গত ৪ জুন প্রথম আলোর ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে প্রকাশিত আমার ‘রবীন্দ্রনাথ কেন পড়ি কিংবা পড়ি না’ শীর্ষক রচনার যে প্রতিক্রিয়া ‘রবীন্দ্রনাথ কেন পড়ব’ নামে গত ১৮ জুন খোন্দকার আশরাফ হোসেন লিখেছেন, তা যথেষ্ট উপভোগ্য হয়েছে। আবার বোঝা গেল, যুক্তির চেয়ে আবেগ বাঙালির বেশি আত্মীয়। তবে তিনি যে রবীন্দ্র-মৌলবাদী নন, তা টের পেয়েছি এবং স্বস্তি বোধ করেছি।
রবীন্দ্রনাথের বিপুলতাকে আমার রচনায় অস্বীকার করা হয়নি। কিন্তু বিপুল হলেই কারও সৃষ্টি প্রশ্নোর্ধ্ব হয়ে যায় না। রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতা কাউকে আকর্ষণ না করলে তা বলার অধিকার তার রয়েছে; তেমনি রয়েছে এই বিকর্ষণে সুখবোধ করলে তা উল্লেখের অধিকার। তবে আমাদের দেশে কপটতার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, ভালো না লাগলেও বলতে হয় ‘খুব ভালো লেগেছে’।
সৃষ্টির বিপুলতার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শামসুর রাহমানের তুলনা চলে না; কিন্তু অপচয়ের প্রসঙ্গে এই দুই কবির নাম উচ্চারণে সমস্যা কী, তা দেখিয়ে দিতে পারলে খুশি হতাম। আলোচনাটি ছিল কেবল কবিতা নিয়ে। তাতে বলতে চেয়েছি, কবিতায় শামসুর রাহমানের অপচয় কম নয়; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি নয়। সৃষ্টির পরিমাণের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই সমুদ্র; কিন্তু কবি হিসেবে তাঁর গভীরতা বহু আগেই ফুরিয়ে গেছে। নইলে, যে-পাঠ ও ব্যাখ্যায় বারবার তাঁকে পাই, তাতে আমরা বছরের পর বছর সন্তুষ্ট কেন? কেন আমরা এর বাইরে যেতে পারছি না? হতে পারে, ব্যাখ্যাকারেরা এই সমস্যার উৎস। কিন্তু এর মূলে রবীন্দ্রনাথের কবিতাও কম দায়ী নয়।
পাশ্চাত্যে কবির জন্য বিশেষণ বা উপাধি বরাদ্দ করা হয় বেশ বুঝেশুনে; কিন্তু ‘বিশ্বকবি’, ‘কবিগুরু’, ‘চিরআধুনিক’ এসব আখ্যা বাঙালি যে বুঝেশুনে দিয়েছে, রবীন্দ্রনাথের এবং তখনকার অপরাপর শ্রেষ্ঠ কবিদের কবিতা পড়লে মনে হয় না। বাঙালি কেন এই সব করেছে এবং এগুলোর ভিত্তি আদৌ আছে কি না, উত্থাপন করতে চেয়েছি সেই প্রশ্ন; ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টাও করেছি।
যদি নোবেল পুরস্কার রবীন্দ্রনাথকে চেনার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে বাঙালির মতো হতভাগা জাতি আর হতে পারে না। একসময় বাঙালি রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে বহু কিছু পেয়েছিল বা নোবেল পুরস্কারের কারণে পাওয়ার ভান ধরেছিল; এখনো চলছে সেই ভান; যদিও বহু আগে শেষ হয়ে গেছে রবীন্দ্রকবিতার মর্মোদ্ধারের কাল। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টেনশনে থাকা মধ্যবিত্ত বাঙালি এটা ঠিকই বোঝে; কিন্তু অভ্যাসে বা কপটতায় কিংবা সাহসের অভাবে বলতে পারে না। হয়তো বিষয়টা সুশীল সমাজে খুব অপ্রীতিকর।
যা-ই হোক, প্রতিক্রিয়াটি পড়ে মনে হয়েছে, আলোচনার মূল বিষয়ে তিনি একমত। সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
২.
২৫ জুন প্রকাশিত রাজু আলাউদ্দিনের প্রতিক্রিয়াটি পড়ে মনে হলো, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বিদেশি পণ্ডিতেরা আকৃষ্ট হয়েছেন বলে আমারও আকৃষ্ট হওয়া উচিত। বেশ বুঝতে পারছি, রবীন্দ্রনাথের প্রতি আকর্ষণ থাকা আমাদের সমাজে বাধ্যতামূলক।
‘বিশ্বকবি’ উপাধির পক্ষে রাজু আলাউদ্দিনের দেখানো যুক্তি ও উদ্ধৃতি দুটোই দুর্বল ও হাস্যকর। এই রকম যুক্তি ও উদ্ধৃতিতে পৃথিবীর বহু গৌণ কবিই ‘বিশ্বকবি’। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ‘গভীরতা’ জিনিসটি কী, রাজু বলেননি। তাঁর ধারণা, রবীন্দ্রনাথের কবিতাভাষা এখনো জীবিত। আমার প্রশ্ন, ‘তরে’, ‘মোরে’, ‘মোদের’, ‘পানে’, ‘ছিনু’, ‘সনে’, ‘নব’, ‘নাহি’, ‘চাহি’ এই সব শব্দ কি এখন ব্যবহূত হয়? এগুলো কি ‘বিষয়বস্তু’? পত্রপুট ও শ্যামলীর যে বৈশিষ্ট্যের কথা আমি লিখেছি, কারও গায়ের জোরে তা ‘অগভীর পর্যবেক্ষণ’ হতেই পারে, কিন্তু তাঁর ‘গভীর পর্যবেক্ষণ’টি কী, সেটি দেখানোর দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না। এড়ালে, এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, এ বিষয়ে কিছু বলার সামর্থ্য তিনি রাখেন না।
আমাদের দেশে ভিন্ন মতকে ভালো চোখে দেখা হয় না। ভিন্ন মত এখানে ‘দৃষ্টি আকর্ষণের নির্লজ্জ চেষ্টা’ এবং এটা ‘অশুভ’ ও ‘অসাধু’। বস্তুত, একটা বিরামহীন কোরাসের সমাজে আমরা আছি। এর বাইরে কেউ গান ধরলে তা ‘অশুভ’ এবং ‘অসাধু’।
চঞ্চল আশরাফ
মণিপুরিপাড়া, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০২, ২০১০
Leave a Reply