০২. দামিনী এ বাড়িতে আসিয়াছিল

দামিনী এ বাড়িতে আসিয়াছিল আট বছরেরটি; আজ বয়স তাহার বাইশ। ইহারই মধ্যে এই সংসার কতরূপেই না তাহার চোখের উপর ফুটিল! প্রথম প্রথম এ গৃহ কারা মনে হইয়াছে, মায়ের জন্য কাঁদিয়া দিন গিয়াছে; তারপর এ সংসার কৈশোরের প্রারম্ভে যেন পুষ্পিত উদ্যান, স্বামী কত ভালবাসিয়াছে, কত গোপন উপহার, মনসার মেলায় গভীর রাত্রে ঘুমন্ত দামিনীর মুখে গরম বেগুনি খুঁজিয়া দেওয়া।

দামিনী জাগিয়া উঠিয়া কহিত, দূর।

গোষ্ঠ কহিত, আমি তো দূর, ওদিকে তো বেশ মুড়মুড় শব্দ উঠছে।—বলিয়া ঠোঙাসুদ্ধ। সম্মুখে ধরিত।

দামিনী হাসিয়া ফেলিত।

গোষ্ঠ সম্মুখে মেলিয়া ধরিত কত উপহার-ফিতে, চিরুনি, তেল, আয়না, সাবান।

দামিনী আয়নাখানা তুলিয়া মুখের সামনে ধরিত।

গোষ্ঠ হাসিয়া কহিত, নিজের রূপ কি নিজে দেখে, পরকে দেখাতে হয়।

দামিনীর মুখখানা রাঙা হইয়া উঠিত, কানের পাশ পর্যন্ত গরম। সে আয়নায় মুখখানা ভাল করিয়া ঢাকিত।

গোষ্ঠ কহিত, রাত্রে আয়না দেখলে কি হয় জান তো?

কি?

কলঙ্ক।

দামিনী চট করিয়া আয়খানা ঘুরাইয়া গোষ্ঠর মুখের সামনে ধরিত।

গোষ্ঠ কহিত, আমি চোখ বন্ধ করেছি।

দামিনী গলা জড়াইয়া ধরিয়া চোখ খুলাইবার কত চেষ্টা করি। শেষে মিনতি করিয়া কহিত, লক্ষ্মীটি চোখ খোল।

গোষ্ঠ চোখ খুলিলে দামিনী কহিত, এইবার?

কি?

তোমারও কলঙ্ক হবে।

আমরা পুরুষ, সোনার গয়না, কলঙ্ক আমাদের হয় না, বিপদ তোমাদের। দামিনী হাসিয়া ঠোঁট উল্টাইয়া কহিত, ভারি বুদ্ধি! এই জন্যে বুঝি আয়না দেখালাম?

তবে কি?

কলঙ্ক হয় তো তোমার সঙ্গেই হবে, তোমাকে সাথী করে রাখলাম।

দূর, আমি তোমার আয়ান ঘোষ।–গোষ্ঠ ইঙ্গিত করিয়া হাসিত।

দামিনী আবার রাঙা হইয়া কহিত, চোরের মন পুঁইমাচাতে, কলঙ্ক বুঝি আর কিছু হয় না?

কি শুনি?

এই লোকে বলবে, অমুক কি মেগো, আর মাগীও কি কি জানে বাপু, অত বড় জোয়ানটাকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছে গো!

তা কর নি নাকি?—বলিয়া গোষ্ঠ পত্নীকে বক্ষে টানিয়া লইত।

সে এক দিন গিয়াছে। এখনও সেদিন মনে পড়িলে দামিনীর চোখ ছলছল করে।

তারপর এই ভরা যৌবনেই অভাবের দাহে সুখের ঘর পুড়িয়া গেল। উত্তাপে বুঝি প্রেমের স্রোতও শুকাইয়া গেল।

গোষ্ঠও মনের মত কিছু দিতে পারে না বলিয়া মরমে মরিয়া থাকে, অমনোমত কিছু দিতেও মন ওঠে না। দামিনীও তাহা বোঝে, তাই সেও কিছু চায় না।

কিন্তু তাহাও গোষ্ঠর প্রাণে বাজে, সে ক্ষুঃস্বরে কয়, কখনও দেখলাম না যে, কিছু চাইলে তুমি।

একমুখ হাসি ভরিয়া দামিনী কয়, বা, বেশ লোক তো তুমি, না দরকার হলেও চাইতে হবে? কি নাই আমার, সবই তো রয়েছে।

হাসিটি ছলনা সত্য, কিন্তু বড় সুন্দর, গোষ্ঠ অতৃপ্ত নয়নে মুখপানে চাহিয়া থাকে।

তারপর আপন মনেই নিজের সামর্থের সঙ্গে দামিনীর অভাবের সূচি মিলাইয়া যায়, শেষে বাহির করে একখানা গায়ের কাপড়; কাবুলীর কাছে ধারে পাওয়া যাইতে পারে, তাই সে বলে, কই, গায়ের র্যাপার তো নাই তোমার?

দামিনী তাড়াতাড়ি কয়, না না, ও আমি গায়ে দিতে নারি; মাগো, যে সুঙসুঙি! ও কিনো না তুমি।

গোষ্ঠ মানে না, কিনিয়া আনে।

দামিনী ঝগড়া করে, বললাম, এনো না।

গোষ্ঠ অপ্রস্তুতের মত কয়, রাগ কেন, আনলাম। আবার কখনও বা দুইটা আম, দুইটা কঁঠাল কিনিয়া আনে, কিন্তু দামিনী তাহা খায় না, স্বামী-পুত্রকেই বাটিয়া দেয়।

গোষ্ঠ অনুযোগ করিয়া কয়, আমাকে কেন, তোমার তরে আনলাম।

এই স্নেহে দামিনীর চোখে জল আসে, তবু সে হাসিয়া কয়, তুমি খাও, আমার আছে।

গোষ্ঠ প্রতিবাদ করে, এ তো আমাকেই সব দিয়েছ, তুমি–

তাড়াতাড়ি কথাটা শেষ করিয়া ফেলিবার অভিপ্রায়ে দামিনী বলিয়া ওঠে, ও আমি খেতে পারি না।

সঙ্কোচে মন শুধু সঙ্কুচিতই হয় না, শঙ্কিতও হয়। গোষ্ঠও নিজের অমনোমত উপহারের জন্য শুধু সঙ্কুচিতই নয়, প্রত্যাখ্যানের শঙ্কায় শঙ্কিতও হইয়া থাকে। তাই সে ভাবে, এ অরুচি দামিনীর রসনায় নয়, তুচ্ছ বলিয়া তাচ্ছিল্যের অরুচি এ।

এ তাচ্ছিল্য মনে বড় লাগে, ক্ষোভে দুঃখে অন্তর মথিয়া বিষ ফেনাইয়া ওঠে, গোষ্ঠ মুখের আহার সার-ডোবায় ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া যায়। দামিনীর মনে হয়, আম ফেলিয়া দিল না, আমাকেই ফেলিয়া দিল। চোখে জল আসে, অন্তর জ্বলিয়া যায়।

এমনই নিরন্তর দাহে উত্তপ্ত অঙ্গার বুকের মাঝে স্থূপ বাঁধিয়া ওঠে, শ্মশানের অঙ্গারস্থূপের চেয়ে সে কম নয়।

এই অশান্তির মাঝে আর এক দারুণ অশান্তি জুটিয়াছিল, প্রতিবেশী সুবল দাস। আট বছরের বউ দামিনী যখন এ বাড়ি আসে, তখন তাহারও ঠিক অমনই বয়স।

আট বছরের বউ ঘোমটা টানিয়া বসিয়া আছে, ফুটফুটে ছেলেটি আসিয়া মুখের ঘোমটা খুলিয়া ডাকিল, বউ!

দুই জনেই ফিক্‌ করিয়া হাসিল।

তারপর। ছেলেতে মেয়েতে মিতালি হইতে কতক্ষণ!

ঠিক মিতা নয়, বউটির দাস হইল সে; ফুল তুলিয়া ফল পাড়িয়া বউটির মন যোগানোই ছিল তাহার কাজ।

সুবল দামিনীকে প্রথম দিনই ডাকিয়াছিল, বউ! এখনও তাই বলে।

দামিনী বলিত, সুবললা। এখন বলে, মহান্ত।

বাউলের ছেলে সুবল দাস, মহান্ত খেতাব তাহাদের।

কৈশোরের প্রারম্ভে দামিনীর দেহে যৌবনের মুকুল দেখা দিলে গোষ্ঠ আসিয়া তাহার হাত ধরিল, দামিনীরও তাহা লাগিল ভাল; সে গোষ্ঠর পানেই মুখ ফিরাইল।

তখন এই লাজুক কিশোরটি দামিনীর পানে, বিদায়-নেওয়া প্রিয়জনের পানে মানুষ যেদৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকে, তেমনই সকরুণ দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

সে দৃষ্টি দেখিয়া দামিনীর করুণা হইত।

ফাঁক পাইলেই সুবল আসিয়া কহিত, বউ, কুল পাড়তে যাবে ভাই?

এদিক ওদিক চাহিয়া দামিনী কহিত, না ভাই, বকবে।

সুবল নতদৃষ্টিতে চলিয়া যাইত, দামিনীর তাহাও প্রাণে বাজিত, সে ডাকিয়া কহিত, আমাকে দুটো দিয়ে যাস ভাই, আমি খাব।

সুবল কৃতার্থ হইত।

আঁচল ভরিয়া পাকা জাম, কাঁচা আম, টকো কুল সুবল গোপনে আনিয়া দিত; দামিনী হাসিমুখে গ্রহণ করিয়া কঁচা আমে কামড় মারিয়া শিহরিয়া উঠিয়া কহিত, মাগো, কি টক! টাকরায় সে টোকার মারিত। সুব তাড়াতাড়ি দামিনীর আঁচল টানিয়া বাছিয়া একটা আম লইয়া কহিত, এইটে খাও, কাচামিঠে আম, কাঁকুড়ের মত।

কিন্তু যৌবনের প্রারম্ভে সম্মোহনের আবেশময় রাজ্যে উভয়ে প্রবেশ করিতেই দুই জনের এই প্রীতি কেমন টুঁটিয়া গেল।

দামিনীর মনে হইল, ওই শান্ত লোকটির একান্ত মুগ্ধ দৃষ্টির দীপ্তি যেন বড় প্রখর, দীপ্তিতে যেন একটা দাহ। সে দাহ দামিনী তাহার সর্বদেহে অনুভব করিল।

সুবলের পরম দাস্যতা-ভরা ব্যবহারের মাঝে একটা সবল শক্তি যেন দামিনীকে আকর্ষণ করিল; তাহার ওই সলাজ নীরবতার মাঝে যেন দূরত্বের সৃষ্টি করিল।

সুবল দেখিল, দামিনী পর হইয়া গেল।

শাস্ত্ৰে বলে, ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ, কিন্তু সুবল দেখিল, ভিক্ষায়াং বসতে লক্ষ্মী। বাউলের ছেলে সুবল গান গাহিয়া ভিক্ষা করে, গায়ে আলখাল্লা, পায়ে নূপুর, হাতে তাহার একতারা।

ভিক্ষার চাউলে তার পাঁচ-সেরি ঝোলাটা ভরিয়া ওঠে; একটা পেটে লাগে আর কত বড়জোর এক সের, বাঁচে চার সের।

ওই চার সের জমিয়া জমিয়া ভিক্ষুককে মহাজন পর্যায়ে দাঁড় করাইয়া দিল।

লোকে বলে, মহান্ত, আর কেন?

মহান্ত হাসিয়া বলে, বাপরে, পিতিপুরুষের বেবসা, কুলকর্ম, ও কি ছাড়তে আছে?

দামিনীর দুঃখের দিনে কিন্তু সুবল সত্য সত্যই মহাজন হইতে ভিক্ষুক পর্যায়ে নামিতে চাহিল; কিন্তু মুখ ফুটিয়া বলা যে যায় না! আর বুক বাঁধিয়া তাহার সঞ্চয় সম্বল দামিনীর পায়ে ঢালিয়া দিতেও সাহস হয় না। হয়ত দামিনী লাথি মারিয়া ফিরাইয়া দিবে।

প্রথম প্রথম সে লুকাইয়া কুলুঙ্গির উপরে, কোনো দিন বা চৌকাঠের ফাঁকে, দুয়ারের প্রবেশমুখেই টাকাটা সিকিটা রাখিয়া আসিত। দামিনীর নজরে ঠেকিলে সে লইয়া আঁচলে বাধিত, আর আপন মনেই বকিত, এই আলবোডেমিতেই তো গেল সব; কাজ দেখ দেখি, কুলুঙ্গির উপরে টাকা, যদি কেউ দেখতে পেত!

ওটুকুও কিন্তু সুবলের সহ্য হইত না, আর অসহ্য হইত যখন গোষ্ঠ আসিত।

দামিনী মুখ টিপিয়া হাসিয়া স্বামীকে কহিত, কারও কিছু হারিয়েছে?

গোষ্ঠ চমকিয়া স্মরণ করিতে চাহিত, জিনিসটা কি? শেষে বলিত, হা হারিয়েছে আমার—

কি?

আমার মন।

দূর। সে তো আমারই, দত্ত জিনিসে স্বত্ব কি? এই দেখ।—বলিয়া সে বাধা খুঁট দেখাইত। গোষ্ঠ অবাক হইত; আবার ভাবিত, হবে হয়ত, বনিয়াদি ঘর তো, কোনো পিতৃ-পিতামহের সঞ্চয় ইদুরে কোনো গর্ত হইতে বাহির করিয়াছে। চোখে জল আসিত।

সুবলের কাছে সমস্ত সংবাদ তিক্ত হইয়া উঠিত।

সর্বস্ব দিয়াও সুবল আপন হওয়ার সুযোগ পাইল না।

কখনও কখনও সাহস করিয়া নতমুখে গিয়া কহিত, বউ!

রুক্ষস্বরে উত্তর আসিত, কি? কি কাজ কি, আগুন নেবে নাকি?

সব কথা সুবলের হারাইয়া যায়, ঝঙ্কারের ঝঞায় সব বিপর্যস্ত হইয়া যায়; তবু চুপ করিয়া থাকাও তো হয় না। অতি কষ্টে সে কহে, হ্যাঁ।

দামিনী হাতার টানে আগুন টানিয়া ফেলিয়া দিয়া কহে, নেবে কিসে? কি আবাঙ তুমি, সঙ নাকি? সঙ্গে সঙ্গে হাসেও; সুবলের অবস্থা দেখিয়া না হাসিয়া পারে না।

প্রতিবেশিনী সাতু-ঠাকুরঝি আসিয়া বলে, কে লো?

দামিনী কহে, ওই দেখ না মাইরি, আগুন নেবে তা শুধু হাতে এসেছে; দিই কিসে বল তোর।

সাতু বেশ ভাল মানুষের মতই বলে, ভিক্ষের ঝোলাটা আন গিয়ে মহান্ত, আগুন নিয়ে যাবে।

দুই সখী দুই জনের মুখপানে চায়।

এই অবসরে সুবল রণে ভঙ্গ দেয়, সহসা পিছন ফিরিয়া পালায়।

দুই সখীতে হাসিয়া গড়াইয়া পড়ে।

সাতু বলে, মরণ! বোবা পুরুষ কি ভাল নাকি, ও বিধেতার অলক্ষুণে ছিষ্টি।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *