১. আশ্বিনের এক বিকেল

প্রথম পরিচ্ছেদ – আশ্বিনের এক বিকেল

হেই…..হৈ….হো…..ও……ও……।

আশ্বিনের রাত্রির আকাশে তখন নক্ষত্রেরা উজ্জ্বল। তখন চণ্ডালিকার অন্ধকার মাঠে ঘাসের পাতায় ধানের শীষে শিশিরের চুপিচুপি স্পর্শ। নির্জন নিঝুম শান্ত সেই মাঠের জগতে কুয়াশার গভীরে মৃত্যুর নৈঃশব্দ্য চিরে ঠিক তখনই কে প্রচণ্ড চিৎকার করে ওঠে:

হেই….হৈ….হো….ও….ও!

গ্রামের নাম চণ্ডালিকা। চণ্ডালিকার পশ্চিমমাঠ থেকে এই তীব্র তীক্ষ্ন ধ্বনিপুঞ্জ ছড়িয়ে যায় উত্তর মাঠে। তারপর পূর্বে। ফের দক্ষিণে।

সব নৈঃশব্দ্য আর মৃত্যুর শান্তি ভেঙে এইসব কণ্ঠস্বর। কারা জেগে আছে। নির্জন রাতের মাঠে—মাঠে ছড়িয়ে পড়া এই কণ্ঠস্বর যাদের, তারা ‘জাগাল’। এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে আরও অনেক কণ্ঠস্বরে তাদের জেগে থাকার চিহ্ন। গ্রামের গৃহস্থ আশ্বস্ত হয়ে পাশ ফেরে শয্যায়। ওরা জেগে আছে। ওরা ‘জাগাল’।

বছরের পর বছর ফসলের পাহারায় এই কণ্ঠ নিয়ে জেগে থাকে, তারা ‘জাগাল’। সারারাত ডাক দেয়। তীব্র তীক্ষ্ন সেই ডাকগুলো পরস্পরকেই যেন সচকিত করে। বলে—আমরা জেগে আছি। ফসলের রাজদেউড়ীতে জেগে থাকা কোতোয়াল। মাঠ—কোটাল।

দূর চণ্ডালিকার রেলস্টেশনের সিগনালপোস্টে লাল আলো সবুজ হয়ে যায়। রাত তিনটের ডাউনট্রেন আলো ফেলে। সুঁদিপুরের গয়লারা ডহরের পথে একপাল মোষ ডাকিয়ে নিয়ে যায় চণ্ডালী ঝিলের দিকে এবং কুঁড়ে থেকে জাগালেরা হেঁকে ওঠে : হেই…হৈ…হো..।

দলে আছে উল্লাস ঘোষ। অতিকায় দানব একটা। লম্বা লাঠিটা তুলে মোষের পিঠে বাড়ি মারে। —ধোঃ, ধোঃ! তারপর কোমর থেকে ছোট্ট বাঁশের বাঁশি বের করে বাজাতে থাকে। শেষ রাতের অন্ধকারে আকাশের নক্ষত্রে দিগন্তের নীলাভ কুয়াশায় যেন পুঞ্জ পুঞ্জ সুরের রেণু জমে ওঠে। এখানে গভীর বিহ্বলতায় চোখের পাতা বুজে আসে নতুন জাগাল ছকুলাল গায়েনের। অন্য এক সুর তরঙ্গ তোলে মনে। গান গাইতে ইচ্ছে করে। ক্ষুব্ধভাবে নিজেকে এই বিহ্বলতা থেকে মুক্ত করতে চায় সে। তখন চিৎকার করে জাগালী হাঁক দেয়। মনে মনে বলে: আমি জাগাল, আমি জাগাল? আমি আর গায়েন লই।

ছকুলাল কর্কশ কণ্ঠে জাগালী হাঁকে। নিজেকেই যেন দমিয়ে রাখে; ওখানে পথ চলতে চলতে উল্লাস বলে—মাগীর হাঁক। শুনতে মিষ্টি। ও কে?

—লোকটা ছকু গায়েন হে, উল্লাস।

—ব্যাটা হাভেতে বোষ্টমটা আবার জাগাল হল কোন দুঃখে? বাঁশি থামিয়ে হা হা করে হাসে উল্লাস। মোষ ডাকায়। —ধোঃ, ধোঃ!

ধীরে অতি ধীরে এই হিমময় অন্ধকার আলোয় মুখোমুখি পৌঁছে যায়। আকাশের নক্ষত্র মুছে উজ্জ্বল আলোয় প্রবাহ পূর্বদিগন্তে জেগে ওঠে। বর্ণচ্ছটায় কেন্দ্র থেকে এক সময় পদ্মফুল সূর্য উন্মোচিত হয়েছে। চণ্ডালিকার পূর্ব মাঠ থেকে ভেসে আসছে সায়েব চাষা শরদিন্দুর ট্রাক্টরের শব্দ। ট্র…..রা….রা….রা! খালপোলের রেলিঙে বসে থাকা দাঁড়কাকটা ভয় পায় না। কেবল সোনাডাঙ্গার আকাশ থেকে একঝাঁক আগন্তুক কাক চমকে গেছে। গতিপথ বদলে উড়ে যাচ্ছে উত্তরে সুঁদিপুরের দিকে।

এখানে পশ্চিম মাঠে ছকুলাল গায়েন পীরপুকুরের পাড়ে ঘনছায়ায় দাঁড়িয়ে জল দেখছে। ধানের মাঠ দেখছে। অন্তহীন সবুজের প্রসারে বাতাসের তরঙ্গ দেখে সে সুখী হতে পারছে। তার মনে হচ্ছে, নতুন বউ ওলাঙ্গিনী হয়তো ভুল বলে না। এই ব্যাপক স্পষ্টতাতেই মানুষ সুখী হতে পারে। মাঠ—রোদ—দৃশ্যের জগৎ এখন ওলাঙ্গিনীর মুখের মতো সহজ মনে হয়। এবং এই আবিষ্কারে আপনমনে বলতে বলতে হাসে সে: আমি আর বাউলের ভেক লিবো না রে ওলাঙ্গিনী। আমি চাষাকুনাই বংশের ছেলে। আমি মাটির আশেপাশেই থাকব।

ঠান্ডা জলে মুখে ধুয়ে ছকুলাল এগিয়ে চলে কুঁড়ের দিকে। কুঁড়ের অপরিসর গর্ভে খড়ের ওপর তখনও বুড়ো জাগাল যোগীবর ভালুকের মতো মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে। কেবল বায়তুল্লা সেখ তার লম্বা লাঠিটা কাঁধে নিয়ে ডহরের পাশে চলে গেছে। গয়লাদের কুকীর্তির চিহ্ন খুঁজতে সে ঝিলের প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। ফিরে এসে গালাগালি করবে। পরের রাতটি সম্পূর্ণ জেগে কাটানোর প্রতিজ্ঞা করবে। তারপর ধুপ করে বসে যোগীবরকে বলবে—একটুকুন খৈনী খাওয়াও দিনি বঁধু। মুখটা পচে যেয়েছে গাল দিতে দিতে।

হাসতে হাসতে হঠাৎ থেমেছে ছকুলাল। আজ যেন মাঠের ওপর রোদ আরও উজ্জ্বল। লক্ষকোটি ধানের শিষ বাতাসের দোলায় মেতে উঠেছে। আলো ঝলমল সবুজে বিন্দু বিন্দু শিশির। তাতে রোদের রেণু নামে লক্ষকোটি প্রজাপতি ছড়িয়ে আছে মনে হয়। বিহ্বল অস্ফুট কণ্ঠে সে বলে উঠেছে : ধন্য, ধন্য মা বসুমতী! তারপর প্রণাম করেছে দুহাত তুলে।

ওখানে বায়তুল্লা অভ্যাসমতো হাসছে এই দৃশ্য দেখে। ছকুলাল কাছাকাছি গিয়ে বলে ওঠে—আহা বেহ্মাণ্ড কী পেকাণ্ড হে বায়তুল্লো!

—জাগালী জীবন সত্যি বড় দুঃখের। ওলাঙ্গিনীই বলেছিল একথা। আমি জানি। আমি মাঠে মাঠে অনেক ঘুরেছি তো। বলতে বলতে ফোঁস করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল সে।—তবু ইটা ভালো। তুমার ভিক্ষের চেয়ে ভালো ইটটা।

মনে মনে আহত হলেও ছকুলাল চুপ করে ছিল। এই চারনম্বর বউটি একেবারে অন্যরকম। চলতে ফিরতে এ শুধু সংসারের ছবি আঁকে। সহজ স্পষ্ট একটি সংসার। তার জন্যে চোখে যেন ঘুম থাকে না। অনেকটা রাত্তির অবধি বিড়বিড় করে। ছকুলাল কিছু শোনে, কিছু শোনে না। সে তার অন্য বউগুলোর কথা ভাবে। তুফানী, আদরবালা ও সুবাসীর কথা। কত সহজে সব এল। চলে গেল। কেবল তুফানী তার ভালোবাসার একটি স্বাক্ষর রেখে গেল ছকুলালের জীবনে। একটি সন্তানের মধ্যে তুফানী নিজেকে রেখে গেল পৃথিবীতে। আদর করে তার নাম রেখেছিল : রতন। সে এখন কলকাতায়। বোন কাজলের কাছে লেখাপড়া শিখে মানুষ হচ্ছে। বোনের নিজের কোনো ছেলেপুলে নেই। তায় ছকুলাল ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে প্রকৃতির মানুষ। কাছে থাকলে ছেলেকেও ভিক্ষের পেশা ধরাত।

আদরবালাকে ঘরে আনার পর কাজল খুবই ভর্ৎসনা করেছিল। আদর মরে গেলে আবার এল সুবাস। সুবাসলতা। জংলী মেয়ে একেবারে। ঝিলের জলে সাপে কামড়াল তাকে। একবছর পরে ছকুলাল হঠাৎ এই ওলাঙ্গিনীকে সংগ্রহ করেছে। এবার যেন আশ্বস্ত হতে পারা যায়। সংসারের সঙ্গে এ মেয়ের নাড়ির যোগ এত গভীর ও দৃঢ় মৃত্যুর কারচুপি হয়তো এবার ব্যর্থ হবে। ওদিকে কলকাতায় কাজল কীভাবে কথাটা জানতে পেরে কড়া করে চিঠি লিখেছিল। লজ্জায় আগের মতো মধ্যে—মাঝে ছেলেকে দেখে আসবার লোভ সম্বরণ করেছে ছকুবালা। এখন ভাবে, নতুনবউ সংসারটা গুছিয়ে তুললেই কাজলকে ডাকবে। সে লিখবে : ভগ্নী, এবার আমি ঘোর সংসারী মানুষ। আর ভয় করোনা। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসো। বাপের ছোঁওয়া লেগে তার আর দোষ ঘটবার ভয় নাই।

প্রতি বছর মাঠগুলোর বন্দোবস্ত হয়। তিন—চারজন মিলে একেকটি মাঠ নেয়। কিছু টাকা দিতে হয় মণ্ডলদের হাতে। ছকুলাল জাগালী জীবনের দুঃখকষ্টের কথা কিছু কিছু জানত। সে ভেবেছিল টাকার অছিলায় পাশ কাটিয়ে যাবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল, ওলাঙ্গিনী টাকা সংগ্রহ করেছে কীভাবে।

তারপর শুরু হল জাগালী।

এ যেন এক প্রবাসী জীবন। সারাটি দিন ও রাত আকাশের নীচে ফসলের মাঠে ক্লান্তিহীন চলাফেরা। ঘরে যাওয়ার এতটুকু অবসর নেই। শেষ গ্রীষ্মের প্রখর রোদ শরীরকে ঝলসে দিয়েছে। বর্ষার মত্ত বর্ষণধারা সব লালিত্য ধুয়েছে। এখন শরতের মুক্ত আকাশে ক্লান্তি ও ক্ষয়ের পালা শেষ হয়ে আসার সংকেত। এখন কিছু আশা মনে। এই মাঠ হয়ে উঠবে সোনালি। পুঞ্জ পুঞ্জ সোনার সমারোহ জমে উঠবে এই প্রবাসী জগতে। তখন ঘরে ফেরার পালা। যোগীবর বলে,—শোননি সেই গল্পকথা, রাজা গেলেন বিদেশে, সওদাগর বাণিজ্যেতে….তা’পরে ফিরে এলেন সঙ্গে নানান সওদা লয়ে।…

এও ঠিক তাই। প্রবাস অনেক কষ্ট। অনেক ক্লেশ সইতে হয় মুখ বুজে। কিন্তু বায়তুল্লা একটু ভিন্নরূপ ভাবে। সে বলে—আমরা হলাম মাঠের বাদশা। এবং এই ভাবটি সবসময় সে সঙ্গে নিয়ে ফেরে। মাথায় পরিপাটি পাগড়ি বাঁধে ছেঁড়া কাপড় জড়িয়ে। হাতে নেয় মস্ত একটা লাঠি। তারপর দাড়িতে হাত বুলিয়ে অত্যন্ত অকারণ বিকট হাঁক মেরে বসে।

যোগীবর বুঝতে পারে এর গূঢ় কারণটা। সে বলে জাগালীর একটা নেশা আছে, বঁধু। ফাঁকা মাঠে ঘুরে ফিরে এই নেশাটা জেঁকে ওঠে। রক্তের মধ্যতে মিশে যায়। আমারও যেয়েছে, তুমারও। তাই না? বায়তুল্লা হাসলে ওপরের গোঁফবিহীন ঠোঁট সার কালো মাড়ি চকচক করে। সে হঠাৎ হাসে, হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়। কিন্তু হাসলে তাকে মনে হয়, নগ্ন শরীরের ওপর চামড়ার শিথিলতা ও হাড়ের রেখাগুলো দেখে মায়া হয়। আফশোশ করে বলে,—বাপজান বেঁচে থাকলে আমি রোজ তিন সের দুধ খেতে পেতাম।

দুধের কথায় ছকুলাল মুখ খোলে।—আম্মো খেতাম স্যাকভাই, বুঝলে। বেঁচে থাকলে…

বায়তুল্লা ভুরু কুঁচকে তাকায় চোখে—চোখে। ওর এই ভঙ্গিটা বড় কটু। কিছু বিদ্রুপ কিছু অবিশ্বাস দিয়ে এটা তৈরি। ছকুলাল ক্রুদ্ধভাবে থেমে গেলে যোগীবর একটু কাশে। গলা ঝেড়ে নেয়। বলে—বাছা আমার রাখোরাজার কথা বলছে হে। চল্লিশটে গাইগোরু ছিল তিনির। এই ছকুর বাবা নাথুলাল সেগুলা দুইত। বড় বড় দুধের জাবনা ছিল উঠোনে পাতা।

ছকুলালের নীচের ঠোঁট তখন ঝুলে পড়েছে। বড় বড় কাঁধছোঁওয়া লালচে চুলগুলো আবার খসে গেছে ঝুঁটি থেকে। ফাঁক পেলেই সে, ইতিহেস, সে—একটা ‘ইতিহেস’ এই কথাগুলো যোগীবরের গল্পে যোগ করে দিতে ব্যস্ত। তার হৃদস্পন্দন তখন দ্রুততর। তার শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে।

রাখো রাজা! অর্থাৎ রাখোহরি রাজা। অর্থাৎ রাজা দুর্গাপ্রসাদ। সে—যুগের ডাকসাইটে জমিদার এই চণ্ডালিকা পরগনার। সরকার খুশি হয়ে তাঁকে রাজা খেতাব দিয়েছিলেন। ঘোড়ায় চেপে দিনমান ঘুরে বেড়াতেন মহাল থেকে মহালে। অমন সোনার রং রোদে বাতাসে পুড়ে তামাটে হয়ে গিয়েছিল। নগ্ন শীর্ণ শরীরের ঊর্ধ্বভাগে জড়ানো একখানি সাদা ওড়না। ধুতির কোঁচা নাভির কাছে গোঁজা। পায়ে হরিণের চামড়ার চটি। হাতে চাবুক। খাড়া নাকের নীচে সূক্ষ্ম গোঁফের রেখা তাঁকে যেন দেবতাসুলভ আকৃতির মহিমা দিত। রাঙা চোখে ক্রোধের চেয়ে বরাভয় ছিল বেশি। তাই প্রজারা আদর করে নাম দিয়েছিল রাখোরাজা। হরি শব্দটা পরে কে যোগ করে দেয়।

মায় একটা শোলার টুপিও পরতেন দুর্গাপ্রসাদ।

এবং এই বিচিত্রবেশে যখন মাঠ অতিক্রম করতেন, রাখালেরা চিৎকার করে উঠত, রাখে হরি মারে কে!

বুড়ো জমিদার চাবুক কষে ঘোড়াকে তাদের পেছনে ধাবিত করতেন। রাখালেরা ছুটে পালাত চণ্ডালী ঝিলের দিকে। দারুণ আতঙ্কে ঝিলের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ত।

ঘোড়া থেকে নামতেন দুর্গাপ্রসাদ। জিনে আটকানো ব্যাগ থেকে মুঠো মুঠো সন্দেশ বের করে ছুঁড়ে দিতেন তাদের মুখ লক্ষ্য করে। সকৌতুক হাসতেন। বলতেন—মারে হরি, রাখে কে।

ওরা বিড়বিড় করে বলত—রাখে হরি, মারে কে।

জিনের সংলগ্ন ব্যাগটা একটা আস্ত হাসপাতাল ছিল। অ্যালোপাথি, হোমিয়োপ্যাথি আর কবরেজি ওষুধে ভরতি সেটা।

আরও অনেক নেশা ছিল দুর্গাপ্রসাদের। কিছু ভালো, কিছু মন্দ। আজ সবই মনে হয় প্রাচীন লোককথার মতো। সব ভালো—মন্দের অতীতে বেঁচে আছে মানুষের স্মৃতিতে।

বায়ুতুল্লা শুনতে শুনতে মন্তব্য করে—পরগনায় কেচ্ছা কি কম? বঁধু বলো না সেই মন্দিরের গপ্পটা।

—দেবী চণ্ডালিকা? যোগীবর তৎক্ষণাৎ চোখ বুজে একটি প্রণাম করে। চণ্ডালিকা গ্রামের এক প্রান্তে মন্দির এখনও রয়েছে। একটি প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ। তাকে ঘিরে সহস্রবাহু জন্তুর মতো তেমনি প্রাচীন ছায়াঘন বটগাছ। কোন যুগের রাজধানী ছিল এই গ্রাম। লোকে বলে—বামুনরাজার চণ্ডাল রানি। পাপ ঢুকল রাজ্যে। সেই বেদিমূলে একদিন নিজের রক্ত দান করে চণ্ডালী রানি মুক্তির জগতে চলে গেল। পড়ে রইল স্মৃতি। সে—স্মৃতিকে আর কেউ কলঙ্ক বলে অপমানিত করে না।

যোগীবর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—আহা, মেয়েটি বড় কাঁদত গো! বড় যন্তনা ছিল জেবনে তার…।

ছকুলালের হঠাৎ তখন মায়ের কথা মনে পড়ে গেছে। তার মা আমোদিনীও এমনি করে কাঁদত। দাওয়ার মাথা ভাঙত। ছটফট করত দারুণ কী যন্ত্রণায়। কাকে কুৎসিত ধিক্কার দিত। চুল ছিঁড়ে পাগলিনীর মতো চিৎকার করত। তারপর একদিন ঘরে ফিরে ছকুলাল দেখেছিল, মা রক্তাপ্লুতা পড়ে রয়েছে। দেহে কোনো স্পন্দন নেই। বাটনাবাটা শিলনোড়ায় নিজের মাথাটা চূর্ণ করে দিয়েছিল আমোদিনী।

কিন্তু কেন?

ছকুলাল প্রশ্ন করেছে নিরন্তর। খুঁজে পায়নি। বোন কাজল এসেছিল খবর শুনে। তাকেও প্রশ্ন করেছিল সে। কাজল কোনো জবাব দেয়নি। কাজলের দাঁতে একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাচ্ছিল শুধু। রক্ত—লাল—চোখে কাজল একবার বলেছিল শুধু—এর জবাব দেব, যদি দিন পাই।

কথাটা আর তোলেনি ছকুলাল। অন্য সবকিছুর মতো এটাও একসময় তার কাছে সহজ হয়ে উঠেছিল। সবকিছুতে সে চিরদিন নির্লিপ্ত ও নিস্পৃহ থেকেছে। ছকুলাল বুঝতে পারে, নিজের কাছে এমনি করে হেরে থাকাটাই সে গৌরব বলে মনে করেছে এতদিন। কিন্তু উপায় কী! নিজের ওপর নিজের দখল না—থাকার জন্যে সে কতটুকু দায়ী। মায়ের মৃত্যু তাই তাকে একটি ফোঁটাও চোখের জল দান করেনি। কিংবা তুফানীর মৃত্যু। কিংবা আদরের। কিংবা সুবাসলতার। নিজের এই কঠোরতার উৎস ছকুলাল খুঁজে পায় না। কখনও নির্জনে বুকে হাত রেখে সে জানতে চেয়েছে, এর গভীরে সবই কি পাষাণ, সবটুকুই কি প্রাণহীনতার প্রতীক? কাঁদবার ইচ্ছেয় সে ফোঁস ফোঁস করেছে। তারপর হেসে উঠেছে। কী বোকা, কী বোকা! ছকুলাল গভীর দুঃখে বলেছে—একটা পাষাণের পিণ্ডি উপড়ে দিয়ে গেল জননীটা। ওদের একটা পাথরের ঢেলা জন্মো দিয়েছিল হতভাগিনী!

আমোদিনীও রাজপরিবারে বংশানুক্রমে লালিতা হয়েছিল। ঝিয়ের কাজ করত সে। যুবক নাথুলাল, যুবতী আমোদিনী। দুর্গাপ্রসাদ রীতিমতো স্বয়ম্বরসভা করে বিয়ে দিলেন। অবিকল পুরাণ—কথার এই স্বয়ম্বরসভা। দুপুর রাত্রে একটা সভায় আয়োজন করা হয়েছিল। পাত্রমিত্র পারিষদের অভাব ছিল না। ঘুমকাতুরে নাথুলাল হঠাৎ চমকে উঠেছিল। ফুলের সাজ গায়ে নিয়ে আমোদিনী তার গলায় মালা পরিয়ে দিলে এসে! নাথুলাল দেখেছিল, স্বয়ম্বরার চোখে জলের ফোঁটা। সে ভেবেছিল বড় সুখে কাঁদছে আমোদ। আঃ বাবা সকল, ইটা কি অপমান? না গো, ইটা সনমানের বেপার। রাখোরাজার পেরাণের শখ, পেরাণের দাসদাসী ছিলাম কিনা! তবু আমোদ কেঁদেছিল। হুঁ হুঁ—সে কি না এক গুহ্যতত্ত্ব!…তারপর আলাদা সংসার পেতে দিলেন রাজাবাবু। কিছু জমি দান করলেন। বেশ চলে যাচ্ছিল সেই সুখের সংসার। তারপর বুড়ো রাজার মৃত্যু হল। ছেলে শংকরীপ্রসাদ বাবার আকৃতি পেলেও প্রকৃতি পায়নি। অত্যন্ত অকারণে জুলুম শুরু হয়েছিল নাথুলালের ওপর। একদিন রাজবাড়িতে খাওয়ার ডাক এল হঠাৎ। নাথুলাল খুশিতে আপ্লুত। আমোদিনী পায়ে মাথা কুটেছিল। সে শুনল না। এবং ফিরে এসে কলেরায় মারা গেল। আমোদিনী বলেছিল—বিষ, বিষ খাইয়ে মারলে জোয়ান মরদটাকে…

শংকরীপ্রসাদের সঙ্গে লড়াই করার হিম্মত আর যারই থাক, চণ্ডালিকার কুনাইকুলের ছিল না। তাতে নাথুলালের ছেলে তো বাউণ্ডুলে। বোন আধপাগলা মেয়ে।

এসব ঘটনাও সময়ের ফেরে সকল ভালোমন্দর অতীতে চলে গেছে। কেউ আর মাথা ঘামায় না। ছকুলালও না।

তবু যোগীবর বললে কান পেতে সে শোনে। শোনে আর সেই প্রাচীন প্রশ্নটা মনে ভেসে ওঠে দু’একবার। এবং এরই তাগিদে সেও ফাঁকে ফাঁকে কিছু নিজস্ব মন্তব্য যোগ করে দিতে চায়। কখনও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ঠোঁট ঝুলে পড়ে। ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। ওই কাহিনীর কোথাও একটু সূত্র রয়েছে, সেখানে সব প্রশ্নের জবাব সহজ হয়ে ওঠে।

এ মুহূর্তে তার কাজলের জন্যে মন কেমন করে উঠেছে। অনেকদিন দেখা হয়নি বোনের সঙ্গে। ছেলেকেও দেখেনি। কেমন অদ্ভুত মেয়ে—বাবার কাছে ছেলেকে নিয়ে আসবে না। একা আসবে, একা ফিরে যাবে। দেখতে হলে ছকুলালকে যেতে হয় সুযোগমতো।

কিন্তু পর পর তিনবার হয়ে গেল। কাজল বলেছিল, কী দরকার তোমায় বউ এনে? পুষতে তো পারবে না। মিছেমিছি পবের মেয়ে ঘরে এনে লাঞ্ছনা দাও। বরং একা থাকো, সেই ভালো। একটা ছেলে যখন রয়েছে, তার মুখের দিকে চেয়ে এমনি থাকা কি ভালো না?

প্রতিবারই বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করেছে ছকুলাল। কিন্তু রাখতে পারেনি। তাই গত গ্রীষ্মে ওলাঙ্গিনীকে ঘরে আনার পর থেকে কাজলকে একটি চিঠি লিখতেও তার ভয় হয়েছে। লজ্জা পেয়েছে সে। সংসার ভালো লাগে না। অথচ সংসারী হবার একটা জটিল ইচ্ছা তাকে এইসব করায় যেন। বিনোদীয়ায় অম্বিকার সঙ্গে এক গানের আসরে বন্ধুতা। তার বোন ওলাঙ্গিনী আগের স্বামীর ঘর থেকে একবস্ত্রে পালিয়ে এসেছিল। লোকটা নাকি ভীষণ জহ্লাদ। অম্বিকার কাছে সব শুনে স্যাঙার প্রস্তাব করে বসে ছকুলাল। হয়তো সদ্যভাবের নেশায় অম্বিকা বিভোর ছিল। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়!

খবরটা কাজল পেয়েছিল দেবীন চৌকিদারের মেয়ে সৈরভীর কাছে। সৈরভী কাজলের মতো ভাগ্য ফেরাতে কলকাতা পালিয়েছিল। দেবীন ফিরে এল তত্ত্বতল্লাস করে। জরিমানা দিয়ে জাতে উঠল। বলল—উরা কি আমাদের মাটিতে জন্মো লিয়েছে? উরা আকাশ থেকে খসেপড়া মেয়ে।

তা সত্যি। কাজলবালাও। আকাশ থেকে খসে পড়া আশ্চর্য মেয়েমানুষ। গাছে চড়ে কাঠ ভাঙত। জাম পাড়ত কুলুটির জঙ্গলে। ঝিলের জলে সাঁতার কাটত। প্রথম যৌবনের আলোয় দেহে তখন সবে রং ধরেছে। সেই সময় চণ্ডালিকায় এল গ্রামের জামাই গোবর্ধন মিস্ত্রি। কলকাতায় কোনো কারখানায় চাকরি করে। তার জামা ঢাকা পাতলুন আর সিগ্রেট কাজলকে প্রলুব্ধ করল। লোকটা খুব সুখী। কাজল তার সই সুদাম সখীকে বলত—ও যেখানে থাকে, সেখানে হয়তো অনেক সুখ। সুদামও সায় দিয়েছিল! তারপরই কাজল কলকাতা চলে যায়। ক’মাস পরে চিঠি পেয়ে ছকুলাল সব খবর জানল! গোবর্ধন ছেড়ে অন্য একজনের কাছে আছে কাজল। তিনি খাঁটি ব্রাহ্মণ সন্তান এবং ভদ্রলোক। তিন কুলে কেউ নেই। কাজল বড় সুখে আছে।

আরও কিছুকাল পরে রতনকে নিয়ে যায় কাজল।

এখন সে ভিন্ন মেয়ে। শিক্ষিত ও ভদ্র হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। বংশী মুখুয্যে একজন মানুষের মতো মানুষ। ছকুলাল প্রতিবারই পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করে এসেছে। রতনের পোশাক ও চলাবলায় মুগ্ধ হয়েছে। কেবল ক্ষোভ—রতন বংশী মুখুয্যেকেই বাবা বলে। কাজলকে বলে মা। আর ছকুলালকে? বলে, মামা। দেশের মামা।

আশ্চর্য, বংশী মুখুয্যে শুধু মিটিমিটি হাসেন।

পরপর অনেকগুলো মৃত্যু ছকুলাল দেখেছে। প্রতিটি মৃত্যু তাকে প্রতিবারই দেশান্তরী করেছে। হাতে একতারা। বাউলের ভেক। তারপর যখন ঘরে ফিরেছে, সঙ্গে একটি বউ। এই যেন সহজ হয়ে উঠেছিল তার কাছে। কোথায় যেন অপেক্ষা করে থাকে একটি মেয়ে। গাছের ফলের মতো করে পেড়ে আনে।

কথাটা বলেছিল সুদামসখী। কাজলেরই সই। পাশের বাড়িতে সে থাকে। তাই ছকুলালের আগের তিনটি বউ পরপর তার সঙ্গ পেত। সারাটি দিন মাঠে মাঠে শাক—মাছ—কাঠ—কুটো সংগ্রহ করে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। ওলাঙ্গিনীকেও সে সঙ্গ দিচ্ছে। যুবতী মেয়েদের পথে মাঠে বনে একা—একা ফেরা ঠিক না।

—তা তুমাকে কোথা পেলে বল দিকিন? সুদাম বলেছিল।

ওলাঙ্গিনী একটু হেসে দূরের দিকে আঙুল তুলেছিল। —হুই বিনোটিতে। দু ইস্টিশান পরে। রেলগাড়ি উখেনেও চলে তো!

—খুব মজা! সুদাম বলেছিল। আমার কিন্তু রেলগাড়ি চাপার খুব ইচ্ছে করে, জানো? কে লিয়ে যাবে!

—আমি লিয়ে যাবো তুমাকে। ওলাঙ্গিনী ওর হাত ধরে বলেছিল। ইবারে মাঠে অনেক ধান। গায়েন অনেক ধান পাবে। বিনোটিতে শ্যামাচাঁদের মেলা বসবে। দেখতে যাব। বাবা মা বেঁচে নাই। কিন্তু দাদা আছে। দাদা খুব ভালোমানুষ। তুমাকে দেখে রাগ করবে না। এমনি করে স্পষ্ট কথা বলে ওলাঙ্গিনী। স্পষ্ট বলেই ওর কথাগুলো কেমন গাঢ় অথবা কঠিন মনে হয়। অথচ চেহারার কমনীয়তা, সব সময় শঙ্কিত চাহনি, একটুতেই অভিমান—কেমন বেমানান লাগে। শরীর অপরূপ নিটোল হয়ে আছে। যেন কোনো দুঃখ গ্লানি যন্ত্রণার আঘাত সে পায়নি। তবু চোখদুটিতে বড় অসহায়তা। ছকুলাল প্রথম যখন তাকে মুখোমুখি দেখেছিল, এটুকুই ভালো লেগেছিল তার। ওই চোখের চাহনি একটা গভীর ইচ্ছার স্রোত প্রকাশ করতে চায়।

এই চোখে ওলাঙ্গিনী সেদিন বিনোটির মেলা দেখতে যাওয়ার কথা বলেছিল। শীতের শেষদিকে বসবে মেলাটা। দাদা মুখে যতই বলুক—কাঁধে থেকে ভার নেমে গেছে বলে হাল্কা হয়েছে, দাদার এই স্বস্তিটা ওলাঙ্গিনী বোঝে। বিয়ের কথা শুনে ওলাঙ্গিনী ভীষণ কান্না জুড়েছিল। —কোথাকার কে ভেকধারী ভিখারি বাউণ্ডুলে, তার সঙ্গে স্যাঙা! ফুলে ফুলে কেঁদেছিল সে। দাদা অম্বিকার পা জড়িয়ে ধরেছিল। অম্বিকা গলে পড়েনি। বরং ক্রুদ্ধ হয়েছিল। চুল খামচে সরিয়ে দিয়েছিল তাকে। —সোমত্ত যোবতী মেয়ে! ঘরে আগুন পুষে রেখেছি একেবারে। তারপর অম্বিকা নরম সুরে বলেছিল—এই ছন্নছাড়া মানুষটাকে যদি সংসারী করতে পারিস তবেই জানব তুর মেয়ে জন্মো খাঁটি। নৈলে এমুখো হবিনে কখনো।

সে—কথা প্রতিজ্ঞার মতো গ্রহণ করেছে ওলাঙ্গিনী। আশ্চর্য, প্রথম রাতেই পাশে শোওয়া লোকটিকে তার কত ভালো লেগে গেল। এত সুন্দর চেহারা! যেন দেবতার মতো। কোনো রূপনদীতে ডুব দিয়ে এই পৃথিবীতে পৌঁছে গেছে ভুল করে। উজ্জ্বল গৌর রঙে নীলাভ শিরাগুলি দেখতে দেখতে নিজের অজ্ঞাতে আত্মসমর্পণ করেছিল ওলাঙ্গিনী। তুমি এত সুন্দর ক্যানে গো? সে প্রশ্ন করতে একটুও লজ্জা পায়নি।

—আমি সোন্দর? ছকুলাল হা হা করে হেসে উঠেছিল। কে জানে আমি কী।

ওলাঙ্গিনী বলেছিল—এত সোন্দর মানুষ আমি দেখি নাই।

ছকুলাল কোনো জবাব দেয়নি। মনে মনে বলেছিল—তাই হয়তো কারুর ভাগ্যে সয় না। এ আগুনে সকলেই পুড়ে মরে। একটু শিউরে উঠেছিল সে। এই সরলা যুবতী মেয়েটি ও হয়তো অমনি করে মৃত্যু কাছাকাছি হচ্ছে। গভীর মমতায় কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ওলাঙ্গিনীর মুখ দেখেছিল। তারপর হঠাৎ বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল—সব যাক, তুমাকে আমি যেতে দিব না।

চণ্ডালিকা এসে তুফানী আদর ও সুবাসলতার কথা জানতে পারে ওলাঙ্গিনী। প্রথমে সে খুবই ভয় পেয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে যেন প্রস্তুত হয়ে উঠল একটা অনিবার্যতার বিরুদ্ধে। কঠোর হচ্ছিল সে দিনে দিনে। ছকুলাল এই ভাবান্তরটা লক্ষ্য করেছে। মধ্যে মধ্যে তার হাসি পেয়েছে। নিয়তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে চায় ওলাঙ্গিনী। এ দুঃসাহসের কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু জাগালী জীবনের অবসরে কোনো সুযোগে কিছু সময় যখন ঘরে থেকেছে, ওলাঙ্গিনীর সংসারকে একটি নীরব প্রস্তুতির মতো মনে হয়েছে তার। উঠোনের প্রান্তে পুরনো একটা শিমুলগাছ রয়েছে। পাশের রায়দিঘির পাড়ে ভাগাড় থাকার দরুন গাছটা সব সময় শকুনে ভরতি থাকে। ওলাঙ্গিনী গাছটা কেটে ফেলার কথা বলেছে তাকে। হয়তো ওই গাছই সব অপঘাতী মৃত্যুর কেন্দ্র। অনেক রাতে অন্ধকারে শকুনের ডানার শব্দ, অস্ফুট চিৎকার অমঙ্গলের লক্ষণ বলে মনে হত। অথচ স্পষ্ট করে এ নিয়ে কিছু ভাবেনি ছকুলাল। ওলাঙ্গিনীই প্রথমে এ বিষয়ে স্পষ্টতা আনল। শীতশেষে মাঠ থেকে ফিরলে তখনই গাছটা কেটে ফেলবে ছকুলাল।

তারপর ওলাঙ্গিনী তার একতারাটা সম্পর্কেও বলেছিল। একদিন ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েছিল রায়দিঘির জলে। দীনুপদ এসে কেড়ে নেয়। পাড়া সম্পর্কে ভাগ্নে হয় দীনুপদ। কবিয়ালির নেশা রয়েছে। তাই ছকুলালকে শুরু বলে মানে। এখন একতারাটা তার কাছেই গচ্ছিত রেখে নিশ্চিন্ত ছকুলাল। একতারাটার একটা ইতিহাস আছে, কেউ জানে না। আদরবালার জীবনের সঙ্গে এক গূঢ় সম্পর্ক আছে ওটার। শুনিয়ে কারুর কিছু লাভ নেই। তাই কারুর কাছে এ কাহিনী বলেনি সে।

—অপঘাতে মানুষ মরে ক্যানে? ওলাঙ্গিনী একরাতে প্রশ্ন করেছিল। ছকুলাল চুপিচুপি মাঠের অন্যপ্রান্তটা পাহারা দেবার ছলে ঘরে চলে এসেছিল। কিছু সময় ওলাঙ্গিনীর সঙ্গ চেয়েছিল সে। কিছু ভালোবাসার কথা বলার ইচ্ছে ছিল তা। শোনবার ইচ্ছেও ছিল।

কিন্তু ওলাঙ্গিনীর এ প্রশ্নে তখন বিস্মিত হয়েছিল সে।—ক্যানে? আমি তো জানি না।

—আমি জানি।

—বেশ তো, বলো।

—মরার ইচ্ছে না থাকলে অসময়ে কেউ মরে না, জানো।

ছকুলাল হেসে উঠেছিল। —ইচ্ছে? স্বামী—সংসার ফেলে কারুর মরতে ইচ্ছে করে?

—করে।

বিনোটির শ্রীধর স্বর্ণকারের মেয়ের একটা গল্প তখন শোনাল ওলাঙ্গিনী। সাজানো ঘর পরিপাটি সংসার সব ত্যাগ করে সে ট্রেনের চাকায় মাথা দিয়েছিল। বলতে বলতে তার বুকে ঘন হচ্ছিল ওলাঙ্গিনী, টিমটিম লম্ফর আলোয় তার চোখদুটি আয়ত হয়ে উঠেছিল।—ভরপুর সনজেবেলা তখন। দাদার সঙ্গে লাইন ধরে আসছি। হঠাৎ পায়ে কী জড়িয়ে গেল। দাদার হাতে টর্চের বাতি। জ্বালতেই দেখি, উঃ মাগো!

অন্যমনস্ক ছকুলাল প্রশ্ন করেছিল—কী?

—মেয়ে মানুষের মাথা। চুলশুদ্ধ থ্যাঁৎলানো মাথাটা। ওলঙ্গ শরীরখানি পাশে পড়ে আছে…

ছকুলালের বুকে মাথা রেখে অনেক সময় শুয়ে থাকল ওলাঙ্গিনী। তারপর ছকুলাল অনুভব করল তার নগ্ন বুক ভিজে যাচ্ছে। তার মুখটা তুলে ধরেছিল দুহাতে।—তুমি কাঁদছো? ক্যানে?

—মনে পড়লে কাঁদন আসে। বড় ডর লাগে আমার।

ব্যাকুলকণ্ঠে ছকুলাল প্রশ্ন করেছিল—ক্যানে ওলাঙ্গিনী, ক্যানে ডর লাগে তুমার?

চোখ মুছে ওলাঙ্গিনী বলেছিল—স্বামী সংসার ফেলে চলে গেল মেয়েমানুষটা!

—সংসারের বড় সাধ তুমার, তাই না?

ওলাঙ্গিনী জবাব দেয়নি। আলতো আঙুলে নাড়া দিচ্ছিল ছকুলালের লম্বা চুলগুলো।

—সে সাধ আমি মিটিয়ে দিব। তুমি কেঁদোনা।

—যদি মরে যাই! হঠাৎ একটু হেসেছিল ওলাঙ্গিনী। বড় ম্লান হাসি।

—তুমিই তো বললে, ইচ্ছে না থাকলে কেউ অসময়ে মরে না।

—আমার ইচ্ছে! বলতে বলতে আরও খিলখিল করে হাসল ওলাঙ্গিনী।

—ওই ইচ্ছেটা বিনেশ করো দিকিন। গাঢ় কণ্ঠে ছকুলাল বলেছিল শেষে।

সেই ইচ্ছার সঙ্গে ওলাঙ্গিনী যেন দিনরাত যুজছে। ছকুলালও এবার তাকে কিছু সাহায্য করতে চায়। একটি গভীর ইচ্ছার সঙ্গে অন্য একটি সহজ ইচ্ছার লড়াই। ছকুলাল জাগালী জীবনে তারই জন্যে কিছু শক্তি সংগ্রহ করতে উৎসুক হয়েছে।

এবং এই অবসরে ঘটনাটা ঘটে গেল।

সুঁদিপুরের উল্লাস যখন বিকেলে মোষ নিয়ে ফিরে আসছিল, দূর থেকে রুক্ষকণ্ঠে তাকে ডেকেছিল ছকুলাল।—কাল রেতে তুমরা অনেক ধান খাইয়েছো বাপু! খবরদার কখনো এমন করে না।

মোষের পিঠে চেপে থেকে উল্লাস হাসল হো হো করে।—সাবাস গায়েন, সাবাস। বুলি পালটিয়ো না কিন্তু। বিপদ হবে।

ছকুলাল অনভ্যস্ত রাগে দারুণ কাঁপছিল থর থর করে। কাছাকাছি বায়তুল্লাও নেই যে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এলোমেলো চিৎকার করছিল শুধু।

—কচ্ছিলে গায়েনী, সেই ভালো। বুঝলে? উল্লাস তীব্র ব্যঙ্গে বলে উঠল? একটা অশ্লীল ছড়াও কাটল সে। তারপর চলে গেল।

 ছকুলাল ফিরে এলে কুঁড়েয়। যোগীবরকে বলল কথাটা। যোগীবর হাঁফ—কাশের রুগি। শুনে ভীষণ কাশল খানিক। শ্লেষ্মাজড়ানো স্বরে যা বলল, তাতে আশ্বাসের কিছু ছিল না।—ওরা দুষ্টু লোক। হয়তো জানসুদ্ধ মেরে দেবে। কী দরকার বাড়াবাড়ি করে, বাবা ছকু?

—কিন্তুক অপমান? ছকুলাল ছটফট করে বলল। অপমানটা কি কম?

—জাগালের আবার মান অপমান? হাসবার চেষ্টা করে অভিজ্ঞ যোগীবর বলতে থাকল।—বাবা ছকুলাল, তুমি সিদিনের ছেলা। তুমাকে একরকম জম্মাতে দেখলাম। জানো সিবারে কী হয়েছিল…।

ওর একঘেয়ে গল্পটা একটুও শোনেনি ছকুলাল। মান—অপমান কথাটা তাকে অন্য এক ভাবনায় পৌঁছে দিয়েছে ততক্ষণে। আশ্চর্য, জীবনে এই প্রথম সে অপমানিত হল। চিরদিন সর্বত্র গায়েন বলে তাকে সকলেই সম্মান জানিয়েছে। এমন ভঙ্গি বা কণ্ঠস্বরে কেউ কোনোদিন তার সঙ্গে বাক্যালাপ করেনি।

 লাঠি হাতে কাঁপছিল। একতারাটার কথা ভাবছিল বারবার। কী অদ্ভুত পার্থক্য এই দুটি জিনিসে। ছকুলাল ক্লান্ত হয়ে ধুপ করে বসল তখন। ঘোলাটে চোখে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকল। এমনি অবহেলা ও অপমান এ জীবনে অনেক তাহলে সইতে হবে। ওই জাগালী জীবনের গুরুতর অসুখের উৎস যেন হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেছে সে।

 ছকুলালের মনে হল, এখুনি একটা চরম কিছু না করে ফেললে বেঁচে থাকার কোনো মানে খুঁজে পাবে না। যে বায়তুল্লার প্রতীক্ষা করতে থাকল।

সন্ধ্যার নমাজ সেরে পীরপুকুরের দিক থেকে ফিরে এল বায়তুল্লা। সব শুনে রেগে আগুন হয়ে গেল সে। একজন জাগালের অপমানে সকলেরই অপমান। বিশেষ করে গয়লাদের চোখরাঙানি বিন্দুমাত্র বরদাস্ত করা অসম্ভব, বারবার জানাল বায়তুল্লা। তারপর বলল,—আজ রাতেই উদের মোষগুলো খোঁয়াড়ে দেব। সকলে জেগে থাকব আজ।

অদ্ভুত উত্তেজনায় দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকল ছকুলাল। আজ যেন একটা নতুন জন্মের প্রস্তুতি চলেছে তার।

পরদিন বিকেল।

চণ্ডালী ঝিলের প্রান্তে শরবনের নীচে পলি মলিন ঘাসের ওপর শুয়ে ছকুলাল গায়েন যখন চোখ খুলেছে, সবকিছু আড়াল করে একখানি মুখ তার ওপর ঝুঁকে ছিল।

বিস্মিত আতঙ্কিত মুখ। কোনো মেয়ের মুখ।

মানুষের মুখ। তাই স্মৃতির ওপর ঘন হয়ে থাকা একটা ধূসরতা প্রাণপণে সরানোর চেষ্টা করছিল সে। ঠোঁট কাঁপছিল। বিড়বিড় করছিল—আমি গায়েন, আমি সেই গায়েন।

তার মনে হচ্ছিল, এবারে আত্মপরিচয় না দিলে ওই মুখের জগৎটাও হারিয়ে যাবে গভীর অন্ধকারে। অদ্ভুত হলুদ একটা অন্ধকার তখনও চারপাশে ঘেরা যেন। এতে ডুবে ছিল সে। এতক্ষণে মুখ তুলে দেখতে পেয়েছে মানুষের মুখ।

কিন্তু উঠতে গিয়ে শরীরে গুরুতর ভার। কাঁধের ওপর, মাথায় দারুণ যন্ত্রণা। ধীরে ধীরে শরীরটা তুলতে পারে সে। ডানপায়ে কে যেন পাথর চাপিয়ে রেখেছে।

পলকে স্মৃতির ওপর থেকে ধূসরতাটা সরে গেছে। সব মনে পড়ে গেছে তার। আতঙ্কে অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে সে।

মেয়ে মানুষের কণ্ঠস্বর কানে আসে। খুবই কাছে।—ভয় কী, ভয় কী। আমাকে ধরো দিকি। ওঠবার চেষ্টা করো। চোখে মুখে জলের ঝাপটা। মাছের কটু গন্ধ কাপড়ে। বোঝার মতো চেয়ে থাকে ছকুলাল। বিন্দু বাগ্দিনী পিঠে হাত বুলোয়।—ভয় কী? ভয় করোনা আর। আমি আছি।

বিকেলের রক্তিম আলোয় পরিচিত জগতের দৃশ্য ফুটেছে। ছকুলাল হাঁফাতে হাঁফাতে চারপাশটা চেয়ে দেখে। তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকে। সে আশ্বস্ত হয়।

সুঁদিপুরের বিন্দুবাসিনী।

বয়সে যুবতী মেয়ে। দীঘল দেহখানি নিটোল লাবণ্যে ভরা। মুখখানি গভীর রসে টলোমলো। যেন সূর্যমুখী ফুলটি। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। গত সনে সোয়ামীর কাল হয়েছে। ছেলেকে রেখে আর স্যাঙায় মন ওঠেনি। সে—মনেরও সবটুকু নিটোল যেন। শরীর ও মনের এই নিটোলতা তাকে শক্তি দিয়েছে অনেকখানি। ছকুলালকে কাঁধে বয়ে চণ্ডালিকা রেখে গেল, তার এই শক্তির কথাই পরস্পর বলাবলি করল লোকে।

বায়তুল্লা ততক্ষণে উনুনের পাশে লম্বা হয়ে পড়ে আছে। বউ গোলবাণু সেঁক দিচ্ছে গায়েগতরে। ন্যাকড়া জড়িয়ে দিয়েছে ক্ষতগুলোয়। সেঁক দিচ্ছে নির্মলা তার বুড়ো সোয়ামী যোগীবরকে। এসব নতুন কিছু নয় জাগালী জীবনে। অনেকখানি রক্ত খরচ করে তবে ঘরে কিছু ধান আসে। জানে এমন হবে। হওয়া উচিত। তবু অবোধ মেয়েমানুষের মন। কাঁদে, চিৎকার করে। হিংস্র গালাগালিতে গ্রামের আকাশ কুৎসিত করে তোলে। প্রধানেরা সান্ত্বনা দেয়। লাঠির সঙ্গে লাঠিই যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা—বারবার বলে তারা।

তাই লাঠি নিয়ে ছোটাছুটি করেছিল অনেকে। গ্রাম থেকে কিছু দূরে বলে খবর পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। ঘাস কাটতে এসে কোনো রাখাল দেখতে পায় বায়তুল্লা আর যোগীবরকে। জলেকাদায় পড়ে গোঙাচ্ছিল। ততক্ষণে গয়লারা চলে গেছে ঝিলের কোন দূরতম প্রান্তে। সেখানে ঘন গভীর কাশবনে সারাটি দিন কাটিয়ে ফিরে যাবে সন্ধ্যার আগে। আজ হয়তো এপথে ফিরবে না তারা।

বিন্দুকে শুনিয়ে তার গ্রামের লোকগুলোকে ওরা গাল দিচ্ছিল। আসলে বিন্দু মেয়েমানুষ এবং এই অসাধ্য সাধন করেছে, এতে লজ্জা পাচ্ছিল ওরা। সে লজ্জা ঢাকতে কুৎসার চূড়ান্ত করে বসল। বিন্দু তখন চোখদুটি ঝাঁপিয়ে বলে উঠল—আমিও কম না।

হারিকেনের আবছা আলোয় তার চোখের দীপ্তি অদ্ভুত বন্য মনে হয়। সকলে চুপ করে গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। আস্তে আস্তে পা বাড়াল সে।—যাই, জালখানা আবার কে মেরে না দেয়!

ওরা টের পাচ্ছিল, বিন্দু সম্ভবত লুকিয়ে সারারাত মাছ ধরবে জলার জলে। কে গাল দিয়ে বলল—মেয়েটি চুন্নী।

—না। বাঘিনী। উটা এক বাঘিনী গো।

হারিকেন হাতে দীনুপদ। একটুখানি দাঁড়িয়ে চলে গেল সে। গায়েন—মামার জন্য ডাক্তার আনতে গিয়েছিল স্টেশন বাজার। ডাক্তারবাবু নেই।

ছকুলালের বাড়ি ঢুকতেই দীনুপদ শোনে, ওলাঙ্গিনী তখনও কান্নাকাটি করছে। আর ছকুলাল বিড়বিড় করে বলছে—উটা স্বর্গের দেবী এসেছিল। একবার প্রণাম করে আসব।

খবর পেয়ে বিনোটি থেকে অম্বিকা এল পরদিন। হন্তদন্ত হয়ে তাকে বাড়ি ঢুকতে দেখে ওলাঙ্গিনী অবাক। ভাবতেই পারেনি, দাদা আসবে। তাই আবার প্রায় মড়া কান্নায় মেতে ওঠে সে।

অম্বিকা ধমক দেয়—থামা দিকি চেল্লানিটা। বিত্যেন্ত বুঝে লিই আগে।

ছকুলাল আস্তে আস্তে সব কথা বলে। শুনতে শুনতে হো হো করে হেসে উঠেছে অম্বিকা।

—খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, মল এঁড়েগোরু কিনে! কী আক্কেল বাপু তুমার!

ওলাঙ্গিনী আবার অবাক।

অম্বিকা বলে—বরঞ্চ আমার সঙ্গে বিনোটিয়া চলো গায়েন। নতুন দালান উঠেছে। অনেক কাজ সিখানে।

—যাবো। ছকুলাল বলে। কিন্তু আর দুটি মাসের জন্যে মাঠ ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না দাদা। ইবার অনেক ধান মাঠে। বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠে বসতে চায় সে। —লাঠি ধরা অভ্যেস নাই। কিন্তু আমি তো পুরুষ বটে। ক্যানে পালিয়ে যাবো বলতো?

ওলাঙ্গিনী সায় দেয়। ধান নিয়ে ইতিমধ্যে একটা সুন্দর স্বপ্ন গড়ে উঠেছে তার মনে। উঠোন ঘরদোর নিকিয়েছে রাঙা মাটি দিয়ে। দেয়ালে খড়ি গুলে এঁকেছে পদ্মফুল, পাখি, ধানের শিষ। লক্ষ্মীমায়ের পায়ের চিহ্ন এঁকেছে পরিপাটি করে। ছকুলাল মাঠ ছেড়ে দেবে ভাবতেও তার ভয় করে। একটা সুখের জগৎ আবার দূরে সরে যাবে না!

অম্বিকা এসব বোঝে না। রাজমিস্ত্রির কাজে কাঁচা পয়সার অনেক বেশি সুখ। তাই এদের ইচ্ছেটা ওকে ক্রুদ্ধ করে। একটু গুড় জল মুখে দিয়েই সে গোমড়ামুখে বেরিয়ে যায়।

ওলাঙ্গিনী যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচে। ছকুলাল বলে—কাজটা কি ভালো হল? অমন মুখোমুখি না করাই উচিত ছিল। ছিঃ!

ওলাঙ্গিনী মুখ ঝামটা দেয়—ভারী আমার দাদা! চিনতে কিছু বাকি নাই। তুমি দেখো, জেবনে আর ও—বাড়ি যাচ্ছিনে।

ছকুলাল একটু হাসে।—বিনোটির মেলা যাবা না?

—তা যাব বৈকি। একবেলার জন্যে যাব। দাদার ঘরে ঢুকব না। ছকুলাল চুপ করে থাকে। কাল বিকেলের পৃথিবীতে নতুন করে একটি জিনিস সে আবিষ্কার করেছে। বিন্দুর কাঁধে ভর করে আসতে—আসতে হঠাৎ সে জেনে নিয়েছিল, মেয়েমানুষের দাবি পুরুষের জীবনে কেন এত গভীর। হয়তো এই জানাটা খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার মনে হয়েছে, মৃত্যুর প্রান্ত থেকে পুরুষকে তুলে আনে। পুরুষ কি পারে তা? ছকুলাল পারেনি তো!

দীনুপদকে ডেকে যম সাবিত্রীর কাহিনীটা আবার শুনতে ইচ্ছে করে তার।

দীনুপদ এই কম বয়সেই অনেক তত্ত্বকথা জানে। তাকে প্রশ্নটা করবে ছকুলাল। বিন্দুর কথার জবাবও যেন এর সঙ্গে জড়ানো। বিন্দু তার রক্তাক্ত শরীর দেখে বলেছিল—একতারা ছেড়ে লাঠি ধরেছিলে গায়েন। বড় ভুল করেছ। কেন একথা বলেছিল সে?

সত্যি কি করেছে ছকুলাল? বাবার বিন্দুর কাপড়ের আঁশটে গন্ধটা তার কাছে ফিরে আসছিল। তখনই সে বিন্দুকে ভাবছিল।

ভাবছিল বিন্দুবাসিনীও….

শেষ রাতে যখন চাঁদ উঠেছে, তার পাণ্ডুর জ্যোৎস্নায় বাড়ি ফিরছিল সে। দুপাশের শিশিরভেজা ধানে তার সদ্য নিঙড়ানো কাপড় আবার ভিজে যাচ্ছিল। মাছের হাঁড়িটা তার কোমরে ঝুলছিল। কাঁধে বাঁকানো দুখানি বাঁশে বাঁধা প্রকাণ্ড বেসাল জালখানি—এই ধূসর আলোয় তাকে দেখলে মনে হয় কোন অমানবী ডানা মেলে উঠে আসছে জলের জগৎ থেকে রাতের শেষ যামে।

দূরে হট্রিটি পাখির একটানা ডাক। ট্রি…ট্রি…ট্রি…।

আঁচল হঠাৎ খসে পড়ে। ভিজে ভারী হয়ে গেছে। তাই পিছলে যাচ্ছে বারবার। সে জ্যোৎস্নায় আঁচল তুলে পরখ করছিল। রক্তের দাগগুলো ঘুচেছে কিনা কে জানে! হয়তো কোথাও লেগে রয়েছে। পুরুষের রক্তের চিহ্ন। একটুখানি অস্বস্তিকর দুঃখ আসে পলকে পলকে। আবার হারিয়ে যায়। মৃত্যুর দুয়ার থেকে আজ একটি পুরুষকে ফিরিয়ে এনে সুখ ও গর্বের চেয়ে একটা প্রায়শ্চিত্তের ধাঁধা বারবার মনে গড়ে উঠেছে। বুদ্বুদের মতো ছোট ছোট ধাঁধা। সে রতিকান্তর কথা ভাবছিল। রতিকান্তকে এমনি করে বাঁচাতে পারেনি। রতিকান্ত ভরা বর্ষায় এমনি এক শরবনের নীচে ডুবে মরে গেল। বিন্দুর চোখের সুমুখে মরে গেল। কেন বিন্দু ছুটে গেল না তার কাছে? কেন?

শেষ রাতে রতিকান্তর কথা মনে পড়ছিল আজ। ট্রি…ট্রি…ট্রি…পাখিটা যতবার ডাকে, মনে হয় রতিকান্তকে এমনি করে বয়ে নিয়ে যেত যদি! কিছু কি ক্ষতি হত? ও যত দিন বেঁচে ছিল যেন একটা অমানুষিক ক্ষতির ভয় মনে পোষা ছিল। মরে গেলে কী লাভ করতে পারল বিন্দু?

সে দ্রুত পা ফেলছিল। দিনের আলো ফোটবার আগে গ্রামে ঢুকতে হবে। ঘাসের পাতায় জমে ওঠা শিশিরে জ্যোৎস্নাগুঁড়ি। অবহেলায় ছড়িয়ে থাকা মুক্তো যেন। পায়ে পায়ে মুক্তো ভেঙে এগিয়ে চলে সে। চলতে চলতে বারবার পেছন ফেরে। পাখিটার ডাক শোনে। যেন রতিকান্ত চিৎকার করে ডাকছে। যেন তার ওই কণ্ঠস্বরে বিন্দুকে কুৎসিত ধিক্কার দিচ্ছে।

প্রচণ্ড ভয়ে বিন্দু থরথর করে কেঁপে উঠেছে। তার দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রুর ফোঁটা শিশিরের মতো করে পড়ছিল। এতদিনে বুঝি নিজের গুরুতর অপরাধ নিজের কাছে ধরা পড়ে গেছে তার!