দুই
বাংলাদেশের কুমারী মেয়েদের জীবনে এই একটা অগ্নিপরীক্ষার কাল। তা সে হিন্দু হোক, কিংবা মুসলমানই হোক! খুব হিসেব করেই বলছি এই কালটা হচ্ছে মোটামুটিভাবে ষোলো থেকে বাইশ—ছটা বছর।
একটি মেয়ের জীবনের সবচেয়ে দুঃখের কাল এটা। সবচেয়ে অনাদরের এবং ঘৃণার এবং ঝাঁটাখাওয়ার বয়স হচ্ছে এই। কারণ, তাকে সবাই দেখে যাচ্ছে, কেউ নিয়ে যাচ্ছে না। সে নিজের ঘোষ খুঁজছে খুঁটিয়ে। পাচ্ছে না। মাংসের দোষ, নাকি মনের দোষ? গালের ওই দাগটার জন্যে? নাকি এই সরু নাকটা? নাকি পাছায় আরও কিছু মাংসের দরকার ছিল? স্তন যথেষ্ট ডাগর নয়? ঠোঁটের রেখায় নেই কি যৌনতার স্মিত আহ্বান?
কিন্তু না—রুবি এমন অশ্লীলভাব ভাববার মেয়ে নয়। সে তো আসলে বেঁচেই যাচ্ছে একটার পর একটা আক্রমণে। এখনও লক্ষ্মীমেয়ের মতো কোনো অচেনা পুরুষের কঠিন হন্তারক মাংসে নিজের ফুলটি ফোটাবার কথা ভাবতেই পারে না। তার ভয় করে। তার ঘৃণা করে সেই আগন্তুক পুরুষপ্রবরকে। যখনই তাদের আসার কথা শোনে, সে দ্যাখে দূর থেকে ধাবমান এক উল্কাপিণ্ড খরবেগে নেমে আসছে তার দিকে। তার রক্ত শুকিয়ে যায়।
বন্ধু ঝুনুর কথা ভেবেই তার যত আফশোস। কেন? ঝুনুর বিয়ের কথা ভেবে তো তার বাপমায়ের কোনো অনিদ্রার কারণ ঘটছে না এখনও! ঝুনু তাকে ডিঙিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কলেজে ভর্তি হয়েছে সদ্য! আরও কতকগুলো পাশ দেবে সে। দাদুর মতো নাকি ডাক্তারি পড়বে। লেডি ডাক্তার হবে।
আর রুবি যাতে খুব তাড়াতাড়ি বাচ্চা বিয়োতে পারে এবং তার মায়ের মতোই সারাবেলা সংসারের ঘানি টানতে সামর্থ্য হয়, তার জন্যে বাপমায়ের যত অশান্তিকর অনিদ্রা!
আফজল খান সৎ বাপ। কিন্তু রুবি তাঁকে আপন বাপের মতো দেখতে অভ্যস্ত ছেলেবেলা থেকে। খাঁসাহেবও সৎ মেয়েকে কস্মিনকালে পর ভাবেননি। বরং মায়ের চেয়ে সৎবাপের দিকেই রুবির টানটা বেশি। সেই তিন বছরের মেয়ে মায়ের সাথে এবাড়ি এসেছে, কিন্তু টেরও পায়নি। বোঝবার মতো বয়স পেলে তখন সে সঠিক বৃত্তান্তটা জানতে পেরেছিল। কিন্তু তা একটুও ভাবেনি সে। এই জানা কোনো দাগ কাটেনি মনে। বরং মাকে নিয়ে কোনো প্রসঙ্গে মা স্বামীর সঙ্গে খুনসুটি করলে হাসিই পেয়েছে রুবির।
কিন্তু এতদিনে কেমন সংশয় জেগে উঠেছিল; ঝুনুর মতো তারও কলেজে পড়া হল না কেন? খাঁসাহেবের আগের পক্ষের ছেলে নুরুল এখানের কলেজে পাশ করে পাকিস্তানে চলে গেল। সেখানে তার মামারা রয়েছেন। বড় বড় সরকারি অফিসার। চাকরি শিগগির পেয়ে গেছে। গত মাসে চিঠি লিখেছিল—ওখানে থেকে না খেয়ে মরবে তোমরা। তার চেয়ে এখানে চলে আসা ভালো। জিনিসপত্রের দামও সস্তা। অঢেল দুধ আর মাছ। সম্পত্তি বিনিময়ের জন্যে এক হিন্দু ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি ইন্ডিয়ায় গিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলবেন। রাজি হয়ে যেয়ো। পুকুর, বাগান ইত্যাদি নিয়ে খুব ভালো বাস্তুভিটে আর একতালা বাড়ি আছে। আমাদের বাড়িটা মাটির হলেও উনি রাজি। তবে সামান্য কিছু বাড়তি জমি চান। সে তো আমাদের আছে। পিরের ডাঙার ওই তিনবিঘের তো ভালো ধান ফলে না—শুকনো মরা মাটি। দিলে ক্ষতি কি? অবশ্যি কিছু নগদ টাকাও দেবেন উনি।…
রুবিকে লিখেছিল—স্নেহের বোনটি, তোর কথা সবসময় মনে পড়ে! কিন্তু কী করব বল? প্রাণের দায়ে এ নির্বাসন নিতে হয়েছে ভাই, বুঝতে পারছিস। হ্যাঁ রে, ঝুনুসুনুরা আমার কথা বলে? ঝুনুও তো পাশ করল তোর সঙ্গে। কলেজে পড়ছে বুঝি? ওরা হিন্দুরা আমাদের মতো বোকা নয়। কী বলব, রুবি, এখানে মুসলমান মেয়েরা আমায় তাক লাগিয়ে দিয়েছে রে। প্রজাপতির ঝাঁকের মতো যখন স্কুল—কলেজে যায়, আমার চোখ দু’টো জ্বালা করে। ওদের দেখতে দেখতে শুধু তোর কথাই মনে হয়, ওদের মাঝে তুই যেন আছিস, তোকে খুঁজতে থাকি ব্যাকুল মনে।…আব্বাকে তোর কথা লিখেছি। যদি ‘বিনিময়’ করে শেষ অব্দি এখানে চলে আসাই সাব্যস্ত হয়, তখন তোর কলেজে পড়ার ব্যবস্থা করে দেব, ভাবিসনে, রাগ করিসনে বোনটি, এইজন্যেই দোনামোনা হয়ে তোর সম্পর্কে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে বলিনি আব্বাকে। একটা বছর লস হবে, হোক। কী এমন বড় হয়েছিস তুই?…
তাহলে সত্যিসত্যি পাকিস্তানে চলে যাবার মতলব? এই কুসুমগঞ্জ ছেড়ে, ওই পিরের দীঘির পাড়ে চমৎকার কলেজটা ছেড়ে, আর ওইসব পথঘাট রেললাইন, ঝুনু, মেজমাসিমা, সুনুদা…উঃ মাগো।
কী হল রে রুবি? উবুড় হয়ে শুয়ে আছিস কেন? দেখি, জ্বরটর নয়তো?
মায়ের ঠান্ডা ভিজে হাত কপালে। রুবি ধড়মড় করে ওঠে। মায়ের মুখের দিকে তাকায়। হঠাৎ বেলাশেষের পাণ্ডুর আলোয় মাকে বড় লোভী মনে হয়। বড় স্বার্থপর আর হীনচেতা দেখতে পায়। তার মনে তীব্র প্রশ্নের ঝাঁক ছোঁ মারতে থাকে। কেন, কেন তার মা নতুনহাট ছেড়ে এক নতুন পুরুষের সাথে এখানে চলে এসেছিল? কেন সেখানে থাকেনি সে? দাদুরা বদরাগী হিংসুটে হোক, নানা তো চমৎকার মানুষ। এখনও মাঝেমাঝে লাঠি ভর করে এবাড়ি এসে ওদের দেখে যান। এই বুড়ো বয়সে ওনার কষ্টের শেষ নেই। ছেলেরা পৃথগন্ন। কেউ দেখবার নেই। মসজিদের এমামগিরি করে কিংবা বিয়েসাদীতে মোল্লার কাজে যা অল্পস্বল্প রোজগার হয়। সাহানা বেগমের স্বাস্থ্যে এখনও ভাঁটা পড়েনি। রুবির মনে হয়, তার মা নানার কাছে থেকে গেলে কী ক্ষতি হত? বরং নানার জন্যে রান্নাবান্না করে রাখত। হাত—পা টিপে আরাম দিত। আর এত চমৎকার উলবোনা আর সেলায়ের কাজ জানে মা। ও বাড়ির বিধবা সুতপামাসি ওই করে কেমন সংসার চালাচ্ছে। ছেলেপুলে মানুষ করছে। মা কি সেটুকুও পারত না? তার মায়ের আসলে ওই জোরটা নেই। তার মা সুতপামাসির মতো নির্লোভ বা নিঃস্বার্থ নয়।….
কী হল? ভূতের মতো প্যাটপ্যাট করে তাকাচ্ছিস যে?
রুবি জবাব দ্যায় না। আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায়।
পিছনে সাহানা বেগম বলে, অবেলায় এলোচুলে কোথায় যাচ্ছিস? কায়েতবাড়ি? দিনরাত্রির ওখানটা ছাড়া আর আড্ডা নেই তোর। লোকে কী বলছে খেয়াল আছে? অ্যাদ্দিন ছোট্ট ছিলি, যা খুশি করেছিস। আর পাড়াবেড়ানি হলে চলবে না কিন্তু।
রুবি ততক্ষণে চোখের আড়ালে চলে গেছে।
দিনটা ছিল খরদাহনের। আকাশ পুড়ে গিয়েছিল যেন। পৃথিবী তামাটে রঙ ধরেছিল। একবারও গাছের পাতাটি নড়েনি। সারাদিন প্রচণ্ড গরমের পর প্রত্যাশা ছিল সন্ধ্যায় কিছু হাওয়া মিলবে। কাছাকাছি অনেক বাড়িতেই ইলেকট্রিক পাখা রয়েছে। ওপাশে কনট্রাকটার খালেক সায়েবের বাড়ি, এপাশে সিঙ্গিদের বাড়ি—দুপুরে গা জ্বলতে থাকলে সাহানা বেগম আড্ডা দেবার ছলে খালেকগিন্নির কাছে গড়িয়ে এসেছে। খালি মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিল সে। খালেকগিন্নি তখন শশব্যস্তে খাট থেকে নেমে নিচে এসেছিল। মাদুর পেতে দিয়েছিল। মেয়েটি বেশ। দেখলে মনে হবে না যে চাষাবাড়িতে জন্ম—ওর বাবা একজন নিতান্ত ‘শেখ’—এখনও লাঙলের মুঠো ধরে! বড় ভাগ্যে খানদানি মিয়াঘরে তার সাদি হয়েছিল। নিরক্ষরা ওই মেয়ের পেটে যারা জন্মেছিল, এখন তারা রীতিমতো খানদান, তাকলাগানো চেহারা, একেলে চালচলন। স্কুলকলেজে পড়ছে। অথচ খালেকগিন্নি এখনও মনে মনে সেই চাষার মেয়েটি রয়ে গেল? খালেক চৌধুরী ওকে আদবকায়দায় দুরস্ত করতে পারেননি। আসলে মেয়েটি বড় সরলচেতা, বোকাহাবা। নয়তো এমনক্ষেত্রে গরবে গিদরে মাটিতে পা পড়ত না! হীন যদি উচ্চে স্থান পায়, তার নাকি দেমাকে খই ফোটে। একথা আফজল খাঁয়ের। অথচ আকবরের মাকে দেখে এসো গে! তাই বলছিলুম বেগম, জন্ম যেথাসেথা হোক না, কিচ্ছু আসে যায় না। আচার—আচরণেই মানুষের পরিচয়। আমিও খালেকের মতো বংশটংশ মানিনি। তাছাড়া ইসলাম ধর্মে এসবের কোনো বালাই নেই। ওসব আমরা হিন্দুদের কাছে শিখেছি।
ইসলামের কথা খাঁয়ের মুখে শুনলে সাহানা বেগমের পিত্তি জ্বলে যায়। তাসত্ত্বেও এ কথায় একটা গূঢ় রহস্য ছিল। খালেক চৌধুরীর বড় ছেলেটি বেশ কেমন চটপটে কথা, স্বাস্থ্যটাস্থ্যও চমৎকার। রুবির সঙ্গে যা মানিয়ে যায়!
সমাজ বলতে আজকাল বস্তুত তেমন কিছু না থেকেও আছে—সেটা অশরীরী অস্তিত্ব। খালেক চৌধুরী শেখের মেয়েকে বিয়ে করেছেন, খানদানিকুলে এ একটা খাপছাড়া ব্যাপার। নিজের ছেলেমেয়েদের বিয়ের সময় এ নিয়ে যে কথা উঠবে, তিনি স্পষ্ট জানেন। শুধু ভরসা ওই টাকা আর বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে তার মানসম্মান। দেখা যাক।
দুপুরে নিঃঝুম পরিবেশে ফ্যানটা অবিশ্রান্ত ঘুরছে, আর দুই মধ্যবয়সিনী গল্প করতে—করতে, কখন একটা কেজো প্রসঙ্গে পৌঁছেছে টের পায়নি।…তা রুবির কথা বলছেন বড়বিবি? মেয়ে আপনার সোনার চাঁদ মেয়ে—যে ঘরে যাবে, বাতি লাগবে না। লোকের কথায় ছাই দিয়ে ঠিকই সোনার ঘর পাবে, দেখে নেবেন!
….তোমার ছেলেটিও বেশ ভাই। শিক্ষিত, চেহারা আছে, স্বাস্থ্য আছে! খালামা বলে ডাকলে কান জুড়িয়ে যায়। আর ওর সময়—অসময় তো নেই, যখন খুশি হাজির হয়ে খালামা, খালামা! আমার ভারি ভালো লাগে ভাই। নিজের পেটে তো আর এল না।
…একটা কথা বলছিলুম বড়বিবি। বলুন না খাঁসাহেবকে। কথাটা উনিই আকবরের বাপকে বলুন!
…বলব বলছ?
…হুঁ। অবিশ্যি যদি আমার জেতের কথা মনে না মানেন!
…যাও! কী বলছ ভাই! জাত কি মানুষের গায়ে লেখা থাকে! আমি জাতটাত মানিনে।
…সেইজন্যেই আপনাকে আমার এত ভালো লাগে ভাই। সেই যে কথায় বলে, বিষ নেই কুলোপনা চক্কর আছে! জানেন? আজও ওনার আত্মীয় কুটুমরা এবাড়ি কাজেকর্মে জিয়াফৎ নেন না। আজ তেইশ—চব্বিশ বছর কাটালুম এবাড়ি, ছেলেপুলে জোয়ান হল—তবু আমার জাতের খোঁটা ঘুচল না। এমনকি, পাড়ার লোকেও কি কম কথা বলে আড়াল থেকে? কাজকর্ম হলেই দেখবেন, কোন মিয়াবাড়ি থেকে ক’জন আসে, বেশিরভাগই শেখ পাড়ার লোকেরা, ওনার বন্ধুবান্ধব হিন্দু ভদ্রলোকেরা। লতিফ মিয়ার বাড়ির লোকেরা সেদিন খোকনের ‘আখিকায়’ (অন্নপ্রাশনে) বড় সাধে যদি বা এল, ছেলেকে একখানা হার গছিয়েই কেটে পড়ল। সাধাসাধি করলুম, খেয়ে গেল না!…তা আমিও তো দেখেছেন ভাই, কারও বাড়ি কাজকর্মে জিয়াফৎ খেতে যাইনে। ছেলেমেয়েরা যায়, উনি যান। জানি, ওরা মুখেই আমায় যাবার জন্যে সাধে। গেলে তো…থাকগে। খুব আনন্দ হল বড়বিবি। ইচ্ছে যখন হয়েছে, খোদা রাজি থাকলে চুকেও যাবে।
বড় আশায় আর আনন্দে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল সাহানা বেগম। সন্ধ্যায় খাঁসাহেব বাড়ি ফিরলে কথাটা তুলেছিল। আফজল বললেন, দেখি। আর আগে একবার মেজবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে নিই। তারপর বরং দু’জনেই একসঙ্গে যাব।
ছোট্ট প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে একটুখানি ফুলের বাগিচা—সুনন্দর হাতে তৈরি। একপাশে বাঁশের মাচা। এই গ্রীষ্মকালটা হেমনাথ সারারাত ওখানেই কাটান। একটু পরেই মাদুর আর সেকেলে প্রকাণ্ড গদিটা বয়ে আনবে সুনন্দ। চাকরবাকর এককালে ছিল, আজকাল নেই। সুনন্দ বলে, এতবড় গাঁট্টাগোঁট্টা মানুষ থাকতে আবার চাকর খুঁজতে হবে! আমিই মস্তো চাকর। আর ঝুনু, তুই হলি ঝি। কেমন? রাজি তো? ঝুনু বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু শেষ অব্দি, এই রাত্রিবেলা হঠাৎ দরকার হলে, দেখা যাবে হরিচরণের মুদিখানায় পেতলের সরা আর কাঁসার বাটি হাতে ময়দা—ডালডা কিনতে মেজবাবুর মেয়েটিই হাজির।
সকাল সকাল শুয়ে পড়েছিলেন হেমনাথ। একে ডায়াবেটিস, তার ওপর পেটের গোলমাল। যার বাবা ছিলেন দেশ খ্যাত ডাক্তার, তার ছেলে এখন এ বয়সে অসুখে পচে যাচ্ছে। বড় সোমনাথ বাবার পেশা নিয়েছেন—তিনি থাকেন ধানবাদে। ছোট ওদিকেই একজন স্টেশন মাস্টার। কেবল মেজ হেমনাথের কিস্যু হল না। যৌবনে দুষ্টুমির চোটে লেখাপড়াটা বেশিদূর হয়নি। জমিদারের নায়েবি করে কাটিয়েছিলেন—কিন্তু এক কানাকড়ি সম্পত্তি করতে পারেননি। তারপর হলেন সরকারের তহশিলদার। কী সামান্য ভুলচুকে কর্তৃপক্ষের ধমক খেয়ে তক্ষুনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। দারুণ জেদি একরোখা মানুষ হেমনাথ। সম্ভবত, এই জেদ আর স্পষ্টভাষীতাই তাঁকে জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক করে ফেলেছে। মিথ্যের প্রতি তাঁর ঘৃণার কোনো সীমা নেই। দারিদ্র্য তাঁর সয়ে গেছে ক্রমশ কিন্তু তার জন্যে কারও কাছে হাত পাততে তিনি নারাজ। সামান্য দশবিঘে জমির আয়ে সংসারটা টেনেটুনে চলে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও চলে যায়। এখন এই দিনান্তকালের জীবন সুনন্দর প্রতি ভরসা রেখে তিনি বেঁচে আছেন।
আকাশে নক্ষত্র দেখেছিলেন হেমনাথ। দু—চারটে মশা আছে—তারা জ্বালাতে শুরু করলে তখন ঘরে গিয়ে শোবেন। আপাতত অভ্যাসবশে যন্ত্রের মতো হাতটা নড়ে পাখা দুলছিল। আঃ এত গরম এবছরে এই প্রথম। ওই মল্লিকরা, সিঙ্গিরা বেশ আছে কিন্তু। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। নয়তো পাকা দালানবাড়ির ছাদে গিয়ে শোওনা তুমি! অত উঁচুতে মশাটশা যেতে পারে না। হঠাৎ একটু হিংসে জাগছিল এদের প্রতি। মল্লিক খালেকের সঙ্গে কনট্রাকটারি করে। হাইওয়েতে কী কাণ্ড করেছে ভাবা যায় না। জায়গায়—জায়গায় কংক্রিট স্ল্যাব ফেটেফুটে পথটা ফের যা ছিল, তাই। চন্দ্রপুরের ওখানে ব্রিজটাই গেল ধসে। কী চালাকি মেরে পয়সা ঘরে তুলল, ভাবলে মাথা গরম হয়ে যায়। আর ওই সিঙ্গিরা! এই তো সেদিনের কথা। দুর্ভিক্ষের বাজারে খুদ আর ভুষি বেচে…
হেম, ঘুমুলে নাকি হে?
খাঁসায়েব? আরে, এসো এসো। ঘুম কি এক্ষুনি আসবে? সেই সওয়াদুটোয় মেলট্রেন যাবে, তার ভোঁ না শুনলে পার নেই রে ভাই।
আমারও ওইরকম।
চালাকি করোনা এবয়সে!…হেমনাথ উঠে বসলেন।…দিব্যি বউর গায়ে গা মিশিয়ে রাত কাটাচ্ছ। তোমার বরাতটা দেখে হিংসে হয়!
চুপ, চুপ। ঝুনুরা রয়েছে।
হেমনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে অদূরে ঘরের জানালাটা দেখে নিলেন। আরে তাইতো! হারিকেন জ্বেলে পড়তে বসেছে ঝুনু। সুনু এখনও স্টেশন বাজার থেকে ফেরেনি। প্যান্ট কিনতে গেছে। একটামাত্র প্যান্ট দিয়ে কলেজ করছে কদ্দিন থেকে। জামাও একটা। দেখা যাক। আমগাছটায় এবার ভালো আম এসেছে। ব্যাপারীরা আসছে ক’দিন থেকে। ঝেড়ে দিতেই হবে শেষ অব্দি। ছেলেমেয়েদের ভাগ্যে ওগাছের পাকা আম কোনো বছরই বা জোটে!
হেম!
হুঁ, বলো।
একটা পরামর্শের জন্যে এলুম। রুবির বিয়ে নিয়ে ওর মা তো জ্বালিয়ে মারলে হে! আমার অবস্থাটা তো কেউ বুঝতে চায় না। এদিকে—
বেশ তো! মেয়ে তো কারও ঘরে রাখবার জিনিস নয়। ভালো প্রস্তাব। হ্যাঁ হে, সেদিন যে কারা দেখেটেখে গেল, কী হল তার? জবাব পাওনি?
আর কী হবে? কতবার তো এরকম হল। কে কোত্থেকে ভাঙচি দিয়ে বসছে। সে তোমার শুনেও কাজ নেই—আর বলতেও আমি পারব না। এখন কথাটা হল, চৌধুরীর ছেলে আকবরের জন্য চেষ্টা করলে কেমন হয় বলো দিকি? কলেজে পড়ছে—তাছাড়া…
খুব ভালো হবে, খুব ভালো হবে।…হেমনাথ সোৎসাহে বললেন। সত্যি, চোখের সামনে এমন সুপাত্র থাকতে চোখে পড়েনি অ্যাদ্দিন, এ বড় আশ্চর্য! তা কি করতে হবে বলো? চৌধুরীকে বলব আমি? আলবৎ বলব, বলো কখন যাচ্ছ? নাকি একা আমিই যাব?
আফজল কানের পাশে অদৃশ্য উড়ন্ত একটা মশাকে মারবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, তুমি একা যাবে?
ক্ষতি কি? আগে ওর মনোভাবটা তো বোঝা দরকার।…হেমনাথ চাপা গলায় বললেন।…মরা হাতির দাম লাখ টাকা। তুমি হাজার হলেও বড় ঘরের ছেলে—আমি তো ভালোই জানি। ওই খালেকের বাবা ছিল দরজি। স্টেশনবাজারে সেলাইয়ের মেশিন চালাত। আজ না হয় খালেক পয়সা করেছে, মানী লোক হয়েছে। না—না, তুমি আগে যাবে কেন? আগে আমিই যাই। সকাল হোক।
আর একটা কথা হেম।
বলো।
নুরু ক্রমাগত তাগিদ দিচ্ছে, বিনিময় করে ওর কাছে চলে যেতে। ভারি দোটানায় পড়ে গেছি ভাই। একবার ভাবছি, বরং রুবির বিয়েটিয়ে থাক, চলেই যাই ওখানে। ওখানে আশা করি কোনো অসুবিধে ঘটবে না। আবার ভাবছি…
ওঁকে চুপ করতে দেখে নাথ শুধু বললেন, উঁ?
ভাবছি সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে চলে গিয়ে কি সত্যি শান্তি পাব? আমার বাবা—দাদারা যে মাটিতে ঘুমোচ্ছে, সে মাটি ছেড়ে আর কোথাও গিয়ে কি ঘুম হবে হে হেম?
হেমনাথ কয়েক মিনিট চুপচাপ—তারপর গলা ঝেড়ে বললেন, আফজল! প্রাণ থাকতে এ তোমায় বলতে পারব না, একাজ তুমি করো। সত্যি, সত্যি আমার বড় কষ্ট হবে ভাই। সেই এতটুকুনটি থেকে দুটিতে বড় হলাম—মাত্র একটা পাঁচিলের এপার ওপার। এখনও যখন মনে অশান্তি হয়, হঠাৎ ওবাড়ির দিকে তাকালেই—বিশ্বাস করো আফজল, বুকটা ফুলে ওঠে। মনে হয়, যাই খাঁয়ের কাছে দুটো গল্পসল্প করে আসি। আমি তো ভাবতেই পারি না—ওবাড়ির দিকে তাকিয়ে আর বুকে বল পাব না…দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমনাথ এবার খিকখিক করে হাসলেন। একটা হাঁটু উঁচু করে মাথাটা ঝুলিয়ে দিলেন তার পাশে। মুখ নীচু। ফের বললেন, তবে জানো হে, এ হচ্ছে নিছক সেন্টিমেন্টের কথা। পেটের খিদের চেয়ে আর ভয়ঙ্কর কি আছে বলো? তুমি সাতপুরুষের ভিটে আর শান্তি না কি বললে? হুঁঃ! সত্যি ভেবে দ্যাখো তো, কোনো মানে আছে কথাটার?
আফজল তীক্ষ্নদৃষ্টে হেমনাথের মুখ দেখবার চেষ্টা করছিল অন্ধকারে। বললেন, তাহলে চলে যাব বলছ?
হেমনাথ নড়ে উঠলেন হঠাৎ।…পাগল? আমি তা বলতে পারি?
আফজল ব্যস্তকণ্ঠে বললেন, কিন্তু চিরটাকাল তোমার পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ তো আমি করিনি। করেছি কি? নুরুকে মামার কাছে পাঠাতে তুমিই বলেছিলে!
হেমনাথ ফের একটু হাসলেন।…বলেছিলুম। কেন বলব না? দেশে চাকরিবাকরির যা অবস্থা, আত্মীয়স্বজন কোথাও না থাকলে সে গুড়ে বালি। ধরো, নুরুর মামা যদি আমেরিকায় থাকত, সুযোগ হলে সেইখানেই কি নুরুকে পাঠাতুম না ভাবছ? আমাদের জীবনের জন্যে ওদের তাজা প্রাণগুলোকে পচিয়ে ফেলতে পারব না ভাই! পারো তুমি?
আফজল মাথা দোলালেন। …উঁহু।
কাজেই নুরুলকে পাকিস্তানে যেতে বলে কিছু ভুল করিনি।
কিন্তু আমার কথাটার কী হল?
কীসের?
এখানে থাকব না যাব?
হেমনাথ একটু ভেবে নিয়ে বললেন, দ্যাখো আফজল, যৌবন তো শেষ হয়ে গেছে। আর কতগুলো বছরই বা আমরা বাঁচব? চোখবুজে নমোনমো করে এখন কোনোভাবে কাটাতে পারলেই হল। তবে যদি বলো, এখনও তোমার আশা—আকাঙ্ক্ষা বা ভোগের ইচ্ছা আরও আছে, এখনও বড়লোক হবার সাধ তুমি ত্যাগ করোনি, তাহলে বলব—পাকিস্তান কেন, যে স্থানে সুবিধে বোঝ চলে যাও। আর যদি বলো, মেয়ের কিনারা করবার জন্যেই ভিটে ছাড়াতে চাও—সেটা আমার মতে এখানে থাকলেও কি আর হবে না? কালই খালেকের কাছে যাচ্ছি। খালেক আমায় বেশ মানেটানে। কথা ফেলতে পারবে বলে মনে তো হয় না!
হঠাৎ চমকে উঠলেন দু’জনে। খুব কাজে অন্ধকারে কখন প্রভাময়ী এসে দাঁড়িয়েছিল। …কথা তো ভালোই বলছ। কিন্তু ধরো, মেয়ের বে হল, সব চুকে গেল। তারপর? আরও বুড়ো হবে যখন, কে দেখাশুনা করবে ওনাদের? জামাই এসে দেখবে ভেবেছ? হুঁ, ঝাঁটা মারো ও আশায়!
হেমনাথ ব্যস্ত হয়ে বললেন, তা বলে—ধুর, ধুর! আমার কাছে ও পরামর্শ চাইতে এসেছে। আচ্ছা, তুমিই বলো তো মেজবউ—আমরা কি ওকে ভিটে ছাড়তে বলব?
প্রভা কয়েক মুহূর্ত চুপ। তারপর ভাঙা গলায় বলল, তা কি বলা যায় ওনাকে? তবে কথা কী, আরও তো কত মানুষ রয়েছে—ধরো যাদের কেউ দেখবার নেই, বুড়ো হয়েছে, তারাও তো আছে! আমাদের এখানকার হিন্দু মানুষদের কথাই বলছি। তারা সব কোন চুলোয় পালিয়ে বাঁচবে? ওদেশ থেকে যারা এদেশে এসেছে, তারা সবাই কি খুব সুখে আছে নাকি? রিফিউজিপাড়া আমি দেখেছি। মানুষগুলো কীভাবে বেঁচে আছে কে জানে।
হেমনাথ বললেন, না—নুরু আছে সেখানে। ভালো চাকরি করছে।
প্রভা ঝাঁঝের সাথে বলে উঠল, ছেলেদের কথা আর বলো না! ক’দিন বাদে বে করবে। ছেলেপুলে হবে। তখন কে কাকে দেখবে, আমি ঢের জানি। আমাদের সুনুর কথা বলবে? হুঁউ—অমন শান্ত গোবেচারা থাকে তদ্দিন, যদ্দিন না বউর মুখ দর্শন হয়! ধুৎ! ও আশা আমি করিনে। আমার দাদাদের কাণ্ড তো চোখের সামনে দেখেছি! হাসতে লাগল প্রভা।
শেষ অব্দি কথাটা চাপা পড়ল। সুনন্দ এসে মাকে ডাকল। তারপর এসে গেল একাল সেকালের তুলনামূলক আলোচনা। রাত যখন গভীর হয়েছে, হাসির মায়ের আবির্ভাব হল।…ও মিয়াসাব, আজ খাবেন না বুঝি? আমার যে বাড়ি ফেরা হচ্ছে না ইদিকে। বিবিসাব আর কতক্ষণ হাঁড়ি আগলে বসে থাকবেন গো?
আফজল উঠে পড়লেন।…চলি হে। কাল তাহলে তুমিই চৌধুরীর হাওয়াটা আঁচ করে এসো। কেমন?
হেমনাথ ডাকছিলেন, অ ঝুনু, একগেলাস জল দিয়ে যাবি, মা। যবনটা আমার গলা শুকিয়ে দিয়েছে।
দূরে অন্ধকারে আফজল সাহেবের গলা শোনা গেল। …কাফেরটাও আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে হাসির মা, বুঝলি?
অন্ধকার নিঝুম বাড়িটার দু’প্রান্তে দুটো ভাঙা গলার অট্টহাসি শোনা যাচ্ছিল।
অনেক দিন পরে হঠাৎ সেদিন আকবর এল এ বাড়ি! রুবি আর ঝুনু একটা এমব্রয়ডারির নকশা নিয়ে বারান্দায় মেঝেয় মাদুর পেতে ব্যস্ত রয়েছে। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে আকবর দরজায় সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে ডাকছিল, খালামা, খালামা!
সাহানা রান্না ঘর থেকে হাসিমুখে বেরোল।…আকবর। এসো, এসো! অ রুবি এই দ্যাখ, কে এসেছে। মোড়াটা বের করে দে ভাইকে।
রুবি মায়ের ব্যস্ততাটা লক্ষ্য করেছিল। একটু অবাকও হয়েছিল। আকবর আগে প্রায়ই আসত। তার সঙ্গে গল্প করত। তারপর ছোট্ট ব্যাপারটা ঘটে যায়। জলের গেলাসসুদ্ধ হাতটা চেপে ধরে…থাক সে কথা। তারপর অনেকদিন ও এবাড়ি আর আসেনি। অলস উদাস চোখে তাকে একবার দেখে নিয়েই রুবি নিঃশব্দে মোড়াটা এনে দিল। এবং ফের ঝুনুর সঙ্গে নাকশাটা নিয়ে ব্যস্ত হল।
আকবর বসলে সাহানা বেগম একটা হাত পাখা এনে নিজেই দোলাতে শুরু করলেন। আকবর হাঁ হাঁ করে উঠল। …আরে, করছেন কী! আমায় দিন।
সাহানা হাসিমুখে বলল, ভালো আছো তো বাবা? অনেকদিন আসোনি কিন্তু। খালামাকে ভুলে গেলে?
আকবর হাসল। …না, না। এমনি।
ঝুনু ফোড়ন দিল। …উঁহু। নুরুদা যখন থেকে নেই, তখন থেকে ওঁরও আর পাত্তা নেই। বন্ধুর শোকে ম্রিয়মাণ ছিলেন কিনা!
আকবর বলল, যাঃ, নুরুলভাই আমার বন্ধু কী বলছিস? আমার এক বছরের সিনিয়ার। আমি ওকে ভাইজান বলতুম না?
ওই হল।…ঝুনু বলল। …ভাইজান নেই বলে যেন এ বাড়িতে আর কেউ নেই!
রুবি আড়ালে ওর আঙুলে ছুঁচ বিঁধিয়ে দিল। তারপর হেসে উঠল, ইস লাগল বুঝি?
সাহানা সরে গেলে আকবর বলল, রুবি যে কথাই বলছ না আমার সঙ্গে।
রুবি মুখ তুলে শান্ত হাসল। সুতো দাঁতে কামড়ে বলল, কথা বলব না কেন!
ঝুনু বলল, আকবরদা, ছবি দেখাবেন? অনেকদিন ফাঁকি দিচ্ছেন কিন্তু। দাঁড়ান হিসেব করি—সেই কবে যেন ‘অমর স্বপ্ন’ দেখে এলাম, সেই যে রুবি, মনে পড়ছে না? কী মাস ছিলরে সেটা?…বলেই জিভ কাটল সে।…এই রে! মাসিমার কানে গেল বুঝি।
আকবর বলল, হ্যাঁ। সেবার যা ভেজান না ভিজিয়েছিলে আমাকে। উফ! দু’জনে দিব্যি রিকশোয় আরামে এলে—আমি পায়ের কাছে কুত্তার মতন!…সে হেসে উঠল।
ঝুনু বলল, বারে! কৃপণের শাস্তি হবে না? আরেকটা রিকশো নিলেন না কেন?
আকবর বলল, কী মুশকিল! তখন পয়সাকড়ি যে এক্কেবারে শেষ!
ওটা চালাকি। ঝুনু অক্লেশে বলে দিল।…চৌধুরীর ছেলের জন্যে রিকশোর অভাব হত না। আসলে…হঠাৎ থেমে গেল সে।
আসলে কী? আকবর একটু ঝুঁকল।
থাক গে। অতীতের কথা অতীতেই থাক। গোরস্থানে সমাহিত করিলাম!…খিলখিল করে হেসে উঠল ঝুনু।
যাও! সবতাতেই ফাজলামি! বলে আকবর সিগ্রেট বের করল। তারপর সাহানা বেগমের অস্তিত্ব টের পেয়ে সোজা উঠে গেল রুবির ঘরে। জানালার পাশে তক্তাপোশে পা ঝুলিয়ে বসল। সিগ্রেট খেতে লাগল।
সাহানা চা—নাস্তা করতে ব্যস্ত। রান্নাঘর থেকে ডেকে বলল, রুবি, এদিকে একবার আসিস তো মা। চা’টা নিয়ে যাবি।
চাপা গলায় ঝুনু বল, ওরে ব্বাস। চা’টা দিচ্ছেন যে রে! ব্যাপার কী? মোঘল সম্রাটের হঠাৎ এত খাতির কেন? ওরে রুবি, তুই তলে তলে বেগম হচ্ছিস না তো?
রুবির ঠোঁটে একটা সূক্ষ্ম বিকৃতি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। সে বলল, চুপ! তারপর রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
ঝুনু সেলাইয়ের নকশাটা হাতে নিয়ে, দাঁতে ছুঁচ কামড়ে ঘরে ঢুকল। বলল, যাক গে। আমি ছোট মানুষ, বড় কথায় নেই। শুধু বলছি—মানে মহামান্য মোগলবাদশাহের দরবারে নিবেদন করিতেছি যে আমরা পুনরায় কবে চলচ্চিত্র দেখিবার সুযোগ লাভ করিব?
আকবর বলল, তথাস্তু।
হুঁঃ! একেবারে মুনিঋষির মতো বাক্য। তা আকবরদা, আজ এরা যে আপনার বড্ড খাতির করছে! চা—নাস্তা বানাতে দেখলুম। ব্যাপারটা জানতে দোষ আছে?
ঝুনুর স্বভাব আকবরের জানা। সে মৃদু হেসে বলল, সেটা ওদের কাছেই জেনে এসো।
ওরা যে বলতে চায় না ছাই।
তবে তোমার বাবার কাছেই জেনে নিয়ো।
সে তো সক্কাল বেলা শুনেছি রে বাবা!
তাহলে আর কী?
ধুস। শুধু আবোল তাবোল বকে। আমার বাবা আপনার বাবার কাছে যাচ্ছেন, এইমাত্র শুনেছি। কিন্তু রেজাল্ট? বুড়োরা তো সব পেটের ভিতর লুকিয়ে রাখে।
রেজাল্ট আমিও জানিনে।
ঝুনু সামান্য দূরে বসল। তারপর বলল, তা মশাই, বিয়ে যে করবেন…বউয়ের…থুড়ি! কী বলছি দ্যাখো। হেসে ভুলটা শুধরে নিল সে।…কনের মতটা জানতে ইচ্ছে করছে না?
আকবর যেন নিস্পৃহভাবে বলল, তা করছে বইকি!
ঝুনু কপট গাম্ভীর্যে বলল, কনের কিন্তু একটুও বিয়ের ইচ্ছে নেই।
আকবর হেসে উঠল।…যাও। জ্যাঠামি করোনা।
সত্যি বলছি। বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছে।
কেন নেই?
ও এখনও পড়াশুনা করতে চায়।
করবে। যদ্দূর খুশি—কোনো আপত্তি নেই।
ঝুনু কী বলতে যাচ্ছিল, রুবি এসে গেল। চায়ের কাপ আর প্লেটসমেত ট্রেটা বিছানায় রেখে বলল, ঝুনু, ওই খবরের কাগজটা পেতে দে তো!
সাহানা বেগম এসে পড়ল, হন্তদন্ত।—কি কাজের ছিরি দ্যাখো! ওসব রাখ। এই দপ্তরখানা বিছিয়ে দে।
নকশা আঁকা সুন্দর একটুকরো কাপড় এগিয়ে দিল সে। রুবি সেটা বিছিয়ে দিল বিছানায়। ঝুনু মুখ টিপে হাসছিল। আকবর বলল, আরে, এসব কী হবে? না—না!
সাহানা চাপা হেসে চলে গেল। ঝুনু বলল, উরে ব্বাস! ডিমের পোচ, সেমাই, ওটা বুঝি ফিরনি? আকবরদা, একা হজম হবে না কিন্তু!
আকবর করল কী হঠাৎ হাত বাড়িয়ে খপ করে রুবির একটা হাত—তারপর ঝুনুর, ধরে সামান্য আকর্ষণ করে বলল, তিনজনে একসঙ্গে খাব কিন্তু। নাও ফার্স্ট রুবি, হাত লাগাও!
রুবি ছাড়াবার চেষ্টা করে মৃদুস্বরে বলল, আঃ লাগছে। ছাড়ুন।
ঝুনুর বাঁহাতটা ধরা, কাজেই ডানহাত চালিয়ে সে বলল, কী মুশকিল! ওর খাবার হাতটাই যে ধরে রয়েছেন মশাই!
রুবি একটু তফাতে বসে কুণ্ঠিত মুখে বলল, আমি ওসব খাইনে। বমি এসে যাবে।
আকবর ছেড়ে দিল হাতটা।—ঠিক আছে আমিও খাব না।
সেই সময় হঠাৎ আফজল এসে ডাকলেন, রুবি এদিকে আয়। এবং রুবি বেরিয়ে গেল। আফজলের চেহারায় কী একটা ছিল—কী একটা ছিল তার ওই ডাকটাতে।
মানুষের মন—কোটিবছরের জীবনজগতের সংস্কার হয়তো আজও তার মধ্যে কিছু না কিছু টিকে রয়েছেই—আমি ইনটুইশানের কথাই বলব—অন্ধকারে সাপের অস্তিত্বও কতসময় ঠিক সে টের পেয়ে যায়।
চায়ের কাপটা শেষ করতে পারছিল না আকবর।
আর ঝুনুরও সেলাইয়ে ভুল হচ্ছিল। জড়িয়ে যাচ্ছিল নকশার রেখায়। কতক্ষণ ওরা কেউ কোনো কথা বলছিল না। ইচ্ছে করছিল না বলতে।