কাছে-দূরে
৩৯·
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জুন মাসের শেষে-সম্ভবত তাঁদের শেষ কার্যদিবসে-জাহানারা ইমাম ও অপর ২৩ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা প্রত্যাহার করে নেন। সংবাদপত্রে পড়ার আগে এ-বিষয়ে আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। ফৌজদারি অভিযোগ মাথায় নিয়ে চলা যে কী দায়, ততদিনে তা বেশ বুঝতে পেরেছি। সুতরাং প্রধান উপদেষ্টার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেছি, সকলে এটা ভালোভাবে নেয়নি; কেউ কেউ মনে করেছেন, এতে তাঁর ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাত প্রকাশ পেয়েছে, হয়তো বা দুইই।
আপাতত আমি আছি হৃষ্টচিত্তে। সেই প্রফুল্লতা নিয়েই আগস্টের গোড়ার দিকে জার্মানি রওনা হলাম। বার্লিনে আয়োজিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে দুদিনের আলোচনা-সভা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাচ্ছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য দিলীপকুমার সিংহ, বিশ্বভারতীর দুই প্রাক্তন উপাচার্য নিমাইসাধন বসু ও অ্লান দত্ত এবং বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রদের শিরোমণি অমিতাভ চৌধুরী। ঢাকা থেকে নিমন্ত্রিত সন্জীদা খাতুন ও আমি। যাত্রাপথ সরল নয়। আমাদের দুজনকে যেতে হবে ঢাকা থেকে কলকাতা, তারপর বাকি চারজনের সঙ্গে সেখান থেকে এরোফ্লোতে দিল্লি ও মস্কো হয়ে বার্লিন। এরোফ্লোতের কলকাতা-দিল্লি ফ্লাইট বেশ বাজে। উড়োজাহাজে কিছুই পাওয়া যায় না, সৌজন্যও নয়। দিল্লি বিমানবন্দরে নিজের পয়সায় তৃষ্ণা নিবারণ করা গেল। দিল্লি-মস্কো-বার্লিন ফ্লাইট বরঞ্চ সহনীয়।
বার্লিনে মামুন নামে এক বাংলাদেশি তরুণের বাড়িতে সন্জীদা খাতুন ও আমার থাকার ব্যবস্থা। তার স্ত্রী বা বান্ধবী এলিজাবেথ জার্মান। ভদ্রমহিলা কিঞ্চিৎ বয়স্কা, পূর্ববিবাহের সূত্রে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়গামী এক কন্যা আছে-মেয়েটির ঝোঁক যন্ত্রসংগীতে, পরে তার সঙ্গেও একদিন দেখা হয়েছিল। গৃহকর্ত্রী ইংরেজি খুব সামান্য জানেন, সবার সামনে তা বলতে সংকোচ বোধ করেন, তবে সর্বদা হাসিমুখ এবং আমাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়ে তীক্ষ্ন নজর রাখেন। মামুন বেশ কিছুকাল এদেশে আছে, চাকরি করে লুফ্ট্হান্সায়, প্রয়োজনের অধিক সমাদর করে। মামুনরা থাকতো পূর্বতন পূর্ব বার্লিনে-পশ্চিমের চেয়ে তা খানিকটা মলিন, ভাঙা জার্মানি জোড়া লাগার পাঁচ-ছ বছর পরেও সে-পার্থক্যের চিহ্ন সুস্পষ্ট।
আমরা পৌঁছবার খানিক পরে মামুন জানালো, তসলিমা নাসরিন আমার খোঁজে ফোন করেছিল, আমি এসে তার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলি-এই অনুরোধ জানিয়ে রেখেছে। এটা খানিকটা প্রত্যাশিত ছিল। তসলিমার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও ভালোই পরিচয় ছিল। পরিচয় হয়েছিল শামসুর রাহমানের মারফত, সাগর পাবলিশার্সে। আমার বাড়িতে ৩১ জন নাগরিকের সভা শেষ করে শামসুর রাহমানের প্রয়োজনে সেখানে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তসলিমা তখন শান্তিনগর বাজারের কাছে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের একটি ফ্ল্যাটে থাকে। সে খুব চাইছিল শামসুর রাহমানকে সেখানে নিয়ে যেতে। শামসুর রাহমান সেই সন্ধ্যায় তার বাড়ি যেতে চাইছিলেন না, কিছুটা হয়তো আমি তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে। পরে তসলিমার সঙ্গে আমার অনেকবার যোগাযোগ হয়েছে। আমার এক বন্ধু-দম্পতি তার সঙ্গে আলাপ করতে খুব আগ্রহী ছিল। আমার অনুরোধে তসলিমা তাদের আতিথ্যগ্রহণে সম্মত হয়, আমিই তার ফ্ল্যাট থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাই এবং ফিরিয়ে আনি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়-আবাসে সে কয়েকবার এসেছে, একাধিকবার সবান্ধব। একবার কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রসঙ্গত বলেছিলাম, আমি তসলিমার কবিতা ও কলামের গুণগ্রাহী, তবে তার উপন্যাসের নই। ঢাকায় ফিরে আসতে-না-আসতে তসলিমার ফোন পেলাম-তার উপন্যাস কেন ভালো লাগে না তার কারণ দর্শাতে। ধর্মান্ধ ব্যক্তির দল যখন তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে, তখন অনেকের সঙ্গে আমিও তার লেখার ও ভাবপ্রকাশের অধিকারের সমর্থনে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছি।
বার্লিনে তসলিমাকে ফোন করায় সে জানতে চাইলো তার বিরুদ্ধে মামলা সম্পর্কে কোনো খবর আছে কি না। আমি বললাম, শামসুর রাহমান তাকে জানাতে বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তসলিমার মামলা নিয়ে শামসুর রাহমান নিজেই কথা বলেছেন। শেখ হাসিনা তাঁকে বলেছেন, তসলিমা দেশে ফিরে মামলার মুখোমুখি হোক। সরকার তেমন জোরের সঙ্গে মামলা লড়বে না, ফলে তসলিমা ছাড়া পেয়ে যাবে। তবে সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক কারণেই তসলিমার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভবপর নয়।
আমার কথা শুনে তসলিমা বেশ বিমর্ষ হলো। সে আশা করেছিল, সরকার মামলা তুলে নেবে-এমন একটা প্রতিশ্রুতির খবর আমি তাকে দেবো। সে বললো, মামলা মাথায় নিয়ে সে দেশে ফিরবে না, ফিরলে যে-কোনো সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। যে-সরকার রাজনৈতিক কারণে মামলা তুলতে সাহস করে না, রাজনৈতিক কারণেই হয়তো সে-সরকার মত বদলে তার বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা নিতে পারে। আমি বললাম, সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে, তবে সরকারের বৈরিতার কোনো কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি না। সে বললো, সরকারের ওপর সে ভরসা রাখতে পারছে না। সুতরাং সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত সে দেশে ফিরবে না।
তসলিমাকে আমি আর কী বলতে পারি! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার সঙ্গে কি দেখা হবে?’ সে বললো, ‘বোধহয় না।’ আমি তার কাছ থেকে টেলিফোনেই বিদায় নিলাম।
একদিন পর তসলিমা আবার ফোন করলো। বললো, অ্লান দত্ত তার বাড়ি যাচ্ছেন। আমি যদি একই সময়ে সেখানে যাই, সে খুশি হবে। আগের বারের কথোপকথনের শেষটা আমার মনে পড়ল। বললাম, আমি পেরে উঠব না।
বার্লিনে আর যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হলো, তাঁদের মধ্যে সুনীল দাশগুপ্তের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। তখনই তাঁর বয়স হয়েছে। তিনি ভারতীয় নাগরিক, বিয়ে করেছেন জার্মান, কিন্তু জ্নভূমি বরিশালকে ভোলেননি। সেই সূত্রে বাংলাদেশের সকলের সঙ্গে তাঁর বেজায় ভাব। দীর্ঘকাল কমিউনিস্ট রাজনীতি করেছেন, এখন আর রাজনীতিতে নেই। সৈয়দ মুজতবা আলীর চাচাকাহিনীর মূল চরিত্র, শুনেছি, তাঁরই পিতৃব্যের আদলে আঁকা। সুনীলদার স্ত্রী বারবারা ভালো বাংলা বলেন, বাংলা সাহিত্যের অনুবাদও করেছেন জার্মান ভাষায়।
শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের স্ত্রী উটাও জার্মান-তাদের দুটি সন্তান। ওয়াকিল স্বল্পভাষী, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির, তবে খুবই সহৃদয় মানুষ।
আমাদের সফরসঙ্গীদের মধ্যে অ্লান দত্তের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘকালের। তিনি যেমন পণ্ডিত, তেমনি সজ্জন। নিমাইসাধন বসুর সঙ্গে আগে ঢাকায় পরিচয় হয়েছিল, দেখলাম তিনি তা ভোলেননি। দিলীপকুমার সিংহ গণিতের অধ্যাপক, কথা কম বলেন, রবীন্দ্রসংগীত গান বেশি। অবাক হয়ে লক্ষ করি শান্তিনিকেতনের সঙ্গে দীর্ঘকাল সংস্রবের পরেও অমিতাভ চৌধুরীর কথায় সিলেটি টান রয়ে গেছে। তিনি জানতে চান, আমি মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে চিনতাম কি না। বললাম, জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম, উপরন্তু তাঁর বড়ো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার ছোটো মেয়ের। অমিতাভ চৌধুরী এক ঝটকায় আপনি থেকে তুমিতে চলে এলেন, ‘তাহলে তো তুমি আমার বেয়াই।’ অনতিবিলম্ব দিলীপ সিংহকে আক্রমণঃ ‘দিলীপ, তুমি আমার বেয়াইকে বিশ্বভারতীতে নিয়ে আসছ না কেন?’ দিলীপ সিংহ হতভম্ব, কে যে অমিতাভ চৌধুরীর বেয়াই, তা তিনি ঠাহর করে উঠতে পারেন না। পরদিন আবার দিলীপ সিংহের প্রতি অমিতাভ চৌধুরীঃ ‘এই যে দিলীপ, আমার বেয়াইকে বিশ্বভারতীতে আনছ কবে?’ নিরুপায় উপাচার্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয় আনবো। আপনি অনুগ্রহ করে আপনার একটা সিভি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন?’ আমি বলি, ‘অবশ্যই’, যদিও জানি পাঠাবো না, কেননা এমন কথার ভিত্তিতে কোনো উপাচার্যকে জীবনবৃত্তান্ত পাঠানো তাঁকে বিব্রত করা এবং নিজে বিব্রত হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
আলোচনা-সভা ভালোই হলো। আলোচনার মাধ্যম ইংরেজি। নারীপুরুষ মিলে আট-দশজন জার্মান বিদ্বান রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখে এনেছেন। নিমাইসাধন বসু, দিলীপ সিংহ, সন্জীদা খাতুন ও আমিও লিখিত বক্তব্য নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রবন্ধটি সদ্য লেখা-‘টেগোর অ্যান্ড দি ওয়েস্ট’। মনে হলো, একেবারে মন্দ হয়নি। কোনো এক জার্মান বিদ্বানের বক্তব্যের খানিক বিরূপ সমালোচনা করেছিলাম আমি। আরেক জার্মান অংশগ্রহণকারী পরে আমাকে বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন, তবে অতটা মোলায়েম করে না বললেও পারতেন। জার্মানির একত্রীকরণের এই ফল হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোকও বিশ্ববিদ্যালয়ে উঁচু পদ পেয়ে যাচ্ছে যোগ্যকে বঞ্চিত করে। দুই জার্মানি এক হয়েছে বটে, তবে ক্ষমতাসীনরা লক্ষ রাখছেন যাতে পূর্ব জার্মানির লোকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল না করতে পারে। যিনি এ-কথা বললেন, তিনি পূর্ব জার্মানির এবং কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের, এটুকু নিঃসন্দেহে বোঝা গেল।
আমার ছাত্র এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী সৈয়দ আবদুল্লাহ ফারুক জার্মান বেতার ডয়েশভিলের বাংলা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। সে প্রথম থেকেই কোলনে যাওয়ার তাগাদা দিচ্ছে। যাবো বলে কথা দিলাম, কিন্তু তার আগে আমাদের একটা সমস্যাপূরণের প্রয়োজন ছিল।
আমরা যেভাবে এসেছি, ফিরতেও হবে ওভাবে। কিন্তু ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনে দু-পথের ট্রানজিট ভিসার আবেদন করেও পেয়েছি এক পথের ভিসা, অথচ এর আগে অনেকবার দু-পথের ট্রানজিট ভিসা লাভ করেছিলাম। ভারতীয় হাই কমিশনে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, ভিসা নিয়ে বার্লিন পৌঁছাবো ঠিকই, কিন্তু ফিরব কেমন করে, তাঁরা বললেন, বার্লিনে ভারতীয় দূতাবাসে আবেদন করলে ফিরতি ট্রানজিট ভিসা পাওয়া যাবে। সন্জীদা খাতুন ও আমি বার্লিনে ভারতীয় দূতাবাসের অফিসে গিয়ে আবেদন করলাম। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জাবেদ আশরাফ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব। তিনি বারবার জানতে চাইলেন, কেন আমাদের দু-পথের ট্রানজিট ভিসা দেওয়া হলো না? সদুত্তর দিতে পারলাম না, তারপরও ভিসা পাওয়া গেল। তবে দুদিন দুবেলা সময় নষ্ট হলো তার পেছনে ছুটে। আমি পরিকল্পনা করলাম লন্ডন যাওয়ার। বার্লিনে এরোফ্লোত অফিসে গিয়ে সামান্য চেষ্টায় বার্লিন-কলকাতার টিকিটটা লন্ডন-কলকাতার টিকিটে রূপান্তর করা গেল। অতঃপর ট্রেনে করে কোলন-যাত্রা। এলিজাবেথ ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে ফারুককে ফোনে জানিয়ে দিলেন আমি কখন পৌঁছাবো। ফারুক স্টেশনে যথাসময়ে উপস্থিত থেকে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো এবং তার বাড়ি নিয়ে গেল। তার স্ত্রী মালা হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষকতার কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। বিনয়ী, স্বল্পভাষী, অতিথিপরায়ণ।
পরের দিন ডয়েশভিলে গিয়ে একটা সাক্ষাৎকার রেকর্ড করলাম। তারপর ফারুকের অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময়ে নাজমুননেসা ওরফে পিয়ারী সে-ঘরে ঢুকতে গিয়ে আমাকে দেখে দোরগোড়াতেই চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে গেল। পিয়ারী এককালে আমার ভাগ্নে মামুনের বন্ধুবৃত্তে ছিল, তখন সে আমাকে মামা বলতো। শহীদ কাদরীর সঙ্গে বিয়ের পরে আমি ভাই হয়ে যাই এবং সেই সম্বোধন এখনো অটুট আছে। পিয়ারী আমার আসার খবর একেবারেই জানতো না, ফলে তার বি্নয়ের অন্ত ছিল না। ওদের অফিস থেকে বেরিয়ে পথে-পথে সে ও আমি অনেক হাঁটলাম, অনেক গল্প করলাম, হাতে যে আরো সময় নেই সে জন্য দুঃখ করলাম। তারপর যখন আর না-ফিরলেই-নয়, তখন ফিরে এলাম বেতারভবনে।
পরদিন আমি বন থেকে ট্রেনে যাত্রা করলাম লন্ডনের পথে। খুবই আরামদায়ক ভ্রমণ। তার ওপর, ট্রেনটা যাবে ইংলিশ চ্যানেলের নিচ দিয়ে। সেটা চাঞ্চল্যকর। বস্তুত চ্যানেল-টানেল আসার আগে ট্রেনের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে জানান দেওয়া হয়, কিছু কিছু পালনীয় নির্দেশ থাকে। যাত্রাটা আমার খুব ভালো লেগেছিল।
সেই ভালো-লাগা কিছুটা ্লান হয়ে গেল লন্ডনের ওয়াটারলু রেলওয়ে স্টেশনে শুল্ক-সংগ্রাহকদের বাড়াবাড়িতে। মনে হয়, র্যানডম স্যাম্পলিংয়ের শিকার হয়েছিলাম আমি। সুতরাং আমার স্যুটকেস খুলতে হলো। ওয়াকিলুর রহমান আর্ট গ্যালারি দেখাতে নিয়ে গিয়ে ছবির একটা প্রিন্ট কিনে আমাকে উপহার দিয়েছিল। সেটি ছিল একটা পিজবোর্ডের চোঙার মধ্যে, ফলে তা সন্দেহের উদ্রেক করে। সন্দেহভঞ্জন হলো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কাস্টমসের তরুণী বেশ একটা উচ্চমন্যতার সঙ্গে যখন জিজ্ঞাসা করলো আগে কখনো লন্ডনে এসেছি কি না, তখন যথেষ্ট খারাপ বোধ করলাম। রূঢ়ভাবে বললাম, ‘বহুবার।’ এবারে প্রশ্ন, ‘কবে?’ বললাম, ‘প্রথম এসেছিলাম তোমার জ্নের আগে-তারপর আরো অনেকবার এসেছি।’ দেখলাম, রূঢ়তায় ফল ফলে।
লন্ডনে সেবার কী করেছিলাম, তা আর এখন মনে পড়ে না। আমার সেই তালিকাগ্রন্থটি প্রকাশিত হবে কি না তার খোঁজ নিতে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। গ্র্যাহাম শ এখন বিভাগীয় কর্তা। তিনি মুখে বলছেন হবে, কিন্তু তাঁর শরীরের ভাষা সেটা সমর্থন করছে বলে মনে হলো না।
এরোফ্লোতের লন্ডন-মস্কো ফ্লাইট বেশ ভালো। আমার পাশে মস্কোযাত্রী যে-রুশ তরুণী বসেছিল, সেও বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। মস্কো-দিল্লি অংশের ফ্লাইট সহনীয়। দিল্লি-কলকাতা আবার বেশ খারাপ। (চলবে)
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০০৮
Leave a Reply