॥ ৫ ॥
পাণ্ডাদের ঘরে গভীর ঘুমে রাত কাটিয়ে ভোর পাঁচটার মধ্যে আলার্ম বাজিয়ে উঠে আমরা তিনজনে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
এত ভোরে বিভিন্ন দেশীয় এত যাত্রীর ভীড় এখানে জমায়েত হয়েছে। সেটা ভাবতেই পারিনি। এদের মধ্যে বাঙালী আছে প্রচুর, আর তাদের প্রায় সবাই দলে এসেছে। দল বলতে অবিশ্যি পরিবারও বোঝায়। সত্তর বছরের দাদু থেকে নিয়ে পাঁচ বছরের নাতনী পর্যন্ত, তার মধ্যে মাসি-পিসিও যে নেই তা নয়।
ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ ক্যামেরা হাতে পবনদেওকে দেখে বেশ অবাক হলাম। তিনি ঘোড়া ভাড়া করেছেন দুটো—একটা নিজের জন্য, একটার পিঠে থাকবে সরঞ্জাম। আমাদের দেখে বললেন, শোনপ্রয়াগে নাকি অনেক ইন্টারেস্টিং ছবি তোলার ছিল, তাই কাল এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়েছে। আমাদের সঙ্গেই অবিশ্যি রওনা হচ্ছেন, তবে উনি থেমে থেমে ছবি তুলতে তুলতে যাবেন; ক্যামেরা ও সাউণ্ডের সরঞ্জাম থাকবে নিজের সঙ্গে—ফিল্ম, অর্থাৎ কাঁচামাল, থাকবে অন্য ঘোড়ার পিঠে।
ফেলুদা ছোটকুমারের কাছ থেকে সরে এসে বলল, ‘রহস্যের শেষ নেই। উনি কি তাহলে কেদারে লোক লাগিয়েছেন উপাধ্যায়কে খুঁজে বার করার জন্য?’
যাই হোক, এসব ভাববার সময় এখন নয়, কারণ আমাদের রওনা দেবার সময় এসে গেছে।
‘আপনি তাহলে দৃঢ়সংকল্প যে হেঁটেই যাবেন?’ ফেলুদা লালমোহনবাবুকে আবার জিজ্ঞেস করল।
‘ইয়েস স্যার,’ বললেন জটায়ু, ‘তবে হ্যাঁ, আপনাদের সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে পারব কিনা সে বিষয়—’
‘সে বিষয় আপনি আদৌ চিন্তা করবেন না। আপনি আপনার নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী হাঁটবেন। গন্তব্য যখন এক, রাস্তা যখন এক, তখন পিছিয়ে পড়লেও চিন্তার কারণ কিছু নেই। এই নিন, এইটে হাতে নিন।’
আমরা তিনজনের জন্য তিনটে লাঠি কিনে নিয়েছি যার নিচের অংশটা ছুঁচোলো লোহা লাগানো। এ লাঠি এখন প্রত্যেক পদযাত্রীর হাতে। এর দাম দু’ টাকা, ফিরে এসে আবার ফেরত দিলে এক টাকা ফেরত পাওয়া যায়। তারই একটা ফেলুদা লালমোহনবাবুকে দিয়ে দিল।
আমরা ঘড়ি ধরে ছটায় রওনা দিলাম। লালমোহনবাবু যেরকম হাঁক দিয়ে ‘জয় কেদার’ বলে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ নিলেন, আমার ত মনে হল তাতেই তাঁর অর্ধেক এনার্জি চলে গেল।
পাহাড়ের গা দিয়ে পাথরে বাঁধানো রাস্তা। শুধু যে শীর্ণ তা নয়, এক এক জায়গায় একজনের বেশি একসঙ্গে পাশাপাশি যেতে পারে না। একদিকে পাহাড়, একদিকে খাদ, খাদের নিচ দিয়ে বেগে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী। দুদিকেই মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ থাকার ফলে যাত্রীদের মাথার উপর একটা চাঁদোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বেশির ভাগ অংশেই গাছপালা নেই, খালি শুক্নো ঘাস আর পাথর। পায়ে যারা হাঁটছে, তাদের মুশকিল হচ্ছে কি অশ্বারোহী আর ডাণ্ডিবাহীদের জন্য প্রায়ই তাদের পাশ দিতে হচ্ছে। এখানে নিয়মটা হচ্ছে কি সবসময়ই পাহাড়ের গা ঘেঁষে পাশ দেওয়া। খাদের দিকটায় গিয়ে পাশ দিতে গেলে পদস্খলনের সমূহ সম্ভাবনা।
যোগব্যায়াম করি বলে বোধহয় আমাদের দুজনের খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না। লালমোহনবাবুর পক্ষে ব্যাপারটা খুব শ্রমসাপেক্ষ হলেও উনি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন সেটা যেন বাইরে প্রকাশ না পায়। চড়াই ওঠার সময় ত কথা বলা যায় না; এরপর খানিকটা সমতল রাস্তায় আমাদের কাছাকাছি পেয়ে বললেন, ‘তেনজিং নোরকের মাহাত্ম্যটা কোথায় সেটা এখন বুঝতে পারছি।’
মিনিট কুড়ি চলার পর একটা ঘটনা ঘটল যেটা আমাদের কেদার পৌঁছানটা আরো আধ ঘণ্টা পিছিয়ে দিল।
একটা বেশ বড় পাথরের খণ্ড পাহাড়ের গা দিয়ে হঠাৎ গড়িয়ে এল সোজা ফেলুদার দিকে। ব্যাপারটা সম্বন্ধে সচেতন হতে যে কয়েকটা মুহূর্ত গেল তাতেই কিছুটা ড্যামেজ হয়ে গেল। পাথরের ঘষা খেয়ে ফেলুদার হাতের এইচ এম টি ঘড়িটা চুরমার হয়ে গেল, আর আমাদের পাশের এক প্রৌঢ় যাত্রীর লাঠিটা হস্তচ্যুত হয়ে পাশের খাদ দিয়ে পাথরের সঙ্গে ঝড়ের বেগে গড়িয়ে নেমে গেল মন্দাকিনী লক্ষ্য করে।
ফেলুদা একটু হকচকিয়ে গেলেও সেটা মুহুর্তের জন্য। ওর শরীর যে কত মজবুত আর স্ট্যামিনা যে কী সাংঘাতিক সেটা বুঝলাম এই এতখানি খাড়াই পথ হাঁটার পর সে সোজা পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে গেল। আমিও ওর পিছন পিছন গিয়েছিলাম, কিন্তু যতক্ষণে ওর কাছে পৌছলাম তার মধ্যেই ও একটা লোকের কলার চেপে তাকে একটা গাছে ঠেসে ধরেছে। লোকটার বয়স বছর পঁচিশের বেশি না। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে এবং সে স্বীকার করেছে যে পাথর ফেলার ব্যাপারে সে আরেকজনের আদেশ পালন করছিল। পকেট থেকে দশটা কড়কড়ে দশ টাকার নোট বার করে সে দেখিয়ে দিল কেন তাকে এমন একটা কাজ করতে রাজি হতে হয়েছে।
কে তাকে এই টাকা দিয়েছে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল তারই এক অচেনা জাতভাই। বোঝাই গেল আসল লোক সে নয়, সে শুধু দালালের কাজ করেছে।
আপাতত ফেলুদা লোকটার গা থেকে একটা পশমের চাদর খুলে সেটা দিয়ে তাকে দু হাত সমেত পিছমোড়া করে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিল। বলল যাত্রীদের ফাঁকে ফাঁকে কনস্টেবল থাকে, তাদের একজনকে পেলে তার কাছে পাঠিয়ে দেবে।
লালমোহনবাবুর ভাষায় পাথর ফেলার অন্তর্নিহিত মানেটা সত্যি করে ভাবিয়ে তোলে। ভদ্রলোক বললেন, ‘বোঝাই যাচ্ছে কেউ বা কাহারা কেদারে আপনার উপস্থিতিটা প্রিভেন্ট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।’
গৌরীকুণ্ড আর কেদারের মাঝামাঝি একটা জায়গা আছে যেটার নাম রামওয়াড়া। সকলেই এখানে থামে বিশ্রামের জন্য। চটি আছে, ধরমশালা আছে, চায়ের দোকান আছে। লালমোহনবাবুকে আমরা এখানে আধ ঘণ্টা বিশ্রাম দেওয়া স্থির করলাম। এখানকার এলিভেশন আড়াই হাজার মিটার, অর্থাৎ প্রায় আট হাজার ফুট। চারিদিকের দৃশ্য ক্রমেই ফ্যানট্যাস্টিক হয়ে আসছে। লালমোহনবাবু একেবারে মহাভারতের মুডে চলে গেছেন; এমন কি এও বলছেন যে যাত্রাপথে তাঁর যদি পতনও হয় তাহলেও কোনো আক্ষেপ নেই, কারণ এমন গ্লোরিয়াস ডেথ নাকি হয় না।
ফেলুদা বলল, ‘আপনি কিন্তু পাবলিকের উপর যে পরিমাণে গাঁজাখুরি মাল চাপিয়েছেন, আপনার নরকভোগ না হয়ে যায় না।’
‘হেঃ’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘যুধিষ্ঠিরও পার পাননি মশাই নরকভোগের হাত থেকে, আর লালমোহন গাঙ্গুলী!’
বাকি সাড়ে তিন মাইলের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। একটা জায়গা থেকে হঠাৎ কেদারের মন্দিরের চুড়ো দেখতে পেয়ে সব যাত্রীরা ‘জয় কেদার!’ বলে কেউ মাথা নত করে, কেউ হাত জোড় করে, কেউ বা সাষ্টাঙ্গ হয়ে তাদের ভক্তি জানালেন। কিন্তু আবার হাঁটা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই মন্দিরের চুড়ো লুকিয়ে গেল পাহাড়ের পিছনে, আর বেরোল একেবারে কেদার পৌঁছানর পর। পরে জানলাম যে এই বিশেষ জায়গা থেকে এই বিশেষ দর্শনটাকে এরা বলে ‘দেও-দেখ্নী’।