5 of 11

২৫.০৩ পাণ্ডিত্য অপেক্ষা তপস্যার প্রয়োজন — সাধ্য-সাধনা

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৩রা জুলাই

পাণ্ডিত্য অপেক্ষা তপস্যার প্রয়োজন — সাধ্য-সাধনা

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। ভক্তেরাও কাছে বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — শশধরকে তোমার কেমন বোধ হয়?

মাস্টার — আজ্ঞা, বেশ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — খুব বুদ্ধিমান, না?

মাস্টার — আজ্ঞা, পাণ্ডিত্য বেশ আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — গীতার মত — যাকে অনেকে গণে, মানে, তার ভিতর ঈশ্বরের শক্তি আছে। তবে ওর একটু কাজ বাকী আছে।

“শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে, কিছু তপস্যার দরকার — কিছু সাধ্য-সাধনার দরকার।”

[পূর্বকথা — গৌরী পণ্ডিত ও নারায়ণ শাস্ত্রীর সাধনা — বেলঘরের বাগানে কেশবের সহিত সাক্ষাৎ ১৮৭৫ — কাপ্তেনের আগমন ১৮৭৫-৭৬ ]

“গৌরী পণ্ডিত সাধন করেছিল। যখন স্তব করত, ‘হা রে রে নিরালম্ব লম্বোদর!’ — তখন পণ্ডিতেরা কেঁচো হয়ে যেত।

“নারায়ণ শাস্ত্রীও শুধু পণ্ডিত নয়, সাধ্য-সাধনা করেছিল।

“নারায়ণ শাস্ত্রী পঁচিশ বৎসর একটানে পড়েছিল। সাত বৎসর ন্যায় পড়েছিল — তবুও ‘হর, হর,’ বলতে বলতে ভাব হত। জয়পুরের রাজা সভাপণ্ডিত করতে চেয়েছিল। তা সে কাজ স্বীকার করলে না। দক্ষিণেশ্বরে প্রায় এসে থাকত। বশিষ্ঠাশ্রমে যাবার ভারী ইচ্ছা, — সেখানে তপস্যা করবে। যাবার কথা আমাকে প্রায় বলত। আমি তাকে সেখানে যেতে বারণ করলাম। — তখন বলে ‘কোন্‌ দিন মরে যাব, সাধন কবে করব — ডুব্‌কি কব্‌ ফাট্‌ যায়গা!’ অনেক জেদাজেদির পর আমি যেতে বললাম।

“শুনতে পাই, কেউ কেউ বলে, নারায়ণ শাস্ত্রী নাকি শরীরত্যাগ করেছে, তপস্যা করবার সময় ভৈরবে নাকি চড় মেরেছিল। আবার কেউ কেউ বলে, ‘বেঁচে আছে — এই আমরা তাকে রেলে তুলে দিয়ে এলাম।’

“কেশব সেনকে দেখবার আগে নারাণ শাস্ত্রীকে বললুম, তুমি একবার যাও, দেখে এস কেমন লোক। সে দেখে এসে বললে, লোকটা জপে সিদ্ধ। সে জ্যোতিষ জানত — বললে, ‘কেশব সেনের ভাগ্য ভাল। আমি সংস্কৃতে কথা কইলাম, সে ভাষায় (বাঙলায়) কথা কইল।’

“তখন আমি হৃদেকে সঙ্গে করে বেলঘরের বাগানে গিয়ে দেখলাম। দেখেই বলেছিলাম, ‘এঁরই ন্যাজ খসেছে, — ইনি জলেও থাকতে পারেন, ডাঙাতেও থাকতে পারেন।’

“আমাকে পরোখ করবার জন্য তিনজন ব্রহ্মজ্ঞানী ঠাকুরবাড়িতে পাঠিয়েছিল। তার ভিতরে প্রসন্নও ছিল। রাতদিন আমায় দেখবে, দেখে কেশবের কাছে খবর দিবে। আমার ঘরের ভিতর রাত্রে ছিল — কেবল ‘দয়াময়, দয়াময়’ করতে লাগল — আর আমাকে বলে, ‘তুমি কেশববাবুকে ধর তাহলে তোমার ভাল হবে।’ আমি বললাম, ‘আমি সাকার মানি।’ তবুও ‘দয়াময়, দয়াময়’ করে! তখন আমার একটা অবস্থা হল হয়ে বললাম, ‘এখান থেকে যা!’ ঘরের মধ্যে কোন মতে থাকতে দিলাম না! তারা বারন্দায় গিয়ে শুয়ে রইল।

“কাপ্তেনও যেদিন আমায় প্রথম দেখলে সেদিন রাত্রে রয়ে গেল।”

[মাইকেল মধুসূদন — নারাণ শাস্ত্রীর সহিত কথা ]

“নারায়ণ শাস্ত্রী যখন ছিল, মাইকেল এসেছিল। মথুরবাবুর বড়ছেলে দ্বারিকবাবু সঙ্গে করে এনেছিল। ম্যাগাজিনের সাহেবদের সঙ্গে মোকদ্দমা হবার যোগাড় হয়েছিল। তাই মাইকেলকে এনে বাবুরা পরামর্শ করছিল।

“দপ্তরখানার সঙ্গে বড়ঘর। সেইখানে মাইকেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি নারায়ণ শাস্ত্রীকে কথা কইতে বললাম। সংস্কৃতে কথা ভাল বলতে পারলে না। ভুল হতে লাগল! তখন ভাষায় কথা হল।

“নারায়ণ শাস্ত্রী বললে, ‘তুমি নিজের ধর্ম কেন ছাড়লে।’ মাইকেল পেট দেখিয়ে বলে, ‘পেটের জন্য — ছাড়তে হয়েছে।’

“নারায়ণ শাস্ত্রী বললে, ‘যে পেটের জন্য ধর্ম ছাড়ে তার সঙ্গে কথা কি কইব!’ তখন মাইকেল আমায় বললে, ‘আপনি কিছু বলুন।’

“আমি বললাম, কে জানে কেন আমার কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার মুখ কে যেন চেপে ধরছে।“

[কামিনী-কাঞ্চন পণ্ডিতকেও হীনবুদ্ধি করে — বিষয়ীর পূজাদি ]

ঠাকুরকে দর্শন করিতে চৌধুরীবাবুর আসিবার কথা ছিল।

মনোমোহন — চৌধুরী আসবেন না। তিনি বললেন, ফরিদপুরের সেই বাঙাল (শশধর) আসবে — তবে যাব না!

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি হীনবুদ্ধি! — বিদ্যার অহংকার, তার উপর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী বিবাহ করেছে, — ধরাকে সরা মনে করেছে!

চৌধুরী এম. এ. পাশ করিয়াছেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর খুব বৈরাগ্য হইয়াছিল। ঠাকুরের কাছে দক্ষিণেশ্বরে প্রায় যাইতেন। আবার তিনি বিবাহ করিয়াছেন। তিন-চার শত টাকা মাহিনা পান।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — এই কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি মানুষকে হীনবুদ্ধি করেছে। হরমোহন যখন প্রথম গেল, তখন বেশ লক্ষণ ছিল। দেখবার জন্য আমি ব্যাকুল হতাম। তখন বয়স ১৭। ১৮ হবে। প্রায় ডেকে ডেকে পাঠাই, আর যায় না। এখন মাগকে এনে আলাদা বাসা করেছে। মামার বাড়িতে ছিল, বেশ ছিল। সংসারের কোনো ঝঞ্ঝাট ছিল না। এখন আলাদা বাসা করে পরিবারের রোজ বাজার করে। (সকলের হাস্য) সেদিন ওখানে গিয়েছিল। আমি বললাম, ‘যা এখান থেকে চলে যা — তোকে ছুঁতে আমার গা কেমন করছে।’

কর্তাভজা চন্দ্র (চাটুজ্যে) আসিয়াছেন। বয়ঃক্রম ষাট-পঁয়ষট্টি। মুখে কেবল কর্তাভজাদের শ্লোক। ঠাকুরের পদসেবা করিতে যাইতেছেন। ঠাকুর পা স্পর্শ করিতে দিলেন না। হাসিয়া বলিলেন, ‘এখন তো বেশ হিসাবি কথা বলছে।’ ভক্তেরা হাসিতে লাগিলেন।

এইবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের অন্তঃপুরে শ্রীশ্রীজগন্নাথ দর্শন করিতে যাইতেছেন। অন্তঃপুরে স্ত্রীলোক ভক্তেরা তাঁহাকে দর্শন করুবার জন্য ব্যাকুল হইয়া আছেন।

ঠাকুর আবার বৈঠকখানায় আসিয়াছেন। সহাস্যবদন। বলিলেন, ”আমি পাইখানার কাপড় ছেড়ে জগন্নাথকে দর্শন করলাম। আর একটু ফুল-টুল দিলাম।

“বিষয়ীদের পূজা, জপ, তপ, যখনকার তখন। যারা ভগবান বই জানে না তারা নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাঁর নাম করে। কেউ মনে মনে সর্বদাই ‘রাম’, ‘ওঁ রাম’ জপ করে। জ্ঞানপথের লোকেরাও ‘সোঽহম্‌’ জপ করে। কারও কারও সর্বদাই জিহ্বা নড়ে।

“সর্বদাই স্মরণ-মনন থাকা উচিত।”


 শ্রীমধুসূদন কবি — জন্ম সাগরদাঁড়ি ১৮২৪; ইংলন্ডে অবস্থিতি ১৮৬২-৬৭; দেহত্যাগ ১৮৭৩। ঠাকুরকে দর্শন ১৮৬৮-র পরে হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *