২১-২৩. স্পেনের বাজার পলায়ন

স্পেনের বাজার পলায়ন রহস্যের জের মিটবার আগেই আর এক দারুণ খবর প্রকাশিত হলো প্যারিসের এক বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকায়।

খবরটির শিরোনাম ছিল–”আলী পাশার হত্যা রহস্য।”

সংবাদদাতা লিখেছিলেন–”জেনিনার সুলতান আলী পাশার মৃত্যু ও জেনিনার পতনের ইতিহাস এতকাল রহস্যাবৃত ছিল, কিন্তু সম্প্রতি এমন কতকগুলো বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ আমাদের হস্তগত হয়েছে যা থেকে আমরা নিঃসন্দেহে জানতে পেরেছি যে, আলী পাশাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়। যে নরপশুর বিশ্বাসঘাতকতায় আলী পাশার মৃত্যু হয়, সে ছিল তারই একজন সেনাপতি। খবরাখবর নিয়ে আরও জানা গেছে যে, ঐ বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি শুধু আলী পাশাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় নাই, সে তাঁর প্রাসাদটিও অরক্ষিত অবস্থায় শত্রুদের হাতে তুলে দেয়। নাটকের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঐ বিশ্বাসঘাতক নরপশু আলী পাশার মহিষী ও তার একমাত্র কন্যা প্রিন্সেস হাইদীকে পাঁচ লক্ষ ফ্রাঁর বিনিময়ে এক দাস-ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে।

গভীর লজ্জার এবং দুঃখের কথা এই যে, ঐ বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি আজ প্যারিসের অভিজাত মহলে কাউন্ট খেতাব নিয়ে সগর্বে বিচরণ করছে।

জনসাধারণ ও সরকারের অবগতির জন্য লোকটির নামও আমরা প্রকাশ করছি। এর আগের নাম ছিল ‘ফার্নাল মন্ডেগু’, যে বর্তমানে কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ নামে পরিচিত।”

***

এই সাংঘাতিক সংবাদটি যখন খবরের কাগজে বের হলো, মহামান্য কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ তখন শাসন-পরিষদের সভায় তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট।

ফ্রান্সের শাসন-সংক্রান্ত ব্যাপারে যে উচ্চতম পরিষদের সদস্যবৃন্দ রাজাকে সুপরামর্শ প্রদান করে থাকেন, কাউন্ট-দ্য মারকার্ফ সেই সভার একজন মাননীয় সদস্য।

সভার কাজ তখন চলছে, এই সময় একজন সদস্যকে সংবাদপত্রের একখানি বিশেষ সংখ্যা হাতে নিয়ে রীতিমত উত্তেজিতভাবে সভাকক্ষে প্রবেশ করতে দেখা গেল। মাননীয় সদস্য সোজা সভাপতির কাছে গিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিম্নকণ্ঠে কি সব বলে সেই কাগজখানা তার হাতে দিলেন।

সভাপতিও গভীর মনোযোগের সঙ্গে খবরের কাগজখানা পড়তে লাগলেন। কাগজখানা পড়বার সময় তার মুখের ভাব মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হতে লাগলো। উপস্থিত সদস্যরা কি ব্যাপার বুঝতে না পেরে মাননীয় সভাপতির মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।

খবরটা পড়া হয়ে গেলে সভাপতি সদস্যদের দিকে তাকিয়ে তার স্বভাবসুলভ গভীরকণ্ঠে বললেন–মাননীয় সদস্যবৃন্দ! এইমাত্র সংবাদপত্রে একটি অতি গুরুতর বিষয় প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টা এতই গুরুতর এবং বিশেষ করে ঐ সংবাদের সঙ্গে আমাদের এই পরিষদের সম্মান এত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যে, আমি এ ব্যাপারটাকে আপনাদের গোচরে না এনে পারছি না।

এই পর্যন্ত বলেই তিনি খবরের কাগজে প্রকাশিত সেই সাংঘাতিক সংবাদটি উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনালেন সদস্যদের কাছে।

পড়া হয়ে গেলে, তিনি বললেন–মাননীয় কাউন্ট-দ্য মারকার্ফ এখন এখানেই উপস্থিত আছেন। আমি তাকে অনুরোধ করছি, তিনি এই জঘন্য হীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদকে অস্বীকার করে সভার সামনে প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করুন যে, সংবাদপত্রে যে সব কথা লেখা হয়েছে ওগুলো একেবারেই মিথ্যা।

সভাপতির এই কথায় উপস্থিত সভ্যবৃন্দ সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন–নিশ্চয়! নিশ্চয়!

কিন্তু কাউন্ট-দ্য-মারকাফের মুখ তখন মৃতের মতো পাণ্ডুর ও রক্তহীন হয়ে গেছে। তিনি কোন কথাই বললেন না।

তাকে নীরব দেখে সভাপতি আশ্চর্য হয়ে বললেন–সে কি কাউন্ট! আপনি চুপচাপ বসে কেন? আপনি যদি প্রকাশ্য সভায় এই সংবাদকে মিথ্যা বলে ঘোষণা না করেন তাহলে আমাকে বাধ্য হয়ে আপনাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিতে হবে! কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ তখন শুষ্ককণ্ঠে বললেন–এ নিশ্চয়ই আমার কোন শত্রুর কাজ।

সভাপতি বললেন–শত্রুর কাজই হোক আর মিত্রের কাজই হোক, এই সংবাদের ভিত্তিতে আমি আপনাকে যদি অভিযুক্ত না করি, তাহলে রাজার কাছে এবং দেশের কাছে আমাকে কর্তব্যভ্রষ্ট হতে হবে। তবে আপনি যদি সংবাদটাকে মিথ্যা ঘোষণা করেন, তাহলে আপনাকে জামিনে খালাস দিতে পারি, এই পর্যন্ত।

কাউন্ট মারকার্ফ বললেন–এ সংবাদ মিথ্যা।

তখন সভাপতি বললেন–বেশ! আপনার ঘোষণার উপরে বিশ্বাস রেখে আপনাকে আমি জামিনে মুক্তি দিচ্ছি। আগামী পরশু এখানেই এই মামলার বিচার আরম্ভ হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের মত দলিলপত্র ও সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আপনি ঐ দিন অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন। খবরের কাগজের আফিসেও আমি সমন পাঠাচ্ছি। তাদের আফিসে যদি এই মামলার কোন সাক্ষী থাকে, তাকে পাঠাতে অনুরোধ করে ব্যক্তিগতভাবে একখানি চিঠিও আমি দিচ্ছি সম্পাদককে।

বিচার সভা। বারজন সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠিত হয়েছে এই অসামান্য চাঞ্চল্যকর মামলাটির বিচার করবার জন্য।

কাউন্ট-দ্য-মারকাকে দেখা গেল আসামীর কাঠগড়ার পাশে একখানা চেয়ারে বসে থাকতে। তার হাতে এক বান্ডিল কাগজ।

আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলো শেষ হতেই সভাপতি বললেন– আসামী ফার্নান্দ মন্ডেগু ওরফে কাউন্ট-দ্য-মারকা! আপনার বিরুদ্ধে যে সাংঘাতিক অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রতিলিপি আপনাকে আগেই দেওয়া হয়েছে। তবুও আর একবার অভিযোগগুলো আপনাকে শুনিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই বলে অভিযোগপত্রটি তুলে নিয়ে উচ্চকণ্ঠে পাঠ করে তিনি বললেন–আসামী ফার্নান্দ মন্ডেণ্ড! আপনি দোষী না নির্দোষ? কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন–নির্দোষ।

–বেশ। তাহলে আমি আপনাকে সুযোগ দিচ্ছি নির্দোষিতা প্রমাণ করতে। আশা করি, আপনি যে নির্দোষ একথা প্রমাণ করতে পারবেন।

–নিশ্চয়ই ধর্মাবতার, আমার কাছে যে দলিলপত্রাদি আছে তা থেকে আমি সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণ করতে পারব যে আমি এ ব্যাপারে একেবারেই নির্দোষ। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার হাতের এই দলিলগুলো পড়ে শোনাতে পারি।

সভাপতি বললেন–পড়ুন।

কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ তখন একে একে সেই দলিলগুলো বিচারকদের পড়ে শোনাতে লাগলেন।

দলিলগুলো থেকে জানা গেল যে, আলী পাশা তাঁকে এত বেশি বিশ্বাস করতেন যে, নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে রক্ষা করবার ভার পর্যন্ত তাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন। এমন কি আলী পাশার অন্তঃপুর অবধি তার ছিল অবাধ গতিবিধি। সভাপতি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন এই সময়–কিন্তু এ থেকে পাশার মৃত্যু বা তার স্ত্রী কন্যার নিরুদ্দেশের কোন খবরই তো জানা যাচ্ছে না।

কাউন্ট বললেন–তা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু সেনা বিভাগের রিপোর্ট থেকে জানতে পারবেন যে আলী পাশার মৃত্যুর পর যখন প্রাসাদ আক্রান্ত হয়, আমি তখন পাশার পক্ষ থেকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে শত্রুপক্ষের রাজার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এই বলে আলী পাশার স্বাক্ষরিত একখানি অনুজ্ঞাপত্র ও সেনা বিভাগের কোন পদস্থ অফিসারের স্বাক্ষরিত একখানি রিপোর্ট আদালতে দাখিল করলেন তিনি।

সভাপতি যখন সেই দলিল দুখানা পড়ছেন, ঠিক সেই সময়ে একজন পত্রবাহক একখানা পত্র এনে তার হাতে দিল।

চিঠিখানা পড়ে সভাপতি আশ্চর্য হয়ে পত্রবাহককে বললেন–তাকে নিয়ে এসো।

একটু পরেই দেখা গেল একজন বোরখাবৃতা মহিলা একজন পরিচারিকার সঙ্গে ধীর পদক্ষেপে আদালত কক্ষে প্রবেশ করছেন। মহিলা সভাপতির সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন–আপনিই লিখেছেন চিঠিখানা?

বীণানিন্দিত কণ্ঠে সেই বোরখার ভিতর থেকে উত্তর এলো—হ্যাঁ।

সভাপতি বললেন–বেশ! আমরা আপনার কথা শুনবো।

এই বলেই অন্যান্য বিচারকদের লক্ষ্য করে এবং আসামীকে শুনিয়ে তিনি বললেন–এই মহিলা বলছেন যে ইনি পরলোকগত আলী পাশার কন্যা। ইনি এই আদালতে নিজের ইচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে এসেছেন।

সভাপতির মুখ থেকে এই কথা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আদালত কক্ষে এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। বিচারকবৃন্দ, দর্শকদল এবং আসামী সবাই একসঙ্গে তাকালেন সেই বোরখাবৃতা মহিলাটির দিকে।

সভাপতি সেই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন–আপনার যদি বিশেষ আপত্তি না থাকে, তাহলে আপনার মুখের আবরণটা সরিয়ে ফেলুন।

মহিলাটি তখন তার বোরখা খুলে ফেললেন আদালতে দাঁড়িয়েই।

সবাই বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, মহিলাটি অপূর্ব সুন্দরী।

সভাপতি তখন জিজ্ঞাসা করলেন–আপনার নাম?

–পিতা বেঁচে থাকতে আমার নাম ছিল জেনিনার শাহজাদী হাইদী।

–”পিতা বেঁচে থাকতে” বলছেন কেন?

–কারণ পিতার মৃত্যুর পর আমাকে এবং আমার মাকে এক দাস-ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়।

এই সময় আসামী পক্ষের উকিল হঠাৎ প্রশ্ন করেন–কিন্তু আপনি যে স্বৰ্গত আলী পাশার কন্যা তার কোন প্রমাণ আছে?

প্রিন্সেস হাইদী মৃদু হেসে বললেন–আছে বৈ কি! এই দেখুন আমার জন্মের সার্টিফিকেট (Birth Certificate)। আর এই দেখুন আমার বাপ্তাইজ হবার সার্টিফিকেট।

এই বলে দুখানা সার্টিফিকেট সভাপতির টেবিলে রাখলেন তিনি।

আসামী পক্ষের উকিল সেই কাগজ দুখানি সভাপতির কাছ থেকে নিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে আবার জিজ্ঞাসা করলেন–কিন্তু আপনার বাবা মুসলমান হয়েও আপনাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন–এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

–অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। আপনারা হয়তো জানেন যে, আমার বাবা মুসলমান হলেও আমার মা ছিলেন খ্রিষ্টান।

–কিন্তু এ থেকে কি করে বোঝা যায় যে, আপনিই প্রিন্সেস হাইদী?

–তা যায় না বটে, তবে যাতে জানা যায়, সে ব্যবস্থাও আমি করে এসেছি। আমার হাতের এই সর্বশেষ ও সর্বপ্রধান দলিলখানা পড়ে দেখলেই আপনারা জানতে পারবেন যে, কি সাংঘাতিক অন্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমাদের উপরে। আমাকে আর আমার মাকে ক্রীতদাসীরূপে বিক্রি করা হয়েছিল অল কবীর নামে একজন দাস-ব্যবসায়ী মুসলমানের কাছে। পাঁচ লক্ষ ঐ দামে আমাদের দুজনকে বিক্রি করা হয়।

এই সময় কোন একজন দর্শক বলে উঠলেন–কী সাংঘাতিক!

দর্শকের সেই কথার জের টেনে প্রিন্সেস হাইদী বললেন–শুধু সাংঘাতিকই নয়, এ রকম অমানুষিক বিশ্বাসঘাতকতা সভ্যজগতে বোধ হয় আজ পর্যন্ত আর কোথাও দেখা যায়নি।

এই সময় সভাপতি বললেন–আপনার হাতের ঐ দলিলখানা দেবেন কি?

–নিশ্চয়ই দেব ধর্মাবতার, কিন্তু দেবার আগে দলিলখানা এই প্রকাশ্য আদালতে একবার পড়ে শোনাতে চাই আমি। এই বলেই দলিলখানা পড়তে আরম্ভ করলেন প্রিন্সেস হাইদী–

“আমি জেনিনার সৈন্যাধ্যক্ষ ফার্নান্দ মন্ডেগু সজ্ঞানে ও সুস্থ শরীরে নিহত আলী পাশার স্ত্রী ও কন্যাকে নগদ পাঁচ লক্ষ ফ্রাঁর বিনিময়ে দাস-ব্যবসায়ী অল কবীরের নিকট বিক্রয় করিলাম।”

দলিলখানা পড়া শেষ হতেই কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ আর্তনাদ করে উঠলেন–মিথ্যা কথা! সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা! ও দলিল জাল।

প্রিন্সেস হেসে বললেন–একথা আমি আগেই জানতাম যে, এই দলিলকে জাল বলা হবে, তাই আমি অল কবীরকেও আদালতে নিয়ে এসেছি। মাননীয় বিচারপতির অনুমতি পেলেই তাকে এখানে হাজির করতে পারি।

সভাপতি বললেন–আসতে বলুন তাকে।

সভাপতির অনুমতি পেয়ে প্রিন্সেস হাইদী তাঁর সহচরীকে কি যেন ইঙ্গিত করলেন। সহচরী সঙ্গে সঙ্গে আদালত থেকে বের হয়ে গেল। একটু পরেই একজন মধ্যবয়স্ক মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো সে। সভাপতি জিজ্ঞাসা করলেন– আপনার নাম?

–অল কবীর!

–এই মহিলাকে আপনি চেনেন?

–চিনি ধর্মাবতার।

–কি করে?

–ওঁকে এবং ওঁর মাকে আমার কাছে পাঁচ লক্ষ ফ্ৰাঁ মূল্যে বিক্রি করা হয়েছিল।

–এঁর মা এখন কোথায়?

–তিনি মারা গেছেন।

–কে বিক্রি করেছিল এঁদের?

–জেনিনার একজন সেনাধ্যক্ষ। তার নাম ফার্নান্দ মন্ডেগু।

–দেখুন তো, এখানে সে লোক আছে কি না?

সভাপতির নির্দেশে আল কবীর আদালত কক্ষের চারদিকে দৃষ্টিপাত করে হঠাৎ কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললো–ঐ সেই লোক!

অল কবীর কাউন্ট-দ্য-মারকাকে সনাক্ত করবার সঙ্গে সঙ্গেই আদালত কক্ষে মৃদু গুঞ্জন উঠলো। সেই গুঞ্জনধ্বনির মধ্যে দুটি কথা স্পষ্টভাবে শোনা গেল—

“বিশ্বাসঘাতক!” “নরপশু!”

সভাপতি তখন আবার বললেন–দেখুন তো, প্রিন্সেস-এর হাতের ঐ দলিলখানা আসল দলিল কি না!

সভাপতির নির্দেশে প্রিন্সেস হাইদীর হাত থেকে দলিলখানা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে সে বললো–হ্যাঁ ধর্মাবতার, এই সেই দলিল!

এই সময় আসামী পক্ষের উকিল তাকে প্রশ্ন করলো–এ দলিল ঐ মহিলার হাতে কি করে গেল বলতে পারেন?

অল কবীর বললো–না, তা আমি বলতে পারি না। ঐ দলিল আমি কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোকে দিয়েছিলাম।

–কাউট অ মন্টিক্রিষ্টোকে দিয়েছিলেন! কেন বলুন তো?

–মোটা দাম পেয়ে। তিনি আমাকে আট লক্ষ ফ্রাঁ দিয়ে দলিলখানা সহ ঐ মহিলাকে কিনে নিয়েছিলেন।

এই সময় সভাপতি প্রিন্সেস হাইদীর দিকে তাকিয়ে বললেন –একথা কি সত্য?

–হ্যাঁ, ধর্মাবতার! সম্পূর্ণ সত্য। কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোই আমার বর্তমান প্রভু।

সভাপতি তখন তীব্র দৃষ্টিতে কাউন্ট-দ্য-মারকার্যের দিকে তাকিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন–আপনার কিছু বলবার আছে?

কাউন্ট নীরব।

সভাপতি তখন বিচার-সভার অন্যান্য সদস্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন–এইবার আপনাদের বলতে হবে, আসামী কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ ওরফে ফানা মন্ডেগু দোষী না নির্দোষ। সবাই একসঙ্গে উচ্চারণ করলেন–”দোষী”!

.

২২.

স্পানিশ হুণ্ডীর ব্যাপারে ব্যারন ড্যাংলার সর্বস্বান্ত হলেও বাইরে তিনি তা প্রকাশ হতে দেননি। তার ধারণা হয়েছিল যে, আবার তিনি সামলে নিতে পারবেন। তাই এদিকে যখন সারা প্যারিসে ফানা মন্ডের মামলা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে, সেই অবসরে তিনি ইটালীর কোটিপতি মেজর ক্যাভালকান্টির পুত্র এন্ডি ক্যাভালকান্টির সঙ্গে তাঁর মেয়ে ইউজিনির বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন। খুব গোপনেই তিনি এই চালটি চেলেছিলেন, কারণ তার ধারণা হয়েছিল যে, এই বিয়ের ফলে মেজর ক্যাভালকান্টির অগাধ ঐশ্বর্য তার ব্যাঙ্কে এনে ফেলে ঐ অর্থের সাহায্যেই আবার অবস্থা ফেরাতে পারবেন। বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গিয়েছিল।

নির্ধারিত দিনে বর-কনে ও আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে গীর্জায় হাজির হলেন ড্যাংলার। অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গেল।

পুরোহিত “বিবাহ সমাপ্ত হয়েছে” এই কথাটা ঘোষণা করবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ একদল পুলিশ সহ একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসে হানা দিলেন সেখানে।

ম্যাজিস্ট্রেট এন্ট্রি ক্যাভালকান্টিকে দেখিয়ে পুলিশদলকে হুকুম করলেন–গ্রেপ্তার করো ওকে!

হুকুমের সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশদল এগিয়ে এসে বরবেশী এন্ট্রি ক্যাভালকান্টির হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।

ব্যারন ড্যাংলার চিৎকার করে বলে উঠলেন–এ সব কি হচ্ছে জানতে পারি কি?

ম্যাজিস্ট্রেট বললেন–নিশ্চয়ই! পলাতক খুনী আসামী বেনডেটোকে গ্রেপ্তার করা হলো।

–বেনডেটো! পলাতক খুনী আসামী! কি বলছেন আপনি?

–ঠিকই বলেছি ব্যারন। এন্ট্রি ক্যাভলকান্টি ছদ্মনামে যে লোকটি এখানে উপস্থিত আছে, সে একজন জেলখাটা দাগী এবং পলাতক খুনী আসামী।

এই বলে একটু হেসে ম্যাজিস্ট্রেট আবার বললেন–আমি খুবই দুঃখিত ব্যারন, কিন্তু কি করবো, কর্তব্যের খাতিরে আমি একে গ্রেপ্তার না করে পারি না।

এন্ড্রিকে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইউজিনি অস্ফুট আর্তনাদ করে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়লো, আর ব্যারন ড্যাংলার দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন সেখানে।

এই সময় হঠাৎ কাউন্ট অল্ মন্টিক্রিষ্টো সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন যে, বহুদিন আগে মার্সেঈ-এর গীর্জায় এক বিবাহ সভাতেও ঠিক এই রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। একটা ক্ষীণ হাসির রেখা তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনের ভাব গোপন করে তিনি ইউজিনির কাছে ছুটে গেলেন।

তিনি দেখলেন–ইউজিনি অজ্ঞান হয়ে গেছে।

.

এ ইউজিনির বিয়ের এই মুখরোচক খবরটা পরদিন সকালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার ফলে ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কে ‘রান’ আরম্ভ হয়ে গেল।

ড্যাংলার যখন বুঝতে পারলেন যে আর রক্ষা নেই, তখন তিনি তাড়াতাড়ি ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর নোট পকেটস্থ করে পিছনের গুপ্ত দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেন। পালিয়ে যাবার আগে স্ত্রী কন্যার কথা একবার তার মনে হলেও, “আপনি বাঁচলে বাপের নাম” এই প্রবাদবাক্যটি স্মরণ করে, তাদের ফেলে রেখেই পালিয়ে গেলেন তিনি।

***

ইউজিনির বিবাহ সভা থেকে বাড়িতে ফিরতেই কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো খবর পেলেন যে ভাইকাউন্ট আলবার্ট তার জন্য বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছেন।

এই খবর শুনে কাউন্ট বৈঠকখানায় গিয়ে আলবার্টকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন কি খবর ভাইকাউন্ট! আপনি হঠাৎ?

আলবার্ট বললো–ভদ্রতার মামুলি বুলি কপচে দরকার নেই কাউন্ট, আমি আপনার কাছে কৈফিয়ৎ চাই।

–কৈফিয়ৎ!

–হ্যাঁ, কৈফিয়ৎ। আমার বাবাকে লোকচক্ষে হেয় করে আমাদের বংশের সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন আপনি। এ অপমানের প্রতিশোধ আমি নেব। আমি আপনাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছি।

–বেশ! তাই হবে। আমি সর্বদাই প্রস্তুত।

–ভাল, কাল সকালেই আমাদের দেখা হচ্ছে তাহলে!

সেই রাত্রেই।

কাউন্ট অব্‌ মন্টিক্রিষ্টো অন্যমনস্কভাবে একখানা তলোয়ার হাতে নিয়ে তার ধার পরীক্ষা করছিলেন, এই সময় এক অবগুণ্ঠিতা মহিলার আবির্ভাব হলো সেই ঘরে।

মহিলাটির দিকে তাকিয়ে কাউন্ট বললেন–আপনি কে মাদাম?

অপরিচিতা মহিলাটি হঠাৎ তার মুখের উপরের অবগুণ্ঠন সরিয়ে ফেলে দিয়ে বললেন–আমি তোমার কাছে আমার ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইতে এসেছি এডমন্ড।

–আপনি! কাউন্টেস্-দ্য-মারকা! আপনি এখানে?

–কাউন্টেন্স-দ্য-মারকার্ফ নই এডমন্ড। আমি মার্সেদেস।

–মার্সেদেস! না না, সে নেই, সে বহুদিন আগে মারা গেছে। তাছাড়া, আমাকে আপনি এডমন্ড নামেই বা ডাকছেন কেন? কাউন্টের এই কথায় মার্সেদেস তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো–আমাকে তুমি ক্ষমা করো এডমন্ড। তুমি যদি জানতে যে কতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে বিয়ে করেছে ফার্নান্দ… কিন্তু থাক সে কথা, আমি শুধু তোমার কাছে আমার ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইতে এসেছি আজ।

তুমি তাহলে জানতে যে আমিই এডমন্ড দান্তে।

–হ্যাঁ, এডমন্ড! তোমাকে যেদিন প্রথম আমাদের বাড়িতে দেখি, সেই দিনই আমি তোমাকে চিনতে পারি; কিন্তু সে কথা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি। তোমার সামনে সেদিন আমি বেরও হইনি। ইচ্ছা করেই বের হইনি। এডমন্ড! তুমি যদি জানতে…

–সবই আমি জানি মার্সেদেস। যাইহোক, আমি কথা দিচ্ছি কাল তোমার ছেলে জয়ী হয়ে বাড়িতে ফিরবে। আমিই কাল তার হাতে প্রাণ দেব।

–না, তোমাকে আমি মরতে দেব না!

–সে কি! আমি না মরলে আলবার্ট কি করে জয়ী হবে?

–তোমাদের মধ্যে যুদ্ধ হবে না। আমি তা হতে দেব না। (তামার সঙ্গে আমার ছেলের দ্বন্দ্বযুদ্ধ…এ কিছুতেই হতে পারে না; না–না–না।

এই বলেই মার্সেদেস ছুটে বেরিয়ে গেল সেই ঘর থেকে। কাউন্ট ধীরে ধীরে হাত থেকে তলোয়ারখানা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলেন।

***

পরদিন সকালেই আলবার্ট এসে দেখা করলো কাউন্টের সঙ্গে। কাউন্টকে একা একটা ঘরে ডেকে নিয়ে সে তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো–আমাকে আপনি ক্ষমা করুন কাউন্ট! কাল রাত্রে মায়ের কাছে আমি সব কথা শুনেছি।

কাউন্ট আলবার্টের হাত ধরে তুলে বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন! তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হলো না।

কাউন্টের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে যেতেই মার্সেদেস তাকে বললো–তৈরি হয়ে নাও আলবার্ট, আমাদের এখনই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। রাস্তায় গাড়ি অপেক্ষা করছে। যাবার সময় আলবার্ট ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তার বাবার মুখের দিকে তাকালো একবার। তারপর নিঃশব্দে মায়ের সঙ্গে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

ওদের গাড়িখানা ফটক পার হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ফার্নান্দ পকেট থেকে পিস্তল বের করে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে গুলি করলো।

সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাণহীন দেহটি লুটিয়ে পড়লো মেঝের উপরে।

.

২৩.

এদিকে এন্ট্রি ক্যাভালকান্টির বিচার-সভায় আর এক চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। বিচারক যখন তার বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন, তখন সে নিঃসঙ্কোচে প্রকিওরার-দ্য-রোয়া আঁসিয়ে ভিলেফোর্টের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো–উনিই আমার বাবা।

এরপর আরও যে সবচাঞ্চল্যকর বিবরণ আদালতে প্রকাশ করলো সে, তাতে জানা গেল যে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট একজন দুশ্চরিত্র, লম্পট, জালিয়াং এবং নরহত্যাকারী। ব্যারনেস ড্যাংলারের সঙ্গে তার অবৈধ প্রণয়ের কথাটাও ফাঁস হয়ে গেল আদালতে।

এইসব ব্যাপারে সেদিন কোর্ট থেকে পাগলের মত ছুটে এসে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করলেন, তারপর দুটো দিন পার হয়ে গেলেও সে দরজা তিনি খুললেন না।

ব্যাপার দেখে ভয় পেয়ে বাড়ির লোকেরা যখন দরজা ভেঙে সেই ঘরে ঢুকলো, তখন দেখা গেল, মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট মেঝের উপর দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে নিজের মাথার চুলগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ছেন। তিনি তখন রীতিমত উন্মাদ।

.

এইভাবে এডমন্ডের দুজন শত্রু নিপাত হবার পর বাকি থাকলো শুধু ড্যাংলার। এডমন্ড জানতে পেরেছিল (এখন থেকে আমরা কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোকে এডমন্ড বলেই অভিহিত করবো) যে ড্যাংলার ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে।

সে তখন গোপনে দস্যু-দলপতি লুইগি ভাম্পার সঙ্গে দেখা করে ড্যাংলারকে খুঁজে বের করতে অনুরোধ করলো। লুইগি ভাম্পাকে এডমন্ড বহুবার বন্ধুভাবে সাহায্য করেছিল বলে সে এডমন্ডের কাছে কৃতজ্ঞ ছিল, তাই এডমন্ডের অনুরোধে সে ভিয়েনার পথ থেকে ড্যাংলারকে ধরে এনে কয়েদ করে রাখলো।

চার দিন নির্জলা উপবাসে রাখবার পর ড্যাংলারের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ আদায় করে এক প্লেট খাবার দিলে লুইগি ভাম্পা।

পাঁচ দিনের মাথায় এডমন্ড এসে তার সঙ্গে দেখা করলো। তাকে দেখে ড্যাংলার অবাক হয়ে বললেন–একি! আপনি এখানে!

এডমন্ড বললো–হ্যাঁ! লুইগি ভাম্পা আমার বিশেষ বন্ধ কি না! তাই দেখা করতে এসেছি তার সঙ্গে।

এডমন্ডের কথা শুনে ড্যাংলার যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল। সে বললো–দেখুন দেখি, দস্যুরা আমাকে অকারণে বন্দী করে রেখেছে। আমার সব টাকা কেড়ে নিয়ে আমাকে এরা না খাইয়ে রেখেছে।

এডমন্ড বললো–আপনার তাহলে খুব খিদে পেয়েছে, কেমন?

–হ্যাঁ কাউন্ট, ভয়ানক খিদে পেয়েছে।

–খুব কষ্ট হচ্ছে, না?

–খুব।

–তাহলে কষ্ট কাকে বলে বুঝতে পারছো কিছু কিছু? বন্দীজীবনে না খেয়ে থাকলে মনের অবস্থা কেমন হয় তাও কিছু কিছু বুঝেছো, তাই না?

কাউন্টের মুখে এই রকম বেসুরো কথা শুনে ড্যাংলার যেন হকচকিয়ে গেল। কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বের হলো না। এডমন্ড বলে চললো–মনে করে দেখ ড্যাংলার, তুমি একজন নির্দোষ যুবকের কী সর্বনাশ করেছিলে! জাল চিঠি পাঠিয়ে তাকে তুমি বিয়ের দিনে গ্রেপ্তার করিয়েছিলে, মনে আছে সে কথা? ভাবতে পারো কি যে, তোমার ষড়যন্ত্রের ফলে সেই হতভাগ্য যুবক কারাগারে বসে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, তিলে তিলে মৃত্যুর জন্য দিন গুনেছে। আর এদিকে তুমি ব্যারন সেজে সমাজের বুকের উপর বসে অত্যাচারের রথ চালিয়ে দিয়েছো! তুমি, তোমার বন্ধু ফার্নান্দ মন্ডেগু আর তোমাদের পাপ কাজের সহায়ক ভিলেফোর্ট এই তিন শয়তান একটি নির্দোষ হতভাগ্য যুবকের সর্বনাশ করে কেউ কাউন্ট, কেউ ব্যারন আর কেউ সরকারী প্রকিওরার সেজে ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলেছিলে… মনে পড়ে সে সব কথা?

–আপনি!…..কে আপনি…?

–এখনও চিনতে পারছো না আমাকে শয়তান! আমি সেই, যাকে তুমি বিবাহ-সভা থেকে ধরিয়ে দিয়েছিলে, আমি সেই, যার বাগদত্তা বধূকে তোমার কুকর্মের সহায়ক ফার্নান্দ মন্ডেগু বিশ্বাসঘাতকতা করে বিবাহ করেছিল; আমি সেই, যাকে তোমার বন্ধু ভিলেফোর্ট কারাগারে পাঠিয়েছিল তার বাবার যড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়ে; আমি সেই, যে ফার্নান্দের কীর্তি-কাহিনী প্রকাশ করে দিয়ে তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। আমি সেই, যে তোমার প্রাণের বন্ধু ভিলেফোর্টের মুখোশ খুলে দেওয়ায় সে আজ উন্মাদ…আমি সেই এডমন্ড দান্তে!

এডমন্ডের মুখে তার নাম শুনে ড্যাংলারের বুকটা কেঁপে উঠলো। সে তখন তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলে উঠলো–এডমন্ড! আমাকে তুমি ক্ষমা করো।

ড্যাংলারের এই কথায় হা-হা করে হেসে উঠে এডমন্ড বললো

–ক্ষমা! হ্যাঁ, আমি তোমাকে ক্ষমাই করবো!

এই বলে লুইগি ভাম্পার দিকে তাকিয়ে সে বললো আমার এই উপকারী বন্ধুটির আরামের দিকে দৃষ্টি রেখো। কাল সকালে আমি আবার এসে এর সম্বন্ধে যা হয় ব্যবস্থা করবো।

.

পরদিন সকালে এডমন্ড এসে আবার যখন দেখা করলো ড্যাংলারের সঙ্গে তখন ড্যাংলারের মাথার সবগুলো চুল সাদা হয়ে গেছে। এক রাত্রের মধ্যেই তার বয়স যেন ত্রিশ বৎসর বেড়ে গেছে। এডমন্ড তখন তার হাতে পাঁচটি ফ্ৰাঁ তুলে দিয়ে বললো–নাও, এই পাঁচ ফ্রাঁ নিয়ে আবার মানুষের সর্বনাশ করে বেড়াও গে। তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম।

-: সমাপ্ত :-

2 Comments
Collapse Comments

Awesome

Such an nice story. True classic

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *