॥ ৫ ॥
রাত্রে বিশেষ ট্র্যাফিক নেই, তাও এক ঘণ্টা হাতে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। খাওয়াটা বাড়িতেই সেরে নিলাম। এত তাড়াতাড়ি খাওয়া অভ্যেস নেই আমাদের; লালমোহনবাবু বললেন, ‘খিদে পেলে ওই মিষ্টির দোকানে ঢুকে পড়া যাবে। কচুরি আর আলুর তরকারি নির্ঘাৎ পাওয়া যাবে।’
একটা সুবিধে এই যে লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদবাবু ফেলুদার ভীষণ ভক্ত। তার উপর বোম্বাই মার্কা ফাইটিং-এর ছবি দেখার সুযোগ ছাড়েন না কখনো। এরকম না হলে রাতবিরেতে বারাসতে ঠ্যাঙাতে অনেক ড্রাইভারই গজগজ করত; ইনি যেন নতুন লাইফ পেলেন।
ভি আই পি রোডে পড়ে লালমোহনবাবু গান ধরেছিলেন—’জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’, কিন্তু ফেলুদা তাঁর দিক চাইতে অমাবস্যায় গানটা বেমানান হচ্ছে বুঝতে পেরে থেমে গেলেন।
আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই। তারার আলো বলে একটা জিনিস আছে, সেটা হয়ত আমাদের কিছুটা হেল্প করতে পারে। ফেলুদার ফরমাশ অনুযায়ী গাঢ় রঙের জামা পরেছি। লালমোহনবাবুর পুলোভারটা ছিল হলদে, তাই তার উপর ফেলুদার রেনকোটটা চাপিয়ে নিয়েছেন। ভদ্রলোক এখন গাড়িতে বসা; যখন হাঁটবেন তখন একটা পকেট ভীষণ ঝুলে থাকবে, কারণ তাতে ভরা আছে একটা হামানদিস্তার লোহার ডাণ্ডা। ওয়েপন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভদ্রলোক ওটা চেয়ে নিয়েছেন শ্রীনাথের কাছে। ফেলুদার পকেটে অবশ্য রয়েছে তার কোল্ট রিভলভার।
আমাদের আন্দাজ ভুল হয়নি; দশটার কিছু আগে আমরা তেমাথায় পৌঁছে গেলাম। মিষ্টির দোকানের পাশেই একটা পানের দোকান—তার সামনে থেকে হৃষিকেশবাবু এগিয়ে এসে আমাদের গাড়িতে উঠে হরিপদবাবুকে বললেন, ‘ডাইনের রাস্তাটা নিন।’
খানিক দূর যেতেই বাড়ি কমে এল। আলোও বেশি নেই; রাস্তায় যা আলো ছিল তাও ফুরিয়ে গেল বাঁয়ে মোড় নিতে। বুঝলাম এটা প্রায় পল্লীগ্রাম অঞ্চল। ‘বারাসতেই ছিল প্রথম নীলকুঠি।’ বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘এদিকটাতে এককালে অনেক সাহেব থাকত; দিনের আলোয় তাদের সব ভাঙা বাগানবাড়ি দেখতে পেতেন।’
মিনিট কুড়ি চলার পর একটা জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন হৃষিকেশবাবু।
‘আসুন।’
গাড়ি থেকে নামলাম চার জনে। ‘গাড়িটা এখানেই ওয়েট করুক’, বললেন হৃষিকেশবাবু, ‘আমি আপনাদের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে আসি, তারপরে এই গাড়িই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে আসবে। আমি সাইকেল রিকশা করে ঠিক এগারোটার সময় চলে আসব।’
লালমোহনবাবু হরিপদবাবুকে টাকা দিয়ে বললেন, ‘তুমি এঁকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় কোনো দোকানটোকান থেকে খাওয়াটা সেরে নিও। ফিরতে রাত হবে আমাদের।’
ঘাসের উপর দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটতে একটা জংলা জায়গা এসে পড়ল।
‘এখানেই ছিল মধুমুরলীর দিঘি’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘আমাদের যেতে হবে ওইখানটায়।’
খুবই কম আলো, কিন্তু তাও বুঝতে পারছি যে গাছপালা ছাড়াও ওদিকে একটা দালানের ভগ্নস্তূপ রয়েছে। শীতকাল বলে রক্ষে, না হলে এ জায়গাটা হত সাপ ব্যাঙের ডিপো!
‘এখন টর্চের আলোটা বোধহয় তেমন বিপজ্জনক কিছু নয়,’ বলল ফেলুদা।
‘মনে ত হয় না,’ বললেন হৃষিকেশবাবু।
ছোট্ট পকেট টর্চের আলোতে ঝোপঝাড় খানাখন্দ বাঁচিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম নীলকুঠির ভগ্নস্তূপের পাশে।
‘ওই যে দেখুন শ্যাওড়া গাছ’, বললেন হৃষিকেশবাবু! ফেলুদা সেদিকে একবার টর্চ ফেলে সেটা নিবিয়ে পকেটে পুরল।
‘আমি তাহলে আসি।’
‘আসুন।’
‘তিন কোয়ার্টার আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
আমরা যেদিক দিয়ে এসেছিলাম সেদিক দিয়েই চলে গেলেন হৃষিকেশবাবু। এক মিনিটের মধ্যেই তাঁর পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল।
‘ওডোমসটা লাগিয়ে নিন।’
ফেলুদা পকেট থেকে টিউব বার করে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।
‘যা বলেছেন মশাই। ম্যালেরিয়া শুনছি আবার খুব বেড়েছে।’
আমরা তিন জনেই ওডোমস লাগিয়ে নিয়ে একটা বড়রকম দম নিয়ে অপেক্ষার জন্য তৈরি হলাম। আমাদের কাউকেই দাঁড়াতে হবে না, কারণ ভগ্নস্তূপে নানান হাইটের ইটের পাঁজা রয়েছে, তাতে চেয়ার চৌকি মোড়া সব কিছুরই কাজ হয়। কথা বলতে হলে ফিস্ফিস্ ছাড়া গতি নেই, তাও প্রথম দিকটায়। পরের দিকে কমপ্লীট মৌনী। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে, এখন চারিদিকে চাইলে বট, অশ্বথ, আমগাছ, বাঁশঝাড়—এসব বেশ তফাৎ করা যায়। ঝিঁঝির শব্দ ছাড়াও যে অন্য শব্দ আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। ট্রেনের আওয়াজ, সাইকেল রিকশার চড়া হর্ন, রাস্তার কুকুরের ঘেউ ঘেউ, এমনকি দূরের কোনো বাড়ি থেকে ট্রানজিস্টারের গান পর্যন্ত। ফেলুদার ঘড়িতে রেডিয়াম ডায়াল, তাই অন্ধকারেও টাইম দেখতে পারে।
শীত যেন মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। শহরের চেয়ে নির্ঘাৎ পাঁচ সাত ডিগ্রী কম। লালমোহনবাবু তাঁর টুপি আনেননি, রুমাল সাদা, তাই সেটা বাঁধলেও চলে না; নিরুপায় হয়ে দু’ হাতের তেলো দিয়ে টাক ঢেকেছেন। একবার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করাতে ফেলুদা বলল, ‘কিছু বললেন?’ তাতে ভদ্রলোক ফিস্ফিস্ করে জবাব দিলেন, ‘শ্যাওড়া গাছেই বোধহয় পেত্নী না শাঁকচুন্নি কী যেন থাকে।’
‘শ্যাওড়া গাছের নামই শুনেছি,’ ফিস্ফিসিয়ে বলল ফেলুদা, ‘চোখে এই প্রথম দেখলাম।’
আকাশে তারাগুলো সরছে। একটু আগে একটা তারাকে দেখেছিলাম নারকোল গাছের মাথার উপরে, এখন দেখছি গাছটায় ঢাকা পড়ে গেছে। কোনো চেনা কনস্টেলেশন আছে কিনা দেখার জন্য মাথাটা উপর দিকে তুলেছি, এমন সময় একটা শব্দ কানে এল। পায়ের শব্দ।
এগারোটা বাজেনি এখনো। ফেলুদা দু মিনিট আগে ঘড়ি দেখে ফিস্ফিস্ করে বলেছে, ‘পৌনে।’
আমরা পাথরের মতো স্থির।
যেদিক দিয়ে এসেছি, সেদিক দিয়েই আসছে শব্দটা। ঘাসের উপর মাঝে মাঝে ইট পাটকেল রয়েছে, তার জন্যই শব্দ। তাও কান না পাতলে, আর অন্য শব্দ না কমলে শোনা যায় না। এখন ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
এবার লোকটাকে দেখা গেল। সে এগিয়ে এসেছে শ্যাওড়া গাছটাকে লক্ষ করে।
এবারে তার হাঁটার গতি কমাল। আমরা মাটিতে ঘাপটি মেরে বসা, সামনে একটা ভাঙা পাঁচিল আমাদের শরীরের নীচের অংশটা ঢেকে রেখেছে। আমরা তার উপর দিয়ে দেখছি।
‘হৃষিকেশবাবু—’
লোকটা চাপা গলায় ডাক দিয়েছে। হাঁটা থামিয়ে। তার দৃষ্টি যে শ্যাওড়া গাছটার দিকে সেটা মাথাটা দেখে আন্দাজ করতে পারছি, যদিও মানুষ চেনার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
‘হৃষিকেশবাবু—’
ফেলুদা ওঠার জন্য তৈরি। তার শরীর টান সেটা বেশ বুঝতে পারছি। লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
লালমোহনবাবুর ডান কনুইটা উঁচিয়ে উঠেছে। উনি পকেট হাতড়াচ্ছেন হামানদিস্তাটার জন্য।
লোকটা এখন দশ হাতের মধ্যে।
‘হৃষিকেশ—’
ফেলুদা বাঘের মতো লাফিয়ে উঠতেই একটা রক্ত জল করা ব্যাপার ঘটে গেল।
আমাদের পিছন থেকে দুটো লোক এসে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
ফেলুদার সঙ্গে থেকেই বোধহয় আমার নার্ভও শক্ত হয়ে গেছে। চট করে বিপদে মাথা গুলোয় না। আমি তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সামনের দিকে। ফেলুদার ঘুঁষি খেয়ে একটা লোক আমারই দিকে ছিটকে এসেছিল। আমি তাকে লক্ষ করে আরেকটা ঘুঁষি চালাতে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘাসের উপর।
কিন্তু এ কি, আরো লোক এসে পড়েছে পিছন থেকে! তার মধ্যে একটা আমায় জাপটে ধরেছে, আরো দুটো গিয়ে আক্রমণ করেছে ফেলুদাকে। ধস্তাধস্তির শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু আমি নিজে বন্দী, যদিও তারই। মধ্যে জুতো পরা ডান পাটা দিয়ে ক্রমাগত পিছন দিকে লাথি চালাচ্ছি।
লালমোহনবাবু কী করছেন এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই থুৎনিতে একটা বিরাশি শিক্কা ঘা খেলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকের অন্ধকার যেন আরো দশ গুণ গাঢ় হয়ে গেল।
তারপর আর কিছু জানি না।
‘কিরে, ঠিক হ্যায়?’
ফেলুদার চেহারাটাই প্রথম দেখতে পেলাম জ্ঞান হয়ে।
‘ঘাবড়াসনি, আমিও নক-আউট হয়ে গেসলাম দশ মিনিটের জন্য।’
এবারে দেখলাম ঘরের অন্য লোকেদের। অমিতাভবাবু তাঁর পাশে একজন মহিলা—নিশ্চয়ই তাঁর স্ত্রী—লালমোহনবাবু, হৃষিকেশবাবু, আর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্যবাবু। এ ঘরটা আগে দেখিনি; বাড়ির বত্রিশটা ঘরের কোনো একটা হবে।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। একটা কন্কনে ব্যথা থুৎনির কাছটায়। তাছাড়া আর কোনো কষ্ট নেই। ফেলুদা ঘুঁষিটা খেয়েছিল ডান চোখের নীচে সেটা কালসিটে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ব্ল্যাক-আই ব্যাপারটা অনেক বিদেশী ছবিতে দেখেছি; স্বচক্ষে এই প্রথম দেখলাম।
‘একমাত্র জটায়ুই অক্ষত’, বলল ফেলুদা।
সেকি। আশ্চর্য ব্যাপার ত!—’কী করে হল?’
‘মোক্ষম ওয়েপন ওই হামানদিস্তা’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘হাতে নিয়ে মাথার উপর তুলে হেলিকপটারের মত বাঁই বাঁই করে ঘুরিয়ে গেলাম। আমার ধারে কাছেও এগোয়নি একটি গুণ্ডাও।’
‘ওরা গুণ্ডা ছিল বুঝি?’
‘হায়ার্ড গুণ্ডাজ’, বললেন লালমোহনবাবু।
‘বললাম লোকটা ডেঞ্জারাস’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘তবে ও যে এতটা করবে তা ভাবিনি। আমি ত গিয়ে অবাক। একজন শোয়া একজন বসা একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাটিতে। আর আসল যে লোক সে হাওয়া।’
ফেলুদা আর লালমোহনবাবু নাকি আমাকে ধরাধরি করে গাড়িতে এনে তোলেন। অমিতাভবাবু নিজে বেশ রাত অবধি পড়েন, তাই উনি জেগে ছিলেন। যে ঘরটায় আমরা রয়েছি সেটা একতলার একটা গেস্টরুম। বেশ বড় ঘর, পাশেই বাথরুম। পুবে জানালা দিয়ে নাকি বাগান দেখা যায়। অমিতাভবাবুই জোর করলেন আজ রাতটা এখানে থাকার জন্য। অসুবিধা এই যে বাড়তি কাপড় নেই, যা পরে আছি তাই পরেই শুতে হবে। ‘হৃষিকেশবাবুর ভয়ের জন্যই এই গোলমালটা হল’, বললেন অমিতাভবাবু, ‘পুলিশকে বলা থাকলে সাধু সমেত গুণ্ডারা এতক্ষণে হাজতে।’
হৃষিকেশবাবুও অবিশ্যি অ্যাপলজাইজ করলেন। কিন্তু ভদ্রলোককেই বা দোষ দেওয়া যায় কি করে?, ওরকম শাসানির পর যে কোনো মানুষেরই ভয় হতে পারে।
অমিতাভবাবুর স্ত্রীই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বললেন, ‘বাড়িতে এইদুর্যোগ, আপনাদের সঙ্গে বসে দু’ দণ্ড কথা বলারও সুযোগ হল না। এনার এত বই আমি পড়েছি— কী যে আনন্দ পাই তা বলতে পারি না।’
শেষের কথাটা অবিশ্যি লালমোহনবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলা।
ফেলুদা বলল, ‘কাল সকালে যাবার আগে আপনার ছেলের সঙ্গে একবার কথা বলে নেব। ঘরে চোর ঢোকার পরেও ও যা সাহস দেখিয়েছে তেমন সচরাচর দেখা যায় না।’
সাড়ে বারোটা নাগাদ যখন আমরা শোবার আইয়োজন করছি তখন ফেলুদা একটা কথা বলল।
‘ঘুঁষিটাও যে ব্রেন টনিকের কাজ করে সেটা আজ প্রথম জানলাম।’
‘কিরকম?’ বললেন লালমোহনবাবু।
‘সাধুবাবু ভ্যানিশ করার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি এতদিনে।’
‘বলেন কি!’
‘তুখোড় লোক। তবে যার সঙ্গে মোকাবিলা করছে সেও ত কম তুখোড় নয়!’
এর বেশি আর ফেলুদা কিছু বলল না।