কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি – ২

কৃষ্ণা বেরিয়ে যাবার পর বাড়িতে আজ একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল কিছুক্ষণ, ননী আঁচ করতে পারেনি গন্ধটা কীসের। দরজা বন্ধ করে সাইকেলে চাপার পরও কয়েক মুহূর্ত গন্ধটা পিছু নিয়েছিল। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে টিচার্সরুমে বসে হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, ওমাসে পিসতুতো দিদি মাধুরী আর জামাইবাবু এসেছিলেন সিউড়ি থেকে। কৃষ্ণাকে জামাইবাবু প্রণবেন্দু একটা বিদেশি সেন্ট দিয়ে যান। উনি থাকেন দুবাইয়ে। ননীকে একটা কলমও দিয়ে গেছেন। কলমটা ননী কৃষ্ণাকেই দিয়েছে।

হুঁ সেই সেন্টটাই বটে। ননী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যেন ইসমিলের মড়া আর ওই আকস্মিক সুগন্ধের সঙ্গে আবছাভাবে একটা যোগসূত্রও সে তখন থেকে খুঁজেছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল। সে ভূত বিশ্বাস করে না। অথচ ভূত তার অবচেতনা থেকে তাকে দাঁত খিঁচিয়ে ভয় দেখায়। জ্বালিয়ে মারে। কেউ আত্মহত্যা করতে যাওয়ার আগে সেন্ট মাখে কি না, ননী জানে না। অথচ এই ভুলটা হচ্ছিল। টিচার্স রুমে ননী আপন মনে একটু হাসল। ফোটো তোলানোর আগে কেউ কেউ নাকি সেন্ট মাখে।

কিন্তু হঠাৎ আজ কৃষ্ণা সেন্ট মেখে কলেজে গেল কেন? ননীর কাছে এও একটা ভাববার মতো প্রশ্ন। সে আবার গম্ভীর হয়ে গেল। বেয়ারা হরিসাধন চা আনতে যাচ্ছে কেটলি নিয়ে। স্যারদের কাছে পয়সা নিয়ে ননীর সামনে হাত বাড়াল। ননী বলল, কী?

চা খাবেন না?

ননী মাথা দোলাল। খাবে না।

হরিসাধন চলে গেলে তার মনে হল, মাথাটা যেন ধরে আছে। চা খেলে হত। টিচার্স রুমে এসময়টা গণ্ডগোল একটু বাড়ে। বাইরেও ছেলেরা তুমুল হল্লা করছে। সামনে মাঠের দিকে গেটটা বন্ধ আছে। ওদিকে নদী। ছেলেরা বেপরোয়া পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে ওপারে। ননী জানে, ওরা সিগারেট খেতেই যাচ্ছে। এক পিরিয়ডে কোনো—কোনোদিন তার ইচ্ছে করে, গেটের ওপারে নদীর ধারে গিয়ে বটগাছটার তলায় কিছুক্ষণ বসে থাকে। বেশ শান্ত নিরিবিলি জায়গা। একটু তফাতে শ্মশান আর এক সাধুর আশ্রম। গাঁদা ফুলে রাঙা হয়ে আছে। কিন্তু গেটটা বন্ধ করা। তাছাড়া গেলেই কোনো—না—কোনো ছেলের সিগারেট খাওয়ার সামনে পড়ে অপ্রস্তুতের একশেষ হবে।

কী রে নোনে? অসুখ—টসুখ করেছে নাকি? বিদ্যুৎ স্যার এসে তার পাশে বসল।

ননী বলল, না তো!

তাহলে অমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?

ননী একটু ভড়কে গেল। সকালে কৃষ্ণাও একথা বলছিল। সে হাসবার চেষ্টা করে বলল, নাঃ। জাস্ট মাথাটা একটু ধরেছে।

বিদ্যুৎ স্যার তার সমবয়সি। মেদিনীপুরের ছেলে। পেটের দায়ে এ বয়সেই এত দূরে স্কুলে মাস্টারি করতে এসেছে। ননীর চেয়ে কোয়ালিফায়েড, এম. এস—সি—তে ফার্স্ট ক্লাস। কিন্তু আর কেউ সমবয়সি শিক্ষক নেই বলেই ননীর সঙ্গে তার এত ভাব। এসে কয়েক মাসের মধ্যেই তুইতোকারি শুরু করেছে। তবে ননীর ওকে ভালো লাগে, বিদ্যুৎ স্কুলের ঘরোয়া কিংবা বাইরের কোনো রাজনীতিতে নেই বলে।

বিদ্যুৎ প্যান্টের পকেট হাতড়ে একটা ট্যাবলেট বের করে বলল, খা। এক্ষুনি ছেড়ে যাবে।

ননী জানে, তার মাথা ধরেনি। সে ট্যাবলেটটা নিয়ে বলল, পরে দেখব’খন। …তারপর হঠাৎ হাসল। …..আজ এক বিশ্রী ব্যাপার ঘটেছে জানিস আমাদের পাড়ায়? ইসমিল নামে একজন ছিল—বুক বাইন্ডিং করত। স্কুলেও অনেকবার এসেছে, দেখে থাকবি। সে হঠাৎ গত রাতে…

বিদ্যুৎ বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। শুনেছি। হরিসাধন বলছিল একটু আগে।

ননী শুকনো হাসল। …আমি ওর ডেডবডি দেখতে গিয়েছিলুম।

তোর আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই! আমি লক্ষ্য করেছি, তুই বড্ড পারভার্টেড….বিদ্যুৎ ঘুরে প্রবীণ স্যারদের জটলাটা দেখে নিল। তারপর চোখ নাচিয়ে চাপা গলায় ফের বলল, চ’। বকুলতলায় সিগারেট টেনে আসি।

দু’জনে বেরুল। টানা লম্বা বারান্দা ঘুরে ওরা বকুলতলায় গেল। পুরনো আমলে ওখানে একটা ইঁদারা ছিল। সেটা এখনও আছে, তবে ব্যবহার করা হয় না। তার পেছনে একটা মস্ত বকুল গাছ আছে। মর্নিং স্কুলের সময়, দু’মাস বাদে খুব মিঠে গন্ধ ছাড়বে বকুলফুলের। নদীর দিক থেকে শিরশিরে হাওয়া আসবে। ওখানে পাঁচিলটা ভাঙা। কিন্তু মেরামত হয় না। একইভাবে রয়ে গেছে। যদি না ওপাশে অয়েলমিল থাকত, ছেলেরা অন্যদিকে পাঁচিল ডিঙোতে যেত না।

ইঁদারার আড়ালে দুটো ছেলে বসে ছিল। তারা অপ্রস্তুত মুখে দ্রুত চলে গেল। বিদ্যুৎ সিগারেট দিয়ে ইঁদারার দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, আজ হেডু কী বলল জানিস নোনে? বড্ড ইনসালটিং। দেখবি কবে পালটা ঝাড়ব।

ননী বকুলগাছটা দেখতে দেখতে বলল, আচ্ছা বিদ্যুৎ, গলায় ফাঁস আটকে মরাটা তো ভীষণ কষ্টকর! বরং পটাসিয়াম সাইনাইড, কিংবা স্লিপিং ক্যাপসুল কত ইজি ডেথ। ….বলে নিজের ডান হাতটা গলায় চেপে ধরল। তারপর হাসতে হাসতে হাত নামিয়ে বলল, ভাবা যায় না! ইসমিল পেচ্ছাপ—পায়খানা করে ফেলেছিল জানিস? এতখানি জায়গা নোংরা হয়ে আছে দেখলুম! ইস!

তুই বড্ড পারভার্টেড! বিদ্যুৎ বিরক্ত হয়ে বলল। আমি বলছি কী কথা, আর তোর মাথায় যত পারভার্সান! অত সাহস না থাকে তো দেখতে যাস কেন?

ননী আসলে আলোচনা চাইছিল। বলল, আমার জীবনে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ভাই। বুঝলি? অ্যাদ্দিন কাকেও বলিনি। তোকে বলতে চাই।

ননীর মুখের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বিদুৎ বলল, কী ব্যাপার?

ননী গলার স্বর চেপে বলল, নো সায়েনটিফিক এক্সপ্ল্যানেশান। আমি বারবার দেখে আসছি, কোনো মারাত্মক ঘটনা ঘটবে—ঠিক তার আগেরটুকু আমি দেখতে পাবই পাব। ধর, একটা গোলাকার পদার্থ আমি হঠাৎ দেখতে পেলুম। আমি আদৌ জানিনে যে ওটা বোমা। মনে কর টাইমবোম। দেখে চলে গেলুম, তারপর এক্সপ্লোসন! প্রচণ্ড শব্দ; কানে তালা ধরে গেল। টের পেলুম, ওটা একটা বোমাই ছিল। অথচ ধরতে পারিনি। পারলে একটা কিছু করতুম, যাতে ওটা ফাটত না।

বিদ্যুৎ গলায় ভিতর পণ্ডিতী সুরে বলল, তোমার এই টাইমবোম থিয়োরি দিয়ে কী বোঝাতে চাইছ?

অন্য কিছু না। ননী সিগারেটে ব্যস্ত টান দিয়ে বলল। বলছি, তখন এত অসহায় লাগে নিজেকে। এত ব্যর্থ মানুষ মনে হয়! প্রতিবার এমন ঘটে, আর প্রতিবার ভাবি, আমি একটা কিছু করার সুযোগ পেলুম না। কাল রাতে ইসমিলকে ইনসিডেন্টের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলুম। কিন্তু কিছু টের পাইনি। আর এমন ঘটনা তো একটা নয়। অজস্র—প্রচুর ঘটেছে আমার লাইফে! আর একবার…..

বিদ্যুৎ দাঁত খিচিয়ে বলল, তুই একটা রামছাগল নোনে। ধর যে—ট্রেনটার অ্যাকসিডেন্ট হবে, সে যখন স্টেশন ছেড়ে যায়, তুই একা না—অজস্র মানুষ দ্যাখে। তুই কী বলছিস বুদ্ধুর মতো! আসলে স্যুইসাইড করা ডেডবডি দেখে তোর ভীষণ ভয় হয়েছে!

ননী আস্তে যাঃ বলল, কিন্তু বিদ্যুৎ আমল দিল না। …দিস ইজ পারভার্সান। ভূতের ভয় যার যত বেশি, সে তত বেশি ভূতের গল্প শুনতে চায়। একে বলে কী জানিস? কমপ্লেক্স অফ নেগেশান। যার খুনখারাপিতে ভীষণ আতঙ্ক, সে খুনখারাপির দৃশ্য নিরাপদে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখতে চায়। তারিয়ে—তারিয়ে দেখতে পেলে ছাড়ে না।

ননী বলল, ভাগ। তুই পণ্ডিত!

বিদ্যুৎ একটু তর্কবিলাসী। কিন্তু ঘণ্টা বেজে উঠল। চারদিকে তুমুল হুলস্থুল উঠে আস্তে আস্তে ঝিম মেরে গেল স্কুলবাড়িটা। ননীর আজ লাস্ট পিরিয়ডে ক্লাস এইটের লাইফ সায়েন্স। মাথাধরার ছুতোয় কেটে পড়তে পারলে ভালো হত। বিদ্যুতের ক্লাস সিক্সথ পিরিয়ডেই শেষ। তাকে বলে ম্যানেজ করা যেত। কিন্তু বাড়ি ফিরে কতক্ষণ একা থাকতে হবে। কৃষ্ণা মদনমোহনতলা হয়ে আসবে। সে অন্তত সাতটার আগে ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না। ননী তেতো মুখে ক্লাস নিতে গেল।

এদিকটা শহরের শেষ উত্তরসীমা। কৃষ্ণাদের কলেজ দক্ষিণসীমায়। এক সময়ে কলেজের পেছনের খাল পেরুলে পাখিডাকা জঙ্গুলে গ্রাম ছিল। পোড়ো মাঠঘাট ছিল। দু—একটা বাগানবাড়ি ছিল শহরের পুরনো বড়লোকদের। স্বাধীনতার পর ওদিকটায় ছড়িয়ে গেছে শহর। মদনমোহনতলা গ্রামটা এখন শহরেরই একটা পাড়া হয়ে উঠেছে। ননীদের বাড়ি শহরের পূর্ব এলাকায়, শেষ দিকে। কয়েকটা বাড়ির পর রেলইয়ার্ড। ওদের পাড়ার নাম তোপ পাড়া। নবাবি আমলে ওখানে নাকি তোপখানা ছিল। আশেপাশে এখনও অনেক ফাঁকা জায়গায় আগাছার জঙ্গল আর ইটের স্তূপ আছে। রাতে একেবারে ঝিম মেরে থাকে পাড়াগাঁর মতো। চুরি—চামারির ভয়ও আছে। ওপাশে ধাঙড়দের বড্ড বদনাম। কিন্তু আজ অব্দি ননীদের বাড়িতে চুরি করতে আসেনি কেউ। ননী ভাবে, চোরেরাও টের পেয়ে গেছে তাদের চুরি করার মতো তেমন কিছু নেই এ বাড়িতে। সেই বেলা দশটার পর থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা অব্দি রোজই বাড়িতে লোক থাকে না—ছুটিছাটার দিনটা বাদে। তবু চুরি হয় না। কদাচিৎ ইভিনিং শোয়ে সিনেমা যায় দাদা—বোনে। কখনও বিয়ে—অন্নপ্রাশন ইত্যাদির নেমন্তন্ন খেতেও যায়। প্রতিবার ভয় হয়, ফিরে গিয়ে দেখবে চুরি হয়ে গেছে। হয় না। ননী হাসতে হাসতে বলে, পুঁটি ব্যাপারটা ভাবলে খারাপ লাগে না? প্রেসটিজে লাগে! চোর এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, দেখছিস!

কৃষ্ণা আঁতকে উঠে বলে, বোলো না! দেয়ালের কান আছে। কবে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে দেখবে। অনিদিদের মতো গামছা পরে থাকতে হবে!

কৃষ্ণার জন্য সদর দরজা ভেজিয়ে রেখে ননী যখন উঠোনে পৌঁছুল, তখন পশ্চিমে দূরে নদীর মাথায় আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে আকাশটা দেখল মিনিটখানেক। ভুষকালো চিমনি বা ইঞ্জিনের বয়লারের মুখে লাল আগুনের হলকার মতো কালো—কালো মেঘের খাঁজে লাল ছটা। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে। বছরের প্রথম কালবৈশাখী হয়তো। একটু উদ্বেগ হল কৃষ্ণার জন্যে। তারপর ভাবল, এতক্ষণ মানুদের বাড়ি পৌঁছে গেছে।

ননী অকারণে একবার কৃষ্ণার ঘরের সামনে দাঁড়াল। আর আশ্চর্য, সেই গন্ধটা কয়েক মুহূর্তের জন্য তার স্নায়ুতে এসে ঝাপটা মারল। ফের মনে হল ননীর, কৃষ্ণা আজ সেন্ট মাখল কেন?

একটু দাঁড়িয়ে থেকে যেন লজ্জাপাওয়া মানুষের মতো সে সরে এল। নিজের ঘরের তালা খুলে ঘরে ঢুকল। কৃষ্ণার বন্ধুরা অনেকেই তো সেজেগুজে থাকে। সেন্টও মাখে নিশ্চয়। কৃষ্ণার বেলায় কেন দোষ হবে?

সে প্যান্টশার্ট ছেড়ে আন্ডারওয়্যার পরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল আনমনে। ঘরের জানলা খোলা ঠিক হবে না। অথচ বন্ধ ঘরে ভ্যাপসা গরম আবছায়া জমে আছে। হঠাৎ ফের ইসমিলকে মনে পড়ল। অমনি সে সুইচ টিপে বাতি জ্বালাল। সত্যি, আত্মহত্যা একটা জঘন্য ব্যাপার! যে প্রাণের শেষ হওয়ার সময় হয়নি, তাকে জোর করে শেষ করে দেওয়া কী যন্ত্রণাদায়ক না হতে পারে! তার ওপর দম বন্ধ হওয়াটা কত সাংঘাতিক! নিজের গলায় ডানহাতটা চেপে ননী কষ্টটা আঁচ করতে চাইল। টের পেল বুকটা ফুলে উঠেছে বেলুনের মতো। শ্বাসনালিতে প্রচণ্ড চাপ লাগছে। ফুসফুস তো ফেটেই যায় শেষ—অব্দি। ইসমিলের দুই নাকে রক্তের ছোপ দেখেছিল। যতক্ষণ পারে, ননী দম আটকে থেকে ব্যাপারটা জানতে চাইছিল। তারপর হঠাৎ ভয় পেয়ে হাত সরিয়ে নিল। মুখে নিশ্চয় রক্ত জমে লালচে হয়ে উঠেছিল। শিরাগুলো ফুলে উঠেছিল। চেহারা ইসমিলের মুখের মতো ভয়ংকর হতে যাচ্ছিল নিশ্চয়।

ননী সিগারেট ধরিয়ে বেরুল। উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে প্রাণভরে শ্বাস—প্রশ্বাস নিল। আকাশে ক্রমশ একটা হুলস্থুল ভাব ছড়িয়ে যাচ্ছে। ধূসর হয়ে আসছে শেষবেলাটা। ঝড়বৃষ্টি না হয়ে যায় না। এখন মনে হচ্ছে, কৃষ্ণাকে আজ মদনমোহনতলা না যেতে বললেই ভালো হত! সে নিজেও যেতে পারত! অথচ ব্যাপারটা কৃষ্ণার বলেই কৃষ্ণাকে যেতে বলেছিল। তবে মানু নিশ্চয় ওকে ঝড়—জলের মধ্যে আসতে দেবে না।

হাত পা মুখ রগড়ে ধুয়ে ননী পাজামা পাঞ্জাবি পরে বারান্দার চেয়ারে বসল। কৃষ্ণা থাকলে এখন চা করে খাওয়াত। ভালো লাগে না। আর আজ বাড়িটা কেন যেন তাকে গিলে খাচ্ছে। কৃষ্ণা বাইরে থাকলে সে কত সময় একা কাটায়। এমন তো কখনও লাগে না! বাতাসও বন্ধ হয়ে গেছে। পাঁচিলের ওপারে রাস্তার ধারের গাছগুলো ছবির মতো স্থির। আর আকাশে শব্দহীন হুলস্থুল। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে বারবার। একটু পরে খেয়াল হল, উঠোনের তারে কৃষ্ণার কাপড় রয়েছে। তুলে এনে কিচেনের সামনে ডাইনিং চেয়ারে রাখল সে। তারপর একটা বাতাস এল শনশন করে। উঠোনে ঘুরপাক খেতে থাকল। ধুলো উড়ল। তারপর শব্দ করে সদর দরজাটা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঝড়টা এল। হুড়মুড় করে বাড়ি ঢুকে পড়ল। তখন ধুলো বালির মধ্যে চোখ পিটপিট করে ননী দৌড়ে গিয়ে দরজাটা আটকে দিয়ে এল। বারান্দা থেকে দেখল, সামনে বাইরে কালো আকাশের তলায় হলদে রঙের একটা বিশাল সামিয়ানার নীচে কাগজকুচো শালপাতার ঠোঙা খড়কুটো ছেঁড়া পাতা মুড়ি দিয়ে ঝড়টা ক্লাউনের মতো নাচানাচি করছে। খুব কাছেই শব্দ করে ও আলোর ঝলকানিতে বাজ পড়ল। মেঘের ডাকে কানে তালা ধরে গেল। পাশের বাড়ির নারকোল গাছের একটা শাখা ছিঁড়ে এসে উঠোনে পড়ল। তখন ননী ঘরে ঢুকল। দরজা আটকে বসে রইল।

টেবিলঘড়িতে ছ’টা বাজছে। কৃষ্ণা বোকামি করে বেরিয়ে পড়েনি তো মানুদের বাড়ি থেকে? এখন মনে হচ্ছে, কৃষ্ণা বরাবর বড্ড বোকা। মুখেই একশো কথা বলে, বুদ্ধিসুদ্ধিতে তত পাকা নয়। বর্ষার সময় ভিজে জবুথবু হয়ে কতদিন বাড়ি ফিরেছে। আসলে ভিজতে ওর ভালো লাগে। রিকশোয় এলেই পারতিস, বললে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছে, আমার পায়ে গোদ না বাত আছে? কে জানে, আজ গোঁয়ার্তুমি করে পায়ে হেঁটে মানুদের বাড়ি গেছে এবং পায়ে হেটে ফিরছে নাকি। তাহলে নির্ঘাত ঝড়ের মুখে পড়বে।

ননী ছটফট করছিল। কিছুক্ষণ পরে—পরে দরজা ফাঁক করে সদর দরজায় কড়া নাড়ছে কিনা শুনতে চাইছিল। মিনিট কুড়ি পরে সে ফের যখন দরজা ফাঁক করে উঁকি দিল, তখন শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়টা আর নেই। সে বারান্দায় গেল। সব কালো হয়ে আছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিকে সাদা শিউলির মতো শিলগুলো উঠোনে—উঠোন থেকে বারান্দায় ছিটকে আসছে। কৃষ্ণা থাকলে শিল কুড়োত। ননী পায়ের কাছ থেকে একটা শিল কুড়িয়ে হাতের তালুতে রাখল। কী ঠান্ডা! তক্ষুনি ফেলে দিল।

আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে ঘরে ঢুকল। টেবিলঘড়িতে সাতটা পাঁচ। শিল পড়াটা কমে এসেছে। ছিঁটেফোটা বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসটা আবার দেখা দিয়েছে। ননী বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিল। সিগারেট ধরিয়ে ঘর—বার করতে থাকল। একবার দৌড়ে গিয়ে সদর দরজা খুলে রাস্তাটা দেখে এল। রাস্তা নির্জন। আলোগুলো বৃষ্টির ছাঁটে আর বাতাসে খুব কাঁপছে মনে হল।

একেকটা মিনিট একেকটা মাসের মতো দীর্ঘ ননীর কাছে। কৃষ্ণা তাহলে মানুদের বাড়িতেই আটকে গেছে। মানু ওকে আসতে দেয়নি ঝড়—বৃষ্টিতে। হয়তো নিজেই রিকশো করে পৌঁছে দিতে আসবে।

আধঘণ্টা পরে বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ কোথাও—কোথাও পরিষ্কার হয়ে নক্ষত্র ফুটছে। ননী কিচেনের অবস্থা দেখতে গেল। দু’বেলাই ভাত খায় ওরা। তরকারিটা সকালে রাঁধা থাকে। কৃষ্ণা ফিরে চা করেই কুকারে দু’মুঠো চাল ফুটিয়ে নেয়। ফ্যানটা গেলে গানের রেওয়াজে বসে। সাতটায় ননী বেরোয় টিউশনিতে। ফেরে প্রায় নটায়। কিন্তু মনটা পড়ে থাকে বোনের কাছে।

ননী ঢাকনা তুলে দেখে নিল, আলু—মাছের ঝোল রয়েছে অনেকটা। ডালও আছে। শুঁকে দেখল টকে গেছে নাকি। ভাত থেকে গেছে অনেকটা। ননী আজ ভালো করে খেতে পারেনি। রাতেও তেমন খেতে ইচ্ছে করছে না। কৃষ্ণার এবেলা ভাত না রাঁধলেও চলবে। আসুক, বলবে ননী—বরং পাউরুটি এনে খেয়ে নে। আজ টিউশনিতে যাবে না সে। ওই রাস্তাটা—নির্জনে রুগণ ফ্যাকাশে রাস্তাটা আজ রাতে ভূতের হাতে চলে গেছে। গা কাঁপবে ননীর। খালের ওদিকে তো তাকাতেই পারবে না। আর কর্তার সিং নামে পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের গ্যারেজের পিছন দিকটায় ইসমিলকে দেখেছিল, সেখানে আজও তাকে দেখতে পাওয়া কি অসম্ভব?

টেবিলঘড়িতে কাঁটায়—কাঁটায় রাত আটটা। ননী আবার সদর—দরজায় গিয়ে রাস্তা দেখতে থাকল। একটা সাইকেল—রিকশোয় কারা দুজন গেল। স্বামী—স্ত্রী হতে পারে।

সাড়ে আটটায় ননীর সিগারেটও ফুরিয়ে গেল। বাড়িতে আলো জ্বেলে রেখে তালা এঁটে সে বেরিয়ে পড়ল। রাতটা ভারি গম্ভীর আর স্তব্ধ। বাঁদিকে দূরে রেলইয়ার্ডে জঙ্গুলে এলাকা থেকে পোকামাকড় আর ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে। নেতাজীর মূর্তি অব্দি এগিয়ে চৌমাথায় একটাও রিকশো দেখতে পেল না সে। শিরীষতলার মোড়ে একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনল। তারপর হাঁটতে শুরু করল। পায়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো, লক্ষ্য রেখে যাওয়া যাবে।

প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্ব। কৃষ্ণাদের কলেজ ছাড়িয়ে গিয়ে খালপোলে দাঁড়িয়ে ফের সিগারেট ধরাল। প্রতিটি মুখের দিকে চোখ রেখে ননী সিগারেট টানতে থাকল। তারপর নীচের খালে ফেলে দিয়ে হনহন করে এগোল। ননীর মনে হল সেই সেন্টের ঝাঁঝালো মিঠে একটা ঝিলিক তার স্নায়ুকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিলিয়ে গেল ফের। চোয়াল আঁটো করে ননী হাঁটছিল।

মানু জানলার রড ধরে ভেতর থেকে চমক—খাওয়া গলায় বলল, আরে! তুমি? কী ব্যাপার? ওখানে কেন? ভেতরে এসো।

ননী গলার ভেতর বলল, কৃষ্ণা আসেনি?

কৃষ্ণা? হ্যাঁ, এসেছিল তো। কেন, বাড়ি ফেরেনি এখনও?

না।

সে কী! ও তো বিকেলে চলে গেছে। ঝড়ের একটু আগে। মানু ব্যস্তভাবে বলল, আমি বারণ করলুম, একটু দেখে বেরোও। শুনল না। কিন্তু ….কিন্তু এতক্ষণ কোথায় থাকবে? কই, ভেতরে এসো।

ননী বলল, না।

সে ঘুরে পা বাড়াল। মানু দৌড়ে বেরিয়ে এল। জানো? আমার ধারণা, নিশ্চয় ঝড়—জলের সময় কোনো বন্ধুর বাড়ি ঢুকেছে। খোঁজ নাও। মানু একটু হাসল। এতক্ষণ বাড়ি ফিরেছে হয়তো। তুমি কখন বেরিয়েছ?

সাড়ে আটটা। এখন প্রায় ন’টা। চলি! ননী হাঁটতে থাকল।

মানু পিছন থেকে বলল, বাড়ি ফিরে নিশ্চয় দেখতে পাবে। কচি মেয়ে তো নয়…

ফেরার সময় একটা রিকশো নিতে পারত ননী। নিল না। মানুর অনুমান সত্যি হতেও পারে। ননী আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকল। কৃষ্ণাকে বাড়িতে দেখার আশায় সে আরও কিছুটা সময় খরচ করতে চাইল।

একটু দূর থেকে বাড়ির দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রেখেছিল ননী। যত কাছাকাছি হল, তার শরীর ফের শক্ত হতে থাকল। সদর দরজায় তেমনি তালা আটকানো আছে।

হিংস্র হাতে তালাটা আঁকড়ে ধরে ননী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ভারী আর গরম একটা নিশ্বাস ফেলে সে রাস্তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

এতক্ষণ কোথায় থাকতে পারে কৃষ্ণা? ঠোঁট কামড়ে ধরল ননী। এখন যদি হঠাৎ কৃষ্ণা এসে পড়ে, সে জীবনে যা করেনি তাই করবে। কৃষ্ণাকে প্রচণ্ড মার মারবে। রাস্তার ওপরই মার লাগাবে বাঁদর মেয়েকে।

হঠাৎ ফের মনে পড়ে গেল, কৃষ্ণা আজ সেন্ট মেখে কলেজ গিয়েছিল। অমনি ননী কাঠ হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কৃষ্ণা কি লুকিয়ে কারও সঙ্গে প্রেম করছে?

কিন্তু তাতে তো ননীর আপত্তি করার কিছু থাকতে পারে না। আজকাল ছেলেমেয়েদের মেলামেশার সুযোগ বেশি। প্রেম করাটা ডাল—ভাত হয়ে গেছে। অথচ ননীর মধ্যে এখন এক কড়া গার্জেন, অবিকল তার বাবার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে—দাঁড়িয়ে ফুঁসছে।

কৃষ্ণা কি তার প্রেমিকের সঙ্গে নাইটশো সিনেমা দেখছে। কৃষ্ণা আজ সেন্ট মেখে বেরিয়েছিল। জিগ্যেস করা হল না মানুকে, কৃষ্ণা একা গিয়েছিল—না, আর কেউ সঙ্গে ছিল। কোনো ছেলে কি?

তবে কোনো মেয়ের সঙ্গে নাইটশো গিয়ে থাকলে পাড়ারই কেউ হবে। পাড়ায় খালি ওই পিউ। ননী একটু দোনামনায় পড়ে গেল।

পিউদের বাড়ি সামান্য দূরে। ওদিকটার বসতি ঘন। অলিগলি রাস্তা ঘুরে ননী পিউদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। পিউয়ের ভাই টোনা দরজা খুলে বলল, কী গো নোনেদা?

পিউ আছে? ডেকে দে।

পিউ ব্যস্তভাবে এল। নোনেদা, কী ব্যাপার? ভেতরে এসো।

না রে! ইয়ে—কৃষ্ণাকে দেখেছিস?

কখন? সে তো কলেজ থেকে অনেক আগে বেরিয়ে গেল, মদনমোহনতলা যাবে বলে। কেন গো নোনেদা? বাড়ি ফেরেনি নাকি?

না। বলে ননী হনহন করে চলে এল।

তারপর ননী রাত একটা অব্দি বারান্দায় বসে আছে আর সিগারেট টানছে একটার পর একটা। কৃষ্ণা ফিরছে না। ফিরল না।….