সন্তান
কিয়া তৃতীয়বারের মতো খাবার টেবিলটি পরিষ্কার করে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ক্রল রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কিয়া, তুমি আর কত রান্না করবে? বাকিটুকু ট্রনের হাতে ছেড়ে দাও।
ট্রন সংসারের সাহায্যকারী রবোট, কাজকর্মে কিয়া বা ক্রল দুজনের থেকেই অনেক বেশি পারদর্শী। কিয়া ক্ৰলের কথায় কান না দিয়ে বলল, কী বলছ তুমি? এতদিন পরে আমার ছেলে আসছে আর আমি নিজের হাতে কিছু রান্না করব না?
তোমার ছেলের বয়স আট, তার জন্যে তুমি আর কত রান্না করবে?
কিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আমার ছেলে–আমি তাকে পেটে ধরেছি, তাকে আমি দেখি বছরে মাত্র একবার, তাও কয়েক ঘণ্টার জন্য! আমি জানি সে কিছু খাবে না, কিন্তু তবু তার জন্যে রান্না করতে আমার ভালো লাগে।
ক্রল হার মেনে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাই যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে সেটাই কর।
কিয়া কপালের উপর ঘামে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে বলল, তুমি দেখ তার ঘরে যে নূতন খেলনাগুলো কিনেছি, সবগুলো ঠিক করে রাখা আছে কি না।
দেখছি।
ক্রল একটা নিশ্বাস ফেলে তাদের সন্তানের জন্যে আলাদা করে রাখা ঘরটিতে হাজির হল। কখনো সে এখানে রাতে ঘুমায় নি, কখনো ঘুমাবে না, কিন্তু তবু এখানে তার জন্যে একটা বিছানা আলাদা করে রাখা আছে, পাশে ছোট টেবিল, টেবিলের পাশে ছোট চেয়ার। দেয়ালে রঙিন ছবি, উপর থেকে ঝুলছে নানা ধরনের মোবাইল, ঘরের একপাশে খেলনার বাক্স, নানারকম খেলনায় উপচে পড়ছে। মেঝেতে নরম কার্পেট, জানালায় রঙিন পরদা। দেয়ালে ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক ছবি, ক্ষণে ক্ষণে সেইসব ছবি পাল্টে যাচ্ছে। ঘরের দেয়ালে লুকানো স্পিকার থেকে শোনা–যায়–না এ রকম নরম সুরে কোমল সঙ্গীতের সুর ভেসে আসছে। ঘরের ভিতরে একটি শিশুর আনন্দের জন্যে সবকিছু রয়েছে, যেটা নেই সেটা হচ্ছে শিশুটি।
ক্রল উবু হয়ে বসে নতুন খেলনার বাক্সগুলো খুলে ভিতর থেকে খেলনাগুলো বের করতে থাকল। তাদের ছেলে আসবে সকাল দশটায়, চলে যাবে তিন ঘণ্টা পর, তার মাঝে সে কি এই খেলনাগুলো স্পর্শ করার সময় পাবে? ক্রল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কী প্রয়োজন ছিল এই সভ্যতার যেখানে একটি শিশুকে কার্যক্ষম মানুষ হিসেবে বড় করবার দায়িত্বটুকু নিতে হয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে? কেন তাকে সরিয়ে নিতে হয় মা–বাবার কাছে থেকে? কেন সে প্রাচীনকালের মানুষের মতো মা–বাবার স্নেহে, আদরে, আবদারে, শাসনে, ভালবাসায় বড় হতে পারে না? সত্যিই কি প্রাচীনকালের পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ? কী প্রমাণ আছে পৃথিবীর মানুষের কাছে?
.
ঠিক দশটার সময় ক্রল এবং কিয়ার বাসার সামনে একটা ভাসমান গাড়ি এসে থামল। নিঃশব্দে গাড়ির পিছনে একটা দরজা খুলে গেল এবং ভিতর থেকে বের হয়ে এল কোমল চেহারার একটি শিশু। সাত–আট বছরের শিশুটি একবার চারদিকে তাকিয়ে বাসার দরজার দিকে হেঁটে আসতে থাকে। সাথে সাথে দরজা খুলে কিয়া প্রায় ছুটে বের হয়ে এসে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। শিশুটি তার মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বলল, মা তুমি ভালো আছ?
কিয়া শিশুটিকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে রেখে বলল, হ্যাঁ বাবা। তুই ভালো আছিস?
আছি মা। বাবা কোথায়?
ওই যে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্রল তখন সামনে এগিয়ে এল। শিশুটি তার মাকে ছেড়ে বাবার দিকে এগিয়ে যায়, কাছে গেলে বাবা গভীর ভালবাসায় তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।
শিশুটিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে এল বাবা-মা। তাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল দুজন। মুগ্ধ বিস্ময়ে তারা তাদের সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে, গভীর ভালবাসায় স্পর্শ করে, চুলে হাত বুলায়। শিশুটি মুখে একটু লাজুক হাসি নিয়ে বসে থাকে, এতদিন পরে বাবা–মাকে দেখে যেন ঠিক বুঝতে পারে না কী করবে।
কিয়া হঠাৎ আরো একবার গভীর ভালবাসায় শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাদের কথা তোর মনে আছে বাবা?
আছে মা
কেমন করে মনে আছে? এক বছর পর পর তুই মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যে আমাদের কাছে আসিস
কিন্তু মা, আমাদের মস্তিষ্কে তোমাদের নিয়ে স্টিমুলেশান দেয়া হয়। আমরা রাতে যখন ঘুমাতে যাই তোমাদের দেখি, তোমাদের কথা শুনি–
কিন্তু সেটা কি সত্যি দেখা হল?
হ্যাঁ মা, সেটা সত্যির মতো।
তুই যখন আমাকে দেখিস তোর ভালো লাগে?
হ্যাঁ মা, ভালো লাগে। আমার যখন মন খারাপ হয় তখন আমি তোমার কথা ভাবি।
কিয়ার চোখে হঠাৎ এক ধরনের আশঙ্কার ছাপ পড়ে, তোর মন খারাপ হয় বাবা?
শিশুটি একটু হেসে বলল, কেন হবে না মা? সবার মন খারাপ হয়। এমনিতেই মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়, তাছাড়া আমাদের মাঝে মাঝে মন খারাপ করিয়ে দেয়া হয়।
ক্ৰল উদ্বিগ্ন মুখে বলল, কেন বাবা? কেন তোদের মন খারাপ করিয়ে দেয়া হয়?
শিশুটি হেসে বলল, বাবা, আমাদের শুধু মন খারাপ নয়; আমাদের রাগ, দুঃখ, আনন্দ, হিংসা–সবকিছু শেখানো হয়। যখন তোমাদের খুব মন খারাপ থাকে তোমরা কোনো কাজ করতে পার?
না বাবা, পারি না
আমরা পারি। শিশুটি উজ্জ্বল চোখে বলল, আমাদের যখন মন খারাপ হয় আমরা তখনো কাজ করতে পারি। আমাদের যখন অনেক আনন্দ হয় কিংবা রাগ হয় তখনো আমরা কাজ করতে পারি।
কেমন করে করিস, বাবা?
আমাদের মস্তিষ্কে স্টিমুলেশান দেয়া হয়। স্টিমুলেশান দিয়ে আমাদের মন খারাপ করানো হয়, যখন খুব মন খারাপ হয় তখন আমাদের কাজ করতে দেয়া হয়। সেটা আরেক রকম স্টিমুলেশান।
কী কাজ করিস তোরা?
নানারকম কাজ। আমাদের কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি পড়তে হয়, সুপার কন্ডাক্টিভিটি শিখতে হয়। নানা রকম মডেল থাকে, টেকনিক্যাল প্রজেক্ট করতে হয়–
তোরা সব করতে পারিস?
শিশুটি লাজুক হাসি হেসে বলল, পারি মা। আমি গত পরীক্ষায় সবগুলো বিষয়ে বেশি নম্বর পেয়েছি। ব্ল্যাকহোল কেমন করে এসেছে তার ওপর আমার একটা পেপার জার্নালে ছাপা হয়েছে।
পুত্রগর্বে গর্বিত মা তার আদরের শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
শিশুটি তার ঘরে ঘুরে বেড়াল, তার জন্যে আলাদা করে রাখা ঘরটিতে তার খেলনাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল। তার বিছানায় পা দুলিয়ে বসে হলোগ্রাফিক ছবি দেখল। মায়ের পিছু পিছু হেঁটে হেঁটে টেবিলে খাবার এনে দিল। গৃহস্থালি রবোট ট্রনের সাথে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্ক–বিতর্ক করল, বাবার ঘাড়ে উঠে ঘরময় ছুটে বেড়াল।
দুপুরে কিয়া, ক্রল এবং শিশুটি একসাথে বসে খেল। শিশুটি খাওয়ার ব্যাপারে একটু খুঁতখুঁতে–অনেক রকম খাবার রান্না হয়েছে তবু কোনোটাই তৃপ্তি করে খেল না। সবগুলো থেকে একটু একটু করে খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে উঠে পড়ল।
কিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল, যে কয়েক ঘন্টা সময়ের জন্যে সে এক বছর থেকে অপেক্ষা করছে সেই সময়টা শেষ হয়ে আসছে। আবার এক বছর পর তার সন্তানটি কয়েক ঘণ্টার জন্যে আসবে। গভীর বেদনায় তার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যেতে চায়।
শিশুটি কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে তার জুতোগুলো পরে নেয়। হাতের ছোট ব্যাগটি তুলে নিয়ে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আসি মা?
মা চোখের অশ্রু ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে শেষবার আলিঙ্গন করে বলল, আয় বাবা।
শিশুটি ক্রলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, আসি বাবা।
ক্রল শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আয় বাবা। ভালো হয়ে থাকিস।
শিশুটি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সাবধানে চোখের পানি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে নেয়। ভাসমান গাড়িটার কাছাকাছি যেতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল। শিশুটি মুখ ঘুরিয়ে একবার পিছনে তাকিয়ে গাড়ির ভিতরে ঢুকে যেতেই নিঃশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথেই ভাসমান গাড়িটা ছোট একটা গর্জন করে উপরে উঠে যায়।
***
শিশুটি ম্লান মুখে একটা ছোট চেয়ারে বসে আছে। পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক একজন লোক নরম গলায় বলল, মন খারাপ লাগছে?
শিশুটি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।
এক্ষুনি তোমাকে আনন্দের স্টিমুলেশান দেয়া হবে তখন তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। যাবে না?
শিশুটি আবার মাথা নাড়ল।
তার আগে তোমাকে ডাউনলোড করতে হবে, মনে আছে?
শিশুটি একটা নিশ্বাস ফেলে শোনা–যায়–না এ রকম গলায় বলল, মনে আছে।
তাহলে দেরি করে কাজ নেই। এস, শুয়ে পড়।
শিশুটি বাধ্য ছেলের মতো এসে পাশে রাখা বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। মৃদু গুঞ্জন করে। মাথার উপরে একটা চতুষ্কোণ যন্ত্র নেমে আসতে থাকে, লাল একটা বাতি জ্বলে ওঠে এবং উচ্চ কম্পনের একটা তীক্ষ্ণ শব্দের গুঞ্জন শোনা যেতে থাকে। শিশুটি ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
ভাসমান গাড়ির সামনে থেকে সোনালি চুলের একজন কমবয়সী মেয়ে এগিয়ে এসে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ডাউনলোড শুরু হয়েছে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, হ্যাঁ।
এখন কাকে ডাউনলোড করছ?
পরের জনকে। শহরতলিতে থাকে বাবা-মা, এক শ এগার তলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের ছিয়ানব্বই তলায়।
কতক্ষণের জন্যে পাবে বাচ্চাটাকে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাবা–মা পাবে দু ঘণ্টার জন্যে।
বাচ্চার চেহারার পরিবর্তন করতে হবে?
হ্যাঁ। চোখগুলো এখন হবে নীল, চুলটা হবে লালচে।
কাজ শুরু করে দেব?
হা দাও। বাবা–মা এক বছর থেকে অপেক্ষা করছে, তাদের আরো অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না।
সোনালি রঙের চুলের মেয়েটি বলল, ঠিকই বলেছ।