স্বপ্ন
ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসেন জুলিয়ান। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। হাতড়ে হাতড়ে মাথার কাছে রাখা টেবিল থেকে পানির গ্লাসটি তুলে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শেষ করে দেন। ধকধক করে হৃৎপিণ্ড শব্দ করছে বুকের ভিতর, অনেকক্ষণ লাগে নিজেকে শান্ত করতে। কী আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখেছেন তিনি!
বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে এসে দাঁড়ান জুলিয়ান, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, পথঘাট পানিতে ভিজে চকচকে। ল্যাম্পপোষ্টের লম্বা ছায়া পড়েছে রাস্তায়। বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে জুলিয়ান আপন মনে বললেন, কী আশ্চর্য স্বপ্ন।
স্বপ্নটা ঘুরেফিরে মাথার মাঝে খেলা করে তাঁর, আশ্চর্য একটা স্বপ্ন, অথচ যতক্ষণ পুটি দেখছিলেন, ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারেন নি তিনি স্বপ্ন দেখছেন। মনে হচ্ছিল সত্যি বুঝি সবকিছু ঘটে যাচ্ছে তাঁর জীবনে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জুলিয়ানের মনে হল, এমন কী হতে পারে যে তিনি এখনো স্বপ্ন দেখছেন? এই গভীর রাতে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, বাইরে বৃষ্টি–ভেজা চকচকে পথ আর ল্যাম্পপোস্টের ছায়া–সবই আসলে একটি স্বপ্ন? তাঁর মনে হয়েছে যে ঘুম ভেঙে গেছে, আসলে ভাঙে নি? কী নিশ্চয়তা আছে যে তিনি সত্যি জেগে আছেন?
জুলিয়ান ঘরের ভিতরে তাকালেন, না, এটা স্বপ্ন নয়। ঐ তো তাঁর পরিচিত চেয়ার, টেবিল, বইয়ের শেল্ফ, বিছানা। ঐ তো আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে বিছানায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে তাঁর স্ত্রী।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জুলিয়ান আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, আর তক্ষুণি হঠাৎ তাঁর একটা আশ্চর্য জিনিস মনে হল। এমন কী হতে পারে, যে-জীবনটাকে তিনি তাঁর জীবন বলে জেনে এসেছেন, সেটা আসলে কোনো-একজনের স্বপ্ন? এই ঘর, চেয়ার, টেবিল, বইয়ের শেলফ, জানালা, জানালার পাশে ঝিরঝির বৃষ্টি সবই সেই স্বপ্নের দৃশ্য? তাঁর মধুর শৈশব, বর্ণাঢ্য যৌবন, হাসি-কান্না মিলিয়ে চমৎকার জীবনটা আসলে কারো স্বপ্নের কয়েকটা মুহূর্ত? চারপাশের পৃথিবী সেই স্বপ্নের ছায়া? এমন কি হতে পারে?
জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে রাখতে চান জুলিয়ান, কিন্তু পারেন না। ঘুরেফিরে তাঁর বারবার মনে হতে থাকে যে, তিনি হয়তো স্বপ্ন দেখছেন। শুধু যে স্বপ্ন তাই নয়, হয়তো অন্য কারো স্বপ্ন। হয়তো জুলিয়ান বলে কেউ নেই, তাঁর পুরো জীবনটা আসলে কোনো একজনের স্বপ্নের কয়েকটি মুহূর্ত।
ভাবতে ভাবতে জুলিয়ান উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, তাঁর হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। নিজেকে প্রতারিত মনে হয় তাঁর, ক্রোধ জমে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। স্বপ্নটা ভেঙে জেগে ওঠার একটা অদম্য ইচ্ছা হতে থাকে আস্তে আস্তে। কিন্তু স্বপ্নটা ভাঙবেন কেমন করে?
জুলিয়ানের মনে পড়ে, একটু আগে তাঁর স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল যন্ত্রণায়, দেখছিলেন, অসংখ্য বুনন কুকুর তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠেছেন তিনি, আর সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেছে তাঁর। তাহলে কি যন্ত্রণা দিয়ে স্বপ্ন ভেঙে দেয়া যায়? নিশ্চয়ই যায়। যন্ত্রণা যখন সহ্যের বাইরে চলে যায়, তখন স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকতে পারে না, স্বপ্ন তখন ভেঙে যায়। জুলিয়ানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, কোনোভাবে অমানুষিক যন্ত্রণা দিতে পারেন না নিজেকে?
চুপি চুপি জুলিয়ান নিচে নেমে আসেন। সিঁড়ির নিচে ঘরের ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি রাখা আছে। হাতড়ে হাতড়ে হ্যান্ডলিটি বের করে দেয়াল ফুটো করার আট নম্বর ডিল বিটটা লাগিয়ে নেন সাবধানে। পা টিপে টিপে বাথরুমে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ান তিনি, উত্তেজনায় তখন তাঁর হাত কাঁপছে। সুইচ টিপে দিতেই ড্রিল বিটটা ঘুরতে শুরু করে, কংক্রিট ফুটো করা যায় এটা দিয়ে। কপালের উপর চেপে ধরলে মাথার খুলি ফুটো হয়ে যাবে অনায়াসে।
জুলিয়ান কাঁপা হাতে হ্যান্ড-ড্রিলটা তুলে কপালের উপর চেপে ধরেন, প্রচণ্ড আর্তনাদ করে ওঠেন পরমুহূর্তে…
কিলবিলে প্রাণীটির ঘুম ভেঙে যায় দুঃস্বপ্ন দেখে। কী বিদঘুটে একটা স্বপ্ন। প্রাণীটি অবাক না হয়ে পারে না। পিটপিট করে তাকায় তার কয়েকটি চোখ মেলে, সূর্য দুটি অনেক উপরে উঠে গেছে। প্রাণীটিতার অসংখ্য ছোট ঘোট পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে লাল রঙের পাথরের উপর দিয়ে।
আরেকটি সুদীর্ঘ দিন শুরু হল তার।