০৩. শাস্তি

. শাস্তি

আপনি রবোট্রনটিকে ছেড়ে দিয়েছেন কেন?

এই নিয়ে আমাকে চতুর্থ বার একই প্রশ্ন করা হল। একটি প্রাচীন রবোট বা নির্বোধ কম্পিউটারের কাছ থেকে এরকম জিজ্ঞাসাবাদে আমি অবাক হতাম না, কিন্তু যে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সে একজন জলজ্যান্ত মানুষ। আগেও দেখেছি নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন কেমন জানি একচক্ষু হরিণের মতো হয়, নিজেদের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে কিছু দেখলে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না।

বলুন, আপনি রবোট্রনটিকে ছেড়ে দিয়েছেন কেন?

আমি ওকে ছাড়ি নি, ও নিজেই পালিয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু ও পালানোর সুযোগ পেয়েছে, কারণ আপনি লাল কার্ড দেখিয়ে ওকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন।

আমি কাঁধ ঝাকিয়ে তার কথা মেনে নিলাম, এটা কোনো প্রশ্ন নয়, তাই আমি উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। লোকটি তবু উত্তরের জন্যে বসে রইল, বলল, বলুন।

কী বলব?

কেন তাকে ছাড়িয়ে নিলেন?

আমার মায়া হচ্ছিল, মেয়েটাকে যেভাবে মারা হল সেটা ছিল অমানুষিক নিষ্ঠুরতা।

মায়া? নিষ্ঠুরতা? লোকটা পারলে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। আমার পাশে যে ডাক্তার মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল তার দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছেন কী বলেছে?

ডাক্তার মেয়েটি দেখতে বেশ, আমার জন্যে খানিকটা সমবেদনা আছে টের পাচ্ছি। লোকটার কথার উত্তর না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। লোকটি আবার রাগ-রাগ মুখে আমার দিকে তাকায়, রবোট্রনের জন্যে মায়া হয়? একটা পেন্সিল ভাঙলে মায়া হয় না?

লোকটি নিজের কথাকে আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যেই সম্ভবত তার হাতের পেন্সিলটি ভেঙে ফেলল।

ডাক্তার মেয়েটি প্রথম বার কথা বলল, আপনি খামোকা উত্তেজিত হচ্ছেন। পেন্সিল আর রবোট্রন এক জিনিস নয়। রবোট্রন দেখতে এত মানুষের মতো যে তাদের ধ্বংস করতে দেখা খুব কষ্টকর, মনে হয় মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আমরা আগেও দেখেছি, অনেকে রবোট্রন ধ্বংস করা সহ্য করতে পারে না।

লোকটি এবার রাগ-রাগ মুখে ডাক্তার মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল, রবোট্রনেরা কী করছে সেটা যদি সবাই জানত, তাহলে সহ্য করা নিয়ে খুব সমস্যা হত না। ক্রুগো কম্পিউটারের শেষ রিপোর্টটা দেখেছেন?

দেখেছি। তাহলে?

কিন্তু ক’জন ঐ রিপোর্টের খোঁজ রাখে? আর ঐ রিপোর্টের সব সত্যি, তার কি নিশ্চয়তা আছে?

লোকটি ভুরু কুঁচকে ডাক্তার মেয়েটির দিকে তাকাল, আপনি বলতে চান ক্রুগো কম্পিউটার একটা মিথ্যা রিপোর্ট লিখবে?

মেয়েটি উত্তর না দিয়ে আবার কাঁধ ঝাঁকাল। লোকটি খানিকক্ষণ চিন্তিত মুখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। আস্তে আস্তে প্রায় শোনা যায় না এরকম স্বরে বলল, আপনি জানেন, আপনি যে কাজটি করেছেন তার শাস্তি কী?

আমি এবারে সত্যি সত্যি মধুর ভঙ্গি করে হেসে বললাম, জানি।

কী?

মৃত্যুদণ্ড।

লোকটার চোখ ছোট ছোট হয়ে এল, আপনি ভাবছেন আপনাকে যখন ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে আপনার আর ভয় কী? মানুষকে তো আর দু বার মারা যায় না।

যায় নাকি? আমি সত্যিই কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

লোকটার মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটে ওঠে। বলে, না, তা যায় না। কিন্তু একটা মৃত্যু অনেক রকমভাবে দেয়া যায়।

আমি ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ না করে মুখে জোর করে একটা শান্তভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতে থাকি। লোকটা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু আমাকে আর কীভাবে কষ্ট দেয়া হবে? আমাকে মহাকাশযানে ওঠানোর আগে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার কথা।

হ্যাঁ। ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হবে, কিন্তু ঠিক ঘুম পাড়ানোর আগে আপনাকে একটা যন্ত্রণা দিয়ে ঘুম পাড়ানো যায়, আপনার মস্তিষ্কে সেটা রয়ে যাবে। আপনার সুদীর্ঘ ঘুম তখন একটা সুদীর্ঘ যন্ত্রণা হয়ে যাবে, তার থেকে কোনো মুক্তি নেই।

লোকটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো দাঁত বের করে হাসে। কিছু কিছু লোক এত নিষ্ঠুর কেন হয় কে জানে?

অজানা একটা আশঙ্কায় হঠাৎ আমার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। আমার লুকাসের কথা মনে পড়ল, এজন্যেই কি সে আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল? আগামীকাল আমার জীবনের শেষদিন বলে ভাবছিলাম, সেটা কি আসলে আরেক দুঃসহ যন্ত্রণার শুরু?

লোকটা উঠে দাঁড়ায়, আপনাকে ঠিক কী করা হবে জানি না। সেটা বড় বড় হর্তাকর্তারা ঠিক করবেন। এখন আপনার পরীক্ষাগুলো সেরে নিই।

লোকটা ডাক্তার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আপনার কাজ শুরু করতে পারেন, আমার কাজ আপাতত শেষ।

ডাক্তার মেয়েটি আমাকে পাশের ঘরে এনে ধবধবে সাদা একটা উচু বিছানায় শুইয়ে দিল। উপরে একটা বাতি ছিল, মেয়েটি বাতিটা টেনে নিচে নামিয়ে আনে। আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমবার অনুভব করি মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী, আমার বুকের ভেতর হঠাৎ একটা আশ্চর্য কষ্ট হতে থাকে। ভালবাসার জন্যে বুভুক্ষু হৃদয় হঠাৎ হাহাকার করে ওঠে। আমার চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি একটু হেসে আমার হাত আস্তে স্পর্শ করে বলল, আপনি ভয় পাবেন না, আপনার ভয়ের কিছু নেই।

নিরাপত্তা বাহিনীর লোকটি এগিয়ে এসে বলল, কী বললেন আপনি?

বলেছি, ভয়ের কিছু নেই।

ভয়ের কিছু নেই। তাই বলেছেন আপনি? লোকটি হঠাৎ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, আপনি বলেছেন তার ভয়ের কিছু নেই? আমি ওর জায়গায় হলে এখন একটা চাকু এনে নিজের গলায় বসিয়ে দিতাম!

লোকটি শুধু যে নিঠুর তাই নয়, তার ভেতরে সাধারণ ভব্যতাটুকও নেই। ডাক্তার মেয়েটি তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আমার হাত ধরে দৃঢ়স্বরে বলল, আমার কথা বিশ্বাস করুন, আপনার ভয় নেই।

আমি বিশ্বাস করেছি।

আমি আস্তে আস্তে মেয়েটার হাত স্পর্শ করে বললাম, আমাকে একটা যন্ত্রণা দিয়ে ঘুম পাড়ানো হবে। ঠিক ঘুমানোর আগে আমি তোমার কথা ভাবতে থাকব, আমার যন্ত্রণা তাহলে অনেক কমে যাবে।

মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে ঝুঁকে এল। আমি ফিসফিস করে বললাম, আমার খুব সৌভাগ্য যে জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে তোমার মতো একটা মেয়ের সাথে দেখা হল। তোমাকে আগে কেউ বলেছে যে তুমি কত সুন্দরী?

মেয়েটা খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা দুর্ভাবনা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকটা এগিয়ে এসে বলল, কী বলছে ফিসফিস করে?

মেয়েটা তার কথার উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি দেখতে পেলাম তার মুখ আস্তে আস্তে গাঢ় বিষাদে ঢেকে যাচ্ছে।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলি।

 

আমাকে যে, ক্যাপসুলটার ভেতরে শুইয়ে পাঠানো হবে সেটিকে দেখে কফিনের কথা মনে পড়ে। সেটি কফিনের মতো লম্বা এবং কালো রঙের, ক্যাপসুলটি কফিনের মতোই অস্বস্তিকর। হাজারো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ক্যাপসুলটা ভরা, এই যন্ত্রপাতি আমাকে সুদীর্ঘ সময় ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব পালন করবে। আমি একটা শক্ত চেয়ারে বসেছিলাম, আমাকে ঘিরে বিভিন্ন লোকজন ব্যস্তভাবে হাঁটাহাঁটি করছে, শেষবারের মতো নানা যন্ত্রপাতি টিপেটুপে পরীক্ষা করছে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যায়, নানা আকারের, নানা আকৃতির মহাকাশযান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, একটিদু’টি থেকে সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছে, সেগুলোর কোনো-একটিতে করে আমাকে পাঠানো হবে, ঠিক কোন মহাকাশযানটি আমার জন্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেটা নিয়েও আমি কোনো কৌতূহল অনুভব করছিলাম না। আমার সমস্ত অনুভূতি কেমন যেন শিথিল হয়ে আসছিল। অপেক্ষা করতে আর ভালো লাগছিল না, মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি সবকিছু শেষ হয়ে যায় ততই ভালো।

একসময়ে আমাকে নিয়ে ক্যাপসুলে শোয়ানো হল, বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরটা অত্যন্ত আরামদায়ক, আমার শরীরের মাপে মাপে তৈরি বলেই হয়তো। একটি শ্যামলা রঙের মেয়ে খুব যত্ন করে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মনিটরগুলো লাগিয়ে দিচ্ছিল। প্রত্যেকবার আমার চোখে চোখ পড়তেই সে একবার মিষ্টি করে হাসছিল। মেয়েটি সম্ভবত একজন নার্স, তাকে সম্ভবত শেখানো হয়েছে প্রয়োজনেঅপ্রয়োজনে হাসতে, তার হাসি সম্ভবত পেশাদার নার্সের মাপা হাসি, কিন্তু তবু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এটি সহৃদয় আন্তরিক হাসি।

সবকিছু শেষ হতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো সময় লেগে গেল। তিন-চার জন বিভিন্ন ধরনের লোকজন সবকিছু পরীক্ষা করার পর ক্যাপসুলের ঢাকনাটা ধীরে ধীরে নামিয়ে দেয়া হল। ভেবেছিলাম সাথে সাথে বুঝি কবরের মতো নিকষ কালো অন্ধকার নেমে আসবে, কিন্তু তা হল না, কোথায় জানি খুব কোমল একটা বাতি জ্বলে উঠে ক্যাপসুলের ভেতর আবছা আলো ছড়িয়ে দেয়। খুব ধীরে ধীরে ভেতরে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসতে থাকে। খুব চেনা একটা গন্ধ, কিন্তু কিসের ঠিক ধরতে পারলাম না, ভেতরের বাতাস নিশ্চয়ই সঞ্চালন করা শুরু হয়েছে। মাথার কাছে একটা স্ক্রীন ছিল জানতাম না, এবারে সেটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এটিতে নিশ্চয়ই কিছু-একটা দেখা যাবে। ভেতরের নীরবতাটুকু যখন অসহ্য হয়ে উঠতে শুরু করল, ঠিক তক্ষুণি কোথা থেকে জানি খুব মিষ্টি একটা সুর বেজে ওঠে।

কতক্ষণ পার হয়েছে জানি না, এক মিনিটও হতে পারে, এক ঘন্টাও হতে পারে, ক্যাপসুলের ভেতর সময়ের আর কোনো অর্থ নেই। আমার একটু তন্দ্রামতো এসে যাচ্ছিল, নিশ্চয়ই কোনো-একটা ওষুধের প্রতিক্রিয়া, এরকম অবস্থায় তন্দ্রা আসার কথা নয়। হঠাৎ সামনের স্ক্রীনে একটা লোকের চেহারা ভেসে ওঠে, লোকটি মধ্যবয়স্ক, মাথার কাছে চুলে পাক ধরেছে। ভাবলেশহীন মুখ, কাঁধের কাছে দু’টি লাল তারা দেখে বুঝতে পারলাম অনেক উচ্চপদস্থ লোক। লোকটি কোনোরকম ভূমিকা না করেই কথা বলা শুরু করে দিল, বলল, আপনার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পালন করার এটি হচ্ছে শেষ পর্যায়। আর পাঁচ মিনিটের ভেতর আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন, আপনাকে যে-ওষুধ দেয়া হয়েছে সেটা কাজ শুরু করতে এর থেকে বেশি সময় লাগার কথা নয়। ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথেই আপনার স্বাভাবিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। যদিও দুঃখজনক, তবু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে আপনার জীবন তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত, কারণ মানুষ হিসেবে আপনার পৃথিবীর প্রতি যে-দায়িত্ব ছিল আপনি সেটি সুচারুভাবে পালন করেন নি। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি নিয়ে আপনার প্রতি কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের কোনো অভিযোগ নেই, তার কারণ আপনাকে আপনার উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়েছে। বেআইনিভাবে ক্রুগো কম্পিউটারে প্রবেশ করার জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, আপনি সেটা পেয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হয়েও আপনি একটি রবোট্রনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন, তার জন্যে আপনাকে কিছু অতিরিক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার শাস্তি হিসেবে আপনার আসন্ন নিদ্রাকে একটি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা হিসেবে পরিবর্তিত করে দেব।

না, আমি পাগলের মতো চিৎকার করে উঠি, তোমাদের কোনো অধিকার নেই; কোনো অধিকার নেই।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমার গলা দিয়ে একটি শব্দও বের হল না, আমি ঝটকা মেরে উঠে বসতে চাইলাম, কিন্তু লাভ হল না, আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এসেছে, আমি আমার আঙুল পর্যন্ত নাড়াতে পারছি না।

লোকটি একঘেয়ে গলায় আবার কথা বলতে শুরু করে, আমাদের যন্ত্রপাতি বলছে আপনি কিছু-একটা করার চেষ্টা করছেন। আপনাকে সম্ভবত বলে দিতে হবে না যে, আপনাকে যে-ওষুধ দেয়া হয়েছে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আপনার এখন দেখা, শোনা এবং চিন্তা করা ছাড়া আর সবরকম শারীরিক প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আপনাকে যেটুকু জিনিস বলার কথা এবং যে-জিনিসটি দেখানোর কথা, সেটি বলে এবং দেখিয়ে দেবার সাথে সাথে আপনি পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়বেন।

যাই হোক, একটি রোষ্ট্রনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্যে শাস্তি হিসেবে আপনাকে একটি তথ্য জানানো হবে। তথ্যটির বীভৎসতা আপনার মস্তিষ্কে পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে, যার প্রতিফল হিসেবে আপনার সুদীর্ঘ নিদ্রা একটি সুদীর্ঘ দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আপনাকে ইতোপূর্বে বলা হয়েছিল যে আপনাকে নিয়ে মহাকাশযানটি এক অভিযানে যাবে, সেখানে কোনো-এক কারণে আপনার মৃত্যু ঘটবে এবং আপনার মৃতদেহ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। কথাটি আক্ষরিক অর্থে সত্যি নয়। আপনাকে একটি গ্রহপুঞ্জের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে কোনো কারণে আপনার একটি পরিবর্তন হবে, সেই পরিবর্তন এত ভয়াবহ যে আপনার জন্যে সেটি মৃত্যুর সমতুল্য। আপনি আর আপনি থাকবেন না, আপনার সেই পরিবর্তিত অবস্থাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। আপনার যে-শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটবে, সেটি সাধারণ মানুষের জন্যে উপলব্ধি করা কঠিন, কোনো সুস্থ মানুষকেই সেই মিশনে রাজি করানো সম্ভব নয় বলে আপনাকে সেখানে পাঠানো হচ্ছে। রবোট্রনকে পালাতে সাহায্য করেছেন বলে তার শাস্তি হিসেবে আপনাকে সেই পরিবর্তন এখন চাক্ষুষ দেখানো হবে। আপনার ঠিক এই ধরনের একটি পরিবর্তন ঘটবে, সেই চিন্তাটুকু আপনার মস্তিষ্কে স্থিতিশীল হওয়ার পর আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন। আপনি আপনার সুদীর্ঘ নিদ্রায় এই দুঃস্বপ্নটুকু সহ্য করে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। ধন্যবাদ।

লোকটির ভাবলেশহীন মুখ স্ত্রীন থেকে সরে গিয়ে সেখানে একজন ঘুমন্ত মানুষের চেহারা ভেসে উঠল, আমার মতো কোনো-একজন দুর্ভাগ্যবান ব্যক্তি। একটি যান্ত্রিক গলার স্বর পরিষ্কার স্বরে বর্ণনা দেয়া শুরু করে, ইনি রুকুল গ্রহপুঞ্জের অভিযাত্রী, গ্রহপুঞ্জের দুই লক্ষ মাইল পৌছানোর ঠিক আগের অবস্থা। সমস্ত শারীরিক ও মানসিক অবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণাধীন।

একটু পরেই লোকটির চেহারায় অস্বস্তি ও কষ্টের ভঙ্গি ফুটে ওঠে, ধীরে ধীরে তার সারা শরীরে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। যান্ত্রিক গলার স্বর জানিয়ে দিল লোকটি গ্রহপুঞ্জের দুই লক্ষ মাইলের ভেতর পৌছে গেছে। এর পরের পরিবর্তন অত্যন্ত ধীরে ধীরে হয়েছে এবং পুরো পরিবর্তনটুকু শেষ হতে প্রায় এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছে, কিন্তু আমাকে সেটি এক নিমিষের ভেতরে দ্রুত দেখিয়ে দেয়া হবে।

সেই দুঃসহ বীভৎস দৃশ্য আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়, কিন্তু মানুষের ধৈর্যের সীমা যে কতদূর বিস্তৃত করা যায় সেটিও আমার জানা ছিল না। লোকটি ধীরে ধীরে একটা কুৎসিত অমানুষিক আকারে রূপ নিল, আমার দেখা কোনো প্রাণী বা সরীসৃপের সাথেই তার মিল নেই, মানুষ কল্পনাতেও এ ধরনের কোনো জীবের কথা কল্পনা করতে পারে না। সেই ভয়াবহ জীবটি ক্ষুদ্র ক্যাপসুলে ছটফট করছিল, সেটি যন্ত্রণার না সুখের অভিব্যক্তি আর বোঝার উপায় নেই।

আমি চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠতে চাইলাম, কিন্তু চিৎকার দেয়া দূরে থাকুক, আমার চোখের পাতা পর্যন্ত নাড়ানোর ক্ষমতা নেই, ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত সেই বীভৎস দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে—এর থেকে আমার কোনো মুক্তি নেই।

হঠাৎ আমার সমস্ত অনুভূতি শিথিল হয়ে আসতে থাকে, আমি বুঝতে পারলাম আস্তে আস্তে আমি গভীর ঘুমে ঢলে পড়ছি। আমার শেষ ঘুম, এই ঘুম থেকে আমি আর জাগব না, কিন্তু কী বীভৎস একটি দৃশ্য আমার চোখের সামনে। আমার ভেতরে কে যেন হঠাৎ বিদ্রোহ করে ওঠে, চিৎকার করে বলে ওঠে, আমি ঘুমাব না, এই বীভৎস দৃশ্য নিয়ে আমি ঘুমাব না, কিছুতেই ঘুমাব না। আমার শেষ মুহূর্তে আমি সুন্দর কিছু চাই, মধুর কিছু চাই—আর সেই মুহূর্তে আমার সেই সুন্দরী মেয়েটির কথা মনে পড়ে। আমার হাত স্পর্শ করে আমার দিকে একাগ্র চোখে তাকিয়েছিল, অপূর্ব সুন্দর দুটি চোখ আর সেই চোখে বিস্ময়, শঙ্কা আর তার সাথে সাথে কী গাঢ় বিষাদ! কী নাম মেয়েটির? জিজ্ঞেস করা হয় নি, আহা—আর কোনোদিন তার নাম জানা হবে না!

পরমুহূর্তে আমি ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম।