এক – ভূগোল ও ইতিহাসের দুচার পাতা
হাওড়া—বারহারোয়া লুপলাইনে চিরোটি নামে এই ছোট্ট স্টেশনটা পড়ে। ভাগীরথীর পশ্চিম পাড় বরাবর এঁকেবেঁকে চলে গেছে এই রেলপথ, দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে। কাটোয়া জংশন পেরোলে ডানদিকের জানলায় জহ্নুকন্যার লুকোচুরি খেলা নজরে পড়ে। এই দেখা যায় তার সন্ন্যাসিনী ধূসর শরীর, এই ঢেকে ফেলে সবুজ গাছপালা কিংবা ধূসর গ্রামপুঞ্জ। কিন্তু সময় যে আর কাটে না। কী দূরদূরান্ত একেকটা স্টেশন! ভুষকালো লজঝড় এঞ্জিন ঘট—ঘটাং ঘট—ঘটাং করে হাঁফাতে হাঁফাতে এগোচ্ছে, ভোঁস ভোঁস করে প্রশ্বাস ফেলে উজ্জ্বল নীল গাঙ্গেয় আকাশটা কুচ্ছিত করে দিচ্ছে। থুত্থুড়ে সবজে কামরাগুলোর হাড় মটমট করছে। চাকায়—চাকায় ‘টিকিটবাবুর কত টাকা…টিকিটবাবুর কত টাকা’ বুলি ছড়িয়ে যাচ্ছে, তারপর অজয় নদীর পুলে এসে ‘এক ধামা চাল তিনটে পটল…এক ধামা চাল তিনটে পটল’ হাঁকতে—হাঁকতে বাজারসাহুতে পাক্কা আধঘণ্টা হুসহুস জলখাওয়ার পালা। চিরোটি পৌঁছতে আরও এক ঘণ্টার ধাক্কা।
কলকাতা যাওয়া—আসা করতে এই রেলপথ ও—তল্লাটে কেউ বাছে না সচরাচর। গঙ্গা পেরিয়ে লালগোলা—শেয়ালদা লাইনই ভালো। দুপাশে কত বাজার কত মানুষজন। হইহই করে কখন পাঁচটা ঘণ্টা কেটে যায়। কিন্তু এপারের লাইনে চেহারাচরিত্র অন্যরকম। মাইলের পর মাইল ফাঁকা ধু—ধু মাঠ। কদাচিৎ মানুষজন গাঁঘর সুন্দরী বউঝি। হ্যাঁ, সুন্দরী বউঝি। চিরোটি স্টেশনের প্রায় ছাঁচতলায় গোরাংবাবু ডাক্তারের (এইচ.এম.বি) ডিসপেনসারি। তিনিই বলেন—বাংলা সন তেরশো আঠারো সালে এই লাইন চালু করল রেলকোম্পানি, আমি তখন থেকেই আছি। হা পোড়াকপাল। আজ অব্দি গাড়ি থেকে একটাও দেখনসই রূপসি নামতে উঠতে দেখলুম না গো! দূর, দূর! ঝাঁটা মারো!… রাঙামাটির কেরু বাউরি লাইন পাতার সময় মাটি কেটেছিল—দিন দুপয়সা মজুরি। সে বরাবর বলে গেছে—গোরাং ডাক্তারের আলুপটলের দোষ আছে। বাউরির মুখ, মুখ তো নয়—ইয়ে (অশ্লীল শব্দ)।
চৌরিগাছা ছাড়ালে দুধারে বিশাল ঢেউখেলানো শক্ত মাটির মাঠ। এই উঁচু, এই নিচু বিস্তার। কোথাও হলুদ, কোথাও লালচে মাটি। আবার কোথাও মাটি ক্ষীরের বরণ হলেও রক্তের মতো লাল অজস্র ছিটে আছে। একফসলি ধানখেতগুলো ধাপবন্দি; মোটাসোটা আঁকাবাঁকা আল, যেন হাজার অজগর শুয়ে নিজ নিজ মালিকানাসত্ত্ব পাহারা দিচ্ছে—ঝিমধরা নির্জীব নিস্পন্দ। গায়ের চামড়ার খসখসে পিঙ্গলবর্ণ ঘাস। রুক্ষু বাঁজা ডাঙায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ফেট্টিবাঁধা চাঁড়ালের মতন তালগাছ। এখানে—ওড়ানে পোড়ো অনাবাদি মাঠে শেয়াকুল বঁইচি—শ্যাওড়ার ক্ষয়াখর্বুটে ঝোপঝাড়। কোথাও বাজপড়া প্রকাণ্ড শিমুলগাছ। তার ডগায় টিয়াপাখির গর্ত। টেলিগ্রাফের তারে বসে আছে আনমনা ট্যাসকোনা পাখি। মাথার ওপরটা ফিকে বেগুনি, ডানা আকাশি নীল, বুকের তলা উজ্জ্বল সাদা। ঠোঁট দুটি লাল টুকটুকে। হঠাৎ চমকে গেলে তাকে ট্যাঁ—ট্যাঁ—ট্যাঁ…. ট্যাঁ—ট্যাঁ—ট্যাঁ! একটু কর্কশ একটু খর—কিন্তু পোষ মানাতে পারলে মানুষ নাকি রাজা হয়।
হাউলির সোঁতা পার হয় রেলগাড়ি। ফের বেজে ওঠে—এক ধামা চাল তিনটে পটল! বাঁয়ে আঁরোয়ার গভীর জঙ্গল। ভিনদেশি (বিহারি) তিনভাষী অসমসাহসী গয়লাদের বাথান। অনেকটা দূরে গাছের ডালে তাদের ঝুলন্ত হাঁড়িকুড়ির সিকে দেখতে পাওয়া যায়। ওখানে লোকজন কেউ নেই। সবাই চলে গেছে দূর পশ্চিম—দক্ষিণ দিকে বাঁকী নদীর অববাহিকায়—সেখানে হিজলভাঁট আর বিষাক্ত ভেলাগাছের (প্রবাদ : কেউ ভেলাফল খেয়ে মরে, কেউ মরে তার বাতাসে) ছায়ায় দাঁড়িয়ে উলু কাশসমাকীর্ণ বিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাতে রয়েছে ছফুট লাঠি, মাথায় লাল ফেট্টি।
ডাইনে মুসলমান চাষিদের গাঁ ডাবকই। উঁচু রেললাইন থেকে স্পষ্ট দেখা যায় মেয়েরা ধবধবে সাদা উঠোনে ধান শুকোতে দিয়েছে। মাই খুলে দিয়েছে ন্যাংটো ছেলেপুলেকে। নিমগাছের ছায়ায় বসে বুনো মাথায় টুপি পরে (নির্ঘাৎ হাজি সাহেব) শণের দড়ি বানাচ্ছে। ইঁদারা থেকে জল তুলছে ঘোমটাপরা নতুন বউ। নয়ানজুলির জলে ঠেলে নামিয়ে দিচ্ছে বলদদুটো কোনো মাঠফেরত লাঙলে মুনিশ। পাকুড়তলায় খেলা করছে একপাল ন্যাংটো ও আধন্যাংটো ছেলেমেয়ে। কে একজন কুলঝোপে বসে কুকর্ম সেরে নিচ্ছে। ওরা সবাই চখে ওঠে। আপ আজিমগঞ্জ লোকাল এসে গেল! সবাই মুখ ফেরায়। কেউ কেউ গা তুলে আকাশ দেখে নেয়। কী কাজ ছিল তার সময় হয়ে গেছে। কুলঝোপের লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছিল—এবার উঁচু পাড়ওয়ালা পুকুরের দিকে জল সারতে এগিয়ে যায়। নতুন বউটি হাতে দড়ি বালতি নিয়ে কতক্ষণ ঘোমটার ফাঁকে এদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এলগাড়ি! এর নাম এলগাড়ি। কোত্থেকে আসে এলগাড়ি?…
ডিসট্যান্ট সিগন্যাল পেরোয় গাড়ি। ডাইনে অসমতল মাঠ উঠে গিয়ে মিশেছে আকাশে। টিলার মতন বাঁজা ডাঙা দেখা যায় অনেকগুলো। বাঁয়ে গাছপালার আড়ালে আঁরোয়া। রেলকোম্পানির জমির ওপারে পুরানো বটগাছ। একটা দোকান মোটে। আর গোরাংবাবুর ডাক্তারখানা চাঁদঘড়ি চাঁড়ালের কুঁড়েঘর। শুয়োরের খুপড়ি। রেলগাড়ির শব্দে চখেওঠা সোনালি ধাড়ি শুয়োরটা ঝোপের দিকে পালায়।
ডাইনে স্টেশনঘরের পিছনে স্টাফ কোয়ার্টার ছাড়িয়ে ধাপে—ধাপে পুবে নেমে গেছে মাঠ। তারপর উঠে গেছে দিগন্তে। সেখানে মাটির রঙ ঘোর লাল। তার পিছনে আচমকা তিনশো ফুট নিচে ভাগীরথীর মজা খাত। তেরোশো বছর আগে জহ্নুকন্যার এই ছিল পথ। খাড়া পাড়ের মাটি দগদগে লাল। রাঙামাটি—চাঁদপাড়া গ্রাম। যদুপুর গ্রাম। তাদের দু’দিকে সব টিলার মতো উঁচু বাঁজা ডাঙা। মাঝে মাঝে কোত্থেকে সায়েবসুবো কারা আসেন সেখানে। মাটি পরখ করেন। জায়গায় জায়গায় মজুর দিয়ে মাটি খোঁড়ানো হয়। ভাঙাপোড়া মাটির পাত্র খুঁজে ব্যাগে রাখেন। লোকেরা বলে, দাতা কর্ণের রাজধানী ছিল রাঙামাটি। সেইসব লোকেদের ঠাকুর্দারা বলে গেছে, মূল নাম কানাসোনা। কেরু বাউরি মুরুক্ষু ছোটলোক মানুষ। সে মহাভারত পড়তে পারে না, আঁরোয়ার পালিতবাবুর কাছে শুনেছে, কুন্তির জারজ ছেলে যিনি—কর্ণ তাঁর নাম, এখানেই থাকতেন। তাঁর পুত্র বৃষসেন। বৃষসেনের অন্নপ্রাশনে লঙ্কার রাজা বিভীষণকে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। সেদিন দাদা কর্ণসেন মুঠোমুঠো সোনাবৃষ্টি করেছিলেন নগরে। তাই নাম হল কর্ণসুবর্ণ। আর, মজার কথা—ওইসব ভাঙা খুঁড়ে ঘরদাওয়া নিকানোর লালমাটি আনতে গিয়ে কেউ কেউ নাকি দুচার ভরি সোনাও পেয়ে গেছে। ডাবকইয়ের ইজু সেখ পেয়েছিল। মধুপুরের মান্যবর মোড়ল একবেলা লাঙল ঠেঙিয়ে দুপুরে একদিন জিরোচ্ছে রাজবাড়িডাঙার কয়েতবেল গাছটার ছায়ায়। বদলদুটো শুকনো ঘাস চিবোচ্ছে খানিক তফাতে। এদিকে জোয়ালে মাথা রেখে নাক ডাকাচ্ছে মান্যবর। হঠাৎ স্বপ্ন হল : ওঠো, ওঠো হে মান্যবর, তোমার পিঠের নিচেই রয়েছে। মান্যবর তখন স্বপ্নে তাঁর আঁটকুড়ি বাঁজা বউ সুখেশ্বরীর সঙ্গে ঝগড়া করছিল। ঝগড়া রেখে চেঁচাল—কী, কী আছে পিঠের নিচে?… ঘুম ভেঙে লালা মোছে আর ফ্যালফ্যাল করে তাকায় মান্যবর। দূরে সড় সড় গুড় গুড় আওয়াজ তুলে লোকাল ছেড়ে যাচ্ছে স্টেশন থেকে। সে লাফ দিয়ে উঠে বসে। পাচন দিয়েই পিঠের নিচের রাঙামাটি খুঁড়তে থাকে।
পরে হাঙ্গামায় পড়ে গিয়েছিল সে। পুলিশ এসেছিল। বহরমপুরের সদর কোতোয়ালে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। গোরা হাকিম হল সায়েব ধমকায়—সট্য কটা বোলো, বখশিস পাবে। মান্যবর কেঁদেকেটে বলে—লা হুজুর মা—বাবা, লা ধর্মাবতার। আমরা বাঁজা মাগমরদ। ধনসম্পত্তি লিয়ে কী করব? এই রকম গল্প প্রচুর আছে এ তল্লাটে। একটা অদ্ভুত লোকের কথা আছে—যে মাথায় বাতি নিয়ে সারারাত ঘুরে বেড়ায়। আলো বিলিয়ে বেড়ানো ছিল তার কাজ। রাক্ষুসীডাঙায় পির তুরকানের মাজার আছে। এক রাক্ষুসী এসে আড্ডা নিয়েছিল। জ্ঞানীদের নেমন্তন্ন করে মহাভারতের বকের মতন প্রশ্ন করত—জবাব না দিতে পারলে কড়মড় করে মুণ্ডুটি চিবিয়ে খেত। সাধু তুরকানকে সে প্রশ্ন করেছিল, মলে মানুষ কোথায় যায়? সাধু তুরকান টুপি খুলে বললেন, এই যে এখানে যায়। এবং টুপির ঘায়ে রাক্ষসী চিৎপটাং হল, আর উঠল না। নিশিরাতে জনমানুষহীন ন্যাড়া টিলার কাঁটামাদার গাছের ঝোপে সাধু তুরকানের নামে কে পিদিম জ্বালিয়ে রাখে, তাকে কেউ চেনেই না। দেখতেই পায় না, কখন একম্মটি সেরে যায়। কবে দেখে ফেলেছিলেন গোরা স্টেশনমাস্টার কলটন সায়েব। সূর্য ডুবুডুবু বেলায় ডাউন পাশ করিয়ে অভ্যাসমতো হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন একা। ধরে ফেলেছিলেন তাকে। রাঙা টুকটুকে বউ—এযে নিতান্ত বালিকা! কলটন ফিরে এলেন স্টেশনে। কিন্তু বোবা হয়ে। পরে ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেল তাঁর স্বরযন্ত্রটি একেবার টেঁসে গেছে।
এই সেদিন এলেন একদল পুরাতাত্ত্বিক। তাঁদের মধ্যে একজন অধ্যাপক ছিলেন বেজায় খামখেয়ালি। তাঁর বক্তব্য : তেরোশো বছর আগে রাজা শশাঙ্কর রাজধানী ছিল এখানে—এই সেই কর্ণসুবর্ণ। হিউয়েন সাঙ এসেছিলেন এখানে। লিখে গেছেন ‘লো—টো—বি—চী’ বা ‘লো—টো—মো—চিহ’র কথা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে। ‘রক্তমৃত্তিকা’ মহাবিহারের ধ্বংসস্তূপ আছে এখানেই। ত্রিশটি সংঘারাম ছিল। দুহাজার বৌদ্ধ শ্রমণ বাস করতেন। সকালসন্ধে সে কী গম্ভীর গমগমানি!
মাটি খোঁড়ার আর পরীক্ষানিরীক্ষার কাজ চলল অবিশ্রান্তভাবে। এক মধ্যরাত্রে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। খামাখেয়ালি তরুণ অধ্যাপক বেরিয়ে পড়েছেন তাঁবু ছেড়ে। ঊষর টিলায় নির্জনতা থমথম করছে। ঝাপসা জ্যোৎস্নায় ভদ্রলোক দেখলেন, এক বিশালদেহী মানুষ একটা গর্তে ঝুঁকে রয়েছে—তার পরনে মাত্র একটুকরো কপনি। চেঁচালেন—কে, কে! মানুষটা হাঁটতে লাগল। দৌড়ে গিয়েও তাকে ধরা গেল না। ভাগীরথীর মজাখাত তিনশো ফুট নিচে—পাড়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে হুঁশ হল অধ্যাপকের। আর একটু হলেই পড়ে হাড়গোড় গুঁড়ো হয়ে যেত।
এই ব্যাপারটা নিয়ে দলে ভীষণ হাসাহাসি হয়। আসলে লোকটা ছিল চোর। আজকাল বিদেশে পুরানো আমলের জিনিস ভারী দামে বিকোয়। একসক্যাভেশানের ফলে পাওয়া দুর্মূল্য মূর্তি শিলমোহর ইত্যাদি চুরি করতে এসেছিল কেউ। পরদিন ডাইনামো চালিয়ে জায়গাটা আলোকিত রাখা হয়। কাঁটাতারের বেড়াও দেওয়া হয়েছিল। তবু তরুণ অধ্যাপকের মন মানে না। তাঁর মতে জায়গাটা রহস্যময়। তেরোশো বছর আগে ওখানে ছিল বহতা ভাগীরথী। ওই ঘাট থেকেই মহানাবিক শ্রীবুদ্ধ গুপ্ত নৌকো ছেড়ে তাম্রলিপ্ত যেতেন। বাণভট্ট লিখেছেন—মহাসামন্ত শশাঙ্ক কান্যকুব্জরাজ হর্ষবর্ধনের বোন রাজ্যশ্রীকে হরণ করেন। কূটবুদ্ধি শশাঙ্ক আমন্ত্রণ করলেন রাজার ভাই রাজ্যবর্ধনকে। রাজ্যবর্ধন নিজের তাঁবুতে খুন হয়ে গেলেন। তাঁবুটা কোথায় ছিল অধ্যাপকটি স্পষ্ট দেখতে পান। ওই আপ ডিসট্যান্ট সিগনালের কাছে, ধুলোওড়া মেঠো পথের পাশে হাজামজা বিশাল পুকুর, তমাল গাছের জঙ্গল, ওখানটায়। ঘোড়াগুলো জ্যোৎস্নার রাতে এখনও মনে হয় চরে বেড়াচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে সেনানীরা হাত—পা ছড়িয়ে গল্পগুজব করছে। দূরে বৌদ্ধ শ্রমণদের সমবেত কণ্ঠে গম্ভীর স্তোত্রধ্বনি বাজছে : বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি! চোখ বুজলেই শোনা যায়। …..
অবশ্য এই পুরাতাত্ত্বিক অভিযানের ব্যাপার অনেক পরের কথা। সেবার একদা আপ আজিমগঞ্জ—হাওড়া লোকাল চিরোটি স্টেশনে ঢুকতে ঢুকতে গোকর্ণের দাসজীমশাই যখন প্রকাণ্ড কাপড়ের গাঁটটা ধূম করে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, হেরু, হারাধন রে—তখন গোরাংবাবু বেঁচে। ঘোড়ায় চেপে রুগি দেখতে যান আশেপাশের গাঁয়ে। দুচারজনের বেশি যাত্রী নামে না যেমন, তেমনি রুগিপত্তরও মাত্র দুচারজন সবে হাতে এসে লাগছে। কেরুর ছেলে হেরু বাউরি মোট বয় স্টেশনে। প্রকাণ্ড মানুষ—সাড়ে ছফুট লম্বা। স্টেশনের বটতলায় একটা মোটে দোকান—মুড়ি মুড়কি আর নুনতেল পাওয়া যায় সেখানে। পিছনে পুকুর আর জঙ্গল। ক’ঘর মাত্র বসতি। আঁরোয়া গ্রাম। কেমন যেন প্রাক—আর্য পুরনো পুঁথির ঘ্রাণ এই নামটায়।
কিন্তু স্টেশনের নাম চিরোটি। তিন—চার মাইল দূরে বহতা নদী ভাগীরথীর পাড়ে চিরোটিকোদলা গ্রাম। রেলকোম্পানির মাথা খারাপ। আঁরোয়ার স্টেশন—নাম দিলে চিরোটি। গোরাংবাবুর তদ্বির আমলই দেননি রেলবাবুরা। বেশিরভাগই তখন গোরা ইংরেজ, গটমটকট করে কেউ কেউ বাংলা বলতে শিখেছে। গোরাংবাবুকে বলল, দ্যাটস ফাইনাল ব্যাবু! আসলে ব্যাটাদের মুখে ‘আঁরোমা’ নামের চেয়ে ‘চিরোটি’ উচ্চারণ করা সহজ ছিল কি না!
যাত্রী কদাচিৎ নামে এ স্টেশনে। অত বাবু ভদ্রলোক আশেপাশের গাঁয়ে কোথায় যে পয়সা দিয়ে রেলগাড়ি চাপবে? একটা স্টেশন যেতে আনা—দু’আনা ভাড়া। এদিকে তখন বাজারদরের সামান্য নমুনা :
চাল টাকায় কুড়ি সের
মজুর প্রতি রোজ শুখা দু পয়সা
তাঁতের গামছা দুই থেকে তিন পয়সা
ডিম আনায় আটটা বা এক আধলা
বেগুন সিকি পয়সায় এক ধাড়া বা পাঁচ সের (গঙ্গার ধারে প্রচুর ফলে) ইত্যাদি ইত্যাদি।… …
আগের বছর খরা ছিল প্রচণ্ড। সেই খরায় এ তল্লাটে জলাভাবে অনেক মানুষ ও জীবজন্তু মারা পড়েছিল। স্টেশনের ইঁদারাটি অতি প্রসিদ্ধ। এখান থেকে উপকারী জল রেলকর্তাদের জন্যে রেলগাড়ি করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জংশনে—জংশনে। মুরশিদাবাদের নবাব বাহাদুরও এখানের জল আনতে লোক পাঠান। বাইশ সনের খরায় রেলপুলিশ রীতিমতো বন্দুক হাতে ইঁদারা পাহারা দিত। স্টেশন মাস্টার কলটন সায়েব থাকলে সবাই জল পেয়ে প্রাণে বাঁচত। নতুন মাস্টার অগস্তিবাবু পচ্ছিমে লোক। আত্মাটা পাথর দিয়ে গড়া। পুলিশ বসিয়ে দিলেন একেবারে। হেরু বাউরি স্টেশনে খুব চেনা মানুষ। অগস্তিবাবুর বেতো বাবাকে কাঁধে বয়েছিল, তবু সে জল পায়নি। হেরু রাগে দুঃখে বুক ফেটে মরার দাখিল হয়েছিল।
তবু সে ডাকাত হয়নি তখনও। ডাকাত হল পরের বছর। সে কী বর্ষা, সে কী বিষ্টি! জষ্টির মাঝামাঝি থেকে পুরো আষাঢ় পচিয়ে দিল এলাকাটা। আর তার কিছু আগে কখন আচমকা হেরু বাউরি ডাকাত হয়ে গেল। তার মাথার মূল্য সরকারবাহাদুর ঘোষণা করলেন—একশত টাকা।
এবং সে আমলে টাকায় চাল পাক্কিসেরের ওজনে (৮২ তোলা) বিশ সের। হেরু মোটঘাট পেলে একটা সিকিপয়সা রোজগার করত। তাই দিয়ে কুড়ানি ঠাকরানের কাছে দুকাঠা মুড়ি কিনত। এক চিলতে সর্ষেতেলও পেত। উঠোনের গাছ থেকে দুটো ধানি লংকা নিলেও ঠাকরান রাগ করত না। রাঙামাটি যেতে যেতে মুড়িগুলো পুরো খেয়ে শেষ করে দিত হেরু। বউ রাঙির জন্যে কী নিয়ে যাবে ভেবে হঠাৎ থমকে দাঁড়াত।
তারপর একদৌড়ে চলে যেত তিনশো ফুট নিচে মজাগঙ্গার ঝিলে। ডুব দিয়ে দিয়ে লেকাফল তুলত এককোঁচড়। যাউরান লেকাফল পেলে আর কিছু চায় না। গায়ে—ভারী (গর্ভবতী) যোবতী সে—তার পেটে হেরুর বংশধর। ছেলে হলে হেরু তাকে রেললাইনের গাংম্যান করবে। মেয়ে হলে গোকর্ণে বিয়ে দেবে। বাজার জায়গা। সপ্তাহে দুদিন হাট বসে। পেটে যাই খাক, ভালোটা মন্দটা দেখেও তো সুখ আছে।