১৫. বড় হলঘরের দরজা খুলে

বড় হলঘরের দরজা খুলে একজন কমবয়সী তরুণী এসে প্রবেশ করল, উত্তেজিত গলায় বলল, স্কাউটশিপ! স্কাউটশিপ আসছে।

কয়টা?

একটা!

রুখ আর ক্রীনা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারা আন্দাজ করতে পারে স্কাউটশিপে করে কে আসছে। কেন আসছে। কী দ্রুতই–না অবস্থার পরিবর্তন হয়।

রুহান গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, রুখ, ক্রীনা, কী করবে এখন?

চল বাইরে যাই। হাজার হলেও বুদ্ধিমত্তার নিনীষ স্কেলে আমাদের উপরের স্তরে! প্রয়োজনীয় সম্মানটুকু না দেখালে কেমন করে হয়?

স্কাউটশিপটা ঘুরে খোলা জায়গাটিতে এসে নামল। গোলাকার দরজাটি খুলে যায় এবং ভিতর থেকে রয়েড নেমে আসে। রুখ এবং ক্রীনা এগিয়ে গিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

আমাদের মানববসতিতে তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি রয়েড।

ধন্যবাদ। আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।

রয়েড

বল।

তোমরা কি আগে কখনো মানববসতিতে এসেছ?

রয়েড কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, না, আসি নি। কখনো প্রয়োজন মনে করি নি।

এখন?

রয়েড সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে ফেলল, এখন আমাকে আসতেই হবে।

কেন?

তোমাদের একটা জিনিস পৌঁছে দিতে হবে।

কী জিনিস?

রয়েড তার পকেট থেকে একটা ছোট ক্রিস্টাল বের করে রুখ এবং ক্রীনার দিকে এগিয়ে দিল। রুখ ক্রিস্টালটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, এটা কী?

প্রায় সাড়ে সাত শ বছর আগে মেতসিস যখন তার যাত্রা শুরু করেছিল তখন পৃথিবীর বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন ক্লাউস ট্রিটন। ক্লাউস ট্রিটন এই মেতসিসে একরকম জোর করে মানুষকে পাঠিয়েছিলেন। মেতসিসের মূল তথ্যকেন্দ্রে এই ক্রিস্টালটিতে তিনি মানুষের উদ্দেশে কিছু কথা বলে গিয়েছিলেন। ক্রিস্টালটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার কথা—যখন–

যখন?

যখন মেতসিসের সর্বময় দায়িত্বে থাকবে মানুষ।

রুখ এবং ক্রীনা চমকে উঠে বলল, কী বললে? কী বললে তুমি রয়েড?

ঠিকই বলেছি। মেতসিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবীর বুদ্ধিমত্তাকে ছড়িয়ে দেওয়া। তোমরা সেই কাজটি করেছ। তোমাদের ডি. এন. এ. দিয়ে এখানে নতুন জগৎ তৈরি হয়েছে। মেতসিসে আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে। রয়েড খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমাদের বিদায় নেবার সময় হয়েছে। এই মেতসিস তোমাদের। তোমরা এটিকে নিজের মতো করে গড়ে তোল।

রুখ এবং ক্রীনা দাঁড়িয়ে রইল, দেখতে পেল রয়েড হেঁটে হেঁটে স্কাউটশিপে গিয়ে ঢুকছে। চাপা গর্জন করে শক্তিশালী ইঞ্জিন স্কাউটশিপটাকে ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়ে নেয়, তারপর সেটি উড়ে যেতে থাকে দূরে।

পরিশিষ্ট

বড় হলঘরটিতে মানুষেরা ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছে। রুখ হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঘরের মাঝামাঝি একটি যান্ত্রিক মানুষের মুখাবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যান্ত্রিক মানুষটি নিচু কিন্তু স্পষ্ট গলায় কথা বলতে শুরু করে।

আমি ক্লাউস ট্রিটন। পৃথিবীর বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক। আমার অনুমান সত্যি হয়ে থাকলে তোমরা মানুষেরা আমার বক্তব্য শুনছ। আমার স্বপ্ন সত্যি হয়ে থাকলে তোমরা মানুষেরা আবার মেতসিসে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছ।

বুদ্ধিমত্তার সংজ্ঞা হচ্ছে সেটিকে ছড়িয়ে দেবার ক্ষমতা। তোমরা সেটি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো একটা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছ। তোমাদের অভিনন্দন। মানুষের বুদ্ধিমত্তা পৃথিবীতে যেভাবে বিকশিত হয়েছিল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও সেটি আবার বিকশিত হোক।

আমার অনুমান সত্যি হয়ে থাকলে এই মেতসিসে তোমাদের নতুন জীবন শুরু হয়েছে। আজ থেকে এর সর্বময় দায়িত্ব তোমাদের, মানুষের। পৃথিবীর বুক থেকে একদিন মানুষকে অপসারণ করে আমরা যে তীব্র অপরাধবোধে দগ্ধ হয়েছি আজ সেই অপরাধবোধ থেকে আমরা মুক্তি পেলাম। আমার প্রিয় মানবসন্তানেরা, তোমাদের জন্য আমার ভালবাসা।

মানুষের ভালবাসাতে একদিন পৃথিবীতে যেভাবে মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছিল, মেতসিসে সেই একইভাবে নতুন সভ্যতা গড়ে উঠুক। মানুষের জয়গানে মুখরিত হোক এই মহাজগৎ।

হলোগ্রাফিক স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল। রুখ হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালাতে চাইছিল, ক্রীনা নিচু স্বরে বলল, জ্বলিও না।

জ্বালাব না?

না, থাকুক না অন্ধকার।

রুখ দেখল ক্রীনার চোখের কোনায় অশ্রু চিকচিক করছে। সে গভীর ভালবাসায় তাকে আলিঙ্গন করে নিজের কাছে টেনে আনে।