২.২৭ কেদার-বদরি ফেরত

কেদার-বদরি ফেরত মাসখানেক বারাণসীতে কাটিয়ে, দীর্ঘদিন পরে কলকাতায় ফিরলেন জয়াবতী। আর এসেই দুদিন পরে দেখতে এলেন সুবৰ্ণকে।

দেখলেন নতুন ব্যবস্থা।

দেখলেন জীর্ণ অবস্থা।

কাছে বসে পড়ে বললেন, মানুষের ওপর অভিমান সাজে সুবর্ণ, ইটপাথরের ওপর অভিমান করে নিজেকে শেষ করার বাড়া বোকামি আর কি আছে?

সুবৰ্ণ হেসে বলে, জানোই তো চিরকেলে বোকা! কিন্তু অভিমানটা ইঁট-পাথরের ওপর এ কথা কে বললো? যদি বলি সৃষ্টিকর্তার ওপর?

তা সে লোকটাও তো ইট-পাথর!

তবে নাচার।

বৌমা বলছিল, শরীরের ওপর অবহেলা করে-করেই নাকি রোগটি বাধিয়েছ!

ওরা মা বলে ব্যস্ত হয়, তাই ওকথা বলে, মরণকালে তো একটা কিছু হবেই?

তা কালটাকে তো স্বেচ্ছায় ত্বরান্বিত করছিস! শুনলাম ওষুধ খাস না, পথ্যি খাস না, বৌরা সেবা-যত্ন করতে এলে নিস না–এটা তো ঠিক নয় ভাই!

সুবৰ্ণর ব্যাধি-স্নান চোখ দুটো একবার জ্বলে উঠলো, তারপর ছায়া হয়ে গেল। বললো, ওই তো বললাম, চিরকেলে বোকা!

জয়াবতী বললেন, তা তো জানি। সংসারে যে পুরো খাঁটিতে কাজ চলে না, ন্যায়ে আর অন্যায়ে, সত্যিতে আর মিথ্যেতে আপস করে নেওয়া ভিন্ন যে সংসার অচল, এ কথা তো কখনো বুঝিয়ে পারি না তোকে। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে নাই বা সরে পড়লি? একজন তো কোনকালে ফেলে চলে গেছে, তুই গেলে যে একেবারে নির্বান্ধব!

সুবৰ্ণর সেই দীর্ঘ কালো চোখ দুটো কোটরে বসে গেছে, তবু বুঝি সে চোখ আজও কথা বলতে ভুলে যায় নি। সেই চোখের কথার সঙ্গে মুখের কথাও মেশায় সুবর্ণ, যে ফেলে চলে গেছে, সে তোমাকে আজও ভরে রেখেছে। জয়াদি, তোমার নির্বান্ধব হবার ভয় নেই।

বুঝলাম, খুব জ্ঞান দিলি। তবু দুটো মনের কথা বলারও তো সঙ্গী দরকার? আর তুই কি শেষটা হার মেনে চলে যাবি?

পণ ছিল হার মানব না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার যে সুবর্ণর ওপর বড় আক্রোশ, আর পারছি না। সেবা-যত্নের কথা বলছে জয়াদি, যে যা করতে আসে, কেউ কি অন্তর থেকে করে? সবই লোকদেখানো!

জয়াবতী হেসে ফেললেন। বললেন, চোখে যেটা দেখা যায় সেটাই দেখতে হয়। সুবর্ণ, অন্তরটা দেখতে যাওয়া বিধাতার বিধানের ব্যতিক্ৰম।

সুবৰ্ণ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে, থাক জয়াদি, ও নিয়ে তর্ক করা বৃথা। এ কাঠামোয় নতুন করে আর কিছু হবে না। তার চাইতে তুমি যা সব দেখে এলে তার কথা বলো।

জয়াবতী ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, সে আর বিশদ করে বলতে ইচ্ছে নেই সুবর্ণ। তোর কাছে চিরকালের লজ্জা রয়ে গেল আমার। তীৰ্থ করেছি না। রাতদিন অপরাধের ভারে মরমে মারে থেকেছি–

ওমা শোনো কথা—, সুবর্ণ ওকথা চাপা দিতে চেষ্টা করে; কিন্তু জয়াবতী কথাটা শেষ করেন, শুধু আমি একা হলে তোকে ফেলে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না। কিন্তু দল বড় ভয়ানক জিনিস! ও জিনিসের মায়া থাকে না, মমতা থাকে না, চক্ষুলজ্জা থাকে না। যাব না বললে খেয়ে ফেলতো আমায়। আমিই তো উয্যুগী।

সুবৰ্ণ বলে, যাবে না কি বল? তীৰ্থ বলে কথা! মহাতীৰ্থ! জীবনে দুবার সুযোগ আসে না, আমার ভাগ্য আমায়—

হ্যাঁ, এই একটা জায়গা যেখানে সুবর্ণ সাধারণ মানুষের মত কথা কয়। ভাগ্য নিয়ে আক্ষেপ করে।

ঠাকুরপোর অসুখ যে শক্ত নয়। সে আমি বুঝেছিলাম। জয়াবতী একটু চুপ করে থেকে বলেন, তবু যাওয়া আটকাতো না। যদি ছেলেরা প্রতিকূল না হতো।

সুবৰ্ণ হঠাৎ হেসে ওঠে।

খাপছাড়া ভাঙা-ভাঙা।

শোনো কথা! জন্মলগ্নই যার প্রতিকূল, তার আবার কে অনুকূল হবে? তা এইটাই হয়তো ঠিক কথা।

জন্মলগ্ন নাকি তার রাশি-নক্ষত্রের সৈন্যসামন্ত নিয়ে আজীবন তাড়া করে বেড়ায় মানুষকে, এটা একটা অঙ্কশাস্ত্রের কথা।

কথায় ছেদ পড়লো।

এক হাতে গেলাস, এক হাতে রেকবি নিয়ে এসে ঢুকলো ভানুর বৌ। সহাস্যে বললো, জেঠিমা তীৰ্থ থেকে ফিরেছেন, আজ কিন্তু আপনাকে জল না খাইয়ে ছাড়বো না। দেখুন। আমি তসর কাপড় পরে, পাথরের বাসনে করে নিয়ে এসেছি।

জয়াবতী স্মিতমুখে বলেন, না জিজ্ঞেস করে এসব করতে গেলে কেন গো পাগলি মেয়ে! আজি যে আমার সঙ্কটা, কিছু খাব না তো!

কিছু খাবেন না?

না গো মা-জননী, কিছু না। দেখো দিকি, শুধু শুধু কষ্ট পেলে।

দুঃখের আর অবধি থাকে না বড়বৌমার, ম্লানমুখে চলে যায়।

চলে গেলে সুবৰ্ণলতা বলে, তুমি তো বেশ অভিনয় করতে পারো জয়াদি!

জয়াবতী হেসে বলেন, উপায় কি? জগৎটা তো থিয়েটারই। তুমি অভিনয় করতে পারলে না। বলেই হেরে মরলে!

সুবৰ্ণলতা আস্তে ওঁর হাতটা মুঠোয় চেপে ঈষৎ চাপ দিয়ে বলে, হেরেছি, কিন্তু হার মানি নি।

জয়াবতী উঠছিলেন, প্ৰবোধ এসে দাঁড়াল, হৈ-চৈ করে বলে উঠল, এই যে নতুন বৌঠান, তীর্থটীৰ্থ হলো? ভালো ভালো। তা দেখছেন তো আপনার সইয়ের অবস্থা? অথচ এক পুরিয়া ওষুধ খাবে না, সেবা যত্ন নেবে না। আবার এই খোলা জায়গায় এসে শোওয়া। নিজের দোষেই প্ৰাণটা খোওয়াবে মানুষটা।

সুবৰ্ণলতা হঠাৎ দারুণ কাসতে থাকে।

থামতেই চায় না।

প্ৰবোধ ভয়ার্তা মুখে চেঁচিয়ে ওঠে, এই বকুল, কোথায় থাকিস সব? রোগা মানুষ, একটু জলও— আচ্ছা আমি দেখছি— বলে বোধ করি নিজেই জলের চেষ্টায় বেরিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *