চতুর্থ পরিচ্ছেদ – স্বপ্ন ও অন্বেষণ
প্রদর্শনীর মেলা শেষ হয়ে গেল একসময়। কেবল রেখে গেল ওলাং—এর মনে একটা সংশয়। তা সযত্নে গোপন রেখে স্তরে স্তরে তার প্রকাশ দেখতে চাইল সে। উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল ছকুলালের সব গতিবিধি আলাপ আচরণের মধ্যে তার বিন্দুমাত্র সমর্থন। চোখে পড়ল না কিছু। বিন্দু আর আসে না। ছকুলালও যায় না বিন্দুর বাড়ি, এ খবর নীলকান্তর কাছে জেনেছে সে। তবু সংশয় একটা জটিল ব্যাধি। তার অভাব ওলাং—এর আচরণে লুকোয় না। ছকুলাল কিন্তু দেখে না কিছু। বরং উলটোটা ভাবে সে। ওলাং—এর বদলে ওঠা ধরনধারণ পুরনো কুৎসিত ঘটনার সঙ্গে মিশিয়ে এক করে দেখে। এমনিভাবে দুটি জীবন সরে সরে যাচ্ছিল পরস্পর দূর হতে দূরে। আর সেই সময় এল কাজলের চিঠি।
মুখে রাগ দেখালেও ভারী খুশি হয়েছে কাজল। ওলাংকে দেখে অনেক আশা তার। এবার যেন সংসারে মন দেয় দাদা। সহজ হয়ে। সাধারণ হয়ে।
ওলাংকে লক্ষ্য করে লিখেছে একতারাটা আগুনে পুড়িয়ে দিতে।
কী চায় স্পষ্ট করে কাজল?
তাও লিখেছে। অভাগী বউদিদের জন্যে বড় ব্যথা তার। পাগল দাদার হাতে পড়ে লাঞ্ছনার চূড়ান্ত। অপঘাতে মৃত্যুর মধ্যে কী এক কুৎসিত ইঙ্গিত আছে বিধাতার। যা মর্মে মর্মে বোঝে কাজল। একদিন বলবে ছকুলালকে সে কথা। বলবে সব ইতিহাস।
দীনু পড়ে। ছকুলাল হাসে হো হো করে। ইতিহাস কীসের রে বাবা? ভগ্নীটা চিরদিনই একধারা। ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোন টুকরো সরল কথার কোন আলতো হাসিতে সহসা নাগালের মধ্যে এলেও আবার যে আকাশে সেই আকাশে। ওর কথা বোঝে সাধ্যি কার?
এবার একটা স্পষ্ট কথা। এবার সহজ পথে না চললে আর ক্ষমা নেই। তার ছেলেকে নিয়ে এমন কোথাও চলে যাবে, ছকুলাল কোনোদিন সেখানে পৌঁছাতে পারবে না। দেখবে না আর ছেলের মুখ। বাপের পাপ—অভিশাপে আকীর্ণ জীবন থেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখবে রতনকুমারকে।
পুনশ্চ :
রাজাবাবুর কাছে ভিটের হেস্ত নেস্ত করতে আর যেন না যায় দাদা। যাবার দিন এলে যে যাবে, তাকে কাজল তার সর্বস্ব দিয়ে আগলে রেখে মানুষ করছে।
কী জানি বাবু, উসব ফালতু কথার অত্থুটা কী! ছকুলাল ভাবতে চায় না। বরং ভাবে রোজগার করে জায়গা কিনে বাড়িঘর তৈরির কথা। শুনে ওলাং খুশি।
কাজলের কথা তার খুবই ভালো লেগেছে। এবার ভালো লাগল স্বামীর সংকল্পটা। বললো, বেবসাটা ধরেছ যখন, ছেড়োনা আর।
ছাড়ল না ছকুলাল। ফিরতে লাগল খরার দারুণ রোদ্দুরে গ্রাম থেকে গ্রামে। দুজনের মাথায় দুটো ঝাঁকা। মনোহারি বেচে ফেরে নীলকান্ত আর ছকুলাল। হাঁকে, চুড়ি সাবান ফুলেলতেল হিমানিপাওডার!
নীলকান্ত পরের লাইন টানে, আলতাচিরুনি ফিতে সেট্টিপিন আয়না।
বউঝিরা ভীড় করে। লুকিয়ে চাল বের করে বুকের ভেতর থেকে। চুরি করে কেনে কেউ। রাঙা সুন্দর হাতে সোনালি ফুটকি বসানো কালো চুড়ি পরায় নীলকান্ত। ভেঙে যায় অনেক। ডাগর পুষ্ট আঙুলে রং লেগেছে বুঝি আলতার? তখন পরায় ছকুলাল।
—আঃ লাগছে যে। মিষ্টি আধোস্বর। অত জোরে নয়।
—এট্টু সবুর করো বাছা। এই……..এই………ব্যাস! কেমুন সোন্দর। হাতটা একটু ঝাঁকি দিয়ে দেয় ছকুলাল। রিনিঠিনি বেজে ওঠে জীবনের বসন্তের গান। বেহায়া মেয়ে বলে, তুমার হাতে মধু আছে গো। এট্টু বেথা লাগে না। নীলকান্তর বুকে জ্বালা। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। এমনি রঙা ডাগরপানা হাত। এমনি আলতাপেটি আঙুল। সেই সব উত্তাল রাত্তির।
সামলাতে না পেরে ফিক করে হেসে ফেলে সে।
—হাসলা কেনে? হাসবা কী জন্যে বাবা? ভারী বজ্জাত স্বভাব তো তুমার! বুড়িটা দাঁত খিঁচোচ্ছে। চোখমুখ বিটকেল করে ইশারা করে ছকুলাল। সব্বোনাশ, মুসলমান মেয়ে সব। এক্ষুনি ভাতার বেটার কানে তুললে ঘুচিয়ে দেবে ব্যবসা করা।
বলে উটা এমনি স্বভাব বাছা। দুষ্যি কিছু নয়। কিছু মনে করো না।
পাটকিলেরং মাড়ি বের করে নীলকান্ত আবার হাসে। মেয়েদের মুখের পানে হাঁ করে নীলকান্ত আবার হাসে। মনে হয়, না দেখলে কত কী যেন হারিয়ে যায় জীবন থেকে। না দেখলে জীবন ভরে না। পৃথিবীতে কত হাসি মুখ আনন্দ আর কত মধুমদির স্মৃতিতে আকীর্ণ সুন্দর মুখগুলি।
ঝাঁঝালো বাতাসে গলাকাঠ। রাঢ়দেশের ফাঁকা ঢেউখেলানো মাঠে হু হু আগুন। চামড়া পুড়ে কালো। ছকুলাল বলে, বড় তেষ্টা পেল গো। হুই গাঁয়ে ঢুকি চলো।
থমকে দাঁড়ায় নীলকান্ত। আর্তনাদ করে ওঠে যেন। না না দাদা।
—তাহলে জলবিনে মরবো যে বাছা।
—না না। তুমার পায়ে পড়ি গায়েনদা। চলো উই পুকুরে।
পুকুরে যায়। পুকুর শুকিয়ে ফেটে কঠোর। মরার মাথার মতো বিকৃত; এবার বলে ছকুলাল, উ গাঁয়ের কারু সঙ্গে বিবাদ আছে নীলকান্ত?
—উটা পলাশ গাঁ।
হো হো হাসে ছকুলাল। সি তো উত্তর। কুটুমবাড়ি গুড়জল খেয়ে শরীরটা সোস্ত করা যাবে।
—কোন মুখে যাব দাদা সেখানে?
—তুমার ভয় লাগছে নীলকান্ত?
—বুড়িটা আমাকে ছিঁড়ে খাবে গায়েনদা। হাত চেপে ধরে ছকুলালের।
ছকুলাল বলে, এসো আমার সঙ্গে। আমি বাঁচলে তুমিও বাঁচবে নীলকান্ত।
রুক্ষ নীরস বন্ধ্যা মাটির পলাশগাঁ। পাথুরে মাটিতে কয়েকটি তালগাছ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না দূর থেকে। খরার রোদে ধূসর পাংশু ঘরের চালে—চালে হাভেতে কাঠের ডাক। ছেঁড়া খোঁড়া ঝাঁঝরাপাতা কুলের গাছে ঝিমুচ্চে ক্লান্ত শালিক। শুকনো ডোবায় পাঁকে মুখ ঘসছে একটা ঘেয়ো কুকুর। গ্রামে ঢোকে দুজনে। তীক্ষ্নকণ্ঠে চেঁচাচ্ছে কারা। মেয়েলি ঝগড়া। ফিসফিস করে বলে নীলকান্ত। ঝগড়ার দ্যাশ পলাশগাঁ। সব্বক্ষণ চিল শকুন উড়বে। শুধু ঝগড়া আর ঝগড়া। বলতে বলতে যায়। বুঝলা গায়েনদা, পেত্থম অষ্টমঙ্গলায় এসে কান তো ঝালাপালা আমার হুই যি চারা পেকুড় গাছটা দেখলা মাঠে, উখেনে থাকলাম বিরক্ত হয়ে।
তরঙ্গিনীর বাড়ির দোরে ছকুলাল। নীলকান্ত একটু তফাতে দাঁড়িয়ে থাকে। ডাকে ছকুলাল, মা জননী আছো গো?
—কে? শঙ্খচিলের ডাক যেন। তরঙ্গ বেরোয়। শকুনের মতো বাঁকানো লম্বা গ্রীবা। ফ্যাকাশে চোখের ভাষা পড়া যায় না। খরার দাপটে মাথার জটা অসাধারণ একটা রং ধরেছে। সারা কপালে সিঁদুরের ছোপ। কে বটে গো;
—বাড়ি চণ্ডালিকে।
—অ। এসো গো। বাড়ির ভেতর এসো। আহা, মুখচোখ অক্তবন্ন বাছা। জল দেবে এসো। ডাইনির মায়া। একমুহূর্ত অজানা ভয়ের রেশ। পরক্ষণেই সংযত ছকুলাল। বলে, আরে একজন সঙ্গে আছে।
—কে সিটা? কই গো?
—হুই দ্যাখো। তুমার জামাই। লজ্জা হচ্ছে আসতে, তাই উখেনে দাঁড়িয়ে আছে।
সুতীক্ষ্ন একটা আর্তনাদ। গনগনে আকাশ তাপাহত ঘন নীল থমথমে আকাশ টুকরো হয়ে গেল বুঝি একটা শানিত সূক্ষ্ম সূচীমুখ ধ্বনিতে। ততক্ষণে ছুটে এসে পায়ে হাত দিয়েছে নীলকান্ত। তাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে পলাশগেঁয়ে ডাইনি। চোখে জল ঝরে না। বিবর্ণ চোখের ভাষা পড়ার সাধ্যি নাই কারুর। বিকটভাবে কাঁদছে তরঙ্গ মেয়ের নাম ধরে জামাইকে বুকে নিয়ে।
কেঁদে হালকা হল বুক। তারপর ফিরল নীলকান্ত আশায় বুক বেঁধে। এবার সত্যি খুঁজতে বেরোবে সে। চষে ফেলবে তন্নতন্ন দেশদেশান্তর। শাশুড়ি আকাশে ঝুলিয়ে দিয়েছে লম্বা লগার মাথায় একটা মরা কাক। তার কালো নিথর চোখ থেকে আড়ালে যায় সাধ্যি নেই নেত্যবালার। ডানা এলানো কাকটা একদিন আচমকা ডেকে উঠবে। পেয়েছি, পেয়েছি কলঙ্কিনীকে।
একদিন সত্যি খুঁজে পাওয়া যায় না নীলকান্তকে। শাশুড়ির মন্ত্রপূত কবচ গলায় ঝুলিয়ে চলে গেছে কোথায় কোন দেশ থেকে দেশান্তর। ছকুলাল একা। বেশিদূরে যেতে পারে না অত বোঝা নিয়ে। দীনুকে বলতে পারে না। বেচারার কোলে বোনের বাচ্চারা। কে দেখে তাদের! খরার দুরন্ত রোদ্দুরে পুড়ে কালি হয়ে যায় অঙ্গ। ছকুলালের কোটরগত চোখের পানে চাইতে গিয়ে ব্যথা পায় ওলাং। অন্তত তখনকার মতো ভুলে যায় তার সংগুপ্ত ক্রোধটা। সংশয় ডুবে থাকে মমতার গহনঘন নিবিড় অনুরাগের নীচে। কী আর করবে ছকুলাল। ব্যবসার টাকা কোথায় ডুবে যাচ্ছে দিনের পর দিন। নতুন ভিটে কিনে ঘর বানানো হল না। ওলাং ভুলে যায় বিন্দুর কথা। বলে, একটা কথা বলব গো?
—বলো।
—একটা থায়ী দুকান পেতে বসো না ইস্টিশানবাজারে।
—ট্যাকা কতি পাব ওলাং!
—ট্যাকা? চুপ করে যায় ওলাং। কবেকার কুড়নো ধানে পেট চলছে। ক্যাম্পে যাওয়া কবে থেকে বন্ধ। কেবল যায় টগর আর এলোকেশী। কী কাজ ওরাই জানে। ওলাং—এর ভয় করে। সুমুখে বর্ষা। বড় ভাবনা মনে। অনশনের দুঃসহ দীর্ঘ—দীর্ঘ প্রহর আসন্ন এবার।
একটু পরে বলে ছকুলাল, আর সত্যি শরীল চলে না ওলাং!
এমন তো আগে হত না। বসন্ত হওয়ার পর থেকে কেমন রদবদল হয়েছে শরীরে। প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে ছকুলাল আগের মতো তেজ নেই। স্ফুর্তি নেই। কেমন যেন আড়ষ্টতা সারাক্ষণ ওকে চেপে ধরে থাকে। মনেও ঘটেছে রূপান্তর। শূন্যতার গভীর স্তরে ভেসেছে মন। শুধু বেঁচে থাকা, জীবনধারণ। শিমুলডালে এসব শকুনদের মতো। আর ওই ভাগাড়। খরার রোদ্দুরে লোলজিহ্ব একটা চিতা। এসবের এত কাছে মানুষ। শংকরীপ্রসাদ শরবিন্দু এদের থেকে এড়িয়ে নেই। ওই তো সংসারের স্বরূপ। স্ফুরিত আদিম এক জন্তু। আগুন তার রোমে। তার চোখের পলকে। নিশ্বাসে। রেহাই পাওয়ার জন্যে যত হইচই সামাল সামাল। তবু কি সামলানো যায়? রক্ত আর অস্ত্র আর ক্লেদে বছরের পর বছর পিচ্ছিল হয়ে থাকে পথ। আর পাথরে বন্দি চেতনা দিন গোনে দুর্জ্ঞেয় মুক্তির জন্যে।
কাকুলিত ভাষা পায় না। নিরবয়ব ইঙ্গিতে ভরিয়ে তোলে মনের আকাশ। ছকুলাল শুধু টের পায় এসব। অনুভূতির থরে থরে পুঞ্জীভূত হয় এদের বাঁকাচোরা রেখা। ভাষার রঙে গড়তে পারে না ছবি। হাঁপিয়ে ওঠে।
কাজের মধ্যে ডুবে থেকে আনন্দে রঙে উত্তেজনায় শারীরিক ইচ্ছা বাসনার ঘূর্ণীপাকে ঘুরপাক খেয়ে তৃপ্তি আসে হয়তো। আর সংসারের এই তো ঘুমপাড়ানি গান। মা বসুমতীর কোলে পড়ার পর শিশুর তাই কান্না। মা শোনান ঘুমপাড়ানি গান ইচ্ছেবাসনার দোলনায়। ছেলে ঘুমিয়ে থাকে। আর সে—ঘুমের সে—দোলনার মধ্যেই যদি মিলিয়ে থাকে জীবনের সার্থকতা, তবে কী হাস্যকর অসহায় তার প্রতীক এই জীবন ধারণ। যন্ত্রণার নীল আকাশ থেকে আবার জন্ম পেতে চায় গান। তাকে ধরতে পারে না ছকুলাল। স্নায়ুর মধ্যিখানে পোকার মতো বসে আছে এক আশ্চর্য শূন্যতা। এবার ছকুলাল মরে যাচ্ছে। ভগ্নী, তুমার ইচ্ছেই পূর্ণ হবে ইবার। শখের বাউল ছকুলাল ইবার ছকু কুনাই হয়ে গেল!
আর পারে না ছকুলাল। সংসার বিমুখ। ঘরনি নষ্টা। অঙ্গে ফুটিয়েছে পাপের ফুল। সে ফুলের লজ্জা পেয়েছে সে। নিষ্ঠুর হাতে ছিঁড়তে না পারার লজ্জা। একটা অনিবার্য স্থূলত্ব তাকে গ্রাস করেছে। মনোহারির অবশিষ্ট মালগুলো মাথায় নিয়ে গোটা একটা মাস। শুকিয়ে গেল সব আশা। ছকুলাল অসুখে পড়ল। আর জ্বরের ঘোরে বলল বিন্দুর নাম। শিউরে উঠল ওলাং। ছকুলাল খুঁজছে সুঁদিপুরের বিন্দুবাসিনীকে বলছে : বিন্দু আসছে। দরজা খুলে দ্যাও।
এল না বিন্দু।
বিন্দুর লজ্জা। চণ্ডালিকার আকাশের দিকে চাইতে পারে না সে। এক নিঃশব্দ ব্যর্থতাবোধ তাকেও গ্রাস করে নিয়েছিল।
রতিকান্তর মুখ আবার ভেসেছিল দহের জলে। বুদ্বুদে কথা ফুটেছিল। অথচ ভেঙে গেল উল্লাসের কাছে এগিয়ে গেল আস্তে আস্তে। শান্ত হতে চাইল। ছকুলালের পাথরে ঘা খেয়ে এসে ছিটকে পড়ল তার উদ্দাম স্পন্দিত চওড়া বুকে। শূন্যতা ভরে জেগে উঠল অন্ধতৃপ্তির স্রোত জীবনের কানায় কানায়।
আর একটা পুরনো মরচে—ধরা স্বপ্নের মতো ছকুলালের জালখানা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলতে লাগল গাছে। একটা বিবর্ণ নিষ্ফল অতীত কাকুতি। বিন্দু আর চেয়ে দেখে না।
তবু হাহাকার। দগ্ধ মনে জল ঠেলে ফোস্কা বাড়ে। বিক্ষত করে দ্যায় জ্বালাময় চিহ্নে সব আবরণ। উথাল পাতাল বিন্দু আরও ক্ষেপে ওঠে। উল্লাসের চওড়া বুকে মাথা রেখে ঘুমুতে চায় চণ্ডালিবাঁধা বিলের উত্তর কিনারায়। শরবনে নরম নরম দূর্বার উপর। বাগদিদের ইজারা নেওয়া জলার পাশে।
গত দাঙ্গার পর গোয়ালারা চণ্ডালিকার ডহর পথ ছেড়ে দিয়েছে। এখন এই পথ ধরে আসে রতনপুরের সীমানায়। উল্লাস স্বভাবমতো দল ‘বেঙড়ে’ একা একা সরে আসে এখানে। বিন্দুও আসে সবার আগে অথবা শেষে একা একা। তবু সোচ্চার বাতাসের কণ্ঠে বুঝি সব জানাজানি হতে থাকে। রটে যায় এই গোপন অভিসারের কাহিনী কুৎসা আর ঈর্ষায় ক্লেদাক্ত হয়ে।
বিন্দু একঘরে হল। আগুন জল পাবে না পাড়ায়। ব্যস। তার বেশি কিছু নয়। আর বেশি কিছু করা সমাজের পক্ষে দুঃসাধ্য। উল্লাসের লাঠির দাপটে সুঁদিপুর কাঁপে থরহরি। সুঁদিপুরের বলভরসা উল্লাসের জোরেই সব মেডেল ঢোকে সুঁদিপুর। ডাকসাইটে চ্যাংড়া—রা সবাই তার হাতের মুঠোয়। ভয় সেই উল্লাসকে।
কিন্তু তার জন্যেই কি বিন্দু গরবিনী? তার অন্বেষণ ফুরোয় না। দুরন্ত দুঃসাহসী এক যৌবনের পায়ে বিকিয়ে দিয়েছে সর্বস্ব নাকি? লাঠি, বাঁশি, না শরীর; কিংবা উল্লাসের রূপ—যা পুরুষত্বের দীপ্তি নিয়ে, তার বন্যতা নিয়ে বিন্দুর মতোই গতিবান?
ও বিন্দু, এছাড়া আর বাঁচতে না তুমি?
মত্তে মোন চায়না যে।
কী চাও তুমি?
পুরুষ।
স্যাঙা করো।
পায়ে বেড়ি পরব না সংসারের।
ভেবে দ্যাখো।
ভাবব না। অকূলে ভেসে যাব।
আপন সত্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বেপরোয়া হল বিন্দু। অকূলে ভাসতে চাইলে।
নির্জন শরবনে বলল উল্লাসকে, চলো। দুজনে চলে যাই কোনোখানে।
—কেনে? ডর কেনে বিন্দু আমি থাকতে?
—ছেলার চোখে চাইতে পারিনে যে।
—গাঁ ছাড়ালে ছেলা কতি এখে যাবা?
—ঠাকুরঝির কাছে।
সদ্যোজাত মোষের বাচ্চাটা শেষ রাত্রির অস্পষ্ট আলোয় ছোটাছুটি করছে।
ছুটে এসে দুজনের সুমুখ খানিক দাঁড়িয়ে থেকে আবার পালাচ্ছে জঙ্গলে। বিন্দু চেয়ে চেয়ে দেখে।
উল্লাস বলে, এমনি থাকাই ভালো বিন্দু।
—ও। বুজেছি।
—কী বুজেছ?
উল্লাস লাঠি দিয়ে মৃদু মৃদু আঘাত করছে ছোট্ট কুলগাছে।
—তুমার বাবার বদলাম লিতে চাওনা।
লাঠি থেমে যায়। চমকে ওঠে উল্লাস। মানে?
—লোকে বলবে বাবার মতো পথ ধরল ছেলা।
উল্লাস চুপ। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে সূচালো গোঁফের শেষ বিন্দু অবধি কাঁপছে বুঝি।
আবছা অন্ধকারে অনুভব করে বিন্দু।
মুখরা বিন্দু আবার বলে, তুমার বাবার কথা কেউ ভোলেনি এখনও।
গাইমোষটা কাছে এসে মাথা ঘসছে উল্লাসের পিঠে। আচমকা লাঠির বাড়ি মারে উল্লাস তার পিঠে। গর্জে ওঠে, ধোঃ ধোঃ!
ভয় পায়না বিন্দু। খিলখিল করে হাসে। উল্লাস বলে, ই কথা অন্য কেউ বললে পরিত্রাণ পেত না। আর কখনো ই কথা তুলোনা বিন্দু। যদি থাকতে চাও আমার সঙ্গে।
লাফিয়ে ওঠে বিন্দু। শরীর দুলিয়ে হাসে। চুল বাঁধে দুহাত তুলে মাথা নীচু করে। আমি তুমার সঙ্গে নাকি? এত মিছে কথা তুমার উল্লেস! উচ্ছ্বসিত হাসির দমকে আবার কবরী খুলে গিয়ে বিস্রস্ত চুল পিঠে পড়ে। ছুটে চলে যায় বিন্দু জলার দিকে। গাইমোষটা আবার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ফিকে অন্ধকারের মধ্যে জেগে উঠছে বিল। দূরে ঘন জঙ্গলের উপর বিন্দুর জালখানা একটু দেখা যাচ্ছে। বিন্দু এবার জলে নামবে।
দিগন্তের মেঘে করুণ একটা লালিত্য। জলচরা দলপিপি পাখির ডাক। ভোর হচ্ছে এবার। লম্বা ফাঁড়ি ঘাসের ফাঁপা গা বেয়ে শামুকটা একেবারে ডগায় পৌঁছেছে। দেখে উল্লাস। ঘাসটা নুয়ে পড়ল জলের বুকে। দেখতে দেখতে ফের অমানুষিক ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে সে ডুবন্ত শামুকটাকে প্রচণ্ড জোরে লাঠির আঘাত করে। তারপর ডাকে—ধোঃ ধোঃ।
ঝাব্বু সিং বড় মুষড়ে পড়েছে। কিছু ভালো লাগে না তার। নিশ্চিন্দি গাছের ছায়ায় খাটিয়া পেতে পড়ে থাকে দিনমান। ক্যাম্পের খামারে স্তূপীকৃত বোরোধান মাড়াই চলে। ঝাঁঝালো বাতাসে ভাসে ধানের কুটো। নাকেমুখে ঢোকে। হাঁচি আসে বারবার। বারবার উঠে গিয়ে গামছা ভিজিয়ে গা—মুখ মোছে। টিউবওয়েলের নীচে একঘণ্টা ধরে বসে বসে স্নান করে শরদিন্দু। বলে, ক্যা, তবিয়ত আচ্ছা নেই মহারাজ;
—জী সাব।
—কাহে?
—এতনা ধুপ মে।
তা বটে। এ তেপান্তর মাঠে দুরন্ত খরায় থাকা সহজ কথা নয়। ছোট্ট সব রাত্তির। এলে খানিক আরাম, তারপর দিনমান আগুনের হলকা বইতে থাকে মাঠে। খরদাহনের ফলাফলরূপে মেজাজও বদ হয়ে ওঠে। গালদেবার লোক নেই। আস্তে আস্তে করে মজুরনিরা কেটে পড়েছিল। শুধু আসে টগর আর এলোকেশী। সব মেয়ে এলে আর দেবার মতো কাজ ছিল না। এখন যা কাজ তা মুকুন্দ নায়েক আর শরদিন্দুর। বাকিটুকু দিনমজুর পুরুষদের।
ঝাব্বু ডাকে, হাসিম ভেইয়া!
হাসিম সাড়া দেয়, কহো সিংজী।
—কুছ শুবিতা নেই মালুম হোতা।
—কাহে?
—ইতনা ধূপমে। ঔর ক্যা।
চতুর হাসিম মুচকি হেসে বলে, ক্যা সুবিস্তা চাহো তুম?
—বদন জ্বল যাতা হ্যায় ভেইয়া।
—দিল ভি। হাসে হাসিম।
—তামাসা রাখো জী। ঝাব্বু খাটিয়ায় শরীর মেলে দেয়।
হাসিম জানে এই ভাবান্তরের কারণ। চণ্ডালিকার মেয়ে সরসীবালার ওপর ঝাব্বুর সব সময় অকারণ পক্ষপাত অজানা ছিল না তার। সে এক কাণ্ড।
বীণা মেয়েটি ধরা পড়ল। অনেক আগে থেকেই চলছিল এমন কারবার। সম্ভবত ঝাব্বুর পরোক্ষ ইঙ্গিত ছিল যেন। প্রথমে অবশ্যি সরসীবালার পেট দেখে একদিন সন্দেহ হয় হাসিমের। তার চোখ থেকে কিছু এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। তেড়ে গেল সে, তুর প্যাট এমন মোটা হল কেনে রে?
কাপড় টেনে ফেলে আর কী। সরসীবালা পাংশুমুখে তাকায়। ঝাব্বু এগিয়ে এল হঠাৎ।
—যানে দো ভাইয়া। দেখতে নেই ক্যা হুয়া?
—দেখতা সিংজী। শালীর প্যাটটা তো দেখতা।
—আরে লড়কা হোগা। ঔর ক্যা!
এবার মালুম পেয়ে গেছে হাসিম। ছোলার দানা হাতে ঠেকেছে তার। চোখ পাকিয়ে গর্জে উঠল সে। খোল মাগি। প্যাটের কাপড় খোল।
বাধা দিল ঝাব্বু। যা নে দো না জী। জানানা কা বেইজতী!
—গুটলিপারা ক্যা হ্যায় সিংজী।
কুছ নেই, উও লড়কা। লড়কা তো ঔসী মাফিক হোনা চাহতা। যাও যাও সোরসী, ভাগো।
হাসিম কাপড় টানতে লাগল। কেঁদে উঠল সরসী, পেটে আমার সন্তান গো, পায়ে পড়ি স্যাকবাবা।
বেরিয়ে এল শরদিন্দু। চেঁচাচ্ছ কেন সব!
ঝাব্বু বুঝিয়ে দেয় হাসিমের আগেই। শরদিন্দু ডাকে, হাসিম!
—জী।
—ছেড়ে দাও।
হাসিম হাসতে হাসতে সরে যায়। ঝাব্বু সিং অন্যমনস্ক হয়ে চেয়েছিল দূরের দিকে।
মুকুন্দ নায়েক পিঠে হাত বুলোতে গেল। তখন হাসল ঝাব্বু।
আজ বিকেলে ছুটি নিয়ে চণ্ডালিকা ঢুকল ঝাব্বু। বেশ সেজে গুজে। গোঁফে শান দিয়ে দেমাকে বুক ফুলিয়ে গেল গ্রামে। শরদিন্দুর লোক। সবখানে খাতির মেলে না। তাই খাতির বাগাতে হয়! মুসলমান পাড়ার বাচ্চা ছোঁড়াগুলো তো দেখলেই সুর ধেরে কোরাস গাইবে—
হেই ভিরিঙ্গি বাবুর বাচ্চা।
আধখানা কলা খেয়ে যা।।
ভৃঙ্গী বলতে পারে না। বলে ভিরিঙ্গি। আর হাসিমকে দেখলে ওখানে বলবে নন্দী। হাসিম সেখ অবশ্যি সোনাডাঙার লোক। ডাকসাইটে দাগি ডাকাত। চণ্ডালিকায় পা দিয়ে সেও একেবারে ভেজা মুরগিটি।
ঝাব্বু পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। হাসিমও সহজে আসতে চায় না চণ্ডালিকা। বেশি আসে নদেচাঁদ। সাদাসিদে ভালোমানুষ। পসার জমাতে চায় নানান গালগল্প কেড়ে। দরকার হলে শরদিন্দুর খানিক সমালোচনাও করে। তাই রক্ষে। শরদিন্দুদের গোটা পরিবারটা যেন চণ্ডালিকায় একঘরের মতো। আরও ক’ঘর ব্রাহ্মণের বাস ছিল এককালে। কোথায় মিলিয়ে গেল সব। শূন্য পোড়া ভিটেয় শুধু নিম আর আতাগাছের জঙ্গল। আর একপ্রান্তে রইল দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজবংশধর শংকরীপ্রসাদ। তিনিও বাইরে বেরোন কম। মাঠের দাঙ্গাফ্যাসাদে তাঁর স্বার্থ ছিল বলে প্রয়োজনে যোগাযোগ রাখতেন শরদিন্দুর সঙ্গে। যেমন রাখে সদগোপ পাড়ার যুগলেশ্বর। মুসলমান পাড়ার গয়জদ্দি মণ্ডল। কিন্তু সে ওই উপরে উপরে। ভেতরে একটা তীব্র অথচ অক্ষম ঈর্ষার আগুন—যার জন্যে ভেতর ভেতর শংকরীপ্রসাদের সঙ্গে নানান কূট ষড়যন্ত্রও চলে। জনসাধারণকে পরোক্ষে সমর্থনও করতে হয়। বেচারা শরদিন্দু।
কায়েত পাড়ার রামনিরঞ্জনের গতিবিধি কুনাই পাড়ার রঙের আড্ডায়। সেই সুবাদে শরদিন্দুর ক্যাম্প কুনাই মেয়েদের নানান রসালো খিস্তিতে মাতিয়ে রাখে পাড়া। শরদিন্দুর চেহারাটা ভদ্র—ইতর ছেলেবুড়ো মেয়ে—বউঝি সবার চোখে সে বদলে দিয়েছে। প্রথম বিদেশ থেকে আসার পর শরদিন্দুর যে চারিত্রিক গুণপনা পাড়ার মেয়েদের মনে তাকে বীরের মতো আসন দিয়েছিল, আস্তে আস্তে সরে গেছে সে রূপ। শরদিন্দু এখন এক লম্পট মাতাল নীচমনা নতুন যুগের রাজা জমিদার। অর্ধেন্দু এসব টের পেয়েছিল। ঝিকটিপোতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল মা বাবা বোনকে। ওরা নারাজ। কিন্তু ভবিষ্যতে কী হয় বলা যায় না। ওখানে অর্ধেন্দু বিরাট দালান বানাচ্ছে এবার।
ঝাব্বু সিং এসবই জানে। জানে বিশেষ করে চাষা পাড়ায় পা দিলে তার নিজের খাতির কতটা গড়াবে। তবু জেদ। জেদ আর দেমাক তার শারীরিক আয়তন নিয়ে। ঝাব্বুকে দেখে তরাস পায় সবে। মুখে যতই বলুক।
গয়জদ্দি মণ্ডল সেলাম ঠুকে বসে ওকে দেখে। আদাব সিংজী!
এবার খুশি হয় ঝাব্বু। আদব, আদব মণ্ডলজী।
—কতি চললেন গো?
—বাবু কা ঘর।
বাবুকা ঘর সে যাবে না। আসলে হাসিমের চোখ এড়ানোর জন্য এভাবে ঘুরে আসা। কিন্তু এবার খাতিরটুকু পেয়ে উদ্যম বেড়ে যায় তার। ছোঁড়াদের বিশ্রী বেতামিজির পর কী মিষ্টি এই সেলামটুকু। হনহনিয়ে গিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে কুনাই পাড়া ঢোকে সে। এখানে সে মান্যবর। শুধু সেলাম নয়, এখানে বরাবরই অপর্যাপ্ত আপ্যায়ন।
একেবারে চোখ বুজে সরসীবালার বাড়ি। ভয়ে ভয়ে একটা বাচ্চা দেখিয়ে দেয় বাড়িটা। অবশ্যি এর আগে কুনাইপাড়া সে এসেছে অনেকবার। এসেছে কপিলেশ্বরের বাড়ি টগর বালার স্বামী কপিলেশ্বর। আড্ডাটা ওখানে বেশ প্রাণবন্ত। আসে বনমালী নাপিত, রামনিরঞ্জন দাস, মুসলমান পাড়ার আমিন সেখ। এ আসরে ঝাব্বুর সম্মান ও প্রতাপ অখণ্ড। মোড়ায় বসে বসে ‘তরল গরল’ আর ‘বিষধূম্রের’ কীর্তিকলাপ লক্ষ্য করে। কোন কথায় হেসে ওঠে গলা ফাটিয়ে। মধ্যে মধ্যে টগরবালার প্রতি নয়ন হানে তেরচা চোখে। টগরও হাসে। কিন্তু ওই টুকুই। ঝাব্বুর মুখ ফুটে কিছু বলার ক্ষমতাটাই নেই। কোনোদিনও না। তাই একসময় ফিরে যেত অবসন্ন মনে আড়ষ্ট শরীরে। তখন উঠোনের ধুলোয় লুটোচ্ছে রামনিরঞ্জনের অর্ধোলঙ্গ শিথিল মাংসপিণ্ড। বনমালীর হাত—পা ছড়িয়ে বসে উচ্চনাদের লতানে সুর ঝিমিয়ে এসে একটা অস্ফুট ধ্বনির বুদ্বুদে পেয়েছে রূপ। আমিন সেখ উঠে গেছে কখন। টগর আর কপিলেশ্বর ঘরে খিল এঁটে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে।
ফিরে গেছে ঝাব্বু সিং। আলতো একটা নেশার সংক্রমণে অস্বচ্ছ স্নায়ুর বিস্তার। কী যেন ঘটবে বলে অনেক আশা ছিল। ঘটল না ঘটছে না। হয়তো ঘটবে কোনোদিন এমনি আসা—যাওয়া। কোনো ঘটনা—যা একান্তই নারীর মুখ চোখ শরীর এসব উপাদানে গড়া। একটুকরো রঙিন মেঘ যেন। গিনঠিয়ার দিগন্তের লাল আবীর মাখা মেঘখানা পৃথিবীর একই আকাশ বেয়ে এসে জেগে উঠবে চণ্ডালিকার উপর। ঝাব্বু সিং আশ্চর্যান্বিত।
তরল গরল বিষধূম্র। তাড়ি আর গাঁজা। রামনিরঞ্জনের বানানো শব্দ। ছোঁয়না ঝাব্বু। দোরে দাঁড়িয়ে একটু চকিত বুক একটু দ্বিধা। পরক্ষণেই দেমাকে ভারী সে। বাবুর কালান্তক অনুচর ঝাব্বু সিং হাঁকে, হৈ সোরসীবালা আছেক!
—কে? প্রমত্ত কণ্ঠ পুরুষের। গানের কলিতে টান দিয়েই থেমে যাওয়া বিরক্তির সাড়া।
—ইধার দেখো না।
বেরিয়ে আসে নটবর। যোগীবর জাগালের ছোট ভাই। আসেন, আসেন সিংজী বাবা। ধন্য হোক। সরসীর স্বামী নটবর। নেশার পুলক আর গানের রুদ্ধ আবেগের সঙ্গে সিংজীর আবির্ভাবটা মিশে ওকে ঘায়েল করে দিয়েছে প্রখরতম একটা সুখ। আপ্যায়ন করতে গিয়ে কেঁদে ফেলে নটবর। কী সুভাগ্যি। ধন্য হোক। সিংজী! চরণ দশ্বন।
টুকরো কথার ঝাঁক সামলাতে পারে না সে। দাদাটা অকালে মল সিংজী। বাদলায় হুই তেপান্তরে সিংজী। থাকলে কী আনন্দ হত গো। আহা, দাদা আমার লাই সিংজীবাবা।
উচ্ছ্বাসের বন্যায় দন্ত্য ন ‘ল’ হয়ে যাচ্ছে।
একসময় সামলে নেয় নটবর। বাড়ির ভেতর নিয়ে যায় অতিথিকে। ছোট টুল পেতে দেয় বসতে। আসন গেহন করুন হুজুর।
গোঁফে তা দিয়ে মনের দুর্বল দিকটুকু মজবুত করে নেয় ঝাব্বু। বলে, সোরলীবালা ক্যাম্প ছোড়িয়ে দিল। বাবুতো হরবগত বোলতা কি, যাও তুমি পাত্তা করো। লেকিন আনে কা টাইম ভী নেই মিলতা। কাম ঔর কাম ঔর………
হেঁ হেঁ করে হাসে কৃতার্থ নটবর। বলে, এট্টু আগে হুই গায়েনের বাড়ি গেল হুজুর।
—গাহেন? কৌন উও;
—ছকু গায়েন গো। হুই শিমুলতলা বাড়ি। উর অবস্থা বড় কঠিন সিংজী। ব্যায়ামে এখন—তখন হয়ে আছে।
একটা অস্পষ্ট মেয়েলি কান্নার সুর বাতাসে। ঝাব্বু কান খাড়া করে। নটবরের ভাইপো গোবরা বলে, মারা গেছে, তাই কাঁদছে।
এতক্ষণে মনে পড়ে ঝাব্বুর। ওঃ হো। উয়ো ওলহাং। হাঁ হাঁ সমঝ গেয়া। পছানতা হাম। গাহেন, গাহেন। মাথা নাড়ে ঝাব্বু। জিভে চুক চুক করে বলে, আঃ বেচারা!
একটু পরে সরসীবালা এল। এসেই অবাক। একটু হাসে। তারপর এগিয়ে যায় স্বামীর কাছে। দেখে এসোনা গো এট্টু শেষ দেখাটা। হতভাগার অন্তিম হচ্ছে। আহা পাড়াসুদ্ধ লোক যেয়েচে দেখতে। যাওনা তুমি।
নটবর অনড়। ঝাব্বুর সুমুখে পাত্রে বসবে। আপন সম্পদ আপন রাজ্যিপাট দেখিয়ে আনন্দ পাবে। সেই আয়োজনে রত সে।
—তাপরে, কী মনে করে সিংজী! শুধোয় সরসীবালা।
স্নিগ্ধ আমেজ টেনে বলে ঝাব্বু, কৈ মানা হ্যায় আনেকা!
সলজ্জ হাসে সরসী। না, না। আমি বলছি ইখেনে তো আসেন না কোনোদিন। এলে টগরের বাড়ি।
—তুম সব মাঠ ছোড়কো আসলা কোত্তোদিন একসাথ এক জগাহপর থা……ভাষা জোগায় না ঝাব্বুর।
—কী করব বলুন, বাবু তো আর কাজ দিতে পারলে না।
—হাঁ হাঁ। উও ঠিক। আমতা আমতা করে ঝাব্বু। আর কী বলার আছে। অথচ এখানে এসেছে সে। আসার একটা স্পষ্টতম উদ্দেশ্য থাকা দরকার। ভারী লজ্জা পায় ঝাব্বু সিং। আর সেই লজ্জা বাঁচাতে আচমকা পকেট থেকে একটি পাঁচটাকার নোট বের করে বসে। কী করতে কী করা। কী বলতে কী বলা।
—একঠো হাঁস। আভি পাকাও।
কী করে বসল, ঝাব্বু সিং। তাতে কৃতার্থ নটবর। সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত একেবারে। তৎক্ষণাৎ উঠে সরসীকে ধমকায় সে, যা পাড়া দিয়ে। হাঁস আবার মিলবে না?
হাঁস আসে! ঝাব্বু বলে সরসীকে, তুম আপনা হাত সে পাকাও।
বিমূঢ় সরসীবালা রান্নার আয়োজনে যায়। বলে ঝাব্বু, মিরচা থোড়া সে কমতি। দৌড়ে বেরোয় নটবর। আরও মাল দরকার। এতবড় শারীরিক আয়তন নিয়ে সে সঙ্গী আজ এসেছে, তাকে তৃপ্ত করতেই হবে পচ্ছিম দেশের লোক, উরা কলসীকে কলসী মেরে দেয় বাবা! হুঁ!
তালগাছের ডগায় বসে চেঁচিয়ে গান ধরে নটবর। ও হো রে দেওয়া ভাসুর বিনিদোষে মেলি।
ঘনকালো রাত্রি। মধুর স্বপ্নের মেঘখানা কখন সে কালোরাত্রির রঙে বিকৃত হয়ে গেছে। স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন। উঠোনে একরাশ দুর্গন্ধ বমিতে মুখ গুঁজে পড়ে রইল ঝাব্বু সিং। বুকে পাথরের ভার। নিশ্বাস বেরুতে চায় না। একটু চোখ মেলে চাইল সে। একটা কুকুরের মুখ। আবার সব অস্পষ্ট। আবছায়া। তারপর ঘন কালো। নিরন্ধ্র নির্মম শূন্যতা। শেষ রাত্তিরে প্রবল বাতাস। জ্যৈষ্ঠ মাসের আকাশে ঘনকালো মেঘ। বাজের ডাকে উঠে বসল ঝাব্বু। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ। উঠোনে সে একা। আঃ পরভূ রামজী! টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। বিদ্যুতের আলোয় পথ চিনে চিনে বেরিয়ে এল বাইরে। সোজা নেমে পড়ল মাঠে। চষা জমিতে আছাড় খেল ক’বার। চলল ক্যাম্পের আলো লক্ষ্য করে।
গেটে হাসিম সেখ। টর্চ জ্বেলেছে। সিংজী!
নিশ্চিন্দিতলায় পেতে রাখা খাটিয়াটা তোলেনি কেউ। জন্তুর মতো অস্পষ্ট হুঙ্কার দিয়ে অক্লেশে ঘরে ঢোকাল সেটা ঝাব্বু সিং। নিঃশব্দে শরীর এলিয়ে দিল। একসময় ঘুমিয়ে গেল কখন।
এমন একদিন ছিল যখন কোনো কিছুই এড়িয়ে যেত না মন থেকে। তুচ্ছতমটাও। মাটির বুকের একটা ছোট্ট কাঁকরও। ঘাস শিশির আলো পাখি। মানুষের মুখ কথা। সব রূপ রস গন্ধ শব্দ। এত তীব্র ছিল ইন্দ্রিয়ে চেতনা। স্বচ্ছ আয়নার মতো।
সেই এক সময়।
তারপর পালাবদল। আর কোনোকিছুতে সাড়া নেই। সুখী হওয়ার নয়। রুক্ষ কর্কশ একটা সাদামাটা বস্তুর অস্তিত্ব। পরচর্চা একটা আয়না। অথচ রোগভোগের পর স্নায়ুর কাছে এর চেয়ে অনেক বেশি পাওনা থাকে। এক খাবলা মাটি তুলে নিয়ে বসে ছিল ছকুলাল। ভাবছিল এগুলো কী। আর শরীর—যা এখন তীব্রতর করে সবকিছু পাওয়ার জন্যে ব্যগ্র? অনেকবার মৃত্যুর নৈঃশব্দ্য ছুঁয়ে আসা শরীর চায় এখন অনেক অনেক শব্দ, অনেক উত্তেজনা। কী এ শরীর? আঙুল হাত বুক মাথা? চোখের ছবিতে ভেসে ওঠা দৃশ্যগুলো?
মিনমিন করে বেড়ালছানার মতো চেঁচাল ছকুলাল, ওলাং!
—কী হল আবার?
—আমি বেঁচে আছি?
—না। মরে ভূত হয়ে আছো। তুমার হাত থেকে ইবার আমার মরণ হলে আমি বাঁচি। দিনে দিনে কি খিটখিটে মেজাজ ওলাং—এর।
বলল ছকুলাল। আচ্ছা।
—আর পারিনে তুমাকে লিয়ে। শুধু বাজে বকুনি।
—ঘরে ভাত নেই বলে তুমি আগ কচ্ছ ওলাং?
—ভাত নাই সি হুঁশটাতো টনটনে।
—কী করব ওলাং?
গজগজ করে ওলাং। হাড়মাস জল করে চাট্টি ধান আখলাম। বর্ষার দিনকটা চলত।
—চলল না কেনে?
—তা জানবা কেনে? ডাক্তারবদ্যি না কল্লে বসে বসে এমন বাক্যি আসতো কোত্থেকে;
—ও।
এত নিষ্ঠুর হয়ে গেছে শান্তশিষ্ট দয়াশীলা ওলাঙ্গিনী। ছকুলাল চুপ করে আবার মাটিগুলো পরখ করে।
অথচ অস্বস্তি কিছু না বললে। এই নিস্তব্ধতাটা যেন সজীব হয়ে চারপাশে কামড়াতে থাকে রাক্ষসের মতো। ছকুলাল আবার কথা বলতে চায়, তুমি অমন করছ কেনে ওলাং?
—কী করছি আমি;
—আমাকে সব্বক্ষণ তরাস লাগে ওলাং!
—তরাস লাগে তো ডাকোনা তুমার পানের বন্ধুকে।
—তুমি ছাড়া আর কে সিটা? ছকুলাল রসিকতা করে হালকা হতে চায়।
—কেনে, সুঁদিপুরের বন্ধুকে! ওলাং বলতে বলতে লাল হয়ে যাচ্ছে রেগে। বিন্দু, বিন্দু, আর বিন্দু। নজ্জা নাই বুদ্ধি নাই মড়াঘাটের মিনষে। খিটকেলের চূড়ান্ত করে আবার বলে তরাস লাগছে। হতচ্ছাড়া হাড়হাবাতে দালাল কতিকার!
কী হল ওলাং—এর? ছকুলাল অবাক—বিন্দুর উপর এত কোধ কেনে গো। সিটা তো তুমারও সই বটে। ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ওঠে সে।
—আবার সই না তো একটা—
—কী, কী? ছকুলাল কাঁপছে উত্তেজনায়।
ওলাং জবাব না দিয়ে ঘাটে যায়। ফিরে আসে জল নিয়ে। আবার বেরিয়ে যায় কোথাও। ছকুলাল ডাকে, ওলাং।
ওলাং থমকে দাঁড়ায়।
—এট্টু তেঁতুল এনো দিকিনি। বড় খেতে ইচ্ছে করে।
—তুমার প্যাটটা কেটে ফেলতে পারো না। ওলাং চলে যায় বাইরে।
ছকুলাল মাটিগুলো হাতে থেকে এতক্ষণে ফেলে দেয়। হাত ঝেড়ে পরিষ্কার করতে থাকে। কিছু বোঝা যায় না। কিছু কানে আসে না। আনমনে নিজেকেই শুধোয় বসে বসে, বিন্দুবাসিনী এল না একবার। উর বাড়িতে এট্টা তেঁতুলগাছ আছে দেখেছিলাম।
বিন্দু—বাসিনী।
স্নায়ুর একখানে নামটা সেঁটে গেছে। অসুখের ঘোরে কতবার বলেছে ও নাম। জ্বরের প্রলাপে। ঘুমের ঘোরে। স্বপ্নে আর জেগে সবসময়। বিন্দু মমতা করে তাকে, এটুকুই ছিল একমাত্র জীবিতের জন্যে তার ভুবনে। বলতো, দরজা খুলে রেখো ওলাং, সে আসবে। আর একদিন স্বপ্নে দেখল তাকে। অবিকল। স্পষ্ট। বিন্দু এসে তার ঘরের চৌকাঠে মাথা ভাঙছে। কেশ রক্তে ‘রক্তবন্ন’। আমোদিনীর মতো আলু—থালু সে রক্তচ্ছটা কেশে ছুটে পালাচ্ছে। ঝাঁপ দিয়েছে জলে। এত জল চণ্ডালিকার মাঠে! বাঁধভাঙা বানের জল।
মা, মা, ও মা!
না, না, বিন্দু। সুঁদিপুরের বিন্দুবাসিনী ভেসে যাচ্ছে হাসতে হাসতে।
তুমি বিন্দু? ওগো ও বাছা।
ওলাং গায়ে ধাক্কা দেয়! পাপের পাল্লায় পড়ে মরে গেলাম মা গো!
—জল, এট্টু জল দ্যাও ওলাং।
ঢকঢক করে জল খায় ছকুলাল। ওলাং বুকে হাত দিয়ে শিঠরে ওঠে। ইস, জ্বরের উপর জ্বর এসেচে তুমার গো। মাথায় জল দেবো?
—দ্যাও!
দাদা অম্বিকে এসেছিল শহর থেকে ডাক্তার নিয়ে। দুদিন থেকেই চলে গেল অম্বিকা। এখন তার বড় কাজ। বড় বড় ‘বেল্ডিং’ হচ্ছে। একতিল অবসর নেই। শিয়রে জাগল দীনুপদ ওলাং আর সুদামুখী।
তুলসীতলায় শোয়ানো হয়েছিল পর্যন্ত। দীনুর কান্নায় পাথর গলে যায়। দীনুকে একখানা ‘আমায়ণ’ কিনে দেবে ছকুলাল। শরীর সুস্থ হোক আগে।
এতক্ষণে ওলাং ফিরে আসে। পেলাম না তেঁতুল! ইদিকে রাতউপোস দিনউপোস চলেছে আর শখ হল তেঁতুল খাবেন!
পাড়ার আর ধার মেলে না। মেলে না অন্য কোথাও। ছকুলালের সুস্থ শরীরের জামিন কোনো কাজেই লাগে না আর। সারা দেশে চলেছে আসন্ন দুর্ভিক্ষের দুর্বিষহ আতঙ্ক।
একদিন বনমালীর কথা মনে এল ছকুলালের। ওলাংকে বলল ডাকতে। শুনল না ওলাং। দীনুকে বলল। তখন এল বনমালী।
—এট্টা কথা বাছা। কটা ট্যাকা ধার দিতে হবে।
—সর্বনাশ! ক্রুর—বুদ্ধি নাপিত আঁতকে উঠে পিছিয়ে যায়। আপনভাতে কচুপোড়া দাদা। উপরে চিকন চাকন, ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন। কেনে হে গায়েন, মনোহারির মালগুলান কী হল?
—সব ওদরে চলে যেয়েছে লবসুন্দর দাদা।
কেটে পড়ে বনমালী। আর তৎক্ষণাৎ ওলাং—এর চিৎকার। (এত বুলি জানত ওলাং?) নামুনে ডাকাবুকো অথব্ব অমানুষ। নজ্জা করে না ওই লম্পটেকে ধার চাইতে। গলায় দড়ি জোটে না একগাছ? সোমসারে নোক নাই চাইতে? শকুন ভিখিরি জাত বংশ! স্বভাব যাবে কতি, চিরকাল যা করে খেয়ে এসেছে।
হাঁপাচ্ছে ওলাং দাওয়ার খুঁটি ধরে। কী বিশ্রী ওর চেহারাটা। ঝুলেপড়া পেট। কোটরগত চোখ। পাঁজরের সার সার হাড়। সব মিলিয়ে একটা বুড়ি ছাগল। পোয়াতী বুড়ি ছাগল।
বনমালী নাপিত আর ওলাঙ্গিনী। ধূর্ত শেয়াল আর বুড়ি ছাগল। বারবার তুলনা করে সুখী হয় ছকুলাল।
এমনি করে কেটে যাচ্ছে দিন। বিন্দুর নাম ভুলে গেছে ছকুলাল। কেবল ভুলতে চাইছে না ওলাং। অনশনক্লিষ্ট পাংশু দিন আরও দুর্গন্ধ বিস্তারে ধুধু জলে উঠছে কলহে ঈর্ষায় দুর্ভাবনায়। সেইসব দিনের হিংসায় সংক্রমিত হল ছকুলাল ক্রমে ক্রমে। আচ্ছন্ন চেতনার দুর্বল কেন্দ্রে জমল পচাটে হিংসা। তারপর একদিন…….
হঠাৎ ডেকেছিল ছকুলাল, ওলাং!
—কেনে?
—একতারা দে।
—কী জন্যে?
—আপন পথ না ধল্লে ইবার মত্তে হবে চামচিকের মতো।
—অবেলায় যাবা কী জন্যে? ভাত চাপিয়েছি? এট্টু থামো। ভাত খাবা সোস্থ হয়ে।
—না, গর্জে উঠেছে ছকুলাল।
—তবে তুমি লাও আপন হাতে।
একতারা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ছকুলাল। ওলাং আর নিজেকে থামাতে পারে না। চেঁচিয়ে ওঠে, যাবার মুখ আছে আর কতি। কে দেবে একমুঠো উই ভাঙা বাঁশির গীত শুনে?
—আমি ভাঙা বাঁশি? কেউ শুনবে না গান?
—শুনবে বইকি। শুনবে না আবার। যার পোকায় কামড় দেবে সে গান শুনতে বেরোবে। ঝগড়ার সুর উচ্চনাদে ওঠে ক্রমশ।
—কীসের পোকাটা শুনি তুর মুখ হতে?
—পেমের পোকা।
—তু ভেবেছিস আমি বিন্দুর বাড়ি যাব?
—তা ছাড়া আর যাবা কতি?
—কেনে, কেনে তুর এত কোধ বিন্দুর উপর। ছকুলাল এগিয়ে আসে। বল, বল আজ পষ্টাপষ্টি শুনব। কেনে কেনে কেনে?
আরও ক্ষেপে ওঠে ওলাং। বিন্দু আমার সতীন যে! তাই এত কোধ। আচম্বিতে উনুন থেকে গনগনে কাঠখানা টেনে বের করে ছকুলাল। দুর্বল হাতে যথাশক্তি আঘাত দিয়ে বসে ওলাং—এর পিঠে। ওলাং আর্তনাদ করে পড়ে যায় উঠোনের ধুলোয়।
ছকুলাল কাঠটা উনুনে ভরে দিল আবার। ঢাকনা তুলে ভাত টিপে পরীক্ষা করতে বসল। আর একবস্ত্রে ওলাং পালাল রায়দিঘির পাড় ধরে। পাড়ার লোক জুটে গিয়েছিল। দীনুপদ ফেরানোর জন্য দৌড়ে গিয়ে হাত চেপে ধরল তার। অশ্লীল একটা কিরে দিয়েছে ওলাং। ছেড়ে দিয়ে চলে এল দীনু।
ছকুলাল ভাত নামাল। সেই ভাত বেড়ে ধীরে সুস্থে নুন মাখিয়ে খেতে বসল দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে। পরম তৃপ্তিতে ঢেকুর তুলল।
নীচেই স্বভাবমতো ভাগাড়চর কুকুরটা এসে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছে। একমুঠো ছুঁড়ে দিয়েছে ছকুলাল। নিত্যি যেমন দেয়।
ফিরেছে নীলকান্ত ততদিনে। মন্ত্রপূত কবচে আটকানো যায়নি কিছু। এক এক করে বলল সব বৃত্তান্ত শাশুড়ির কাছে। বেশিদূরে তারা নেই। আছে ঝিকটিপোতায়। হরিমাখন দত্তের চালকলে চাকরি করছে শুওরটা। ঝি—এর কাজ করে নেত্যবালা দত্তের বাড়িতে। বেশ গুছিয়ে বসেছে।
—নেত্যকে বলেছিলা আমার কথা?
—সাক্ষাৎই পেলাম না গো।
—তবে করলা কী শুনি বাছা?
—শোন না বলছি কী কাণ্ড। শুওরের বাচ্চাকে যখন যেয়ে চেপেচুপে ধল্লাম, উলটে আমাকেই মাল্লে।
—মাল্লে?
—হ্যাঁ গো।
—তুমি মাত্তে পাল্লেনা?
—আর বলছি কী গো তাহলে। বিদেশবিভুঁই জায়গা। শালার দ্যাশে একটাও মানুষ নাইগো। কেউ ধল্লেনা। কেউ বিচের কল্লেনা এট্টু। দাঁত বার করে হাসলে সবাই। ভীড় জমেছিল খুব। টাউন তো তা এক বাবুর কাণ্ড শোন। ভারী ভালোমানুষ উনি কিন্তুক। ধরে থানায় নিয়ে গেল আমাকে। বললে, দারোগাবাবুকে সব বুঝিয়ে বলো। দ্যাখো না, বাছাধনকে হাজতে ভরে চিৎ করে শুইয়ে এনে দেবে।
—তারপর?
—দারোগাবাবুর কথা আর কী বলব। বিচের জিনিসটা সোমসার থেকে উঠে গিয়েছে। তদন্তটা অবিশ্যি কল্লে। তা কল্লে। কিন্তুক যার কলে চাকরি কচ্ছে, উ দত্তবাবু কী সব ফালতু বুজিয়ে দিতেই আমাকে বাপান্ত।
—বাপান্ত? মরা কাকটার দিকে চোখ তুলে একবার চাইল তরঙ্গ।
—শালাটালা কত কী বল্লে। পালিয়ে এলাম। খোঁজটা তো পেইছি। আপন মনে বিড়বিড় করে নীলকান্ত, নেত্যর একবারটি দেখা পেলে ভাবনা ছিল না। উ নিশ্চয় পেছন ধরতো গো। আমার চোখে চোখ পল্লে….
তরঙ্গ চুপ। আবার বলে নীলকান্ত, হ্যাঁগো, কাগটা ডেকেছিল?
মাথা নাড়ল তরঙ্গ। হ্যাঁ, ডেকেছিল।
না। কাকটা ডাকেনি একবারও। কোনোদিনই ডাকবে না, জানে তরঙ্গ। জেনেও এসব করে! এক পুরনো নেশা তার। সারাজীবনকে ঘিরে রেখেছে এই নেশা। এর বাইরে আপন অস্তিত্ব সে সইতে পারে না। সারাজীবন নেত্যর বাবার সঙ্গে তার বনেনি এজন্যে। স্বামীর ভালোবাসার ডাকের কোনো দাম দিতে পারেনি। নিরাত পাথুরে দেশের পোড়া মাটিতে খেতে ক্লান্ত স্বামী তাকে পেতে চেয়েছে নিবিড় করে। আর পেয়েচে এক দেয়াশিনী ডাইনিকে। বেদির ভর ওঠা এক বেসামাল শরীর মাত্র। সেটা তরঙ্গ নয়। অমানবিক এক সত্তার উচ্ছিষ্ট মাংসপিণ্ড।
এ এক দুর্ভাগ্য তরঙ্গিনীর। কত সময় সে সহজ হতে চেয়েছে। আরও পাঁচটি মেয়ের মতো মন নিয়ে ডুবতে চেয়েছে ঘর সংসারের কাজে। স্বামীর বুকে মিশিয়ে যেতে চেয়েছে। কে যেন ওকে ঘিরে ধরেছে সব সময়। মাথা ঘুরেছে। বারবার শিউরে উঠেছে শরীর। তারপর যে অবস্থা, তা তার আয়ত্তের বাইরে। প্রথম প্রথম এটা হয় বিয়ের কিছু আগে থেকে। বিয়ের পর বলত নেত্যর বাবা, কিছু দেখতে টেখতে পাও? বলত তরঙ্গ, না তো। কিছু দেখা যায় না। অথচ কিছু আসে। তাকে নিজের মুঠোয় পাওয়া যায় না। তাকে সচেতনভাবে নিজের প্রয়োজনে খাটানো যায় না। সে তাকে খাটায়। বলিয়ে নেয় তার মুখ দিয়ে আপন বক্তব্য। কত সময় কেটে গেছে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে। দেবতা রক্ষ যক্ষ যেই হও, আমাকে এট্টু দরশন দ্যাও। আমি মলাম গো।
কেউ না। কোনো মুখ কোনো শব্দ কোনো অস্পষ্ট রূপরেখা আকৃতি কিছু না। অথচ একজন আসে তার কাছে। শরীরকে ভেঙে চুরে দিয়ে যায়। বিপর্যস্ত করে হাড় মাংস পেশি গ্রন্থি। সে চলে গেলে শারীরিক অস্তিত্বটা দুর্বহ বোঝার মতো ঠেকে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত নিস্তেজ শরীরে অনুরোগের মাধুর্য জাগিয়ে স্বামীর কাছে সংসারের কাছে আবার কীভাবে পৌঁছানো যায়। যখন শিখা জ্বলে জ্বলে পড়ে রইল একরাশ মোমের পিণ্ড। নরম নরম উষ্ণ বেদিতলে শিখা জ্বলবে না আর, সুতোটাই পুড়ে গেছে আগে।
আর তাই সে যখন কাছে নেই, পাগলের মতো আশ্রয় খোঁজে তরঙ্গ। জড়িবুটি, ছেঁড়াজুতো, মরা সরীসৃপ, মেয়েদের ঋতুকালীন নোংরা কাপড় কুড়িয়ে আনে। বাদুড়ের নখ প্যাঁচার চোখ শকুনের হাড়। আরও সব কদর্য উপাদান দিয়ে বানায় শূন্যমনের নির্জন রহস্যপুরী। এই স্বখাত গভীরতায় ডুবে শান্তি পায় সে। আর কী আশ্চর্য, এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে কোনো সন্তর্পণ যোগ আছে সেই অমানুষি সত্তাটার। বারবার অনুভব করে সে।
আরও গভীর হল মন বয়সের সঙ্গে। সে টের পেল এতে পয়সা আসে। সম্মান আসে। এইটুকু শুধু বাঁচার পথ। অনেক ভাবনায় খুঁজে পেয়েছিল তরঙ্গ বাঁচার এই অনন্য অবলম্বনটুকু।
আবার মাথা নাড়ল তরঙ্গ। বলল, আচ্চা। গুড়জল খেয়ে সোস্থ হও। নেদ্রা যাও। ইবার আমি যাব।
এবার নিশ্চিন্ত নীলকান্ত। উৎসাহে গুড়ের ডেলা চিবুতে চিবুতে বলল, বিনোদীয়া হয়ে যেয়ো। আমাদের গাঁয়ের ছকু গায়েনের শ্বশুরবাড়ি উখেনে। উর দাদা অম্বিকেকে সঙ্গে লিয়ো।
গেল তরঙ্গ। চণ্ডালিকা স্টেশনে ট্রেনে চেপে! পাঁচ আনা ভাড়া। পলাশগাঁ থেকে সোজাপথে অবশ্যি বেশিদূর নয়। কিন্তু পথে বিল চণ্ডালিবাঁধা। অকূল অথই জল। খরাতেও বিলের জল ডুবসাঁতার! তারপর আছে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। পেরোয় সাধ্যি কার।
বিনোদীয়া হয়ে ঝিঁকটিপোতা।
স্টেশনে নেমেই বৃষ্টি। মুখের দিকে তাকায় সকলে। চেনাচেনা মুখ মাথায় জটা। পলাশগেঁয়ে দেবী না? সারাপথ ট্রেনেও ওই ব্যাপার। ভারী খুশি হয় তরঙ্গিনী। একজন তাকে ছাতি ধরে পৌঁছে দেয় অম্বিকার বাড়ি!
অম্বিকা ঘরে নেই। ওলাং ছুটে আসে। এসো এসো, মা এসো গো। একটু ঘাবড়ে যায় ওলাং। একটু খুশিও হয়। গায়েন পঠিয়েছে তবে!
বলে তরঙ্গ, সন্তান হতে এসেছ বুঝি?
মৃদু হাসে ওলাং, হ্যাঁ গো!
মাথা নাড়ে তরঙ্গ। ভালো ভালো। বংশ বিরিদ্দি হোক! আসবে বইকি বাছা। তা পেথম বুঝি। দেখেই বুজেছি। পেথম পোয়াতী মায়ের বাড়ি খালাস হওয়া ভালো।
আতিপাতি খোঁজখবর নেয় তরঙ্গ। নেত্যর খবর এরা জানে কিনা। জানে খানিক, খানিক জানে না। নীলকান্ত বাকিটা বলে যায়নি।
অম্বিকার বউটা বেশ সুন্দরী। ফিসফিস করে বলে ওলাং, উই রূপ দিয়ে সব ঢেকে এসেছে গো। গুণের অন্ত নাই। হিংসুটে ঝগড়াটে। বুলি শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। বড় সয়ে আছি বাছা। মা’টা বুড়োমানুষ। সারাদিন অ্যালের লাইনে ঘোরে চাট্টি কয়লার জন্যে! দাদা আগে ইসব দেখতো। এখন বউর কথায় ওটে বসে। বড্ড অশান্তি মা, সর্ব্বঠাঁই অশান্তি। ওলাং স্বভাবমতো পায়ের আঙুলে মাটি খোঁড়ে। তারপর আবার কী শুধোতে গিয়ে চুপ করে যায়। চণ্ডালিকার সংবাদ? কেউ তো এল না এতদিন।
সন্ধেয় ফিরল অম্বিকা। ভারী খুশি হল সে। তখন বলল তরঙ্গ সব কথা নির্জনে ডেকে নিয়ে গিয়ে। অম্বিকা লাফিয়ে ওঠে, এক্ষুনি চলেন জননী। শালার টুঁটি ছিড়ে নিয়ে আসি। যার শিল যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া?
আশায় বুক বেঁধে পরদিন অম্বিকার সঙ্গে গেল তরঙ্গ ঝিঁকটিপোতা। নেত্যদের সঙ্গে অসে বোঝাপড়া করে পরে ‘কাজে জয়িন’ দেবে অম্বিকা।
আকাশ মেঘে মেঘে কালো। নীচে ঝিকটিপোতার বাজারে ভীড়। রান্নাঘরের পরিত্যক্ত আবর্জনায় ভরা নোংরা ঘিঞ্জি রাস্তা। দুধারে ভাঙা ইঁটের টুকরো পীচের পর্দা তুলে উঁকি মারছে। ড্রেনে রাস্তায় এক সমতল এ পাড়াটা। সেখানে হরিমাখন দত্তের বাড়ির সুমুখে ক্ষেপেছে পলাশগেঁয়ে দেবী। রাস্তায় বসে জট নেড়ে পেতেছে। ফ্যাকাশে চোখে ঝলক দিয়ে যায় যেন আকাশের বিদ্যুৎ। হিংস্র ত্রূর খল সাপিনীর মতো এই চোখ কীভাবে লুকিয়ে থাকে অন্যসময় মনের কোনো রহস্যের ঝাঁপিতে। দুলছে সিঁদুর রাঙানো ক্রুদ্ধ জটার গোছা এ পাশে ও পাশে! ভর উঠেছে শেতলার।
—এলাম, এলাম বলে তুদের দ্যাশে! পাপের ছেদ্র দিয়ে পবেশ কল্লাম। তুদের ঘরে পাপ পুষেছিস। আশ্রয় দিইছিস। তুদের লিব্বংশ করব। লিব্বংশ, লিব্বংশ!
প্রথমে অনেক তামাশার হাসি! পরে খানিক দুর্ভাবনা! শেষে কিছু বিস্ময় চারপাশের ভীড়ে। বিস্মিত অম্বিকাও। পাশে দাঁড়িয়ে জোড়হাতে চোখ বুজে রেখেছে। গোড়ালি থেকে উঁচুতে ঘনরং পাতলুন পরে চিত্রবিচিত্র জামাগায়ে মেয়েদের মতো চুল আঁচড়ানো জোয়ানেরা হাততালি দিচ্ছে থেকে থেকে। তত ক্ষেপছে শেতলা।
—কী! আমাকে অবহেলা, আমাকে হেনস্তা? এই, এই লরকখেকো ডাকাবুকো, তুর ভগ্নীর জ্বর, মাথা কপালে যন্তন্না। বাড়ি যেয়ে দ্যাখ গে মিনসে! আমি লিইছি তাকে। কামড়ে দিইছিরে মাগি মুখো ড্যকরা। হি……..হি……..হি……….
উৎকট তীক্ষ্ন হাসি। দুলে দুলে হাসছে ডাইনি। ওরা পরস্পর তাকায়! কে বুঝি সরে যায় ভীড় থেকে। তার বোনের জ্বর, মাথায় যন্ত্রণা সকাল থেকে।
কথা আর হাসির তীব্রতা ততক্ষণে এক গভীরতার সৃষ্টি করেছে। তাই এবার একটু স্তব্ধতার ঢেউ। একটুখানি গা ছমছম। তারপর উঁকি দেয় একখানি মুখ। হরিমাখন দত্ত ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসছে। সরে গিয়ে পথ দেয় জনতা! আর ঢুকেই সাষ্টাঙ্গ প্রণাম!
ভর থামল। ভীড় কমল। শুধু কিছু অতি কৌতূহল অথবা নিষ্কর্মার ভীড়। অম্বিকা চোখ খোলে এতক্ষণে। ক্লান্ত তরঙ্গ বলে, মায়ের পেসাদগুলো কুড়োও অম্বিকে।
অনেক পয়সা মিষ্টি। ফুল আর আতপচাল। এবড়োখেবড়ো পীচ আর ইঁটের গুঁড়োর উপর লুটোচ্ছে। পয়সা আর ফুলগুলো তুলে নেয় অম্বিকা। দালানের উপর থেকে মেয়েরা ফুল আর আতপচাল ছুঁড়েছে। অম্বিকে দালানের উপরে একবার তাকায়।
ঘরে বসে দত্ত শুনল সবকথা। ডাকল জাম্ভু আর নেত্যকে। গর্বিত জাম্ভু এল মোটা মোটা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে। এখানে সে জাম্ভু নয়। রসিকলাল।
—পায়ের ধুলো দাও গো শাশুড়িঠাকুরুণ।
মুখ ফিরিয়ে বসল তরঙ্গিনী।
এল নেত্যবালা। মাথা নীচু করে নয়। বলল, মা কখন এলে?
দত্তের দালানে সয়না তরঙ্গের চিৎকার। গমগমিয়ে ওঠে কংক্রিটের মসৃণ সিলিং।
—লজ্জা করেনা পোড়ামুখী, শাঁকচুন্নী, বৌষ্টুমী ছেনাল কাঁহে কা। দড়ি জোটে না একগাছ মত্তে। অ্যালের লাইন পড়ে আছে না গবরমেন্টের! আবার মা বলে ঢং! কে তুর মা লা?
কাঁপেনা নেত্য। সে—নেত্য নয় যাকে একটু চড়িয়ে কথা বললে ভয়ে কাঠ হয়ে যেত। মায়ের ভয়ে যে—নেত্য বাবার কোলে সেঁধিয়ে যেত নীল হয়ে।
—আমার বাড়ি চলো মা। ওঠ। কথায় শহুরে টান। হাত ধরে টানতে একটুও সংকোচ নেই। তরঙ্গ হতাশ। তরঙ্গ নির্বাক। নাগালের বাইরে চলে গেছে মেয়ে। পেঁচার ঠোঁট, শকুনের চোখ বাদুড়ের নখ কোনোকিছু দিয়ে ধরে রাখা যায় না পুরনো দিন, পুরনো নেত্যকে। খাঁচাছাড়া পাখি ঝিকটিপোতার আলোকিত আকাশের আস্বাদ পেয়ে বে—বশ হয়ে গেছে। তরঙ্গ হারল। জীবনের প্রথম হার। পেটে মেয়ের কাছে হেরে গিয়ে নিঃশব্দে উঠল।
—অম্বিকে?
—মা।
—তুমি কাজে যাও!
নেত্যবালার সংসার। পঞ্চাশটাকা মাইনে পায় জাম্ভু। প্রথমে বিনি মাইনেতে কাজ শিখে নিয়েছিল। তারপর বুদ্ধির মূল্য আদায় করছে আস্তে আস্তে। সারা গায়ে ময়লা মেখে ভূত হয়ে বাড়ি ফেরে সন্ধ্যায়। হাফপ্যান্ট আর বগলকাটা ফতুয়া গায়ে। মাথায় রুমাল বাঁধা। সাবান মেখে গা ধোয়। মুখে হিমানি ঘসে। পরিষ্কার জামাকাপড় পরে ফিটফাট বাবুটি সেজে নেত্যকে নিয়ে বেরোয় সিনেমায়। নেত্যর পরনে রংছোপানো শাড়ি, লম্বাহাতা ব্লাউজ। পায়ে লালফিতের স্যান্ডেল। ওরা দুটিতে শহুরে হয়ে গেছে। চণ্ডালিকা পলাশগাঁয়ের দুটি ভবিষ্যৎ রূপ নিচ্ছে ঝিকটিপোতায় এসে।
—এই আমার সংসার মা। বলে নেত্য। বলো, আর কী চাও মেয়ের জন্যে!
—কিন্তুক—থতোমতো করে তরঙ্গ। কী যেন মনঃপূত হয় না তার।
—কিন্তু কী মা?
—কিছু না বাছা।
নীলকান্তর মুখখানা এই সুখী শহুরে সংসারের উপর কী কুৎসিত দেখাচ্ছে । তরঙ্গ ঘাবড়ে গেছে এই বর্ণিল উচ্ছল সমারোহের মধ্যে। নেত্যর উজ্জ্বল শাড়ির চোখধাঁধানো আলোয় চণ্ডালিকা পরগনার জীবনযাত্রা তার পরিপূর্ণ রহস্যসমেত পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে গেছে। নেত্যর সংসারের তুচ্ছতম শহুরেপণাটুকুই তরঙ্গের জীবনের এক অনাবিষ্কৃত ঐশ্বর্য। পলাশগাঁয়ের চণ্ডালিকার জীবন! ছি, ছি, ছি! তরঙ্গ প্রলুব্ধা। তরঙ্গ যেন সার্থক।
নীলকান্ত এখানে পৌঁছাতে পারে না কেন? সাধ্যি থেকে পৌঁছাক। ভাবে তরঙ্গ, জটিল জটার পাকে আঙুল বুলিয়ে। তবু যেন পথের মধ্যে অতল খাল। নীলকান্ত পুরুষ বলে জানল না। জানল তরঙ্গ। এ খাল পার হতেই যে অনেক জম্ম কেটে যাবে নীলকান্তর।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে নীলকান্ত। তরঙ্গ বাড়ি ঢুকছে। ধুঁকছে বুড়ি। হাঁপাচ্ছে একটু একটু। হাত ধরে টেনে আনতে চায় সে। তরঙ্গ বারণ করে হাত নেড়ে। নিজেই একপাত্র জল গেলে ঢকঢক করে।
বুকে—ঝড় নীলকান্ত শুধোল এল না!
তরঙ্গ চুপ।
—কথা বলছো না যে গো। কী বল্লে নেত্য! দেখা পেইছিলা তো?
তরঙ্গ বলবে না কথা।
গায়ে ঝাঁকুনি দিল নীলকান্ত। তুমাকে মাল্লে নাকিন?
তরঙ্গ পাথর।
চেঁচিয়ে ওঠে নীলকান্ত। এল না তাহলে!
পলকে বদলে গেছে তরঙ্গিনী। ডাইনিটা ক্ষেপে উঠেছে হঠাৎ। কী এল না এল না করিস রে অনামুখো!
নীলকান্ত মরিয়া। কেনে গো; উয়ারা!
—কেনে, আসবে কেনে? তুর বদনছিরি দেখতে আসবে রে ছোঁড়া?
—ও, বুজেছি। ঢোক গিলে চুপ করে নীলকান্ত। অভিমানে ব্যথায় আহত সে।
—কী বুঝেছিসরে ছারকপালে।
—লতুন জামাই—এর কাছে খেয়ে পরিবর্তন হয়ে যেয়েছো।
—কী, কী বললি!
—শালা তুমাকে ট্যাকা খাইয়ে বশ করেছে গো। মেজাজ চড়ে গেছে নীলকান্তর। এই কি পলাশগেঁয়ে সব মেয়ের ব্যাপার। নামেই শুনতো সে। আজ মুখোমুখি সে সেই কদর্য বাস্তবতার। নেমকহারাম, ধড়িবাজ পাড়াকুঁদুলি স্বার্থপর। গালাগালি তীব্র আমেজ মনে। হিংস্রতায় আক্রোশে টগবগিয়ে রক্ত ফুটে উঠেছে তার।
ওদিক ক্ষেপেছে বুড়িও। এলোপাথাড়ি অশ্লীল গাল। খিস্তিখেউড়ের চূড়ান্ত। সইতে পারে না নীলকান্ত। লাফিয়ে উঠে টুঁটি চেপে ধরে থামিয়ে দিতে চাইল ডাইনিকে।
সেও ছাড়ে না সহজে। তীক্ষ্ন নখে নীলকান্তর মুখ বুক ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। ঠিক যেন ভাগাড়ের বুকে প্রমত্ত কুকুর আর শকুন। স্বভাবমতো লোক জমেছে মজা দেখতে। ছাড়িয়ে দেয় এবার। হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে এল নীলকান্ত। হাতের চেটোয় রক্ত মুছতে মুছতে নেমে পড়ল মাঠে। জলকাদা না মেনে দৌড়ে চলে গেল চণ্ডালিকা লক্ষ্য করে। তরঙ্গর কবচটা ছিঁড়ে ফেলে দিল বাহু থেকে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে চলল নীলকান্ত।
তরঙ্গের আঁচলে গিঁটেবাঁধা প্রসাদী পয়সাগুলো ঝুলছে। পা ছড়িয়ে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে স্বামীর নাম ধরে। মরা কাক গতরাত্রের ঝড়ে ছিঁড়ে পড়ে গেছে কোথায়।
আর ডাকবে না কাকটা।
পলেস্তারা খসে গিয়ে দাঁত বের করে আছে পাঁচিল। উপরে ফাটলে গজিয়েছে অনেক চারাগাছ। শ্যাওলাসবুজ কার্নিশের টুকরো ছড়ানো সবখানে। উঁচু দেউড়ি পার হতে গিয়ে বরাবরের মতো মুখ তুলে তাকায় শরদিন্দু। ভেঙে পড়বে না তো। যতবার ওটা পার হয়েছে, একই আতঙ্ক। মৃত সামন্তবাদের এই অনুচরটা যেন সব সময় ছোবল মারার জন্যে তৈরি। আর একে অতিক্রম না করে শঙ্করীপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করা যাবে না। কালের কালান্তক প্রহরী! একটু হাসে শরদিন্দু।
সুমুখে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। মধ্যখানে গোলাকার ফুটবাগিচা। চারপাশে আলকাতরা মাখানো বাঁশের বেড়া। কোথাও বেঁকেচুরে খসে খসে আছে। বর্ষায় ঘাস আর আগাছা গজিয়েছে রাশ রাশ! ফুলের গাছ সহজে চেনা যায় না। ওখানে একসময় ইঁটের বেড়া ছিল। বড়ো বড়ো গোলাপ ফুটত। একটু একটু মনে পড়ে তার।
তারপর ক’ধাপ সিঁড়ি। দুটো মস্ত উঁচু থাম। তার মাথায় কার্নিশ ভেদ করে ত্রিকোণ একটা লাইমকংক্রিটের দুপাশে দুটো বাঘের মাথা। মধ্যিখানে উদীয়মান অর্ধসূর্য। ইটালিয়ান স্থাপত্যের হাস্যকর অনুকরণে গড়া সেকেলে দালান। দীর্ঘ জানালার বিবর্ণ খড়খড়িগুলো ছেড়ে গেছে কোথাও! দুপাশে দুটো কামরা। মধ্যে বারান্দা! সুমুখের বড় ঘরটা ড্রয়িং রুম বলা চলে। দরজার মাথার উপর টানাপাখার নিশানা। আগাগোড়া সাদাপাথর বসানো মেজে। কারুকর্ম শুধু বাঘের মুখ। গা ছমছমিয়ে ওঠে। কড়িকাঠ থেকে ঝরে পড়া পায়রার সবুজ বিষ্ঠায় মেঝের ফাটলগুলো সূক্ষ্ম নকশার মতো দেখাচ্ছে। দরজা জানালার উপরে লাল নীল কাচ টুকরো করে মাত্র আটকানো আছে ফ্রেমে। ফলস প্যানেল দরজার বুকে বাঘের মুখ।
মেঝেয় গামবুটের টুকরো সাদা। একটু অপ্রস্তুত হয়ে সরে আসে সে। প্রাঙ্গণটা লক্ষ্য করে। কালান্তরের চিহ্নে জটিল। পাঁচিলের ধারে ধারে লাগানো সেকালের দেশিবিদেশি গাছগুলোর নীচে ঘাস গজিয়েছে রাশরাশ। বর্ষায় সঞ্জীবনী ধরায় স্নান করে জীর্ণস্থবির পুরানো মাটিতে নতুন বন্য প্রাণের উদ্দাম আবির্ভাব। বিশীর্ণ ইউক্যালিপটাসের গোড়ায় ঘাসের চিরল পাতা তুলেছে। আকাশের অমৃতগন্ধে মাতাল ঘনসবুজ বনানী। ফাঁকে ফাঁকে নতুন গাছ পুঁতেছে কে, এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। রজনীগন্ধার নীচের মাটিতে কার হাতের কারুকর্ম।
হয়তো শঙ্করীপ্রসাদের মেয়ের কীর্তি। (কেন একথা মনে আসে তার, যখনি এসে নতুন কিছু দেখে!) ওপাশে সারসার ভেঙেপড়া ঘর। আগের সেরেস্তাখানা। তারপর সারসার ধানের গোলা চলে গেছে দালানের পাশ ঘেঁসে ভেতরের দিকে। তাদের মরচেধরা জমাটরক্তের মতো রং টিনের চালে একঝাঁক পাখি। মেঘলা আকাশ চুপ করে আছে। আবার বুঝি বৃষ্টি নামবে। বর্ষাতিটা তুলে ধরে জল ঝেড়ে ফেলার জন্য ঝাঁকি দেয় শরদিন্দু।
একজনেরও পাত্তা নেই। মরেছে নাকি! অভ্যাসমতো চাপা গর্জায় সে, দি হেল!
তৎক্ষণাৎ ভেতর থেকে ভারী গলায় সাড়া! কে?
সর্বনাশ শুনে ফেলল নাকি! শরদিন্দু একটু কাশে। তৈরি হয়ে নেয়!
পাশের দরজাটা খুলে যায়। বিশ্রী অস্বস্তিকর শব্দ। মুখে মৃদু হাসি আনে শরদিন্দু। তাকায়। একটা রোগা বাস্তুসাপ ধীরে ধীরে বেরুচ্ছে এভাবে শংকরীপ্রসাদ আবির্ভূত হচ্ছেন। দিনে দিনে আরও বিশ্রী হয়ে গেছে চেহারা। লুঙ্গিপাঞ্জাবিপরা শংকরীপ্রসাদ হেসে উঠেন হো হো করে। আরে, নাস্তু যে! আমি ভাবলাম সরকারি কর্তারা কেউ এল নাকি।—তারপর, আছো কেমন? ঘাড়ে হাত রাখেন শংকরীপ্রসাদ। কড়ে আঙুলে লাল পাথর বসানো চাঁদির আংটিতে ক্ষয়িষ্ণুকালের অবশিষ্ট দীপ্তি।
হেঁট হয়ে পায়ের ধুলো নিতে হয় শরদিন্দুকে।
হাসতে থাকেন শংকরীপ্রসাদ। এত ঘন ঘন আসা তো ভালো নয়।
লোকটার ভদ্রতার কোনোদিন ছিল বলে শোনেনি শরদিন্দু। বলে, আমি ঘনঘন আসি নাকি?
—তোমার বাবা তো আসেন। একই কথা। এসো ভেতরে এসো।
হাতধরে টেনে নিয়ে যান তাকে। পুরনো আসবাবে বেকায়দায় সাজানো ঘরখানা যেন আগন্তুকের জন্যে বিরূপ হয়ে আছে। শংকরীপ্রসাদ বেত ছিঁড়ে যাওয়া আরামকেদারায় বসেন। শরদিন্দুও বসে।
—তারপর, খবর কী বলো? আবার কিছু বাধল নাকি?
সেদিকে কান দেয় না শরদিন্দু। শংকরীপ্রসাদের গোড়ায় কথাটার তাৎপর্য তাকে ক্রুদ্ধ করেছে। বলে, আমার ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে কোথাও একদণ্ড থাকা অসুবিধে। দরকার হলেও আসতে পারিনে। তবে বাবার সুমুখে আপনার সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে ঘনঘন। সম্ভবত বাবা সেই সূত্রে নিজে থেকে এসেছেন আপনার কাছে।
আবার উচ্চকণ্ঠ হাসি। তা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার সম্পর্কে আলোচনা মানে আমার ও—মাঠের জমি সম্পর্কে। কেমন, তাই নয়?
ওল্ডফুল! শরদিন্দু আরও আহত। প্রত্যেকবার একধরনের একটা প্রস্তুতি তার মনে ওই দেউড়ি পার হয়েই জন্মে যায়। স্মৃতির সংস্কারের অন্ধকার থেকে কোনো সংগুপ্ত ঈর্ষার প্রচ্ছন্ন ধারাবাহিকতা বুঝি এসময় ভর করে তাকে। জেগে ওঠে একটা ক্ষুব্ধ অহমিকা বোধ। তাকে কিছুতেই এড়ানো যায় না। কীজন্যে এমন হয়? দূর শৈশবের কিছু স্মরণ আসে না তার।
—যাক সে কথা। খবর বলো এবার। নিশ্চয়ই কোনো গোলমাল বেধেছে মাঠে?
খুশি হয় শরদিন্দু। এই হচ্ছে লোকটার ভাইটাল পয়েন্ট। এবার নিজের বক্তব্য আদর্শ লক্ষ্য তিলতিল বিশ্লেষণ করে বোঝাতে চায় সে। অনেক সময় ধরে উচ্ছ্বাসে উৎসাহে ফেনিল করে তোলে আগামী অনিবার্য কালের ছবিখানা। সমবায় কৃষিউৎপাদন ব্যবস্থার খুঁটিনাটি, গ্রামনির্ভর সমাজ—অর্থনীতি, তারপর তার জীববিজ্ঞান। ক্রোমোসামবাদ জীবনের রহস্যের বিরুদ্ধে দুর্বোধ্য বক্তৃতা। সব চোখ বুজে শোনেন শংকরীপ্রসাদ। একেবারে চুপচাপ শোনেন। তাই আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে শরদিন্দু। এবার বুঝি ওষুধ ধরেছে ব্যাধির। এবার লোকটা বলে বসবে, হ্যাঁ, আমি তোমাদের সনদে সই দিতে তৈরি আছি। ডাকো গয়জদ্দি মণ্ডলকে, যুগলেশ্বর আর ইনতাজ সরদারকে।
না। সেকথা বলেন না শংকরীপ্রসাদ। বলেন, সবই বুঝি আমি নান্তু। তবে কি জানো, চিরদিন নিজের একটা স্বভাব পুষে রেখেছি, তার লাভ—খতিয়ানটাই আসল কথা। সেটা আমার ব্যক্তিগত দিক বলতে পারো। তোমার সঙ্গে আমার মিল হবে এমন কথা নেই।
শরদিন্দু হতাশ।
—আর তাছাড়া, এখন বোধ হয় তোমাকে বলার সময় এসেছে যে ও জমি আমার মেয়ের।
—আপনার মেয়ের? অবাক হয় শরদিন্দু?
—বাবা তাঁর নাতনিকে বিয়ের আগাম যৌতুক দিয়ে গেছেন বলতে পারো।
—মিনু কি মত দেবে না বলতে চান?
—না। তা নয়। সমস্যাটা একটু জটিল। বাবার উইলে একটা শর্ত আছে ও—জমি সম্পর্কে।
—কী শর্ত?
—বিয়ের পর মিনুর হাতে আসবে জমির স্বত্ব। এখন বোঝ তাহলে।
—স্বত্বের প্রশ্ন কেন তুলছেন বুঝছিনে। কোঅপারেটিভ ফার্মিং—এ ঢুকলে………
বাধা দেন শংকরীপ্রসাদ। তাতে কী হয়েছে? শরদিন্দু আবার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। নৈতিক বাধার অর্থ মোটেও বোধগম্য নয় তার কাছে।
—আপনি কি জমি হারানোর ভয় করছেন?
—জমি মিনুর। শংকরীপ্রসাদ উঠে দাঁড়ান। পায়চারী করেন। আমি তার অভিভাবক মাত্র। বিয়ের পর তার অন্যমত হলে…..
বাধা দেয় শরদিন্দু। তখন অন্যমত হলে ফার্মিং থেকে বেরিয়ে আসবে।
হঠাৎ মুখোমুখি দাঁড়ান শংকরীপ্রসাদ। অস্বাভাবিক কলকণ্ঠ হাসি। তারপর বলেন, নান্তু আগামী যুগের ছবি আমিও কিছু কিছু আঁকি। ফার্মিং থেকে বেরিয়ে আসার কোনো চিহ্ন সে ছবিতে নেই। আর ………..একমুহূর্ত থামেন।
শরদিন্দু বলে, আর?
—তোমার মতো সেন্টিমেন্টাল ছেলের গড়া ফার্মিং থেকে বেরিয়ে আসার ফলাফলের জন্যে তাহলে এখন থেকে প্রস্তুত থাকতে হয়!
এত হাসতে কোনোদিনের জন্যেও দেখেনি শরদিন্দু। সবটা কি তামাশা করে উড়িয়ে দিচ্ছে লোকটা! আমি সেন্টিমেন্টাল? শরদিন্দু তীক্ষ্ন চোখে তাকায়।
—আমাকে ভাবতে দাও নান্তু। যুগের পদধ্বনি তোমার মতোই কিছু কিছু আমার কানেও আসে। উঠে দাঁড়ায় শরদিন্দু। উত্তেজিত ক্রুদ্ধ আহত। শংকরীপ্রসাদের দেখা আগামীকালের সঙ্গে তার প্রত্যয়ের মিল আছে বলে অন্য কোনো সময় হয়তো খুশিই হত সে। কিন্তু এখন তার মনটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে শংকরীপ্রসাদের ওই শেষ কথাটিতে। সে সেন্টিমেন্টাল!
—নান্তু!
ঘুরে দাঁড়ায় শরদিন্দু!
—ঘোড়া না বাঁধলে তো চলবে না বাবা।
একটা সেকেলে বাক্য দিয়ে আলতো কুটুম্বিতার সুর। শরদিন্দুর দ্রুততা নাগাল পায় না এরা। এই ভূতুড়ে বাড়িতে শুয়ে দেশিমদের নেশায় অপ্সরা নাচানো বিলম্বিত প্রাচীন সময় কবে ওই কড়িকাঠের মাকড়সার জালে আটকে গেছে।
—বলুন।
—আমার কথায় রাগ করেছ। এবং তুমি যে সেন্টিমেন্টাল তার প্রমাণ এখানেই।
শরদিন্দু অপ্রস্তুত। কোথাও যেন হেরে যাচ্ছে সে। তার শিক্ষাদীক্ষার আভিজাত্যে কোথাও খানিক রং ছুঁড়ে মেরেছে এই দাম্ভিক ব্যারনটা।
—একটু বসে যাও।
আবার কি কিছু বলবেন শংকরীপ্রসাদ? আশায় স্ফুলিঙ্গ আবার তার মনে। বসে পড়ে সে।
প্রতিবেশীর বাড়ি হলেও তুমি বিদেশি। কারণ তুমি থাকো তেপান্তরে। কলকণ্ঠ হাসির ঝড়ে সব মালিন্য বুঝি ঘুচিয়ে দিতে চান। বলেন, জলযোগ না করে গেলে অতিথির অমর্যাদা হয় বাবা। বসো তুমি।
কী বিশ্রী অবস্থাটা। শরদিন্দু ঘেমে ওঠে। ছুটে বেরিয়ে পড়তেও পারে না। পারে না এই দুর্গন্ধ আবহাওয়ায় খানিক বসতে।
কিন্তু সইতে হবেই। অর্ধেন্দুর নির্দেশ। নিজের চিন্তার ফলাফল। এইসব প্রাগৈতিহাসিক জীবগুলো সহজে মানবে না। কিছু কলাকৌশল দরকার হবে।
খানিকপরে হালকা মেজাজে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামে শরদিন্দু। শংকরীপ্রসাদের আকস্মিক কুটুম্বিতার মধ্যে সে আশা করার মতো কিছু পেয়েছে। তাছাড়া আগামী ফাংশনে উনি অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন বলে কথা দিয়েছেন।
প্রাঙ্গণের খোয়াঢালা পথ। সুরকির রক্তিমতা বর্ষার জলে ক্ষয়ে গিয়ে বাদামি। দেউড়ি পার হতে গিয়ে অভ্যাসমতো মাথা তুলল সে। হাসিভরা মুখে। খানিক আতঙ্কেও দিনে দিনে বাড়ছে ফাটল। এই মুহূর্তেই ধসে যেতে পারে। আকস্মিকটা ঘটে যেতে পারে দীর্ঘ সময়ের তিল তিল নেপথ্য প্রস্তুতির পর।
বেশ উঁচু তোরণ। আর কাছে গিয়ে মনে পড়তেই মাথা তুলছিল। তাই হাসছে কমলারং শাড়িপরা একটি মেয়ে। মিনু না? কী যেন আসল নামটা। হ্যাঁ, মৃণ্ময়ী। বড্ড ফাজিল হয়ে গেছে।
বর্ষণসিক্ত ঘন সবুজ পত্র পল্লবে ভরা গাছ। অজানা সুবাস বাতাসে। মেঘার্দ্র আকাশের নীচে কিছু ধূসরতা। স্মৃতির দুর্গম পৃথিবী থেকে এমনি একটা আর্দ্রমন্থর পুলকের মদিরতা। ছায়াছায়া কী সব স্বপ্নিল ছবির রেখা। তুচ্ছ আশা আনন্দের অনেক তুচ্ছতম ব্যর্থতায় বিষণ্ণ বেদনাবিধুর স্মৃতি ঘনিয়ে আসে। অথচ সবই এখন নাগালের বাইরে।
আবার বৃষ্টি নামল। ধূসরতার একফালি পর্দা ঘন হয়ে কাঁপতে লাগল পৃথিবীর বুকে। মাঠের পথে চলল শরদিন্দু।
চণ্ডালিবাঁধা বিলে জাল নামছে। নালা দিয়ে জল ঢুকছে বিলে! সেখানে বেসাল জাল পেতে একবুক জল ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে সুঁদিপুরের বাগদি—বাগদিনীরা। এসেছে বিন্দুও। তাঁর কলঙ্ক আস্তে আস্তে গা—সওয়া হয়ে গেছে ক্রমশ।
এলাকাটা বছর বছর ডাক হয় সরকার থেকে। গত ক’বছর নিয়েছিল চণ্ডালিকার গয়জদ্দি মণ্ডল। এবার ডেকে নিয়েছে এরা। আর লুকিয়ে মাছ ধরার ঝক্কি নেই। নিশ্চিন্তে বুক ফুলিয়ে জাল নামিয়েছে।
সুঁদিপুর মৎস্যজীবী সমবায়। সম্প্রতি গড়ে উঠেছে। সরকারি ঋণ থেকে সরকারি তত্ত্বাবধানে সুতো জাল সবকিছুই সুবিধে দরে মিলবে। ব্যক্তিগতভাবে আর কাউকে এসব জমা দেবেন না সরকার। অন্তত যেক্ষেত্রে সমবায় সমিতিগুলো নিতে চাইবে।
হিড়িক পড়ে গেছে সমবায়ের। যদি আদ্যিকাল থেকে এগুলো কিছু না কিছু আছেই। তাদের জীর্ণ মরচে ধরা হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার করে আবার নতুন জীবনদানের আয়োজন চলেছে। নিরক্ষর সমবায়ীরা অযত্নে ফেলে রাখা কীটস্পৃষ্ট পুরানো খাতাপত্তরগুলো ঝেড়ে মুছে নিয়ে হাজির হচ্ছে সরকারি সমবায় দপ্তরে। স্থানীয় কর্তারা টোপ ফেলছেন নতুন করে টার্গেটের অঙ্ক আর চাকরির ভবিষ্যৎ দুটোই মগজে দাঁত খিচোচ্ছে বসে বসে। আর সাধারণে ছুটছে টাকার স্বপ্নে।
সুঁদিপুরের শ্রীনিবাস সাহা। লোকে বলে, ঘড়েল মাল। সারাজীবন এসব নিয়েই আছে। ক্ষুরধার বুদ্ধির ছটায় ঝলমলিয়ে তুলেছে সমবায়ের সাতরঙা পতাকাটা। বিভিন্ন ধরনের সমবায়ে ঘোরে শ্রীনিবাস। গতবছর গড়ল ঘানিতৈল সমবায়! এবার চুয়াল্লিশ হাজার লোকসান খাতায়! সরকারি বলদগুলোর খোরাক পরিচর্যাখাতে এবং অবশেষে বলীবর্দ কুলের অনশনে পতন ও মৃত্যুর খাতে। বাকিটা ‘খাম্বাখরচ’। খাম্বাখরচের কাহিনী তার কথায় কথায়। শ্রীকান্তপুরের মণি সিং মস্ত জমিদার সেকালের। তার ছেলের বিয়ে। খাজাঞ্চিখানায় নতুন সাদাসিদে কর্মচারী ঢুকেছে সুঁদিপুরের হারাধন সরকার। বেচারার সম্মুখে বড় বড় হাতি সেঁধিয়ে যাচ্ছে কর্মচারীদের পকেটে। দেখাদেখি সরকার মহাশয়ও চোখবুজে কয়েকশো। শেষটা খাতায় খরচ দেখানোর ঝামেলা। খাস খাজাঞ্চি ছিলেন আত্মীয়। বললেন, ঘাবড়ানোর কী আছে। অতশত কেউ দেখেনা হে। টোটালের অঙ্কটা ঠিক আছে কিনা দেখবার জন্য শুধু আইটেমের অঙ্কগুলোয় চোখ বুলোয়। তুমি ওখানে এত টাকা খাম্বা খরচ লিখে দাও।
—খাম্বা খরচ! হাঁ করে তাকান সরকার।
—হ্যাঁ হে। বিয়েতে হাজারে হাজারে লোক পাত পাড়ল। সামিয়ানা বাঁশ এল গাড়ি গাড়ি।
—বাঁশতো একবার লেখা হয়েছে!
—আস্ত বুদ্ধু তুমি। ওর নীচে লেখো—খাম্বাখরচ সাতশো এগারো টাকা তেরো আনা তিন পাই মাত্র।
—বাঁশ কেটেই তো খাম্বা হয়।
—দুত্তোরি! শুধু তর্ক করে। অত দেখে কে। দুটো আইটেম হল কিনা!
শ্রীনিবাস বলে, তোগলকী কাণ্ড চলেছে ভায়া। তখন কী মাথায় আসে সরকারের। অমুক স্কীম এত লক্ষ। ব্যাস, চুপ করে বসে ভাবলে চলবে না। ঝুলে পড়ো স্কীমের চার গিলে। টাকার টোপটা ধরে ফেলো। তারপর খেঁচিয়ে তোলে কে! বঁড় সেল তখন অন্য কোথাও গিয়ে বসে আছে। এসব কিছু মনে নেই। তুমি সরে পড়ো চুপচাপ। নয়তো জলের নীচে বসে বসে বুজকুড়ি তোল। চার থেকে মাছ পালায়নি এই যথেষ্ট।
সেই শ্রীনিবাস ঘটিয়ে দিল এসব। এই সুঁদিপুর মৎস্যজীবী সমবায়। সোনার চুড়ি দুগাছ বেচে শেয়ার কিনল বিন্দু। এল বুক ফুলিয়ে জাল কাঁধে নিয়ে চণ্ডালিবাঁধার বিলে। আজ আর হিমরাত্তিরে তাকে শ্যাওড়া গাছে পেত্নী সেজে লুকোতে হবে না।
প্রথম বর্ষণের জল। মাঠ বেয়ে জমেছে নালায়। ওদিকে বিলের অন্যপ্রান্তে টান দিয়েছে বাঁকী নদী। ‘প্রথম বাইচে’ ওখানে বেশ মাঠ উঠেছিল। এখন অথই জল।
বিল থেকে উজোনে ছুটেছে মাছ। ডিমভর পুষ্ট বুক। আড় বোয়াল রুইকাতলার পোনা আর কইশিঙি মাগুর। বছরটা ভারী ভালো।
চেঁচিয়ে উঠেছে অম্বু, যেল যেল রে!
সোয়াগী জালখানা একটু বেঁকিয়ে ধরে। লাফ দিয়ে বোয়ালটা নালার পাশ ঘেঁষে চলে যায়। বিন্দু ঠিক মধ্যিখানে। মাথায় ন্যাকড়া জড়িয়েছে। সর্দারনির মতো দেখাচ্ছে তাকে। এই তার স্বভাব। শিকারে নামলে রূপ বদলে যায়। তীব্র তীক্ষ্ন চোখের সন্ধান। সতর্ক পদক্ষেপ। নিপুণ ক্ষিপ্ত হাতে জালখানা নিয়ে যাওয়া। হাতে আড়কাঠি খানা ধরে আছে শক্ত করে।
মলি, তুর ভাতারকে বলনা এট্টু পাশ ঘেঁসতে। ফারাক হচ্ছে যে!
চণ্ডালিকা দূর দিগন্তের বুকে জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে। ঝাপসা দৃষ্টি চোখে। চোখ মুছল বিন্দু! সব্বোনাশ!
পচা বাগদির জালে বোরা সাপ। সেকেলে বিলের কালান্তক সাপগুলো কোনোদিন সরে যাবে না। ঠেঙিয়ে মারে পচা। এবার খানিক তরাস সবার মনে। কোথাও কিছু ঠেকলে শিউরে উঠেছে শরীর।
কী একটা পায়ে ঠেকেছে বিন্দুর। নালা যেখানে বিলের সঙ্গে মিশেছে। চমকে উঠেই আবার শান্ত হয় সে। অস্বাভাবিক মুখের চেহারাটা। অন্য সময় হলে খিলখিল করে হেসে উঠত। পায়ে যেটা ঠেকেছে পুঁটলির মতো। জালখানা শক্ত করে ধরে রেখে ডুব দেয় বিন্দু। ওটা টেনে তোলে। একরাশ বুজকুড়ি। কলকলিয়ে কথা বলছে বিলের জল। সে কথা কেউ বোঝে না।
সোয়াগী বলে, মাছ নাকিন?
জালের নীচে তখনও হাত, জবাব দেয় বিন্দু, মানিক। তারপর তুলে ধরে উপরে। ওমা, ছি, ছিঃ ছিঃ। কোন আবাগীর কাণ্ড লো। কোন আঁটকুড়ি মাগির………ওয়াক থুঃ। ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে। লাল ন্যাকড়ার পিণ্ড। পচে পচে ছিঁড়ে কুড়ে আছে।
—কোনও ছার কপালীর কীত্তি লো! থুঃ থুঃ!
হেসে উঠেছে সবে। মেয়েরা এলোপাথাড়ি হাসছে। ভালো হয়েছে, সোন্দর হয়েছে। জলে ডুবে মানিক তুলেছে। ছি ছি থুঃ! গঙ্গাচান না করে এসে ছুঁসনে ভাই।
রেগে ওঠে বিন্দু! বেশ করেছি তুলেছি। তুরা সব করিস, আর ইখেনে চুবিয়ে এখে যাস। আমি এসে তুলবো!
সোয়াগীকে লক্ষ্য করেই বলে। তাই তেড়ে ওঠে সোয়াগী, মুখে আখঢাক করিস বিন্দু। তুর মতো সবাই ওই কত্তে আসে না।
জাল ছেড়ে দেয় বিন্দু। চেঁচিয়ে ওঠে, কী কী করেছি আমি আঁটকুড়ি সতীন! যা যা গুমোর করিসনে বেবুশ্যে দ্যাশমাতানি!
পলকে পলকে বদলায় আকাশ। কালো ধূসর সাদা নানা রঙের মেঘ! নীচে বিলের একবুক জলে দাঁড়িয়ে দুটি মেয়ের অশ্লীল গালাগালি। কেউ থামাতে পারে না।
হঠাৎ জাল ছেড়ে এগিয়ে আসে বিন্দু। ডুবিয়ে ধরে সোয়াগীকে জলের নীচে। অম্বু সুঁদিপুর মৎস্যজীবী সমবায়ের চেয়ারম্যান। এবার ছুটে আসে সে। ছাড়িয়ে দেয় দুজনকে। সোয়াগী হাঁসফাস করে আর চেঁচায়। মুখ কাদায় ঠেসে দিয়েছে বিন্দু। কাদায় চুলগুলো কদাকার। দূরে ভেসে যাওয়া মাছের হাঁড়িটা আনতে যায় বিন্দু। বিলের জলে মাছগুলো সতর্ক হয়ে যাচ্ছে দেখে অম্বু শাসাল, তুকে সমিতি থেকে বাদ না দিই তো আমার নামে কুকুর পুষে ছাড়িস। আজই মিটিং ডাকব।