৪. পবনদেওর আমেরিকান গাড়ি

॥ ৪ ॥

আমরা ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় ট্যাক্সির সামনে গিয়ে হাজির হলাম। যোগীন্দররাম তার আগেই রেডি। আমাদের গাড়ির কাছেই পবনদেও-এর আমেরিকান গাড়িতে মাল তোলা হচ্ছে। ও গাড়ি আধ ঘণ্টার আগে বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে এও ঠিক যে মাঝপথে ও আমাদের ছাড়িয়ে যাবে।

ট্যাক্সিতে যখন উঠতে যাব, তখন ছোটকুমার হঠাৎ আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। বোঝাই যাচ্ছে কিছু বলার আছে।

ভদ্রলোক ফেলুদাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘কাল রাত্রে মিঃ গিরিধারী নেশার ঝোঁকে আপনার আসল পরিচয়টা আমাদের দিয়ে দিয়েছেন। আমি আপনাকে একটা সোজা প্রশ্ন করতে চাই।’

‘বলুন।’

‘উমাশঙ্কর কাকা কি আমার উপর চোখ রাখার জন্য আপনাকে এ কাজে বহাল করেছেন?’

‘তিনি যদি সেটা করেও থাকতেন, বলল ফেলুদা, ‘সেটা আমি নিশ্চয়ই আপনার কাছে প্রকাশ করতাম না, কারণ সেটা নীতিবিরুদ্ধ এবং বোকামি হত। তবে আমি আপনাকে বলেই দিচ্ছি—আসলে আমি মিঃ পুরীর হয়ে কিছু করছি না। আমাদের এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ভ্রমণ। তবে যদি কোনো গণ্ডগোল দেখি তাহলে গোয়েন্দা হয়ে আমার নিজেকে সংযত রাখা খুবই মুশকিল হবে। ভবানী উপাধ্যায় সম্পর্কে আমার নিজেরও একটা প্রবল কৌতূহল জেগে উঠেছে। তার একটা বিশেষ কারণ আছে, যদিও এখনো সেটা প্রকাশ করতে পারছি না।’

‘আই সী।’

‘এবার আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’

‘করুন।’

‘আপনি কি আপনার ফিল্মে সেই বিখ্যাত লকেটটি দেখাতে চান?’

‘নিশ্চয়ই। অবিশ্যি সেটা যদি এখনো উপাধ্যায়ের কাছে থেকে থাকে।’

‘কিন্তু উপাধ্যায়ের কাছে যে ওরকম একটা জিনিস আছে সেটা জানাজানি হয়ে গেলে ত ওঁর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে। এতদিন যে ব্যাপারটা গোপন ছিল সেটা আপনি প্রচার করে দেবেন?’

‘মিঃ মিত্তির, তিনি যদি সত্যিই সন্ন্যাসী হয়ে থাকেন তাহলে ত তাঁর আর ও জিনিসের কোনো প্রয়োজনই থাকতে পারে না। আমি ওঁকে বলব একটা কোনো বড় মিউজিয়ামে ওটা দান করে দিতে। জিনিসটা চারশো বছর আগে ত্রিবাঙ্কুরের রাজার ছিল। কারিগরির দিক দিয়ে অতুলনীয়। উনি ওটা ডোনেট করলে চিরকাল ওঁর নাম ওই লকেটের সঙ্গে জড়িত থাকবে। মোটকথা, ওই লকেট আমি ছবিতে দেখাচ্ছি, এবং সেখানে আপনি আশা করি কোনো বাধা দিতে চেষ্টা করবেন না।’

শেষের কথাটা বেশ দাপটের সঙ্গেই বলে ছোটকুমার তার গাড়িতে ফিরে গেলেন। এবার তাঁর জায়গায় সাংবাদিক মিঃ ভার্গব এসে বললেন, ‘আপনারা তিনজন আছেন জানলে ত আপনাদের সঙ্গেই যাওয়া যেত। উপাধ্যায় সম্বন্ধে আমি যে সব তথ্য আবিষ্কার করেছি সেগুলো আপনাকে বলতে পারতাম।’

‘আপনার এই তথ্যের সোর্স কী?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।

‘কিছু দিয়েছেন রূপনারায়ণগড়ের বড় কুমার সূরযদেও, কিন্তু আসল তথ্য দিয়েছে রাজবাড়ির এক আশি বছরের বুড়ো বেয়ারা। আপনি কি জানেন যে রূপনারায়ণগড়ের রাজা চন্দ্রদেও সিং-এর হাঁপানি উপাধ্যায় সারিয়ে দিয়েছিলেন?’

‘তাই বুঝি?’

‘আর তার জন্য রাজা তাঁকে ইনাম দিয়েছিলেন ওয়ান অফ হিজ মোস্ট প্ৰেশাস অর্নামেন্টস। এ খবর এতদিন ওদের ফ্যামিলির বাইরে কেউ জানত না। আপনি ভাবতে পারেন খবরের কাগজের কাছে এই ঘটনার কী দাম?’

‘আপনি ত তাহলে রাজা হয়ে যাবেন, মিঃ ভার্গব!’

‘আমি আপনাকে বলছি মিঃ মিত্তর, এই লকেট উপাধ্যায়ের কাছে বেশিদিন থাকবে না। আপনি কি ছোটকুমারের কথায় বিশ্বাস করেন যে ও শুধু টি ভি ছবি তুলতে এসেছে? আমি বলছি আপনাকে, এখানে শিগগিরই আপনার নিজের পেশার আশ্রয় নিতে হবে।’

‘তার জন্য আমি সদা প্রস্তুত’, বলল ফেলুদা।

মিঃ ভার্গব চলে গেলেন।

‘লোকটা ত ঘোড়েল আছে, মশাই,’ বললেন লালমোহনবাবু।

‘সাংবাদিক মাত্রেই ঘোড়েল, বলল ফেলুদা। ‘গোয়েন্দাগিরিতে ওরাও কম যায় না। রাজবাড়ির পুরনো বেয়ারাকে জেরা করায় ও খুব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। চাকররা অনেক সময় এমন খবর রাখে যা মনিবেরা জানতেই পারে না। কিন্তু তাও—’

‘তাও কী?’ আমি জিগ্যেস করলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম ফেলুদার মনটা খচখচ করছে।

‘তাও যে কেন লোকটাকে দেখে অসোয়াস্তি লাগছে তা বুঝতে পারছি না।’

আমাদের গাড়ি রুদ্রপ্রয়াগ থেকে রওনা হয়ে অলকনন্দার পাশ দিয়ে কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ একটা টানেলে ঢুকে পড়ল। সেই টানেল থেকে যখন আবার আলোয় বেরোলাম, তখন নদী পালটে গিয়ে হয়ে গেছে মন্দাকিনী। এটাই এখন চলবে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কেদার পর্যন্ত। কেদার থেকেই। নাকি মন্দাকিনীর উৎপত্তি।

ফেলুদার ভ্রূকুটি থেকেই বুঝতে পারছিলাম কোনো একটা কারণে ওর বিরক্ত লাগছে, এবারে ওর কথায় বুঝতে পারলাম।

‘আমার সমস্ত রাগটা পড়ছে ওই গিরিধারী লোকটার উপর। ও যে এত ইরেসপনসিব্‌ল তা ভাবতে পারিনি। ছোটকুমার এখন যে কথাগুলো বললেন সেগুলো অবিশ্যি ওঁর পক্ষে স্বাভাবিক, তবে আশ্চর্য লাগছে জেনে যে মিঃ পুরীর সঙ্গে ওঁর আর দ্বিতীয়বার কোনো কথাই হয়নি। সেক্ষেত্রে মিঃপুরীর চিঠি, টেলিগ্রাম দুটোই রহস্যজনক হয়ে উঠছে। অবিশ্যি সবই নির্ভর করছে কে সত্যি বলছে কে মিথ্যে বলছে তার উপর। মোটকথা, কেস ড্রপ করলেও, এখানে আসার সিদ্ধান্ত যে ড্রপ করিনি সেটা খুব ভাগ্যের কথা।’

গৌরীকুণ্ড রুদ্রপ্রয়াগ থেকে আশি কিলোমিটার হলেও এত চড়াই-উৎরাই আর এত ঘোরপ্যাঁচের রাস্তা যেতে বেশ সময় লাগে। পথে তিনটে শহর পড়ে। ৩০ কিলোমিটারের মাথায় অগস্ত্যমুনি, হাইট আন্দাজ ৯০০ মিটার; সেখান থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে গুপ্তকাশী—যদিও হাইট এইটুকুর মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে ডবল। গুপ্তকাশী থেকে শোনপ্রয়াগ, যেখানে শোনগঙ্গা মন্দাকিনীর সঙ্গে এসে মিশেছে। এই শোনপ্রয়াগ থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে হল গৌরীকুণ্ড—যদিও সেখানে গিয়ে হাইট হয়ে যাচ্ছে সোয়া দুহাজার মিটার।

আমাদের গরম জামা যাতে প্রয়োজন হলে সহজেই বার করে নেওয়া যায় তার ব্যবস্থা আমরা করে নিয়েছিলাম। বড় সুটকেস জাতীয় মাল আমাদের সঙ্গে যা ছিল তা সবই গাড়ওয়াল নিগম রেস্ট হাউসের লকারে রেখে দিয়ে এসেছি, ফেরার সময় আবার নিয়ে যাব। লালমোহনবাবুর টাকের জন্য উনি এর মধ্যেই টুপি পরে নিয়েছেন , যদিও আমাদের বাঙালী মাঙ্কি ক্যাপ না; রাজস্থান থেকে কেনা কান-ঢাকা পশমের লাইনিং দেওয়া স্মার্ট চামড়ার টুপি।

অগস্ত্যমুনি পৌঁছে গাড়ি থামিয়ে যখন আমরা গরম জামা পরছি, তখন আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল পবনদেও-এর আমেরিকান টুরার। ছোটকুমার জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওয়েভ করাতে ফেলুদাকেও হাত নাড়াতে হল।

আমরা শীতের সঙ্গে লড়াই করবার জন্য তৈরী হয়ে আবার রওনা দিলাম। বাঁয়ে মন্দাকিনী একবার আমাদের পাশে চলে আসছে, আবার পরক্ষণেই নেমে যাচ্ছে সেই খাদের একেবারে নিচে। নদীর শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে লালমোহনাবুর সুর করে বলা, ‘ওরে তোরা কি জানিস কেউ, জলে কেন এত ওঠে ঢেউ’। আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনি পুরো কবিতাটার কেবলমাত্র ওই দুটো লাইনই জানেন।

শেষে ফেলুদা আর থাকতে না পেরে লাইন যোগ করতে শুরু করে দিল—ওরে তোরা কি জানিস কেউ, কেন বাঘ এলে ডাকে ফেউ..ওরে তোরা কি শুনিস কেউ কুকুরের ঘেউ ঘেউ, খোকা কাঁদে ভেউ ভেউ…

গুপ্তকাশী যখন পৌঁছলাম তখন বেজেছে দশটা। এখানে একটা চায়ের দোকান দেখে থামতে হল। যাকে ব্রেকফাস্ট বলে সেটা সকালে হয়নি, কাজেই খিদেটা ভালোই হয়েছিল। গরম জিলিপি, কচুরি আর চা দিয়ে দিব্যি ব্রেকফাস্ট হয়ে গেল।

যোগীন্দরের এক ভাই কাছেই থাকে, সে বলল তার সঙ্গে পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করে আসছে। সেই ফাঁকে লালমোহনবাবু চন্দ্রশেখর মহাদেব আর অর্ধনারীশ্বরের মন্দিরগুলো দেখতে গেলেন।

গুপ্তকাশী থেকে পাহাড়ের উপর দেখা যায় উখীমঠ। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কেদারের পথ যখন বরফের জন্য বন্ধ থাকে তখন কেদারেশ্বরের পুজো এই উখীমঠেই হয়ে থাকে।

লালমোহনবাবু মন্দির দেখে ফিরে এলেন, কিন্তু যোগীন্দরের ফেরার নাম নেই। ফেলুদা আর আমি ব্যস্তভাবে এদিক ওদিক দেখছি। এমন সময় দেখি ছোটকুমারের গাড়ি আসছে। ওরা আমাদের পেরিয়ে গিয়ে আবার পিছিয়ে পড়ল কেন?

আমাদের দেখে গাড়ি থামিয়ে কুমার নেমে এলেন। বললেন গুপ্তকাশী থেকে নাকি কেদার ও বদ্রী দুটো চুড়োরই ভিউ পাওয়া যায়, তাই ওঁরা এখানে কিছুটা সময় দিলেন। তবে আর দেরি করলে চলবে না, কারণ তাহলে যাত্রীদের রওনা দেবার দৃশ্য তোলার জন্য আর আলো থাকবে না।

কিন্তু তাও যোগীন্দরের দেখা নেই। তার বদলে দেখা দিলেন সাংবাদিক মিঃ ভার্গব। তাঁর গাড়িটা আগে দেখেছিলাম, আর ভাবছিলাম তিনি এখানে এতক্ষণ কী করছেন। ভদ্রলোক বললেন যে কেদারনাথের সেবায়েতের একজন নাকি এখানে রয়েছেন। এরা সকলেই রাওয়াল পরিবারের লোক; এই বিশেষ রাওয়ালটির সঙ্গে নাকি একটা ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলেন মিঃ ভার্গব। এখনই আবার তাঁকে ছুটতে হবে শোনপ্রয়াগ হয়ে গৌরীকুণ্ড।

মিঃ ভার্গব চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা বছর পনেরর ছেলে হঠাৎ এসে ‘ফোর-থার্টি-ফোর ট্যাক্সি কি কোই পাসিঞ্জর হ্যায় ইঁহা?’ বলে হাঁক দিতেই ফেলুদা ব্যস্তভাবে তার দিকে এগিয়ে গেল।

‘ফোর-থ্রী-ফোর কি পাসিঞ্জর?’

‘হ্যাঁ। কেন, কী হয়েছে?’

ব্যাপার আর কিছুই না, আমাদের গাড়ির ড্রাইভার জখম হয়ে পড়ে আছে কিছু দূরে। ছেলেটি তাকে চেনে বলে সে খবর দিতে এসেছে।

লালমোহনবাবুকে আমাদের জিনিসপত্র পাহারা দেবার জন্য রেখে আমরা দুজন ছেলেটাকে অনুসরণ করে গেলাম।

পাঁচ সাতটা বাড়ি নিয়ে একটা নিরিবিলি পাড়ায় একটা কলাগাছের ধারে যোগীন্দররাম মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তার মাথার পিছন দিকের ঘন কালো চুলে রক্তের ছোপ। শরীরের ওঠানামা থেকে বোঝা যাচ্ছে সে মরেনি, কিন্তু ফেলুদা তাও দৌড়ে গিয়ে তার নাড়ী পরীক্ষা করল।

কে এই কুকীর্তি করেছে এ নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই; এখন দরকার ওর চিকিৎসা। ছোকরাটি বলল এখানে হাসপাতাল দাওয়াখানা দুইই আছে। সে আবার গাড়িও চালাতে জানে। শেষ পর্যন্ত সে-ই নিজে ট্যাক্সি চালিয়ে যোগীন্দরকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।

সব মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক দেরি হয়ে গেল। যোগীন্দরের মাথায় ব্যাণ্ডেজ, ব্যথাও আছে; তাকে বলা হল যে এখান থেকে অন্য ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিলে আমরা তাতেই যাব। কিন্তু সে রাজি হল না। সে নিজেই যাবে আমাদের নিয়ে।

‘কে মেরেছিল কিছু বুঝতে পেরেছিলে?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘নেহী’, বলল যোগীন্দর, ‘পিছে সে আ কর মারা।’

‘এখানে তোমার কোনো দুষমণ আছে?’

‘কোই ভি নেহী।’

ফেলুদা কী ভাবছে সেটা আমি জানি। দুষমণ যদি থাকে ত সে আমাদের দুষমণ। আমাদের দেরি করিয়ে দেবার জন্য ব্যাপারটা করা হয়েছে। শত্রু কে আমরা বুঝতে না পারলেও, শত্রু যে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

আমরা রওনা হবার পর আমি ফেলুদাকে বললাম, ‘আচ্ছা, মিঃ পুরী যে তোমার কাছে এসেছিলেন, সেটা জানতে পেরে ছোটকুমার তাঁকে দিয়ে টেলিগ্রামটা করিয়ে চিঠিটা লেখায় নি ত?—যাতে তার কাজে ফেলু মিত্তির কোনো বাধার সৃষ্টি না করতে পারে?’

‘এটা তুই খুব ভাল ভেবেছিস তোপ্‌সে। আমারও কথাটা মনে হয়েছে। অবিশ্যি তার মানে এটাও বোঝা যায় যে,মিঃ পুরীর উপর এতটা কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা ছোটকুমারের আছে।’

‘তা থাকবে না কেন,’ বললেন লালমোহনবাবু, ‘ছোটকুমার ইজ এ প্রিন্স, অ্যাণ্ড পুরী ইজ ওনলি এ কর্মচারী।’

‘ঠিক বলেছেন আপনি,’ বলল ফেলুদা, ‘এখানে বয়সের তফাৎটা কিছু ম্যাটার করে না। তবে হ্যাঁ—এটাও ঠিক যে টেলিগ্রাম আর চিঠি সত্ত্বেও যে আমি চলে আসব সেটা বোধহয় ছোটকুমার ভাবতেই পারেনি।’

‘তার মানে যোগীন্দরকে জখম ওরাই করিয়েছে?’

‘যোগীন্দর যখন বলছে এখানে ওর কোনো শত্রু নেই তখন আর কী হতে পারে?’

‘এক্সকিউজ মি স্যার,’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘আমার কিন্তু ওই সাংবাদিক লোকটিকেও বিশেষ সুবিধের লাগছে না।’

‘কেন বলুন ত? আমার নিজেরও যে ভদ্রলোককে একেবারে আদর্শ চরিত্র বলে মনে হচ্ছে তা নয়, কিন্তু আপনার ভালো না-লাগার কারণটা জানার কৌতূহল হচ্ছে।’

‘সাংবাদিক হলে পকেটে কলম থাকবে না?’ বললেন লালমোহনবাবু। ‘বাইরের পকেটে ত নেই-ই, কাল যখন কোট পরছিল তখন দেখলাম বুক পকেটেও নেই, সার্টের পকেটেও নেই।’

‘আমার মতো যদি একটা মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডার থাকে?’

লালমোহনবাবু যেন কথাটা শুনে একটু দমে গেলেন। বললেন, ‘তা যদি হয় তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। আসলে আমার চাপ দাড়ি দেখলেই কেমন যেন একটা সন্দেহ হয়।’

‘যাক্‌গে—এবার একটু কাজের কথায় আসা যাক।’

‘কী?’

‘আপনি কোনটা প্রেফার করবেন—ঘোড়া না ডাণ্ডি?’

‘ন্যাচারেলি আপনারা যেটা প্রেফার করবেন সেটাই। এক যাত্রায় ত আর পৃথক ফল হতে পারে না।’

‘কেদারের পথ সম্বন্ধে আপনার কিঞ্চিৎ ধারণা আছে আশা করি?’

‘হ্যাঃ হাঃ হাঃ হ্যাঃ!’

‘হাসছেন কেন?’

‘আমার ধারণাটা বোধহয় আপনার চেয়েও ভিভিড়, কারণ কেদার যাত্রা সম্বন্ধে এথিনিয়ামের বাংলা শিক্ষক বৈকুণ্ঠ মল্লিক যা লিখে গেছেন তার তুলনা লিটারেচরে বেশি পাবেন না। তপেশ, জান পোয়েমটা?’

‘না ত!’

‘শুনুন ফেলুবাবু।’

‘দাঁড়ান, সামনে দুটো ইউ-টার্ন আসছে, সেগুলো পেরিয়ে যাক। সোজা রাস্তা না পেলে আবৃত্তি করাও যায় না, শোনাও যায় না।’

মিনিট দশেক পরে একটা সোজা রাস্তা পেয়ে লালমোহনবাবু তাঁর আবৃত্তি আরম্ভ করলেন।—

“শহরের যত ক্লেদ, যত কোলাহল

ফেলি পিছে সহস্র যোজন

দেখ চলে কত ভক্তজন

হিমগিরি বেষ্টিত এই তীর্থপথে

শুধু আজ নয়, সেই পুরাকাল হতে—

সাথে চলে মন্দাকিনী

অটল গাম্ভীর্য মাঝে ক্ষিপ্রা প্রবাহিনী”—

এইবার হচ্ছে আসল ব্যাপার। শুনুন কি ভাবে ওয়ার্নিং দিচ্ছেন ভদ্রলোক যাত্রীদের—

“তবে শুন এবে অভিজ্ঞের বাণী—

দেবদর্শন হয় জেনো বহু কষ্ট মানি’

গিরিগাত্রে শীর্ণপথে যাত্রী অগণন

প্রাণ যায় যদি হয় পদস্খলন,

তাও চলে অশ্বারোহী, চলে ডাণ্ডিবাহী,

যষ্টিধারী বৃদ্ধ দেখ তাঁরও ক্লান্তি নাহি

আছে শুধু অটল বিশ্বাস

সব ক্লান্তি হবে দূর, পূর্ণ হবে আশ

যাত্রা অন্তে বিরাজেন কেদারেশ্বর

সর্বগুণ সর্বশক্তিধর

মহাতীর্থে মহাপুণ্য হবে নিশ্চয়

উচ্চকণ্ঠে বল সবে—কেদারের জয়!”

‘হুঁ,’ বলল ফেলুদা, ‘বোঝাই যাচ্ছে মল্লিক মশাই এ কবিতা লিখেছিলেন বাস-ট্যাক্সির যুগের অনেক আগে।’

‘সার্টেনলি,’ বললেন লালমোহনবাবু, ‘তাঁকে তীর্থযাত্রীর পুরো ধকল ভোগ করতে হয়েছিল।’

‘কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কি অশ্বারোহী হতে চান, না ডাণ্ডির দ্বারা বাহিত হতে চান, না পয়দল যেতে চান।’

‘সেটা সব ডিপেণ্ড করছে আপনাদের উপর। দলচ্যুত হবার প্রশ্ন ত আর উঠতে পারে না।’

‘আমি আর তোপ্‌সে ত হেঁটেই যাব স্থির করেছি। আপনার পক্ষে ডাণ্ডিটা সবচেয়ে নিরাপদ, কারণ ঘোড়াগুলোর টেণ্ডেন্সি হচ্ছে পথের যে দিকটায় খাদ, তার কানা ধরে চলা। সে টেনশন আপনার সহ্য হবে না।’

লালমোহনবাবু ভয়ঙ্কররকম গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘শুনুন ফেলুবাবু, আপনি কিন্তু আমার ক্ষমতাকে ক্রমান্বয়ে আণ্ডারএস্টিমেট করে চলেছেন। আমি গেলে হেঁটে যাব, আর নয়ত যাব না। এই আমার সোজা কথা।’

‘যাক্‌, তাহলে এটা সেট্‌লড,’ বলল ফেলুদা।

‘একটা প্রশ্ন আমি করতে পারি কি?’ বললেন লালমোহনবাবু—‘অবিশ্যি এটা জার্নি সম্বন্ধে নয়।’

‘নিশ্চয়ই পারেন।’

‘এরা ত মশাই আমাদের চিনে ফেলেছে; এখন কেদার গিয়ে আমরা করছিটা কী?’

‘সেটা সব নির্ভর করছে কে আগে উপাধ্যায়ের সন্ধান পায় তার উপর।’

‘ধরুন যদি আমরাই পাই।’

‘তাহলে তাঁকে সবিস্তারে ব্যাপারটা বলতে হবে। সন্ন্যাসী হয়ে তাঁর মনোভাব যদি বদলে গিয়ে থাকে, তাহলে হয়ত লকেটটা উনি আর নিজের কাছে রাখতে চাইবেন না। আমাদের কর্তব্য হবে তিনি সেটা কাকে দিয়ে যেতে চান তাঁর অনুসন্ধান করা—অবশ্য সেরকম লোক যদি কেউ থেকে থাকে। এর মধ্যে যদি ছোটকুমারও উপাধ্যায়ের সন্ধান পেয়ে যান, তাহলে তিনি হয়ত লকেটটার ছবি তুলতে চাইবেন। চন্দ্ৰদেও-এর ছেলে বলে উপাধ্যায় হয়ত স্নেহবশত তাতে রাজিও হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু উপাধ্যায়ের অমতে পবনদেওকে কোনোমতেই লকেটটা হস্তগত করতে দেওয়া যায় না। অবিশ্যি সে যে সেটা হাত করতে চাইছে এমন বিশ্বাস করার কোনো কারণ এখনো ঘটেনি। আমরা শুধু অনুমান করছি যে সে-ই হুম্‌কি দিয়ে মিঃ পুরীকে চিঠি ও টেলিগ্রামটা পাঠাতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তারও এখনো কোনো প্রমাণ নেই। টেলিভিশনের ছবি তোলা ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্য নাও থাকতে পারে।’

আমি বললাম, ‘কিন্তু সাংবাদিক মিঃ ভার্গবও যে উপাধ্যায়ের খোঁজ করছেন।’

ফেলুদা বলল, ‘আমার বিশ্বাস ভার্গব যখন আসল ঘটনা জেনে গেছে। তখন তার শুধু দুটো ছবি পেলেই কাজ হয়ে যাবে—একটি উপাধ্যায়ের, একটি লকেটের। কারণ এই কাহিনী খবরের কাগজে প্রকাশিত হলে ভার্গবের অন্তত কিছুদিন আর অন্নচিন্তা থাকবে না।’

ইতিমধ্যে আমাদের গাড়িটা কিন্তু অত্যন্ত বেয়াড়ারকম চড়াই উঠে দশ হাজার ফুট বা সাড়ে তিন হাজার মিটারের উপর পৌঁছে গেল। অন্তত যোগীন্দর তাই বলল, আর সেই সঙ্গে বাইরের কনকনে শীতেও তার প্রমাণ পেলাম। এখন মাঝে মাঝে বরফের পাহাড়ের চুড়ো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কোনটা যে কোন শৃঙ্গ তা বুঝতে পারছি না। মিনিট পনেরর মধ্যেই গৌরীকুণ্ড পৌঁছে যাওয়া উচিত। ঘড়ি বলছে পাঁচটা পনের। দূরে পাহাড়ের চুড়োয় উজ্জ্বল রোদ থাকলেও আশেপাশের পাহাড়ে পাইন আর রডোডেনড্রনের বনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।

একটা মোড় ঘুরে সামনে ঘর বাড়ি গাড়ি ঘোড়া ইত্যাদি দেখে বুঝলাম যে আমরা গৌরীকুণ্ডে এসে গেছি। এটাও বুঝলাম যে আজ রাতটা এখানেই থাকতে হবে। আমাদের কেদার যাত্রা শুরু হবে কাল ভোরে। আর ভোরে রওনা হলেও চোদ্দ কিলোমিটার চড়াই পথ যেতে সন্ধে হয়ে যাবে। অর্থাৎ আসল ঘটনা যা ঘটবার তা পরশুর আগে নয়।

বাস টারমিনাস হবার ফলে ছোট জায়গা হওয়া সত্ত্বেও গৌরীকুণ্ডে ব্যস্ততার শেষ নেই। ঘোড়া, ডাণ্ডি, কাণ্ডি, কুলি—এদের সঙ্গে দরদস্তুরী চলছে। কাণ্ডি জিনিসটা ঝুড়ি টাইপের। এতে করেও মানুষ যায়, যদিও দেখে মোটেই ভরসা হয় না।

এখানে রাত্রে থাকতে হবে জেনেও আগে কোন বন্দোবস্ত করিনি, কারণ জানি অন্তত একটা ধরমশালা কি চটি পেয়ে যাব। সত্যিই দেখা গেল জায়গার কোন অভাব নেই। এখানে পাণ্ডারা ঘর ভাড়া দেয়। বিছানা বালিশ লেপ কম্বল সবই দেয়। পাণ্ডারা বাঙালী না হলেও বাঙালী যাত্রী এত আসে যে এরা দিব্যি বাংলা শিখে গেছে। এদের থাকার ঘরগুলো হয় দোতলায়। বেঁটে বেঁটে ঘর, যার সীলিং-এ ফেলুদার প্রায় মাথা ঠেকে যায়। এই ঘরের নীচে থাকে সেইরকমই বেঁটে বেঁটে সার বাঁধা দোকান। সস্তার ব্যাপার, তবে আমাদের কথা হচ্ছে, রাত্তিরে ঘুমোন। সেই কাজটায় কোনো ব্যাঘাত হবে বলে মনে হল না।

আমরা এখানে এসেই ছোটকুমারের হলদে আমেরিকান গাড়িটা দেখেছিলাম। ওরা আমাদের চেয়ে ঘণ্টা চারেক আগে পৌঁছেছে নিশ্চয়ই। অর্থাৎ দুপুরে ঘোড়া নিয়ে রওনা হয়ে রাত্তিরের মধ্যে পৌঁছে যাবে। তার মানে কেদারে একটা পুরো দিনেরও বেশি সময় পাচ্ছে ছোটকুমার।

আমার ধারণা মিঃ ভার্গবও আজ রাত্তিরের মধ্যে পৌঁছে যাবেন।

আশ্চর্য এই যে সকলেরই উদ্দেশ্য এক—উপাধ্যায় মশাইয়ের সন্ধান করা।