মুখোমুখি
মৃত একটা আগ্নেয়গিরির ভিতর একটি গুহায় লাইনা আর সুহান জড়াজড়ি করে বসেছে। বাইরে ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। কিরির চোখ থেকে বাঁচার জন্যে তারা যে জায়গাটি বেছে নিয়েছে সেটি গ্রহটির প্রায় অন্য পৃষ্ঠে। জায়গাটা হিমশীতল। সুহান আর লাইনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে ট্রিনি। তাকে দেখে মনে হতে পারে ঠিক কী করা প্রয়োজন সে বুঝতে পারছে না।
লাইনা বলল, ট্রিনি, তুমি যদি দাঁড়িয়ে না থেকে আমাদের কাছে বসতে, খুব চমৎকার হত।
ট্ৰিনি ঘুরে জিজ্ঞেস করল, কেন চমৎকার হত?
সবাই বসে থাকলে খুব একটা ঘরোয়া ভাব হয়। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন, যখন বাইরে তুষার ঝড় হত তখন আমরা সবাই ঘরের ভেতর জড়াজড়ি করে বসে থাকতাম। একটা আগুন জ্বলত। সত্যিকারের আগুন। সেই আগুনের সামনে আমরা বসে বসে গল্প করতাম।
বসে গল্প করা এবং দাঁড়িয়ে গল্প করার মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, মহামান্যা লাইনা।
লাইনা তরল গলায় হেসে উঠে বলল, দাঁড়িয়ে মানুষ আবার গল্প করে কেমন করে? গল্প করতে হয় বসে। একটা আগুনকে ঘিরে। গরম কোনো পানীয় খেতে খেতে। খুব একটা ঘরোয়া ভাব হয়। কোমল শান্ত একটা ভাব।
মহামান্যা লাইনা, আগুন খুব বিপজ্জনক জিনিস। সেটাকে ঘিরে বসে থাকলে শান্ত ভাব হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
সুহান গলা উঁচিয়ে বলল, ট্রিনি, তুমি কেন বাজে তর্ক করছ? মানুষের সভ্যতা এসেছে আগুন থেকে।
মানুষের সভ্যতাটি খুব ভালো জিনিস নয়।
লাইনা খিলখিল করে হেসে বলল, একেবারে খাটি কথা বলেছ তুমি ট্রিনি! একেবারে খাটি কথা!
সুহান লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, লাইনা, ট্রিনিকে তুমি বেশি প্রশ্রয় দিও না, একেবারে জীবন অতিষ্ঠ করে দেবে!
লাইনা ট্রিনিকে বলল, ট্রিনি, তুমি কাছে এসে বস।
সুহান উচ্চৈঃস্বরে হেসে বলল, লাইনা, ট্ৰিনি একটি জোড়াতালি দেয়া রবোট। সে বসতে পারে না! বসার জন্যে হাঁটুর প্রয়োজন হয়। ট্রিনির কোনো হাঁটু নেই।
ট্রেনি বলল, বসার জন্য হাঁটুর প্রয়োজন হয় সেটি পুরোপুরি সত্যি কথা নয়।
ঠিক আছে, পুরোপুরি সত্যি নয় কিন্তু অনেকখানি সত্যি।
ট্রিনি কোনো কথা না বলে গুহা থেকে বের হয়ে গেল। লাইনা জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেল ট্রিনি?
জানি না, আসবে এক্ষুনি।
সত্যি সত্যি ট্ৰিনি একটু পরে ফিরে এল, তার হাতে বাই ভার্বালের বাড়তি ছোট ইঞ্জিনটি।
ইঞ্জিন কেন এনেছ ট্রিনি?
এটা চালু করলে আগুন বের হতে থাকে, তখন আমরা সবাই এটাকে ঘিরে বসতে পারি। সুহান যদি আমাকে সাহায্য করে হাঁটু ছাড়াও বসা সম্ভব হতে পারে।
একটু পরে দেখা গেল গুহার মাঝামাঝি বাই ভার্বালের ইঞ্জিন থেকে প্রচণ্ড শব্দ করে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। ইঞ্জিনটির খুব কাছাকাছি, প্রায় বিপজ্জনক দূরত্বে বসে আছে একটি বিভ্রান্ত রবোট এবং দুজন আনন্মেত্ত মানব-মানবী। তারা কথা বলছে, হাসছে, একজন আরেকজনকে স্পর্শ করছে এবং সম্পূর্ণ অকারণে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়ছে।
সেটি ছিল এই গ্রহে মানুষের প্রথম ভালবাসার রাত।
০২.
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে লাইনা আবিষ্কার করল সুহান তার অনেক আগে উঠে গেছে। তার মাথার কাছে একটা ছোট রেকর্ডিং যন্ত্র। সেটা স্পর্শ করতেই সুহানের ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে উঠল, হাত নেড়ে বলছে—আমাদের এখানে দীর্ঘ সময় লুকিয়ে থাকতে হতে পারে। আমি আর ট্রিনি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে গেলাম। দ্বিতীয় সূর্য ওঠার আগে চলে আসব, তুমি ভয় পেয়ো না। এই জায়গাটি নিরাপদ।
লাইনা তার ঘুমানোর ছোট সিলিন্ডারটিতে উঠে বসে। গত রাতে তার ঘুমোতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে তাকে মতিক রেজোনেট করে ঘুমাতে হয়েছে। এভাবে গভীর ঘুম হয় সত্যি কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর দীর্ঘ সময় চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে থাকে। সিলিন্ডারের ভিতরে বাতাসের অনুপাত ঠিক করে রাখা ছিল। বাইরে যাবার আগে তার সম্ভবত অক্সিজেন মাস্কটি পরে নেয়া দরকার।
লাইনা যখন তার মুখে অক্সিজেন মাস্কটি লাগাচ্ছিল তখন হঠাৎ সিলিন্ডারের ওপর একজন মানুষের ছায়া পড়ে। চোখ তুলে তাকানোর আগেই হঠাৎ লাইনা বুঝতে পারে, মানুষটি কিরি। সে ঘুরে তাকাল, সত্যিই সিলিন্ডারের উপর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লাইনাকে দেখে সে সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসল।
লাইনা একটা আর্ত চিৎকার করতে গিয়ে থেমে যায়। এই নির্জন গ্রহে কেউ তার চিৎকার শুনতে পাবে না।
কিরি হাত দিয়ে অনায়াসে সিলিন্ডারের ঢাকনাটি খুলে ফেলে হাসিমুখে বলল, আমি তোমাকে নিতে এসেছি লাইনা।
লাইনা ভয়ার্ত মুখে কিরির দিকে তাকাল। একটা অমানুষিক আতঙ্কে তার হৃৎস্পন্দন থেমে যেতে চাইছে। কিরি একটা হাত বাড়িয়ে লাইনাকে স্পর্শ করে বলল, তুমি জানতে চাইছ না আমি তোমাকে কেমন করে খুঁজে পেয়েছি?
লাইনা কোনো কথা বলল না।
অনেক কষ্ট হয়েছে লাইনা। কাল সারা রাত দুটি উপগ্রহ তোমাদের খুঁজেছে। জেনারেটরগুলো নষ্ট, মহাকাশযানে বিদ্যুৎপ্রবাহ খুব কম, তাই খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তোমাকে পেয়েছি। কিরি সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে তাকে হ্যাচকা টানে ক্যাপসুল থেকে বের করে আনে।
লাইনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। কিরি সেটা লক্ষ করল না, অনেকটা নিজের মনে বলল, ছেলেটির জন্যে অপেক্ষা করে লাভ নেই। সে নিজেই আসবে আমার কাছে।
একটু থেমে যোগ করল, আমি যেরকম এসেছি!
কালো একটা ক্যাপসুলে শুয়ে আছে লাইনা, তার দুই হাত উপাসনার ভঙ্গিতে রাখা। তার কপালে এবং হতের কজিতে সেন্সর লাগানো। তার মাথার উপর একটা নীল মনিটর। সেখানে তার তাপমাত্রা, রক্তচাপ, শ্বাসযন্ত্র আর পরিপাকতন্ত্রের অবস্থা, মস্তিষ্কের কম্পন এবং আরো খুঁটিনাটি তথ্য ভেসে আসছে। মাথার কাছে একটি ছোট টিউব দিয়ে মিষ্টি গন্ধের গ্রুস্টান গ্যাস আসছে, তার দেহ অবশ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। প্রথমে শরীর, তারপর মন, সবার শেষে মস্তিষ্ক। তারপর সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাবে।
লাইনা চোখ খুলে তাকাল। তার বুকের ভিতর এক গভীর শূন্যতা। এক গভীর হাহাকার। তার ইচ্ছে করছে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে সারা সৃষ্টিজগৎ ছারখার করে দিতে। কিন্তু সে তার চোখের পাতাও নাড়াতে পারছে না। গভীর ঘুমের জন্যে তার দেহকে প্রস্তুত করছে গ্রস্টান গ্যাস।
ক্যাপসুলের উপর হঠাৎ কিরির মুখ ভেসে আসে। সে মাথা নিচু করে লাইনার কাছাকাছি এসে নরম হাতে তার চুল স্পর্শ করে কোমল গলায় বলল, ঘুমাও লাইনা। ঘুমাও।
লাইনা এক ধরনের অসহায় আতঙ্কে কিরির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিরি তার আরো কাছে এসে বলল, তোমাকে কত দিনের জন্যে ঘুম পাড়াব জান? এক শ বছর! যখন তুমি জেগে উঠবে তখন এই গ্রহে আর কেউ থাকবে না। শুধু তুমি আর আমি। আমি আর তুমি।
কিরি বিষণ্ণ স্বরে বলল, মানুষের বসতি এই গ্রহে হবে না লাইনা। হতে পারত কিন্তু হবে না। কেন হবে না জান? কারণ আমি চাই না, তাই হবে না। আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমি যা চাই তাই করতে পারি। আমি মানুষের খুব কাছাকাছি। মানুষ যেরকম অন্যায় করতে পারে, আমিও পারি। মানুষ যেরকম নিষ্ঠুরতা করতে পারে, আমিও পারি। মানুষ যেরকম ভালবাসতে পারে, আমিও পারি!
কিরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি একটি একটি করে প্রাণ ধ্বংস করব। একটি একটি করে ঐণ। তারপর আমি এই ক্যাপসুলের সামনে থাকব। শুধু তুমি আর আমি। আর মহাকাল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখব, তোমার সুহান এই মহাকাশযানকে ঘিরে ঘুরে বেড়াবে। ধীরে ধীরে তার বয়স হবে, তার চোখের দৃষ্টি ম্লান হয়ে আসবে। তার হৃদযন্ত্র। দুর্বল হবে, ত্বকের মাঝে হবে কুঞ্চিত বলিরেখা। মাথার চুল হবে তুষারের মতো সাদা। তারপর একদিন সে এই মহাকাশযানের বাইরে হাঁটু ভেঙে পড়বে। তার দেহ পড়ে থাকবে দীর্ঘদিন। ঝড়ো বাতাসে একদিন তার দেহ ঢাকা পড়ে যাবে শুকনো বালুর নিচে।
তারপর একদিন আমি তোমাকে ডেকে তুলব। ঘুম ভেঙে উঠবে তুমি, যেন এইমাত্র উঠেছ। তোমার শরীর হবে সতেজ, তোমার মন হবে জীবন্ত। সঙ্গীতের সুর বেজে উঠবে মহাকাশযানে, আর আমার হাত ধরে তুমি হাঁটবে এই করিডোরে। শুধু তুমি আর আমি। আমি আর তুমি।
কিরির সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে, চোখ থেকে হঠাৎ উজ্জ্বল আলো ঠিকরে বের হয়ে আসে। শরীর থেকে বিদ্যুৎফুলিঙ্গ বের হয়ে আসে কিলবিল করে।
ভয়াবহ আতঙ্কে লাইনা কিরির দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ঘুম নেমে আসছে, ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো ঘুম। সে ঘুমাতে চায় না। তার সমস্ত মনপ্রাণ অস্তিত্ব চিৎকার করতে থাকে কিন্তু তবু তার চোখে ঘুম নেমে আসে। অসহায় মূক এক ধরনের আতঙ্কে ছটফট করতে করতে সে অচেতন হয়ে পড়ে। তার দেহ শীতল হয়ে আসে, ক্যাপসুলের ঢাকনাটা নিচে নেমে আসে ধীরে ধীরে।
কিরি গভীর ভালবাসায় বলল, ঘুমাও লাইনা। সোনামণি আমার।
০৩.
সুহান খোলা সিলিন্ডারটির দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বুকের মাঝে সে এক গভীর শূন্যতা অনুভব করে, এক গভীর হাহাকার। জীবন পূর্ণতার কত কাছাকাছি এসে আবার শূন্য হয়ে গেল! লাইনা—তার লাইনা! কিরি এসে নিয়ে গেছে তার লাইনাকে।
সিলিন্ডারটা ধরে চিৎকার করে ওঠে সে একটা আহত বন্য পর মতো। দুই হাত দিয়ে আঘাত করে সিলিন্ডারের উপর, মাথা কুটে, তারপর মাটিতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে শিশুর মতো।
কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ সে মুখ তুলে উঠে দাঁড়ায়। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মোছে। সে একবার আকাশের দিকে তাকাল, তারপর অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। ট্ৰিনি এতক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল। সুহানকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বলল, তুমি এখন কী করবে সুহান?
সুহান অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিরির সাথে একটা বোঝাপড়া করতে হবে আমার।
কিরি?
হ্যাঁ। কিরি। হয় কিরি বেঁচে থাকবে, না হয় আমি।
কিরি দশম প্রজাতির রবোট, সুহান।
সুহান ট্রিনির দিকে তাকিয়ে তীব্র স্বরে বলল, আমি প্রথম প্রজাতির মানুষ।
প্রথম প্রজাতির মানুষ?
হ্যাঁ।
ও। ট্ৰিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি কেমন করে বোঝাপড়া করবে, সুহান?
আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না।
কেন নয়?
কারণ আমি জানি না।
তুমি জান না?
না।
ও ট্ৰিনি আবার চুপ করে গেল।
সুহান আবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে এক ধরনের লালচে আভা। আবার ঝড় আসবে। সে অন্যমনকের মতো কয়েক পা হেঁটে সামনে যায়। তারপর ঘুরে ট্রিনির দিকে তাকাল, বলল, ট্রিনি, আমার সেই অস্ত্রটি কোথায়?
কোন অস্ত্র?
আমি যেটা তৈরি করেছিলাম। একটা নল, তার সাথে একটা ট্রিগার, আর ধরার জন্যে একটা হাতল, যার ভিতরে বিস্ফোরক ভরে আমি গুলি করি?
যেটিতে মেগা কম্পিউটার নেই?
হ্যাঁ।
যেটিতে বন্ধ করার জন্যে কোনো লেজার নেই? যেটি তুমি চোখের আন্দাজে ব্যবহার কর? যেটি আসলে কোনো অস্ত্র নয়, একটি বিপজ্জনক খেলনা?
হ্যাঁ, কোথায় সেটা?
আছে এখানে।
আমাকে এনে দাও।
ট্রিনি খানিকক্ষণ সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিক আছে। এনে দিচ্ছি।
ট্ৰিনি প্রাগৈতিহাসিক যুগের অস্ত্রের মতো দেখতে এই অস্ত্রটি সুহানের উরুর সাথে বেঁধে দিল। জিজ্ঞেস করল, ভেতরে বিস্ফোরক আছে ট্রিনি?
আছে।
বুলেট?
আছে।
বুলেট বিস্ফোরক আছে ট্রিনি?
আছে। চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরক।
সুহান তখন লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে। ট্রিনি বলল, আমি তোমাকে পৌছে দেব সহান, সাবধানে নিয়ে যাব কিরি যেন টের না পায়।
তার আর কোনো প্রয়োজন নেই, ট্ৰিনি।
ট্ৰিনি নিচু স্বরে বলল, তুমি আমাকে বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে চলে যাচ্ছ সুহান।
সুহান ঘুরে ট্রিনির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, আমার বিদায় সম্ভাষণ জানাতে ভালো লাগে না, ট্রিনি।
কিরি কন্ট্রোলরুমে বড় স্ক্রিনটার সামনে দাঁড়িয়েছিল। সুহানকে সে বাই ভার্বালে করে উড়ে আসতে দেখল। মহাকাশযানটিকে দুবার ঘুরিয়ে বাই ভার্বালটি সে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে মহাকাশযানের কাছাকাছি থামিয়ে সেখান থেকে নেমে আসে। তারপর সে হেঁটে হেঁটে মহাকাশযানের কাছাকাছি একটা পাথরে হেলান দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভিতরে কোনো উত্তেজনা নেই, ঝড়ো বাতাসে তার চুল উড়ছে, তার মাঝে সে সম্পূর্ণ অবিচলিত ভঙ্গিতে মহাকাশযানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মহাকাশযানের গোল জানালা দিয়ে সুহানকে প্রথম দেখতে পেল রিশা। বিশাল ধু-ধু শূন্য প্রান্তরে একটি বড় পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি অনিন্দ্যসুন্দর কিশোর। এটি যেন কোনো বাস্তব দৃশ্য নয়, যেন একটি স্বপ্নের দৃশ্য। যেন কাল্পনিক কোনো জগৎ থেকে নেমে এসেছে একটি রক্তমাংসের মানুষ। রিশার চিৎকার শুনে কয়েকজন ছুটে আসে। তাদের দেখাদেখি অন্যেরা। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই মহাকাশযানের জানালা দিয়ে অবাক হয়ে বাইরে তাকিয়ে এই বিচিত্র কিশোরটিকে দেখতে থাকে। যাকে হত্যা করার জন্যে কিরি। মানুষ থেকে অমানুষে পাল্টে গেছে।
কিরি তার স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে রইল দীর্ঘ সময়। ছেলেটি খালি হাতে এসেছে, উরুতে কিছু একটা বাধা আছে, সেটি কোনো এক ধরনের অস্ত্র মনে হতে পারে কিন্তু সে জানে সেটি সত্যিকারের অস্ত্র নয়। বলা যেতে পারে, সে এসেছে আত্মহত্যা করতে। কিরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ছেলেটিকে তার হত্যা করার কথা ছিল, কিন্তু এভাবে নয়। কিন্তু সে যদি এভাবেই চায় তাহলে এভাবেই হোক। সে প্রতিরক্ষা রবোটটিকে ডেকে বলল, কিউ-৪৬, মহাকাশযানের দরজা খুলে দাও। আমি একটু যাব।
মহাকাশযানের ভারি দরজা ঘরঘর শব্দ করে উঠে যায়। ঝড়ো বাতাস এসে ঝাপ্টা দেয় কিরিকে। সেই বাতাসে হেঁটে হেঁটে সে সুহানের দিকে এগিয়ে গেল। তার কাছাকাছি গিয়ে নরম গলায় বলল, আমি তোমাকে এভাবে আশা করি নি।
সুহান হিসহিস করে বলল, লাইলা কোথায়?
আছে।
কোথায় আছে?
ঘুমিয়ে আছে। শীতলঘরে ঘুমিয়ে আছে।
সুহান হিংস্র স্বরে বলল, শয়তান!
কিরি শব্দ করে হেসে উঠে বলল, তুমি কেন এখানে এসেছ?
তোমাকে শেষ করতে এসেছি।
তুমি জান আমি দশম প্রজাতির রবোট?
জানি।
তুমি জান আমাকে হত্যা করার মতো কোনো অস্ত্র তৈরি হয় নি পৃথিবীতে?
সুহান তার উরু থেকে অস্ত্রটি টেনে হাতে নিয়ে কিরির দিকে তাক করে বলল, এই অস্ত্রটি পৃথিবীতে তৈরি হয় নি।
তুমি জান আমার দিকে একটি অস্ত্র তাক করা মাত্র আমার সংবেদনশীল দেহ সেটি জানতে পারে? তুমি জান লেজার রশ্মি দৃষ্টিবদ্ধ করা মাত্র আমার কপোট্রনের হাইপার কিউব অস্ত্রের মেগা কম্পিউটার অচল করে দেয়? তুমি জান গুলি করা মাত্র বিস্ফোরক তার গতিপথ পরিবর্তন করে অস্ত্রধারীর কাছে ফিরে যায়?
এখন জানলাম।
তুমি জান আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু?
মানুষ মানুষকে হত্যা করে কিরি। রবোটকে না। রবোটকে ধ্বংস করে। আমি তোমাকে হত্যা করব না, ধ্বংস করব।
কিরি সুহানের দিকে তাকাল, তার মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসে সূক্ষ্ম অপমানে। সুহান তার প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র তুলে ধরেছে। কিরি আবার তাকাল সুহানের চোখের দিকে। কী সহজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে এই কিশোর! শুধুমাত্র মানুষই বুঝি পারে এ রকম, তার ভিতরে হঠাৎ ঈর্ষার একটি খোচা অনুভব করে সে। সুহানের চোখের দিকে তাকাল। কী ভয়ঙ্কর তীব্র দৃষ্টি! কী গভীর আত্মপ্রত্যয়! কী আশ্চর্য একাগ্রতা! কিরি তার সমস্ত কপোট্রনকে স্থির করিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে লেজার রশ্মির জন্যে, মেগা কম্পিউটারের সঙ্কেতের জন্যে।
সুহান ট্রিগার টেনে ধরল তখন।
কিরি অবাক হয়ে দেখে, সুহানের প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র থেকে একটি বিস্ফোরক ঘুরতে ঘুরতে ছুটে আসছে। তার আগে কোনো লেজাররশ্মি নেই, কোনো দৃষ্টিবদ্ধ করার চেষ্টা নেই, কোনো মেগা কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নেই, শুধু একটি সাদামাঠা বিস্ফোরক। কিরির চোখ সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বিস্ফোরকটিকে, তার কপোট্রনের শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্র বিকল করে দিতে চেষ্টা করে বিস্ফোরকটির গতি নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার। কিন্তু সে আবিষ্কার করে কোনো কম্পিউটার নেই বিস্ফোরকটিতে। ঘুরতে ঘুরতে তার দিকে আসছে। একটু উপর দিয়ে কিন্তু এই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সেটাকে টেনে নামিয়ে আনছে নিচে। ঠিক যখন তার কাছে আসবে এটি সোজা আঘাত করবে তার মাথায়। কিরির কপোট্রন জানে সে সরতে পারবে না, তার দেহ মানুষের মতো ধীরস্থির, তার নড়তে সময় প্রয়োজন, সমস্ত শক্তি দিয়েও সে গুলিটি আঘাত করার আগে এক চুল নড়তে পারবে না। প্রাগৈতিহাসিক একটি অস্ত্র থেকে ছুটে আসছে একটি অন্ধ বিস্ফোরক, তাকে থামানোর কোনো উপায় নেই। কিরি অবাক হয়ে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কিছু করার নেই, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে অপেক্ষা করতে হবে। সেটি প্রায় এক মহাকাল সময়। সেটি প্রায় একটি জীবন।
কিরি বিস্ফোরকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গভীর বিষণ্ণতায় তার বুক হাহাকার করে ওঠে। মানুষ কেন তাকে সৃষ্টি করেছিল মানুষের সব ক্ষুদ্র দিয়ে মানুষ কেন তাকে সৃষ্টি করেছিল দুঃখ কষ্ট আর বেদনা দিয়ে? মানুষ কেন তাকে তৈরি করেছিল মানুষের এত কাছাকাছি…।
মহাকাশযানের জানালা দিয়ে সবাই দেখল প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কিরির মস্তিষ্ক চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে উড়ে গেল।
০৪.
খুব ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে আসছে লাইনার। কেউ একজন তাকে ডাকছে কোমল স্বরে। কে? কে ডাকছে তাকে? আবছা কুয়াশার মতো একটা পরদায় সব ঢাকা, কষ্ট করে চোখ খুলে তাকায় সে। তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে অনিন্দ্যসুন্দর একটি মুখ, লম্বা কালো চুল, রাতের আকাশের মতো কালো চোখ। কোথায় দেখেছে সে এই মুখ? কোথায়?
আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিল লাইনা, বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে জোর করে নিজেকে টেনে তুলে আনে লাইনা। চোখ খুলে তাকায় আবার। অপূর্ব সুন্দর একটি মুখ, একটি কিশোরের মুখ, উজ্জ্বল চোখে কিছু একটা বলছে তাকে। কী বলছে সে? কোথায় দেখেছে তাকে? কোথায়?
হঠাৎ করে কিছু একটা মনে পড়ে তার। বুকের ভিতর গভীর ভালবাসার একটি স্রোতধারা বাধ ভেঙে ছুটে আসে হঠাৎ। প্রাণপণে চোখ খুলতে চেষ্টা করে লাইনা। তাকে দেখতে হবে সেই মুখটি। সেই অনিন্দ্যসুন্দর মুখটি। তাকে দেখতেই হবে আর একবার।
পরিশিষ্ট
অনেকগুলো শিশু গোল হয়ে বসে আছে একটি আলোকোজ্জল ঘরে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে ট্রিনি। তার হাতে একটি স্বচ্ছ কোয়ার্টজের প্রিজম। প্রিজমটি উপরে তুলে সে উচু স্বরে বলল, সবাই চুপ করে বস, কারণ এখন আমাদের বিজ্ঞান শেখার সময়। এটি একটি প্রিজম। প্রিজমের মাঝ দিয়ে আলো গেলে কী হবে?
একটি শিশু মুখ ভেংচে বলল, ছাই হবে।
ছিঃ নিশান, এভাবে কথা বলে না। ছিঃ!
কী হয় বললে?
ট্রিনিকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়। প্রায় দুই যুগ আগে এই শিশুটির পিতাকে কী বলেছিল মনে করতে পারে না। তার কপোট্রনের মেমোরি মডিউলটি দীর্ঘ ব্যবহারে জীর্ণ, পুরোনো তথ্যের ওপর নতুন তথ্য লেখা হয়ে গেছে। ট্ৰিনি প্রাণপণ চেষ্টা করে একটি উত্তর খুঁজে পাবার কিন্তু কোনো লাভ হয় না। হঠাৎ করে তার ডান হাতটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নড়তে রু করে।
শিশুগুলো উচ্চৈঃস্বরে হাসছে। ট্রিনির আবছাভাবে মনে পড়ে এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছিল। কিন্তু কখন সে মনে করতে পারে না। তার স্মৃতি খুব দুর্বল হয়ে আছে, দীর্ঘ ব্যবহারে তার কপোট্রন জীর্ণ। শুধু মনে পড়ে একটিমাত্র শিশু ছিল তখন, এ রকম অনেকগুলো শিশু নয়।
মানুষের বসতি হয়ে এখন অনেক শিশু হয়েছে এই গ্রহে। শিশুগুলো দুরন্ত, তাদেরকে সামলে রাখা এখন অনেক কঠিন। সুহান আর লাইনাকে বলতে হবে এ রকম করে আর চলতে পারে না। কিছুতেই চলতে পারে না। সুহান আর লাইনা তার কথা না শুনলে অন্যদেরও বলতে হবে। তারা নিশ্চয়ই তার কথা শুনবে। এ রকম করে চলতে পারে না সেটা তাদের স্বীকার করতেই হবে।
কিন্তু ট্ৰিনি জানে এ রকমভাবেই চলবে। কারণ সে মনে হয় এ রকমই চায়। দ্বিতীয় প্রজাতির রবোটের বুকে ভালবাসা থাকার কথা নয়, তার বুকেও নিশ্চয়ই কোনো ভালবাসা নেই। দীর্ঘদিন মানুষের সাথে থেকে এইরকম অযৌক্তিক এবং অর্থহীন কাজ করার বিচিত্র যে প্রবৃত্তির জন্ম নিয়েছে সেগুলো নিশ্চিতভাবেই অতি ব্যবহারে জীর্ণ একটি কপোট্রনের নানা ধরনের ত্রুটি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু ট্রিনি সেভাবে ব্যাখ্যা করতে চায় না। তার ভাবতে ভালো লাগে সে ভালবাসতে শিখেছে।
মানুষ যেরকম করে ভালবাসে অন্য মানুষকে।