১. ট্যাক্সিক্যাবের দরজা খুলে

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

মুখবন্ধ

গন্ধটা যেনো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো তাকে।

ট্যাক্সিক্যাবের দরজা খুলে মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে টের পেলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত একটি গন্ধ। এ জীবনে নেয়া যতো গন্ধ আছে তার মধ্যে এটি একেবারেই অজ্ঞাত। এর মধ্যে যে সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে সেটাও টের পেলো খুব দ্রুত।

টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা ক্যাবে করে ভ্রমণ করার পর এমনিতেই খিদেয়। পেট চৌ চৌ করছিলো, প্রলুব্ধকর গন্ধে সেটা যেনো বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়লো এবার। তার থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে, রাস্তার পাশে রেস্টুরেন্টটি দেখতে পেয়ে সানগ্লাস খুলে ভালো করে তাকালো। সাইনবোর্ডে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অদ্ভুত আর অপ্রচলিত নামটি। দুই ঠোঁটে চেপে রাখা জ্বলন্ত সিগারেটে জোরে টান দিলো সে। পা বাড়ানোর আগে ট্যাক্সি ক্যাবের দিকে ফিরে তাকালো। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মাথা বের করে রেখেছে। তার সাথে চোখে চোখ পড়তেই মাথা নেড়ে সায় দিলো লোকটি। তাকে চলে যাবার ইশারা করতেই হুস করে শব্দ তুলে ট্যাক্সিক্যাবটি চলে গেলো। তার চোখের সামনে যে রেস্টুরেন্টটি দাঁড়িয়ে আছে সেটা গর্বসহকারেই জানান দিচ্ছে :

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি!

একদম সত্যি কথা। আমিও কখনও এখানে আসতাম না, যদি..

বুক ভরে গন্ধটা নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো।

মহাসড়কের পাশে চমৎকার একটি বাংলো বাড়ির মতো একতলার এই রেস্টুরেন্টটির সামনে লম্বা বারান্দা, সেই বারান্দার উপরে সবুজ রঙ করা টিনের ছাউনি। বড় বড় ফ্রেঞ্চ জানালা আর নক্সা করা বিশাল একটি কাঠের দরজা-এক নজরেই জায়গাটা মানসপটে স্থান করে নেবে। রাস্তার পাশে এমন চমৎকার ছিমছাম রেসটুরেন্ট খুব কমই আছে। মহাসড়কের পাশে যেসব রেস্টুরেন্ট থাকে সেগুলো মূলত যাত্রিবাহী বাসের স্টপেজ হিসেবে কাজ করে। বড়বড় বাস-সার্ভিস কোম্পানি নিজেরাই কিছু রেস্টুরেন্টের মালিক। ওগুলোর সামনে বিশাল একটি খালি জায়গা রাখা হয় বাস-কোচ রাখার জন্য কিনতু এই অদভুত রেটুরেন্টটি সে-রকম নয়। এর সামনে যে খোলা জায়গাটি আছে সেখানে বড়জোর দশ-বারোটি প্রাইভেটকার রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। সম্ভবত দূরপাল্লার কোনো বাস-কোচ এখানে রাখা হয় না। তাহলে কোথায় রাখা হয়?

জবাবটা পেয়ে গেলো রেস্টুরেন্টের বামদিকে।

ছিমছাম রেস্টুরেন্টের এক-দেড়শ’ গজ দূরে একটি পেট্রলপাম্প। সেখানে অনেকগুলো বাস-ট্রাক-কোচ দাঁড়িয়ে আছে।

চারপাশে তাকিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে নজর দিলো আবার। এ মুহূর্তে সামনের প্রাঙ্গণে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার আর কালো রঙের মাইক্রোবাস ছাড়া কিছু নেই।

দুপুর গড়িয়ে গড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বিকেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু যেনো ঝিমিয়ে পড়েছে এখানে। মহাসড়কটিও অলসভাবে পড়ে আছে। অনেকক্ষণ পর পর দুয়েকটা বাস-ট্রাক যাচ্ছে-আসছে তার উপর দিয়ে।

রেস্টুরেন্টের আশেপাশে ডোবা-নালা আর ধানক্ষেত। পেছনে, বহু দূরে একটি গ্রামীণ জনপদ। বিস্তীর্ণ ক্ষেতের মাঝে গুচ্ছ-গুচ্ছ কৃষকের বসতবাড়ি। সরু একটি পথ চলে গেছে সেই বসতবাড়িগুলোর দিকে। মেঠোপথের দু-ধারে বিস্তীর্ণ আবাদি-জমি। মাঝে-মাঝে ছোটো-বড় ডোবা পুকুর, খাল। চারদিকে তাকালে সবুজ প্রান্তরে আকাশ মিশে যাবার সেই চিরায়ত দৃশ্যই চোখে পড়বে।

বারান্দার কাছে এসে একটু থেমে সুখটান দিয়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ধূমপান নিষেধ লেখা সাইনের পাশেই নক্সা করা বিশাল দরজা, সেটা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই থমকে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। হালকা ভলিউমে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে বেড়াচ্ছে। অবাক হলো না সে। এটা প্রত্যাশিতই ছিলো, বিশেষ করে এমন একটি রেসটুরেন্টে।

ঘরের ভেতরে নজর দিলো এবার। সাজসজ্জা আর পরিবেশ একদমই আলাদা। টেবিল-চেয়ারগুলো একটু ভিন্নভাবে সাজানো। এক একটা রাউন্ড টেবিল ঘিরে আছে তিন থেকে চারটা করে চেয়ার। এরকম পাঁচ-ছয়টি টেবিল আছে ঘরে। সর্বোচ্চ বিশ-পঁচিশজন বসতে পারবে। এই বিশাল জায়গাটি যতো কাস্টমার ধারণ করতে পারে তার অর্ধেকের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মালিক যেনো স্পষ্ট একটি বার্তা দিচ্ছে-সবাইকে আমি নিছক টাকা। কামানোর জন্য রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করি না। আমি যেটা করি সেটা এক ধরণের শিল্প!

শীতের এই পড়ন্ত বিকেলে মাত্র দুটো টেবিলে পাঁচ-ছয়জন কাস্টমার আয়েশ করে খাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘ ভ্রমণপথে বিরতি দিয়ে খেয়ে নিচ্ছে এরা বা অন্য কারোর কাছ থেকে এই হোটেলের সুনাম শুনে চলে এসেছে হয়তো। তাকে ঢুকতে দেখে কিছু কাস্টমার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলো, তবে খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়, আবারো মনোযোগ দিলো নিজেদের সামনে রাখা সুস্বাদু খাবারের দিকে।

চারপাশে তাকিয়ে কোনো ওয়েটার দেখতে পেলো না। আস্তে করে কয়েক পা হেঁটে সামনের একটি টেবিলে বসে পড়লো সে। বেশ আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা। সাধারণত রেস্টুরেন্টগুলো এরকম আরামের। ব্যবস্থা করে না। হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায় এখানে। সেও তাই করলো। দীর্ঘ ভ্রমনে সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে আছে।

রেস্টুরেন্ট হিসেবে জায়গাটা অদ্ভুত। টেবিলে কোনো মেনু নেই। এটাও অদ্ভুত। কোনো ওয়েটারও চোখে পড়ছে না। একেবারেই ব্যতিক্রমী দৃশ্য। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভেতরের উত্তর দিকে ছোট্ট একটা দরজা আছে, ওটা দিয়ে হয়তো ভেতরের কোনো ঘরে যাওয়া যায়। দরজার পাশেই রয়েছে ছোট্ট একটা জানালা। গাঢ়-কালচে কাঁচের কারণে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না।

পশ্চিম দিকে ফিরলো। আরো দুটো দরজা আছে। সাইন দেখে বুঝতে পারলো ওগুলো ওয়াশরুম, নারী-পুরুষ দু-জনের জন্যেই। খুট করে শব্দ হতেই চমকে তাকালো সে। তার পেছনে, ঠিক ডানদিকে এক লোক দাঁড়িয়ে। আছে। ওয়েটার হাতে খাবারের মেনু না থাকলে একজন কাস্টমার হিসেবেও ভুল হয়ে যেতে পারতো।

 “মেনু দিয়ে গেলাম,” বললো ছেলেটা। “আপনি দেখুন। অর্ডার করার দরকার হলে আমি চলে আসবো।” আর কোনো কথা না বলে চলে গেলো সে।

এই ওয়েটার কিভাবে বুঝবে কখন আমার অর্ডার করার দরকার হবে? ভাবলো সে। আজব। মেনুর দিকে চোখ গেলো। অন্যসব রেসটুরেন্টের মতো আইটেমের বাহূল্য নেই, তবে যে নামগুলো দেখতে পাচ্ছে তার বেশিরভাগই অপরিচিত। সম্ভবত, পরিচিত খাবারগুলোর নতুন করে নামকরণ করেছে এরা। মেনুতে কিছু আইটেম আলাদা করে চিহ্নিত করা আছে মুশকান’স স্পেশাল হিসেবে।

মুশকান’স কারি।
মুশকান’স সিক্রেসি!
মুশকান’স স্যুপ অব লাইফ!
মুশকান’স হাইব্রিড ক্র্যামচপ!
মুশকান’স গোল্ডেন ড্রিঙ্কস!
মুশকান’স জাস্ট টি!

মুশকান জিনিসটা কি? এটা কি কোনো আরবী-পার্সিয়ান খাবারের নাম? যেমন লেবানিজশওয়ার্মা?

সে বুঝতে পারলো এই রেসটুরেন্টটি রহস্য সৃষ্টি করতে, রহস্য বানাতে পারঙ্গম, আর সেটা প্রকাশ করতে একেবারেই অকপট। রহস্য? আমি সেটা ভেদ করতেই এসেছি, মনে মনে বললো সে। মেনু থেকে চোখ সরিয়ে আশেপাশে তাকালো। ওয়েটারের কোনো দেখা নেই। এতো বড় রেসটুরেন্ট অথচ একজনমাত্র ওয়েটার! তাও আবার ভুতের মতো নাজেল হয়, চোখের সামনে থাকে না।

উত্তর দিকে দরজা খুলে সেই ওয়েটারকে বের হয়ে আসতে দেখলো সে। তার কাছে এসে বললো, “জি, স্যার বলেন?”

“আমি লম্বা জার্নি করে এসেছি..পেট ভরে খেতে পারি এরকম কি খাওয়া যেতে পারে? তোমাদের মেনু দেখে তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

ওয়েটারের মুখে কোনো হাসি নেই, বরং কাস্টমারের কথা শুনে কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছে মনে হলো। “আপনি ভাত-মাংস কিংবা ফিশ কারি নিতে পারেন, সাথে স্পেশাল কিছু?” “স্পেশাল মানে মুশকান’স জাতীয় কিছু?”।

তার কথার মধ্যে যে শ্লেষ আছে সেটা ওয়েটারকে রুষ্ট করলো। “জি, সেরকমই কিছু।” কাটাকাটাভাবে বললো সে।

“এই মুশকান জিনিসটা কি? অ্যারাবিয়ান নাকি পার্সিয়ান কুইজিন?”

ওয়েটার কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো কাস্টমারের দিকে। “আপনি আমাদের এখানে প্রথমবার এসেছেন, মনে হয়?” “হ্যাঁ।”

সৌজন্যমূলক হাসি দিলো ছেলেটি। “এটা একটা নাম, স্যার।

 “কিসের নাম?”

“আমাদের এই রেস্টুরেন্টের মালিকের নাম। উনিই আমাদের সব মেনু তৈরি করেছেন।”

“মেনু তৈরি করেছেন মানে?”

“উনি একজন শেফ…বলতে পারেন, খুবই অসাধারণ একজন শেফ।”

“ও,” মাথা নেড়ে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো কাস্টমার। এরকম প্রত্যন্ত জায়গায় একজন মহিলা রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে, সে নিজে আবার শেফ? অসাধারণ শেফ! “আচ্ছা, ভাতের সাথে তাহলে কি নিতে পারি?” চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। তার খিদে অসহ্য পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।

“মুশকান’স কারি নিতে পারেন? বিফ কারি?”

“তাহলে তাই দাও।”

 “ওকে, স্যার।”

ওয়েটার আর কিছু না বলে চলে যাচ্ছে দেখে সে অবাকই হলো।

 “শোনো?” পেছন থেকে ডাকলো তাকে।

ঘুরে দাঁড়ালো ছেলেটা। “জি?”

“সাথে ডাল কিংবা ভাজি দিলে ভালো হয়..তোমাদের মেনুতে ওরকম কিছু-”

“ডাল আর কয়েক ধরনের ভর্তা পাবেন, স্যার,” তার কথা শেষ করার আগেই ওয়েটার বললো। “ওগুলো আমরা রাইসের সাথে এমনিই দেই, তাই মেনুতে মেনশন করা থাকে না।”

“ও,” ভুরু কপালে তুলে বললো সে। “ঠিক আছে।”

“আপনার যা যা লাগবে বলবেন, সমস্যা নেই।” ওয়েটার সোজা চলে গেলো বন্ধ দরজাটার দিকে।

দূরে বসে থাকা তিনজন কাস্টমারের দিকে তাকালো সে। এরা নিশ্চয় একসঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে কোথাও। লোকগুলো এমন আয়েশ করে খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ খাবারের আস্বাদন করছে তারা। চুপচাপ খাচ্ছে আর একে অন্যের দিকে তাকিয়ে প্রশংসার দৃষ্টিতে ভাব বিনিময় করছে। ব্যাপারটা দেখার মতো। যেমন প্যান্টো মাইম করছে একেকজন! পোশাক আশাক দেখে মনে হচ্ছে বেশ শিক্ষিত আর ধনী, হাতের আঙুল চেটে চেটে খাওয়ার লোক নয় কোনোভাবেই কিন্তু এ মুহূর্তে তাই করছে!

অতো দূর থেকেও ঐ টেবিলের খাবারের সুস্বাদু গন্ধ তার নাকে এসে লাগছে। অদ্ভুত আর সম্মোহনী এক গন্ধ!

উঠে দাঁড়ালো সে। এইমাত্র অর্ডার দিয়েছে, নিশ্চয় খাবার আসতে কমপক্ষে দশ-পনেরো মিনিট লাগবে। ওয়েটারের গদাইলস্করি চালচলন দেখে তার মনে হচ্ছে আরো বেশিও লাগতে পারে। এই ফাঁকে ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসা দরকার।

তাহলে অদ্ভুত এই রেস্টুরেন্টের মালিক একজন মহিলা! ওয়াশরুমের দিকে যাওয়ার সময় মনে মনে বললো সে। এই অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটি তাকে আরো বেশি আগ্রহী করে তুললো।

সিজন করা মোটা মোটা বাঁশ দিয়ে তৈরি এর দেয়ালগুলো। দুটো বেসিন আর একটি ইউরিনাল প্যান। পাশের একটি দরজায় লাগানো সাইন। দেখে বুঝতে পারলো ওটা মহিলাদের জন্য নির্ধারিতা।

শার্টের স্লিভ গুটিয়ে বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফেললো। সামনের আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখলো সে। আজ সকালে শেভ করা হয় নি। একদিন শেভ না করলেই তার মুখের দাড়ি বেশ বেড়ে যায়। বিশ্রি দেখায় তাকে। অর্ধেকের বেশি দাড়ি-গোঁফ পেকে গেছে মধ্যবয়সের আগেই। ইদানীং নিজেকে আরেকটু কমবয়স্ক দেখানোর জন্য প্রতিদিন শেভ করে, তবে আজ সেটা করতে ভুলে গেছিলো।

ভেজা হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুলগুলো আচড়ে নিলো। সে কখনও চিরুনী ব্যবহার করে না। তার হাতের চিকন আঙুলগুলো চিরুণীর চেয়েও বেশি ভালো কাজ করে। আয়নায় তাকিয়ে দেখলো নিজেকে। ভেজা চুলে তাকে বেশি হ্যান্ডসাম লাগে!

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে টেবিলের কাছে ফিরে এসে অবাক হয়ে গেলো। এরইমধ্যে খাবার চলে এসেছে। ধোঁয়া উঠছে মুক্তার মতো সাদা-সাদা ভাত থেকে। মুশকান’স কারি থেকে বের হচ্ছে অজ্ঞাত আর প্রলুব্ধকর সেই গন্ধ। ডালের বাটিটাও চোখ এড়ালো না। চমৎকার রঙ! এরকম চমৎকার রঙের ডাল সে কখনও দেখে নি। ঠিক হলুদ নয়, আবার বাসন্তি রঙও বলা যায় না। ডালের মধ্যে ভেসে আছে ছোটো ছোটো লাল-সবুজ মরিচের ফালি!

চেয়ারে বসে পড়লো। একটা প্লেটে তিন ধরণের ভতা। সবগুলোই বলের আকৃতিতে। বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে এমনটিই দেখা যায় কিন্তু এখানে একটু ব্যতিক্রম আছে। ছোটো গলফ বলের মতো ভতার দলাগুলো তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

চোখ আর হাসিমুখটি বানানো হয়েছে দুটো লালচে দানা আর কেপসিকনের সরু-লম্বা একটি ফালি দিয়ে।

আনমনেই হেসে ফেললো। ক্ষিদের বায়না মেটাতে আর বেশি দেরি করলো না। ঝটপট খেতে শুরু করলো। খাবারগুলো তার গলা দিয়ে নেমে যাবার সময় বিমোহিত হয়ে গেলো এর স্বাদের কারণে।

দশ মিনিট পর আবিষ্কার করলো চারপাশের সবকিছু ভুলে সে শুধু খেয়েই যাচ্ছে। প্রচণ্ড খিদের সময় সব খাবারের স্বাদই ভালো লাগে কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হলো, যে খাবার মুখে পুরছে তা সত্যি অসাধারণ। সামান্য ভর্তা থেকে শুরু করে ডাল পর্যন্ত অসম্ভব সুস্বাদু। আর মুশকান’স কারির কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারলো না। সত্যি বলতে, এটা গরুর নাকি খাসির মাংস সেটা ধরতে গিয়ে হিমশিম খেলো। কার কাছ থেকে যেনো শুনেছিলো, ভালোভাবে রান্না করলে গরু আর খাসির মাংসের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। আরো অবাক হলো, গরুর মাংসে যে কটু একটা ঘ্রাণ থাকে সেটা নেই। সম্পূর্ণ নতুন একটি গন্ধ নাকে আসছে আর সেটা খাবারের রুচি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

যে খাবারগুলো দেয়া হয়েছিলো তার সবগুলো শেষ করে আঙুল চাটতে চাটতে আশেপাশে তাকালো। ওয়েটারকে দেখতে পাচ্ছে না। দূরের টেবিলে বসা তিনজন লোকের দিকে চোখ গেলো। এরা আবার নতুন করে। কিছু খাবারের অর্ডার দিয়েছে। তিনজনের মধ্যে দু-জনের স্বাস্থ্য বেশ ভালো। মোটাসোটা, দেখেই মনে হয় পেটুক। লোকগুলো চামচ দিয়ে কিছু একটা খাচ্ছে। মুখে থেকে বের করার সময় চামচটা এমনভাবে চেটে চেটে বের করছে যেনো খাবারের সামান্যতম অংশও চামচে রেখে দেবার কোনো ইচ্ছে তাদের নেই। সঙ্গে সঙ্গে নিজের আঙুল চাটা বন্ধ করে দিলো সে। বিব্রতকর একটি অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো চেহারায়। চোখ সরিয়ে নিতেই দেখতে পেলো তার টেবিলের উপর একটি সুপ আর একটি গ্লাস রাখা। একটু চমকে উঠলো। এগুলো কখন রেখে গেলো? অনেকদিন পর গা ছমছম করে উঠলো তার। এখানে ঢোকার আগেই বুঝতে পেরেছিলো জায়গাটা খুবই রহস্যজনক, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একদম ভুতুরে। কয়েক মুহূর্ত পর্যন্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুপ আর গ্লাসের দিকে। “স্যার?”

চমকে উঠে মুখ তুলে তাকালো। সেই ওয়েটার দাঁড়িয়ে আছে তার ডানপাশে।

“সুপটা খাওয়ার পর একটু বিরতি দিয়ে ড্রিঙ্কসটা নেবেন।”

অবাক হলো সে। এরা দেখি রীতিমতো চাপিয়ে দিচ্ছে কে কোন খাবার খাবে, কখন খাবে! “আমি তো এ দুটো অর্ডার দেই নি…” আস্তে করে বললো।

এই প্রথম মুচকি হাসলো ওয়েটার। “আপনার খাওয়া শেষ..তাই এ দুটো আইটেম নিয়ে এলাম। খেয়ে দেখবেন, অনেক ভালো লাগবে।”

“তোমাদের রেসটুরেন্টে কি সবাইকে এভাবে খাবার দেয়া হয়?”

ছেলেটা কিছু বললো না, অপেক্ষা করলো আরো কিছু শোনার জন্য।

“মনে কিছু করবে না, আমি আসলে সিরিয়াসলিই জানতে চাচ্ছি।”

“স্যার, প্রথমত আমরা এটাকে রেসটুরেন্ট বলি না। অতিথিশালা বলি। এখানকার কোথাও রেসটুরেন্ট শব্দটি পাবেন না আপনি।”

ভুরু কপালে তুললো শহূরে কাস্টমার। “সেজন্যেই না-চাইলেও অনেক আইটেম দেয়া হয়?”

“জি, স্যার,” ওয়েটার হাসিমুখে বললো। “মেহমানদারি না চাইলেও তাকে কিছু দেয়া যায়।”

“কিন্তু আমি কি খেতে চাই সেটা জানতে হবে না?”

“কাস্টমারের অর্ডার দেখে আমরা বাড়তি কিছু দিয়ে দেই। আমরা জানি কোনটার সাথে কি খেলে তৃপ্তি পাওয়া যায়। আর কিছু না বলে ওয়েটার চলে গেলো।

সশব্দে হাফ ছেড়ে সুপের বাটি থেকে এক চামচ সুপ নিয়ে মুখে দিলো। স্বাদের তীব্রতায় দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো তার। দারুণ!

পাঁচ মিনিট পর খালি সুপের বাটিটার দিকে তাকিয়ে এই প্রথম তার মনে প্রশ্ন জাগলো এটা কিসের সুপ? নিজে নিজে উত্তরটা জানার চেষ্টা করলো কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলো না। একটা ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত, এ জীবনে টাটকা সবুজ রঙের সুপ কখনও খায় নি।

এটা কি সুপ অব লাইফ? মেনুতে এরকম কিছু দেখেছিলো। হতে পারে। জীবনের রঙ তো সবুজই হওয়ার কথা। সম্ভবত রঙের কারণে সুপের এমন নামকরণ।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। কোমরের বেল্টটা একটু আলগা করে নিলে ভালো হয় কিনতু সেটা করতে ইচ্ছে করছে না। এরকম কাজ অন্য কাউকে করতে দেখলে তার হাসি পায়। পর পর তিনটি ঢেকুর উঠলো এবার। তৃপ্তির ঢেকুর। টের পাচ্ছে তার শরীরটা কেমন রিল্যাক্স হয়ে গেছে। ভ্রমণের ক্লান্তি কোথায় উড়ে গেছে কে জানে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। ভর দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস তার নেই কিন্তু আজ খুব ইচ্ছে করছে। আরো দু তিনটি ঢেকুর দেবার পর ড্রিঙ্কসের গ্লাসটা হাতে তুলে নিলো। সাদা। চিনেমাটির গ্লাস বলে ড্রিঙ্কসের রঙটা এতোক্ষণ চোখে পড়ে নি। গাঢ় সোনালি রঙের ড্রিঙ্কস দেখে আরেকবার বিস্মিত হলো সে।

গোল্ডেন পন্ড ড্রিঙ্কস! মেনুতে এটাই তো লেখা ছিলো? বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে চুমুক দিলো ড্রিঙ্কসে। আবারো বিস্মিত হলো। এ জীবনে ঝাল, টক আর মিষ্টির মিশ্রনে কোনো ড্রিঙ্কস সে পান করে নি। সম্ভবত, বিভিন্ন ধরণের মসলাও দেয়া হয়েছে এতে। সব মিলিয়ে যে রাসায়নিক মিশ্রণটি তৈরি হয়েছে সেটা অজ্ঞাত, অব্যাখ্যাত। কিন্তু স্বর্গীয় স্বাদের।

খালি গ্লাসটি রেখে দিলো। অনুভব করলো সারা শরীরে এক ধরণের শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগার একটি অনুভূতি। কেমন ঘোরলাগা এক আবেশে বসে রইলো মিনিটের পর মিনিট। সম্বিত ফিরে পেতেই চারপাশে তাকালো। কেউ নেই। যে তিনজন লোক দূরের টেবিলে বসে খাচ্ছিলো তারা চলে গেছে কখন টেরই পায় নি।

উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো সে। তার মধ্যে দেখা দিলো অস্থিরতা। “স্যার?”

চমকে উঠে পেছনের দিকে তাকালো। তার পেছন দিকে ডানপাশে ওয়েটার দাঁড়িয়ে আছে।

“আর কিছু খাবেন?”

 “না।” ঢোক গিলে আবার বললো, “বিলটা নিয়ে-”।

তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বিলটা টেবিলের উপর রেখে দিলো ওয়েটার। বিল দেখে অবাক হলো সে। মহাসড়কের পাশে রেসটুরেন্টগুলো ক্রেতাদের গলাকাটার জন্য কসাইর মতো ধারালো চাকু নিয়ে বসে থাকে, সেদিক থেকে দেখলে রবীন্দ্রনাথ বেশ ব্যতিক্রম।

তিনটা একশ’ টাকার নোট বের করে ওয়েটারের হাতে ধরিয়ে দিলো। “বাকি টাকা ফেরত দিতে হবে না। ওটা ভোমার বখশিস৷”

_ “সরি স্যার,” নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো ছেলেটি, যার বয়স পঁচিশের বেশি হবে না। “আমরা টিপস নেই না।”

“কি?” আবারো অবাক হলো সে। টিপস নেয় না? পাগল নাকি?

 “এখানে ওয়েটারদেরকে টিপস দেয়া নিষেধ।”

চারপাশে চোখ বুলালো। “কেউ তো দেখছে না, রেখে দাও।” বলেই চোখ টিপে দিলো সে।

আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলো ওয়েটার।

 “আজব জায়গা!” অস্ফুটস্বরে কথাটা বের হয়ে গেলো তার মুখ দিয়ে। উঠে দাঁড়ালো সে। অনেকদিন পর পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেয়েছে। দেহমনে অলস একটি ভাব চলে এসেছে এখন। তার মনে হচ্ছে আর কিছু করার আগে একচোট ঘুমিয়ে নিতে হবে। দরজা দিয়ে যে-ই না বের হয়ে যাবে অমনি পেছন থেকে সেই ওয়েটার তাকে ডাকলো।

“স্যার?”

ঘুরে তাকাতেই টাকাগুলো বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। “তোমাদের খাবার কিন্তু সত্যি অসাধারণ,” বললো সে।

আলতো করে হাসলো ওয়েটার, যেনো এ-রকম প্রশংসা শুনে শুনে বহু আগেই তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

টাকাগুলো হাতে নিয়ে বললো, “অনেকদিন পর ভালো স্বাদের খাবার খেলাম।”

“থ্যাঙ্কস, স্যার,” সৌজন্যবশত বললো ছেলেটি।

“আমাকে না, তোমাদের মালিককে থ্যাঙ্কস জানিয়ে দিও আমার তরফ থেকে।”

“জি, স্যার। অবশ্যই জানিয়ে দেবো।”

থুতনীর নিচে চুলকে নিলো সে। “উনার পুরো নাম কি?”

ওয়েটার একটু চুপ থেকে বললো, “মুশকান জুবরি।”

“উনি কি এখানকার স্থানীয়?”

“এটা আমি জানি না, স্যার।” কথাটা বলেই চলে গেলো ওয়েটার।

পেছনের পকেটে মানিব্যাগটা ঢুকিয়ে নিলো সে। বুঝতে পারছে, তাকে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কারো সাথে কথা বলার সময়!

.

অধ্যায় ১

সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগেই রাস্তার ওপারে জ্বলজ্বল করে উঠলো। রবীন্দ্রনাথ।

 “ওয়াক থু!” সাইনটার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে থুতু ফেললো রহমান মিয়া। যেনো বুকের ভেতরে দলাপাকানো ঘৃণা বেরিয়ে এলো।

“কিমিয়া, কারে থুতু মারলা?”

রহমান দেখলো ভুতের মতো কোত্থেকে যেনো হাজির হয়েছে অতিপরিচিত এক কাস্টমার। লোকটার মুখে দুষটুহাসি লেগে রয়েছে। ভরসন্ধ্যায় এর মতো কাস্টমার পেয়ে মোটেও খুশি হতে পারলো না। “কারে আবার মারুম…আজাইরা কথা..মুখে থুতু আইছিলো ফালায়া দিলাম,” বিরক্ত হয়েই বললো দোকানি।

“ঐ ডাইনিটার উপরে চেইতা আছে, জানি তো,” গুলখাওয়া লালচে দাঁত বের করে বললো কাস্টমার। “এহন তো আমি ছাড়া কেউ তোমার গুড়ের চা খায় না। খালি বিড়ি-সিগরেট বেইচা কি চলে।” আবারো লালচে দাঁতগুলো বিকশিত হলো।

গুড়ের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো রহমান, কথাগুলো যেনো আমলেই নিলো না।

“গুড় ইটটু বাড়ায়া দিও..তুমি কইলাম দিন দিন কিপ্টা হইয়া যাইতাছো। মিয়া…গুড় দিবারই চাও না। পারলে গরম পানি গুলায়া খাওয়াইয়া দিবার চাও।”

একমাত্র কাস্টমারের দিকে চকিতে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিলো রহমান। “এতো মিষ্টি খাইলে ডাইবিটিস হইবো।”

 “ঐসব বড়লোকি রোগ আমাগো হইবো না।”

“রোগশোক কি বড়লোক-ছোটোলোক দেহে নি,” রহমান মিয়া চায়ে গুড় মেশাতে মেশাতে বললো।

“দেহে না তো কি,” তর্ক জুড়ে দেবার জন্য বললো কাস্টমার। “এই ধরো-”

“বেনসন আছে?”

কাস্টমারে কথা থেমে গেলো। রহমান মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ভদ্রগোছের এক লোক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মাঝারি উচ্চতা, পরিপাটি পোশাক, চোখেমুখে কেমন খবরদারি করার ভঙ্গি। দেখেই বোঝা যায় শহর থেকে এসেছে। মুখটা চেনা চেনা লাগলো। হূম, তার মনে পড়েছে। সম্ভবত কয়েক ঘণ্টা আগে এই লোককেই দেখেছে ঐ হোটেলে ঢুকতে হলুদ রঙের ট্যাক্সিতে করে এসেছিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখছিলো হোটেলটি। খেয়েদেয়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছিলো তখন দেখেছে লোকটার মুখে কেমন তৃপ্তির আভা লেগে রয়েছে। ওখান থেকে বের হওয়া সব কাস্টমারেরই একই অবস্থা হয়। এ আর নতুন কি। কয়েক বছর ধরেই তো দেখছে এ দৃশ্য।

“আছে,” ছোট্ট করে বললো দোকানি।

“এক প্যাকেট দিন।”

রহমান মিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। রবীন্দ্রনাথের ঠিক পঞ্চাশ গজ দূরে রাস্তার ওপারে ছোট্ট একটি চা-বিস্কুটের টঙের মালিক। বড় আর ক্ষমতাবানের সামনে দুর্বল-গরীবেরা যেমন কুঁকড়ে থাকে, তেমনি তার টঙ দোকাটিও কাচুমাচু হয়ে মাথা নুইয়ে থাকে সব সময়, যদিও বয়সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কয়েক বছরের বড়!

ওই রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়েদেয়ে যারা বের হয় তারা এতোটাই তৃপ্ত থাকে যে, খুব কম সময়ই তার দোকানে এসে চা-সিগারেট খায়, এক প্যাকেট বেনসন-ফাইভ-ফাইভ চাওয়া তো দূরের কথা। তাই সিগারেটের কার্টন থেকে প্যাকেটটা বের করতে করতে মনে মনে লাভের হিসেবটা না করে পারলো না সে। অঙ্কটা খুব সহজ-প্রতিটি সিগারেটে যদি এক টাকা লাভ হয় তাহলে এক প্যাকেটে পুরো বিশ টাকা।

নতুন কাস্টমার, যে কিনা একটু আগে রবীন্দ্রনাথে এসেছিলো, প্যাকেটটা হাতে নিয়েই একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললো। আরেক কাপ চা। বিক্রি হবার সম্ভাবনা দেখতে পেলো রহমান। লোকটার তীক্ষ্ণণদৃষ্টি আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দোকানের সামনে দুটো কাঠের বেঞ্চের একটাতে বসে আছে একটু আগে আসা হ্যাংলা মতোন লুঙ্গি পরা মাঝবয়সী কাস্টমার, তাকেও চকিতে দেখে নিলো সে।

“রঙচা হবে?”

 “হইবো।”

 “এক কাপ দিন। চিনি কম।” বেঞ্চে বসে পড়লো সে।

“গুড়ের চা দেই? এক্কেবারে খাঁটি গুড়…কুনো ভেজাল নাই।”

রহমান মিয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো নতুন কাস্টমার।

লুঙ্গি পরা কাস্টমারে দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলো দোকানি। “লও”

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সিগারেট খেতে থাকা ভদ্রলোককে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেপে নিলো সে। সশব্দে চুমুক দিলেও তার চোখ এক মুহূর্তের জন্যেও সরছে না নতুন কাস্টমারের উপর থেকে।

রহমান মিয়া এবার আরেক কাপ গুড়ের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এমন সময় টঙ দোকানের পাশ ঘেষে একটি সাদা প্রাইভেটকার চলে গেলো রবীন্দ্রনাথের দিকে।

“এসপিসাব আইছে মনে হয়, প্রথম কাস্টমার বললেও রহমান কোনো জবাব দিলো না। “আইজ তো বিসুদবার…পুরা হাট বইসা যাইবো। এমপি সাবেও আইছে হুনলাম। মনে হয় ডাইরেক্ট ঐ বাড়িতে গেছে,” সশব্দে চায়ে চুমুক দিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো হ্যাংলা।

রহমান মিয়া চা বানাতে বানাতে বললো, “সব খবরই দেহি থাকে তুমার কাছে।”

কথাটা আমলে নিলো না হ্যাংলা, নতুন কাস্টমারের দিকে মনোযোগ দিলো। “ভাইজান কি নতুন আইছেন এইহানে?”

“হুম,” সিগারেটে টান দিয়ে বললো সে। রবীন্দ্রনাথের সামনে পার্ক করা। গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে এখনও।

“আপনেরে দেইখাই বুঝছি ক্যান আইছেন৷” লুঙ্গি পরা লোকটি হেসে বললো।

হ্যাংলার দিকে ভুরু কুচকে তাকালে শহূরে লোকটি। একটু অবাকই হলো যেনো। “কেন এসেছি?”

“ঐ হোটেলে খাইতে আইছেন।” হ্যাংলা তার হলদে দাঁত বের করেই রেখেছে, বন্ধ করার নাম নেই।

কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে অভিব্যক্তি বদলে গেলো তার, মুচকি হেসে মাথা দোলালো। “না। অন্য একটা কাজে এসেছি।”

 “ও” হলদে দাঁতগুলো আড়ালে চলে গেলো। “তয় একবার ওইখানে গিয়া টেস্ট কইরা আইতে পারেন…অনেক দূর থেইকা লোকজন আসে খাইতে। মেলা নাম-ডাক।”

“উনি ওইখানে খাইছেন, তোমারে আর কইতে হইবো না,” শহুরে কাস্টমারের দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে লুঙ্গি পরা লোকটিকে বললো। রহমান। “অইন্যের তল না পিটায়া নিজের ঢোল পিটাও।”

হ্যাংলা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকালো দোকানির দিকে, কী বলবে কথা খুঁজতে লাগলো।

চায়ের কাপটা নিয়ে দোকানির দিকে তাকালো শহূরে কাস্টমার। দুপুরের পর যে এখানে এসেছিলো তা এই দোকানি দেখেছে। মহাসড়কের পাশে নিরিবিলি জায়গায় ছোট্ট একটি টঙ দোকান, দেখেই বোঝা যায় দিনের বেশিরভাগ সময় আক্ষরিক অর্থেই মাছি মারে এই লোক। তার উনমুক্ত গুড়ের চাকতির উপরে এখনও ভনভন করে কিছু মাছি ঘোরাফেরা করছে আর সে অভ্যাসবশত বার বার হাত নেড়ে তাড়াচ্ছে ওগুলো। এমন লোকের আগ্রহ যে সামনের রেসটুরেন্টের দিকেই বেশি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।

 “হুম। লোকজনের মুখে শুনেছিলাম ওখানকার খাবার নাকি খুব ভালো। কিনতু আমার কাছে তেমন ভালো লাগে নি,” গুড়ের চায়ে চুমুক দেবার আগে বললো সে।

লুঙ্গি পরা কাস্টমারের মতো দোকানিও অবাক হলো কথাটা শুনে। এখন পর্যন্ত কেউ এরকম কথা বলে নি। ঐ ডাইনিটার শত্রুরাও এ কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করে।

 “কি কন?” বিস্মিত কাস্টমার বললো। “ওইখানকার খাওন খাইতে কতো দূর থেইকা লোকজন আসে…কতো নামডাক…আর আপনে কইতাছেন ভালা লাগে নাই!”

 “আরে মিয়া, উনার ভালা না লাগলেও কি কইতে হইবো ভালা লাগছে?” রহমান কিছুটা মেজাজের সাথেই বললো। “খাওন-দাওনের ব্যাপার..সব খাওন সবার ভাল লাগে এ কথা ঠুনছো কুনোদিন?”

 “না, মাইনে,” লোকটার বিস্ময় এখনও কাটছে না, “কেউ তো খারাপ কয় না।”

“কয় না আবার কি? এই যে উনি কইলেন এহন।”

“আমার যে খুব খারাপ লেগেছে তা নয়,” বললো শহুরে লোকটি। “আসলে যে-রকম নামডাক শুনেছি খাবার খেয়ে সে-রকম মনে হয় নি। এই আর কি।”

“আপনে নিজে খাইছেন, আপনে কইতেই পারেন ভালমন্দ। কেউ তো আর অন্যের মুখে খায় না, কি ক?”

মুচকি হাসলো সে। এই দোকানি ঠিকই বলেছে। কেউই অন্যের মুখে খায় না।

“খাওন ভালা লাগে নাই ক্যান আপনের?” হ্যাংলা জানতে চাইলো।

“আমার মনে হয়েছে ওখানকার খাবারের চেয়ে ভাবই বেশি। আর এটাই মানুষকে মুগ্ধ করে।”

“এক্কেবারে ঠিক কইছেন,” রহমান মিয়া বললো। “ভাব দেখেন …দিছে। ভাতের হোটেল আর নাম রাখছে রবিঠাকুর!”

মুচকি হাসলো সে।

“রবিঠাকুর না…রবীন্দনাথ এইহানে কুনোদিন খাইতে আসেন নাই!” দোকানির ভুল শুধূরে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো হ্যাংলা মতোন লোকটি।

“ঐ ব্যাটা কবে মইরা ভূত…সে ক্যান এইহানে খাইতে আইবো?”

 “আরে মিয়া আসে নাই দেইখাই তো ইমুন নাম রাখছে।”

“যত্তোসব বুজরুকি।”

 “চ্যাতে ক্যান, মিয়া? আরে একটু ইস্টাইল করছে, বুঝো না?”

“ইস্টাইল না ছাই,” বিরক্ত হয়ে বললো রহমান। “ভাব লইছে।”

“ইসটাইল মাইনে তো ভাব লওয়াই। হে তো তোমার মতো মুকখু-শুকখু মানুষ না। বিরাট শিক্ষিত। দেমাগে মাটিতে পা ফালায় না। তার উপরে জমিদারের বৌ…একটু ভাব লইবারই পারে।”

“অ্যাতো শিক্ষিত হইলে ভাতের হোটেল খুলছে ক্যান, অ্যাঁ?” রহমান রেগেমেগে বললো। “আর জমিদারের বৌ হে কেমনে অয়? জমিদারের কুনো ঠিক-ঠিকানা নাই বৌ আয়া নাড় গাঁড়ছে এই সুন্দরপুরে!”

“রহমান মিয়া, আস্তে কও, ঐ বেটির কানে গেলে তোমার টঙ চাঙ্গে উঠায়া দিবো,” হ্যাংলা বললো ইঙ্গিতপূর্ণভাবে। “হের ঘাটে কইলাম বাঘে মহিষে একলগে খানা খায়। একটু আগে একটা মহিষ আইছে,” কথাটা বলেই চোখ টিপে চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। “যাই, মহিষটার লগে একটু দেখা কইরা আসি। চায়ের দামটা লেইখা রাইখো।”

 “ইতরের বাচ্চা!” আতর আলী রাস্তার দিকে পা বাড়াতেই তিক্তমুখে অসফুটস্বরে বলে উঠলো রহমান।

“কিছু কইলা নাকি, মিয়া?” পেছন ফিরে বললো আতর।

“না। তুমারে না…কইলাম পিপড়ার বাচ্চা! ধুর, অ্যাতো পিপড়া ক্যান গুড়ের মইদ্যে?” সত্যি সত্যি গুড় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে চায়ের দোকানি।

বাঁকা হাসি হেসে হ্যাংলা চলে গেলো রবীন্দ্রনাথের দিকে।

“কাম-কাইজ কিছু করে না, খালি মাইনষের খবর নিয়া থাকে,” গজগজ করতে করতে বললো রহমান। “হাদে কি সবতে কয় বিবিচি।”

“বিবিচি মানে?” চায়ে চুমুক দিয়ে বললো শহুরে লোকটি।

“ঐযে রেডিওর খবর আছে না, বিবিচি?”

“ও,” বুঝতে পারলো সে। সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কাপটা রেখে উঠে। দাঁড়ালো। “কতো হয়েছে আমার?”

“একশ ষাইট।”

পকেট থেকে দুশ’ টাকা বের করে বাড়িয়ে দিলো দোকানির দিকে। নোট দুটো হাতে নিয়ে রহমান বললো, “হালায় কুনো কাম-কাইজ করে না, পুলিশের ইনফর্মার, বুঝলেন?”

 “হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো কাস্টমার।

“দুনিয়ার সব খবর রাখে ইতরের বাচ্চা…এইহানে কুন লোকের পাছায় খাজলি আছে তাও হে জানে!”

মুচকি হেসে ভাঙতি টাকাগুলো পকেটে ভরে সে আবারো পা বাড়ালো রবীন্দ্রনাথের দিকে।

রহমান মিয়া সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “মুখে তো কইলো খাওন ভালা না…এহন দেহি ওইদিকেই যায়! মাইষে কী আর হাদে কয়, ঐ বেটি সবৃতেরে জাদু কইরা ফালায়!”

.

অধ্যায় ২

রবীন্দ্রনাথের বড় দরজাটা দিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে যে-ই না দেখলো এসপিসাব নেই সঙ্গে সঙ্গে আতরের ঠোঁটে লম্পটমার্কা হাসি ফুটে উঠলো।

ছ্যাদা পাইলে ব্যাটামানুষের হুঁশ থাকে না। খালি ছ্যাদার মইদ্যে হান্দাইতে চায়!

সেই হাসি মুখে লাগিয়ে রেখেই বাইরে পার্ক করা এসপির গাড়ির সামনে চলে গেলো সে। এসপি’র ড্রাইভার গান শুনছে, তার সাথে কথা বলতে গেলে সুবিধা করতে পারলো না। আতরের সালামের জবাবে বিরক্তমুখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মুসলমান হয়ে আরেক মুসলমানের সালাম নেয়াটা ফরজ, কিন্তু এই ফরজ কাজটা বাদ দিয়ে হারামজাদা হিন্দিগান শুনতেই বেশি মনোযোগী। চুতমারানির পোলা, মনে মনে গালিটা দিয়ে যেই না কয়েক পা বাড়িয়েছে অমনি থমকে দাঁড়ালো সে।

“আতর আলী?”

পেছন থেকে কেউ তার নাম ধরে ডেকেছে। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো একটু আগে রহমান মিয়ার টঙের সেই কাস্টমারকে। লোকটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো আতর।

“আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?” শহুরে কাস্টমার ভদ্রভাবে বললো তাকে।

 “কন, কি কইবেন।”

“কোথাও গিয়ে একটু বসি?”

অবাক হলো ইনফর্মার। তবে এরকম ঘটনা তার জন্য একেবারে বিরল নয়। মাঝে-মধ্যেই অচেনা লোকজন তার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে চায়, কিছু ইনফর্মেশন জানতে চায়। অনেকে আবার নিষিদ্ধ জিনিসপত্রের খোঁজও করে। “চলেন, ঐ টঙ দোকানেই যাই,” রহমান মিয়ার দোকানটা দেখিয়ে বললো সে।

“ওখানে না, অন্য কোথাও।”

শহুরে কাস্টমারের দিকে ভালো করে তাকালো আতর। এই লোকটা কে হতে পারে? কি চায়? লোকাল থানার ইনফর্মার সে, কাউকে ভয় করে না। তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করলো।

 “তাইলে চলেন, পেট্রলপাম্পের লগে একটা বটগাছ আছে…ঐটার নীচে বইসা কথা কওয়া যাইবো। রহমান মিয়ার টঙে বইসা কথা কইলে বেবাকৃতে জাইন্যা যায়। বুইড়ার আবার যার-তার লগে প্যাচাল পাড়নের স্বভাব।”

আতর এগিয়ে গেলো রবীন্দ্রনাথের বামপাশে বিশাল পেট্রলপাম্পের দিকে, তাকে অনুসরণ করলো শহরের লোকটি। পাম্পের ঠিক বিশ-ত্রিশ গজ দূরে একটি বিশাল বটগাছ, সেটার চারপাশ গোল করে ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো একটি চত্বর।

“বসেন,” শানবাঁধানো বটের নীচে বসে বললো আতর আলী।

শহূরে লোকটি সিগারেট ফেলে পা দিয়ে পিষে বসে পড়লো।

“কন, কি কইবেন?”

ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করলে আতরের চোখে সেটা এড়ালো না। “উমম…ঐ রেস্টুরেন্টের মালিক সম্পর্কে কিছু জানতে চাইছি…আমার ধারণা আপনার চেয়ে বেশি এ-ব্যাপারে কেউ খবর রাখে না।”

ভুরু কুচকে ফেললো সে। প্রশংসা তাকে বিগলিত করতে পারলো না। “আপনে কে, ভাই?”

চুপ মেরে রইলোশহুরে লোকটি।

“সাম্বাদিক?” আন্দাজ করে বললো ইনফর্মার।

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো ভদ্রলোক, যেনো অনিচ্ছায় স্বীকার করতে হচ্ছে পরিচয়টা।

“আমি আগেই বুঝবার পারছিলাম,” তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। আতরের মুখে। টিভির না পেপারের?”

“উমমম…পেপারের।”

“কুন পেপারের?”

“মহাকাল।”

আতরের চোখেমুখে সশ্রম ফুটে উঠলো এবার। “আচ্ছা…” একটু ভেবে বললো, “ঐ বেটির খবর জানবার চান?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো শহূরে লোকটি।

“আপনের নাম কি?”

“নুরে ছফা।”

 “কি!” নামটা ধরতে পারলো না ইনফর্মার।

“নুরে ছফা,” একটু ধীরে আর জোরে বললো এবার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে একাধিকবার নিজের মান্ধাতা আমলের নামটা উচ্চারণ করতে হয়।

“ও।” আতরের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কখনও এমন অদ্ভুত নাম শোনে নি। “ঐ বেটির খবর দিয়া কি করবেন?”

নুরে ছফা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। “উনার হোটেল আর উনাকে নিয়ে একটা রিপোর্টিং করবো আমি কিন্তু ঐ মহিলা সম্পর্কে এই এলাকার লোকজন তেমন কিছুই জানে না। উনার হোটেলের লোকজন তো মুখই খোলে না কোনো ব্যাপারে। খুবই সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছি।”

বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সায় দিলো আতর। এই সাংবাদিক কেন ঐ হোটেলের খাবার পছন্দ না করলেও খেতে গেছিলো সেটা বুঝতে পারলো। “ওই হোটেলে যারা কাম করে তারা কেউই এই এলাকার না..জানবো। কেমনে, কন? সব বাইরের ডিসটিকের লোক।”

“কিন্তু এই এলাকায় যারা থাকে তারাও তো তেমন কিছু জানে না?”

“ঐ বেটি এইখানকার মানুষ না। কয়েক বছর আগে আইছে। সুন্দরপুরে। ওর হিস্টোরি মাইনুষে কেমনে জানবো?”

“তাহলে আপনিও কি খুব বেশি জানেন না?”

আতর একটু থতমত খেলো। “আরে কি কন, আমি জানুম না ক্যান?”

ছফা অপেক্ষা করলো, আরো কিছু শুনতে চায় সে।

“বেটির অনেক পাওয়ার, বুঝলেন? ডিসি, এসপি, ইউনও-টিএনও সবুতে হের পিছে পিছে ঘুরে। আর এমপিসাব তো হের ভাইরা হইয়া গেছে।”

“কেন?”

“ক্যান আবার…বেটি সবতেরে জাদু করছে!” কথাটা আতর এমনভাবে বললো যেনো সে এ-ব্যাপারে একদম নিশ্চিত, সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।

“জাদু?”

“হুম।” বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনফর্মার। “আমার তো মনে হয় এই বেটি মানুষই না..ডাইনি!”

“ডাইনি?”

“কইথেকা যে উইড়া আইছে, আল্লা-ই জানে।”

“উনি কোত্থেকে এসেছেন আপনারা কেউ জানেন না?” নুরে ছফাকে বিস্মিত দেখালো।

ঢোক গিললো আতর। “এইখানে আইছেন…কয়দিন থাকেন, সব জানবার পারবেন।”

“ঐ মহিলাকে ডাইনি বললেন কেন? উনি করেছেনটা কি?”

“বেটি জাদুটোনা কইরা এমন খাওন বানায় যে আপনে মুখে দিছেন তো শ্যাষ…বুঝলেন?”

 “শেষ মানে?” চোখেমুখে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললেও ছফা আসলে আগ্রহী হয়ে জানতে চাইছে।

“মাইনে, আপনে হের চক্করে পইড়া গেলেন। বার বার হের খাওন। খাইতে আইবেন…আপনেরে আইতেই হইবো।”

“ও,” নুরে ছফা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। “আমি ভেবেছিলাম মারাত্মক কিছুর কথা বলছেন। মানে, তার খাবার খেয়ে ক্ষতি-টতি হয়,” মুচকি হাসলো সে। “ভালো খাবারের জন্য মানুষ বার বার ছুটে আসতেই পারে..তাতে তো কোনো সমস্যা দেখছি না?”

“কি কন,” হতাশ দেখালো আতর আলীকে। “জাদুটোনা কইরা যে। খাওন বানায় সেই খাওন সমস্যা না?”

“আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না…যদি না খাবারের মধ্যে অন্য কিছু থাকে।”

“এই যে, অ্যাতোক্ষণে লাইনে আইছেন,” হেসে উঠলো ইনফর্মার। দু পা তুলে বসলো এবার। “খাওনের মইদ্যে যদি উল্টাপাল্টা কিছু না-ই মিশায় মানুষ ক্যান হিরোইনচি’র মতো নেশাখোর হইবো, কন?”

“উল্টাপাল্টা কিছু মেশায়?” আৎকে উঠলো নুরে ছফা। তার মনে পড়ে গেলো আজ সে ওখানে পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া করেছে।

বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সায় দিলো আতর।

“কি মেশায়?”

“সেইটা কেমনে কই তয় কিছু একটা তো করেই.” একটু থেমে গলাটা নীচু করে বললো, “কবুতর তো বশ করে আফিম দিয়া, হে কি দিয়া বশ করে কে জানে?”

একবার বলে ডাইনি আবার বলে আফিম মেশানোর কথা-ছফা বুঝতে পারলো এই লোক মুশকান জুবেরির ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। কবুতর আফিম দিয়ে বশ করা হয় মানে?” কৌতূহলি অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে জানতে চাইলো সে। “কবুতর তো এমনিতেই পোষ মানানো যায়..বশ করার জন্য আফিম মেশানোর দরকার হবে কেন? এরকম কথা জীবনেও শুনি নি।”

লালচে দাঁত বিকশিত হলো আতরের। “আপনে তাইলে জানেন না। কবুতর যারা পালে তারা কবুতরের খাওনের মইদ্যে ইটটুখানি আফিম মিশাইয়া দেয়, ঐ আফিম খাইয়া খাইয়া কবুতরের নিশা হইয়া যায়। কঠিন নিশা।”

“নিরীহ কবুতরকে আফিমের নেশা করিয়ে কী লাভ? আফিম তো সস্তা নয়, বেশ দামি।”

– “লাভ না হইলে কেউ ট্যাকা খরচ কইরা আফিম খাওয়াইবো?” একটু থেমে আবার বললো, “কেন আফিম মিশায় জানেন?” ছফার জবাবের অপেক্ষা না করেই বলতে লাগলো সে, “আফিমখোর কবুতরগুলা হাটে নিয়া বেইচা দেয়, তারপর যারা ঐসব কবুতর কিনা নেয় তারা খায় ধরা, বুঝলেন?”

“কিভাবে ধরা খায়?”

“ঐ কবুতরগুলা উড়াল দিয়া পুরান মালিকের কাছে চইলা আহে আফিমের টানে। তারপর ওইগুলারে আবার বেইচা দেয়, আবার উড়াল দিয়া ফিরা আহে আহে আর বেচে..লাভই লাভ…এক কবুতর দশবার বেচতে পারে হেরা।”

 “ও,” দারুণ বিস্মিত নুরে ছফা। “আপনার ধারণা ঐ রেস্টুরেন্টও একই কাজ করে?”

“কিছু একটা তো দেয়ই না দিলে মানুষ নিশাখোরগো মতোন ছুঁইটা আইতো না।”

“আপনি এতোটা নিশ্চিত হলেন কিভাবে? ঐ রেস্টুরেন্টের রান্না বান্নার খবর তো আপনার জানার কথা নয়?”

বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো আতরের ঠোঁটে। “তাইলে হূনেন, বেটির হোটেলে বাবুর্চির কাম করতে এক পোলা…হে আমারে কইছে, বেটি নাকি সব খাওনের মইদ্যে কী একটা মিশাইয়া দেয়।”

“কি মেশায়?” নড়েচড়ে উঠলো ছফা।

“এইটা তো ঐ পোলায়ও বাইর করতে পারে নাই” আশেপাশে তাকিয়ে এবার নীচকণ্ঠে বললো সে, “বুঝলেন, সব খাওন পাক করার সময় কী জানি একটা জিনিস মিশাইয়া দেয়। বেটি ওইগুলা বোতলে কইরা নিজের বাড়িতে রাখে। রান্দোনের আগে বোতলগুলা নিয়া আসে কর্মচারীরা। ওই বোতলে কি আছে কেউ কইবার পারে না। বাবুর্চি আমারে কইছে, বোতলের সিরাপগুলার জইন্যই খাওনগুলা এতো মজার হয়। এইটা দিয়া-ই সবতেরে জাদু কইরা ফালায়। বার বার ছুঁইটা আসে কাস্টমার।”

“কিন্তু আমি তো আজ খেয়েছি, আমার কাছে ভালো লাগে নি…দ্বিতীয়বার ওখানে গিয়ে খেতেও ইচ্ছে করছে না।”

একটু সন্দেহের চোখে তাকালো আতর। “ক কি?”

 “হুম। একদম সত্যি বলছি।”

“তাইলে আপনের কে আলাদা,” বলেই মুখ টিপে হাসলো।

 “আলাদা হবে কেন?”

“কিছু মনে কইরেন না…আপনে মনে হয় নিশা-পানি করেন,” কথাটা বলেই আবারো দাঁত বের করে হেসে উঠলো পুলিশের ইনফর্মার।

নুরে ছফা একটু থ বনে গেলেও বেশ শব্দ করে হাসলো। “হা-হা-হা।”

আতর আলী ভ্যাবাচ্যাকা খেলো একটু।

“আপনি লোকটা আসলেই খুব মজার। আপনার জ্ঞান-বুদ্ধির প্রশংসা। না করে পারছি না। আপনার অবজার্ভেশন ক্ষমতা মারাত্মক।”

এবার নিঃশব্দে হাসতে লাগলো ইনফর্মার।

 “একদম ঠিক ধরেছেন, আমার একটু বদঅভ্যাস আছে।”

“নিশা-পানি করলে জিব নষ্ট হইয়া যায়..তহন আর অন্য কিছু ভালা লাগে না,” কথাটা বলে একটু থেমে আবার বললো, “আপনে কি খান?”

 “তেমন কিছু না…এই ধরেন একটু গাঁজা-মদ।”

“আমি ইমুন সাম্বাদিক দেখি নাই যে এইসব জিনিস খায় না, একদম নিশ্চিত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো আতর। “সব সাম্বাদিকই গাঞ্জা-মদ খায়, বুঝলেন? এইগুলা না খাইলে হেরা কামই করতে পারে না।”

“সবাই খায় কিনা জানি না, আমি খাই। তবে এখানে আসার পর বিপদে পড়েছি…গাঁজা-মদ কিছু পাচ্ছি না।”

“আরে কী কন, এইলা কুনো ব্যাপার হইলো..এই আতররে খালি কইবেন, কয় মণ গাঞ্জা চান? কয় ডেরাম মদ লাগবো? চুটকি বাজামু আর সব হাজির হইয়া যাইবো।”

“আপনি এসবের কারবারও করেন নাকি?”

আতর লাজুক হাসি দিলো। “আমি করি না, তয় যারা করে তারা সবুতে আমারে বাও কইরা কাম করে..আমারে হাতে রাখে আর কি. আমার লগে এগোর হট টেরাম আছে।”

“তাহলে আপনি থাকতে এসব নিয়ে আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না মনে হচ্ছে।”

“খালি কইবেন, বান্দা জিনিস লইয়া হাজির হইবো।” একটু থেমে আবার বললো সে, “উঠছেন কুনখানে?”

“টাউনের হোটেলে।”

ভুরু কুচকালো আতর। “ঐযে সুরুত আলীর তিনতলার হোটেলে? সানমুনে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। এই টাউনে আবাসিক হোটেল ঐ একটাই।

“আর জায়গা পাইলেন না..সুরুত আলী তো ঐটারে খানকিপট্টি বানায়া রাখছে। সব ভুসকি মাগিগো আড্ডাখানা। আপনের মতো মানুষ কেমনে উঠলো ঐখানে?”

“আমি তো এখানকার তেমন কিছু চিনি না। এখানে আমার পরিচিত কেউ নেইও…ঐ হোটেলে না উঠে উপায় ছিলো না।”

“আচ্ছা, ওরা আপনার কাছ থিকা পার ডে কতো নিতাছে?”

“তিনশ”

আতরের ভুরু কপালে উঠে গেলো। “পুরা ডাকাইতি। ওইটা কি ফাইভস্টার নি…ওইখানকার রুমের ভাড়া তো দুইশ’ টাকা।”

“তাই নাকি?” নুরে ছফা কৃত্রিম বিস্ময়ের ভঙ্গি করলো।

 “ওরা আপনের গলা কাটতাছে। খাড়ান, আমি রাইতে গিয়া ফাপড় দিতাছি, দেখবেন ভাড়া কেমনে নাইমা আসে।”

নুরে ছফা কিছু বলতে গিয়েও বললো না।

 “কয়দিন থাকবেন ওইখানে?”

কটু ভাবলো সে। “তিন-চারদিন?”

“তিন-চাইরদিনে আপনের কাম হইয়া যাইবো?”

“আপনার মতো যোগ্য লোক পেলে হয়ে যাবে আশা করি।”

একটু বিগলিত হলো আতর। “কথাটা কওন ঠিক না, কিন্তু আপনে কইলাম আসল লোকের দেহা-ই পাইছেন।”

“আমারও তাই মনে হচ্ছে।”

“এইবার কন, কি জানবার চান?”

একটু গুছিয়ে নিলো নুরে ছফা। “ঐ মহিলা কোত্থেকে এসেছে, এখানে এরকম জায়গায় কেন এসেছে…এর পেছনে সত্যিকারের কারণ কি..তার রেস্টুরেন্টের খাবারগুলো কেন এতো সুস্বাদু হয়…এইসব।”

“আপনে না কইলেন হের খাওন আপনের ভালা লাগে নাই?” আতরের চোখেমুখে সন্দেহ।

“আমার ভালো লাগে নি তো কি হয়েছে, সবার তো লাগে..” একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে বললো সে।

“ঠিকই কইছেন।”

“আমি যে কয়দিন এখানে থাকবো আপনি আমাকে একটু হেল্প করবেন। চিন্তা করবেন না, এজন্যে আমি আপনাকে বখশিস দেবো।” টাকা না বলে বখশিস বললো ইচ্ছে করেই।

আতরের লালচে দাঁত বখশিসের কথায় আবারও বিকশিত হলো।

 “কিন্তু একটা শর্ত আছে৷” সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকালো ইনফর্মার।

“কি?”

“আমার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে পারবেন না। মানে আমি যে সাংবাদিক এটা-”

 “আরে, আমি আবার কারে কমু?” কথার মাঝখানে বলে উঠলো। “আমার কি খায়দায়া কাম নাই? এই আতর খামোখা পাবলিকের লগে কুনো বিষয়-আসয় নিয়া গপ মারে না।”

“আমি পাবলিকের কথা বলছি না।”

“তাইলে?”

“পুলিশের কথা বলছি।”

চুপ মেরে গেলো লোকটা।

“আমি জানি আপনি পুলিশের হয়ে কাজ করেন, নুরে ছফা ইনফর্মার শব্দটাও ব্যবহার করলো না। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশকে বলতে পারেন আমি কে, কেন এখানে এসেছি..” একটু থেমে আবার বললো, “কিন্তু এটা করলে পুলিশ আমাকে ডিস্টার্ব করতে পারে। বোঝেনই তো, ঐ মহিলার সাথে ওদের কেমন খাতির?”

হাত তুলে থামিয়ে দিলো ইনফর্মার। “আর কওন লাগবে না। এইটা আমার চায়া আর কে বেশি জানে…আপনে এইটা নিয়া টেনশনই কইরেন না। পুলিশ কিছু জানবার পারবো না।”

“কিনতু তারা যদি আমার ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে কিছু জানতে চায় তখন কী বলবেন?”

একটু ভেবে নিলো আতর। “এইটা এমন কঠিন কিছু না। আমি পুলিশরে কমু আপনে জমি কিনবার আইছেন। আমি আপনেরে হেল্প করতাছি।”

এবার নুরে ছফার মুখে হাসি দেখা গেলো। “বাহ, দারুণ তো। আপনি কি জমি-টমিও খুঁজে দেবার কাজ করেন নাকি?” জমির দালাল শব্দটিও ইচ্ছে করে বাদ দিলো সে।

বিনয়ী হাসি দেখা গেলো আতরের মুখে। “মাজেমইদ্যে এইটাও করতে অয়। কুনখানে কুন জমিটা মাইনষে বেইচবো এইটা আমার জানা থাকে। আপনে কইতে পারেন এইখানকার গেরাম আর টাউনে কেউ যদি ঘরের চিপায় ঢুইকা পাদও মারে এই আতর ঠিকই জানবার পারে। হের লাইগাই তো মাইনষে আমারে বিবিচি কয়।”

আতরের চোখেমুখে একধরণের গর্বিত ভাব দেখতে পেলো নুরে ছফা।

“কুন পোলায় কুন মাইয়ার লগে চকর চালাইতেছে তাও আতর জানে!”

নুরে ছফা মুচকি হাসি দিয়ে পকেট থেকে একশ’ টাকার একটি নোট বের করে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিলো। “এটা রাখুন। চা-সিগারেট খাবেন। কাল থেকে আমি আর আপনি একসাথে কাজ শুরু করবো। এরজন্য প্রতিদিন আপনি পাবেন পাঁচশ’ টাকা, ঠিক আছে?”

টাকাটা হাতে নিয়ে দাঁত বের করে হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনফর্মার। দুর্দিনের সময় এমন একজন লোক জুটে যাওয়াতে খুশিই হলো। কয়েকটা দিন নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। “ঠিক আছে, কাম হইবো। এই আতর আলী ট্যাকা-পয়সারে দাম দেয় না…দাম দেয় মিল-মহব্বতরে। আপনেরে আমার অনেক পসন্দ হইছে, এইটাই হইলো আসল কথা।”

 “আমারও আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আপনি আসলেই কাজের মানুষ। আমার মনে হয় না আর কারোর হেল্প দরকার হবে আমার।”

 “কেউ আপনেরে হেল্প করবো কেমনে? ওরা তো ঐ ডাইনির তিরি সীমানায়ও যাইতে পারে না।”

 “এখন বলুন, ঐ মহিলা কোত্থেকে এলো, কিভাবে এখানে এলো?”

আতর একটু গাল চুলকালো। “লম্বা কাহিনী..কইতে অনেক টাইম লাগবো..আমার তো অহন একটা কাম আছে..থানায় যাইতে হইবো…রাইতে। আপনের হোটেলে আইতাছি…তহন কমুনে?”

“ঠিক আছে।” একটু ভেবে নিলো ছফা। “আর ঐ বাবুর্চি ছেলেটার সাথে কি কথা বলা যাবে?”

“বেটি তো ঐ পোলারে কবেই চাকরি নট কইরা দিসে।”

 “বলেন কি?” অবাক হলো ছফা।

 “পোলাটা যে আমার লগে মিলামিশা করতো হেইটা মনে লয় বেটি বুইঝা গেছিলো।”

“ঐ মহিলা কিভাবে জানতে পারলো এটা? সে কি আপনাদেরকে একসাখে দেখেছিলো?”

“আরে না, আমাগো কুনোদিন দেখে নাই। তয়, আগেই কইছি..বেটি একটা ডাইনি…হে কেমনে জানি সব জাইনা যায়।”

“ও,” একটু আনমনা হয়ে গেলো ছফা।

 “আমি কইলাম এর আগেও আপনাগো লগে কাম করছি।”

“কি?” বুঝতে না পেরে বললো সে।

“সাম্বাদিকগো কথা কইতাছি।”

 “ও।”

 বিগলিত হাসি দিলো ইনফর্মার।

“আপনার মোবাইলফোন আছে না?”

“আছে একটা…তয় সুবিধার না, কাচুমাচু খেয়ে বললো সে।

 “বুঝলাম না?”

 “আমারে ফোন করন যায়…আমি কাউরে ফোন করতে পারি না।”

 ছফা বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো।

 “বুঝলেন না? ডিচপ্লে আন্ধার হইয়া গেছে।”

 “ও,” হেসে বললো ছফা।

 “সমস্যা নেই আমিই কল করবো। নাম্বারটা দিন।”

আতর আলী ফোন নাম্বারটা মুখস্ত বলে গেলে ছফা তার ফোনে সেভ করে রাখলো। “তাহলে রাতে কথা হবে। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।”

আতরকে বিদায় দিয়ে পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ধরালো সে। দীর্ঘ একটা টান দিয়ে তাকালো জ্বলজ্বল করতে থাকা রবীন্দ্রনাথের দিকে। চারপাশে ঘন অন্ধকারে লালচে আলোর একমাত্র সাইনটি কিছুক্ষণ পর পর কয়েক সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে নিভে যেতেই জ্বলে উঠছে আবার। এক রহস্যময়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে যেনো। সত্যি বলতে এমন অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টের কথা সে জীবনেও শোনে নি, আর এখন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে।

সিগারেটটা আর্ধেক শেষ হতেই ফেলে দিলো। হাত দিয়ে মাথার বিতস্ত্র চুলগুলো ঠিক করে পা বাড়ালো রবীন্দ্রনাথের দিকে।

.

অধ্যায় ৩

সন্ধ্যা সাতটার আগেই দ্বিতীয় বারের মতো রবীন্দ্রনাথে এলো সে।

অদভুত রেসটুরেন্টের সামনের খোলা প্রাঙ্গণে কমপক্ষে ছয়-সাতটি প্রাইভেটকার আর মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। ধীরপায়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো বসার মতো খালি কোনো আসন নেই। অবশ্য ভালো করে চোখ বোলানোর পর দূরে, বামদিকে একটি টেবিল খালি দেখতে পেলো। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো চারজন ওয়েটার দেখতে পাচ্ছে এখন। তারা সবাই শান্তশিষ্টভাবে টেবিল থেকে টেবিলে অর্ডার নিচ্ছে। নয়তো খাওয়া শেষে বিল দিচ্ছে কাস্টমারকে। দিনের বেলায় এরা কোথায় ছিলো? তখন মাত্র একজন ওয়েটারকে দেখেছে।

খালি আসনে বসেই টেবিল থেকে মেনুটা তুলে নিলো। আসলে মেনুর আইটেম নিয়ে তার মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই। এর আগে যা খেয়েছিলো তা ই খাবে আবার। সে তো এখানে মনভোলানো খাবার খেতে আসে নি, যদিও খাবারগুলো তাকে আকর্ষণ করছে।

“স্যার?” দুপুরের সেই ওয়েটার ছেলেটা এসে বললো।

 “দুপুরে যা খেয়েছিলাম তা-ই নিয়ে আসো,” সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার দিয়ে। দিলো সে।

“নতুন কিছু ট্রাই করবেন না?”

“নতুন?”

আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো ওয়েটার। “ডিনারের সময় নতুন কিছু আইটেম ট্রাই করে দেখতে পারেন…মানে ড্রিঙ্কস আইটেমটা বাদে অন্য কিছু?”

“যেমন?”

“আপনি চা কিংবা কফি নিতে পারেন?”

“তোমাদের চা-কফিও কি অসাধারণ হয় নাকি?”

ওয়েটার নির্বিকার রইলো। কাস্টমারের হাসির জবাবে সে একটুও হাসলো না। “এখানকার সবকিছুই অসাধারণ…এটা আমরা বলি না…মেহমানরা বলে।”

“গুড।” ভাবলো ব্যঙ্গাত্মক সুরে আর কথা বলা ঠিক হবে না। তাহলে তা-ই দাও।”

ওয়েটার চুপচাপ চলে গেলে আশেপাশে তাকালো সে। যথারীতি আয়েশ করে সুস্বাদু খাবার গলাধকরণ করা কাস্টমারে পরিপূর্ণ! আঙুল চাটার দৃশ্য আবারও দেখতে পেলো। এই রেস্টুরেন্টের সব কাস্টমার যেনো কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়ে খাবার খাচ্ছে। এই ঘোরের মধ্যে সে নিজেও পড়ে গেছিলো আজ।

একটু পরই টের পেলো ঘরের মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। এটা কোনো খাবারের গন্ধ নয়-অন্তত তার কাছে তাই মনে হচ্ছে। পারফিউম? হতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের প্রবেশপথে একটু শোরগোল হতেই সেদিকে তাকালো। দেখতে পেলো পাঁচ-ছয়জন লোক ঢুকে পড়ছে হুরমুর করে। তাদের মধ্যে স্পষ্টতই নেতাগোছের একজন আছে, তাকে ঘিরে রেখেছে বাকি চার পঁচজন। নেতার গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবি।

ঘরে কোনো টেবিল খালি নেই। সবগুলো দখল করে নিয়েছে ভোজনরসিক মেহমানের দল। নেতার চামচাঁদের চোখে এটা ধরা পড়লো খুব দ্রুত। ঘরের মাঝখানে এসে বিব্রত ভঙ্গিতে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো নেতা, বুঝতে পারছে না কী করবে। এখানকার প্রায় সব কাস্টমারই বাইরে থেকে এসেছে তাই তাকে দেখে কেউ চিনতে পারছে না, সম্মান দেখিয়ে উঠেও দাঁড়াচ্ছে না। একজন ক্ষমতাসীন রাজনীতিকের কাছে এরচেয়ে অসহনীয় ব্যাপার আর কী হতে পারে! বেচারা না পারছে মানুষজনকে খাওয়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে দিতে, না পারছে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে।

বেচারিকে মুক্তি দিলো একজন ওয়েটার। দৌড়ে এসে নীচুস্বরে কিছু একটা বললে নেতার কালোমুখটি উজ্জ্বল হয়ে গেলো মুহূর্তে। সঙ্গে থাকা লোকগুলোকে কিছু একটা বলে ওয়েটারকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের শেষমাথায় যে দরজা রয়েছে সেখানে চলে গেলো সে।

 “কোনো ভিআইপি এসেছে নাকি?” একটু পর ওয়েটার খাবার নিয়ে এলে স্বাভাবিক কৌতূহলে জানতে চাইলো ছফা।

“হুম। এখানকার এমপিসাহেব এসেছেন,” খাবার রাখতে রাখতে বললো ওয়েটার।

“তোমাদের মালিকের সাথে দেখা করতে এসেছে?”

সোজা হয়ে দাঁড়ালো ছেলেটা, মুচকি হেসে চলে গেলো।

আনমনে খাবার খেতে লাগলো নুরে ছফা। তার দৃষ্টি ঘরের এককোণে থাকা ঐ দরজার দিকে। ওখান দিয়েই এমপিসাহেব ঢুকে পড়েছে একটু আগে। সঙ্গে থাকা তার চ্যালা-চামুণ্ডারা অবশ্য বাইরে চলে গেছে।

খুবই আস্তে আস্তে খেতে শুরু করলো সে, আর কিছুক্ষণ পরই আবিষ্কার রলো ইচ্ছে করলেই সুস্বাদু খাবার ধীরে ধীরে খাওয়া যায় না। তবে সচেতনভাবেই আঙুল চাটার মতো অরুচিকর কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারলো এবার।

খাওয়া শেষে চুপ মেরে বসে রইলো। অনেক সতর্ক থাকার পরও টের পেলো তার চোখ বার বার চলে যাচ্ছে ঘরের শেষমাথায় প্রাইভেট রুমের দরজার দিকে। দরজা থেকে চোখ সরিয়ে খাবার খেতে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকালো। সবার মুখে এক ধরণের প্রশান্তি। আয়েশ করে খাবার খাচ্ছে। মানুষ যখন অসম্ভব মজাদার খাবার খায় তার মুখ এমনিতেই বন্ধ থাকে, কথা বলতে ইচ্ছে করে না। এরাও প্রায় নিঃশব্দে আহারে নিমগ্ন। তিন চারজনের দলবেঁধে যারা এসেছে কেবল তারাই একটু আধটু কথা বলছে।

মানুষের মন জয় করতে হলে তার পেট জয় করা চাই-নুরে ছফা বুঝতে পারলো, এই রেস্তোরাঁ ভালোভাবেই সেটা করতে পেরেছে। কিন্তু বিজয়িনীর দেখা পাচ্ছে না। সে জানে ঐ দরজার ওপাশেই আছে রহস্যময় সেই নারী।

আরো কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নুরে ছফা ঠিক করলো চলে যাবে। দূর থেকে ওয়েটারকে ইশারা করে বলে দিলো বিল নিয়ে আসার জন্য। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেলো ছেলেটা। এমন সময় তাকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এমপিসাহেব। বিরসমুখে চুপচাপ রবীন্দ্রনাথ থেকে চলে গেলো সে।

বিল নিয়ে ওয়েটার হাজির হলে ছফা প্রায় উদাস হয়েই পাঁচশ’ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিলো, যদিও তার দৃষ্টি মেইনগেটের দিকে। বড় বড় জানালা দিয়ে দেখতে পেলো দলবল নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছে সুন্দরপুরের এমপি। লোকটার চোখেমুখে যে অভিব্যক্তি দেখেছে তাতে নিশ্চিত করে বলা যায়, মুশকান জুবেরির সাথে স্থানীয় এমপির সাক্ষাৎকারটি সুখকর কিছু ছিলো না। ঝগড়া? মনোমালিন্য? নুরে ছফা অনুমাণ করার চেষ্টা করলো।

“স্যার।”

তাকিয়ে দেখলো ওয়েটার বাকি টাকা নিয়ে ফিরে এসেছে। ভাঙতি টাকাগুলো পকেটে ভরতে যাবে অমনি দেখতে পেলো ঐ দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে সেই রহস্যময়ী! এই প্রথম কাউকে দেখে তার বয়স আন্দাজ করতে পারলো না ছফা।

সাদা-লালের জামদানি শাড়ি, তার উপরে টকটকে লাল উলের লং কার্ডিগান। চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা, তাতে বেলি ফুলের মালা পেঁচানো। কপালে সিঁদুররঙা টিপ, চোখে দুর্দান্তভাবে কাজল দেয়া। ছফা কখনও এভাবে কাজল দিতে দেখে নি কোনো নারীকে। কাজলের টংটি তার চোখদুটোকে দান করেছে অপার্থিব এক ভঙ্গি।

এতোক্ষণ ধরে সুস্বাদু খাবারের ঘোরে ছিলো যারা তাদেরও ধ্যান ভাঙলো, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলো চোখধাঁধানো রূপ নিয়ে অভিজাত পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছে এক নারী।

ছফার টেবিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ করেই তাকালো সে। বড়জোর দুই সেকেন্ড। তারপর আবার চোখ নামিয়ে সোজা চলে গেলো মেইনগেটের দিকে। তার দৃষ্টি নিক্ষেপ এবং দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার মধ্যে অদ্ভুত একটি ভঙ্গিমা ছিলো।

কয়েক মুহূর্ত মন্ত্ৰতাড়িত হয়ে বসে রইলো ছফা। সে নিশ্চিত, মহিলা তার দিকে তাকানোর সময় অদ্ভুতভাবে হেসেছিলো। সেই হাসি এতোটাই ক্ষীণ যে ওটাকে ঠিক হাসি বললেও ভুল বলা হবে। কেবল ঠোঁটের একপ্রান্ত একটুখানি ঢেউ খেলে যাওয়া।

কিন্তু ছফা বুঝতে পারলো না এই হাসির মানে কী?

.

অধ্যায় ৪

রাত ন’টার পরই সুনসান হয়ে উঠলো সুন্দরপুর। স্থানীয় লোকজন গর্ব করে বলে টাউন, আদতে মফশ্বল শহর বললেও বেশি বলা হবে। এ যেনো বিশুদ্ধ একটি গ্রাম। সেই গ্রামের বুক চিড়ে মহাসড়ক চলে গেছে। সেই সড়কের দু পাশে গড়ে উঠেছে কিছু দোকানপাট। নিম্নমানের একটি আবাসিক হোটেল থাকলেও কোনো ব্যাঙ্ক কিংবা সরকারী দপ্তর নেই, আছে শুধু পল্লী বিদ্যুতের ছোটোখাটো একটি অফিস।

বিছানাঘেষা জানালার সামনে বসে কানে ফোন চেপে রেখেছে ছফা। নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছে বলে জানালার সামনে বসে কথা বলছে, তারপরও পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনবার লাইন কেটে গেছে, কথাবার্তাও মাঝেমধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে দুর্বল সিগন্যালের কারণে। দশ-বাই আট ফুটের একটি রুম। সিঙ্গেল খাট আর আমকাঠের টেবিল-চেয়ার রাখার পর খুব বেশি জায়গা নেই।

 “.কমপক্ষে সপ্তাহখানেক লাগতে পারে..তবে আমি শিওর না…” একটু জোরেই বললো সে। “…হোমরাচোমরা লোকজনের সাথে মহিলার খাতির…সাবধানে কাজ করতে হবে.. টের পেয়ে গেলে কাজটা করা কঠিন। হয়ে যাবে…” মুশকান জুবেরির সেই রহস্যময় চাহনির কথাটা মনে পড়ে গেলো তার। এরইমধ্যে কি মহিলা টের পেয়ে গেছে? অসম্ভব! সে এমন কিছু করে নি যে টের পেয়ে যাবে। এখানে নেটওয়ার্ক খুব খারাপ…আমি সময়। আর সুযোগ পেলে নিজেই ফোন করবো…ওকে?”

ঠিক এমন সময় কেউ তার দরজায় নক করলে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বলে উঠলো, “কে?”

“আমি আতর।”

দরজার ওপাশ থেকে কণ্ঠটা শোনামাত্র, “এখন রাখি পরে কথা হবে,” বলে দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে।

“আপনের পঞ্চাশ ট্যাকা সেভ কইরা দিলাম,” দাঁত বের করে বললো আতর। “এমুন ফাঁপড় মারছি যে পাতলা-পায়খানা শুরু কইরা দিছে ম্যানেজার।”

 “আরে, এটার তো কোনো দরকার ছিলো না, একটু বিরক্তির সাথে বলেই আতরকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। “বসেন।” ঘরের একমাত্র চেয়ারটা দেখিয়ে বললো সে। নিজে বসলো বিছানার উপর।

 “রাইতের খানা খাইছেন?”

“হ্যাঁ।”

ইনফর্মার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেও সেটা অশ্লীল দেখালো। “ওই বেটির ওইখানে?”

আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

 “হি-হি-হি,” দাঁত বের করে হাসলো ইনফর্মার।

ছফা কিছু বললো না।

“ভালা ভালা,” বুঝতে পারছে না হাসিটা কিভাবে থামাবে। প্রথমে শব্দহীন করলো তারপর অভিব্যক্তি পাল্টে বললো, “গাঞ্জা-মদ কিছু লাগবো নি?”

“না। আজ ইচ্ছা করছে না। লাগলে আমি জানাবো আপনাকে।”

“ঠিক আছে,” একটু হতাশ হয়ে বললো আতর। “তাইলে এহন আমার লগে চলেন, আপনেরে এক জায়গায় নিয়া যামু।”

অবাক হলো ছফা। “কোথায়?”

“আপনে তো হের ব্যাপারে অনেক কিছু জানবার চান…কইথেকা আইলো, কেমনে আইলো..না?”

“হ্যাঁ, কিন্তু…”

“জলদি আসেন, বুইড়া গেরামে ফিরা চাইছে। আবার কই যায় না-যায় তার কি কুনো ঠিক আছে।”

“কার কথা বলছেন?”

“গেলেই দেখবার পারবেন…আহেন তো।”

আর কিছু না বলে হাতঘড়িটা পরতে পরতে জানতে চাইলো সে, “এখানে মোবাইলে টাকা ভরা যাবে কোথায়? ব্যালান্স একেবারে শেষ হয়ে গেছে,” টেবিল থেকে মোবাইলফোনটা পকেটে ভরে নিলো।

“এই তো, ডিসপিন্সারিটার লগেই একটা আছে। চলেন, যাওনের সময় ভইরা নিয়েন।”

ছফা দরজা লাগিয়ে চুপচাপ বের হয়ে গেলো আতর আলীর সাথে। তার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকলেও কিছুই জানতে চাইলো না। তার দরকার তথ্য, আর সেটা পেতে হলে এই লোকটাকেই বেশি প্রয়োজন।

হোটেল থেকে বের হয়ে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে একটা ওষুধের দোকানের পাশের দোকান থেকে ব্যালান্স ভরে নিলো সে। ভাগ্য ভালো দোকানটা খোলা আছে। দোকানির সাথে আতর আলীর কথা-বার্তা শুনে। বোঝা গেলো ইনফর্মারের সাথে বেশ ভালো খাতির। পথে কোনো যানবাহন। নেই দেখে হেঁটেই রওনা দিলো তারা। আতরের ভাষায় তাদের গন্তব্য বেশি দূরে নয়। ছফা অবশ্য এ-কথায় খুব একটা আস্থা রাখতে পারছে না। গ্রামের লাকজনকে সে ভালো করেই চেনে। এরা সব সময় ‘তালগাছ’ দেখাবে!

সুনসান মহাসড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তারা। দূর থেকে একজোড়া হেডলাইট দেখা গেলো। কোনো বাস-ট্রাক হয়তো আসছে। অনেকটা পথ হাটার পর মহাসড়ক থেকে ডানদিকে চলে গেছে। এরকম একটি মেঠোপথের দিকে পা বাড়ালো আতর, তার পেছন পেছন ছফা। মাথার উপরে পৌণে-আধখান চাঁদের আলো ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুটা ফিকে করে দিয়েছে। এমন মৃদু আলোয় পথ চলতে অভ্যস্ত নয় বলে ইনফর্মারের বড় বড় পা ফেললে তার পক্ষে তাল মেলানো সহজ হলো না, একটু পেছনে পড়ে গেলো সে। পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে ডিসপ্লের আলোতে আতরের পেছন পেছন পথ চলতে শুরু করলো।

হাঁটতে হাঁটতেই একটু পেছন ফিরে তাকালো ইনফর্মার। “আন্ধারে পবলেম হইতাছে নি, ভাইজানের?”

“না, না…ঠিক আছে।”

“আপনে কইলাম সাম্বাদিক না,” সামনের দিকে তাকিয়েই বললো আতর।

 “কি?” ছফা চমকে উঠলো।

একটা সিগারেট ধরালো ইনফর্মার। “আপনে আইছেন বিয়া করতে. মাইয়ার ব্যাপারে একটু খোঁজ নিতাছেন। বুঝলেন?”

“আরেকটু খুলে বলেন।”

আবারও পেছন ফিরে তাকালো সে, “বুঝলেন না…টেকনিক আর কি। সাম্বাদিক ঠুনলে বুইড়া তো কুনো কথা কইবো-ই না, পাদও দিবো না। সব বন কইরা বয়া থাকবো।”

“আচ্ছা,” ছফা এবার বুঝতে পারলো। “কিন্তু মেয়েটা কে..মানে কাকে দেখতে এসেছি?”

“আবার কে…ঐ বেটি!”

ছফা প্রায় হোঁচট খেতে যাচ্ছিলো তবে সেটা মেঠোপথের উপরে পড়ে থাকা কোনো মাটির চাকার জন্য নাকি কথাটার অভিঘাতে বোঝা গেলো না।

 “বুইড়া কইলাম মানুষ ভালা খালি মাথায় এই ছিট আছে…একবার মিজাজ বিগড়াইলে আর কিছু কইবো না। আমাগো এমপিসাবরেও হে পান্তা দেয় না…মুখের উপরে কথা কইয়া দেয়,” সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, “তয় মাথাটা একেবারে সলিড। সব কিছু জানে। এইখানকার সব তার মুখস্ত।”

 “আমি তো জানতাম এখানকার সব খবর আপনি রাখেন,” ছফা আস্তে করে বললো পেছন থেকে। “সেজন্যে লোকজন আপনাকে বিবিসি বলে। ডাকে। এখন দেখছি সিএনএন-ও আছে!”

হে-হে-হে করে হাসলো আতর। “হের কাছে আপনে সব খবর পাইবেন। কিন্তু এই জমানার কুনো খবর পাইবেন না…সব পুরানা আমলের খবর।”

“বুঝলাম না?”

আবারো পেছন ফিরে তাকালো পুলিশের ইনফর্মার। “বুইড়া পুরানা আমলের মানুষ…হে খালি পুরানা জমানার কথা জানে…এখনকার কুনো খবর হে রাখে না৷”।

ওহ্ হিস্টোরি চ্যানেল! মনে মনে বললো ছফা তবে মুখে বললো, “লোকটা কি করে?”

 “মাস্টর আছিলো, এহন কাম-কাইজ কিছু করে না। আমাগো এমপি হের চাকরি নট কইরা দিছে।”

“কেন?”

“এমপিসাব কইছিলো সুন্দরপুর প্রাইমারি স্কুলটার নাম বদলাইয়া হের বাপের নামে রাখতে…মাস্টর খুব ঘাড়ত্যাড়া মানুষ..বুঝলেন? মুখের উপর কইয়া দিছে, এইটা সে বাঁইচা থাকতে হইতে দিবো না।”

“কারণটা কি?”।

“এমপির বাপ হামিদুল্লা তো গণ্ডগোলের সময় মিলিটারিগো লগে পিচকমিটি করছিলো…মাইনষে তারে হামিদ্যা-রাজাকার কয় এহনও। হে কইলাম মেলা মানুষ মারছে।”

“স্কুলের নামটা কি বদলাতে পেরেছিলেন আপনাদের এমপি?”

পেছন ফিরে না তাকিয়েই বললো আতর, “আরে না…কেমনে বদলাইবো? কইলাম না, মাস্টর বাগড়া দিছে।”

অবাক হলো ছফা। “সামান্য একজন মাস্টার হয়ে তিনি কিভাবে এটা করতে পারলেন?”

“মাস্টরের পুরানা ছাত্ররা আছে না…হেরা তো বিরাট বড় বড় জায়গায় আছে…হেরা আবার মাস্টররে খুব মাইন্য করে…বুইড়্যা ঢাকায় গিয়া পুরানা ছাত্রগো দিয়া এমন টাইট দিছে…এমপিসাব আর স্কুলের নাম বদলাইবার সাহস করে নাই

“আচ্ছা।”

“এইটা কইলাম পেপারে আইছিলো।”

 “তাই নাকি?”

“হ। রাজাকারের নামে স্কুল হইবো এই কথাটা পেপারে আহনের পরই ক্যাচাল লাইগা যায়।”

ছফা বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হলেও ভদ্রলোকের ক্ষমতা নেহায়েত কম নয়। তাদের গ্রামেও এরকম দু-একজন মাস্টার আছে, যাদেরকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করে…পুরনো ছাত্রদের অনেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, ফলে এক ধরণের ক্ষমতাও তৈরি হয় তাদের।

 “এই গেরামের সবতে একদিনের জইন্য হইলেও হের কাছে পড়ছে।” আতর আবার বলে উঠলো। “খুব ভালা মাস্টর। আমার পোলারেও পড়াইছে৷”

“আপনার ছেলে আছে?”

আতর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “আছিলো…” কথাটা বললো মলিন কণ্ঠে।

ছফা ইচ্ছে করেই চুপ মেরে রইলো, সে অন্য কিছুর গন্ধ পাচ্ছে। এ মুহূর্তে ব্যক্তিগত প্যাচাল শুরু করার কোনো ইচ্ছে তার নেই।

“এহনও আছে,” আপন মনেই বলতে লাগলো সামনের লোকটি, “তয় আমার লগে কুনো কানেকশন নাই। ওর মার লগে থাকে, কলেজে পড়ে।”

“ও,” ছোট্ট করে বললো ছফা।

 “দেইখেন..গর্ত আছে।”

আতরের সতর্কবাণী শুনে একটু থমকে দাঁড়িয়ে মোবাইলফোনের ডিসপ্লের আলো ফেললো। গর্তটা লাফিয়ে ডিঙলো সে।

গ্রামের মেঠোপথ যেমন হয়, আঁকাবাঁকা হয়ে পথটি চলে গেছে কতোদুর সেটা এই আবছা-অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, তবে চারপাশে ঝোঁপঝাঁড় দেখে মনে হচ্ছে না এটা কোনো লোকালয়। ছফা কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ অনুসরণ করে গেলো আতর আলীকে। দুজনের পদক্ষেপের শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। জনমানবহীন এলাকাটি রাতের অন্ধকারে ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করেছে। ছফা নিশ্চিত, একা একা এরকম জায়গা দিয়ে শহরে বড় হওয়া মানুষ হেঁটে যেতে পারবে না, গা ছমছম করে উঠবে। তবে তার মধ্যে এ নিয়ে কোনো ভয়ডর নেই। পুরোটা কৈশোর গ্রামেই কাটিয়েছে। তাছাড়া ভূতে বিশ্বাস করে না সে। গড়পরতা মানুষের চেয়ে তার সাহসও একটু বেশি।

“ধ্যাত!” বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো ছফা।

আতর থমকে দাঁড়ালো। “কি হইছে?”

“মোবাইলের চার্জ শেষ।” তার ফোনটা অফ হয়ে গেছে।

ইনফর্মার আবার হাঁটতে শুরু করলো। অনেকটা বিড়বিড় করেই বলতে লাগলো, “শহরের মানুষ তো…রাইত-বিরাইতে গাও-গেরামে চলাফেরা করার অভ্যাস নাই।

মুচকি হেসে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো ছফা। অন্ধকারেই টের পেলো ঢালু একটি জায়গা দিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে যাচ্ছে।

“শটকাটে যাইতাছি আর বেশিক্ষণ লাগবো না।”

আতর আলীর কথায় কোনো জবাব দিলো না সে। লোকটা থেকে মাত্র দু-তিনহাত পেছনে আছে। অন্ধকারেই টের পেলো চারপাশের ঝোঁপঝাঁড় একটু বদলে গেছে। জায়গাটা কেমন জানি। একটা গন্ধ নাকে আসছে। সুগন্ধী কিছু। তবে এর সাথে মিশে আছে বাজে একটা গন্ধও। সব মিলিয়ে অশরীরি এক আবহ ফুটে উঠছে আস্তে আস্তে।

“গন্ধটা কিসের?” খুব স্বাভাবিক কণ্ঠেই জানতে চাইলো সে।

“আগরবাত্তির,” পথ চলতে চলতে বললো আতর।

“এইটা আমাগো বড় কবরস্তান…এইটার ভিতর দিয়া গেলে শটকাটে যাওন যায়।”

কবরস্তান শুনে ছফার গা ছমছম করে উঠলো। এই ইনফর্মার তাকে এরকম রাতের বেলায় কবরস্তানের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে লোকটার সাহস আছে কিন্তু ভব্যতাজ্ঞান নেই।

জায়গাটা কবরস্তান শোনার পর থেকে আপনাআপনি তার চোখ চলে যাচ্ছে আশেপাশে, এটা কোনোভাবে এড়াতে পারছে না। এখন আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে ছোটো ছোটো ঢিবির মতো মাটির স্তূপগুলো ওগুলোর নীচে শায়িত আছে মৃতেরা।

“রাইতে নতুন কুনো কব্বর দিছে মনে হয়,” আতর বললো, “মুরদার লোকেরা আগরবাত্তি জ্বালায়া গেছে।”

ছফা কিছু বললো না। ভুতের ভয় না থাকুক, কবরস্তান দিয়ে রাতের বেলায় হেঁটে যাওয়াটা মোটেও স্বস্তির ব্যাপার নয়। আতর আলীর উপর রাগ করেই জোরে জোরে পা চালাতে লাগলো সে। এখান থেকে যতো দ্রুত বের হওয়া যায় ততোই স্বস্তির ব্যাপার।

 “ঐ লোকের নাম কি?” জোরে জোরে পা চালিয়ে আতরের ঠিক পাশে এসে বললো সে।

“নাম তো একখান মাশাল্লা..কী আর কমু…উল্টাইলেও যা সোজা করলেও তা!”

“কি বল-” বিস্মিত ছফা কথাটা শেষ করতে পারলো না, “আ-আ!” চিৎকার দিয়ে উঠলো সে। ভারসাম্য হারিয়ে বাম দিকে কাত হয়ে পড়ে গেলো। ডানহাত দিয়ে আতরের কাঁধ ধরার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হলো সে। মাটিতে আছড়ে পড়ার আগে তার মনে হলো কয়েক মুহূর্ত শূন্যে ভেসে ছিলো!

.

অধ্যায় ৫

“…কোমল বাছুর ডোর ছিন্ন হয়ে যায়,
মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে।
 কেহ কারে নাহি চিনে আঁধার নিশায়…”

মৃদু ভলিউমে যে গানটা বাজছে সেটার কথাগুলো খুব খেয়াল না করলে বোঝা যাবে না। তবে তাতে কোনো সমস্যা নেই, সবটাই তার মুখস্ত।

সাধারণত এভাবে রকিংচেয়ারে দোল খেতে খেতে গান শোনার সময় বিড়বিড় করে গানের সাথে ঠোঁট মেলায়, তবে আজ তার ঠোঁটজোড়া

পুরোপুরি স্থির। চোখ দুটো শূন্যে নিক্ষেপ করে ভেবে যাচ্ছে। আস্তে করে চেয়ারের পাশ থেকে কফি টেবিলের উপরে রাখা গ্লাসটা হাতে তুলে নিলো। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে লাল টকটকে তরলে ভর্তি ওটা। গ্লাসটা নাকের সামনে নিয়ে গন্ধ নিলো প্রথমে, তারপর চুমুক দিয়েই বন্ধ করে ফেললো দু চোখ। লাল তরল মুখের ভেতরে কিছুক্ষণ রেখে দিয়ে অনুভব করলো এর স্বাদ। গন্ধ।

আনমনেই আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো যেনো। গলা দিয়ে লাল তরলটা নামিয়ে দিয়ে চোখ খুললো সে। আকাশে ভেসে থাকা চাঁদের দিকে তাকালো। তিন-দিন পর পূর্ণিমা হবে। চাঁদটা এখন পূর্ণতার পথে। অল্প কিছু বিচ্ছিন্ন মেঘের টুকরো চাঁদটাকে আড়াল করে দিয়ে পরক্ষণেই চলে যাচ্ছে। দোতলার বারান্দায় বসে রকিংচেয়ারে দোল খেতে খেতে দৃশ্যটা দেখতে মনোরম লাগছে। গ্লাসটা সরিয়ে গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো। সদ্য ফোঁটা হাসনাহেনা ফুলের গন্ধে তার বাগানটা অপার্থিব হয়ে উঠেছে।

সে জানে হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ মিষ্টি। যেমন গোলাপের গন্ধ নোনতা, আর জংলী ফুলের গন্ধ তেতো। প্রকৃতির প্রতিটি গন্ধেরই এরকম স্বাদ রয়েছে। একটি গন্ধ আরেকটি গন্ধের সাথে মেশানো যায়; একটি স্বাদের সাথে আরেকটি স্বাদেরও মিশ্রণ হয়। তবে মানুষ গন্ধের ব্যাপারে সবচেয়ে আনাড়ি। শব্দ-স্বাদ-দৃষ্টি-স্পর্শ, এগুলোর ব্যাপারে মানুষ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। শব্দকে ছয়টি সুরে-সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-বেধেছে। স্বাদকে টক, ঝাল, মিষ্টি, নোনতা আর তেতো এই পাঁচটি ভাগে আলাদা করেছে। জগতের সকল রঙকে সাতটি রঙে ভাগ করেছে মানুষ। আর স্পর্শ সবচেয়ে সথুল ইন্দ্রিয়; গরম-ঠাণ্ডা, নরম-কোমল, শক্ত-তরল-বায়বীয়-এর বাইরে আর কোনো অনুভূতি নেই। কিন্তু গন্ধের বেলায় এসে বিপাকে পড়ে গেছে। গন্ধ কয় প্রকার-কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। মুচকি হাসলো সে। ভালো করেই জানে এর কারণ কি। গন্ধ সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর। এটা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। নানারকম গন্ধের সাথে মিশে যায় দ্রুত। এই মেলামেশাকে থামানো যায় না। অদৃশ্যভাবে, সবার অগোচরে ঘটে যায়, সেজন্যে আলাদা করাটাও খুব কঠিন হয়ে পড়ে। শৈশব থেকে মানুষ গন্ধ নেবার ইন্দ্রিয় ‘নাক’ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। এ জগতের প্রায় সবকিছুরই গন্ধ আছে। সেগুলো ভেসে বেড়ায় বাতাসে। আর বাতাস মানেই সর্বত্রগামী। ফলে প্রকৃতিতে এক একটি গন্ধ খুব বেশি সময় নিজস্বতা ধরে রাখতে পারে না।

স্বাদ পুরোপুরি জিভের উপর নির্ভরশীল। শব্দ নির্ভর করে কানের উপরে। দৃষ্টির নির্ভরতা চোখেতে। একদিক থেকে দেখলে স্বাদের ব্যাপারটা বেশ নিশ্চিত। টক-ঝাল-মিষ্টি-নোনতা-তেতো-এসব স্বাদের পার্থক্য বোঝাটাও খুব কঠিন কিছু নয়। পাঁচটি স্বাদের মধ্যে বেশ ভিন্নতার কারণে আলাদা। করতে খুব একটা অসুবিধাও হয় না।

একটি স্বাদকে আরেকটির সাথে মিশিয়ে তৈরি করা যায় নতুন স্বাদ। মিষ্টির সাথে মিষ্টি। এটা ভারসাম্য তৈরি করে। কিন্তু প্রকৃতিতে শুধু ভারসাম্য আর সাযুজ্যই মেলে না, বৈপরীত্যও দেখা যায়। দেখা যায় ভিন্নতা। ডিজাইনাররা একে বলে কন্ট্রাস্ট। ভারসাম্যের ঠিক উল্টো। কিংবা আদৌ ভারসাম্যপূর্ণ নয়। টকের সাথে ঝাল। ঝালের সাথে মিষ্টি! টকের সাথে মিষ্টি। মিষ্টির সাথে নোনতা! নোনতার সাথে ঝাল! সবই সম্ভব। শুধু দরকার সীমাটুকু বোঝা। ঝালের রয়েছে নির্দিষ্ট সীমা। মিষ্টি, টক, নোনতা সবকিছুরই সীমানা আছে। কে কার সীমানায় কতোটুকু অনুপ্রবেশ করবে সেই পরিমিতবোধ থাকতে হবে, নইলে বিপর্যয়।

এই বিপর্যয় উভয়ের জন্যেই!

আজ হঠাৎ করেই একজন সীমানা লঙ্ঘন করেছে। তাকে অসহায় আর দুর্বল এক নারী ভেবেছে। মনে করছে তার সাথে যা-ইচ্ছে তাই করা যাবে। লোকটার ধারণাই নেই সে কতো বড় ভুল করেছে। তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে না। দুশ্চিন্তা করার মতো নার্ভ বস্তুকাল আগে এক অবিশ্বাস্য ঘটনার পর হারিয়ে ফেলেছে সে।

আরেকটু চুমুক দিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দিলো গ্লাসটা। বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।

বিপদের সবটুকু, বিপর্যয়ের সবটুকু সীমা লঙ্ঘনকারীর জন্যেই বরাদ্দ!

*

“হায় হায়!” গর্তের উপর থেকে আতর আলীর কণ্ঠটা শুনতে পেলো ছফা।

“কব্বরে পইড়া গেছেন দেহি!”

কথাটা শুনে তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। কবরে! নরম আর ভেঁজা মাটির সাথে তার গালে আর দু-হাতে লেগে আছে কঙ্কালের মতো কিছু। সারা শরীর গুলিয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। আমি কি পচা-গলা লাশের উপরে পড়ে আছি? সঙ্গে সঙ্গে ধরফর করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই টের পেলো আতর আলী তার ডানকাঁধে হাত রেখেছে।

“ভাইজান, আমার হাতটা ধরেন…জলদি উইঠ্যা আসেন।”

ইনফর্মারের হাতটা শক্ত করে ধরলো সে। গর্ত থেকে উঠে আসার পর বুঝতে পারলো শরীরে কিছু কাদা লেপ্টে আছে।

“চোট পান নাই তো?”

“না।” দাঁতে দাঁত পিষে বললো ছফা। “এ-এক্ষুণি ধুতে হবে এগুলো!” গায়ের কাদাগুলো দেখিয়ে বললো। কবরস্তানের কাদা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা চিন্তাও করতে পারছে না।

“আসেন,” আতর তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো। “সামনেই একটা খাল আছে.. ধুইয়া নিয়েন।”

রাগেক্ষোভে সারা শরীর কাঁপছে তার কিন্তু মুখে কিছু বললো না। এই ব্যাটা ইনফর্মার শর্ট-কাট মারতে গিয়ে কবরস্তানের ভেতর দিয়ে না এলে এভাবে কবরে গিয়ে পড়তে না আজ। “ও-ওখানে কঙ্কাল আছে মনে হলো!” খোলা কবরের দিকে ইঙ্গিত করে বললো সে।

 “আরে না। ওইটা তো নতুন কব্বর…ঐ দেহেন,” জবাব দিলো। ইনফর্মার। কবরের একপাশে আলগা মাটির স্তূপ দেখালো হাত দিয়ে।

হাফ ছেড়ে বাচলো ছফা। সম্ভবত আতঙ্কের কারণে সে মনে করেছে কবরের ভেতরে কঙ্কাল রয়েছে। ওগুলো হয়তো গাছের ডালপালাও হতে পারে, কিংবা অন্য কিছু। এমন সময় গাছের পাতা নড়ার শব্দে চমকে উঠলো সে। শব্দটার উৎসের দিকে তাকালো। তাদের থেকে দশহাত দূরে একটা বড় গাছ। ডাল-পালা ছড়িয়ে আছে মাথার উপরে। গাছটার চারপাশে কবরের সারি।

“কে ওখানে?” গাছটা দেখিয়ে বললো।

 “ওইখানে আবার কে?” বুঝতে না পেরে বললো আতর।

“আপনি কিছু শুনতে পান নি? আমার তো মনে হচ্ছে গাছের আড়ালে কেউ আছে।”

আতর চোখ কুচকে তাকালো সেদিকে। অন্ধকারে অবশ্য বেশি কিছু দেখারও নেই। “আরে না,” অবশেষে বললো সে। “কবরস্তানে আইলে সতেরই এমন মনে হয়। এইটা হইলো মনের ভুল।”

আক্ষেপে মাথা দোলালো ছফা। আসলেই তার মনের ভুল কিনা বুঝতে পারছে না।

“কবরস্তানে আত্ম-ফাত্মা কিছু থাকে না..থাকে বাঘডাশ, শিয়াল এইসব জানোয়ার।” একটু থেমে আবার বললো, “আহেন…সামনে আগাই

ছফাও চাইছে এই কবরস্তান থেকে যতো দ্রুত সম্ভব বের হয়ে যেতে। ইনফর্মারের পাশাপাশি আবার হাঁটতে শুরু করলো সে।

“ফালু পোলাটা আজিব কিসিমের, বুঝলেন?” হাঁটতে হাঁটতে বললো ইনফর্মার। “হালারপুতে অ্যাডভান্স কব্বর খুইদা রাখে।”

অ্যাডভান্স কবর খুরে রাখে মানে! অবাক হলো ছফা। “ফালু কে?”

“ফালু এই কবরস্তানের গোর খুদে।” বলতে শুরু করলো ইনফর্মার। “পোলাটার বেরেইনে এটু পবলেম আছে।”

ফালু কিংবা খালু, কারোর ব্যাপারেই তার কৌতূহল নেই। যত্তসব ফালতু লোকজন। হাতে-পায়ে লেগে থাকা কাদাগুলোর জন্য সারা শরীর গুলিয়ে উঠছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে আতর আলীর পাশে চলে আসার সময় অন্ধকারে খেয়াল করেনি সরু রাস্তার পাশে সদ্য খোরা একটি কবর ছিলো। সেই খোলা কবরে বাম পা-টা পড়তেই ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে নি।

 “সুন্দরপুরের অনেকে মনে করে ফালু খুব কামেল লোক। তারে খুব মাইন্য-গইন্যও করে। বাড়িতে কেউ বিমারে পড়লে ওরে নিয়া গিয়া ভালমন্দ খাওয়ায়…যেন ফালু তাগোর রুগির লাইগা অ্যাডভান্স কব্বর না খুদে। এইটারে আপনে ঘুষও কইবার পারেন।”

ছফা তু-হা কিছুই করলো না। সে জানে প্রতিটি গ্রামেই এরকম কিছু কামেল লোকজন থাকে। অর্ধেক গ্রাম তাকে মানে, বাকি অর্ধেক তার ব্যাপারে আধো-অবজ্ঞা আর সন্দেহ পোষণ করে। এদেরকে ঘিরে এক একটি কিংবদন্তী ঘুরে বেড়ায় গ্রামের চৌহদ্দির মধ্যেই। বড়জোর আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে সেটা। তারপর কামেলদের কেরামতি আর দৌড়ায় না! এ দেশে কেরামতিগুণসম্পন্ন বাবা হওয়াটা খুব সহজ। একজন মস্তিষ্কবিকৃত মানুষও উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাটা-হাটি করে বাবা হয়ে যেতে পারে!

 “পোলাটা কেমতে জানি জাইনা যায় গেরামে কেউ মরবো…মরার আগেই অ্যাডভান্স কব্বর রেডি কইরা রাখে।”

শালার অ্যাডভান্স কবর! মনে মনে বললো ছফা। এইসব তারছেঁড়া লোকজনের ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। সে নিশ্চিত, এই ফালু লোকটি চতুর জ্যোতিষী, ভণ্ডপীর আর সাধুবাবাদের মতোই কেউ হবে। নিজের চাতুর্য আর গ্রামের মানুষজনের বিশ্বাসের দুর্বলতাই যাদের একমাত্র সম্বল।

“ওর অ্যাডভান্স কব্বর খুদার কথা শুনলে গেরামের বুড়া-বুড়িগো বুকপুকানি শুরু হইয়া যায়। আর যে ব্যাটা-বেটি বিমার হইয়া বিছানায় পইড়া আছে ওর তো পাতলা পায়খানা শুরু হইয়া যায়। বার বার খালি দরজার দিকে তাকায় দেখে আজরাইল আইলো কিনা!”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা। এসব কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে উঠছে সে।

“এহন পর্যন্ত ফালুর অ্যাডভান্স কব্বর মিস হয় নাই!” প্রশংসার সুরে বললো আতর।

জীবিত অবস্থায় কবরে পতিত হবার বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা লাভ করার পর এসব গাঁজাখুড়ি গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে না। ফালুর শতভাগ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ থাকবে কি থাকবে না সেটা নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা নেই।

 “তয় আইজ মনে হয় মিস্ হইবো। রাইত তো মেলা হইছে, এহনও কুনো মরার খবর নাই!”

“আর কত দূর?” অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলে ছফা। ফালুসংক্রান্ত আলাপ থেকে তাদের গন্তব্যের দিকে মনোযোগ ফেরাতে চাইছে।

“ওই তো মাস্টরের ভিটা দেহা যাইতাছে…হারিকেন জ্বলছে ঘরে।”

একটু দূরে মিটমিট করে লালচে আলো জ্বলতে দেখলো সে। “আমি খালের কথা বলছি, হাত-পা ধুতে হবে।”

“ও,” ইনফর্মার বললো, “ওইটা মাস্টরের ভিটার এটটু আগেই..”

ছফা আর কথা বাড়ালো না, জোরে জোরে পা চালালো।

 “…এই তো, সামনেই…”

*

আতর আর ছফা যখন কবরস্তান থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তখন তাদের অলক্ষ্যে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আবছায়া এক মূর্তি মুখে গামছা। পেচিয়ে বড়সড় জারুল গাছের আড়াল থেকে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। দু-জন মানুষের অবয়ব মিইয়ে গেলে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো সে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো সিদ্ধান্তহীনতায় তারপর এগিয়ে গেলো খোলা কবরের দিকে।

Leave a Reply to Aditi Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *