5 of 11

২৬.০১ শিবপুর ভক্তসঙ্গে যোগতত্ত্ব কথা — কুণ্ডলিনী ও শট্‌চক্রভেদ

দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে মাস্টার, রাখাল, লাটু, বলরাম, অধর, শিবপুরভক্তগণ প্রভৃতি সঙ্গে

প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৩রা অগস্ট

শিবপুর ভক্তসঙ্গে যোগতত্ত্ব কথা — কুণ্ডলিনী ও শট্‌চক্রভেদ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে মধ্যাহ্ন সেবার পর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বেলা দুইটা হইবে।

শিবপুর হইতে বাউলের দল ও ভবানীপুর হইতে ভক্তেরা আসিয়াছেন। শ্রীযুক্ত রাখাল, লাটু, হরিশ, আজকাল সর্বদাই থাকেন। ঘরে বলরাম, মাস্টারও আছেন।

আজ রবিবার, ৩রা অগস্ট, ১৮৮৪, ২০শে শ্রাবণ। শুক্লা দ্বাদশী, ঝুলনযাত্রার দ্বিতীয় দিন। গতকল্য ঠাকুর সুরেন্দ্রের বাড়িতে গিয়াছিলেন, — যেখানে শশধর প্রভৃতি ভক্তেরা তাঁহাকে দর্শন করিয়াছিলেন।

ঠাকুর শিবপুরের ভক্তদের সম্বোধন করিয়া কথা কহিতেছেন —

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকলে যোগ হয় না। সাধারণ জীবের মন লিঙ্গ, গুহ্য ও নাভিতে। সাধ্য-সাধনার পর কুলকুন্ডলিনী জাগ্রতা হন। ইড়া, পিঙ্গলা আর সুষুম্না নাড়ী; — সুষুম্নার মধ্যে ছটি পদ্ম আছে। সর্বনিচে মূলাধার, তারপর স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা। এইগুলিকে ষট্‌চক্র বলে।

“কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রতা হলে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর — এই সব পদ্ম ক্রমে পার হয়ে হৃদয়মধ্যে অনাহত পদ্ম — সেইখানে এসে অবস্থান করে। তখন লিঙ্গ, গুহ্য, নাভি থেকে মন সরে গিয়ে চৈতন্য হয় আর জ্যোতিঃদর্শন হয়। সাধক অবাক হয়ে জ্যোতিঃ দেখে আর বলে, ‘একি!’ ‘একি!’

“ষটচক্র ভেদ হলে কুণ্ডলিনী সহস্রার পদ্মে গিয়ে মিলিত হন। কুণ্ডলিনী সেখানে গেলে সমাধি হয়।

“বেদমতে এ-সব চক্রকে — ‘ভূমি’ বলে। সপ্তভূমি। হৃদয় — চতুর্থভূমি। অনাহত পদ্ম, দ্বাদশ দল।

“বিশুদ্ধ চক্র পঞ্চমভূমি। এখানে মন উঠলে কেবল ঈশ্বরকথা বলতে আর শুনতে প্রাণ ব্যাকুল হয়। এ-চক্রের স্থান কণ্ঠ। ষোড়শ দল পদ্ম। যার এই চক্রে মন এসেছে, তার সামনে বিষয়কথা — কামিনী-কাঞ্চনের কথা — হলে ভারী কষ্ট হয়! ওরূপ কথা শুনলে সে সেখান থেকে উঠে যায়।

“তারপর ষষ্ঠভূমি। আজ্ঞা চক্র — দ্বিদল পদ্ম। এখানে কুলকুণ্ডলিনী ঈশ্বরের রূপ দর্শন হয়। কিন্তু একটু আড়াল থাকে — যেমন লন্ঠনের ভিতর আলো, মনে হয় আলো ছুঁলাম, কিন্তু কাচ ব্যবধান আছে বলে ছোঁয়া যায় না।

“তারপর সপ্তভূমি। সহস্রার পদ্ম। সেখানে কুণ্ডলিনী গেলে সমাধি হয়। সহস্রারে সচ্চিদানন্দ শিব আছেন — তিনি শক্তির সহিত মিলিত হন। শিব-শক্তির মিলন!

“সহস্রারে মন এসে সমাধিস্থ হয়ে আর বাহ্য থাকে না। সে আর দেহরক্ষা করতে পারে না। মুখে দুধ দিলে গড়িয়ে যায়। এ অবস্থায় থাকলে একুশদিনে মৃত্যু হয়। কালাপানিতে গেলে জাহাজ আর ফেরে না।

“ঈশ্বরকোটি — অবতারাদি — এই সমাধি অবস্থা থেকে নামতে পারে। তারা ভক্তি-ভক্ত নিয়ে থাকে, তাই নামতে পারে। তিনি তাদের ভিতর ‘বিদ্যার আমি’ — ‘ভক্তের আমি’ — লোকশিক্ষার জন্য — রেখে দেন। তাদের অবস্থা — যেমন ষষ্ঠভূমি আর সপ্তভূমির মাঝখানে বাচখেলা।

“সমাধির পর ‘বিদ্যার আমি’ কেউ কেউ ইচ্ছা করে রেখে দেন। সে আমির আঁট নাই। — রেখা মাত্র।

“হনুমান সাকার-নিরাকার সাক্ষাৎকারের পর ‘দাস আমি’ রেখেছিলেন। নারদাদি — সনক, সনন্দ, সনাতন, সনৎকুমার, এঁরাও ব্রহ্মজ্ঞানের পর ‘দাস আমি’ ‘ভক্তের আমি’ রেখেছিলেন। এঁরা, জাহাজের মতো, নিজেও পারে যান, আবার অনেক লোককে পার করে নিয়ে যান।”

ঠাকুর এইরূপে কি নিজের অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন? বলিতেছেন —

[পরমহংস — নিরাকারবাদী ও সাকারবাদী। ঠাকুরের ব্রহ্মজ্ঞানের পর ভক্তি — নিত্যলীলাযোগ ]

“পরমহংস — নিরাকারবাদী আবার সাকারবাদী। নিরাকারবাদী যেমন ত্রৈলঙ্গ স্বামী। এঁরা আপ্তসারা — নিজের হলেই হল।

“ব্রহ্মজ্ঞানের পরও যারা সাকারবাদী তারা লোকশিক্ষার জন্য ভক্তি নিয়ে থাকে। যেমন কুম্ভ পরিপূর্ণ হল, অন্য পাত্রে জল ঢালাঢালি করছে।

“এরা যে-সব সাধনা করে ভগবানকে লাভ করেছে, সেই সকল কথা লোকশিক্ষার জন্য বলে — তাদের হিতের জন্য। জলপানের জন্য অনেক কষ্টে কূপ খনন করলে — ঝুড়ি-কোদাল লয়ে। কূপ হয়ে গেল, কেউ কেউ কোদাল, আর আর যন্ত্র কূপের ভিতরেই ফেলে দেয় — আর কি দরকার! কিন্তু কেউ কেউ কাঁধে ফেলে রাখে, পরের উপকার হবে বলে।

“কেউ আম লুকিয়ে খেয়ে মুখ পুঁছে! কেউ অন্য লোককে দিয়ে খায় — লোকশিক্ষার জন্য আর তাঁকে আস্বাদন করবার জন্য। ‘চিনি খেতে ভালবাসি’।

“গোপীদেরও ব্রহ্মজ্ঞান ছিল। কিন্তু তারা ব্রহ্মজ্ঞান চাইত না। তারা কেউ বাৎসল্যভাবে, কেউ সখ্যভাবে, কেউ মধুরভাবে, কেউ দাসীভাবে ঈশ্বরকে সম্ভোগ করতে চাইত।”

[কীর্তনানন্দে — শ্রীগৌরাঙ্গের নাম ও মায়ের নাম ]

শিবপুরের ভক্তেরা গোপীযন্ত্র লইয়া গান করিতেছেন। প্রথম গানে বলিতেছেন, “আমরা পাপী, আমাদের উদ্ধার কর।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — ভয় দেখিয়ে — ভয় পেয়ে — ভজনা, প্রবর্তকের ভাব। তাঁকে লাভ করার গান গাও। আনন্দের গান। (রাখালের প্রতি) নবীন নিয়োগীর বাড়িতে সেদিন কেমন গান করছিল —

হরিনাম মদিরায় মত্ত হও —

“কেবল অশান্তির কথা ভাল নয়। তাঁকে লয়ে আনন্দ — তাঁকে লয়ে মাতোয়ারা হওয়া।”

শিবপুরের ভক্ত — আজ্ঞা, আপনার গান একটি হবে না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি কি গাইব? আচ্ছা, যখন হবে গাইব।

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর গান গাহিতেছেন। গাইবার সময় ঊর্ধ্বদৃষ্টি।

গান – কৌপিন দাও কাঙালবেশে ব্রজে যাই হে ভারতী।

গান – গৌর প্রেমের ঢেউ লেগেছে গায়।

গান – দেখসে আয় গৌরবরণ রূপখানি (গো সজানী)।
আলতোলা দুধের ছানা মাখা গোরার গায়,
(দেখে ভাবের উদয় হয়)।
কারিগর ভাঙ্গড়, মিস্ত্রী বৃষভানুনন্দিনী

গান – ডুব্‌ ডুব্‌ ডুব্‌ রূপসাগরে আমার মন।

গৌরাঙ্গের নামের পর ঠাকুর মার নাম করিতেছেন:

(১) শ্যামা ধন কি সবাই পায়। অবোধ মন বোঝে না একি দায়।।

(২) মজলো আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে।

(৩) শ্যামা মা কি কল করেছে, কালী মা কি কল করেছে,
চৌদ্দ পোয়া কলের ভিতরি, কত রঙ্গ দেখাতেছে।
আপনি থাকি কলের ভিতরি, কল ঘুরায় ধরে কলডুরি;
কল বলে আপনি ঘুরি, জানে না কে ঘুরাতেছে।।
যে কল জেনেছে তারে, কল হতে হবে না তারে,
কোনো কলের ভক্তি ডোরে আপনি শ্যামা বাঁধা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *