত সংকেত। এই সংকেতের পর চতুর্দিক থেকে তাঁবু এলাকায় এমন হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল যেন পাহাড়ের চূড়া ভেঙ্গে তাঁবুতে শায়িত মানুষগুলোর উপর আঁছড়ে পড়ছে। সুলতান মাহমুদের দুই সেলজুকী সেনাপতি সেলজুকীদের পণ্যসামগ্রীতে আগুন ধরিয়ে দিল এবং আগুনের আলোয় গযনী বাহিনী ঘুমন্ত সেলজুকীদের উপর চড়াও হলো।

সেলজুকীদের তুলনায় সুলতান মাহমুদের পাঠানো সৈন্য সংখ্যা ছিলো খুবই নগন্য। কিন্তু ঘুমন্ত সৈন্যদের পিষে মারার জন্য মাত্র দুটি অশ্বারোহী ইউনিটই যথেষ্ট ছিলো । আসলে সেই ঘুমন্ত তাঁবুপল্লীতে যা ঘটেছিল তা কোন লড়াই ছিল না, ছিল সেলজুকীদের গণ হত্যা। সেলজুকীরা কোন প্রতিরোধ বা আত্মরক্ষার সুযোগ পেলো না, ঘনী বাহিনী সেলজুকীদের কচুকাটা করতে লাগল।

সুলতানের পাঠানো দুই সেলজুকী সেনাপতি ইসরাঈল সেলজুকী ও আহমদ তোগা খানকে জীবন্ত পাকড়াও করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ওরা চিল সাসার সেলজুকীদের চেয়ে অনেক সতর্ক। তাঁবুতে আক্রমণ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তারা দু’জন জীবন নিয়ে পালাতে সক্ষম হলো। সকাল বেলায় জ্বলন্ত তাঁবু ও অগণিত লাশের স্তূপের মাঝে ইসরাঈল সেলজুকী ও আহমদ তোগা খানের মরদেহ খুঁজে পাওয়া গেল না।

কয়েক দিন পরে ঘটনা। ইসরাঈল সেলজুকী মারয়ামকে বিয়ের পর যেখানে দাঁড়িয়ে তার গোত্রের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলো– তোমরা সবাই তোমাদের তীর ধনুক ঠিক ঠাক করে নাও, তরবারীকে শান দিয়ে নাও, আমাদের আগামী উৎসব হবে বিজয় উৎসব। পালিয়ে এসে ঠিক সেই টিলার পাদদেশে একটি তাঁবুতে ভগ্ন হৃদয়ে হতাশ ইসরাঈল বিছানায় পড়ে এপাশ ওপাশ করছিল। আর মারয়াম নিজ হাতে ইসরাঈলকে শরাব পান করাচ্ছিল। আর ইসরাঈলের পাশে বসা ছিল একজন পণ্ডিতধরনের লোক।

জীবনের প্রথম পরাজয়ই শেষ যুদ্ধ নয় ইসরাইল! তুমি এভাবে ভেঙে পড়ো না। কারণ, তোমার অজ্ঞাতসারে অতর্কিত আক্রমণে তুমি পরাজয় বরণ করেছে। আবার নিজেকে শানিত করে প্রস্তুতি নিয়ে মোকাবেলা করো, শেষ বিজয় তোমারই হবে।

ইসরাঈল নীরব। যেনো কোন কথাই তার কানে প্রবেশ করছে না। এ অবস্থা দেখে পণ্ডিত লোকটিকে মারয়াম বাইরে চলে যেতে ইঙ্গিত করলে সে তাঁবুর বাইরে চলে গেলো। এবার ইসরাঈলকে একান্তে পেয়ে তাকে চাঙা করার জন্যে নিজের রূপ যৌবনের যাদুকরী কৌশল প্রয়োগ করতে লাগলো মারয়াম। খুব মায়াবী কণ্ঠে ইসরাঈলকে স্মরণ করিয়ে দিলো, একটু খানি পরাজয়ে তুমি এতোটা ভেঙ্গে পড়েছো? অথচ আমার সাথে প্রথম পরিচয়ের দিনই তুমি বলেছিলে, প্রথম মোকাবেলায় পরাজিত হলেও পরবর্তী মোকাবেলায় তুমি ভিন্ন। কৌশল অবলম্বন করে মাহমূদকে শেষ ঠিকানায় পৌঁছে দেবে।

মারয়ামের উদ্দীপনামূলক কথাবার্তা ও দৈহিক উষ্ণতায় ইসরাঈল যেনো প্রাণ ফিরে পেলো। সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো এবং মারয়ামকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে নতুনভাবে প্রস্তুত হওয়ার প্রতিজ্ঞা করলো।

কয়েক দিন পর যখন পরাজয়ের অবসাদ ও গ্লানি কাটিয়ে ইসরাঈল আবার সেলজুকীদের একত্রিত করে পুনরায় যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো, তখন খবর এলো– এলিকখান মারা গেছে। মৃত্যুর আগে সে বলে গেছে, ইসরাঈলকে বলবে, সে আমাকে আমার জীবদ্দশায় মাহমুদকে পরাজিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তার পরাজয়ের বর্ণনা শুনে আমি এতোটাই শোকাহত হয়েছি যে, এই বয়সে এতোটা কষ্ট আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হলো না। আমি আমার ছেলে আহমদ তোগা খানকে আমার স্থলাভিষিক্ত করে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছি। ইসরাঈলকে বলল, সে যেনো আমার সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি পূরণ করে। নয়তো আমার বিদেহী আত্মা প্রেতাত্মা হয়ে তাকে শান্তিতে ঘুমাতে দেবে না।

ইসরাঈল যেনো তোগা খানের সাথে সৌহার্দ্য বজায় রাখে এবং আলাফতোগীনের সাথেও মৈত্রী বজায় রাখে। কারণ, তোমাদের কারো একার পক্ষে মাহমূদকে পরাজিত করা সম্ভব হবে না। আমি আলাফতোগীনকে শীঘ্রই তার কাছে পাঠাচ্ছি। ইসরাঈল ও আলাফতোগীন দু’জন এক সাথে বসে যেন ভবিষ্যত করণীয় নির্ধারণ করে।

বস্তুত আলাফতোগীনের হাতেই এলিকখান এই লিখিত পয়গাম দিয়েছিল। সে পয়গামে আরো জানালো, আলাফতোগীনের সাথে তোমার কাছে আমি দু’জন যুবতাঁকে পাঠালাম। মারয়াম এদেরকে ভালো ভাবেই জানে। মৃত্যুর আগে আমি তোমাকে একটা গোপন কৌশল বলে দিতে চাই–

আমার সাথে সাক্ষাতে তুমি বলেছিলে, প্রথম আক্রমণে মাহমূদকে পরাজিত করতে পারলে তুমি অন্য পন্থা অবলম্বন করবে। অন্য পন্থা হিসেবে এই দু’টি মেয়েকে তুমি ব্যবহার করতে পারো। এরা খুবই চতুর ও সতর্ক মেয়ে। সুলতান মাহমূদের সেনাবাহিনীতে কয়েকজন সেলজুকী কমান্ডার রয়েছে। এদেরকে এই মেয়ে দুটি দিয়ে তুমি ফাঁদে আটকাতে পারো। মেয়ে দুটিকে গযনী পাঠিয়ে দেবে। এরা সেখানে গিয়ে সেলজুকী কমান্ডারদের বিয়ে করবে। কিন্তু পর্দার অন্তরালে এরা মাহমূদের সেনাবাহিনীতে কর্মরত অন্যান্য সেলজুকীদেরকে তাদের ফাঁদে ফাসাতে থাকবে।

এদেরকে বুখারার বাইরের একজন উস্তাদ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সে ইহুদী। ইহুদীর কথা শুনে মনে করো না, ইহুদী হয়তো আমাদের ক্ষতি করবে। আসলে আমাদের ক্ষতি করবে না, তার লক্ষ্য বস্তু মাহমূদ। সে আমার সাথে ওয়াদা করেছে মাহমূদের সেনাবাহিনীতে কর্মরত সেলজুকীদের খরীদ করতে যতো টাকার প্রয়োজন হয় সে নগদ অর্থ সহায়তা দেবে। এ ব্যাপারে অর্থ খরচের ব্যাপারে তুমি মোটেও চিন্তা করো না। আহমদ তোগা খানও তোমাকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা করবে।

ইসরাঈল যখন তার তাঁবুতে আগত দুই তরুণীকে দেখলো, তখন তার কাছে মনে হলো, রূপ সৌন্দর্যের দিক থেকে এরা মারয়ামের কাছে কিছুই নয়। তবে সুন্দরী।

দুই তরুণী যখন ইসরাঈলের সাথে কথা বলতে শুরু করলো এবং তাদের যাদুকরী অঙ্গভঙ্গি দেখাতে শুরু করলো, তখন মারয়ামের রূপসৌন্দর্য ইসরাঈলের কাছে পানসে হয়ে গেলো। তার হৃদয় থেকে ধীরে ধীরে মারয়ামের প্রেম ফিকে হতে শুরু করলো। সেখানে ঝড় তুললো এই দুই তরুণী।

কারণ তরুণী দুজন ছিল পুরুষের মনে কামনা জাগানোর ব্যপারে পারদর্শী। কিভাবে কথা বলে, অঙ্গ-ভঙ্গি, চাহনী ও হাসি দিয়ে দৃষ্টি ও শরীর প্রদর্শন করে পুরুষের মনে আগুন ধরিয়ে দেয়া যায়, এ ব্যাপারে এরা ছিল চারুণ পারঙ্গম।

দুই তরুণীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ইসরাঈল গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়লো। তার মন থেকে পরাজয়ের গ্লানি দূর হয়ে গেল এবং সে ফিরে পেলো নতুন শক্তি, নতুন উদ্যম। দুই তরুণী ইসরাঈলের মধ্যে জাগিয়ে দিলো জীবনী শক্তি।

ডুবন্ত মানুষ খড়খুটোকে আঁকড়ে ধরেও বাঁচতে চেষ্টা করে। আর সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিতরা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য গোপন চক্রান্ত শুরু করে। ইতিহাস সাক্ষী? বহু খ্যাতিমান বীর পুরুষ যাদেরকে সম্মুখ যুদ্ধে কেউ পরাজিত করতে পারেনি তাদেরকে নারীর ফাঁদে ফেলে অনায়াসে নিঃশেষ করা হয়েছে। বহু ক্ষমতাধর রাজা বাদশাকে নাকানী চুবানী খাইয়েছে নারী। আবার বহু নারী নিজেকে জলাঞ্জলী দিয়ে অধপতনের অতল থেকে উদ্ধার করেছে পতনমুখ রাজা বাদশাকে।

সম্মুখ যুদ্ধে বারবার পরাস্ত হওয়ার পর বৃদ্ধ বয়সে কুচক্রী এলিকখান সুলতান মাহমূদকে পরাস্ত করার জন্য ইহুদীদের শরনাপন্ন হয়। ইহুদীরা এলিকখানের পাঠানো দুই তরুণীকে দীর্ঘ দিন প্রশিক্ষণ-দেয়, কিভাবে নারী দেহ প্রদর্শন করে এবং নারীত্বের ছলাকলা দেখিয়ে পুরুষকে ফাঁদে ফেলতে হয়। কিভাবে নারীর ইজ্জত বিকিয়ে দিয়ে কাংখিত পুরুষকে ঘায়েল করতে হয়।

ইহুদীদের হাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দুই মুসলিম তরুণী হতাশাগ্রস্থ সেলজুকী গোত্রপতি ইসরাঈলকে উজ্জীবিত করে পুনরায় সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে তৈরী করতে এসেছে এবং সেলজুকী মেয়ের পরিচয়ে গযনী বাহিনীর সেলজুকী কমান্ডারদের বিয়ের নামে বিভ্রান্ত করে গযনী বাহিনীর সৈন্যদের দিয়েই সুলতানকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।

এদিকে আরেক এলিকখানী মেয়ে মারয়াম রাণী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। অথচ এই খান মেয়েদেরই একজন আম্বরী। মারয়ামের মতোই যুবতী সে। একই আলো বাতাস ও পরিবেশে বড় হয়েছে মারয়াম এবং আম্বরী। তাদের পরিবার ও পরিবেশে সুলতান মাহমুদের নাম অত্যন্ত ঘৃণাভরে উচ্চারিত হতো। ছোট বড় সকল এলিকখানী সুলতান মাহমূদকে ধ্বংসের জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকতো। সেই পরিবার ও পরিবেশে বেড়ে উঠেও আম্বরী ছিল ব্যতিক্রম। সমবয়সীরা যখন সুলতান মাহমুদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতো, তখন সেটির মধ্যেও সে খোঁজে পেতো শ্রদ্ধার উপাদান।

আম্বরীর এই ব্যতিক্রমী বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা ছিল মারয়ামের।

আম্বরী একদিন মারয়ামকে দৃঢ়ভাবে বলে ছিলো, তোমাদের এই ঘৃণা বিদ্বেষ আসলে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে না, ইসলামের বিরোধ্যিায় পর্যবসিত হচ্ছে। সুলতান মাহমূদের বিরোধিতা করে তোমরা বাস্তবে ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করছে।

দু’জন খান তরুণীকে যখন বাইরের এক লোক একটি বদ্ধ কক্ষে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘ সময় কাটাতে এটি তখন আম্বরীর নজর এড়াতো না। তার চোখের সামনেই প্রতিদিন একটি গোপন কক্ষে ভিনদেশ এক পুরুষের সাথে সময় কাটাতো তারই বয়সী দুই খান তরুণী।

একদিন আম্বরী তরুণীদের জিজ্ঞেস করলো- তোমরা এই ঘরে দীর্ঘ সময় ধরে কি করো? ওই অপরিচিত লোকটি কে? ওরা আম্বরীকে জানালো, তিনি আমাদের গৃহ শিক্ষক। আমরা সেখানে তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করি।

একথা শুনে আম্বরীর খুব আফসোস হলো । সে মনে মনে বললো, দুরের মেয়েদের জন্য বাইরে থেকে শিক্ষক এনে শিক্ষা দেয়া হয়; কিন্তু ঘরের মেয়ে হওয়ার পরও তাকে উস্তাদের কাছে বসতে দেয়া হয় না। অবশ্য আফসোস হলেও পরবর্তীতে আম্বরীর কারণ উদঘাটনে মোটেও কষ্ট হয়নি। এলিকখানের বংশের সবাই আম্বরীকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মনে করতো। কারণ সব সময় তার মুখে থাকতো, ইসলাম দীন পরকাল জান্নাত জাহান্নাম, পাপ পুণ্য ইত্যাকার কথাবার্তা। শাহী খান্দানের অন্যান্য তরুণীদের মতো আম্বরী বিলাস ব্যাসনও আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকতো না। ফলে সবাই তাকে বলতো, ওর মধ্যে আবেগ উচ্ছ্বাস নেই। রাগ অনুরাগহীন নিরামিষ ধরনের একজন নারী আম্বরী।

অথচ আম্বরী ছিলো খান পরিবারে যে কোন তরুণীর চেয়ে অনেক বেশী প্রখর অনুভূতির অধিকারী। কিন্তু তার আবেগ উচ্ছ্বাস ছিল নিয়ন্ত্রিত। অশ্বারোহণও তীরন্দাজী ছাড়া আর কোন কাজ ও খেলাধুলায় সে মনোযোগী ছিলো না। সেই যুগে শাহী খানদানের সব মেয়েরাই অশ্বারোহণ ও তীরন্দাজীতে পারদর্শী হতো । এটাই ছিল সাধারণ রীতি। কিন্তু এ কাজে আম্বরীর পারদর্শিতা ছিল অসাধারণ । সে পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘোড়া দৌড়াতে এবং ধাবমান ঘোড়ার উপর থেকে নির্ভুল লক্ষ্যবস্তুতে তীর নিক্ষেপে অসাধারণ পারদর্শিতা অর্জন করেছিল। আম্বরীর তীর কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো না। এ ব্যাপারে তার কোন জুড়ি ছিল না। প্রায় দিনই সে একাকী ঘোড়া হাঁকিয়ে বাড়ি থেকে বহু দূরে চলে যেতো।

* * *

সেলজুকীরা মারাত্মক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল। জনবল হারানোর পাশাপাশি তাদের বিপুল সংখ্যক উট, ঘোড়া ও সহায় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু সুলতান মাহমূদ এই বিজয়ে মোটেও নিরুদ্বিগ্ন হতে পারেননি। কারণ তিনি জানতেন, সেলজুকী একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এদের লোক সংখ্যা বিপুল। তাছাড়া এলিকখানের রাজশক্তি এবং আলাফতোগীন এদের সহযোগী। কাজেই যে কোন সময় এরা একত্রিত হয়ে সীমান্ত এলাকায় আঘাত হানতে পারে। ফলে এদের উপর দৃষ্টি রাখা জরুরি। সুলতান মাহমুদ সীমান্তরক্ষীদের নির্দেশ দিয়ে দিলেন, সীমান্ত চৌকিগুলোর টহল ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হোক এবং যতদূর সম্ভব টহল সেনাদের সীমান্তের বাইরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে সতর্ক রাখা হোক।

সুলতানের এই নির্দেশের পর সীমান্ত চৌকিগুলোর শক্তি বাড়ানো হলো। টহল জোরদার করা হলো এবং সীমান্তের বাইরেও বহুদূর পর্যন্ত গযনী সৈন্যদের টহলের নির্দেশ দেয়া হলো।

উমর ইয়াজদানী ছিল গযনী বাহিনীর একজন কমান্ডার। তিনটি সীমান্ত চৌকির দায়িত্ব ছিল তার উপর। উকেসাস ইয়াজদানীর কর্মক্ষেত্র। উকেসাস নদীর একেবারে তীরবর্তী একটি চৌকিতে থাকতো উমর ইয়াজদানী। উমর ইয়াজদানীর অধীনস্ত সেনাদের জন্যে সবসময় নদীর তীরে বাধা থাকতো একাধিক নৌকা। নৌকা করেও তারা ওপারের অবস্থা পর্যবেক্ষণে বের হতো। কমান্ডার হিসেবে ইয়াজদানী প্রায়ই একাকী ‘টহল দলের অবস্থা দেখার জন্যে বেরিয়ে পড়তো। যাচাই করতো টহল সেনারা ঠিকমতো কর্তব্য পালন করছে কি না।

একদিন টহল সেনাদের পর্যবেক্ষণে বের হয়ে উমর ইয়াজদানী দূর থেকে লক্ষ করলো, তার টহলদল ঠিক মতোই টহল দিচ্ছে। অশ্বারোহী টহলদল অবিরাম ঘোড়া হাঁকিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। উমর দেখলো, তার দৃষ্টিসীমার বাইরে ওরা গহীন অরণ্যে চলে গেছে। এটাই ছিল স্বাভাবিক। উমর তার অধীনস্থদের কাজে আশ্বস্ত হয়ে উল্টো দিকে ঘোড়া হাকাল।

উমর ছিল কমান্ডার। তার কাছে তীর ধনুক রাখার দরকার ছিল না। কিন্তু উমর এসবের ধার ধারে না। ঘর থেকে বের হলে তীর ধনুক, তরবারী তার সাথে থাকবেই। এগুলোকে একজন সৈনিকের সার্বক্ষণিক পোষাক মনে করে উমর। অফিসার ও সিপাহীর ভিন্নতায় বিশ্বাসী নয় উমর ইয়াজদানী।

সীমান্তের এই এলাকাটি ছিল শিকারে জন্যে উপযুক্ত জায়গা। এখানে দল বেঁধে হরিণ, খরগোশ, বনগরু বিচরণ করতো। উমর ইয়াজদানী হরিণ শিকারেও ছিল পটু। প্রায়ই একাকিই শিকার করে নিয়ে আসতো হরিণ খরগোশ ইত্যাদি।

সে দিন টহল সেনাদের গতিবিধি দেখে উল্টো দিকে রওয়ানা হতেই সামান্য দূরে তার চোখ পড়লো কয়েকটি হরিণের উপর। হরিণকে শিকার করতে হলে পেছন দিয়ে কিছুটা পথ ঘুরে অগ্রসর হয়ে আক্রমণ করতে হয়। কিন্তু হরিণগুলো হঠাৎ সেখান থেকে আরো দুরে সরে যেতে লাগল। উমর ইয়াজদানীর মনোযোগ নিবদ্ধ ছিলো হরিণের প্রতি। তার খেয়াল ছিলো না হরিণ তাড়া করে সে সীমানা থেকে কতোটুকু দূরে চলে এসেছে।

এক পর্যায়ে তার চোখে পড়লো পাহাড়ী এলাকা। হঠাৎ হরিণগুলো কান খাড়া করে উর্ধশ্বাসে দৌড়াতে লাগল। মনে হচ্ছে ওরা কোন শত্রুর উপস্থিতি টের পেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উমর ইয়াজদানীর কানে ভেসে এলো ছুটন্ত অশ্বখুড়ের আওয়াজ। ধীরে ধীরে ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ আরো কাছে এগিয়ে এলো। উমর ইয়াজদানী ঘোড়া থামাল। চতুর্দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে দেখতে পেলো, একটি ধাবমান অশ্বারোহী ডানে বামে তীর চালাচ্ছে আর তার ঘোড়াটি একে বেঁকে দৌড়াচ্ছে।

হঠাৎ ঘোড়াটি একদিকে ঘুরে গেলে উমর দেখলো, অশ্বরোহী একজন নারী এবং তাকে তাড়া করছে চারটি চিতা বাঘ। মহিলা তার ঘোড়াকে ডানে বামে ঘুরিয়ে চিতাগুলোর উপর তীর চালাচ্ছিল, কিন্তু কোন তীরই চিতাকে আঘাত করতে পারছিল না।

সেই অঞ্চলের চিতাবাঘের হিংস্রতা ছিল প্রবাদতুল্য। অন্যান্য বাঘের চেয়ে ওখানকার বাঘ ছিলো অনেক বেশী শক্তিশালী ও হিংস্র। বাঘের ভয়ে ঘোড়া উর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছিল। কিন্তু দৌড়াতে দৌড়াতে ঘোড়াটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এ দিকে একটি মেয়ের পক্ষে চারটি চিতাবাঘের মোকাবেলা করা ছিল অসম্ভব। দৃশ্যত চিতাবাঘের আক্রমণ থেকে মেয়েটির বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে কাল বিলম্ব না করে ধনুকে তীর ভরে উমর ইয়াজদানী তার ঘোড়া চিতার পেছনে ছুটালো। ততোক্ষণে চিতা ও আক্রান্ত মেয়েটি অনেক দূর চলে গেছে। আর দুটি চিতা মেয়েটির দু’পাশ থেকে ঘোড়াকে আক্রমণ উদ্যত অবস্থায়।

উমর তার ঘোড়াকে ইশারা করতেই সেনাবাহিনীর তাজাম প্রশিক্ষিত ঘোড়া বাতাসের আগে ছুটতে লাগল। ততোক্ষণে একটি চিতা মেয়েটির ঘোড়ার গায়ে দু’একটি থাবা মেরে দিয়েছে। এমন নাজুক অবস্থায় তীর চালালে তীর লক্ষভ্রষ্ট হয়ে মেয়েটি আহত হতে পারে, এই আশংকায় তীর না চালিয়ে উমর ইয়াজদানী বিদ্যুৎবেগে মেয়ের ঘোড়াকে আক্রমণকারী একটি চিতার উপরে তার ঘোড়াটি তুলে দিলো। ঘোড়র পায়ে পিষ্ট হয়ে বাঘটি পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার ঘোড়াকে ঘুরিয়ে ধাবমান ঘোড়া থেকে একটি চিতাকে লক্ষ করে তীর ছুড়ল । চিতা একটি আর্ত চিৎকার দিয়ে শিকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু বেশী দূর যেতে পারলো না, পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগল।

অপর দুই চিতা সঙ্গী দু’জনের অবস্থা দেখে শিকার ত্যাগ করে জীবন নিয়ে পালালো। চিতার তাড়া না থাকলেও চিতার ভয়ে ভড়কে যাওয়া মেয়েটির ঘোড়া বেলাগাম হয়ে পড়েছিল। সে তখনো জীবনপণ দৌড়াচ্ছে, থামার নাম নেই। উমর ইয়াজদানী লাগামহীন হয়ে যাওয়া ঘোড়াটিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে তার ঘোড়াকে সেই ঘোড়ার পাশে চালিয়ে দিল। এবার সে দেখতে পেলো আরোহী বয়স্ক মহিলা নয়, একজন দারুন সুন্দরী তরুণী। চেহারা ছবি দেখে মনে হয় কোন শাহী খান্দানের মেয়ে।

উমর ইয়াজদানী তরুণীর ঘোড়াকে অতিক্রম করে থাবা দিয়ে ঘোড়ার লাগামটি হাতিয়ে নিয়ে ঘোড়াটিকে থামাতে চেষ্টা করল। বহু কষ্টে সে আতংকগ্রস্ত ঘোড়াটিকে থামাল। তবে আরোহী তরুণীকে মোটেও শংকিত মনে হলো না। হাপাচ্ছিল তরুণী। এভাবে জীবন বাঁচানোর জন্য উমর ইয়াজদানী ক্লান্ত কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা জানালো তরুণীকে। তরুণীর কণ্ঠ শোনে উমর ইয়াজদানী বললো– আচ্ছা! আপনি এলিকখানী?

হ্যাঁ, আপনি?

গযনবী। আমি গযনী বাহিনীর একজন কমান্ডার। একটি হরিণকে তাড়া করে অনেক দূরে এসে পড়েছিলাম। কিন্তু আপনার ঘোড়াকে চিতা বাঘে তাড়া করতে দেখে আমি এ পর্যন্ত এসে গেলাম।

আপনি কি জানেন? আপনার সীমান্ত থেকে আপনি অন্য রাজ্যের কতখানি ভেতরে চলে এসেছেন? মুচকি হেসে বললো তরুণী। আপনি এখন আমাদের সীমান্তের পাঁচ মাইল ভেতরে। আপনি আর আমি কিন্তু পরস্পর শত্রু।

হ্যাঁ শত্রু বটে, কিন্তু প্রধান শত্রু এলিকখান মারা গেছে। জীবিত অবস্থায়ই আমরা তার শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছিলাম। আপনি খানদের কোন অংশের মেয়ে?

আমি শাহী খান্দানের মেয়ে। এলিকখান আমার চাচা ছিলেন। আমার নাম আম্বরী।

আচ্ছা, আপনি তাহলে শাহজাদী।

হ্যাঁ, শাহী বংশের মেয়ে বলেই আমরা একে অন্যের শত্রু।

একজন অপরিচিত তরুণীকে কোন কড়া কথা বলতে আমার ইচ্ছে করছে । তবে না বলেও পারছি না। শাহজাদী আম্বরী! আপনার বয়স তেমন হয়নি। এই বয়সে কে শত্রু কে বন্ধু, কার রাজনৈতিক কর্মকান্ড ঠিক, কারটি বেঠিক তা নির্ণয় করার মতো জ্ঞান আপনার হয়নি। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি, সুলতান মাহমূদের প্রতি আপনাদের যে হিংসা ও শত্রুতা তা মন থেকে দূর করে দিন। ভবিষ্যত প্রজন্মকে একথা শিক্ষা দিন যে, দু’জন মুসলমান একে অন্যের শত্রু হতে পারে না।

আমাকে আপনি শত্রু পক্ষের লোক মনে করবেন না কমান্ডার। আপনার এই উপদেশেরও আমার প্রয়োজন নেই। আপনি কি জানেন? সুলতান মাহমূদকে শত্রু জ্ঞান করি না বলে আমার খান্দানের লোকেরা আমাকে পাগল মনে করে। সত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করি এবং ন্যায়পরায়ণ সত্যপন্থি সুলতান মাহমূদকে শ্রদ্ধা করি বলেই হয়তো আজ বাঘের আক্রমণ থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য এক শত্রু সেনা কমান্ডারকে আল্লাহ তাআলা সীমান্তের পাঁচ মাইল ভেতরে পাঠিয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। হ্যায় আল্লাহ! আপনি না এলে এতোক্ষণে চিতাবাঘ আমাকে চিড়ে খেয়ে ফেলতো।

আমি আপনার শত্রুপক্ষের লোক। শত্রুপক্ষের লোক হওয়ার পরও আপনাদের সীমানায় অবৈধভাবে প্রবেশ করেছি। এখন আমার ব্যাপারে আপনার। সিদ্ধান্ত কি হবে? আমি কি আপনার বন্দি?

না, না। আপনি বন্দি হবেন কেন? আপনি আমার কাছে সম্মানিত অতিথি। বললো আম্বরী। আপনার যদি তাড়া থাকে তবে এখন চলে যেতে পারেন। আমাকে এক্ষুণি বাড়ি ফিরতে হবে। কারণ বাড়ি থেকে বেরিয়েছি অনেক্ষণ হয়েছে। বাড়ির লোকজন হয়তো আমাকে খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়েছে।

আম্বরী ও ইয়াজদানী একে অন্যের দিকে তাকাল। তাদের মধ্যে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় হলো। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে উভয়েই মুচকি হাসলো। এরপর ঘোড়ার দিক ঘুরিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে ইয়াজদানী বললো– খোদা হাফেয, শাহজাদী! ইয়াজদানীর ঘোড়া চলতে শুরু করেছিল। ঠিক সেই সময়ে ডেকে উঠলো আম্বরী।

দাঁড়ান! আগামীকাল কি আপনি এখানে আসতে পারবেন? আমি আগামী কাল এখানে আসবো।

আমাকে পাকড়াও করতে কতোজন লোক আসবে? জানতে চাইলো ইয়াজদানী।

একথা শুনে আম্বরীর মুখ থেকে হাসি উবে গেল। মলীন হয়ে গেল তার চেহারা।

আমার প্রতি এমন সন্দেহ করতে পারলেন আপনি? উদাস কণ্ঠে বললো আম্বরী। অবশ্য আমার পক্ষে আপনাকে নিশ্চয়তা দেয়ার কোন উপায় নেই। আমি আপনাকে ধোঁকা দেবো না একথা কিভাবে বুঝবো? তবে একথা জেনে রাখুন, আপনি চাইলে আমি আপনার চৌকিতেও হানা দিতে পারি ।

দুঃখিত, আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য আমি একথা বলিনি। যাক, আমি কথা দিলাম, আগামীকাল আপনার জন্যে এখানে আসবো।

ইয়াজদানী আর কালক্ষেপণ না করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। ঠায় দাঁড়িয়ে ইয়াজদানীর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলো আম্বরী।

ঝুঁকি নিলো ইয়াজদানী। পরদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আম্বরীকে যেখানে পেয়েছিল সেখানে এলো। আম্বরী আগে এসেই দাঁড়িয়ে ছিল। কুশল বিনিময়ের পর নিজ নিজ শখ, রুচি, প্রত্যাশা ও স্বপ্নের কথাই অগ্রাধিকার পেলো। দীর্ঘ আলোচনায় তারা একে অন্যের আদর্শিক জীবনাদর্শে এতোটাই মুগ্ধ হলো যে, দুজনে মিলে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। এভাবে সীমান্ত পেরিয়ে শত্রু রাজ্যের ভেতরে গিয়ে আম্বরীর সাথে নিয়মিত দেখা সাক্ষাত করতে লাগলো ইয়াজদানী ।

সপ্তম দিনের সাক্ষাতে ইয়াজদানী লক্ষ করলো, আম্বরীর মধ্যে আগের মতো এতোটা উৎফুল্ল ভাব নেই। তার চেহারা মলিন এবং বিব্রত। কিছুক্ষণ নীরব থেকে এক পর্যায়ে আম্বরী নিজে থেকেই বললো–

তোমার প্রতি ভালোবাসার টান আমাকে আজো এখানে নিয়ে এসেছে। অথচ এখন আমাদের উভয়ের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ। গতকাল আমাকে রাজমহলের এক সেবিকা বলেছে, প্রতি দিন দীর্ঘ সময়ের জন্যে বাড়ির বাইরে থাকার ব্যাপারটি আমার প্রতি রাজমহলের সবার মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। তাই আজ থেকে আমার পেছনে গুপ্তচর লাগিয়ে দেয়া হতে পারে। এমন হলে কিন্তু আমাদের কারোরই প্রাণ বাঁচবে না। অবশ্য নিজের জীবনের ভ্রূক্ষেপ করি না আমি। কিন্তু তোমাকে নিয়েই আমার চিন্তা। একটু সতর্ক থেকো।

কেউ যদি আমাদের দেখে ফেলে তবে আমি আর রাজমহলে ফিরে যাবো না। যদি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে, তোমার সাথেই চলে যাবো। তুমি কি আমাকে নিয়ে যেতে প্রস্তুত?

প্রতি দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রু রাজ্যের ভেতরে এসে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করি কি ঠাট্টা করতে? কি মনে করো তুমি? দৃঢ় কণ্ঠে বললো ইয়াজদানী।

এ ব্যাপারে আর বেশী চিন্তা ভাবনার সুযোগ পেলোনা ওরা। উভয়ের কানে ভেসে এলো অশ্বখুড়ের আওয়াজ।

হয়তো আমাকে অনুসন্ধানকারী লোকেরা এসে গেছে–বললো আম্বরী।

ওই যে দেখো- দূরে ধাবমান তিনজন অশ্বারোহীর দিকে ইঙ্গিত করে আম্বরীর উদ্দেশে বললো ইয়াজদানী। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল এরা এলিকখানের রাজকীয় বাহিনীর সৈন্য। তিন অশ্বারোহীকে এদিকে আসতে দেখে দ্রুত উভয়েই নিজ নিজ ঘোড়ায় সওয়ার হলো । ততোক্ষণে অনুসন্ধানী দল তাদের দেখে ফেলেছে এবং পাকড়াও করতে ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াজদানীকে দ্রুত ঘোড়া হাঁকানোর জন্যে তাড়া দিল আম্বরী। ধাবমান ঘোড়া থেকে তিনটি তীর ছুটে এসে দু’টি আম্বরীর ঘোড়াকে আঘাত করলো। ঘোড়াটি হঠাৎ হেষারব করে লাফিয়ে উঠলো।

পিছন ফিরে ইয়াজদানী দেখলো, আম্বরীর ধরা পড়া নিশ্চিত। সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে আম্বরীর ঘোড়ার পাশে নিয়ে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে আম্বরীকে বললো তার ঘোড়ার উপর চলে আসতে। দক্ষ অশ্বারোহীর মতো আম্বরী ধাবমান অবস্থায়ই লাফ দিয়ে ইয়াজদানীর সামনে তার ঘোড়ায় চড়ে বসলো এবং নিজের ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিল। ততোক্ষণে পিছু ধাওয়াকারীদের দূরত্ব কমে গেছে।

ইয়াজদানী একহাতে আম্বরীকে ধরে অপর হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে ঘোড়াকে এমন তীব্র গতিতে একে বেঁকে চালাতে লাগলো যে, পিছু ধাওয়াকারীদের সাথে তার দূরত্ব মুহূর্তের মধ্যে অনেকটা বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর একটি পাহাড়ের টিলা এসে গেল। ইয়াজদানী দ্রুত তার ঘোড়াটিকে পাহাড়ের ওপারে নিয়ে গেল। সেই সাথে সীমান্ত পেরিয় এলো ইয়াজদানী ।

ইয়াজদানী আম্বরীকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে নিজের ভূখণ্ডে চলে আসার পর আর পিছু ধাওয়া করলো না খান সেনারা। তারা নিজ গন্তব্যে ফিরে গেল। ভাগ্যক্রমে গযনী সুলতানের এক শুভাকাঙ্খী গযনী বাহিনীর এক কমান্ডারের জীবন সঙ্গীনী হয়ে ইসলামের সেবা করার সুযোগ পেয়ে গেল। যা ছিল তার আশৈশব লালিত স্বপ্ন।

* * *

উমর ইয়াজদানী আর আম্বরীর বিয়ের ব্যাপারটি ছিল বছর খানিক পূর্বের ঘটনা। এই ঘটনার এক বছর পর সুলতান মাহমূদ পুনর্বার হিন্দুস্তান অভিযানে বের হলেন। এবার তার ইচ্ছা হিন্দুস্তানের কুচক্রী হিন্দু রাজাদের কোমর ভেঙে দিয়ে হিন্দুস্তানে পরিপূর্ণ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য তিনি সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক থেকে অফিসার পর্যন্ত সবাইকে অনুমতি দিয়েছিলেন তারা ইচ্ছা করলে এই অভিযানে তাদের স্ত্রী সন্তানদের সাথে নিয়ে যেতে পারে। তিনি হিন্দুস্তানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে সেখানে স্থায়ীভাবে কিছু সৈন্য রাখার জন্যে এই অনুমতি দিয়েছিলেন। এবার তার প্রধান টার্গেট ছিল লাহোর। অবশ্য অন্যান্য হিন্দু রাজাদেরও শক্তি নিঃশেষ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু লাহোরের ক্ষমতাসীন নতুন রাজা তরলোচনপাল বেশী বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। খবর এসেছে, রাজা তরলোচনপাল তার সেনাবাহিনী কনৌজ ও মথুরার মধ্যবর্তী কোন অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে গেছে এবং সে অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে সে অন্য হিন্দু রাজাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার শক্তি সঞ্চয় করছে।

সুলতানের অনুমতি পেয়ে অনেক সৈনিক, কমান্ডার ও সেনাপতি তাদের স্ত্রী সন্তানদের সাথে নিয়ে রওয়ানা হলো। তখন ইয়াজদানী ছিল কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে। সীমান্তের চৌকি থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল । উমর ইয়াজদানীকে হিন্দুস্তান রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে শুনে তার স্ত্রী আম্বরীও সাথে যাওয়ার জন্যে বায়না ধরলো। ইয়াজদানী কিছুতেই আম্বরীকে সাথে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল না। কিন্তু আম্বরীর সবিনয় অনুরোধ ও উপযুপরী তাগাদা আর জেদের কাছে হার মেনে আম্বরীকে সাথে নিতে রাজি হলো ইয়াজদানী

আম্বরীর এই সফরে যাওয়ার বায়না ধরার মধ্যে যতোটা না স্বামীর সঙ্গ লাভের আকাঙ্ক্ষা ছিল তার চেয়ে বেশী ছিল জিহাদে অংশ গ্রহণের আবেগ। আম্বরী প্রায়ই ইয়াজদানীকে বলতো আল্লাহর প্রতি আমার খুব অভিমান হয়, আমাকে কেন নারী করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছে? নয়তো আমি তোমাদের মতো তরবারী হাতে নিয়ে বেঈমান দুশমনদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে ধন্য হতে পারতাম। নারী হয়েও আমার আত্মা সব সময় জিহাদের ময়দানে ঘুরে বেড়ায়।

ওই কাফেরদেকেই তুমি শুধু দুশমন মনে করছো? এদের চেয়ে আরো ভয়ংকর দুশমন নিজ ধর্মের লেবাসধারীরা। কারণ কাফেরদেরকে সবাই চিনে। জানে যে এরা দুশমন। কিন্তু মুসলমান বেঈমানদের অনেকেই চিনে না। এরা মুসলিম পরিচয়ে দৃশ্যত সুহৃদ হয়ে পাশে থাকে, কিন্তু সুযোগ মতো পিঠে খঞ্জর বসিয়ে দিয়ে বলে আমি আঘাত করিনি। আমি তো তোমার ভাই! এ ব্যাপারটি তুমি ভালোই জানো। কারণ, খান্দানী ভাবেই তুমি ঈমান বিক্রেতা গোষ্ঠীর মেয়ে। কিন্তু আমি ভেবে অবাক হই, এমন খান্দানের হয়েও তুমি বেঈমানদের বিরুদ্ধে এতোটা ক্ষোভ কিভাবে পোষণ করো? বললো ইয়াজদানী।

শোন! আমার মা ছিলেন খাঁটি ঈমানদার গোষ্ঠীর মেয়ে। আমার বাবা ছিলেন খান রাজবংশের ছেলে। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমার মাকে জোর করে বিয়ে করেছিলেন। আমার মা জীবনেও খানদের কর্মকাণ্ড সমর্থন করতে পারেননি। আমার জন্মের পর আমি যখন কিছুটা বুঝতে শিখেছি, তখনই আমার মা আমাকে বলতেন, মুসলমানদের লেবাসধারী এই এলিকখান গোষ্ঠী ইসলামের ভয়ংকর শত্রু। শৈশব থেকে মা আমাকে সুলতান মাহমুদের নানা গল্প শোনাতেন। সেই শৈশব থেকেই আমি সুলতান মাহমূদকে আমার আদর্শ বলে মনে করি এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করি।

আমি ছিলাম আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার মা প্রায়ই বলতেন, আল্লাহ যদি আমাকে একটি পুত্র দেন তবে তার হাতে আমি এসব ইসলাম দুশমনদের খতম করাবো। দুর্ভাগ্য যে, আমার কোন ভাই হয়নি। মায়ের সেই ইচ্ছা আমি পূরণ করতে না পারলে আমার বেঁচে থেকে কি লাভ? আমি স্ত্রী হিসেবে তোমার সঙ্গী হতে চাচ্ছি না। একজন নারী সৈনিক হিসেবে তোমার সাথে যেতে চাই। তুমি আমাকে নিতে না চাইলে আমি ঘোড়া চালাতে জানি, তীর নিক্ষেপে দক্ষ একথা তুমি জানো। তোমার নেয়ার অপেক্ষা না করে আমি নিজেই সেনাদের পিছু পিছু চলে যাবো। আমাকে একটা কিছু করতেই হবে ইয়াজদানী! আমাকে সেটা করতে দাও। নারী পুরুষের শক্তি। সে শক্তি নষ্ট করে ঘরে আবদ্ধ না রেখে একে সক্রিয় রাখো। হয়তো বা সময়ে কাজে লাগতে পারে।

অবশেষে আম্বরীও হিন্দুস্তানী কাফেলার সঙ্গী হলো। কাফেলার বিস্তৃতি ছিল দুই মাইলের চেয়ে দীর্ঘ। রসদপ্রত্রবাহী ঘোড়ার গাড়ীর দীর্ঘ সারির আগে সৈন্যরা, আর এর পিছনে পালকীতে মহিলারা।

দুর্ভাগ্য বশতঃ একই কাফেলার সহযাত্রী ছিল প্রাণঘাতি কতিপয় শত্রু। এই অজ্ঞাত পরিচয় শত্রু ছিল গযনী বাহিনীর কতিপয় সেলজুকী সদস্য। এরা দীর্ঘ দিন ধরে গযনী বাহিনীতে কর্মরত। কখনো তাদের কোন কাজে সন্দেহ করার মতো কিছু ঘটেনি। তাদের বিশ্বস্ততা ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু এবারের সফরের কিছু দিন আগে এদের বিশ্বস্ততায় চির ধরে। ভেতরে ভেতরে এরা সাংঘাতিক বেঈমান হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ব্যাপারটি ধরা পড়ার মতো কোন কর্মকান্ড কারো চোখে পড়েনি।

প্রায় বছর খানিক আগে রজব ভাই নামের এক সেলজুকী কমাণ্ডার একজন সেলজুকী মেয়েকে বিয়ে করে। তার মতো আরেক সৈনিকও একই সময় আরেক সেলজুকী মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। এই দুজনের বিয়ের পর ধীরে ধীরে সেলজুকী সৈন্যরা একটি জায়গায় বসবাসের স্থান করে নেয়।

কেউ জানতো না, এই দুই সেলজুকী সৈনিকের কাছে স্ত্রী পরিচয়ে দুই তরুণীকে পুরস্কার স্বরূপ পাঠানো হয়েছে। এরা পছন্দ করে তাদেরকে বিয়ে করে নিয়ে আসেনি।

একবার কমান্ডার রজব ভাই ও তার এক স্বগোত্রীয় সঙ্গী এক সাথে তাদের পরিবার পরিজনের সাথে ছুটি কাটাতে বুখারার পাহাড়ী এলাকায় গেল। ছুটিতে যাওয়ার পর সেলজুকী গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকেরা এবং একজন দরবেশ লেবাসধারী ব্যক্তি তাদের সাথে সাক্ষাত করতে এলো। সাক্ষাতে নানা কথাবার্তার পর দরবেশ কমান্ডার রজব ভাই ও তার সঙ্গীর সামনে গোত্রপ্রেমের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সেলজুকীদের বিরুদ্ধে গযনী বাহিনীর লড়াই ও সেলজুকীদের নির্মমভাবে হত্যা করার বিষয়টি এমন জ্বালাময়ী ও হৃদয়বিদারক ভাষায় বর্ণনা করলো যে, স্বগোত্রীয় ভাইদের করুন মৃত্যুতে তাদের চোখে পানি এসে গেল এবং হত্যাকারী গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের রক্ত টগবগিয়ে উঠলো। কমান্ডার রজব ক্ষোভে দুঃখে বললো, সে আর গযনী বাহিনীতে ফিরে যাবে না।

না, না। তোমার এমনটি করা উচিত হবে না। এটা হবে কাপুরুষতা বললো দরবেশ ব্যক্তি। তোমাকে সেলজুকী ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যেই তোমার গযনী বাহিনীতে থাকা উচিত।

এবার গিয়ে মাহমূদকে আমরা খুন করে ফেলবো- উত্তেজিত কণ্ঠে বললো কমান্ডার রজব ভাই।

তাতে তেমন কোন লাভ হবে না– বললো একজন নেতৃস্থানীয় লোক। তোমাদের কি করতে হবে সেটি আমরা তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি। তোমাদের গযনী বাহিনীতে যতো সেলজুকী আছে, অতি গোপনে সবাইকে তোমাদের দলে ভেড়াবে। তারা যখন নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠবে ও তোমাদের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে উঠবে তখন তোমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদেরকে জানাবে।

তোমরা প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। যুদ্ধের ব্যাপারে তোমরাই অভিজ্ঞ। হিন্দুস্তানের যুদ্ধের ময়দানে সুলতান মাহমুদকে ধোকা দিতে হবে, তার সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে হবে। সুলতান মাহমদু থাকলো কি মরলো তাতে কিছু যায় আসে না।

মাহমূদ আগামী কিছু দিনের মধ্যেই হিন্দুস্তানে অভিযান চালাবে। সেই অভিযানে নিশ্চয়ই তোমরা থাকবে। তোমরা তখন হিন্দু বাহিনীর সাথে মিলে গযনী বাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণ করে নিঃশেষ করে দিতে পার।

কিন্তু হিন্দুস্তানে গিয়ে আমরা হিন্দুদের সাথে কি ভাবে যোগাযোগ করবো? আমরা তো কেউ হিন্দুস্তানের ভাষা জানি না! উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো রজব ভাই।

সেই ব্যবস্থা তোমাদের নাগালের মধ্যেই আছে– বললো দরবেশরূপী ব্যক্তি। গয়নীতেও এই কাজের বহু লোক রয়েছে। এরা হলো সেই সব হিন্দু, যাদেরকে প্রতিটি যুদ্ধের পর গযনী বাহিনী পাকড়াও করে গযনী নিয়ে এসেছে। এদের বাছাই করে মাহমূদ দুটি সেনা ইউনিট গঠন করেছে। তাছাড়া বিপুল সংখ্যক হিন্দু সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কাজ করছে। গ্রেফতারকৃত হিন্দুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে গযনীর বিত্তশালীরা দাস হিসাবে কিনে নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছে।

আমরা তোমাদেরকে এমন কয়েকজন হিন্দুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো, যারা তোমাদের ব্যক্তিগত কর্মচারী কিংবা কোচওয়ান হিসেবে সেনাবাহিনীর সাথেই থাকবে। এরা মুসলিম পরিচয় ধারণ করবে। কিন্তু বাস্তবে তারা নিষ্ঠাবান হিন্দু। এরাই হিন্দুস্তানে সব প্রয়োজনে তোমাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে। এরা হিন্দু সেনাদের সাথে তোমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেবে ।

আমরা তাদেরকে এই পরিমাণ ধন-সম্পদ দেবো, যা তারা জীবনে পাবে তো দূরের কথা কল্পনাও করতে পারে না। তাদের সবচেয়ে বেশী প্রাপ্তি হব, তারা গোলামীর জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের জন্ম ভূমিতে ফিরে যেতে পারবে। যুদ্ধের ময়দানে তোমরা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে যে, গোটা গযনী বাহিনী হিন্দুদের সহজ আক্রমণের শিকার হয়ে যায়।

তোমরা মাহমূদের যুদ্ধ কৌশল জানো– বললো আরেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। মাহমূদের আক্রমণ কৌশল অনেক জায়গা নিয়ে হয়ে থাকে। সম্মুখভাগে সে খুবই সামান্য সৈন্য রাখে। অধিকাংশ সৈন্যকে ডানে বামে ছড়িয়ে দিয়ে শত্রুপক্ষকে ডানে বামে এবং পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে। মাহমূদ শত্রুপক্ষকে এগিয়ে আসতে বাধ্য করে। তার গেরিলা যোদ্ধারা রাতের বেলায়ও ৪ শত্রুপক্ষকে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না।

এবার মাহমূদের যুদ্ধ কৌশলের প্রতি তোমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। তার পরিকল্পনার কথা আগেই হিন্দুদের জানিয়ে দেবে। মাহমূদ যদি কোথাও ফাঁদ তৈরী করে তবে তা যথা সময়ে তোমরা হিন্দু বাহিনীকে জানিয়ে দেবে। তোমরা তো আগেই জানতে পারবে, এবার যে সেনাপতি তার সাথে যাচ্ছে, সে কতটুকু ঝানু ও অভিজ্ঞ।

তোমরা হয়তো জানো, আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈ সুলতান মাহমূদের ডান হাত। ইতিহাসে আলতাঈর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভবিষ্যতে মানুষ যখন মাহমূদের নাম উচ্চারণ করবে পাশাপাশি সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈর নামও স্মরণ করবে। যুদ্ধের ময়দানে যদি সুযোগ পাও, তাহলে আলতাঈকে খুন করে ফেলবে। হত্যার ক্ষেত্রে দূর থেকে তীর ব্যবহার করবে, তবে কিছুতেই যাতে ধরা না পড়ো। ধরা পড়লে কিন্তু আমাদের সব পরিকল্পনা ধুলিস্যাঁত হয়ে যাবে।

এজন্যই আমরা সুলতান মাহমূদের হত্যার ব্যাপারে কোন কথা বলি না –বললো দরবেশরূপী ব্যক্তি। কারণ, তাকে আমরা গযনী থেকে হাজারো মাইল দূরে হিন্দুস্তানের ভেতরে হিন্দুদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে চাই। আমরা চাই, গযনী বাহিনীর শক্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাক এবং বেঁচে থাকা গযনীর সকল সৈন্য হিন্দুদের হাতে বন্দি হোক আর চরম পরাজয়ের গ্লানী নিয়ে মাহমূদ হিন্দুদের হাতে গ্রেফতার হয়ে লাঞ্চনার শিকার হোক। তোমরা কি জানো, এমনটি ঘটাতে পারলে এরপর গযনীর রাজত্বের অধিকারী হবে। সেলজুকীরা? তোমরা কি অনুভব করতে পারো না, সেলজুকী একটি বিরাট শক্তি? দেখবে, বুখারা থেকে হিন্দুস্তান পর্যন্ত গোটা অঞ্চল সেলজুকী রাজত্বের আওতায় চলে আসবে। গভীর আবেগ ও উচ্ছ্বাসে বললো দরবেশ।

সেলজুকী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তোমরাই হবে সেনাপতি ও ডেপুটি সেনাপতি– বললো আরেকজন। আমরা এমন দু’জন মেয়েকে তোমাদের স্ত্রী হিসেবে দিচ্ছি, এ ধরনের মেয়ে সাধারণত রাজা বাদশাদের ঘরে শোভা পায়। তা ছাড়া তোমাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে বিপুল ধন-সম্পদ।

প্রথমত কমান্ডার রজব ভাই ও তার সঙ্গীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ উস্কে দেয়া হলো। এরপর গয়নী সেনাদের হাতে সেলজুকীদের নিহত হওয়ার ঘটনাটিকে চরম নৃশংস কাহিনী বানিয়ে তাদেরকে গমনী বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হলো। সেই সাথে তাদের সামনে হাজির করা হলো দু’জন অপরূপ সুন্দরী যুবতী।

উপজাতি সেলজুকী বংশের কোন যুবকের পক্ষে এমন শিক্ষিত ও অভিজাত মেয়েকে বিয়ে করার বিষয়টি কল্পনা করার সাধ্যও ছিলো না। সুন্দরী দুই যুবতাঁকে দেখে রজব ও তার সঙ্গীর চোখ ছানাবরা। তাদের সামনে এমন অর্থসম্পদ রাখা হলো যে এতো বিপুল সোনা দানা একত্রিত করার কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। সেই সাথে বিশাল সালতানাতে সেলজুকীদের সেনাপতি ও ডেপুটি সেনাপতি হওয়ার বিষয়টি কমাণ্ডার হিসেবে তাদের কাছে এতোটাই লোভনীয় ছিল যে, বিষয়টি তারা কেবল স্বপ্নে ভাবতে পারতো, কিন্তু কোন দিন বাস্তবে রূপলাভ করার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু সেলজুকী সালতানাত হলে এমন অধরা স্বপ্নই তাদের হাতের মুঠোয় ধরা দেবে এই ভাবনায় তারা উৎসাহী হয়ে উঠলো।

এর পরের ঘটনা খুবই দ্রুত ঘটতে শুরু করলো। ছুটি সংক্ষিপ্ত করে সুন্দরী স্ত্রী সাথে নিয়ে কমান্ডার রজব ভাই ও তার সঙ্গী কমান্ডার ফরীদ সেলজুকী গযনী সেনাবাহিনীতে ফিরে এলো। অল্পদিনের মধ্যেই তারা কর্মরত সেলজুকীদেরকে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে সুকৌশলে ক্ষেপিয়ে তুলতে সক্ষম হলো। আসলে সেলজুকীদেরকে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার পেছনে কমান্ডার রজব ও ফরীদের চেয়ে তাদের স্ত্রী পরিচয়দানকারী ইহুদীদের হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুই সুন্দরীর ভূমিকাই ছিলো বেশী।

রজব ও ফরীদের স্ত্রী বাছাই করে করে একেক জন সেলজুকী সৈনিককে তাদের খালি ঘরে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসতো এবং তাদের রূপ সৌন্দর্যের ঝলক দেখিয়ে, নগদ সোনা দানা, ক্ষমতা ও জায়গা জমির লোভ দেখিয়ে সহজেই তাদের ফাঁদে আটকাতে সক্ষম হতো। দুই সুন্দরী সেলজুকী সৈন্যদের ডেকে সেলজুকীদের উপর, গযনী বাহিনীর জুলুম, অত্যাচার, গযনী বাহিনীর হাতে সেলজুকীদের নিহত হওয়ার ব্যাপারটি আবেগ, মমতা ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে উপস্থাপন করে প্রতিটি সেলজুকী সৈনিকের মনে জাতীয়তাবোধ উস্কে দিতে সক্ষম হয়। ফলে সেলজুক সৈনিকদের ইসলামী চেতনা বিলীন হয়ে সেখানে জন্ম নেয় প্রতিশোধ প্রতিহিংসা স্বজাতি হত্যা, বঞ্চনার প্রতিশোধ স্পৃহা আর স্বাধীন সেলজুকী সালতানাত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রতিটি সেলজুকীর রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়।

শিক্ষণীয় ব্যাপার হলো, কোন নারী যদি কোন পুরুষের মধ্যকার পৌরুষ ও হিংস্রাতাকে উস্কে দিতে চায় তা সহজেই পারে। কেননা, একজন পুরুষের পৌরুষ, সাহস ও শক্তিকে যখন কোন নারী প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় তখন পুরুষ মাত্রই সেটিকে অপমানজনক মনে করে এবং প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে। সেলজুকীদের ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটলো। খুব সহজেই ইহুদীদের ক্রীড়নক দুই সুন্দরী তরুণী তাদের রূপ সৌন্দর্য ও বাক চাতুর্যের ফাঁদে ফেলে সেলজুকীদের গযনী বাহিনীর জন্যে আত্মঘাতি যোদ্ধায় পরিণত করলো ।

১০২০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্ম মৌসুমে সুলতান মাহমূদ যখন পুনর্বার হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা হলেন, তার সেনাবাহিনী পরিচয়েই তার কাফেলার অংশ হয়ে গেলো গযনী বাহিনীর চরম শত্রু সেলজুকী কুচক্রী। এদের সহযোগী হিসেবে আত্মপরিচয় গোপনকারী কয়েকজন হিন্দুও রওয়ানা হলো কোচওয়ান ও কমান্ডারদের একান্ত সেবকের বেশ ধারণ করে।

এসব হিন্দু ছিল গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী গোড়া হিন্দু পরিবারের লোক। এদেরকে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দেয়া হলো, কখন তাদেরকে কি ভূমিকা পালন করতে হবে।

গযনীর সৈন্যরা যখন হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করল, তখন এই হিন্দুদের অবস্থা হলো অনেকটা পানি থেকে তুলে নেয়া মাছকে পানীতে পুনর্বার ছেড়ে দেয়ার মতো। হিন্দুস্তানের মাটি মানুষের গন্ধে এরা যেন প্রাণ ফিরে পেলো। তাদের দেমাগ তখন আরো বেশী সক্রিয় ও সতর্ক হয়ে গেলো এবং নিজেদেরকে তারা হিন্দুত্ববাদ রক্ষার অতন্ত্র প্রহরী ভাবতে শুরু করলো। যে কোন মূল্যে সেলজুকীদের দিয়ে সুলতান মাহমুদকে ধ্বংস করার বিষয়ে তারা হয়ে উঠলো ঘরের শত্রুবিভীষণ।

* * *

এদিকে হিন্দুস্তানের অবস্থা খুব দ্রুত গযনী সরকারের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছিল। রাড়ীতে মহারাজা রাজ্যপাল এক বিভ্রান্ত তরুণীর হাতে নির্মমভাবে খুন হয়। এই খুনের নেপথ্য শক্তি ছিল তিন হিন্দু রাজার চক্রান্ত। রাজ্যপালের ছেলে লক্ষণপাল ছিল অন্যান্য হিন্দু রাজাদের সহযোগী। কিন্তু রাড়ীর হিন্দু সৈন্যরা ছিল গযনী সরকারের নিয়োগকৃত কমান্ডারদের আজ্ঞাবহ। তাদের পূর্বানুমতি ছাড়া রাড়ীতে রাজ্যপালের এবং তার সেনাদের কোন কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। সর্বক্ষেত্রেই রাজ্যপালের প্রশাসনকে গয়নীর কমান্ডারদের কাছে জবাবদেহি করতে হতো। ফলে লক্ষণপালের পক্ষে হাত পা নাড়ানো ছাড়া কার্যত কোন কিছু ঘটানোর সুযোগ ছিল না।

কিন্তু সবসময় মুসলিম আধিপত্য খর্ব করে নিজেদের হারানো গৌরব ও জৌলুস ফিরে পাওয়ার চিন্তায় বিভোর থাকতো লক্ষণপাল।

চক্রান্তমূলকভাবে মহারাজা রাজ্যপাল নিহিত হওয়ার পর চক্রান্ত উন্মোচন করতে রাড়ীতে নিয়োজিত গমনী বাহিনীর লোকেরা চক্রান্তে জড়িত সন্দেহভাজনদের ধরপাকড় শুরু করলে এই ধরপাকড় বিদ্রোহে রূপ নিলো। কিন্তু ব্যাপক আকারের বিদ্রোহ দমনের মতো জনবল গযনী বাহিনীর হাতে ছিল না। কারণ, রাড়ীকে গযনীর নিয়ন্ত্রনণে রাখার জন্যে মাত্র কয়েকজন সেনা কমান্ডার এবং কর্মকর্তা ছিল।

রাজ্যপাল নিহতের পর ধরপাকড় শুরু হলে লক্ষণপাল তার পক্ষের সেনাদের অতি গোপনে প্রস্তুত করে ফেলে এবং রাতের বেলায় তার নিয়ন্ত্রিত সেনাদের দিয়ে গযনীর কর্মকর্তা ও সেনা কমান্ডারদের গ্রেফতার করে রাড়ীকে স্বাধীন ঘোষণা করে লক্ষণপাল নিজেকে স্বাধীন রাজা ঘোষণা করে। রাড়ীতে নিয়োজিত গযনীর সকল কমান্ডার কর্মকর্তা লক্ষণপালের সেনাদের হাতে গ্রেফতার হলেও কোনভাবে একজন সেনা কমান্ডার পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সে দ্রুত কনৌজের দিকে পালাতে থাকে। কিন্তু কনৌজের পথে পূর্ব থেকেই হিন্দু সৈন্যরা অবস্থান নিয়েছিল। ফলে এই কমান্ডারও ধরা পড়ে। কনৌজ ও রাড়ীর মধ্যখানে যে সৈন্যরা অবস্থান নিয়েছিলো এরা ছিল তিন রাজ্যের সম্মিলিত সৈন্য।

কালাঞ্জরের রাজা গোবিন্দ, গোয়ালিয়রের রাজা অৰ্জুন, লাহোরের রাজা তরলোচনপালের সৈন্যরা ছাড়াও কনৌজের পরাজিত সৈন্যরাও তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল। তা ছাড়া রাড়ীর কিছু সৈন্যও এদের সঙ্গে ছিল। মূলত একটি সম্মিলিত বাহিনী ও গণফৌজ তৈরী হয়েছিল গযনীর বিরুদ্ধে। তিন ক্ষমতাধর হিন্দু রাজার সৈন্যরা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক যোদ্ধা ছিল স্বেচ্ছা সেবক হিসাবে। এরা হিন্দুত্ববাদ রক্ষা ও ক্রমবর্ধমান গযনী সালতানাতের শক্তিকে নিঃশেষ করে দিতে স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। কোন ঐতিহাসিক এদের প্রকৃত সংখ্যা উল্লেখ করতে পারেননি। শুধু এতটুকু বলেছেন, স্বেচ্ছাসেবীদের সংখ্যা ছিল সম্মিলিত তিন বাহিনীর সংখ্যার চেয়েও বেশি।

যে জাতির দেবালয় গুঁড়িয়ে দিয়ে দেবদেবীদের মূর্তিগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে রাস্তায় মিশিয়ে দিয়েছে গযনী বাহিনী, যে জাতির সবচেয়ে পবিত্র স্থান মথুরার হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মন্দির ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে মুসলমান সৈন্যরা, সেই জাতি স্বভাবতই মুসলমানদের ব্যাপারে নির্বিকার থাকার কথা নয়। নির্বিকার ছিল না তারা। মুসলমানদের হাতে পরাজিত হিঃ রাজা মহারাজা এবং এলাকার ছোট বড় প্রতিটি হিন্দু ভেতরে ভেতরে মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্যে তৈরী হচ্ছিল।

হিন্দু নারীরা তাদের সখের অলংকারাদি পুরোহিতদের হাতে সপে দিয়েছিল, যুদ্ধ তহবিলের ঘাটতি কমাতে। হিন্দু পুরোহিত ঠাকুরেরা সমাজে প্রচার চালাচ্ছিল মুসলমানদের পরাজিত করতে জীবন-সম্পদ উৎস না করলে হিন্দু জাতি দেবদেবীদের অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যাবে।

পুরোহিত ঠাকুররা যা বলে তা আসলে কতটুকু বাস্তব? সাধারণ হিন্দুরা এ ব্যাপারে কখনো প্রশ্ন তুনে । হিন্দুরা এ ব্যাপারটিও যাচাই করে দেখার প্রয়োজনবোধ করেনি সুলতান মাহমূদ হিন্দুস্তান আক্রমণের প্রথম দিনেই একদল হিন্দুর সামনে কয়েকটি মূর্তিকে টুকরো টুকরো করে বলেছিলেন– এই দেখো তোমাদের দেবতার অবস্থা! সত্যিই যদি এদের কোন শক্তি থাকে তাহলে এদের বলো, আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে। আমরা যে এদের অপমান করছি এজন্য আমাদের শাস্তি দিতে।

* * *

১০০১ সালে, প্রায় বিশ বছর আগে সুলতান মাহমুদ প্রথম হিন্দুস্তানে মূর্তি ভেঙেছিলেন। এরপর তিনি একে একে মথুরা থানেশ্বর মহাবন কন্নৌজের হাজার বছরের প্রাচীন মন্দিরগুলো ধ্বংস করে এগুলোর টুকরো রাস্তায় ফেলে উপর দিয়ে সেনাবাহিনীর ঘোড় চালিয়ে দেন। হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল এই মূর্তিরূপী দেবদেবীরাই ভারতের সুখ সমৃদ্ধির নিয়ামক।

এসব দেবদেবীদের মূর্তি না থাকলে কোন হিন্দুর অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু বিগত বিশ বছর ধরে একের পর এক মন্দির ও মূর্তি ধ্বংস করে, হরেকৃষ্ণ হরিদেব এবং দশহাত বিশিষ্ট সরস্বতীর ধ্বংসযজ্ঞের পরও এ পর্যন্ত কোন মুসলমানের কিছুই হলো না। দেবদেবীরা কোনই প্রতিকার কিংবা মুসলমানদের উপর প্রতিশোধ নিতে পারলো না। এর পরও কুসংস্কার ও কল্পনাবিলাসী হিন্দু জাতিকে চরম ধোকাবাজ ঠাকুর ও পুরোহিতেরা অন্ধত্বের এমন গ্যাড়াকলে বেঁধে রাখলো যে, হিন্দুরা একটু জোরে বাতাস প্রবাহিত হলেও হাত জোড় করে ভজনা করতে শুরু করে। আর ভাবতে থাকে, এটাই বুঝি দেবদেবীদের ক্রোধ। এরা এমনই অন্ধ ছিল যে, এসব মূর্তির পূজা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে ঘরের সকল ধন-সম্পদ অকাতরে ঠাকুরদের হাতে তোলে দিয়েই ক্ষান্ত হতো না, নিজেদের কুমারী মেয়েদেরকে নরবলি দেয়ার জন্যে পুরোহিদের হাতে তোলে দিতো। আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে গযনীর মুসলমানদের প্রতি তৎকালীন ভারতের হিন্দুদের যে ক্ষোভ, হিংসা ও শত্রুতার মনোভাব ছিলো হিন্দুদের প্রতি মুসলমানদের তেমন হিংসাত্মক মনোভাব ছিলো না।

সুলতান মাহমুদের এবারের ভারত অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়লে সুলতান মাহমূদকে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্যে হিন্দুস্তানের সকল রাজা, মহারাজা এবং বিজিত এলাকার সকল হিন্দু প্রজা এক কাতারে শামিল হয়ে মুসলমানদের পরাজিত করতে ধন-জন এবং জীবন উৎসর্গ করার ঘোষণা দিলো। যে সব পুরুষ অশ্বচালনা, তীরন্দাজী, তরবারী চালনা ও বল্লম চালাতে জানতো তারা সবাই সেনাবাহিনীতে যোগ দিলো। অবস্থা এমন হলো যে, যুবতী মেয়েরা পর্যন্ত মুসলমানদের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে তৈরী হয়ে গেলো। মন্দিরের ঘণ্টা অনবরত বাজতে থাকলো এবং মন্দিরের শিংগা ভয়ংকর শব্দে চিৎকার করতে লাগলো।

দৃশ্যত গযনীর সৈন্যদের ব্যাপারে সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু রাজপুতদের মধ্যে ততটা আতংক ছিলো না।

রাজপুতেরা হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দুদের ঐতিহ্য রক্ষার্থে এবং গযনী বাহিনীকে ঠেকাতে জীবন বিলিয়ে দেয়াটাকে অতি স্বাভাবিক ব্যাপার মনে করতো। রাজপুতনা হিন্দুদের মধ্যে তখন বিরাজ করছিলো জীবন দেয়ার উন্মাদনা। এই যুদ্ধ উন্মাদ স্বেচ্ছাসেবীরা গযনী বাহিনীর সামনে পাহাড়ের মতো প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালো।

তিন মহারাজার সম্মিলিত বাহিনীতে ছিল এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার পদাতিক সেনা, ছত্রিশ হাজার অশ্বারোহী এবং ছয়শ বিয়াল্লিশটি জঙ্গি হাতি।

পেশোয়র অতিক্রম করার পর থেকেই সুলতান মাহমুদের কাছে নিয়মিত খবর আসছিল হিন্দুদের যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে। গোয়েন্দারা জানিয়ে দিয়েছিল গযনী বাহিনীর তুলনায় শত্রু বাহিনীর সংখ্যা তিনগুণেরও বেশী। আরো খবর আসছিল হিন্দু সেনারা কোথায় কোথায় অবস্থান নিয়েছে।

সুলতান মাহমূদ তার সেনাদল নিয়ে চন্নাব নদী পার হচ্ছিলেন। ঠিক এই সময় খবর এলো, রাড়ীতে লক্ষণপালের সেনারা মুসলমান কর্মকর্তা ও কমাণ্ডারদের বন্দি করে রেখেছে। কনৌজ দুর্গও অবরুদ্ধ হওয়ার আশংকা আছে।

ঠিক এর পর পরই খবর এলো, কনৌজ অবরোধের সম্ভাবনা নেই। কারণ, মহারাজা অৰ্জুনও মহারাজা গোবিন্দ বিপুল জনশক্তির বলে খোলা ময়দানেই গযনী বাহিনীর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। এক গোয়েন্দাকে সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, লাহোরের সৈন্যরা কোথায় আছে?

যমুনার তীরবর্তী কোন ঘন জঙ্গলে–জবাব দিল গোয়েন্দা। লাহোরের সৈন্যরা ঠিক কোথায় তাঁবু ফেলেছে তা জানা সম্ভব হয়নি সুলতান! তবে জানার চেষ্টা অব্যাহত আছে। লাহোরের সেনাদের বিষয়টিই বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এরা কোন দিক থেকে কিভাবে হামলা করবে এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

ঠিকই বলেছো তুমি–গোয়েন্দাকে বললেন সুলতান। এদের বিষয়টি আমাকে খুব ভাবনায় ফেলেছে। আমি এদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাই।

তৎকালীন কয়েকটি ইতিহাসগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে ইংরেজ ঐতিহাসিক স্মিত লিখেছেন– রাড়ীতে গযনীর কর্মকর্তারা বন্দি হয়েছে– এ খবর পাওয়ার পর পাঁচটি নদী পাড়ি দিয়ে দুই দিনের মধ্যে সুলতান মাহমূদ রাড়ী এলাকায় পৌঁছে গেলেন এবং কোন বিশ্রাম না নিয়েই রাড়ী আক্রমণ করলেন। আক্রমণের সাথে সাথে সুলতানের কাছে খবর এলো, মুসলিম সৈন্য ও কর্মকর্তাদেরকে হিন্দুরা হত্যা করেছে। একথা শুনে সুলতান রাড়ীকে সম্পূর্ণ মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। তাই ঘটলো। রাড়ীতে যে হিন্দুবাহিনী ছিলো এদের পক্ষে প্রাথমিক আক্রমণ সামলানোও সম্ভব হলো না। রাড়ীকে এভাবে ধ্বংস করে দেয়া হলো যে, সেখানে সকল বাড়ি ঘর ভেঙে ফেলা হলো। মন্দিরগুলোকে সম্পূর্ণ ভেঙে চুড়ে ধ্বংসাবশেষও নদীতে নিক্ষেপ করা হলো।

আসল যুদ্ধ তখনো শুরু হয়নি। সুলতানের কাছে অনবরত রাজা গোবিন্দ ও রাজা অর্জুনের সেনাদের খবরাখবর আসছিল। সুলতান মাহমুদ ভাবছিলেন কিভাবে এদের মোকাবেলা করবেন। এক সাথে উভয় বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বেন,

দুই বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করবেন।

সুলতান যখন এমন চিন্তায় বিভোর তখন প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈ সুলতানের উদ্দেশ্যে বললেন– সম্মানিত সুলতান! লাহোরের সেনাদের অবস্থান জানা যায়নি। আশংকা কিন্তু এদের থেকেই বেশী। হতে পারে এরা পেছন থেকে আমাদের উপর হামলা করবে।

সুলতান মাহমূদও প্রধান সেনাপতির মধ্যে যখন এসব কথা হচ্ছিল, তখন হঠাৎ গযনী সেনাদের মধ্যে শোরগোল দেখা দিল। সুলতান মাহমূদ দ্রুত তাঁবু থেকে বেরিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীদেরকে বললেন, দ্রুত গিয়ে শোরগোলের কারণ জেনে এসো।

নিরাপত্তারক্ষীরা ঘুরে এসে যে খবর দিলো তাতে বেশ অবাক হলেন সুলতান। নিরাপত্তারক্ষীরা জানালো, চার কমান্ডার ও চার সৈনিক চামড়ার থলের মধ্যে হাওয়া ভরে এগুলোতে ভর করে নদী পারাপারের জন্যে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে এবং নদী পেরিয়ে গেছে।

সুলতান ও প্রধান সেনাপতি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এই আট সেনা হয়তো পালিয়ে গেছে এবং এরা গিয়ে শত্রু বাহিনীতে যোগ দিবে। এদেরকে পিছু ধাওয়ার ব্যাপারটি সহজ ছিলো না। তবুও কয়েকজন সাহসী যোদ্ধাকে নির্দেশ দেয়া হলো, তারাও যেনো পানির থলের মধ্যে হাওয়া ভরে নদী পেরিয়ে ওদেরকে পাকড়াও করতে চেষ্টা করে। যদি সাহায্যের দরকার হয় তবে যেনো সংকেত দেয়। যাতে আরো সহযোগী পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায়।

একে তো শীতের মওসুম, তদুপরী রাতের অন্ধকার। সেই সাথে বরফ শীতল ঠাণ্ডা পানি। রাতের অন্ধকারে ঠাণ্ডা পানিতে সাঁতার কাটা সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু সবকিছুকে উপেক্ষা করে বারো তেরোজন সৈনিক স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে পানির থলিতে হাওয়া ভরে ততোক্ষণে নদীতে নেমে পড়েছে। শীত মওসুম হওয়ার কারণে নদীতে পানি কম ছিল এবং শ্রোতের তীব্রতাও বেশী ছিল না। দশ বারোজনের কাফেলা যখন নদীতে নেমে গেলো, তখন নদীর তীরে আবারো শোরগোল শোনা গেল। সেই সাথে নদীর ওপারে দেখা গেল আগুনের কুণ্ডলী। দেখে মনে হলো কোন বসতীতে আগুন লেগেছে।

অবস্থা দেখে প্রধান সেনাপতি নদীর তীরবর্তী লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, যারা প্রথমে নদী পার হয়েছে এরা কারা? তাকে তাদের নাম পরিচয় জানানো হলো। শুনে প্রধান সেনাপতি বললেন– মুহতারাম সুলতান! যারা প্রথমে নদী পার হয়েছে এরা পালিয়ে যাওয়ার লোক নয়। এদেরকে আমি ভালোভাবেই জানি, খুবই আবেগপ্রবণ। নিশ্চয়ই এরা শত্রুপক্ষের কোন তাঁবুতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়েছে। আমাকে অনুমতি দিন, আমি দু’টি ইউনিট নিয়ে ওপাড়ে চলে যাই।

কিন্তু যাওয়ার আগে তো জানা দরকার ওখানে কারা আছে এবং কি অবস্থায় আছে? বললেন সুলতান। সেনা ইউনিট তুমি প্রস্তুত রাখতে পারো, যে কোন সময় কাজে লাগতে পারে।

এদিকে নদীর ওপাড়ের শোরগোল ক্রমশ বাড়তে থাকলো। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলটি ছিল প্রায় তিন মাইল দূরে। সেখানকার শোরগোলের আওয়াজ কিছুটা এখানেও শোনা যাচ্ছিল। কারণ, রাতের পরিবেশ ছিল অনেকটাই শান্ত।

এভাবে কিছুটা সময় কাটার পর এক অশ্বারোহীকে নদীর পানি চিড়ে এ পাড়ের দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেলো। লোকটি যখন এপাড়ে উঠে এলো তখন দেখা গেলো গযনী বাহিনীর যে চারজন নদী পেরিয়ে গিয়েছিল সে তাদেরই একজন। লোকটি ঘোড়ার পিঠের উপর বসে নদী পার হলো। লোকটি নদীর মাঝখানে থাকতেই চিৎকার করে বলছিল, সুলতান কোথায়? প্রধান সেনাপতি কোথায়? সবাই হামলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাও। আগত এই সৈনিকের চিৎকারে ছিল চরম উত্তেজনা।

তীরে দাঁড়ানো লোকেরা সেই সৈনিককে থামিয়ে দিল। সুলতান ও প্রধান সেনাপতি আগে থেকেই নদীর তীরে ছিলেন। সৈনিককে যখন সুলতানের সামনে হাজির করা হলো, তখন জানা গেল, সে গযনী বাহিনীর একজন কমান্ডার। সে সুলতানকে যা জানলো, তা কিছুতেই সুলতানের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না।

আগন্তুক কমান্ডার জানালো গযনী বাহিনীর এক গোয়েন্দা সন্ধার পর এসে তাকে খবর দেয়, নদীর ওপাড় থেকে মাইল তিনেক দূরে লাহোরের সৈন্যরা তাঁবু ফেলেছে এবং তারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। একথা শুনে সে তার সঙ্গী আরো তিন কমাণ্ডারকে সাথে নিয়ে ওপাড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তাদের এই পরিকল্পনার কথা শোনে আবেগপ্রবণ আরো কিছু সৈনিকও তাদের সহগামী হলো। সবাই মিলে পানির থলের মধ্যে বাতাস ভরে নদী পেরিয়ে শত্রুবাহিনীর তাঁবুতে চলে গেল। সংবাদবাহী গোয়েন্দাকে তারা গাইড হিসেবে সাথেই নিয়ে গেল। তারা সবাই শত্রুবাহিনীর তাঁবুতে গিয়ে ঝটিকা আক্রমণ চালালো।

আবেগ ও উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা এই কমান্ডার অতি সংক্ষেপে তাদের অভিযানের কথা জানিয়ে সুলতানকে বললো, বেশী কিছু চিন্তা করার দরকার নেই সুলতান! আপনি সৈন্যদের নিয়ে চলুন, শত্রুকে পরাজিত করার এটাই মোক্ষম সময়।

একথা শুনে আগে থেকেই দু’টি সেনা ইউনিটকে নিয়ে প্রস্তুত থাকা প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈকে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিলেন সুলতান। কমান্ডারের নির্দেশে আলতাঈর সহযাত্রী সৈন্যদের সংখ্যা বাড়ানো হলো। সহযোগী হলো আরো দু’টি অশ্বারোহী ইউনিট।

সবাইকে নিয়ে নদী পার হলেন প্রধান সেনাপতি। আগত কমান্ডার তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আলতাঈ যখন চারটি ইউনিট নিয়ে তবু পল্লীর দিকে অগ্রসর হলেন, তখন অধিকাংশ তাঁবুতে আগুন জ্বলছে। গোটা শিবির জুড়ে চলছে দৌড় ঝাঁপ আর চেঁচামেচি। আগুন দেখে আতংকিত হয়ে ঘোড়াগুলো এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে।

অবস্থা দেখে প্রধান সেনাপতি আলতাঈ তার অশ্বারোহী ইউনিটকে গোটা তাঁবু ঘিরে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। শত্রুবাহিনীর অবস্থা তখন খুবই বেসামাল। তাদের আত্মরক্ষার জন্যে পালানো ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিল না। লাহোরের সৈন্যরা যে যার মতো করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোন উট ঘোড়াই তাদের নাগালের মধ্যে ছিল না। ফলে দৌড়ে পালাতে গিয়ে লাহোরের সৈন্যরা গয়নী সেনাদের ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হতে লাগল। যারা প্রতিরোধের চেষ্টা করলো তারা কাটা পড়ল, আর যাদের সামনে পালানো ও প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থাই ছিল না, তারা কোন কিছুর আড়ালে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করতে লাগল।

লাহোরের সৈন্যরা যেহেতু পলায়নপর ছিল এজন্য দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করছিল। আর এদের ধাওয়া করছিল গযনীর সৈন্যরা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে একেকজন সৈন্যের পিছু ধাওয়া করে বেশী দূর অগ্রসর হওয়া ঠিক হবে না বলে আলতাঈ সবাইকে সতর্ক করে দিলেন। সংবাদবাহী সৈন্যদের বললেন, সবাইকে বলে দাও, তারা যেন কারো পিছু ধাওয়া না করে। তাঁবুর আশপাশে থেকে লড়াই করে। এভাবেই কেটে গেল রাত ।

সকাল বেলায় সূর্য উঠার পর দেখা গেল তাঁবু এলাকার ভয়াবহ দৃশ্য। জায়গায় জায়গায় অর্ধদগ্ধ সৈনিক, নিহতদের স্তূপ আর আহতদের কাতরানোর করুণ অবস্থা। অনেক হিন্দু সৈনিক ভয় ও আতংকে হত বিহ্বল হয়ে ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে আং মরার মতো পড়েছিল। পালানোর সাহস পাচ্ছিল না। ভোরের আলোয় এরা মুসলিম সৈন্যদের হাতে ধরা পড়লো। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সেনাপতি আলতাঈ নিশ্চিত জানতে পারলেন, এরাই হলো সেই লাহোরের সেনাবাহিনী। রাতের বেলায় মহারাজা তরলোচনপালও এদের সাথেই ছিল। কিন্তু মুসলমানদের আক্রমণ টের পেয়ে সেনাপতি ও তরলোচনপাল পালিয়ে যায়।

আগের দিন বিকেলেই লাহোরের এই সেনারা এখানে এসেছিল। এদের নিয়েই বেশী চিন্তিত ছিলেন সুলতান। অবশ্য ধৃত কোন হিন্দু সৈনিক তাদের এখানে নিয়ে আসার কোন কারণ বলতে পারেনি। তবে সৈনিকরা কিছু বলতে না পারলেও গযনী বাহিনীর এতো কাছাকাছি অবস্থান নেয়া থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছিল, সুলতান মাহমূদ যদি কারো সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন তাহলে তরলোচনপাল পেছন দিক থেকে গযনী বাহিনীকে আক্রমণ করতো।

রাজা তরলোচনপাল ও তার ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তাদের কাউকে তাঁবুতে পাওয়া যায়নি। লাহোর বাহিনীর কর্মকর্তারা শুধু পালিয়ে যায়নি, ছেড়ে গেছে সকল সেনা আসবাবপত্র, ঘোড়ার গাড়ি। সবই আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। এবং সৈন্যরা হয় কাটা পড়েছে নয়তো ধরা পড়েছে কিংবা আহত হয়েছে। ফলে লাহোর বাহিনীর পক্ষ থেকে আর কোনপ্রকার আক্রমণের আশংকা রইলো না।

এক ইংরেজ ঐতিহাসিক তৎকালের মুসলিম ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, তরলোচনপাল রামগঙ্গা নামের একটি খরস্রোতা নদীর ওপাড়ে অবস্থান নিয়ে ছিলো।

এটি ছিল সুলতানের আট সৈনিকের একটি যুগান্তকারী বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। মাত্র আটজন যোদ্ধা প্রায় বিশ হাজার সৈন্যের শিবিরে অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলো। যা ছিল বিশাল এক তাঁবুপল্লী। সুলতান মাহমূদ এই আট যোদ্ধাকে পরদিনই বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করলেন। কারণ, এই আটজনের ঝটিকা আক্রমনের পেছনে কোন উধ্বর্তন সেনা কর্মকর্তার নির্দেশনা ছিলো না। তারা স্বউদ্যোগেই এমনটি করেছিল। ঝটিকা আক্রমনের বিস্তারিত বর্ণনা সেই সময়কার ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে এভাবে লেখা হয়েছে–

কমান্ডাররা বললো, সুলতান প্রায়ই লাহোরের সৈন্যদের ব্যাপারটি আলোচনা করতেন। লাহোর বাহিনীকে তিনি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছিলেন। তা ছাড়া রাড়ীতে হিন্দুরা গযনীর সেনা কমান্ডার ও কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে। এ নিয়ে সুলতান খুবই বিচলিত ছিলেন। রাজা তরলোচনপালের প্রতি সুলতান ছিলেন খুবই রাগান্বিত। মৈত্রী চুক্তি থাকার পরও সে অন্য হিন্দু রাজাদের গযনীর বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছে এবং পেছন দিক থেকে গযনী বাহিনীর উপর আক্রমণ করার জন্যে তার সেনাদেরকে লুকিয়ে রেখেছে।

ঘটনাক্রমে সেই দিন সন্ধ্যায় গযনীর এক গোয়েন্দা নদী পার হয়ে এপাড়ে উঠছিল। সে সময় এক কমান্ডার নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছিল। কমান্ডার ছিল গোয়েন্দার পরিচিত। ফলে বন্ধুকে পেয়ে সে আনন্দ চিত্তেই বলে দিল বহু প্রত্যাশিত একটি কাজ আমি করে এসেছি। দীর্ঘ দিন অনুসন্ধানের পর আজ আমি লাহোরের সেনা শিবির দেখে এসেছি।

একথা শুনে কমান্ডার আবেগে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। সে কথাটি তার তিন সহকর্মী কমান্ডারকে জানালো। তারাও মনের মধ্যে বিরাট উত্তেজনা অনুভব করলো এবং অভিযানের জন্যে তৈরী হয়ে গেল। বিষয়টি এদের পাশে থাকা চার সৈনিক শুনে তারাও সহযাত্রী হতে উৎসাহী হলো। ফলে তৈরী হয়ে গেল আটজনের কাফেলা। কোন উপায় না পেয়ে উধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে পানির থলের মধ্যে বাতাস ভরে তাতে ভর করে নদী পেরিয়ে গেল তারা। এরাই সংবাদ সংগ্রহকারী গোয়েন্দাকে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে উজ্জীবিত করলো। ফলে সেই কমান্ডার ও সেনারা একাকার হয়ে সুলতানের কাছে খবর না পৌঁছিয়েই ঝটিকা অভিযানে বেরিয়ে পড়লো।

যে চারজন কমান্ডার অভিযানে গিয়েছিল এরা ছিল রাতের ঝটিকা আক্রমণে পারদর্শী। তরলোচনপালের শিবিরের নিরাপত্তা বলয়ের ভেতরে গিয়ে তারা প্রথমে দু’জন প্রহরীকে হত্যা করল। এরপর একটি তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিল। সাথে সাথে আগুন জ্বলে উঠলো। তারা দ্রুত কিছু কাপড়ের টুকরোতে আগুন ধরিয়ে সারিবদ্ধভাবে তৈরী তাঁবুগুলোর দিকে নিক্ষেপ করতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে এক সঙ্গে অনেকগুলো তাঁবুতে জ্বলে উঠলো আগুন। অপর দিকে দু’জন সেনা অতি সংগোপনে অনেকগুলো ঘোড়ার রশি খুলে দিল। কয়েকটি ঘোড়াকে খঞ্জর দিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করল। বন্ধনমুক্ত ও আহত ঘোড়াগুলো আতংকিত হয়ে দিগবিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করলো এবং তীব্র হ্রেষারব করে অপর ঘোড়াগুলোর মধ্যে আতংক ছড়িয়ে দিল।

গযনীর ঝটিকা আক্রমণকারীরা যখন আক্রমণ করেছিলো তখন লাহোরের সেনারা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল। অগ্নি সংযোগের ব্যাপারটি দুর্ঘটনা না শত্রু বাহিনীর আক্রমণ তা বুঝতে তাদের অনেক সময় লেগে গেল। ততোক্ষণে গোটা শিবিরেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। লাহোর বাহিনীর তাঁবু ছিল খুব ঘন। একটির সাথে একটি লাগানো। দুপাশে পাহাড় আর মাঝখানে একটি সংকীর্ণ সমতল জায়গায় গাদাগাদি করে কয়েক হাজার তাঁবু খাঁটিয়ে ছিল তারা। ফলে দ্রুত একটির আগুন আরেকটিতে ছড়িয়ে পড়ল। ঘটনাক্রমে ঠিক সেই সময় তীব্র বাতাস বয়ে যাওয়ায় আগুন আরো ছড়িয়ে পড়েছিল।

সাফল্যের সাথে লাহোর শিবিরে অগ্নিসংযোগ করে গযনী বাহিনীর মরণজয়ী যোদ্ধারা পাশের পাহাড়ের উপড়ে উঠে গেল এবং দৌড় ঝাঁপরত হিন্দু সেনাদের উপর এলোপাথাড়ী তীর ছুঁড়তে লাগলো। তীর ধনুক তারা নিজেদের সাথে নিয়ে গিয়েছিল।

এই সময় একজন কমান্ডারের মাথায় এলো, আমরা যদি আমাদের সেনাবাহিনীকে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে এই অবস্থায় এদেরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব। একথা সে তার সাথীদের জানিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে নেমে এলোপাথাড়ী ঘুরতে থাকা যে ঘোড়াগুলো দূরে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে অগ্নিকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছিল এমন একটি ঘোড়াকে ধরে সেটির পিঠে চড়ে নদীর তীরের দিকে ঘোড়া ছুটাল। এই কমান্ডারই নদী পেরিয়ে এসে প্রধান সেনাপতি ও সুলতানকে খবর দেয়। সুলতান প্রধান সেনাপতিকে চারটি অশ্বারোহী ইউনিটকে নিয়ে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন।

* * *

কালাঞ্জরের রাজা গোবিন্দ তার সেনাদের নিয়ে কালাঞ্জর ছেড়ে আসার খবর সুলতান মাহমুদের কাছে পৌঁছে যায়। সুলতান এ খবর পেয়ে তার সেনাদেরকেও অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। সুলতান কনৌজ থেকে কালাঞ্জরের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তিনি খবর পেলেন গোবিন্দের সেনাবাহিনী যমুনা নদী পেরিয়ে এসেছে। সুলতান মাহমুদের সৈন্যরা পথিমধ্যে মাত্র দু’টি বিরতি দিয়ে এলাহাবাদ নামক স্থানের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। তাদের অবস্থান থেকে এলাহাবাদ খুব বেশি দূরে ছিল না। এদিকে রাজা গোবিন্দের সেনাদের অবস্থান মাত্র তিন চার মাইল দূরে ছিল।

এই সময় সুলতান মাহমুদের সেনাদের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা সেই চক্রান্তকারীরা তাদের চক্রান্তের চাল দিতে শুরু করল। চক্রান্তের মূল হোতা ছিল দুই সেলজুকী কমান্ডারের আত্মপরিচয় গোপনকারী স্ত্রী। এরা এই অভিযানে আসার শুরু থেকেই অন্যান্য মহিলাদের থেকে দূরে দূরে থাকতো। কেউ তাদের ব্যাপারে যাতে টের না পায় তাই এ ব্যবস্থা করেছিল তারা। এলাহাবাদ এলাকায় এসে যাত্রা বিরতি করলে এরা সক্রিয় হয়ে উঠে।

এক রাতে আম্বরী পায়চারী করতে করতে তার তাঁবু থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছিল। হঠাৎ তার কানে মানুষের ফিসফিসানির আওয়াজ ভেসে এলো। কেন জানি আম্বরীর মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধলো । সে ব্যাপারটি বোঝার জন্য পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে সেই ফিসফিসানির দিকে অগ্রসর হলো। কিছুটা অগ্রসর হলে সে শুনতে পেলো একজন মহিলার অনুচ্চ আওয়াজ। খুবই সতর্কভাবে কথা বলছে। কি বলছে তা পরিষ্কার শুনতে পেল আম্বরী। চাঁদনী রাত। বাইরে কিছুটা আলো আধারী অবস্থা। আম্বরী শুনতে পেল–

আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। লাহোরের সৈন্যরা তো ধোকায় পড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে বলছিল এক মহিলা। তোমরা বলছে, মহারাজা গোবিন্দের সৈন্যরা আসছে। তাই যদি সত্যি হয় তবে কোচওয়ান দু’জনকে পাঠিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা কর। যোগাযোগ হয়ে গেলে পরবর্তী কাজ লড়াই শুরু হলে করা যাবে।

আমি কিন্তু সকলকেই সতর্ক করে দিয়েছি। আমাদের কি করতে হবে তাও বলে দিয়েছি–বললো এক পুরুষ।

তুমি কাজের লোক। এজন্যই তো আমি তোমাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসি। আমি তো তোমারই। ও তো শুধু নামের স্বামী আসল স্বামী তুমি। বললো সেই নারী।

এসময় কারো পায়ের শব্দ শোনে পুরুষটি একটু দূরে সরে গেল। আম্বরীও তার জায়গা থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে এলো। কিন্তু নারীটিকে চেনার জন্য সে কোন দিকে যায় সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখল আম্বরী। যে দিকে মহিলাদের তাঁবু ছিল সেদিকেই মহিলাটি আসছিল। নিজেকে আড়াল করার জন্যে আম্বরী একটি ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়ল। মহিলা যখন কাছাকাছি এলো, তখন আম্বরী বসা থেকে এমনভাবে দাঁড়াল যাতে মনে হয়, সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসেছিল। মহিলাকে দেখে আম্বরী হতবাক!

দোশীন! আমি ভুল করছি না তো? মহিলাকে চিনতে পেরে বললো আম্বরী।

আরে! আম্বরী না? কার সাথে যুদ্ধে এসেছো? ও! ওই লোকটার সাথে এসেছে মনে হয়, যার সাথে পালিয়ে এসেছিলে? বললো দোশীন।

তুমিও হয়তো পালিয়েই এসেছো? কোন খান মেয়েকে গয়নী সৈনিকের সাথে দেখলে আসলে আশ্চর্যই লাগে–বললো আম্বরী।

আচ্ছা! তোমার স্বামী কে? দোশীনকে জিজ্ঞেস করলো আম্বরী।

কমান্ডার রজব ভাই? সে সেনাবাহিনীর কমান্ডার জান না?

এভাবে বলছো কেন? রজব সেলজুকী বলো না। আমি তাকে চিনি। তার সাথেই এসেছো তাহলে? বললো আম্বরী।

আমি অন্য কারো সাথে আসিনি। এসেছি স্বামীর সাথে বললো দোশীন।

হেসে ফেললো আম্বরী। বললো, আমি চিনি রজবকে। তুমি যার সাথে কথা বলছিলে সে রজব ছিল না। আজ কোন কমান্ডারের এ সময়ে এখানে থাকা সম্ভব নয়। আমার স্বামীও কমান্ডার। আমি জানি তাদের কারো পক্ষে এই মুহূর্তে এদিকে আসা সম্ভব নয়।

দোশীন! যাই করো না কেন বুঝে শুনে করো। সেনাবাহিনীর সাথে থাকতে হলে নিয়ত ঠিক রাখতে চেষ্টা করো।

একথা শুনে দোশীন আম্বরীকে জড়িয়ে ধরে হেসে বললো –তুমি ঠিকই বলেছো আম্বরী। লোকটি আসলে রজব ছিল না। তার এক বন্ধু তার খবর নিয়ে এসেছিল। তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো? আমি গযনী সালতানাতের অনুগত ও বিশ্বস্ত। যদি গযনী সালতানাতের অনুগতই না হতাম তাহলে এখানে আসতাম না। আমাকে নিজের মতোই মনে করো। আমি গয়নী বাহিনীর নিরাপত্তা ও বিজয়ের জন্যে সব সময়ে দু’আ করি– একথা বলে আম্বরীকে একটি হাসি উপহার দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল দোশীন। আম্বরী সেখানেই দাঁড়িয়ে ব্যাপারটি নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল।

মহারাজা গোবিন্দের সেনাদের অবস্থা জানার জন্য সুলতান মাহমূদ নিজেই এগিয়ে গেলেন। প্রধান সেনাপতি আলতাঈও তার সঙ্গে ছিলেন। সুলতান ঘোড়া থেকে নেমে একটি উঁচু গাছে চড়লেন। মহারাজা গোবিন্দের সেনা বাহিনী দেখে তার চক্ষু ছানাবড়া। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক গারদীজী, ইবনুল আসির ও কারখী লিখেছেন– সুলতান মাহমূদ যখন মহারাজা গোবিন্দের সেনাবাহিনী দেখলেন, তখন তার উদ্বেগ আড়াল করতে পারলেন না। যতদূর দৃষ্টি গেলো সবখানে ছড়িয়ে ছিল সেনা শিবির, হাতি, ঘোড়া। জায়গায় জায়গায় খন্দক খুঁড়ে রাখা হয়েছিল। ঐতিহাসিক আবুল কাসেম ফারিশতাও একথা সমর্থন করেছেন।

ঐতিহাসিকগণের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সুলতান মাহমূদ গোবিন্দের বিপুল সেনা সমাবেশ দেখে প্রধান সেনাপতিকে বললেন, নিজের দেশ ছেড়ে এতদূর আসাটা উচিত হয়নি। আমাদের জন্য কোন সেনাসাহায্য বা রসদপত্র সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। পিছু হটারও কোন ব্যবস্থা নেই। শত্রু বাহিনী তো আমাদেরকে কনৌজের দুর্গ পর্যন্তও পৌঁছতে দেবে না। আমাদের দুর্গ বন্দি হয়েই লড়াই করা উচিত।

আমি এই প্রথম সুলতানের কণ্ঠে পিছু হটার কথা শুনলাম– বলে মন্তব্য করেছিলেন আলতাঈ। এরপর সুলতানের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, শত্রু বাহিনীর জনশক্তি বিপুল। কিন্তু আমাদের পিছু হটার চিন্তা ত্যাগ করা উচিত সুলতান!

তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু ঠিক এই পরিমাণ সৈন্য গোয়ালিয়রেরও রয়েছে। ওরাও যদি এখানে এসে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে? একথা বলতে বলতে নীরব হয়ে গেলেন সুলতান। কিছুক্ষণ এভাবে থেকে মৃদু মাথা ঝাড়া দিয়ে বললেন, তওবা তওবা! আল্লাহ আমাকে মাফ করুন! আল্লাহ আমাকে মাফ করুন! হায়! আমি আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিলাম। আল্লাহ মহান। তিনিই জয় পরাজয়ের মালিক।

বিপদের সময় সুলতান যা করতেন, গাছ থেকে নেমে এবারও তাই করলেন। কিবলামুখী হয়ে দু’রাকাত নামায পড়লেন। তার সাথে যারা ছিল তারাও নামায পড়লো। তারপর সুলতান শিবিরে ফিরে এলেন।

মহারাজা গোবিন্দের সৈন্যদের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার পদাতিক, ছয়ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী, এবং ছয়শো চল্লিশটি জঙ্গি হাতি ছিল। সে ছিল তার রাজধানী থেকে মাত্র এক দিনের দুরত্বে। তার রাজ্যের ছোট বড় সকল ধরনের লোকই যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে শরীক ছিল। গোটা হিন্দু জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ। এদিকে সুলতান মাহমূদের আল্লাহর উপর ভরসা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। সুলতান মাহমূদ শিবিরে গিয়ে সকল কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডারসহ সেনাকর্মকর্তাদের একত্রিত করলেন। তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, কোন দিন রণাঙ্গনে তোমরা আমাকে হতাশ করনি। খুব কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তোমরা শত্রুদের পরাজিত করেছে। দুই গুণ, তিন গুণ জনশক্তির অধিকারী শত্রু বাহিনীকেও তোমরা হাতিয়ার ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আজ তোমাদের সামনে পাহাড় দাঁড়ানো। তোমাদের একজনকে আমি বারোজনের সাথে মোকাবেলা করার নির্দেশ দিতে পারি না। তোমাদেরকে বিশাল হাতির সাথে মোকাবেলা করতে বলতে পারি না।

আমি তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তোমরা এখানে একটা পবিত্র আকাখা নিয়ে এসেছে। আমি তোমাদের শুধু একথা বলে দিতে চাই, শত্রু বাহিনী যতো প্রবলই হোক না কেন আমাদের পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার কোন জায়গা নেই। পরাজিত হলে আমাদের অধিকাংশই নিহত হবো। আর যারা বেঁচে থাকবে তারা হবে হিন্দুদের কয়েদী। হিন্দুরা গযনীর যে কোন বন্দির বিরুদ্ধে তাদের প্রতিটি পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবে। তাদের দেবদেবীদের অপমান ও লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নেবে।

আমরা পরাজিত হলে আমাদের প্রাণ সম্পদের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইসলাম। হিন্দু রাজারা গয়নী দখল করে নেবে। তোমরা জীবিত না থাকলে বিজয়ী না হলে গযনী দখল থেকে হিন্দুদের বাধা দেয়ার কেউ থাকবে না। তখন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি হিন্দুরা দখল করে নেবে। আমাদের মা বোন কন্যারা হিন্দুদের বাদী দাসীতে পরিণত হবে। যে গযনী এখন ইসলামী সালতানাতের রাজধানী, হিন্দুরা সেটিকে মূর্তি পূজার রাজধানীতে রূপান্তরিত করবে। এদিকে হিন্দু শত্রু আর ওদিকে ইহুদী ও খৃস্টান শত্রু। ইহুদী ও খৃষ্টশক্তি মিলে আমাদের ক্ষমতালোভী আমীর উমারাদের বিভ্রান্ত করে ভেতরে ভেতরে আমাদের শক্তিকে ফোকলা করে রেখেছে। ফলে আমাদের চতুর্দিকে মুসলিম শাসন থাকলেও তারাও আমাদের ও ইসলামের ঘোরতর শত্রু।

হিন্দুরা যদি একবার গযনী পৌঁছে যেতে পারে তাহলে সকল কাফের বেঈমান মিলে কা’বা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। আর এমনটি হলে আল্লাহর কাছে আমাদের সবাইকে অপরাধী সাব্যস্ত হতে হবে।

তাই বলছি বন্ধুরা! আজ তোমরা আল্লাহর নির্দেশে লড়াই করবে। আল্লাহর নাম নিয়ে লড়বে, আল্লাহর সাহায্য নিয়ে লড়বে। আল্লাহর রহমতের প্রতি শতভাগ ভরসা রেখে তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বাকী কাজ আল্লাহ করে দেবেন।

একথা বলার পর সুলতান সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে শুরু করলেন। কোন ইউনিট কোন দিকে থাকবে এবং কিভাবে কোন কৌশলে মোকাবেলা করবে তা কমান্ডারদের বুঝিয়ে দিলেন।

গযনী বাহিনীর অবস্থানের ডান দিকে ছিল যমুনা এবং বাম দিকে ছিল গঙ্গা নদী। দুই নদীর মাঝখানের বিস্তৃতি কোথাও বিশ মাইল কোথাও চল্লিশ মাইল। সুলতান মাহমূদ চাচ্ছিলেন রাজা গোবিন্দের সেনাদেরকে দু’ভাগে ভাগ করতে; কিন্তু দৃশ্যত এটা সম্ভবপর মনে হচ্ছিল না। তবুও তিনি তার পরিকল্পনা মতো সেনাদের দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়ে বললেন, প্রত্যেক কমান্ডার যেন তাদের অধীনস্ত প্রত্যেক সেনার কাছে তার এই বার্তা ও পয়গাম পৌঁছে দেয়।

* * *

এদিকে আম্বরী দোশীনের তাঁবুটি তখনই চিহ্নিত করে এলো। দোশীনের কার্যক্রমে আম্বরীর দৃঢ় বিশ্বাস হলো, সে শুধু তার স্বামীকেই ধোকা দিচ্ছে না, সুলতান মাহমূদের জন্যও মারাত্মক ধোকা হয়ে এসেছে। সেই রাতের প্রথম প্রহরে আম্বরীকে তার স্বামী উমর ইয়াজদানী শত্রুবাহিনীর বিপুলতা এবং সুলতানের উদ্বেগ ও তাঁর ভাষণ সম্পর্কে জানিয়ে দু’আ করতে বলে তখনই তাঁবু ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

আম্বরী তখনো তার স্বামী উমরকে জানায়নি, এখানে এক সেলজুকী কমান্ডারের স্ত্রী হয়ে এসেছে এক খান তরুণী। আম্বরী দোশীনকে ভালো ভাবেই জানতো। জানতে দোশীনের মন মানসিকতা এবং স্বভাবচরিত্র। ফলে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না দোশীন ও তার সেলজুকী স্বামী গযনী সরকারের প্রতি অনুগত। কারণ, দোশীন ছিল একজন মারাত্মক কূট স্বভাব ও দুশ্চরিত্রের প্রতিমূর্তি। তাই আম্বরী সেই সন্ধ্যার পর থেকেই দোশীনের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগলো। আম্বরী তার কর্মচারীকেও বলে দিয়েছিল দোশীনের প্রতি কড়া নজর রাখতে এবং তার তৎপরতা সম্পর্কে সাথে সাথে তাকে জানাতে।

পরের রাতের ঘটনা। সন্ধ্যার পর আম্বরী তার তাঁবুতে একাকি বসে আছে। তার স্বামী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। এমন সময় আম্বরীর কর্মচারী তাঁবুতে ঢুকে তাকে জানালো, সে দোশীনকে নদীর দিকে যেতে দেখেছে এবং তার পিছু পিছু দুইজন কোচওয়ানও নদীর দিকেই যাচ্ছে।

একথা শোনার সাথে সাথে আম্বরী তার কর্মচারীর নির্দেশনা অনুযায়ী নদীর দিকে অগ্রসর হলো। আম্বরী মূল পথ ছেড়ে একটু দূর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। কিছুক্ষণ অগ্রসর হয়েই সে দেখতে পেলো, চারজন লোকের সাথে শুধু দোশীন একা নয় আরেকজন নারীও দাঁড়ানো। আম্বরী একটা ঝোঁপের আড়াল দিয়ে পা টিপে টিপে তাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল এবং তাদের কথাবার্তা পরিষ্কার শুনতে পেলো। তাদের কথা থেকে আম্বরী বুঝতে পারলো, তাদের মধ্যে আসল কথা আগেই হয়ে গেছে। সে শুধু একজনকে বলতে শুনল–

নদীর তীরে নৌকা বাধা আছে, নিঃশব্দে নৌকা পর্যন্ত গিয়ে নৌকার রশি খুলে দেবে। তোমরা যে দিকে যাবে সেদিকেই এখন পানির স্রোত। কিছুক্ষণ ভেসে দূরে গিয়ে বৈঠা চালাবে। প্রহরীরা কিন্তু ওদিকেও যায়, সতর্ক থাকবে। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে পৌঁছে যাবে তোমরা।

মহারাজা অশ্বারোহী সৈন্যদেরকে যেন আমাদের বামপাশে রাখে। তুমি তো আমাদের পথ দেখে এসেছে। এই পথের কথা ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেবে। আমরা এপাশেই থাকবো। মহারাজাকে বলবে, এ পাশে আমাদের পক্ষ থেকে তার বাহিনীর উপর কোন আক্রমণ হবে না। তারা একেবারে গযনী বাহিনীর মাঝখানে চলে যেতে পারবে। সুযোগ পেলে আমরাই তীর মেরে সুলতানকে মেরে ফেলবো।

মহারাজাকে আমাদের বাম পাশের অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছার পথ বুঝিয়ে দেবে। আর বলবে, আমাদের সেনারা তার সেনাদের উপর আক্রমণ করে পিছিয়ে আসবে, তারা যেন আমাদের পিছিয়ে আসার কারণে এগিয়ে না আসে। তাহলে কিন্তু সুলতানের ফাঁদে আটকে যাবে। আমাদের আক্রমণকারীরা পেছনে সরে আসলে তারাও যে পিছিয়ে যায়, নয়তো আমরা উভয় বাহুর আক্রমণের শিকার হবো। যাও, এখ, চলে যাও। তোমাদের পুরস্কারের বিষয়টাতো জানাই আছে। ঠিক ঠিক পেয়ে যাবে।

দু’জন লোক নদীর দিকে অগ্রসর হলো। আর দোশীন, অন্য মহিলা ও বাকী দু’জন পুরুষ ভিন্ন পথ ধরলো। আম্বরী তাড়াতাড়ি ঝোঁপের আড়াল থেকে উঠে দ্রুত তার তাঁবুতে এলো এবং তীর ধনুক এবং একটি খঞ্জর কোমরে গোঁজে তাঁবু থেকে দ্রুত পায়ে নদীর দিকে অগ্রসর হলো। সে তার কর্মচারীকেও তারবারী আর বর্শা নিয়ে তার সঙ্গী হতে বললো।

আম্বরী ছিল অনভিজ্ঞ। কিন্তু সে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। সে এটা বুঝতে পেরেছিল, সুলতান মাহমূদ জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতারণার শিকার হতে যাচ্ছেন। কিন্তু কিভাবে এই চক্রান্ত সামাল দেয়া যাবে? এই অভিজ্ঞতা তার ছিল না। সুলতান মাহমূদের প্রতি তার এতোটাই শ্রদ্ধা ছিল যে, আবেগের তীব্রতায় সে তীর ধনুক ও খঞ্জর নিয়ে তার কর্মচারীকে সঙ্গী করে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। নদী খুব বেশী দূরে ছিল না। অতি আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ার কারণে তাকে কেউ অনুসরণ করছে কিনা সেই খেয়াল আম্বরীর ছিল না। কত তাড়াতাড়ি সে নদীর তীরে পৌঁছাতে পারবে এটাই ছিল তার লক্ষ্য। ঠিক সময়েই নদী তীরে পৌঁছে গেল আম্বরী।

সে নদী তীরে পৌঁছে দেখল, চক্রান্তকারী দু’জন নৌকায় উঠে পানিতে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছে। স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে নৌকা। চাঁদনী রাত। বেশী দূর যায়নি নৌকাটি। আম্বরী তাড়াতাড়ি কিছুটা ভাটির দিকে গিয়ে এক হাটু মাটিতে ঠেকিয়ে ধনুকে তীর ভরে ছুঁড়ে দিল। কাল বিলম্ব না করে বিদ্যুৎ বেগে আরেকটি তীর ছুড়লো আম্বরী। উভয় তীর লক্ষভেদ করলো। কিন্তু ততোক্ষণে ঘটে গেছে অন্য কাণ্ড।

তার পিছনে আসা কর্মচারীর কণ্ঠ চিড়ে বেরিয়ে এলো আর্তচিৎকার। শেষ তীরটা ধনুক থেকে বেরিয়ে যেতে না যেতেই পেছন দিকে তাকিয়ে আম্বরী দেখল, তার কর্মচারীর উপর দু’জন লোক আক্রমণ করেছে। এদের একজন আম্বরীর দিকে দৌড়াতে চাচ্ছে, আর আম্বরীর কর্মচারী বর্শা দিয়ে তাকে আটকাতে চাচ্ছে । কর্মচারী সর্বশক্তি দিয়ে দু’জনের মোকাবেলা করতে চাচ্ছিল। কিন্তু আক্রমণকারী দু’জন ছিল তরবারী ধারী। তাদের যৌথ আক্রমণে কর্মচারী আহত হয়ে গেল।

এক আক্রমণকারী ততোক্ষণে আম্বরীর উপর আক্রমণ করল। কিন্তু আঘাতটি ব্যর্থ হলো। আক্রমণকারী আবার আক্রমণ করলো। এটিও ব্যর্থ করে দিয়ে আম্বরী গলা ছেড়ে চিৎকার শুরু করে দিল। বলতে লাগল– আয়! তোরা নদীর দিকে আয়! একথা বলে সে উল্টো পায়ে পেছনের দিকে সরে গেল এবং চটজলদি একটি তীর ধনুকে ভরে নিল। আম্বরী চাচ্ছিল এদেরকে জীবিত ধরিয়ে দিতে।

ধনুক থেকে তীর বের করে ফেলো মেয়ে। আমরা তোমাকে ছেড়ে দেবো–আম্বরীকে শাসালো এক আক্রমণকারী। আম্বরী ছিলো পাকা তীরন্দাজ। সে ধনুক উপরে উঠিয়ে তীর ছুঁড়ে দিলো। আক্রমণকারী লাফিয়ে অন্য দিকে সরে গেল। কিন্তু তীর ততোক্ষণে তার উরু ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।

অপর আক্রমণকারী আম্বরীর কর্মচারীকে হত্যা করার চেষ্টা করছিল। আম্বরী আরেকটি তীর ওই হামলাকারীকে লক্ষ্য করে ছুড়লো । তারও পায়ে আঘাত হানলো তীর।

তীরবিদ্ধ হওয়ার পর উভয় আক্রমণকারী দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলো; কিন্তু কেউই বেশী দূর এগুতে পারলো না। আম্বরী গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দিল। আম্বরীর চিৎকার শুনে প্রহরীরা দৌড়ে এলো। আম্বরী প্রহরীদের জানালো– দু’জন চক্রান্তকারীকে সে তীরবিদ্ধ করেছে। এরা তীরবিদ্ধ হয়ে পালিয়ে যেতে চাচ্ছে। আর দু’জন হিন্দু গোয়েন্দাকে সে তীরবিদ্ধ করেছে। এরা নৌকায় চড়ে শত্রু বাহিনীর কাছে খবর নিয়ে যাচ্ছে। একটা নৌকা ভেসে যাচ্ছে, এর মধ্যে তীরবিদ্ধ দুই লোক রয়েছে। এরা গযনী বাহিনীতে হিন্দুদের চর হয়ে কাজ করে। এক প্রহরী একথা শুনে উচ্চস্বরে চিৎকার করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেল কয়েকজন অশ্বারোহী। তাদেরকে বলা হলো, নদীতে ভাসমান নৌকায় তীরবিদ্ধ শত্রু সেনা আছে, এদেরকে পাকড়াও করো।

নির্দেশ পাওয়া মাত্র কয়েকজন সৈনিক নদীর ভাটির দিকে দৌড়াল এবং দু’জন পানিতে নেমে নৌকায় উঠে সেটিকে তীরে এনে দুই আহতকে নদী তীরে তুলে আনলো। অপর দিকে পলায়নপর তীরবিদ্ধ দুই আক্রমণকারীকেও ধরে ফেললো প্রহরীরা। কিন্তু প্রহরীরা এদেরকে দেখে অবাক হলো। এরা যে তাদেরই সেনাবাহিনীর দু’জন কমান্ডার।

গ্রেফতার করা সবাইকে সাথে সাথে প্রধান সেনাপতি আলতাঈর কাছে নিয়ে গেল প্রহরীরা। যে দু’জন নৌকা করে হিন্দুদের খবর পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল, এরা ছিল পরিচয় গোপনকারী হিন্দু। এরা দুই সেলজুকী কমান্ডারের কর্মচারী পরিচয়ে গযনী বাহিনীর সাথে এসেছিল।

তীরবিদ্ধ দুই কমান্ডার ছিল সেলজুকী কমান্ডার রজব ভাই আর কমান্ডার ফরিদ আফিন্দি। নৌকায় আরোহী দুই হিন্দুর শরীর থেকে তীর খোলে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু কমান্ডার দু’জনকে দেখে সুলতান নির্দেশ দিলেন, যতক্ষণ না এরা সত্য কথা বলবে, ততোক্ষণ এদের শরীর থেকে তীর খুলবে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই হিন্দু মুখ খুললো এবং বললো–আমরা আসলে হিন্দু। এই দুই সেলজুকী কমান্ডার আমাদেরকে পরিচয় গোপন করে সাথে এনেছে। এখন আমাদেরকে মহারাজা গোবিন্দের কাছে গযনী বাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কে খবর নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল।

গ্রেফতারকৃত দুই সেলজুকী কমান্ডারও স্বীকার করলো– তারা ইসরাঈল সেলজুকীর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করছিল। সুলতান একথা শুনে রাগে ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। বললেন- আল্লাহ যদি আমাদেরকে গযনী ফিরিয়ে নেয়, তাহলে সবার আগে ইসরাঈল সেলজুকী এবং আলাফতোগীনকে শায়েস্তা করবো।

এই ভয়াবহ চক্রান্তের কথা জানার সাথে সাথে সুলতান দোশীন ও তার সহযোগী তরুণীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন এবং সকল সেলজুকী সৈন্যকে একত্রিত করে তাদের কাছ থেকে সব অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিলেন। সেলজুকীদের সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করে তাদেরকে নজরবন্দি ঘোষণা করে তাদের জন্য পাহারাদার নিয়োগ করলেন। ভয়ঙ্কর চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর আর কোন সেলজুকীর উপর আস্থা রাখা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করলেন সুলতান।

মহারাজা গোবিন্দের বিশাল সৈন্যবহর দেখে সুলতান মাহমূদ খুবই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। পরিস্থিতি কিভাবে সামলানো যাবে এই চিন্তায় তিনি ছিলেন পেরেশান। এর মধ্যে নিজ সেনাদের মধ্যে আত্মঘাতি ভয়ঙ্কর চক্রান্তের বিষয়টি তাকে দারুন উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিল। বাহ্য দৃষ্টিতে কোন উপায় অন্তর না দেখে তিনি নফল নামাযে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে একান্ত মনে খুব কান্নাকাটি করলেন।

সারা রাত কখনো নামাযে কখনো হাতে কুরআন শরীফ নিয়ে আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করলেন সুলতান।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, শেষ রাতে তার মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি দেখা গেলো। তিনি তখনই এক দূতকে ডেকে রাজা গোবিন্দের কাছে পয়গাম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মনে হলো, সংকট থেকে উত্তোরণের কোন সহজ পথ পেয়ে গেছেন তিনি। তিনি রাজা গোবিন্দের উদ্দেশ্যে লিখলেন– ইসলাম সত্য ধর্ম, আর পৌত্তলিকতা সম্পূর্ণ মানুষের তৈরি অবাস্তব ধর্ম। ইসলাম গ্রহণ করলে আপনি শান্তি ও নিরাপত্তা পাবেন। যদি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, তাহলে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, আপনি আপনার সেনাবাহিনী ও আপনার রাজধানীর উপর কেমন ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসবে।

আপনি যদি নেতিবাচক জবাব দেন, তাহলে সাথে সাথেই আমার সৈন্যরা আপনার উপর আক্রমণ করেবে। আর আপনার রাজধানী অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে রাজধানী অবরোধের আয়োজন হয়ে গেছে। আমার সৈন্যরা হয়তো সেখানে পৌঁছে গেছে। আশা করি, আপনি আমার সৈন্যদের হাতে আপনার সেনাদের গণহত্যার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করবেন এবং কালাঞ্জরের মন্দির ও শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে হেফাযত করবেন।

এই পয়গাম দিয়ে সুলতান রাজা গোবিন্দের কাছে দূত পাঠালেন। মহারাজা গোবিন্দ ইসলাম গ্রহণ করলেন না বটে, কিন্তু সুলতানের দূতকে সসম্মানে ফেরত পাঠালেন। তিনি সুলতানের সাথে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সুলতানের সেনা শিবিরের দিকে অগ্রবর্তী সেনাদল পাঠিয়ে দিলেন।

সুলতান মাহমুদের গোয়েন্দা ইউনিট সাথে সাথে খবর দিয়ে দিলো, রাজা গোবিন্দের অগ্রবর্তী সেনারা গযনী বাহিনীর দিকে রওয়ানা করেছে। সুলতান প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন গোবিন্দের অগ্রবর্তী বাহিনীর উপর এমন আক্রমণ করেন যে, তার গোটা বাহিনীর মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে।

প্রধান সেনাপতি আলতাঈ যুদ্ধের ময়দানেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন। কোন অবস্থায় কি ব্যবস্থা নিতে হয় এ ব্যাপারে তিনি ইতিহাস বিখ্যাত ছিলেন। অগ্রীম খবর পাওয়া মাত্রই তিনি দুটি অশ্বারোহী ইউনিটকে ডানে বামে পাঠিয়ে দিলেন এবং তাদের কমান্ড নিজের হাতে রাখলেন।

মহারাজা গোবিন্দের অগ্রবর্তী সেনারা যখন তাদের মুখোমুখি এলো, তখন আলতাঈর নির্দেশে উভয় পাশের সৈন্যরা হিন্দু সেনাদের উপর উভয় দিক থেকে আক্রমণ করলো। আলতাঈ নিজে সেনাদের আক্রমণ পরিচালনা করলেন। ফলে মহারাজা গোবিন্দের অগ্রবর্তী বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ল। অধিকাংশই নিহত হলো। আর যারা প্রাণে বেঁচে পালাতে সক্ষম হলো, তার গোটা সেনাবাহিনীর মধ্যে আতংক ছড়িয়ে দিল।

সেদিন আর কোন লড়াই হলো না। রাতের বেলায় সুলতান মাহমূদ আবারো আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। সুলতানের আশংকা ছিল, মহারাজা গোবিন্দের সৈন্যরা রাতে নিশ্চয়ই আক্রমণ করবে। কিন্তু রাতে আর কোন আক্রমণের ঘটনা ঘটলো না। নিরাপদেই রাত পোহাল। সুলতান যখন ফজরের নামায শেষ করলেন, তখন প্রধান সেনাপতি তাকে জানালেন মহারাজা গোবিন্দের সেনাবাহিনীকে রাতের বেলায় কোথাও চলে যেতে দেখেছে। আমাদের গোয়েন্দারা।

এটা নিশ্চয়ই থোকা। এতো বিশাল বাহিনী মোকাবেলা না করে পালিয়ে যেতে পারে না। রাজা গোবিন্দ আমাদেরকে সামনে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। সে আশা করছে, আমরা সামনে চলে গেলে আমাদেরকে উভয় দিক থেকে ঘিরে ফেলবে।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, আসলে রাতের অন্ধকারে মহারাজা গোবিন্দের সেনাদের স্থানান্তর গয়নী বাহিনীর মোকাবেলার জন্য ছিল না। পালানোর উদ্দেশ্যে তারা রাতেই পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলেছিল। দিনের বেলায় গোবিন্দের অগ্রবর্তী বাহিনীর শোচনীয় অবস্থা দেখে রাত হতে না হতেই তার মনে হতে লাগলো, এতো দিন গযনী বাহিনীর দুর্ধর্ষতা সম্পর্কে তিনি যা শুনেছেন তাই ঠিক। তিনি গযনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নিজের ও রাজ্যের নিশ্চিত ধ্বংস ডেকে এনেছেন। তার মধ্যে দেখা দিল মারাত্মক আতংক। ফলে তিনি কাল বিলম্ব না করে রাতের মধ্যেই তার সেনাদেরকে শিবির ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।

এটি ছিল সুলতান মাহমুদের দুআর বরকত। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ও আত্মনিবেদনের ফল। আল্লাহ তার দু’আর বরকতেই প্রবল শক্তির অধিকারী হিন্দু রাজার মনে আতংক সৃষ্টি করে দিলেন। এই হিন্দুরাজা এতোটাই আতংকিত হলেন যে, তিনি মোকাবেলা না করে রাতের অন্ধকারে রণাঙ্গণ ত্যাগ করলেন।

সুলতানের গোয়েন্দারা খবর দিলো, শত্রুবাহিনী শিবির ত্যাগ করে চলে গেছে। তিনি বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্যে এবং পরিস্থিতি যাচাই করার জন্যে দু’টি সেনা ইউনিটকে সাথে নিয়ে রাজা গোবিন্দের শিবির পর্যন্ত অগ্রসর হলেন। সত্যিই অবাক করা দৃশ্য। ছাউনী তাঁবু যথারীতি রয়েগেছে; কিন্তু গোটা শিবির ফাঁকা। কোথাও একজন পাহারাদার পর্যন্ত নেই। সুলতান এটিকে ফাঁদ মনে করে অনাকাঙ্খিত আক্রমণ প্রতিহতের জন্যে সেনাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেন; কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও কোন দিক থেকে শত্রুপক্ষের কোন আক্রমণের আলামত দেখা গেলো না।

এক পর্যায়ে সুলতানের কাছে খবর এলো, মহারাজা গোবিন্দের সৈন্যরা কালাঞ্জরের পথে রাজধানীতে ফিরে যাচ্ছে। সুলতান পিছু ধাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে নিজেই গোবিন্দের সৈন্যদের ধাওয়া করার জন্যে বিদ্যুৎ বেগে অগ্রসর হয়ে শত্রু সেনাদের একেবারে কাছে চলে গেলেন। এটি ছিল একটি অতি দুঃসাহসী কাণ্ড। অবস্থা আঁচ করে প্রধান সেনাপতি আলতাঈ আরো চারটি সেনা ইউনিট নিয়ে দ্রুত সুলতানের সাথে যোগ দিলেন, যাতে কোন অনাআঙ্খিত পরিস্থিতি না ঘটে। অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি। বরং গোবিন্দের সৈন্যরা গযনী বাহিনীর তাড়া খেয়ে মালপত্র, হাতি ঘোড়া ত্যাগ করে যে যার মতো জীবন নিয়ে পালিয়ে গেলো।

কোন ঐতিহাসিকই মহারাজা গোবিন্দের মোকাবেলা না করে রাতের অন্ধকারে রণাঙ্গন ত্যাগ করার কারণ বলেননি। ঐতিহাসিক স্মিথ ও উথবী লিখেছেন– আসলে মহারাজা গোবিন্দ গয়নী বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে যাননি। তার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিলেন। এটা দেখে তার সেনাকর্মকর্তারা আতংকিত হয়ে পড়ে এবং গযনী বাহিনী পিছু ধাওয়া করলে তারা হাতি ঘোড়া রসদপত্র ফেলেই জীবন নিয়ে পালিয়ে যায়।

অবস্থা এমন হয় যে, সুলতান যখন পিছু ধাওয়া ত্যাগ করে শিবিরে ফিরে আসতে থাকেন, তখন রাজার ছয়শ’ জঙ্গি হাতির মধ্যে পাঁচশ আশিটি হাতিই ছিল তার সেনাদের দখলে। বিনা যুদ্ধে এই অস্বাভাবিক বিজয়ের পর সুলতানের অবস্থাও এমন হলো যে, তিনি হিন্দুস্তানে নিয়মিত সরকার গঠন না করেই গযনী ফিরে আসেন। ফিরে আসার ব্যাপারে কোন কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন– সুলতানের কাছে খবর পৌঁছে যে, সেলজুকীরা বিপুল শক্তি সঞ্চয় করেছে। যে কোন দিন তারা গযনী আক্রমণ করতে পারে। এ খবর শুনে সুলতান হিন্দুস্তানে সরকার প্রতিষ্ঠা না করেই গযনী ফিরে আসেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *