২.৩ নগরকোটের নর্তকী

নগরকোটের নর্তকী

নগরকোট ছিলো হিন্দুস্তানের এক বিখ্যাত দুর্গ। সেই যুগ ছিল দুর্গ শাসনের। নগরকোট দুর্গের ভগ্নস্তূপ এখনও বিদ্যমান। তৎকালীন হিন্দুস্তানের দুর্গগুলো একটির চেয়ে আরেকটি ছিলো নানা কারণে বৈশিষ্ট্যের দাবীদার। বিখ্যাত নগরকোট দুর্গের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো এর শক্ত কাঠামো, বিশাল বিস্তৃতি। মধ্যে অবস্থিত বিশাল মন্দিরটি ছিলো নগরকোট দুর্গের প্রধান আকর্ষণ। মন্দিরটিই ছিলো দুর্গের ভেতরে আরেক দুর্গসম। মন্দিরের মধ্যে অসংখ্য কক্ষ ছিলো। ভেতরে ঢুকলে অচেনা মানুষ হারিয়ে যেতো। মন্দিরের ভেতরে ছিলো গোপন কক্ষ, সুড়ঙ্গ পথ। নগরকোট মন্দিরের মধ্যে ঘোড়া-হাতি হারিয়ে গেলেও খুঁজে পাওয়া ছিলো দুষ্কর। বিশাল এই মন্দিরের নিরাপত্তার জন্যে এটিকে ঘিরে তৈরি হয় বিশাল দুর্গ। যা তৎকালীন মহাভারতের দুর্গগুলোর মধ্যে ছিলো অন্যতম।

এই দুর্গ ছিলো মহাভারতের বিখ্যাত শহর কাংরার নিকটবর্তী একটি পাহাড়ের উপর। পাহাড়ের উপর থাকার কারণে এটি ছিলো সুরক্ষিত। এই দুর্গে আক্রমণ করতে হলে পাহাড়ের উপর উঠতে হতো। দুর্গে অবস্থানরত নিরাপত্তা রক্ষীরা পাহাড়ের উপর থেকে তীর ছুঁড়ে এবং বড় বড় পাথর গড়িয়ে দিয়ে যে কোনো হামলাকারীকেই পরাস্ত করে দিতো। যার ফলে কারো পক্ষে এই দুর্গ দখল করা ছিলো দুষ্কর।

সুলতান মাহমুদ গজনবী যখন পেশোয়ার, বেড়া ও মুলতান দখল করে নিলেন তখন মহাভারতের হিন্দু রাজা-মহারাজাদের টনক নড়ে। তাদের কাছে মনে হলো, বিজয়ী সুলতান মাহমূদ মূর্তিপূজারী ভারতের বুকে খঞ্জর বিদ্ধ করেছেন। সুরক্ষিত হওয়ার ফলে নগরকোট মন্দিরের গুরুত্ব আরো বেড়ে গেলো । মন্দির যেমন ছিলো গুরুত্বপূর্ণ দ্রুপ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণও ছিলো হিন্দুদের কাছে পূজনীয়। নগরকোট মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রাধাকৃষ্ণ কট্টর ব্রাহ্মণ।

রাজা-মহারাজারা শাসন করতো নিম্নবর্ণের হিন্দুদের, আর পুরোহিত রাধাকৃষ্ণ শাসন করতে রাজা-মহারাজাদের। অবতারের মতোই সকল বর্ণের হিন্দু রাধাকৃষ্ণকে সম্মান করতো, তার পায়ে মাথা ঠুকে প্রণাম জানাতে। সাধারণত মন্দিরে যেসব ঘটনা ঘটে থাকে, নগরকোট মন্দিরে সেসব কখনো ঘটতো না। পুরোহিত রাধাকৃষ্ণ নগরকোট মন্দিরে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছিলো যে, সেখানে হিন্দু পূজারীরা পূজা-পার্বন ছাড়া অন্যকিছু ভাবতেও পারতো না। নগরকোট মন্দিরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর পূজারীদের যাতায়াত ছিলো বটে, কিন্তু কোনো নারীর পক্ষে কোনো পণ্ডিতের সংস্পর্শে আসার অনুমতি ছিলো না এবং নারী-পুরুষ একত্রে পূজায় শরীকও হতে পারতো না।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর পূজারী পুরোহিত রাধাকৃষ্ণের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে চাইতো, কিন্তু পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ কোনো নারীকে শরীর স্পর্শ করতে দিতো না। নারী, শিশু, কিশোরী, যুবতী আর বৃদ্ধ যাই হোক না কেননা, কারো পক্ষেই প্রধান পুরোহিত রাধাকৃষ্ণের কাছে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। সে নারী সংস্পর্শ থেকে নিজেকে দূরে রাখাকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বলে বিশ্বাস করতো।

মন্দিরে বড় পুরোহিত রাধাকৃষ্ণের আরো কয়েকজন সহকারী পুরোহিত ছিলো। নারীর সংস্পর্শ থেকে তাদেরকে রাধাকৃষ্ণ দূরে থাকার জন্যে নির্দেশ দিতো। কঠোরভাবে তাদেরকে নারী সঙ্গ থেকে দূরে রাখতো। রাধাকৃষ্ণ মনে করতো, নারীই পৃথিবীতে সকল অনিষ্টের মূল। পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ বিশ্বাস করতো, নারীর মধ্যে এমন জাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে, সে জাদু যদি কোনো পুরুষকে পেয়ে বসে তাহলে সেই পুরুষ আর কোনো ভালো কাজ করতে পারে না। সে পাপ ছাড়া ভালো কিছুর কথা ভাবতেও পারে না।

এই বিশ্বাস থেকে রাধাকৃষ্ণ যৌবনে সংসার ত্যাগ করে হিমালয় পাহাড়ের কোলে হিন্দুদের পবিত্র গঙ্গা নদীর উৎসস্থলে চলে গিয়েছিলো । দীর্ঘ পনের বছর রাধাকৃষ্ণ বিজন প্রান্তরে দেব-দেবীর পূজা করে কাটিয়েছে। ততোদিনে তার রিপু তাড়না মরে যায়। তার মনে কোন কামনা-বাসনা আর বাকি থাকেনি। দীর্ঘ সাধনার পর গঙ্গা প্রবাহের পথ ধরে লোকালয়ে এগুতে থাকে রাধাকৃষ্ণ। নগরকোটে পৌঁছে পাহাড়ের উপর এ বিশাল মন্দির দেখে স্থানটি তার কাছে খুবই ভালো লাগে। মন্দিরের সেবায় লেগে যায়। এক পর্যায়ে কঠোর সাধনাবলে নিজেকে উন্নীত করে প্রধান পুরোহিতের মসনদে।

প্রধান পুরোহিত রাধাকৃষ্ণের বয়স এখন ষাটের কাছাকাছি। এতোগুলো বছর পাড়ি দিয়ে এলেও তার চেহারা-শরীরে বয়সের ছাপ পড়েনি। শরীরের শক্ত বাঁধনের ফলে চেহারার কোথাও বলিরেখা দখল পায়নি। নিরামিষভোজী রাধাকৃষ্ণ কোনো জীবজন্তুর গোশত ভুলেও আহার করে না। পূজা-পার্বন আর সেই ভোরবেলায় গঙ্গাজলে স্নান শীত-বর্ষা-হেমন্ত কোনো ঋতুতেই বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না। কঠোর নিয়ম-নীতি মেনে চলার কারণেই নগর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসেবে সবাই তাকে বরণ করেছে। সাধারণ হিন্দুদের কাছে সে শুধু মন্দিরের পুরোহিতই নয়, এক জ্যান্ত দেবমূর্তিও।

তার হাঁটা-চলা, চাহনী, বলায় রয়েছে দারুণ সম্মোহনী শক্তি। রাজা-মহারাজাদের চেয়েও তার চলন-বলনে রয়েছে ঐশ্বর্যের বহিঃপ্রকাশ। সে গর্বভরে সবাইকে বলতো, দুনিয়ার খেল-তামাশা, আমোদ-প্রমোদ, নারীর স্পর্শ থেকে আমার দেহ-মন পবিত্র। তাই শত বছর পর্যন্ত আমার শরীর এমনই থাকবে। সে গর্ব করে বলতো, যে তার দেহ-মনকে পবিত্র করে নিতে পারে, তার শরীর সবসময় থাকে তরতাজা। জগতের রোগ-শোক জড়া তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

মহাভারতের হিন্দু ধর্মীয় অঙ্গনে সে ছিলো একটা স্তম্ভ। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ ও মহাভারত ছিলো তার কণ্ঠস্থ। তার ভাষায় ছিলো জাদুকরী ক্ষমতা। মানুষ তাকে বাস্তব অবতার বলে পূজা করতো। ভাবতো, নগরকোট মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সনাতন ধর্মের বাস্তব নতুনা। রাজা-মহারাজাদেরকে সে দাপটের সাথে শাসন করতো। যেসব রাজা-মহারাজাকে সাধারণ প্রজারা পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতো, সেসব রাজা-মহারাজা তার পায়ে মাথা ঠুকে প্রণাম জানাতো। তারা এই পণ্ডিতের সান্নিধ্যে এলে নিজেদের ক্ষমতা ও দাপট তার পদমূলে সঁপে দিতো।

নগরকোট মন্দির ছিলো সোনাদানা, মণিমুক্তা, হীরা-জহরতের ভাণ্ডার। সারা ভারতের রাজা-মহারাজারা প্রাণ খুলে নগরকোট মন্দিরে নিয়মিত নজরানা পাঠাতো। মণিমুক্তা, হীরা-জহরত, সোনাদানা পাঠাতে পারাকে তারা সৌভাগ্যের পরিচায়ক ভাবতো। নগরকোট অঞ্চলের সকল কৃষক, জমিদার নিয়মিত মন্দিরে খাজনা দিতো। কারণ, এ অঞ্চলের সব জমির মূল মালিকানার অধিকারী ছিলো না মন্দির। বিশাল এই সম্পদ পুরোহিত রাধাকৃষ্ণ না নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করতে, না সম্পদে কোন পুরোহিতকে হাত দিতে দিতো। এসব সম্পদের ব্যাপারে সে বলতো, এ সম্পদের মালিক ভগবান। ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানেই খরচ হবে এ সম্পদ। মন্দিরের বিশাল আয়ের একটি অংশ প্রধান পুরোহিত রাধাকৃষ্ণ অতি দরিদ্র হিন্দু প্রজাদের মাঝে ব্যয় করতো, আর কিছু বরাদ্দ থাকতো গরীব হিন্দুদের শিক্ষা-দীক্ষায়। বাকি সম্পদের ব্যাপারে তার কথা ছিলো, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পবিত্রতা রক্ষায় ব্যয় হবে মন্দিরের সব ধন-রত্ন।

১০০৭ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৩৯৮ হিজরী সনের ঘটনা। সুলতান মাহমুদ বর্তমান আটকাবাদে তৎকালীন লাহোরের প্রতাপশালী রাজা আনন্দ পালকে সম্মুখ সমরে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। লজ্জাজনকভাবে তৃতীয়বারের মতো পরাজিত হয়ে রাজা আনন্দপাল কাশ্মীরের দিকে পালিয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাজা আনন্দ পাল আর নিজের রাজধানীতে ফিরে আসেনি। এরপর সুলতান মাহমূদ বেরায় রাজা বিজি রায়কে চরমভাবে পর্যদস্ত করেন। বিজি রায়কে পরাজিত করার পরই মুলতানে হামলা করে হিন্দু ও খৃষ্টানদের ক্রীড়নক কারামতিদের দুর্ভেদ্য দুর্গ চিরতরে ধ্বংস করে দেন। সেই সাথে মুলতানকে গজনী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। বেরার অপর যুদ্ধে আনন্দ পালের ছেলে শুকপাল পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু সুলতানের অনুপস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে ধোঁকা দিয়ে পুনরায় ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত করায় সুলতান মাহমূদ নিজে গজনী থেকে ফিরে এসে শুকপালের চক্রান্ত ভণ্ডুল করে দিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ১০০৭ খৃস্টাব্দে মহাভারতের বুকে ইসলামের ঝাণ্ডা নতুন করে উড্ডীন হওয়ার ফলে নগরকোট মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সুলতান মাহমূদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রাভিযান এবং বেরা, পেশোয়ার ও লাহোর যুদ্ধে হিন্দু রাজাদের শোচনীয় পরাজয়বরণের সংবাদ নিয়মিত পাচ্ছিলো। এ কথাও তার অজানা ছিলো না যে, রাজা আনন্দ পাল পরাজিত হওয়ার পর রাজধানীতে না ফিরে কাশ্মীরের দিকে পালিয়ে গেছে। এ সংবাদ শুনে নগরকোটের প্রধান পুরোহিত পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ হিন্দুস্তানের সকল রাজা-মহারাজাকে নগরকোটে ডেকে পাঠায়। পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের ডাকে উজান, কাশ্মীর, কনৌজ, গোয়ালিয়ার, আজমীরের রাজাসহ সকল রাজা-মহারাজা উপস্থিত হয়।

“তোমরা কি আরাম-আয়েশ আর বিলাস-ব্যসনের ফল এখনো পাওনি? না এখনো আরো পাওয়ার বাকি আছে।” নগরকোট মন্দিরের রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসে রাজা-মহারাজাদের উদ্দেশ্যে বললো পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ। তোমাদের এই লজ্জাজনক পরাজয়ের কারণ তোমরা তোমাদের রাজপ্রাসাদগুলোকে স্বর্গে পরিণত করেছে। তোমরা ঘুমোত যাও তো নারী সেবিকারা তোমাদের ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তোমাদের ঘুম থেকে জাগানোর সময় হলে নারী সেবিকারাই তাদের নরম হাতের স্পর্শে তোমাদের ঘুম ভাঙ্গায়। তোমাদের জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, তাও নারী সেবিকারাই সারিয়ে দেয়। নারীর স্পর্শ আর নারীর সহযোগিতা ছাড়া তোমরা এক কদম চলতে পারো না। সেবিকাও তো এমন যারা সুন্দরী-রূপসী। তোমাদের তৃষ্ণা পেলে তো মিষ্টি শরাব দিয়েও তৃষ্ণা মেটাতে পারো।

“আনন্দ পাল বলেই না পরাজিত হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে এই স্নেহোর বাচ্চা আসুক না…।”

‘আনন্দ পাল নয়, ভারতের প্রত্যেক রাজার জন্যই এটি পরাজয়।” গর্জে উঠলো পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ। “বলছ কি? তোমরা কি হিন্দু নও! এই পরাজয় কি তোমাদের মোটেও স্পর্শ করেনি? গজনীর এক মুসলিম যোদ্ধা তোমাদের এক জাতি ভাইকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করার অর্থ হলো, গোটা হিন্দু ধর্মের পরাজয়। আনন্দ পালের পরাজয় তোমাদের পরাজয়। আমার পরাজয়। বেরা, মুলতান, লাহোরের মন্দিরগুলো কি তোমাদের বিবেচনায় পবিত্র নয়?”

মুসলমানরা দেব-দেবীর মূর্তিগুলোকে মন্দির থেকে বাইরে ফেলে এগুলোর উপর দিয়ে ঘোড়া দাবড়িয়ে পায়ে পিষে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। এগুলোর সাথে কি তোমাদের ধর্মের কোনোই সম্পর্ক নেই। যেখানে শঙ্খধ্বনি বাজতো, যেখানে বাজতো ঘণ্টা, যেখানকার তরুলতা আকাশ-বাতাস মন্দিরের গুণকীর্তন শুনতো, সংস্কৃতি ও ধর্মের শ্লোক ধ্বনিত হতো; সেখানে আজ ধ্বনিত হয় ‘আযান’!”

পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের শ্লেষাত্মক কথায় রাজা-মহারাজাদের সমাবেশে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ বলছেন, “ওখানকার মুয়াজ্জিনের আযান এতোটা দূরে বসেও আমার কানে বিদ্ধ হয়। কষ্টে আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। হরেকৃষ্ণ ও হরেরামের পরিবর্তে আমার কানে বাজে আযানের ধ্বনি। আমি এখন মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করতে ভয় পাই। দেব-দেবীদের চোখে-মুখে ক্ষোভ দেখছি। আমার মনে হয়, এ মন্দির, এ দুর্গ, এ পাহাড় সবই যেনো ক্ষোভে কাঁপছে। তোমরা কি চাও যে মুসলমানরা এখানে এসে আমাদের এই দেব-দেবীগুলোকেও উড়িয়ে দিক। এ মন্দিরেও ধ্বনিত হোক ওদের আষান।”

“এমনটি হতে দেয়া হবে না মহারাজ!” সমবেত সকল রাজা-মহারাজার কণ্ঠে সমস্বরে উচ্চারিত হলো। “আমরা আমাদের সবকিছু উৎসর্গ করে দেবো। কিন্তু কোনো মুসলমান এদিকে এলে তাকে আর জীবিত ফিরে যেতে দেবো না।”

“ওরা এখান থেকে ফিরে যাওয়ার জন্য আসবে না। ওরা এখানে আসবেই। আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি। আমার দৈবজ্ঞান এ কথাই বলছে। তোমরা তো সুন্দর প্রমোদবালা আর নর্তকীদের নিয়ে আমোদে ডুবে রয়েছে। তোমরা কি লক্ষ্য করছে, মুসলমান বিজয়ীরা কি তোমাদের মতো সুন্দরী ললনাদের সঙ্গে রাখে? তোমরা এই পবিত্র মন্দিরেও ভোগের সকল উপকরণ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে!

বলতে পারো, আমার কেনো ঘুম আসে না। আমি গভীর রাতে গঙ্গামাতার নির্মল পানিতে ডুব দিয়ে ভগবানের কাছে কান্নাকাটি করি কেন? আমার তো কোনো রাজ্য নেই, রাজধানী নেই। কিন্তু তারপরও আমার এতো উদ্বেগ, এতো দুশ্চিন্তা কেনো? তোমরা যদি পরিস্থিতি আমার চোখে দেখো, আমার জ্ঞানে চিন্তা করো, তাহলে সারা মহাভারত তোমাদের নিজের দেশ মনে হবে। মনে রেখো, মাহমুদ গজনবী কোনো দেশ দখলের জন্য লড়ছে না। হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব বিলীন করা আর এখানে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার যুদ্ধ। মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে ভারতের হিন্দু রাজার পতন ঘটলেও পরে আমাদের বাপ-দাদারা এ দেশ থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করেছিলেন। অথচ আজ আবার ইসলাম ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছে। আর তোমরা এখনো গভীর বিলাস ঘুমে ডুবে আছে।

ধর্মকে না হয় তোমরা ভুলেই গেলে। কিন্তু তোমাদের নিজেদের কথা কি একটু ভেবেছো? তোমরা যদি পরাজিত হও, তোমরা কোথায় যাবে? তোমাদের শবদেহের সৎকার করার কেউ থাকবে? জীবিত থাকলে বাকি জীবনটা মুসলমানদের কারাগারে ধুকে ধুকে মরতে হবে। আর তোমাদের স্ত্রী-কন্যাদের সাথেও সেই আচরণই করা হবে, এসব নর্তকী-বাইজীদের সাথে তোমরা যা করে থাকো ।”

পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের বক্তব্য শুনে রাজা-মহারাজাদের চৈতন্যদয় হলো। তাদের ভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক তারা ভুলে যায় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-ভেদাভেদ। তারা চরম উত্তেজনায় সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। তারা সম্মিলিত হিন্দু বাহিনী গঠন করে বেরা ও মুলতানের মাঝে মুসলিম বাহিনীকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা আঁটে।

আবেগ নয়, আকল দিয়ে কাজ করো। সবাই মিলে একক সেনাবাহিনী তৈরি করে মুলতানের দিকে অভিযান শুরু করে। আর মুসলিম সুলতানকে সেখানকার কোনো পাহাড়ের গিরি খাদে আটকে ফেলে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করো । তাকে উন্মুক্ত ময়দানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেরেশান করে তোলে। তাহলে বেরা ও মুলতান এমনিতেই তোমাদের দখলে চলে আসবে। তোমরা যদি পেশোয়ারে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হও তাহলে তোমাদের মোকাবেলায় থাকবে মুসলমানদের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য। বেরা ও মুলতান থেকে পাঠানো সাহায্যকারীদের তোমরা পথিমধ্যেই আটকে দিতে পারবে।

রাজা-মহারাজাদের বৈঠকে কিছুক্ষণ সামরিক কৌশল নিয়ে কথাবার্তা হলো। সকল রাজা-মহারাজাই আনন্দ পালের শূন্যতা অনুভব করছিলো। পণ্ডিত তাদের জানালো, “জানতে পেরেছি সে কাশ্মীরে আছে। তাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে। তোমরা প্রত্যেক রাজ্যে ঘোষণা করে দাও, মুসলমানদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য বহুসংখ্যক সৈন্য, অনেক রসদপত্র, বাহন, অস্ত্র, পোশাক ও তাবুর প্রয়োজন। এ জন্যে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। ধর্ম ও দেব-দেবীদের মর্যাদা রক্ষা তহবিলে প্রত্যেকের উচিত উদার হস্তে দান করা। আর প্রত্যেক যুবককে সোৎসাহে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্যে আহ্বান জানাও।”

“লাহোরে আমরা দু’বার দু’টি কুমারী বলী দিয়েছি, তবুও অদৃষ্টের চাকা ঘুরলো না। দু’টি নরবলীই ব্যর্থ হয়েছে। মুসলমানরা বিজয়ী হয়েছে আর আমরা হেরেছি। মনে হয় ভগবান আমাদের প্রতি খুব অসন্তুষ্ট।” বললো এক রাজা।

“কবুল না হওয়ার কারণ হলো, এসব কুমারী সতী-সাধ্বী ছিলো না।” বললো স্তম্ভিত রাধাকৃষ্ণ। “আমি পণ্ডিতদের জানি, এরা দীর্ঘদিন এই কুমারীদ্বয়কে হেফাজতের নামে দেবতাদের আমানতের খেয়ানত করেছে। এমন পাপী পণ্ডিতদের হাতে ব্যবহৃত কুমারী বলী দিলে দেবতারা তা গ্রহণ করে না। আমিও এ কথা ভাবছি। দেবতার চরণে এক পবিত্ৰা কুমারী বলী দেয়া দরকার। এ কুমারী তোমাদের কারো নর্তকীর মধ্য থেকে দিতে হবে। নর্তকী হতে হবে যুবতী, সুন্দরী, রূপসী এবং সে হবে মুসলমান। তাকে হতে হবে রাজার খুব ও প্রিয়জন।”

“নর্তকীরা তো আর পবিত্র হয় না মহারাজ। আর আপনি বলছেন তাকে মুসলমানও হতে হবে।” বললো এক রাজা।

“হ্যাঁ, আমি এ জন্যই বলছি, তাকে কোনো পণ্ডিত নিজের কাছে রাখেনি তা তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্ডিতের কাছে রক্ষিতা ন্ম হলে তাকেই আমি পবিত্র মনে করি। আমি সেই নর্তকীকে আমার তত্ত্বাবধানেই মন্দিরে রাখবো। এরপর দেখো, এই কুমারী বলী দেবতারা কবুল করে কিনা। নর্তকীকে আমি বাছাই করবো।”

সারা হিন্দুস্তানের সকল হিন্দু রাজ্যজুড়ে হাটে-মাঠে, অলিতে-গলিতে, মন্দিরে-ভজনালয় সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়লো এ খবর- মুসলমানরা তুফানের মতো মহাভারতের একটির পর একটি দুর্গ জয় করছে। মুসলমানরা পেশোয়ার থেকে মুলতান পর্যন্ত সকল হিন্দু তরুণীদের ধরে নিয়ে সেনাদের যৌন দাসীতে পরিণত করছে। মন্দিরগুলো মুসলমানরা আস্তাবলে পরিণত করছে। যেসব হিন্দু সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে, এরা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং পঙ্গু হয়ে গেছে। এদের প্রতি দেবতারা অভিশাপ করেছে। যদি সকল হিন্দু রাজা-প্রজা মিলে মুসলমানদের প্রতিরোধ না করে, তাহলে সকল হিন্দু দেবতার অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যাবে।

এসব প্রচারণায় সকল হিন্দুর মনে দেব-দেবীর অভিশাপের ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। মন্দিরগুলোতে পুরোহিতরা ধর্মালোচনার চেয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সকল পূজারী ও হিন্দু নারী-পুরুষের মধ্যে মুসলমানদের সম্পর্কে পচণ্ড ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়। সবচেয়ে বেশি আতংক ছড়িয়ে দেয়া হয় নারীদের মাঝে। এর ফল দাঁড়ায়, (ঐতিহাসিক গরদিজী, উতবী এবং আবুল কাসেম ফারিশতার ভাষায়) হিন্দু নারীরা তাদের রক্ষিত গহনাপত্র বিক্রি করে টাকা-পয়সা সরকারী কোষাগারে জমা দিতে থাকে। যেসব নারীর গহনাপত্র ছিলো না, তারা সূতা কেটে উপার্জিত অর্থ রাজকোষে জমা করতে থাকে। অতি দরিদ্র হিন্দু মেয়েরা শ্রম বিক্রি করে অর্জিত অর্থ রাজা-মহারাজাদের সামরিক তহবিলে জমা দিতে থাকে। সারা হিন্দুস্তানের হিন্দুদের মধ্যে এমন এক উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে যে, সবাই অর্থ উপার্জন আর তা সরকারী তহবিলে জমা করার চিন্তায় পেরেশান হয়ে যায়। হিন্দু যুবকরা নিজেদের ঘোড়া সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য উদগ্রীব সময় কাটায়।

এ উন্মাদনা ছিলো মহাভারতের হিন্দুদের মনে। বিষয়টি এমন যে, পাহাড়ী আগ্নেয়গিরি তার ভূগর্ভস্থ লাভা উদগিরণ করতে চাচ্ছে। আর ভেতর থেকে আগুন-পাথর বের করে দিচ্ছিলো তার লেলিহান শিখা। দেখে মনে হচ্ছিলো, এ পাহাড় যদি এখন ভেঙ্গে পড়ে তাহলে তার আগ্নোৎপাতে সারা দুনিয়া জ্বলেপুড়ে ভ হয়ে যাবে।

সুলতান মাহমুদ গজনবী এই মানব অগ্নেয়গিরির পাদদেশেই অবস্থান করছিলেন। তিনি সেসব মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াই করে পুনরায় ফিরে এসেছেন, যারা তার আশা-আকতক্ষা এবং তার বিশ্বাসের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে। এসব ঈমান বিক্রেতাদের আক্রমণ থেকে গজনী সালতানাতকে রক্ষার জন্য সীমান্ত এলাকায় প্রচুর সংখ্যক সৈন্য যদি প্রহরায় নিয়োগ না করতে হতো, তাহলে এরা ভারত অভিযানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতো। বেরা ও মুলতান যুদ্ধে সুলতান মাহমূদের বহু সৈন্য নিহত হয়েছিলো। সৈন্য ঘাটতিতে তিনি নতুন সৈন্য ভর্তি করে অনেকাংশে পূর্ণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ভারত অভিযানের জন্য তা ছিলো অপর্যাপ্ত।

অব্যাহত বিজয়ের পরও সুলতান কখনো নিজের শক্তি-সামর্থের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আস্থায় আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেন না। তিনি এমনটিও কখনো ভাবেননি যে, হিন্দু রাজা-মহারাজারা তাকে বিনা প্রতিরোধে ছেড়ে দেবে। সুলতান নিজের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করার জন্য একটু অবকাশ চাচ্ছিলেন। রাজা আনন্দপালের পক্ষ থেকেই তিনি প্রত্যাঘাতের বেশি আশংকা করছিলেন। ভারতের সকল রাজা-মহারাজা সম্মিলিতভাবে তার বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে এ চিন্তাও তিনি মাথায় রেখেছিলেন।

ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় পাওয়া যায়, সুলতান মাহমূদ তার বাহিনীকে বিজয়ের আনন্দে বিভোর হয়ে অবকাশ যাপনের সুযোগ দেননি। তিনি পুনরায় সৈন্যদেরকে অধিকতর কঠিন সামরিক কৌশল রপ্ত করাতে মনোযোগী ছিলেন এবং সৈন্যদেরকে শৃঙ্খলা রক্ষার প্রতি যত্নবান করে তোলেন। সেনাবাহিনীকে নতুন করে উচ্চতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা এবং কমান্ড ও নিয়ম-শৃখলা মেনে চলার প্রতি অভ্যস্ত করে তোলার কাজটি করতেন সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত ইমামগণ। তাছাড়া সুলতান মাহমূদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো, তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (মালে গনীমত) থেকে কখনো সেনাদের বঞ্চিত করতেন না। পক্ষান্তরে বিজিত এলাকায় সেনাবাহিনীর যথেচ্ছাচার ও লুটপাটও তিনি বরদাশত করতেন না।

তিনি গোয়েন্দা বাহিনী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন রাজধানীতে বসবাসকারী স্থানীয় মুসলমানরা সুলতানের গোয়েন্দাদের সম্ভাব্য সহযোগিতা করতো। অবশ্য এসব মুসলমানদের মধ্যে ঈমান বিক্রেতাও ছিলো। এরা প্রায়ই মুসলমান গোয়েন্দাদের ধরিয়ে দিতো। তদুপরি সুলতানের গোয়েন্দা ব্যবস্থা এতোটুকু মজবুত ছিলো যা দ্বারা তিনি কোনো রাজধানীতে হিন্দু রাজা-মহারাজারা কি করছে, এসব খবর তার কাছে সময় মতোই পৌঁছে যেতো। কিছু সংখ্যক সৈন্যের অনুরোধে রাজা আনন্দ পাল কাশ্মীর থেকে তার রাজধানী লাহোরে ফিরে এলো। সে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছিলো বলে সুলতান মাহমুদের সাথে সন্ধি চুক্তি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এমনকি আনন্দ পাল এক দূত মারফত সুলতান মাহমূদের কাছে সন্ধি প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলো।

এ ব্যাপারে বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং সুলতান মাহমূদের এসব অভিযানের প্রত্যক্ষদর্শী আলবেরুনী লিখেছেন, রাজা আনন্দ পালের পক্ষ থেকে এমন সময় এক দূত সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলো, যখন সুলতান কাশগড় সীমান্তে আক্রমণকারী এক মুসলিম ক্ষমতালিম্পুর সাথে জীবনপণ যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। সেই যুদ্ধ এতোটাই কঠিন হয়ে পড়েছিল যে, সুলতানের কাছে কখনো বিজয় সুদূরপরাহত মনে হতো। এমন সংকটজনক পরিস্থিতির সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিলো আনন্দ পালের কাছে। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার পরও আনন্দ পাল সুলতানের কাছে এই বলে পয়গাম পাঠায়;

“আমি জানতে পেরেছি, তুর্কীরা আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং বিদ্রোহ খোরাসান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আপনি সম্মত হলে আমি পাঁচ হাজার অশ্বারোহী, দশ হাজার পদাতিক এবং একশ’ জঙ্গী হাতি নিয়ে আপনার সহযোগিতার জন্য আসতে প্রস্তুত। তাছাড়া আপনি সম্মতি দিলে আমার পরিবর্তে আমার ছেলেকে এর চেয়েও দিগুণ সৈন্যসহ পাঠাতে প্রস্তুত। আমার এই প্রস্তাবকে আপনি যেভাবেই মূল্যায়ন করুন না কেননা, আমি তাতে দুঃখিত নই। কারণ, আপনি আমাকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। আমি চাই না আপনার উপর অন্য কেউ বিজয়ী হোক।”

এ পয়গাম ও প্রস্তাব থেকে অনুমান করা যায়, রাজা আনন্দ পাল সুলতান মাহমূদের সামরিক দক্ষতা ও রণকৌশলের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল ও ভীত ছিলো। সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে পুনর্বার যুদ্ধ করার মতো সাহস আনন্দ পাল হারিয়ে ফেলেছিলো।

অবশ্য সুলতান মাহমূদ শুধু কৌশলি সেনাপতিই ছিলেন না; মেধা ও দূরদর্শিতার ক্ষেত্রে তৎকালীন মুসলিম শাসকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি হিন্দুদের কূট-চরিত্র সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন। সেই সময় তার সামরিক সহযোগিতার খুবই প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তিনি এক পরাজিত হিন্দু রাজার সহযোগিতা নিতে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি আনন্দ পালের সামরিক সাহায্যের অন্তরালে এই আশংকাবোধ করছিলেন, আনন্দ পাল হয়তো চাচ্ছে, সুলতান মাহমূদ গযনবী গজনীর মধ্যেই স্বজাতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত থাকুক। তাছাড়া এ আশংকাও উড়িয়ে দেয়ার মতো ছিলো না যে, সাহায্যের নাম করে কঠিন কোন মুহূর্তে সুলতানের পক্ষ তাগ করে আনন্দ পাল সৈন্যবল নিয়ে প্রতিপক্ষে চলে যাবে।

আনন্দ পাল কি ইতিহাস ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একথা জানাতে চায় যে, সুলতান মাহমূদ এক হিন্দু রাজার সহযোগিতায় যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলো।

আনন্দ পালের পয়গাম ও প্রস্তাব নিজ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শুনিয়ে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন সুলতান। এর মধ্যে যদি অন্য কোন দূরভিসন্ধি নাও থাকে, তবুও এ কথা কিভাবে মেনে নেয়া যায় যে, চরম দু’প্রতিপক্ষের মাঝে এখন মৈত্রী স্থাপিত হয়ে গেছে। যে আমার ধর্মের শুক্র, আমার জাতির শত্রু, তার কোন প্রস্তাবে আমি সম্মত হতে পারি না, তার সহযোগিতার প্রস্তাব গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

তিনি আনন্দ পালের দূতকে মৌখিকভাবেই এ বলে জবাব দিলেন যে, তোমার রাজাকে গিয়ে বলবে, “আমাদের সাথে তার কোনো সন্ধি সমঝোতা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন অসম্ভব।”

এ জবাবের পরও আনন্দ পাল লাহোরে ফিরে এলো। সন্ধি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আনন্দ পালের সামনে একটাই পথ খোলা ছিলো, চূড়ান্ত যুদ্ধ করে পরিণতিতে পৌঁছা। তখনো আনন্দ পালের সৈন্য সামন্তের ঘাটতি ছিলো না। সে রাজধানীতে পৌঁছেই তার সামরিক কমান্ডার, সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসলো। বৈঠকে সে জানালো, খুব অত্যল্প সময়ের মধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানতে চায়। সে বললো, এবার সে যেভাবেই হোক লড়াই করে সুলতানের কজা থেকে বেরা ছিনিয়ে আনতে চায়। কথোপকথনে এ কথাও উঠলো, এতো কম সৈন্য নিয়ে সুলতান মাহমূদ কিভাবে জয়লাভ করবে।

আজ পর্যন্ত কিংবা স্বর্গবাসী মহারাজা জয়পালও সুলতান মাহমূদকে কোন ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকাতে পারেনি। বললো জয়পালের এক সেনাপতি। আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছার আগেই সে খবর পেয়ে যায়। যার ফলে সে তার সেনাবাহিনীকে নিজের মতো করে প্রস্তুত করে নেয়। প্রতিবারই দেখা গেছে, আমরা তার তৈরি ফাঁদে আটকা পড়েছি। এর অর্থ হলো, সে আমাদের অগ্রাভিযানের আগাম সংবাদ পেয়ে যায়। তার গোয়েন্দারা খুবই সতর্ক। এরা হয়তো আমাদের মধ্যেই বসবাস করে।

কিছুসংখ্যক মুসলমান আমাদের এখানে বসবাস করে, এদের মধ্যেই হয়তো গোয়েন্দা রয়েছে। বললো আনন্দ পাল। এ জন্য মুসলমান আবাদী ধ্বংস করে দেয়া দরকার।

এই পদক্ষেপ আমাদের তেমন কোন ফল দেবে না মহারাজ। বললো আনন্দপালের প্রধান উজীর। সেসব লোককে এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে গোয়েন্দারাও পালিয়ে যাবে। তার চেয়ে আমাদের উচিত, এমন পদক্ষেপ নেয়া যাতে গোয়েন্দাদের ধরা যায়। এখানকার মুসলমানদের শত্রু বানানো ঠিক হবে না। আপনি তো জানেন, সব মুসলমান গোয়েন্দাগিরি করে না। মুসলমানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি মুসলমানের দ্বারা স্বার্থকভাবে করানো সম্ভব। আমাদের এ পদক্ষেপ নেয়া দরকার, যাতে মুসলমানরাই আমাদের হয়ে মুসলমান আবাদীর ভেতরের খোঁজ-খবর রাখে। এদের মধ্যে কে কে গোয়েন্দাগিরি করে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। অন্তত একজনকে যদি ধরা যায়, তাহলে এ কাজে কারা জড়িত সে তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে।

তাহলে এদের ধরার কাজ আজ থেকেই শুরু করো এবং দ্রুত সেনা প্রস্তুতি শুরু করে দাও।

আনন্দ পালের উজির সন্তুষ্টির সাথে জানালো, প্রজারা খুবই সহযোগিতা করছে মহারাজ। মন্দিরে মন্দিরে পুরোহিত পণ্ডিতরা সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা এবং পুনরায় চূড়ান্ত আঘাত হানার ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করছে। জনসাধারণকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। ফলে সেনাবাহিনীতে দলে দলে যুবক ভর্তি হচ্ছে এবং প্রজাসাধারণের পক্ষ থেকে অঢেল ধন-সম্পদ রাজকোষে জমা হচ্ছে।

* * *

রাজা আনন্দ পালের রাজপ্রাসাদে ঘোড়ার দেখাশোনা এবং বেয়াড়া ঘোড়াকে বাগে আনার কাজে নিয়োজিত ছিলো ওয়াইব আরমুগানী নামের এক মুসলমান। সে ছিলো সুঠাম ও স্বাস্থ্যবান, দীর্ঘদেহী ও অভিজ্ঞ অশ্বারোহী। সে পেশোয়ারের অধিবাসী। রাজা জয়পালের আত্মাহুতির আগে সে লাহোরে আসে। তখন সে ছিলো তরুণ। আর এখন সে পূর্ণ যুবক। সে যে কোনো বেয়াড়া ঘোড়াকে সহজে বাগ মানাতে পারে। এ জন্য রাজা জয়পাল যেমন শুয়াইব আরমুগানীকে ভালবাসতো, রাজা আনন্দ পালও তাকে অধিক পছন্দ করে। ঘোড়া বাগ মানানো ছাড়া আরও বহু গুণের অধিকারী ওয়াইব। যার ফলে রাজ প্রাসাদের সকল মানুষ এমনকি রাজকুমারী ও রাজকুমারদের কাছে শুয়াইব আরমুগানী ছিলো খুবই প্রিয়পাত্র। তার কণ্ঠ ছিলো মায়াবী এবং কথাবার্তায় ছিলো জাদুমাখা। তার ঠোঁটে সব সময় হাসি লেগে থাকতো। তার বিশ্বস্ততার প্রশ্নে কারো মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিলো না। রাজপ্রাসাদে সে এতোটাই বিশ্বস্ত ও প্রিয়পাত্র ছিলো যে, রাজমহলের সবাই তাকে নামে মাত্র মুসলমান ভাবতো।

রাজা আনন্দ পালের রাজমহলে আরো ক’জন মুসলমান কর্মচারী ছিলো। তারা ছোট ছোট কাজ করতো। রাজা আনন্দ পালের নির্দেশে অতি গোপনে এসব মুসলমানদের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে দিলো উজির। হিন্দু সেনারা মুসলমানদের ছদ্মবেশে তাদের যাচাই করতে শুরু করলো। তারা সুলতান মাহমূদের পক্ষে আর হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিষোদগার করতো। সেই সাথে মুসলমান মহিলাদের সাথে খাতির জমিয়ে তাদের স্বামী-পুত্রদের মনোভাব ও কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতো। হিন্দু পুরুষরা ছদ্মবেশ ধারণ করে মুসলমান পুরুষদের সাথে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করতো এবং তাদের ভেতরের খবর জানার জন্যে বন্ধুত্বের অভিনয় করতো। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদেরকে সুলতান মাহমুদের গোয়েন্দা বলেই পরিচয় দিতো। এই প্রচেষ্টায় একজন মুসলমানকে গোয়েন্দা সন্দেহে গ্রেফতার করা হলো। সন্দেহের ভিত্তিতে আরো কয়েকজন মুসলমানকে গ্রেফতার করে কারা প্রকোষ্ঠের অন্তরালে কঠিন শাস্তির চাকায় পিষ্ট করতে শুরু করলো।

শুয়াইব আরমুগানী মুসলমান হলেও তার প্রতি কারো সন্দেহ করার অবকাশ ছিলো না। কারণ, সে ছিলো আস্তাবলের প্রধান। ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করা এবং আস্তাবল দেখাশোনার মধ্যে তার কার্যক্রম ছিলো সীমিত। তাকে সন্দেহ করার একটিমাত্র অজুহাত ছিলো যে, সে একাকী থাকতো। পেশোয়ারে তার স্ত্রী-সন্তান থাকলেও তাদের সে কখনো লাহোর আনেনি। সে অবিবাহিত হলে অতোদিনে তার বিয়ে করার প্রয়োজন ছিলো। এদিক থেকে তাকেও সন্দেহ করা যেতো কিন্তু এসব ব্যাপারে তাকে সবাই সন্দেহের বাইরে রেখেছিলো। তার সম্পর্কে অনেকেই জানতো, সে সুলতান মাহমূদ সম্পর্কে খুবই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। সে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলে। তাকে কেউ কখনো মসজিদে যেতে দেখেনি। কোন মুসলমানের সাথে মিশতেও তাকে দেখা যায়নি।

এক সন্ধ্যায় তার বসতঘরে সে একাকী বসেছিলো। এমন সময় তার দরজায় কে যেনো টোকা দেয়। সে উঠে এসে দরজা খুলে দেয়। বাইরে দাড়িওয়ালা এক পৌঢ়ের সাথে বোরকা পরিহিতা এক যুবতী দাঁড়িয়ে। পুরুষটি নিজের পরিচয় দিয়ে জানালো, সে পেশোয়ারের অধিবাসী। একজন ব্যবসায়ী। সে ব্যবসায়িক কাজে এখানে এসেছে। তার মা মরা মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ, বাড়িতে কারো কাছে রেখে আসার মতো লোক তার নেই। মেয়েটির মা দু’বছর আগে মারা গেছে। মেয়েটিও বেড়ানোর জন্য আগ্রহী ছিলো। এ জন্য তাকে আর রেখে আসার চিন্তা করিনি।

লোকটি পেশোয়ারের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিল। মুসাফিরদের জন্যে সরাইখানায় থাকার ভালো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এমন সুন্দরী যুবতী মেয়েকে সরাইখানায় রেখে আসা ঠিক মনে করিনি। শুনেছি, হিন্দু সেনারা হঠাৎ করে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায় আর সন্দেহের নাম করে মুসলমানদের বন্দী করে। এক লোক আপনার কথা বলে দিলো। বললো, সে খুব ভালো মানুষ। একাকী থাকে। আপনি মেয়টিকে নিয়ে তার বাড়িতে চলে যান। সেই লোকটির মুখে আপনার খুব প্রশংসা শুনলাম। সে-ই আমাকে আপনার বাড়ির পথ দেখিয়ে দিয়েছে। লোকটি বললো, আপনার বাড়িও নাকি পেশোয়ারে।

কোনো মুসলমান অসহায় মুসাফিরের জন্যে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে পারে না। যেখানে একটি মুসলিম তরুণীর ইজ্জতের প্রশ্ন, সেখানে আমি প্রয়োজনে সারারাত পাহারা দিয়েও কাটাতে পারি। মুসলমান অপরিচিত হলেও পর হতে পারে না। আসুন, আপনার মেয়েকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসুন। আমার ঘরে কয়েকটি কক্ষ আছে।

লোকটি তরুণী মেয়েটিকে নিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। তরুণী বাতির আলোয় যখন তার চেহারার নিকাব ফেলে দিলো, তখন শুয়াইব আরমুগানী তার চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলো।

মেয়েটি কোনো সাধারণ তরুণী ছিলো না। তার চেহারা ছিলো চাঁদের মতো আকর্ষণীয়। তরুণীর রূপ দেখে আরমুগানীর মুখ থেকে আচমকা উচ্চারিত হলো, আপনি সরাইখানায় না থেকে ভালো করেছেন। ঢেকে রাখার মতো জিনিসকে একটি নয়, সাত পর্দার আড়ালে রাখাই উচিত।

আগন্তুককে বসিয়ে রেখে দৌড়ে বাজারে গেলো আরমুগনী। বাজার থেকে মেহমানদের জন্যে খাবার নিলো। ততক্ষণে তরুণী বোরকা খুলে মাথার উড়নাও খুলে ফেলেছে। বে-নেকাব তরুণীর রূপ-সৌন্দর্য দেখে আরমুগানী আর তরুণীর চেহারা থেকে দৃষ্টি সরাতে পারলো না।

রাজপ্রাসাদের চাকরির সুবাদে কয়েকজন সুন্দরী তরুণী আরমুগানীকে বাহুডোরে বাঁধতে চেয়েছিলো। কিন্তু আরমুগানী কারো বাঁধনেই নিজেকে আবদ্ধ করেনি। রাজা আনন্দ পালের দু’রাজকুমারী আরমুগানীর কাছে অশ্বারোহণ শিখতে আসতো। এরা উভয়েই চেষ্টা করতো তারা নিজে নিজে ঘোড়ার পিঠে ওঠে বসবে না, আরমুগনী যাতে হাত ধরে তাদের ঘোড়ার পিঠে তুলে দেয়। তারা অশ্বারোহণ শিখে ফেলেছিলো, তবুও বারবার শেখার জন্যে আসতো আর বলতো, এখনো তারা ভালোভাবে অশ্বারোহণ করতে পারে না।

উভয় রাজকুমারী ছিলো সুন্দরী-রূপসী। তাদের পরিষ্কার ইঙ্গিতপূর্ণ আবেদনগুলোও আরমুগানী এভাবে এড়িয়ে যেতো, সে এতোটাই গেয়ো যে এসব বোঝে না। অথবা এমন ভাব করতো যে, তার বুকের মধ্যে পুরুষের আত্মাই নেই।

একবার এক রাজকুমারী ঘোড়া হাঁকিয়ে তাকে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানকার এক নিরিবিলি বনানীতে রাজকুমারী আরমুগনীকে অনুরোধ করে বলে, সে যেনো তার পেছনে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে। কারণ, তার পড়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছে। রাজকুমারী প্রথমে বন্ধুত্বের সুরে বললো, আরে এসো না! আমাকে ধরে রাখো। কিন্তু আরমুগানী তার সহ-সওয়ার হতে অস্বীকৃতি জানালো। কয়েকবার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলে রাজকুমারী নির্দেশের সুরে তার ঘোড়ায় চড়তে বলে। এবার মুচকি হেসে আরমুগনী এড়িয়ে গেলো, তবুও একই ঘোড়ার পিঠে রাজকুমারীর সাথে বসতে রাজি হলো না। এতে রাগ করে রাজকুমারী ঘোড়া ফিরিয়ে প্রাসাদে চলে এসেছিলো।

নারীদের ব্যাপারে আরমুগানী ছিলো পাথর। কিন্তু এবার সে নিজের ঘরে আসা মেহমানের তরুণী মেয়েকে দেখে নিজের মধ্যে ঝড় অনুভব করলো। এক প্রবল আকর্ষণ তাকে তরুণীর দিকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করতে লাগলো। সে তরুণীর সাথে কথা বলার জন্য মনের মধ্যে তাড়না বোধ করলো। সেই সাথে মনে মনে এ কথাও সে ভাবতে লাগলো, এর মধ্যে তার কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই তো! সে চাচ্ছিলো, তার মেহমান যদি বাইরে চলে যেতো, তবে এখানেই সে তরুণীর সাথে আলাপ জমাতে পারতো। তরুণী যখন শুয়াইব আরমুগনীর দিকে তাকাতো, তখন তার ঠোঁটের কোণার ঈষৎ মুচকি হাসিটা আরমুগানীর মধ্যে এক তাণ্ডব শুরু করে দিচ্ছিলো।

রাতের আহার পর্ব সেরে আরমুগানী মেহমানদের রাত যাপনের জন্য অন্য দু’টি কক্ষ দেখিয়ে দেয়। তরুণী দেখিয়ে দেয়া কক্ষে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তরুণীর বাবা ফিরে এসে আরমুগানীর পাশে বসে।

রাতের অবসরে তারা নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে মেহমান বলে, আমি মুসলমান হিসেবে সুলতান মাহমূদের অব্যাহত বিজয়ে গর্ববোধ করি। মেহমানের কথাবার্তায় প্রকাশ পাচ্ছিলো, সে সুলতান মাহমূদের খুবই ভক্ত এবং তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। সে শুধু একজন ব্যবসায়ী নয়, জ্ঞান-গরিমা ও বেশ উঁচুমানের লোক মনে হলো তার আলাপচারিতায়। সে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রসঙ্গেও আলোচনা করলো। এখনও যদি সেই চেতনায় সুলতান মাহমূদ অগ্রসর হন, তাহলে সারা হিন্দুস্তান মুসলমানদের কজায় নিয়ে আসা সম্ভব। মেহমান এই আশংকাও ব্যক্ত করলো, সুলতান মাহমুদের কাছে সৈন্য বাহিনী কম। হিন্দুস্তানের সকল রাজা-মহারাজা মিলে যদি তার বিরুদ্ধে। যুদ্ধ ঘোষণা করে, তাহলে সুলতান মাহমূদের পক্ষে পেরে ওঠা অসম্ভব।

আরমুগানী মেহমানের বুদ্ধিদীপ্ত কথায় খুবই খুশি হলো এবং বললো, মুসলমানদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সুলতানের সৈন্যরা আল্লাহর উপর অসা রেখে যুদ্ধ করে।

“তা ঠিক। কিন্তু শুধু সেনাদের যুদ্ধ করাই যথেষ্ট নয়। সকল মুসলমানেরই উচিত কিছু না কিছু করা। দেখুন, আমরা দুজন মুসলমান এখানে আছি। আমরা মুসলিম বাহিনীর জন্য কি করেছি। অথচ তারা জীবনবাজি রেখে কাফেরদের দেশে ইসলামের পতাকা তুলে ধরেছে। আর আমি এখানে ব্যবসা করছি, আপনি বেঈমানদের নৌকরী করছেন।” মেহমান বললো।

“এখন করছি বটে। প্রয়োজনে আমি চাকরি ছেড়ে দেবো।”

“না ভাই। চাকরি ছাড়ার প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে দেখতে চেয়েছিলাম, আপনি কোন্ পর্যায়ের মুসলমান। এখন বুঝতে পারছি, আপনি ইসলামের জন্যে মরণ স্বীকার করতে প্রস্তুত। এখন আমি আপনার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারবো। আপনি চাকরি ছেড়ে দেয়ার কথা বলছেন। এটা ঠিক হবে না। চাকরিটাকে আপনি সুলতান মাহমূদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারেন। আপনি আস্তাবলের প্রধান এবং প্রশিক্ষক। অশ্বারোহণ প্রশিক্ষক হওয়ার সুবাদে হিন্দু সেনা কর্মকর্তাদের ছেলে-মেয়েরা আপনাকে খুবই পছন্দ করে বলে আমাকে জানিয়েছে সেই লোক- যে লোকটি আমাকে আপনার বাড়ির পথ দেখিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, শাহজাদীরা ও উজির-মন্ত্রীদের তরুণী মেয়েরাও আপনাকে ভালোবাসে। আপনার আর কিছু করার দরকার নেই, শুধু এতোটুকু জানতে চেষ্টা করবেন, রাজার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? এখানকার প্রস্তুতি ও তৎপরতা দেখে-শুনে সুলতান মাহমূদের কাছে সুযোগ মতো খবর পাঠিয়ে দেবেন।”

“আপনি এ ধরনের কাজ করেন নাকি?”

একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে মেহমান বললো, “আসলে আমি যথার্থই একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু ব্যবসায়িক কাজে আমার লাহোর আসার কোন প্রয়োজন ছিলো না। আমি উট বোঝাই করে মালপত্র নিয়ে এ জন্যে লাহোর এসেছি যাতে এখানকার পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারি। রাজা আনন্দ পাল কি করেছে, তার রণপ্রস্তুতি কোন্ পর্যায়ে এবং কবে নাগাদ সে মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছে- এসব জানাই হলো আমার মূল উদ্দেশ্য। ওদিকে সুলতানের কিছুটা সময় দরকার। কাশগরীদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে তার বিপুল সৈন্য হারাতে হয়েছে। সেনাবাহিনীকে পুনরায় তৈরি করার জন্যে তার কিছুটা সময় একান্তই দরকার।”

“আপনাকে কেউ পাঠিয়েছে। না আবেগের টানেই আপনি এ কাজ করছেন?”

“আমি কোনো মাধ্যম হয়ে কাজ করি না। সরাসরি আমার সম্পর্ক সুলতান মাহমূদের সাথে এবং তার প্রধান সেনাপতি আবু আবদুল্লাহ আল-তায়ীর সাথে। এখানে আমার এমন একজন লোকের দরকার যে রাজ-দরবার ও রাজমহলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে খবর রাখে, আর সেই লোকটি আপনি। যে লোকটি আমাকে বাড়ির পথ দেখিয়ে দিয়েছে সে আমার বিশ্বস্ত। সে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে বুঝে-শুনেই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে।”

“সে কো”।

“সে কথা আমি আপনাকে বলতে পারবো না। তাতে আপনি এমনটা মনে করবেন না আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি না। আমি সবই আপনাকে জানাবো কিন্তু আপনাকে এ প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, আপনি আমার কাজে সহযোগিতা করবেন? যদি আপনি আমাকে ধোকা দেন তাহলে পস্তাতে হবে।”

মেহমানের এসব কথা শুনে আরমুগনীর মাথা নীচু হয়ে গেলো। সে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো।

“আপনি একটু ভেবে দেখুন। সুলতান মাহমূদের প্রয়োজনে আমি আমার তরুণী মেয়েকে পর্যন্ত ব্যবহার করার জন্যে তৈরি হয়ে গেছি।” প্রচণ্ড আবেগে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো মেহমান। “এমন রূপসী তরুণী যে প্রয়োজনে পাথর ভেঙ্গে ভেতরের তথ্য বের করে আনতে পারবে। এমনও হতে পারে যে, এখানে আমাদের কোনো নাশকতামূলক তৎপরতা চালাতে হবে।”

“আমার দুটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন।” বললো আরমুগানী।

“মেয়েদেরকে কখনো এ কাজে ব্যবহার করবেন না। মুসলমান মেয়েরা প্রয়োজনে লড়াই করে, অতীতে বহু ক্ষেত্রে মেয়েরা ময়দানে লড়াই করেছে। কিন্তু গোয়েন্দা কাজের জন্য তাদেরকে কাফেরদের মনোরঞ্জনের জন্য ছেড়ে দেবেন না। এটা সম্পূর্ণ হারাম। এ ঘৃণ্য কাজ বেঈমানরা করে। মুসলমানরা নারীর ইজ্জত রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে- ইজ্জত বিকিয়ে দেয়ার জন্য নয়। দ্বিতীয় কথা হলো, আমি আপনার কোনো সহযোগিতা করতে পারবো না। আমি রাজার খাই, রাজার সেবা করি। রাজা আমাকে এতো পারিশ্রমিক দিচ্ছেন যে তা আমার শ্রমের তুলনায় বহুগুণ বেশি।”

“হু, একদিকে আপনি ইসলামী চেতনা ও মর্যাদার কথা বলেন, আর অপরদিকে বেঈমানদের নিমক হালালী করেন। অথচ আমি শুনেছিলাম আপনি খুবই সাহসী ও নির্ভেজাল ঈমানদার মানুষ।”

“এই উভয়টাই আমার মধ্যে আছে। সাহসও আমার আছে, ঈমানেও কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু তাই বলে মুসলমান নিমকহারাম হয় তা আমি বলতে পারবো না।”

“তাহলে তো তাড়াতাড়ি আমার লাহোর ছাড়া দরকার। কারণ, আপনি আমাকে ও আমার মেয়েকে ধরিয়ে দিতে পারেন। এখানকার বিশ্বস্ত লোকেরা আমাকে বলেছে, সন্দেহ হলেই মুসলমানদেরকে রাজার সৈন্যরা পাকড়াও করছে।”

চকিতে বসা থেকে ওঠে তাক থেকে কুরআন শরীফ নামিয়ে মেহমানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, পবিত্র কিতাবের শপথ করে বলছি, আমি আপনাকে ও আপনার মেয়েকে কখনো ধরিয়ে দেবো না। আপনার সাথে কোনো ধরনের ধোকাবাজি করবো না। এখন আপনি শপথ করে বলুন, এ কাজে আপনি আপনার মেয়েকে কখনো ব্যবহার করবেন না। আর আপনি সুলতান মাহমূদ গজনবীকেও ধোকা দেবেন না।”

মেহমান কালবিলম্ব না করে কুরআন শরীফ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো, “মেয়ের ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে আপনি আমার উপর জুলুম করেছেন। আপনি জানেন না আমি কী ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছি। যদি আমি ধরা পড়ে যাই তাহলে আমার মেয়েকে করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। আপনি কি এ মুহূর্তে আমার মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারবেন? কিছুক্ষণ তাকে আপনার এখানে রাখতে পারবেন। এ অবসরে আমাকে ব্যবসায়িক কাজে একটু বাইরে কাটাতে হবে।”

“কোনো তরুণী মেয়েকে অনাত্মীয়ের ঘরে রাখা অশংকাজনক কাজ। কিন্তু আমি আপনার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারছি না, আবার গ্রহণ করতেও ভয় পাচ্ছি।”

মেহমান বণিক বসা থেকে ওঠে ঘরের মেঝেতে মাথা নীচু করে পায়চারী করতে থাকে। কিছুক্ষণ ভেবে বললো, “আমি যদি আপনার কাছে আমার মেয়েকে পেশ করি, তাহলে আপনি তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হবেন? আমি চাচ্ছি, নিজেই ওর বিয়ে পড়িয়ে দেবো।”

“আপনি আমার মধ্যে এমন কি গুণ দেখতে পেলেন যে এমন সুন্দরী মেয়েকে আমার মতো একটা সাধারণ লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন? আমি নিজেকে আপনার মেয়ের জন্য উপযুক্ত মনে করি না।”

“তোমার সবচেয়ে বড় গুণ তুমি গোয়েন্দা নও। এ জন্যই আমি তোমাকে যাচাই করতে চাচ্ছিলাম, তুমি গোয়েন্দাগিরি করো কিনা। তুমি একজন বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী। এদিক থেকে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপদ। কারণ, গোয়েন্দাদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। তারা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের সাথে রাখতে পারে না। আমার মেয়ের জন্যে বহু বিত্তশালী পাত্র আছে। পেশোয়ারে অবস্থানকারী এক ডেপুটি সিপাহসালার আমার মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহী। কিন্তু আমি সম্মতি দেইনি। আমি কোনো বিত্তশালীর কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চাই না। কারণ, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এক বিবিতে সন্তুষ্ট থাকে না।”

মেহমানের বিয়ের প্রস্তাবের কথা নিজের কানে শুনেও শুয়াইব আরমুগানীর যেনো বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কারণ, এই তরুণীকে প্রথম দর্শনে সে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেছে। মেয়ের বাবা নিজ থেকে বিয়ের প্রস্তাব করায় তার পক্ষে এ ব্যাপার নিয়ে আর ভাবনা-চিন্তা করা অপ্রীতিকর মনে হচ্ছে। তারপরও আরমুগানীর মাথায় বিক্ষিপ্ত ভাবনারা ভীড় করছে।

“আমি আজ সন্ধ্যায় আবার আসবো।” এই বলে আরমুগানীর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মেহমান। এখন আরমুগানী আর তরুণী ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই।

সকাল বেলা। নাস্তার আয়োজন করে আরমুগানী তরুণীর সামনে রেখে বললো, “তোমার নাম কি?”

মেয়েটির সলজ্জ উত্তর, “যারকা।”

“আমার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে। তোমার বাবা কি তোমাকে একথা বলেছেন?”

আরমূগানীর কথা শুনে তরুণী লজ্জায় মাথা এতোটাই নীচু করে ফেললো যে, সে যেনো লজ্জায় মারা যাচ্ছে।

“আরে এতো লজ্জা কিসের? আমার কথার জবাব দাও যারকা?” আরমুগানী তরুণীর চিবুক ধরে মাথা উপরে তুলে বললো। “আমাকে ভালো করে দেখে নাও। আমাকে যদি তোমার পছন্দ না হয় তাহলে পরিষ্কার বলে দাও। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সারা জীবনের জন্যে আমি তোমাকে শিকলে বাঁধতে চাই না। তুমি অসম্মত হলে আমি তোমার বাবাকে খোলাখুলি নিষেধ করে দেবো। বলবো, এ বিয়ে হবে না।”

তরুণী মুখে কিছুই বললো না। আরমুগানীর ডান হাতটি টেনে নিয়ে চুমু দিলো এবং চোখে চোখ রাখলো তরুণী।

প্রায় যৌবনের শুরু থেকেই অশ্বারোহণ ও অশ্ব প্রশিক্ষণে কেটেছে আরমুগানীর জীবন। অশ্বলোমের স্পর্শে ঘোড়ার গায়ে হাত বুলাতে অভ্যস্ত সে। সে কখনো অনুভব করেনি কোনো যুবতী তরুণী সুন্দরীর এমন মায়াবী স্পর্শ, শরীর জুড়ে শিহরণ। এমন ভুবন মোহিনী চাহনী, এমন নজরকাড়া দৃষ্টি, এমন রেশম কোমল স্পর্শের সাথে আরমুগানী অপরিচিত। হঠাৎ রূপসীর এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ ও আত্মনিবেদনে আবেগে আত্মহারা হয়ে গেলো আরমুগানী।

সন্ধ্যায় যারকার বাবা যখন ফিরে এলো, তখন তার সাথে এলো আরও দু’জন। তারা এসে শুয়াইব আরমুগানীর সাথে যারকার বিয়ে পড়িয়ে দিলো। যারকার পিতা যারকাকে বিয়ে উপলক্ষে দামি দামি কাপড়, গহনাপত্র এবং প্রচুর নগদ অর্থ উপঢৌকন দিলো।

বিয়ে পর্ব সেরে রাতেই যারকার বাবা আরমুগানীর ঘর থেকে বিদায় নেয়। তার যাওয়ার ভঙ্গিটা এমন ছিলো, সে যেনো যারকার বিয়ে দিতেই এখানে এসেছিলো। সেই রাতে ওয়াইব আরমুগানীর সংশয় হচ্ছিলো, কোনো স্বপ্ন দেখছে না তো?

যারকার বাবা চলে যাওয়ার একটু পরে যারকা আরমুগানীর সাথে এমন অন্তরঙ্গ মনোভাব পোষণ করছিলো যেনো আরমুগানী তার অনেক দিনের পরিচিত। মনে হচ্ছিলো, দীর্ঘদিন থেকে সে আরমুগনীকেই মনের একান্ত পুরুষ হিসেবে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলো। যারকার আত্মনিবেদনে আরমুগানী এতোটাই আত্মহারা যে, মনে হচ্ছিল ঝর্নার তীরে এসেও সে তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছে।

“তোমার বাবা সুলতান মাহমুদের ব্যাপারে বেশি আবেগপ্রবণ।” যারকার উদ্দেশ্যে বললো আরমুগানী। “আচ্ছা তুমি কি বলতে পারো তার এসব বলার উদ্দেশ্য কি?”

“আমি যদি বলি, বাবা যে ইচ্ছা পোষণ করেন, আমিও তাই পোষণ করি। তাহলে আপনি আমার এ ইচ্ছাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? বাবা আপনার সাথে যেসব কথা বলেছেন, তিনি সবই আমাকে বলে গেছেন।”

‘এ কথাও কি তিনি বলেছেন, তার গোয়েন্দা কাজে সহযোগিতার জন্য তুমি যাতে আমাকে সম্মত করাও?”

“যা, আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনার সাথে এখন আর আমার কিছু লুকানোর নেই। তিনি আমাকে বলে গেছেন, আমি যাতে বলে-কয়ে আপনাকে তার সহযোগিতা করতে উৎসাহিত করি। কারণ, রাজা আপনাকে এমন দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন, যেখান থেকে আপনি খুব মূল্যবান তথ্য সগ্রহ করতে পারেন।”

“এ জন্যই কি তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। আমার তো মনে হয়, এ কাজের পুরস্কার হিসেবে আমার হাতে তোমাকে তুলে দেয়া হয়েছে।”

“না না, তা নয়। পুরস্কার মনে করতে পারেন। তবে তা আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন। কোনো ব্যক্তি দেননি। আপনি এখন শুধু আমার জীবন সঙ্গী নন, আপনি আমার মনের শান্তি, হৃদয়ের অধিপতি। আমি গতকালই আপনাকে প্রথম দেখেছি। অথচ আমার মনে হচ্ছে, কতকাল ধরে আপনি আমার একান্ত পরিচিত। এখন থেকে আপনিই আমার সুখ, আপনিই স্বপ্ন, আপনিই বাস্তব। এখন আপনিই আমার হৃদয় রাজ্যের অধিকারী। আপনার কোনো সংশয়-সন্দেহ পোষণের কারণ নেই। বাবা আপনাকে ইসলামের জন্যে আত্ম-উৎসর্গকৃত পতঙ্গ মনে করতে পারেন। তিনি এতোটাই উগ্রীব যে, পারলে একাই সারা হিন্দুস্তান ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে আসবেন। আমি দেখেছি, তিনি যতো মুসলমানের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, সবাইকে এ কথাই বুঝাতে চেয়েছেন, সুলতান মাহমুদের বিজয় অভিযানে প্রত্যেক মুসলমানের করণীয় রয়েছে। মসজিদে গিয়ে তিনি দীর্ঘ সময় সুলতানের বিজয় ও হিন্দুদের পরাজয়ের জন্য দুআ করেন। তিনি নিজে আমাকে তরবারী চালনা, অশ্বারোহণ ও তীরন্দাজী শিখিয়েছেন। একবার তো তিনি আবেগে আমার উদ্দেশে বলেই ফেললেন, বেটি হতে পারে আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারবো না, এর আগেই ইসলামের জন্য তোমার কুরবান হয়ে যেতে হবে।”

যারকার কথায়ও আরমুগানী বুঝতে বাধ্য হলো, এ মেয়েটিও তার বাবার মতোই আবেগপ্রবণ।

“এ কথা তোমাদের কে বলেছে যে, আমি গজনীর গোয়েন্দা?”

যারা এ সময় এক হাত আরমুগানীর কাঁধে তুলে নিজেকে এতোটাই কাছে নিয়ে এলো যে, তার ললাট আরমুগানীর ললাট স্পর্শ করছে। বাবাকে এ ব্যাপারে কে কি বলেছে তা আমি জানি না। তিনি আমাকে শুধু বলেছেন, আমরা যার কাছে যাচ্ছি তিনি খুবই কাজের লোক। আপনি যদি সত্যিই বলে থাকেন যে, আপনি সুলতান মাহমুদের গোপন দলের লোক নন, তাহলে সেটা হবে আমার জন্য হতাশার কারণ।”

“তাহলে কি মনে-প্রাণে তুমি আমাকে ভালোবাসা দিতে পারবে না?”

“এ কথা বলছেন কেন? ভালবাসা ভিন্ন জিনিস। একবার মনের মণিকোঠায় যার ঠাই হয়ে যায়, দুনিয়ার কোনো স্বার্থের কারণে তা নষ্ট হতে পারে না। আমার হৃদয় রাজ্যে আপনার আসন পাকাঁপোক্ত হয়ে গেছে। আমি আপনাকে বোঝাতে চাচ্ছি, আমি এমন একটা কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই, যাতে গোটা হিন্দুস্তান না হোক অন্তত অর্ধেক হিন্দুস্তান ইসলামী পতাকার ছায়ায় স্থান পায়। যাতে এখানকার অনাগত প্রতিটি শিশু মুসলমান হিসেবে পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেড়ে উঠতে পারে।

“তোমাকে এ কথা কে বলেছে যে, শুধু গোয়েন্দাগিরির দ্বারাই সুলতান মাহমূদকে সহযোগিতা করা যাবে। গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ ছাড়াও তাকে আরো সহযোগিতা করার বহু পদ্ধতি রয়েছে।”

“বাবা শুধু গোয়েন্দাগিরির কথাই আমার কাছে বলেছেন। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, নারীরা নাকি গোয়েন্দা কাজে বেশি সহযোগিতা করতে পারে। বাবা বলেছেন, আপনি নাকি এ কাজে আমাকে ব্যবহার না করার জন্য তাকে কুরআন শরীফ হাতে তুলে দিয়ে শপথ করিয়েছেন। আমিও এমন কোনো কাজ করতে পারবে না যে ক্ষেত্রে আমার ইজ্জতের উপর আঘাত আসতে পারে। তবে এ কথাও ঠিক, শুধু আপনার বিবি হয়ে ঘরে বসে থাকাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার হয়ে আপনি সে কাজ করুন যা বাবা আপনাকে বলে গেছেন। তাতেই আমার আত্মা শান্তি পাবে।”

শুয়াইব আরমুগানী যারকার এ আবেদনের কোনো সান্ত্বনাদায়ক জবাব দিতে পারেনি।

* * *

সেদিন থেকেই ঘরের প্রতি আরমুগানীর আকর্ষণ বেড়ে যায়। সে এখন কাজের মধ্যে সময় বের করে ঘরের পথ ধরে। ঘরে কিছুক্ষণ যারকার সাথে কাটিয়ে আবার কাজে যায়। যারা এখন আরমুগানীর স্ত্রী। কিন্তু আরমুগনী তাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েও স্বস্তি পাচ্ছে না। বারবার সে যারকার দিকে এমনভাবে তাকায়, যেনো যারকাকে কেউ কোনো সময় তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার আশংকা আছে। আরমুগানীর সীমাহীন ভালোবাসার বিপরীত যারকাও তার প্রতি আত্মোৎসর্গকৃত মনোভাব পোষণ করে, তার প্রেমে যারকা যে চরম সুখী তা অকপটে প্রকাশ করে। আর প্রতি রাতেই সে আরমুগনীকে প্ররোচনা দেয় ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণে আরমুগানী যেনো অবশ্যই তার বাবার কাজে সহযোগিতা করে। সুলতান মাহমূদের বিজয়ের জন্য অবশ্যই আরমুগানী যেনো কিছু একটা ভূমিকা রাখে। সেই সাথে যারকা আরমুগানীর প্রতি সীমাহীন বিশ্বস্ততার প্রকাশ ঘটাতে থাকে। সুলতান মাহমুদের সাফল্যের চিন্তায় সে বারবার আবেগে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। যেনো সুলতান মাহমূদের অমঙ্গল হলে সে মরেই যাবে।

* * *

বিয়ে পরবর্তী উষ্ণতা, আবেগ ও পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার মুগ্ধতার মধ্যে কিভাবে কেটে গেলো দশ-বারো দিন তা আরমুগানী টেরই পায়নি। দশ-বারো দিন পর এক রাতের প্রায় দ্বিপ্রহর। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর ভালোবাসার উষ্ণতায় পরিতৃপ্ত। যেনো উভয়ের শরীর বেয়ে প্রেম গলে গলে পড়ছে। রাত বাড়ছে। দিনভর ক্লান্তিকর শ্রমের কারণে আরমুগনীর দু’চোখ বুজে আসছে। যারকা আরমুগানীর গলায় নিজেকে জড়িয়ে বলে, “আপনার শরীরের উষ্ণতা, আপনার ভালোবাসা, আপনার সৌন্দর্য আমাকে যেনো বেহেশতে পৌঁছে দিয়েছে। সত্যিই আমার মনে হয় জান্নাত এর চেয়ে মোটেও বেশি সুখের নয়। কিন্তু এতো ভালোভাসা, এতো প্রেম, এতো সুখের মধ্যেও আমার চোখে যখন দীনের জন্যে শাহাদাতবরণকারী যোদ্ধাদের ছবি ভেসে ওঠে, তখন আমার মনটা বিষিয়ে ওঠে। মনে হয় শহীদদের আত্মাগুলো আমার এই সুখানন্দে অভিশাপ দিচ্ছে। আমার কানে যেনো ধ্বনিত হয় শহীদদের কণ্ঠ, তুমি প্রেম ভালোবাসায় ডুবে আছে! আমাদের আত্মার শান্তি আর আত্মত্যাগকে সফল করার পরিবর্তে অলস সময় কাটাচ্ছে!”

আরমুগনীকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, “প্রিয়তম! তুমি আমার খ্র আত্মার এই আকুতিটুকু মেরে ফেলে। যাতে আমি শুধু একটা সুন্দরী পুতুলে প্র পরিণত হয়ে যাই। নয়তো আমার কাছে মনে হয় শহীদদের অসমাপ্ত মিশন যদি আমরা পূর্ণ করতে না পারি, তাহলে আমরা মুসলমান হিসেবে নিজেকে পরিচয় C দেয়ার অধিকার রাখি কি? এমন হলে ধর্মই ত্যাগ করা উচিত।”

এমনিতেই যারকার আত্মনিবেদন, কথার জাদুমালা আর রূপ-সৌন্দর্যে আরমুগানীর মধ্যে জন্ম নেয় ভাবালুতা। আবেগে তার মনের গোপন বাঁধ ছিঁড়ে যাওয়ার দশা। এর মধ্যে যারকার এই কাব্যিক কথামালা আর হৃদয় গলানো নিবেদন তাকে আরো বেশি উদ্বেলিত করে তোলে। যারকার ভালোবাসা আরমুগানীর বোধজ্ঞান কর্তব্য ও অঙ্গীকারকে পরাভূত করে ফেলে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে অন্তরের গোপন কুঠরীতে পুষে রাখা রহস্যের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে আরমুগানী। সে বলে, “যারকা! আমি মসজিদে বসে হাতে কুরআন শরীফ নিয়ে শপথ করে বলেছিলাম, জীবন দোবো কিন্তু আমার বন্ধুদের কথা কারো কাছে প্রকাশ করবো না। কিন্তু আজ আমি নির্দিধায় শপথ ভেঙ্গে দিচ্ছি এ কারণে যে, এখন আমার বিশ্বাস হয়েছে তুমি শুধু আমার বিবাহিতা স্ত্রীই নও, তুমি আমার সেইসব বন্ধু ও সহকর্মীদের মতোই বিশ্বস্ত, যারা পেশোয়ার থেকে এখানে আসার আগে কুরআন শরীফ নিয়ে নিজেদের আত্মপরিচয় গোপন রাখার শপথ নিয়েছিলো। যারকা, শোন! তোমাকে আমার গোপন ভেদ বলে দিচ্ছি। আমি গজনী সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। যৌবনেই আমি গজনী সেনাবাহিনীতে গোয়েন্দা বিভাগে প্রশিক্ষণ নিয়েছি এবং প্রশিক্ষণের পর কর্তা ব্যক্তিরা আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। আমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, যতো বেয়াড়া ঘোড়াই হোক না কেন আমার হাতে তাকে বশ মানতেই হবে। তাছাড়া আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আমার রয়েছে। এখানে আসার পর আমার এই গুণের কথা জানতে পেরে রাজা আমাকে আস্তাবলের প্রধান নিয়োগ করেন।… সেই দায়িত্ব পালনে আমার ত্যাগের কথা চিন্তা করলে তুমি পেরেশান হয়ে যাবে যারকা। যৌবনের সব আকাক্ষাগুলোকে কর্তব্য পালনের প্রয়োজনে গলাটিপে মেরে ফেলেছি। এখনো পর্যন্ত বিয়ে করিনি। বছরের পর বছর আমি সম্পূর্ণ একাকী কাটিয়েছি। তোমার মতো বহু সুন্দরী রূপসী আমাকে প্রেম নিবেদন করেছে। এমনকি রাজ কুমারীরাও আমাকে একান্তে পাওয়ার জন্য বহু লোভ দেখিয়েছে। প্রেমের আবেদন প্রত্যাখ্যান করায় আমাকে হত্যা করানোর ভয়ও দেখিয়েছি। তবুও নারীর ব্যাপারে আমি পাথর ছিলাম। লাহোর ও বাটান্ডায় গজনীর যতো গোয়েন্দা, সব আমার কমান্ডের অধীনে। যতোবার হিন্দুরা আমাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনা করেছে, আমার সহকর্মীরা আগেভাগেই এ খবর সুলতানের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। যার ফলে সুলতান পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে হিন্দু সেনাদের ফাঁদে ফেলে কচুগাছের মতো কেটেছে।

যারকা! আমরা হলাম সেই চোখ, যে চোখ দিয়ে সুলতান গজনীতে বসেও এখানকার প্রকৃত পরিস্থিতি দেখতে পান। আমরা হলাম সেই কান, যে কানের দ্বারা সুলতান গজনীতে থেকেও লাহোর থেকে কয়টি ঘোড়া তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পান। আমার সহকর্মীরা লাহোরে হিন্দু বাহিনীর রসদপত্র জ্বালিয়ে দেয়ার মতো দুঃসাহসী কাজও সাফল্যের সাথে সম্পাদন করেছে। এখন রাজা আনন্দ পাল পুনর্বার সুলতানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা আবারও তাদের রসদপত্রে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চালাবো, যাতে সুলতান যুদ্ধের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ পান।

যারকা! আমার পক্ষে একথা বলা সম্ভব নয়, আর কতদিন আমি তোমায় সঙ্গ দিতে পারবো। তুমি এমন একজন মানুষের সাথে নিজেকে জড়িয়েছে, যার মাথা জল্লাদের তরবারীর নীচে অঁকানো। তোমার বাবাকে আমার এই গোপন পরিচয়ের কথা বলা সম্ভব ছিলো না। কারণ, তার পরিচয় আমার অজ্ঞাত।”

যারকা আরমুগনীকে বুকে জড়িয়ে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললো, “আপনি আমার হৃদয়কে আনন্দে ভরে দিয়েছেন। আপনার এই কর্তব্য পালনের কথা শুনে আমার দারুণ সুখ লাগছে। আমি ভীষণ গর্ব অনুভব করছি। আমি আপনার সাথে এ মর্মে অঙ্গীকার করছি, আমাকে আপনি যে কোন কঠিন কাজেই ব্যবহার করুন না কেন। আমি ঠিকই সাফল্যের সাথে সেই কাজ সম্পাদন করতে পারবো। আমাকে যদি আপনি কোনো জায়গায় আগুন লাগাতে বলেন কিংবা আগুনে ঝাঁপ দিতে বলেন, তাতেও আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবো না।”

“আমি নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তোমাকে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে দেবো না। আমি যদি গ্রেফতার হওয়ার আশংকা বোধ করি কিংবা আমার জীবনহানীর আশংকা সৃষ্টি হয়, তবে বহু আগেই আমি তোমাকে বলে দেবো, আমার অবর্তমানে তোমাকে কোথায় আশ্রয় নিতে হবে।”

“আপনার দু’একজন সহকর্মীর নাম-ঠিকানা আমাকে বলুন। আপনার ঘরে ফিরতে দেরি হলে বা কয়েক দিন বাড়ি ফেরার সুযোগ না পেলে আমি যাতে আপনার খোঁজ-খবর তাদের কাছ থেকে নিতে পারি।”

“না যারকা! আমরা নিজের মায়ের কাছেও বন্ধুদের পরিচয় প্রকাশ করি না। আমার অবর্তমানে যদি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে আমার সহকর্মীরাই এসে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। তাদের সাথে এমন কোনো চিহ্ন থাকবে, যা দেখে তুমি নিশ্চিত হতে পারবে যে, তোমার সাথে তারা কোনো ধরনের ধোকাবাজি করছে না।”

যারকা যখন আরমুগানীর দু’একজন সহকর্মীর নাম-ঠিকানা জানার জন্য কয়েকবার বিগলিত আবেদন জানালো, তখন এক পর্যায়ে রাগে-ক্ষোভে চোখ লাল করে আরমুগানী বললো, “যারকা! এ কথা তোমার মুখে যেননা আর কোনদিন উচ্চারিত না হয়। মনে রাখবে, এ ব্যাপারে আমি তোমার ভালোবাসাকেও ত্যাগ করতে পারবো।”

***

আরো কিছুদিন এভাবেই কেটে যায়। যারকা আরমুগানীর ঘরণী হয়ে দৃশ্যত চরম সুখানুভব প্রকাশ করলেও ভেতরে ভেতরে কঠিন হয়ে ওঠে। ততদিনে আরমুগনী যারকার কাছে নিজের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছে। আরমুগানীর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর যারা তার প্রতি প্রকাশ্যে আরো বেশি পতিগতপ্রাণ স্ত্রীর মতো আচরণ করতে শুরু করে। এক রাতে দীর্ঘ সময় আরমুগানী ও যারা নিজেদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা ও আদর-সোহাগে কাটিয়ে দেয়। আরমুগানী দিনের বেলায় আস্তাবলে নতুন কিছুসংখ্যক আনীত ঘোড়াকে সামলানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটানোর ফলে দিনে ঘরে সময় দিতে পারেনি বলে মধ্যরাত পর্যন্ত যারকার সাথে খোশালাপ করে। এক পর্যায়ে সে ক্লান্তশ্ৰান্ত দেহে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে! কিন্তু যারকার চোখ নিধুম।

ঘুমন্ত স্বামীকে কিছুক্ষণ জেগে জেগে নিরীক্ষণ করে যারকা। যারকা যখন দেখলো, আরমুগানী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তখন আস্তে করে বিছানা থেকে ওঠে সে সতর্ক পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পা টিপে টিপে দেউড়ির কাছে চলে আসে। দেউড়িতে এসে বাড়ির গেটে কান লাগিয়ে আবার উঠানে দাঁড়িয়ে কি যেন আন্দাজ করতে চেষ্টা করে। এরপর ঘরের ভেতরে গিয়ে আরমুগনীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। আরমুগানী তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে নাক ডাকছে। আবার ঘর থেকে উঠানে এসে পা টিপে টিপে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে যারকা। এমন সময় বিড়ালের ডাক শুনতে পায় যারকা। কিন্তু বিড়ালের ডাক কি ঘরের ছাদ থেকে এলো না সদর দরজার বাইরে থেকে এলো, ঠিক ঠাহর করতে পারলো না। সে পা টিপে টিপে সদর দরজার কাছে যায়। সদর দরজার খিল খুলে সে দরজা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকালে দেখে তিনজন লোক দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এদের একজন এগিয়ে এসে কানে কানে বলে, “ঘুমিয়ে পড়েছে।”

যারকা তাৎক্ষণিক কোন জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে থেকে অতি ক্ষীণকণ্ঠে বললো, “একটু আগেও সজাগ ছিলো, এখন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি তোমাদের জন্যে গেটের পাশেই অপেক্ষা করছিলাম। তোমরা এখানেই দাঁড়াও। যদি ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে আমি তোমাদের ডাকবো।”

গেটের বিল বন্ধ করে দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘরে প্রবেশ করে যারকা। হঠাৎ সে আরমুগনীকে মাথা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেয়। গভীর ঘুম থেকে ধড়ফড় করে জেগে উঠে আরমুগানী। চোখ মেলে প্রদীপের আলোয় যারকার চেহারা দেখে ভড়কে যায়। “কি ব্যাপার, তোমার কি হয়েছে যারকা?”

আরমুগানীর মুখে আঙ্গুল দিয়ে যারকা ফিস ফিস করে বলে, “বেশি কথা বলার সময় নেই আরমুগানী।” দ্রুত কথা বলতে শুরু করলো যারকা। “আরমুগানী! এ মুহূর্তে তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও। আমি তোমাকে ধোকা দিয়েছি। আমার বাবা তোমাকে ফাঁসানোর জন্য আমাকে প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমার বাবা আসলে কোন ব্যবসায়ী নন, তিনি আনন্দ পালের পোষা এক গোয়েন্দা। আমরা পেশোয়ার নয়, বাটান্ডা থেকে এসেছি। তোমার ব্যাপারে রাজপ্রাসাদের একজন সংশয় প্রকাশ করেছিলো যে, তুমি গজনী সুলতানের পক্ষে গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত। কিন্তু এই দাবীর পক্ষে এ পর্যন্ত কেউ কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। এই দায়িত্ব অবশেষে আমার বাবার কাঁধে অর্পণ করা হয়- তুমি গোয়েন্দা কিনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে এবং তুমি গোয়েন্দী হয়ে থাকলে তোমার সাথে আর কে কে রয়েছে তা জানতে। দায়িত্ব নিয়ে বাটান্ডা থেকে সে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে আসে এবং নিজেকে একজন সুলতান ভক্ত ব্যবসায়ী হিসেবে তোমার কাছে পরিচয় দেয়। সে নিজে তোমার প্রকৃত পরিচয় জানার বহু চেষ্টা করেছে কিন্তু তোমার প্রকৃত পরিচয় জানা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে তার কর্তব্য পালনের হাতিয়ার হিসেবে সে আমাকে তোমার কাছে বিয়ে দেয়। অবশ্য আমার রূপ-সৌন্দর্যে তুমি অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছিলে বটে, কিন্তু তোমার প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করা ছিলো আমার দায়িত্ব। কোনো পুরুষই নারীর প্রতি দুর্বলতাকে অস্বীকার করতে পারে না। তদুপরি তোমার কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসা ও চরম অনুগত স্ত্রীর অভিনয় করে তথ্য উদ্ধার করার সফলতা ছিলো আমার একান্ত কাম্য। আমার কাজে আমি শতভাগ সাফল্য পেয়েছি।”

যারকার কথা শুনে আরমুগানীর পিলে চমকে যায়। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো যারকার কথা শুনতে থাকে। যারকা দ্রুত বলে চললল, “তুমি কাজে চলে যাওয়ার ফাঁকে এক মহিলা আমার কাছে আসতো, আমি তোমার কাছ থেকে কতটুকু রহস্য উদ্ধার করতে পেরেছি, প্রতিদিন সে এ রিপোর্ট নিয়ে যেতো। একদিন আমি সেই মহিলাকে বললাম, লোকটি গজনী বাহিনীর একজন ভয়ংকর গোয়েন্দা। সে লাহোর বাটান্ডায় নিয়োজিত গোয়েন্দাদের কমান্ডার। এ কথা শুনে আমাকে তোমার সহকর্মীদের পরিচয় জানার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তুমি আমার একান্ত চেষ্টার পরও সহকর্মীদের পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানালে। আমি আমার বাবাকে খবর পাঠালাম, এ লোকের কাছ থেকে তার সহকর্মীদের পরিচয় জানা সম্ভব নয়। এ কথা শুনে আমাকে খবর পাঠালো, আজ রাতে যেন আমি জেগে থাকি। বাইরে বিড়াল ডাকার মিউ মিউ শব্দ শুনতে পেলে আমি যেন দরজা খুলে দিই। তিনজন সশস্ত্র লোক আসবে। এদের মধ্যে আমার বাবাও থাকবে। তারা তোমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। তারপর এরা তোমার কাছ থেকে বাকি তথ্য উদ্ধার করার জন্য তোমাকে অবর্ণনীয় শাস্তি দেবে। আরমুগনী! আমার একটি অনুরোধ তুমি রাখো। এর বেশি আর তুমি আমার কাছ থেকে জানতে চেয়ো না। ওরা এসে গেছে। বাইরে অপেক্ষা করছে।”

“তাহলে তুমি দরজা খুলে দিচ্ছে না কেন?” এক লাফে একথা বলে বিছানা থেকে ওঠে দাঁড়ালো আরমুগানী। তার কক্ষে রাখা বর্শা হাতে নিয়ে বলে, “দূর হো বদকার, বেশ্যা কোথাকার! তোর ঘাতক তিনজনকে নিয়ে আয়, নয়তো আমিই দরজা খুলে দিচ্ছি। দেখবি, কিভাবে তিনজনকে বধ করে তোর শিকার বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়।”

আরমুগনীকে জড়িয়ে ধরে যারকা। বলে, “আরমুগানী! তোমার পায়ে পড়ি, আমার কথা একটু শোনো। আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি বাইরে যেও না।”

এদিকে তিন ঘাতক বাইরে দাঁড়িয়ে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। একজন বললো, “এতোক্ষণে তো দরজা খুলে দেয়ার কথা।”

“কি জানি, ছুড়কি না আবার আমাদের ধোকা দেয়। ও ভেতর থেকে দরজা আটকিয়ে গেলো কেন?” বললো অপর একজন।

“হু, মনে হয় তোমার মেয়ে ওর দাসীতে পরিণত হয়েছে। যারকার বাবার উদ্দেশ্যে উন্মা প্রকাশ করলো অপর এক ঘাতক। “তুমি তো খুব চালাক। কিন্তু অনেক সময় অতি চালাক লোকও বেকুব হয়ে যায়।”

“আরে বক বক করো না তো! আরেকটু সময় অপেক্ষা করেই দেখো না কি হয়।” কিছুটা ধমকের স্বরে বললো যারকার বাবা।

***

যারকা শুয়াইব আরমুগনীকে আরো বলে, “তোমার প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করে দেয়ার দায়িত্ব আমি কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। সেই দায়িত্ব আমি ষোল আনা আদায় করেছি। আমি বাবাকে তোমার প্রকৃত পরিচয় বলে দিয়েছি। আমি ধোকা ও প্রতারণার যে পুতুল সেজে তোমার ঘরে প্রবেশ করেছিলাম, কিন্তু তোমার আকর্ষণীয় পৌরুষ, তোমার ব্যক্তিত্ব আর ইসলামী সালতানাতের প্রতি তোমার শুভ কামনা এবং তোমার উন্নত নৈতিকতার জিঞ্জিরে আমি আটকা পড়ে গেছি। তোমার প্রতারণামূলক কাজের প্রয়োজনে তোমার কাছে আমাকে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তোমার অকৃত্রিম স্নেহ-ভালোবাসা আমাকে সারা জীবন তোমার দাসী হয়ে থাকার জন্যে বিবেকে তাড়না সৃষ্টি হয়েছে। আমি কোনো দ্র ঘরের মেয়ে নই। এ পর্যন্ত যারাই আমার সঙ্গ দিয়েছে, সবাই আমার শরীর নিয়ে উল্লাস করেছে। একমাত্র তুমি আমাকে হৃদয়ের সীমাহীন ভালোবাসা দিয়ে সিক্ত করেছে। আমাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছো বলেই আমার নিকট তোমার প্রকৃত পরিচয় জানাতে দ্বিধা করোনি। তুমি নিজের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে আমার প্রতি তোমার অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছে। এর ফলে আমার হৃদয়ে মরে যাওয়া ইসলামী চেতনা পুনরুজ্জীবন লাভ করেছে।

বাবার নির্দেশ আমি এ জন্যে মানতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, ছোট বেলায় আমার মা মারা গেছে। বাবা আমাকে মায়ের আদর দিয়ে বড় করেছে। সে কোনো দিন আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। বাবার ধন-রত্নের কোনো অভাব ছিলো না। সে আমাকে শাহজাদীর মতো আরাম-আয়েশে বড় করেছে। আমি বড় হলে তার ন্যায়-অন্যায় প্রতিটি নির্দেশ অতি-আনুগত্যের সাথে পালন করেছি। বাবা আমাকে ব্যবহার করে হিন্দু ক্ষমতাশীলদের হাত করেছে এবং তাদের মাধ্যমে রাজার বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে। সে তার ঈমান বিক্রি করে প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জন করেছে। সে মুসলমান হয়েও হিন্দুদের হাতে মুসলমানদের অপমা ও লাঞ্ছিত করেছে। এ সবকেই আমি ‘জীবন ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার সামনে যে নতুন জগতের দরজা খুলে দিয়েছে, সে জগত সম্পর্কে আমি মোটেও পরিচিত ছিলাম না। আমি জানতাম না, স্বামীর ভালোবাসাই যে নারীর জাগতিক জান্নাত।

আমি বাবার হক আদায় করেছি। দরজা খুলে ওদের আসা নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত আমার ইচ্ছা ছিলো তোমাকে ধরিয়ে দেবো। কিন্তু যখন ওদের দিকে তাকালাম, ওদের চেহারা দেখে মনে হলো ওরা যেনো আমাকে চিড়ে আমারই কলজেটা বের করে নিতে এসেছে। আমার হৃদয়ে একটা কাঁপুনী অনুভব করলাম। আমার বাবার চেয়ে তখন তোমাকেই বেশি আপন মনে হতে লাগলো। বাবার কাছে আমি একটা পণ্য মাত্র। কিন্তু তোমার হৃদয়ে আমি এক নিঃসীম সুখের আধার। এ জন্য আমি তাদের কাছে মিথ্যা বলেছি। বলেছি, ও এখনো ঘুমোয়নি। একটু অপেক্ষা করো, ঘুমিয়ে পড়লেই তোমাদের ডাকবো। ওরা বাইরে তোমাকে গ্রেফতার করার জন্য অপেক্ষা করছে। আরমুগনী! তোমার ভালোবাসা, ধর্মের প্রতি তোমার নিষ্ঠা এবং তোমার কর্তব্যপরায়ণতার কসম! তুমি পালিয়ে যাও। দেয়াল টপকে পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যাও। হয়তো তোমার সাথে আবারও দেখা হবে। যদি জীবিত থাকি তবে দেখা হবেই। তুমি যেখানেই থাকো না কেনো আমি তোমাকে খুঁজে বের করবোই।”

ওদিকে অপেক্ষমান তিন ঘাতক দরজা খুলতে বিলম্ব হওয়ায় অস্থির হয়ে পড়ে। তাদের একজন বলে, “আমি ঘরের পেছনের দিকে যাচ্ছি। আমার মনে হয় ওরা পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে গেছে।”

রাজার গোয়েন্দা দলের একজন যখন ঘরের ছাদের উপর ওঠে, তখন আরমুগানী ছাদ থেকে দেয়াল টপকে নীচে নেমে গেছে। কারো উপরে ওঠার শব্দ শুনে সে দেয়াল ঘেঁষে একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়। লোকটি ছাদের উপর থেকে আরমুগানীর উদ্দেশে হুমকি দিলে আরমুগানী এক লাফে বাউন্ডারির দেয়াল টপকে দৌড় দেয়। তাকে দৌড়াতে দেখে রাজার লোকেরা হৈচৈ শুরু করে দেয় কিন্তু ততোক্ষণে আরমুগানী কয়েকটি গলি পেরিয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। এরপরও তিন ঘাতক তার পিছু ছুটতে থাকে। আরমুগানী পেছনে তাদের আসতে দেখে দৌড়ের গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। রাতের অন্ধকার তার পথ চলা এবং নিজেকে আড়াল করার জন্য সহায়ক হয়।

এক পর্যায়ে শহরের অলিগলি পেরিয়ে সে অনেকটা ফাঁকা জায়গায় চলে এসেছে। এখানটায় বাড়িঘর কম। এখানে একটি হাভেলী দেখতে পায় যার চারপাশটা দেয়াল ঘেরা এবং দেয়ালের পাশে ঝোঁপ-ঝাড়ের মতো বাগান। সে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ একটা ঝোঁপের কাছে এসে বসে পড়ে এবং উঁকিঝুঁকি করতে থাকে। আরমুগানী হামাগুড়ি দিয়ে দেয়ালের ফটক পর্যন্ত এসে ত্বরিৎ ফটকের ফাঁক দিয়ে দেয়ালের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং ফটকের বিপরীত দিকে চলে যায়। সে তখনও দাঁড়ায়নি। হামাগুড়ি দিয়েই এগুচ্ছিলো।

পেছনে দৌড়াতে থাকা ঘাতকরা ফটকের কাছে এসে আরমুগনীকে খুঁজতে থাকলে ফটকের প্রহরী তাদের বললো, “এখানে কাউকে খুঁজছো? এখানে কেউ আসেনি।” রাজার লোকেরা যখন জোর দিয়ে বললো, “আমরা তো দেখলাম একটা চোর এদিকেই এসেছে।” প্রহরী তাদের কড়া ভাষায় বলে দেয়, “না, এখানে কোনো লোক আসেনি। এটা একজন সম্মানি লোকের বসতবাড়ি। এখানে চোর প্রবেশ করবে কিভাবে?”

রাজার লোকেরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।

কিছুক্ষণ পর আরমুগানী দাঁড়িয়ে দেখে, হাভেলীর একটি কক্ষে প্রদীপ জ্বলছে। সে বুঝতে পারে, এখানে অপেক্ষা করা ঠিক নয়। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ভাবলো, তার পিছু নেয়া ঘাতকরা এখনও হাভেলীর আশপাশে তাকে খুঁজতে পারে। এ ভাবনায় সে ঠায় বসে থাকে।

আরমুগানী এই হাভেলী সম্পর্কে জানতে কিন্তু কখনো এখানে আসার সুযোগ হয়নি। এটা ছিলো রাজা আনন্দ পালের একান্ত নর্তকী ও গায়িকার হাভেলী। প্রকৃতপক্ষে এই গায়িকা ছিলো মুসলমান। কিন্তু নিজেকে সে বাদিনী বলে পরিচয় দিতে। পেশাগত যোগ্যতা ও দৈহিক সৌন্দর্যে সে ছিলো অনন্যা। সামুরাতি নামেই পরিচয় দিতো নর্তকী। সামুরাতি নিজের যোগ্যতা ও মান সম্পর্কে ছিলো পূর্ণ সচেতন। সে রাজা আনন্দ পালের কাছ থেকে এ দাবী আদায় করে নিয়েছিলো যে, সে রাজ প্রাসাদের ভেতরে বসবাস করবে না। সামুরাতির আবেদনে রাজার টাকায় নির্মিত এই হাভেলীটি ছিলো যথার্থ অর্থেই রাজকীয়। হাভেলীর চারপাশে ছিলো সাজানো মনোরম বাগান। অসংখ্য বাহারী গাছ-গাছালি আর ফুল-ফলের সমাহার। প্রতি রাতের মামুলী নাচের অনুষ্ঠানে নাচ-গান করতো না সামুরাতি। রাজপ্রাসাদে যদি বিশেষ কোন অতিথি আসতো তখন নাচ-গান পরিবেশনের জন্য ডাক পড়তো সামুরাতির। সামুরাতি সাধারণ কোনো নর্তকী নয়, সে একটা উড়ন্ত প্রজাপতি। কারো পক্ষে সামুরাতিকে স্পর্শ করাও অসম্ভব।

সে রাতে যখন আরমুগানী তার হাভেলীতে প্রবেশ করে, এর কিছুক্ষণ আগেই রাজমহল থেকে ফিরেছিলো সামুরাতি। কারণ, এ রাতে অন্য কোনো রাজ্যের রাজার আগমনে রাজপ্রাসাদে বিশেষ নাচ-গানের অনুষ্ঠান ছিলো। সে রাজপ্রাসাদ থেকে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাজ-পোশাক খুলছিলো। সামুরাতির যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যৌবন তাকে বিদায় জানাতে চাচ্ছে। সে তার বৃদ্ধা সেবিকার উদ্দেশে বলে, “আজ খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি খালাম্মা।”

“নর্তকীরা যখন ক্লান্তি অনুভব করে, তখন তার উচিত বিয়ে করে ফেলা।” সামুরাতির উদ্দেশে বলে বৃদ্ধা সেবিকা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নর্তকী ও গায়িকারা মনে করে তাদের কণ্ঠ আর রূপ-জৌলুস আজীবন অম্লান থাকবে আর তাদের উপর মানুষ সবসময় ফুলচন্দন ছিটাবে।”

“আরে আমি তো এখনও যুবতী।” মুচকি হেসে সেবিকার উদ্দেশে বলে সামুরাতি।

“আমিও তোমার মতোই ভাবতাম। তুমি তো জানো, আমিও তোমার মতোই রাজমহলের নর্তকী ছিলাম। এখন তুমি যেমন সুখ্যাতি পেয়েছে, আমার সময়ে আমিও ছিলাম এমন বিখ্যাত। তুমি যেমন কাউকে পাত্তা দাও না, আমিও তখন বড় বড় মহারাজকেও পাত্তা দিতাম না। তখন আমার পেশায় যেসব প্রবীণ মহিলা ছিলো, তারা আমাকে বিয়ে করার কথা বলতো। আমিও তখন তোমার মতোই বলতাম, আরে এখনই বিয়ে কিসের? আমি তো এখনও যুবতী মাত্র। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, আজ আমি তোমার সেবিকা। প্রবীণদের কথা না মেনে আমি যখন অনেক বয়সে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুতি নিলাম, তখন আমার শরীর ভেঙ্গে গেছে। যৌবনে আমার ঘরের আঙ্গিনায় আমার সাথে ভাব জমানোর জন্য যারা সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করতো, তারা আমার বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কোনো বুড়োও আমাকে বিয়ে রাজি হলো না।”

সেবিকার কথায় ছিলো রূঢ় বাস্তবতা। সামুরাতিও অনুভব করে, তার শরীর অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছে। সেবিকা তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বাস্তবতাকে এভাবে দেখিয়ে দিলো যে, সামুরাতির আত্মমগ্নতা উবে গিয়ে তার মনের মধ্যে উঁকি দেয় উদ্বিগ্নতা।

এমন সময় হাভেলীর বাইরে কুকুর ডাকার শব্দ শোনা গেলো। সেই সাথে এমন শব্দ শোনা যায়, যাতে মনে হয় কুকুর কারো উপর হামলে পড়েছে এবং ক্ষতবিক্ষত করছে। সামুরাতি হাভেলী পাহারার জন্য কুকুর পালতো। রাতের বেলায় যে কোনো অনাকাক্ষিত আগন্তকের প্রবেশ থেকে হাভেলীকে রক্ষার জন্য কুকুর হাভেলীর বাগানে ছেড়ে দিতো। কুকুরটি ছিলো খুবই ভয়ংকর আর শক্তিশালী। কুকুরের আগ্রাসী ডাক শুনেই সামুরাতি বুঝতে পারে, নিশ্চয়ই সে কারো উপর হামলা চালিয়েছে। তাই সে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়। সে দেখতে পায়, কুকুর একজনকে কামড়ে ধরে হেচড়াচ্ছে। সে দৌড়ে গিয়ে কুকুরটাকে ধরলে কুকুর রাগে সামুরাতির হাতেও কামড় দেয়।

“কে তুমি?” আক্রান্তকে জিজ্ঞেস করে সামুরাতি। “চুরিটুরি করতে এসেছিলে নাকি?”

“দেখো, চোর কিংবা ডাকাত হলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। আমার নাম শুয়াইব আরমুগানী।”

“আরে, তুমি কি অস্তিাবলের প্রশিক্ষক না?”

“হ্যাঁ, সামুরাতিজী। তুমি ঠিকই বলেছে।”

“তো এখানে তুমি কি নিতে এসেছিলে? ঘরে চলো। তুমি তো জানো, যদি পালাতে চাও, তাহলে তোমার অবস্থা কত কঠিন হবে”।

ঘরের আলোয় গেলে আরমুগানী বুঝতে পারে, কুকুর কামড়ে তার শরীরের সব কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলেছে। তার উভয় বাহু ও পা থেকে রক্ত ঝরছে। কুকুর তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। তার এক পা থেকে অনেকটা গোশত খাবলে নিয়েছে।

“এ কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না, তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে এখান থেকে কিছু নিতে এসেছিলো।” বললো সামুরাতি। “আমার মনে হয়, যারা আমাকে একান্তে পেতে চায় তুমিও সেই দলের একজন। লোভই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তুমি হয়তো বুঝেছো, আমি একাকী এখানে থাকি। জানো, আমার কুকুর আমার হাভেলীর চার দেয়ালের ভেতরে কোন বাঘকেও একদণ্ড দাঁড়াতে দেয় না।”

সামুরাতি তার বৃদ্ধা পরিচারিকাকে বললো, “ওর সারা শরীর কুকুর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। ওর ক্ষতস্থান ধোয়ার জন্য পানি গরম করো এবং পরিষ্কার কাপড় নিয়ে এসো, সেই সাথে শরাবও এনো। শরাব এবং কাপড় ভস্ম ক্ষতস্থান তাড়াতাড়ি শুকাতে সাহায্য করে।”

পরিচারিকা চলে গেলে আরমুগানী সামুরাতিকে বলে, “তোমার বাগানে তোমার কুকুর আমাকে হামলা করেছে, তাই তুমি আমাকে চোর বলতেই পারো। সেই সাথে আমাকে চরিত্রহীনও বলতে পারে যে তুমি একা থাকো জেনে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এসেছি। শোনো সামুরাতি! যে রূপ-সৌন্দর্যের প্রতি তোমার এতোটা গর্ব আর অহংকার, যদি তুমি তোমার এই রূপ-জৌলুস আমার চোখে দেখো, তাহলে নিজের প্রতিই তোমার ঘৃণা আসবে।”

“ও, তাহলে কি তুমি আমাকে ঘৃণা করতে রাতের আঁধারে চোরের মতো আমার বাড়িতে এসেছো?”

“শোনো, যে তোমাকে ভালোবাসে আর আমি যাকে ভালোবাসি তাকে যদি তুমি একবার দেখো, তাহলে আয়নায় নিজের চেহারা দেখাই তুমি ছেড়ে দেবে। আমি রাতের আঁধারে তোমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তোমার রূপ-সৌন্দর্য ভোগ করতে এসেছি এই অহংকার অন্তর থেকে বের করে দাও। তুমি তো আর রাজা আনন্দ পালের রাজকুমারীদের চেয়ে বেশি রূপসী নও। আমি তাদেরও প্রত্যাখ্যান করেছি।”

“হু, তাহলে এখানে কেন মরতে এসেছিলে?”

সামুরাতির এক হাতেও কুকুর কামড়ে দিয়েছিলো। সামুরাতির ক্ষতস্থান থেকে বিছানার উপর দু’তিন ফোঁটা রক্ত টপ টপ পড়লো। আরমুগানী সামুরাতির সামনে দাঁড়ানো। তার ক্ষতস্থান থেকে অনবরত রক্ত ঝরছিলো। আরমুগানী দেখলো, সামুরাতির রক্ত আরমুগনীর রক্তের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

“দেখো, তোমার রক্ত আর আমার রক্ত একসাথে মিশে কেমন উজ্জ্বল রঙ ধারণ করেছে। অথচ তোমার রক্ত কিন্তু এতোটা উজ্জ্বল ছিলো না। তুমি অব্যাহত অপরাধ আর গুনাহ করতে করতে নিজের রক্তকেও দূষিত করে ফেলেছে। তোমার রক্ত যখন দূষণমুক্ত রক্তের সাথে মিশেছে, তখন সে তার আসল বর্ণ ফিরে পেয়েছে। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছো নর্তকী। তোমাকে আমার সামুরাতি নামে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। তোমার প্রকৃত নাম আমি জানি না বটে, কিন্তু একজন মুসলিম যুবতাঁকে হিন্দু নামে ডেকে মুসলমানের অবমাননা করতে আমার বিবেক সায় দেয় না। যাক, আমি যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। দেখো, তোমার আর আমার রক্ত একই ধারার। সেই সব পিতার রক্ত আমরা শরীরে বহন করছি, যারা অভিন্ন বিশ্বাস ও আকাক্ষা পোষণ করতেন। এমনও হতে পারে, আমি এবং তুমি একই বংশজাত সন্তান।”

“আরে, তোমাকে তো পাগল মনে হচ্ছে। পাগলের মতো কি সব আবোল-তাবোল বকছো!”

“তুমি কি আমাকে চেনো, আমি কে? আমি তোমাকে তোমার রক্তের আসল পরিচয় বলে দিচ্ছি। নাচ-গান তোমার পেশা হতে পারে না। তোমার ধর্মে নাচ-গান বৈধ নয়। তোমার এই রূপ-জৌলুস, তোমার কণ্ঠ তোমার নিয়ন্ত্রিত জিনিস নয়। ভবিষ্যতে এ সবই তোমার কাছ থেকে বিদায় নেবে। আজ তুমি আমাকে বলছো, চোরের মতো আমি তোমার ঘরে হানা দিয়েছি। একদিন এমন আসবে, যখন তুমি আমার মতো কোনো চোর তোমার ঘরে হানা দিক এমন কামনায় অধীর হয়ে থাকবে। তখন রাতের বেলায় তোমার কুকুরকে বেঁধে রাখবে, যাতে কেউ তোমার ঘরে হানা দিতে পারে কিন্তু তোমার কুকুর ছাড়া আর কাউকে তুমি তোমার ঘরে দেখতে পাবে না। যাক, তুমি অন্তত একটা ভালো কাজ করো, আমাকে তোমার ঘরে আশ্রয় দাও।”

“কেন আশ্রয় চাচ্ছ তুমি? কি অপরাধ করে তুমি পালিয়েছে?”

“আমি তোমাকে একটি তরুণীর গল্প শোনাবো। সে বয়সে তরুণী, আর তোমার চেয়েও সুন্দরী। অটুট তার শরীর। পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে উজ্জ্বল তার অবয়ব। সে এক দৃষ্টিতে তোমার চেয়েও বেশি গুনাহগার, কিন্তু একটি কাজের দ্বারাই সে জান্নাতের বাসিন্দা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তুমিও অন্তত একটা পুণ্য কাজ করো। আমাকে আশ্রয় দাও…।”

 “তোমার পরিচারিকাকে এখানে আসতে দিও না। আমার ক্ষত আমি নিজেই পরিষ্কার করে নেবো। তাকে বলে দাও, আমি যে এখানে আছি, তা যেন কাউকে না জানায়।”

রাজপ্রাসাদ থেকে ঘরে ফিরে কাপড় বদলানোর সময়ও সামুরাতিকে তার বৃদ্ধা পরিচারিকাও এমন কিছু বাস্তব কথাই বলেছিলো। সেসব কথা তখনো তার মানসপটে উচ্চারিত হচ্ছিলো। এমতাবস্থায় এক সৌম্য কান্তি যুবক আহত অবস্থায় যে তার ঘরেই আশ্রয়প্রার্থী সেও তাকে বলছে, তার রূপ-সৌন্দর্যে এখন ভাটা পড়ে গেছে। এতে সামুরাতির মনের বোঝা আরো ভারী হয়ে যায়। সে পরিচারিকাকে এই বলে তার কক্ষ থেকে যেতে বলে, “আমার ঘরে যে অচেনা লোক প্রবেশ করেছে তা তুমি কাউকে বলবে না।”

সামুরাতি নিজ হাতে আরমুগানীর ক্ষতস্থানের রক্ত পরিষ্কার করলো। শরাব দিয়ে সব ক্ষতস্থান ধুয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলো। পায়ের আঘাত ছিলো খুবই মারাত্মক।

আরমুগানী সামুরাতির হাতের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে তাতে পট্টি বেঁধে দেয়। এর ফাঁকে আরমুগানী সামুরাতিকে যারকার ইতিবৃত্ত সবিস্তারে শোনায় । সামুরাতির কাছে আরগানী কোনো কথাই আর আড়াল করলো না এবং কোনো মিথ্যাও বললো না। সে সামুরাতিকে এ কথাও জানালো যে, সে সুলতান মাহমূদের হয়ে এখানে গোয়েন্দা কাজে জড়িত। সে দীর্ঘক্ষণ ইসলামের মর্যাদা ও হিন্দুদের ইসলাম বিদ্বেষের ব্যাপারে কথা বললো।

আরমুগানী বললো, “যারকাকে তার বাবা বিলাস-ব্যসনে অভ্যস্ত করে শাহজাদীতে পরিণত করেছিলো। আমাকে প্রতারিত করার ব্যাপারেও সে ছিলো সফল এবং নিপুণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু আমার আন্তরিক ভালোবাসা ও প্রেম তার মধ্যে মরে যাওয়া ইসলামী চেতনা পুনরুজ্জীবিত করেছে। যার ফলে শেষ মুহূর্তে সে এমন কাজ করেছে যাতে আল্লাহ নিশ্চয়ই তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন।”

“হয়েছে হয়েছে, আর বলতে হবে না। এখন আমার কথা শোনো। আজ রাতে কালারের রাজা এসেছে। এ জন্য রাজপ্রাসাদে আমার ডাক পড়েছিলো। রাজা আনন্দ পাল কালাজারের রাজাকে বলেছে, এই মেয়েটি মুসলমান এবং সে আমার খুব প্রিয়পাত্র ও নর্তকী। তাতে কালাজারের রাজা বললো, আমি কোনো মুসলিম সুন্দরী তরুণী দেখলে ওকে অপহরণ করে নর্তকী বানাই, নয়তো বেশ্যাবৃত্তিতে লাগাই। মুসলিম বংশ নিপাত করতে এবং ওদের চরিত্র ধ্বংস করার এই একটিই যুৎসই পথ। আপনিও যদি এই পদ্ধতি অবলম্বন করেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাবেন আপনার দেশে যেসব মুসলমান বসবাস করছে, এরা হয় নর্তকী নয়তো সব বেশ্যাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছে।”

সামুরাতি যখন আরমুগনীকে রাজা কালাঞ্জারের কথা শোনায়, তখন আরমুগনীর চেহারা দুঃখে-অনুশোচনায় লাল হয়ে যায়। আরমুগানী সামুরাতির ভেতরকার মৃতপ্রায় জাতীয় চেতনায় নাড়া দেয়। সামুরাতি যখন তাকে রাজা আনন্দ পালের রাজপ্রাসাদের কথা বলে, তখন সে সামুরাতিকে আরো উজ্জীবনীমূলক কাহিনী শোনায়। সামুরাতির জ্বলন্ত প্রদীপে এসব কথা ছিলো তেল ঢালার মতো।

আরমুগানী বললো, “দেখো সামুরাতি! আজ আমি মুসলমান তরুণীদের সম্ভ্রম বিক্রির কারণে মৃত্যুর মুখোমুখি। অথচ গজনীর যেসব যোদ্ধা এখানে এসে যুদ্ধ করে শাতাদাতবরণ করেছেন, তারা মুসলমান নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে নিজেদের জীবন বিলীন করে দিয়েছেন। শোনো সামুরাতি! তোমরা হলে হিন্দুদের খেলনার পুতুল। তোমরা পুরনো হয়ে যাচ্ছে। খেলনা পুরনো হয়ে গেলে সেগুলো আর খেলার উপযুক্ত থাকে না, তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তোমরাও চিরাচরিত নিয়মে একসময় আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই যারকা হয়ে যাও, সামুরাতি! নিজ বিশ্বাসের সাথে আর বেঈমানী করো না।”

সামুরাতি এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হয়নি। কঠিন-কঠোর রূঢ় কথা শুনতে সে অভ্যস্ত নয়। সে সাধারণত তার রূপ-সৌন্দর্য আর নিপুণ নাচ ও মনোহরী কণ্ঠের প্রশংসাই মানুষের নিকট থেকে শুনে থাকে। নিজেকে যে কেউ স্পর্শ না করতে পারা দেবী ভাবে সামুরাতি। যাকে সবাই ছুঁতে চায়, একান্তে পেতে প্রত্যাশী, আজ ঘরে ঢুকেই বৃদ্ধা পরিচারিকার মুখে শুনতে পেলো তার এই রূপ-রস, খ্যাতি ও জৌলুসে ভাটা শুরু হয়েছে, অচিরেই তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। এরপর আরমুগানী চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যৌবনের রূপ-জৌলুস বেশি দিন থাকে না। ফুল সৌরভ হারিয়ে শুকিয়ে গেলে মানুষ যেমন তা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়, কোনো ভ্রমর আর সেই ফুলে বসে না। তেমনি যৌবনের দীপ্তি নিতে গেলে কোনো পুরুষ আর তার প্রতি তাকিয়েও দেখবে না।

সামুরাতিকে আরমুগানী বললো, “তুমি নিজেই একটা ধোঁকা, আর যারা তোমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তারাও মারাত্মক ধোঁকাবাজ।”

“যারকাকে হয়তো আমি দেখেছি। যে মেয়েটির কথা বলছি সেই যদি যারকা হয়ে থাকে, তবে সে যে খুবই রূপসী তাতে সন্দেহ নেই। আচ্ছা আরমুগানী! তুমি তাকে খুব ভালোবাসো! একান্তে পেতে চাও!”

“আমার প্রাণ ওর জন্য ব্যাকুল সামুরাতি। এটা এমন এক টান, এমন এক আকর্ষণ, যে আকর্ষণের স্বাদ তুমি কখনো অনুভব করোনি।”

“আমি যদি তোমাকে আশ্রয় দেই তবে আমাকে কি সেই ভালোবাসা দেবে। বুঝতে পারছি না আমার হৃদয়ের মধ্যে যে কি তুফান শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা দুলছে।”

“তুমি আমাকে ভাই হিসেবে গ্রহণ করতে পারো। হৃদয়কে যদি তৃপ্ত করতে চাও, তাহলে তোমার হৃদয়ে এক বোনের মমতার ঢেউ তোলো, দেখবে আমার সান্নিধ্য তোমাকে স্নেহ-মমতার পরশে ভরে দেবে।”

“ঠিক আছে, তুমি আমার এখানেই থাকো।” কিন্তু কথা জড়িয়ে এলো সামুরাতির। আর কিছু বলতে পারলো না।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আরমুগানীর দু’গাল দু’হাতে ধরে ওর চোখের দিকে তাকাতেই সামুরাতির দু’চোখ বেয়ে শ্রাবণের ধারার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ধরাগলায় অস্পষ্ট ভাষায় বলে, “আর কখনো আমার সামনে তুমি যারকার নাম নেবে না। তুমি বলেছো, সে তোমার বোন নয় কিন্তু আমি এতেও প্রতারিত হওয়ার আশংকা করছি।” আরমুগানীর চেহারা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে চোখের পানি মুছে সামুরাতি।

“রাজা-মহারাজা আর সম্রাটদের হৃদয়েও রাজত্ব করো তুমি। আমার মতো একজন সামান্য মানুষকে তোমার এতো ভয় কেনো?”

“আমি জানি না… আমি বলতে পারবো না কেনো তোমাকে আমার এতোটা ভয় করছে। কেননা অনতিক্রম্য মনে হচ্ছে তোমাকে। তুমি এখন আমার আশ্রয়ে, বলতে গেলে আমার অধিকারে।”

“কিন্তু না, আমি বলতে পারবো না।”

“হ্যাঁ, তুমি আর আমি অভিন্ন জাত। এই রক্ত দেখিয়ে তুমি আমার প্রকৃত পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে। আমি এখন নিজের পরিচয় জেনে গেছি। তোমার পা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত কেউ এ ঘরে ঢুকবে না।”

* * *

পিছু ধাওয়াকারীরা ওয়াইব আরমুগনীকে ধরতে না পেরে হতাশ হয়ে ওর বাড়িতে ফিরে গেশো। শুয়াইব আরগানীব বাড়িতে গিয়ে দরজার কড়া নাড়াতেই যারকা দরজা খুলে দিলো। যারকার বাবা জিজ্ঞেস করলো, “ও বেরিয়ে গেলো কি করে?”

“ও জেগেই ছিলো, তোমরা বারবার বিড়ালের মতো ডাকছিলে। আমি তোমাদের থামাতে এলে সে টের পেয়ে যায়। লোকটি খুবই চালাক। সে আমাকে কিছু না বলে দৌড়ে গিয়ে ঘরের ছাদে উঠে। এ সময় আমি তোমাদের একজনের চিৎকার শুনে বুঝতে পারি ও পালিয়েছে। তোমরা বড় ভুল করেছে। তোমাদের ভুলের কারণে সে পালাতে পারলো । মিছেমিছি এতোদিন শুধু আমাকে ওর বউ বানিয়ে রাখলে। লাভটা কি হলো?”

শহর ও আশপাশের এলাকাজুড়ে শুয়াইব আরমুগানীর খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত চললো তল্লাশি অভিযান। তল্লাশির সময় প্রতিটি মুসলমানের বাড়ির আস্তাবলের খড়কুটো পর্যন্ত ওলোট-পালট করা হলো। কিন্তু কোথাও আরমুগানীর চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া গেলো না।

এদিকে নগরকোটের বড় পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ খবর পায়, রাজা আনন্দ পাল রাজধানীতে ফিরে এসেছে। রাজার ফিরে আসার খবর পেয়ে পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ তাকে নগরকোট মন্দিরে ডেকে পাঠায়। পণ্ডিতের খবর পেয়ে সাথে সাথেই রাজা আনন্দ পাল তার একান্ত প্রহরীদের রওনার প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়। হিন্দুস্তানের অন্যান্য রাজা-মহারাজার মতো রাজা আনন্দ পালও নগরকোট মন্দিরকে পুৰ সম্মান করতো এবং সেখানকার প্রধান পণ্ডিতের নির্দেশকে অবশ্য পালনীয় ভাবতো। এবার সে শুধু পণ্ডিতের নির্দেশ পালনের জন্যই পণ্ডিতের খবর পাওয়া মাত্র রওনার নির্দেশ দিলো না। তার উদ্দেশ্য ছিলো, পণ্ডিতের মাধ্যমে সে অন্যান্য রাজা-মহারাজার সহযোগিতা লাতে সমর্থ হবে। যেনো সে সুলতান মাহমূদের সাথে একটা চূড়ান্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার সামর্থ অর্জন করতে পারে। সে একজন যথার্থ মহারাজার মতো পূর্ণ শান-শওকতের সাথে রাজা আনন্দ পালের নগরকোট মন্দিরে পদার্পণ করে। তার সাথে রীতিমতো এক বিরাট কাফেলা। কাফেলায় তার একান্ত দেহরক্ষী বাহিনী ছাড়াও রয়েছে তার প্রিয় গায়িকা ৩ নর্তকী সামুরাতি। এ ছাড়াও রয়েছে কয়েকজন সেবিকা ও পরিচারিকা। সামুরাতি তার বৃদ্ধা পরিচারিকাকে ঘরে রেখে এসেছে এবং তাকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়ে এসেছে, সে যেনো আরমুপানীকে গুপ্তধনের মতোই লোকচক্ষুর আড়ালে হেফাজতে রাখে। বিপুল লোক বহর নিয়ে রাজা আনন্দ পাল নগরকোট মন্দিরের কাছে পাহাড়ের পাদদেশে এক সবুজ প্রান্তরে তবু তুলে। টানা চার-পাঁচ দিন ভ্রমণের পর রাজা আনন্দ পাল নগরকোট পৌঁছে। সফরের ক্লান্তির কারণে নগরকোট পৌঁছেই রাজার মন্দিরে প্রবেশ করা সম্ভব হলো না।

পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের কাছে যখন রাজা আনন্দ পালের আগমন সংবাদ পৌঁছালো, তখন পণ্ডিত খবর পাঠালো, বিকেলে পণ্ডিত রাজাকে অভ্যর্থনার জন্য নিচে আসবে। পড়ন্ত বিকেলে পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ রাজাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য যখন নিচে নেমে এলো, তখন রাজা আনন্দ পাল তাঁবু থেকে বেরিয়ে পণ্ডিতের পা স্পর্শ করে তাতে চুমু দেয় এবং তাকে ভক্তি জানায়। রাজার তাঁবু দেখে পণ্ডিত তো হতবাক। তাঁবু তো নয়, যেনো কোনো এক রাজপ্রাসাদ। রাজার বিশাল তাবুতে রঙ-বেরঙের শামিয়ানা, সুদৃশ্য ঝালর আর চতুর্দিকে বাহারী ঝাড়বাতি। রাজার তাঁবুতে গালিচা বিছানো। পণ্ডিত রাজার কক্ষে বসার একটু পরই তাকে উদ্দেশ্য করে চার নর্তকী নাচ শুরু করে দেয়। নৃত্যগীতের মধ্যে পণ্ডিত রাজা আনন্দ পালের উদ্দেশ্যে বলে, “মনে হয় আপনি সেই আনন্দপাল নন, যে আনন্দ পাল নিজে আর তার পিতা একাধারে কয়েকবার সুলতান মাহমুদের কাছে পরাজিত হয়েছেন। আপনার কি মনে নেই, পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আপনার বাবা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন আর সম্মুখ সমরে শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে আপনি দেশত্যাগ করেছিলেন? যদি আপনি সেই আনন্দ পালই হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার পরাজয়ের প্রধান কারণ এই বিলাসিতা। যে বিলাসিতা আপনি আমাকে খুশি করার জন্য প্রদর্শন করছেন। কারণ, আমি শুনেছি, আমাদের মহারাজারা নাকি যুদ্ধক্ষেত্রেও নাচ-গান ও আমোদ-ফুর্তির সকল আয়োজন সঙ্গে রাখেন।”

“পণ্ডিত মহারাজ! মৃত্যুর আগে আমরা মনের চাহিদা পূর্ণ করার জন্যে বিনোদনের উপকরণসমূহ সঙ্গে রাখি আর কি?”

“তা ঠিক। কিন্তু আপনি তো এখানে মরতে আসেননি। এখনও বেঁচে আছেন। আপনার এই বেঁচে থাকার লক্ষ্য কি বাকি জীবন বিলাসিতায় মেতে থাকা? আমি এ জন্যই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি যে, আপনার পরাজয়ের ও কারণগুলো আর কেউ বলার সাহস না পেলেও আমি বলে দেবো। রূপসীদের সৌন্দর্য আর শরীর নিয়ে যারা উল্লাসে মেতে থাকে, তাদের করুণ পরিণতি ছাড়া আর কি হতে পারে!”

পণ্ডিতের কথা শেষ না হতেই নর্তকী মেয়েগুলো এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেলো, যেনো বাতাসে ওরা হারিয়ে গেছে। এরপর বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বদলে যায়। এবারের বাজনার ধ্বনি এমনই আকর্ষণীয় যে পণ্ডিত নিজেও হতচকিত হয়ে উঠলো। ঠিক এমন সময় তাঁবুর এক কোণা থেকে সামুরাতি এভাবে দৃশ্যপটে এলো যেনো একটি জলপরী পানি থেকে ভেসে ওঠেছে। সামুরাতি বিস্ময়কর এক নৃত্যের তালে তালে পণ্ডিতের একেবারে কাছে চলে আসে। তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি খেলা করছে। নৃত্যের ছন্দে এগিয়ে এসে পণ্ডিতের সামনে বাঁকিয়ে প্রণাম করে। রঙিন ফানুসের বাহারী আলোয় নর্তকী সামুরাতির নৃত্যে পণ্ডিত বিমোহিত হয়ে গেছে। সামুরাতির শরীর যখন নাচের নানা মুদ্রায় কখনো ফুটন্ত ফুলের মতো মেলে ধরলো এবং বাজনার উচ্চাঙ্গ তালে নিজেকে পাখির মতো বাতাসে ভাসিয়ে রাখলো, তখন পণ্ডিত রাজা আনন্দ পালকে জিজ্ঞেস করলো, “এ হিন্দু না মুসলমান?”

“মুসলমান।” জবাব দিলো রাজা আনন্দ পাল। “মুসলমান তরুণীদেরকেই এ পেশায় আমরা ব্যবহার করি। এই মেয়েটিকে যদি আমরা মন্দিরের নর্তকী হিসেবে রেখে দেই, তাতে আপনি রাজি হবেন তো?”

“এর পরিবর্তে আপনি চাইলে আমি একশ’ নর্তকী দিয়ে দিতে পারি। এই মেয়েটি আমার খুবই প্রিয়।”

“হ্যাঁ, আমি আপনার কাছে এমন কথাই শুনতে চাচ্ছিলাম। আপনার বোঝা উচিত, এ মেয়েকে আমি নিজের সেবার জন্য নিতে চাচ্ছি না। আমি নর্তকী রাখবো কেন? আমি তো নারী স্পর্শও করি না। ওকে আমি কৃষ্ণ ভাগবানের চরণে বলীদান করবো।”

“বলি দেবেন!” চোখ কপালে তুলে জানতে চাইলো রাজা।

“হ্যাঁ, রাজা আনন্দ পাল। এটা আমার ব্যক্তিগত কোনো ইচ্ছা নয়। দেব-দেবীদের চাহিদা এটা। এই নর্তকীকে দেবতারা ভোগ করতে চায়।”

“আমরা তো ইতিমধ্যে লাহোরে দুটি তরুণী বলী দিয়েছি।”

“তবুও আপনি দু’বারই পরাজিত হয়েছেন, তাই না। এর কারণ হলো, যেসব পণ্ডিতের হাতে আপনি কুমারীদের বলী দিয়েছেন, এসব পণ্ডিত আপনার দেয়া কুমারীদের সতীত্বহারা করে পাপ করেছে। আমাকে দেবী কৃষ্ণ স্বপ্ন দেখিয়েছেন, এমন কোনো মুসলিম তরুণীকে বলী দিতে হবে যে রূপে-গুণে অনন্যা। আর সে না হবে বয়স্কা, আর না হবে কিশোরী। নাচ-গানে সে হবে অনন্যা। সে যার কাছে থাকবে, তাকে সে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসবে। কোনো মূল্যেই এই মেয়েকে সে হারাতে সম্মত হবে না। বহুদিন থেকে আমি এমন একটি নর্তকী খুঁজছিলাম। আজ আপনার কাছে তা পাওয়া গেলো। আমি হিন্দু ধর্মের বিজয় দেখতে চাই, আমি দেব-দেবীদের অভিশাপ থেকে আপনাদের রক্ষা করতে চাই।”

রাজা আনন্দ পালের পক্ষে নগরকোট মন্দিরের বড় পণ্ডিতের কথা অমান্য করা সম্ভব ছিলো না। কিছুদিন আগে অন্যান্য রাজা-মহারাজাদের ডেকে পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ যেসব কতা বলছিলো, রাজা আনন্দ পালকেও হিন্দু ধর্মের জয় এবং সুলতান মাহমূদকে পরাজিত করার দিক-নির্দেশনামূলক কথা শোনালো। রাজা আনন্দ পালকেও পণ্ডিত পরামর্শ দিলো, সুলতান মাহমুদকে পেশোয়ারের পার্শ্ববর্তী ময়দানে যুদ্ধের নামে আটকে রাখতে হবে আর অপরদিকে গজনী আক্রমণ করে দখল নিতে হবে। এছাড়া গজনীর মুসলমানদের অভিযান ঠেকানো সম্ভব নয়।

“আমি যদি লাহোরেই ব্যস্ত থাকি, তাহলে বেরা এবং মুলতানের কি হবে?” প্রশ্ন করলো আনন্দ পাল।

“দেখবেন, এই দুই শহরের সকল মুসলিম সৈন্য আমাদের হাতে বন্দীরূপে গ্রেফতার হবে।” বললো পণ্ডিত। “আপনি এখন রাজধানীতে ফিরে যান। নাচ-গান বাদ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিন। সকল রাজ্য থেকেই আপনার কাছে সৈন্য আসছে। সে ব্যবস্থা আমি সেরে ফেলেছি।”

পরদিন সকাল বেলা রাজা আনন্দ পাল পাহাড়ের উপর অবস্থিত মন্দিরে গিয়ে পূজাপার্বন শেষ করে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। এদিকে সেই রাতেই বড় পণ্ডিত সামুরাতিকে সাথে নিয়ে যায়। আনন্দ পালের পক্ষে বিদায়লগ্নেও আর সামুরাতির সঙ্গে দু’চার কথা বলার সুযোগ হলো না।

পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ পাহাড়ের উপর অবস্থিত বড় মন্দিরের মূল আস্তানায় সামুরাতিকে নিয়ে যায়। সামুরাতি ঘুণাক্ষরেও জানতো না তাকে বলী দিয়ে তার দেহের রক্তে হিন্দুদের কৃষ্ণদেবীর চরণ ধোয়া হবে। সামুরাতিকে পণ্ডিত যখন মন্দিরের পাতাল কক্ষে নিয়ে গেলো, তখন সামুরাতি জানতে চাইলো, তাকে এখানে কেন আনা হয়েছে।

“আমার সাথে আসা কি তোমার কাছে ভালো লাগেনি?” সামুরাতির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো পণ্ডিত। পণ্ডিত বিছানা দেখিয়ে বললো, “আগে বসো, তারপর কথা বলো।”

সামুরাতি বিছানায় বসতে বসতে পণ্ডিতের দু’হাত তার দুহাতে তুলে নেয় এবং পণ্ডিতকে নিজের দিকে টান দেয়। সামুরাতির টানে পণ্ডিত তার পাশে বসে পড়লো। সামুরাতি পণ্ডিতের চোখে চোখ রেখে একটা ভুবন মোহিনী হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে দেয়। এই হাসির ঝিলিকে পণ্ডিতের শরীর কেঁপে ওঠে। সামুরাতি বললো, “মহারাজা! আমার নাচের সম্মান করতে পারেনি। আপনি আমার নাচ দেখেছেন কিন্তু কণ্ঠের গান শুনেনি। তবুও আপনার দৃষ্টিতে আমার দেহবন্ধুরী আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।”

“হ্যাঁ। আরে তুমি তো ভুল বুঝেছো তরুণী।” গম্ভীর স্বরে বললো পণ্ডিত। “তোমার রূপ-সৌন্দর্য আমার ভালো লেগেছে বটে কিন্তু তুমি বুঝতে ভুল করছে। আমি জীবনে কোনোদিন নারী স্পর্শ করিনি আর জীবনে কোনদিন তা করবোও না।”

“কেনো?”

“আমি নারীর সংস্পর্শে যাওয়াকেই পাপ মনে করি।”

“তাই নাকি? তাহলে আজ এই পাপ করছেন কেনো?” জানতে চাইলো সামুরাতি।

‘এ কথার জবাব আমি এখন দিতে পারবো না।” বললো পণ্ডিত। “তবে এ কক্ষে এসে তুমি মনে যে ধারণা পোষণ করেছে, আমার ক্ষেত্রে এমন ধারণা মন থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলো। তোমার শরীরের সৌন্দর্য নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমাকে এসব ব্যাপারে তুমি আর কিছু জিজ্ঞেস করো না। তোমাকে আমি মনের মধ্যে দেবীর মর্যাদা দিয়ে রেখেছি। তোমাকে আমি গঙ্গা জলে স্নান করাবো। তোমার সকল পাপ ধুয়ে সাফ করে ফেলবো।”

পণ্ডিতের কথা শুনে সামুরাতির হাসি পেলো । বেশি সময় সে নিজের হাসি চেপে রাখতে পারলো না। টানা কিছুক্ষণ হাসলো। আর পণ্ডিত নির্বাক হয়ে সামুরাতির চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। শিশুর মতো হাসতে হাসতে উচ্ছ্বসিত হয়ে সামুরাতি পণ্ডিতের কোলে লুটিয়ে পড়ে। সামুরাতির রেশমী কোমল চুলগুলো পণ্ডিতের কোলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সামুরাতি তার চুলে এমন সুগন্ধি লাগিয়েছিলো- বিশেষ কোনো রাজার আগমনের অনুষ্ঠানেই শুধু এ ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করে সে। সুগন্ধিতে ছিলো মন মাতানো সৌরভ। মনোহরী এই সৌরভের সাথে সামুরাতির ভোলা কাঁধ আর নরম হাত যখন পণ্ডিতের শরীর স্পর্শ করে, তখন হঠাৎ যেনো পণ্ডিত তার শরীরে একটা কাঁপুনি অনুভব করে। পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ জীবনে এতো ঘনিষ্ঠভাবে কোনো তরুণীকে দেখেনি। কিন্তু আজ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট এক অপ্সরা তার কোলে লুটিয়ে আছে।

“ওঠো নর্তকী! বলো, তুমি কেননা এভাবে হাসছে।” সামুরাতিকে স্পর্শ না করেই লুটিয়ে পড়া থেকে ওঠে বসতে নির্দেশ দেয়।

সামুরাতি বিশেষ কোনো অভিজাত বংশের মেয়ে নয়। সে যৌবনের শুরু থেকেই শরীর নিয়ে খেলা করতে শিখেছে। পণ্ডিতের তাড়া খেয়ে ওঠে বসার পরিবর্তে সে পণ্ডিতের কোলে আরো বেশি করে নিজেকে মেলে ধরে। সে চিত হয়ে পণ্ডিতের মুখের দিকে শিশুর মতো কৌতূহলীকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “গঙ্গা জলে স্নান করিয়ে আপনি আমার সব পাপ ধুয়ে দেবেন? না, তা নয়। আপনি ভুল বলেছেন। আপনার বলা উচিত ছিলো, যখন গঙ্গা জলে ঝাঁপ দেবো, তখন গঙ্গার সব পাপ গঙ্গার পানির সাথে ধুয়ে চলে যাবে।”

পণ্ডিত নিজে সামুরাতির হাত ধরে উঠানোর কোনো চেষ্টাই করলো না। সামুরাতি নাগিনীর মতো ফণা ধরে ওঠে বসলো এবং পণ্ডিতের দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো, “আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি কেননা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন? আপনি আমাকে পবিত্র করতে চাচ্ছেন…।” একথা বলে সে গম্ভীর হয়ে যায়। “আমার পাপ সেদিন মুছবে যেদিন আপনি ওইসব পাপীষ্ঠকে গঙ্গা জলে ডুবিয়ে জনমের স্নান করাবেন, যারা এতোদিন আমার শরীর নিয়ে খেলা করেছে। আমার শরীরকে যারা খেলার পুতুলে পরিণত করেছে। বলুন, আপনার ভগবান কি ওদের কোনো বিচার করতে পারে না…।

পণ্ডিত মহারাজ! আমার কোনো জাত-ধর্ম নেই। ওরা আমার জাত-ধর্ম থাকতে দেয়নি। কিছুদিন থেকে আমি অনুভব করছি, দৃশ্যত আমি যতো পাপ কর্মেই লিপ্ত থাকি না কেন, আমার দেহের খাঁচার ভেতরে যে হৃদয় আছে সেটি সম্পূর্ণ পবিত্র। এই পবিত্র হৃদয়টি সেই মহাপুরুষের জন্য অপেক্ষা করছিলো যে স্কুল লালসা নয়, আমাকে প্রকৃত হৃদয়ের ভালোবাসা দেবে।”

“তুমি কি জানো সেই মহাপুরুষটি কে?”

“হ্যাঁ, জানি। আপনিই সেই মহাপুরুষ। সে আপনার চেয়েও বয়স্ক কেউ হতে পারতো কিংবা আমার চেয়ে আরো তরুণ কেউ, সেই মহাপুরুষ হতে পারতো। সে কোনো মুনিঋষি কিংবা মাওলানা মুফতী হতে পারতো। সে কোনো চাটাইয়ে শয়নকারী দরবেশ হতে পারতো। আবার রাজপ্রাসাদের বিলাসী বাসিন্দাও হতে পারতো।… বলুন, আপনার কাছে কি গঙ্গা জলে বিধৌত অমলীন ভালোবাসা আছে?”

সামুরাতির কথা শুনে পণ্ডিত এভাবে চমকে উঠলো যেনো হঠাৎ কেউ তাকে সুখ-স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে দিয়েছে। পণ্ডিত নিজেকে যতোই দাবী করছিলো নারী স্পর্শ থেকে তার শরীর পবিত্র এবং ভবিষ্যতেও পবিত্র থাকবে, কিন্তু সামুরাতির কোমল স্পর্শ আর তার রেশমী কোমল চুলে সে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলো। সামুরাতির লাজুক হাসি পণ্ডিতকে জাদুর মতো অবচেতন করে দিয়েছে। পণ্ডিত নিজেও মুগ্ধ হাসি হেসে বললো, “অবশ্যই, একজন পূজারীর কাছ থেকে তুমি পাপ নয়, ভালোবাসাই পাবে।”

“আপনি যদি আমাকে সেই রকম ভালোবাসা দেন, যে ভালোবাসার জন্য আমার হৃদয় উন্মুখ হয়ে আছে, তাহলে আমি পাথরের মূর্তির সামনে এমন নাচন নাচবো যে, তারাও আমার নাচ দেখে নাচতে শুরু করবে। আর যে মূর্তির হাতে আপনি বাঁশি রেখেছেন সেই বাঁশি থেকে এমন সুর বের হবে, যে সুরে আপনিও হারিয়ে যাবেন। দূর দরাজ থেকে লোকজন নগরকোটের নর্তকীর নাচ দেখার জন্য আসবে। লোকজন কৃষ্ণ ভগবানকে ভুলে গিয়ে নগরকোটের নর্তকীর পূজা করতে শুরু করবে।”

হঠাৎ পণ্ডিত বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং কক্ষে দু’হাত পেছনে বেঁধে মাথা নিচু করে পায়চারি করতে শুরু করে। পণ্ডিতের পায়চারি লক্ষ্য করছিলো সামুরাতি। পণ্ডিত থেমে থেমে সামুরাতির দিকে তাকাচ্ছিলো আর পায়চারী করছিলো।

“আপনি কি সকাল বেলা মহারাজের তাঁবুতে যাবেনা” পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করলো সামুরাতি।

“আমি যদি মহারাজা আনন্দ পালের কাছ থেকে চিরদিনের জন্যে তোমাকে নিয়ে আসি, তাতে তুমি খুশি হবে”

“এটা আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। পরিবর্তন শুধু একটাই। আগে আমি এক রাজার দখলে ছিলাম, সেখান থেকে এখন একজন মন্দিরের পণ্ডিতের দখলে এলাম। যখন এনেছেন আমাকে মনের মতো করে ভালোবাসা দিতে হবে। আপনাকে অবশ্যই আমার হৃদয়ের মূল্য দিতে হবে। সোনা-দানা দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব নয়।

চকিতে সামুরাতি তার শরীর থেকে হীরা-মতি-পান্নার গহনা খুলে পণ্ডিতের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেয় এবং আঙ্গুল থেকে মুক্তার আংটি খুলে ছুঁড়ে ঘরের মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলে, “নিন, এসব গঙ্গা জলে ফেলে দিন।”

পণ্ডিত মাথা নিচু করে হার ও আংটি কুড়িয়ে তার সামনে রেখে বলে, “যাও, এখন আরামে শুয়ে ঘুমাও। আমি খুব ভোরে আসবো এবং তোমাকে গঙ্গা তীরে নিয়ে যাবো।”

***

সামুরাতিকে পণ্ডিতের হাতে তুলে দিয়ে রাজা আনন্দ পাল লাহোর ফিরে যায়। রাজার বুকভরা কষ্ট তার সবচেয়ে প্রিয় গায়িকা নর্তকীকে ছেড়ে আসতে হলো। সামুরাতির নাচের মুদ্রা আর জাদুকরী কণ্ঠের জন্য রাজা আনন্দ পাল একশ’ তরুণীকেও নর বলী দিতে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ তাকে কোনো কথা বলারই অবকাশ দিলো না। দেবীর নামে তাকে বলী দেয়ার জন্য তুলে দিয়ে গেলো। শেষবারের মতো সামুরাতির সাথে দুটি কথা বলারও সুযোগ দিলো না। উপরের মন্দিরে গেলেও রাজা আর সামুরাতির দেখা পেলো না। এ জন্য রাজার মনটা ভারী হয়ে আছে। বেশ ক’দিন সামুরাতির শূন্যতায় মন খারাপ রইলো রাজার। কিন্তু খুব বেশি দিন সামুরাতির প্রেমের যাতনা বোধ করার অবকাশ পেলো না রাজা। অন্যান্য রাজা থেকে দলে দলে সৈন্য তার রাজধানীতে আসতে শুরু করেছে। বাধ্য হয়েই সামুরাতির কথা ভুলে গিয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতির দিকে তাকে মনোনিবেশ করতে হলো।

দেখতে দেখতে আজমীর, কনৌজ ও গোয়ালিয়রের সেনাবাহিনী লাহোর পৌঁছে যায়। কাজরের সেনাবাহিনীকে লাহোর না পাঠিয়ে পেশোয়ারের দিকে পাঠানো হয়। কাজর বাহিনীর কমান্ডারকে বলে দেয়া হলো, সে যেনো সিন্ধু নদী পার হয়ে তাঁবু খাঁটিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

১০০৮ সালের শ্রাবণ-ভাদ্র মাস। সিন্ধু নদ তখন উত্তাল। কানায় কানায় পানিতে ভরা থাকায় সেনাবাহিনীর যাতায়াত যথেষ্ট কষ্টকর হয়ে উঠলো। সে সময় বহু নৌকা একসাথে জুড়ে দিয়ে পুল তৈরি করা হতো। কিন্তু নৌকার তৈরি পুলকে বারবার ঢল এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। সেই সাথে বিশাল সেনা বহরের সাথে অপরাপর উট-ঘোড়া ও গরুগাড়ি বোঝাই রসদপত্র পারাপারের জন্য অন্তত মাসখানেক সময় দরকার ছিলো। কিন্তু হিন্দু রাজা সুলতান মাহমূদকে সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের সুযোগ মোটেও দিতে চাচ্ছিলো না।

তৎকালীন ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, সে সময় গোটা লাহোের একটি সেনা ক্যাম্পে পরিণত হয়েছিলো। যেদিকেই চোখ যেতো শুধু সেনাবাহিনীর আনাগোনা চোখে পড়তো। দলে দলে বিভিন্ন রাজ্য থেকে সেনাবাহিনী লাহোরে পদার্পণ করেছিলো। সেই সাথে দলে দলে হিন্দু তরুণ-যুবকরা সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য লাহোরে এসে জড়ো হচ্ছিলো।

যেসব হিন্দু যুবক-তরুণ অশ্বারোহণ ও তীর তরবারী চালাতে পারতো, তাদেরকে নিয়মিত সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে নেয়া হচ্ছিলো। হিন্দু মহিলা তাদের যুবক ছেলেদের এবং তরুণী বধূরা তাদের সামর্থবান স্বামীদেরকে সেনাবাহিনীতে পাঠিয়ে গর্ববোধ করছিলো।

মন্দিরের পণ্ডিতরা ভক্তদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এতোটাই ক্ষেপিয়ে তুলেছিলো যে, কোন হিন্দু মা আর তার তরুণ ছেলেকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বারণ করতে না বরং যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতো। সাধারণ হিন্দু প্রজারা সেনাদের জন্য পণ্যসামগ্রীর পাহাড় গড়ে তুলেছিলো। সেনাদের জরুরী রসদপত্র বহনের জন্য সাধারণ প্রজারা পর্যন্ত তাদের উট, মহিষ ও গরুগাড়ী দিয়ে দিচ্ছিলো। তখন মন্দিরগুলোতে শুধু একটাই প্রার্থনা হতো, “হে ভবগান! হিন্দুদের বিজয়ী এবং মুসলমানদের পরাজিত করো।”

অবস্থা দেখে মনে হতো, হিন্দুদের অন্যসব কামনা-বাসনা হারিয়ে গিয়েছিলো। তাদের তখন একটা কামনাই ছিলো, মুসলমানদের পরাজিত করা, তাদের নিঃশেষ করা। লাহোরের আশপাশের লোকেরা বিশাল সেনাবাহিনীর আগমনে আনন্দে নেচে ওঠেছিলো। ঐতিহাসিক আল-বিরুনী ও ফিরিশতা লিখেন, হিন্দুস্তানে এর আগে এতো বিপুল সেনা সমাবেশ কখনো ঘটেনি।

হিন্দু রাজাদের বিশাল রণপ্রস্তুতির বিপরীতে সুলতান মাহমূদের ছিলো মুষ্টিমেয় সেনা আর আল্লাহর উপর ভরসা। অবশ্য হিন্দু বাহিনীর আধিক্যে তিনি মোটও চিন্তাৰিত ছিলেন না। কারণ, তার নিজস্ব রণকৌশলের প্রতি তিনি ছিলেন পূর্ণ আস্থাশীল এবং আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির প্রতি তার ছিলো অগাধ বিশ্বাস।

সেই দিনগুলোতে সুলতান ছিলেন পেশোয়ারে। লাহোর থেকে অব্যাহতভাবে তার কাছে খবর আসছিলো। সেনাবাহিনী তো নয় বিশাল এক প্লাবন তার দিকে ধেয়ে আসছে। অবশ্য তখনো সুনির্দিষ্টভাবে তার কাছে খবর পৌঁছেনি, এ প্লাবনের গতি কোন্ দিকে।

বেরা ও মুলতানে তিনি এতো পরিমাণ রসদপত্র সঞ্চিত করেছিলেন যে, বেরা ও মুলতান অবরুদ্ধ হলেও এক বছর পর্যন্ত অবরোধবাসীরা নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারবে। তিনি মনে করেছিলেন, হিন্দুরা যদি তার দখলিকৃত এসব শহর অবরোধ করে তাহলে বাইরে থেকে তিনি অবরোধ ভাঙ্গার চেষ্টা করবেন।

* * *

একদিন সুলতান মাহমূদকে তার গোয়েন্দা শাখা খবর দিলো, বিদয়ো অঞ্চলে ফঞ্জরের সেনারা শিবির স্থাপন করেছে। এ সংবাদ সুলতানকে আরো ভাবিয়ে তুললো। তিনি বুঝতে পারলেন, হিন্দুরা একসাথে তিনটি রণক্ষেত্র তৈরি করছে। তারা বেরা এবং মুলতান অবরোধ করবে, একই সাথে আমাকে এখানে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য করবে।

বিষয়টি প্রকৃতপক্ষেই সুলতানের জন্য ছিলো চরম উদ্বেগের। কারণ, এমন পরিস্থিতিতে একই সাথে তিনটি রণাঙ্গন মোকাবেলা করা এবং জয়লাভ করার ব্যাপারটি তার পক্ষে মোটেও সম্ভব ছিলো না। বিজয় তো দূরের কথা, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই তখন সংশয়পূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

হিন্দু সেনাদের বিদরো পৌঁছার সংবাদের কয়েক দিন পরই সুলতানের কাছে খবর এলো, সম্মিলিত হিন্দু বাহিনী প্লাবনের মতো ধেয়ে আসছে। হিন্দু বাহিনীর দৃষ্টি ছিলো পেশোয়ারের দিকে। লাহোর ও আশপাশের লোকেরা হিন্দু বাহিনীকে এতোটাই সহযোগিতা করেছে যে, তারা কাঁধে বয়ে সেনাদের রাভী নদী পার করে দিয়েছে। তখন রাভী নদীতে ছিলো যথেষ্ট স্রোত। নদী পার হওয়ার জন্য নৌকা দিয়ে পুল তৈরি করা হয়। নৌকা স্রোতে যাতে নড়তে না পারে এ জন্য স্থানীয় লোকেরা মোটা মোটা রশি দিয়ে বেঁধে হাজার হাজার লোক টেনে রাখে, যার ফলে সেনাদের নদী পার হতে বেগ পেতে হয়নি। সামরিক রসদপত্রের বোঝাই গরুগাড়ীগুলোকে হিন্দু জনতা নিজেরা ঠেলে নদী পার করে আরো এগিয়ে দেয়, যাতে নরম মাটি ও কাদা পানিতে আটকে মালবাহী জন্তুগুলো কাহিল না হয়ে যায়।

সুলতান মাহমূদকে যখন জানানো হলো, সকল হিন্দু ফৌজ লাহোর থেকে পেশোয়ারের দিকে চলে এসেছে তিনি তা বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি বেরায় ছদ্মবেশে গোয়েন্দা পাঠিয়েছিলেন। তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিলো না, কেন হিন্দুরা বেরা ও মুলতান এড়িয়ে লাহোরের দিকে অগ্রসর হবে। সকল দিক থেকেই গোয়েন্দারা যখন খবর পাঠাচ্ছিলো, বেরা ও মুলতানের দিকে হিন্দুদের কোনো দৃষ্টি নেই, সম্মিলিত হিন্দু ফৌজ পেশোয়ারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সেই সাথে তার একান্ত গোয়েন্দা দলও যখন এ খবর নিশ্চিত করলো যে, হিন্দু বাহিনী পেশোয়ারের পথে অগ্রসর হচ্ছে, তখনই সুলতানের বিশ্বাস হলো কিন্তু ততোদিনে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে।

সুলতান এ খবর নিশ্চিত হলে তার সেনা কর্মকর্তাদের বললেন, শত্রুদের কাছে বেরা ও মুলতানের চেয়ে গজনী বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হচ্ছে, পেশোয়ারের যে ময়দানে জয়পাল আমাদের কাছে পরাজিত হয়েছিলো, হিন্দু সম্মিলিত বাহিনী সেই ময়দানেই আমাদের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে। ওরা আমাদের বাহিনীকে কচুকাটা করে গজনী দখলের পরিকল্পনা এঁটেছে। তারা যদি এ লক্ষ্য অর্জনে এদিকে এসে থাকে, তাহলে অবশ্যই তা দূরদর্শিতার পরিচায়ক বটে। এতো বিপুল সেনা সদস্যের একটি বাহিনীর লক্ষ্য এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক।…

আল্লাহ ছাড়া দৃশ্যত সিন্ধু নদ আমাদের সহায়ক হতে পারে। কোনভাবেই যাতে হিন্দু বাহিনী সিন্ধু নদ পার হতে না পারে, সে ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। এখন আমাদের দরকার একদল আত্মত্যাগী যোদ্ধা আর লক্ষ্যভেদী তীরন্দাজ। শবাহিনী যদি নদ পার হতে চায়, তাহলে তারা যে কোনো মূল্যে শক্রদের নদ পরাপার রুখে দেবে। শত্রুবাহিনী যদি নৌকা দিয়ে পুল তৈরি করে সিন্ধু পার হতে চায়, তাহলে আমাদের যোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে ওদের নৌকার রশি কেটে দেবে। আর হাতি যদি নৌকার পুল দিয়ে পার করতে চায়, তাহলে হাতিগুলোকে তীরন্দাজরা তীরবিদ্ধ করবে। দু’একটি হাতি তীরবিদ্ধ হলে পুল দিয়ে আর কাউকে পার হতে দেবে না।

অবশ্য শুধু এই তৎপরতা দ্বারা শত্রুবাহিনীর পথ রোধ করা যাবে না। কারণ, শত্রবাহিনী যখন এখানে পৌঁছবে, তখন শীতকাল শুরু হয়ে যাবে। তখন নদীর পানি কমে যাবে। নদীর স্রোতও তেমনটা থাকবে না। আমরা শত্রু বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করবো নদীর তীরে। এ যুদ্ধটা হয়তো আমাদের জীবন-মরণ যুদ্ধে পরিণত হবে।

সুলতান তখনই বেরা, মুলতান ও গজনীতে দূত পাঠিয়ে খবর দিলেন, ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রিজার্ভ বাহিনীর সকল সদস্য পেশোয়ার এসে পড়ো। খুব দ্রুতগতিতে এসো। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুলতান মাহমূদ এমন হয়ে গেলেন যে, তিনি মানচিত্র সামনে রেখে গভীর চিন্তায় ডুবে যেতেন, ঘন্টার পর ঘণ্টা শুধুই ভাবতেন। পানাহার ও ঘুমের কথাও ভুলে যেতেন। তার আঙ্গুল মানচিত্রের রেখায় রেখায় ঘুরতো। তিনি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র নির্ধারণ করতেন, কৌশল নির্ধারণ করতেন। সবদিক বিবেচনা করে আবার সেটি পরিবর্তন করে নতুন রণক্ষেত্র নির্ধারণ করতেন। এভাবে সকাল, দুপুর হয়ে রাতও চলে যেতো। ওয়াক্ত মতো নামায আদায় ছাড়া তার আর কোনো কিছুর দিকে খেয়াল ছিলো না।

***

রাজা আনন্দ পাল যখন নগরকোট মন্দির থেকে রাজধানীতে ফিরে এলো, তখন শুয়াইব আরমুগানী সামুরাতির ঘরে। সামুরাতির পরিচারিকা আরমুগানীকে জানালো, “রাজা সফর থেকে ফিরে এসেছে কিন্তু সামুরাতি ফেরেনি।”

দু’তিন রাত পর সামুরাতির পরিচারিকা আরমুগানীকে জানালো, “যেসব তরুণী সামুরাতির সঙ্গে নগরকোট গিয়েছিলো তারা বলেছে, প্রথম রাতেই নগরকোটের বড় পণ্ডিত সামুরাতিকে মন্দিরের ভেতরে নিয়ে গেছে। এরপর তারা আর সামুরাতির দেখা পায়নি। রাজাও আর তার ব্যাপারে কিছু বলেনি।”

এ খবর শুনে আরমুগানী ভাবতে লাগলো, নগরকোট থেকে সামুরাতির ফিরে না আসার কারণ কি? সে ভাবলো, পণ্ডিত সামুরাতিকে দেখে এতোই মুগ্ধ হয়ে গেছে যে, সামুরাতিকে সে নিজের কজায় রেখে দিয়েছে। নগরকোটের বড় পণ্ডিতের কথা রদ করার দুঃসাহস হিন্দুস্তানের কোনো রাজা-মহারাজার নেই।

বৃদ্ধা পরিচারিকা হৃদয়ের সবটুকু মমতা দিয়ে শুয়াইব আরমুগানীর সেবা-শুশ্রূষা করছিলো। সে ছিলো আরমুগানীর প্রতি বিশ্বস্ত। সামুরাতির নির্দেশে অতি গোপনীয় রত্নের মতোই আরমুগনীকে সবার দৃষ্টি থেকে আড়ালে রেখেছিলো বৃদ্ধা। সেই সাথে প্রতিদিন আরমুগানীর ক্ষতস্থানের পট্টি বদলে ওষুধ দিয়ে দিচ্ছিলো। যার ফলে আরমুগনীর ক্ষতস্থান দ্রুত সেরে উঠছিলো।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে শুয়াইব আরমুগানী। সামুরাতির ঘরে আশ্রয় নিয়ে গ্রেফতারী এড়িয়ে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিলো আরমুগানী। আত্মরক্ষার ব্যাপারটিই তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো আরমুগানীর জন্য। অপরদিকে যারকার কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারছে না। এতোদিন গোয়েন্দা কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে বলে কোনো মেয়েকে বিয়ে করেনি আরমুগানী। কিন্তু যারকাকে বিয়ে করার পর আরমুগানীর জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে। সে প্রবৃত্তির গোলামে পরিণত হয়ে পড়ে। ফলে যদিও আরমুগানী জানতো যারকার সাথে তার বিয়েটা হয়েছে চক্রান্তমূলক কিন্তু সেটিকে সে এই বলে মেনে নিয়েছিলো যে, যারকা চক্রান্তের ক্রীড়নক হলেও মনে-প্রাণে তাকে ভালোবেসেছে। এর প্রমাণ হলো, সে ঝুঁকি নিয়ে তার প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন তার হৃদয়ের একমাত্র আকুতি, যারকাকে সে কোথায় পাবো।

সামুরাতির বৃদ্ধা পরিচারিকা আরমুগানীর এসব গোপন কথা জানতো না। তার পক্ষে বৃদ্ধাকে এ কথা বলাও সম্ভব ছিলো না, সে যারকা নামের এক তরুণীর সাহচর্য পেতে অধীর হয়ে আছে।

একদিন একটি ঘোড়াগাড়ী সামুরাতির বাড়ির সামনে এসে থামলো। সামুরাতি বাড়ি ফিরে এসেছে ভেবে বৃদ্ধা পরিচারিকা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ঘোড়াগাড়ী থেকে দুই তরুণী নামলো। তারা এসে সামুরাতির পরিচারিকার সাথে কথা বলতে শুরু করলো। আরমুগানী লুকিয়ে আগন্তুকদের দেখছিলো। দুই তরুণীকে দেখে সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। দুই তরুণীর একজন ছিলো যারকা। যারকা সামুরাতির সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য এসেছিলো।

বৃদ্ধা পরিচারিকা তাদেরকে সামুরাতির কক্ষে বসিয়ে গল্প করছিলো। এমতাবস্থায় আরমুগানীর পক্ষে বৃদ্ধাকে ডাকা সম্ভব ছিলো না। সাত-পাঁচ ভেবে সে একটি ফুলদানী মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। ফুলদানী ভাঙ্গার আওয়াজ শুনে পরিচারিকা দৌড়ে এ কক্ষের দিকে এলো এই ভেবে যে, হয়তো বিড়াল কোনো কিছু ফেলে দিয়েছে।

বৃদ্ধা এ কক্ষে এলে আরমুগানী তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে কানে কানে বললো, তোমাকে এ ঘরে আনার জন্যে আমিই ফুলদানী ছুঁড়ে ফেলেছি। আগন্তুক মেয়ে দুটির মধ্যে যারকা নামের মেয়েটিকে এভাবে আমার কাছে পাঠাবে যাতে তার সঙ্গী মোটেও বুঝতে না পারে।

বৃদ্ধা আরমুগানীকে জানালো, সে সামুরাতির সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলো। সে জানতো না, মাসুরাতি বাড়িতে নেই। এখন তো সে চলে যাচ্ছে, কিভাবে আমি ওকে তোমার কথা বলবোর

আরমুগানী নাছোরবান্দা। সে বৃদ্ধাকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলো, তুমি যে করেই হোক আমার কাছে ওকে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। এ কাজটি খুব জরুরী।

আরমুগনীর উপর্যুপরি অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধা সম্মত হলো। এই বৃদ্ধা পরিচারিকা ছিলো অভিজ্ঞ। জীবনে বহু নারী-পুরুষকে সে আঙ্গুলের ইশারায় নাচিয়েছে। উটকো একটা বাহানা সৃষ্টি করে পরিচারিকা অপর তরুণীকে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলো। এই ফাঁকে আরমুগানী এসে যারকার সামনে দাঁড়ালো। যারকা আরমুগনীকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। সে আরমুগানীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিস্ময়ের সাথে বললো, তুমি এখনো এদেশে রয়ে গেছে? পায়ে আঘাত পেয়েছো কিভাবে?

“যদি ধোকা দিতে চাও তাহলে পরিষ্কার বলে দাও। আমি তোমার জন্যই এখানে অপেক্ষা করছিলাম। প্রতারণা করলে জীবনের জন্য চলে যাবো। নয়তো বলো, কোথায় তোমার সাথে সাক্ষাৎ হবে?”

“হায়! আমি কিভাবে বিশ্বাস করাবো যে, তোমার সাথে ধোঁকাবাজি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি যেখানে যেতে বলবে সেখানেই যাবো। চাইলে এখানেও আসতে পারি।”

“ঘরে নয়, বাইরেই আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। প্রয়োজনে তোমাকে ঘরেও নিয়ে আসতে পারবো।… তবে এর মধ্যে তুমি এ ব্যাপারটা জানতে চেষ্টা করবে, সামুরাতি কেন নগরকোট থেকে ফিরে আসেনি। সে আমাকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে উপকার করেছে। এখন চলে যাও। তোমার সঙ্গীনী এসে পড়ছে।”

যারকা আরমুগানীর সামনে থেকে আড়াল হতে চাচ্ছিলো না। বহুদিন পর অপ্রত্যাশিতভাবে সে আরমুগানীর সাক্ষাৎ পেলো। সে ভেবেছিলো, আরমুগানী নিরাপদেই শহর থেকে পালাতে পেরেছে। সে কোনদিন আরমুগনীর দেখা পাবে এমনটি আশা করেনি। কারণ, তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলে আরমুগানীর গ্রেফতার হওয়ার আশংকা ছিলো। আরমুগানী কোনো অবস্থাতেই গ্রেফতার হতে চাইবে না। কারণ, আরমুগনী যে সুলতান মাহমুদের গোয়েন্দা, এ সংবাদ লাহোরে জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো। কাজেই, আরমুগানীর পক্ষে আর লাহোরে আসা সম্ভব নয়।

যারকা আরমুগানীর জীবনে এক আয়েশী মরীচিকা হয়ে দেখা দিয়েছিলো। যারা যারকাকে মরীচিৎকার মতো ব্যবহার করেছিলো, তাদের এই প্রয়োগ ছিলো স্বার্থক। এই ধোকায় পড়ে আরমুগানী ওয়াদা ভঙ্গ করে তার আত্ম-পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছিলো। আরমুগানী নারী সৌন্দর্যের ফাঁদে পড়ে নিজের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছিলো কিন্তু হয়তো সেটি কুরআন কারীমেরই বরকত যে, যে ফাঁদ পাতা হয়েছিলো আরমুগনীকে ফাঁসানোর জন্য, সেই ফাঁদে সে নিজেই আটকে গিয়েছিলো। আরমুগানীর ফাঁদও ছিলো এমন কার্যকর যে, চক্রান্তকারিণী যারকা নিজের মিশন ভুলে গিয়ে শিকারকে শুধু মুক্ত করেই দেয়নি, সেও শিকারের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। কারণ, জীবনে যত পুরুষের স্পর্শে সে গিয়েছিলো, কেউ তাকে আরমুগানীর মতো অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত করেনি। সবাই তার দেহ-সৌন্দর্য নিয়ে উল্লাস করেছে মাত্র। নারী মনের ভালোবাসার অভাবটুকু আরমুগানীর অপত্য ভালোবাসায় আরো তীব্র হয়ে ওঠে, বুকের মধ্যে না পাওয়ার হাহাকার আরো প্রচণ্ড হয়। আরমুগানীর অকৃত্রিম ভালোবাসার ঝর্নাধারায় অবগাহন করে নিজেকে সিক্ত করতে সবকিছু ভুলে যায় যারকা। যারকা নিজেকে ভাসিয়ে দেয় আরমুগনীর প্রেমের জোয়ারে। কিন্তু জোয়ারের পর ভাটার টানে তারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই যারকা সামুরাতির ঘরে আরমুগনীর দেখা পেয়ে যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ আরমুগানীর সান্নিধ্যে কাটানোর সুযোগ ছিলো না যারকার। কারণ, তার বান্ধবীকে খুব বেশি সময় বৃদ্ধা পরিচারিকা অন্য ঘরে বসিয়ে রাখতে পারছিলো না।

“আগামীকাল রাতে এই বাড়ির বাগানে তোমার সাথে আমার দেখা হবে।” এই বলে কক্ষ থেকে চলে গেলো আরমুগানী ।

যারকা ও তার বান্ধবী চলে যায়। বৃদ্ধা পরিচারিকা আরমুগানীকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি লুকিয়ে যারকার সাথে কি কথা বলেছে? ওই মেয়েটি থেকে নিজেকে আড়ালে রাখলে কেন?”

এমন প্রশ্ন করা ছিলো স্বাভাবিক। বৃদ্ধা আরমুগানীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলো বটে কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় সে মোটেও জানতো না। সামুরাতি তাকে শুধু বলেছিলো, ওকে তুমি লোকচক্ষুর দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখবে। আর ওর ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করবে। বৃদ্ধা সামুরাতির কথা যথার্থভাবেই পালন করছিলো।

এই বৃদ্ধা ছিলো রাজমহলের শীর্ষ নর্তকীদের একজন। রূপে-গুণে-নাচে সমবয়স্কাদের মধ্যে সে ছিলো অনন্যা। কিন্তু বয়সের ভারে যখন তার সুঢৌল গণ্ডদ্বয়ে দেখা দিলে বলী রেখা, আর মাথার দু’চারটি চুলে সাদা বর্ণ ধারণ করলো, নাচের মুদ্রায় দেখা দিলো ছন্দপতন তখন তার প্রতি আকর্ষণে ভাটা পড়লো। সে রাজমহল থেকে বিতাড়িত হলো। তার নাচের মুদ্রায় যারা বিমোহিত হতো, তার শরীর নিয়ে খেলতো, যারা অহর্নিশ উন্মুখ থাকতো, তাদের সবাই তার দিকে আর ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করতো না। রাজমহল থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তার রক্তের কণায় কণায় আত্মোপলব্ধি হলো যে, রাজমহলের মহারথীরা আমার মতো নারীদের শরীর ও সৌন্দর্যকেই শুধু ভোগ করতে চায়। এদের মধ্যে কোনো মানবিক দয়া নেই। এরপর সে একজনকে ভালোবাসে। স্বপ্ন দেখে তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার। কিন্তু বয়োজ্যষ্ঠ এক নর্তকীর ঘর বাঁধার স্বপ্ন পূরণ হলো না। রাজার আনুগত্য প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণে সেই পুরুষকে রাজা কারান্তরীণ করলো। কারণ, সে ছিলো মুসলমান। বস্তুত সেই লোক স্বজাতির সাথেও বেঈমানী করেছিলো, কিন্তু পরিণামে আজীবন অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে মরা ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্তি ঘটলো না। বয়স্ক এই নর্তকীর এই ভালোবাসার কথাও নীরবে-নিভৃতে মৃত্যুবরণ করলো। কেউ তা জানতে পারলো না তার সেই স্বপ্নের পুরুষের কথা। কারণ, জানাজানি হয়ে গেলে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে তাকেও কারাবরণ করতে হতো।

এখনও সে শাব্দিক অর্থে বুড়ি নয়। স্বাস্থ্য সচেতন বলে এখনও তার শরীরের গাঁথুনী ও চেহারা ছবি ছিলো ভরাট ও টলটলে। সে যখন বুঝতে পারলো তার পক্ষে আর নাচা সম্ভব নয়, তার জায়গা দখল করে নিয়েছে সামুরাতি তখন সে সামুরাতির ঘরে এসে ঠাই নেয়। সামুরাতির সাথে এই বয়োজ্যেষ্ঠ নর্তকীর সম্পর্ক অন্য নর্তকীদের মতো ছিলো না। যেমনটি নর্তকীদের মধ্যে পারস্পরিক হয়ে থাকে। সামুরাতিকে সে খুব ভালোবাসতো। সামুরাতি নাচে-গানে ছিলো সকলের সেরা। জাদুকরী কণ্ঠ ও রূপ-সৌন্দর্যে সামুরাতি ছিলো অনন্যা। পরিচয়ের শুরু থেকেই সামুরাতির প্রতি মনের টান ছিলো এই প্রবীণার। এক পর্যায়ে রাজমহল থেকে বিতাড়িত হয়ে সে যখন সামুরাতির বাড়িতে ঠাই নিলো, তখন সামুরাতি তাকে সানন্দে জায়গা দিলো। সেও নিজেকে ঢেলে দিলো সামুরাতির সেবা-যত্নে। দিনে দিনে সামুরাতি তাকে মায়ের আসনে স্থান দিয়েছিলো আর বয়োজ্যেষ্ঠও তার হৃদয় নিংড়ানো স্নেহ-মমতা উৎসর্গ করে দিলো সামুরাতির কল্যাণে।

শুয়াইব আরমুগানী আহত হলে সামুরাতি তাকে ঘরে নিয়ে সেবা-শুশ্রূষা করে যখন বললো, গোপন রত্নের মতো তুমি ওকে আগলে রাখবে এবং সেবা-যত্ন করবে। তখন সে জানতেও চায়নি, লোকটি এমন কি রত্ন আর কেনই বা তাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখতে হবে। সে এমনিতেই বুঝে নিয়েছিলো, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে। বৃদ্ধা বুঝে নিয়েছিলো, নিশ্চয়ই এ সুদর্শন যুবককে বিশেষ লক্ষ্যে লুকিয়ে রাখতে চায় সামুরাতি। কারণ, এক সময় সেও একজনকে আপন করে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু রাজার বাহিনী তার ভালোবাসার মানুষটিকে ধরে নিয়ে সারাজীবনের জন্য কয়েদখানায় বন্দী করে রেখেছে। ঘর বাঁধার স্বপ্নটা তার স্বপ্নই থেকে যায়। আজীবন বুকের মধ্যে সেই কষ্ট-যাতনা সে বয়ে বেড়াচ্ছে। তাই সামুরাতির জীবনটাও এমন যন্ত্রণাদগ্ধ হোক, তা সে ভাবতেই পারে না। ফলে সামুরাতির এতোটুকু বলায়ই সে অমূল্য রত্নের মতোই আরমুগনীকে আগলে রাখতে চেষ্টা করে। সামুরাতি রাজা আনন্দ পালের নগরকোট মন্দিরে গিয়ে ফিরে না এলেও আরমুগনীকে সে যথারীতি লোকচক্ষুর আড়ালেই রেখেছে। আসলে এ কাজটি সে করেছে সামুরাতির ভালোবাসার টানে। নিজের অপূরণীয় প্রেমের সুপ্ত ঝর্না থেকে সিঞ্চিত মমতা দিয়ে সে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলে আরমুগনীকে। সামুরাতির দীর্ঘ অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সে কোনো দিন আরমুগনীকে এ কথাটিও জিজ্ঞেস করেনি, সে কে? কি তার পরিচয়? কোত্থেকে এসেছে যাবেই বা কোথায়?

যারকা এ বাড়িতে সামুরাতির সাথে সাক্ষাৎ করতে এলে আরমুগানী যখন তার সাথে লুকিয়ে কথা বলতে অনুরোধ জানায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধা পরিচারিকার মনে প্রশ্ন দেখা দেয়, লুকিয়ে থাকা এই যুবকের সাথে যারকার কি সম্পর্ক? কিভাবে তার পরিচয় যারকার সাথে? যারকার সাথে অতি গোপনে বান্ধবীকে এড়িয়ে কি কথা সে বললো?

বৃদ্ধার মনোভাব আন্দাজ করে আরমুগানীর মধ্যেও এ তাড়না সৃষ্টি হলো যে, সে নিজের প্রকৃত পরিচয় বৃদ্ধার কাছে ব্যক্ত করবে কিনা? ভেবে-চিন্তে সে সিদ্ধান্ত নিলো, হ্যাঁ, বৃদ্ধাকে বলেই দেবে তার পরিচয়।

আরমুগানী বৃদ্ধাকে ডেকে বললো, “যারা আমার বিবাহিতা স্ত্রী।”

“তাই যদি হবে তবে এমন রাখঢাক কেন?” জানতে চাইলে বৃদ্ধা।

“তুমি কি ওর সৌন্দর্য দেখেছ?” আরমুগানীর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে বলল, “তুমি কি জানো যারকা কার মেয়ে?”

“যারকা এক ভয়ংকর সাপের সন্তান?” উত্তর দিলো বৃদ্ধা। “ওর বাবাকে আমি চিনি। সে দুর্নীতিবাজ, বেঈমান, আত্মমর্যাদাহীন, গাদ্দার, কুলাঙ্গার এক মুসলমান। সে তার নিজের কন্যার রূপ-সৌন্দর্যের বিনিময়ে রাজ দরবারে বিশেষ সম্মানের অধিকারী হয়েছে।”

“ওর মেয়ে গোপনে আমাকে বিয়ে করেছিলো। সে আমার ঘরে চলে এলে তার বাবার কানে এ সংবাদ চলে যায়। তুমি জানো, গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে লাহোরের সব মুসলমানদের ঘরে তল্লাশি করছে এবং নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। ব্যক্তিগত আক্রোশেও অনেকে নিরপরাধ মানুষকে ধরিয়ে দিচ্ছে। যারকার বাবা সামরিক বাহিনীর এক পদস্থ কর্তাব্যক্তির কাছে তার সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কথা বলে প্রশাসনকে পক্ষে নিয়ে এক রাতে কয়েকজন পুলিশ নিয়ে আমার ঘরে হানা দেয় এই বলে যে, আমি গজনী সুলতানের গোয়েন্দা। কিন্তু যারা আমাকে গ্রেফতারির কবল থেকে বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। পুলিশ আমার ঘরে হানা দেয়ার আগেই যারকা কিভাবে যেনো জানতে পারে এবং আমাকে গভীর ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে, তোমাকে গ্রেফতার করতে পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করেছে। পরিস্থিতির ভয়াবতা অনুমান করতে পেরে আমি ঘরের ছাদে উঠে দেয়াল টপকে দৌড়ে পালাতে গিয়ে তোমাদের বাড়ির চৌহদ্দিতে এসে বাগানে লুকাই। পুলিশ আমার পিছু ধাওয়া করেও ধরতে পারেনি। কিন্তু তোমাদের কুকুর আমাকে পেয়ে বসে। তোমাদের বিবি সাহেবা আমার এ অবস্থা দেখে দয়াপরবশ হয়ে আমাকে আশ্রয় দেয়। আচ্ছা, আমাকে কি গোয়েন্দা মনে হয়?”

“না, তোমাকে গোয়েন্দা মনে হবে কেন?” বললো বৃদ্ধা পরিচারিকা। “রকার বাবা আক্রোশের কারণে এমনটা করেছে। আচ্ছা, তুমি এখন কি করতে চাও?”

“আমার পক্ষে এখন আর শাহোরে থাকা সম্ভব নয়। যারকার বাবা যদি আমার কথা জানতে পারে, তবে সে আমাকে ধরিয়ে দেবে, নয়তো হত্যা করবে। আমি যারকাকে নিয়ে পেশোয়ার চলে যেতে চাই।”

“সে কি তোমার সাথে যেতে প্রস্তুত?”

“হ্যাঁ, সে তো একপায়ে খাড়া। আমি এ ব্যাপারে তোমার সহযোগিতা চাই। আগামীকাল সন্ধ্যায় যারকা লুকিয়ে এখানে আবার আসবে। আমি গোপনে বাগানের একটি জায়গায় ওর সাথে দেখা করবো বলে কথা দিয়েছি। এখন তো আদ্যপান্ত তুমিও জানতে পারলে। এখন তুমি কি ওকে ঘরে নিয়ে আসা পছন্দ করবে? অবশ্য ওর পিছু পিছু যদি কেউ এখানে পৌঁছে যায়, তাহলে আমার ধরা পড়ার আশংকা আছে।”

“তুমি নির্দিধায় ওকে ঘরে নিয়ে আসতে পারো। আমি কুকুর ছেড়ে দেবো, তাহলে কারো পক্ষে এদিকে পা বাড়ানো সম্ভব হবে না। কেউ পিছু নিলেও তুমি পালানোর সুযোগ পাবে। যারকাকে আড়াল করার প্রয়োজন নেই। কারণ, আমি দৃঢ়তার সাথে যে কারো সাথে এ কথা বলতে পারবো যে, সে সামুরাতির সাথে দেখা করতে এসেছিলো।”

“তুমি কি এ বিষয়টি জানতে পেরেছে, মহারাজা ফিরে এসেছে কিন্তু সামুরাতি ফিরে এলো না কেন?”

“চেষ্টা করছি।” বললো বৃদ্ধা। “এমন তো হওয়ার কথা নয় যে, মহারাজা সামুরাতিকে উপঢৌকনস্বরূপ কাউকে দিয়ে আসবে। কারণ, যে কোনো মূল্যে সামুরাতিকে সে হাতের মুঠোয় রাখতে চাইবে।”

“আমি অবশ্য যারকাকে এ ব্যাপারে খবর নেয়ার জন্য বলে দিয়েছি। আশা করি, সে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহে সক্ষম হবে।”

***

যারকা কথা মতো সন্ধ্যায় সামুরাতির বাড়িতে এলো। সে ঠিকই সামুরাতির না ফেরা সম্পর্কে খবর সগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছে। আরমুগানী বাগানের বাইরে এ যে জায়গায় সে গকিয়ে ছিলো, সেই জায়গায় যারকার জন্য অপেক্ষা করছিলো। এ দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর যারকা এলো। যারকা একাকীই এলো। সে যারকাকে # ঘরের ভেতরে নিয়ে এলে পরিচারিকা বাগানে কুকুর ছেড়ে দেয়।

যারা প্রথমেই জানালো, সামুরাতিকে নগরকোটের প্রধান পণ্ডিত বলী ৫ দেয়ার জন্য রেখে দিয়েছে। সে দ্বিতীয় সংবাদ দিলো, বিগত কয়েক মাস ধরে তিন-চারটি রাজ্যের যেসব সেনা রাজা আনন্দ পালের রাজধানী লাহোরে জমায়েত হচ্ছিলো, এরা সবাই পেশোয়ারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই সম্মিলিত হিন্দু বাহিনীর বিজয়ের জন্য পণ্ডিত দেবীর পদমূলে নর বলী দেয়ার জন্য সামুরাতিকে আটকে রেখেছে। মনে হয় এর মধ্যে পণ্ডিত সামুরাতিকে বলী দেয়ার কাজ সমাপ্ত করেছে।” বললো যারকা।

“আমার বিশ্বাস, সামুরাতি এখনো বেঁচে আছে।” বললো বৃদ্ধা পরিচারিকা। “কারণ, যেসব নারীকে পণ্ডিতরা বলী দিতে চায়, এদেরকে কয়েক দিন নিজেদের কজায় রেখে মানসিকভাবে তৈরি করে। তাদেরকে গঙ্গাজলে ধৌত করে আর নানা তন্ত্রমন্ত্র পড়ে বশে আনে। এদেরকে নেশাদ্রব্য খাইয়ে এমন করে ফেলে যে, তরুণী নিজে থেকেই বলতে থাকে, আমাকে দেবীর চরণে বলী দিয়ে দাও।”

তিন জনের মধ্যে নেমে এলো গভীর নীরবতা।

“সামুরাতি আমার যে উপকার করেছে, তা কোনো সাধারণ কাজ নয়। আমি তা ভুলে যেতে পারি না।” বললো আরমুগানী। “আমি অবশ্যই নগরকোট যাবো এবং সামুরাতি জীবিত না ইতিমধ্যেই তাকে বলী দেয়া হয়েছে- তা জানতে চেষ্টা করবো। যদি জীবিত থাকে, তবে আমি তাকে বাঁচানোর সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করবো।”

“নগরকোট মন্দির সম্পর্কে তুমি জানো না।” বললো বৃদ্ধা। “সেটি সাধারণ কোনো মন্দির নয় যে, তুমি সেটিতে প্রবেশ করে সব কক্ষ ঘুরে দেখতে পারবে। আমি নগরকোট মন্দিরের ভেতরে গিয়েছি। নগরকোট মন্দির একটা গোলক ধাঁধা। সেখানে রয়েছে বিশাল পাতাল কক্ষ। পাতাল কক্ষগুলো এতোটাই বিশাল যে, কোনো হাতিও যদি-সেখানে হারিয়ে যায়, তাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। তাছাড়া মন্দির ঘিরে রয়েছে বিশাল সেনা দুর্গ। বহু মানুষ সেখানে পূজা পাঠ করতে যায় বটে, কিন্তু সামুরাতিকে পণ্ডিতেরা কোথায় রেখেছে তা জানা সহজ ব্যাপার নয়।”

শুয়াইব আরমুগানীর শরীরে তখন যৌবনের দৃপ্ত তারুণ্য ঝিলিক দিয়ে উঠে। সে জানতো, সামুরাতি একটি মুসলিম মেয়ে। একজন মুসলিম তরুণী হিন্দুদের যুদ্ধ জয়ের জন্য বলীর শিকার হবে, তা মোটেও বরদাশত করতে পারছিলো না আরমুগানী। আরমুগানীর চোখে তখন ভেসে উঠলো সেই দৃশ্য, যখন কুকুর তাকে মারাত্মকভাবে আহত করার পর সামুরাতি তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে নিজের হাতে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে দিচ্ছিলো। সামুরাতির এক হাতও কামড়ে দিয়েছিলো কুকুর। অনবরত ঝরেপরা আরমুগানীর রক্তের সাথে সামুরাতির ক্ষতস্থান থেকেও যখন দু’ফোঁটা তাজা রক্ত বিছানায় পড়েছিলো, তখনই এই রক্ত দেখিয়ে সামুরাতিকে সে বলেছিলো, দেখো, তোমার আর আমার রক্তের মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই, যেনো একই রক্ত। সেদিন সামুরাতি তাকে বলেছিলো, আজ তুমি আমার রক্ত দেখিয়ে আমার মৃতপ্রায় বোধকে জাগিয়ে দিলে। এই রক্ত দেখে এখন আমি নিজের আত্মপরিচয় উপলদ্ধি করতে পারছি।

দীর্ঘক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো আরমুগানী। সেই রাতের গোটা ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ভেসে উঠলো সামুরাতির হৃদয়ের আকুতি এবং মমতার পরশ। হঠাৎ সে বলে উঠলো, “পাথরের তৈরি মূর্তির কল্যাণে এক মুসলিম তরুণীর মৃত্যু হতে আমি কখনো দেবো না।” চকিতে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে আরমুগানী বললো, “তুমি দাবী করো, সামুরাতিকে নিজের মেয়ের মতোই মেহ করো। তোমার হৃদয়ে তার জন্য রয়েছে মায়ের মমতা। যদি তাই মনে করো তাহলে তুমি কি তা প্রমাণ করতে পারবে? তুমি কি আমার সাথে নগরকোট যেতে পারবে? কারণ, আমি নগরকোটের পথ চিনি না। তুমি আমাকে নগরকোট নিয়ে চলো আর ভেতরের পরিবেশটা একটু বুঝিয়ে দিও। আমার বিশ্বাস সামুরাতি এখনও জীবিত আছে।”

“পথেই আমরা গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার আশংকা নেই কি?” বৃদ্ধা বললো।

“না। অন্তত পথের গ্রেফতারী আমরা এড়িয়ে যেতে পারবো। কারণ, আমরা ছদ্মবেশে যাবো।” আরমুগানী যারকার উদ্দেশে বললো, “তুমি এখানেই থাকো যারকা। আমি বেঁচে থাকলে অবশ্যই দেখা হবে।”

“আমিও যাবো তোমাদের সাথে।” দৃঢ়তার সাথে বললো যারকা। “আমি আর একাকী থাকতে পারবো না। যেখানে তুমি যাবে আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।”

পরিচারিকা আগেই জেনেছিলো আরমুগনী আর যারকা স্বামী-স্ত্রী। এ জন্য সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সামুরাতির মৃত্যু আশংকা আর আরমুগানীর প্রতি তার অবদানের বিষয়টি আরমুগনীকে এতোটাই আবেগাপ্লুত করে ফেলেছিলো যে, সে ভুলেই গিয়েছিলো তার একান্ত প্রেয়সী দীর্ঘদিন পর তার একান্তই পাশে রয়েছে এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে তার একান্ত সান্নিধ্যের জন্য চলে এসেছে। আরমুগানীর ভাবান্তর অনুধাবন করে যারা তার কাঁধে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দেয়। যারকার দিকে তাকায় আরমুগানী।

“মনে হয় তুমি এখন পর্যন্ত আমাকে ধোকাই ভাবছো।” শ্লেষমাখা কণ্ঠে বললো যারকা। “একজন নর্তকীকে তুমি আমার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবছো এবং ওর জন্য পেরেশান হয়ে পড়েছে?”

“ওহ্ যারকা!” যারকার হাত ধরে বললো আরমুগানী। এভাবে বলো না। সামুরাতি আমাকে আশ্রয় না দিলে আজ রাজার বন্দীশালায় আমাকে জীবন্ত লাশে পরিণত হতে হতো। তুমি জানো না, তুমি যেমন মুসলমান, সামুরাতি একজন মুসলিম তরুণী। আমি তোমাকে মোটেও অবিশ্বাস করছি না। ভাবছি, তোমাকে এখানে রেখে যেতেও মন চাচ্ছে না, আবার সাথে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। এখানে রেখে গেলে মনে হয় না পুনর্বার ফিরে এসে আমার পক্ষে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করা সব হবে।”

“ছদ্মবেশে যেভাবে তুমি পরিচারিকাকে নিয়ে যাবে, সেভাবে আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে চলো। অতীতের কৃত গুনাহর কাফফারা করার সুযোগটুকু আমাকে দাও।”

“যারকা! একটা বিষয় তোমার খেয়াল রাখতে হবে যে, সামুরাতির পরিচারিকাকে তুমি যে আমার স্ত্রী একথা আমি বলেছি বটে কিন্তু আমি যে গজনী সুলতানের গোয়েন্দা এ কথা কিন্তু বলিনি। আমার আরো দুই সাথীকে সঙ্গে নিতে হবে। আজ রাতে আমি ওদের সাথে দেখা করবো। আমি ওদের বলে-কয়ে আমাকে সহযোগিতা করার জন্য রাজি করাবো। তুমি এখন চলে যাও। সম্ভব হলে আগামীকাল সকালে একটু এদিকে এসো। তখন বলে দিতে পারবো, আমাদের যাত্রা কিভাবে হবে।”

যারা তাকে জানালো, “সরকারীভাবে তোমাকে এখন আর খোঁজাখুজি করছে না। এ মুহূর্তে লাহোর অনেকটাই শান্ত। সেনাবাহিনী অভিযানে বেরিয়ে পড়েছে, ধর-পাকড়ও থেমে গেছে।”

আরমুগানীর দাড়ি তখন বেশ বড় হয়ে গেছে। এমনিতেই সে রূপ বদল করার বিস্ময়কর ক্ষমতা রাখতো। তাছাড়া বহু ধরনের আওয়াজ সে করতে পারতো। যারকাকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়ে তার বন্ধুদের উদ্দেশে অন্যদিকে চলে গেলো আরমুগানী। তার মন-মানসিকতায় এখন সামুরাতির মুক্তিই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।

***

নগরকোটের পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের হৃদয়রাজ্যেও সামুরাতি প্রভাব সৃষ্টি করেছিলো। নারীর ব্যাপারে পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ ছিলো পাথর। পণ্ডিত নারীদের খুবই ঘৃণা করতো। বলতো, নারী একটা জীবন্ত যন্ত্রণা, সকল অঘটনের শিকড় এই নারী। নারীর মধ্যে এমন জাদু রয়েছে যদি তা কোনো পুরুষকে পেয়ে বসে তাহলে সেই পুরুষের আর কোন কর্মশক্তি থাকে না। তখন মন্দ ছাড়া মঙ্গলের কিছু ভাবতেই পারে না নারী প্রভাবিত পুরুষ।

কিন্তু সামুরাতিকে বলী দেয়ার জন্য যখন পাহাড়ের উপর মন্দিরের গোপন কক্ষে নিয়ে গেলো এবং সামুরাতিকে বশীর কথা শোনালো, তখন সামুরাতি তার সাথে এমনসব আচরণ করছিলো, যেন পণ্ডিতের ভেতরকার কোনো এক শক্তি মোচড় দিয়ে ওঠে। সেই শক্তির উপস্থিতি এতোদিন পণ্ডিত অনুভব করেনি। অতঃপর ভোরবেলায় এসে সামুরাতিকে গঙ্গাতীরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে পণ্ডিত নিজের শয়নকক্ষে চলে যায়। নিজের ভেতর পণ্ডিত এতোটাই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলো যে, বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া মাত্রই সে ঘুমিয়ে পড়তে পারতো। সে কখনো মানসিক অস্থিরতায়ও ভোগেনি কিন্তু এ রাতে পণ্ডিতের কি যে হলো, ঘুমানোর চেষ্টা করেও সে ঘুমাতে পারছিলো না। সামুরাতির অট্টহাসি আর শির মতো গায়ের উপর লুটিয়ে পড়ার মতো আচরণ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। সামুরাতির রেশম কোমল চুলের স্পর্শ যেনো তার অনুভবে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। নারীর স্পর্শ, নারী দেহের উষ্ণতা ও গন্ধের সাথে তার পরিচয় ছিলো না। কিন্তু আজ নারীদেহের আকর্ষণ থেকে সে নিজেকে কিছুতেই মুক্ত করতে পারছিলো না।

সামুরাতির উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ তার কানে নিরন্তর ধ্বনিত হচ্ছিলো- “আপনি যদি আমাকে সেই ভালোবাসা দেন, যে ভালোবাসার জন্য আমার হৃদয় বহুদিন থেকে তৃষ্ণার্ত, তাহলে মনের আনন্দে আমি এমন নৃত্য করবা যে, পাথরের মূর্তিগুলোও আমার সাথে নাচতে শুরু করবে। লোকজন দূর-দূরান্ত থেকে নগরকোটের নর্তকীর নাচ দেখতে আসবে আর ভগবানের পূজা বাদ দিয়ে লোকজন নগরকোটের নর্তকীর পূজা করতে শুরু করবে।”

পণ্ডিত এতোটাই মোহাবিষ্ট হয়ে সামুরাতির কথা ভাবছিলো, যেনো সে রঙিন স্বপ্নে মেতে আছে। আর এরই মধ্যে কেউ তার শরীরে সুঁই ফুটিয়ে জাগিয়ে দিয়েছে। সে রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলো। এক লাফে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো। তার স্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো যেনো। সে মনে মনে স্বগতোক্তি করলো সামান্য একজন নর্তকী… মুসলমান… ম্লেচ্ছ পাপীষ্ঠা। জানা নেই কত পুরুষের সাথে মেলামেশার পাপ মাথায় নিয়ে বেড়াচ্ছে। ও করছে কৃষ্ণ ভগবানকে অপমান? কৃষ্ণ ভগবানের ক্রোধ সম্পর্কে জানে না হতভাগী। এ জন্যই দেব-দেবীকে পাথরের মূর্তি বলে।

নিজের হাতের তালুতেই প্রচণ্ড আঘাত করে পণ্ডিত। ক্ষোভে দাঁতে দাঁত পিষে স্বগতোক্তি করলো- ছিঃ ছিঃ স্নেচ্ছের বাচ্চা ম্লেচ্ছ, আমার শরীর অপবিত্র করে দিয়েছে। আমি মিথ্যা বলিনি, নারীর শরীর পুরুষকে জানোয়ার বানিয়ে দেয়। পণ্ডিত নিজের অজান্তেই বিড় বিড় করতে লাগলো। সে যা ভাবছিলো তা কণ্ঠ দিয়ে সশব্দে বেরিয়ে আসছিলো- “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকে পবিত্র করতে হবে । হয়তো বহু দিন লাগবে, তবুও ওকে পবিত্র করে ওর রক্ত দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পা ধুইয়ে দিতে হবে।”

দীর্ঘক্ষণ পর পণ্ডিতের দেমাগ সামুরাতির প্রভাবমুক্ত হলো। মধ্যরাতের পর পণ্ডিত গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো ভোরেই পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তোরের আবছা অন্ধকারে উঁচু পাহাড়ী মন্দির থেকে নীচে নেমে ভজন গুনগুনিয়ে পণ্ডিত গঙ্গার একটি শাখা নদীর তীরে পৌঁছালো । নদীতে নেমে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে দু’হাত পানি ছিটিয়ে ভজন জপতে জপতে পানিতে বসে পড়লো। হিন্দুরা আজো বিশ্বাস করে, গঙ্গা নদীর পানিতে স্নান করলে সকল পাপ ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। ঠাণ্ডা পানিতে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর পণ্ডিত অনুভব করলো তার শরীরটা এখন জুড়িয়ে এসেছে। সারারাত সে শরীরে একটা জ্বালা অনুভব করেছে। সে অনুভব করলো নর্তকী সামুরাতি তার শরীরে যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, সে আশুন চিরদিনের জন্য নিভিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছে।

ভজন ও গঙ্গা স্নান পণ্ডিতের মনে স্বস্তি এনে দিলো। এখন সে আগের পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের ভাবগাম্ভীর্য ফিরে পেলো। যে কারণে কোনো পূজারিণী নারীকেও পর্যন্ত কোনদিন তার শরীর স্পর্শ করতে দেয়নি রাধাকৃষ্ণ। রাতের অস্থিরতায় সামুরাতির প্রতি তার মনে যে ঘৃণা ও ক্ষাভ দানা বেঁধেছিলো, তাও তিরোহিত হয়ে গেলো। সে ভাবতে লাগলো, মাসুরাতির কোনো দোষ নেই, তাকে পাপ কাজে বাধ্য করা হয়েছে। তাই তো সে বলেছে, সে নির্ভেজাল প্রেমের কাঙালী । সে বলেছিলো, আমাকে কি গঙ্গা জলে বিধৌত অকৃত্রিম ভালোবাসা দিতে পারবে?

হ্যাঁ, তোমাকে আমি গঙ্গা জলে বিধৌত নির্ভেজাল প্রেম দেবো। স্বগতোক্তি করে রাধাকৃষ্ণ। আমি এ নর্তকীকে গঙ্গা জলে ধৌত করে অকৃত্রিম প্রেম দেবো। এরপর ওকে কৃষ্ণ দেবীর চরণে বলী দিয়ে বলতে পারবো যে, আমি এমন এক নারীকে বলী দিয়েছি যাকে আমি ভালোবাসি। অবশ্যই এই বলীদান দেবীর কাছে কবুল হবে। গজনী, বলখ, বোখারা, সমরকন্দ মহাভাতের অন্তর্ভুক্ত হবে। মন্দিরের শাখা ধ্বনি মাহমূদের প্রতিটি মসজিদে ধ্বনিত হবে। হিন্দু ধর্মের মহাবিজয় আর ইসলাম ধর্মের পতন ঘটবে।

গঙ্গা স্নান থেকে ফিরে এসে মন্দিরের যেখানে হিন্দু নারী-পুরুষ সকালের পূজা দিচ্ছিলো, মণ্ডিত সেখানে গেলো। সে ঘটি থেকে গঙ্গার পানি মূর্তির চরণে ছিটিয়ে দিয়ে হাত জোড় করে মূর্তিকে প্রণাম করলো।

অন্যদিনের চেয়ে সেদিন সকালে সময় বেশি নিয়ে পূজা-অর্চনা করতে লাগলো। সে যখন দেব-দেবীর সন্তুষ্টি বিধানে আত্মতুষ্টির মোহময়তা কাটিয়ে স্বাভাবিক হলো, তখন সেখানে আর কেউ নেই। নগরের লোকজন পূজা-অর্চনা শেষ করে সবাই যে যার মতো চলে গেছে।

পণ্ডিতের মনে পড়লো, আরে, এই নর্তকীকেও গঙ্গা জলে স্নান করানো উচিত ছিলো। কিন্তু ততোক্ষণে সূর্য উঠে চতুর্দিকে সকালের কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে। সে কক্ষে এসে দেখলো, সামুরাতি এখনো গভীর ঘুমে অচেতন। সে সামুরাতির বিছানা থেকে দু’তিন কদম দূরে দাঁড়ালো। যেনো কোনো অদৃশ্য হাত তাকে ওখানেই থামিয়ে দিয়েছে।

সামুরাতি নিরুদ্বেগে ঘুমাচ্ছিলো। তার ঠোঁটে যেনো তখনও নিষ্পাপ শিশুর হাসি মেখেছিলো। দেখে মনে হচ্ছে, সে হয়তো রঙিন কোন স্বপ্ন দেখছে। বেলা অনেক উপরে ওঠে গেলেও সে নিশ্চিন্তে বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। পণ্ডিত ভাবলো, পাপ তো মানুষকে স্বস্তি দেয় না! এই নর্তকী তো পূজা পাঠের ঘোরবিরোধী। ওর আত্মা কি পবিত্র? এটা কি ওর আত্মিক প্রশান্তি যে বলীদানের কথা শুনেও নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে?

ঘুমন্ত সামুরাতিকে দেখতে দেখতে পণ্ডিতের ভাবান্তর ঘটলো। ঘুমন্ত নর্তকীর চেহারায় সে কোন পাপ দেখছে না। ইত্যবসরে সামুরাতির ঘুম ভেঙ্গে গেলে পণ্ডিতের মনে হলো এ যেনো সদ্যভূমিষ্ঠ নিষ্পাপ কোনো শিশু, যে নিশ্চিন্তে মায়ের কোলে শুয়ে আছে। পণ্ডিত অনুভব করলো, নর্তকী আর তার মধ্যে যেনো একই রক্ত প্রবাহিত। পণ্ডিত সামুরাতির দিকে তাকিয়ে অতীতে হারিয়ে যায়। তার মনে পড়ে শৈশবের কথা। যখন এই তরুণীর মতোই সে বেঘোরে ঘুমাতো। ছোটবেলার দেখা সেই মায়ের চেহারা তার চোখে ভেসে ওঠে। অতীতের ভাবনা কাটিয়ে বাস্তবতা অনুভব করার জোর চেষ্টা করলো পণ্ডিত কিন্তু ভাবালুতা তাকে আরো বেশি আবিষ্ট করে ফেললো। তার মনে হতে লাগলো, তার মায়ের চেহারা যেন অবিকল সামুরাতির চেহারার মতোই ছিলো অমলিন নিষ্কলুষ।

কন্যা-জায়া-জননী- পণ্ডিতের হৃদয়ে এ তিন মমতার কাঁটা বিদ্ধ হতে শুরু করলো। হঠাৎ তার মধ্যে দেখা দিলো বিশাল শূন্যতা। নিজেকে বিরান ভূমিতে ভগ্নস্তূপের মতো মনে হতে লাগলো। জীবনের দীর্ঘ সময় কন্যা-জায়া-জননীর শূন্যতা পূরণের জন্য সে দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করে পূরণ করতে চেয়েছে, কিন্তু আজ এই নর্তকী তার মধ্যে সেই শূন্যতাকেই প্রকট করে তুলেছে। মনে হচ্ছে তার এতোদিনের সাধনা নর্তকী গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দিয়েছে। সে একটা পরিত্যক্ত উজার শ্মশান। নর্তকীর মধ্যে নারীর সকল রূপ-সৌন্দর্য, স্নেহ-মমতা জীবন্ত হয়ে উঠলে পণ্ডিতের হৃদয়ে শুরু হলো এক ধরনের হাহাকার। সামুরাতিকে স্পর্শ করার জন্য অধীর হয়ে উঠলো।

পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ যখন সামুরাতির আরো কাছে আসে তখন সামুরাতি চোখ খুলে। সে পণ্ডিতকে দেখে আড়মোড়া দেয় এবং হাই তুলে। পণ্ডিত জীবনে কখনো কোন নারীকে এতো কাছে থেকে ঘুম থেকে ওঠে হাই তুলতে দেখেনি। সামুরাতির হাইতোলা দেখে পণ্ডিতের মধ্যে এক ধরনের ঝড় সৃষ্টি হয়। এমন এক ভাবের সৃষ্টি হয় যা কখনো সে অনুভব করেনি। এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি অনুভব করতে লাগলো। দেখা দিলো আত্ম-বিমোহিতা।

“ওহ! কত বেলা হয়ে গেছে। গত রাতে আপনি আমাকে একাকী ফেলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?” সামুরাতি বললো।

“তুমি একাকী ভয় পাও?”

“ভয়? হেসে লুটিয়ে পড়লো সামুরাতি। ভয় তো একটা অনুভূতি। আমার অনুভূতি মরে গেছে। নারী পরপুরুষে ভয় পায় কিন্তু পরপুরুষের হাতের খেলার পুতুল নারীর কোনো ভয় থাকে না। যে পথিক একবার লুটেরা দ্বারা লুষ্ঠিত হয়, বাকি পথ সে নির্ভয়েই অতিক্রম করে। আমার এখন আর কোনো দস্যুর ভয় নেই।”

“তুমি যেভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলে তা কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব যাদের আত্ম পবিত্র। কিন্তু একটা নর্তকী কিভাবে এতো প্রশান্তচিত্ত হতে পারে!”

“আমার শরীরে এখন শুধু রূহটাই আছে, যাকে আপনি আত্মা বলছেন। আমার শরীরটা পর হয়ে গেছে কিন্তু আত্মা আমার নিজের, এটা প্রকৃতপক্ষে শান্তই আছে।”

“কি! কিভাবে তা সম্ভব?”।

“ধর্মীয় উন্মাদনায় অন্ধ ব্যক্তিরা আত্মার এই প্রশান্তির কথা বুঝতে পারে না। তারা একটাই শোর তোলে, প্রার্থনা করো আত্মার প্রশান্তি পাবে। জাগতিক বোকা হৃদয়ে না থাকলে আত্মা প্রশান্ত থাকে। মানসিকতার মধ্যে যদি সুচিন্তা কাজ করে তাহলে আত্মা শান্তি পায়…। এসব কথার কথা পণ্ডিত মশাই। আমি মানুষের পাপের বোঝা নিজের মাথায় তুলে নিয়েছি, যার দ্বারা আমি আত্মার প্রশান্তি পাচ্ছি।”

কথাগুলোতে হয়তো সামুরাতির জাদুকরী কৌশল ছিলো নয়তো তা ছিলো আত্মশক্তির প্রভাব। সামুরাতির বলার ভঙ্গিতে এতোটাই আত্মবিশ্বাস ছিলো যে, তার কথা শুনে পণ্ডিতের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যায়। পণ্ডিতের মন-মানসিকতায় প্রভাব বিস্তার করে সামুরাতি। পণ্ডিতের দেমাগে এতোদিন পুষে রাখা পাপ-পুণ্যের সংজ্ঞা আর স্বর্গ-নরকের দর্শন এলোমেলো হয়ে গেলো।

ভোলা কাঁধ। বিক্ষিপ্ত কেশরাজি। পণ্ডিত সাধনার এ দীর্ঘ জীবনে এই প্রথম অনুভব করলো নারীকে যন্ত্রণা বলা সহজ কিন্তু নারীর ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষা করা ততোটা সহজ নয়। সামুরাতিকে এ অবস্থায় দেখে পণ্ডিতের হৃদয়রাজ্যে তোলপাড় শুরু হলো। মনের মধ্যে শুরু হলো যুদ্ধ।

“আরে আপনি একেবারে চুপ হয়ে আছেন যে?” স্মিত হেসে বললো সামুরাতি। “আপনি মহারাজা আনন্দ পালের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে এনে একাকী ফেলে চলে গেছেন। আচ্ছা, রাতে আপনি কোথায় ছিলেন? আপনি না আমাকে পবিত্র করতে চান? পবিত্র করতেই আমাকে নিয়ে এসেছেন। আমাকে পবিত্র কবে করবেন?”

হঠাৎ হতচকিয়ে উঠলো পবিত। তার মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে পড়লো, “কৃষ্ণদেবীর চরণে তোমাকে বলী দেবো।”

কথাটা এমনভাবে বললো পণ্ডিত যেনো এমন সৌভাগ্য সবার কপালে জোটে না।

পণ্ডিতের কথায় সামুরাতির মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। বলীদানের কথা শুনে বিস্মিতও হলো না। ঠোঁটের স্মিত হাসিও ম্লান হলো না।

কিন্তু মুখ ফসকে কথাটা বের হওয়ায় পণ্ডিত নিজেই বিস্মিত হলো, এ মুহূর্তে কথাটা বলা তার উচিত হয়নি। যাকে বলীদান করা হয়, তাকে কখনো বলীদানের কথা জানানো হয় না। বরং নেশা জাতীয় কিছু খাইয়ে ও কৌশল প্রয়োগ করে তার দেমাগে বিকৃতি সাধন করা হয়। তার চিন্তা-চেতনায় পণ্ডিতের মনোবাসনা আত্মপ্রবিষ্ট করা হয়। কিন্তু পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণকে সামুরাতির প্রভাব এতোটাই আবিষ্ট করে ফেলেছিলো যে পণ্ডিত নিজের নিয়ন্ত্রণ বিবেকের কজায় রাখতে ব্যর্থ হয়।

“আপনি আমার দেহকে বলী দিতে চান। কিন্তু এই শরীর তো আমার শরীর নয়। এটা যদি আমার দেহ মেনে নিই, তাহলে তা তো অনেক আগেই বলী হয়ে গেছে। দেখুন, আত্মাটা একান্তই আমার। আপনি এটিকে বলীদান করুন। অবশ্য আমার আত্মা আপনার কজায় যাবে না। আপনি কি কখনো কারো আত্মা কজা করেছেন অথবা আপনার আত্মার উপর কি অপর কারো কজা হয়েছিলো?”

এসব তাত্ত্বিক কথায় বোকার মতো সামুরাতির দিকে তাকিয়ে রইলো পণ্ডিত।

“আপনি সত্যিকার প্রেম-ভালোবাসার সাথে পরিচিত নন। কারণ, আমি আপনাদের সম্পর্কে মন্দিরগুলোর ভেতরে কি ঘটে তা জানি। এখানে সেইসব জিনিসকে পছন্দ করা হয় যেগুলো দৃশ্যত সুন্দর আর যেগুলোকে স্পর্শ করা যায়। এ জন্যই তো আপনারা সেই প্রভুকে বিশ্বাস করেন না, যে প্রভুকে দেখা যায় না। দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রভু আপনারা নিজের হাতে তৈরি করে নেন। আপনারা দেহকে বলী দিয়ে মনে করেন এসব মূর্তিকে খুশি করেছেন। এটাও বিশ্বাস করেন, এসব পাথরের মূর্তি আপনাদের সব আকভক্ষা পূর্ণ করে দেবে।”

“তুমি মুসলমান বলেই এ ধরনের কথা বলছে।”

“না, আমি কিছুই না। আমার কোনো ধর্ম নেই। আমি একটা তৃষ্ণার্ত আত্মা। আপনার আত্মাও তৃষ্ণার্ত। আমি পুরুষের চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের অবস্থা বলে দিতে পারি।” সামুরাতি একটি হাত এগিয়ে বললো, “আপনার হাত আমার হাতে রাখুন। দূরে বসে আছেন কেন? আমার কাছে আসুন।”

মূর্তির মতো বসে রইলো পণ্ডিত। সামুরাতি লাফিয়ে উঠে তার গা ঘেঁষে বসে। সামুরাতি দু’হাতে পণ্ডিতের চেহারা তালুবদ্ধ করে পণ্ডিতের চোখে চোখ রাখে। কেঁপে উঠলো পণ্ডিতের শরীর। সামুরাতির হাত তার চেহারা থেকে সরিয়ে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যায়।

কি যেনো বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু পণ্ডিতের কথা জড়িয়ে যায়। জড়ানো কণ্ঠে পণ্ডিত বললো, তোমার জন্য কাপড় পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি স্নান করে নাও। ইতিমধ্যে তোমার খাবারও পৌঁছে যাবে। এ কথা বলেই পণ্ডিত দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।

পণ্ডিতের মনোভাব দেখে প্রচণ্ড হাসি পেলো সামুরাতির। শোয়াইব আরমুগানীর কথা তার মনে পড়লো। সে আরমুগনীকে বলেছিলো, তার উপস্থিতিতে আনন্দ পালকে কাঞ্জরের রাজা বলেছিলো, আমরা সুন্দরী মুসলিম তরুণীদেরকে ধরে এনে বেশ্যাবৃত্তিতে লিপ্ত করি এবং তাদেরকে নৃত্যসংগীত ও বেহায়াপনায় উৎসাহিত করি। মুসলমানদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও তাদের বংশধারা বিনষ্টকরণে এর বিকল্প নেই। এ তৎপরতা অব্যাহত রাখলে এমন এক সময় আসবে যখন যেসব মুসলমান হিন্দু প্রধান এলাকায় বসবাস করবে, সম বিক্রি ও নাচ-গান ছাড়া এদের জীবন-জীবিকার উপায় থাকবে না।

সামুরাতির মনে পড়লো, আরমুগানী তাকে বলেছিলো, মুসলমান তরুণীদের চরিত্রহীনতার শিকার সে নিজে। সে আরো বলেছিলো, গজনী থেকে এতো দূরে এসে মুসলমান যোদ্ধারা তোমাদের মতো মুসলিম তরুণীদের সম্ভ্রম বিক্রির কারণে শাহাদতবরণ করছে, জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে। অথচ তারা তোমাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য আত্মত্যাগ করছে। আরমুগানী তাকে আরো বলেছিলো, সামুরাতি কাউকে বিয়ে করে বন্ধু হয়ে যাও, নিজের আত্মাকে শান্তি দাও, নিজের আত্মপরিচয় উপলব্ধি করো।

আরমুগানীর কথায় সামুরাতি আত্ম-পরিচয় ফিরে পেয়েছিলো। সামুরাতির হৃদয়পটে যখন আরমুগনীর চেহারা ভেসে উঠলো, তখন তার ভেতর একটা ঝড় বয়ে গেলো। আরমুগানীর প্রতিটি কথা তার কানে ধ্বনিত হতে লাগলো। তার যখন মনে পড়লো, আরগানী হয়তো যারকার সাক্ষাৎ পেয়েছে এবং তার সাথে বসবাস করছে। সে বুকের ভেতর একটা কষ্ট অনুভব করলো । আরমুগানীই ছিলো সামুরাতির জীবনের প্রথম পুরুষ যে তার আশ্রয় ও এক প্রকার বন্দীত্বে থেকেও তার মনকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো।

সামুরাতির মধ্যে একটা দৃঢ় সংকল্প জন্ম নিলো, কিছুতেই হিন্দুদের মূর্তির জন্য সে নিজেকে বলী হতে দেবে না। সে বন্দীদশা থেকে পালানোর কথা ভাবতে লাগলো। এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি সে কখনো হয়নি। সে কোনো সৈনিক ছিলো না, ছিলো না কোনো নারীযোদ্ধা। এক অর্থে সামুরাতি ছিলো শাহজাদী। কারণ, রাজ-রাজন্যবর্গের হৃদয়রাজ্যে বিরাজ করতো সামুরাতি। বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতাবান পুরুষও তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার আবেদন করতো। ফলে ফেরার হওয়ার বিষয়টি তার জন্য ছিলো একটা সুকঠিন কাজ। তাছাড়া এই দুর্গসম মন্দির থেকে পালানোর বিষয়টি সহজ ছিলো না। কিন্তু এরপরও মনে মনে সে পালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়সংকল্প করলো।

বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে এমন সময় সামুরাতির কক্ষে প্রবেশ করলো দুই তরুণী। এদের একজনের হাতে কাপড় আর অপরজনের হাতে খাবার। তরুণী দু’জন যুবতী বটে কিন্তু সুন্দরী নয়। খাবার অবসরে সামুরাতি তরুণীদ্বয়কে জিজ্ঞেস করলো, আমরা মন্দিরের সদর দরজা থেকে কতটুকু দূরে তরুণীদ্বয় তার কথার জবাব না দিয়ে বললো, আমাদের কঠোরভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে, আপনার সাথে যেনো কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা না বলি। সামুরাতির কথার জবাব এড়িয়ে তরুণীদ্বয় তার পরিচয় জানতে চাইলো। আপনার পরিচয়

“আমি নগরকোটের নর্তকী। বড় পণ্ডিতজী মশাই এ মন্দিরে নাচ-গান করার জন্য আমাকে এনেছেন।”

“মহারাজ আপনার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।” বললো এক তরুণী।

“কোন নারীর প্রতি এতটা আগ্রহী হতে মহারাজকে আমরা কখনো দেখিনি।” বললো অপর তরুণী। তিনি তো এর আগে কোন নারীর সাথে কথাই বলতেন না। কিন্তু আপনার ব্যাপারে তিনি এভাবে কথা বলছেন, মনে হয়েছে আপনি তার মেয়ে কিংবা বোন।”

“এটা মহারাজার অনুগ্রহ।” বললো সামুরাতি। তিনি আমাকে সারা মন্দির দেখাবেন। এমনিতেই তোমাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মন্দিরের সদর গেট এখান থেকে কোন্ দিকে।”

“আপনি তো সদর দরজা দিয়েই মন্দিরে এসেছিলেন।”

তরুণীরা সামুরাতিকে সদর দরজার কথা বললেও সে কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না। তবে এটা বুঝতে পারলো, কোননা জানাশোনা লোকের পথ দেখানো ছাড়া তার পক্ষে সদর গেট পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয়। সে তরুণীদের কাছে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলো। তরুণীদ্বয় কিছু কিছুর জবাব দিলো, কোনো কোনো কথার জবাব এড়িয়ে গেলো। পণ্ডিত সম্পর্কে তরুণীরা তাকে জানায়, নারীর নাম নিতেও সে অপছন্দ করে।

এই তরুণীরা জানতো না এই নর্তকীকে বলীদানের জন্য আনা হয়েছে। তারা সামুরাতিকে গোসল করালো এবং তাদের নিয়ে আসা কাপড় পরিয়ে দিলো। কাপড়টি ছিলো শাড়ি। তরুণীদ্বয় সামুরাতির মাথায় তিলক পরিয়ে দিয়ে চলে যায়।

পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের একান্ত কক্ষে আরো দু’পণ্ডিত উপবিষ্ট। তারা জানতো, সামুরাতিকে বলীদানের জন্য আনা হয়েছে। সামুরাতিকে বলীদানের জন্য প্রস্তুত করা ছিলো তাদের কাজ। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তাদের কাজ শুরু করার। বলে রাখা ভালো, নগরকোট অঞ্চলে তখন চলছিলো ভয়ানক অভাব-অনটন। কারণ, দীর্ঘদিন থেকে এ অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছিলো না। অথচ পাহাড়ী এলাকা হওয়ার কারণে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো। অনাবৃষ্টির কারণে খাদ্যাভাবে মানুষ ও গৃহপালিত পশু মরতে শুরু করে। অতঃপর পতি রাধাকৃষ্ণের নির্দেশে এক কিশোরীকে বলীদান করা হয়। সেই তরুণীকেও এ কক্ষে রেখে বলীদানের জন্য দু’পণ্ডিতকে প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো।

আগের মেয়েটি ছিলো অল্পবয়সী বালিকা। কিন্তু এ বালিকা নয়, যুবতী। সে রাজার একান্ত নর্তকী ছিলো। আগের তরুণী ছিলো পবিত্র। কিন্তু সামুরাতিকে আগে পবিত্র করতে হবে- সহকর্মী দু’পণ্ডিতকে রাধাকৃষ্ণ বলেছিলো। একেই বলী দেয়া হবে কিন্তু তৈরি করতে বেশ সময় লাগবে। এ হচ্ছে মুসলমান। একে পূজা-অর্চনার জন্য আগে মানসিকভাবে তৈরি করতে হবে। এরপর বলী দেয়ার ব্যাপারে ভাবতে হবে।

“আপনি জানেন মহারাজ! রাজা আনন্দ পালের নেতৃত্বে আমাদের সম্মিলিত সেনাবাহিনী অভিযানে বেরিয়ে পড়েছে। বলীদান তো যুদ্ধ শুরুর আগেই করা উচিত।” বললো এক পণ্ডিত।

“রণাঙ্গনে পৌঁছতে সেনাবাহিনীর অনেক দিন লাগবে।” বললো বড় পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ। “যে পরিমাণ সেনাবাহিনী অভিযানে গেছে, তারা মাহমূদ গজনবীর সেনাদের কচুকাটা করে গজনী পর্যন্ত চলে যাবে। আর যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত পৌঁছতে সেনাদের দু’তিন মাস সময় লেগে যাবে। এর মধ্যে আমাদের বলীদান কর্মও সমাধা হয়ে যাবে। আমরা এ সময়ের মধ্যে এ নর্তকীকে বলীদানের জন্য প্রস্তুত করে ফেলবো। আশা করি নিজের পক্ষ থেকেই নর্তকী দেবীর চরণে তাকে বলীদানের জন্য অনুরোধ করতে থাকবে।”

রাধাকৃষ্ণের সহকর্মী দুই পণ্ডিত বলীদানে বিলম্বের ব্যাপারে সম্মত হচ্ছিলো না, কিন্তু প্রধান পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ মনে মনে বলীদান মূলতবী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। সহযোগী দু’পণ্ডিতের বারংবার অসম্মতিতে বড় পণ্ডিতের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হলো। সে নির্দেশের স্বরে বললো, যে যাই বলুক, এই নর্তকী বলীদানে সে কারো কথাই শুনবে না। কারণ, নর্তকী বলীদানের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ তার একার। ওকে নির্বাচনও করেছে পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ নিজে। দেব-দেবীর ইঙ্গিতে যেহেতু সে এই নর্তকীকে বলীদানের জন্য বাছাই করেছে, তাই সে-ই ভালো জানে কখন কিভাবে ওকে বলীদান করতে হবে।

সহযোগী দুই পণ্ডিত যখন ওঠে চলে গেলো, তখন চিন্তার গভীরে তলিয়ে গেলো রাধাকৃষ্ণ।

* * *

এদিকে সামুরাতির বিস্ময়ের অবধি রইলো না। টানা তিন দিন তিন রাত চলে গেলো কিন্তু একবারও বড় পণ্ডিত তার কক্ষে এলো না। সেই দুই তরুণী তার জন্য খাবার নিয়ে আসে আর তার সব প্রয়োজন পূরণ করে। সামুরাতি তাদের অনেকবার বলেছে, তারা যেনো পণ্ডিতজী মহারাজকে একবারের জন্য হলেও তার কাছে পাঠায়। কিন্তু এরপরও পণ্ডিত আসেনি। নিজের প্রাণ সংহারের জন্য সামুরাতির কোনো দুঃখ ছিলো না, কিন্তু তার মনটা ভারী হয়ে উঠলো এ জন্য যে হিন্দুরা তাকে নর্তকীতে পরিণত করেছে, তার ধর্মীয় চেতনা বিনষ্ট করে। দিয়েছে, তার সম্ভ্রম লুটেছে, শেষ পর্যন্ত হিন্দুদের বিজয়ের জন্য দেবীর পদতলে তার প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে।

সামুরাতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো, মাটি-পাথরের তৈরি মূর্তিগুলোর কোনো ক্ষমতা নেই, ওরা কিছুতেই মাবুদ হতে পারে না। জয়-পরাজয়ে মূর্তিগুলোর কোনো প্রভাব নেই। যিনি সত্য ও প্রকৃত মাবুদ, তার বিধান মতে নরবলী দান ও নিরপরাধ মানুষ হত্যা সম্পূর্ণ অন্যায়, গুনাহের কাজ। নরবলী নিতান্তই মিথ্যা ধর্মের অপরীতি।

সামুরাতির মনে পড়লো, কয়েক বছর আগে রাজা জয়পালের বিজয়ের জন্য লাহোরে এক তরুণীকে বলী দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু সেই যুদ্ধে রাজা এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলো যে, রাজধানীতে ফিরে এসে সে জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দেয়।

মৃত্যুকে সামুরাতি ভয় করছিলো না কিন্তু পৌত্তলিকদের মূর্তির জন্য মোটেও মরতে চাচ্ছিলো না। আরমুগামী সামুরাতির আত্ম-পরিচয়কে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু মন্দিরের বন্দী দশা থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো পথ তার দৃষ্টিতে পড়ছিলো না। সামুরাতি বিচলিত হচ্ছিলো এই ভেবে যে, যে কোনো সময় তাকে নিয়ে মূর্তির পদমূলে বলীদান করবে। সামুরাতি বহুবার শুনেছে মন্দিরের পণ্ডিতদের কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে না। কিন্তু তার দেখাশোনাকারী দুই তরুণী বলেছে, পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের মধ্যে কোনো চারিত্রিক ক্রটি নেই, সে প্রকৃত অর্থেই একজন সাধক পুরুষ, ঋষি। অনেকের মুখে সে আগেও শুনেছে, পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ শুধু ঋষিই নয়, সে একজন ব্রাহ্মচারী।

সামুরাতির মনে পড়লো প্রথম যে রাতে তাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো, তখন তার কাছে মনে হয়েছিলো পণ্ডিত নিজে ভোগ করার জন্য তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। সে যখন এ ধরনের ইঙ্গিত করে তখন পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ তাকে বলেছিলো, “তোমার দেহ সৌন্দর্য আমার ভালো গেলেছে বটে কিন্তু যা ভেবেছো তা ভুল। আমার জীবন নারীভোগ থেকে পবিত্র। নারীসঙ্গ নেয়া দূরে থাক, নারীকে কাছে থেকে দেখাও আমি পছন্দ করি না।”

সামুরাতির মনে পড়লো, পণ্ডিত যখন তার সাথে কথা বলছিলো, তখন পণ্ডিতের চেহারার মধ্যে একটা উদাস ভাব সে দেখতে পেয়েছে। পুরুষের মনের কথা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারে সামুরাতি। তাছাড়া নিজের রূপ-সৌন্দর্য ও ভাবভঙ্গীর জাদুময়তা সম্পর্কেও পূর্ণ সচেতন। সামুরাতির মনের মধ্যে নতুন একটা চিন্তা উঁকি দিলো। সেই সাথে পালানোর একটা পথও বের করার কথা ভাবতে লাগলো। সে মনে মনে তার প্রকট নারীত্বের জাদুময়তাকে মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ফন্দি আঁটলো। এটাই ছিলো সামুরাতির একমাত্র পুঁজি, যা দিয়ে কঠিন লোহাকেও সে মোমের মতো গলিয়ে দিতে সক্ষম।

নগরকোট মন্দিরে আসার চতুর্থ রাতের প্রথম প্রহর। পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ সামুরাতির কক্ষে এলো। সামুরাতির কক্ষে দুটি প্রদীপ জ্বলছে আর সামুরাতি সারা কক্ষ জুড়ে পায়চারি করছে। পণ্ডিত তাকে দেখে স্থবির হয়ে যায়। সে সামুরাতিকে নৃত্যের পোশাকে প্রথম দেখেছিলো, সেই পোশাক ছিলো কৃত্রিম। তখন তার কাধ, গলা, বুক ও পিঠের ঊর্ধ্বাংশ ছিলো উন্মুক্ত। তার চেহারায় ছিলো কৃত্রিম প্রলেপ আর চুল ছিলো নাচিয়ের টংয়ে সাজানো, চোখে ছিলো কাজলমাখা। সেই পোশাকে ছিলো উগ্রতা কিন্তু এখনকার পোশাক সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন সামুরাতি একান্তই অকৃত্রিম। সাজ-পোশাক ও চেহারায় কোনো কৃত্রিমতা নেই। অকৃত্রিম প্রাকৃতিক অবয়বে সামুরাতিকে এখন দেখতে পেলো পণ্ডিত। তার চেহারা ও কনুই উন্মুক্ত। এলোমেলো তার চুল আর চোখে নেই বাড়তি কাজল। অবিকল অকৃত্রিম অবয়বে সামুরাতিকে আরো বেশি মোহনীয় মনে হলো। পণ্ডিতের দৃষ্টিতে মনে হলো সামুরাতি মর্ত্যের নারী নয়, স্বর্গের অপ্সরা।

“আপনি কি আমাকে ভুলে গিয়েছিলেন মহারাজ” পণ্ডিতের কাছ ঘেঁষে বললো সামুরাতি। “লোকে বলে জীবজন্তুকে জবাই করার আগে পানি পান করাতে হয়, আপনি কি আমাকে পান করাবেন না। আমার আত্মার তৃষ্ণা মিটাবেন না? আমাকে জবাই করার আগে যদি আমার মনের তৃষ্ণা না মিটান, তাহলে এই মন্দিরে আমার আত্মা ঘুরে বেড়াবে। আমার আত্মা সর্বক্ষণ আপনাকে অস্থির করে রাখবে।”

পণ্ডিতের চোখে চোখ রেখে কথা বলছিলো সামুরাতি। তার চোখে-মুখে-চেহারায় ছিলো সেই জাদুকরী ভাষা যা সে কারো মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করতো। পণ্ডিত অনুভব করলো, তার শরীরে একটা কামোদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। সামুরাতিকে নৃত্যের পোশাকে দেখে পণ্ডিতের মনে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হতো কিন্তু অকৃত্রিম পোশাকে মাথায় তিলক পরিহিতা সামুরাতির অঙ্গভঙ্গিতে নর্তকীর নির্লজ্জতা নেই। মেয়েটিকে এখন শান্ত সৌম্য কান্তিময় পূতঃপবিত্র মনে হচ্ছিলো পণ্ডিতের কাছে। পণ্ডিত সামুরাতির কথায় উদাস মোহন্দ্র হয়ে যায়।

সামুরাতি পণ্ডিতের হাত ধরে তাকে বিছানায় বসতে অনুরোধ করে। কিন্তু পণ্ডিত বসলো না। সে কক্ষে পায়চারি করতে লাগলো। সামুরাতি নীরব দাঁড়িয়ে রইলো। পণ্ডিত দাঁড়িয়ে তাকে দেখলো এবং মাথা নীচু করে ফেললো, যেনো সামুরাতির মুখোমুখি হতে অপ্রস্তুত। কয়েক কদম পায়চারি করে দাঁড়িয়ে সামুরাতিকে কাছে ডাকে পণ্ডিত।

“আমি জানি, তুমি প্রেমের কাঙালিনী।” বললো পণ্ডিত। “আসলে তুমি স্নেহ-মম-ভালোবাসা বর্ষিতা। তোমার ভালোবাসা প্রয়োজন। স্নেহ-মমতা ও প্রেম দরকার। বাবার আদর… ভাইয়ের মেহ.. সন্তানের মমতা… অথবা তোমার চাই…”

“হ্যাঁ, আপনি কি জানেন না, তৃষিত হৃদয় কোন্ ভালোবাসা চায় আপনার কাছে কোন্ ভালোবাসা আছে?”

পণ্ডিতের চেহারার ভাব বদলে যেতে থাকে। তার চোখে আন্তরিকতা ভেসে ওঠে। সামুরাতি পণ্ডিতের কাঁধে তার বাজু রেখে নিজেকে পণ্ডিতের শরীরের সাথে এতোটাই মিশিয়ে দিলো যে সামুরাতির বুক পণ্ডিতের বুক স্পর্শ করে। সামুরাতির শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠানামা স্পষ্টই অনুভব করতে লাগলো পণ্ডিত। সামুরাতি পণ্ডিতকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে কানে কানে বললো, ‘আপনার কাছে আছে কি সেই ভালোবাসা, যে ভালোবাসার সাথে দেহের কোনো সম্পর্ক নেই, যে প্রেমে নেই কোনো পাপের গন্ধ?’

সামুরাতির তপ্ত নিঃশাস পন্ডিতের নিঃশ্বাসের সাথে মিশে তাকে মোহাচ্ছন্ন করে তুলে।

“ঘাবড়ে যাবেন না সাধু! আপনি যে নারী থেকে পালিয়ে থাকেন, সেই নারী হয় শরীর সর্ব, সে তো একটা জীবন্ত মূর্তি মাত্র। আমি কোনো মানব মূর্তি নই। দেহকে আমি ত্যাগ করেছি, আপনাকে হৃদয়ের ভালোবাসা দিচ্ছি আমি, আপনাকে আমার আত্মার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। এ আত্মা থেকে আপনার পালানোর দরকার নেই, এটাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” বললো সামুরাতি।

অবচেতন হয়ে যাচ্ছিলো পণ্ডিত। সামুরাতি দু’হাতে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিলো পণ্ডিতকে। পণ্ডিত সামুরাতির জাদুকরী দৃষ্টির অদৃশ্য শিকলে বাঁধা পড়ে না যায়।

“আমি জানি, আপনার আত্মাও তৃষ্ণার্ত। নারীর প্রেম-ভালোবাসার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। নারী অপবিত্র হতে পারে কিন্তু তার ভালোবাসা অপবিত্র নয়।”

হঠাৎ করে পণ্ডিত সামুরাতির কাঁধে হাত রেখে সামুরাতিকে বুকের বেষ্টনী থেকে দূরে ঠেলে চোখে চোখ রেখে বললো- “আমি জানি না ভালোবাসা কেমন। আমি জানি না কোন্ প্রেম-ভালোবাসার কথা তুমি বলছো। আমার কোনো মেয়ে নেই, বোন নেই। মাকে দেখেছি ছোটবেলা। বিয়েও করিনি আমি। তুমিই আমাকে ভালোবাসা বোঝাও।”

“আপনার হৃদয়ে কি কোনো ধরনের তৃষ্ণা অভাববোধ অনুভব হচ্ছে না?” বললো সামুরাতি।

“আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে যুবতী।” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো পণ্ডিত। “তুমি আমাকে আর জ্বালিও না।”

সামুরাতি গভীরভাবে পণ্ডিতের কথায় পরিবর্তন লক্ষ্য করলো, আগে পণ্ডিত কথায় কথায় আমাদের শব্দ ব্যবহার করতো কিন্তু আজ ‘আমার’ শব্দ ব্যবহার করছে।

“আমাকে জবাই করার আগে ভালোবাসার স্বাদটুকু আপনি আস্বাদন করে নিন, নয়তো আমার দেহ জবাই হয়ে যাবে বটে কিন্তু আপনার আত্মার অপমৃত্যু ঘটবে।”

পণ্ডিতের মাথা গুলিয়ে গিয়েছিলো, সে মনের মধ্যে কোনোকিছুই গোছাতে পারছিলো না। কখনো সামুরাতির দিকে তাকাতো আবার কখনো মাথা নীচু করে কক্ষে পায়চারি করছিলো।

“কবে আমাকে বলী দেবেন পণ্ডিতজী মহারাজ!” চকিতে ঘুরে দাঁড়ালো পণ্ডিত। এভাবে কথাটি বললো যেনো তার মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়েছে, “না না, এখনই নয়- তোমাকে এখনই বলী দেয়া হবে না।”

‘আজ না হয় হবে না, কিন্তু কাল তো দেয়া হবে? পণ্ডিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড় বিড় করে বললো- “কাল আসতে বহু সময় বাকী। কে জানে কাল কি হবে!”

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালো পণ্ডিত এবং দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলো। পণ্ডিতের কক্ষ ত্যাগের ভঙ্গি দেখে সামুরাতির হাসি পায়। সে পণ্ডিতের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামুরাতির কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে সরস্বতী মূর্তির সামনে হাতজোড় করে প্রণাম জানায়। সরস্বতী মূর্তি হাসছিলো। সরস্বতী মূর্তির আদলটা হাস্যোজ্জ্বল। পণ্ডিত জীবনে এই প্রথম সরস্বতী মূর্তির হাস্যোজ্জ্বল চেহারার দিকে গভীরভাবে তাকালো। তার মনে এক অস্থিরতা তোলপাড় করছে, যা সে বুঝে উঠতে পারছে না। জীবনের যতো দুঃখ-কষ্ট সবই ভজন-গুঞ্জনের ভাষায় পণ্ডিত এ সরস্বতী মূর্তির কাছে পেশ করতো। কিন্তু আজ তার কি যে হলো তা কিছুতেই ব্যক্ত করতে পারছে না।

হাস্যোজ্জ্বল সরস্বতী মূর্তির সামনে হাতজোড় করে ভজন গাইতে গাইতে মূর্তির অম্লান হাসির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললো পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ। সরস্বতী মূর্তির সামনে প্রার্থনা করে তার মনের জ্বালা দূর করার জন্য বসেছিলো পণ্ডিত কিন্তু আজ দীর্ঘক্ষণ ভজন-বন্দনা করেও মনের মধ্যে স্বস্তি পাচ্ছিলো না। মূর্তির হাস্যোজ্জ্বল চেহারা তার কাছে অপূর্ব মনে হচ্ছিলো। মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে সরস্বতির মূর্তিটাই সামুরাতির অবয়ব ধারণ করলো। মূর্তির হাসিতে বিকশিত হলো সামুরাতির অকৃত্রিম অবয়ব। মনের অজান্তেই তার কণ্ঠে গীত হতে লাগলো ভজন সংগীত।

***

১০০৮ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৩৯৯ হিজরী সনের সেপ্টেম্বর মাস। পাবনের মতো হাজার হাজার হিন্দু সৈন্য পেশোয়ারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের গতি তীব্র করা সম্ভব হচ্ছিলো না। কারণ, এ বাহিনীতে ছিলো কয়েকটি হিন্দু রাজ্যের সৈন্য। কঞ্জরের সেনাবাহিনী খিদররা এলাকায় শিবির স্থাপন করে। লাহোর থেকে যে বাহিনী যাত্রা শুরু করে, তন্মধ্যে রাজা আনন্দ পালের বাহিনী ছাড়াও উজান, গোয়ালিয়র, কনৌজের সৈন্যও ছিলো। এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে আরো নতুন সেনাদল এদের সাথে এসে শামিল হচ্ছিলো। নতুন বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য সম্মিলিত বাহিনী যাত্রাবিরতি করতো। সম্মিলিত বাহিনীর কমান্ডে ছিলো রাজা আনন্দ পালের ছেলে ব্রাক্ষ্যপালের উপর ন্যস্ত। সে সৈন্যদের জড়ো করে তারপর একসাথে অগ্রসর হতে চাচ্ছিলো।

সম্মিলিত বাহিনীর গতি মন্থর হওয়ার অপর কারণ ছিলো নদী। সৈন্যরা নদী পার হয়ে গেলেও তাদের রসদ সামগ্রীর গাড়ি পার করা ছিলো কঠিন। সম্মিলিত বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা প্রায় লাখের কোঠায় পৌঁছে। অপরদিকে সুলতান মাহমূদের কাছে তখন সৈন্য ছিলো মাত্র হাজারের কোঠায়। বিশাল হিন্দু বাহিনীর নদী পার হতে কয়েক দিন লেগে যায়। বড় নদী ছাড়া আরো ছোট ছোট নদীও তাদের গতিপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সম্মিলিত বাহিনীর গতি মন্থরতার অপর কারণ ছিলো জনগণের অতি উৎসাহ। মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোটা ভারতের মন্দিরগুলো থেকে এমন জোরদার প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, গজনী বাহিনী গোটা হিন্দুস্তান দখল করতে ধেয়ে আসছে, ওরা সব হিন্দু মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে মসজিদ বানাবে, সকল হিন্দু তরুণীকে ধরে বাদী-দাসীতে পরিণত করবে, সকল হিন্দুকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করবে। মন্দিরের এই অপপ্রচারে হিন্দুস্তান জুড়ে সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন সেনাবাহিনীকে আশীর্বাদ জানানোর জন্য, তাদের আদর-আপ্যায়ন করার জন্য জড়ো হতে থাকে। এতে সেনাদের গতিতে মাঝে-মধ্যে ছেদ পড়ছে। সাধারণ হিন্দুরা তাদের সঞ্চিত সোনাদানা, খাবার-দাবার, উট-ঘোড়া সেনাদের উপঢৌকন দেয়ার জন্য খবর শুনে আগেভাগেই পথিমধ্যে জমা করে রাখতো। যেসব হিন্দু যুবক তীর-তরবারী ও বর্শা চালাতে পারতো, অশ্বারোহণে দক্ষতা রাখতো; তারা নিজেদের ঢাল-তরবারী ও অশ্ব নিয়ে সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত হতো। মন্দিরের ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতরা ধর্মের দোহাই দিয়ে হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করছিলো।

সম্মিলিত হিন্দু বাহিনী মহা-প্লাবনের মতো অগ্রসর হচ্ছিলো। প্রতিদিনই হিন্দু বাহিনীতে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো সৈন্য সংখ্যা। সকল হিন্দু নাগরিক ও সৈন্যের মধ্যে একই শ্লোগান, একই আওয়াজ- মুসলমানদের পিষে ফেলো, ওদেরকে ভারত সাগরের ওপারে পাঠিয়ে দাও। ইসলামকে চিরদিনের জন্য হিন্দুস্তানের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দাও।

পেশোয়ারে অবস্থানরত সুলতান মাহমুদের কাছে প্রতিদিন খবর আসছিলো, হিন্দু বাহিনী কতটুকু অগ্রসর হয়েছে এবং এ পর্যন্ত ওদের বাহিনীর সংখ্যা কি পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি তার সেনাপতিদের বলে দিয়েছিলেন, শত্রুবাহিনী কিছুতেই যাতে নদী পার হতে না পারে। যুদ্ধ নদী তীরেই সংঘটিত হবে। তার সেনাপতিরা এই আশংকা প্রকাশ করেছিলো, যেহেতু শত্রুবাহিনী সংখ্যায় বিপুল, তাই পেছনে নদী রেখে মোকাবেলায় অবতীর্ণ হওয়া আত্মঘাতী হতে পারে। কারণ, প্রয়োজনে পশ্চাদপসারণের সুযোগ তখন বিপদ শংকুল হয়ে উঠবে।

সুলতান মাহমূদ তাদের বললেন, আমাদের গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে। সম্মুখ মোকাবেলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর গেরিলা যুদ্ধের জন্য নদী তীরবর্তী এলাকাই সবচেয়ে উপযুক্ত। তিনি সেনাপতিদের বলেন, পেশোয়ারের নদী তীরবর্তী এলাকা অসমতল। এখানটা গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী নয়। শত্রুবাহিনী এপাড়ে এসে গেলে সংখ্যাধিক্যের জোরে দু’চার ইউনিট সৈন্য হারিয়েও আমাদের ঘেরাও করতে সমর্থ হবে। আর ওপারে যদি ওরা আমাদের পিছু হটতে বাধ্যও করে, তবুও রিজার্ভ বাহিনী দিয়ে আমরা ওদের নদী পারাপার ঠেকিয়ে দিতে পারবো।

নিজ সেনাদের চেতনা, তাদের আবেগ, আদর্শিক দৃঢ়তা, নিজের রণ-পরিকল্পনা সর্বোপরি আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা ছিলো সুলতানের। তিনি অনেক আগেই মাঝি-মা ও মুটে-মজুরদের বেশে সিন্ধু তীরে কিছু সৈনিক মোতায়েন করে রেখেছিলেন। অপরদিকে কিছু ঝটিকা বাহিনীর সদস্য খিদররাতে মোতায়েন করেছিলেন। তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো, শত্রুবাহিনীর আনাগোনা, গমনাগমন পর্যবেক্ষণ করবে এবং এরা যদি নদী পার হতে চায় তবে নদী পারাপারের জন্য তৈরি নৌকা-পুলের রশি কেটে দেবে। সম্ভব হলে নৌকা ছিদ্র করে দেবে।

গভীর চিন্তা-ভাবনার পর সুলতান তার বাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দিলেন এবং সিন্ধুকূলে এসে পৌঁছলেন। তিনি সেনাবাহিনীকে চার অংশে ভাগ করলেন। দুই অংশকে নদীর অপর পাড় আটকের উত্তর পাশে নিযুক্ত করলেন। আর দুই অংশকে নদীর এপাড়ে পেশোয়ার তীরে রাখলেন। এ পাড়ের দুই ভাগের একভাগ ছিলো অশ্বারোহী ও তীরন্দাজ। তাদেরকে নদী রক্ষার নির্দেশ দেয়া হলো। তাদের দায়িত্ব হলো নদীর তীরবর্তী এলাকাকে শত্রুমুক্ত রাখা এবং কিছুতেই যাতে শত্রুবাহিনী কোনদিক থেকে নদী পাড় হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। আর এপাড়ের অপর অংশটি ছিলো রিজার্ভ বাহিনী। সেই সাথে নদীতে একটি নৌকা-পুলও তৈরি করা হলো।

সেনাবাহিনীর অবস্থান ঠিক করতেই সুলতানের কাছে খবর এলো, শত্রুবাহিনী তাদের অবস্থান থেকে পনের মাইল কাছে এসে গেছে। এটাই ছিলো শত্রুবাহিনীর শেষ ছাউনী। সুলতান আরো কিছু সময় চাচ্ছিলেন। তার একটু অবকাশের প্রয়োজন ছিলো। অবশ্য এ অবকাশ থেকে কোনো দিক থেকে সামরিক সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না। তখন শীতের মৌসুম শুরু হয়েছিলো। তিনি চাচ্ছিলেন যুদ্ধটা প্রচণ্ড শীতের মধ্যে টেনে নিতে। তার সেনারা প্রচণ্ড শীতেও সড়াই করতে অভ্যস্ত। কিন্তু কনৌজ ও গোয়ালিয়রের সেনাদের সম্পর্কে তিনি জানেন, ওরা অত্যধিক শীতে যুদ্ধ করতে অসুবিধা বোধ করে।

* * *

এদিকে নগরকোট মন্দিরে সামুরাতির প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। নর্তকী সামুরাতির কক্ষ ততদিনে শাহজাদীর কক্ষে পরিণত হয়েছে। পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ সামুরাতির কক্ষে এসে ঘণ্টার পর ঘন্টা গল্পগুজব করতো। পণ্ডিতের বর্তমান অবস্থা দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারত না, এই সেই পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ। রাধাকৃষ্ণের বয়স সামুরাতির বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো। পণ্ডিত সামুরাতির কক্ষে একটি পালঙ্ক নিয়ে এলো এবং এর মধ্যে গালিচা ও মখমলের বিছানা পাতার নির্দেশ দিলো। প্রদীপের পরিবর্তে সামুরাতির কক্ষে এলো রঙিন ফানুস, আর সেবিকা দুই তরুণী প্রতিদিন সকালে কক্ষ ঝাড়া-মোছা করে পুরনো ব্যবহার্য জিনিসপত্র সরিয়ে নতুন জিনিস ও নতুন ফুলের তোড়া দিয়ে যেতো।

অন্য পণ্ডিতরা ভেবেছিলো, তাদের গুরু সামুরাতিকে বলীদানের জন্য নিজেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করছে। কিন্তু পণ্ডিত সামুরাতির কক্ষে গিয়ে ভুলেই যেতো বলীদানের জন্য প্রস্তুত করার কথা। কিন্তু সামুরাতি কখনো বিস্মৃত হয়নি যে তাকে বলী দেয়া হবে। সে জানতো তাকে বলীদানের জন্যই প্রস্তুত করা হচ্ছে।

এতোদিন কখনো ভুলেও পণ্ডিত সামুরাতিকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু যে পণ্ডিতকে কেউ কোনদিন হাসতে দেখেনি, এখন সে এ কারণে ও কারণে রীতিমতো হাসে। সামুরাতির কোনো কোনো কথায় সে সশব্দে হেসে ওঠে। ইতিমধ্যে সামুরাতি তাকে কয়েকবার বলেছে, তাকে যেনো শীঘ্রই বলী দিয়ে দেয়। কারণ, মৃত্যুর অপেক্ষা খুব কষ্টকর। সামুরাতির মুখে এ কথা শুনলে পণ্ডিতের চেহারা বিমর্ষ হয়ে যায়।

যে পণ্ডিত ভাবতো নারীর সংসর্গ ত্যাগ করে সে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে নিয়েছে, সেই পণ্ডিত এখন দেবতাদের অসন্তুষ্ট করে সামুরাতিকে খুশি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নারী বঞ্চিত রেখে নিজের মধ্যে পণ্ডিত যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছিলো, সেই শূন্যতা সামুরাতির মাধ্যমে পূর্ণতা পাচ্ছিলো। পিপাসার্ত মানুষ পানি দেখলে যেমন তৃষ্ণার কষ্ট আরো বেশি অনুভব করে, তেমনি পণ্ডিত সামুরাতির সান্নিধ্যে নিজের শূন্যতা আরো বেশি অনুভব করতে লাগলো। সে সামুরাতিকে কখনো নিজের কন্যা রূপে, কখনো বোনের অবয়বে, কখনো নিজের মায়ের কাপে অনুভব করতে লাগলো। এই মন্দিরে সামুরাতির চেয়ে আরো সুন্দরী তরুণীও এসেছে কিন্তু পণ্ডিত কখনো ওদের সাথে কথা বলার প্রয়োজনও অনুভব করেনি। দৈবক্রমে ওদের দিকে কখনো দৃষ্টি পড়ে গেলে সাথে সাথে সে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতো। সামুরাতিই ছিলো প্রথম নারী যার সাথে পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ কথা বলেছে এবং নিজের অজান্তেই সামুরাতি তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। সামুরাতির সেই স্পর্শ ও আলিঙ্গন পণ্ডিতের মধ্যে সেই অনুভূতি সৃষ্টি করে, যে অনুভূতির দ্বারা মানুষ নিজেকে অনুধাবন করতে পারে।

“তোমার আত্মা কি এখনো সেই শূন্যতা অনুভব করে যে ভালোবাসা পূরণের অনুরোধ তুমি আমাকে করেছিলো সামুরাতিকে জিজ্ঞেস করলো পণ্ডিত।

“সম্ভবত আপমিই প্রথম পুরুষ যে এততদিন আমাকে নিজের আয়ত্তে রেখেও এভাবে রেখেছেন যেনো আমি আপনার কজায় থেকেও আপনার আয়ত্তের বাইরে।” বললো সামুরাতি। “আমার শরীরের প্রতি আপনার কোনো আকর্ষণ নেই। এতেই আমার আত্মা শান্তি পেয়েছে।… আচ্ছা, এখন কি দেবতার চরণে বলী হওয়ার যোগ্য আমি হতে পেরেছি।”

“না, এখনও সেই সময় আসেনি।” উদাস কণ্ঠে বললে পণ্ডিত।

পণ্ডিত গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামুরাতির দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে পণ্ডিতের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু পরতে শুরু করলো। সামুরাতি আগ বেড়ে পণ্ডিতের মাথা তার বুকে চেপে ধরলো। শাড়ির আঁচলে পণ্ডিতের চোখের পানি মুছে দিলো। তার ঝুঁকে থাকা মাথার এলোমেলো চুলগুলো পণ্ডিতের নাকে-মুর্থে ছড়িয়ে পড়লো। পণ্ডিতের একটি হাত কাঁপতে কাঁপতে উপরের দিকে উঠে এলো। সামুরাতির গাল পণ্ডিতের মাথা স্পর্শ করছিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে পণ্ডিত সামুরাতির রেশমী কোমল ফুল স্পর্শ করলো। কয়েকটি চুল নিজের চোখের উপর ছড়িয়ে দিলো পণ্ডিত।

হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় পণ্ডিত। ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে গেলো সামুরাতি। উঠে চোখ বড় বড় করে পণ্ডিত সামুরাতিকে দেখতে লাগলো। যেনো তার আত্ম-পরিচয়কে জাগিয়ে দিয়েছে কেউ। যেনো কোনো অশরীরী আত্মা এসে তার হাতকে নারীর চুলে স্পর্শ করিয়েছে।

মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি বাজতে লাগলো। সমূর্তিতে ফিরে এলো পণ্ডিত। কোনো রাজা-মহারাজা মন্দিরে এলেই কেবল এই ঘণ্টা ধ্বনিত হয়। পণ্ডিত নিজে মন্দিরের সদর দরজায় গিয়ে আগন্তুক রাজা-মহারাজাকে অভ্যর্থনা জানায়। সামুরাতির দিকে গভীর মমতার দৃষ্টি মেলে পণ্ডিত বললো, “হয়তো কোনো মেহমান এসেছে, আমি আসছি।”

বিশেষ ঘণ্টা ধ্বনি অমূলক ছিলো না। রাজা আনন্দ পালের স্ত্রী এলো নগরকোট মন্দিরে। এই স্ত্রী হলো আনন্দ পালের অপর পুত্র ব্রাহ্মপালের মা। আনন্দ পাল সম্মিলিত বাহিনীর সাথে থাকলেও গোটা বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড ছিলো ব্রাহ্মপালের হাতে। রাজা আনন্দ পাল তার এই স্ত্রীকে বলেছিলো, রাজমহলের সবচেয়ে সুন্দরী ও অভিজ্ঞ নর্তকীকে নগরকোটের পণ্ডিত বলীদানের জন্য রেখে দিয়েছে। রাজা আরো বলেছে, এবার ব্রাহ্মপালের নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনী বিজয়ী হবেই হবে।

এর আগে আনন্দ পালের অপর স্ত্রী শুকপালের মা এই ভেবে ছেলেকে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়েছিলো যে, শুকপাল বিদ্রোহ করে বেরায় সুলতান মাহমূদকে বন্দী করতে পারবে। আর শুকপাল হবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। কিন্তু পরিণতিতে শুকপাল নিজেই বন্দী হলো আর সুলতান তাকে আজীবনের জন্য বন্দী করে জেলখানায় আটকে রাখলো।

এখন আনন্দ পালের দ্বিতীয় স্ত্রী ভাবলো, তার ছেলে পেশোয়ার জয় করে গজনী পদানত করবে এবং বাপের সিংহাসনের উত্তাধিকারী হবে। সে পুত্রের বিজয়ের জন্য উন্মুখ ছিলো। তাই নগরকোটে নর্তকীর বলীদান পর্ব সমাধান হয়েছে কিনা তা জানার জন্য রাণী এখানে এসেছে।

বড় পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ রাজা আনন্দ পালের স্ত্রীকে জানায়, মুসলমান ঘরের মেয়ে এবং নর্তকী হওয়ার কারণে মেয়েটিকে পবিত্র করে বলীদানের উপযোগী করতে অনেক সময় লেগে গেছে।

ব্রাহ্মপালের মা বললো, “এর আগেও এক কুমারী মেয়েকে বলী দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাকে প্রস্তুত করতে এতো সময় লাগেনি!” সে পণ্ডিতকে তাকিদ করলো, শীঘ্রই যেনো বলীদান কাজ সেরে ফেলা হয়। কারণ, আমাদের সৈন্যরা রণাঙ্গনের একেবারে কাছে চলে গেছে অথচ সে জানতে পেরেছে, নর্তকীকে নাকি এখনো মা গঙ্গার জলে স্নান করানো হয়নি।

পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণের মর্যাদা ছিলো রাজা-মহারাজাদের চেয়েও বেশি। হিন্দুস্তানে তাকে ভগবানের বিশেষ দূত মনে করা হতো। কিন্তু আনন্দ পালের স্ত্রীর আশংকা ও উমায় পণ্ডিতের আভিজাত্য ও অহংবোধে আঘাত হানে। রাণী আরো বললো, নর্তকী সামুরাতি এতোটাই সুন্দরী যে ওকে কেউ দেখলে আর চোখ ফেরাতে পারে না। জানি না, ওর এই জাদুময়তা নগরকোট মন্দিরেও প্রভাব সৃষ্টি করেছে কিনা। আমার সন্দেহ হচ্ছে, নর্তকীর জাদু এখানেও প্রভাব বিস্তার করেছে। নর্তকীর বলীদান কর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি মন্দিরেই অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ এ কথার পরও আনন্দ পালের স্ত্রীকে কিছুই বললো না। কারণ, তার সন্দেহ অমূলক ছিলো না। পণ্ডিত আনন্দ পালের স্ত্রীকে জানালো, “এই একটি কাজই বাকি রয়েছে, এ কাজ আগামীকাল সকালেই সমাধা হবে। তার পরদিন নর্তকীর বলীদান কর্ম সেরে ফেলা হবে।”

রাজা আনন্দ পালের স্ত্রী এ কথার পর শাহী মেহমানখানায় চলে যায়। পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ আবার ফিরে আসে সামুরাতির কক্ষে। সামুরাতি স্মিত হেসে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। পণ্ডিতের চেহারা ছিলো উদ্বিগ্ন। সে নিষ্পলক সামুরাতির দিকে তাকিয়ে রইলো। সামুরাতি তার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ জিজ্ঞেস করলে পণ্ডিত জানালো, “সে আগামীকাল ভোরে আসবে এবং তাকে নিয়ে গঙ্গা তীরে যাবে।” এ কথা বলেই কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো পণ্ডিত।

***

এদিকে শুয়াইব আরমুগনীর কাফেলা সামুরাতির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। দুটি উট ও তিনটি ঘোড়ার ছোট কাফেলা। একটি উটে এক যুবতী আর অপর উটে এক অর্ধবয়স্কা মহিলা আরোহী। আর তিনটি ঘোড়ায় তিনজন পুরুষ। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হবে এরা তীর্থযাত্রী, একটি কুকুরও এই কাফেলার সহযাত্রী। সেই যুগে দূর ভ্রমণযাত্রী কাফেলার সাথে প্রশিক্ষিত কুকুর নেয়া হতো নিরাপত্তার সহায়ক হিসেবে। লাহোর থেকে রওয়ানা হয়ে নগরকোটের দিকে যাচ্ছে কাফেলা। রাস্তায় তাদের কেউ জিজ্ঞেস করলে তারা জানিয়েছে, পূজাপাঠের জন্য তারা নগরকোট মন্দিরে যাচ্ছে। টানা তিন দিন চলার পর আরমুগানীর ছদ্মবেশী এই কাফেলা নগরকোট মন্দিরের কাছে চলে আসে। নগরকোট মন্দিরের নিকটবর্তী হয়ে তারা লোকজনকে বলে, তারা মহাঋষি রাধাকৃষ্ণের দর্শনের জন্য, তার পদধূলি নেয়ার জন্য নগরকোট এসেছে। কারণ, নগরকোটের আশপাশের লোকরা পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণকে অবতার বলেই মনে করে।

নগরকোটের অনতিদূরে আরমুগানীর কাফেলা শেষ রাত যাপনের জন্য যাত্রাবিরতি করে। রাতের বেলা আগুন জ্বালিয়ে আগুনের চারপাশে বসে কাফেলার একজন বললো, “আমরা যদি মন্দিরে প্রবেশ করতে পারি আর আমাদের কেউ সন্দেহ না করে, তাহলে মন্দিরের কোথায় কি আছে তা জানা সম্ভব হবে। যদি জানতে পারি, সামুরাতিকে বলী দেয়া হয়ে গেছে, তাহলে আমি নগরকোটের সব পণ্ডিতকে হত্যা করে ক্ষ্যান্ত হবো।”

এই দৃঢ়তা ও প্রতিজ্ঞা আর কারো নয়, শুয়াইব আরমুগানীর। কারণ, মন্দিরের আচার অনুষ্ঠান সে জানতো। লাহোর থেকে আমরা দুজন সহকর্মীকেও সে সাথে করে নিয়ে আসে। যারকা আগেই সামুরাতির বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলো। সামুরাতির পরিচারিকা তো পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিলো। আরমুগানী ও তার দু’সহকর্মী মাথা ন্যাড়া করে হিন্দু পুরোহিতদের মতো মাথায় তিলক পরেছিলো। গোঁফ পরিষ্কার করে এমন কৃত্রিম গোঁফ মুখে লাগিয়ে নিয়েছিলো যে, তাদের ঠোঁট দেখাই যাচ্ছিলো না। পরিচারিকা ও যারকাকেও হিন্দু সন্ন্যাসীদের মতো পোশাকে সজ্জিত করা হয়েছিলো। মহিলা দু’জন শরীরে লম্বা দানাওয়ালা দস্তানা ঝুলিয়ে দিলো।

উট ও ঘোড়ার ব্যবস্থা শুয়াইব আরমুগানীর সহকর্মীরা করেছিলো। কুকুর সাথে নেয়ার বায়না ধরেছিলো পরিচারিকা। কারণ, ওখানে গেলে সামুরাতির অতি যত্নে পোষা কুকুরের দেখাশোনা করার কেউ ছিলো না। সামুরাতি এই কুকুরকে খুবই যত্ন করতো। অবসরে কুকুরের সাথে খেলা করতে সামুরাতি আর রাতের বেলা তার বাড়ি পাহারা দিতো এই দুর্ধর্ষ কুকুর। অবশ্য পথে এমন একটি কুকুর সাথে রাখার প্রয়োজনও ছিলো।

শেষ মঞ্জিলে রাত যাপনের অবসরে তারা সামুরাতিকে উদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছিলো। তারা এটাই ভাবলো, এ ধরনের অপারেশন শেষ করে জীবন নিয়ে ফিরে আসা খুবই কঠিন। যারকা ও বৃদ্ধা পরিচারিকা দায়িত্ব নিলো, সামুরাতি যদি জীবিত থেকে থাকে তবে তারা তাকে উদ্ধার করবেই করবে।

বিশাল মন্দিরে ছিলো প্রায় কুড়িটি বড় বড় কক্ষ। ছিলো ছোট ছোট আরো বহু খিলান। তা ছাড়াও রয়েছে বিশালাকার পাতাল সুড়ং। সুড়ঙের সিঁড়িগুলো অন্ধকার। সামুরাতিকে এসব অন্ধ গলি থেকে বের করে আনার ব্যাপারটি জীবন বাজি রাখারই নামান্তর। বৃদ্ধা পরিচারিকা মন্দিরের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে তাদের অবহিত করলো। তাছাড়া সবচেয়ে বেশি আশংকার কারণ ছিলো, মন্দিরের চারপাশ ঘিরে রাখা দুৰ্গসম সেনা ছাউনী।

আরমুগানী ও আরমুগানীর দু’সহযোগী খঞ্জর ও ছোট তরবারী তাদের পরিধেয় কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলো। রাতের শেষ প্রহরে তাদের এই ছোট্ট কাফেলা মন্দিরের দিকে রওয়ানা হলো। বৃদ্ধা পরিচারিকা কাফেলাকে পথ দেখাচ্ছে। রাতের অন্ধকার থাকতেই তারা মন্দিরের প্রধান ফটকে পৌঁছে যেতে চায়।

এই রাতটিই ছিলো সেই রাত, যে রাতে পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণ সামুরাতিকে বলেছিলো, খুব ভোরে এসে গঙ্গাস্নান করানোর জন্য তাকে গঙ্গাতীরে নিয়ে যাবে। খুব ভোরে পণ্ডিত যখন সামুরাতির কক্ষে উপস্থিত হলো, সামুরাতি তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পণ্ডিত তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললো। বললো, তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে। সামুরাতি নীরবে পণ্ডিতের সাথে রওয়ানা হলো। মন্দির থেকে বের হলে তাদের জন্য দুর্গের প্রধান ফটক খুলে দেয়া হলো। দুর্গের বাইরে এসে তারা পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নীচে নামতে শুরু করলো। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে ওঠানামা পণ্ডিতের জন্য কোনো মুশকিলের ব্যাপার ছিলো না। কারণ, তার এ পথ খুবই চেনা। কিন্তু সামুরাতির জন্য নীচে নামা ছিলো কঠিন। কারণ, ঘোড়াগাড়িতে যাতায়াত করে সে অভ্যস্ত। তার পক্ষে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের নীচে নামার ঘটনা কখনো ঘটেনি। তাছাড়া তাকে যে চপ্পল দেয়া হয়েছিলো, তা পায়ে দিয়ে হাঁটা তার জন্য ছিলো আরো মুশকিল। পাহাড় থেকে নীচে নামার সময় বারবার সামুরাতির পা পিচলে যাচ্ছিলো। পণ্ডিত তাকে ধরে সহযোগিতা করছিলো, যার ফলে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছিলো সামুরাতি। পণ্ডিতকে এক হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছিলো সামুরাতি। পণ্ডিতও নিজেকে সামলানোর জন্য একহাতে সামুরাতিকে ঝাঁপটে রাখলো। তারপরও যখন বারবার সামুরাতি হোঁচট খাচ্ছিলো, তখন পণ্ডিত অনেকটা সামুরাতিকে তার কাঁধেই আগলে নিয়ে নীচে নামতে শুরু করলো। মওসুম ছিলো শীতের। সামুরাতি ছোট হয়ে পণ্ডিতের শরীরের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখে।

অনেক কষ্টে তারা পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নীচে নেমে নদী তীরের দিকে রওয়ানা হয়। মন্দির নদীতীর থেকে বেশ দূরে। উপরের পাহাড় চূড়ায় মন্দির আর নীচের নদী তীরবর্তী এলাকা জঙ্গলাকীর্ণ। পণ্ডিত সামুরাতিকে তার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করেনি। পরস্পর জড়াজড়ি করেই তারা নদীর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। তখনো পূবাকাশে ভোরের লালিমা দেখা দিতে অনেক দেরী। ভোর হতেই লোজন গঙ্গাতীরে আসতে শুরু করবে। এ জন্য পণ্ডিত অন্ধকার থাকতেই সামুরাতিকে নিয়ে গঙ্গাতীরের দিকে ছুটলো। যাতে অন্ধকারে মাসুরাতিকে সে লুকিয়ে রাখতে পারে।

“আপনি কি আমাকে শেষ গোসল দেয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন জানতে চাইলো সামুরাতি।

পণ্ডিত তার হাতের বন্ধনে সামুরাতিকে আরো বেশি করে নিজের শরীরের সাথে লেপ্টে নেয়ার চেষ্টা ছাড়া কোনো জবাব দেয় না। মনে হচ্ছিলো, পণ্ডিত বুঝি তাকে নিজের শরীরের সাথে পিষে ফেলবে।

“আপনি কথা বলছেন না কেন? আমাকে আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আমাকে আজই যদি মরতে হয় তাহলে বলেই দিন না?”

“হ্যাঁ, সবই বলবো সামুরাতি।” দু’হাতে বুকের সাথে সামুরাতিকে চেপে ধরে বললো পণ্ডিত। “আমার মন বলছে শুধু তুমি একা নও, আমরা উভয়েই বলী হয়ে যাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে, আমার হয়তো আজকের সূর্য আর দেখা হবে না।” আওয়াজ জড়িয়ে এলো পণ্ডিতের। জড়ানো কণ্ঠে বললো, “হয়তো এটাই জীবনের শেষ সময়। আমাকে পিপাসা নিয়ে মরতে দিও না। আমি ভেবেছিলাম, আমার হৃদয়ের আবেগ-ভালোবাসা মরে গেছে। কিন্তু না, আমার হৃদয়ের আবেগ মরেনি। আমি তোমার মধ্যে মমতাময়ী নারীর ছবি আঁকতে চেয়েছি তোমাকে মেয়েরূপে, বোনরূপে, মায়ের অবয়বে চিত্রিত করতে চেয়েছি। দেবীর চরিত্রও তামার মধ্যে আমি চিত্রিত করতে চেয়েছি। কিন্তু কোনোটিই স্থিতি পায়নি। আমি তোমার মধ্যে দেবীর হাসিও দেখেছি কিন্তু তবুও আমার পাপীমনকে বোঝাতে পারিনি। আমি বুঝতে পারি না, এমন কেনো হলো। নারীর সঙ্গ থেকে আমি পালাতে বহু চেষ্টা করেছি কিন্তু…।”

“আপনি পাথরের মূর্তির পূজা করেন। আমার আল্লাহর ইবাদত করুন, দেখবেন মন থেকে সব পাপ দূর হয়ে যাবে।”বললো সামুরাতি।

“আমাকে আর কথার প্যাঁচে জড়িও না নর্তকী। আমি তোমাকে হৃদয়ের প্রেম দিয়েছি। এর বিনিময়ে তুমি আমাকে দেহের উষ্ণতা দিয়ে তৃপ্ত করে। আজ হয়তো তোমার জীবনের শেষ দিন। এরপর তোমার দেহকে জ্বালিয়ে দেয়া হবে কিন্তু আমি তো বেঁচে থেকেও জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে ভস্ম হচ্ছি।”

সামুরাতি হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো এবং নিজেকে হঠাৎ করে পণ্ডিতের বাহবন্ধন থেকে দূরে সরিয়ে নিলো। “শোনো! তোমার কৃষ্ণদেবী যদি সত্য হতো, তাহলে তোমার পঞ্চাশ বছরের প্রার্থনাকে এভাবে পাপে ভেসে যেতে দিতো না। আমি স্বাধীন। আমি জানতাম, তুমিও কোনো একদিন ওদের মতোই আমাকে চাইবে পাপীষ্ঠ পুরুষগুলো আমাকে যেভাবে পেতে চায়। আমি এ জন্যই তোমার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সেই পাশবিকতাকে উস্কে দিয়েছি, যেন তুমি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আমার পায়ে এসে পড়ো। আমি তোমাকে ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো আমার পিছু পিছু মন্দিরের বাইরে নিয়ে আসবে এবং তোমার বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে যাবো।…, হ্যাঁ, আমি এখন স্বাধীন, আমি এখন মুক্ত।”

সামুরাতি হঠাৎ করে একদিকে দৌড়াতে লাগলো। কিন্তু অসমতল জমিনে সে বেশি দূর এগুতে পারলো না। পণ্ডিত দৌড়ে ওকে ধরে ফেললো এবং বললো, “পাগলামী করো না নর্তকী। আমার কাছ থেকে পালিয়ে তুমি কোথায় যাবে? আমি ঠিকই তোমাকে ধরিয়ে আনবো এবং বলী দিয়ে দেবো। আমি তো তোমার কাছে তেমন দামী জিনিস চাচ্ছি না।”

সামুরাতি গায়ের সব শক্তি দিয়ে পণ্ডিতের গালে থাপ্পর মেরে বললো, “আমি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাবো কিন্তু তোমার মূর্তির জন্য মরতে পারবো না।”

“তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না নর্তকী। মূর্তির অপমান করো না।”

“আমার আল্লাহ আমাকে বাঁচাবে। আমার আল্লাহ যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তোমাদের একটা মূর্তিও অটুট থাকবে না।”

পণ্ডিতের ভেতরকার পৌরুষরূপী পশুটা ক্ষুধার্ত বাঘের মতো বেপরোয়া হয়ে উঠলো। যে প্রবৃত্তিকে হিমালয়ের পাদদেশে হত্যা করে এসেছিলো বলে মনে করেছিলো, পণ্ডিতকে তা আজ মাংসখেকো হিংস্র শৃগালে পরিণত করলো।

হঠাৎ অনতিদূরে একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা যায়। দেখতে দেখতে কুকুরের ডাক নিকটবর্তী হতে থাকে।

যে সময় উপরের পাহাড় থেকে নীচে নেমে পণ্ডিত সামুরাতিকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো, ঠিক সে সময় শুয়াইব আরমুগনীর ছোট কাফেলা মন্দিরে যাওয়ার জন্য পাহাড়ী পথের শুরুটায় এসে পৌঁছে। সামুরাতির পরিচারিকা এই পথ ভালোভাবেই চেনে। এখানেই উট ও ঘোড়া তাদের ছেড়ে দিতে হবে। সামুরাতির কুকুরটি ছিলো বন্ধনমুক্ত। কুকুর হঠাৎ জমিন কে দু’পায়ে মাটি আচড়াতে থাকে এবং ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে শুরু করে। সেই সাথে ওই পথেই কুকুরটি দৌড়াতে লাগলো যে পথে পণ্ডিত সামুরাতিকে নিয়ে গঙ্গাতীরের দিকে গিয়েছিলো। কাফেলার কেউ এদিকে তেমন খেয়াল করেনি। কারণ, কুকুর এমনটা করেই থাকে। কিন্তু কুকুর উচ্চ আওয়াজে ঘেউ ঘেউ করে সামনের দিকে দৌড়াতে থাকে। সামুরাতির সেবিকা বললো, মনে হয় কুকুর কোনো শিয়াল বা বনবিড়ালের গন্ধ পেয়েছে। তাদের কারো পক্ষে ঘুণাক্ষরেও ভাবার অবকাশ ছিলো না, কুকুর তার মালিকের গন্ধ পেয়ে দৌড়াচ্ছে। মাসাধিক সময় ধরে সামুরাতির সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন। কুকুরটি সামুরাতির এতোটাই প্রিয় ছিলো যে, শিশুর মতো সে কুকুরের সাথে খেলা করতো। কুকুর বিছানায় ওঠে সামুরাতির সঙ্গ দিতো।

পণ্ডিত কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দের কোনো পরোয়া করলো না। সে সামুরাতিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ঝাঁপটে ধরে। সামুরাতি পণ্ডিতের পাঞ্জা থেকে মুক্ত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এ সময় কুকুরটি এসে সামুরাতির মুখের কাছে মুখ নিয়ে ওঁকে। সামুরাতি ভাবলো, এটি হয়তো কোনো নেকড়ে নয়তো মন্দিরের কোনো কুকুর হবে। কুকুরটি যে তারই পোষ তা সামুরাতির কল্পনার অতীত ছিলো। কুকুর ওর মুখে মুখ ঘষতে এবং ওর গা চাটতে শুরু করলো। সামুরাতির কেন যেনো সন্দেহ হলো, এটি তো তার শিরির মতোই মনে হচ্ছে। হঠাৎ মনের অজান্তেই সামুরাতির মুখ থেকে বেরিয়ে এলো- “শিরি, ছিঁড়ে ফেলো।”

সামুরাতির নির্দেশ মাত্রই কুকুর সামনের দুটি পা ছড়িয়ে দিয়ে পণ্ডিতের উপর হামলে পড়লো এবং পণ্ডিতের এক কাঁধের গোশত কামড়ে ছিঁড়ে ফেললো। কুকুর পণ্ডিতকে কামড়ে ধরে হেঁচড়াতে শুরু করলে পণ্ডিত বিকট শব্দে চিৎকার দিতে থাকে। এ সুযোগে সামুরাতি উঠে দাঁড়ায়। আর কুকুর পণ্ডিতের এক রান কামড়ে ধরে। পণ্ডিত মরণ চিৎকার দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। এবার কুকুর তার রানের গোত ছিঁড়ে নিয়ে এক পা কামড়ে ধরে। সামুরাতি তখন চিৎকার করে বললো, আমি তোকে বলেছিলাম না পণ্ডিত! আমার আল্লাহ আমাকে বাঁচাবে। এটি আমার পালিত কুকুর। লাহের থেকে আমার গন্ধ এঁকে এঁকে দৌড়ে আমাকে বাঁচাতে এসেছে।

সামুরাতি কুকুর শিরিকে ঝাঁপটে ধরলো। সে ভাবতেই পারছে না তার কুকুর কী করে এখানে আসলো। দীর্ঘদিন পর মালিককে পেয়ে সামুরাতির পায়ে লুটোপুটি খেতে শুরু করলো। এদিকে পণ্ডিত প্রচণ্ড আঘাত নিয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য পালাতে লাগলো। এমন সময় সামুরাতির কানে ভেসে আসে কারো পায়ের আওয়াজ। ভয়ে কেঁপে উঠে সামুরাতি। ভাবে, পণ্ডিতের আর্তনাদ শুনে হয়তো মন্দিরের সেনারা সাহায্যের জন্য আসছে। সামুরাতি কোথাও লুকানোর চেষ্টা করে। ঠিক এমন সময় এক নারীকণ্ঠ শোনা যায়, শিরি শিরি। কুকুর শিরিকে সামুরাতির বৃদ্ধা সেবিকা ডাকছে। এদিকে পণ্ডিতের আর্তনাদ এতোটাই বিকট ছিলো যে, সামুরাতির মনে হলো পণ্ডিত মরণ আর্তনাদ করছে। আরমুগানী ও তার সঙ্গীরা পণ্ডিতের আর্তনাদের পাশাপাশি কুকুরের গোঙানীর আওয়াজও শুনতে পাচ্ছিলো। এ সময় আরমূগানীর মনে পড়লো, এই কুকুর তাকেও একদিন হামলা করে আহত করেছিলো।

তারা সবাই কুকুরকে ধরার জন্য এদিকে দৌড়ে এলে আলো-আঁধারীর মধ্যে সামুরাতি সুকাতে চেষ্টা করছিলো। কিন্তু লুকানোর মতো যুৎসই জায়গা পাচ্ছিলো না সামুরাতি। দৌড়-ঝাপের মধ্যে গলার আওয়াজ শুনে যখন আগন্তুকদের কণ্ঠ আরমুগানী ও তার সেবিকার কণ্ঠের মতো মনে হলো তখন ভাবনায় পড়লো, সে কোনো স্বপ্ন দেখছে না তো? না, আর লুকানোর চেষ্টা করলো না সামুরাতি। সামুরাতি তাদের মুখোমুখি হয়ে বললো, কিভাবে এখানে নীত হয়েছে। অতি সংক্ষেপে আরমুগনীও সামুরাতিকে জানালে তারা কি করে এ পর্যন্ত এসেছে। অকুস্থলে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যুকিপূর্ণ ভেবে তারা সবাই যে জায়গায় উট ও ঘোড়া বেঁধে রেখেছিলো, সেখানে ফিরে এলো। যারকা ও সামুরাতিকে একটি উটের পিঠে, সেবিকাকে আরেকটি উটের উপর সওয়ার করিয়ে অন্যরা ঘোড়ায় চড়ে বসলো। খুব দ্রুতগতিতে স্থান ত্যাগ করে অগ্রসর হতে লাগলো আরমুগানীর কাফেলা। তাদের ফেরার গন্তব্য এখন লাহোর নয়, বেরা। লাহোর এখন আর তাদের কারো জন্যই নিরাপদ নয়।

পরিচিত পথ ছেড়ে বিজন জঙ্গল ও অচেনা পথ ধরে তারা অগ্রসর হতে লাগলো। তাদের পশ্চাদ্ধাবনের আশংকা ছিলো। আরমুগানী ভেবেছিলো, পণ্ডিত মন্দিরে গিয়ে বলবে, সামুরাতি পালিয়ে গেছে। সামুরাতির পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে পাহাড়ের সেনা ছাউনী থেকে সেনারা ঘোড়া নিয়ে নীচে অবতরণ করবে এবং সামুরাতির খোঁজে বের হবে। ইত্যবসরে তাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

আরমুগানীর আশংকা সঠিক ছিলো না। কেউ তাদের খোঁজে পশ্চাদ্ধাবন করেনি। সামুরাতির কুকুর পণ্ডিতের কাঁধ ও রানের গোশত্ ছিঁড়ে নিয়ে পাজরের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছিলো। ক্ষতস্থান থেকে অস্বাভাবিক রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিলো। পণ্ডিত অব্যাহত চিৎকার করলেও কেউ না কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য অবশ্যই আসতো। কারণ, এই আঘাতে তাৎক্ষণিকভাবে পণ্ডিতের মৃত্যু হওয়ার আশংকা ছিলো না। কিন্তু তাৎক্ষণিক দু’চারটি আর্ত-চিৎকার দিয়ে পণ্ডিত আর কোনো শব্দ করেনি। সে কাউকে তার সাহায্যের জন্যও ডাকেনি। এছাড়া পরনের কাপড় ছিঁড়ে ক্ষতস্থানে বেঁধে রক্ত বন্ধ করার জন্যও সে কোনো চেষ্টা করেনি। পাহাড়ের উপরে যাওয়ার পরিবর্তে পণ্ডিত অনতিদূরের সমতল ভূমির লোকালয়ের দিকেও নিজেকে বাঁচানোর জন্য অগ্রসর হয়নি।

কোথাও গেলো না পণ্ডিত। বাঁচার কোনো চেষ্টাই করলো না। কাষ্ঠ হাসি হেসে মনে মনে বললো, হয়েছে, খুব হয়েছে। এমনটাই হওয়া উচিত ছিলো। উচিত শিক্ষা হয়েছে…। পণ্ডিত নিজের নিস্তেজ ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে টেনে-হেঁচড়ে গঙ্গার তীরের দিকে চললো এবং বলতে লাগলো, “গঙ্গা মাও আমার এই পাপরাশি ধুতে পারবে না, কোনো আগুনও হয়তো আমার পাপ জ্বালাতে পারবে না। মন যখন পাপী হয়ে যায়, তখন শরীর পাপে ডুবে যেতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। আহ্! খুব তেষ্টা পেয়েছে ভগবান…!” পণ্ডিতের মাথা চক্কর দিতে শুরু করলো। কয়েকবার চক্কর খেয়ে পড়ে গেলো পণ্ডিত। শরীরের সব রক্ত ঝরে পড়েছে। এভাবে হোঁচট খেতে খেতে গঙ্গার পানির দিকে এগুতে থাকলো। এক পর্যায়ে পণ্ডিত ক্ষীণ আওয়াজে স্বগতোক্তি করলো, “আর একটু শক্তি দাও ভগবান, আমাকে গঙ্গা মার কোলে যেতে দাও!”

পণ্ডিতের প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছিলো। সে চক্কর খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। আবার কোনো মতে মাথা তুলে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো। এভাবে সামনে এগুচ্ছিলো। গঙ্গার পানির স্রোত ও ঢেউয়ের শব্দ তার কানে ভেসে আসছিলো। গঙ্গার শব্দ শুনে আরো তাড়াতাড়ি পৌঁছার জন্য অবশিষ্ট সব শক্তি দিয়ে গড়াতে লাগলো পণ্ডিত। এমন সময় তার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো সামুরাতির কথা “আমাকে আমার আল্লাহ বাঁচাবে, তোমাদের এসব মূর্তি সব ধ্বংস হয়ে যাবে।” তখন নিজের স্বগতোক্তিও মনে পড়লো তার- “নারী মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা হতে পারে, এছাড়া নারীকে অন্য কোনো রূপে রূপায়িত করে কাছে টানলে জ্বলে যেতে হবে। পরিণতি খুবই খারাপ হবে।” গোটা মন্দিরে এই নীতিই প্রতিষ্ঠা করেছিলো পণ্ডিত। কিন্তু নিজের নীতিতেই সে অটল থাকতে পারেনি। নিজেই। সেই পাপে জড়িয়ে পড়েছিলো। সামুরাতিকে সে সেই রূপই দিয়েছিলো, যা না ছিলো মা-বোন-কন্যা, না ছিলো স্ত্রী।

শরীরের রক্ত ঝরতে ঝরতে শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছিলো পণ্ডিতের। এদিকে পাপের অনুশোচনায় পণ্ডিতকে আরো নির্জীব করে ফেলেছিলো। এমতাবস্থায় গড়াতে গড়াতে সে গঙ্গা তীরে পৌঁছে যায়। এ জায়গাটা ছিলো ঈষৎ ঢালু। নদীর ঢেউ অনেক উপরে উঠে আসতো, আবার চলে যেতো অনেক নীচে। এমতাবস্থায় দু’চোখে অন্ধকার নেমে এলো পণ্ডিতের। কাদামাটিতে নিথর দেহ এলিয়ে দিলো পণ্ডিত। গঙ্গার ঢেউ এসে আছড়ে পড়লে তার গায়ে। পণ্ডিত শেষবারের মতো ক্ষীণকণ্ঠে বললো, “আমি পাপের পিয়াসী, আমি পাপী। এ সময় বিশাল এক ঢেউ এসে পণ্ডিতের নিথর দেহটি গঙ্গা তার গভীর বুকে টেনে নিয়ে যায়।

এদিকে মন্দিরের অন্যরা নগরকোটের মূর্তিগুলোকে নর্তকীর রক্তে স্নাত করার জন্য অপেক্ষা করছিলো। মন্দিরের সকল পুরোহিত মহাঋষির পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে। ব্রাহ্মপালের মা পণ্ডিতের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলো। বেলা এক প্রহর পার হলেও যখন পণ্ডিতকে গঙ্গাতীর থেকে ফিরে আসতে দেখা গেলো না, তখন ঋষির খোঁজে বেরিয়ে পড়লো লোকজন। দিনের শেষভাগে অনুসন্ধানকারী লোকজনও ফিরে এলো। কোথাও পণ্ডিত ও সামুরাতির খোঁজ পাওয়া গেলো না। অনুসন্ধানকারীরা গঙ্গাতীরে যাওয়ার পথে দেখতে পেলো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। কিন্তু সেই রক্তের কোনো পরিচয় পাওয়া গেলো না। সেই রক্তের দাগ জন্ম দিলো বহু কাহিনী। অনেকেই অনেকভাবে রয়ে ব্যাখ্যায় গল্প তৈরি করলো। কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও নগরকোটের পণ্ডিত ও সামুরাতির অস্তিত্ব উদ্ধার করতে পারলো না। এমতাবস্থায় সম্মিলিত হিন্দু বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ব্রাহ্মণপালের মা দেবদেবীর অভিশাপের ও অসন্তুষ্টির ভাবনায় মানসিকভাবে মুষড়ে পড়লো। ভয় করতে লাগলো, না জানি দেব-দেবীর পক্ষ থেকে কোন গজব আপতিত হয় কিনা।

* * *

গজব আপতিত হচ্ছিলো সুলতান মাহমূদের উপর, তাদের উপর নয়। দৃশ্যত হিন্দুরা এতো বিপুল সেনা সমাবেশ ঘটাবে, তা সুলতান আগে আন্দাজ করতে পারেননি। বিপুল সেনা সমাবেশ থেকে কিভাবে সুলতান নিজের বাহিনীকে নিরাপত্তা দেবেন তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন। সম্মিলিত হিন্দু বাহিনীর দুর্বলতাগুলো ইংরেজ ঐতিহাসিকের লেখায় পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ইংরেজ ঐতিহাসিক স্যার ভিএ স্মিথ লিখেন

‘হিন্দু বাহিনীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত বিভিন্ন রাজ্যের সেনাদেরকে একই কমান্ডের অধীনে ন্যস্ত করা। অথচ এই কমান্ডার অন্যান্য বাহিনীর রণকৌশল ও যুদ্ধপারদর্শিতা সম্পর্কে কিছুই জানতো না। দ্বিতীয়ত, হাই কমান্ডের প্রতি অন্যান্য সেনাধ্যক্ষদের আস্থা ছিলো না। তাদের মধ্যে সমন্বয়ের প্রচণ্ড অভাব ছিলো। তৃতীয়ত, হাজার হাজার বেসামরিক লোককেও এই বাহিনীতে তাদের আবেগ ও দৈহিক সামর্থের বিচারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। অথচ এরা কোনো দিন যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত দেখেনি। রণকৌশল সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিলো না। চতুর্থত, হিন্দু বাহিনী ছিলো। সংখ্যাধিক্যে ও সামরিক সরঞ্জামের প্রতি অতিশয় নির্ভরশীল।

হিন্দু বাহিনীকে মানসিকভাবে শক্তি যোগাতে সেনাবাহিনীর সহগামী হিন্দু পুরোহিত ও তাদের সাথে নিয়ে আসা বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। মুসলমান সেনারা দেখেছে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলে হিন্দু পুরোহিতরা সবার আগে এসব মূর্তি ফেলে পালাতে শুরু করে। পক্ষান্তরে সুলতান মাহমূদ তার রণকৌশল ও জানবাজ যযাদ্ধাদের পরিবর্তে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের ভরসা করতেন। প্রত্যেক লড়াইয়ের আগে তিনি দু’রাকাত নফল নামায আদায় করে আম্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। নিজের রণকৌশলের প্রতি তিনি ছিলেন আস্থাশীল। সেই সাথে এ বিষয়টিও তাকে শক্তি যোগাতে যে, নিজের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থে তিনি যুদ্ধ করেন না, স্রেফ আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার জন্যই তিনি রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হন। সম্মিলিত হিন্দুদের বিশাল বাহিনী দেখে তার সেনাদের সর্বশেষ নির্দেশনা দিতে গিয়ে তিনি বললেন

বন্ধুরা! বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর চেয়ে তিনগুণ বেশি বেঈমান বাহিনীকে নবীজী পরাজিত করেছিলেন। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হবে আমাদের। আমি আজ তোমাদের কয়েকটি কথা বলতে চাই। নিজের অশে আরোহণ করা অবস্থায় সেনাদের উদ্দেশ্যে সুলতান বলতে লাগলেন, “আমি তোমাদের এই আত্মতুষ্টিতে ভুলিয়ে রাখতে চাই না যে, বিজয় তোমাদেরই হবে। তবে এ কথা অবশ্যই বলবো, তোমরা যদি আল্লাহর হয়ে যুদ্ধ করো, তাহলে আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের মদদ করবেন। মনের মধ্যে এই চেতনা রাখো, তোমরা আল্লাহর সত্য ধর্মের জন্য যুদ্ধ করছে। আল্লাহর কোনো শত্রুকেই তোমরা জীবিত থাকতে দেবে না। তোমাদের সামনে এখন পাহাড় দাঁড়ানো। এই পাহাড়কে অজেয় মনে করে যদি জীবনের প্রতি তোমরা বেশি দরদী হয়ে উঠো, তাহলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য। মনে রাখবে, পাহাড় যতো দুর্ভেদ্য ও দুর্গম হোক না কেন, আমরা একে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। নিজেদের কম জনবল আর শক্রদের সংখ্যাধিক্যের কথা ভুলে যাও। মনে রেখো, যুদ্ধ মনের জোরে হয়ে থাকে। আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন। আল্লাহ তাদেরই মদদ করেন যারা আল্লাহর নামকে উচ্চকিত করার জন্য বিজয়ের আশা নিয়ে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়।’

নিজ বাহিনীর ছোট্ট দুটি ইউনিটকে নিজের প্রত্যক্ষ কমান্ডে নিয়ে সুলতান মাহমূদ সিন্ধু নদের পাঞ্জাব তীরে তাবু গাড়লেন। তার গোয়েন্দাদের চোখে যেমন ৪ হিন্দু বাহিনীর বর্ণনা তিনি শুনেছেন, নিজের চোখে দেখেও তিনি হিন্দু বাহিনীকে পরখ করেছেন। হিন্দু বাহিনী এবার বিজয়ের নেশায় উন্মত্ত। তাই তিনি সেনা ক্ল কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে বললেন- এবার হিন্দুরা বিজয়ের নেশায় উন্মত্ত, তাই ই আমাদেরকে খুবই ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তে অগ্রসর হতে হবে।’ তিনি পূর্বের যুদ্ধ ৫ পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন এনে সেনাবাহিনীকে কয়েকটি ঝটিকা বাহিনী ওগেরিলা দলে বিভক্ত করেন এবং কিছুসংখ্যক সৈন্যকে নদীর তীরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে দিলেন। পেশোয়ার ও গজনীর নিরাপত্তার জন্য তিনি নদীকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর প্লান করলেন।

এছাড়া তার সেনা শিবিরের চতুর্দিকে তিনি পরিখা খনন করালেন। শিবিরের ভেতরে মরিচাবন্দী হয়ে প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করাকে সমীচীন ভাবলেন। আরো কিছু নতুন কৌশলের কথা তিনি ভাবছিলেন কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করাও তার জন্য ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, প্রতিদিনই নতুন নতুন লোক ও সেনা এসে হিন্দু বাহিনীর সাথে যোগ দিচ্ছিলো।

সুলতান দেখলেন, হিন্দু বাহিনী এখনো যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেনি। আল্লাহর উপর ভরসা করে একদিন ভোরবেলায় ফজর নামাযের পরক্ষণেই এক হাজার তীরন্দাজ ঝটিকা সৈন্যকে শত্রু সেনাদের উপর আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। বাহিনীর সবাই ছিলো ধাবমান অশ্বারোহণ ও লক্ষ্যভেদী তীরন্দাজে পারদর্শী।

৩৯৯ হিজরী মোতাবেক ২৯ রবিউস সানি ১০০৮ খৃস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর। বিখ্যাত ঐতিহাসিক গারদিজী স্বচক্ষে দেখা সেই যুদ্ধের বর্ণনায় বলেন, মাত্র এক হাজার তীরন্দাজকে আক্রমণে পাঠিয়ে সুলতান যেনো ভিমরুলের চাকে ঢিল দিলেন। শত্রু বাহিনী এদেরকে এভাবেই তুচ্ছজ্ঞান করলো, কোনো গুরুত্বহীন জিনিস লোকেরা যেমন অবজ্ঞাভরে আবর্জনায় ফেলে দেয়।

শত্রুবাহিনীর ৩০ হাজার অশ্বারোহী ১ হাজার মুসলিম তীরন্দাজের উপর হামলে পড়লো। গুরখা জাতি সেই সময় কোনো ধর্ম-কর্ম পালন করতো না। কিন্তু তাদের বিশ্বাস ছিলো, আদিতে তারাও হিন্দুদের অংশ ছিলো। এই বিশ্বাস থেকে হিন্দুদেরই সহযোগী ছিলো গুরখা সমাজ। এরা এতোটাই লড়াকু ও হিংস্র ছিলো যে, শীত-গ্রীষ্ম, পাহাড়-সমতল সবসময় সব জায়গায় খোলা মাথায় কোনো ঢাল ছাড়াই প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। ঐতিহাসিক কাসিম ফারিশতা লিখেন–

গুরখা সৈন্যরা কয়েক মিনিটের মধ্যে সুলতানের অশ্বারোহী তীরন্দাজদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে পাঁচশ’ মুসলিম সৈন্যকে শহীদ এবং বহু সেনাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। সুলতানের ক্যাম্পে গুরখারা ঢুকে পড়ে। কিন্তু সুলতানের পরিখা গুরখাদের পেছনে ফেরা অসম্ভব প্রমাণ করে। সুলতান আশংকা করছিলেন, প্রতিপক্ষের গোটা ফৌজ যদি একযোগে আক্রমণ করে, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে দেবে। সুলতান তার সৈন্যদের নিয়ে ক্যাম্পে আটকা পড়ে। আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি তার বাহিনীকে যেভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন এর সুফল দেখা দিলো। ভততক্ষণ পর্যন্ত সুলতানের প্রধান সেনাপতি আবদুল্লাহ আলতাঙ্গ যে পাঁচ হাজার অশ্বারোহী রিজার্ভ সৈন্য নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, এরা তখনো গুরখা বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হয়নি।

ইঙ্গিত পেয়ে সেনাপতি আবদুল্লাহ আলতাঈ গুরখাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করলেন। শুরু হলো গুরখাদের কচুকাটা করা। ততোক্ষণে গুরখারা ক্ষান্ত হয়ে পড়েছে আর সংখ্যারও যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। গুরখারা জীবন বাঁচানোর জন্য যখন পরিখায় ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো, তখন আলতাঈ’র রিজার্ভ সৈন্যরা তীর ও বল্লমের আঘাতে তাদের ধরাশায়ী করছিলো। যুদ্ধের এই অবস্থা দেখে মুসলমানদের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অবকাশ না দেয়ার লক্ষ্যে সকল সেনাকে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়া হলো। মুসলমান শিবিরের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আনন্দ পালের জানা ছিলো না। সেখানে তখন গুরখারা কচুকাটা হচ্ছিলো। রাজা আনন্দ পাল বিজয় অবশ্যম্ভাবী ভেবে তার হস্তি বাহিনীসহ নিজে সামনে অগ্রসর হয় এবং তার ঝাণ্ডা আরো উঁচু করে তুলে ধরা হয়।

সুলতানের সেনাপতি আবদুল্লাহ আলতাইর দু’হাজার রিজার্ভ সৈন্যের একটি অংশ রাজা আনন্দ পালের বাহিনীর একপ্রান্তে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঐতিহাসিক ফারিশতা লিখেন, লক্ষাধিক শত্রুর মোকাবেলায় মাত্র ৬ হাজার সৈনিক মোটেও উল্লেখ করার মতো নয়। কিন্তু তদুপরি অলৌকিক ঘটনার মতোই বিস্ময়করভাবে মুসলিম বাহিনী রাজার বিশাল বাহিনীর উপর অল্পক্ষণের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে ফেললো। রাজার বাহন হাতির মুখে বিদ্ধ হলো কয়েকটি তীর। হঠাৎ রাজার হাতির চোখে একটি তীর বিদ্ধ হলে সেটি বিকট চিৎকার দিয়ে পেছনে ফিরে নিজ বাহিনীর মধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলো। রাজার ঝাণ্ডা মাটিতে পড়ে যায়। হিন্দু বাহিনীর ঝাণ্ডা আর উঁচুতে তুলে ধরা সম্ভব হলো না। রাজার হাতির বিকট চিৎকারে অন্যান্য হাতিও ভড়কে গিয়ে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি শুরু করে। ফলে নিজ হস্তি বাহিনীর পায়ের তলায় পিষ্ট হতে লাগলো হিন্দু বাহিনী। রাজার হাতি প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে সবকিছু মাড়িয়ে রাজাকে নিয়ে পিছু পালাতে দেখে অন্যান্য হিন্দু রাজ্যের সেনারা মনে করলো, হয়তো সামনে মুসলমানরা জোরদার হামলা করেছে। তাই রাজা পশ্চাদপসরণ করছে। কিছু না ভেবেই তারা পালাতে শুরু করলো। ভেঙ্গে গেলো সম্মিলিত বাহিনীর চেইন অব কমান্ড।

সম্মিলিত বাহিনী হয়ে পড়লো কাণ্ডারীহীন। তখন ছিলো শীতের মওসুম। ডিসেম্বরের শেষ দিন। পাশের পাহাড়গুলো বরফে ঢাকা। শীতের তীব্রতা ছিলো সমতলের হিন্দুদের জন্য অসহনীয়। এই সময়টার জন্যই সুলতান অপেক্ষা করছিলেন। সুলতান যখন দেখলেন, শত্রু বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে, তখন তিনি তার সকল সৈন্যকে সরাসরি আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন এবং শত্রু বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করার হুকুম করলেন। প্রধান সেনাপতির দু’হাজার রিজার্ভ ফোর্স আর ডেপুটি সেনাপতি আরসালানের অধীনস্ত দশ হাজার আফগান, তুকী ও খিলজী সৈন্য হিন্দু বাহিনীর উপর একই সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তততক্ষণে শত্রুবাহিনী আক্রমণ নয়- আত্মরক্ষা এবং পশ্চাদপসরণে লিপ্ত।

কাসিম ফারিশতা লিখেন- পালাতে গিয়ে হিন্দু বাহিনীর ২০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। যারা অস্ত্র সমর্পণ করলো এদের বন্দী করা হলো। সুলতানের নদীর পাড়ের ঝটিকা বাহিনীও ততোক্ষণে এসে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে। সুলতান ইতিপূর্বে কখনো পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দেননি, কিন্তু এবার শত্রুদের তাড়া করার নির্দেশ দিলেন। শত্রু সেনাদের তাড়া করতে গিয়ে মুসলিম বাহিনী নগরকোটে পৌঁছে গেলে তার গোয়েন্দারা জানালো, নগরকোটের এ মন্দিরকে হিন্দু রাজা-মহারাজারা অন্যতম একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করে রেখেছে। এটিকে রক্ষার জন্য হিন্দু সেনাক্যাম্প স্থাপন করেছে। সুলতান একথা শুনে আর অগ্রসর না হয়ে নগরকোট মন্দির অবরোধের নির্দেশ দিলেন।

রাজা আনন্দ পালের সেনা ও কালিঞ্জরের সৈন্যরা ইচ্ছা করলে নগরকোট মন্দিরকে বাঁচাতে পারতো কিন্তু ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওরা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সুলতান মন্দির অবরোধ করে দূর থেকে এর ভেতরে পাথর নিক্ষেপের নির্দেশ দেন। মন্দির ও মন্দির রক্ষাকারী সেনাদের অবস্থান ছিলো পাহাড়ের উপর। এ জন্য সুলতানের পক্ষে ওদেরকে সরাসরি আঘাত হানা সম্ভব হচ্ছিলো না। দুতিন দিন অবরোধ করে প্রধান ফটক ভাঙ্গার জন্য জোরদার আক্রমণ হানলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মন্দিরের লোজন ফটক খুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে।

সুলতান মাহমূদ মন্দিরে প্রবেশ করে প্রথমেই মূর্তিগুলোকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচের দিকে ফেলে দিলেন। সেগুলো ভেঙ্গেচুড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। নগরকোট মন্দিরে ছিলো সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার। মন্দির থেকে সাত কোটি স্বর্ণের চাকতি বের হলো। স্বর্ণের অলংকার ছিলো মণকে মণ। হীরা-মতি-পান্নাও মণ হিসেবে ওজন করতে হয়েছিল। সুলতান মাহমূদকে পরাজিত করার জন্য হিন্দু পণ্ডিত ও রাজা-মহারাজারা প্রজাদের কাছ থেকে এসব ধন-সম্পদ সগ্রহ করেছিলো। হাজরো থেকে নগরকোট পর্যন্ত গোটা অঞ্চল সুলতান ইসলামী শাসনের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। সেই যুদ্ধের শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি সইতে না পেরে রাজা আনন্দ পাল কয়েক দিন পর মৃত্যুবরণ করে।

সুলতান নতুন বিজিত এলাকায় থেকে তার প্রশাসনকে শক্তিশালী করার প্রতি মনোনিবেশ করলেন। ঠিক এ সময় তার কাছে সংবাদ এলো, গৌড় অঞ্চলে মুহাম্মদ নামের এক আফগান শাসক ১০ হাজার সৈন্য সমাবেশ করেছে এবং গৌড়ি সম্প্রদায়ের সব লোক তার সহযোগী হতে রু করেছে। সেটিও ছিলো এক গৃহযুদ্ধের খবর। কালবিলম্ব না করে ১০০৯ খৃষ্টাব্দ মোতাবেক ৪০০ হিজরী সনে সুলতান মাহমূদকে বাধ্য হয়েই গজনী ফিরে যেতে হলো এবং আরেকবার নামধারী মুসলিম বেঈমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হলো ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *