০৪. জন রাঞ্জের জবানবন্দী

৩নং লরিস্টন গর্ডেন্স থেকে যকন বেরলাম তখন বেলা একটা। শালক হোমস নিকটবর্তী টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে একটা লম্বা তার পাঠাল। তারপর একটা গাড়ি ডেকে গাড়োয়ানকে লেস্ট্রেডের দেওয়া ঠিকানায় যাবার নিদেশ দিল।

যেতে যেতে সে বলল, ‘চোখে-দেখা প্রমাণের মত কিছু হয় না। আসলে এ কেস সম্পর্কে আমার মন সব ঠিক করে ফেলেছে। তথাপি যা কিছু জানবার আছে সেসব জানাই ভাল।ৎ

আমি বললাম, ‘তুমি আমাকে বিস্মিত করেছ হোমস। যেরকম নিশ্চয়তার সঙ্গে খুটিনাটি কথা তুমি জানালে, নিশ্চয় আসলে ততটা নিশ্চিত তুমি নও।’

উত্তরে সে বলল, ‘ভুলের কোনরকম সুযোগই নেই। ওখানে পৌঁছে প্রথমেই আমি লক্ষ্য করলাম, পথের উপর একটা গাড়ির চাকার দুটো দাগ পড়েছে। এখন, গত রাতের আগে গত এক সপ্তাহ এখানে কোন বৃষ্টি হয় নি। কাজেই যে চাকাগুলির দাগ এত গভীরভাবে মাটিতে বসে গেছে সেগুলি নিশ্চয় গত রাত্রেই সেখানে এসেছিল। ঘোড়ার ক্ষুরের যে দাগ সেখানে রয়েছে তার একটা অন্য তিনটের তুলনায় বেশী গভীর। তা থেকেই বোঝা যায় ক্ষুরের একটা নাল নতুন। যেহেতু বৃষ্টি আরম্ভ হবার পরেও  গাড়িটা সেখানে ছিল এবং কাল সকালে কোন সময়ই সেটাকে দেখা যায় নি—একথা গ্রেগসনই বলেছে—সুতরাং অনুমান করা চলে যে রাত্রে ওটা সেখানেই ছিল এবং ওই গাড়িতে করেই দুই ব্যক্তি ও বাড়িতে এসেছিল!’

আমি বললাম, ‘এটা তো বেশ সোজা। কিন্তু অপর লোকটির উচ্চতা?’

‘কেন? প্রতি দশজনের ন’জনের ক্ষেত্রেই পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য দেখেই তার উচ্চতা বলে দেওয়া যায়। ‘হিসাবটা খুবই সোজা। তার বিবরণ দিয়ে তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। বাইরের মাটিতে এবং ঘরের ধুলোর মধ্যে এই লোকটির পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য আমি দেখেছি। তারপর একটা বিশেষ উপায়ে হিসাবটা আমি পরীক্ষা করেও নিয়েছি। কোন লোক যখন দেওয়ালে কিছু লেখে, সাধারণত সে তার চোখের সমান উচ্চতায়ই লেখে। ঐ লেখাটা আছে মেঝে থেকে ছ’ফুটের সামান্য উঁচুতে। বাকিটা তো ছেলেখেলা।’

‘আর তার বয়স?’ আমি প্রশ্ন করলাম। একটাোক যদি অনায়াসে প্রতি পদক্ষেপে সাড়ে চার ফুট পার হতে পারে তাহলে সে নিশ্চয়ই অথর্ব বৃদ্ধ নয়। বাগানের পথে একটা খানা পথ আছে। সেটাও সে পার হয়েছে নিশ্চয়। পেটেন্ট লেদার জুতোর ছাপ রয়েছে চার দিকে। তার চৌকোণা ডগার চিহ্ন ও স্পষ্ট। এর মধ্যে তো রহস্যের কিছু নেই। আমার সেই প্রবন্ধটাতে পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের যেসব নীতির উল্লেখ আমি করেছি, তারিই কিছু কিছু বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেছি মাত্র, আর কিছু কি বুঝবার আছে?’

‘আঙুলের নখ আর ত্রিচিনোপোলি,’ আমি মনে করিয়ে দিলাম।

‘একটা মানুষের তর্জনীকে রক্তে ডুবিয়ে দেওয়ালের উপর শব্দটা লেখা হয়েছে। আমার কাঁচের সাহায্যে দেখেছি। লেখার দরুন দেওয়ালের প্লাসারে কিছুটা আচঁড় লেগেছে। ছাইটা দেখতে কালো এবং পাতলা আঁশযুক্ত। এরকম ছাই একমাত্র ত্রিচিনোপোলি সিগারে হয়। সিগারের ছাই নিয়ে আমি অনেক পড়াশুনা করেছি, ও বিষয়ে একখানা ছোট বইও লিখেছি। আমি গর্ব করে বলছি, যেকোন পরিচিত ব্যান্ডের সিগার বা তামাকের ছাইয়ের পার্থক্য আমি একবার দেখলেই বলে দিতে পারি। এই সব ছোটখাট ব্যাপার নিয়েই একজন দক্ষ গোয়েন্দা আর লেস্ট্রেড-গ্রেগসনের মধ্যে এত তফাৎ।’

‘আর লাল মুখ?’ আমি প্রশ্ন করলাম।

‘ওঃ, ওটা তো খুব মোক্ষম চাল। বর্তমান অবস্থায় নির্ভূল সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বর্তমান অবস্থায় ও বিষয়ে তুমি আমাকে কোন প্রশ্ন করো না।’

কপালে হাত বুলিয়ে আমি বললাম, ‘আমার মাথাটা ঘুরছে। যত ভাবছি ততই যেন রহস্য বাড়ছে। খালি বাড়িটাতে দুজন এল কি করে? অবশ্য যদি দু’জনের কথা ঠিক হয়। যে গাড়োয়ান গাড়িটা চালিয়েছিল তার কি হল? একজন অপরজনকে বিষ খেতে বাধ্য করল কেমন করে? কোন কিছু ডাকাতি যখন হয় নি, তখন খুনির উদ্দেশ্য কি ছিল? একটি স্ত্রীলোকের আংটিই বা এল কোথা হতে? সর্বোপরি, পালাবার আগে দ্বিতীয় লোকটি জার্মান ভাষায় “রাসে” (RACHE) শব্দটি লিখল কেন? আমি স্বীকার করছি, এই সব ঘটনাকে মিলিয়ে দেবার কোন পথ আমি দেখতে পাচ্ছি না।’

আমার সঙ্গী সমর্থনসূচক হাসি হাসতে লাগল।

বলল, ‘পরিস্থিতির অসুবিধাগুলি তুমি পরিষ্কার ভাষায় বেশ ভালভাবেই বলেছ। মুল ঘটনাবলী সম্পর্কে আমার মনস্থির করা হলও এখনও অনেক কিছুই অস্পষ্ট রয়েছে। বেচারি লেস্ট্রেডের আবিষ্কার সম্পর্কে বলতে পারি, ওটা পুরোপুরি ধাপ্পা। সমাজতন্ত্রের ও গুপ্ত সমিতির ধারণা সৃষ্টি করে পুলিশকে ভুল পথে চালাবার মতলব। ওটা কোন জার্মানের লেখা নয়। লক্ষ্য করলে দেখতে পেতে A অক্ষরটা জার্মান কায়দাই লেখা হয়েছে। কিন্তু একজন সত্যিকারের জার্মান সব সময়ই ল্যাটিন কায়দায় লেখে। কাজেই অসংকোচে বলা যায়, ওটা কোন জার্মানের লেখা নয়, কোন অক্ষম নকলনবীশ বাড়াবাড়ি করে বসেছে। সমস্ত তদন্তটাকে ভুল পথে ঘুরিয়ে দেবার একটা ফন্দী মাত্র।কিন্তু ডাক্তার, আর কোন কথা নয়। তুমি তো জান, যাদুকর যদি তার খেলা সবাইকে বুঝিয়ে দেয়, তাহলে আর কেউ তাকে বাহবা দেয় না। আমার কাজের পদ্ধতি যদি সবটা তোমাকে বুঝিয়ে দেই, তাহলে তুমিও আমাকে একজন অতি সাধারণ মানুষ বলে মন করবে।’

‘আমি কখনও তা বরব না’, আমি উত্তরে বললাম,‘অপরাধতত্ত্বকে‘তুমি নির্ভূল বিজ্ঞানের এত কাছাকাছি এনে ফেলেছ যে পৃথিবীতে আর কেউ এর চাইতে বেশী কিছু করেত পারবে না।’

এমন আন্তরিকতার সঙ্গে আমি কথাগুলি বললাম যে আমার সঙ্গীর মুখখানি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটা জিনিস আমি এর মধ্যেই রক্ষ্য করেছি যে, একটি মেয়ে তার রূপের প্রশংসা শুনলে হোমসও তেমনি খুশিতে জরমর করে।

সে বলল,‘তোমাকে আর একটি কথা বলছি।পেটেপ্ট লেদার এবং চৌকো-ডগা একই গাড়িতে এসেছিলে, এক্ সঙ্গে বন্ধুর মত-সম্ভবত হাত-ধরাধরি করেই পতটা হে‘টেছিল।ঘরে ঢুকে এদিক-ওদিক পায়চারি করেছিল,-বরং বলা যায় পেটেপ্ট-লেদার দাড়িয়ে ছিল, আর চৌকো-ডগা পায়চারি করছিল। ধূলোর উপরে এসব দাগই স্পষ্ট।তাই বুঝতে পেরেছি, হাঁটতে হাঁটতে সে ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। পা ফেলবার ফাঁকটা ক্রমাগতই দীর্ঘ্ হয়েছে দেখেই সেটা্ বোঝা যায়। সারাক্ষণ কথাবলছিল এবং ক্রোধে জ্বলছিল।তারপরই দূর্ঘ্টনাটি ঘটল।আমি যতটা জেনেছি সবই তোমাকে বললাম।বাকিটা এখনও অনুমান মাএ। অবশ্য এর ভিত্তিতেই কাজ শুরু করা যেতে পারে।এখন তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে,কারণ সন্ধ্যায় হ্রালে-র কনসার্টে নর্মান নেরুদার বাজনা শুনতে চাই।’

যতক্ষণ সে এই সব বরছির ততক্ষণে আমাদের গাড়িটা পরপর অনেকগুলো সরু রাস্তা ও ময়লা গলি পার হয়ে চলেছে। এতক্ষণে সবচাইতে সরু ও সবচাইতে ময়লা একটা পতে পৌছে গাড়োয়ান হটাৎ গাড়িটা থামিয়ে দিল। একটা চিলতে মত জায়গায় একসারি রং-মরা ই‘টের বাড়ি দেখিয়ে সে বলল, ‘ওই যে অডলি কোর্ট্। আপনারা ফিরে এসে আমাকে এখানেই পা্বেন।’

অডলি কোর্ট্ মোটেই আকর্ষণীয় জায়গা নয়। চিনতে পথটা পেরিয়ে একটা চৌকো মত জায়গা আর সারি সারি জঘন্য বাড়ি। একদল নোংরা ছেলে-মেয়ে আর রংওঠা নানারকম নিশানের ভিতর দিয়ে পথ করে ৪৬নম্বরে পৌছিলাম। দরজায় ভিতরের একটা জাহাজ আটা। তার উপরে রাঞ্চের নাম খোদাই করা। খোজঁ নিয়ে জানলাম, কনেস্টবল তখনও বিছানায়। একটা ছোট বসবার ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায একটু বিরক্ত হয়েই সে ঘরে ঢুকল;বলল, ‘আমি তো আপিসে  রিপোর্ট্ দিয়ে দিয়েছি।’

পকেট থেকে একটা আধ-গিনি বের করে নাচাতে নাচাতে হোমস বলল, ‘আমরা ভেবেছিলাম তোমার মুখ থেকেই সব শুনব।’

সোনার চাকতিটার ঊপরে চোখ রেখে কনেস্টবর বলল,‘আমি যা জানি সব বলব।’

‘যেমন যেমনটি ঘটেছিল ঠিক তেমনটি করে সব বল।’রাচ্ঞ সোফায় বসে ভূর  দুটো কোঁচকালো। যেন মনে মনে সংকল্প করে নিল, কোন কিছুই যাতে বাদ না পড়ে। তারপর বলতে শুরু করল,‘গোড়া থেকেই বলছি। রাত দশটা থেকে ভোর ছটা পর্য্ন্ত আমার সময়। এগারটার সময়‘‘হোয়াইট হার্ট্’’’-এ একটা লড়াই হয়েছিল । তাছাড়া আর সব শান্ত্ ।একটার  সময় বৃষ্টি শুরু হল। সেইসময় হল্যান্ড গ্রোভ বীটের হ্যারি র্মাচারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। দুজনে হেনডরয়েটা স্ট্রীটের মোড়ে দাঁড়িযে গল্প করছিলাম। একটু পরে- হয় তো দুটো নাগাদ বা তার একটু পরে-ভাবলাম বিকসটন রোডের দিকটা একটু দেকে আসি। ওদিকটা যেমন নোংরা, তেমনি র্নিজন।সারা পথে জন-মনিষ্যির দেখা নেই শুধু একটা গাড়ি চলছে।হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঐ বাড়িটার জানালা দিয়ে একটা আলো চোখে পড়ল। আমি জানতাম লরিস্টন গার্ডেস্নের ঐ দুটো বাড়ি খালি আছে। তার মধ্যে একটার শেষ ভাড়াটে টাইফয়েডে মারা গেছে। তাই জানালার আলো দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বলে সন্দেহ হল। দরজার কাছে পৌঁছে—’

সঙ্গী বাধা দিল, ‘তুমি থেমে গেলে এবং আবার বাগানের গেটের কাছে ফিরে গেলে। এরকমটা কেন করলে?’

রাঞ্চ একটা প্রকান্ড লাফ দিয়ে অবাক বিস্ময়ে শালর্ক হোমসের দিকে হী করে তাকিয়ে বলল, ‘আর, ঠিক তাই স্যার। ভগবান জানেন সেকথা আপনি জানলেন কেমন করে? বুঝতেই তোর পারছেন, যখন আমি দরজার কাছে পৌঁছলাম তখন চারিদিকটা এমন নির্জন আর থমথমে যে মনে হল এ অবস্থায় একজন সঙ্গে থাকলে মন্দ হয় না। যদিও কবরের এপারে কোন কিছুকেই আমি ভয় পাই না, তবু কেন জানি মনে হল, ড্রেন পরীক্ষা করতে গিয়ে টাইফয়েড হয়ে যে মারা গেছে এটা হয় তো তারই কাজ। এই ভাবনাই আমাকে ঘুরিয়ে দিল। মার্চারের লণ্ঠনাটা চোখে পড়ে কি না দেখবার জন্য আমি গেটের কাছে ফিরে গেলাম। কিন্তু তাকে বা অন্য কাউকেই দেখতে পেলাম না।

‘পথে কেউ ছিল না?’

‘কোন জীবন্ত প্রাণী নয় স্যার। একটা কুকুর পর্যন্ত না। তখন সাহস করে ফিরে গেলাম এবং ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললাম। ভিতরে চুপচাপ। ঘরের মধ্যে যেখানে আলোটা জ্বলছিল সেখানে গেলাম। ম্যান্টেল-পিসের উপর মোমবাতিটা—একটা লাল মোমবাতি জ্বলছিল আর তারই আলোয় দেখলাম—’

জন রাঞ্চ লাফিয়ে উঠল। তার মুখে ভয়, তার চোখে সন্দেহ। চেঁচিয়ে বলল, ‘এসব দেখবার জন্য আপনি কোথায় লুকিয়ে ছিলেন? আমি তো দেখেছি, আপনি এমন অনেক কিছুই জানেন যা আপনার জানবার কথা নয়।’

হোমস হেসে উঠল। তার কাডখানা কনেস্টবলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খুনের দায়ে আমাকেই যেন গ্রেপ্তার করে বসো না। আমিও একটি শিকারী, নেকড়ে নই। মিঃ গ্রেগসন বা মিঃ লেস্ট্রেডের কাছেই সব জানতে পারবে। এখন বলে যাও। তারপর কি করলে?’

রাঞ্চ আবার আসনে বসল। তার চোখে তখনও বিস্ময়ের ঘোর। ‘গেটের কাছে গিয়ে আমার বাঁশিটা বাজালাম। তাই শুনে মার্চার এবং আরও দুজন ঘটনাস্থলে হাজির হল।’

‘তখন কি রাস্তা খালি ছিল?’

‘তা—ছিল। কাজেই লোক বলতে কেউ ছিল না।’

‘তুমি কি বলতে চাও?’

কনেস্টবলের মুখে মুচকি হাসি খেলে গেল। বলল, ‘জীবনে অনেক মাতাল আমি দেখেছি, কিন্তু ও ব্যাটার মত পাড় মাতাল কখনও দেখি নি; আমি যখন বেরিয়ে আসি, সে তখন রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর কলম্বাইনের “খোলা নিশান” বা ঐ জাতীয় কোন গান গলা ফাটিয়ে গাইছিল। ব্যাটা পায়ের উপর দাঁড়াতেই পারছিল না, তার সাহায্য করবে কি।’

‘লোকটা কেমন?’ শার্লক হোমস প্রশ্ন করল।

একথায় জন রাঞ্চ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কেমন আবার? বেহদ্দ মাতাল হলে যেমন হয়। তখন যদি আমরা ওরকম ব্যস্ত না থাকতাম তাহলে তো শ্রীমানকে থানায় নিয়ে যেতাম।’

হোমস অধীরভাবে বলে উঠল, ‘তার মুখ—তার পোশাক—সেসব কি লক্ষ্য কর নি?’

‘তা মনে হয় করেছিলাম। আমি আর মার্চারই তো অতি কষ্টে তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়েছিলাম। লোকটা বেশ লম্বা, লাল মুখ, নীচের দিকটা জড়ানো—’

হোমস চেঁচিয়ে বলল, ‘ওতেই হবে। তারপর কি হল?’

পুলিশটি ক্ষুদ্ধ গলায় বলল, ‘তার দিকে নজর দেওয়ার চাইতে অনেক বড় কাজ আমাদের ছিল। আমি বাজী ধরে বলতে পারি, সে ঠিক বাড়ি পৌঁছেছিল।’

‘তার পরনে কি ছিল?’

‘একটা বাদামী ওভারকোট।’

‘হাতে একটা চাবুক ছিল?’

‘চাবুক—না।’

‘নিশ্চয়ই রেখে এসেছিল।’ আমার সঙ্গী নিজের মনেই বলল।

‘তারপরই কোন গাড়ি দেখ নি? বা গাড়ির শব্দ শোন নি?’

‘না।’

‘এই নাও তোমার আধ-গিনি।’ আমার সঙ্গী উঠে দাঁড়িয়ে টুপিটা হাতে নিল। ‘আমার ভয় হচ্ছে রাঞ্চ, পুলিশ-লাইনে তুমি কোনদিন উন্নতি করতে পারবে না। দেখ, তোমার মাথাটা শুধু শোভাই নয়, ওটাকে কাজে লাগাতেও হয়। কাল রাতেই তুমি সার্জেন্টের পদ অর্জন করতে পারতে। কাল যে লোকটিকে তুমি হাত ধরে তুলে-ছিলে সেই এই রহস্যের গুরু আর তাকেই আমরা খুঁজছি। এখন এ নিয়ে তর্ক করে কোন লাভ নেই। আমি বলছি, এটাই ঠিক। চলহে ডাক্তার।’

আমার গাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। কনেস্ট-বলটির মনে তখনও অবিশ্বাস থাকলেও সে বেশ অস্বস্থিত বোধ করতে লাগল।

বাসার দিকে যেতে যেতে হোমস তিক্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘একেবারে বেহদ্দ বোকা! ভেবে দেখ, এমন একটা অতুলনীয় সৌভাগ্য ওর হাতের কাছে এসেছিল, অথচ ও সেটাকে কাজে লাগাতে পারল না।’

‘আমি কিন্তু এখন সেই অন্ধকারেই আছি। এ কথা ঠিক যে, এই রহস্যের দ্বিতীয় পক্ষ সম্পর্কে তোমার ধারণার সঙ্গে এই লোকটির বিবরণ মিলে যাচ্ছে। কিন্তু ঐ বাড়ি থেকে চলে গিয়েও সে আবার ফিরে আসবে কেন? অপরাধীরাও তো এরকম করে না।’

‘ঐ আংটি, বাবা ঐ আংটি। ঐ আংটির জন্যই সে ফিরে এসেছিল। তাকে ধরবার আর কোন পথ যদি না পাই, ওই আংটিটাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। ডাক্তার, আমি তাকে পাবই, বলতে পার পেয়ে গেছি। আর এসবের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি না থাকলে আমি হয় তো সেখানেই যেতামই না। আমর এমন একটা অদ্ভুত-পূর্ব সূক্ষ্ম সমীক্ষা আমার হাতছাড়া হয়ে যেতঃ রক্ত-না কেন? জীবনের বর্ণহীন বস্ত্রের ভিতর দিয়ে বোনা হয়েছে হত্যার একগাছি রক্তববর্ণ সুতো। আমাদের কাজ তাকে আবিষ্কার করা, পৃথক করা, তার প্রতিটি ইঞ্চিকে প্রকাশিত করা। কিন্তু এবার লাঞ্চে যেতে হবে আর সেখান থেকে নর্মান নেরুদার উদ্দেশ্যে। তার প্রতিটি কাজ অনবদ্য। কিরকম আশ্চর্জনকভাবে সে “চপিন”-এর সুর বাজায়ঃ ট্রা—লা—লা—লিরা—লিরা—লে—’

গাড়ির মধ্যে হেলান দিয়ে এই সৌখিন শিকারী কুকুর চাতক পাখির মত গান গেয়ে উঠল। আর আমি মানব মনের বিপুল বৈচিত্র্যের চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *