॥ ২ ॥
পার্বতীবাবুকে মাথার উপরের একটা ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত মেরে খুন করা হয়েছে। এঁদের বাড়ির ডাক্তার সৌরীন সোম বললেন, মৃত্যুটা হয়েছে মারার সঙ্গে সঙ্গেই। ভদ্রলোকের রক্তের চাপ ওঠা-নামা করত, হার্টেরও গোলমাল ছিল।
ইতিমধ্যে পুলিশও এসে গেছে। ইনস্পেক্টর হাজরা ফেলুদাকে চেনেন। মোটামুটি খাতিরও করেন। সাধারণ পুলিশের লোক প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরকে যেরকম অবজ্ঞার চোখে দেখে সেরকম নয়। বললেন, ‘আমাদের যা রুটিন কাজ তা করে যাচ্ছি আমরা, যদি কিছু তথ্য বেরোয় ত আপনাকে জানাব।’
ফেলুদা বলল, ‘যে ভারী জিনিসটা দিয়ে খুন করা হয়েছিল সেটা সম্বন্ধে কোনো আইডিয়া করেছেন?’
হাজরা বললেন, ‘তেমন ত কিছু দেখছি না আশেপাশে। খুনি সেই জিনিসটা নিয়েই ভেগেছে বলে মনে হচ্ছে।’
‘পেপারওয়েট।’
‘পেপারওয়েট?’
‘একবার আসুন আমার সঙ্গে।’
হাজরা ও ফেলুদার পিছন পিছন আমরাও ঢুকলাম ঘরের মধ্যে। ফেলুদা টেবিলের একটা অংশে আঙুল দিয়ে দেখাল।
সবুজ ফেল্টের উপর মিহি ধুলো জমে আছে। তারই একটা অংশে একটা ধুলোহীন গোল চাকতি। খুব ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না।
‘অমিতাভবাবুকে জিগ্যেস করেছিলাম’, বলল ফেলুদা, ‘একটা বেশ বড় এবং ভারী ভিক্টোরীয় আমলের কাচের পেপারওয়েট থাকত এই টেবিলের উপর। এখন নেই।’
‘ওয়েল ডান, মিস্টার মিত্তির!’
‘কিন্তু আসল লোক ত বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে’, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল ফেলুদা।
হাজরা বললেন, ‘নাম আর ডেস্ক্রিপশন যখন পাওয়া গেছে, তখন তাকে খুঁজে বের করতে অসুবিধা হবে না। তাছাড়া সে ত অ্যাপ্লিকেশন করেছিল; সেটা থেকে থাকলে ত তার ঠিকানাই পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় দারোয়ান সত্যি কথা বলছে না। একটা সময় সে গেটের কাছে ছিল না; তখনই লোকটা পালিয়েছে। মেন রোডের উপর বাড়ি, হয়ত বেরিয়েই বাস পেয়ে গেছে। অবিশ্যি সে ছাড়াও ত আরো লোক এসেছিল সকালে। সাধনবাবু আসার ঠিক আগেই আরেকজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। খুনটা তিনিও করে থাকতে পারেন।’
‘কিন্তু পার্বতীবাবুকে মৃত দেখলে সাধনবাবু আর থাকবেন কেন?’
‘আপনি ত দেখেছেন ঘরটা; ও ত কিউরিওর দোকান মশাই। একজন লোক যদি অসৎ হয়, ও ঘরে ঢুকে মালিক মৃত দেখলে ত তার পোয়া বারো!’
‘আপনি দেখলে বুঝতে পারবেন কোনো জিনিস গেছে কিনা?’
ফেলুদা প্রশ্নটা করল বর্তমান সেক্রেটারি হৃষিকেশ দত্তকে। ভদ্রলোক দশটার ঠিক আগে বেরিয়েছিলেন পোস্ট আপিসে দুটো জরুরী বিদেশী টেলিগ্রাম করতে। ফেরার পরেই আমাদের সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা হয়।
‘তা হয়ত পারতে পারি’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘বাইরের যা জিনিস তা মোটামুটি সবই আমার জানা। ভিতরে আলমারিবন্দী জিনিসেরও একটা তালিকা একবার আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন মিঃ হালদার। তার কিছু জিনিস বোধ হয় আজ পেস্টনজীকে দেখাবার জন্য বার করেছিলেন। পেস্টনজী আসেন সাড়ে নটায়।’
‘এই পেস্টনজীর সঙ্গে কি আগেই আলাপ ছিল পার্বতীবাবুর?’
‘খুব। প্রায় দশ বছরের আলাপ। মাসে অন্তত দুবার করে আসতেন। উনিও একজন কালেকটার। মিঃ হালদারের সংগ্রহে একটা চিঠি ছিল, সেটা দেখতেই ভদ্রলোক আসেন।’
‘এটা কি সেই নেপোলিয়নের চিঠি?’
‘হ্যাঁ।’
‘সেটা কি মিঃ হালদার বিক্রী করার কথা ভাবছিলেন?’
‘মোটেই না। পেস্টনজীর খুব লোভ ছিল ওটার উপর। তিনি মোটা টাকা অফার করবেন, আর মিঃ হালদার রিফিউজ করবেন—তাতে পেস্টনজীর মুখের ভাবটা কেমন হবে সেটা দেখেই মিঃ হালদারের আনন্দ। এ ব্যাপারে ওঁর একটা জিদও ছিল। এই চিঠিটা কেনার জন্য একবার এক আমেরিকান দাম চড়াতে চড়াতে বিশ হাজার ডলারে উঠেছিল। মিঃ হালদার ক্রমাগত মাথা নেড়ে গেলেন। সাহেবের মুখ লাল, শেষ পর্যন্ত মুখ খারাপ করতে আরম্ভ করল, আর সমস্ত ব্যাপারটা বসে বসে উপভোগ করলেন মিঃ হালদার। আজও পেস্টনজী গলা চড়াতে শুরু করেছিলেন সেটা আমি বাইরে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম।’
‘কিসের মধ্যে থাকত জিনিসটা?’
‘একটা অ্যালক্যাথীনের খামে।’
‘তাহলে বোধ হয় যায়নি চিঠিটা। কারণ খামটা টেবিলের উপরই রয়েছে। আর তার মধ্যে একটা সাদা ভাঁজ করা কাগজও দেখলাম।’
‘না গেলেই ভালো। ও চিঠির মর্ম সকলে বুঝবে না।’
চুরি হয়েছে কিনা সেটা এখন জানা যাবে না, কারণ পুলিশ ও ঘরে কাজ করছে; তাছাড়া পুলিশের ডাক্তার এইমাত্র এসেছেন, তিনি লাশ পরীক্ষা করছেন।
হৃষিকেশবাবু বললেন, ‘আশ্চর্য। যে সময় সাধনবাবু গেলেন, প্রায় সে সময়ই আমি ফিরেছি। অথচ লোকটার সঙ্গে দেখা হল না।’
‘আপনি বেরিয়েছেন ক’টায়?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।
‘ঠিক দশটা বাজতে পাঁচ। এখান থেকে পাঁচ মিনিট লাগে পোস্টাপিস যেতে। খোলার সঙ্গে সঙ্গে টেলিগ্রামগুলো দিতে চেয়েছিলাম।’
‘সে তো পাঁচ মিনিটের কাজ, তাহলে ফিরতে এত দেরি হল কেন?’
হৃষিকেশবাবু মাথা নাড়ালেন। —’আর বলবেন না মশাই। ঘড়ির ব্যাণ্ডের খোঁজ করছিলুম স্টেশনারি দোকানগুলোতে। দেখছেন না ডান হাতে ঘড়ি পরেছি। ব্যাণ্ডটা ঢিলে হয়ে গেছে। বাঁ কব্জি আমার ডান কব্জির চেয়ে প্রায় আধ ইঞ্চি সরু। ব্যাণ্ড ঢলঢল করে। কোনো লাভ হল না। সেই নিউ মার্কেট ছাড়া গতি নেই।’
ভদ্রলোক ডান হাতে ঘড়ি পরেন সেটা আগেই লক্ষ করেছি।
‘আপনি এ বাড়িতেই থাকেন?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল। অমিতাভবাবু ভিতরে সামলাচ্ছেন, তাছাড়া উনি নিজেও বেশ ভেঙে পড়েছেন, তাই ফেলুদা হৃষিকেশবাবুর কাছ থেকে যা তথ্য পাওয়া যায় বার করে নিচ্ছে।
‘হ্যাঁ, এ বাড়িতেই’, বললেন, হৃষিকেশবাবু, ‘একতলায়। ফ্যামিলি-ট্যামিলি নেই, তাই মিঃ হালদার বললেন এখানেই থাকতে; ঘরের ত অভাব নেই। সাধনবাবুও শুনেছি এ বাড়িতেই থাকতেন।’
‘এ কাজ ত ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন আপনি। ভালো লাগছিল না বুঝি?’
‘প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছিল মশাই। তাছাড়া উন্নতির সুযোগ আজকের দিনে কে ছাড়ে বলুন। মিঃ হালদার অবিশ্যি এমপ্লয়ার হিসেবে ভালোই ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই আমার।’
আরেকজন ভদ্রলোকের সঙ্গে এর মধ্যে আলাপ হয়েছে, যদিও কথা হয়নি। তিনি হলেন অমিতাভবাবুর ছোট ভাই অচিন্ত্যবাবু। ভদ্রলোক বাড়িতেই ছিলেন, তাই বোধ হয় পুলিশ এখন তাঁকে জেরা করছে। ফেলুদা হৃষিকেশবাবুকেই জিগ্যেস করলেন ছোট ভাইয়ের কথা।
‘অচিন্ত্যবাবু কী করেন?’
‘থিয়েটার।’
‘থিয়েটার?’
আমরা তিনজনেই অবাক।
‘পেশাদারী থিয়েটার? মানে থিয়েটার করেই ওঁর রোজগার?’
হৃষিকেশবাবুকে উত্তরটা দিতে যেন বেশ একটু ভাবতে হল। বললেন, ‘এসব ভেতরের ব্যাপার। আর সত্যি, আমার পক্ষে বলাটা বোধ হয় খুব শোভা পায় না। এ ফ্যামিলিতে থিয়েটার করাটা বেমানান তাতে সন্দেহ নেই, তবে আমার একটা সন্দেহ হয়েছে যে অচিন্ত্যবাবুর মনে একটা বড় রকমের অভিমান ছিল। চার ভাইয়ের মধ্যে উনিই একমাত্র বিলেত যাননি পড়াশুনো করতে। আসলে বড় ফ্যামিলিতে ছোট ভাই অনেক সময় একটু নেগলেকটেড হয়। ওনার ক্ষেত্রে মনে হয় সেটাই হয়েছে। আমার সঙ্গে মাঝে-মধ্যে কথাবার্তা থেকেও সেটাই মনে হয়েছে। চাকরি একটা করিয়ে দিয়েছিলেন মিঃ হালদারই, কিন্তু অচিন্ত্যবাবু সেটা ছেড়ে দেন। থিয়েটারের শখটা বোধ হয় এমনিতেই ছিল। বারাসতে একটা ড্রামাটিক ক্লাব নিয়ে খুব মেতে ওঠেন, কিন্তু তাতে মন ভরে না। এখন নবরঙ্গমঞ্চে ঘোরাঘুরি করছেন। দু-একটা হিরোর পার্টও নাকি করেছেন। কালও দেখছিলাম পার্ট মুখস্থ করছেন।’
এবারে ইনস্পেক্টর হাজরা এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। অচিন্ত্যবাবুর জেরা শেষ। তিনি গোমড়া মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হাজরা বললেন, ‘খুনটা হয়েছে দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। পেস্টনজী ছিলেন সাড়ে ন’টা থেকে দশটার কিছু পর অবধি। সাধন দস্তিদার এসেছেন সোয়া দশটায়, গেছেন সাড়ে দশটায়। ছোট ছেলের ঘর থেকে বাইরের বারান্দা দিয়ে সোজা বাপের ঘরে যাওয়া যায়। বাড়ির ভেতরের লোক দেখতে পাবে না। দশটা পাঁচ থেকে সোয়া দশটার মধ্যে অচিন্ত্যবাবু বাপের ঘরে এসে থাকতে পারেন। উনি বলছেন সারা সকাল পার্ট মুখস্থ করেছেন, কেবল সাড়ে দশটা নাগাদ একবার ভাইপো অনিরুদ্ধর ডাক পেয়ে তার কাছে যান তার খেলার মেশিনগানটা দেখতে। তখনও তিনি বাপের মৃত্যুসংবাদ পাননি। যাই হোক, মোটামুটি তিন জনেরই মোটিভ ছিল। ছেলের সঙ্গে বাপের বনত না, পেস্টনজী ছিলেন মিঃ হালদারের রাইভ্যাল, আর সাধন দস্তিদারের ছিল পুরনো আক্রোশ। এই হল ব্যাপার। এবার আপনি এসে একটু দেখে বলুন ত কিছু চুরি গেছে কিনা।’
শেষ অনুরোধটা করা হল হৃষিকেশবাবুকে। ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন স্টাডির দিকে, আমরা তাঁর পিছনে।
ঘরটায় ঢুকে হৃষিকেশবাবু একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। মেক্যানিক্যাল জিনিসে পার্বতীবাবুর খুব শখ ছিল, কারণ বৈঠকখানায় দেখেছি একটা প্রথম যুগের সিলিণ্ডার গ্রামোফোন, আর এ ঘরে দেখছি একটা আদ্যিকালের ম্যাজিক ল্যানটার্ন। তাছাড়া ছোট ছোট মূর্তি, পাত্র, দোয়াত, কলম, পিস্তল, পুরনো ছবি, ম্যাপ, বই—এসব ত আছেই। বাইরের জিনিসপত্র দেখে, চাবি দিয়ে আলমারি, বাক্স দেরাজ ইত্যাদি খুলে দেখে অবশেষে হৃষিকেশবাবু জানালেন যে কোনো জিনিস গেছে বলে ত মনে হচ্ছে না।
ফেলুদা বলল, ‘আপনি অ্যালক্যাথীনের খামটা একবার দেখলেন না?’
‘ওতে ত চিঠিটা রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।’
‘তবু একবার দেখে নেওয়া উচিত।’
হৃষিকেশবাবুকে খামটা খুলে ভেতরের কাগজটা টেনে বার করতে হল। কাগজের রংটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল; পুরনো কাগজ কি এত সাদা হয়? ভাঁজ করা কাগজটা খুলে ফেলেই ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন।
‘এ কী! এতো প্যাড থেকে ছেঁড়া হালদার মশাইয়ের নিজের চিঠির কাগজ!’
অর্থাৎ নেপোলিয়নের চিঠি উধাও।