০১. প্রাককথন

প্ৰাক্‌কথন

অন্নাভাব প্রাচীনকালে পৃথিবীর সব দেশেই ছিল। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের গ্রিসে হেসিয়ডের ‘ওয়র্কস অ্যান্ড ডেজ’ বইতে পড়ি, ‘যে ব্যক্তির বাড়িতে যথাকালে এক বছরের খাদ্য সঞ্চিত হয়নি— ভূমিতে জন্মায় যে ফসল, শস্যলক্ষ্মীর দানা সেই খাদ্য— সেই লোকের কোর্ট কাছারির বিবাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই।’[১] অর্থাৎ সমাজে প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হল খাদ্য সঞ্চয়। এ রকম বিত্তবান সমাজে মুষ্টিমেয়ই ছিল, গ্রিসে শুধু নয়, সর্বত্রই। সঞ্চয়ের উপদেশ দিচ্ছেন হেসিয়ড, সঞ্চয় ক্ষুধাকে ঠেকায়।[২] সঞ্চয়ের প্রাকশর্ত হল প্রাচুর্য এবং উদ্বৃত্ত এবং সেটা জনসাধারণের ভাগ্যে কখনওই ঘটত না। তারা সারা পৃথিবীতে চিরকালই ‘দিন আনি দিন খাই’-এর শেকলে বাঁধা। প্রাচীন মিশর, চিন কোথাওই চাষি-মজুর সারা বছর পেট ভরা খাবার পেত না। ভারতবর্ষও ব্যতিক্রমী নয়; দারিদ্র্যে, অভাবে, ক্ষুধায় অন্য সব দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভারতবর্ষেরও বৃহৎ জনগোষ্ঠী এক সারিতেই ছিল। পার্থক্য একটাই: আমরা বলে থাকি, প্রাচীনকালের মানুষ প্রাচুর্যে লালিত ছিল। দেশটা ছিল সুজলা সুফলা। এমনকী রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন, ‘চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য / দেশ বিদেশে বিতরিছ অন্ন’। কখনও কখনও ভারতবর্ষ থেকে খাদ্যপণ্য বিদেশে গেছে এ কথা যেমন সত্য তারই সঙ্গে এ-ও সত্য, সে রপ্তানি সম্ভব হয়েছে দেশের বহু লোককে ক্ষুধার অন্ন থেকে বঞ্চিত করে। ভারতবর্ষ বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানিও করেছে। বৈদিক আর্যরা সর্বতোভাবে তৃপ্ত ছিল এমন একটা রূপকথা প্রায়ই প্রচারিত হয়। এক ধরনের ইতিহাস বইতে এবং গণমাধ্যমে এ ধরনের কল্পিত কথা প্রায়ই পরিবেশিত হয়। সেই রূপকথাটা যাচাই করতেই এ প্রবন্ধের সূত্রপাত।

ক্ষুধা ও খাদ্যের মধ্যে প্রচুর ব্যবধান ছিল। এ কথা শুনতে যত অপ্ৰিয়ই হোক, মানতে যত অসুবিধেই হোক না কেন, বৈদিক সাহিত্যের সাক্ষ্য থেকে প্রত্যক্ষ উদ্ধৃতি-সহযোগে সেই তথ্যগুলি এ বইতে সন্নিবেশিত হল। যে ধরনের নির্লজ্জ মিথ্যা, প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস বলে ছড়ানো হয়েছে তারই কিছু প্রতিকার ঘটুক প্রকৃত তথ্য থেকে, এ বাসনা এই রচনার পিছনে কার্যকরী। বৈদিক যুগে অধিকাংশ মানুষ পেট ভরে খেতে পেত না, এটা তথ্য। বিজ্ঞান তখন খুবই পশ্চাৎপদ ছিল; শস্য উৎপাদনের কৃৎকৌশল ছিল অনুন্নত, শস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না; প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্যহানি ঘটত; এ সবের জন্যে যে-অভাব তা ছিল সার্বত্রিক এবং তার মধ্যে গ্লানির কিছু নেই। আবার বৈদিক ইতিহাস অনুধাবন করতে করতে দেখি, আর্যরা আসার চার পাঁচ শতাব্দীর মধ্যেই উৎপাদন ব্যবস্থায় কৌশলগত প্রকরণে বিপ্লব এসে যাওয়ায় উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটেছে, প্রয়োজনকে ছাপিয়ে কিছু উদ্বৃত্তও থাকছে। কিন্তু ঠিক তার সঙ্গে সঙ্গেই সমাজে শ্রেণিবিভাগও দেখা দিয়েছে এবং উদ্বৃত্ত জমা হচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে। তারা তা নিরন্ন মানুষের মধ্যে বণ্টন না করে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি বাড়ানোর জন্যে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করল স্বদেশে ও বিদেশে। ফলে নিচের তলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ক্ষুধার অন্ন কোনও দিনই মিলল না।

উপনিষদের যুগে দেখা দিল জন্মান্তরবাদের তত্ত্ব এবং তার কিছু পরে কর্মবাদ। কাজেই খেটেখাওয়া মানুষের অর্ধাহার-অনাহারের পুরো ব্যাখ্যা মিলল: মানুষ যেহেতু মৃত্যুর পরে বারে বারে জন্মায়, তাই এ জন্মের এই যে অন্নাভাব এ তার পূর্বজন্মের দুষ্কৃতিরই ফল। পূর্বজন্মের দুষ্কৃতিটা এ জন্মের অগোচরে, এ জন্মের সুকৃতি দিয়ে তার প্রতিকার ঘটবে যে পরজন্মে, সে-ও তার অগোচরে। ফলে মেনে নেওয়া ছাড়া এবং সমাজের কর্তাব্যক্তিদের শ্রীচরণ সেবা করা ছাড়া অভুক্ত দরিদ্রের আর করবার কিছুই রইল না। কাজেই দুঃখ দারিদ্র্য যথাপূর্বম রইল, ব্যাখ্যা রইল, আর রইল নিষ্প্রতিকার ক্ষুধা।

ব্যাখ্যা-দুর্ব্যাখ্যা দিল শাস্ত্র এবং তার প্রবক্তা ও পুরোহিতরা। এরা নিজেরা উৎপাদনকর্ম থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি পেয়ে বাকি সমাজের ওপরে পরগাছার মতো থেকে খাদ্যের নিশ্চিত আশ্বাস পেয়েছিল। এই উৎপাদক-অনুৎপাদক বিভাজন বৈদিক যুগ থেকেই ছিল। পুরোহিতদের উৎপাদন করতে হত না, যজ্ঞের ক্রিয়াকর্মই তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত কর্ম, বাকি সময়ে তার বিনিময়ে তারা বরাদ্দ খাদ্যে অধিকারী ছিল। শ্রমকে যখন কায়িক ও মানসিক হিসেবে দু’ভাগ করা হল, তখন থেকে পৃথিবীর সর্বদেশে, সর্বকালে কায়িকশ্রমী বুদ্ধিজীবীর চেয়ে নিচের স্তরের জীব বলে পরিগণিত হতে লাগল। সমাজের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে গেল শাস্ত্রকার ও পুরোহিতদের হাতে। যেহেতু মূলত ক্ষত্রিয় রাজারাই তখনও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তাই ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ সাহিত্যে ক্ষমতার জন্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এই দুই বর্ণের একটা রেষারেষি চোখে পড়ে।

সংহিতা-ব্রাহ্মণে অর্থাৎ বেদের কর্মকাণ্ডে খাদ্যের জন্যে সরাসরি প্রার্থনা অসংখ্য; সমস্ত দেবতার কাছে, সব ঋষিবংশের সূক্তকাররাই খাদ্যের জন্যে করুণ আর্তি নিবেদন করেছেন। তার মধ্যে ক্ষুধার ব্যাপ্তি ও তীব্রতা দুই-ই ধরা পড়ে। যজ্ঞ করা হত খাদ্যলাভের জন্যে, অন্যান্য ঐহিক সুখের জন্যেও, কিন্তু খাদ্য ছিল একটি মুখ্য কাম্যবস্তু। ক্ষুধা সম্পর্কে আতঙ্ক বারে বারে প্রকাশ পেয়েছে অশনায়াপিপাসে, ক্ষুধাতৃষ্ণা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে আবেদনে। অশনায়াপিপাসার অপর নাম মৃত্যু, এর থেকেই ক্ষুধা সম্পর্কে আতঙ্ক স্পষ্ট বোঝা যায়। যজ্ঞ দিয়ে, দেবতার স্তব দিয়ে, তীব্র প্রার্থনা দিয়ে ক্ষুধাজনিত মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে ব্যাকুলতা দেখতে পাই।

আরণ্যক-উপনিষদে অর্থাৎ বেদের জ্ঞানকাণ্ডে কি ছবিটা পালটে গেল? তখন তো লোহার লাঙলের ফলা ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, স্বল্পতর শ্রমে বেশি জমি চাষ করা যাচ্ছে, ফসল ফলছে বেশি। ক্ষুধার প্রকোপ কি তখন কমল কিছু? এ যুগে মুখ্য কথাটা যজ্ঞ নয়, ব্রহ্মজ্ঞান। ধর্মচেতনায় জন্মান্তরবাদ এসে গেছে, এবং তারই সঙ্গে জন্মান্তরের পরম্পরা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যে জ্ঞান দিয়ে নিজেকে ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন ভাবে উপলব্ধি করাই তখনকার ধর্মাচরণের প্রকৃষ্ট পথ। যেখানে এই সব তত্ত্বকথা সমাজে প্রাধান্য পেয়েছে সেখানে খাদ্যের জন্যে আকুলতা কি কমেছে কিছু?

আরণ্যক-উপনিষদ সাহিত্য ভিন্ন সাক্ষ্য দেয়। এখানেও ক্ষুধার অন্নের জন্যে একই রকম আগ্রহ এতটাই যে এ যুগের শ্রেষ্ঠ তত্ত্বে ব্রহ্মের সঙ্গে অন্নকে বারে বারে একাত্ম করে দেখানো হয়েছে। নানা উপাখ্যানে ও সন্দর্ভে ক্ষুধার গুরুত্ব এবং অন্নের মহিমা ব্যক্ত করা হয়েছে। তার সংখ্যা ও পরিমাণ এত বেশি যে এ যুগেও নিরন্ন মানুষের সংখ্যা, সমাজে অন্নের ব্যাপক অভাব, ক্ষুধায় মৃত্যুর আতঙ্ক সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকে না।

তত্ত্ব আলোচনার যুগে মাঝেমাঝেই যাজ্ঞবল্ক্য রাজা জনকের সভায় এসে আলাপ করতেন। একবার তেমনই আসার পরে জনক প্রশ্ন করলেন, ‘কী মনে করে ঠাকুর? ব্রহ্মতত্ত্বের জন্যে এলেন, না গাভীর জন্যেই?’ ‘দুইয়ের জন্যে, মহারাজ’, নিঃসংকোচে বললেন যাজ্ঞবল্ক্য। অন্যত্রও পড়ি খাদ্যসংস্থান বা বৈভববৃদ্ধির জন্যে যাজ্ঞবল্ক্যের তৎপরতার কাহিনি। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের যেমন সরাসরি জনকের সভায় খাতির ছিল বলে নিজের ইষ্টসিদ্ধিটা তিনি ঠিক মতো গুছিয়ে নিতে পারতেন, আপামর জনসাধারণের তো সে সুবিধে ছিল না। রাজদ্বারে তাদের প্রবেশাধিকার ছিল না, তাই অভাবের দিনে তাদের উপবাস করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন বিধান ছিল না যে, খরা-অজন্মার দুর্ভিক্ষে রাজকোষ উন্মুক্ত করে নিরন্ন মানুষের অন্ন জোগাতে হবে। নিশ্চয়ই অঞ্চলে কোনও কোনও রাজা বা ভূস্বামী তা করতেন, কিন্তু এমন বহু তথ্য পাওয়া যায় যখন ভিক্ষা সংগ্রহ করতে না পারলে মানুষকে উপবাস করতেই হত। মনে পড়ে দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে
জাগিয়া উঠিল হাহা রবে,
বুদ্ধ নিজ ভক্তগণে
শুধালেন জনেজনে,
ক্ষুধিতের অন্নদানসেবা
তোমরা লইবে বল কেবা।

রাষ্ট্রে কোনও প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকলে বুদ্ধ তাঁর ভক্তদের সে দায়িত্ব নিতে বলতেন না।

পুরাকালে মানুষের অবস্থা ভাল ছিল, বেদের যুগে মানুষ বেশি ভাল খেতে, পরতে পেত এমন একটা কল্পকথা সমাজে চালু আছে; এ গ্রন্থে বৈদিক সাহিত্যের প্রত্যক্ষ নজিরে এ কল্পকথাটা যাচাই করতে গিয়ে ঠেকে গেছি। উত্তর-বৈদিক তত্ত্বের যুগেও যাঁরা ব্রাহ্মণ্য ও ব্রাহ্মণ্যেতর প্রস্থানের বড় বড় তত্ত্বের প্রবক্তা, তাঁরা ইহকাল, পরলোক, জন্মান্তর, কর্ম, কর্মফল নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। কিন্তু যে মানুষগুলো দিনভর খেটে তাঁদের অন্ন জুগিয়ে নিশ্চিন্ত রেখেছে, ওই সব তত্ত্ব আলোচনার অবকাশে সেই হতভাগ্যরা দু’বেলা পেট ভরে খেতে পেল কিনা তা নিয়ে তাঁরা কেউই মাথা ঘামাননি। ফলে সমাজে ধর্মচর্চাও চলল, পাশাপাশি ক্ষুধার প্রকোপও রইল অব্যাহত। মনে পড়ে, গান্ধীজির একটি উক্তি,[৩] ‘ক্ষুধিতের সামনে স্বয়ং ভগবানও খাদ্য ছাড়া অন্য চেহারায় আসতে সাহস পান না।’ ‘সাহস পান না’ কথাটা প্রণিধানযোগ্য। ক্ষুধা এক তীব্র অভিজ্ঞতা, তার দাবিও তেমনই অপ্রতিরোধ্য। তার মুখোমুখি হতে গেলে কেবলমাত্র খাদ্যসংস্থান দিয়েই তা সম্ভব; নীতিকথা, ধর্মাচরণ, তত্ত্ব-উপদেশ সেখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। এই যে সরাসরি খাদ্য দিয়ে ক্ষুধার মোকাবিলা করা, তা বেদের যুগেও হয়নি, আজও হয়নি।

এই নিয়ে বর্তমান প্রবন্ধ। পূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু ‘গাঙচিল’ কর্তৃক খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত আমার রচনা সংকলনে অন্তর্ভুক্তি কালে যথাসম্ভব পরিমার্জন করার চেষ্টা হয়েছে। মূল্যায়নের ভার পাঠকের।

***

১ ‘Little concern has he with quarrels and courts who has not a year’s victuals laid up betimes, even that which the earth bears.’ Hessiod, Works and Days. pp. 30-32.

২ ‘He who adds to what he has will keep off brighteyed hunger. ‘ ibid. p. 363.

৩ ‘Before the hungry even God dares not come except in the shape of bread.’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *